বিলিবটন
ডাহল…অদ্ভুত হলেও সত্যি যে এই সেক্টরের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ স্থান হলো বিলিবটন। এই অঞ্চলের প্রসিদ্ধিও প্রায় কিংবদন্তীর মতো। অসংখ্য গল্প, উপকথা, রূপকথা ছড়িয়ে আছে এই অঞ্চলকে ঘিরে, যার মূল উপজীব্য বিষয় হচ্ছে সেইসব সাহসী অভিযাত্রীরা (বা ভিকটিম) যারা বিপজ্জনক এই অঞ্চল পাড়ি দিয়েছিল বা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। হ্যারি সেলডন এবং ডর্স ভেনাবিলিকে নিয়েও এইরকমই একটা গল্প প্রচলিত আছে…
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা
.
৬৬.
এমারিল চলে যাওয়ার পর ডর্স জিজ্ঞেস করল, তুমি কী আসলেই এই মাদারের সাথে দেখা করতে চাও, হ্যারি?
ভাবছি, ডর্স।
তুমি সত্যি অদ্ভুত, হ্যারি। দিনে দিনে আরো জঘন্য হয়ে উঠছ। স্ট্রিলিং-এ থাকার সময় আপারসাইডে গেলে। আপাতদৃষ্টিতে তা বিপজ্জনক ছিল না মোটেই। এবং যাওয়ার। পেছনে যথেষ্ট ভালো কারণ ছিল। মাইকোজেনে তুমি এল্ডারদের বাসস্থানে ঢুকে পড়লে। কাজটা ছিল অনেক বেশি বিপজ্জনক এবং যুক্তিহীন। আর ডাহলে তুমি বিলিবটনে যেতে চাইছ। এবং এমারিলের মতে তা হবে স্রেফ আত্মহত্যা।
আমি পৃথিবীর বিষয়ে কৌতূহলী–আদতেই কিছু আছে কী না সেটা আমাকে জানতেই হবে।
পৃথিবীর ব্যাপারটা একটা কিংবদন্তী এবং জনপ্রিয় কিছু না। এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন গ্রহে হয়তো বিভিন্ন নাম ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বিষয়বস্তু একই। বহুযুগ থেকেই একটা গ্রহ আর সোনালি অতীতের গল্প মানুষের। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। ধরা হয় যে ঐ গ্রহটাই অরিজিনাল ওয়ার্ল্ড। শুধু এই গ্রহেই–এই একটা গ্রহেই জানা অজানা সকল জীব প্রজাতির উদ্ভব এবং বিকাশ ঘটেছিল। পুরো গ্যালাক্সিতেই একটা অন্ধবিশ্বাস প্রচলিত আছে যেকোনো এক সুদূর অতীতে সমাজ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সরল এবং নীতিপরায়ণ। বর্তমান গ্যালাক্সির প্রতিটি সমাজের বাসিন্দারা মনে করে যে তাদের সমাজ ব্যবস্থা–তা যতই সরল হোক না কেন–সেটাই সব থেকে জটিল এবং পাপাচারপূর্ণ। তোমার সাইকোহিস্টোরির গুরুত্বপূর্ণ একটা পয়েন্ট। ডাইরিতে লিখে রাখো।
যাইহোক, সেলডন বললেন, আমাকে ধরে নিতেই হবে যেকোনো এক সময় একটা গ্রহ ছিল। অরোরা… পৃথিবী… যে নামই হোক। সত্যি কথা বলতে কী- চুপ করে কী যেন চিন্তা করতে লাগলেন তিনি।
বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে যাবার পর ডর্স জিজ্ঞেস করল, বলো?
মাথা নাড়লেন সেলডন। মাইকোজেনে তুমি গল্প শুনিয়েছিলে, মনে আছে? আমি নাম দিয়েছি হ্যান্ড-অন-থাই স্টোরি। রেইনড্রপ ফরটি খ্রীর কাছ থেকে পবিত্র গ্রন্থ পাওয়ার পর পরই… কিছুদিন আগে সন্ধ্যায় টিসালভারদের সাথে কথা বলার সময়। হঠাৎ গল্পটা আমার মনে পড়ে। আমি যেন কী একটা কথা বলেছিলাম, তারই। পরিপ্রেক্ষিতে তোমার কাছে শোনা গল্পটার কথা মনে পড়ে, এবং সেটা আমাকে। আরো একটা কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল, মাত্র এক পলকের জন্য কী মনে করিয়ে দিয়েছিল?
আমার মনে নেই। চিন্তাটা মাথায় যেমন দ্রুত এসেছিল সেরকম দ্রুতই হারিয়ে। যায়। কিন্তু যখনই আমি সিঙ্গেল ওয়ার্ল্ডের কথা চিন্তা করি কেন যেন মনে হয় যে আমি সমাধানটা পেয়েই আবার হারিয়ে ফেলছি।
ডর্স অবাক হয়ে গেল সেলডনের কথা শুনে। তোমার কথা বুঝতে পারছি না। পৃথিবী বা অরোরার সাথে হ্যান্ড-অন-থাই স্টোরির কোনো সম্পর্ক নেই।
জানি, কিন্তু এটা… ঐ যে সমাধানটা মাথায় এসেও চট করে হারিয়ে যায়, মনে হচ্ছে তার সাথে সিঙ্গেল ওয়ার্ল্ডের একটা সম্পর্ক আছে। তাই যেভাবেই হোক এই গ্রহের সবকিছু আমাকে জানতে হবে। এবং… রোবটের ব্যাপারেও।
রোবটও আছে? আমি তো ভেবেছিলাম এল্ডারদের বাসস্থানের পরেই তার সমাপ্তি ঘটেছে।
মোটেই না। আমি এখনো ওগুলো নিয়ে ভাবছি। অনেকটা সময় অস্বস্তি নিয়ে ডর্সের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, কিন্তু আমি নিশ্চিত নই।
কোন বিষয়ে নিশ্চিত নও, হ্যারি?
তিনি শুধু মাথা নাড়লেন, কোনো জবাব দিলেন না।
ভুরু কুঁচকালো ডর্স, তারপর বলল, হ্যারি, তোমাকে একটা কথা বলি। প্রকৃত ইতিহাসে আমার কথা বিশ্বাস কর ওয়ার্ল্ড অব অরিজিন বলে কোনো গ্রহের উল্লেখ নেই। স্বীকার করছি যে এটা অত্যন্ত প্রচলিত একটা বিশ্বাস। শুধু যে মাইকোজেনিয়ান বা ডাহ্লাইটদের মতো অশিক্ষিত মানুষের মাঝেই এই বিশ্বাস প্রচলিত তাও না। অনেক বায়োলজিস্টও এটা বিশ্বাস করে এবং তারা বৈজ্ঞানিক কোনো যুক্তিতেই করে। ওগুলো আমি বুঝি না তাই বলতেও পারব না। ধর্মীয় বা অতিপ্রাকৃত ইতিহাস নিয়ে যারা গবেষণা করে তাদের কাছেও পৃথিবীর বিষয়টা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শখের। বুদ্ধিজীবী যারা তাদের কাছেও। কিন্তু মৌলিক বা প্রকৃত ইতিহাসে এই বিষয়ের কোনো তথ্য বা প্রমাণ নেই।
সম্ভবত এই কারণেই প্রকৃত ইতিহাসে যে তথ্য প্রমাণ আছে তার বাইরেও মনোযোগ দিতে হবে। সেলডন বললেন। আমি শুধু একটা ডিভাইস চাই যা সাইকোহিস্টোরিকে আমার জন্য অত্যন্ত সহজ করে দেবে। সেই ডিভাইসটা কী হবে গাণিতিক কৌশল, ইতিহাস নির্ভর কৌশল নাকি কল্পনাতীত সম্পূর্ণ নতুন একটা কৌশল হবে–তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। যে তরুণের সাথে কিছুক্ষণ আগে কথা বললাম তার যদি সামান্য একটু আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থাকত, তাকে আমার সহযোগী করে নিতাম। ছেলেটার চিন্তাভাবনা যথেষ্ট পরিস্কার এবং নিজস্ব স্বকীয়তা আছে-
তুমি তাহলে সত্যি সত্যি ওকে সাহায্য করবে?
অবশ্যই। সুযোগ পাওয়া মাত্রই।
কিন্তু রাখতে পারবে কিনা সেই ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া কী ঠিক?
আমি এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে চাই। আর অসম্ভব প্রতিশ্রুতির কথা তুলেছই যখন সানমাস্টার ফোরটিনকে হামিন কী বলেছিল মনে আছে। বলেছিল যে আমি হয়তো সাইকোহিস্টোরির সাহায্যে ওদের হারানো গ্রহ ফিরিয়ে দেব। সেইরকম সম্ভাবনা শূন্যেরও কম। এমনকি সাইকোহিস্টোরি সম্ভবপর হলেও এইধরনের নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য পূরণ করা যাবে কী না জানি না। আর এটাই সত্যিকার অসম্ভব প্রতিশ্রুতি।
ডর্স কিছুটা রেগে গেল। হামিন আমাদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছিল, চেষ্টা করছিল যেন সম্রাট এবং ডেমারজেলের হাতে আমরা বন্দী না হই। এবং আমার মনে হয় হামিন সত্যি সত্যিই মাইকোজেনিয়ানদের সাহায্য করতে চায়।
আমিও সত্যি সত্যিই ইউগো এমারিলকে সাহায্য করতে চাই। এবং মাইকোজেনিয়ানদের চেয়ে তাকেই সাহায্য করতে পারব বেশি। হামিনের প্রতিশ্রুতি যথার্থ প্রমাণ করার জন্য যত খুশী যুক্তি দেখাও, আপত্তি নেই, কিন্তু আমার প্রতিশ্রুতি নিয়ে সমালোচনা করো না। তাছাড়া ডর্স- রাগ ঝলকে উঠল সেলডনের চোখে মাদার রিটার সাথে আমি দেখা করবই এবং একা যাব।
কক্ষনো না। দ্বিগুণ তেজে জবাব দিল ডর্স। যদি তুমি যাও, আমিও যাব।
.
৬৭.
এমারিল চলে যাওয়ার দুঘণ্টা পরে মিস্ট্রেস টিসালভার মেয়েকে নিয়ে ফিরে এলো। মুখে কিছু বলল না। শুধু ডর্স আর সেলডনের দিকে তাকিয়ে সামান্য একটু মাথা নাড়ল। নিজেদের কামরায় ঢোকার আগে চারপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে নিল হিটসিঙ্কার তার উপস্থিতির কোনো নিদর্শন রেখে গেছে কিনা।
টিসালভার ফিরল আরো পরে। ডিনার টেবিলে মিস্ট্রেস টিসালভার যখন অন্য দিকে ব্যস্ত ছিল সেই ফাঁকে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, লোকটা এসেছিল?
চলেও গেছে, গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন সেলডন। আপনার স্ত্রী তখন ঘরে ছিলেন না।
আবার আসবে?
মনে হয় না।
ভালো।
ডিনারের সময়টা পার হলো নিঃশব্দে। কিন্তু তারপর ছোট মেয়েটা যখন কম্পিউটার অনুশীলনের জন্য নিজের কামরায় ঢুকে গেল সেলডন সামনে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলেন, বিলিবটনের ব্যাপারে কিছু জানান আমাকে।
হতভম্ব হয়ে পড়ল টিসালভার। এতই বিস্মিত হলো যে মুখ খুললেও কোনো শব্দ বেরোল না। কিন্তু ক্যাসিলিয়া চুপ থাকতে পারল না।
আপনাদের নতুন বন্ধু ওখানেই থাকে? জিজ্ঞেস করল সে। এবার আপনারাও যাবেন ওখানে?
অনেকটা তাই, শান্ত গলায় বললেন সেলডন। আমি বিলিবটনের কথা জিজ্ঞেস করেছি।
তীক্ষ্ণ সুরে জবাব দিল ক্যাসিলিয়া, ওটা একটা বস্তি। গুন্ডা বদমাশরা থাকে। কেউ যায় না ওখানে, শুধু চোর ছ্যাচড় ছাড়া।
আমি শুনেছি মাদার রিটা ওখানে বাস করে।
এই নামের কাউকে চিনি না, বলেই মুখ বন্ধ করল ক্যাসিলিয়া। পরিস্কার বুঝিয়ে দিল বিলিবটনে থাকে এমন কারো কথা শুনতে বা এমনকি তার নাম জানতেও সে আগ্রহী নয়।
অস্বস্তির সাথে স্ত্রীর দিকে একবার আড়চোখে তাকালো টিসালভার। বলল, আমি শুনেছি। ক্ষ্যাপাটে এক বুড়ি। সে নাকি ভবিষ্যৎ বলতে পারে।
সে কী বিলিবটনে থাকে?
আমি জানি না, মাস্টার সেলডন। বুড়িকে কখনো দেখিনি। ভবিষ্যদ্বাণী করে দুএকবার হলোভিশনের খবর হয়েছিল।
ওগুলো কী সত্যি হয়েছিল?
নাক কুঁচকালো টিসালভার। ভবিষ্যদ্বাণী কখনো সত্যি হয়? তারটাতো ছিল আরো বেশি অর্থহীন।
সে কখনো পৃথিবীর কথা বলেছিল?
জানি না। বললেও অবাক হব না।
আপনি পৃথিবীর কথা শুনে একবারেই আশ্চর্য হন নি। পৃথিবীর কথা আপনি জানেন?
এবার টিসালভারকে বিস্মিত দেখালো। নিশ্চয়ই, মাস্টার সেলডন। বর্তমান মানবজাতি ঐ গ্রহের মানুষদেরই বংশধর… সম্ভবত।
সম্ভবত? আপনি বিশ্বাস করেন না?
আমি? আমি লেখাপড়া জানা মানুষ। অশিক্ষিত মানুষরা এটা বিশ্বাস করে।
পৃথিবীকে নিয়ে কোনো বুক-ফিল্ম আছে?
বাচ্চাদের গল্পের বইয়ে পৃথিবী নিয়ে অনেক গল্প আছে। ছোট বেলায় একটা গল্প ছিল আমার খুব প্রিয়। শুরুটা ছিল এরকম, অনেক অনেক দিন আগে পৃথিবীর বুকে, যখন পৃথিবী ছিল একমাত্র গ্রহ- মনে আছে ক্যাসিলিয়া? তুমিও গল্পটা খুব পছন্দ করতে।
ক্যাসিলিয়া শুধু কাঁধ নাড়ল, জবাব দিল না।
সুযোগ পেলে আমিও পড়ে দেখব। কিন্তু আমি বলছি বুক-ফিল্ম… আহ্… শিক্ষিত মানুষেরা যেগুলো পড়ে… অথবা ছবি… বা কোনো প্রিন্টআউট।
আমার জানা নেই, কিন্তু গ্রন্থাগার
সেটা পরে দেখা যাবে। পৃথিবীর কথা আলোচনা করার উপায় কী, কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে?
মানে?
আমি বলছি যে আপনাদের এখানে এমন কোনো প্রথা বা সামাজিক নিয়ম আছে। যার কারণে পৃথিবীর নাম কখনো মুখে আনা যাবে না, আলোচনা করা যাবে না।
টিসালভারের বিস্ময় দেখেই জবাবটা পেয়ে গেলেন সেলডন।
আলোচনায় যোগ দিল ডর্স। অস্থানীয় যারা তাদের জন্য কী বিলিবটনে না যাওয়ার ব্যাপারে কোনো আইন আছে?
এবার টিসালভারকে সত্যিকারের আন্তরিক এবং উদ্বিগ্ন দেখালো, কোনো আইন নেই, কিন্তু ওখানে যাওয়ার চিন্তাটাই বিপজ্জনক। আমি কখনো যাব না।
কেন? জিজ্ঞেস করল ডর্স।
ভীষণ বিপজ্জনক এলাকা। মানুষগুলো সব হিংস্র, সশস্ত্র।–ডাহলে অবশ্য এমনিতেই সবার কাছে অস্ত্র থাকে, কিন্তু বিলিবটনে ওরা অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে। এখানে থাকলে কোনো বিপদ নেই।
কতদিন, মুখ কালো করে বলল ক্যাসিলিয়া। সবচেয়ে ভালো হয় সবাই একসাথে এখান থেকে চলে গেলে। হিটসিঙ্কাররা আজকাল সবখানেই ঢুকে পড়েছে।
ডাহলের সবাই নিজের কাছে অস্ত্র রাখে মানে? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন। অস্ত্রের ব্যাপারে ইম্পেরিয়াল আইন যথেষ্ট কড়া।
জানি, টিসালভার বলল। কিন্তু আমাদের কাছে স্টান্ট গান, সাইকিকপ্রোব বা অন্য কোনো মারণাস্ত্র নেই। আছে শুধু ছুরি। বিব্রত দেখালো তাকে।
আপনি নিজেও সবসময় একটা ছুরি রাখেন, টিসালভার? ডর্স জিজ্ঞেস করল।
আমি? ভয় পাওয়া গলায় বলল ডাহলাইট। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ আর আমাদের এলাকাটা যথেষ্ট নিরাপদ।
বাড়িতে বেশ কয়েকটা ছুরি আছে, আবারো মুখ বাঁকা করে বলল ক্যাসিলিয়া। এলাকাটা এখন আর সেরকম নিরাপদ মনে হচ্ছে না।
সবাই সাথে ছুরি রাখে?
প্রায় সবাই, মিস্ট্রেস ভেনাবিলি। কিন্তু তার মানে এই না যে সবাই তা ব্যবহারও করে।
কিন্তু বিলিবটনে ওরা ঠিকই ব্যবহার করে।
মাঝে মাঝে। যখন ওরা হিংস্র হয়ে উঠে, মারামারি করে।
এবং সরকার এই ব্যাপারে কোনো বাধা দেয় না? ইম্পেরিয়াল গভর্নমেন্টের কথা বলছি।
মাঝে মাঝে বিলিবটনের জঞ্জাল সাফ করার চেষ্টা করে, কিন্তু ছুরি লুকিয়ে রাখা অনেক সহজ। তাছাড়া বেশিরভাগ সময় ডাহ্লাইটরাই মারা পড়ে। তাই বোধহয় ইম্পেরিয়াল গভর্নমেন্ট খুব একটা মাথা ঘামায় না।
যদি কোনো বহিরাগত মারা যায়?
রিপোর্ট করা হলে তদন্ত হবে কিন্তু কিছুই প্রমাণ হবে না। কারণ সবাই তখন বলবে যে আমি কিছু দেখিনি, কিছু শুনিনি। ফলে কর্মকর্তারা ধরে নেয় যে দোষটা বহিরাগতেরই ছিল। অনুরোধ করছি বিলিবটনে যাবেন না, এমনকি সাথে ছুরি থাকলেও না।
বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়লেন সেলডন। আমি সাথে কখনো ছুরি রাখব না। ব্যবহারই করতে জানি না।
তাহলে তো কোনো কথাই নেই, মাস্টার সেলডন, সব বুঝে নেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল টিসালভার। যাবেন না। যাবেন না ওখানে।
সেটাও সম্ভব হবে না, সেলডন বললেন।
বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকালো ডর্স, টিসালভারকে বলল, ছুরি কোথায় কিনতে পাওয়া যায়? নাকি আপনাদের কাছ থেকে ধার পাওয়া যাবে।
দ্রুত বলল ক্যাসিলিয়া, নিজেরটা ছাড়া অন্যেরটা কেউ ব্যবহার করে না। আপনাকে কিনে নিতে হবে।
ছুরির দোকান সবখানেই আছে, টিসালভার বলল। যদিও থাকার কথা না। ওগুলো তো বেআইনি। গৃহ সামগ্রীর যেকোনো দোকানেই পাবেন। যদি দেখেন যেকোনো দোকানে ডিসপ্লেতে ওয়াশিং মেসিন আছে তাহলে নিশ্চিত ধরে নেবেন যে ওখানেই পাবেন।
আর বিলিবটনে কীভাবে যাব? সেলডন জানতে চাইলেন।
এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে।
তারপর?
ইস্টবাউন্ড সাইডের এক্সপ্রেসওয়েতে চড়বেন তারপর সাইনবোর্ডের দিকে নজর রাখবেন। কিন্তু, মাস্টার সেলডন, যদি যানই মিস্ট্রেস ভেনাবিলিকে সাথে নেবেন না। মেয়েদের সাথে আরো… জঘন্য আচরণ করা হয়।
যাবে না, সেলডন বললেন।
আমার ধারণা সে যাবে, দৃঢ় গলায় জবাব দিল ডর্স।
.
৬৮.
দোকান মালিকের গোঁফ এখনো তার তরুণ বয়সের মতো ঘন তবে রংটা ধূসর হতে শুরু করেছে, অবশ্য চুল এখনো কালো। অভ্যাসবশত গোঁফের দুই প্রান্ত আঁচড়াতে আঁচড়াতে ডর্সকে দেখল সে।
আপনি ডাহলাইট নন।
হ্যাঁ, কিন্তু আমার ছুরি প্রয়োজন।
কাজটা বেআইনী আপনি জানেন।
আমি পুলিশ বা সরকারি এজেন্ট নই। আমি বিলিবটনে যাচ্ছি।
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ডর্সের দিকে তাকিয়ে থাকল দোকান মালিক। একা?
বন্ধুর সাথে। বুড়ো আঙ্গুল বাকা করে কাঁধের উপর দিয়ে সেলডনের দিকে ইশারা করল সে। সেলডন দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন।
উনার জন্য কিনছেন? সেলডনের দিকে তাকিয়ে দোকান মালিক বলল। সিদ্ধান্ত নিতে খুব বেশি দেরী হলো না তার। উনিও আউটসাইডার। ভিতরে এসে নিজেই কিনছে না কেন?
সেও সরকারের কোনো এজেন্ট নয়। আর ছুরি আমি নিজের জন্য কিনছি।
দোকানদার মাথা নাড়ল। আউটসাইডাররা আসলেই পাগল। তবে আপনি যখন কিছু ক্রেডিট খরচ করতেই চাইছেন আমার নিতে আপত্তি নেই। নিচু হয়ে তলার একটা কাউন্টার থেকে একটা ছুরি বের করল সে। অভ্যস্ত হাতে ছুরির হাতল ধরে ঝাঁকুনি দিল। চকচকে ধারালো ফলা বেরিয়ে পড়ল।
এরচেয়ে বড়ো নেই?
মেয়েদের জন্য এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত।
পুরুষরা যেরকম ছুরি ব্যবহার করে সেগুলো দেখান।
ওগুলো ভীষণ ভারী হবে। আপনি ব্যবহার করতে জানেন?
শিখে নেব। আর ওজন নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই।
দোকানদার মুচকি হাসল। বেশ, আপনি যখন দেখতে চাইছেন- একেবারে নিচের কাউন্টার থেকে আরো বড়ো একটা ছুরি বের করল সে। ছোট একটা ঝাঁকুনি দিতেই ধারালো ব্লেড বেরিয়ে পড়ল এবং বোঝা গেল যে এটা আসলে কসাইদের ছুরি।
জিনিসটা ডর্সের হাতে দিল সে, আগে বাড়িয়ে ধরেছে হাতল, এখনো হাসছে।
আপনি যেভাবে খুলেছিলেন আবার দেখান আমাকে।
আরেকটা ছুরি নিয়ে ধীরে ধীরে একবার খুলল বন্ধ করল।
আরেকবার। আদেশ পালন করল দোকানদার।
ঠিক আছে, এবার বন্ধ করে আমাকে আঘাত করার জন্য শুধু হাতলটা ছুঁড়ে মারুন।
ভীষণ আস্তে ছুঁড়ল দোকানদার, ডর্স অনায়াসে লুফে নিল, বলল, আরো দ্রুত, জোরে।
ভুরু উঁচু করল দোকানদার, তারপর বোঝার কোনো সুযোগ না দিয়েই ছুরিটা ডর্সের দেহের বা অংশের দিকে ছুঁড়ে মারল। ডান দিকে সরার কোনো চেষ্টা করল না ডর্স বরং বা হাত দিয়েই চোখের পলকে ধরে ফেলল। ছুরির ফলা খুলেই আবার বন্ধ হয়ে গেলো। চোয়াল ঝুলে পড়ল দোকানদারের।
এটাই সবচেয়ে বড়ো?
হ্যাঁ।
আরেকটা লাগবে।
আপনার বন্ধুর জন্য?
আমার নিজের জন্য।
দুটো ছুরি ব্যবহার করবেন?
আমার দুটো হাত আছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল দোকানদার। মিস্ট্রেস, আমার অনুরোধ, বিলিবটনে যাবেন না। জানেন না ওখানে মেয়েদের সাথে কী জঘন্য আচরণ করা হয়।
অনুমান করতে পারছি। ছুরিগুলো বেল্টে আটকাবো কীভাবে?
ওটাতে হবে না। খাপসহ একটা বেল্ট আমি বিক্রি করতে পারি।
দুটো ছুরি রাখা যাবে?
দুই খাপওয়ালা বেল্ট বোধহয় আছে একটা। আসলে ওগুলো কেউ চায় না।
আমি চাইছি।
হয়তো আপনার সাইজে হবে না।
কেটে বা অন্য কোনোভাবে ঠিক করে নেব।
অনেক ক্রেডিট লাগবে।
কোনো সমস্যা নেই।
দোকান থেকে বেরুনোর পর সেলডন তিক্ত কণ্ঠে বললেন, এত চওড়া বেল্টে তোমাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
সত্যি, হ্যারি। তোমার সাথে বিলিবটনে যাওয়ার চেয়েও অদ্ভুত। তাহলে চল এপার্টমেন্টে ফিরে যাই।
না। আমি নিজেই যাব। একা গেলেই নিরাপদ থাকব।
কোনো লাভ নেই ওসব কথা বলে। হয় দুজনেই পিছিয়ে যাব নয়তো দুজনেই সামনে বাড়ব। কোনো অবস্থাতেই আমাদের ছাড়াছাড়ি হবে না।
ডর্সের নীল চোখের কাঠিন্য, ঠোঁটের দৃঢ়তা এবং ছুরির হাতলে হাত রেখে দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে সেলডন বুঝে নিলেন তর্ক করে লাভ হবে না।
বেশ, তিনি বললেন, তবে হামিনের সাথে যখন আবার দেখা হবে তখন তার কাছে সাইকোহিস্টোরি নিয়ে কাজ করার বিনিময়ে শুধু একটা জিনিসই চাইব। সেটা হচ্ছে–যদিও তোমাকে আমি যথেষ্ট পছন্দ করি–তোমাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিতে হবে।
এবং হঠাৎ করেই হেসে ফেলল ডর্স। ভুলে যাও, হ্যারি। ওসব চালাকি করে কোনো ফায়দা হবে না। কোনো কিছুই আমাকে তোমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না। বুঝতে পেরেছ?
.
৬৯.
বিকাল এবং সন্ধ্যার মাঝামাঝি একটা সময়ে ডর্স আর সেলডন এক্সপ্রেস ওয়ে থেকে নেমে বিলিটনের ফুটপাথে পা রাখলেন। একটা সাইনবোর্ডে লেখা বিলিবটন। প্রতিটা বর্ণই আলোকিত। শুধু দ্বিতীয় বর্ণটার আলো প্রায় নিভুনিভু।
প্রথম দৃষ্টিতে মনে হলো বিলিবটন ডাহলের অন্যান্য জায়গার মতোই। তবে বাতাসে দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে আর ফুটপাথগুলোতে আবর্জনার জঞ্জাল। এবং পরিবেশটাও কেমন যেন উত্তেজনায় টানটান হয়ে আছে।
বোধহয় আশেপাশের মানুষগুলোর কারণে। ফুটপাথে যথেষ্ট মানুষ। তবে তাদের স্বাভাবিক পথচারী বলে মনে হলো না। ট্র্যান্টরের অসংখ্য মানুষের ভিড়ে–যখন তারা রাস্তায় হাঁটে তখন প্রত্যেকেই নিজের ভেতরে গুটিয়ে থাকে। কেউ কারো দিকে তাকায় না। কাউকে নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। বোধহয় অন্তত মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে–এতে বেঁচে থাকাটা অনেক সহজ হয়। অথবা টিসালভারদের ওখানে রাস্তায় যেরকম বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ দেখেছেন সেটাও হতে পারে।
কিন্তু এখানে, বিলিবটনে, না আছে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ না আছে স্বাভাবিক উপেক্ষা। পথচারীদের সবাই তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ও দেখছে আবার সামনে বা পিছনে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। প্রতি জোড়া দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ধূর্তামি আর শয়তানি।
বিলিবটনারদের পোশাক পরিচ্ছদ অত্যন্ত মলিন, দীর্ণ, ঘেঁড়াখোঁড়া। অশুভ দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। নিজের দামি পোশাকের কারণে অস্বস্তি বোধ করলেন সেলডন।
মাদার রিটা বিলিটনের কোথায় থাকে, তোমার কী মনে হয়? সেলডন বললেন।
জানি না, ডর্স বলল, তুমি এখানে নিয়ে এসেছ, কাজেই মনে করাকরির কাজটা তুমিই কর। আমার দায়িত্ব বিপদ সামলানো এবং মনে হচ্ছে দায়িত্বটা এখানে ভালোভাবেই পালন করতে হবে।
পথচারীদের কাউকে জিজ্ঞেস করলে হতো, কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না।
তোমার দোষ নেই। আমারও মনে হয় তোমাকে কেউ সাহায্য করবে না।
তবে অল্পবয়সিদের কথা আলাদা। হাতের ইশারায় তিনি প্রায় বারো বছরের এক বালককে দেখালেন–এখনো তার গোঁফ উঠেনি। ছেলেটা পুরোপুরি থেমে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
তুমি বলতে চাইছ ছেলেটা এখনো আউটসাইডারদের ঘৃণা করার মতো প্রাপ্তবয়স্ক বিলিবন্টনার হয়ে উঠেনি।
আমি বলতে চাইছি যে বিলিবটনিয়ানদের মতো সহিংস হয়ে উঠার জন্য যথেষ্ট শক্ত সমর্থ নয় সে। আমরা সামনে বাড়লে সে হয়তো দূরে গিয়ে চিৎকার শুরু করবে। তবে আমাদের আক্রমণ করবে বলে মনে হয় না।
জোরে ডাক দিলেন সেলডন, এই যে খোকা।
ছেলেটা এক পা পিছিয়ে গেল। এখনো তাকিয়ে আছে।
আবার ডাকলেন সেলডন, এদিকে এসো।
ক্যান, ছেলেটা জবাব দিল।
তোমার কাছ থেকে একটা ঠিকানা জানতে চাই। আরেকটু কাছে এলে আমাকে আর চিৎকার করে কথা বলতে হবে না।
দুই পা সামনে বাড়ল ছেলেটা। তার চেহারা মলিন, কিন্তু চোখদুটো অসম্ভব উজ্জ্বল আর তীক্ষ্ম। দুই পায়ে দুই রকম স্যান্ডেল। ট্রাউজারটা ছেঁড়া। বলল, কী ঠিকানা জানবার চান।
আমরা মাদার রিটার কাছে যেতে চাইছি।
ছেলেটার চোখে আলো জ্বলে উঠল, ক্যান যাইবেন?
আমি একজন স্কলার, স্কলার মানে কী তুমি জানো?
হ জানি। আপনি স্কুলে লেহাপড়া করছেন।
তুমি স্কুলে যাও না?
ফুটপাথে থুথু ফেলল ছেলেটা, নাহ্।
মাদার রিটার কাছ থেকে আমি কয়েকটা পরামর্শ চাই–অবশ্য তুমি যদি নিয়ে যাও।
আপনে ভাইগ্য জানবার চান?
তোমার নাম কী, খোকা?
নাম দিয়া কী করবেন?
তাহলে আমরা বন্ধু হতে পারব। তুমি আমাদেরকে মাদার রিটার কাছে নিয়ে যাবে। মাদার রিটা কোথায় থাকেন তুমি জানো তো?
জানবারও পারি আবার নাও জানবার পারি। আমার নাম রাইখ। লইয়া গেলে আমারে কী দিবেন?
কী চাও, রাইখ?
রাইখের চোখ ডর্সের কোমরে বাধা ছুরিগুলোর উপর আটকে গেল। উনার কাছে দুইডা ছুরি আছে। একটা আমারে দিলে আপনাগোরে মাদার রিটার কাছে লইয়া যামু।
ওগুলো বড়ো মানুষের ছুরি। তুমি এখনো অনেক ছোট।
তাইলে মাদার রিটা কোনহানে থাহে হেইডা জানার লাইগাও আমি ছোড।
অস্বস্তি বোধ করছেন সেলডন। এভাবে চললে ভিড় জমে যাবে। এরই মধ্যে দুই একজন পথচারী দাঁড়িয়ে পড়েছিল। মজার কোনো ঘটনা নয় বুঝতে পেরে আবার চলেও গেছে। কিন্তু ছেলেটা যদি ক্ষেপে উঠে চিৎকার শুরু করে তাহলে বিপদ একটা ঘটবেই।
তিনি হাসিমুখে বললেন, তুমি পড়তে জানো, রাইখ।
ছেলেটা আবার থুথু ফেলল। না, পড়বার চায় ক্যাডা?
কম্পিউটার চালাতে পারো?
কথা কইন্যা কম্পিউটার? জানি, ব্যাবাকতেই জানে।
তাহলে আমাকে সবচেয়ে কাছের কম্পিউটার দোকানে নিয়ে চল। আমি তোমাকে একটা কম্পিউটার কিনে দেব সেই সাথে কিছু সফটওয়্যার। এক কী দুই সপ্তাহেই তুমি পড়তে শিখে যাবে।
সেলডনের মনে হলো ছেলেটার চোখে তিনি খুশির ঝিলিক দেখেছেন কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার কঠিন হয়ে গেল। না, হয় ছুরি, আর নইলে কিছুই না।
শোনো, রাইখ, যখন পড়তে শিখবে কথাটা কাউকে জানাবে না। সবাইকে অবাক করে দেবে। এমনকি বাজীও ধরতে পারবে। এই ধরো পাঁচ ক্রেডিট করে সবার সাথে বাজী ধরবে। তারপর যখন যথেষ্ট ক্রেডিট জমা হবে তখন নিজেই ছুরি কিনে নিতে পারবে।
ইতস্তত করছে রাইখ। না, কেউ আমার লগে বাজী ধরব না। কোনো ব্যাডার কাছেই ক্রেডিট নাই।
পড়তে জানলে যেকোনো ছুরির দোকানে কাজ পাবে। তারপর বেতনের টাকায়। একটা ছুরি কিনে নেবে।
আপনি কহন কম্পিউটার কিন্যা দিবেন?
এক্ষুনি কিনব। কিন্তু তোমাকে দেব মাদার রিটার কাছে পৌঁছে দেওয়ার পর।
আপনের কাছে ক্রেডিট আছে?
আমার কাছে একটা ক্রেডিট টাইল আছে।
চলেন তাইলে, কম্পিউটার কিন্যা দেন।
লেনদেন সারতে বেশিক্ষণ লাগল না। কিন্তু রাইখ যখন নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো সেলডন মাথা নেড়ে জিনিসটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। আগে আমাদেরকে মাদার রিটার কাছে নিয়ে চলো। উনি কোথায় থাকেন তুমি আসলেই জান তো?
রেগে গেল রাইখ। জানি, জানি। আপনেগরে লইয়া যামু। কিন্তু হের পরে জিনিস না দিলে কইলাম খবর আছে। আমি লোকজন লইয়া আমু। তহন বুঝবেন ঠ্যালা কারে কয়। কাজেই সাবধান।
ভয় দেখানোর দরকার নেই। আমরা নিজেদের বাঁচাতে পারব।
সকলের কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে রাইখ দ্রুত হাঁটতে শুরু করল।
ডর্স এবং সেলডন হাঁটছেন নিঃশব্দে। ডর্স অবশ্য নিজের চিন্তায় মগ্ন। একই সাথে চারপাশের মানুষগুলোর উপরও তীক্ষ্ম নজর রেখেছে। পথচারীদের যেই তাকাচ্ছে সেও তাদের চোখে চোখ ফেলছে। পিছনে পায়ের শব্দ পেলেই গম্ভীরভাবে ঘুরে দেখছে।
তারপর একটা জায়গায় এসে থেমে গেল রাইখ। বলল, এইহানেই থাহে।
একটা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ভেতর ঢুকতে হলো এবং কিছুক্ষণের ভেতরেই দিশা হারিয়ে ফেললেন সেলডন।
এইরকম অলি গলির ভেতরে রাস্তা মনে রেখেছ কীভাবে, রাইখ? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
ছেলেটা সামান্য কাঁধ নাড়ল। এইহানে আমি ছোড বেলা থিকাই ঘুইরা বেড়াইতাছি। প্রত্যেক বাড়ির দরজায় নম্বর লাগানো–পোলাপানে অবশ্য ওই গুলান ভাইঙ্গা ফালায়। তাছাড়া চিহ্ন দেওয়া থাকে। পথ হারাইবেন না যদি কৌশল জানা থাকে।
কৌশলটা যে সে ভালোমতোই জানে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কমপ্লেক্সের ভিতরে চারপাশে দারিদ্র্যের ছোঁয়া। নোংরা পুরনো দেয়াল, আবর্জনার ছড়াছড়ি। একগাদা ছোট পোলাপান দৌড়াদৌড়ি করে কিছু একটা খেলছে। আউটসাইডাররা দুই একবার তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতেই চিৎকার করে বলল, ওই, মিয়া, সামনেততে সরেন। একজনের ছুঁড়ে দেওয়া বল মাত্র ইঞ্চিখানেকের জন্য ডর্সের গায়ে লাগল না।
শেষ পর্যন্ত রাইখ কালো একটা দরজার সামনে থামল। দরজাটার গায়ে অসংখ্য আঁচড়ের দাগ, চোখ বরাবর উচ্চতায় ২৭৮২ নাম্বার অত্যন্ত হালকাভাবে জ্বলছে।
এইডাই। বলল রাইখ, তারপর হাত বাড়িয়ে দিল।
প্রথমে দেখা যাক ভিতরে কে আছে, নরম গলায় বললেন সেলডন। সিগনাল বাটনে চাপ দিলেন তিনি, কিছুই ঘটল না।
এইডা নষ্ট। রাইখ বলল। আপনারে শব্দ করতে অইব, জোরে। বুড়ি আবার কানে হুনে না।
সেলডন দমাদম কয়েকটা ঘুষি মারলেন দরজায়। ভিতরে সাড়াশব্দ পাওয়া গেল। কাঁপা কাঁপা দুর্বল গলায় কে যেন জিজ্ঞেস করল, মাদার রিটার সাথে কে দেখা করতে চায়?
দুজন স্কলার। চিৎকার করে বললেন সেলডন।
ছোট কম্পিউটার এবং সফটওয়্যারের প্যাকেটটা তিনি ছুঁড়ে দিলেন। রাইখ সেটা লুফে নিল। হাসি একান থেকে ওকানে গিয়ে পৌঁছেছে। দৌড়ে চলে গেল সে। মাদার রিটার মুখোমুখি হওয়ার জন্য ঘুরলেন সেলডন।
.
৭০.
মাদার রিটার বয়স সত্তর বা বোধহয় তারও বেশি হবে, কিন্তু প্রথম দর্শনে সেটা বোঝা যায় না। তার গাল দুটো ফোলা ফোলা, মুখটা ছোট, গোলাকার থুতনি, মাঝখানে সামান্য একটা খাজ। লম্বায় চার ফুটের বেশি হবে না এবং অত্যন্ত শীর্ণ দেহ।
কিন্তু যখন হাসে–যেমন এখন অতিথিদের দেখে হাসছে–তখন চোখের চারপাশে এবং সেই সাথে সারা মুখে অসংখ্য বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠে। চলাফেরা করতেও তার কষ্ট হয়।
এসো, এসো, নরম কিন্তু উঁচু স্বরে বলল মাদার রিটা। পিট পিট করে তাকালো। বোধহয় তার দৃষ্টিশক্তিও দুর্বল হয়ে আসছে। আউটসাইডারস্… এবং আউটওয়াল্টারস্। তাই না? তোমাদের গায়ে ট্র্যান্টরের গন্ধ নেই।
সেলডনের মনে হলো গন্ধের কথা না বললেই ভালো হতো। এপার্টমেন্টটা অসংখ্য ছোট বড়ো জিনিসে বোঝাই হয়ে আছে। ধূলি বালিতে সয়লাব। পচা বাঁশি ঘামের দুর্গন্ধ এত প্রকট যে তিনি নিশ্চিত এখান থেকে চলে যাওয়ার পরেও কাপড় চোপড়ে এই দুর্গন্ধ লেগে থাকবে।
ঠিকই ধরেছেন। আমি হ্যালিকনের হ্যারি সেলডন। আমার বন্ধু সিনার ডর্স ভেনাবিলি।
তো, মাদার রিটা বলল। কামরার চারপাশে নজর বুলিয়ে অতিথিদের কোথায় বসতে দেবে তাই দেখছে, কিন্তু সেরকম কিছুই পাওয়া গেল না।
আমরা দাঁড়িয়ে থাকতে পারব, মাদার। ডর্স বলল।
কী? ডর্সের দিকে তাকালো সে। জোরে বল, মেয়ে। এখন আর যৌবনের মতো কানে ভালো শুনতে পাই না।
আপনি হিয়ারিং ডিভাইস ব্যবহার করেন না কেন? গলা উঁচু করে সেলডন জিজ্ঞেস করলেন।
তাতেও লাভ হবে না, মাস্টার সেলডন। নার্ভে কী যেন একটা সমস্যা হয়েছে এবং চিকিৎসা করার মতো অর্থ আমার নেই। বুড়ি মাদার রিটার কাছ থেকে তোমরা ভবিষ্যৎ জানতে এসেছ?
ঠিক উল্টোটা, সেলডন বললেন। আমরা অতীত জানতে এসেছি।
চমৎকার। মানুষ কী শুনলে খুশি হবে তা ঠিক করা অত্যন্ত কঠিন।
এটা নিশ্চয়ই একটা শিল্প। হাসিমুখে বলল ডর্স।
কাজটা সহজ মনে হয়, তবে মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে। আমি আমার যোগ্যতা প্রমাণ করেছি।
আপনার যদি কোনো ফি থাকে, সেলডন বললেন, আমাদের দিতে আপত্তি নেই। যদি আপনি আমাদের পৃথিবীর তথ্য দিতে পারেন–অবিশ্বাস্য কোনো গল্প শুনতে চাই না। আমরা সত্য জানতে চাই।
বৃদ্ধা কামরার ভেতরে পায়চারি করছে। এখানে ওখানে থেমে দুই একটা জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছে। বোধহয় অতিথিদের কাছে ঘরটা একটু আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করছে। সেলডনের কথা শুনে থমকে গেল। পৃথিবীর সম্বন্ধে তুমি কী জানতে চাও?
যা জানেন, একেবারে প্রথম থেকে।
বৃদ্ধা ঘুরে অসীম শূন্যতার মাঝে তাকিয়ে রইল। কথা বলল নিচু কিন্তু দৃঢ় সুরে।
একটা বিশ্ব, অতি প্রাচীন গ্রহ। এখন হারিয়ে গেছে এবং সবাই তার কথা ভুলে গেছে।
ইতিহাসে এই গ্রহের কোনো বিবরণ নেই। ডর্স বলল।
এই গ্রহ এত আগে তার যাত্রা শুরু করে যে তখন ইতিহাস বলে কোনো শব্দ ছিল না। গ্যালাক্সিতে যখন সভ্যতার প্রথম লগ্ন শুরু হয় তখনও সে ছিল। আসলে তারও বহু আগে থেকেই ছিল।
পৃথিবীর আরেক নাম কী… অরোরা? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।
এবার মাদার রিটার চেহারায় চরম ঘৃণা ফুটে উঠল। কে বলেছে তোমাকে?
তথ্য সংগ্রহের জন্য আমি অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। সেইরকম এক জায়গায় শুনেছি যে অরোরা বহুপূর্বে হারিয়ে যাওয়া এক গ্রহ যেখানে অতি সুপ্রাচীন কালে মানব বসতি ছিল।
মিথ্যা কথা, বৃদ্ধা এমনভাবে মুখ মুছল যেন এইমাত্র যা শুনেছে তার তিক্ত স্বাদটা দূর করার চেষ্টা করছে। যে নামটা এইমাত্র বললে সেটা হচ্ছে শয়তানের পরিপূরক। যত অশুভ আছে তার শুরু ওখানেই। এর আগে পৃথিবী তার সঙ্গীদের নিয়ে শান্তিতে ছিল। অশুভ এসে সব তছনছ করে দেওয়া শুরু করল। কিন্তু পৃথিবীর বীর সন্তানরা অশুভকে পরাজিত করল।
অশুভ আসার আগে থেকেই পৃথিবী ছিল, আপনি নিশ্চিত?
তারও অনেক অনেক আগে। গ্যালাক্সিতে পৃথিবী ছিল একা হাজার হাজার বছর কোটি কোটি বছর।
মানবজাতি কোটি কোটি বছর এই গ্রহে বাস করেছিল, একা। গ্যালাক্সির অন্য কোনো গ্রহেই মানব বসতি ছিল না তখন?
হ্যাঁ। হ্যাঁ। হ্যাঁ।
আপনি এগুলো কীভাবে জেনেছেন? কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রাম আছে? প্রিন্ট আউট বা অন্য কিছু?
মাদার রিটা মাথা নাড়ল। আমি শুনেছি আমার মায়ের কাছ থেকে, তিনি শুনেছেন তার মায়ের কাছ থেকে। এভাবেই গল্পগুলো চলে আসছে। আমার কোনো সন্তান নেই। তাই অন্যদের বলি। কিন্তু এখানেই বোধ হয় থেমে যাবে সব। সময়টা আসলে অবিশ্বাসের।
কথাটা ঠিক নয়, মাদার। ডর্স বলল। অনেক স্কলারই এখন প্রি হিস্টোরিক যুগ নিয়ে গবেষণা করছে।
হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল মাদার রিটা। ওরা পেশাগত দৃষ্টিতে বিচার করে। চেষ্টা করে নিজেদের গবেষণায় সেটা প্রতিস্থাপন করতে। বছরের পর বছর আমি তোমাদের মহান বীর বা-লীর গল্প শোনাতে পারব, কিন্তু তোমাদের সেই সময় হবে না, আর আমারও এখন সেই সামর্থ্য নেই।
আপনি রোবটের কথা শুনেছেন? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।
কেঁপে উঠল বৃদ্ধা, তার কণ্ঠ আর্তনাদের মতো শোনালো, এগুলো কেন জিজ্ঞেস করছ। ওগুলোই ছিল আসল শয়তান এবং সেই দুষ্ট গ্রহের সৃষ্টি। সবগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
একটা বিশেষ রোবট আছে, তাই না, যাকে দুষ্ট গ্রহ অসম্ভব ঘৃণা করে?
দুর্বল পায়ে সেলডনের কাছে এসে পিট পিট করে তার চোখের দিকে তাকালো মাদার রিটা। তুমি কী আমার সাথে রসিকতা করতে এসেছ? সবই জানো তারপরেও জিজ্ঞেস করছ? কেন?
কারণ আমি জানতে চাই।
একটা রোবট ছিল যে পৃথিবীকে সাহায্য করে। তার নাম ডা-নী। বা-লীর বন্ধু। সে মারা যায়নি। এখনো জীবিত এবং গ্যালাক্সিরই কোথাও আছে, সঠিক সময়ে ফিরে আসার অপেক্ষা করছে। সেই সময় কখন আসবে কেউ জানে না, কিন্তু একদিন সে ফিরে আসবে, অতীতের সুখী দিনগুলো আবার প্রতিষ্ঠিত করবে, সমস্ত অন্যায় অবিচার দূর করবে। কথাগুলো বলে সে চোখ মুদল, খানিকটা হাসল, যেন সোনালি অতীতের সুখে ডুবে যাচ্ছে…
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন সেলডন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ধন্যবাদ, মাদার রিটা। আপনি যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। কত দিতে হবে?
আউটওয়ার্ল্ডারদের সাথে কথা বলে আমি তো যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছি। জবাব দিল বৃদ্ধা। দশ ক্রেডিট। তোমরা কিছু খাবে?
না, ধন্যবাদ। সেলডন আন্তরিকভাবে বললেন। আমি বিশ ক্রেডিট দিচ্ছি। শুধু বলুন এখান থেকে কীভাবে এক্সপ্রেসওয়েতে যাব।–আর মাদার রিটা, আপনি যদি পৃথিবীর কিছু গল্প কম্পিউটার ডিস্কে তুলে দিতে পারেন আমি ভালো পারিশ্রমিক দেব।
আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে, কত ভালো?
নির্ভর করে গল্পগুলো কত পুরনো এবং কত ভালোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। হয়তো এক হাজার ক্রেডিট।
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো মাদার রিটা। এক হাজার ক্রেডিট। কিন্তু তোমাকে আমি কোথায় পাব?।
আমার কম্পিউটার কোড নাম্বার দিয়ে যাব।
কোড নাম্বার দিয়ে মাদার রিটার কাছ থেকে বিদায় নিল ডর্স আর সেলডন। বাইরের তুলনামূলক কম দুর্গন্ধে কিছুটা স্বস্তি বোধ হলো। বৃদ্ধার দেখিয়ে দেওয়া পথে ইতস্তত ভঙ্গিতে হাঁটছেন তারা।
.
৭১.
সাক্ষাৎকার পর্বটা দীর্ঘ হয়নি, হ্যারি। ডর্স বলল।
আমি জানি। পরিবেশটা ছিল জঘন্য, তাছাড়া মনে হয় অনেক কিছু জানতে পেরেছি। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে লোককাহিনীগুলো রূপান্তরিত হয়।
মানে?
মাইকোজেনিয়ানদের গল্প হলো যে তাদের অরোরা গ্রহে মানুষ বহু শতাব্দী বাস করেছে আর ডালাইটরা বলছে পৃথিবীতে কোটি কোটি বছর মানব সভ্যতা ছিল। আর দুজায়গাতেই একটা রোবটের কথা বলা হচ্ছে যা আজো বেঁচে আছে। অন্তত এখানে সবার মিল রয়েছে।
কোটি কোটি বছর আসলে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি?
মাদার রিটা বলেছিল এইদিক দিয়ে গেলে একটা রেস্ট এরিয়া পাব, তারপর সেন্ট্রাল ওয়াকওয়ের সাইনবোর্ড অনুসরণ করে যেতে হবে। আসার পথে কোনো রেস্ট এরিয়া দেখেছ?
বোধহয় যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি না। আমি কোনো রেস্ট এরিয়া দেখিনি। তবে আমি আসলে রাস্তার দিকে বেশি খেয়ালও করিনি–চোখ রেখেছিলাম পথচারীদের দিকে এবং–।
তার কণ্ঠস্বর নির্জীব হয়ে পড়ল। ঠিক সামনে গলিটা দুদিকে মোড় নিয়েছে।
মনে পড়ল সেলডনের। এদিক দিয়েই এসেছিলেন। কারণ দুপাশের ফুটপাথেই নোংরা গদিওয়ালা চেয়ার আছে।
আর ডর্সের এখন পথচারীদের দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ কোনো পথচারীই নেই। তবে রেস্ট এরিয়া ছাড়িয়ে গলির মাথায় একদল লোক দাঁড়িয়ে আছে। গড়পরতা ডাহলাইটদের চেয়েও দীর্ঘদেহী কালো গোফ, সবল দড়ির মতো। পাকানো হাতের পেশী, ফুটপাথের নির্জীব হলুদ আলোয় আরো ভয়ংকর দেখাচ্ছে।
কোনো সন্দেহ নেই ওরা আউটওয়ার্ল্ডারদের জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। ডর্স এবং সেলডন নিজের অজান্তেই থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেন সেলডন। আরো দুই তিনজন দুবৃত্ত চোখে পড়ল।
দাঁতের ফাঁক দিয়ে সেলডন বললেন, আমরা ফাঁদে পড়েছি। তোমাকে এখানে আনাটা ঠিক হয়নি।
ঠিক এই কারণেই আমি সাথে এসেছি। কিন্তু মাদার রিটার সাথে দেখা করার মূল্য হিসেবে এই বিপদ কী যথার্থ?
যদি বেঁচে ফিরতে পারি, তাহলে যথার্থ।
তারপর সেলডন উঁচু এবং দৃঢ় গলায় বললেন, আমরা যেতে পারি?
দুবৃত্তদের একজন সামনে বাড়ল। লম্বায় সেলডনের সমান। কিন্তু কাধ আরো। চওড়া এবং পেশীবহুল।
আমার নাম ম্যারন, লোকটা বলল। তোমাদেরকে একটা কথা বলতে এসেছি। আমাদের এখানে আউটওয়ার্ল্ডারদের কেউ চায় না। এসেছ ভালো কথা কিন্তু যেতে হলে মূল্য দিতে হবে।
বেশ। কত?
তোমরা ধনী আউটওয়াল্টার। তোমাদের কাছে ক্রেডিট টাইল আছে, ঠিক? সব আমার হাতে দাও।
না।
না বলে কোনো লাভ হবে না। আমরা কেড়ে নেব।
আমাকে খুন বা আহত না করে কেড়ে নিতে পারবে না আর আমার ভয়েসপ্রিন্ট ছাড়া ওগুলো কাজ করবে না। আমার স্বাভাবিক ভয়েসপ্রিন্ট।
সেটা ঠিক না, মাস্টার–দেখো আমি ভদ্র ব্যবহার করছি তোমাদেরকে আহত না করেই আমি ওগুলো কেড়ে নিতে পারি।
কয়জন মিলে কেড়ে নেবে? নয়জন? না, দ্রুত গুনে ফেললেন সেলডন। দশজন?
শুধু আমি। একা?
কারো সাহায্য নেবে না?
শুধু আমি।
বাকিরা যদি সরে গিয়ে আমাদের জায়গা করে দেয়, তাহলে আমি দেখতে চাই তোমার গায়ে কত শক্তি, ম্যারন।
তোমার কাছে ছুরি নেই, মাস্টার। দেব একটা?
না, তুমি ইচ্ছে হলে ব্যবহার করতে পারো, আমার লাগবে না।
ম্যারন ঘাড় ঘুরিয়ে সঙ্গীদের দিকে তাকালো, হেই, লোকটা বেশ মজার। মোটেই ভয় পায়নি। চমৎকার। তোমাকে আঘাত করাটা লজ্জাজনক।–আমি কী বলি শোনো, মাস্টার। আমি মেয়েটাকে নিয়ে যাব। যদি আমাকে থামাতে চাও তাহলে দুজনের ক্রেডিট টাইল এদিকে ছুঁড়ে দাও। এবং স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে অ্যাকটিভেট করো। যদি না করো, তাহলে মেয়েটার সাথে কাজ শেষ করে… শেষ হতে কিছুটা সময় লাগবে–হাসল সে–তোমাকে আমার আঘাত করতেই হবে।
না, সেলডন বললেন। তোমাকে আমি চ্যালেঞ্জ করেছি। একজনের সাথে একজন। তোমার কাছে ছুরি থাকবে, আমি খালি হাতে। বেশি ভয় লাগলে আরেকজনকে নাও। কিন্তু মেয়েটাকে ছেড়ে দিতে হবে।
থামো, হ্যারি! চিৎকার করল ডর্স। ও যদি আমাকে চায়, তাহলে আসতে দাও। ধরুক দেখি। তুমি যেখানে আছ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক। নড়বে না।
শুনেছ? দন্তবিকশিত হাসি দিয়ে বলল ম্যারন। যেখানে আছ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক। নড়বে না। আমার মনে হয় লিটল লেডীও আমাকে চায়। তোমরা দুজন ধরে রাখো ওকে।
সেলডনের হাত দুটো বজ্রমুঠিতে আটকা পড়ল এবং গলায় ছুরির ধারালো ফলা অনুভব করলেন তিনি।
নড়বে না, একটা কর্কশ কণ্ঠস্বর বলল। দেখতে থাকো। মেয়েটাও পছন্দ করবে সম্ভবত। ম্যারন এই কাজে বেশ দক্ষ।
ডর্স আবার চিৎকার করে বলল, নড়বে না, হ্যারি। সতর্কভাবে ম্যারনের দিকে ঘুরল সে, হাত দুটো বেল্টের কাছাকাছি।
ম্যারন সামনে বাড়ল, যথেষ্ট কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত নড়ল না ডর্স। তারপর হঠাৎ করেই তার হাতে বিদ্যুৎ খেলে গেল। আর ম্যারন নিজেকে আবিষ্কার করল দুটো বিশাল ছুরির মুখোমুখি।
কয়েক মুহূর্ত পিছন দিকে হেলে থাকল সে, তারপর হেসে উঠল। লিটল লেডীর হাতে দুটো ছুরি–পুরুষরা যেরকম ব্যবহার করে। আর আমার কাছে মাত্র একটা। কোনো অসুবিধা নেই। সেও দ্রুত ছুরি বের করল। তোমাকে মারতে আমার কষ্ট হবে, লিটল লেডী, কারণ দুজনে বেশ মজা করতে পারতাম।
তোমাকে আমি খুন করতে চাই না, ডর্স বলল। চেষ্টা করব যেন সেইরকম কিছু না ঘটে। যাইহোক যদি মেরেই ফেলি তাহলে সবাই সাক্ষী থাকবে, আমি শুধু আমার বন্ধুকে বাঁচাতে সেটা করেছি।
ভয় পাওয়ার অভিনয় করল ম্যারন। ওহ্, না, আমাকে মারবে না, লিটল লেডী। তারপর গলা ছেড়ে হেসে উঠল, সঙ্গীরাও যোগ দিল সেই হাসিতে।
ছুরি বাগিয়ে সামনে বাড়ল ম্যারন। আঘাত করার ভঙ্গি করল। একবার, দুবার, তিনবার। কিন্তু ডর্স চমকালও না, পিছিয়েও গেল না।
খানিকটা সচকিত হলো ম্যারন। আশা করেছিল তার ভঙ্গি দেখে ভয় পাবে ডর্স, কিন্তু উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এরপর সে ছুরি চালালো সরাসরি ডর্সকে লক্ষ্য করে। ডর্স বিদ্যুতের গতিতে বাহাতের ছুরি দিয়ে সেটা ঠেকিয়ে দিল। ডান হাতের ছুরি চালালো কোণাকুণি। ম্যারনের বুকের কাছে টি-শার্টের উপর রক্তের পাতলা একটা রেখা ফুটে উঠল।
হতভম্ব হয়ে বুকের দিকে তাকালো ম্যারন আর দর্শকদের বাকি সবাই বিস্ময়ে দম বন্ধ করে ফেলল। সেলডন টের পেলেন যে তাকে ধরে রাখা হাতগুলো কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ছে, কারণ বুঝে নিয়েছে যে লড়াই তারা যেমন আশা করেছিল তেমন হবে না।
আবার হামলা চালাল ম্যারন। এবার সে তার বা হাত বাড়ালো ডর্সের ডান হাতকে আটকানোর জন্য। আবারো ডর্সের বা হাতের ছুরি ম্যারনের ছুরি আটকে দিল আর বাহাতেরটা দিয়ে উপর থেকে নিচে কোপ মারল। ম্যারন যখন হাত খুলল তখন তালুতে রক্তের পাতলা রেখা দেখা গেল।
কেউ একজন আমাকে আরেকটা ছুরি দাও, চিৎকার করল ম্যারন।
খানিকক্ষণের দ্বিধা, তারপর একজন নিজের ছুরিটা ছুঁড়ে দিল। ধরার জন্য হাত বাড়ালো ম্যারন। কিন্তু ডর্সের গতি আরো বেশি দ্রুত। ডান হাতের ছুরি দিয়ে ছুঁড়ে মারা অস্ত্রটাকে আবার ফিরতি পথে পাঠিয়ে দিল।
সেলডন টের পেলেন ধরে রাখা হাতদুটো আরো শিথিল হয়েছে। তিনি প্রচণ্ড গতিতে হাঁটু দিয়ে একজনের কুচকীতে আর কনুই দিয়ে আরেকজনের সোলার। প্লেক্সাসে গুতো মারলেন। দুই ব্যাটাই শুয়ে পড়ল মাটিতে।
নিচু হয়ে ছুরিগুলো তুলে নিলেন তিনি। যখন সোজা হলেন তখন তিনিও ডর্সের মতো সশস্ত্র। তিনি ছুরি ব্যবহার করতে জানেন না, কিন্তু সেটা ডাহ্লাইটদের জানা নেই।
শুধু ওদেরকে আটকে রাখ, হ্যারি। ডর্স বলল। তোমার মারামারি করার দরকার নেই।–ম্যারন, এরপরে কিন্তু শুধু আঁচড় দেব না।
রাগে অন্ধ হয়ে গেল ম্যারন। গায়ের সমস্ত জোর নিয়ে আক্রমণ করল। শক্তি দিয়েই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ইচ্ছা। কিন্তু ডর্স চট করে তার ডান বাহুর নিচে ঢুকে পড়ল, একই সাথে গোড়ালিতে পা বাধিয়ে ল্যাং মারল। দরাম করে আছাড় খেল ম্যারন, ছুরি ফসকে গেল হাত থেকে।
ডর্স একটা ছুরি ম্যারনের ঘাড়ের পাশে আরেকটা কণ্ঠনালীর উপরে ধরে বলল, যথেষ্ট হয়েছে নাকি আরো লাগবে?
প্রচণ্ড এক চিৎকার করে ম্যারন ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিল, তারপর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু তার আগেই ডর্স তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ছুরি চালিয়ে গোফের অর্ধেক কেটে ফেলল। এইবার ম্যারন চিৎকার করে উঠল বুনো জন্তুর মতো, হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। তারপর যখন হাত সরালো রক্ত ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না।
ওখানে আর মোছ গজাবে না, ম্যারন। ঠোঁটেরও অনেকটা কেটে ফেলে দিয়েছি। আবার চেষ্টা করে দেখ তোমাকে খুন করে ফেলব।
কিন্তু ম্যারনের সাধ মিটে গেছে। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে পিছিয়ে গেল সে।
অন্যদের দিকে ঘুরল ডর্স। সেলডন যে দুজনকে শুইয়ে দিয়েছেন তারা এখনো নিরস্ত্র অবস্থায় মাটিতে শুয়ে আছে। উঠার কোনো তাড়া নেই। ডর্স তাদের বেল্ট কেটে ট্রাউজার হাঁটু পর্যন্ত নামিয়ে আনল। বলল, এখন হাঁটার সময় প্যান্ট ধরে রাখতে হবে।
বাকি সাত জনের দিকে ঘুরে বলল, ম্যারনকে ছুরি দিয়েছিল কে?
কোনো জবাব নেই।
না বললেও চলবে। একজন একজন করে অথবা সবাই একসাথে আসতে পারো। তবে মনে রেখো যতবার ছুরি চালাবো ততবার একজন মরবে।
সাতজন একসাথে ঘুরল, একসাথে পালিয়ে গেল।
ভুরু উঁচু করে সেলডনকে বলল ডর্স, এবার অন্তত হামিন বলতে পারবে না যে আমি তোমাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি।
যা দেখলাম এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, সেলডন বললেন। তুমি যে এভাবে মারামারি করতে পারো বা এভাবে কথা বলতে পারো জানতাম না।
হাসল ডর্স, ঠিক হাসি নয়, ঠোঁট একটু বাঁকা করল, তুমিও কম যাও না। আমরা চমৎকার একটা জোড়া হতে পারব। এবার ছুরিগুলো ব্যাগে রেখে দাও। আমার মনে হয় সংবাদটা বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে বিলিবটন থেকে। বেরিয়ে যেতে আমাদের আর কোনো বিপদে পড়তে হবে না।
তার অনুমান ছিল একশ ভাগ নির্ভুল।
.
আণ্ডারকভার
ডাভান… সময়টা ছিল সত্যিকার অর্থেই বিশৃঙ্খল এবং অস্থির। গ্যালাক্টিক এম্পায়ার পৌঁছে গেছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। রাজনৈতিক এবং সামাজিক নেতারা সুপ্রিম পাওয়ারের জন্য নিজেদের ভেতর কামড়াকামড়ি শুরু করে দিয়েছে (যা ক্রমেই হয়ে উঠছিল আরো অর্থহীন)। সাইকোহিস্টোরি পরিপূর্ণ বিকশিত হওয়ার পূর্বে সত্যিকার অর্থবহ কোনো আন্দোলন হয়নি। সবচেয়ে আকর্ষণীয়। উদাহরণ হচ্ছে ডাভান, যার ব্যাপারে প্রকৃত কিছু জানা যায়নি। সম্ভবত তার সাথে হ্যারি সেলডনের দেখা হয়েছিল যখন….
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা
.
৭২.
ফিরে এসে ডর্স আর সেলডন দীর্ঘসময় নিয়ে গোসল সারলেন। যদিও টিসালভারদের এখানে সুযোগ সুবিধা অত্যন্ত পুরনো। পোশাক পাল্টে বসে রইলেন নিজেদের কামরায়। জর্ড টিসালভার বাড়ি ফিরল সন্ধ্যায়। কিছুক্ষণ পরেই সেলডনের দরজায় নক করল।
সেলডন নিজেই দরজা খুলে দিলেন। শুভ সন্ধ্যা, মাস্টার টিসালভার। মিস্ট্রেস।
মহিলা দাঁড়িয়ে আছে স্বামীর ঠিক পিছনেই, কপালে অনেকগুলো ভাঁজ।
টিসালভার আন্তরিক গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনারা ঠিক আছেন তো?
পুরোপুরি। কোনো সমস্যা ছাড়াই বিলিবটনে গিয়ে ফিরে এসেছি। গোসল করে পোশাক পাল্টেছি। কোনো দুর্গন্ধ নেই। মাথা কাত করে তিনি গন্ধ শুঁকলেন। কথাগুলো বলেছেন টিসালভারের স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে।
মহিলাও গন্ধ শুঁকে দেখল।
টিসালভার এখনো আন্তরিক। আমি শুনলাম ওখানে নাকি ভীষণ মারামারি হয়েছে।
তাই নাকি?
কমপক্ষে একশ দুবৃত্ত আপনাদের আক্রমণ করেছিল। তাদের সবাইকে মেরে ফেলেছেন।
মোটেই না, বিরক্ত সুরে বলল ডর্স। কী মনে হয় আমাদেরকে? খুনী? খুন। হওয়ার জন্য ওরা কী ওখানে দাঁড়িয়েছিল মনে হয় আপনার?
সবার মুখে একই কথা, ক্যাসিলিয়া টিসালভার কঠিন সুরে বলল। কিন্তু এই বাড়িতে ওসব চলবে না।
প্রথম কথা, সেলডন বললেন, ঘটনাটা এই বাড়িতে ঘটেনি। দ্বিতীয় কথা একশজন ছিল না, ছিল মাত্র দশজন। তৃতীয় কথা, কেউ মারা যায়নি। একটু ধ্বস্তা ধ্বস্তি। তারপর ওরা সরে গিয়ে আমাদের পথ করে দেয়।
ওরা আপনাদের পথ করে দেয়? আমি এই কথা বিশ্বাস করব আউটওয়ার্ল্ডারস? মিস্ট্রেস টিসালভার আরো জেদের সাথে বলল।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেলডন। মানুষ সামান্য ঘটনাতেই কত দ্রুত পাল্টে যায়। বললেন, স্বীকার করছি যে একজন জখম হয়েছে। তেমন মারাত্মক কিছু না।
অথচ আপনাদের কিছুই হয়নি। টিসালভার বলল। কণ্ঠে প্রশংসা।
একটা আঁচড়ও পড়েনি। মিস্ট্রেস ভেনাবিলি দুইটা ছুরি দিয়ে চমৎকার সামলেছেন।
আমার এক কথা, ডর্সের বেল্টের উপর দৃষ্টি রেখে মিস্ট্রেস টিসালভার বলল, ওসব এখানে চলবে না।
আমাদের কেউ হামলা না করলে, কঠিন সুরে বলল ডর্স, সেরকম কিছু এখানে ঘটবে না।
কিন্তু আপনাদের কারণেই রাস্তার একটা আবর্জনা আমাদের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
ক্যাসিলিয়া, স্ত্রীকে শান্ত করার চেষ্টা করল টিসালভার। রাগ দেখিয়ে-
কেন, তুমি কী ওর ছুরিগুলোকে ভয় পাও? আরো বেশি ক্ষেপে উঠল মহিলা। দেখি এখানে কীভাবে ছুরি ব্যবহার করে।
এখানে ব্যবহার করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। দ্বিগুণ তেজে জবাব দিল ডর্স। রাস্তার আবর্জনার ব্যাপারটা কী?
টিসালভার বলল, আমার স্ত্রী বলতে চাইছে যে বিলিবটনের এক ভিখারী–অন্তত চেহারা সুরতে তাই মনে হয় আপনাদের সাথে দেখা করতে চায়। কিন্তু আমরা ঢুকতে দিতে পারি না। আমাদের মান সম্মানের প্রশ্ন।
ঠিক আছে, মাস্টার টিসালভার। সেলডন বললেন, আমরা বাইরে গিয়ে দেখা করছি।
না, দাঁড়াও। ডর্স বলল, এই ঘর আমাদের। আমরা ভাড়া দিচ্ছি। আমরাই ঠিক করব কে আসবে, কে আসবে না। বিলিবটন থেকে যেই আসুক সেও একজন ডালাইট। বড়ো কথা সে একজন ট্র্যান্টরিয়ান। আরো বড়ো কথা সে এম্পায়ারের নাগরিক এবং মানুষ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা সে আমাদের অতিথি। কাজেই সে ভিতরে আসবে।
মিস্ট্রেস টিসালভার নড়ল না একটুও। আর মাস্টার টিসালভার বুঝতে পারছে না কী করবে।
যেহেতু আপনারাই বলছেন যে বিলিবটনে আমি একশ জন দুবৃত্তকে মেরে ফেলেছি। নিশ্চয়ই ভাবছেন না যে ছোট কোনো ছেলেকে আমি ভয় পাবো বা আপনাদেরকে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বেল্টের উপর হাত রাখল ডর্স।
টিসালভার হঠাৎ প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে বলল, মিস্ট্রেস ভেনাবিলি, অবশ্যই এই ঘর আপনাদের, যাকে খুশি তাকে ভিতরে নিয়ে আসতে পারেন। পিছিয়ে গেল সে। অনিচ্ছুক স্ত্রীকে টেনে নিয়ে চলল।
কঠিন দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল ডর্স।
শুকনো হাসলেন সেলডন। ঠিক মিলছে না, ডর্স। মনে করতাম আমিই খুঁজে খুঁজে সমস্যা বের করি আর তুমি সেগুলো সামাল দাও। এখন দেখছি উল্টোটা।
মানুষের প্রতি মানুষের এমন অবজ্ঞা আমার সহ্য হয় না। এখানের ছদ্মবেশী ভদ্রলোকেরাই রাস্তার চোর ডাকাতগুলো তৈরি করেছে।
আরেক দল ভদ্রলোক এদেরকে তৈরি করেছে, সেলডন বললেন। এটা আসলে মানব সমাজেরই-
তোমার সাইকোহিস্টোরিতে এটা নিয়ে কাজ করবে তাহলে।
যদি সাইকোহিস্টোরি আদৌ সম্ভব হয়।–আহ্, ঐ যে আমাদের অতিথি চলে এসেছে। রাইখ। আমি অবাক হইনি।
.
৭৩.
ভিতরে ঢুকল রাইখ। বিস্ময় মাখানো দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। তর্জনী ছুঁইয়ে রেখেছে উপরের ঠোঁটে। বোধহয় ভাবছে কবে যে দাড়ি গোঁফ উঠবে।
রাগে ফোঁস-ফোঁস করতে থাকা মিস্ট্রেস টিসালভারের দিকে ঘুরল সে। অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে মাথা নোয়ালো, ধইন্যবাদ, মিসেস। আপনের বাড়িডা খুব সুন্দর।
দড়াম করে দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বেশ অনেকটা সহজভাবে ডর্স এবং সেলডনের দিকে ঘুরল সে। সুন্দর বাড়ি।
তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুশী হলাম, গম্ভীরভাবে বললেন সেলডন। আমরা এখানে থাকি কীভাবে জানলে।
পিছন পিছন আইছি। আর ক্যামনে জানুম। হেই লেডী, ডর্সের দিকে ঘুরল সে, যে একখান ফাইট দিছেন।
এরকম ফাইট কী তুমি অনেক দেখেছ?
না, কই শিখলেন?
আমার নিজের গ্রহে।
আমারে শিখাইবেন?
সেজন্যই এখানে এসেছ?
না, হের লাইগানা। আমি একটা খবর লইয়া আইছি।
আমার সাথে একজন ফাইট করতে চায়?
আপনার লগে কেউ আর ফাইট করবার চায় না। বিলিবটনের যেইহানেই যাইবেন ব্যাবাকতেই সম্মান কইরা রাস্তা ছাইড়া দিব। এর লাইগ্যাই হে আপনের লগে। দেহা করবার চায়।
কে দেখা করতে চায়, রাইখ? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।
এক লোক। বিলিবটনেই থাহে কিন্তু লগে কোনো ছুরি রাহে না।
অথচ এখনো বেঁচে আছে?
হে অনেক লেহাপড়া করে। কোনো বিপদ আইলে আমগরে সাহায্য করে। হেরে কেউ ঘাডায় না।
তাহলে নিজে না এসে তোমাকে পাঠিয়েছে কেন? জিজ্ঞেস করল ডর্স।
এই জায়গাডা হে পছন্দ করে না। কয় এইহানে অসুস্থ হইয়া পড়ব। এইহানের মানুষগুলা নাকি সরকারের চামচা- হঠাৎ থেমে গিয়ে ভয়ে ভয়ে আউটওয়ার্ল্ডারদের দিকে তাকালো। যাইহোক, এইহানে আইব না। আমারে পাঠাইছে এই বইলা যে ছোড দেইখা আমারে ঢুকতে দিব। আসলে তো দ্যায়নাই, ঠিক না। ওই বেডির ভাব দেইখা তো মনে হইল দুর্গন্ধ পাইতাছে।
থেমে লজ্জিতভাবে নিজের বেশভূষা দেখল। যে অবস্থায় থাহি কাপড় চোপড় পরিস্কার রাহন কঠিন।
কোনো ব্যাপার না, হাসি মুখে বলল ডর্স। কোথায় দেখা হবে তাহলে। আমরা আর বিলিবটনে যেতে চাচ্ছি না।
বেশি দূরে না। আমি আপনাগোরে লইয়া যামু।
আমাদের সাথে কেন দেখা করতে চায়।
জানি না। কইছিল, মনে করার চেষ্টায় চোখ আধবোজা করল রাইখ। ওদেরকে বলবে আমি সেই লোকটার সাথে দেখা করতে চাই যে একজন ডাহ্লাইট হিটসিঙ্কারের সাথে ভালো ব্যবহার করেছে এবং সেই মহিলার সাথে যে সুযোগ পেয়েও ম্যারনকে খুন করেনি। মনে হয় ঠিকই কইছি।
আমারও তাই মনে হয়। হাসিমুখে বললেন সেলডন। এখন দেখা করা যাবে?
হ।
চলো তাহলে। চোখে সন্দেহ নিয়ে ডর্সের দিকে তাকালেন তিনি।
মাথা নাড়ল ডর্স। ঠিক আছে। দেখা যাক ঘটনা কী। মনে হয় না এটা কোনো ফাঁদ। আশা করি।
.
৭৪.
চমৎকার গোধূলির আলো ছড়িয়ে আছে চারপাশে। মেঘগুলো হালকা বেগুনি। কিনারায় গোলাপী আভা, চমৎকার দৃশ্য। ডাহলাইটরা ইম্পেরিয়াল শাসনের বিরুদ্ধে যতই অভিযোগ করুক না কেন, কম্পিউটারের তৈরি করে দেওয়া আবহাওয়াতে কোনো দোষ নেই।
ডর্স নিচু গলায় বলল, আমরা এখন বিখ্যাত। কোনো সন্দেহ নেই।
আকাশ থেকে চোখ নামালেন সেলডন (আসলে তো ট্র্যান্টরের আকাশ হচ্ছে উঁচু ধাতব আবরণ, কম্পিউটারের সাহায্যে কৃত্রিম আকাশ তৈরি করা হয়েছে)। টিসালভারদের অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে বিশাল ভিড় চোখে পড়ল।
এখন বুঝতে পারছি মিস্ট্রেস টিসালভার কেন এত রেগে উঠেছিল। ডর্স বলল। আমার এতটা খারাপ ব্যবহার করা ঠিক হয়নি।
ভিড়ের অধিকাংশেরই পোশাক পরিচ্ছদ অত্যন্ত মলিন, অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে ওরা সবাই বিলিবটন থেকে এসেছে।
মৃদু হেসে সবার উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন সেলডন। উপস্থিত জনতা করতালি দিয়ে উঠল। ভিড়ের মাঝ থেকে একটা কণ্ঠস্বর বলল, ভদ্রমহিলা কী এখন আমাদের দুএকটা ছুরির খেলা দেখাতে পারবেন?
ডর্স যখন পাল্টা জবাব দিল, না, রেগে গেলেই ওরকম করি, সবাই হেসে উঠল।
ভিড়ের ভেতর থেকে একটা লোক সামনে বাড়ল। লোকটা বিলিবটনের তো নয়ই এমনকি ডালাইটও নয়। বোঝা গেল এই কারণে যে তার গোঁফ অত্যন্ত ছোট এবং কালো নয় বাদামী। ট্র্যান্টরিয়ান এইচ.ভি. নিউজের মারলন ট্যান্টো, বলল সে, একটু এদিকে আসবেন, রাতের সংবাদ প্রচারের জন্য আপনাদের ছবি নিতে চাই।
না, সংক্ষেপে বলল ডর্স। কোনো সাক্ষাঙ্কার নয়।
সাংবাদিক দমল না মোটেই। বিলিবটনে অনেকগুলো গুন্ডার সাথে আপনাদের একটা লড়াই হয়েছে এবং আপনারা তাদের পরাস্ত করেছেন। ঠিক?
না, ওখানে বেশ কিছু লোকের সাথে আমাদের দেখা হয়। কিছুক্ষণ তাদের। সাথে গল্পগুজব করে আমরা চলে আসি। ব্যস, এইটুকুই, এবং এর বেশি কিছু আপনারা জানতে পারবেন না।
আপনার নাম? কথা শুনে ট্র্যান্টরিয়ান মনে হচ্ছে না।
আমার কোনো নাম নেই।
আপনার বন্ধুর নাম?
ওর-ও কোনো নাম নেই।
সাংবাদিক খানিকটা বিরক্ত হলো। শুনুন, আপনারা এখন খবরের শিরোনাম আর আমি শুধু দায়িত্ব পালন করছি।
ডর্সের জামার হাত ধরে টান দিল রাইখ। ঝুঁকে তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল ডর্স।
তারপর সোজা হয়ে বলল, আমার মনে হয় না আপনি একজন সাংবাদিক, মি. ট্যান্টো। আমার মনে হয় আপনি একজন ইম্পেরিয়াল এজেন্ট। ডাহুলের জন্য সমস্যা তৈরি করার চেষ্টা করছেন। আসলে কোনো মারামারিই হয়নি অথচ আপনি এমনভাবে রং চড়িয়ে প্রচার করার চেষ্টা করছেন যেন সম্রাটের সৈনিকরা বিলিবটনের সহজ সরল নাগরিকদের হয়রানি করার একটা সুযোগ পেয়ে যায়। আমি আপনার জায়গায়। থাকলে এখানে আর একমুহূর্তও দাঁড়াতাম না। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে এই মানুষগুলো আপনাকে মোটেই পছন্দ করে না।
ডর্সের প্রথম কথাতেই ভিড়ের মাঝে একটা গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। সেটা এখন বাড়ছে এবং মানুষগুলো ধীর গতিতে ট্যান্টোকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলল। আক্রমণের ভঙ্গিতে বৃত্তটা ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। শঙ্কিত দৃষ্টিতে চারপাশে তাকালো সাংবাদিক তারপর দ্রুত হাঁটা ধরল।
গলা চড়াল ডর্স। যেতে দিন ওকে। কেউ ওর গায়ে হাত দেবেন না। তাহলে অভিযোগ করার একটা সুযোগ পেয়ে যাবে।
ভিড়টা দুপাশে সরে গিয়ে ট্যান্টোর যাবার পথ করে দিল।
ব্যাটারে ওগোর হাতে তুইলা দিলেই ভালো অইত। রাইখ বলল। প্যাদানি খাইয়া সোজা অইয়া যাইত।
শয়তান ছেলে, ডর্স বলল, তোমার বন্ধুর কাছে নিয়ে চল আমাদের।
.
৭৫.
ডাভানের সাথে দেখা হলো একটা প্রায় ধ্বংসতূপে পরিণত হওয়া রেস্তোরাঁর পিছনে। অনেক পিছনে।
পথ দেখালো রাইখ, আরো একবার প্রমাণ করল যে বিলিটনের অলিগলিগুলোতেই সে আজন্ম বেড়ে উঠেছে। অনেকটা হ্যালিকনের টানেলের ছুচোর মতোই।
প্রথমে ডর্সের সতর্ক চোখেই ব্যাপারটা ধরা পড়ল। থেমে জিজ্ঞেস করল, রাইখ, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
ডাভানের কাছে, বিরক্ত হয়ে বলল রাইখ। আগেই কইছি।
কিন্তু এখানে তো কেউ থাকে বলে মনে হয় না। জায়গাটা পরিত্যক্ত। চারপাশে তাকালো ডর্স। মানুষ তো দূরের কথা কাক পক্ষীও নেই। আলো যা আছে সেটা থাকা আর না থাকা সমান কথা, অন্ধকার তাতে দূর না হয়ে বরং আরো গাঢ় হয়েছে।
ডাভান এইভাবেই থাকবার পছন্দ করে, রাইখ বলল। আইজকা এইহানে। থাহে তো কাইলকা ওইহানে। খালি জায়গা বদলায়… বুঝবার পারছেন?
কেন?
ধরা না পড়ার লাইগা।
কে ধরবে?
সরকার।
সরকার ডাভানকে কেন ধরতে চায়?
কইবার পারুম না। আমি বরং আপনাগোরে বইলা দেই ক্যামনে যাইতে অইব। নিজেরাই চইলা যান।
না রাইখ, সেলডন বললেন, তুমি সাথে না থাকলে আমরা যে পথ হারাব তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তুমি যদি অপেক্ষা করো তাহলে আরো ভালো হয়। তাহলে ফিরে যেতেও কোনো সমস্যা হবে না।
আমারে কী দিবেন? খামখা এইহানে ঘুইরা খিদা লাগামু ক্যা?
লাগুক খিদে। ফিরে এসে তোমাকে চমৎকার ডিনার কিনে দেব। তুমি যা চাও।
আপনের মুখের কথা ক্যামতে বিশ্বাস করমু?
বিদ্যুৎ খেলে গেল ডর্সের শরীরে। এক সেকেন্ড পরেই তার হাতে শোভা পেল ধারালো ছুরি। তুমি নিশ্চয়ই বলছ না যে আমরা মিথ্যেবাদী, তাই না, রাইখ?
বিস্ফারিত হয়ে গেল রাইখের চোখ। ভয় পেয়েছে বলে মনে হয় না। উৎসাহের সুরে বলল, আমি বুঝবারই পারি নাই। আরেকবার করেন তো দেহি।
করব, পরে, যদি অপেক্ষা করো এখানে। না থাকলে, কড়া দৃষ্টিতে তাকালো ডর্স, তোমাকে ঠিকই খুঁজে বের করব।
মিছা কথা। আপনে ওইরকম মানুষ না। তয় আমি অপেক্ষা করমু। বয়স্কদের মতো ভঙ্গি করল রাইখ। কথা দিলাম।
তারপর নিঃশব্দে বাকি পথটুকু দেখিয়ে নিয়ে গেল সে। ফাঁকা করিডোরে তাদের পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল।
কামরায় ঢোকার পর ঝট করে তাকালো ডাভান। তার সতর্ক দৃষ্টি নরম হলো রাইখকে দেখে। প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে বাকি দুজনের দিকে ইশারা করল সে।
এই দুইজনেই, বলল রাইখ। তারপর দন্তবিকশিত হাসি দিয়ে চলে গেল।
আমি হ্যারি সেলডন। ইনি ডর্স ভেনাবিলি। কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে ডাভানকে দেখতে লাগলেন সেলডন। অন্যান্য ডাহলাইটদের মতোই সেও বেটে এবং ঠোঁটের উপর পাতলা গোঁফ। ব্যতিক্রম হচ্ছে, লোকটার মুখে দাড়ি আছে। এই প্রথম একজন দাড়িঅলা ডালাইট দেখতে পেলেন সেলডন। এমনকি বিলিটনের গুন্ডাগুলো পর্যন্ত নিয়মিত দাড়ি কামায়। আপনার নাম, স্যার? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
ডাভান। রাইখ বলেছে নিশ্চয়ই।
আপনার পুরো নাম?
আমি শুধুই ডাভান। কেউ আপনাদের অনুসরণ করেনি তো?
না, নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। কেউ পিছু নিলে রাইখের কাছে ঠিকই ধরা পরে যেত। সে না পারলেও ডর্স ভেনাবিলি ঠিকই বুঝতে পারত।
মুচকি হাসল ডর্স। আমার উপর দেখছি তোমার অগাধ বিশ্বাস, হ্যারি।
সবসময়ই ছিল। চিন্তিত সুরে বললেন সেলডন।
ডাভানের চোখে অস্বস্তি। তার আগেই অবশ্য আপনারা ধরা পড়ে গেছেন।
ধরা পড়ে গেছি?
হ্যাঁ, ভণ্ড সাংবাদিকের কথা শুনেছি আমি।
এত জলদি, কিছুটা অবাক হলেন সেলডন। আমি তো সত্যি সত্যি সাংবাদিক মনে করেছিলাম, আর… কোনো বিপদের আশঙ্কা করিনি। রাইখের পরামর্শেই লোকটাকে আমরা ইম্পেরিয়াল এজেন্ট বলি। পরামর্শটা ভালোই ছিল। আশেপাশের মানুষগুলো খেপে উঠে আমরাও তাড়াতাড়ি ছাড়া পেয়ে যাই।
না, আপনারা যা বলেছেন লোকটা আসলেই তাই। আমার লোকেরা ওকে ভালোমতোই চেনে এবং আসলেই সে এম্পায়ারের পক্ষে কাজ করছে। কিন্তু আমি যা করছি আপনারা সেরকম করছেন না। আপনারা ছদ্মনাম ব্যবহার করছেন না বা থাকার জায়গাও বদলাচ্ছেন না। আসল নামই ব্যবহার করছেন। আপনি হ্যারি সেলডন, সেই গণিতবিদ।
হ্যাঁ, সেলডন বললেন। আমি ছদ্মনাম ব্যবহার করব কেন?
সম্রাট আপনাকে চায়। তাই না?
কাঁধ নাড়লেন সেলডন। আমি এমন জায়গায় থাকি যেখানে সম্রাট আমার কিছুই করতে পারবে না।
হয়তো সরাসরি বা খোলাখুলি কিছু করতে পারবে না, কিন্তু সরাসরি কিছু করার প্রয়োজনও নেই। আমার অনুরোধ আপনি অদৃশ্য হয়ে যান… সত্যিকার অর্থেই অদৃশ্য।
আপনার মতো… বললেন সেলডন। তাকালেন চারপাশে। যে করিডর দিয়ে এসেছেন সেগুলোর মতো কামরাটাও পুরোপুরি নিষ্প্রাণ, ধুলোবালি আর আবর্জনাতে ভর্তি।
হ্যাঁ, ডাভান বলল। হয়তো আপনি আমাদের কাজে আসবেন?
কীভাবে?
ইউগো এমারিলের সাথে কথা বলেছেন আপনি?
হ্যাঁ, বলেছি।
সে আমাকে বলেছে যে আপনি ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারেন।
বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেলডন। এখানে আসার পর থেকেই ক্লান্তি বোধ করছেন তিনি। ডাভান একটা গদির উপর বসেছে। আরো কয়েকটা গদি আছে। কিন্তু এত বেশি নোংরা যে বসতে ইচ্ছে হলো না। দেয়ালগুলোও যথেষ্ট নোংরা।
হয় আপনি এমারিলকে ভুল বুঝেছেন অথবা এমারিলই আমাকে বুঝতে ভুল। করেছে। তিনি বললেন। আমি শুধু প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি যে কতগুলো নির্দিষ্ট শর্তমতে ভবিষ্যৎ ইতিহাসের চরম অরাজকতা আর বিশৃঙ্খলা কমিয়ে আনা যাবে, তবে তা হবে অনেক সীমিত। সেই নির্দিষ্ট শর্তগুলো কী আমি জানি না। এটাও জানি
একজন বা অনেক মানুষের পক্ষে নির্দিষ্ট সময়সীমার মাঝে সেগুলো বের করা সম্ভব কী না। বুঝতে পেরেছেন?
না।
আবারো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সেলডন। ঠিক আছে আবার বলছি। হয়তো ভবিষ্যৎ অনুমান করা সম্ভব কিন্তু সেই অনুমিত ভবিষ্যৎ থেকে কার্যকরী সুবিধা অর্জন পুরোপুরি অসম্ভব। বুঝতে পেরেছেন?
ডাভানের চেহারা হতাশায় কালো হয়ে গেল। প্রথমে সেলডন তারপর ডর্সের দিকে তাকালো। তার মানে আপনি ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারেন না?
এবার আপনি সঠিক বুঝতে পেরেছেন, মাস্টার ডাভান।
শুধু ডাভান বললেই হবে। কিন্তু একদিন নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার কৌশল আপনার আয়ত্তে আসবে?
হয়তো।
তাহলে এই কারণেই এম্পায়ার আপনাকে চায়?
না, শাসানোর ভঙ্গিতে তর্জনী খাড়া করলেন সেলডন। আমার মতে এই কারণেই এম্পায়ার আমাকে ধরার জন্য ব্যাপক কোনো প্রচেষ্টা চালাচ্ছে না। ওরা জানে যে এই মুহূর্তে আমার হাতে ওদেরকে দেওয়ার মতো কিছু নেই। তাহলে শুধু শুধু বিভিন্ন সেক্টরের স্থানীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে গোলমাল বাড়ানোর দরকারটা কী। আর তাই তো আমি নিজের আসল নাম ব্যবহার করে প্রকাশ্যে এবং নিরাপদে ঘুরে বেড়াতে পারছি।
বেশ কয়েকটা মুহূর্ত মাথা নিচু করে মুখ ঢেকে রইল ডাভান। তারপর ডর্সকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কী মাস্টার সেলডনের স্ত্রী?
আমি তার বন্ধু এবং তাকে যেকোনো বিপদআপদ থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার। শান্ত গলায় জবাব দিল ডর্স।
উনাকে কতটুকু চিনেন আপনি?
আমরা দুজন একসাথে আছি এই কয়েক মাস হবে।
তার বেশি না?
তার বেশি না।
আপনার কী মনে হয় উনি আসলেই সত্যি কথা বলছেন?
কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার কথা আপনি বিশ্বাস করবেন কেন যদি উনার কথাই বিশ্বাস না করেন। হ্যারি যদি কোনো কারণে মিথ্যে কথা বলে তাহলে ওকে। সমর্থন দেওয়ার জন্য আমিও তো মিথ্যে কথা বলতে পারি।
অসহায়ের মতো দুজনের মুখের দিকে তাকাতে লাগল ডাভান। তারপর বলল, আপনারা কোনোভাবেই আমাদের সাহায্য করতে পারেন না?
এই আমরা বলতে কাদের কথা বলছেন এবং কীভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি?
ডাহলের অবস্থা তো আপনি দেখেছেন, ডাভান বলল। আমরা শোষিত। ইউগো এমারিলের সাথে যেরকম ভালো আচরণ করেছেন তাতে আমার বিশ্বাস আমাদের প্রতি আপনাদের পুরোপুরি সমবেদনা রয়েছে।
ঠিকই বলেছেন।
কারা আমাদের শোষণ করছে সেটাও আপনি জানেন।
বোধহয় ইম্পেরিয়াল গভর্নমেন্টের কথা বলছেন, কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি ওরা তাদের দায়িত্ব যথার্থই পালন করেছে। বরং আমি শুনেছি যে ডাহুলেরই মধ্যবিত্ত সমাজ এখানে শ্রেণীবৈষম্য তৈরি করে রেখেছে।
ডাভানের ঠোঁটের কোণায় ক্রোধের আভাস। বলল, সত্যি কথা। সত্যি কথা। কিন্তু এম্পায়ারই তাতে ইন্ধন যোগায়। যদি হিটসিঙ্কাররা ধর্মঘট শুরু করে তাহলে ট্রান্টর অকল্পনীয় সমস্যায় পড়বে। তখন ডালেরই অভিজাত শ্রেণী বিলিবটন বা অন্য কোনো স্থান থেকে গুন্ডা ভাড়া করে আনবে হিটসিঙ্কারদের শায়েস্তা করার জন্য। আর নিজেদের স্বার্থে এম্পায়ার তাদের সাহায্য করবে।
ইম্পেরিয়াল গভর্নমেন্ট সব জায়গাতে একই কৌশল অবলম্বন করছে–আগের মতো এখন আর ইচ্ছে হলেই সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারে না। ট্র্যান্টরের সামগ্রিক কাঠামো বর্তমানে এত বেশি জটিল এবং ভঙ্গুর যে ইম্পেরিয়াল ফোর্স পারতপক্ষে কোনো বিষয়েই হস্তক্ষেপ করে না।
এক ধরনের অবক্ষয়, হামিনের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন সেলডন।
কী? ডাভান জিজ্ঞেস করল।
কিছু না, আপনি বলে যান।
ইম্পেরিয়াল ফোর্স যদিও কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না, কিন্তু তারা বুঝতে পেরেছে যে অন্য কৌশলে কাজ হবে বেশি। এম্পায়ার প্রতিটা সেক্টরকেই তার প্রতিবেশীদের সাথে বিবাদ জিইয়ে রাখতে উৎসাহিত করে। সেক্টরগুলোর ভেতরেও অভিজাত এবং দরিদ্র শ্রেণীর মাঝে সবসময়ই অযৌক্তিক লড়াই চলছে। ফলে ট্রান্তরের জনগণকে এক মঞ্চে উঠানো সত্যিই অসম্ভব। তারা নিজেদের ভেতর মারামারি কাটাকাটি করবে কিন্তু আসল স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে একত্র হবে না।
এবং, ডর্স বলল, আপনি কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে চান?
দীর্ঘদিন থেকেই আমি ট্র্যান্টরের জনগণের মাঝে একতা তৈরি করার চেষ্টা করছি।
আমার ধারণা, সেলডন বললেন, কাজটা অসম্ভব কঠিন এবং মানুষ তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ তো দেয়ই না বরং গালি দেয়।
আপনি ঠিকই ধরেছেন, কিন্তু আমাদের দল ক্রমেই বড়ো হচ্ছে। আমাদের অনেকেই এখন বুঝতে পেরেছে যে ছুরি পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করে অন্য কাজে ব্যবহার করলে লাভ বেশি। বিলিবটনে যারা আপনাদের হামলা করেছিল তারা। আমাদের দলে আসেনি এখনো। সাংবাদিক মনে করেছিলেন এজেন্টকে তার হাত থেকে আপনাদের রক্ষা করতে যে মানুষগুলো এগিয়ে এসেছিল তারা আমার দলের। এদের মাঝেই আমি বাস করি। যদিও খুব সুখের জীবন তা বলছি না, কিন্তু নিরাপদে থাকতে পারছি। প্রতিবেশী সেক্টরের অনেকেই আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে এবং প্রতিদিনই আমাদের সমর্থন বাড়ছে।
কিন্তু আমরা কীভাবে সাহায্য করতে পারি? ডর্স জিজ্ঞেস করল।
আপনারা আউটওয়াল্টার এবং স্কলার। দলের নেতৃত্বে এইধরনের মানুষেরই প্রয়োজন। আমাদের মূল শক্তি দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ, কারণ তারাই সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত। কিন্তু তারা তো নেতৃত্ব দিতে পারবে না। আপনাদের দুজনের যেকোনো একজনই তাদের একশ জনের সমান।
শোষিত মানুষকে যে উদ্ধার করতে চায় তার মুখে এই কথা, সত্যি অদ্ভুত।
আমি কার্যকরী নেতৃত্বের কথা বলছি। দলের নেতৃত্বে বুদ্ধিমান শিক্ষিত লোকের প্রয়োজন।
অর্থাৎ আপনার দলের মর্যাদা বাড়ানোর জন্যই আমাদের প্রয়োজন।
মহৎ যেকোনো কিছুই আপনি নাক সিটকে বাতিল করে দিতে পারেন। ডাভান বলল। কিন্তু আপনি, মাস্টার সেলডন, সকলের চেয়ে অনেক বেশি সম্মানী অনেক বেশি শিক্ষিত। ভবিষ্যতের দৃষ্টিপথে পাতলা কুয়াশার যে চাদর আছে সেটা যদি আপনি ভেদ নাও করতে পারেন-।
প্লিজ, ডাভান, সেলডন বললেন, কাব্য করবেন না এবং অসম্ভব কিছু আশাও করবেন না। আমার সাফল্যের পথে পাতলা কুয়াশার চাদর নয় বরং ক্রোম স্টিলের শক্ত দেয়াল বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমাকে শেষ করতে দিন। আপনি যদি–কী যেন বলেন? সাইকোহিস্টোরিক্যালি নির্ভুলভাবে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ নাও করতে পারেন, গবেষণার খাতিরে আপনাকে ইতিহাস স্টাডি করতে হবে। তখন কী হতে পারে তার একটা অনুভূতি বা অন্তর্দৃষ্টি তৈরি হবে আপনার ভেতরে। তাই না?
মাথা নাড়লেন সেলডন। হয়তো গাণিতিক ফলাফল কী হতে পারে আমি সেটা বুঝতে পারব, কিন্তু সেটা কতদূর কার্যকরীভাবে ব্যবহার করতে পারব তা পুরোপুরি অনিশ্চিত। সবচেয়ে বড়ো কথা আমি ইতিহাস পড়িনি। উচিত ছিল, এখন সেটা বুঝতে পারছি।
আমি একজন ইতিহাসবিদ, ডাভান। স্বাভাবিক গলায় বলল ডর্স। যদি শুনতে চান তাহলে দুএকটা কথা বলতে পারি।
বলুন, ডাভান বলল, খানিকটা ভদ্রতা খানিকটা চ্যালেঞ্জের সুরে।
প্রথম কথা গ্যালাকিক ইতিহাসে অনেকবার গণআন্দোলন বা স্বৈর শাসনের। বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে। কখনো নির্দিষ্ট কোনো গ্রহে, কখনো দলবদ্ধ অনেকগুলো গ্রহে। প্রি-ইম্পেরিয়াল যুগে রিজিওনাল গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধেও এইরকম আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এইসব আন্দোলন বা বিদ্রোহের ফলাফল ছিল একটাই। পুরনো স্বৈরশাসককে সরিয়ে নতুন স্বৈরশাসকের ক্ষমতা দখল। অন্য কথায় বলা যায় যে, একটা শাসক গোষ্ঠীকে হটিয়ে আরেকটা শাসক গোষ্ঠী তার স্থান দখল করত যারা বেশিরভাগ সময়ই হতো আরো বেশি কৌশলী এবং নিজেদেরকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে পারত। ফলে দরিদ্র হতো আরো দরিদ্র, শোষিত হতো আরো বেশি শোষণের স্বীকার।
মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ডাভান, বলল, আমি জানি এগুলো। আমরা সবাই জানি। হয়তো ইতিহাস থেকেই আমরা শিক্ষা নিতে পারব। বড়ো কথা হচ্ছে এই মুহূর্তে যে স্বৈরশাসক ক্ষমতায় বসে আছে সে কোনো কল্পনা নয় বাস্তব সত্য। ভবিষ্যতে যে স্বৈরশাসক আসবে সেটা শুধুই কল্পনা। পরিবর্তন সবসময়ই খারাপ ফলাফল বয়ে আনবে এটা ভেবে পিছিয়ে গেলে কখনো অন্যায় অবিচার থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।
আরেকটা বিষয় আপনাকে মনে রাখতে হবে, ডর্স বলল, হয়তো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু কতটুকু। যেহেতু আপনি সমর্থন দিয়েছেন, বা সাহায্য করেছেন তাই নতুন স্বৈরশাসক নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তার সমর্থক এবং পছন্দের লোকদেরই যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দেবে। সাধারণ মানুষের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। আপনার লোকেরা শুধু ছুরি হাতে একটা সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীর কাইনেটিক, কেমিক্যাল এবং নিউরোলজিক্যাল অস্ত্রের বিরুদ্ধে কী করতে পারবে? সাধারণ মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীদের আপনি কখনোই পাশে পাবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না সিকিউরিটি ফোর্স এবং ইম্পেরিয়াল আর্মিকে পরাজিত করতে পারছেন বা অন্তত বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর উপর থেকে তাদের আনুগত্য কিছুটা হলেও কমাতে পারছেন।
ট্র্যান্টরে অনেকগুলো প্রদেশ। প্রতিটি সেক্টরের আবার নিজস্ব সরকার ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের অনেকেই এ্যান্টি-ইম্পেরিয়াল। তেমন শক্তিশালী কোনো সেক্টর যদি আমাদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে, তাই না?
সেইরকম কোনো সেক্টর কি আপনাকে সমর্থন দিয়েছে নাকি আশা করছেন যে পাবেন।
জবাব দিল না ডাভান।
আপনি বোধহয় ওয়ি প্রদেশের মেয়রের কথা বলছন। ডর্স বলল। কিন্তু আপনি কী ভেবে দেখেছেন ওয়ির মেয়র কেন সাহায্য করবে। শুধু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য? আপনার সাথে মিলে সে যদি সম্রাটকে সিংহাসনচ্যুত করতে পারে তাহলে সে নিজে সিংহাসনে বসতে চাইবে না? অন্য আর কীসের বিনিময়ে সে তার বর্তমান নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি নষ্ট করার ঝুঁকি নেবে।
আপনি বলতে চাইছেন যেসব নেতা এখন আমাদের সাহায্য করবে তারাই পরবর্তীকালে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।
গ্যালাক্টিক ইতিহাসে এইধরনের ঘটনাই সবচেয়ে স্বাভাবিক।
যদি আগেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখি, তাহলে তো আমরাই তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি?
অর্থাৎ কাজ উদ্ধার হয়ে গেলেই তাকে মেরে ফেলবেন?
সেইরকম কিছু নয়, কিন্তু তার হাত থেকে ছাড়া পাবার নিশ্চয় কোনো পথ বের করা যাবে।
অর্থাৎ এখানে আমরা এমন একটা রিভোলিউশনারি মুভমেন্ট-এর আলোচনা করছি যার কেন্দ্রীয় নেতারা শুরু থেকেই একে অপরের পিঠে ছুরি চালানোর জন্য তৈরি হয়ে আছে।
তাহলে আমাদেরকে সাহায্য করছেন না? ডাভান বলল।
সেলডন এতক্ষণ ডর্স এবং ডাভানের বাকবিতণ্ডা শুনছিলেন। এবার জবাব দিলেন, আসলে বিষয়টা এত সহজ সরল না। আমরা আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আমরা আপনার পক্ষে। আমার মতে সুস্থ কোনো মানুষই চায় না যে কেউ তাদের ভিতর স্বজাতির প্রতি ঘৃণা এবং বিদ্বেষের বীজ বপন করুক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে: আমরা কীভাবে সাহায্য করতে পারি? যদি আমার কাছে সাইকোহিস্টোরি থাকত, যদি আমি বলতে পারতাম আসলে কী ঘটবে, অথবা যদি অন্তত বলতে পারতাম যে অনেকগুলো বিকল্প থেকে কোনটা বেছে নিলে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে তাহলে আমি আমার যাবতীয় ক্ষমতা নিয়ে আপনার পাশে দাঁড়াতাম। কিন্তু আমার কাছে কিছুই নেই। শুধু সাইকোহিস্টোরি ডেভেলপ করার চেষ্টা ছাড়া আমি আপনাকে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারছি না।
এবং সেটা ডেভেলপ করতে আপনার কতদিন লাগবে?
কাঁধ নাড়লেন সেলডন, বলতে পারি না।
আপনি আমাদের অনন্তকাল অপেক্ষা করতে বলছেন?
আর কী করতে পারি, যেহেতু আমি আপনার কোনো কাজেই আসছি না। তবে একটা কথা জেনে রাখুন : মাত্র কিছুদিন আগেও আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে সাইকোহিস্টোরি ডেভেলপমেন্ট পুরোপুরি অসম্ভব। কিন্তু এখন আর ততটা অনিশ্চিত নই।
অর্থাৎ আপনি একটা সমাধান পেয়েছেন।
না, সমাধান হতে পারে, শুধু এইরকম একটা অনুভূতি। এই অনুভূতির উৎস কী বুঝিয়ে বলতে পারব না। তবে চেষ্টা করছি। আমাকে চেষ্টা করতে দিন।
অথবা, ডাভান বলল, যেখানে থাকছেন সেখানে গিয়ে হয়তো ইম্পেরিয়াল এর ফাঁদে পড়বেন। হয়তো ভাবছেন যে সাইকোহিস্টোরি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এম্পায়ার আপনাকে কিছুই করবে না। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে সম্রাট এবং তার খাস চামচা ডেমারজেল আমার মতো অপেক্ষা করবে না মোটেই।
আমাকে বন্দী করে ওদের কোনো লাভ হবে না, শান্ত সুরে বললেন সেলডন। যেহেতু আমি আপনার বা সম্রাটের কোনো কাজেই আসব না। এসো, ডর্স।
ডাভানকে তার ধূলিধূসর নিষ্প্রাণ কামরায় একা রেখে বেরিয়ে এলেন দুইজন। রাইখ বাইরে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
.
৭৬.
খাওয়া শেষ করে আঙ্গুল চাটছে রাইখ। যে প্যাকেটে খাবার ছিল সেটাতে লেগে থাকা কণাগুলো পর্যন্ত বের করে খাচ্ছে। পেয়াজের ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে।
গন্ধে কিছুটা পিছিয়ে গেল ডর্স, জিজ্ঞেস করল, খাবারগুলো কোথায় পেয়েছ, রাইখ?
ডাভানের লোকেরা দিছে। ডাভানরে কেমন লাগল?
তাহলে আমাদের আর খাবার কিনে দিতে হবে না তোমাকে, তাই না? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন, ক্ষিধেয় নিজের পেটও চোঁ চোঁ করছে।
আমি আপনের কাছে একটা কিছু তো পাওনা। ডর্সের দিকে লোভীর মতো তাকিয়ে কথাগুলো বলল রাইখ। ওনার একটা ছুরি দিয়া দিলেই তো অয়।
ছুরি পাবে না, ডর্স বলল। আমাদেরকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঁচ ক্রেডিট পাবে।
পাঁচ ক্রেডিট দিয়া ছুরি কিনন যায় না। গজগজ করে বলল রাইখ।
এছাড়া তুমি আর কিছুই পাচ্ছ না।
আপনি একটা বেয়াড়া মানুষ।
আমি আসলেই বেয়াড়া আর খুব দ্রুত ছুরি চালাতে পারি, রাইখ, কাজেই পা চালাও।
অইছে, অইছে। চ্যাত দেখানো লাগব না। হাত নাড়ল রাইখ। এই পথে আসেন।
আবার সেই শূন্য করিডর ধরে ফিরে চলা, কিন্তু এবার কিছুদূর এগিয়েই দুপাশে তাকিয়ে থেমে দাঁড়াল ডর্স। দাঁড়াও, রাইখ। আমাদের অনুসরণ করা হচ্ছে।
বিরক্ত হলো রাইখ, আপনের তো বুজনের কথা না।
মাথা একপাশে হেলিয়ে সেলডন বললেন, আমি কিছু শুনিনি।
আমি শুনেছি, ডর্স বলল, ঠিক আছে, রাইখ, আমি কোনো ঝামেলা চাই না। আসলে কী হচ্ছে ঠিক ঠিক করে বলো, নইলে এমন মার দেব যে এক সপ্তাহ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
আত্মরক্ষার জন্য হাত তুলে এক পা পিছিয়ে গেল রাইখ। খালি চেষ্টা কইরা দেহেন, বেয়ারা মাইয়া মানুষ, চেষ্টা কইরা দেহেন খালি।–হেরা ডাভানের লোক। আমাগর যাতে কোনো বিপদ না অয়, হের লাইগা পাহারা দিয়া নিয়া যাইতাছে।
ডাভানের লোক?
হ। সার্ভিস করিডর দিয়া হাঁটতাছে।
বিদ্যুৎ বেগে ডানহাত বাড়িয়ে রাইখের কলার ধরে তাকে শূন্যে উঠালো ডর্স। পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে চিৎকার করল রাইখ, অই, ছাইড়া দ্যান কইলাম, ছাইড়া দ্যান।
ডর্স, ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করো না, সেলডন বললেন।
আরো খারাপ ব্যবহার করব যদি মনে হয় যে ও মিথ্যে কথা বলছে।
আমি সত্যি কইতাছি, রাইখ বলল। মুক্তি পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে।
আমার কোনো সন্দেহ নেই, বললেন সেলডন।
বেশ, দেখা যাক। রাইখ ওদেরকে বলো এমন জায়গায় এসে দাঁড়াতে যেন আমরা দেখতে পারি। মাটিতে নামিয়ে ধুলোবালি পরিস্কার করার ভঙ্গিতে হাত নাড়ল ডর্স।
আপনে আসলেই কড়া মাইয়ামানুষ, ক্ষুব্ধ সুরে বলল রাইখ। তারপর গলা চড়ালো, অই, ডাভান। বাইরে আহেন। দুই একজন আইলেই চলব।
পেরিয়ে গেল কয়েকটা মিনিট, তারপর করিডরের একটা অনালোকিত প্রবেশ মুখে কালো গোঁফওয়ালা দুইজন লোক এসে দাঁড়ালো। একজনের চিবুকে লম্বা ক্ষতচিহ্ন। দুজনের হাতেই উন্মুক্ত ছুরি।
তোমরা কতজন এসেছ? কর্কশ সুরে জিজ্ঞেস করল ডর্স।
অল্প কয়েকজন, একজন জবাব দিল। আদেশ। আমরা আপনাদের পাহারা দিচ্ছি। ডাভান চায় যেন আপনাদের কোনো বিপদ না হয়।
ধন্যবাদ। চেষ্টা করো যেন শব্দ আরো কম হয়। রাইখ, পথ দেখাও।
সত্যি কথা বলনের পরেও আপনি আমারে এইভাবে ব্যথা দিলেন, মুখ ভার করে বলল রাইখ।
আমি দুঃখিত।
ভাইবা দেখমু মাফ করন যায় কী না, বুক চিতিয়ে দাঁড়ালো রাইখ। কিন্তু এই একবারই। তারপর চলা শুরু করল।
ওরা যখন ফুটপাথে পৌঁছল ডাভানের লোকগুলো চলে গেল। অন্তত ডর্সের তীক্ষ্ণ কানে তাদের পদশব্দ আর আসছে না। এখন তারা এই সেক্টরের মোটামুটি ভদ্র এলাকায় চলে এসেছে।
তোমার গায়ে লাগবে এমন কোনো পোশাক বোধহয় আমাদের কাছে নেই, চিন্তিত সুরে বলল ডর্স।
আমার কাপড় নিয়া আপনের মাথাব্যথা ক্যান, মিসাস, জবাব দিল রাইখ (বোধহয় করিডর থেকে বেরিয়ে এসে তার ভদ্রতাবোধ জেগে উঠছে)। আমার কাপড় আছে।
ভাবছিলাম আমাদের ঘরে এসে তুমি গোসল করতে চাইবে।
ক্যান? দুই তিনদিন পরে একবার গোসল করি। আরেকটা শার্ট আছে হেইডা পরি। সরু চোখে ডর্সের দিকে তাকালো সে। আসলে আমার লগে যে ব্যবহার করছেন হের লাইগা খারাপ লাগতাছে। এহন বুঝ দেওনের চেষ্টা করতাছেন, ঠিক না?
হেসে ফেলল ডর্স। হ্যাঁ, তা খানিকটা।
দরাজ ভঙ্গিতে হাত নাড়ল রাইখ। বাদ দ্যান। ব্যথা পাই নাই। হুনেন, আপনে মাইয়া মানুষ অইলেও গায়ে জোর অনেক বেশি। এমনভাবে আমারে তুললেন য্যান আমি কিছুই না।
আসলে ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। মাস্টার সেলডনকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার।
আপনে আসলে বডিগার্ড? প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে সেলডনের দিকে তাকালো রাইখ। মাইয়ামানুষরে নিজের বডিগার্ড বানাইছেন?
উপায় নেই, বললেন সেলডন, মুখে ক্লান্ত হাসি। ওর হাত থেকে ছাড়া পাওয়া খুব মুশকিল। তবে নিজের কাজ সে ভালোই বোঝে।
চিন্তা করে দেখো রাইখ, ডর্স বলল। তুমি কী আসলেই গোসল করতে চাও না? হালকা গরম পানি দিয়ে চমৎকার একটা গোসল?
কুনু উপায় নাই। মনে অয়না ওই বেডি আবার আমারে হের বাড়িতে ঢুকবার দিব।
সামনে তাকিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে ঢুকবার দরজায় মিস্ট্রেস টিসালভারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ডর্স। মহিলা প্রথমে তাকালো আউটওয়ার্ল্ডারদের দিকে তারপর রাস্তার অর্বাচীন বালকটার দিকে। কাকে দেখে সে সবচেয়ে বেশি রেগে উঠল বোঝা গেল না।
ঠিক আছে, আমি গেলাম গিয়া, মিস্টার আর মিসাস। জানি না ওনি আপনাগরেও বাড়িতে ঢুকবার দিব কিনা। তারপর দুপকেটে দুহাত পুরে মহাজগৎ সম্পর্কে উদাসীন অথচ বেপরোয়া এক সুখী বালকের মতো শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেল রাইখ।
শুভ সন্ধ্যা, মিস্ট্রেস টিসালভার। একটু দেরী হয়ে গেল, তাই না? বললেন সেলডন।
একটু না, বেশ দেরী করেছেন, মহিলা জবাব দিল। আপনাদের কারণে এই কমপ্লেক্সের বাইরে আজকে দাঙ্গা বাধার উপক্রম হয়েছিল।
আমরা কিছু করিনি, ডর্স বলল।
আমি ওখানে ছিলাম, সব দেখেছি। উদ্দেশ্যপূর্ণ গলায় জবাব দিল মিস্ট্রেস টিসালভার, তারপর ওদেরকে ঢুকতে দেবার জন্য দরজা ছেড়ে একপাশে সরে দাঁড়ালো।
মহিলার আচরণে মনে হচ্ছে বোধহয় কোনো ফন্দি করেছে, নিজেদের কামরায় যাবার পথে সেলডনকে বলল ডর্স।
তো? কী করবে সে? সেলডন জিজ্ঞেস করলেন।
ভাবছি, জবাব দিল ডর্স।