৬. বাস্তবের মুখোমুখি

৬. বাস্তবের মুখোমুখি

“১৯৫০ সালে তখন খুব ধরপাকড় চলছে”–বললেন বসু, “জেলখানা তখন প্রায় ঘরবাড়ি, তখন কোথায় কিভাবে থাকি, আর কিভাবে ধরা পড়ে যাই কোনও ঠিক নেই—সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি।” বাড়িতে তখন নবপরিণীতা স্ত্রী প্রায়ই একা থাকতে বাধ্য হন। আত্মগোপন অবস্থায় থাকার সময় ছদ্মবেশে কখনও সখনও বসু দেখা করতেন তাঁর সঙ্গে, চারিদিকে পুলিসের সতর্ক চোখ এড়িয়ে খুব সাবধানে সেই ঝাঁকি সাক্ষাতের কথা এখনও তাঁর মনে আছে। কোথা থেকে উড়ে যেত সেই মুহূর্তগুলো। বসন্তের উতল হাওয়ায় পাখির হালকা পালকের মত।

“তখন চারিদিকে প্লেন ড্রেসে পুলিস ঘুরত, আমার উপর কড়া নজর ছিল, কখনও দেখতাম মোড়ের মাথায় একটা পাজামা পরা লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে, কখনও দেখতাম একটা গাড়ি প্রায়ই আমি যেখানে যাই সেখানেই পেছন পেছন যায়। একবার একটা ফলঅলা বেশ কয়েকদিন ধরে আমার হিন্দুস্তান পার্কের বাড়ির সামনের ফুটপাথে বসে থাকত—মনে হত সে যেন ফল বেচতেই এসেছে, লক্ষ করলাম কয়েকদিন বাদেই চলে গেল, বুঝলাম সে ছিল পুলিসের লোক”–বসু বললেন। বসুর তখন পরনে প্যান্ট সার্ট, সরু গোঁফ আর চোখে চশমা, চেনে কার সাধ্য। তবুও পুলিস ‘জ্যোতিবাবুকে’ চিনে ফেলত, ধরাও পড়ে যেতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। ধরা পড়ার আশঙ্কা নিয়ে ঘোরাফেরা করার ফলে বসুর সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন দিনে দিনে যেন আরও বেশি সজাগ, আরও বেশি সতর্ক হয়ে উঠছে। তড়িৎগতিতে কাজ করত তাঁর রিফ্লেক্স। আর প্রতিবারই ধরা পড়ার পর, কেন এমনটা হল একটা ভেবে নিয়ে, মনে মনে কারণটা শুধরে নেওয়ার কথা ভাবতেন। ফলে উপস্থিতবুদ্ধি হয়ে উঠেছিল আরও তীক্ষ্ণ, সঠিক জবাব দিতেও তাঁর এক মুহূর্ত দেরি হত না। আগেই ভেবে রাখতেন, পরে কি করতে হবে।

১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসটা ছিল বেশ ঘটনাবহুল। এই মাসে ‘কমিনফর্মে’র (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমিউনিস্ট ও শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে চিন্তার আদান প্রদানের জন্য একটি সংগঠন) মুখপত্রে দেশে দেশে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম বিষয়ক এক সম্পাকীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ভারতে কমিউনিস্টরা যে সংকীর্ণতাবাদী পথ নিয়েছেন এই প্রবন্ধে সেটা খুব পরিষ্কার হয়ে যায়। সেই সময়কার পার্টির পলিটব্যুরো এক সার্কুলার প্রকাশ করে জানিয়ে দেন যে ঐ সম্পাদকীয় মন্তব্যের ভিত্তিতে পার্টির নীতির মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করা হবে। বসুর আগেকার সংশয় অনেকটাই দূর হয়ে যায়। ভুলত্রুটির সংশোধনের জন্য শুরু হয় আন্তঃপার্টি সংগ্রাম। পার্টির পলিটব্যুরোয় রদবদল হয়, অন্তবর্তী ব্যবস্থা হিসাবে রাজেশ্বর রাও সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। পশ্চিমবঙ্গেও একটি পি. ও. সি. (প্রভিন্সিয়াল অরগানাইজেশন কমিটি) – প্রাদেশিক সংগঠন কমিটি গঠন করা হয়। সম্পাদক করা হয় রণেন সেনকে। এর ফলে যে নানারকম মতপার্থক্য দেখা দিত না তা নয়, বসুদের মত ছিল রাজনৈতিক থিসিসের ওপর গুরুত্ব নয়, গুরুত্ব দিতে হবে নেতৃত্বের পুনর্গঠনের ওপর। এ সময় বসু ছাড়াও আন্তঃপার্টি সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত, ভূপেশ গুপ্ত, আবদুল্লাহ রসুল, সরোজ মুখার্জি, নিরঞ্জন সেনগুপ্ত, আবদুল হালিম, বঙ্কিম মুখার্জি ও আরও অনেকে। এঁরা ধরাও পড়েছিলেন অনেকবার। একদিন বসু নিরঞ্জন সেনগুপ্তর সঙ্গে এক গোপন বৈঠক সেরে ফেরার সময় পুলিসের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসারদের হাতে গ্রেপ্তার হলেন। ডাঃ নিশিকান্ত বসুর ডায়রি থেকে জানা যায় বসু গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ১লা সেপ্টেম্বর হ্যারিসন রোড থেকে। তার আগের দিন ৩১শে আগষ্ট শিশুমঙ্গলে তাঁর স্ত্রী এক শিশুকন্যার জন্ম দেন। বসুর ছোট শ্যালক মুকুল সন্দেশ নিয়ে তাঁকে খবরটা জানায়। প্রথমে বসুকে নিয়ে যাওয়া হল লর্ড সিন্হা রোডের এস বি অফিসে। “কয়েকজন পুলিস অফিসার ছিলেন ভদ্র, কিন্তু কয়েকজন ছিলেন রীতিমত অভদ্র আর উদ্ধত”–বসু বললেন, “প্রথমে আমাদের নিয়ে গেল প্রেসিডেন্সি জেলে, তারপর আবার সেখান থেকে দমদম জেলে। সে সময় আমাদের আরও কমরেডরা ধরা পড়েন—প্রমোদবাবু, আবদুল হালিম, ভূপেশ, সরোজবাবু আরও অনেকে। আমরা তখন সবাই দমদম জেলে। আমরা ছিলাম রাজনৈতিক বন্দী, একটু আলাদা এই আর কি!”—বললেন বসু, “সকালের খাওয়াটা অবশ্য আর পাঁচজন বন্দীর মত একই ছিল—লসি ছিল আমাদের ব্রেকফাস্ট। তবে রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য আলাদা কিচেন ছিল”, জানালেন বসু “সেখানে দিনের আর রাতের খাবার রান্না করা হত।” আমার সব রকম খাবার খাওয়াই অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল, যদিও এক এক সময় এক একটা খাবারের স্বাদ অত্যন্ত বিস্বাদ লাগত—ডাল, চচ্চড়ি যা পেতাম, তাই খেতাম—মানিয়ে নেওয়া এই আর কি।”—বসু মন্তব্য করেন।

১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি সংবিধান চালু হল। ২৭শে ফেব্রুয়ারী হাইকোর্টের রায়ে বলা হল— ব্রিটিশ শাসকরা যেভাবে পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিকে বে- আইনি ঘোষণা করেছিল, তা সংবিধান বিরোধী। “তবে আমাদের কিন্তু তখনই দিন বদলালো না”–বসু বলেন, “আমি জেলে রইলাম পুরো এক বছর, তাছাড়া কমরেডদেরও গ্রেপ্তার আটক করা বন্ধ হল না। সামান্য কয়েকজন ছাড়া পেয়েছিলেন”–বসু জানালেন।

বসু মুক্তির জন্য হেবিয়াস কর্পাসের আবেদন করলেন। স্ত্রী কমল বসু বললেন, ‘হেবিয়াস কর্পাসের জন্যে আমি অনেক ঘোরাঘুরি করেছিলাম’। ১৯৫১তে হাইকোর্টের আদেশে তিনি ছাড়া পেলেন। ‘কাকাবাবু’ ছাড়া পেলেন এপ্রিল মাসে। জেল থেকে বেরোনোর পর বসু দেখলেন পার্টির অবস্থা রীতিমত অসংগঠিত। অধিকাংশ নেতা জেলে বা আটক থাকার ফলে পার্টির সংগঠন বেশ শিথিল হয়ে গেছে। নতুন উৎসাহে বসু আবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ৫ই জানুয়ারি (১৯৫১ সাল) কমিউনিস্ট পার্টির বে-আইনি যুগের অবসান হল। কলকাতা ময়দানে পার্টির ডাকে এক বিশাল জন সমাবেশ হল। এই ‘ঐতিহাসিক’ জনসমাবেশে বসু সভাপতিত্ব করেছিলেন। পার্টির অতীত ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্য আহ্বানও জানিয়েছিলেন। ঐ জনসভায় দৈনিক ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকা আবার প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। মে মাসে কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল গোপনে। বসু এই সম্মেলনে প্রতিনিধি হিসাবে যোগ দেন। এই সম্মেলনেও নেতৃত্ব এবং নীতিতে কিছু রদবদল হয়। অজয় ঘোষ নির্বাচিত হন সাধারণ সম্পাদক, গঠিত হয় নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি। এই সম্মেলনের আগে কলকাতায় মুসলিম ইনস্টিটিউটে পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার বৈধ সম্মেলনে কাকাবাবু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। জ্যোতি বসু নির্বাচিত হলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির অন্যতম সদস্য। এইভাবেই বসু রাজ্য নেতৃত্বে এলেন।

বসু জেল থেকে বাড়িতে ফিরলেন ১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে। তবুও যেন পুলিসের শ্যেনদৃষ্টি থেকে রেহাই নেই। রোজই লক্ষ করেন বাড়ির সামনে একটা প্রাইভেট গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে, আর বসু কোথাও বেরোলেই তাঁকে অনুসরণ করে। বুঝলেন পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগ তাঁর গতিবিধির ওপর অযথা নজর রাখছে। একদিন বসু বাড়ি থেকে বেরোলেন, দু’বার ট্যাকসি পাল্টালেন, পুলিসের চোখে দিব্যি ধুলো দিয়ে সোজা চলে গেলেন রাইটার্স বিল্ডিংস্-এ ডাঃ বিধান রায়ের ঘরে। বসু ডাঃ রায়কে বললেন “আপনারা তো আমাকে জেল থেকে রেহাই দেননি, আমাকে হাইকোর্ট মুক্তি দিয়েছে, আমাকে এখনও আই. বি-র গাড়ি অনুসরণ করছে কেন?” ডাঃ রায় তক্ষুনি পুলিসের আই. জি. হীরেন সরকারকে ডেকে পাঠিয়ে জবাবদিহি চাইলেন ‘জ্যোতিকে পুলিসের গাড়ি অনুসরণ করছে কেন?’ হীরেন সরকার জবাব দিলেন, ‘স্যর, ওঁরা হিংসাত্মক কাজকর্ম করেন।’ বসু এই অপবাদ সহ্য করতে পারলেন না। উত্তপ্ত বাদানুবাদ শুরু হল। ডাঃ রায় হীরেন সরকারকে বললেন, ‘তুমি এখন যেতে পার।’ এরপর থেকে বাড়ির সামনে পুলিসের গাড়ির পাহারাদারি বন্ধ হল। বসু আইনসভার বাইরে ছিলেন দু’বছর। বেতন, ভাতা মিলিয়ে কিছু টাকা পেলেন। খানিকটা পার্টিকে দিলেন, খানিকটা রাখলেন নিজের খরচের জন্য।

কয়েকদিনের মধ্যে বসুকে আর কাকাবাবুকে পার্টি পাঠাল তেলেঙ্গানায়। তখন তেলেঙ্গানা আন্দোলনের অবসান ঘটেছে কিন্তু বন্দীরা মুক্তি পায়নি। বসু তেলেঙ্গানার জেলখানায় আটক বন্দীদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বন্দীমুক্তির ব্যাপারে তাঁকে আরও দায়িত্ব দেওয়া হল, দিল্লীতে গিয়ে তাঁকে পণ্ডিত নেহরুর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে বলা হল। শ্রীমতী মৃদুলা সারাভাই নেহরুর সঙ্গে বসুর সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিলেন। বসু নেহরুকে বন্দীমুক্তির ব্যাপারে অনুরোধ করলেন, নেহরু বেশ ধৈর্যভরেই সব কথা শুনে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলে তাঁকে আশ্বাস দিলেন। হঠাৎ নেহরু আলোচনা প্রসঙ্গ পাল্টালেন। বসুকে জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর পার্টির পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে কি অভিমত? বসু বললেন—”মোটামুটি ঠিকই আছে। তবে কাশ্মীর সমস্যা ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, এখানে একজন বিদেশী নাগরিক পর্যবেক্ষক হিসাবে কেন আছেন, এটাই প্রশ্ন।” এই উত্তর শুনে নেহরু চটে উঠলেন, “আমি তো কমিউনিস্ট নই, আমাকে সকলের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে হয়।” বসু সচেতনভাবে বিতর্ক এড়িয়ে গেলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক নেহরুর সঙ্গে কথা বলে যখন তিনি বেরিয়ে আসছেন তখন মৃদুলা সারাভাই বসুকে বললেন, “নেহরুর সঙ্গে আপনার সঠিক আচরণের তারিফ করতে হয়।” কথাটা শুনে বসু মৃদু হাসলেন। তিনি বুঝেছিলেন নেহরু তেলেঙ্গানার বন্দীদের মুক্তি অবশ্যই দেবেন।

দীর্ঘদিন পর আইনসভায় ফিরে বসু দেখলেন সভার চেহারা পাল্টে গেছে। কংগ্রেস দল ভাঙতে শুরু করেছে। ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, ডঃ সুরেশ ব্যানার্জি, দেবেন সেন, চারুচন্দ্র ভাণ্ডারী প্রমুখ নেতারা কংগ্রেস দল ছেড়ে গঠন করেছেন প্রজা সোস্যালিস্ট দল। তাঁরা বসছেন বিরোধীপক্ষের আসনে। বিরোধীপক্ষ বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কংগ্রেসকে আক্রমণের একটি সুযোগও বসু তখন ছাড়েন নি। একদিকে সভায় বিরোধীপক্ষের তরফে সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি পর্যালোচনা, আর একদিকে গণআন্দোলেনের জোয়ার—”কোথা দিয়ে যে দিন কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না।”—বসু বললেন, “আমি সেই সময় ট্রেড ইউনিয়নের কাজ, রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের কাজকর্মও দেখাশোনা করতাম। তাছাড়া আমি ছিলাম ই. আই. রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি, তাই প্রায়ই শহরের বাইরে আমাকে যেতে হত, কখনও শিলিগুড়ি, কখনও কুচবিহার, কখনও আসানসোল।”

যাতায়াত করতেন কয়লার ইঞ্জিনের ট্রেনে। ফেরার সময় ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবী কালো কয়লার কুচি পড়ে আর সাদা থাকত না। “ট্রেনে যেতে বেশ ভালই লাগত, অনেক রকম লোক খুব কাছ থেকে দেখতে পেতাম, বুঝতে পারতাম সাধারণ মানুষের সমস্যার কথা। এই মফস্বল শহরে যাতায়াত আর সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশাও আমার বেশ লাগত”—বললেন বসু।

১৯৫১ সালের এপ্রিল মাসে বসু গিয়েছিলেন কুচবিহার শহরে। তখন রাজ্যে খাদ্য সমস্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কুচবিহারে বিরাট ভুখ-মিছিল বেরোয়, নির্দয় পুলিস ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। বহু নিরপরাধ মানুষ গুরুতর আহত ও নিহত হন। বসু কুচবিহারে পার্টি কর্মীদের সঙ্গে দেখা করে সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করেন। শহরের বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে দেখা করেন, নিহতদের বাড়ি গিয়ে সমবেদনা জানান। ২৯শে এপ্রিল এক বিরাট সমাবেশে বসু বক্তৃতা দেন। আবার মে মাসে কুচবিহারে দিনহাটায় বসু এক জনসমাবেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। বসু বলেন এইসব মানুষের সমাবেশ থেকে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন। “আমার কাছে অনেক মানুষের ভিড় কোনওদিনই নামহীন, বৈশিষ্ট্যহীন বলে মনে হয়নি”, বসু জানালেন, “আমি প্রত্যেকের সমস্যার সঙ্গেই যেন একাত্ম বোধ করতাম। আমি মনে করি প্রতিটি জনসমাবেশের একটা নিজস্ব চরিত্র থাকে, এক জনতা আর একটি জনতার থেকে অবশ্যই আলাদা আর আমি সব সময় সেই নিজস্বতাটুকু খুঁজতে চেষ্টা করি।”

খাদ্য সমস্যার জেহাদ, বন্দীমুক্তি আন্দোলনের তোড়জোড় করতে করতেই এসে গেল ১৯৫২ সালের লোকসভা ও বিধানসভার সাধারণ নির্বাচন। জ্যোতি বসু এবং কমিউনিস্ট পার্টির কাছে এই নির্বাচন ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। “আসলে তখন আমরা ক্ষমতায় আসব, বিকল্প সরকার গঠন করব এটা ঠিক ভাবিনি, যদিও আমরা কংগ্রেসকে হারিয়ে কংগ্রেসবিরোধী সরকার গঠনের স্লোগান দিয়েছিলাম”— আজ চার দশক পর বসু বললেন, “আমরা চেয়েছিলাম কংগ্রেসকে হারিয়ে যত বেশি আসন জয় করা যায়। আমরা এই নির্বাচনকে আমাদের সংগ্রামেরই এক অঙ্গ হিসাবে দেখেছিলাম। আমাদের সংগ্রাম ছিল রাজনৈতিক সংগ্রাম, মেহনতী মানুষের স্বার্থরক্ষার ন্যায়রক্ষার সংগ্রাম—তার মধ্যে খাদ্য সমস্যা, মূল্যবৃদ্ধি, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সমস্যা সবই ছিল।”

সরকার গড়ার স্বপ্ন নয়, কংগ্রেসের থেকে অনেক বেশি আসন দখল করার আশা নিয়ে বসু নির্বাচন লড়েছিলেন। সে সময় পার্টির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। তাছাড়া অনেক কমরেডই তখন জেলে। পার্টির কমরেডদের উৎসাহ উদ্দীপনাই তখন পাথেয়। “আমাদের উদ্দেশ্য ছিল অ-সাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল এবং অ-কংগ্রেসি সরকার গঠন করা”—বসু বললেন। নির্বাচনী জোট নিয়ে আলাপ আলোচনা চলে। কমিউনিস্ট পার্টি ফরওয়ার্ড ব্লক, শরৎচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টি, বলশেভিক পার্টি অফ্ ইণ্ডিয়া, পিপলস্ মুভমেন্ট এবং অন্যান্য গ্রুপ ও ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত সংযুক্ত সমাজবাদী সংস্থা বা ইউ. এস. ও. (ইউনাইটেড সোস্যালিস্ট অরগানইজেশন) চুক্তি করে নির্বাচনে লড়েছিল। বিধানসভায় কমিউনিস্ট পার্টি পেয়েছিল ২৮টি আসন এবং লোকসভায় ৫টি আসন।

বসু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন বরানগর কেন্দ্র থেকে। বরানগর জায়গাটা বসুর কাছে একেবারে নতুন। “কাকাবাবু আমার সম্বন্ধে একটা পরিচয় পত্র লিখে আমায় পাঠিয়েছিলেন—বিলেতফেরত ব্যারিস্টার, নানা গুণ আছে ইত্যাদি সব লিখেছিলেন— উনি খুব মেথডিক্যাল আর বুদ্ধিমান ছিলেন”,—বসু বললেন। বরানগর পার্টি সংগঠন তখন তেমন শক্তিশালী ছিল না, সেখানকার মানুষজনও ছিলেন রক্ষণশীল প্রকৃতির। “তার ওপর আবার আমার বিরুদ্ধে অদ্ভুত মজার সব অপপ্রচার চালানো হল”, বসু মৃদু হেসে বললেন, “আমি নাকি বাঙাল, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রতি আমার কোনও দরদ থাকা অসম্ভব, আমার বাড়ি বালিগঞ্জে, সেখানে আবার ঢোকা যায় না, দশটা কুকুর আছে। তাছাড়া আমরা জিতলে লক্ষ্মীপূজো উঠিয়ে দেবো— এইরকম আরও কত কি।” ১৮ই জানুয়ারি ভোট হল। এত সব রটনা সত্ত্বেও বসু জিতলেন। পূর্বতন ডাঃ বিধান রায়ের মন্ত্রীসভার সদস্য রায় হরেন্দ্রনাথ চৌধুরিকে হারিয়ে বসু এলেন বিধানসভায়। বসুর পার্টি পেয়েছিল ২৮টি আসন। বিরোধী শক্তির মধ্যে সর্ববৃহৎ একক শক্তি হওয়ার কারণে কমিউনিস্ট পরিষদীয় দলের নেতা হিসাবে জ্যোতি বসু দাবী জানিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিকে বিরোধী পক্ষ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। স্পীকার এই দাবি মানতে চান নি। পার্টি বিরোধীপক্ষ হিসাবে স্বীকৃত হল না তবে পার্টিকে প্রধান বিরোধী পার্টি এবং কমিউনিস্ট পরিষদীয় দলের নেতা বসুকে প্রধান বিরোধী পার্টির নেতা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়ছিল।

“আমি বিরোধী পক্ষের নেতা হওয়াতে বাবা খুব খুশী হলেন”–বসু বললেন, “তখন বাবা বেশির ভাগ সময় বারদিতেই থাকতেন, মাঝে মাঝে হিন্দুস্তান পার্কের বাড়িতে এসে থাকতেন। বাড়িতে থাকলেও অবশ্য দেখাশোনা কম হত। আমি হয়তো কলকাতার বাইরে, তাছাড়া আমার বাড়ি ফেরার কোনও ঠিক ছিল না। অনেক সময় সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে দেখেছি, বাবার ঘরে ধর্মীয় পাঠ, ভজন গান চলছে, আমি সে ঘরে না ঢুকে আবার কাজে বেরিয়ে গেছি এমনও হয়েছে।” এ প্রসঙ্গে বসুর আর একটা কথা মনে পড়ে যায়। তখন সদ্য বিরোধীপক্ষের নেতা হয়েছেন। “একদিন বাবা বললেন ‘এক মাদ্রাজী জ্যোতিষী বলেছিলেন, তুমি ব্যারিস্টার হবে এবং সব ব্যারিস্টারের শীর্ষস্থানীয় হবে—ইউ উইল লীড দ্য বার”–আমি হেসে বললাম “তোমার জ্যোতিষী তো ঠিকই বলেছিল—শুধু ‘বার’এর জায়গায় ‘অপোজিশন’ হয়েছে”–এই কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে গলে যায় দুজনের মধ্যে জমে থাকা অভিমানের বরফ।

বসুর তখন আটত্রিশ বছর বয়স। দায়িত্বের ব্যাপারে রীতিমত সিরিয়াস, অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারেন, সর্বস্তরে মেলামেশা করতে পারেন, রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে বাস্তববুদ্ধিসম্মত চিন্তাভাবনা করতে পারেন। পারেন রাজনৈতিক হাওয়া অনুধাবন করতে। তখনও স্বপ্ন দেখছেন, আদর্শকে ভেতরে ভেতরে লালন করে চলেছেন, সত্যি সত্যি ভেবে চলেছেন, “ঐ হাইকোর্টটাকে লেনিনগ্রাদের স্মলনি বানাতে হবে”–কিন্তু পা দুটো সর্বদাই থাকে মাটিতে। প্রখর বাস্তববুদ্ধি। ঘটনা কোন্ দিকে মোড় নেবে চট করে ধরে নিতে পারেন। বিধানসভায় তোড়ে বক্তৃতা দেন, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ধারালো বাগযুদ্ধ চালান, গম্ভীর অথচ সূক্ষ্ম রসবোধের অভাব নেই। ভয়ংকর আক্রমণ করতে পারেন অথচ কখনই শোভনতার সীমা ছাড়ান না। ইংরেজিটা আগেই ভাল রপ্ত ছিল। জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে, আর রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পড়ে বাংলাটাও মন্দ মাজাঘষা হয়নি। অলংকার আড়ম্বর তাঁর পছন্দ নয়, ছোট ছোট মেদহীন বাক্যেই সরকারপক্ষের যুক্তি ধরাশায়ী করতেন। সেই সময় বসু ছিলেন বিরোধীপক্ষের নির্ভীক আদর্শবাদী যথার্থ কমিউনিস্ট নেতা

১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর নতুন বিধানসভায় বেশ বড় রকমের রদবদল দেখা যায়। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় মুখ্যমন্ত্রী হলেন। শৈল মুখার্জি এবং আশুতোষ মল্লিক যথাক্রমে হলেন স্পীকার এবং ডেপুটি স্পীকার। কংগ্রেস সদস্যরা বেশিরভাগই ছিল জোতদার ও জমিদার—কিছু রাজা রানীও ছিলেন। এঁদের মধ্যে বসুর দাদা সৌরীন্দ্রকিরণের শাশুড়ি জলপাইগুড়ির রানীও ছিলেন। অপরদিকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা সকলেই ছিলেন গণ-আন্দোলনের নেতা। এঁরা প্রত্যেকেই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। নতুন বিধানসভায় বিরোধীপক্ষের সদস্য সংখ্যাও বেশ বেড়ে গিয়েছিল। আগে বসু আর রতনলাল ব্রাহ্মণ এই দুজনেই বিরোধীপক্ষের প্রতিনিধি ছিলেন। নতুন বিধানসভায় বিরোধী সদস্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৬।

১৯৫২ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর দক্ষিণ কলকাতায় পার্কসার্কাসের কাছে (এখনকার সার্কাস অ্যাভিনিউ) ডাঃ বিবেক সেনগুপ্তর তত্ত্বাবধানে বসুর স্ত্রী কমল বসু এক শিশুপুত্রের জন্ম দেন।…বসু বললেন, “তারিখের কয়েকদিন আগে ছেলের জন্ম হওয়ায় ঐ সময়টায় থাকতে পারিনি। খবর পেয়ে অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেকে দেখতে নার্সিংহোমে চলে গিয়েছিলাম, ডাঃ সেনগুপ্ত বকেও ছিলেন মনে আছে—কি মিঃ বসু, এ সময় স্ত্রীকে ছেড়ে পার্টির কাজে কোথায় গিয়েছিলেন?”– বসু লজ্জিত বোধ করেছিলেন, উত্তর দিতে পারেন নি। তখন ছেলেকে দেখে মন ভরে গেছে। বসুজায়া অবশ্য জোর দিয়ে বার বার আমাকে বলেছেন “উনি সে সময় ছিলেন, একটু দেরি হয়েছিল আসতে। এক কাপ চা রাখা ছিল, চা খেলেন, আমার সঙ্গে কথা বললেন, ছেলের মুখ দেখে খুব খুশী। আর প্রতিদিন আসতেন, যতই কাজ থাক। বাড়ি আসার পর একদিন ছেলের জন্য গ্রাইপ ওয়াটার কিনে এনেছিলেন।”

সন্তানের জন্মের পর কমল বসু চলে গেলেন গড়িয়াহাট রোডে তাঁর বাবামায়ের বাড়িতে। তখন হিন্দুস্তান পার্ক-এর বাড়িতে বয়ঃজ্যেষ্ঠ কেউ ছিলেন না। বসুও সে সময় শ্বশুরবাড়িতেই বেশির ভাগ সময় থাকতেন। তাঁর শ্বশুর বাড়ির পরিবার ছিল অ-রাজনৈতিক। ছেলে মামারবাড়িতেই মানুষ হতে থাকে। বসু নিজের রাজনৈতিক জীবনে আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সকালবেলা সামান্য দুটি ভাত খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন গড়িয়াহাটের মোড়। সেখান থেকে ট্রামে করে পার্টি অফিস, তারপর আরও অন্যান্য জায়গা হয়ে বেশ রাতে বাড়ি ফেরা। ছাতা নেওয়ার অভ্যাস ছিল না, গনগনে রোদে হেঁটে যেতেন। দিনেরবেলা খাওয়ার কোনও ঠিক ছিল না। রাতে ফিরে দেখতেন উৎকণ্ঠায়, দুশ্চিন্তায় নীল হয়ে অপেক্ষা করছেন স্ত্রী। শ্বশুরমশায় অনেক সময় অস্থির হয়ে দালানে পায়চারি করছেন। হাতমুখ ধুয়ে বসু সোজা চলে যেতেন শিশুপুত্র চন্দনের কাছে। সে তখন অকাতরে ঘুমোচ্ছে তারপর রাতের খাওয়াদাওয়া। ঐ অঞ্চলে তিনি বেশ জনপ্রিয়ও ছিলেন। অনেকেই তখন কমিউনিস্টদের পছন্দ করতেন না, কিন্তু বসুকে সবাই রীতিমত শ্রদ্ধা করতেন। নানা সমস্যার ব্যাপারে স্থানীয় লোকজন তাঁর ওপর বেশ নির্ভর করতেন। পাড়ায় চুরি ডাকাতির জন্য প্রতিবেশীরা পালা করে পাহারা দিতেন রাতে। কোনও কিছু বিপত্তি দেখলেই সে গভীর রাতই হোক বা ভোরের আলো ফোটার ঠিক আগেই হোক, প্রথম ডাক পড়ত ‘জ্যোতিবাবুর’। ‘জ্যোতিবাবু, জ্যোতিবাবু—একবার আসবেন?’—সারাদিনের পরিশ্রম ক্লান্ত জ্যোতিবাবু ঘুম ঘুম চোখে উঠে আসতেন কি হয়েছে দেখবার জন্য। দারোয়ানও প্রায়ই ডাকত ‘সাব, সাব চোর আয়া’। “একদিন জামাইবাবু বললেন, ‘আচ্ছা খুকু, আমাকেই কেন ডাকে বলতো?’—বললেন মঞ্জুলা রায়, জ্যোতিবাবুর শ্যালিকা। এর উত্তরটাও তিনিই দিলেন, “আসলে জামাইবাবুর ওপর সব লোকই ভরসা করতো, তাই যখন তখন ডাকও পড়তো।” বোঝা গেল রাজনৈতিক নেতা হিসাবে নয়, ডাক পড়ত মুস্কিল-আসান এক সর্বজনপ্রিয় মানুষের।

বিধানসভায় বসু তখন বিরোধীদলের দাপুটে নেতা। সোচ্চার প্রতিবাদী কণ্ঠে চালিয়ে যাচ্ছেন সরকারের জনবিরোধী নিয়মনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। এই সময় তিনি কয়েকটি অগণতান্ত্রিক বিলের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিলেন। যেমন ‘পশ্চিমবঙ্গ বেতন ও ভাতা বিল, ১৯৫২’, ‘অপরাধমূলক কাজকর্মের এক্তিয়ারভুক্ত ট্রাইবুনাল বিল ১৯৫২’ ইত্যাদি। এইসব বিলের একটি ধারাও বসু গ্রহণযোগ্য মনে করেন নি, কারণ এইসব বিলের মাধ্যমে সরকার নিজের হাতে যে ক্ষমতা চেয়েছিল, সে ক্ষমতা আসলে বিত্তবান শ্রেণীরই। বিষয়গুলি নিয়ে সভায় উত্তপ্ত বিতর্ক চলে। মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ রায়ের সঙ্গে বসুর বাদানুবাদ হয়। বসু ডাঃ রায়কে “সেরা স্বেচ্ছাচারী” বলতেও দ্বিধা করেন না। তবুও সমস্ত প্রতিরোধ প্রতিহত করে এই ট্রাইবুনাল বিলটি ১৩৮-৬৪ ভোটে কংগ্রেস সরকার পাস করিয়ে নেয়।

১৯৫৩ সালে বসুর রাজনৈতিক দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্মেলনে নতুন রাজ্য কমিটি নির্বাচিত হল। সর্বসম্মতিক্রমে বসু রাজ্য কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত তাঁর এই দায়িত্ব ছিল। ১৯৫৩ সালের ২৭শে ডিসেম্বর থেকে ১৯৫৪ সালের ৪ঠা জানুয়ারি পর্যন্ত মাদুরাই-এ অনুষ্ঠিত হল কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় কংগ্রেস। অজয় ঘোষ আবার কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নতুন সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হলেন বসু।

বসু তখন দ্বৈত ভূমিকা পালন করছেন। একদিকে বিধানসভার ভেতরে জনবিরোধী কার্যকলাপের সমালোচনায় মুখর হতেন তিনি, অপরদিকে গণ-আন্দোলনগুলিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতেন। সংসদীয় বৃত্ত এবং সংসদের বাইরের বৃত্ত— উভয়ক্ষেত্রেই তাঁর প্রধান ভূমিকা ছিল।

“আসলে গোটা পঞ্চাশের দশকটাই ছিল আন্দোলনের দশক” বললেন বসু, “ট্রামভাড়া বাড়ানোর আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন, গোয়া-মুক্তি আন্দোলন আর এই সব আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।” ট্রামভাড়া বেড়েছিল এক পয়সা। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সব বামপন্থী দল সারা কলকাতা ও হাওড়ায়—দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন চালিয়েছিল। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় তখন ইউরোপে। আন্দোলন দমন করতে পুলিস লাঠি, গুলি, কাঁদানে গ্যাস চালায়। বহু মানুষ নিহত হন, গ্রেপ্তার হন। বসু নিজে অনেকবার গ্রেপ্তার হন। পুলিস নির্দয়ভাবে সাংবাদিক এবং চিত্রসাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ চালায়। ফলে সরকার জনসাধারণের আস্থা হারায় এবং ভাড়াবৃদ্ধি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। এরপর শুরু হল শিক্ষক আন্দোলন। ফেব্রুয়ারি মাস। প্রায় বিশ হাজার মাধ্যমিক শিক্ষক নিজেদের ন্যায্য দাবিদাওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নেমেছিলেন। রাজ্য জুড়ে তখন সভা, মিছিল, সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট চলছে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা গ্রেপ্তার হন শ্রীমতি মনিকুন্তলা সেন, ডঃ কানাই ভট্টাচার্য, সত্যপ্রিয় রায়, অনিলা দেবী, জ্যোতিষ জোয়ারদার এবং শৈলেন রায়ের মত নেতারা। বসু সে সময় নিজের বাড়িতে ছিলেন না, শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। পুলিস তাঁর হিন্দুস্তান পার্কের বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বসু ঠিক করেন এখন ধরা দেওয়া ঠিক হবে না। এখন তাঁর প্রথম কাজ হবে বিষয়টি বিধানসভায় তোলা। কিন্তু বিধানসভায় যাবেন কি করে? মাথা খাটিয়ে এক কৌশল বার করলেন। তৈরি হয়ে একটা ট্যাক্সি করে বসু চলে গেলেন এক বন্ধুর বাড়ি। সেখান থেকে পার্টিকে জানিয়ে দিলেন তাঁর ধরা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত। তারপর বন্ধুর বাড়ি থেকে তাঁর গাড়িতে করে বিধানসভার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। সেদিন বিধানসভার অধিবেশন ছিল। সভার চারদিকে রাইফেল নিয়ে পুলিস কড়া নজর রেখেছে। বসু ভাবলেশহীন মুখে গাড়ি নিয়ে একেবারে ভেতরে ঢুকে পড়লেন— একেবারে পুলিসের নাকের ডগা দিয়ে। আসলে বসু যে এইভাবে ঢুকে পড়বেন এ কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। তবে বসু ভেতরে ঢুকতেই তাদের টনক নড়ে, চারিদিকে হৈ হৈ পড়ে যায়। তাঁকে ধরার জন্য শোরগোল ওঠে, ছোটাছুটি আরম্ভ হয়। বিধানসভার ভেতর থেকে এক বিধায়ককে গ্রেপ্তার করা যায় কিনা এ নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের শলাপরামর্শ শুরু হয়ে যায়। বসু জানতে পারেন সভাগৃহ ত্যাগ করলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। প্রশ্নোত্তর পর্বের পর বসু অধ্যক্ষ শৈল মুখার্জির কাছে স্বাধিকারের আর্জি জানান। তিনি তাঁর কাছে বিধানসভা কমপ্লেক্স-এ সভাগৃহে কয়েকদিনের জন্য আশ্রয় চান। অধ্যক্ষ তাঁর এই অনুরোধ রক্ষা করেন। সভায় চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। পরে বসু শুনেছিলেন অধ্যক্ষের এই রুলিং ডাঃ বিধান রায় ভালচোখে দেখেন নি। সত্যিই সভাগৃহে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায় কিনা এ নিয়ে আইনী পরামর্শ নেওয়ার জন্য রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেলকেও ডেকে পাঠানো হয়। শেষ পর্যন্ত ৭ দিনের জন্য বসু বিধানসভা ভবনে রয়ে গেলেন। ঐ ক’দিন গোয়েন্দা পুলিস ও রাইফেলধারী পুলিসের বিশাল বাহিনী বিধানসভা ভবন ঘিরে রইল।

বসু একা রইলেন। চারিদিকে কড়া পাহারা। ছুঁচ গলার উপায় নেই। বসুর দেখাশোনা করতেন রহমান নামে এক কর্মী। তার স্বভাবটি বেশ ভাল ছিল, মনে দয়ামায়া ছিল। বসু শুতেন বিরাট ঘরে, ঘরের দেওয়ালে বিরাট বিরাট অয়েল পেন্টিং—সব দেশনেতাদের ছবি—কেমন অদ্ভুত লাগত। খাবার আসত বাড়ি থেকে, কখনও বা বন্ধুর বাড়ি থেকে। বিকেলে আসতেন স্ত্রী কমল আর ছোট্ট ছেলে চন্দন। আসামাত্রই নজরদারি আরও জোরদার হত। পরিবারের সঙ্গে কথা হত খুব অল্প সময়। “ওরা চলে যাবার সময় বেশি খারাপ লাগত”, বসু বললেন। প্রায়দিনই চন্দন যাবার সময় কান্নাকাটি করত। জোর করে বসু পিছন ফিরে বিদায় নিতেন। চন্দনের তখন মাত্র দু’বছর বয়স।

সাতদিন পর বসুকে বিধানসভা ভবন থেকে বেরোতেই হয়। বসুর কাজ শেষ হয়েছে। তিনি বিষয়টি সভায় তুলতে পেরেছেন। বন্ধু ডাঃ নারায়ণ রায় তাঁকে নিতে আসেন, রেড রোড আর পার্ক স্ট্রীটের সংযোগস্থলে পুলিসের কনভয় তাঁদের পথ আটকায়। পুলিস অফিসার বসুকে অ্যারেষ্ট ওয়ারেন্ট দেখায়। “এই জংশনটুকু পার হতে দিন, ট্রাফিক সিগন্যালটা সবুজ আছে”–বসু বলেন। মোড় পার হতেই গাড়ি থামে। বসু গ্রেপ্তার হন। ৭ দিন বসুকে জেলখানায় থাকতে হল। ২১শে ফেব্রুয়ারি শিক্ষকদের বারদিনের কর্মবিরতি শেষ হয়। মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষক ও সত্যাগ্রহী বন্দীদের ছেড়ে দেন। ব্যাপক শিক্ষক আন্দোলন শেষ হল কিন্তু গণ-আন্দোলনের দিন তখনও শেষ হয়নি। তখন খাদ্যসংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, খাদ্য ও সরবরাহ কর্মীদের ছাঁটাইএর নোটিশ দেওয়া হয়েছে, লেক ব্যারাকে পুলিস অত্যাচার চালাচ্ছে। বছরের শেষের দিকে জলপাইগুড়ি জেলায় প্রবল বন্যা হয়। এর মধ্যেই চলে আসে পুরসভা নির্বাচন। বসুর তখন নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। পার্টির নির্দেশে কখনও তিনি সুন্দরবনের হাড়োয়ায়, অথবা সন্দেশখালি, হাসনাবাদে। কখনও কুলগাছিতে। এখনও মনে পড়ে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে সেই পথসভা। বসুর নিজের জামাকাপড় ভিজে সপ্‌সপে, সঙ্গে ছাতা নেই, লোকজন ভিজছে, মাথার ওপর অঝোর ধারায় জল ঝরছে, কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, তারা তাদের নিপীড়নের কাহিনী বসুকে শুনিয়ে চলেছেন। পকেটে রুমাল ছিল, মুখমাথা একটু মুছতে গিয়ে দেখেন, সেটাও ভিজে সপ্‌সপে। ঐ জামাকাপড়েই বাড়ি ফেরেন। ভিজে জামা গায়েই শুকোয়। “তখন শরীর বেশ ভালই ছিল, সহজে আমার ঠাণ্ডা লাগত না”—জানালেন বসু।

রাজ্যকমিটির সম্পাদক হিসাবে বসুর তখন অনেক দায়িত্ব। ১৯৫৪ সালের ২২শে মে যখন ইন্দোচীনগামী একটি যুদ্ধবিমান হঠাৎ দমদম বিমানবন্দরে অবতরণ করে তখন বসু এবং ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ভূপেশ গুপ্ত এই ঘটনার রিপোর্ট দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন। জুন মাসে স্বাক্ষরিত পাক-মার্কিন চুক্তির প্রতিবাদে ১৪ই জুন কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারে অধ্যাপক হীরেন মুখার্জির নেতৃত্বে এক জনসভা হয়। এই সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বসু পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির তীব্র নিন্দা করেন। সপ্তাহ দুয়েক বাদে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে আর একটি সভায় বসু বক্তৃতা দেন। এই সভার উপলক্ষ ছিল চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাইএর শুভেচ্ছা ভারতসফর।

১৯৫৫ সালে শুরু হল গোয়ামুক্তি আন্দোলন। উদ্দেশ্য—গোয়ায় পর্তুগীজ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটানো। সারা দেশ থেকে এই মুক্তি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক পাঠানো হয়েছিল। এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করে আর. এস. পি. নেতা ত্রিদিব চৌধুরি সালাজারের জেলে বন্দী ছিলেন। ২১শে জুলাই কমিউনিস্ট পার্টির এক জনসভায় বসু এই উপলক্ষে একটি ভাষণ দেন। পার্টি কমরেড নিত্যানন্দ সাহা এই আন্দোলনে মৃত্যুবরণ করেন। এই শহীদের স্মৃতির উদ্দেশে নীরবতা পালন করার জন্য বসু বিধানসভার সদস্যদের অনুরোধ করেন। কিন্তু সরকারপক্ষ তাঁর প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে, কেবলমাত্র বিরোধীপক্ষের সদস্যরাই উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান। ১৪ই আগষ্ট পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় দুশ জন সত্যাগ্রাহী গোয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। এই উপলক্ষে যাত্রার শুরুতে বসু এক দীর্ঘ বিবৃতি দেন। গোয়ামুক্তি আন্দোলনে বসু বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে সক্রিয় ভূমিকা গ্ৰহণ করেছিলেন। বসু বুঝেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় সুনিশ্চিত। ভারত সরকার অদূর ভবিষ্যতেই গোয়াকে মুক্ত করবে।

পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যেতেও বসুর “ভালই লাগত”। অন্ধ্রপ্রদেশের বিধানসভার সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে বসু অন্ধ্রপ্রদেশের কয়েকটি এলাকার পার্টির প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে গিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের শুভেচ্ছার প্রতীক হিসাবে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন দুটি মাইক। কয়েকটি বিশাল নির্বাচনী সমাবেশে বসু ভাষণও দিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন বিজানগর আর বিশাখাপত্তনম। ভারতের অন্য প্রদেশে ভাষণ দেবার সময় বসুর তখন মনে হত—বেশভূষা, আচার আচরণ, সাহিত্য, সংস্কৃতি একেবারে আলাদা হলেও মূলত সব মানুষের সমস্যার স্বরূপ কিন্তু একই।

বসুর প্রথম চীন সফরও এই ১৯৫৫ সালেই। চীনে গিয়ে কমিউনিস্টদের কর্মকাণ্ড দেখে বসু অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। চীনের অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে বেইজিং-এ ‘মে ডে’র প্যারেড দেখেছিলেন। চৌ-এন-লাইএর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন আর মিশেছিলেন বেশ কিছু সাধারণ মানুষের সঙ্গে। সবচেয়ে ভাল লেগেছিল চীনের কর্মসংস্কৃতি। চীনা খাবার বসুর বরাবরই প্রিয়। খাস চীনে ডিস্‌ও খেয়েছিলেন, তবে চপস্টিক দিয়ে নয়, ভারতীয় স্টাইলে। “চপৃস্টিকটা আমি কোনকালেই ওদের মত ব্যবহার করতে পারি না, কমল আর চন্দন দিব্যি পারে। আমি এখনও পারি না”- বসু মৃদু হেসে বললেন। পরবর্তীকালে বসু একাধিকবার চীনে গেছেন, প্রতিবার চীনে কমিউনিজমের প্রয়োগ নতুন মনে হয়েছে। প্রথমবার যখন তাঁর খুব ভাল লাগার কথা চৌ-এন-লাইকে জানিয়েছিলেন, “চৌ-এন-লাই বলেছিলেন”, বসু জানালেন, “আপনি যদি হাজার বছর বাদেও আসেন, তখনও দেখবেন কিছু ত্রুটি, কিছু ফাঁক থেকেই গেছে, বাস্তব থেকে শিক্ষা নিয়ে সেই ফাঁকগুলো ভরাতে হবে। সার কথা, উন্নতির অবকাশ সব সময়েই থেকে যায়।” বসু নিজেও এ কথা বিশ্বাস করেন।

সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কাজকর্ম ছাড়াও মানবিক কারণে ছোটখাটো কাজ করতেও বসুর কোনও আপত্তি ছিল না। অসুস্থ কমরেডকে সাহায্য করা অথবা কারো কোনও সমস্যা হলে সহজ সমাধান বাতলে দেওয়া—এসব তিনি প্রায়ই করতেন বলে বসুর এক পুরোনো কমরেড বন্ধু জানালেন। এ প্রসঙ্গে বসু একদিন বললেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসুস্থতার কাহিনী। “উনি মনেপ্রাণে কমিউনিস্ট ছিলেন। একবার খুব অসুস্থ হলেন, আমি আর কাকাবাবু ওঁর বাড়ি গেলাম। টাকার অভাবে কিছুতেই হাসপাতালে ভর্তি হবেন না। জোর করে আমরা ওঁকে ট্যাকসি করে ইসলামিয়া হাসপাতালে ভর্তি করে দিলাম। টাকাকড়ির ব্যবস্থাও করা হল। কয়েকদিন পর চেহারা ভাল হতেই একদিন কাউকে না বলে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেলেন— আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লেগেছিল একটা ব্যাপার”, বসু বললেন, “আমি দেখেছিলাম উনি দুটো টেবিলে দুটো উপন্যাস একসঙ্গে লিখছেন, বললেন টাকার তাঁর খুব দরকার, তাই একই সঙ্গে দুটো উপন্যাস নামাতে হবে।”

১৯৫৫ সালের ২৯শে নভেম্বর কলকাতায় এলেন ক্রুশ্চেভ ও বুলগানিন। দমদম বিমানবন্দরে ডাঃ বিধান রায়, কমিউনিস্ট নেতা বঙ্কিম মুখার্জি, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, এবং অন্যান্য মন্ত্রীবর্গের সঙ্গে জ্যোতি বসুও তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। ৩১শে নভেম্বর তাঁদের দুজনকে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনার রেশ শেষ হতে না হতেই বিধানসভায় ওঠে রাজ্য পুনর্গঠন বিষয়ক বিতর্ক। বসু বিধানসভায় বার বার ভারতের অখণ্ডতার কথা বলেন, বার বার বলেন ভাষা, ভৌগোলিক সংলগ্নতা এবং জনগণের ইচ্ছা—এর ওপর দাঁড়িয়েই রাজ্য পুনর্গঠনের বিষয়টির মীমাংসা করা উচিত।

১৯৫৬ সালের ২০শে জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার এই দুটি রাজ্যকে যুক্ত করে ‘পূর্বপ্রদেশ’ নাম দিয়ে একটি রাজ্য গঠন করার প্রস্তাব দিয়ে একটি যুক্ত বিবৃতি দিয়েছিলেন। জনগণ এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিলেন। বসু এই সংযুক্তিকরণের বিপক্ষে বিধানসভায় যুক্তিগর্ভ ভাষণ দিয়েছিলেন। ডঃ মেঘনাদ সাহা, অতুল গুপ্ত প্রমুখ বিশিষ্ট নাগরিক এই সংযুক্তি-বিরোধী আন্দোলনের শরিক হয়েছিলেন। আন্দোলন অনেকদূর গড়িয়েছিল। বসু বললেন, “আমরা বলেছিলাম, এ হয় না, এ তো চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল নীতি। তাছাড়া এতে বাঙালী-বিহারী বিরোধী বিদ্বেষ আরও বাড়বে। দেশের সংহতির মধ্যে এটা অত্যন্ত হানিকর।” ১৪ই ফেব্রুয়ারি বিধানসভায় রাজ্যপালের ভাষণের ওপর বিতর্কে অংশগ্রহণ করে বসু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সৌভাগ্য ও ডাঃ রায়ের দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশের মানুষ এখনও বেঁচে আছেন, কংগ্রেস এতদিনের, ৫০ বছরের ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের আদর্শ, ঐতিহ্য ও দেশবাসীর আশা আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিয়েছে।’

ইতিমধ্যে পার্টির সদস্য সংখ্যা ভালমত বেড়েছে, বেড়েছে পার্টির শক্তিসামর্থ্য আর জনপ্রিয়তা। ১৯শে এপ্রিল পালঘাটে পার্টি কংগ্রেসের উদ্বোধন হল। বসু আর প্রমোদ দাশগুপ্ত এই কংগ্রেসে যেতে পারলেন না। তাঁরা দুজন তখন কলকাতার উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্রে একটি উপ-নির্বাচন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। এই উপ- নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী ছিলেন মোহিত কুমার মৈত্র, কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন অশোক সেন। অশোক সেন প্রচুর টাকা ঢালা সত্ত্বেও হেরে গেলেন। “আমাদের কাছে বিষয়টা তখন একটা কঠিন চ্যালেঞ্জের মত”, বসু বললেন “গণ- অভিযান, প্রতিবাদ-দিবস কম হয়নি, উপ-নির্বাচন আমরা প্রাণপণে লড়েছিলাম, জয়ও হল। প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম জনগণের সায় না থাকলে এই প্ৰস্তাব কখনও বাস্তবায়িত হতে পারে না; ডাঃ রায় অবশ্য জেদ ধরে বসেছিলেন।”

আরও একটি জয় জনগণের পক্ষেই গেল। মেদিনীপুরে খেজুরী নির্বাচন কেন্দ্ৰে বামপন্থী সমর্থিত পি. এস. পি. প্রার্থী লালবিহারী দাস প্রায় ২০,০০০ ভোটের ব্যবধানে কংগ্রেসপ্রার্থী ভিখারী মণ্ডলকে হারিয়ে দেন। এই বিপর্যয়ের ফলে ডাঃ রায় ৩রা মে সংযুক্তিকরণের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। “আসলে এই জয় ছিল জনগণের ইচ্ছারই জয়”–বসু মন্তব্য করেন।

আবার আর একটা নির্বাচন এসে গেল। “১৯৫৭ সালের দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনটা একটু আলাদা রকমের ছিল”, বসু বলেন, “কারণ আমরা সেবার চেয়েছিলাম ‘বিকল্প সরকার’ গঠন করতে। ‘বিকল্প সরকার’ গঠন করার মত শক্তি ও বিশ্বাস আমরা ততদিনে অর্জন করেছি।” পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা তখন ভাল নয়। বেকার সমস্যা, খাদ্যসমস্যা, মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই—কোনও সমস্যারই সমাধান হয়নি, বরং আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এরই মধ্যে নির্বাচন। বসু শুরু করলেন বাড়ি বাড়ি যাওয়া, মিটিং, মিছিল, স্কোয়াড। দাঁড়ালেন তাঁর আগেরবারের নির্বাচনী কেন্দ্র বরানগর থেকেই। এবারে বসু যেন আরও আত্মবিশ্বাসী এবং আরও সপ্রতিভ। বরানগরের কয়েকজন পুরোনো বাসিন্দা বললেন “জ্যোতিবাবু খুব আসা যাওয়া করতেন, ঘোরাঘুরি করতেন, কয়েকজন ছেলের কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলতে বলতে খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতেন। রোগা ছিপছিপে চেহারা, রোদে ঘুরে ঘুরে গায়ের তামাটে বর্ণ, কারো কোনও সমস্যা হয়েছে শুনলে ছুটে আসতেন।” সারা জানুয়ারি চলল নির্বাচনী প্রচার। বসুকে বরানগর ছাড়া অন্যান্য জায়গাতেও যেতে হত।

এর মধ্যে একটা নাটক হল। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে গান্ধীজির একটি চিঠি প্রকাশ করলেন। গান্ধীজি তাঁকে সেই চিঠিতে লিখেছিলেন যে সর্দার প্যাটেল একটি বার্তায় বলেছেন যে একজন মারোয়াড়ীকে, বদ্রীদাস গোয়েঙ্কা অথবা খৈতানকে ডঃ ঘোষের মন্ত্রিসভায় নিতে হবে। তিনি অবশ্য এই নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে অস্বীকার করে তখনকার কংগ্রেস সভাপতি আচার্য কৃপালনীকে জানিয়ে দেন। এই কারণেই আসলে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। এতদিন সৌজন্যবশত এই চিঠি প্রকাশ করেন নি কিন্তু এখন কংগ্রেসীরা তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলায় তিনি সত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হলেন। এর ফলে কংগ্রেস এবং অন্যান্য কমিউনিস্টবিরোধী দলে নিজেদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়ে যায়, এতে কমিউনিস্ট পার্টির লাভই হয়। বেশ বোঝা যাচ্ছিল জনগণ পার্টির পক্ষেই যাবেন তবুও বসু কোনওদিনই আত্মপ্রসন্ন থাকতে পারেন নি। তিনি যেন পরিশ্রম দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলেন, নাওয়া খাওয়া প্রায় উঠে গেল, দিনরাত কখন কোথা দিয়ে কেটে যেতে লাগল। ন্যায়সম্মত পদ্ধতিতে লড়াইটা হোক—তাঁর জেদ চেপে গেল। প্রথম রাউণ্ড ভোটের পরই তিনি জানতে পারলেন বেশির ভাগ ব্যালটবাক্সই ছিল সীলভাঙা।

৫ই মার্চ নির্বাচন কমিশনারকে তিনি ঘটনাটা রিপোর্ট করলেন, কয়েকটি নির্বাচনী কেন্দ্রে আবার নির্বাচনের জন্য আবেদনও করলেন। ২১শে মার্চ বসুর নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র বরানগরের ফল বেরোল। বসু আবার জিতলেন। ৯,৪১৫ ভোটের ব্যবধানে তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের কানাইলাল ঢোলকে হারিয়েছিলেন। বসু খুবই খুশী। তাঁর সমর্থকরা বিজয়োল্লাসে সজোরে ঢোল বাজিয়ে ঢোল ফাটালেন। আরও ফলাফল আসতে লাগল, দেখা গেল অনেক কেন্দ্রেই কমিউনিস্ট প্রার্থী জিতেছেন। আগের থেকে অবশ্যই ফল ভাল। বিধানসভায় আসন বেড়ে হল ৪৬। বোঝা গেল সাধারণ মানুষ তাঁদের সমর্থন করেছেন।

তবুও তাঁরা সরকার গঠন করতে পারলেন না। ডাঃ বিধান রায় খুব মুষড়ে পড়েছিলেন। তিনি বহুবাজার নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কমিউনিস্ট পার্টির ট্রেড ইউনিয়ন নেতা মহম্মদ ইসমাইলকে মাত্র ৫৪০ ভোটে পরাজিত করেছিলেন। এই সামান্য সংখ্যক ভোটে জেতাটা ডাঃ রায়ের কাছে খুব অপমানজনক হয়েছিল। এতবড় একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক কিনা শেষকালে এক মামুলি কমিউনিস্ট পার্টিকর্মীর কাছে প্রায় হেরে গেলেন। ডাঃ রায়ের দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল। কমিউনিস্টরা যদি সত্যিই ক্ষমতায় এসে যায় তো কি হবে—এই চিন্তায় তাঁর রাতের ঘুম চলে গেল। কমিউনিস্টদের প্রতিহত করার জন্য তিনি ভেতরে ভেতরে অনেক ব্যবস্থা নিলেন। পরে এক সময় বসুকে তিনি বলেছিলেন যে এমন কি জন কেনেডির কাছেও তিনি কমিউনিজমের বিপদ নিয়ে কথাবার্তা বলেছিলেন। “আপনি বিদেশে কেন এমনভাবে কথা বলেছিলেন”–বসু তাঁকে শুধিয়েছিলেন। “তা না হলে ওরা আমাদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করত না”–ডাঃ রায় জবাব দিয়েছিলেন।

ডাঃ রায় ও বসুর মধ্যে সম্পর্কটা ছিল অদ্ভুত। ব্যক্তিগত স্তরে সম্পর্কটা ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধামিশ্রিত বন্ধুত্বের, রাজনৈতিক স্তরে তাঁরা পরস্পরকে আক্রমণ করতে ছাড়তেন না। বিধানসভায় দুজনের মধ্যে চলত ধারালো বাগযুদ্ধ, কেউ কাউকে এতটুকু ছাড়তে রাজি নন। যেমন একবার ডাঃ রায়ের মনে হল কমিউনিস্টা পিপলস্ থিয়েটারের নাটকগুলো বড় বেশি বামপন্থী করে তুলছে। বসু এই অভিযোগ মেনে নিতে মোটেই রাজি নন। বসু বললেন : “বলুন কোন্ নাটক কমিউনিস্টরা বদলেছে?”

ডাঃ রায়—আমি নাটকের নাম করতে পারব না।

বসু—কেন করবেন না?

ডাঃ রায়—করা যাবে না বলে।

বসু—সভায় এইভাবে আচরণ করা ঠিক নয়। আপনি হিটলারের মত আচরণ করছেন।

ডাঃ রায়—হ্যাঁ, হিটলার স্তালিনের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।

আবার ডাঃ রায়ের বাড়িতে বসে যখন বসু কথা বলতেন তখন মনে হত না যে তাঁরা দু’টি বিরোধী দলের নেতা। বসু বলেন ডাঃ রায় ছিলেন অন্যদের তুলনায় উদারমনা ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। বসুকে ডাঃ রায় বিশেষ স্নেহ করতেন। অনেক সময় ডাঃ রায়ের মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা অভিযোগ করতেন যে তিনি জ্যোতিবাবুর সমস্ত অনুরোধ রাখেন অথচ তাঁদের অনেক কথাই রাখেন না। ডাঃ রায়ের জবাব : “কারণ জ্যোতি সব সময় অন্যের আর্জি নিয়ে আসে, নিজের জন্য ব্যক্তিগত কোনও অনুরোধ নিয়ে ও কখনও আমাদের কাছে আসে না।”

একবার পার্টি কমরেড গণেশ ঘোষ বসুকে অনুরোধ করেন ডাঃ রায়কে বলার জন্য যাতে তিনি এক ক্যানসার রোগীকে দেখে দেন। বসু বলেন ডাঃ রায়ের দাতব্য চিকিৎসালয়ে দেখিয়ে নেওয়াই ভাল। তবুও কমরেড নাছোড়। অগত্যা বসু ডাঃ রায়কে বলেন, “আমি ওদের বললাম আপনি পুরোনো স্কুলের ডাক্তার, তবুও ওরা আপনাকে দেখাবেই, তাই যদি আপনি রোগীকে দেখে দেন…।” ডাঃ রায় উত্তরে বললেন : “যাই হোক, তোমার এই নিন্দাত্মক মন্তব্য সত্ত্বেও আমি রোগীকে দেখে দেব”। এরপর উনি হাসপাতালে গিয়ে সেই রোগীকে দেখে দেন।

আর একবার বসুর হাতের একটা জায়গা ফুলেছিল। কিছুতেই সারে না। বসুর বন্ধু ডাঃ নারায়ণ রায় ফোলা জায়গাটা পরীক্ষা করে, ড্রেস করে, ওষুধ দিলেন। ডাঃ রায়ের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন : “হাতে কি হয়েছে? ব্যাণ্ডেজ কেন?”

“আপনার ছাত্র ডাঃ নারায়ণ রায় আন্দাজ করছে ফাইলেরিয়া”—জবাব দিলেন বসু।

“নারায়ণ সেটা কি করে জানল? আমার তো তা মনে হয় না”–আত্মবিশ্বাসের সুরে মন্তব্য করলেন ডাঃ রায়। তক্ষুণি ডাঃ নারায়ণ রায়কে ফোন করে বললেন “জ্যোতির হাতটা দেখলাম। আমার তো মনে হয় না এটা ফাইলেরিয়া, তুমি ওকে রক্তপরীক্ষা করতে বলতে পার। তবে তোমার ডায়াগনসিস্ ঠিক নয়।” বসুকে তিনি একটা ভেষজ ওষুধ বাতলে দিলেন, এবং ডাঃ নারায়ণ রায়ের দেওয়া ওষুধ বন্ধ করে দিলেন। রক্তপরীক্ষার রিপোর্ট এল, দেখা গেল ডাঃ বিধান রায়ের অনুমানই ঠিক, কেসটা মোটেই ফাইলেরিয়া ছিল না।

একবার বসু ডাঃ রায়কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন “আচ্ছা যখনই কোনও ঝামেলা হয়, তখন আমাকেই প্রথম এ্যারেস্ট করা হয় কেন?”

“যখন ঝড় হয়, তখন বড় গাছেই প্রথম ঝাপ্‌টা লাগে, তুমি তো নেতা, তাই তোমার ওপরই প্রথম আঘাত তো আসবেই।”—জবাব দিলেন ডাঃ রায়।

পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন না করতে পারলেও ১৯৫৭ সালে কেরালায় কমিউনিস্ট পার্টি সরকার গঠন করে। জাতীয় রাজনৈতিক চিত্রে এ এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেটা ছিল মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ। বসুর এখনও মনে আছে পার্টি অফিসে কেরালায় কমিউনিস্ট পার্টির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার খবর আসামাত্র আনন্দের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। ই. এম. এস. নাম্বুদিরিপাদ কেরালার মুখ্যমন্ত্রী হলেন। ২৭শে অক্টোবর বনগাঁয় সারা ভারত কৃষকসভার আটদিনব্যাপী অধিবেশনে বক্তৃতা দিতে ই. এম. এস. পশ্চিমবঙ্গে আসেন। কলকাতায় মনুমেন্টের পাদদেশে তাঁর সংবর্ধনা সভায় তিনি পেলেন অগণিত মানুষের উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন। বসুও এই সময় বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

১৯৫৮ সালে বিধানসভার কাজ আর পার্টি-আন্দোলনের ফাঁকে ফাঁকেই বসু গিয়েছিলেন অমৃতসর। গিয়েছিলেন চেকোশ্লাভাকিয়া আর সোভিয়েত ইউনিয়ন। এপ্রিল মাসে অমৃতসরে পার্টির বিশেষ কংগ্রেস ডাকা হয়। হরকিষেণ সিং সুরজিৎ ছিলেন এই কংগ্রেসের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি। প্রথম দিন শহরে একটি বড় জনসভা হয়। অন্যান্যদের সঙ্গে সেখানে বসুও বক্তৃতা দিয়েছিলেন। প্রকাশ্য অধিবেশনে প্রায় এক লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়েছিল। পাঞ্জাবের বিভিন্ন জেলা ও শহরতলী থেকে হাজার হাজার মানুষ উৎসবের মেজাজে অমৃতসরে এসে পৌঁছান—কেউ বাসে, কেউ টাঙ্গায়, সাইকেলে, কেউ বা পায়ে হেঁটে—প্রত্যেকের হাতেই লাল পতাকা। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। খোলা জীপে বসু, ই. এম. এস. ও সুরজিৎ শহর পরিক্রমা করেন—বাড়ির ছাদ থেকে মেয়েরা, ছোট ছেলেরা ফুল ছুঁড়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানায়। জালিয়ানওয়ালাবাগেও গিয়েছিলেন। বসুর সঙ্গে ছিলেন কাকাবাবু, আবদুল হালিম, ই. এম. এস. প্রমুখ। প্রায় চল্লিশ বছর আগের বৈশাখী দিনের সেই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিতে তাঁর মন ভারাক্রান্ত হয়েছিল। ফেরার সময় সকলেই নীরব, কারো মুখে কোনও কথা ছিল না।

পার্টির এই বিশেষ কংগ্রেস ডাকা হয়েছিল গঠনতন্ত্রের আমূল সংশোধনের জন্য। বসু সহ অনেকেই কয়েকটি সংশোধন-প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। অনেকদিন থেকেই বসুর মনে হয়েছিল তাঁর দায়িত্ব যেন বড় বেশি হয়ে যাচ্ছে। সংগঠনের কাজ, গণ-আন্দোলনের কাজ ক্রমশ বেড়েই চলেছে, সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে তিনি মুক্তি চাইছিলেন। পার্টির বিশেষ কংগ্রেসের আগে বসু তাঁর বক্তব্য রাজ্য সম্মেলনে পেশ করেছিলেন। সম্মেলনে সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে তিনি রেহাই পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অনেক কমরেডই বসুর প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি হন নি।

এর মধ্যেই এল সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের সুযোগ। বসুর সঙ্গে ছিলেন এস. এ. ডাঙ্গে। প্রথম বসু গিয়েছিলেন চেকোশ্লোভাকিয়া। পার্টির কাজ করার পর প্রাগ শহরটাও ঘুরে দেখলেন, দেখলেন বিখ্যাত উষ্ণ প্রস্রবণ—”আর সবচেয়ে অদ্ভুত, দেখি সবাই হাতে একটা মাগ্ নিয়ে ঘুরছে, ঐ জলটা খুবই স্বাস্থ্যকর তাই”–বসু জানালেন। কমরেড অজয় ঘোষ ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। বসু ও ডাঙ্গে দুজনেই মস্কোয় গেলেন, দুজনেই রইলেন কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দিষ্ট বাসগৃহে। প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর বসুর কেমন লেগেছিল?—”আমরা যা দেখেছিলাম, বা আমাদের যা যা দেখানো হয়েছিল, তাতে আমাদের মনে হয়েছিল সমাজতন্ত্রী দেশের চেহারা এই রকমই হওয়া উচিত”, বললেন বসু, “তবে একটা ব্যাপার আমার খুব অদ্ভুত লেগেছিল, মনে হয়েছিল, রাজনীতি, সমাজ এই সব বিষয়ে সাধারণ লোকজন ভীষণ উদাসীন। তাদের এই সব ব্যাপারে কোনও আগ্রহই নেই। আমি জিজ্ঞাসাও করেছিলাম আমার সঙ্গে যে অফিসারটি ছিলেন তাঁকে। আমরা তখন সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়েছিলাম। তিনি উত্তর দিলেন : ‘এরা সবাই ছুটির মেজাজে আছে, তাই আপনার এ রকম মনে হচ্ছে।’ কিন্তু আমি যখন যেখানে গেছি, যতটা সাধারণ লোকের সঙ্গে কথা বলেছি আমার একই কথা মনে হয়েছে।” একবার এক বাঙালী ভদ্রলোকের বাড়িও গিয়েছিলেন, তিনি বহুদিন ওদেশে আছেন। “আমি বললাম, আচ্ছা, সোভিয়েত ইউনিয়ন তো কারিগরিবিদ্যায় অনেক উন্নতি করেছে, কিন্তু ছোটখাট জিনিস, যেমন রেডিও, কলম ইত্যাদি—এগুলো কি আরও উন্নত করা যায় না? উত্তরে ভদ্রলোক হেসেছিলেন। আসলে দেশের ভেতরকার প্রকৃত অবস্থা জানতে হলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশা উচিত। আমাদের সে সুযোগ বড় একটা ছিল না”—বসু বললেন।

বসুর প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের স্মৃতি এখনও তাজা। পরে আরও বার ছয়েক সে দেশে গেছেন। দেশটাকে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে, এক এক রকম মনে হয়েছে। তবে প্রতিবারই ভাল লেগেছে ওদেশের মানুষদের।

ওরা অত্যন্ত ‘ব্রেনি’ এবং ‘ভাল মানুষ’। ও দেশের ‘ক্যাভিয়ার’ বসুর আর এক প্রিয় খাদ্য। ভেঙে যাবার পর আর যান নি। ভাঙল কেন? শক্তিশালী ধনতন্ত্রের হাত? বসুর মতে ভেতর থেকেই ভাঙন ধরেছিল, ভেঙেছে নিজেদের কারণেই, বাহ্যিক কারণ বলা হয়, তবে আভ্যন্তরীণ কারণ কিছু কম নয়।

১৯৫৮ সালে বিধানসভায় সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বসুর যুদ্ধ অব্যাহত ছিল। এর মধ্যেই বছরের প্রথম দিকে তিনি তাঁর শ্রদ্ধেয় নেতা হো চি মিনকে কলকাতায় অভ্যর্থনা করেন। আবার দশ বারোদিনের মাথায় তাঁকে ছুটে যেতে হয় আসানসোলে চিনাকুরি কয়লাখনিতে দুর্ঘটনাস্থলে। এই খনিতে এক বিস্ফোরণের ফলে ১৮২ জন খনিশ্রমিক মারা যান। বসু তাঁদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানান, অকুস্থলে গিয়ে সরেজমিনে খনির বিপজ্জনক জায়গাগুলি পরিদর্শন করেন। এদিকে বিধানসভায় আর এক চমক। সিদ্ধার্থশংকর রায় কংগ্রেস সরকারের দুর্নীতির প্রতিবাদে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন। এই পদত্যাগ উপলক্ষে সিদ্ধার্থশংকর রায়ের নিজের বিবৃতি পড়তে সময় লেগেছিল পাক্কা তিন ঘণ্টা। তাঁর আক্রমণের প্রথম লক্ষ্য ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন আর স্বরাষ্ট্র (পুলিস) ও পরিবহণ মন্ত্রী কালীপদ মুখার্জি। কয়েকদিন পর বসু অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই প্রস্তাবের ওপর বিতর্ক চলেছিল সাড়ে আট ঘণ্টা। বসু বলেছিলেন এক ঘণ্টা ধরে। বসুর বিবৃতিতে মূল বিষয় ছিল খাদ্যসমস্যা এবং সরকারী দুর্নীতি। বসু একটানা বলে যেতেন, গম্ভীর গলা, বলার মধ্যে কোনও নাটকীয়তা নেই। মাঝে মাঝে দেখা যেত ডাঃ বিধান রায় মাথায় হাত দিয়ে চোখ নামিয়ে স্থির হয়ে বসে আছেন। ‘ডাঃ রায় কি ঘুমিয়ে পড়েছেন’–এক সদস্য হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেন। ‘কে বলল, কে বলল আমি ঘুমোচ্ছি’—ধড়মড়িয়ে উঠে সোজা হয়ে বসে তিনি আবার বসুর বক্তৃতা শুনতে থাকেন। ১৯৫৮ সালের মার্চ মাসে ডাঃ রায় যে বাজেট বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তাতে তিনি কেন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছিলেন। তিনি কংগ্রেসের প্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও দিল্লীর কংগ্রেস সরকারের নীতির নিন্দা করতে পেরেছিলেন। তার জন্য বসু তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

“তখনকার বিরোধীদলের নেতারা এখনকার বিরোধীদলের নেতাদের মত অভদ্র, অসভ্য ছিল না। বিধানসভাটা হাতাহাতি, গুণ্ডামি করার জায়গা নয়। তাছাড়া আমি সব সময় বলি, এঁরা তো জনগণের নির্বাচিত নেতা, আর এঁদের আচরণ দেখে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাই বা কি শিখবে?”—বসুর বিরক্ত মন্তব্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *