৬. বয়সটার সঙ্গে বনিবনা

অধ্যায়: ৬

“তোমাকে দেখছি বয়সটার সঙ্গে কিছুতেই তোমার বনিবনা হচ্ছে না। এখন কি তোমার জোয়ানবয়সিদের মতো গ্যাটম্যাট করে চলাফেরা সইবে? হুড়যুদ্ধু করা তোমার চিরকালের স্বভাব। কত কী হতে পারত বলো তো!”

“আরে না, সেদিন হুড়যুদ্ধু কিছু করিনি, সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাব বলে পা বাড়িয়েছি, আজ কত তারিখ সেটা জানতে একবারই একটু ঘাড় ঘুরিয়ে ডান দিকের দেওয়ালে ক্যালেন্ডারটা দেখবার চেষ্টা করেছিলাম, সিম্পল ব্যাপার, কোনও অ্যাডভেঞ্চার করিনি, তাতেই কী যে হয়ে গেল! লাট্টুর মতো পাক খেয়ে, চোখে অন্ধকার দেখে পড়ে যাচ্ছিলাম। নিজেকে এমন গাধার মতো লাগছিল তখন! কেন পড়ে যাচ্ছি, কী এমন নিয়ম ভাঙলুম, ভাবতে ভাবতেই পড়ে হাতে চোট, কোমরে চোট, মাথাটাও দেয়ালে ঠুকে গিয়েছিল। রাগ হয় কি না বলো নিজের ওপর, দুনিয়ার ওপর!”

“অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে শুনলাম।”

“ওরা তো তাই বলে। হয়তো দু’-একমিনিট একটু ব্ল্যাকআউট হয়েছিল, তবে সেটা সিরিয়াস কিছু নয়। সঙ্গে-সঙ্গেই আমি সামলে গেছি। রাজু এসে ধরে তুলছিল, আমি বারণ করলাম, ধরিস না। নিজেই পারব। বলে উঠতে গিয়ে দেখি ডান হাঁটুটা ফেল মেরেছে। তখন রাজু পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল আর শুয়ে-শুয়ে তিনদিন ধরে মনে-মনে নিজেকেই গালাগাল করে যাচ্ছি, গাধা, গোরু, কচ্ছপ, নিনকমপুপ, আরও কত কী! আর জয়তিকে তো জানোই, আমার পতনজনিত উত্তেজনায় ননস্টপ পাড়া জানান দিয়ে চেঁচামেচি করে যাচ্ছে।”

“ডাক্তার কী বলল?”

“ওরা যা বলে এবং চিরকাল বলে আসছে। নো সাডেন টার্নিং, নো সাডেন মুভমেন্টস, নো কুইক স্টেপস। একটা লোককে ধরে-বেঁধে বুড়ো বানানোর চেষ্টা।”

“আর, তুমি কিছুতেই বুড়ো হতে রাজি নও তো!”

“আরে থিওরেটিক্যাল বুড়ো আর প্র্যাকটিক্যাল বুড়ো তো এক নয়।”

“তুমি তা হলে থিওরেটিক্যাল বুড়ো তো! বেশ বাপু, তাই না হয় হল, কিন্তু থিওরেটিক্যাল বার্ধক্যকেও তো একটু সমঝে চলতে হবে। তুমি তাকে মাড়িয়ে চললে কি তার সম্মান থাকে? সে শোধ নেবে না? তোমাকে বুড়ো হতে কেউ বলছে না। আমরা ধরেই নিচ্ছি তুমি খুব যুবাপুরুষ। কিন্তু যার যা পাওনা তাকে তা না দিলে সে ছাড়বে কেন?”

“আরে, এটা সে ব্যাপার নয়। স্ট্রোক বা প্রেশার থেকে তো হয়নি, ঘাড় থেকে হয়েছে, স্পন্ডেলাইটিস।”

“সেটা শুনেছি। তবু এখন একটু ধীর স্থির হও তো, বুড়ো না হয়েও সেটা তো হওয়া যায়। কবজিটায় তো এখনও কালশিটে পড়ে আছে। একটু কাছে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াও তো, রাজুর সোয়েটারটার মাপটা নিই। ও তো তোমার মতোই লম্বা, না?”

“আমি পাঁচ এগারো, রাজু ছয় এক।”

“তা হলে দু’ইঞ্চি বাড়াতে হবে। রংটা দ্যাখো তো, রাজুকে মানাবে না?”

“তোমার কালার সেন্স আমার চেয়ে অনেক ভাল। হ্যাঁ রংটা তো দারুণ!”

“একটু টানটান হয়ে দাঁড়াও, নইলে ঠিক মাপটা পাওয়া যাবে না।”

সত্যচরণ পদ্মাবতীর নিকটবর্তী হলেন। এখনও নৈকট্য রোমাঞ্চকর। পদ্মাবতী সোয়েটারের মাপ নিতে ঘাড়ের কাছে হাতদুটো যখন ছোঁয়ালেন, তখন জোয়ারের জল উপকূলে আছড়ে পড়ছিল। সত্যচরণ বুকের মৃদু কম্পন এখনও টের পান। মৃদুস্বরে বললেন, “পদ্মাবতী, বিছানায় পড়ে থাকলে একটাই অসুবিধে। বড্ড তোমার কথা মনে হয়।”

“আমিও তো পথ চেয়ে বসে থাকি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *