সে-রাত্রে সুরপতি সম্মুখবর্তী এক পান্থশালায় বিশ্রাম নিল। আবার বেরিয়ে পড়ল পরদিন খুব সকালেই। দ্রুত সে এই এলাকা ছাড়িয়ে যেতে চায়। এবার সে আর কোনও ভুল করবে না, কথা বলবে না কোনও অচেনা ব্যক্তির সঙ্গে, আশ্রয় নেবে না কোনও গৃহে। ঝড়-বৃষ্টি-মহাপ্লাবন যাই আসুক, সে শুধু অগ্রসর হবে দারুকেশরের দিকে।
একবার সে ভাবল, দাড়িগোঁফ মুণ্ডন করে ফেলবে। কিন্তু একটু পবেই সেমত পরিবর্তন করল। এই দাড়িগোঁফই এখন তার ছদ্মবেশ। নইলে দারুকেশ্বরে আবার যদি কেউ তাকে বংশীলাল বলে ভুল করে।
তার কাছে এখনও কিছু অর্থ আছে, তার খাদ্যাভাব হবে না। পান্না বসানো অঙ্গুরীয়টি সে আঙুল থেকে খুলে কোমরের কাছে গুঁজে রাখল। তারপর তিন দিন তিন রাত্রি সমানে পদব্রজের পর সে পৌঁছল দারুকেশরে।
সুরপতি নগবে প্রবেশ করল বিপরীত দিক দিয়ে। এদিক দিয়ে সেই সরাইখানার পথ খুঁজে পাওয়া শক্ত। তবুএকসময় সে এসে পৌঁছল রাজবৈদ্য বাসবদত্তের প্রাসাদের সামনে। এখানে থেকে তার আর পথ চিনে নিতে ভুল হবে না।
বাসবদত্তের প্রাসাদের সামনে যথারীতি অসংখ্য লোকের ভিড়। সকলেই কী একটা বিষয় নিয়ে গুঞ্জন করছে। সুরপতি একটু কাল দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনল।
লোকেরা বলাবলি করছে যে, রাজবৈদ্য বাসবদত্ত নিজে গুরুতর রকমের অসুস্থ। প্রতি দিন তার অবস্থার অবনতি হচ্ছে। দেশে আর এমন কোনও বৈদ্য নেই যে বাসবদত্তের চিকিৎসা করতে পারে। বাসবদত্ত অন্য কোনও চিকিৎসককে তার কাছেই ঘেঁষতে দেবেন না। তিনি ঘোষণা করেছেন যে, তার মৃত্যু রোধ করার ক্ষমতা কারুর নেই। এই অবস্থাতেও কিন্তু বাসবদত্ত রোগী দেখেন। এক সময় তাকে ধরাধরি করে ওপর তলা থেকে নিচে নামানো হয়। রোগীদের মধ্য থেকে তিনি বেছে মাত্র তিন-চার জনকে নিদান দেন। এবং এখনও তিনি ধন্বন্তরি। তার ওষুধে মুমূর্ষও খাড়া হয়ে ওঠে। এখন কথা হচ্ছে, রোগীদের মধ্যে কোন তিন-চার জন সে-রকম ভাগ্যবান।
সুরপতি রাজবৈদ্য বাসবদত্তের জন্য একটু দুঃখ বোধ কবল। যে-কোনও কারণেই হোক এই বিস্ময়কর মানুষটি সম্পর্কে তার একটা শ্রদ্ধাবোধ আছে। হায়, একবার এঁর চোখে পড়লেই সুভদ্রা সেরে উঠত। সুভদ্রা কি এখনও সেই রকম আছে?
সুরপতি বিষণ্ণ মনে ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল। সবাইখানাটি আর বেশি দূর নয়। তবু সেখানে যেতে সুরপতির এখন ভয় করছে। কী দেখবে সেখানে গিযে? যদি সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমাব ইতিমধ্যে-–!
সুরপতি বার বার থেমে যাচ্ছে, তবু এক সময় সে এসে পৌঁছল সরাইখানার সামনে।
সরাইখানাটি নতুন রঙ করা হয়েছে। সামনের আস্তাবলে অনেকগুলি বলবান অশ্ব বাঁধা। মনে হয় ওই সবঅশ্ব সৈনিক পুরুষদের। ভিতরে বেশ একটা সবব উৎসব চলছে মনে হয়। সুরপতিব গা ছম ছম করে উঠল। সব কিছুই কেমন যেন নতুন নতুন মনে হয়।
যে-ঘরটায় সুরপতিদের থাকতে দেওয়া হয়েছিল, সুরপতি আস্তে আস্তে সেই ঘরটির সামনে এসে দাঁড়াল। তক্ষুনি সেখান থেকে বর্মচর্মপরা দুজন সৈনিকপুরুষ বেরিয়ে এল, সুরপতির প্রতি সন্দেহজনক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তারা প্রশ্ন করল, মহাশয়ের কী চাই?
সুরপতি একটু সংকুচিত হয়ে পড়ল। বিনীতি ভাবে বলল, আমি বলভদ্রের সঙ্গে দু’একটি কথা বলতে এসেছিলাম।
বলভদ্র কে?
সুরপতি বিস্মিত ভাবে বলল, এইসরাইখানার মালিক!
মালিকের নাম তো জীবক। সে আবার বলভদ্র হল কবে থেকে?
সৈনিক দু’টি অবশ্য সুরপতিকে নিয়ে আর কালক্ষেপ করল না। তারা ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল।
সুরপতি হতভম্ব হয়ে গেল। এ আবার কী? বলভদ্রকে এরা কেউ চেনে না? জীবক আর বলভদ্র কি এক?
সে আর ভেতরে প্রবেশ করল না। তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এল। সেকারুর মনে কোনও রকম সন্দেহের উদ্রেক করতে চায় না।
সরাইখানার বাইরে একটি কলাইয়ের দোকান আছে। এই কশাইকে সুরপতি আগেও দেখেছে।
সে কশাইয়ের দোকানের পাশে একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর এক সময় নিরালা দেখে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করল, ভাই, এইসরাইখানার মালিক কি বলভদ্র নয়?
কশাই সুরপতিকে একটুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল। তারপর বলল, আপনি বুঝি অনেক দিন পর এদিকে আসছেন?
সুরপতি বলল, হ্যাঁ, পাঁচ-ছ’বছর পর হবে অন্তত।
কশাই বলল, এই সরাইখানা এক সময় বলভদ্রেরই ছিল বটে। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, দু-দুবার এই সরাইলুটপাট হয়ে যায়। জানেন না, ইদানীং দলভ্রষ্ট পাঠান-মোগল সৈনিকদের উৎপাত বড় বেড়েছে।
সুরপতি ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, বলভদ্র আর নেই?
সে এই সরাইখানা বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছে। শুনেছি, নগরীর উত্তর দিকে সে নতুন এক সরাইখানা খুলেছে।
কোন পথ দিয়ে সেদিকে যেতে হয়?
এই পিপুল গাছের পাশ দিয়ে যে-পথ, সেই পথ দিয়ে সোজা চলে যান, সামনে দেখবেন রাজপুষ্করিণী, তার দক্ষিণ দিক দিয়ে আবার রাস্তা —
সুরপতি তখুনি চলে যাচ্ছিল, আবার ফিরে এল। সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমারের কথা কি এই কশাই জানে? অত দিন আগেকার কথা কি এর মনে থাকবে?
তবু সে জিজ্ঞেস করল, ভাই, আর একটি কথা–এই সরাইখানাতে কি কোনও স্ত্রীলোক আর শিশু–।
কশাই তাকে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ভদ্র না পণ্যা?
ভদ্র রমণী, সঙ্গে একটি শিশু।
এখান এত সৈনিকের উৎপাত, এখানে কোনও ভদ্র রমণী থাকতে পারে? কেউ নেই। সৈনিকরা রাত্তিরের দিকে কিছু স্ত্রীলোক নিয়ে আসে বটে, কার ঘরের সর্বনাশ করে কে জানে। আমি সামান্য লোক, সে-খবর জানি না।
সুরপতি আর আপেক্ষা করল না। সে এক প্রকার ছুটতেই লাগল। বলভদ্রের সন্ধান পেলেই একমাত্র সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমারের কথা জানা যাবে।
খানিক দূর এসে সে বিশাল রাজপুষ্করিণী দেখতে পেল। এবার এর দক্ষিণ দিকে রাস্তা। সেদিকে যেতে গিয়েও সে একটি বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল।
বৃক্ষের গায়ে একটি ইস্তাহার ঝুলছে। তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা–
বংশীলাল! বংশীলাল! কুখ্যাত অপরাধী এবং কারা-পলাতক বংশীলালকে যে বা যারা জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় রাজসরকারে উপস্থিত করতে পারবে, তাকে বা তাদের এক সহস্র মুদ্রা পুরস্কার দেওয়া হবে।
সুরপতির গায়ে একটা শিহরণ বয়ে গেল। সে বংশীলাল নয়, কিন্তু বংশীলালের নামে ওই ঘোষণা দেখে মনে হল যেন তারই মৃত্যুদণ্ড। জীবিত অথবা মৃত। না, জীবিত অবস্থায় কেউ আর তাকে কারাগারে নিয়ে যেতে পারবে না।
সুরপতি নিজের মুখে হাত বোলাল। এত দাড়িগোঁফ ভেদ করে কেউ আর তাকে বংশীলাল বলে মনে করবে না। সে শুনেছে, বংশীলালের রোগা পাতলা চেহারা। সে-তুলনায় সুরপতি এখন অনেক সবল স্বাস্থ্যবান।
বংশীলালের সঙ্গে কি তার কোনও দিন দেখা হবে? মনে হয় যেন নিয়তিতে কোথাও বাঁধা আছে যে, একদিন সে বংশীলালের মুখোমুখি দাঁড়াবে, সব বোঝাঁপড়া হবে সেদিন।
দক্ষিণের রাস্তা দিয়ে এক ক্রোশ আসার পর সুরপতি দেখতে পেল একটি সরাইখানা। এটাই কি বলভদ্রের? হঠাৎ ভিতরে প্রবেশ না করে সুরপতি ভাবল, আগে একটু অনুসন্ধান করা যাক।
এইসরাইখানার সামনে একটি ছোট কুঠরিতে থাকে এক জন ক্ষৌরকার। সুরপতি তার সামনে গিয়ে কোনও প্রশ্ন করতে যাবে, এমন সময় সরাইখানা থেকে বেরিয়ে এল একটি নদশ বছরের বালক।
সুরপতির চিনতে এক মুহূর্ত দেরি হল না। তার পুত্র ধ্রুবকুমার।