ষষ্ঠ অধ্যায়
পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা
পাকিস্তান তাথা ভারত বিভাগের প্রস্তাব হিন্দুরা তাদের স্বার্থের পরিন্হী মনে করে মেনে নিতে পারেনা এবং তাই তারা তীব্র বিরোধিতা শুরু করে।পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ৬ই মে পুনাতে, বলেন,হিন্দু মহসভা এবং মুসলিম লীগের কোন ইতিবাচক কর্মসূচী নেই। তিনি পাকিস্তান প্রস্তাবকে নির্বুদ্ধতা বলে আখ্যয়িত করে বলেন, এ চব্বশি ঘন্টার অধিককাল টিকে থাকবেনা। হিন্দু মহাসভা ১৯ মে পাকিস্তান প্রস্তাবকে হিন্দু বিরোধী এবং জাতীয়তা বিরোধী বলে উল্লেখ করে।
কংগ্রেস ও হিন্দুজাতির চরম বিরোধিতা ও প্রতিবন্দ্ধকাত সত্ত্বেও পাকিস্তান আন্দোলন চলতে থাকে এবং হিন্দুদের বিরোধিতা ও অপপ্রচার মুসলমানদের ঐক্য সুদৃঢ় করতে থাকে।
পাকিস্তান আন্দোলকে জনপ্রিয় ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচারণার জন্যে মুসলিম ভারতের ইতিহাসে সর্বত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়, তা এই যে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের জামিলুদ্দীন আহমদকে আহবায়ক করে একটি লেখক কমিটি গঠন করা হয়। প্রখ্যাত প্রবন্দ্ধকারগণ বিভিন্ন প্রচারপত্র রচনা করেন এবং সেগুলো পাকিস্তান সাহিত্য অনুক্রম (Pakistan Literature series) নামে লাহোরের শেখ মুহাম্মদ আশরাফ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। জামিলুদ্দীন আহমদ বলেন, স্বাধীন পাকিস্তান এবং স্বাধীন হিন্দুস্তান বন্দ্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশে অবস্থান করতে থাকবে। ভারতীয় ঐক্য এক অলীক কল্পনা বিলাস এবং ঐতিহাসিক সত্যের পরিপন্হী। (I.H Qurshi The Struggle for Pakistan, o. 136)
পয়লা জুলাই, ১৯৪০ কায়েদে আযম শিমলা অবস্থানকালে ভাইসরয়ের নিকটে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করেন এবং প্রস্তাবগুলোকে “পরীক্ষামূক” বলে চিহ্নিত করেন। প্রস্তাবগুলো নিম্নরূপঃ
ভারত বিভাগ এবং উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের যে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়, তার মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক কোন বিবৃতি সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা যাবে না
ভারতের মুসলমানদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট নিশ্চিয়তা দান করতে হবে যে, মুসলিম ভারতের অনুমতি ব্যতিরেকে কোন অন্তর্বর্তীকালীন অথাবা চুড়ান্ত সাংবিধানিক স্কীম গঠন করা হবে না। ইউরোপে যেভাবে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে এবং ভারত বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে তাতে আমরা পুনোপুরি উপলদ্ধি করছি যে, যুদ্ধ প্রচেষ্টা তীব্রতর করা উচিত। যাতে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও শান্তি শৃংখলা নিশ্চত করা সম্ভব যদি বৃটিশ সরকার কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারসমূহে দেশ পরিচানার ক্ষেত্রে মুসলিম নেতৃত্বকে সমান অংশীদার হিসাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হন।
সাময়িকভাবে এবং যুদ্ধকালীন অবস্থায় নিন্মক্ত পদক্ষেপ করতে হবে যাতে সরকারের অধিকার এখতিয়ারে সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সরকারের সাথে সহযোগিতার ফরমুলা মেনে চলা যায়ঃ
ক. বর্তমান সাংবিধানিক আইনের আওতায় ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিন্স সম্প্রসারিত করতে হবে। আলোচনার পরই অতিরিক্ত সংখ্যা নির্ধারিত হবে। কিন্তু মুসলিম প্রতিনিধিত্ব অবশ্যই হিন্দুর সমসংখ্যক হতে হবে যদি কংগ্রেস যোগদান করেন। অন্যথায়
, অতিরিক্ত সদস্যদের অধিকাংশ মুসলমান হতে হবে। কারণ প্রধান গুরুদায়িত্ব মুসলমানদেরকেই বহন করতে হবে।
খ. যে সকল প্রদেশে আইনের ৯৩ ধারা বলবৎ, সেখানে নন- অফিসিয়াল উপদেষ্টা নিয়োগ করতে হবে। আলোচনার পর সংখ্যা নির্ধারিত হবে। তবে উপদেষ্টাগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতা মুসলিম প্রতিনিধিগণের হবে। কিন্তু যেসব প্রদেশে কোয়ালিশন সরকার আছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর দায়াত্বি হবে আলোচানার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
গ. প্রেসিডেন্টসহ পনেরো জনের একটি সমর কাউন্সলি (War Council) হবে। ভাইসরয় সভাপতিত্ব করবেন। এখনেও মুসলমানের সংখ্যা হিন্দুর সমান হবে যদি কংগ্রেস যোকদান করে।
সর্বশেষ কথা এই যে, সমর কাউন্সিলে, ভাইসরয়ের কার্যকরী কাউন্সিলে (Executive Ccouncil) এবং গভর্ণরের নন-অফিসিয়াল উপদেষ্টাদের মধ্যে যাঁরা মুসলিম প্রতিনিধি হবেন, তাঁদেরকে বেছে নেবে মুসলিম লীগ।
পয়লা জুলাই সুভাসচন্দ্র বোস গ্রেফতার হন এবং তেসরা জুলাই মিঃ গান্ধী বৃটেনের প্রতিটি নাগরিকের কাছে অহিংস নীতি অবলম্বন করে অস্ত্র পরিহারের আবেদন জানান। সাথে সাথেই দিল্লীতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার পুনর্দাবী করা হয়। সেইসাথে কেন্দ্রে একটি জাতীয় সরকার গঠনের দাবীও জানানো হয়।
মিঃ জিন্নাহ ভাইসরয়ের নিকট তাঁর যে পরীক্ষামূল (Tentative) প্রস্তাব পেশ করেন, সে সম্পর্কে ভাইসরয় ৬ই জুলাই তারিখে লিখিত তাঁর পত্রে তাঁর দৃষ্টভংগী মিঃ জিন্নাহকে জানিয়ে দেন।তিনি তাঁর কাউন্সিল সম্প্রসারণে সম্মত হন কিন্তু তার মধ্যে মুসলিম অংশীদারিত্ব অসম্মতি জানান। কাউন্সিলের মুসলিম সদস্যগণকে মুসলিম লীগ নমিনেশন দেবে এ দাবী মানতেও তিনি রাজী নন। কারণ, তিনি বলেন, এটা ভারত সচিবের অধিকার এবং কাউন্সিল সদস্যগণ রাজনৈতিক দলের মনোনীত হবেন না। প্রাদেশিক গভর্ণরদের নন- অফিসিয়াল উপদ্ষ্টে নিয়োগও তিনি মেনে নিতে পারেন না। ওয়ার কাউন্সিল (War Council) গঠনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।এর বিস্তারিত খুটিনাটি বিষয়গুলো নির্ধারিত করা হবে।
মিঃ জিন্নাহর পরীক্ষামূলক প্রস্তাবের শর্তাবলী প্রত্যাখ্যান করা হলো। কিন্তু অভিজ্ঞ রাজনীতিক মিঃ জিন্নাহ দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। তিনি তাঁর আলাপ আলোচানা অব্যাহত রাখেন।
ব্রিটিশ সরকারের আগস্ট প্রস্তাব
ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে মতানৈক্য এবং কংগ্রেসলীগ ও বড়োলাটের মধ্যে মতবিরোধের কারণে হতাশ হয়ে পড়েননি।১৯৪০ সালের ৮ই আগস্ট ব্রিটিশ সরকার যে ঘোষাণা দেন তা আগস্ট প্রস্তাব নামে অভিহতি করা হয়।এ ঘোষণায় কিছু নতুন ধারণা দেয়া হয়। প্রথমতঃ ইন্দোব্রিটিশ ইতিহাসে এই প্রথমবার ভারতীয়দের নিয়ে একটি গণপরিষদ গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।এ যাবত ব্রিটিশ পার্লান্টের ইচ্ছাই ছিল চুড়ান্ত এবং ভারত সরকার আইন ১৯৩৫ এ প্রাধান্য অনুমোদন করতো। এখন ভারতীয় গণপরিষদের ধারণা শুধু সমর্থনই করা হলোনা
, বরঞ্চ তা গঠনের প্রতিশ্রুতিও দেয়া হলো।দ্বিতীয়তঃ গণপরিষদ সম্পর্কে কংগ্রেসের ধারণা প্রত্যাখ্যান করা হয়। একথাও সুস্পষ্ট করে বলা হয় যে, গণরিষদ এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করবেনা যার দ্বারা সংখ্যালঘুদের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়। তৃতীয়তঃ ডমিনিয়ন স্টেটাসকেই ভারতের লক্ষ্য মনে করা হয়। এসব ব্যবস্থা গৃহীত হবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর। আগষ্ট প্রস্তাবের কিছু মন্দ দিকও ছিল যা লীগ ও কংগ্রেসের প্রস্তাবে তুলে ধারা হয়।
মিঃ জিন্নাহ ১২ই ও ১৪ই আগষ্ট উপরোক্ত প্রস্তাব নিয়ে মতবিনিময় করেন। তবে পয়লা ও দুসরা সেপ্টেম্বরে বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র মুসলিম লীগের অনুমোদন ব্যতীত প্রণীত হবে না এ দাবী মেনে নেয়ার মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। সেইসাথে এয়ার্কিং কমিটি এ কথা ঘোষণা করা যথার্থ মনে করে যে, কমিটি লাহোর প্রস্তাব ও তার শর্তাবলীর মূলনীতির উপর অবিচল আছে এবং তা এই যে, ভারতের মুসলমান একটি জাতি এবং তাদের ভবিষ্যৎ ভাগ্য নির্ধারণের অধিকারী তারাই। মধ্যেবর্তী ব্যবস্থার জন্যে সরকারের প্রস্তাব অসন্তোষজনক। মুসলিম লীগ এয়ার্কিং কমিটির ১৬ই জুনের দাবীগুলি মেনে নেয়া হয়নি। নিম্নলিখিত কারণে সরকারের আগস্ট প্রস্তাব মেনে যায় না বলে মুসলিম লীগরে পক্ষ থেকে ঘোষাণা করা হয়ঃ
১. বড়োলাটের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যার যে প্রস্তাব করা হয়, সে সম্পর্কে লীগ সভাপতি অথবা ওয়ার্কিং কমিটির সাথে কোন আলাপ আলোচানা করা হয়নি।
২. কাউন্সিল কিভাবে গঠিত হবে তার ধরন সম্পর্কে ওয়ার্কিং কমিটিকে অবহিত করা হয়নি।
৩. অন্য কোন দলের সাথে কাজ করতে লীগকে ডাকা হবে ও সম্পর্কে ওয়ার্কিং কমিটি অবহিত নয়।
৪. কাউন্সিলের নতুন সদস্যদের কোন কোন পদ (Portfolio) দেয়া হবে, সে সম্পর্কে লীগের কোন ধারনা নেই।
৫. যুদ্ধ উপদেষ্টা পরিষদ (War Advisory Council) সম্পর্কে যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তা অম্পষ্ট ও দুর্বোধ্য।
মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি তার সভাপতিকে এ ক্ষমতা দান করে যে, তিনি প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্র, যুদ্ধ উপদেষ্টা পরিষদের গঠন পদ্ধতি ও দায়িত্ব কর্তব্য এবং বড়োলাটের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের কলেবর বৃদ্ধি সম্পর্কে বড়োলাটের কাছে ব্যাখ্যা দাবী করবেন।
মিঃ জিন্নাহ ২০শে সেপ্টম্বর বড়োলাটের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং পরদিন বড়োলাটে লীগের উথাপিত প্রশ্নগুলির জবাব দেন। ২৮শে সেপ্টম্বর নয়া দিল্লীতে অনুষ্ঠিত লীগ ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশন বড়োলাটের জাবাব সম্পর্কে আলোচানা হয়। বড়োলাটের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয় বলে কমিটি অভিমত ব্যক্ত করে। সরকারের আগস্ট প্রস্তাব সম্পর্কে কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত তীব্র। কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ১০ই আগস্ট বড়োলাটের সাথে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকৃতি জানান। কংগ্রেস প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে। বলা হয়, সরকার ক্ষমতা ছাড়তে রাজী নন এবং প্রস্তাবটি সরাসরি দ্বন্দ্ব সংগ্রামে উন্ধন যোগাচ্ছে। সংখ্যালঘুদের বিষয়টি ভারতের উন্নতির পথে এক অলংঘ্য প্রতিবন্ধক।কংগ্রেসকে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করতে হবে বলে ভীত প্রদর্শন করা হয়।
সরকারের আগস্ট প্রস্তাব রাজিনৈতিক দল কর্তৃ গৃহীত হয়নি।কিন্তু এতে মুসলমানদের কিছু লাভ হয়েছে। ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায়,তা মধ্যবর্তী হোক অথবা চুড়ান্ত মুসলমানদের সন্তোষজনক অনুমোদন লাভ করা হবে বলে সরকার প্রতিশ্রুতি দান করেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক বছরের মধ্যে এবং লাহোর প্রস্তাবের পর পাঁচ মাসের মধ্যে সরকারের এ ধরনের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা মুসলিম লীগের কম কৃতিত্ব নয়।মুসলমানদের প্রতি কংগ্রেসের আচড়ণের ফলেই এ কৃতিত্ব লাভ হয়। কংগ্রেসের হাতে মুসলমানদের ভাগ্য ছেড়ে দেয়া সরকার সমীচীন মনে করেননি।
কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলন ও মুসলমান
মিঃ গান্ধী বড়োলাটে লর্ড লিনলিথগোর সাথে ২৭শে ও ৩০শে সেপ্টম্বর সাক্ষাৎ করেন ও তাঁর এ দৃষ্টভংগী মেনে নিতে পারেননি।তিনি বলেন, একজন বিবেকবান বিরুদ্ধবাদী যুদ্ধ করতে না পারেন, তিনি জনগণের কাছে তাঁর দৃষ্টিভংগী পেশ করতে পারেন। কিন্তু তাঁকে এ অনুমতি দেয়া যেতে পারেনা যে, তিনি অন্যকে যুদ্ধে বাধা দান করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করবেন। ১১ই অক্টোবর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে সত্যাগ্রহ শুরু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
গান্ধীজির নির্দেশে সর্বপ্রথম বিনোবা ভাবে গ্রেফতারীর জন্যে নিজেকে পেশ করেন। রাজা গোপালাচারিয়া এবং আবুল কালাম আজাদও কারাবরণ করেন। কংগ্রেসপন্থীদের ব্যাপক কারাবরণ সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন ভাবাবেগ সৃষ্টি করতে পারেনি। বিশেষ করে মুসলিম প্রদেশগুলিতে এ সত্যাগ্রহ মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। সারা ভারতের মধ্যে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সবচেয়ে ক্ষীণ সাড়া পাওয়া যায়। প্রথম দিকে ডাঃ খান এ আন্দোলনে যোগদান করতে অনীহা প্রকাশ করেন। কিন্তু ১৪ই ডিসেম্বর তাঁর গ্রেফতারী জনমনে শান্ত পরিবেশের উপর সামান্য তরংগ সৃষ্টি করে মাত্র।
একচল্লিশের এপ্রিলে মিঃ গান্ধী সকল কংগ্রেসীর জন্যে সত্যাগ্রহ উন্মুক্ত করে দেন। তার পলে প্রায় ২০,০০০ লোক স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন। কংগ্রেসের জন্যে এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। আন্দোলন ক্রমশঃ স্তিমিত হয়ে আসে।
কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলন মুসলমানগণ মেনে নিতে পারেননি। কারণ কংগ্রেসের দুরভিসদ্ধি তাঁরা বুঝতে পারেন। ১৯৪০ সালের নভেম্বর মাসে মিঃ জিন্নাহ দিল্লীতে প্রদত্ত তাঁর এক ভাষণে কংগ্রেসের দাবীর প্রতি উপহাস করে বলেন যে, কংগ্রেস আন্দোলন করছে স্বাধীনতার জন্যে।তাঁর কাছে এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে এ কথা পরিস্কার যে, কংগ্রেস সরকারকে ভীতি প্রদর্শন করে এক স্বীকৃতি আদায় করতে চায় যে কংগ্রেস ভারতবাসীর একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন। কংগ্রেসের মনোভাব হলোঃ ‘মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের দাবী প্রত্যাখ্যান করে আমাদের দাবী মেনে নাও।কংগ্রেস ক্ষমতা লাভ করতে চায় এবং চায় অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি বলপ্রয়োগের ক্ষমতা হস্তন্তরের জন্যে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বল প্রয়োগ করতে চায়।
একচল্লিশের ফেব্রুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে এবং এপ্রিলে অনুষ্ঠিত মাদ্রাজ মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে মিঃ জিন্নাহর ভাষণের সমর্থনে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় যে, সরকার যদি তাঁদের বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভংগ করে কংগ্রেসের দাবী মেনে নেয় তাহলে উদ্ভুত পরিস্থিতি মুকাবিলা করার জন্যে মুসলিম লীগ যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণে প্রস্তুত থাকবে
(The Struggle for Pakistan, Ishtiaq Hussain Qureshi, pp. 163-64)
লিবারাল পার্টি প্রস্তাব-১৯৪১
দুটি প্রধান দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নীতি পলিসি আলোচনার পর দেখা যাক ন্যাশনাল লিবারাল ফেডারেশন কি মনোভাব পোষণ করছে। আইন সভায় তাঁদের একটি ক্ষুদ্র দল আছে। তবে তাঁদের মধ্যে স্যার তেজ বাহাদুর সাপ্র, স্যার চিমনলাল শিতলবন্দ এবং স্যার শ্রী নিবাস শাস্ত্রর মতো অভজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোকও আছেন। তাঁদের দুষ্টিভংগী ও মনোভাব জানারও প্রয়োজন আছে। চল্লিশের ডিসেম্বরে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত তাঁদের বার্ষিক অধিবেশনে লিবারালগণ তাঁদের রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতির মূলনীতি মূলনীতি ঘোষণা করেন এবং তা সমাধানের ভিত্তি হিসাবে গৃহীত হবে বলে তাঁরা মনে করেন। এ বিষয়ে তাঁরা যে প্রস্তাব করেন তা নিম্নরূপঃ
১. যুদ্ধ প্রচেষ্টার প্রতি পূর্ণ সহায়তা দান।
২.যুদ্ধ শেষ হওয়ার দু’বছরের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা করা উচিত য
যে ভারত একটি ডমিনিয়ন হবে।
৩. কেন্দ্রীয় সরকাকে পুনগঠিত করতে হবে যাতে ভাইসরয় একটি পরিপূর্ণ জাতীয় সরকারের শাসনতান্ত্রিক প্রধান হতে পারেন।
৪. ভারত বিভাগ প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং সাম্প্র্রদায়িক নির্বাচন প্রথা ক্রমশঃ রহিত করতে হবে।
৫. কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলন দুঃখজনক। একচল্লিশের মার্চে লিবারালগণ বোম্বাইয়ে এক নির্দলীয় সম্মলনে মিলিত হন। সম্মেলনকে নির্দলীয় বলা হলেও তা ছিল হিন্দুমহাসভা প্রভাবিত এতে তিন চারজন মুসলমান অংশগ্রহণ করলেও তাঁরা মুসলিম স্বার্থে কোন কথা বলতে পারেননি। হিন্দু মহাসভার তিনজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি- সাভারকার ডাঃ মুঞ্জে ও ডাঃ শ্যমাপ্রসাদ মুখার্জি সম্মেলনে যোগদান করেন। তেজ বাহাদুর সাপ্র সভাপতিত্ব করেন এবং স্যার নৃপেন্দ্র নাথ সরকার কতিপয় প্রস্তাব পেশ করেন যা গৃহীত হয়। প্রস্তাবগুলি সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। এতে তথাকথিত লিবারালগণ উম্মা প্রকাশ করেন এবং ২৯শে জুন পুনায় ন্যাশনাল লিবারাল ফেডারেশনের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সংকট নিরসনের জন্যে তাঁদের উথপিত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার জন্যে সরকারের তীব্র সমলোচনার করা হয়। মুসলিম লীগের সম্মতি ব্যতিরেকে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ ভারত সচিবের অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের জন্যে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। ভারত বিভাগ প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয় এবং প্রস্তাবিত বিভাগ প্রতিরোধের জন্যে সকল ভারতবাসীর প্রতি আহবান জানানো হয়।
সাপ্রু প্রস্তাব বা সুপারিশের উপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে কায়েদে আযম মাহাম্মদ আলী জিন্নহ বলেন, কেন্দ্র একটি জাতীয় সরকার গঠনের যে দাবী কংগ্রেসের পক্ষ থেকে করা হয়েছে সাপ্রূ প্রস্তাব রহিত করার শামিল। ভারত সচিব এল এম অ্যামেরী ২২শে এপ্রিল ১৯৪১, হাউস অব কমন্স এ নম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, ভারতে যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা বিরাজ করছে তা এ জন্যে নয় যে, বৃটিশ ভারতের স্বাধীনতা দিতে রাজী নয়, বরঞ্চ এ জন্যে যে ভারত তার দাবীতে একমত হতে পারেনি। অধিকতর ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন ধরনের যে এক্সিকিউটিভের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা হিন্দু মুসলিম অনৈক্য প্রশামিত না করে অধিকতর বর্ধিত করবে, আমি সাপ্রুর মতো লোকের কাছে এ আবেদন রাখব যে, তাঁরা যেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।
গান্ধীর প্রতিক্রিয়া
ভারত সচিবের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন মিঃ গান্ধী। তিনি বলেন, অনৈক্যের জন্যে ভারতের স্বাধীনতা বিলাম্বিত হচ্ছে এ কথা বলে অ্যামেরী ভারতীয় জ্ঞানবুদ্ধির( Indian intelligence) অবমাননা করেছেন। ভারতের শ্রেণী বিভেদের জন্যে ব্রিটিশ রাজনীতিকগণই দায়ী। যতোদিন ব্রিটিশ অস্ত্রের মাধ্যমে ভারতকে পদানত রাখবে ততোদিন এ বিভেদ মতানৈক্য চলতে থাকবে। আমি স্বীকার করি যে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে দুর্ভাগ্যক্রমে এক দুর্লংঘ্য ব্যবধান রয়েছে। ব্রিটিশ রাজনীতিকগণ কে স্বীকার করেন না যে এ একটি ঘরোয়া বিবাদ (Domestic quarrel)? তারা ভারত ছেড়ে চলে যাকনা, তারপর আমি ওয়াদা করছি, কংগ্রেস, লীগ এবং অন্যান্য দল তাদের নিজেদের স্বার্থেই একত্রে মিলিত হয়ে ভারত সরকার গঠনের সমাধান বের করবে। ….বাইরের কোন হস্তক্ষেপ আহবান না করতে যদি আমরা একমত হই –তাহলে সম্ভবতঃ এ সংকট এক পক্ষকাল বিদ্যমান থাকবে। অন্য কথায় ব্রিটিশ ক্ষমতা ছেড়ে চলে গেলে, হিন্দুই যথেষ্ট শক্তিশারী হবে –সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনার জন্যে। গান্ধীজির এ কথা কারো বুঝতে বাকী থাকার কথা নয়। ১৯৪৭-এর জুলাই পর্যন্ত তিনি তাঁর এ কথার পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন। মুসলিম জাতির অস্তিত্ব সহ্য করতে না পারা এবং উপরোক্ত অশোভন উক্তি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠানকে ত্বরান্বিত করে।
প্রতিরক্ষা পরিষদ (Defence Council) গঠন
একচল্লিশের ২০শে জুলাই বোম্বাই-এর গভর্ণর স্যার রজার লিউমলী মিঃ জিন্নাহর নিকটে এ মর্মে ভাসরয়ের এক বাণী পৌঁছিয়ে দেন যে, ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদনক্রমে ভাইসরয় তাঁর এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল (Executive Council) অতিরিক্ত পাঁচটি কোর্ট ফাইলসহ বর্ধিত করার সিদ্ধান্ত করেছেন। নতুন পদ গ্রহণে যাঁরা সম্মত হয়েছেন তাঁরা হলেন স্যার হোসী মোদী, স্যার আকবর হায়দরী, আর রাও, এম এস এনী এবং স্যার ফিরোজ খান নূন। একই সাথে ত্রিশ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিরক্ষা পরিষদ (Defence Council) গঠনের কথাও বলা হয়। দেশীয় রাজ্য থেকেও দশজন সদস্য গ্রহণ করা হবে। এতে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব অপরিহার্য বিধায় বাংলা, আসাম, পাঞ্জাব এবং সিন্ধুর প্রধানমন্ত্রীগণকেও তিনি সদস্যপদ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েয়েছ।
পরের দিন মিঃ জিন্নাহ স্যার রজার লিউমলীর প্রত্রের জবাবে ভাইসরয়ের পদক্ষেপের প্রতি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, মুসলিম লীগের সভাপতি ও ওয়ার্কিং কমিটিকে ডিঙিয়ে এসব ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো নীতিবহির্ভূত হয়েছে। আগষ্টের ২৪,২৫ ও ২৬ তারিখে বোম্বাইয়ে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ তারিখের গৃহীত প্রস্তাবে পাঞ্জাব, বাংলা ও আসামের প্রধানমন্ত্রী যথাক্রমে স্যার সেকান্দার হায়াত খান, ফজলুল হক ও স্যার সা’দুল্লাহকে ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিল থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়।
আটজন মুসলমান প্রতিরক্ষা পরিষদে যোগদানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে পাঁচ জন সিকান্দার হায়াত, ফজলুল হক, সা’দুল্লাহ, বেগম শাহনেওয়াজ এবং ছাতারীর নবাব, লীগের নির্দেশক্রমে পাঞ্জাব, বাংলা ও আসামের প্রধানমন্ত্রীগণ ১১ই সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। ছাতারীর নবাব হায়ধরাবাদ এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভাপতি হওয়ার কারণে পূর্বেই পদত্যাগ করেন। বেগম শাহনওয়াজ এবং স্যার সুলতান আহমদ পদত্যাগ না করার জন্যে পাঁচ বছরের জন্যে লীগ থেকে বহিস্কৃত হন। লীগ ২৬ ও ২৭ তারিখের দিল্রীর বৈঠকে সেন্ট্রাল এসেম্বলীর গোটা অধিবেশন থেকে বাইরে আসার সিদ্ধান্ত করে। তদনুযায়ী ২৮ তারিখে মুসলিম লীগ দল হাউস থেকে ওয়াকআউট করে। তাঁরা অভিযোগ করেন যে, ব্রিটিশ সরকার কেন্দ্রে এবং প্রদেশে লীগকে তার সত্যিকার দায়িত্ব ও অধিকারের অংশীদারিত্ব প্রদানে অস্বীকার করেন। (The Struggle for Pakistan I.H. Qureshi, pp. 169-191)
অক্টোবরের মাঝামঝি ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সম্প্রসারণ সম্পন্ন করা হয়। একই দিনে অসহযোগ আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট বহু কংগ্রেসীকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়। কংগ্রেসের একটি অংশ প্রস্তাব করে যে, প্রদেশে আবার ক্ষমতাগ্রহণ করা হোক। কিন্তু মিঃ গান্ধী এতে সম্মত হননি।
এদিকে লীগের অবস্থা সংকটমুক্ত ছিলনা। কারণ যেসব দল তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে মনে করে তারা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। যদিও বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক প্রতিরক্ষা পরিষদ থেকে এস্তেফা দান করেন, তিনি তা করেছিলেন অনিচ্ছাকৃতভাবে। লীগ বিরোধীমহল তাঁকে পরোক্ষভাবে তাদের সমর্থনের নিশ্চয়তা দান করে। মুসলিম লীগের একটি দল ফজলুল হক সাহেবের লীগ থেকে বহিস্কার দাবী করে। অন্যটি নমনীয় হওয়ার পক্ষে ছিল। কায়েদে আযম স্বয়ং কিছু অবকাশ দানের পক্ষে ছিলেন যাতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে পারেন। ফজলুল হক দুঃখ প্রকাশ করে যে পত্র দেন তা লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে আলোচনার পর বিষয়টির পরিসমাপ্তি ঘটে।
কিন্তু বছরের শেষে মিঃ ফজলুল হক এবং তাঁর জনৈক সহকর্মী ঢাকার নবাব, বাংলার আইন পরিষদের লীগ দল থেকে বেরিয়ে কংগ্রেস এবং অন্যান্য হিন্দু দলের সংগে মিলিত হয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। পরিষদের ইউরোপিয়ান দলও তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে। নতুন কোয়ালিশন সরকার এ কথাই প্রমাণ করে যে, একদিকে কংগ্রেস এবং অপরদিকে ব্রিটিশ সরকার বংলায় মুসলিম লীগের প্রভাব বিনষ্ট করতে চান। লীগের পক্ষ থেকে ফজলুল হক সাহেবের কৈফিয়ৎ তলব করা হলে তিনি গড়িমসি করতে থাকেন। ফলে ১৯৪১ সালের ১১ই ডিসেম্বর ফজলুল হক সাহেবকে লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। (Creation of Pakistan Justice Sayed Shameem Husain Kadir, pp.226-27)