৬. পঞ্চম দিনে তিনশো শ্রমিক

পঞ্চম দিনে তিনশো শ্রমিক পাঠালেন মাই মেতাম্মা। এরা কেউই সন্ন্যাসী নয়, পাহাড়ী গ্রামগুলোর তরুণ অধিবাসী। সবাইকে নিয়ে দল গঠন করা হলো, প্রতি দলে থাকলো ত্রিশজন শ্রমিক। দলের নেতা নির্বাচন করা হলো একজন সন্ন্যাসীকে। বাঘ, সিংহ, মৌমাছি-এভাবে রাখা হলো দলের নাম। স্বেচ্ছাসেবক হয়ে এসেছে সবাই, একঘেয়ে লাগলেই পালাবে। তাই পারিশ্রমিক দেয়ার কথা ঘোষণা করলো নিকোলাস, কাজের বিনিময়ে সবাইকে রূপালি ডলার, অর্থাৎ মারিয়া থেরেসা দেওয়া হবে। একটা লোহার সিন্দুকে ভরে এ ডলার প্রচুর পরিমাণে নিয়েও এসেছে নিকোলাস।

ফ্রন্ট-এন্ডারের উঁচু সিটে বসে কলকাঠি নাড়লো ড্যানিয়েল, ট্র্যাক্টরের হাইড্রলিক বাহু তুলে নিল তারের জাল দিয়ে তৈরি প্রথম গ্যাবিয়ন। বোল্ডর ভর্তি পার্সেল, ওজন হবে কয়েক টন। সবাই যে যার কাজ ফেলে ডানডেরা নদীর কিনারায় জুড়ো হয়েছে দেখার জন্য। হলুদ ট্রাক্টর নিয়ে খাড়া পাড় বেয়ে সাবধানে নেমে যাচ্ছে ড্যানিয়েল, বিস্ময়সূচক গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। গ্যাবিয়ন শূন্যে ঝুলছে, নদীতে নেমে এলে ট্র্যাক্টর। বাধা পেয়ে খেপে উঠলো নদীর স্রোত, পেছনের চাকার চারপাশে ফণা তুলছে! কিছুই গ্রাহ্য করছে না ড্যানিয়েল, নদীর আরো গভীরে নেমে যাচ্ছে সে।

মেশিনার পেট ডুবে গেল পানিতে। সন্ন্যাসীরা গান ধরল, বাকি সবাই তালি দিচ্ছে। মেশিন লক করে ব্রেক কষলো ড্যানিয়েল, ভারী গ্যাবিয়ন নিচে নামিয়ে এনে খালাস করলো পানিতে, তারপর পিছিয়ে আনছে ট্র্যাক্টর। গ্যাবিয়ন সঙ্গে সঙ্গে ডুবে গেছে, তবে ছোট একটা ঘূর্ণি ওটার অবস্থান চিহ্নিত করছে। নদীর কিনারায় আরেকটা গ্যাবিয়ন তৈরি রাখা হয়েছে, হাইড্রলিক বাহু তুলে নিল সেটাকে।

চিৎকার করে শ্রমিদের কাজে ফিরতে বলল নিকোলাস। উপত্যকা ধরে এক লাইনে উঠতে শুরু করলো তারা। নিকোলাসের নির্দেশে কাজের সময় তারা শুধু ল্যাঙট বা নেংটি পরে আছ। প্রচণ্ড গরমে দরদর করে ঘামছে সবাই, কয়লার মতো কালো চামড়া চকচক করছে।

পাথরখনি থেকে পাথর বয়ে আসতে হচ্ছে নদীর কিনারায়, ওখানে তারের জালে ভরা হচ্ছে গ্যাবিয়ন।

*

যতোই কিনা ডলারের লোভ বা মারের ভয় দেখাও, সন্ন্যাসীরা কেউ রোববারে কাজ করবে না। রোববারে সারাদিন ঘুমোবে তারা। এর প্রস্তুতি হিসেবে প্রতি শনিবারে আগে ভাগেই কাজকর্ম শেষ করে ফেলে।

তো, শনিবার রাতে যখন সব কয়টা ভোস ভোস করে ঘুমাচ্ছে, নিকোলাসের চোখে কোনো ক্লান্তি নেই। কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না সে। শেষমেষ, একা একাই বাধের এলাকাটা দেখে এলো সে। ফিরে এসে দেখে, পুরোদস্তুর কাপড়-চোপড় পরে বসে আছে রোয়েন–তারও ঘুম আসে না।

কফি? আগুনের ধার থেকে নিকোলাসের জন্য কাপে কফি ঢাললো ও।

গতরাতে আমারও ঘুম হয় নি, স্বীকার গেল রোয়েন। একদম বাজে একটা স্বপন দেখেছি। একবার দেখলাম, মামোসের সমাধিতে গোলকধাঁধার মধ্যে হারিয়ে গেছি। সমাধি প্রকোষ্ঠ খুঁজছি-, একের পর এক দরজা খুলছি কিন্তু প্রতিটি কক্ষেই মানুষজন। একটা কক্ষে কাজ করছিল ডুরেঈদ–আমি দেখলাম–ও আমার উদ্দেশ্যে বলছে, চার ষাঁড়ের চাল মনে আছে তো? শুরু থেকে ওই নিয়মে খেলবে! এতো জীবন্ত, এতো সত্যি! আমি খুব চাইছিলাম ওকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। সাথে সাথেই বুঝলাম, ওকে আর কোনোদিনও

দেখতে পাবো না! ক্যাম্পফায়ারের আলোয় মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করছে। রোয়েনের চোখের পানি।

এমন বেদনাবিধুর অভিজ্ঞতা থেকে ওর এ সরিয়ে নেওয়ার অভিপ্রায়ে নিকোলাস বলল, অন্যান্য কক্ষে কাদের দেখলেন?

পরের রুমে ছিলেন নাহুত গাদ্দাবি। খুশির হাসি হেসে, তিনি বললেন, শিয়াল ধাওয়া করছে সূর্যকে! সাথে সাথে, তার চেহারা পাল্টে হয়ে গেল শিয়াল দেবতা আনুবিস–সমাধি দেব। এমন ডাকাডাকি শুরু করলো, ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম আমি।

নীরবে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে ওরা। শেষমেষ, রোয়েন বলে উঠলো, জানি, এ সবই উঠলোতু–অর্থহীন। কিন্তু পরের রুমে ফন শিলার ছিলেন। তিনি আকাশে উড়ে, ডানা ঝাঁপটে বললেন, পাখা মেলেছে শকুন, আর পতন ঘটছে অতিকায় পাথরের। ঘৃণায় ইচ্ছে হলো তাকে আঘাত করি, কিন্তু তা করার আগেই পালিয়ে গেল যে!

এরপর আপনি জেগে গেলেন? নিকোলাস বলে।

না। আরো একটা কক্ষ দেখেছি স্বপ্নে।

এবারে কে ছিল? চোখ নামিয়ে নিল রোয়েন, মৃদুস্বরে বলল, আপনি ছিলেন।

আমি? বলেন কি?

কিন্তু আপনি কিছু বলেন নি। বলে, লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো রোয়েন। দারুণ মজা পেল নিকোলাস।

কী করলাম আমি তখন?

কিছু না। মানে আপনাকে তা বলতে পারবো না। রোয়েনের চোখের সামনে এখনো ভাসছে দৃশ্যগুলো একেবারে জীবন্ত। নিকোলাসের সুঠাম-নগ্ন শরীরের সৌন্দর্য, গন্ধ–সব এসে যেনো ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইলো ওকে।

আরে, বলুনই না! কি করছিলাম? নিকোলাস শুনেই ছাড়বে!

না! দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে চট করে উঠে দাঁড়ায় রোয়েন, লজ্জায় মুখ লাল। এ প্রথম স্বপ্নে কাউকে ওমন করে দেখলো ও। অনুভব করলো চরম পুলক। ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে রোয়েন আবিষ্কার করেছে, ওর পাজামার নিচটা ভিজে গেছে।

আমাদের সামনে পুরো এক দিনের কাজ! এ কথাটাই মাথায় এলো মেয়েটার।

হ্যাঁ। এখান থেকে বের হবার উপায় খুঁজে পেতে হবে আমাদের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিকোলাস বলে।

*

প্রথম কয়েকদিন কাজের কোনো অগ্রগতি খালি চোখে ধরা পড়লো না। জালে আটকানো যতো বোল্ডারই ফেলা হলো সব বেমালুম হজম করে ফেলছে ডানডেরা। তারপর অবশ্য ধীরে ধীরে উঁচু হতে শুরু করলো বাঁধ। অমনি কাজের উৎসাহ বেড়ে গেল সবার। আরো দু দিন পর নদীর এদিক থেকে পানিতে বোল্ডার ফেলা অসম্ভব মনে হলো, এবার কাজ শুরু করতে হবে নদীর উপর থেকে।

শ্রমিকদের ঘন ঘন আসা-যাওয়ায় ডানডেরার অগভীর পয়েন্ট পর্যন্ত একটা রাস্তা তৈরি হয়ে গেল। ট্যাক্টরটাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওপারে, একশো লোক রশি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে গেছে। ওখান থেকে ড্যাম সাইটে আসার জন্য আরো একটা পথ তৈরি করতে হলো। তারপর থেকে প্রতিদিন কয়েক মিটার করে লম্বা হচ্ছে বাঁধটা, মাঝখানের ফাঁক ক্রমশ সরু হয়ে আসছে।

ওদিকে বাফেলল আর হাতি–শ্রমিকদের দুটো দল, ড্যাম সাইট থেকে দুশো : মিটার দূরে কঠিন পরিশ্রম করছে। জঙ্গল থেকে কেটে আনা গাছের কাণ্ড দিয়ে খেলনা তৈরি করছে তারা। গাছের কাণ্ড পাশাপাশি জোড়া লাগিয়ে হেভি পিভিসি দিয়ে মোড়া হচ্ছে, ওয়াটারপ্রুফ করার জন্য। কাঠামোটার উপর চাপানো হচ্ছে একই আকৃতির আরো একটা কাঠামো। দৈত্যকার একটা স্যান্ডউইচ তৈরি হলো, বাঁধা হলো মোটা তার দিয়ে। সবশেষে জোড়া লাগানো কাঠামোর একপ্রান্তে বোল্ডার ভরে ব্যালাস্ট তৈরি করা হলো। ভেলার একটা দিক ভারী করতে চেয়েছে ড্যানিয়েল, ওটা যাতে পানিতে প্রায় খাড়াভাবে ভেসে থাকে-একটা প্রান্ত নদীর তলায় আঁচড় কাটবে, অপরপ্রান্তটা ভেসে থাকবে সারফেসের উপর। এ ভেলা বাঁধের দুই বাহুর মাঝখানের ফাঁকে আলম্ব বা ঠেকনা হিসেবে কাজ করবে।

হাতি, মোষ আর গণ্ডার, এ তিনটে দল উপত্যকার মাথায় মাটি খুঁড়ে একটা খাল তৈরি করছে; নদী দিক বদলে ওই খালে ঢুকবে।

পনেরো দিনের দিন তৈরি হয়ে গেল বাঁধ। সেদিনই নতুন কাটা খাল বেয়ে ছুটলো ডানডেরা, কিছুদূর গিয়ে ছড়িয়ে পড়লো গোটা উপত্যকায়।

খালের পাড় ধরে রোয়েনকে নিয়ে হাঁটছে নিকোলাস, লম্বা উপত্যকার পুরোটা দৈর্ঘ্য পেরিয়ে এলো ওরা। অবশেষে সেই প্রবাহটার কাছে পৌঁছল দু জন, যে ঝরনার মেরের সঙ্গে এসেছিল ওরা-তামের হাত লম্বা করায় আঙুলে এসে বসেছিল রঙিন প্রজাপতি। পাড়ে এসে দাঁড়ালো ওরা, তারপর কথা না বলে পরস্পরের দিকে তাকালো। প্রবাহটা নেই, শুকিয়ে গেছে।

ঘুরে গিয়ে খালি ঝরনার তলা অনুসরণ করলো ওরা, ঢাল বেয়ে উঠছে। খানিক দূর ওঠার পর একটা কার্নিসে পৌঁছল, প্রজাপতি ঝরনার এখান থেকেই নির্গত হতো। গুহাটা এখনো গাঢ় সবুজ লতা গুল্মে ভরে আছে, তবে এখন দেখতে হয়েছে কঙ্কালের খুলির অক্ষিগোলকের মতো, অন্ধকার ও খালি।

ঝরনা শুকিয়ে গেছে! ফিসফিস করলো রোয়েন, নিকোলাসের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। বাধ তৈরি হওয়ার ফলে পানির সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেছে। এ থেকেই প্রমাণ হয় টাইটার পুল থেকেই এখানে পানি আসছিল!

আসুন, উত্তেজনায় রোয়েনের একটা হাত চেপে ধরলো নিকোলাস। এখানে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

কোথায়? রোয়েন অবাক। নিকোলাসের আরো কাছে সরে এলো ও।

কোথায় আবার, টাইটার পুলে। ফিসফিস করলো নিকোলাস।

*

টাইটার পুলে প্রথমে নামলো নিকোলাস। পাহাড়-প্রাচীরের মাথা থেকে নিচে নামার জন্য এবার চওড়া কপিকল ব্যবহার করা হচ্ছে, দোলনার মতো দেখতে রশির শেষ প্রান্তে কাঠের চেয়ার সহ। পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে ফুলে থাকা ঝুল পাথরটাকে এড়াবার সময় আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দুলতে শুরু করলো চেয়ার, পাঁচিল আর চেয়ারের মাঝখানে আটকা পড়লো ওর ডান হাতটা। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলো নিকোলাস, হাতটা ছাড়িয়ে আনার পর দেখলো একটা আঙুলের গিটের চামড়া উঠে গেছে, টপ টপ করে রক্ত ঝরছে ক্ষতটা থেকে। জখমটা তেমন গুরুতর নয়, মুখের ভেতর পুরে চুষে পরিষ্কার করে নিল। তারপরও অবশ্য রক্ত বের হচ্ছে, তবে এ মুহূর্তে আর কিছু করার নেই ওর।

জুল-পাথরটাকে ছাড়িয়ে এসেছে কপিকল, ওর নিচে উন্মুক্ত হয়ে পড়লো অতল গহ্বর, প্রায় অন্ধকার গা ছমছম করা পরিবেশ। পাথর পাঁচিলের গায়ে খোদাই করা নকশাটার উপর চোখ আটকে গেল, খাড়া দুই সারি কুলুঙ্গির মাঝখানে। কী খুঁজতে হবে জানে বলেই এবার পঙ্গু বাজপাখিটার আউটলাইন চিনতে পারলো ও। প্রায় এক মাস আগে গিরিখাদ ছেড়ে চলে যাবার পর মনে প্রায়ই একটা সংশয় জাগত যে ব্যাপারটা বোধহয় তাদের কল্পনা, পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে টাইটা নিজের কোনো প্রতীক চিহ্ন খোদাই করে নি, আবার ফিরে এলে দেখতে পাবে পাচিলটা মসৃণ ও নিষ্কলঙ্ক। কিন্তু না, ব্যাপারটা কল্পনা নয়। প্রতীক চিহ্ন একটা সত্যি আছে, সেই সঙ্গে আছে প্রতিশ্রুতি।

পায়ের নিচে গিরিখাদের তলায় তাকালো নিকোলাস, পুরের উপর জলপ্রপাতের ধারা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। উজানে তৈরি বাঁধের ভেতর দিয়ে জোয়ানো পানি এখনো নেমে আসছে, তবে খুব বেশি নয়। ওর নিচে হ্রদের লেভেল নাটকীয়ভাবে কমে গেছে, পাথর পাঁচিলের গায়ে পানির ভেজা ধাপ দেখে বোঝা গেল। এখন আরো পঞ্চাশ ফুট পাঁচিল পানির উপর রয়েছে। আরো আট জোড়া কুলুঙ্গি দেখা যচ্ছে পানির উপর। আগে যেখানে ওগুলোর কাছে যাবার জন্য সাঁতরাতে হয়েছে। নিকোলাসকে, এখন সেখানে প্রায় কোনো পানিই নেই।

তবে পুলটা পুরোপুরি পানি শূন্য হয়ে পড়ে নি। মাঝখানটায় এখনো কালো পানি জমে আছে, চারপাশে সরু কার্নিস। ওই কার্নিসেই নামলো নিকোলাস। বিচিত্র অভিজ্ঞতাই বলতে হবে। এখানে যখন শেষবার এসেছিল, পানির নিচের ফাটলটা ওকে টেনে নিতে চেয়েছিল ভেতরে, প্রাণ বাঁচাবার জন্য মরণপণ যুদ্ধ করতে হয়েছিল ওকে।

মুখ তুলে তাকালো নিকোলাস, গহ্বরের ওপরের স্তরে, রোদ যেখানে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। ও যেনো একটা মাইনশ্যাফটের তলায় রয়েছে। তলপেটের ভেতরটা খালি খালি লাগলো, স্যাঁতসেঁতে বাতাসে কেঁপে উঠলো শরীর। কপিকলের রশিতে ঝাঁকি দিল ও, উপর থেকে সেটা টেনে নিল ওরা। পিচ্ছিল পাথুরে কার্নিস ধরে পাহাড়-প্রাচীনের দিকে এগুলো নিকোলাস, ওখানে কুলুঙ্গির সারিগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

পাঁচিলের গায়ে ফাটলটার আকৃতি এখন পরিষ্কারই দেখতে পাচ্ছে নিকোলাস। ওই ফাটলই ওকে নিজের শ্যাওলা ভরা গলায় টেনে নিতে চেয়েছিল। পাচিলের গোড়ায় পানি জমে গেছে, গভীরতাও একটু বেশি, ফলে ফাটলট। প্রায় পুরোপুরি ডুবে আছে এখনো। সারফেসের উপর দেখা যাচ্ছে শুধু নেমে আসা কুলুঙ্গি সারির নিচে খিলান আকৃতির ফাটলটার ওপরের অংশ। বাকিটা পানির নিচে।

ক্যার্নিস ধরে পাঁচিল ঘেঁষে এগুচ্ছে নিকোলাস, ক্রমশ সরু হয়ে আসছে কার্নিস। পাঁচিল পিছ ঘষে এগুতে হচ্ছে ওকে, পায়ের গোড়ালি পানি ছুঁয়ে থাকছে। তারপর আর পানিতে না নেমে এগুবার উপায় থাকলো না। অথচ এখানে পানির গভীরতা সম্পর্কে ওর কোনো ধারণা নেই।

তবু পা শুকনো রাখার জন্যে সরু কার্নিসে উবু হয়ে বসলো নিকোলাস, একটা হাত পাঁচিলে রেখে ঝুঁকলো, অপর হাতটা দিয়ে ভোবা ফাটলটার নাগাল পেতে চাইছে।

গর্তটার ঠোঁট মসৃণ। কিনারাগুলো এতো বেশি সরল আর ফাটলটা এতো বেশি চৌকো, ধরেই নিতে হয় মানুষের তৈরি। শার্টের আস্তিন গুটাবার সময় নিকোলাস লক্ষ্য করলো, ওর আহত আঙুলটা থেকে এখনো রক্ত গড়াচ্ছে। তবে গ্রাহ্য না করে হাতটা ডুবিয়ে দিল পানির তলায়। নিচের দিকটা হাতড়াচ্ছে, ফাঁকটার সিল বা গোবরাট খুঁজছে। আঙুলের ডগায় কর্কশ পলস্তারা করা একটা ব্লক ঠেকলো। আরো ঝুঁকলো নিকোলাস, পানির নিচে বাইসেপের অর্ধেকটা ডুবে গেল।

অকস্মাৎ জ্যান্ত একটা প্রাণী, ক্ষিপ্র ও ভারী, ঠিক ওর চোখের সামনে পানির ভেতর পাক খেল, আঁতকে উঠে ঝট করে হাতটা পানি থেকে তুলে নিল নিকোলাস। প্রাণীটা ওর হাতের পিছু নিয়ে সারফেস পর্যন্ত উঠে এলো, ওর নগ্ন মাংসে লম্বা সূচের মতো দাঁত বসাতে চেষ্টা করলো। পলকের জন্য কুৎসিত ও ভীতিকর ব্যারাকুড়ার মতো মাথাটা দেখতে পেল ও, সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো আঙুলের ক্ষত থেকে বের হওয়া রক্তের গন্ধই ওটাকে আকৃষ্ট করেছে।

লাফ দিয়ে সোজা হলো নিকোলাস, সরু কার্নিসে টলমল করছে অক্ষত হাতে অপর হাতের বাহু খামচে ধরেছে। প্রাণীটার শুধু সামনের একটা দাঁত স্পর্শ করেছে ওকে, অথচ তাতেই ডান হাতের উল্টোপিঠের চামড়া যেনো ধারালো ক্ষুর দিয়ে চিরে দেওয়া হয়েছে। ওর পায়ের সামনে পানির উপর ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছে।

চোখের পলকে কালো পানি যেনো জ্যান্ত হয়ে উঠলো, জলজ প্রাণীর আকৃতি তীব্র উন্মাদনায় মোচড় খাওয়ায় আলোড়িত পানিতে ফেনা তৈরি হলো। পাঁচিল পিঠ সাঁটিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে নিকোলাস। আকৃতিগুলো অস্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছে ও, মোচড়ানো ও আঁকাবাঁকা ফিতের মতো, কোনো কোনটা ওর কব্জির মতো চওড়া, কালো আর চকচকে।

ঈল, বুঝতে পারলো নিকোলাস। ওর জানা আছে ট্রপিক্যাল ঈল এরকম দৈত্যাকারই হয়। বদ্ধ জলে আটকা পড়েছে ওগুলো, ছোট্ট জায়গায় সংখ্যায় খুব বেশি হওয়ায় সমস্ত মাছ ইতোমধ্যে সাবাড় করে ফেলেছে, ফলে খিদের জ্বালায় একেকটা রাক্ষসে পরিণত হয়েছে। শেষবার এখানে সাঁতার কাটার সময় ওর শরীর থেকে রক্ত ঝরেনি, সেজন্য ভাগ্যকে কৃতজ্ঞতা জানালো নিকোলাস।

গলা থেকে সূতি রুমালটা খুলে হাতের ক্ষতটা বাধলো। পাহাড়-প্রাচীরের ফাটলটা পরীক্ষা করা সম্ভব নয়, ঈলগুলো মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে এরই মধ্যে ওগুলোয় কী ব্যবস্থা করে যায় চিন্তা করে কেরেছে নিকোলাস।

ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো হ্রদের পানি। চেয়ার সহ কপিকলটা নেমে আসছে আবার। ফাটলের ভেতর কোনও টানেল পেলেন? চেয়ার তেকে জানতে চাইলো। রোয়েন। তারপর নিকোলাসের হাতে বাধা রুমালটা দেখে আঁতকে উঠলো। আরে রক্ত কেন? কীভাবে কাটলো?

রক্ত একটু বেশি বের হচ্ছে, তবে ক্ষতটা গভীর নয়, বলল নিকোলাস। কীভাবে হলো? রক্তে ভেজা রুমালের একটা কোণ ছিঁড়ে পানিতে ফেললো ও। দেখুন।

লম্বা আকৃতিগুলো পানিতে আলোড়ন তুলতে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো রোয়েন। একটা ঈল পানির উপর মাথা তুলে শরীরের অর্ধেকটা আছড়ালো সরু কার্নিসে, তারপর কয়েকটা মোচড় খেয়ে আবার অদৃশ্য হলো পানির নিচে। কি… কি ওগুলো?

বিশ্বস্ত দারোয়ান রেখে গেছে টাইটা, বলল নিকোলাস। আমরা যাতে পানির নিচে ফাটলটায় ঢুকতে না পারি।

*

বাঁশ দিয়ে নিকোলাস ও ড্যানিয়েল যে ভারাগুলো বানিয়েছে সেগুলো ঝুলে আছে প্রায় চার হাজার বছর আগে পাথর কেটে তৈরি করা কুলুঙ্গিতে গাঁথা অবস্থায়। টাইটা প্রতিটি কাঠামো জোড়া লাগিয়েছিল সম্ভবত গাছের বাকল দিয়ে তৈরি রশি দিয়ে, তবে ড্যানিয়েল ব্যবহার করছে হেভী-গজ গ্যালভানাইজ ওয়ায়্যার, ফলে অনেক লোকের ভার সহ্য করার মতো পোক্ত হয়েছে। বাঘ নামে শ্রমিকদের গ্রুপটা একটা চেইন তৈরি করলো, সমস্ত জিনিসপত্র আর ইকুইপমেন্ট হাতে হাতে নামতে শুরু করলো এক ভারা থেকে আরেক ভারায়।

খাদের নিচে প্রথমে নামানো হলো পোর্টেবল হোল্ডা ইএমফাইভ হানড্রেড জেনারেটর। পাহাড়-প্রাচীরের গোড়ায় ফ্লাডলাইট সাজানো হয়েছে আগেই, কানেকশন দেয়ার পর জেনারেটর চালু করতেই উজ্জ্বল আলো বহুদূরে তাড়িয়ে নিয়ে গেল ছায়াগুলোকে। ভারার উপর থেকে শ্রমিকদের হাততালি আর হাসির আওয়াজ ভেসে এলো। ফুয়েল বাঁচানোর জন্য একটু পরই অবশ্য বন্ধ করে দেওয়া হলো জেনারেটর।

জলমগ্ন ফাটলটার চারধারে গ্যাবিয়ন অর্থাৎ তারের জানে আটকানো বোল্ডার ফেলা হলো, এরপর বালতি করে শুরু হবে পানি সেচা। তার আগে সবাইকে ভারার উপর আশ্রয় নিতে বলল নিকোলাস, হ্রদের কিনারায় একা থেকে গেল ও সঙ্গে ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড ভরা একটা ব্যাগ। গ্রেনেডগুলো গেরিলা লীডার মেক মেক নিমুরের কাছ থেকে দান হিসেবে পেয়েছেও।

পিন খোলার সাত সেকেন্ড পর বিস্ফোরিত হলো ওগুলো হ্রদের মাঝখানে একের পর এক অনেকগুলো ছুঁড়ে দিল নিকোলাস। একটা করে ছেড়ে, কার্নিস ধরে যতটা সম্ভব দূরে সরে আসে, কানে হাত। শেষ গ্রেনেডটা বিস্ফোরিত হওয়ার পর হ্রদের কিনারায় ফিরে এসে নিকোলাস দেখলো অসংখ্য ঈল মারা গেছে, তবে আহত হয়ে মোচড় খাচ্ছে তারচেয়েও বেশি, বিস্ফোরণের ধাক্কায় হ্রদের পানি থেকে ডাঙায় উঠে এসেছে। ভারা থেকে নেমে এসে শ্রমিকরা মরা ও আধমরা ঈলগুলো তুলে যত্ন করে সাজিয়ে রাখছে দেখে নিকোলাস একজন সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করলো, আপনারা এগুলো খান?

পেটে হাত বুলিয়ে সন্ন্যাসী একগাল হাসলেন, ভারি স্বাদ!

একটা বাঁশ দিয়ে হ্রদের গভীরতা মাপল নিকোলাস, প্রায় সাত ফুট। গ্যাবিয়ন ফেলে পুলটাকে অর্ধচন্দ্র আকৃতিতে ঘিরে ফেলা হয়েছে, বালতি দিয়ে বাঘেরা পানি সেচতে শুরু করলো। পানির লেভেল নিচে নামছে, সেই সঙ্গে পাহাড়-প্রাচীরের গোড়ার পালটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে।

একটু পরই বোঝা গেল ফাটলটা প্রায় চৌকোই, তিন মিটারের মতো চওড়া, দুমিটারের মতো উঁচু। পাশ আর ছাদ পানির তোড়ে ক্ষয়ে গেছে, তবে পানির লেভেল আরো নিচে নামতে সুগঠিত পাথুরে ব্লক-এর অবশিষ্ট দেখতে পেল ওরা, ওগুলো সম্ভবত ফাটলটা বন্ধ করে রেখেছিল। চার প্রস্থ ব্লক এখনো অক্ষত রয়েছে, প্রাচীন রাজমিস্ত্রী ফাটলটার গোড়ায় যেখানে বসিয়েছিল, বাকিগুলো কয়েক হাজার বছরের বন্যায় ভেঙে গেছে, ঢুকে পড়েছে পেছনের টানেলে। ফলে আংশিক বন্ধ হয়ে আছে টানেলটা।

পুলে নামলো নিকোলাস। পানি এখনো হাঁটু সমান। ফাটলটার সামনে হেঁটে এসে খালি হাতে পাথুরে আবর্জনা সরাচ্ছে। রোয়েনও ধৈর্য ধরতে পারলো না, পুলে নেমে নিকোলাসের পাশে চলে এলো। টানেল বলেই তো মনে হচ্ছে! উত্তেজনায় ফিসফিস করলো ও। নাকি শ্যাফট? কিন্তু বাধাটা কেন? টাইটার ইচ্ছাকৃত নয় তো?

বলা কঠিন। নদীর মূল স্রোত থেকে প্রচুর আবর্জনা ঢুকেছে ভেতর। খানিকটা হতাশ দেখার নিকোলাসকে। আর্কিওলজির নিয়ম ধরে পথটা পরিষ্কার করতে হলে কয়েক সপ্তা লেগে যাবে। ও সব এখানে আমাদের পোষাবে না। আলো আর লোকবল যখন আছে রাতদিন হাত লাগিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে হবে কাজটা।

*

ওরা ডানডেরা নদীতে বাঁধ দিয়েছেন, হের ফন শিলারকে বললেন নাহুত গাদ্দাবি। হারপার নিকোলাসের ক্যাম্পে আমাদের স্পাই আছে, সেই রিপোর্ট পাঠিয়েছে। খাদের ভেতর তিনশো লোককে কাজে লাগিয়েছেন তিনি, ইকুইপমেন্ট আর সাপ্লাইয়ের পরিমাণও বিপুল। এমন কী একটা ট্র্যাক্টরও নিয়ে গেছেন।

ভুরু কুঁচকে জ্যাক হেলমের দিকে তাকালেন হের ফন শিলার, হেলম্ মাথা আঁকালো। গম্ভীর দেখালো জার্মান বিলিওনিয়ারকে। জরুরি স্যাটেলাইট মেসেজ পেয়ে আদ্দিস আবাবার চলে আসেন তিনি, ওখান থেকে জেট রেঞ্জার হেলিকপ্টারে চড়ে পৌঁছেছেন অ্যাবে গিরিখাদের উপর পেগাসাস বেস ক্যাম্পে, ঢালের চূড়ায়।

ডানডেরা নদীকে বাঁধ দিয়ে বাঁধা চাট্টিখানি কথা নয়, জানেন তিনি। অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা আবিষ্কার না করলে এতো বড় একা কাজে হাত দেবে না তার প্রতিপক্ষ হারপার নিকোলাস, এ ও তাঁর কাছে পরিষ্কার। ঠিক কোথায় বাঁধটা দেওয়া হয়েছে দেখতে চাইলেন তিনি। স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফের উপর একটা ক্রশ চিহ্ন আঁকলো হেলম। তাকে তিনি প্রশ্ন করলেন, কেন বাধ দিল ওরা? কারণটা ব্যাখ্যা করো, হেলম্।

প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে অনুমান পাল্টা অনুমান করার পর সবাই একমত হলো, পানির নিচে কিছু একটার নাগাল পেতে চেয়েছে নিকোলাস। তারপর প্রশ্ন উঠলো, বাঁধ এলাকার নিচে কী আছে? হেলম্ জানালো, বাঁধটার ঠিক নিচে নদী ঢুকে পড়েছে। সরু ও গভীর একটা নালার ভেতর। নালাটা আট মাইল লম্বা, শেষ মাথার ওপরে রয়েছে মঠটা। ওই নালার উপর দিয়ে হেলিকপ্টার নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব, তবু কয়েকবার গেছে হেলম। একবার তারা নিকোলাস আর ওঁর বান্ধবীকে নালার উপর উঁচু জমিনে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখেছে। কি করছিল ওরা? না, কিছু করছিল না, নালার উপর পাহাড়-প্রাচীরের মাথায় বসে ছিল শুধু। হেলিকপ্টারটা ওরা দেখতে পায়? হ্যাঁ, অবশ্যই, দেখতে পেয়ে নিকোলাস হাতও নাড়ে। হের ফন শিলার বললেন, তোমাদের আওয়াজ পেয়ে বসে পড়েছিল ওরা, তার আগে নিশ্চয়ই। ওখানে কিছু করছিল। তারপর সিদ্ধান্তে আসলেন, নিকোলাস বিশ্বাস করে ড্যামের নিচে খাদের ভেতর সমাধিটা আছে। হেলমকে জিজ্ঞেস করলেন, স্পাই লোকটা কখন আর কীভাবে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে?

হেলম্ ব্যাখ্যা করলো। ঢালের কয়েকটা গ্রাম থেকে কিছু কিছু সাপ্লাই গ্রহণ করছে নিকোলাস, খচ্চরের পিঠে মালপত্র চাপিয়ে ওদের ক্যাম্পে আসা-যাওয়া করছে কয়েকজন মহিলা। স্পাই লোকটা ওই মহিলাদের হাতে রিপোর্ট পাঠায়।

পরশুর মধ্যে রিপোর্ট করো আমাকে, বাঁধের নিচে কী করছে নিকোলাস, নির্দেশ দিলেন হের ফন শিলার। কনফারেন্স টেবিলের উল্টোদিকে বসা কর্নেল টুমা নগুর দিকে তাকালেন। এলাকায় কতজন লোককে আপনি ডিউটিতে রাখছেন?

তিনটে পুরো কোম্পানি, সব মিলিয়ে তিনশোর বেশি লোক, জবাব দিলেন কর্নেল নগু। সবাই অভিজ্ঞ যোদ্ধা।

কোথায় তারা? ম্যাপে আমাকে দেখান।

তাঁর পাশে চলে এলেন কর্নেল। একটা কোম্পানি এখানে। দ্বিতীয়টা ডেবরা মারিয়াম গ্রামে। তৃতীয়টা ঢালের নিচে, নিকোলাসের ক্যাম্পে হামলা চালাবার জন্য তৈরি হয়ে আছে।

আমার ধারণা হামলাটা এখুনি চালানো দরকার, নাহুত গাদ্দাবি বললেন।

শত্রুকে সময় দিতে নেই।

চুপ করুন! ধমক দিলেন হের ফন শিলার। আমি আপনার মতামত চেয়েছি? ম্যাপটা কিছুক্ষণ দেখার পর কর্নেলকে তিনি প্রশ্ন করলেন, গেরিলা কমান্ডারের সঙ্গে কতজন রয়েছে, জানেন? কী যেনো নাম তার, নিকোলাসকে সাহায্য করছে?

মেক নিমুর। এককোরো কম, সম্ভবত পঞ্চাশজন, বাধ আর ক্যাম্প পাহারা দিচ্ছে।

দু আঙুলের মাঝখানে ধরে কানের লতি মোচড়াচ্ছেন হের ফন শিলার। গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ পর তার ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি ফুটলো।

দ্বিতীয়বার যে পথে ইথিওপিয়ায় ঢুকেছে নিকোলাস, বেরিয়েও যাবে সেইপথে, গেরিলা কমান্ডারের সাহায্য নিয়ে, বললেন তিনি। ঢোকার সময় বৈধ পথ ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না, বেরিয়ে যাবার সময় আরো সম্ভব হবে না। কাজেই আমি চাই ওই পথে ডেবরা মারিয়াম কোম্পানিটাকে মোতায়েন করুন আপনি, কর্নেল নগু। নদীটার দুই দিকেই পাহারায় থাকুক তারা, মঠের নিচে। নিকোলাস যেনো উদ্ধার করা ট্রেজার নিয়ে সুদান সীমান্তে পৌঁছতে না পারে।

ইয়েস, গুড আইডিয়া! কর্নেলকে উল্লাসিত দেখালো।

আপনার বাকি লোককে ঢালের নিচে জড়ো করুন। গেরিলাদের চোখে ধরা পড়া চলবে না, তবে বাঁধ দখল করার জন্য তৈরি হয়ে থাকতে হবে। আমি নির্দেশ দিলেই যাতে হামলা শুরু করতে পারে।

হামলাটা কখন শুরু করব আমরা?

নিকোলাসের উপর কড়া নজর রাখা হবে, বললেন হের ফন শিলার। আর্টিফ্যাক্ট সরাতে শুরু করলে আমরা জানতে পারব। অনেকগুলোই এতো বড় হবে যে লুকানো সম্ভব নয়। তখনই হামলা করব আমরা। ওরা চুরি করছে, আমরা ওদের উপর বাটপারি করব।

*

টানেলের মুখ পরিষ্কারের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। শিফটিং পদ্ধতিতে কাজ চলছে, নতুন শিফট শুরু হওয়ার আগে ড্যানিয়েলের স্টীল টেপ নিয়ে টানেলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে নিকোলাস। শেষবার মাপার পর বলল, একশো বিশ ফুট পরিষ্কার করা হয়েছে। সাবাশ, হানশিত শেরিফকে বলল ও। হানশিত শেরিফ স্বেচ্ছাসেবী সন্ন্যাসীদের ফোরম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।

টানেলের মেঝে এখনো তির্ষক একটা পথ ধরে নিচের দিকে চালু হয়ে আছে। ফ্লাডলাইটের আলোয় টানেলের প্রবেশ মুখটা এখন পরিষ্কারই চৌকো দেখাচ্ছে। টানেলটা যে একজন ইঞ্জিনিয়ারের নকশা ধরে তৈরি করা হয়েছে, এখন আর হাতে কোনো সন্দেহ নেই। পায়ের কাছে পানি কাদায় পড়ে থাকা একটা জিনিস দেখতে পেয়ে কুঁকলো নিকোলাস, দু আঙুলে ধরে ফ্লাডলাইটের আলোয় পরীক্ষা করলো।

টানেল থেকে বেরিয়ে এলো নিকোলাস হাসতে হাসতে। পুলটাকে ঘিরে থাকা নিচু পাঁচিলের উপর বসে রয়েছে রোয়েন, জিনিসটা ওকে দেখালো। ছো দিয়ে নিকোলাসের হাত থেকে নিয়ে নিল রোয়েন, চিৎকার করে উঠলো, ওহ, সুইট মেরি! নিকোলাস, এ আপনি কোথায় পেলেন?

কাদায় পড়েছিল, বলল নিকোলাস। চার হাজার বছর ধরে। জিনিসটা চিনতে পারছেন কী? মদের পাত্র ছিল এক কালে, তারই ভাঙা একটা টুকরো। সম্ভবত টাইটার কোনো শ্রমিকের হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায়।

মৃৎপাত্রের টুকরোটা হাত দিয়ে ঘষে চুমো খেলো রোয়েন। আমরা যে ঠিক পথ ধরে এগুচ্ছি, এটা তার আরেকটা প্রমাণ।

পরবর্তী শিফটের কাজ দু ঘণ্টা চলার পরই শেষ বাধাটা অপসারিত হলো, হৈ চৈ শুনে টানেলের ভেতরে ঢুকে নিকোলাস দেখলো বড় একটা বোল্ডার এক পাশে সরিয়ে আনার পর সামনে একটা ফাঁক তৈরি হয়েছে। পাঁচিলের এ জানালার ভেতর টর্চের আলো ফেললো ও। খালি ও কালো শূন্যতা ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। পিছিয়ে এসে হানশিত শেরিফের পিঠ চাপড়ে দিল ও। প্রত্যেকের জন্য এক ডলার করে বোনাস। তবে কাজ চালিয়ে যাও, সমস্ত আবর্জনা সরিয়ে ফেলতে হবে। আবর্জনা সরাতে আরো দু শিফট লাগলো। ফাঁকটা বড় হওয়ার পর দেখা গেল সামনে একটা গুহা রয়েছে।

গুহা মানে বিরাট একটা গর্ত। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার দশ ফুট নিচে পানি দেখা যাচ্ছে, চারপাশে গোলাকার ও খাড়া পাচিল। টর্চের আলোয় দেখা গেল ছাদে কয়েকটা ফাটল তৈরি হয়েছে, সম্ভত কোনো এক কালে পাথর ধসে পড়েছিল। গুহা বা গর্তের ওপারে কালো ছায়া ছাড়া কিছুই দেখা যায় না, দূরত্ব হবে একশো ফুট বা আর কিছু বেশি।

পানিতে না নেমে এ বাধা পেরুনো সম্ভব নয়। ত্রিশ ফুট লম্বা একটা বাঁশ এনে গভীরতা মাপার চেষ্টা করা হলো, কিন্তু থই পাওয়া গেল না। এর মানে? নিকোলাসকে জিজ্ঞেস করলো রোয়েন, বিহ্বল দেখাচ্ছে ওকে।

আমার ধারণা, এটা একটা ন্যাচারাল ফল্ট, বলল নিকোলাস। পানিকে পথ দেখিয়ে পাহাড়ের দিকে নিয়ে গেছে, সারফেসে আবার বেরিয়েছে সেই প্রজাপতি ফোয়ারায়। নদী আসলে নিজেই নিজের পথ খুঁড়ে নিয়েছে।

পানি তাহলে জমে আছে কেন?

শ্যাফটে একটা বাঁক থাকায়, সম্ভবত, বলে নিচের পানিতে টর্চের আলো ফেললো নিকোলাস। আলোয় আকৃষ্ট হয়ে সারফেসের দিকে উঠে এলো একটা ঈল, দেখে আঁতকে উঠলো রোয়েন।

গুহাটার ওপারে আরেক বার টর্চের আলো ফেললো নিকোলাস। গর্তটা যদি পাথর ধসে তৈরি হয়ে থাকে, টাইটার টানেল তাহলে তো গুহার ওপারেও থাকার কথা। আছেও, যদিও ওর চোখে নয়, ধরা পড়লো রোয়েনের চোখে। ওটা কি, চৌকো ফাঁকটা?

মুচকি হেসে নিকোলাস বলল, ওটাই আমি খুঁজছিলাম। এ টানেলেরই অংশ ওটা।

আমরা ওপারে যাব কীভাবে? রোয়েন উদ্বিগ্ন।

আশপাশে প্রচু বেওবাব গাছ আছে, ওগুলোর শুকনো কাঠ খুব হালকা, বলল নিকোলাস। ভাসমান একটা ব্রিজ বানাতে কতক্ষণই বা লাগবে।

*

জুলুরা বলে–এনকুলু-কুলু তাঁদের মহান দেবতা, বেওব্যাব গাছকে উল্টো করে মাটিতে গেঁথেছেন, শ্বাস্তি হিসেবে। নিকোলাস জানালো রোয়েনকে।

কেনো? বেওব্যাব গাছের এমন শাস্তি কোনো? কী এমন করেছিল এ গাছ? রোয়েন জানতে চায়।

নিজেকে জঙ্গলের সবচেয়ে উঁচু আর মোটা গাছ বলে বেশ গর্ব ছিল তার। তাই এনকুলু-কুলু এ শাস্তি দিলেন।

সেই বেওব্যাব গাছের কাণ্ড পাশাপাশি পানিতে ফেলে তার দিয়ে বাঁধা হয়েছে, ভাসমান সেতু পেরিয়ে সিঙ্কহোল-এর ওপারে প্রথমে পৌঁছাল নিকোলাস, তারপর ওর পিছু নিয়ে রোয়েন। টানেলের দ্বিতীয় অংশের মুখে দাঁড়ালো দু জন, ভেতরে টর্চের আলো ফেলার সঙ্গে সঙ্গে দুই অংশের পার্থক্যটা ধরা পড়লো চোখে। মুল স্রোতটা নিশ্চয়ই সিঙ্কহোল দিয়ে বেরিয়ে যেত। টানেলের দ্বিতীয় অংশের মাপ প্রথমটার মতোই-তিন মিটার চওড়া, দুই মিটার উঁচু। তবে চৌকো আকৃতি আরো বেশি স্পষ্ট। পাঁচিল আর ছাদ কর্কশ হলেও, এগুলোকে আকৃতি দেয়ার জন্য, যে টুলস ব্যবহার করা হয়েছে তার চিহ্ন পরিষ্কার চোখে পড়লো। পায়ের নিচে টানেলের মেঝে চ্যাপ্টা পাথর ফেলে তৈরি করা হয়েছে, পলেস্তারার কাজ এখনো সবটুকু ক্ষয়ে যায় নি। টানেলের পুরোটা দৈর্ঘ্য জলমগ্ন ছিল, পানি সরে যাবার পরও পিচ্ছিল হয়ে আছে শ্যাওলায়। ভেতরের বাতাসে পচা একটা গন্ধ ভেসে আছে। ড্যানিয়েল তার টেনে নিয়ে এসে আলো জ্বালার ব্যবস্থা করলো। ওরা দেখলো, দ্বিতীয় অংশের শ্যাফট ক্রমশ উপর দিয়ে উঠে গেছে।

টাইটা প্রথমে টানেলটাকে নিচে নামিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছিল, পরে আবার ওপরে তুলেছে, মন্তব্য করলো রোয়েন, হাসছে। নিকোলাসের পাশে রয়েছে ও, দু জনেই শ্যাফট ধরে সাবধানে এগুচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপ গুনছে নিকোলাস।

একশো দশ কদম হাঁটার পর দাঁড়িয়ে পড়লো ওরা। সামনের টানেল ভিজে নয়, মেঝে ও পাঁচিল শুকনো খটখটে। আরো পঞ্চাশ পা এগুলো ওরা, পাঁচিলের দাগ দেখে বোঝা গেল বন্যায় সময়ও এ লেভেলে পানি উঠত না। এদিকের মেঝে ও পাঁচিল চার হাজার বছর আগে মিশরীয় ক্রীতদাসরা যেভাবে তৈরি করে রেখে গেছে এখনো ঠিক তেমনি আছে। ব্রোঞ্জের তৈরি বাটালির দাগগুলো এতো তাজা, মনে হচ্ছে মাত্র কয় দিন আগে কাজ শেষ করে ফিরে গেছে তারা। আরো দশ গজ এগুবার পর একটা পাথুরে ল্যান্ডিঙে পৌঁছল ওরা। মেঝে এখানে সমতল। টানেল এখানে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে, একশো আশি ডিগ্রী কোণ ঘুরে।

পানির লেভেল এখান পর্যন্ত কোনদিনই উঠবে না, এ কথা টাইটা জানলে কীভাবে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস। তখনকার দিনে নিখুঁত মাপজোকের জন্যে কোনো যন্ত্রপাতি ছিল না, অথচ হিসেবে তার এতোটুকু ভুল হয় নি।

কেন স্ক্রোলে তো সে বারবার বলেছে, আমি একটা জিনিয়াস। তার দাবি স্বীকার করে নিতে হয়, বলল রোয়েন।

পাশাপাশি একশো আশি ডিগ্রী বাকটা ঘুরলো ওরা। হাতের ইলেকট্রিক ল্যাম্পটা উঁচু করে ধরে আছে নিকোলাস, পেছনে কেবল ঝুলছে। সামনের দিকটা আলোকিত হয়ে উঠতে বিস্ময়সূচক একটা আওয়াজ করলো রোয়েন, নিকোলাসের খালি হাতটা খামচে ধরল। দাঁড়িয়ে পড়লো দু জনেই, অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।

টানেলের নিচের যে অংশটা ওরা পেরিয়ে এসেছে সেটা তৈরি করার সময় তেমন একটা যত্ন নেওয়া হয় নি, দেয়াল আর মেঝে এবড়োখেবড়ো ছিল, ছাদে ছিল ফাটল। তার মানে টাইটা জানত নিচের লেভেলটা পানিতে ডুবে থাকবে, তাই সৌন্দর্য বাড়ানোর কোনো চেষ্টা করে নি।

এখন ওদের সামনে থেকে ওপরে উঠে গেছে একটা চওড়া সিঁড়ি। একটু তির্যক ভঙ্গিতে উঠেছে, ফলে সিঁড়ির মাথাটা দেখা যাচ্ছে না। প্রতিটি ধাপ টানেলের পুরো প্রস্থের সমান লম্বা, পুরো এক হাত চওড়া। চকচকে, মসৃণ পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ধাপগুলো, এতো নিখুঁত কাজ যে জয়েন্টগুলো চোখে পড়ে না। নিচের অংশের টানেলের চেয়ে এ দিকের টানেলের ছাদ তিনগুণ বেশি উঁচু, সারি সারি গম্বুজের মতো দেখতে, প্রতিটি গম্বুজের মাপ সমান। দেয়াল আর ছাদের গম্বুজে আবরণ হিসেবে বসানো হয়েছে নীল এ্যানিট ব্লক। তবে কোথাও কোনো অলঙ্করণ চোখে পড়লো না।

নিকোলাসের হাতে মৃদু চাপ দিল রোয়েন। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো ওরা। ধামগুলো মিহি ধুলোয় ঢাকা, নরম আর ট্যালকম পাউডারের মতো সাদা। কিছু দূর ওঠার পর সিঁড়ির মাথাটা দৃষ্টিপথে চলে এলো। নিকোলাসের হাতের তালুতে নখ ঢুকিয়ে দিল রোয়েন। সিঁড়িটা শেষ হয়েছে আরেকটা ল্যান্ডিঙে, ল্যান্ডিঙের ওপারে চারকোনা একট দরজা দেখা যাচ্ছে। ল্যান্ডিং পেরিয়ে দরজাটার সামনে দাঁড়ালো ওরা। বিরল এক শুভ মুহূর্ত উপস্থিত ওরা যেনো নিঃশব্দে অনন্ত কাল ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলো, পরস্পরের হাত শক্ত করে ধরে আছে। পৃথিবীর আর কোনো মানুষের সাথে এ মুহূর্ত ভাগাভাগি করতে কোনোদিনও চাইতো না নিকোলাস, চোখ তুলে রোয়েনের মুখে তাকিয়ে দেখলো একই অনুভূতি।

নদীর সাদা মাটি দিয়ে প্লাস্টার করা দরজা, দেখে মনে হলো আইভরি দিয়ে মোড়া। কোথাও কোনো দাগ নেই, যেনো ত্রুটি হীন কোনো কুমারীর ত্বক। সাদা প্লাস্টারের মাঝখানে এমবস করা একজোড়া সীল রয়েছে। ওপরের সীলটার আকৃতি চৌকো একটা গিট, মুড়ে রেখেছে শিং-ওয়ালা গুবরে পোকা। বৃত্তাকার শিং অনন্ত কাল বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। এটা রাজকীয় একটা প্রতীক চিহ্ন। লেখাগুলো, হায়ারোগ্লিফিকস, পড়লো রোয়েন, তবে নিঃশব্দে।

সর্বশক্তিমান। ঐশ্বরিক ও স্বর্গীয়। মিশরীয় নিম্ন ও উচ্চ রাজ্যের শাসনকর্ম। দেবতা হোরাস-এর ঘনিষ্ঠ। ওসিরিস আর আইসিসি-এর প্রিয়পাত্র। মামোস, তিনি যেনো চিরজীবী হন!

রাজকীয় বর্ণমালার নিচে ছোট আরেকটা ডিজাইন রয়েছে, বাজপাখির আকৃতি, ভাঙা ডানা সেঁটে আছে বুকে, আর লেখাগুলো-আমি, ক্রীতদাস টাইটা, আপনার নির্দেশ পালন করেছি, স্বর্গীয় ফারাও। পঙ্গু বাজপাখির নিচে আর মাত্র একটা লাইন দেখা গেল, তার অর্থ করলে দাঁড়ায়-আগন্তুক! দেবতারা দেখছেন! রাজার চিরকালীন বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটালে চড়া মাশুল দিতে হবে।

*

দরজার সীল ভাঙা বিশাল একটা কাজ এবং সময় সাপেক্ষ, অথচ বর্ষা শুরু হওয়ার আগে হাতে অল্প যে সময় আছে তা দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। দরজা ভেঙে সমাধির ভেতর ঢোকার প্রস্তুতি নিতে মূল্যবান একটা দিন বেরিয়ে গেল। স্বভাবতই সমাধি এলাকার নিরাপত্তা বিধান নিকোলাসের প্রথম উদ্বেগ। সিঙ্ক-হোলের উপর ভাসমান সেতুর মুখে মেককে সশস্ত্র প্রহরার ব্যবস্থা করতে বলল ও, এ সীমা রেখার সামনে বাড়া নিষিদ্ধ করা হলো। সেতু পেরুতে পারবে সব মিলিয়ে মাত্র নয়জন-নিকোলাস, রোয়েন, ড্যানিয়েল, মেক, টিসে আর চারজন সন্ন্যাসী।

লোহার টানেল পরিষ্কার করার কাজে হানশিত শেরিফ বারবার নিজের বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছে, ফলে আগেই তাকে প্রধান সহকারি হিসেবে বেছে নিয়েছে নিকোলাস। সিদ্ধান্ত হলো, এখন থেকে যা কিছু আবিষ্কার করা হবে প্রতিটির রেকর্ড রাখা চাই। তেপায়া ও স্পেয়ার ক্যামেরা ইকুইপমেন্ট নিয়ে হাজির হলো হানশিত, অ্যাপ্রোচ টানেল আর সীল করা দরজার ফটো তুললাম নিকোলাস। ফটো তোলার কাজ শেষ হতে দরজা ভাঙার টুলস নিয়ে আসার জন্য হানশিতকে অনুমতি দিল ও।

সিঙ্কহোল পর্যন্ত সরিয়ে আনা হয়েছে জেনারেটর, ফ্লাডলাইট জ্বেলে সিঁড়ির উপরের ল্যান্ডিং আর দরজাটা আলোচিত করার ব্যবস্থা হলো। টৌকো আকৃতির প্লাস্টার যে টুকু কাটা হবে তা চিহ্নিত করে নিয়েছে নিকোলাস, তা আগে টাইটার সতর্কবাণীর অনুবাদ শুনিয়ে দিয়েছে ড্যানিয়েল, মেক আর টিসেকে। কেউই ওরা ব্যাপারটাকে হালকা ভাবে নেয় নি।

দরজার গা থেকে দুটো সালই অক্ষত অবস্থায় তুলে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

প্রথমে প্রোব হিসেবে বড় সূচ ব্যবহার করা হলো। প্লাস্টারের নিচে কী আছে সেটা জানাই উদ্দেশ্য। একটু পরই জানা গেল প্লাসাটারের নিচে রয়েছে নল খাগড়ার ছিলকা দিয়ে নিখুঁতভাবে বোনা কয়েকটা স্তর। রোয়েন বলল, ওই বুননই প্লাস্টারকে খসে পড়তে দেয় নি। লম্বা সূচটা গায়ের জোরে আরো ভেতরে ঢোকালো নিকোলাস, এক পর্যায়ে ওটা আর ঠেকল না কোথাও, অপর দিকে বেরিয়ে গেছে ডগা। দরজার কবাট ছয় ইঞ্চি চওড়া, জানালো নিকোলাস। চার কোণে চারটে খুদে ফুটো তৈরি করা হলো। সরে এসে হানশিতকে জায়গা ছেড়ে দিল ও, তুরপুন দিয়ে ফুটোগুলোকে বড় করার কাজে হাত দিল সে।

গর্তগুলো বড় হওয়ার পর হানশিতকে সরিয়ে দিয়ে ভেতরে তাকালো নিকোলাস। অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখার নেই। তবে প্রাচীন বদ্ধ বাতাস লাগলো মুখে। গন্ধটা শুকনো, উগ্র। আলোটা দাও! ড্যানিয়েলকে বলল ও। ড্যানি স্যাপার ওর হাতে ল্যাম্পটা ধরিয়ে দিল।

কী দেখছেন? রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। বলুন আমাকে! রঙ! ফিসফিস করলো নিকোলাস। চোখ ধাঁধানো বিচিত্র সব রঙের বাহার! সরে এসে কোমর ধরে রোয়েনকে উঁচু করলো ও। ফাঁকাটায় চোখ রাখলো রোয়েন।

কী সুন্দর! চেঁচিয়ে উঠলো সে। কী সুন্দর!

*

হেভী-ডিউটি ইলেকট্রিক ব্লোয়ার ফ্যান চালু করলো ড্যানি স্যাপার, শ্যাফটের বাতাস চারদিকে ছড়িয়ে দেবে। দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকার সময় রোয়েন ছাড়া আর কাউকে থাকতে দেবে না নিকোলাস, সবাইকে পাঠিয়ে দিল ভাসমান সেতুর কাছে। ওর হাতে একটা চেইন-স রয়েছে দু জনেই মাস্ক আর গগলস পরে নিল।

তুরপুন দিয়ে বড় করা ফুটো থেকে হেন-শ কাজ শুরু করলো, প্লাস্টার ও নিচের ছিলকার বুনন নরম কেকের মতো কেটে ফেলছে। চৌকো ফাঁকটা তৈরি হতে খুব বেশি সময় লাগলো না। জোড়া সীলসহ প্লাস্টারের চারকোনা টুকরোটা সাবধানে কবাট থেকে আলাদা করে নিল ওরা। এবার ফাঁকের ভেতর ফ্লাডলাইটের আলো ফেললো নিকোলাস। ভেতরে এখন ধুলোর মেঘ তৈরি হয়েছে, কিছুই দেখা গেল না। হ্যাঁচ গলে ভেতরে ঢুকলো নিকোলাস, তারপর রোয়েনকে ঢুকতে সাহায্য করলো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো দু জন, ব্লোয়ার ফ্যান ধুরোর মেঘ সরিয়ে দেয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে গেল ধুলো, তারপর প্রথমেই ওদের চোখ পড়লো পায়ের নিচে মেছের উপর। মেঝে এখানে পাথরের ফলক দিয়ে তৈরি নয়, হলুদ আকিক পাথরের টানলো দিয়ে মোড়া, পালিশ করা চকচকে, আর এমন কৌশলে জোড়া লাগানো যে জয়েন্টগুলো দেখা যায় না। স্বচ্ছ ও অবিচ্ছিন্ন কাঁচের একটা চাদর বলে মনে হয়, স্লান দেখাচ্ছে শুধু যেখানে মিহি ধুলো জমেছে। ওদের পা লেগে ধুলো খোনে সরে গেছে, ফ্লাডলাইটের আলো পড়ায় ঝলমল করছে আকীক। ওদেরকে ঘিরে থাকা ধুলো আরো পাতলা হয়ে এলো, সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে ফুটছে বিচিত্র বর্ণ আর আকৃতি। মাস্ক খুলে আকিক মেঝেতে ফেলে দিল রোয়েন। নিকোলাসও তাই করলো। প্রাচীন, অস্বাস্থ্যকর বাতাসে নিশ্বাস নিল ওরা। বাতাস এখানে কয়েক হাজার বছর আটকে আছে। ছাতা ধরা গন্ধ, লিনের ব্যান্ডেজ আর সুবাসিত লাশের ঘ্রাণ পেল ওরা।

ধুলো পুরোপুরি সরে যেতে লম্বা ও সোজা একটা প্যাসেজওয়ে দেখতে পেল ওরা, শেষ প্রান্তটা ছায়া আর অন্ধকারে লুকিয়ে আছে। হ্যাঁচ দিয়ে গলিয়ে স্ট্যাডসহ ফ্লাডলাইটটা ভেতরে নিয়ে এলো নিকোলাস। প্যাসেজটার পুরো দৈর্ঘ্য এবার আলোচিত হয়ে উলঠ।

পাশাপাশি এগুচ্ছে ওরা, প্রাচীন দেবতাদের ছায়া ও মূর্তি চারদিকে থেকে ঝুঁকে রয়েছে ওদের উপর। দেয়াল থেকে চোখ রাঙাচ্ছেন তারা, বিশাল চোখে আক্রোশ ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন সিলিং থেকে। রোয়েনকে নিয়ে ধীরে পায়ে এগুচ্ছে নিকোলাস। আকিক টাইলের উপর ধুলো জমে থাকায় পা ফেলায় কোনো শব্দ হচ্ছে না। বাতাসে ভেসে থাকা ধুলো আলোকিত জালের মতো লাগছে, পরিবেশে এনে দিয়েছে অলৌকিক স্বপ্নরাজ্যের ভাব। প্রতি ইঞ্চি দেয়ালে আর ছাদে লিপি বা নকশা দেখা যাচ্ছে সবই দীর্ঘ উদ্ধৃতি, বুক অব ব্রিদিংস, বুক অব দা পাইলনস ও বুক অব উইজডম থেকে নেয়া। অন্যান্য হায়ারোগ্লিফিক্স ফুটিয়ে তুলেছে মর্ত্যলোকে ফারাও মামোসের অস্তিত্বের ইতিহাস, সদগুণের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, যে কারণে দেবতাদের ভালোবাসা পেয়েছিলেন তিনি।

আরো খানিক সামনে লম্বা ফিউনারাল গ্যালারি দেখতে পেল ওরা, আটটা শ্রাইন-এর পথমটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। শ্রাইন হলো লাশের দেহাবশেষ বা জীবিতকালে তার ব্যবহার করা জিনিসপত্র স্মৃতি হিসেবে রাখার বাক্স। প্রথমটা ওসিরিস-এর শ্রাইন। বৃত্তকার একটা চেম্বার, দেয়ালে ঈশ্বরের প্রশংসা লিপিবদ্ধ করা, কুলুঙ্গিতে ওসিরিস-এর খুদে মূর্তি, চোখগুলো আকীক মনি আর স্ফটিক পাথর দিয়ে তৈরি, এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন যে চোখাচোখি হতেই শিউরে উঠলো রোয়েন। হাত বাড়িয়ে দেবতার গোড়ালি ছুঁলো নিকোলাস, একটা মাত্র শব্দ উচ্চারণ করলো, সোনা।

তারপর মুখ তুলে তাকালো টাওয়ারের মতো উঁচু দেয়ালচিত্রের দিকে, শ্রাইনের চারদিকে ছড়িয়ে আছে, উঠে গেছে গম্বুজ-আকৃতির ছাদে। পাতাল রাজ্যের অধিপতি পিতা ওসিরিস-এর আরেকটা দৈত্যাকার ফিগার, মুখটা সবুজ, নকল দাড়ি, বাহু জোড়া বুকে ভাঁজ করা, হাতে বাঁকা লাঠি, মাথায় লম্বা হেড-ড্রেস বা মুকুট, মুকুটের কপালে ফণা তোলা গোক্ষুর। সচল ধুলোর মধ্যে দেবতাকে জ্যান্ত মনে হলো, ওদের চোখের সামনে যেনো নড়াচড়া করছেন।

প্রথম শ্ৰাইনের সামনে বেশিক্ষণ থামলো না ওরা। গ্যালারিটা তীরের মতো লম্বা হয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। পরবর্তী শ্রাইন দেবীর প্রতি উৎসর্গিত। কুলুঙ্গিতে বসে আছেন আইসিস, বসে আছেন সিংহাসনে, এ সিংহাসনই তার প্রতীক চিহ্ন। শিশু হোরাস স্তন পান করছেন। দেবীর চোখ আইভরি আর নীল ল্যাপিস ল্যাজুলি।

কুলুঙ্গির চারপাশ দখল করে আছে দেয়ালচিত্র, শিল্পীর আঁকা তাঁরই ছবি। এখানে জননী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে তাঁকে, সুর্মা টানা কালো রাতের মতো চোখ, মাথায় সান ডিস্ক আর পবিত্র গরুর শিং। তার চারপাশের দেয়াল হায়ারোগ্লিফিক্স সঙ্কেত, এতো উজ্জ্বল যে জোনাকি পোকার মতো জ্বলছে। একশো নাম তাঁর, কখনো অ্যাসট তিনি, কখনো নেট বা বাস্ট। পটাহ, সেকের, রেনাট নামেও ডাকা হয় তাঁকে। প্রতিটি নাম এককটা শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।

পরবর্তী শ্রাইনে রয়েছে হোরাস-এর মূর্তি, এ-ও সোনার তৈরি, মাথাটা বাজপখির। ডান হাতে ধনুক, বাঁ হাতে ইংরেজি হরফটি আকৃতির ক্রস। জীবন মৃত্যুর দেবতা তিনি। তাঁর চোখ লাল রত্ন। মূর্তির চারপাশে তারই বিভিন্ন বয়েসের দেয়ালচিত্র। শিশু হোরাস আইসিস-এর স্তন পান করছেন। তরুণ হোরাস ঋজু ও গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। তারপর, বাজপাখির মুখ নিয়ে অন্য এক রূপে হোরাস, শরীরটা কখনো সিংহের, আবার কখনো বীরযোদ্ধার, মাথার মুকুট। তাঁর নিচে হায়ারোগ্লিফিক্স-মহান দেবতা এবং স্বর্গের প্রভু, বহু গুণের অধিকারী, সমস্ত দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তিধর, যে শক্তি তার স্বর্গীয় পিতা ওসিরিস-এর শত্রুকে পরাভূত করেছিল।

চার নম্বর শ্রাইনে দাঁড়িয়ে আছেন সেথ, শয়তান, ধ্বংস আর যুদ্ধের দেবতা। তারও শরীর সোনার তৈরি, তবে মাথাটা কালো হায়েনার।

পঞ্চম শ্রাইনে রয়েছেন লাশ আর কবরের দেবতা, আনুবিস, মাথাটা শিয়ালের। লাশের দেখাশোনা করেন তিনি, বিশাল দাঁড়িপাল্লায় হৃৎপিণ্ড ওজন করার সময় নিক্তির কাটা পরীক্ষা করেন। পাল্লা দুটো যদি সমান সমান হয়, মৃত ব্যক্তির গুরুত্ব ও মূল্য আছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়, কিন্তু যদি একদিকের পাল্লা তার বিরুদ্ধে এক চুলও নিচে নেমে থাকে, আবিস তার হৃদয় দৈত্যাকার কুমীরকে খেতে দেন।

তারপর তথ-এর শ্রাইন। ইনি ভাষা বা লিখন-এর দেবতা, মাথাটা পবিত্র সারস জাতীয় পাখির, হাতে কলম। সপ্তম শ্রাইনে চার পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন পবিত্র গাভী হ্যাঁথোর, গায়ের রঙ সাদা ও কালো, মুখটা মানুষের মতো, তবে কান দুটো ট্রাম্পেট আকৃতির। অষ্টম শ্রাইন আকারে সবচেয়ে বড়, তিনি সমস্ত সৃষ্টির জনক আমন রা। তিনি সূর্য; প্রকাণ্ড সোনার বৃত্ত, সোনালি রশ্মি ছড়াচ্ছেন।

এখানে দাঁড়িয়ে পেছন দিকে তাকালো নিকোলাস। আটটা পবিত্র শ্রাইন ট্রেজার হিসেবে এতো গুরুত্বপূর্ণ, এরকম মূল্যবান প্রত্ন নিদর্শন এর আগে আবিষ্কার হয়েছে কিনা সন্দেহ। টাকার অঙ্কে এগুলোর কি দাম হতে পারে ভাবতে গিয়ে চিন্তাশক্তি লোপ পাবার অবস্থা হলো ওর। ওজন দরে সোনা বিক্রি করলে কী দাম পাওয়া যাবে সেটা বের করা সহজ কাজ, কিন্তু প্রাচীন এ শিল্পকর্মের মূল্য তার চেয়ে শত বা সহস্র গুণ বেশি হবে। তাছাড়া, সবে মাত্র শুরু ট্রেজারের কয়েকটা মাত্র নমুনা দেখতে পেয়েছে ওরা। না জানি সামনে আর কত কি আছে।

চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দিয়ে গলিপথের শেষ মাথায় বিশাল চেম্বারের দিকে ঘুরলো নিকোলাস।

সমাধি, ফিসফিস করলো রোয়েন।

ওরা সামনে বাড়ছে, সেই সঙ্গে পিছিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার। এখন ওরা সমাধির ভেতরটা দেখতে পাচ্ছে। ওটার দেয়ালও চিত্ৰশোভিত, প্রতিটি বিচিত্র বর্ণ থেকে যেনো আগুনের মতো আভা ফুটে বের হচ্ছে। দীর্ঘ এক মানুষের ছবি দেয়াল ধরে সিলিং পর্যন্ত পৌঁছেছে। ওটা দেবী নাট-এর নমণীয়, সর্পিল দেহ, সূর্যের জন্ম দিচ্ছেন। তার ভোলা জরায়ু থেকে সোনালি কিরণ বের হচ্ছে, ফারাও-এর অলকৃত পাথুরে শবাধারকে আলোকিত করছে, মৃত রাজাকে দান করছে নতুন জীবন।

চেম্বারের ঠিক মাঝখানে রাখা হয়েছে রাজকীয় শবাধার, বিশাল এক কফিন, প্রকাণ্ড এক নিরেট গ্র্যানিট থেকে কেটে বের করা। এতো বড় আর অসম্ভব ভারী কফিনটা জলমগ্ন টানেল দিয়ে বয়ে আনতে কতজন ক্রীতদাস লেগেছে, ভাবতে গিয়ে তাজ্জব বনে গেল নিকোলাস।

তারপর কফিনের ভেতর তাকালো ও আর তাকিয়েই হতভম্ব হয়ে গেল। শবাধারটা খালি। প্রকাণ্ড গ্র্যানিট ঢাকনি তুলে ফেলা হয়েছে, তুলে এমনভাবে এক পাশে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে যে পুরোটা প্রস্থ জুড়ে ফাটল ধরেছে ওটায়, এ মুহূর্তে দু ভাগ হয়ে পড়ে রয়েছে কফিনের পাশের মেঝেতে।

ধীর পায়ে সামনে বাড়লো ওরা, হতাশার তিক্ত স্বাদের সঙ্গে ধুলো মিশছে জিভে। একেবারে কাছে এসে কফিনের ভেতর চারটে জার-এর ভাঙা টুকরো দেখলো ওরা। পাত্রগুলো তৈলস্ফটিক দিয়ে তৈরি, রাজার নাড়িভূঁড়ি, লিভার ও শরীরের অন্যান্য ভেতরকার অঙ্গ রাখার জন্য। ভাঙা ঢাকনিতে দেবতা আর অবাস্তব প্রাণীদের মাথা অলঙ্করণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

ফাঁকা! ফিসফিস করলো রোয়েন। রাজার লাশ গায়েব হয়ে গেছে।

*

দেয়ালচিত্রের ফটো তুলতে কয়েকটা দিন ব্যয় হলো। দেবতা ও দেবীদের মূর্তিও বাক্স বন্দি করা হলো এ সময়। কাজের ফাঁকে খালি শবাধার নিয়ে আলোচনা করলো নিকোলাস ও রোয়েন। রোয়েন বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, সমাধির গেটের সীল তো ভাঙা হয় নি।

ওটার একটা ব্যাখ্যা আছে, নিকোলাস তাকে বলল, সম্ভবত টাইটা নিজেই সমাধি থেকে রাজার শরীর আর ট্রেজার সরিয়ে রেখেছিল। সপ্তম স্ক্রোলের বহু জায়গায় এমন বিপুল পরিমাণ সম্পদের অপচয়ে দারুণ হতাশ ছিল সে। বলেছিল, তার চেয়ে দেশ ও জাতীর কল্যাণে ব্যবহৃত হতে পারতো এ সম্পদ।

মানতে পারলাম না, রোয়েন জেদ ধরে। এতো কষ্ট করে, নদীর উপর বাঁধ দিয়ে পুলে নামার রাস্তা বন্ধ করলো, এমন জটিল ফাঁদের মধ্যে সমাধি মুখ বানালো, আর এরপর সে কিনা রাজার সমাধি নষ্ট করে ফেলবে? হতেই পারে না। টাইটা অন্তত বিচক্ষণ ব্যক্তি, নিজের মতো করে মিশরে দেব-দেবীদের আরাধনা করতে সে। ওমন গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ সে কিছুতেই সরিয়ে রাখবে না। এ সমাধির কিছু একটা ব্যাপার আমার এখনো বোধগম্য নয়, কেমন যেনো অদ্ভুত–ফারাও-এর দেহ নেই, দেয়ালচিত্রগুলোও কেমন যেনো।

ফারাও-এর বডির কথা না হয় মানলাম, কিন্তু ছবিগুলোকে কেনো অদ্ভুত বলছেন? নিকোলাস জানতে চায়।

ঠিক আছে, দেখাচ্ছি, এক হাত দিয়ে আইসিস-এর ছবিটা ইঙ্গিত করলো রোয়েন। সুন্দর আঁকা–সন্দেহ নেই, দারুণ কোনো শিল্পীর কাজ। কিন্তু ওগুলোর মধ্যে যত্নের ছাপ কম। কেমন যেনো কাঠখোট্টা আঁকা–জীবন্ত নয়, কখনোই মনে হয় না, একজন জিনিসের সৃষ্টি। রাণী লসট্রিসের সমাধির যেখানে আমরা অ্যালাবাস্টারের জারে স্ক্রোলগুলো খুঁজে পেয়েছিলাম সেগুলোর তুলনায় এরা কিছুই না।

চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে দেয়ালচিত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করছে নিকোলাস। মনে হয়, ঠিক বলেছেন। এমনকি, মঠে ট্যানাসের সমাধির আঁকাও এরচেয়ে অনেক অভিজাত।

ঠিক তাই! খুশি মনে বলে রোয়েন। ওগুলো টাইটার নিজের হাতের পেইন্টিং। কিন্তু এগুলো তার নয়–কোনো একজন নকলবাজের।

চিত্রের কোন বার্তা আপনার কাছে অপছন্দনীয় লাগছে?

এমন কোনো মিশরীয় সমাধির কথা শুনেছেন, যেখানে মৃতের পুস্তক থেকে কোনো উদ্ধৃতি নেই? যেখানে স্বর্গের সাতটি প্রবেশদ্বার মৃতব্যক্তি কেমন করে পার হবেন–তার কোনো বর্ণনা নেই?

এখান থেকে আপনি জেনি বাদেনহোর্সটের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন কীভাবে?

মাথা নিচু করে ভাবছে নিকোলাস। কিছু না বলে রোয়েনের কাছ থেকে সরে এলো ও। মেয়েটার কথা নিয়ে একান্তে ভাবা প্রয়োজন। সমস্ত ট্রেজার প্যাকিং করা তদারকি করার ফাঁকে ফাঁকে ওটা নিয়েই ভাবতে চাইছে সে।

ছয়টা পবিত্র মূর্তি বড়ো বড়ো বাক্সে এঁটে গেল, কিন্তু দেবী হ্যাঁথোর এবং দেবতা সেথ-এর মাথাটা বিশেষ বড়ো হয়ে গেছে বাক্সের জন্য। নিকোলাসের ধারণা, এ দুই অংশ আলাদা ভাবে তৈরি করা হয়েছিল। সেথ-এর মাথা আলাদা করা সম্ভব। ধীরে ধীরে কাঠের পেরেক খুলে অংশে অংশে আলাদা করা হলো বিশাল মূর্তিদ্বয়।

নিকোলাসের পর্যবেক্ষণের সমানে হানশিত সুসম্পন্ন করলো প্যাকিং। সব কিছু গোছানো শেষ হতে রোয়েনের কাছে ফিরে নিকি দেখলো, শূন্য শবাধারের কাছে বসে দেয়াল লিখন পড়ছে মিশরীয় সুন্দরী।

আপনি ঠিক বলেছেন, সায় দিয়ে বলল নিকোলাস। এখানে মৃতের পুস্তক থেকে কোনোই উদ্ধৃতি নেই। ব্যাপারটা অদ্ভুত। কিন্তু কী করার আছে আমাদের? এ রহস্য, রহস্যই থাকবে।

নিকি, ব্যাপারটা এতো সহজ নয়। আমার পুরো সত্তা বলছে–আমরা কিছু একটা মিস করছি।

আমি বেচারা মাথামোটা, একজন সুন্দরী-বিদূষী নারীর ইন্সটিঙ্কট নিয়ে কেনো প্রশ্ন তুলবো?

জ্বালাবেন না। এখন বলুন, এ সমাধির হায়ারোগ্লিফিকস্ নিয়ে কতোটা সময় কাজ করতে পারবো আমি?

খুব বেশি হলে দুই সপ্তাহ। জেনির সাথে রেডিও যোগাযোগ করতে হবে আমাকে। ও আমাদের রোসেইরেস এয়ারস্ট্রিপ থেকে তুলে নেওয়ার কথা। এর কোনো অন্যথা করা যাবে না।

আরে, আগে কেননা যোগাযোগ করেন নি? রোয়েন বলল অবাক হয়ে। এখন কি করে যোগাযোগ করবেন?

ডেবরা মারিয়ামে একটা পাবলিক টেলিফোন আছে, পোস্ট অফিসে, হেসে বলল নিকোলাস।

টিসে তো গোজামের যে কোনো জায়গায় অনায়েসে ঘোরাফেরা করতে পারে। একদল সন্ন্যাসী থাকবে এসকর্ট হিসেবে, এসকাপমেন্টে উঠে ব্রিটিস এমব্যাসির জিওফ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করবে টিসে, জিওফ্রে মেসেজটা পৌঁছে দিবে জেনির কাছে।

কবে যাবে টিসে?

মেক বলেছে, কাল। মাল্টা থেকে প্লেন নিয়ে রওনা হবার জন্য জেনিকে সময় দেওয়া দরকার, কিন্তু প্লেন পৌঁছতে দেরি হলো, কিংবা প্লেন পৌঁছল, আমরা পৌঁছতে দেরি করলাম-এরকম হলে বিপদ ঘটতে পারে। সঠিক টাইমিং হতেই হবে।

*

পয়লা এপ্রিল ভোরবেলা, টিসেকে মেসেজটা দিল নিকোলাস। জেনিকে তুমি বলবে, এপ্রিল ফুলস ডে-র ভোরবেলা ওঁকে পৌঁছতে হবে রদেভোয়। তারিখটা মনে রাখতে সুবিধে হবে।

সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তখুনি রওনা হয়ে গেল টিসে। বেশ খানিক দূর চলে গেছে সে, হঠাৎ রোয়েন বলল, ওকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে! ছুটলো ও। এই টিসে! টিসে, দাঁড়াও!।

আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের ঘনঘটা দেখে গম্ভীর হয়ে উঠলো নিকোলাস।

দাঁড়িয়ে পড়েছে টিসে, হাঁপাতে হাঁপাতে তার কাছে পৌঁছল রোয়েন। ওরা দু জন কথা বলছে, আবার ঢালের উপর আকাশের দিকে তাকালো নিকোলাস, ভাবছে সময়ের আগেই না বর্ষা শুরু হয়ে যায়। তারপর আবার যখন ওদের দিকে তাকালো, দেখলো টিসের হাতে কী যেনো একটা গুঁজে দিল রোয়েন। শার্টের পকেটে সেটা খুঁজে মাথা ঝাঁকালো টিসে, তারপর আবার সন্ন্যাসীদের পিছু নিয়ে রওনা হয়ে গেল। রোয়েন ফিরে আসতে নিকোলাস জানতে চাইলো, কী ব্যাপার, রোয়েন?

মেয়েদের অনেক গোপন ব্যাপার থাকে, জবাব দিল রোয়েন। সব কথা জিজ্ঞেস করতে হয় না। তারপর হেসে উঠে বলল, জিওফ্রের মাধ্যমে মামিকে একটা মেসেজ পাঠাতে বললাম টিসেকে, জানাতে চাই আমি ভালো আছি।

উত্তরটা নিকোলাসকে সন্তুষ্ট করতে পারলো না। মায়ের ফোন নম্বর টিসেকে দেওয়ার জন্য আগেই একটা কাগজে লিখে রেখেছিল রোয়েন? তাহলে সবার সামনে কেন টিসেকে দিল না? ঠিক আছে, সিদ্ধান্ত নিল নিকোলাস, টিসে ফিরে এলে আসল ব্যাপার জেনে নিবে ও।

টানেলের ভেতর সিঁড়িটার গোড়ায় ওয়ার্কশপ তৈরি করেছে ওরা। হানশিত শেরিফ একটা টেবিল বানিয়ে দিয়েছে, তাতে রোয়েনের ড্রইং, বই, ফটোগ্রাফ ইত্যাদি ছড়ানো। ড্যানিয়েল একটা ফ্লাডলাইটেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পাশের দেয়ালে আটটা ক্রেটে রয়েছে দেব-দেবীদের মূর্তি। সিঙ্ক-হোলের উপর ভাসমান সেতুতে কমান্ডার মেকের সশস্ত্র গেরিলারা চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দিচ্ছে। টেবিলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে হচ্ছে রোয়েনকে-ফটোগ্রাফ পরীক্ষা, দেয়ালচিত্রের মাপজোক, শিলালিপির অনুবাদ, কাজের কোনো শেষ নেই। কোনো কোন দিন একটানা পনেরো ঘণ্টাও কাজ করে। এক পর্যায়ে রেগে যায় নিকোলাস, হুকুমের সুরে ঘুমাতে যেতে বলে।

আজও ঠিক তাই ঘটলো। ধমক খেয়ে টানেল থেকে বেরিয়ে চওড়া কার্নিসে চলে এলো রোয়েন, এখানেই ওদের ক্যাম্প ফেলা হয়েছে। মশারি আগেই টাঙানো হয়েছে, ভেতরে ঢুকে শ্লীপিং ব্যাগে আশ্রয় নিল। একটু দূরে নিকোলাসও শুলো।

মাত্র তিন ঘণ্টা পর সকাল হয়ে গেল। ঘুম ভাঙার পর রোয়েনকে ওর মশারির ভেতর দেখতে পেল না নিকোলাস। মাখন, ইনজেরা রুটি আর সেদ্ধ ডিম খেল। হাতে দুকাপ কফি নিয়ে টানেলে ঢুকলো, সেতু পেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় উঠে এলো। গ্যালারিতে পৌঁছে দেখলো ওসিরিস-এর খালি শ্রাইনের সামনে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে কী যেনো দেখছে রোয়েন। বাম হাতের গরম কাপটা ওর বাহুতে ঠেকাতে চমকে উঠলো ও। রেগে গিয়ে বলল, আমাকে আপনি ভয় পাইয়ে দিয়েছেন।

কী দেখছেন? জানতে চাইলো নিকোলাস, রোয়েনের বাড়ানো হাতে ধরিয়ে দিল কাপটা। কী আবিষ্কার করলেন?

বলতে হলে দেখাতে হবে, জবাব দিল রোয়েন। আসুন আমার সঙ্গে। নিকোলাসকে নিয়ে সিঁড়ির গোড়ায়, নিজের ওয়ার্কশপে নেমে এলো ও। কয়েকদিন ধরে আমি শুধু ট্যানাস-এর সমাধিতে পাওয়া ফলকের এক পাশের লিপি অনুবাদ করেছি। সবই মুল বই থেকে নিয়ে খোদাই করা, একটা লাইনও টাইটার নয়। সব আমি নোটবুকে লিখে রেখেছি। নোটবুকটা নিকোলাসকে দেখালো ও তারপর একপাশে সরিয়ে রাখলো। দ্বিতীয় নোটবুকটা হাতে নিল। এটায় আছে ফলকের চতুর্থ পাশের লিপির নকল। এগুলোর অর্থ আমি জানি না। শুধু সংখ্যার লম্বা তালিকা। সম্ভবত কোনো ধরনের কোড বা সঙ্কেত। তবে এ ব্যাপারে আমার একটা আইডিয়া আছে, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

এবার এটা দেখুন, বলে তৃতীয় একটা নোটবুক হাতে নিল রোয়েন। এখানে রয়েছে ফলকের তৃতীয় দিকটায় যে লিপি পাওয়া গেছে তার অনুবাদ। এগুলো উদ্ধৃতি হতে পারে না, কারণ প্রাচীন কোনো ক্লাসিক্যাল বইতে এ সব আমি পাই নি। এগুলোর বেশিরভাগই, আমার ধারণা টাইটার লেখা। সে যদি আরো কোনো সূত্র রেখে গিয়ে থাকে, এ লিপির মধ্যেই পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

দুষ্ট ক্ষীণ হাসি ফুটলো নিকোলাসের ঠোঁটে। এটা সেই অংশ না, দেবীর লালচে আর ব্যক্তিগত অঙ্গের বিশদ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে?

নোটবুক থেকে মুখ তুলতে পারলো না রোয়েন। আপনি দেখছি ভোলার বান্দা নন। সামান্য একটু লালচে হলো ওর চেহারা। ফলকের তৃতীয় দিকের মাথায় কী লেখা ছিল দেখুন। টাইটা এ দিকটার নামকরণ করেছে, শরৎ। সবচেয়ে আগে এটাই আমার চোখে পড়েছিল।

সামনের দিকে ঝুঁকে হায়ারোগ্লিফিক্স পড়লো নিকোলাস, পড়ছি-ষড় চতুষ্টয়ের নিয়ম মেনে নিয়ে মহান দেবতা ওসিরিস প্রথম চাল দিলেন। হ্যাঁ, এ অংশটুকু আগেও পড়েছি আমি। টাইটা বাও খেলার কথা বলছে এখানে, খেলাটা সে সাংঘাতিক ভালোবাসত।

হ্যাঁ, বলল রোয়েন। এবার বলুন, আমি যে স্বপ্নটার কথা বলেছিলাম, তা কি আপনার মনে আছে? যে স্বপ্নে ডুরেঈদকে সমাধির একটা চেম্বারে দেখি আমি?

দুঃখিত, বলল নিকোলাস। মনে করিয়ে দিলে খুশি হই।

সেই স্বপ্নে ডুরেঈদ আমাকে বলেন, ষড় চারটের আচরণ বিধি মনে রাখবে-শুরু করবে প্রথম থেকে।

খেলাটা সম্পর্কে আমি বিশেষজ্ঞ নই। স্বপ্নে তিনি আপনাকে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন?

খেলাটার নিয়ম বা কৌশল এতো হাজার বছর পর হারিয়ে গেছে। তবে আপনি জানেন, এগারো আর সতেরোতম সাম্রাজ্যের সমাধির ভেতর পাওয়া জিনিসপত্রের সঙ্গে বাও বোর্ডও ছিল, তা থেকে ধরে নেওয়া চলে যে দাবা খেলারই অনুন্নত সংস্করণ ছিল সেটা। নোটবুকের খালি একটা পৃষ্ঠায় স্কেচ আঁকলো রোয়েন। কাঠের বেৰ্ডি, মেলা হত দাবার বোর্ডের মতো করে, খুঁটি হিসেবে থাকত আট সারি চওড়া কাপ, আট সারি গভীর কাপ। ওগুলো ছিল রঙিন পাথর, প্রত্যেকের আচরণ নির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধা। বিশদ ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না, তবে প্রথমেই চারটে ষাঁড়ের চাল দেওয়া টাইটার মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড়দেরই শোভা পায়। এ চালের অর্থ হলো, কিছু খুঁটি বিসর্জন দিয়ে গুরুত্বপুর্ণ প্রথম সারির কাপগুলোকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যাতে বোর্ডের মাঝখানটায় প্রভাব বিস্তার করা যায়।

বলে যান, শুনছি।

ছকের প্রথম সারির কাপ, ইঙ্গিতে স্কেচটা দেখালো রোয়েন। ডুরেঈদ বলেছেন, প্রথম থেকে শুরু করবে। আর টাইটা বলেছে, মহান ওসিরিস প্রথম চাল দিলেন।

ঠিক বুঝলাম না।

আসুন আমার সঙ্গে, বলে নোটবুক হাতে সাদা প্লাস্টার করা দরজার হ্যাঁচ দিয়ে ভেতরে ঢুকলো রোয়েন, দাঁড়ালো ওসিরিস-এর শ্রাইন-এর কাছে। প্রথম চাল। শুরু। গ্যালারির দিকে মুখ করলো ও। এটা প্রথম শ্রাইন। সব মিলিয়ে কয়টা শ্রাইন?

আটটা।

বাহ্, হারপার নিকোলাস দেখছি শুনতেও জানেন!

আটটা উপর-নিচে, আটটা আড়াআড়ি… থেমে গেল নিকোলাস, রোয়েনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মানে আপনি বলতে চাইছেন

জবাব না দিয়ে নোটবুকটা খুলল রোয়েন। এখানে যে সংখ্যা আর সঙ্কেত রয়েছে, অর্থবহ ভাষায় রূপান্তর করা সম্ভব নয়। একটার সঙ্গে আরেকটার কোনো রকম সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। শুধু একটা ব্যাপার দেখতে পাচ্ছি, তালিকায় এমন কোনো সংখ্যা নেই যেটা আট-এর চেয়ে বড়।

কী যেনো বুঝেও বুঝতে পারছি না।

আজ থেকে চার হাজার বছর আগে কেউ যদি দাবার চাল ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করত, সে কী এভাবে সংখ্যা সাজিয়ে রাখত না?

আপনি বলতে চাইছেন, টাইটা আমাদের সঙ্গে বাও খেলা খেলছে।

হ্যাঁ, আর প্রথম শ্রাইনটাই টাইটার প্রথম চাল।

কিন্তু খেলার নিয়ম যেখানে জানি না, টাইটার সঙ্গে এ খেলা আমরা খেলব কীভাবে? জানতে চাইলো নিকোলাস।

*

হের ফন শিলার ডেকে পাঠিয়েছেন, গর্বিত ভঙ্গিতে কনফারেন্স রুমে ডুকলেন কর্নেল টুমা নগু। পিছু নিয়ে ঢুকলেন নাহুত গাদ্দাবিও, তিনিও নিজের গুরুত্ব বোঝাবার জন্য চেহারায় ভাবগাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। উতে কেম্পারের সঙ্গে কথা বলছিলেন ফন শিলার, ওদেরকে দেখে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন, এগিয়ে এলেন দ্রুত। নাহুতকে যেনো দেখতেই পান নি, কর্নেলকে প্রশ্ন করলেন, কাল আমাকে রিপোর্ট দেয়ার কথা ছিল। খাদ থেকে আপনার ইনফরমার কোনো মেসেজ পাঠায় নি?

এক নিমেষে চুপসে গেলেন কর্নেল নগু। জার্মান বিলিওয়ানিয়ারকে খুব ভয় পান তিনি। দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত, হের ফন শিলার। নিকোলাসের ক্যাম্প থেকে মেয়েগুলো ফিরতে দেরি করে ফেলেছে।

বুঝলাম, কিন্তু খবর পেতে দেরি হলে আমার তো চলবে না, কর্কশ সুরে বললেন ফন শিলার। রিপোর্ট দিন।

নিকোলাস বাঁধের কাজ শেষ করেছেন সাতদিন আগে। ভাটির দিকে সরে গেছেন তিনি, ঝুলন্ত মাচা বানিয়ে নালায় নেমেছেন। আমার ইনফরমার জানিয়েছে, খালি হ্রদের তলায় একটা ফাঁক পরিষ্কার করছে ওরা।

একটা ফাঁক? কী ধরনের ফাঁক? অসুস্থ দেখালো হের ফন শিলারকে।

গর্ত বা ফাটল হবে…।

ব্যাখ্যা করুন, বর্ণনা দিন। ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করছেন ফন শিলার।

যে মেয়ে মেসেজটা নিয়ে এসেছে তার মাথায় খুব একটা বুদ্ধি নেই, হের:ফন শিলার, বললেন নগু। পানি সরে যাবার পর হ্রদের তলায় নাকি একটা ফাঁক বা গর্ত দেখা গেছে। আবর্জনায় ভরা ছিল।

ওটা একটা টানেল! হিসহিস করে উঠলেন ফন শিলার। সমাধির ভেতর ঢোকার পথ পেয়ে গেছেন ওঁরা। আর কী দেখেছে সে?

মেয়েটা বলছে, ফাঁকটার ভেতর একটা গুহা আছে। পাথরের কুলুঙ্গি আর দেয়ালচিত্র আছে…

ওহ, গড! দেয়ালচিত্র মানে কি? খ্রিস্টান সেইন্টদের ছবি?

নাহুত বললেন, তা সম্ভব নয়, হের ফন শিলার। আমি আপনাকে বলছি, হারপার নিকোলাস ফারাও মামোসের সমাধি আবিষ্কার করেছেন।

আপনি চুপ থাকুন। হুংকার ছাড়লেন ফন শিলার। কর্নেলের দিকে ফিরলেন তিনি। মেয়েটা কী বলেছে সব আমাকে জানান।

দেয়ালচিত্র আর মূর্তির কথাই শুধু বলেছে, হের ফন শিলার। দুঃখিত।

বাক্সে ভরেছেন, বললেন নগু।

নিকোলাস কি শ্রাইনে কোনো মমি পাননি?

আমি জানি না, হের ফন শিলার। মেয়েটা আর কিছু বলতে পারে নি।

কোথায় সে? আমার কাছে আনুন তাকে। আমি নিজে তাকে জেরা করতে চাই।

কয়েক মিনিটের মধ্যে গ্রাম্য এক তরুণীকে কনফারেন্স রুমে নিয়ে আসা হলো। তার মুখে লাল আর কালো কালি দিয়ে ডোরা কাটা দাগ, পরনে ঢোলা আলখেল্লা, কোলে দুধের বাচ্চা। আলখেল্লা সরিয়ে স্তনের বোঁটাটা বাচ্চার মুখে পুরে দিল সে। শিশু ও মা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিলারের দিকে।

ওকে জিজ্ঞেস করুন কুলুঙ্গি বা শ্রাইনে কোনো কফিন ছিল কিনা।

এক মিনিট মেয়েটির সঙ্গে কথা বললেন কর্নেল। তারপর ফন শিলারকে। জানালেন, বোকা মেয়েলোক। বলছে, লাশ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। তবে মূর্তিগুলো বাক্সে ভরা হয়েছে। ওগুলো পাহারা দিচ্ছে একদল সৈনিক।

সৈনিক? সৈনিক মানে?

ও আসলে মেক মেক নিমুরের গেরিলাদের কথা বলতে চাইছে, ব্যাখ্যা করলেন নগু। কমান্ডার মেক এখনো নিকোলাসের সঙ্গে আছেন।

মোট কটা বাক্স? কটা মূর্তি? জানতে চাইলেন ফন শিলার।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন মেয়েটিকে। তারপর ফন শিলারকে বলরেন, পাঁচটার কম নয়, দশটার বেশি নয়। ও ঠিক জানে না।

একেকটা কত বড়?

কর্নেলের প্রশ্ন শুনে একটা হাত পুরোপুরি লম্বা করে দেখালো মেয়েটি।

ফন শিলার বললেন, সংখ্যায় এতো কম? আকারে এতো ছোট? জানালার সামনে এসে বাইরে তাকালেন তিনি। মেয়েটা যদি মিথ্যে কথা না বলে, নিকোলাস এখনো মামোসের ট্রেজার আবিষ্কার করতে পারেন নি। আরো অনেক বেশি থাকার কথা। :

মেয়েটির সঙ্গে এখনো কথা বলছেন কর্নেল নগু। শিলারের দিকে ফিরে তিনি বললেন, ও বলছে, টিসে নামে একটা মেয়ে নিকোলাসের ক্যাম্প থেকে ডেবরা মারিয়ামে গেছে, সঙ্গে আছে সন্ন্যাসীদের একট দল। মেয়েটিকে আমি চিনি, হের ফন শিলার। এক রাশিয়ান শিকারীকে বিয়ে করেছিল, এখন অবশ্য মেকের মনোরঞ্জন করছে।

ছুটে মেয়েটির সামনে ফিরে এলেন ফন শিলার। টিসে? ডেবরা মারিয়াম? কেন, ডেবরা মারিয়ামে কী করছে সে?

প্রশ্ন শুনে মাথা নাড়লো মেয়েটি। তারপর অ্যামহ্যারিক ভাষায় কিছু বলল। কর্নেল জানালেন, ও বলছে, কী করছে তা ও জানে না, তবে এখনো সে ডেবরা মারিয়ামে আছে।

মেঝেতে দুধ ফেলছে। ভাগান ওকে, তাড়ান! ঘৃণায় মুখ কোচকালের ফন শিলার। মেয়েটা চলে যেতে কর্নেলকে তিনি বললেন, এই টিসে সম্পর্কে আর কি জানেন বলুন আমাকে।

আদ্দিস আবাবার অভিজাত পরিবারের মেয়ে সে, বললেন নগু। ওদের পরিবারের সঙ্গে সম্রাট হাইলি সেলাসির রক্তের সম্পর্ক আছে বলে শোনা যায়। রাস টাফারি মাকোনেন গোত্রের।

সে যদি গেরিলা কমান্ডার মেকের মেয়েমানুষ হয়, আর যদি নিকোলাসের ক্যাম্প থেকে এসে থাকে, আমরা তার কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে পারি, বললেন ফন শিলার। কাজেই তাকে আমি চাই।

প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে, কিডন্যাপ করে আনলে, সমস্যা হতে পারে, চিন্তিত দেখালো কর্নেলকে। তবে আমি তাকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার খাতিরে গ্রেফতার করে আনতে পারি। আর সে যদি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে, তাকে আদ্দিস আবাবায় ফিরে যেতে দেওয়া যাবে না। ওদের পরিবার আমাদের জন্য বিপদ হয়ে দেখা দিতে পারে।

আপনার পরামর্শ কী? জানতে চাইলেন ফন শিলার।

জেরা করার পর ছোট একটা অ্যাক্সিডেন্ট।

যা ভালো বোঝেন করবেন, বললেন ফন শিলার। তবে কোনো কাজেই আমি খুঁত দেখতে চাই না। বলে, নাহুতের চোখে তাকালেন তিনি, ভয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলো নাহুত।

*

ওসিরিস-এর শ্রাইন আরো একটা দিন পরীক্ষা করলো ওরা। এখন এমন কী চোখ বুজেও শ্রাইনের উপর দেয়ালচিত্রগুলো পরিষ্কার দেখতে পায় ওরা। এরপর ট্যানাস-এর সমাধিতে পাওয়া ফলকের লিপিগুলো মুখস্থ করে ফেললো, রোয়েনের নোটবুকে লেখা অনুবাদ পড়ে। একজন পড়ে, অপরজন দেয়ালচিত্রের দিকে তাকিয়ে মিল বা তাৎপর্য খোঁজার চেষ্টা করে।

আমার প্রেম উত্তপ্ত মরুভূমিতে পাত্র ভর্তি ঠাণ্ডা পানি। আমার প্রেম বাতাসে পতপত করা পতাকা। আমার প্রেম সদ্যোজাত শিশুর প্রথম ক্রন্দন।

দেয়াল থেকে চোখ নামিয়ে হাসলো রোয়েন। টাইটা মাঝে মধ্যে খুব রোমান্টিক হয়ে পড়ে।

কাজে এ লাগান। এখানে আমরা কাব্যচর্চা করতে আসি নি।

নীরস, বিড়বিড় করলো রোয়েন, তবে আবার চোখ তুললাম দেয়ালে।

এখানে দেখুন–নিকোলাস পড়ে, বহু সম্পর্কের মাঝে জড়িয়ে আমরা মিছে বলি, এ সম্পর্ক হতে পারে শিশুর সঙ্গে মায়ের, প্রেমিক আর প্রেমিকার, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর, শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের, নারীর সঙ্গে পুরুষের।

এই নিয়ে আজ সকালে তিনবার এ লাইনটা পড়লেন। কী এমন আছে এতে? রোয়েন ঝঝিয়ে উঠে। একটু লাল হয়ে গেছে ওর গাল।

দুঃখিত। ভেবেছিলাম, এটাও আপনার কাছে রোমান্টিক লাগবে! বিড়বিড় করে নিকোলাস। আচ্ছা, এটা পড়ি—

আমি ভুগেছি আবার ভালোবাসাও পেয়েছি। ঝড়-ঝাঁপটা আমাকে টলাতে পারে নি। তীর আমার মাংসভেদ করে গেছে, কিন্তু কোনো ক্ষতি করতে পারে নি। সামনে পড়ে থাকা সরল অথচ ভুল পথ আমি এগিয়ে গেছি। আমি গোপন সিঁড়ি ধরেছি, পৌঁছে গেছি দেবতাদের আসন পর্যন্ত।

লম্বা গ্যালারি ধরে সামনে তাকালো রোয়েন। এই কথাগুলোর মধ্যে কিছু থাকতে পারে। সামনে পড়ে থাকা সরল অথচ ভুল পথ… গোপন সিঁড়ি? কাল থেকে চুল সরালো ও। নাহ, নিকোলাস, আমার আর ধৈর্য্যে কুলাচ্ছে না। কোত্থেকে শুরু করব তাই তো বুঝতে পারছি না।

ধৈৰ্য্য হারালে চলবে কেন, বলল নিকোলাস, হাসলো। আসুন, আপনার বন্ধুর মতো প্রথম থেকে শুরু করি। পড়ছি আবার, কেমন? প্ৰকাণ্ড ডানায় ভর দিয়ে শকুন আকাশে উড়লো সূর্যকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য–

নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে হাসতে যাবে রোয়েন, হঠাৎ সামনের দেয়ালে চোখ পড়তে স্থির হয়ে গেল। শকুন! বলে হাত তুলে নিকোলাসের পেছনের দেয়ালটা দেখালো। ঘুরে সেদিকে তাকালো নিকোলাস।

ওদিকে একটা শকুন রয়েছে, ছবিটা এতো সুন্দর যে কোনো তুলনা হয় না। সুতীক্ষ দৃষ্টি থেকে যেনো আগুন ঝরছে, হলুদ ঠোঁট বাঁকা ও চুঁচালো। ডানাগুলো পুরোপুরি মেলা, প্রতিটি পালকের কিনারা বহুমূল্য পাথরের আকৃতিতে রঙ করা। প্রায় নিকোলাসের মতোই লম্বা পাখিটা, তবে মেলে দেওয়া ডানা অর্ধেক দেয়াল দখল করে রেখেছে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সরাসরি মাথার উপর সিলিংয়ে তাকালো রোয়েন, তারপর নিকোলাসের বাহু ছুঁয়ে ওকেও তাকাবার তাগিদ দিল।

সূর্য, ফিসফিস করলো রোয়েন। আমন রা-র সোনালি সুর্য-চাকতি আঁকা হয়েছে। গম্বুজ আকৃতির ছাদের সবচেয়ে উঁচু অংশে। সূর্যের আভা যেনো ছায়াগুলোকে আলোকিত করে রেখেছে। রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে সম্ভাব্য সবগুলো দিকে, তবে এটা রশ্মি দেয়ালের মোচড় খাওয়া অংশ অনুসরণ করে নেমে এসে আলোকিত করে রেখেছে শকুনটাকে। সূর্যকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আকাশে উড়লো শকুন, আবার বলল রোয়েন। টাইটা কি আক্ষরিক অর্থেই বলেছে কথাটা?

সামনে এগিয়ে এসে দেয়ালচিত্রটা গভীর মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করলো নিকোলাস, হাত বুলাল ডানা, পেট আর বাঁকা ঠোঁটের উপর। পেইন্টের নিচে প্লাস্টার করা দেয়াল মসৃণ। হাতে কিছুই ঠেকে না।

মাথাটা, নিকোলাস! মাথাটা দেখুন! লাফ দিয়ে শকুনের মাথা ছুঁতে চাইলে রোয়েন, কিন্তু নাগাল পেল না। আপনি চেষ্টা করুন।

এবার নিকোলাসও শকুনের মাথার একপাশে সূক্ষ্ম একটা ছায়া দেখতে পেল, যেখানে ফ্লাডলাইটের আলো ক্ষীন বাধা পেয়েছে। হাত তুলে স্পর্শ করার পর বুঝতে পারলো দেয়ালের যে অংশে মাথাটা আঁকা হয়েছে সেটা দেয়ালের অন্যান্য অংশের চেয়ে চুল পরিমাণ ফুলে আছে। উঠলো একটু ভাব থাকলেও, কোনো জয়েন্ট আছে বলে তো মনে হচ্ছে না, রোয়েনকে বলল ও। একদম মসৃণ, একটা দেয়ালেরই অংশ মনে হচ্ছে।

চাপ দিন। চাপ দিন! শকুনের মাথাটা সূর্যের দিকে ঠেলুন! তাগাদা দিল রোয়েন।

মাথায় তালু ঠেকিয়ে তাই করলো নিকোলাস। কই, কিছুই তো ঘটছে না।

চার হাজার বছর ধরে এঁটে বসে আছে, জোর খাটান!

জোর খাটালো নিকোলাস। হতাশ দেখালো ওকে। এ নিরেট দেয়াল, নড়বে না।

আমাকে তুলুন। আমাকে দেখতে দিন। রোয়েনের কথামতো ওর কোমরে দুহাত রেখে ওপরে তুললাম নিকোলাস। আঙুলের ডগা দিয়ে পরীক্ষা করছে। রোয়েন। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো, নিকোলাস! কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলেছেন আপনি। মাথার চারপাশের আউটলাইনের রঙে ফাটল ধরেছে। আঙুলে অনুভব করছি। আরো ওপরে তুলুন আমাকে।

রোয়েনকে আরো একটু ওপরে তুললাম নিকোলাস।

হ্যাঁ, কোনোই সন্দেহ নেই! উল্লাসে কেঁপে গেল রোয়েনের গলা। কিছু একটা নড়ে গেছে। মাথার উপর দেয়ালে সরু চুলের মতো খাড়া ফাটলও দেখতে পাচ্ছি। আপনি নিজেই দেখুন।

খালি অ্যামুনিশনের একটা ক্রেট এনে শকুনটার নিচে রাখলো নিকোলাস, সেটার উপর উঠে দাঁড়াতে শকুন আর ওর চোখ একই লেভেল থাকলো। চেহারা বদলে গেল ওর। পকেট নাইফ বের করে মাথাটার আউটলাইনের মেঝেতে। মনে হচ্ছে মাথাটা আলাদা একটা অংশ, স্বীকার করতে হলো ওকে। ওটার উপর খাড়া একটা চিড়-ও এখন দেখতে পাচ্ছে নিকোলাস, তাতে ছুরির ফলা ঢুকিয়ে এদিক ওদিক চাপ দিতে তিন ফুট প্লাষ্টার খসে পড়লো। টাইলের মেঝেতে পড়া মাত্র মিহি ধুলোয় পরিণত হলো সেটা। দেয়ালে একটা ফাটল তৈরি হয়েছে। একটা খাজ বলে মনে হচ্ছে। পুরোটা পরিষ্কার করলে বোঝা যাবে আসলে কী।

নিচে আরো প্লাস্টার খসে পড়লো। হাঁচি দিচ্ছে রোয়েন। কিন্তু জায়গা ছেড়ে নড়ছে না।

হ্যাঁ, খাড়া একটা খুঁজই বটে, উপর দিকে উঠে গেছে, বলল নিকোলাস। এরপর শকুনের মাথার আউটলাইন থেকে প্লাস্টার খসাতে শুরু করলো। মাথাটা এখন মুক্ত, কাজটা শেষ করে বলল। দেখে মনে হচ্ছে খাজ ধরে উপর দিকে ওঠানো যাবে এটাকে। চাপ দিয়ে দেখবো?

একশো বার! হাজার বার! রুদ্ধশ্বাসে বলল রোয়েন।

শকুনের মাথার নিচে দুই হাতের তালু ঠেকিয়ে চাপ দিল নিকোলাস। চোখ-মুখ কুঁচকে উঠলো ওর। সেই সঙ্গে রোয়েনেরও, যেনো নিকোলাসের সঙ্গে সে-ও চাপ দিচ্ছে।

নরম একটা ঘষা খাওয়ার আওয়াজ হলো, মৃদু ঝাঁকি খেতে খেতে উপর দিকে উঠে যাচ্ছে মাথাটা। খাঁজের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল ওরা। লাফ দিয়ে বাক্স থেকে নেমে পড়লো নিকোলাস।

দু জনেই ওরা বিচ্ছিন্ন মাথাটার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে থাকলো। দীর্ঘ রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর ফিসফিস করলো রোয়েন, কই, কিছুই তো ঘটছে না!

ফলকের বাকি লেখা কী বলে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

তাই তো! দেয়ালের চারদিকে চোখ বুলাল রোয়েন, তারপর মুখস্থ বলে গেল, আরো লেখা আছে-শিয়াল ডেকে উঠে লেজের দিকে ঘুরে গেল। খুদে আনুবিস-এর ছবির দিকে কাঁপা একটা হাত তুললাম ও, কবরস্থানের দেবতা আনুবিস-এর মাথাটা শিয়ালের। শকুনের ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে তাঁর ছবিটা, ওসিরিস-এর প্রকান্ড ছবির নিচে। সেদিকে ছুটলো রোয়েন, শিয়ালের মাথায় তালু রেখে চাপ দিল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না।

সরুন, আমি দেখছি, বলে ছুরির ফলা দিয়ে শিয়ালের মাথার চারপাশ থেকে প্লাস্টার খসাল নিকোলাস। তারপর নতুন করে চাপ দিল। শুধু মাথা নয়, গোটা ছবিটা ঘুরে যেতে শুরু করলো, যতক্ষণ না কালো হলুদ টানলোসের দিকে ফিরলো।

দু জনেই পিছিয়ে এসে তাকিয়ে থাকলো, প্রত্যাশায় চকচক করছে দু জোড়া চোখ। কিন্তু এবারও কিছু ঘটল না।

ফলকে আরো একটা কথা লেখা আছে, বিড়বিড় করলো রোয়েন। মনে পড়ে? নদী জমিনের দিকে গড়ায়। পবিত্র স্থানের অমর্যাদাকারীরা সাবধান, তোমাদের উপর সমস্ত দেবতার অভিশাপ নেমে আসবে।

নদী? আমি তো দেয়ালে কোনো নদী দেখছি না।

দেয়ালে তন্নতন্ন করে খুঁজছে রোয়েন। পেয়েছি! হাপি! উত্তেজনায় সরু ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো কণ্ঠস্বর। নীলনদের দেবতা! নদী।

মহান দেবতা ওসিরিস-এর মাথার সঙ্গে একই সমতলে রয়েছেন নদীর দেবী। হাপি উভলিঙ্গ, বুকে স্তন আছে, উঠলো পেটের নিচে পুরুষের জননেন্দ্রিয়। মাথাটা জলহস্তীর, হাঁ করা, চোয়ালের ভেতর বিশাল গহ্বর দেখা যাচ্ছে।

কয়েকটা অ্যামুনিশন ক্রেটের উপর দাঁড়িয়ে হাত লম্বা করলো নিকোলাস, ছুঁতে পারলো হাপিকে। পরীক্ষা করার পর বলল, এটাও আলাদা করা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

নদী জমিনের দিকে গড়ায়, নিকোলাস। তার মানে নিচের দিকে নামবে ওটা। টানুন।

আগে কিনারাগুলো পরিষ্কার করতে দিন। কাজটা শেষ করতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো। ছুরিটা পকেটে রেখে দিয়ে নিকোলাস বলল, এবার কিছু একটা ঘটবে বলে মনে হচ্ছে। তৈরি থাকুন। আমার জন্য একটু দোয়াও করতে পারেন।

দেবতার ছবিতে দু হাতের তালু রেখে নিচের দিকে চাপ দিল নিকোলাস, ধীরে ধীরে শক্তি বাড়াচ্ছে। কিন্তু কিছুই নড়লো না। কাজ হচ্ছে না।

দাঁড়ান, আমি আসছি! বাক্সের উপর উঠে নিকোলাসের পেছনে দাঁড়ালো রোয়েন, ওর দুই কাঁধের উপর দিয়ে সামান্য বাড়ালো হাত দুটো, দেবতার ছবির উপর তালু।

দু জন মিলে চাপ দিচ্ছে। আরে, নড়ছে দেখছি! হঠাৎ করে হাপির ছবি আলগা হয়ে গেল, ছুটে গেল ওদের হাত থেকে, তীক্ষ্ণ ঘষা খাওয়ার শব্দের সঙ্গে খাজ ধরে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নেমে এলো।

ভারসাম্য হারিয়ে ফেলায় বাক্স সহ নিচে পড়ে গেল ওরা, নিকোলাসের পিঠে বসে আছে রোয়েন। এক মুহূর্ত পর দু জনেই লাভ দিয়ে সোজা হলো।

কী ঘটলো? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন, তারপরই ঝট করে ছাদের দিকে তাকালো। উপর থেকে গুরুগম্ভীর একটা আওয়াজ ভেসে আসছে। কী ঘটছে বলুন তো? ওর গলায় আতঙ্ক। দু জনেই মুখ তুলে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের ভুল, নাকি সত্যিসত্যি গোটা ছাদ নড়ছে?

শব্দটা ভৌতিক লাগছে না? ফিসফিস করলো নিকোলাস। যেনো ছাদের কোথাও বিশাল কোনো প্রাণী নড়াচড়া করছে?

আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছে। মেঘ ডাকার মতো গড়গড় করছে গোটা ছাদ। পাহাড় ধসের সাথে অনেকটা মেলে। তারপর কামান দাগার মতো বিকট শব্দ হতে লাগলো।

উঁচু সিলিঙে একটা ফাটল ধরল, গ্যালারির পুরো দৈর্ঘ্য জুড়ে। আঁকাবাঁকা ফাটলটা থেকে ধুলোর মেঘ নেমে আসছে। তারপর, ধীরগতি দুঃস্বপ্নের মতো, ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সরাসরি তার উপরের ছাদটা ধসে পড়তে শুরু করলো।

টাইটার সতর্কবাণী! চেঁচিয়ে উঠলো রোয়েন। দেবতাদের অভিশাপ! স্তম্ভিত বিস্ময়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ও, নড়ার শক্তি নেই।

খপ করে ওর একটা হাত ধরে টান দিল নিকোলাস। ছুটুন! বাঁচতে চাইলে ছুটুন! রোয়েনকে নিয়ে খিচে দৌড় দিল ও।

গ্যালারি ধরে ছুটছে ওরা সীল করা প্রবেশপথের ফাঁকটার দিকে। পাথর আর প্লাস্টারের টুকরো বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে গলিপথে, ধুলোয় চারদিক অন্ধকার। ওদের পেছনে অবিরত বজ্রপাতের শব্দ হচ্ছে, ধসে পড়ছে গোটা ছাদ। ওরা ছুটছে, ওদেরকে অনুসরণ করছে নিয়ন্ত্রণহীন পাথর ধস। পেছন দিকে তাকানোর সময় বা সাহস কোনোটাই ওদের নেই, তবে পতনের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারছে ফাঁকটা গলে বাইরে বের হওয়ার সময় ওরা পাবে না।

প্লাস্টারের একটা টুকরো রোয়েনের কাঁধে ঘষা খেয়ে বেরিয়ে গেল। হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল ওর, নিকোলাস ধরে না ফেললে পড়ে যেত। না পড়লেও, আতঙ্কে হাঁটতে পারছে না। নিকোলাস ওকে টেনে নিয়ে আসছে। ধুলোয় সামনেটা দেখা যাচ্ছে না, প্রবেশপথের ফাঁকটা কত দূরে বোঝা যাচ্ছে না। প্রায় পৌঁছে গেছি, মিথ্যে আশ্বাস দিল নিকোলাস। ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই প্লাস্টারের একটা টুকরো ফ্লাডলাইটে আঘাত করলো। পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল গ্যালারি।

নিকোলাস এখন পুরোপুরি অন্ধ, বাঁচার আকুতি প্রথমেই ওকে দিশা খুঁজে পাবার তাগাদা দিল। কিন্তু চারদিকেই ধসে পড়ছে ছাদ, প্রতি মুহূর্তে পতনের মাত্রা আরো বাড়ছে। বুঝতে পারল, যে কোনো মুহূর্তে গোটা ছাদ নেমে আসবে ওদের উপর। কোথাও না থেমে ছুটছে ও, ভারী বোঝার মতো টেনে আনছে রোয়েনকে। কিছুই না দেখে দেয়ালের শেষ মাথায় পৌঁছল, ধাক্কা খেয়ে সব বাতাস বেরিয়ে গেল ফুসফুস থেকে। ধুলোর মেঘের ভেতর প্লাস্টার করা দরজার গায়ে চৌকো ফাঁকটা অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে, সিঁড়ির মাথা থেকে আসা ল্যাম্পের আলোয় শুধু আভাসটুকু পাওয়া যায়। হ্যাঁচকা টানে রোয়েনকে বুকে তুলে নিল নিকোলাস, তারপর ফাঁকের ভেতর ছুঁড়ে দিল। ওপারে পড়লো রোয়েন, কাতর শব্দ ভেসে এলো এপারে। আবর্জনার আরেকটা টুকরো লাগলো নিকোলাসের মাথার পেছনে, ব্যথায় জ্ঞান হারাবার অবস্থা হলো। হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেছে, দাঁড়াতে চেষ্টা করেও পারছে না। শুনতে পেল রোয়েন ওর নাম ধরে চেঁচাচ্ছে।

হামা দিয়ে এগুলো নিকোলাস। হাত তুলে ফাঁকটার নাগল পেতে চাইছে। ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে একটা হাত ওর কব্জি চেপে ধরল। আর ঠিক এক সেকেন্ড পরই গ্যালারির সম্পূর্ণ ছাদ ধসে পড়লো নিচে।

ল্যাম্পলাইটের আলোয় নিকোলাসের হাত ধরে পথ দেখালো রোয়েন। কোথায় লেগেছে? হাঁপাচ্ছে ও। কপালের উপর চুলের ভেতর থেকে রক্তের একটা ধারা গালে নেমে আসছে। ধুলো মাথা মুখে লাল নদীর মতো লাগছে দেখতে।

তাড়াতাড়ি পা চালান, বলল নিকোলাস। খকখক করে কাশছে ও। গোটা টানে নল ধসে পড়তে পারে। পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে ছুটলো ওরা। তারপর ধুলোর ভেতর সামনে একটা ছায়ামূর্তি দেখা গেল। ড্যানিয়েল।

আপনারা বেঁচে আছেন! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। কী ঘটছে ওদিকে?

নিকোলাস আর রোয়েন থামলো না। পালিয়ে এসো! কর্কশ সুরে বলল নিকোলাস। দ্রুত টানেল থেকে উঠে এলো নিকোলাস, রোয়েন আর ড্যানি স্যাপার।

ভাসমান সেতুর উপর উঠে বিশ্রাম নেয়ার জন্য থামলো ওরা।

*

সন্ন্যাসীদের বাইরে রেখে পোস্ট অফিসে ঢুকলো টিসে। বহুসময় বসে থাকার পর আদ্দিস আবাবার লাইন পাওয়া গেল, ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে ভেসে এলো জিওফ্রে টেনেন্টের কণ্ঠস্বর। হ্যালো?

নিজের পরিচয় দিল টিসে।

আমি আপনার কলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, বলল জিওফ্রে। আপনারা সবাই কেমন আছেন, টিসে?

নিকোলাসের মেসেজটা মুখস্ত বলে গেল টিসে।

আমার বন্ধুকে বলবেন ওর কথামতো সব করা হবে, বলে যোগাযোগ কেটে দিল জিওফ্রে।

এবার আমি, পোস্ট মাস্টারকে বলল টিসে, আদ্দিস আবাবায় আরেকটা ফোন করতে চাই-মিশরীয় দূতাবাসে।

দ্বিতীয় কলের লাইন পেতে একটু দেরি হলো। বিকেল পাঁচটার সময় মিশরীয় দূতাবাসের কালচারাল অ্যাটাশের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো টিসের। ভদ্রলোককে আগে থেকেই চেনে সে, কূটনীতিকদের কয়েকটা পার্টিতে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি জানতে চাইলেন, মিটিংয়ে যেতে হবে। বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি, ওইজিরো টিসে?।

এই ভদ্রলোকের মাধ্যমে কায়রোর যাঁকে মেসেজটা দিতে হবে তাঁর নাম ঠিকানা ও পদমর্যাদা একটা কাগজে লিখে দিয়েছে রোয়েন। নামটা শুনে কালচারাল অ্যাটাশে ভদ্রলোক টিসেকে খুশি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নাম ও পদমর্যাদা ভুল শুনেছেন কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য দু বার রিপিট করতে বললেন। সবশেষে লিখে নেওয়া মেসেজটা পড়ে শোনালেন টিসেকে। ঠিক আছে তো?

রাত হতে আর বেশি দেরি নেই, কাজেই আজ আর খাড়া ঢাল বেয়ে নিচে নামা সম্ভব নয়। কোথায় রাত কাটানো যায় ভাবছে টিসে, এ সময় গ্রামের সর্দার তার কিশোরী মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন। রাতটা তাঁর বাড়িতে মেহমান হিসেবে কাটাবার অনুরোধ করেছেন তিনি। স্বস্তিবোধ করলো টিসে, কিশোরীর সঙ্গে সর্দারের বাড়িতে চলে এলো। অভিজাত পরিবারের মেয়ে সে, তার সম্মানে রাতে বড়সড় একটা ভোজ দিলেন সর্দার। গ্রামে তার বাড়িটাই সবচেয়ে বড়। সন্ন্যাসীদের থাকার ব্যবস্থা হলো বাড়ির উঠানে, তাঁবুর ভেতর। বাড়ির পেছনের একটা গেস্টরুম খুলে দেওয়া হলো টিসেকে। ভোজন পর্ব শেষ হতে রাত গম্ভীর হয়ে গেল। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লো টিসে।

ওর ঘুম ভাঙল ভোরের দিকে, কেনো জানে না, টিসের মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। সেই মেনজিস্টুর দিনগুলোর মতো, তড়িঘড়ি বাইরে তাকিয়ে নিশ্চিত হতে চাইলো সে। অন্ধকারে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে ট্রাকের আওয়াজ। ক্রমশই কাছে চলে আসছে। মাথায় উলের কাপড় দিয়ে ঢেকে যতোক্ষণে পোশাক পরে ফেললো ও, বাইরের দরজায় তখন তুমুল কড়াঘাত।

দরজা খুলুন! বজ্রকণ্ঠে আদেশ এলো। আমরা সরকারের গোয়েন্দা।

পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে চাইলো টিসে। ও জানে, তাঁরই খোঁজে এসেছে এরা। কিন্তু কোথায় দৌড়াবে সে অন্ধকারে? কিছুই চেনে না টিসে, এ এলাকার। হঠাৎ করে মনে পড়লো, নদী রয়েছে কাছে ধারে। অন্তত নদীর পাড় পর্যন্ত তো পালিয়ে যেতে পারবে। ছুটলো টিসে। ঠিক এ সময়েই টর্চের উজ্জ্বল রশ্মি আবিষ্কার করে ফেললো ওকে।

ওই তো মেয়েটা! কে যেনো বলল কর্কশ কন্ঠে। টর্চের আলোয় রোয়েনের শাম্মা পতপত করে উড়ছে, প্রাণপণে ছুটছে সে।

গুলি কোরো না! নির্দেশ এলো। একে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে!

ক্ষীপ্র গ্যাজেলের গতি টিসের পায়ে, দৌড়ে ওকে ধরা কারো কম্ম নয়। কিন্তু হলো না। কিছু না বুঝেই অন্ধকারে সামনের কাঁটাতারের বেড়ায় আছড়ে পড়লো

সে। জামায় কাঁটা আটকে, পরে রইলো ওখানেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই টেনে হিঁচড়ে ওকে ছাড়িয়ে আনলো সৈনিকের দল।

এগিয়ে এসে টিসের চুলের গোছা ধরে টান দিল একজন, ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলো টিসে। লোকটা চড় মারতে যাবে, হাঁপাতে হাঁপাতে সৈনিকদের ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন একজন অফিসার। ভীষণ মোটা।

কী করছ! কাকে মারছ? লোকটাকে চোখ রাঙালেন তিনি। ওঁনাকে তোমরা ক্রিমিন্যাল ভেবেছ নাকি? রাজধানীর অত্যন্ত অভিজাত পরিবারের মেয়ে উনি।

টিসের দিকে ফিরে ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বললেন, ডিস্ট্রিক্ট কমান্ডার কর্নেল নগুর নির্দেশে আপনাকে একবার আমাদের আর্মি হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে, মিস টিসে।

কেন, কী করেছি আমি? ঢোক গিলে জানতে চাইলো টিসে।

গোজামে শুফতা–দুস্কৃতকারীদের তৎপরতা সম্পর্কে কর্নেল আপনাকে প্রশ্ন করতে চান।

তর্ক করে বা বাধা দিয়ে কোনো লাভ নেই, অফিসারের সঙ্গে বেরিয়ে এসে একটা সামরিক ট্রাকে চড়লো টিসে। ট্রাকের সামনে অফিসারের সঙ্গে বসেছে ও, ড্রাইভার একজন সৈনিক। কিছুক্ষণ কোনো কথা হলো না। তারপর অফিসার বললেন, ড্রাইভার ইংরেজি বোঝে না। আপনাকে বলতে চাই, আপনার বাবা, অল্টো জিম্যানকে আমি চিনতাম। তাঁর প্রতি আমি ঋণী ও কৃতজ্ঞ। আজ রাতে যা ঘটছে তার জন্য সত্যি আমি দুঃখিত, কিন্তু একজন লেফটেন্যান্ট হিসেবে কতোটুকুই বা আমার ক্ষমতা। উপর থেকে নির্দেশ এলে আমাকে তা মেনে চলতে হয়।

আমি কোনো অভিযোগ করছি না, বলল টিসে।

আমার নাম হাম্মেদ। যদি সম্ভব হয়, আপনাকে আমি সাহায্য করব–অল্টো জিম্যানের খাতিরে, কথা দিলেন লেফটেন্যান্ট হাম্মেদ।

ধন্যবাদ, এখন বন্ধুর বড়ো প্রয়োজন আমার।

*

ধুলো সরার জন্য সময় দিতে হলো। তারপরও বেশ কিছুক্ষণ গ্যালারি থেকে আলগা পাথর খসে পড়ার আওয়াজ ভেসে এলো ওদের কানে। সিঙ্কহোলের উপর ভাসমান সেতুর উপর রয়েছে ওরা, ইতোমধ্যে রোয়েনের মাথায় অ্যান্টিসেপটিক মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে নিকোলাস। দু জনের কারো আঘাতই তেমন গুরুতর নয়।

দু ঘণ্টা পর টানেলে ঢোকার জন্য তৈরি হলো নিকোলাস। ড্যানিয়েল আর রোয়েনকে সেতুর উপর থাকতে বলল ও, রওনা হলো একাই, সঙ্গে নিয়েছে লম্বা একটা বাঁশ আর জেনারেটরের সঙ্গে সংযুক্ত হ্যান্ড ল্যাম্প।

খুব সাবধানে এগুচ্ছে নিকোলাস, এগুবার আগে বাঁশ দিয়ে টানেলের ছাদ খোঁচা মারছে। ল্যান্ডিঙে পৌঁছেই দেখতে পেল সমাধির প্রবেশপথটাকে সীল করে রেখেছিল যে প্লাস্টার করা দরজা, সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। অ্যামুনিশন ক্রেটগুলো, আটটাই, ছিটকে পড়েছে এদিক সেদিক, কোনো কোনোটা আবর্জনায় ডুবে আছে। মূর্তিগুলোর কথা ভেবে মাথাটা ঘুরে উঠলো নিকোলাসের। একেকটা অক্ষত মূর্তির জন্য বিলিওনিয়ার কালেক্টররা বস্তা বস্তা ডলার দিতেও দ্বিধা করবেন না, জানে ও। এতো কষ্টকর আর ঝুঁকিবহুল অভিযান থেকে এ আটটা মূর্তিই হয়তো সর্বমোট প্রাপ্তি ওদের, তা ও যদি ভেঙে গিয়ে থাকে, দুঃখের কোনো সীমা থাকবে না।

আবর্জনা থেকে বাক্সগুলো উদ্ধার করলো নিকোলাস। প্রত্যেকটা খুলে ভেতরে তাকালো, পরীক্ষা করলো মূর্তিগুলো। নেহাতই ওদের ভাগ্য বলতে হবে, সবগুলোই অক্ষত আছে। আর কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয় ও, প্রতিবার একটা করে বয়ে নিয়ে এলো সেতু পর্যন্ত।

সমাধির বাইরের ল্যান্ডিঙে ফিরে এসেছে নিকোলাস, ওর পেছনে এসে দাঁড়ালো। রোয়েন। কোনো যুক্তিই মানল না, নিকোলাসের সঙ্গে সে-ও টানেলে ঢুকলো।

গ্যালারিতে ঢোকার মুখে স্থির হয়ে গেল রোয়েন। শোকে কাতর, ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। এ আমি বিশ্বাস করি না! ধরা গলায় বলল ও। টাইটা নিশ্চয়ই চায় নি এতো সুন্দর শিল্পকর্ম এ ভাবে ধ্বংস হয়ে যাক।

মানে? কী বলতে চান?

পরে ব্যাখ্যা করব, কারণ নিজেই এখনো বুঝতে পারছি না, বলল রোয়েন। শুধু জানি, টাইটাকে আমি যতটুকু চিনেছি, তার মধ্যে ধ্বংস করার প্রবণতা একেবারেই ছিল না। আপনি লোকজন ডেকে গ্যালারিটা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করুন।

স্যাপারকে ডেকে নিয়ে এলো নিকোলাস। গ্যালারির অবস্থা দেখে হাঁ হয়ে গেল সে। কী করতে হবে শোনার পর বলল, সবচেয়ে বড় সমস্যা ধুলো। আবর্জনায় হাত দিলেই মেঘের মতো উড়তে শুরু করবে।

কাজেই পানি দরকার, বলল নিকোলাস। টানেল থেকে সিঙ্কহোল পর্যন্ত দুই লাইনে দাঁড় করিয়ে দাও লোকজনকে। একটা চেইন পানির বালতি আনবে, আরেকটা আবর্জনা সরাবে।

 ঈশ্বরই জানে কয় দিন লাগবে? হতাশ দেখার ড্যানিয়েলকে, তবে হানশিতকে ডেকে এসে কাজটা বুঝিয়ে দিল সে।

সন্ন্যাসী বা গ্রামবাসী যুবকদের মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই, কারণ এখনো তারা বিশ্বাস করে এটা একটা ধর্মীয় কাজ, অংশগ্রহণ করতে পারায় নরকের আজাব থেকে নিস্কৃতি পাওয়া যাবে। হানশিত শেরিফের নেতৃত্বে বাঘেরা কাজ শুরু করে দিল।

ভাঙা পাথর আর আবর্জনা বলে নিয়ে ফেলা হচ্ছে সিঙ্কহোলে। ওটা এতো গভীর, পানির লেভেল উঁচু হলো না, সব গ্রাস করে নিচ্ছে। অল্প জায়গার ভেতর একশোর উপর লোক কাজ করছে, পরিবেশটা গুমোট হয়ে উঠলো। তাজা বাতাসের জন্য টাইটার পুলে বেরিয়ে এলো নিকোলাস। পুলটাকে ঘিরে থাকা পাঁচিলে এসে দাঁড়াতেই, দেখলো ওর জন্য ওখানে অপেক্ষা করছে মেক।

 নিকোলাস, জিজ্ঞেস করলো সে, ডেবরা মারিয়াম থেকে এখনো ফেরেনি টিসে? কালই না ওর ফিরে আসার কথা ছিল?

ওকে তো দেখিনি আমি। ভাবছিলাম ও বোধহয় তোমার সঙ্গে আছে।

ওর খোঁজে লোক পাঠাবো, তাই ফিরেছে কিনা নিশ্চিত হতে এলাম, বলল মেক, চেহারায় শুধু উদ্বেগ নয়, অপরাধী অপরাধী ভাবও ফুটে আছে। ডেবরা মারিয়ামে টিসেকে পাঠানোর প্রস্তাবটা তারই ছিল।

নিকোলাসেরও খারাপ লাগছে। দুঃখিত, মেক। ওকে ঢালের উপর পাঠানোটা বিপজ্জনক হতে পারে বলে আমিও ভাবিনি।

গোজামের সবাই ওকে চেনে, বলল মেক।

বিপদ হওয়ার তো কথা নয়। তবু, খোঁজ নিচ্ছি আমি। চলে গেল সে।

পরবর্তী কয়েকটা দিল টিসেকে নিয়ে দুচিন্তায় থাকতে হলো ওদেরকে। এদিকে গ্যালারি পরিষ্কার করার কাজও খুব ঢিমে তালে এগুচ্ছে। গ্যালারির মুখে নিকোলাসের সঙ্গেই বেশিরভাগ সময় কাটাচ্ছে রোয়েন। দেয়ালচিত্রের প্রতিটি ভাঙা টুকরো দেখা মাত্র কান্না পাচ্ছে ওর, কাতর হয়ে পড়ছে শোকে। ছবির কোনো অক্ষত অংশ দেখতে পেলেই নিজের দখলে রেখে দিচ্ছে। এক টুকরো প্লাস্টারে আইসস-এর মাথাটা অক্ষত অবস্থায় পেল। আরেকটায় পেল তথ এর পুরো ছবি।

লম্বা গ্যালারির ভেতর সময়ের কোনো হিসাব পাওয়া সম্ভব নয়, এখানে রাত ও দিন সমান। একেবারে ক্লান্ত ও বিরক্ত না হওয়া পর্যন্ত টানেল ছেড়ে বেরোয় না ওরা। তারপর যখন বেরোয়, টাইটার হ্রদের উপর সরু আকাশে তারার মেলা দেখে সময় কাটায়, ক্লান্তি সত্ত্বেও চোখে ঘুম আসে না।

হ্রদের পাশে ক্যাম্পে কয়েক ঘণ্টা ঘুমাবার পর টানেলে ঢুকতে যাচ্ছে ওরা, ভাসমান সেতু পেরুচ্ছে, এ সময় গ্যালারির দিক থেকে তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার ভেসে এলো। তারপর শোনা গেল বহু লোকের হৈ-চৈ। হানশিত শেরিফ কিছু একটা পেয়েছে, বলল রোয়েন।ধ্যেত, ওখানে আমাদের থাক, উচিত ছিল- দৌড় নিল ও, পিছু নিয়ে নিকোলাসও।

গ্যালারির সামনে ল্যান্ডিঙে পৌঁছল ওরা, দেখলো অর্ধনগ্ন শ্রমিকরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে সবাই একসঙ্গে কথা বলছে, ইঙ্গিতে ও হাত নেড়ে পরস্পরকে কী যেনো বোঝাবার চেষ্টা করছে। ভিড় ঠেলে সামনে এগুলো নিকোলাস ও রোয়েন, দেখতে পেল যেখানে ওসিরিস-এর শ্রাইন ছিল সেই পর্যন্ত গ্যালারিটা পরিষ্কার করা হয়ে গেছে। ওদের উপর ছাদ ভাঙাচোরা আর এবড়োখেবড়ো, নিচে টানলোসের বিধ্বস্ত মেঝেতে পড়ে রয়েছে বিশাল আকারের একটা পাথুরে ঢাকা। এটা টাইটার মেকানিজম বা তার অবশিষ্ট, প্রাচীন ক্রীতদাস ছাদে ফিট করেছিল। ওরা, নিকোলাস ও রোয়েন, ডিভাইসটা কাজ করায় ছাদটা ধসে পড়ে। বিশাল চাকাটাই মেকানিজমের মুল অংশ, দেখতে অনেকটা মিল হুইলের মতো, ওজন হবে কয়েক টন। জিনিসটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলো নিকোলাস।

রিভার গড পড়ার সময় নিশ্চয়ই আপনি খেয়াল করেছেন চাকার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল টাইটার, রোয়েনকে বলল ও। রথের চাকা, পানি তোলার চাকা, আর একটা নিশ্চয়ই ব্যালেন্স হুইল-বুবি ট্র্যাপের জন্য। আমরা লিভার নাড়তেই গোঁজ সরে যায়। ওই গোঁজই চাকাটাকে জায়গা মতো আটকে রেখেছিল। চাকা যে-ই ঘুরতে শুরু করলো, গ্যালারির উপর সিলিঙে সাজিয়ে রাখা প্রকাণ্ড পাথরগুলো খসে পড়লো ছাদে, ভেঙে পড়লো ছাদ।

এখন নয়, নিকোলাস! ধৈর্য হারিয়ে বলল রোয়েন। পরে আপনার লেকচার শোনা যাবে। টাইটার ডেথ-ট্র্যাপ হানশিতকে উত্তেজিত করে নি। সে অন্য কিছু আবিষ্কার করেছে। আসুন।

ভিড় ঠেলে আরো সামনে এগুলো ওরা, দাঁড়ালো দীর্ঘদেহী হানশিতের মুখোমুখি। কী ঘটেছে? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। কী পেয়েছ তুমি?

পাল্টা চিৎকার করলো হানশিত, এ দিকে, ইফেন্দি! জলদি আসুন!

আরো কিছুটা এগিয়ে পাথর ধরেস বন্ধ গ্যালারির সামনে থামলো। ওই দেখুন! হাত তুললাম হানশিত।

ভাঙা শ্রাইনের ভেতর একটা হাঁটু গাড়লো নিকোলাস। ফাটল ধরা পাথুরে দেয়ালে এখনো রঙ করা প্লাস্টারের টুকরো দেখা যাচ্ছে। ধসে পড়া দেয়ালের মুখ থেকে বড় একটা টুকরো সরালো হানশিত, তারপর সদ্য তৈরি ফাঁকটার দিকে আঙুল তাক করলো। চোখের পলকে পালস রেট বেড়ে গেল নিকোলাসের। গ্যালারির এক পাশে একটা পথ দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত আরেকটা টানেলের মুখ। মহান দেবতার প্লাস্টার মোড়া ছবির পেছনে লুকিয়ে ছিল। নিকোলাস তাকিযে আছে, বাহুতে রোয়েনের স্পর্শ আর মুখের পাশে গরম নিঃশ্বাস অনুভব করলো।

এটাই, নিকোলাস! এ টানেলটাই! ফারাও মামোসের আসল সমাধিতে ঢোকার পথ। এ গ্যালারি, যেকানে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি, এটা স্রেফ একটা ধাপ্পা। আসল সমাধি আছে দ্বিতীয় টানেলের ভেতর।

হানশিত! আবেগে রুদ্ধ গলায় নির্দেশ দিল নিকোলাস, তোমার লোকদের বলো পথটা পরিষ্কার করুক।

সঙ্গে সঙ্গে পাথর আর আবর্জনা সরাবার কাজ শুরু হয়ে গেল। ফাঁকটার ভেতর ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠলো একটা দরজা। এটাও চৌকো, তিন মিটার চওড়া, দুই মিটার লম্বা। লিনটেল আর চৌকাঠের বাজু নিখুঁতভাবে কাটা, পালিশ করা পাথর। দরজাটা ভেঙে পড়েছে, ভেতরে সউঠে গেছে পাথুরে সিঁড়ির ধাপ।

তার টেনে নতুন দরজার মুখে আরোর ব্যবস্থা করা হলো। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পাও রাখলো নিকোলাস, দেখলো ওর পাশে পাও রাখলো রোয়েন।

আমিও আপনার সঙ্গে যাব, জেদের সুরে বলল ও।

এখানে কোনো ফাঁদ থাকতে পারে, সাবধান করলো নিকোলাস। হয়তো প্রথম বাকেই টাইটা আপনার জন্য ওত পেতে আছে।

এসব বলে কোনো কাজ হবে না, আমি যাবই।

ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে ওরা, প্রতি ধাপে থেমে দেয়াল আর সামনের দিকটা পরীক্ষা করে নিচ্ছে। বিশ ধাপ ওঠার পর আরেকটা ল্যান্ডিঙে পৌঁছল ওরা, . দুদিকে দুটো দরজা দেখা যাচ্ছে। তবে সিঁড়িটা সোজা আরো উপরে উঠে গেছে।

কোনদিকে? জানতে চাইলো নিকোলাস।

চলুন উপরে উঠি, বলল রোয়েন। পাশের প্রকোষ্ঠে দুটোয় পরে ঘুরে আসব।

সাবধানে আবার উপরে উঠতে শুরু করলো ওরা। আরো বিশ ধাপ পার হওয়ার পর হুবহু একই রকম আরেকটা ল্যান্ডিং দেখা গেল, দুদিকে দুটো দরজা। সিঁড়িটা এরপরও ওপরে উঠে গেছে।

নিকোলাসকে প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে রোয়েন বলল, উপরেই উঠব।

আরো বিশ ধাপের মাথায় আরেকটা ল্যান্ডিং, এটাও দুদিকে একটা করে দরজা। সিঁড়িটাও উঠে গেছে নাক বরাবর।

ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। অভিযোগের সুরে বলল নিকোলাস।

কনুই দিয়ে ওর পিঠে খোঁচা মারল রোয়েন। কোন বাধা না পাওয়া পর্যন্ত ওঠা উচিত, বলল ও। আবার উঠতে শুরু করে একই ধরনের আরো দুটো ল্যান্ডিং পেল ওরা।

অবশেষে! শেষ ল্যান্ডিঙে উঠে এসে বিস্ময় প্রকাশ করলো নিকোলাস। আশা করেছিল এটারও দুদিকে দরজা দেখতে পাবে, পেলও দেখতে, কিন্তু সামনে আর কোনো ধাপ নেই, তার বদলে নিরেট দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। এবার কি করবেন?

সব মিলিয়ে কয়টা ল্যান্ডিং? জানতে চাইলো রোয়েন।

আটটা, বলল নিকোলাস।

আটটা, পুনরাবৃত্তি করলো রোয়েন। সংখ্যাটা খুব পরিচিত লাগছে না?

ল্যাম্প লাইটের আলোয় রোয়েনের মুখটা ভালো করে দেখলো নিকোলাস।

আপনি বলতে চাইছেন….।

বলতে চাইছি গ্যালারিতে আটটা শ্রাইন রয়েছে বা ছিল, এখানে রয়েছে আটটা ল্যান্ডিং, বাও বোর্ডেও আটটা খুঁটি থাকে।

টপ ল্যান্ডিঙে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকলো ওরা, চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে।

অবশেষে নিস্তব্ধতা ভাঙল নিকোলাস, ঠিক আছে, এবার বুলুন কোনদিকে যাবেন।

একটায় গেলেই হয়, বলল রোয়েন। ডানদিকে চলুন।

ডান দিকের দরজা দিয়ে একটা গলিপথে ঢুকলো ওরা। খানিক দূর যাবার পর একটা টি-জাংশনে পৌঁছল-সামনে নিরেট দেয়াল, দুদিকে দুটো দরজা। আবার ডান দিকের গলিপথে ঢুকি আসুন, বলল রোয়েন। তাই ঢুকলো নিকোলাস। কিন্তু কানিক দূর যাবার পর আরেকটা টি-জাংশন পড়লো সামনে।

রোয়েনের দিকে তাকালো নিকোলাস। কি ঘটছে বুঝতে পারছেন তো? জিজ্ঞেস করলো। টাইটার আরেকটা চালাকি। সে আমদেরকে একটা গোলকধাঁধায় নিয়ে এসেছে। সঙ্গে লম্বা তার না থাকলে এতোক্ষণে হারিয়ে যেতাম।

ফেলে আসা পথের দিকে তাকালো রোয়েন, তারপর দৃষ্টি ফেললো ডান ও বাম দিকের গলিপথে। শিউরে উঠে নিকোলাসের বাহু খামচে ধরল ও। আমার ভয় করছে! চলুন ফিরে যাই। কেন যেনো মনে হচ্ছে বিপদের মধ্যে আছি আমরা। এভাবে প্রস্তুতি না নিয়ে চলে আসা উচিত হয় নি।

বাঁকের পর বাঁক পেরিয়ে প্যাসেজ ধরে ফেরার পথে ইলেকট্রিক তাঁর গুটিয়ে নিচ্ছে নিকোলাস, ইচ্ছে হচ্ছে বিপদ এগাবার জন্য দৌড় দেয়। নিকোলাসের গায়ে প্রায় সেঁটে আছে রোয়েন। দুজনেরই মনে হচ্ছে অন্ধকার থেকে কে যেনো লক্ষ রাখছে ওদের উপর, পিছু নিয়েছে, অপেক্ষা করছে ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।

*

আর্মি হেডকোয়ার্টারে নয়, টিসেকে নিয়ে আসা হলো ঢালের নিচে ফরেন প্রসপেক্টিং কোম্পানি পেগাসাসের বেস ক্যাম্পে। টিসে অভিযোগ করায় লেফটেন্যান্ট হাম্মেদ কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না, বললেন, আমি শুধু কর্নেল নগুর নির্দেশ পালন করছি।

বিশাল কনফারেন্স রুমে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, কর্নেল নগু। ইউনিফর্ম পরে আছেন, চোখে মেটাল-ফ্রেমের চশমা, তবে মাথায় কিছু নেই। টেবিলের এক ধারে জ্যাক রাফেরও বসে আছে, হাত দুটো বুকে ভাঁজ করা। একটা চুরুট নিচ্ছে সে, আগুনটা নিভে গেছে।

লেফটেন্যান্ট হাম্মেদ, অ্যামহারিক ভাষায় বললেন কর্নেল নগু। আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন। প্রয়োজন হলে আপনাকে ডাকা হবে।

লেফটেন্যান্ট চলে যাবার পর টিসে বলল, আমাকে অ্যারেস্ট করা হলো কেন, কর্নেল নগু?

দুজনের কেউই জবাব দিল না, নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকর টিসের দিকে।

আমি কি এখন চলে যেতে পারি? আবার জিজ্ঞেস করলো টিসে।

এবার কথা বললেন কর্নেল, কুখ্যাত একদল টেরোরিস্টের সঙ্গে মেলামেশা করছেন আপনি। এর মানে হলো, ওদের মতো আপনিও একজন শুফতা।

এ আপনার মিথ্যে অভিযোগ।

অ্যাবে উপত্যকার একটা মিনারেল কনসেশনে অনধিকার প্রবেশ করেছেন আপনি, বলল হেলম্। কুখ্যাত টেরোরিস্টদের নিয়ে এ কোম্পানির নিজস্ব এলাকায় মাইনিং অপারেশন শুরু করেছেন।

কোথাও কোনো মাইনিং অপারেশন শুরু হয়নি, প্রতিবাদ করলো টিসে।

আমাদের কাছে আরো তথ্য আছে। আপারা ডানডেরা নদীতে একটা বাঁধ দিয়েছেন।

তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

তাহলে আপনি অস্বীকার করছেন না যে একটা বাঁধ তৈরি করা হয়েছে?

বললামই তো, এসবের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, বলল টিসে। আমি কোনো টেরোরিস্ট গ্রুপের মেম্বার নই। কোনো মাইনিং অপারেশনেও অংশ নিই নি।

নোটবুকে কী যেনো লিখলেন কর্নেল। চেয়ার ছেড়ে জানালোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো হেলম্। ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা দীর্ঘতর হচ্ছে আবার গুপ মেরে গেছে ওরা।

টিসে বলল ছয়-সাত ঘণ্টা একটানা ট্রাকে ছিলাম। আমি ক্লান্ত। আমাকে টয়লেটে যেতে হবে।

টয়লেটের কাজ আপনি এখানেই সারতে পারেন। আমি বা মি. হেল খারাপ বোধ করব না। হাসলেন কর্নেল, তবে নোটবুক থেকে চোখ তুললেন না।

ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকালো টিসে। জানালোর কাছ থেকে সরে এসে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল হেলম্। টিসে ভাবল, এদেরকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে সে ভয় পেয়েছে। খুবই ক্লান্ত সে, তলপেট ব্যথা করছে, তবু চেহারায় মর্যাদার ভাব ফুটিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো।

মুখ তুলে ভুরু কোঁচকালেন কর্নেল। টিসের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ তিনি আশা করেন নি। শুফতা ডাকাত মেক মেক নিমুরের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা

আপনি অস্বীকার করতে পারে না। হঠাৎ অভিযোগ করলেন তিনি।

মেক নিমুর ডাকাত নন, বলল টিসে। তিনি সত্যিকার দেশপ্রেমিক এবং গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী একজন শ্রদ্ধের নেতা।

আপনি তার উপপত্নী। বেশ্যাও বলা চলে।

ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল টিসে।

হঠাৎ গর্জে উঠলেন কর্নেল নগু, মেক নিমুর কোথায়? তার সঙ্গে ডাকাতরা মোট কয়জন? টিসের দৃঢ় মনোভাব অস্থির করে তুলেছে তাঁকে।

টিসে জবাব দিল না।

কথা বলুন! মুখ খুলুন! গর্জে উঠলেন কর্নেল। তা না হলে আপনাকে টরচার করা হবে।

মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলো টিসে।

দ্রুত পায়ে হেঁটে কর্নেলের পেছনে চলে এলো হেলম, পেছনের একটা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল কনফারেন্স রুম থেকে। বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল সে। খানিক পর আবার ফিরে এলো, কর্নেলের সঙ্গে চোখাচোখি হতে মাথা ঝাঁকালো।

সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছাড়লেন কর্নেল নগু। তারপর দু জনই টিসের সামনে চলে এলো।

ঝামেলা যত তাড়াতাড়ি চুকিয়ে ফেলা যায় ততই ভাল, বলল হেলম্। আমাকেও ব্রেকফাস্টে বসতে হবে, আপনাকেও টয়লেটে যেতে হবে। কর্নেল সরকারী কর্মচারী, তাকে অনেক নিয়ন-কানুন মেনে চলতে হয়। আমার ও-সব বালাই নেই। উনি যে প্রশ্নগুলো করেছেন, আমিও সেগুলো করব। তবে এবার আপনাকে উত্তর দিতে হবে। কথা শেষ করে চুরুটে আগুন ধরালো সে। এক মুখ ধোয়া ছেড়ে বলল, মেক নিমুর কোথায়?

কাঁধ ঝাঁকালো টিসে, ঘাড় ফিরিয়ে আবার জানালার বাইরে তাকালো।

আগে থেকে কিছু বুঝতে না দিয়ে দুশ করে টিসের মুখে ঘুসি মারল হেলম্। একটা মেয়েকে এভাবে কেউ ঘুসি মারতে পারে, ভাবা যায় না। ছিটকে চেয়ার সহ মেঝেতে পড়ে গেল টিসে। এগিয়ে এসে তার পেটে সবুট লাথি মারল হেলম্। বেশ্যা মাগী, কথা বলিস না কেন?

এরপর এগিয়ে এলেন কর্নেল নগু। টিসের বুকের মাঝখানে একটা পা রাখলেন তিনি, তারপর ঝুঁকে চুলের গোছা ধরে টান দিলেন। নতুন করে শুরু করা যাক। মেক নিমুর এখন কোথায়?

ঘুসি আর লাথি খেয়ে জ্ঞান হারাবার অবস্থা হয়েছে টিসের। এবার তার উপর ঝুঁকলো হেলম্, ট্রাউজারের বেল্টটা খুলে নিল। এখনো সময় আছে, কথা না বললে ন্যাংটো করে চুরুটের ছ্যাকা দেওয়া হবে গায়ে। কোথায় সে? কি করছে মেক নিমুর? তোর সঙ্গী-সাথীরা ডানডেরা নদীতে বাঁধ দিয়েছে কেন?

মুখের ভেতর থুথু জমিয়ে হেলমের চোখে ছুঁড়ে দিল টিসে। ছিটকে দূরে সরে গেল হেলম্, হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছলো।

ধরে রাখুন শালীকে! কর্নেলকে বলল সে। টিসের বুক থেকে পা নামিয়ে বসে পড়লেন কর্নেল, তারপর শক্ত করে হাত দুটো ধরলেন।

পা ছুঁড়ছে টিসে, কিন্তু দু জন শক্তসমর্থ পুরুষের সঙ্গে সে পারবে কেন। তার ট্রাউজার খুলে ফেললো হেলম্। তারপর শার্টটাও ছিঁড়ে ফেললো। কোথায় সে? কি করছে মেক? জিজ্ঞেস করলো হেলম্, টিসের স্তনের বোঁটার কাছে জ্বলন্ত চুরুট সরিয়ে আনল।

মরিয়া হয়ে ধস্তাধস্তি শুরু করলো টিসে, কিন্তু কর্নেল তার হাত দুটো পিছমোড়া করে ধরে রেখেছেন। আর্তনাদ করে উঠলো টিসে, রুটের লালচে ডগা তার স্তনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

*

শীতকাল, বলল রোয়েন, ট্যানাসের সমাধিতে পাওয়া ফলকের চতুর্থ দিকটার এনলার্জ করা ফটোগ্যাফ ফ্লাডলাইটের আলোয় মেলে ধরল। এদিকটাতেই টাইটার নোটেশন রয়েছে, যেটাকে আমি বাও বোর্ড বলে মনে নিয়েছি। সংখ্যা ও সঙ্কেত সবগুলো আমি বুঝি না, তবে বাদ দেয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, প্রথম সঙ্কেতটা চারটে দিকের একটাকে চিহ্নিত করে। এ চারটে দিককে বোর্ডের একেকটা দুর্গ হিসেবে বর্ণনা করেছে সে। নোটবুকের পাতাগুলো দেখালো নিকোলাসকে, ওগুলোয় হিসাব করেছে ও।

এদিকে দেখুন, উত্তর দুর্গে বসে আছে বেবুন, দক্ষিণ দুর্গে মৌমাছি, পশ্চিমে পাখি আর পূর্বে কাঁকড়া বিছে। ফলকের ফটোগ্রাফেও চিহ্নগুলো রয়েছে, আঙুল দিয়ে দেখালো নিকোলাসকে। তারপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ফিগার, এগুলো

সংখ্যা-আমার ধারণা, এগুলো ফাইল আর কাপ-এর প্রতিনিধিত্ব করে। এগুলোর সাহায্যে আমরা তার কাল্পনিক লাল পথরের চাল অনুসরণ করতে পারব। লাল হলো বোর্ডের হাইয়েস্ট-র্যাংকিং কালার।

প্রতি সেট নোটেশনের মাঝখানে স্তবকগুলো কি? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।যেমন এখানে লেখা রয়েছে উত্তুরে বাতাস আর ঝড় সম্পর্কে।

আমি জানি না, স্মোকস্ক্রীন হতে পারে। কোনো কাজই সে আমাদের জন্য সহজ করে রাখেনি। ওগুলোর কোনো তাৎপর্য থাকতেও পারে, তবে সেটা ধরা পড়বে আমরা যখন আমাদের পথর দিয়ে চাল দিতে দিতে খেলাটায় অনেক দূর এগিয়ে যাব। রোয়েন এবার মুখ তুলে পাথুরে সিঁড়ির দিকে তাকালো, যে সিঁড়ি টাইটার গোলকধাঁধার দিকে উঠে গেছে।

এবার দেখতে হবে আমার থিওরির সঙ্গে টাইটার আর্কিটেকচারের কঠিন পাথর আর দেয়াল মেলে কিনা। প্রশ্ন হলো, আমরা শুরু করব কোত্থেকে?

প্রথম থেকে, বলল নিকোলাস। দেবতা প্রথম চাল দিলেন। টাইটা তো তাই জানিয়েছে। আমরা যদি ওসিরিস-এর শ্রাইন থেকে শুরু করি, সিঁড়ির গোড়া থেকে, তাহলে আমরা হয়তো তার কাল্পনিক বাও বোর্ডের অ্যালাইনমেন্ট পেয়ে যাব।

আমারও তাই ধারণা, বলল রোয়েন। আসুন ধরে নিই এটা টাইটার বোর্ডের উত্তর দুর্গ। এখান থেকে আমরা ষাঁড় চতুষ্টয়ের ধ্রুপদী নিয়ম আবিষ্কার করব।

কঠিন ও একঘেয়ে কাজ, এগুলো শম্বুকগতিতে। প্যাসেজ আর টানেলের ভেতর বারবার ঢুকে প্রাচীন লেখকের এ মস্তিষ্কের তার আর চিন্তাধারা চার হাজার বছর পর আঁচ করতে চাওয়া। গোলকধাঁধায় এখন ওরা ঢুকছে চক নিয়ে, প্রতিটি টানেলের শাখা ও মোড়ের দেয়াল চিহ্নিত করছে নিকোলাস, লিখে রাখছে শীতকাল শিরোনামে নিকোলাসমে ফলকের দিকটায় পাওয়া নোটেশন।

ওরা বুঝতে পারলো ওদের প্রথম ধারণাটা সঠিক হয়েছে, ওসিরিস-এর শ্রাইন হলো বোর্ডের উত্তর দুর্গ। কাজেই খুশি হয়ে উঠলো মন, জানে এটাকে সূত্র ধরে খেলার চাল আবিষ্কার করা খুব একটা কঠিন কাজ হবে না। কিন্তু আবার হতাশ হতে হলো যখন বুঝল প্রচলিত বোর্ডের সহজ দুই ডাইমেনশন-এর কথা ভাবে নি টাইটা। সমীকরণে তৃতীয় একটা ডাইমেনশন যোগ করেছে সে।

ওসিরিস-এর শ্রাইন থেকে উঠে যাওয়া সিঁড়িটাই আটটা ল্যান্ডিঙের মাঝখানে একমাত্র লিঙ্ক নয়। সিঁড়ি থেকে শুরু হওয়া প্রতিটি প্যাসেজ অতি সূক্ষভাবে হয়ে উপরে উঠে গেছে, নয়তো নিচে নেমেছে। এ-ধরনের একটা টানেল অনুসরণ করতে গিয়ে অনেক মোচড় আর বাঁক ঘুরতে হলো ওদেরকে, অথচ টেরই পেল না যে ওদের লেভেল বদলে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ ওরা সেন্ট্রাল ল্যান্ডিঙে বেরিয়ে এলো, তবে যেটা ধরে ঢুকেছিল তারচেয়ে এক ল্যান্ডিং উপরে।

ওখানে দাঁড়িয়ে স্তম্ভিত বিস্ময়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলো ওরা। নিস্তব্ধতা ভাঙল রোয়েন। একবারও মনে হয় নি যে ওপরে উঠছি। আমাদের ধারণার চেয়ে গোটা ব্যাপারটা আরো অনেক বেশি জটিল, নিকোলাস।

ভীতিকর, মন্তব্য করলো নিকোলাস।

তবে কিছু প্রতাঁকের অর্থ এখন আমার কাছে পরিষ্কার, বলল রোয়েন। ওগুলো লেভেল-এর প্রতিনিধিত্ব করে। গোটা ছকটা আবার নতুন করে সাজাতে হবে।

থ্রী-ডাইমেনশনাল বাও, ধাঁধা মেলনোর নিয়মে খেলতে হবে, বলল নিকোলাস। আমাদের আসলে একটা কমপিউটর দরকার। বুড়ো ক্রীতদাস সত্যিই জিনিয়াস ছিল। জানা সত্ত্বেও বোঝার উপায় নেই যে টানেলের মেঝে উপরে উঠেছে। নাকি নিচে নেমেছে, অথচ তার কাছে একটা স্লাইড কল পর্যন্ত ছিল না। এ গোলকধাঁধা আশ্চর্য এক ইঞ্জিনিয়ারিং বিস্ময়।

তার প্রশংসা পরে করলেও চলবে, বলল রোয়েন। এখন আসুন সংখ্যাগুলো নতুন করে সাজাই।

তার আগে এ সেন্ট্রাল ল্যান্ডিঙে আলো আর ডেস্ক নিয়ে আসি, বলল নিকোলাস। বোর্ডের মাঝখান থেকে কাজ শুরু করা উচিত বলে মনে করি। চাক্ষুষ বা আন্দাজ করা সহজ হতে পারে।

*

কামরার ভেতর শুধু নরম একটা গোঙানির শব্দ হচ্ছে। নিজের রক্ত আর প্রস্রাবের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। কর্নেল ন কনফারেন্স টেবিলে বসে একটা চুরুট ধরালেন। হাত সামান্য একটু কাঁপল, দেখে মনে হলো অসুস্থ। তিনি একজন সৈনিক, মানুষের নিষ্ঠুরতা দেখে অভ্যস্ত, তিনি নিজেও একজন নিষ্ঠুর মানুষ। মেনজিস্টুর সময়ে নির্যাতন সয়েছেন। কিন্তু আজ যা চাক্ষুষ করলেন, তাঁর বুকটা রীতিমত কেঁপে গেছে। এখন তিনি জানেন হের ফন শিলার কেন এতো ভরসা করেন হেলমের উপর। লোকটা আসলে মানুষ নয়, জানোয়ার।

কামরার আরেক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছোট একটা বেসিনে হাত ধুচ্ছে হেলম্। সময় নিয়ে তোয়ালে দিয়ে হাত দুটো মুছলো সে, কাপড়ে লাগা রক্তের দাগও মুছলো তারপর হেঁটে এসে দাঁড়ালো টিসের সামনে। আর বোধহয় কিছু বলার নেই ওর, শান্ত সুরে বলল সে। কিছু গোপন করেছে বলে মনে হয় না।

টিসের দিকে তাকালেন কর্নেল। গোটা বুক আর মুখ জুড়ে পোড়া দাগগুলো দগদগে ঘায়ের মতো লাগছে। উপুড় করলে নিতম্বেও এ দাগ দেখা যাবে। চোখ বুজে পড়ে রয়েছে টিসে, চোখের পাপড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ পর্যন্ত মুখ খোলেনি মেয়েটা। শুধু হেলম্ যখন তার চোখের পাতায় জ্বলন্ত চুরুট ছোঁয়াল, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে নি, গড়গড় করে সব বলে ফেলেছে।

খানিকটা স্বস্তিবোধ করছেন কর্নেল নগু। হেলম্ তাঁকে টিসের চোখের পাতা খুলে রাখতে বলেছিল। কিন্তু তার প্রয়োজন হয় নি।

ওর উপর নজর রাখুন, নির্দেশের সুরে বলল হেল, শার্টের গুটানো আস্তিন কব্জিতে নামাল। কর্নেলকে পাশ কাটিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল সে। দরজাটা খোলা রেখে গেল, ফলে জার্মান ভাষার দুএকটা শব্দ শুনতে পেলেন কর্নেল। এখন তিনি জানেন পাশের ঘরেই রয়েছেন হের ফন শিলার। হেলমের কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে জানেন ভদ্রলোক, সেজন্যই কনফারেন্স রুমে ঢোকেন নি।

ফিরে এসে কর্নেলের উদ্দেশ্যে মাথা ঝাঁকালো হেলম্।ওকে আর দরকার নেই আমাদের। কি করতে হবে আপনি জানেন।

নার্ভাস ভঙ্গিতে চেয়ার ছাড়লেন কর্নেল, হোলস্টারে হাত রাখলেন। এখানে? এখুনি?

বোকার মতো কথা বলবেন না, ধমক দিল হেলম্। অন্য কোথাও পাঠান। দূরে কোথাও। তারপর কাউকে ডেকে জায়গাটা পরিষ্কার করতে বলুন। আবার পাশের ঘরে চলে গেল সে।

দরজার কাছে গিয়ে চিৎকার করলেন কর্নেল, লেফটেন্যান্ট হাম্মেদ!

দু জন মিলে টিসেকে কাপড় পরাল ওরা। তার ট্রাউজার আর শার্টও অনেক জায়গায় পুড়ে গেছে। কাপড় পরাবার সময় আহমেদ টিসের দিকে না তাকাবার চেষ্টা করলেন। ট্রাকে একটা চাদর আছে, নিয়ে আসি, বলে বেরিয়ে গেলেন তিনি। ফিরে এলেন একটু পরই। টিসের ট্রাউজার আর শার্টের উপর চাদরটা জড়িয়ে দেওয়া হলো, তারপর দু জন মিলে দাঁড়াতে সাহায্য করলো তাকে। কর্নেল কনফারেন্স রুম থেকে বেরুলেন না, হাম্মেদ একাই টিসেকে নিয়ে ট্রাকের দিকে এগুলেন। প্যাসেঞ্জার সীটে বসানো হলো টিসেকে। দুহাতে পোড়া মুখটা ঢেকে রেখেছে সে।

মাথা ঝাঁকিয়ে হাম্মেদ আবার ডাকলেন কর্নেল। শান্ত সুরে নির্দেশ দিলেন তিনি। নির্দেশ শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন হাম্মেদ। এক পর্যায়ে প্রতিবাদ করতে গেলেন তিনি, খেঁকিয়ে উঠে তাকে থামিয়ে দিলেন কর্নেল। তারপর বললেন, মনে রাখবেন, জায়গাটা কোনো গ্রামের কাছাকাছি হওয়া চলবে না। নিশ্চিত হয়ে নেবেন, কোনো সাক্ষী যেনো না থাকে। কাজ শেষ করেই রিপোর্ট করবেন আমাকে।

স্যালুট করে ট্রাকে ফিরে এলেন লেফটেন্যান্ট, ক্যাবে টিসের পাশে উঠে বসলেন। নির্দেশ পেয়ে ট্রাক ছেড়ে দিল ড্রাইভার।

ব্যথায় দিশেহারা বোধ করছে টিসে, সময় সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। উঁচু পথ ধরে ছুটছে ট্রাক, প্রায় অচেতন টিসের মাথা ঘন ঘন আঁকি খাচ্ছে। মুখটা এতো ফুলে আছে, চোখ খুলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। খোলার পর মনে হলো অন্ধ হয়ে গেছে সে। তারপর বুঝতে পারলনা, সূর্য ডুবে গেছে, দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসছে। চারদিক। তারমানে হেলম্ তাকে প্রায় সারাটা দিন কনফারেন্স রুমে আটকে রেখেছিল।

চোখ খুলে উইন্ডস্ক্রীনে তাকিয়ে আছে টিসে, হেডলাইটের আলোয় সামনের পথটা চিনতে পারলো না। আমাকে আপনারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? বিড়বিড় করলো সে। এটা তো গ্রামে ফেরার পথ নয়।

নিজের সীটে লেফটেন্যান্ট হাম্মেদ যেনো আরো কুঁজো হয়ে গেলেন, কোনো কথা বললেন না। ব্যথায় আর ক্লান্তিতে টিসেও আর কোনো প্রশ্ন করলো না। চোখ বুজে সীটের উপর নেতিয়ে পড়লো সে।

হঠাৎ ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়লো ট্রাক, ঝাঁকি খেয়ে ঘুম ভাঙল টিসের। কর্কশ কয়েক জোড়া হাত ক্যাব থেকে নামিয়ে হেডলাইটের আলোয় দাঁড় করালো তাকে। হ্যাঁচকা টান দিয়ে হাত দুটো পিছনে আনা হলো, বাঁধা হলো চামড়ার বেল দিয়ে। আপনারা আমাকে ব্যথা দিচ্ছেন, ফুঁপিয়ে উঠলো বেচারি।

বাঁধা কব্জি ধরে টান দিল একজন সৈনিক, রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে এলো টিসেকে। আরো দু জন সৈনিক পিছু নিল ওদের, হাতে কোদাল। রাস্তা থেকে একশো মিটার দূরে ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর থামলো ওরা। একটা গাছের গোড়ায় বসানো হলো তাকে, তার ফাঁক দিয়ে গায়ে চাঁদের আলো পড়ছে। ওই আলোতেই টিসে দেখতে পেল তার জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছে। কবর খুঁড়ছে দু জন লোক, অপর লোকটা তার দিকে রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে নাগালের ঠিক বাইরে।

প্লিজ, ফিসফিস করলো টিসে। আমাকে মারবেন না!

কথার জবাব না দিয়ে সৈনিক এক পা এগুলো, সবুট লাথি মাল টিসের পাঁজরে। একদম চুপ!

ব্যথার চেয়ে মৃত্যু ভয় বেশি কাহিল করে ফেললো টিসেকে।

কবর খোঁড়া হয়ে গেল। গর্ত থেকে উঠে এলো সৈনিক দু জন। ট্রাক থেকে নেমে এলেন লেফটেন্যান্ট হাম্মেদ, হাতে একটা টর্চ। টর্চের আলোয় গভীরতা দেখলেন তিনি। গুড। যথেষ্ট গম্ভীর হয়েছে। টর্চটা নিভিয়ে দিলেন। তোমরা সবাই ট্রাকের কাছে চলে যাও। কর্নেল বলে দিয়েছেন, কোনো সাক্ষী থাকা চলবে না। গুলির আওয়াজ হলে ফিরে আসবে, কবরে মাটি ফেলতে সাহায্য করবে আমাকে।

সৈনিকরা ফিরে গেল।

এগিয়ে এসে টিসেকে ধরে দাঁড় করালেন হাম্মেদ, টেনে আনলেন কবরের কাছে। আপনার চাদরটা দিন আমাকে, বলে নিজেই টিসের গা থেকে খুলে নিলেন সেটা। তারপর লাফ দিয়ে নেমে পড়লেন কবরের ভেতর। টিসে শুনতে পেল হাত . দিয়ে কবরের তলার মাটি নাড়াচাড় করছেন লেফটেন্যান্ট। তারপর তার নিচু গলা শুনতে পেল, কবরের ভেতর কিছু একটা দেখাতে হবে ওদেরকে। দেখে যাতে মনে হয় লাশ….

চামড়ার বেল্টটা কব্জি থেকে খুলে ফেলে দিলেন কবরের ভেতর। দিশেহারা টিসে ফিসফিস করে জানতে চাইলো, কি করছেন আপনি? কবরের ভেতর তাকিয়ে দেখলো চাদরের উপর এমন ভাবে মাটি ফেলা হয়েছে, দেখে মনে হবে ভেতরে একটা লাশ আছে।

প্লিজ, কথা বলবেন না! চাপা গলায় সতর্ক করে দিলেন হাম্মেদ। টিসেকে নিয়ে চলে এলেন ঘন একটা ঝোঁপের ভেতর, বসিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে শুয়ে পড়ন। পালাবার চেষ্টা করবেন না। আমরা চলে না যাওয়া পর্যন্ত নড়বেন না বা কথা বলবেন না।

কবরের কাছে ফিরে এসে পিস্তলের ফাঁকা দুটো আওয়াজ করলেন আহমেদ। তারপর তার চিৎকার শুনতে পেল টিসে, চলে এসো তোমরা, কাজটা শেষ করি।

সৈনিকরা কবরের কাছে ফিরে এলো। ঝোঁপের ভেতর থেকে মাটিতে কোদালের কোপ মারার আওয়াজ পেল টিসে, গর্তটা ভরা হচ্ছে। একজন সৈনিক বলল, লেফটেন্যান্ট, আপনার টর্চটা জ্বালছেন না কেন? কবরের ভেতরটা তো দেখতে পাচ্ছি না।

মাটি ভরার জন্য আলো লাগবে কেন? ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন হাম্মেদ। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করো। আলগা মাটি সমান করে দেবে, আমি চাই না এখানে এসে কেউ হোঁচট খাক।

কিছুক্ষণ পর মাটি ভরার কাজ শেষ হলো, ট্রাক নিয়ে ফিরে গেল সৈনিকরা। স্বস্তি, ব্যথা ও ক্লান্তিতে ঝোঁপের ভেতর শুয়ে কাঁদছে টিসে। আরো কিছুক্ষণ পর হামাগুড়ি দিয়ে ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এলো সে, একটা গাছ ধরে দাঁড়ালো, টলছে।

এতোক্ষণে অপরাধবোধটা গ্রাস করলো তাকে। ভাবল, মেকের সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, শত্রুপক্ষকে বলে দিয়েছি সব কথা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে গিয়ে তাকে আমার সাবধান করা উচিত।

টলতে টলতে রাস্তার দিকে এগুলো টিসে।

*

টাইটার কোড ভাঙা গেছে কিনা বোঝার একমাত্র উপায় হলো তার তৈরি তালিকায় পাওয়া চাল অনুসারের খেলাটা চালিয়ে যাওয়া। জটিল ছকে তৈরি টানেলের শাখা-প্রশাখার ভেতর দিয়ে সাবধানে এগুলো ওরা, টাইটার চাল ধরে এগুচ্ছে, সেগুলো সাদা চক দিয়ে এঁকে রাখছে দেয়ালের গায়ে।

ফলকের শীতকাল শিরোনামে আঠারোটা চাল রয়েছে। রোয়েন যেটাকে প্রথম চাল ধরে নিয়েছে সেখান থেকে বারোটা চাল পর্যন্ত এগোনো সম্ভব হলো। কিন্তু তারপর সামনে পড়লো নিরেট দেয়াল, পরবর্তী চালে পা ফেলার কোনো সুযোগ নেই।

ধ্যেত, এতো পরিশ্রম সব বৃথা গেল, দেয়ালটায় লাথি মেরে বলল নিকোলাস।

দুঃখিত, চোখ থেকে চুল সরাল রোয়েন। আমারই কোথাও ভুল হয়েছে। দ্বিতীয় কলামের ফিগার উল্টো করে ধরে এগুতে হবে।

তার মানে নতুন করে শুরু করো আবার।

হ্যাঁ, প্রথম থেকে।

খেলাটা যদি ঠিকমতো খেলতেও পারি, জানব কীভাবে খেলতে পেরেছি? জানতে চাইলো নিকোলাস।

সূত্র অনুসরণ করে আমরা যদি একটা উইনিং কম্বিনেশনে পৌঁছতে পারি, সেটা : হবে চালমাত, ঠিক আঠারো চালের মাথায়। এরপর আর যুক্তিসঙ্গত কোনো চাল থাকবে না, তখন ধরে নিতে হবে খেলাটা আমরা শেষ করতে পেরেছি।

ওই পজিশনে পৌঁছে কী পাব আমরা?

ওখানে পৌঁছনোর পর বলতে পারব। মিষ্টি করে হাসলো রোয়েন। হাসিখুশি থাকুন, নিকোলাস। কষ্টের মাত্র শুরু হয়েছে।

টাইটার নোটেশনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির সংখ্যাগুলোর মূল্যমান নতুন করে নির্ধারণ করলো রোয়েন, প্রথমগুলোকে ধরল কাপ মূল্যমানে, দ্বিতীযগুলোকে ফাইল মূল্যমানে। কিন্তু এভাবে মাত্র পাঁচটা চল এগোলো গেল, তারপর আর সামনে বাড়ার পথ নেই।

তৃতীয় সারির প্রতীকগুলোকে আমরা লেভেল পরিবর্তনের চিহ্ন হিসেবে ধরেছি, হয়তো এখানে ভুল হচ্ছে বলল নিকোলাস। আসুন আবার শুরু করি, এবার ওগুলোকে দ্বিতীয় মূল্যমান দিই।

তাতে প্রচুর সময় লাগবে, প্রতিবাদ করলো রোয়েন। তারচেয়ে আসুন, নোটেশনের মাঝখানে টাইটা যেসব উক্তি করেছে সেগুলো আরেকবার পড়ি। দেখা যাক কোনো সূত্র বেরোয় কিনা।

বেশ।

প্রথম কোটেশন, হায়ারোগ্লিফিক্সে আঙুল রাখলো রোয়েন। পড়ছি-নাম থাকলে জিনিসটাকে চেনা যায়। নামবিহীন জিনিস শুধু অনুভব করা যায়। পেছনে জোয়ার আর মুখে বাতাস নিয়ে জলপথে ভ্রমণ করেছি আমি। হে, ভালোবাসা আমার, তোমার স্বাদ আমার ঠোঁটে মিষ্টি-মধুর।

ব্যস?

হ্যাঁ, তারপর পরবর্তী নোটেশন। কাঁকড়া বিছে, দুই আর তিন সংখ্যা, তারপর আবার….

জলপথে ভ্রমণ আর ভালোবাসা আমার মানে কী? এভাবে ফলকের ধাঁধা নিয়ে গবেষণা চলল। রাতদিনের হিসাব ভুলে গেল ওরা, ঘুম আর খিদে গ্রাহ্যের মধ্যে আনলো না। তারপর একদিন বাস্তব জগতে ফিরে এলো সিঁড়ির গোড়া থেকে ড্যানিয়েলের আওয়াজ ভেসে আসায়। ডেস্ক ছেড়ে দাঁড়ালো নিকোলাস, আড়মোড়া ভেঙে হাতঘড়ি দেখলো আটটা বাজে। কিন্তু রাত নাকি দিন জানি না। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে দেখতে পেল সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে ড্যানিয়েল, তার কাপড়চোপড় ভেজা। তোমার এ অবস্থা কেন? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস। সিঙ্কহোলে পড়ে গিয়েছিলে?

হাতের তালু দিয়ে মুখ মুছলো ড্যানিয়েল। কেউ তোমাকে বলে নি? বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে।

রোয়েন আর নিকোলাস পরস্পরের দিকে আতঙ্ক ভরা দৃষ্টিতে তাকালো।

এতো তাড়াতাড়ি? ফিসফিস করলো রোয়েন। আমাদের হিসেবে তো বর্ষা শুরু হতে আরো এক সপ্তাহ দেরি আছে।

কাঁধ ঝাঁকালো ড্যানিয়েল। ঋতুর পরিবর্তন হয় না?

অকাল বর্ষণ নয় তো? জানতে চাইলো নিকোলাস। নদীর কি অবস্থা? লেভেল উঠতে শুরু করেছে?

সে কথা বলার জন্যই তো এলাম। বাঁধের উপর উঠতে যাচ্ছি আমি বাঘ গ্রুপটাকে নিয়ে। ওটার উপর নজর রাখা দরকার। যদি দেখি বাঁধ ভেঙে পড়তে যাচ্ছে, একজন নিকোলাসেরকে পাঠাব। তখন কোনো তর্ক বা সময় নষ্ট করো না, সেই মুহূর্তে বেরিয়ে যাবে এখান থেকে। আমার লোক পাঠানোর মানে হবে যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হবে বাঁধ।

হানশিত শেরিফকে সঙ্গে নিয়ো না, নির্দেশ দিল নিকোলাস। ওকে এখানে আমার দরকার।

টানেল থেকে বেশিরভাগ শ্রমিককে নিয়ে চলে গেল ড্যানিয়েল। নিকোলাস ও রোয়েন পরস্পরের দিকে তাকালো, দু জনেই গম্ভীর।

আমাদের সময় ফুরিয়ে আসছে, অথচ টাইটার ধাঁধার সমাধান করতে পারছি না, বলল নিকোলাস। একটা ব্যাপার নিশ্চিত জানবেন, নদীর লেভেল বাড়তে শুরু করলে…

কথাটা রোয়েন শেষ করতে দিল না। নদী! চেঁচিয়ে উঠলো। সাগর নয়। অনুবাদে ভুল করেছি আমি। শব্দটার অনুবাদ করেছি-জোয়ার। ধরে নিয়েছিলাম টাইটা সাগরের কথা বলতে চাইছে। কিন্তু আসলে হবে স্রোত বা প্রবাহ। মিশরীয়রা দুটোর মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না।

দু জনেই ওরা ডেস্কে পড়ে থাকা নোটবুকের কাছে ছুটে এলো। পড়ছি আবার–পেছনে স্রোত আর মুখে বাতাস নিয়ে জলপথে ভ্রমণ করেছি…। মুখ তুলে রোয়েনের দিকে তাকালো নিকোলাস।

নীলনদে, জলপথে মানে নীলনদে, বলল রোয়েন। জোরালো বাতাস সব সময় উত্তরদিক থেকে আসছে, আর স্রোত সব সময় দক্ষিণ দিক থেকে বয়। টাইটা উত্তর দিকে মুখ করেছিল। উত্তর দুর্গ।

কিন্তু আমরা ধরে নিয়েছিলাম উত্তরের প্রতীক বেবুন, ওকে মনে করিয়ে দিল নিকোলাস।

না! আমার ভুল হয়েছে। অনুপ্রেরণায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে রোয়েনের চেহারা। শুনুন–হে, ভালোবাসা আমার, তোমার স্বাদ আমার ঠোঁটে মিষ্টি-মধুর। মধু! মৌমাছি! উত্তর আর দক্ষিণের প্রতীক চিহ্ন আমি উল্টোপাল্টা করে ফেলেছিলাম।

আর পুব ও পশ্চিম? ওখানে কী পাচ্ছি আমরা? নতুন উদ্যমে অনুবাদে মনোযোগ দিল নিকোলাস। পড়ছি–আমার পাপ গোলাপের মতোই টকটকে লাল। ওগুলো আমাকে বেঁধে রেখেছে ব্রোঞ্জের মতো শেকল দিয়ে। ওগুলো আমার হৃদয়ে জ্বালাময়ি খোঁচা দেয়, এবং আমি চোখ ফেরাই সন্ধ্যা তারার দিকে।

এখানে কী ভুল করলাম বুঝতে পারছি না…

খোঁচা শব্দটা ভুল অনুবাদ, বলল নিকোলাস। হওয়া উচিত বিদ্ধ করে বা কামড় দেয়। কাঁকড়া বিছে কামড় দেয়। কাঁকড়া বিছে তাকিয়ে আছে সন্ধ্যা তারার দিকে। সন্ধ্যা তারা সব সময় পশ্চিমে দেখা যায়। কাঁকড়া বিছে হলো পশ্চিম দুর্গ, পুবদিকের দুর্গ নয়।

বোর্ডটাকে উল্টো করে দেখতে হবে! উত্তেজনায় লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়লো রোয়েন। চলুন নতুন নিয়মে খেলি।

লেভেল সম্পর্কে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসি নি আমরা, প্রতিবাদ করলো নিকোলাস। সিস্ট্রাম কী আপার লেভেল, নাকি তিন তলোয়ার?

উপায় যখন পেয়েছি, এটা ধরেই এগুতে হবে আমাদের। সিস্ট্রামকে আপার লেভেল ধরে খেলব আমরা, তাতে কাজ না হলে আরেক ভাবে চেষ্টা করা যাবে।

কাজটা আগের চেয়ে সহজ লাগলো। বহুবার আসা-যাওয়া করায় পরিচিত হয়ে উঠেছে, এখন আর আগের মতো গা ছমছমও করে না। টানেলের প্রতিটি কোণে, মোচড়ে, বাঁকে আর টি-জাংশনে নিকোলাসের হাতের চক দিয়ে লেখা চিহ্ন রয়েছে। জটিল বাক আর মোচড় ঘুরে দ্রুত এগুতে পারছে ওরা। প্রতিটি নোটেশন অনুসরণ করে এগুতে পারছে দেখে উৎসাহ আর উত্তেজনা বেড়ে গেল, সামনে কোনো বাধা পাচ্ছে না।

আঠারোতম চাল, কেঁপে গেল রোয়েনের গলা। এটা যদি আমাদেরকে ভোলা ফাইলগুলোর একটায় নিয়ে যেতে পারে, যেটা প্রতিপক্ষের দক্ষিণ দুর্গের জন্য হুমকি, তাহলে সেটা হবে চেক কু। বড় করে শ্বাস টানলো ও। পাখি। তিন আর পাঁচ নম্বর। সঙ্গে লোয়ার লেভেলের প্রতীক তিন তলোয়ার।

শুনে শুনে পা ফেলে পাঁচটা জাংশন পেরিয়ে এলো ওরা, নেমে এলো গোলকধাঁধার সবেচেয়ে নিচের লেভেলে, প্রতিটি মোড়ের পাথরের ব্লকে চক দিয়ে আঁকা চিহ্নগুলো পড়ে নিজেদের পজিশন সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছে।

এটাই! রোয়েনকে বলল নিকোলাস, দাঁড়িয়ে পড়লো দু জনে, নিজেদের চারদিকে তাকালো।

অসাধারণ কিছুই এখানে নেই, রোয়েনের গলায় হতাশার সুর। এর আগে অন্তত পঞ্চাশবার এখান দিয়ে আসা-যাওয়া করেছি আমরা। এটাও আর সব বাঁকের মতো।

টাইটা চেয়েছেও তাই, আমরা যাতে পার্থক্যই বুঝতে না পারি।

এখন তাহলে কী করব আমরা? এ প্রথম দিশেহারা দেখালো নিমাকে।

ফলকের শেষ লেখাটা পড়ন তো।

হাতের নোটবুক খুলল রোয়েন। পড়েছি-মিশরের এ পবিত্র আর কালো মাটিতে ফসলের কোনো কমতি নেই। আমি আমার গাধার পাঁজরে চাবুক মারলাম, রাঙলের কাঠের ফলা নতুন জমিন গুঁড়ো করল। আমি বীজ বপন করলাম, ঘরে তুললাম আঙুর আর শস্যদানা। সময় মতো আমি মদ্য পান করলাম আর রুটি খেলাম। মরশুমের ছন্দ মেনে চলি আমি, জমিনের যত্ন নিই।

মুখ তুলে নিকোলাসের দিকে তাকালো রোয়েন। মরশুমের ছন্দ? টাইটা কি ফলকের চারটে মুখের কথা বলছে? জমিন? প্রশ্ন করে পায়ের সামনে পাথরের দিকে তাকালো। জমিন কি পায়ের নিচে নয়, নিকোলাস?

পাথরের ফলকে পা ঠুকলো নিকোলাস, কিন্তু আওয়াজটা হলো তো আর নিরেট। জানার একটাই উপায় আছে। তারপর গলা চড়িয়ে হাঁক ছাড়লো, হানশিত! এদিকে এসো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *