৬. নুরে ছফার আপাত অমীমাংসিত কেস

ধ্যায় ২৬

নুরে ছফার আপাত অমীমাংসিত কেস

ডিবির জাঁদরেল ইনভেস্টিগেটর নুরে ছফার দশ বছরের চাকরি জীবনে কোনো অমীমাংসিত কেস নেই। এ নিয়ে তার গর্ব ছিলো কিন্তু অনন্য এই রেকর্ডটি মারাত্মকভাবে হুমকির শিকার হয় গত বছরের একটি মিসিং কেস’ তদন্ত করতে গিয়ে। পুলিশ থেকে সিআইডি ঘুরে ডিবিতে দেয়া হয়েছিলো সেটা। বড়কর্তাদের আশা ছিলো ডিবির চৌকষ ইনভেস্টিগেটর নুরে ছফা নিশ্চয়ই এটার সুরাহা করে নিজের রেকর্ডটা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে। সবাই যখন ব্যর্থ তখন একজনই কেবল সমাধা করতে পারে, আর সেটি নুরে ছফা ছাড়া আর কেউ নয়-এমন বদ্ধমূল ধারণা ডিপার্টমেন্টে এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তার সক্ষমতার কথা উপরমহলে এতোটাই প্রচারিত যে, অনেক সময় এক ধরণের ভীতিও কাজ করে তাকে নিয়ে। এটি এমন এক ভীতি যা ছফাকে অন্যভাবে গর্বিত করে।

দু-বছর আগে আলোচিত এক সাংবাদিক-দম্পতির হত্যার তদন্ত সাংবাদিক মহলের প্রবল চাপ থাকা সত্ত্বেও তার কাছে অর্পণ করা হয় নি শুধুমাত্র কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়ে যাবে বলে। কর্তারা চায় নি সাপটা বেরিয়ে পড়ুক। কেসটা একে-ওকে দিয়ে সময়ক্ষেপন করা হয়। ফলে দীর্ঘ দুই বছরেও ওটার কোনো সুরাহা হয় নি।

যাইহোক, মিসিং-কেসটা হাতে পেয়ে চ্যালেঞ্জ অনুভব করেছিলো ছফা। সে জানতো খুনের ঘটনার চেয়ে নিখোঁজ আর গুমের ঘটনা একটু বেশি কঠিন হয়। তবে এতোটা কঠিন নয় যে, সমাধানই করা যাবে না। দু দুটো সরকারী প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হবার পর তার হাতে কেসটা অর্পণ করার একটাই মানে-শেষ পর্যন্ত তার উপরেই আস্থা রাখা হয়েছে। যদিও ঈর্ষান্বিত কলিগদের কেউ কেউ মুখ ফুটে একটি আশংকার কথা বলতেও ভুলে যায় নি সমাধানের অযোগ্য একটি কেস দেয়া হয়েছে তার ক্যারিয়ারে ব্যর্থতার কলঙ্ক এঁটে দেয়ার জন্য। নিশ্চয়ই ঈর্ষাকাতর কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কুমতলব এটি।

ছফা অবশ্য এরকম কিছু ভাবে নি। সে ভালো করেই জানতো কেন তাকে এই কেসটির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ছেলেটা সাধারণ কোনো পরিবারের নয়, যারা পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াবে আর কাকুতি মিনতি জানিয়ে নিজের সন্তানের হদিশ করবে। কেসটা দেবার আগে ডিবির কমিশনার তাকে ডেকে গোপন একটি কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের এক শীর্ষকর্মকর্তার ইচ্ছেয় এই কেসটা তাকে দেয়া হয়েছে। ভিক্টিম সেই কর্মকতার আপন বড়বোনের ছেলে। সঙ্গত কারণেই ভাগ্নের জন্য মামা বেশ উদ্বিগ্ন। ভাগ্নের পরিণতি কি হয়েছে, আর কে এর জন্যে দায়ি সেটা জানতে বদ্ধপরিকর ভদ্রলোক। লোকেমুখে ছফার সাফল্যের কথা শুনেই তিনি কেসটা ডিবিতে ট্রান্সফার করিয়েছেন আর ব্যক্তিগতভাবে কমিশনারকে অনুরোধ করেছেন, তদন্তের দায়িত্বটি যেনো অবশ্যই তাকে দেয়া হয়।

কেসটা যখন ছফার হাতে এলো সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি এটা তাকে কতোটা ভোগাবে। ত্রিশ বছরের এক স্মার্ট আর কপোরেট এক্সিকিউটিভ নিখোঁজ। কথা নেই বার্তা নেই লোকটা দুনিয়া থেকে উধাও হয়ে গেছে। অফিসের কলিগের জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার পাঁচটার পর কাজশেষে যথারীতি অফিস থেকে বেরিয়ে যাবার পর তার আর কোনো খবর নেই। ছফা বেশ তিক্ততার সাথেই দেখতে পেলো, কেসটার সামান্য অগ্রগতিও করতে পারে নি আগের তদন্তকারীরা। ফলে একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হয় তাকে।

পুলিশ আর সিআইডির একগাদা ফাইল পড়ার পর ফিল্ডে নেমে পড়ে সে। ছেলেটা অবিবাহিত, থাকতে একদম একা, অভিজাত এলাকার নির্জন এক ফ্ল্যাটে। আশেপাশের কারো সাথে কোনো রকম যোগাযোগ রাখতো না। বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই থাকে কানাডায়। অভিজ্ঞতা থেকে ছফা জানতো, এরকম অসামাজিক, পরিবারহীন লোকজনের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেয়াটা খুব কঠিন হয়।

ছেলেটার অফিসের কলিগদের সাথে দেখা করেও সুবিধা করতে পারলো সে। নিখোঁজ ছেলেটি মিশুক প্রকৃতির ছিলো না। অফিসের যে দু চারজনের সাথে তার বেশি খাতির তারা গুরুত্বপূর্ণ কিছুই জানাতে পারলো না। ওদের কাছ থেকে সামান্যতম ইঙ্গিতও বের করতে পারলো না সে। সবাই একই গল্প শোনালো নিখোঁজ হবার আগে হাসিব অন্যসব দিনের মতোই। অফিসের কাজে ডুবে ছিলো। তারপর কাজশেষে অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। একজন কলিগ তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো উইকেন্ডে সে কি করবে মাল্টিপ্লেক্সে হলিউডের একটা নতুন ছবি এসেছে, দেখবে নাকি? সে তাকে জানিয়েছিলো, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ছবিটা দেখতে পারছে না কারণ শুক্রবার তার একটা দাওয়াত আছে।

কিসের দাওয়াত?

আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কথা বলেও তার কোনো হদিশ বের করতে পারে নি ছফা। ঐদিন ছেলেটার কোনো আত্মীয়, এমনকি পরিচিত কারোর কোনো অনুষ্ঠান ছিলো না। এটা খোঁজ করতে গিয়ে বরং সে জানতে পেরেছে, হাসিব একেবারেই অসামাজিক একটি ছেলে। নিকটাত্মীয়ের বিয়েতেও সচরাচর যায় না। অফিস থেকে বাসা, বড়জোর মাঝেমধ্যে সিনেমা দেখা। অফিসের বাইরে তার বন্ধুমহলটিও খুব ছোটো। ওদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগও রক্ষা করে না। বিদেশে থাকা বাবা-মা বিয়ের জন্য বেশ তাড়া দিলেও বিয়ে করতে রাজি হয় নি। ছফা ধরে নিয়েছিলো হাসিবের সাথে হয়তো কোনো মেয়ের সম্পর্ক আছে। কিন্তু এখানেও আশাহত হতে হয় তাকে।

নিখোঁজের পর পুলিশ এবং পরবর্তীকালে সিআইডি তদন্ত করেছে, অনেক লোকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। অনেককে সন্দেহ করে জিজ্ঞাসবাদও করেছে কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। ছফা যখন তৃতীয়বারের মতো ঐসব লোকজনের সাথে কথা বলতে গেলো তখন স্বাভাবিক কারণেই সবাই বিরক্তি প্রকাশ করলো। একটা কেস নিয়ে পুলিশ বার বার তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, এটা কেমন কথা? ফলে ছফাকে একটু বেকায়দায় পড়তে হয়।

কেসটা হাতে পাবার এক মাস পরেও সে কিছুই করতে পারে নি। ব্যাপারটা তার জন্য রীতিমতো হতাশার ছিলো। এরকম সাদামাটা কেস নিয়ে যে বিপাকে পড়বে সেটা একদমই ধারণা করতে পারে নি। সারাদিন অফিস করে রাতে বাড়িতে গিয়েও প্রচুর কাগজপত্র, তথ্য ঘাঁটাঘাটি করতে শুরু করে। প্রায় কয়েক শ পৃষ্ঠার কাগজে লোকজনের ইন্টারভিউয়ের কপি, হাসিবের বিভিন্ন সময়ের ছবি, ক্রেডিট কার্ডের মানি ট্রানজাকশান, ব্যাঙ্কের কাগজ, তার ঘর থেকে পাওয়া নানান ধরণের দলিল-দস্তাবেজ, রিসিট, এরকম কাগজের স্তূপে ডুবে গিয়েও সামান্যতম কলু বের করা যায় নি।

দেড় মাসের মাথায় তার বস, ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের কমিশনার নিজের হতাশা প্রকাশ করে ছফাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, শুধু তিনি নিজে নন, ছেলেটার মামা, প্রধানমন্ত্রীর অফিসের ঐ ক্ষমতাবান কর্মকর্তাও তদন্তের এমন বেহাল দশা দেখে অসন্তুষ্ট। ছফা তার চাকরি জীবনে প্রথমবারে মতো বসের রুম থেকে মাথা নীচু করে বের হয়ে আসে। নিরস্ত্র সৈনিকের চেয়েও বেশি অসহায় কলু আর এভিডেন্স ছাড়া একজন ইনভেস্টিগেটর। অবশ্য তার বস দয়া করে, সম্ভবত ছফার অনন্য কীর্তি অক্ষুণ্ণ রাখার সুযোগ দেবার জন্য তাকে আরো এক মাসের সময় বাড়িয়ে দেয়।

ঐদিন রাতে বাসায় ফিরে গেলেও সারারাত তার ঘুম আসে নি। হাসিরের মতো একজন যুবক হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে যাবে? সে তো কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে মারা যায় নি। পুলিশ বহু আগেই এটা খতিয়ে দেখেছে। খারাপ কোনো লোকের পাল্লায় পড়ে কিডন্যাপও হয় নি। তাকে জিম্মি করে টাকা দাবি করার মতো ঘটনাও ঘটে নি।

তার ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড কেএস খান ঢাকার বাইরে অন্য একটা কেস নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। বলা নেই কওয়া নেই এক সজ্জন ব্যক্তির ফ্ল্যাটে কোত্থেকে যেনো লাশ এসে হাজির! অজ্ঞাত মৃতলোকটি ফ্ল্যাটে কিভাবে ঢুকলো, কিভাবে খুন হলো সে-ব্যাপারে সামান্যতম কুলুও খুঁজে পায় নি পুলিশ। ফলে যা হবার তাই হয়েছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা হালে পানি না পেয়ে কেএস খানের দ্বারস্থ হয়। পুলিশ আর ডিবির প্রায় সবাই কোনো কেসে সুবিধা করতে না। পারলে মি. খানের শরণাপন্ন হয়। ভদ্রলোকও কাউকে না করতে পারেন না।

অবশেষে ছফাও তাই করে কিনতু বেচারা কক্সবাজারে গিয়ে জুরে। পড়ে গেছিলো। জ্বরের ঘোরেই তার কাছ থেকে কেসটার ব্যাপারে সংক্ষেপে সব শুনে বলেন, আগের তদন্তকারীরা নিশ্চয়ই কোনো ভুল করেছে, আর সেই ভুলটা তাদের কাজের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। চলভাষায় স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তিনি আরো বললেন, “নুরে ছফা, একটা কথা মনে রাখবেন, যে মাটিতে আছাড় খাইবেন সেই মাটি থেইকাই আপনেরে উঠতে হইবো।”

কেএস খান তাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরে তিনি কেসটা দেখবেন। এই ফাঁকে ছফা যেনো আগের তদন্তের কিছু ভুল-ত্রুটি খুঁজে বের করে।

পরদিনই ছুটি নিয়ে নেয় সে, সারাদিন পড়ে থাকে নিজের ঘরে। কেসের যতো কাগজপত্র আছে সবকিছুতে আবার চোখ বুলাতে শুরু করে। লোকজনের ইন্টারভিউ, ভাষ্য, সব আরেকবার পড়তে শুরু করলো গভীর মনোযোগের সাথে। আগের ফাইলে থাকা হাসিবের কিছু ছবি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখে গেলো, আর এটা করতে গিয়েই একটা বিষয় তার মাথায় এলো। আগের তদন্তকারীরা কি হাসিবের ঘনিষ্ঠ কারোর সাক্ষাৎকার বাদ দিয়েছে?

হাসিবের সাথে তার কলিগ আর বনধুবান্ধবদের কিছু ছবিতে চোখ বুলাতে গিয়ে সে চেক করে দেখলো এদের মধ্যে কার কার সাথে আগের তদন্তকারী অফিসাররা কথা বলেছে। কাগজপত্র ঘেঁটে সে নিশ্চিত হলো পুলিশ আর সিআইডি একটি ছেলের ইন্টারভিউ নেয় নি। কিন্তু হাসিবের সাথে বেশ কিছু ছবিতে ঐ কলিগকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখা গেছে, অথচ তার কোনো ভাষ্য পলিশ কিংবা সিআইডি নেয় নি কেন?

পরদিন সকালে নিজের মোটরসাইকেলে করে ঐ কলিগের সাথে কথা বলার জন্য হাসিবের অফিসে চলে যায় ছফা। ঐ কলিগের সাথে কথা বলার সময় সে জানতে চায়, হাসিবের কি কোথাও যাবার প্ল্যান ছিলো? এরকম কিছু কি সে ঐদিন বলেছিলো?

না। এরকম কোনো কথা হাসিব তাকে বলে নি। কথাটা শুনে ছফা হতাশ হয়েছিলো, কিন্তু পরক্ষণেই ছেলেটা জানায়, তবে নিখোঁজ হবার দিন। হাসিব ওর কাছে জানতে চেয়েছিলো ভালো কোনো ট্যাক্সিক্যাব কোম্পানির নাম্বার দিতে পারবে কিনা।

ট্যাক্সিক্যাব?

হ্যাঁ। হাসিবকে সে গ্রিনল্যান্ড-ক্যাব কোম্পানির নাম্বারটা দিয়ে জানতে চেয়েছিলো, ক্যাব দিয়ে ও কি করবে। জবাবে ভিক্টিম বলেছে, সন্ধ্যার পর এক আত্মীয়কে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করতে হবে।

ছফা উত্তেজনায় টগবগ করতে শুরু করে। হাসিব তার ঘনিষ্ঠ কলিগকে বলেছে এক আত্মীয়কে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করতে হবে। অথচ অন্য এক কলিগকে সে বলেছিলো শুক্রবারে একটা বিয়ের দাওয়াত আছে।

অসঙ্গতি!

হাসিব কেন এরকম মিথ্যে বললো? তার নিকটজনেরা জানিয়েছে কোনো আত্মীয়কে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করার মতো ঘটনার কথা কারোর জানা নেই।

হুট করে এরকম কলু পেয়ে নড়েচড়ে বসলো সে। হাসিব মিথ্যে বলেছে। কেন বলেছে? কিছু একটা লুকানোর জন্য? অবশ্যই। সেটা কি? ছফা জানতো জবাবটা পাওয়া যাবে ঐ ট্যাক্সিক্যাব কোম্পানির কাছ থেকেই।

সঙ্গে সঙ্গে সে চলে যায় ট্যাক্সিক্যাব কোম্পানিতে। এক মুহূর্ত দেরি করার মতো মানসিক অবস্থায় ছিলো না। হাসিব ঠিক কোন দিন কতো তারিখে, আনুমানিক কয়টার দিকে ফোন করেছিলো সেটা জেনে নিয়েছিলো। ঐ ঘনিষ্ঠ কলিগের কাছ থেকে। ট্যাক্সিক্যাব কোম্পানি প্রথমে গাইগুই করলেও ছফার চাপাচাপিতে বাধ্য হয়েই পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে দেখে, কিন্তু কয়েক মাসের পুরনো বলে ঐদিনের কোনো রেকর্ড সংরক্ষিত করা ছিলো না। ছফা এতে হতাশ না হয়ে অন্যভাবে চেষ্টা করে। ঐদিন গ্রিনল্যান্ড ক্যাব কোম্পানিতে কয়টি ক্যাব পথে ছিলো-সেগুলোর ড্রাইভার ছিলো কারা? কোম্পানি থেকে জানতে পারে, ঐদিন ক্যাবের সংখ্যা ছিলো একত্রিশটি। তার মধ্যে সাতাশজন ড্রাইভার বর্তমানে কর্মরত আছে, বাকিরা চাকরি ছেড়ে চলে গেছে, কোথায় গেছে সে সম্পর্কে তারা কিছু জানে না।

ছফা এরপর তিনদিন ধরে ঐ সাতাশজন ড্রাইভারকে ইন্টারভিউ করে যায়, হাসিবের একটি সাম্প্রতিক ছবি দেখিয়ে জানতে চায় এই লোককে তাদের মধ্যে কেউ প্যাসেঞ্জার হিসেবে পেয়েছিলো কিনা। তৃতীয় দিনে এক তরুণ ড্রাইভার হাসিবের ছবি দেখে জানায়, সম্ভবত লোকটাকে সে চিনতে পেরেছে। আগ্রহী হয়ে ওঠে ছফা। ড্রাইভার বলে, ঢাকার গুলশানের একটি অফিস থেকে প্যাসেঞ্জারকে তুলেছিলো। টেলিফোন করে ক্যাবটা বুকিং দেয়া হয়। ঠিক তখনই নুরে ছফা বুঝে গেছিলো এটাই সেই ড্রাইভার যে হাসিবকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছিলো।

কিনতু গন্তব্যটা কোথায় ছিলো সেটা কি ড্রাইভারের মনে আছে? প্রশ্নটা করার আগে ছফা আশংকা করেছিলো, সম্ভবত অনেক দিন আগের ঘটনা বলে ড্রাইভারের পক্ষে গন্তব্যের কথাটা মনে না-ও থাকতে পারে। এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে চমকে দিয়ে ঐ ক্যাবচালক জানায় তার স্পষ্ট মনে আছে ঐ প্যাসেঞ্জারকে কোথায় নামিয়ে দিয়েছিলো।

কথাটা শুনে ছফা যারপরনাই বিস্মিত হয়। কিন্তু সে নিশ্চিত হতে পারছিলো না ক্যাবচালক কিভাবে এটা মনে রাখতে পারলো। ঠিক তখনই চালক তাকে ভড়কে দিয়ে আরেকটি তথ্য দেয়-হাসিবকে ওখানে পৌঁছে দেবার মাস দুয়েক আগে আরেকজন প্যাসেঞ্জারকে একই জায়গায়, একই রেস্টুরেন্টে নামিয়ে দিয়েছিলো সে। রেস্টুরেন্টটির অদ্ভুত নাম আর দু জন প্যাসেঞ্জারকে একই গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার কারণেই এতোদিন পরও ওই জায়গাটা ক্যাবচালকের মনে আছে।

সুন্দরপুরে? ওখানকার সড়কের পাশে একটি রেসটুরেন্টে?

 রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসে নি??

.

ধ্যায় ২৭

এসপি মনোয়ার হোসেন অনেকক্ষণ চুপ মেরে সব শোনার পর গাল চুলকালো।

এরইমধ্যে চা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছে ছফাকে। চায়ের কাপে পর পর কয়েক চুমুক দিয়ে শেষ করে রেখে দিলো সে। এসপি আরো আগেই নিজের কাপ খালি করেছে। ছফা এতোক্ষণ একনাগারে কথা বলছিলো বলে চায়ে খুব কমই চুমুক দিতে পেরেছে।

 “বুঝলাম ঐ দু-জন নিখোঁজ ব্যক্তি ঢাকা থেকে রবীন্দ্রনাথে এসেছিলো,” সুন্দরপুরের এসপি যথেষ্ট নরমকণ্ঠে বললো, “কিন্তু তার মানে তো এই নয়, ওদের নিখোঁজের সাথে মিসেস জুবেরি জড়িত?”

 “দু-জন মানুষ একই গন্তব্যে আসার পর নিখোঁজ হয়ে যাওয়াটা কি খুব বেশি কাকতালীয় হয়ে যায় না?” ছফা পাল্টা জানতে চাইলো।

“তা ঠিক,” এসপি থুতনি চুলকালো। “আমি কিন্তু তা বলছি না, আমি বলতে চাচ্ছি…এমনও তো হতে পারে, অন্য কেউ বা কোনো গ্রুপ এসবের সাথে জড়িত…তারা হয়তো রবীন্দ্রনাথকে সেফ-প্লেস হিসেবে ব্যবহার করেছে?”

ছফা মুচকি হাসলো কথাটা শুনে। “দুই-দু-জন লোক রবীন্দ্রনাথে এসে নিখোঁজ হয়ে গেছে-এটা জানার পর আমি ঢাকার থানাগুলোতে চেক করে দেখেছি একই রকম নিখোঁজ হবার আনসলভ কেস তাদের কাছে আছে কিনা। সব রেকর্ড চেক করার পর এরকম আরো তিনটি কেস পাওয়া গেছে। হ্রট করে তারা কাউকে কিছু না বলে একদিন উধাও হয়ে গেছে। তাদের সবার বয়স ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশের মধ্যে। সবাই ভালো চাকরি করতো। সিঙ্গেল ছিলো।”

এসপি হা করে চেয়ে থেকে অবশেষে বললো, “ওই তিনজনও কি এখানে এসেছিলো?”

 “না। সেটা এখনও জানা যায় নি। তবে আমার মনে হয় ওই তিনটি ঘটনাও এই কেসের সাথে সম্পর্কিত। সম্ভবত তারাও একইরকম ভাগ্য বরণ করেছে এখানে এসে।”

“কি রকম?”

“আশা করি সেটা খুব জলতি জানতে পারবো।”

“এমন কি হতে পারে না,” নরম কণ্ঠে বললো এসপি, “সংঘবদ্ধ একটি গ্রুপ এসবের সাথে জড়িত। ওরা হয়তো এখানেই, এই সুন্দরপুরে অপারেট করে?”

“যুক্তির খাতিরে যদি বলেন, তাহলে এটা অবশ্যই হতে পারে।”

এসপি নিজের হাইপোথিসিস বলতে উৎসাহী হয়ে উঠলো। “অনেকটা ছিনতাইকারীদের মতো আর কি..তারা একটা জায়গা বেছে নেয় নিরাপদে ছিনতাইয়ের জন্য। তার মানে তো এই নয়, ঐ জায়গার মালিক কিংবা আশেপাশে যারা থাকে তারা ছিনতাইর সাথে জড়িত?”

“আমি কিন্তু এটা জানার পরই ঐ মহিলাকে সাসপেক্ট করি নি,” আস্তে করে বললো ছফা। “এখানে আসার আগে আমি আসলে জানতামই না রেস্টুরেন্টটির অসাধারণ খাবারের কথা আর তার মালিক একজন মহিলা।”

এসপি চুপ মেরে গেলো।

“তার চেয়েও বড় কথা রেস্টুরেন্টটা যে মিটিংপ্লেস হতে পারে সেটাও ধরে নিয়েছিলাম কিন্তু এর অদ্ভুত নাম আর রহস্যময়ী মালিক আমার মনোযোগ আর্কষণ করলো, কারণ এই কেসটার সাথে রবীন্দ্রনাথের একটা কানেকশান আছে।”

“মানে?” এসপিকে খুবই বিস্মিত দেখালো।

“আমি যে ভিক্টিমের মিসিং-কেসটা নিয়ে কাজ করছি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে চারুলতা নামের রহস্যময় একটি আইডি আছে। ঐ আইডিটা এখন ডি-অ্যাক্টিভ।”

 “চারুলতার সাথে রবীন্দ্রনাথের কী সম্পর্ক?” বোকার মতো বলে ফেললো এসপি।

গাল চুলকালো ছফা। রবীন্দ্রনাথ যার ভালোমতো পড়া নেই তাকে এটা। বোঝাতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। “লম্বা গল্প…বাদ দেন। আসল কথা হলো, গত তিন-চারদিনে আমি আরো অনেক কিছুই জানতে পেরেছি। এখানে আসার আগে নিখোঁজ ঘটনাগুলোর সাথে রেসটুরেন্টটার কি কানেকশান থাকতে পারে সেটা নিয়ে আগে থেকে কিছুই ভাবি নি। ঐ মহিলার কথা তো বহু দূরের ব্যাপার।” একটু থেমে আবার বললো, “যাইহোক, আমি যে অনেক কিছু জেনে গেছি সেটা ঐ মুশকান জুবেরিও বুঝে ফেলেছে খুব দ্রুত, সে-কারণেই আমার পেছনে আপনাদের লেলিয়ে দিয়েছে।”

কথাটা শুনে এসপি মনোয়ার হোসেন কাচুমাচু খেলো।

“মনে রাখবেন, আমাদের ভিক্টিম যাত্রাপথে গাড়ি থামিয়ে রবীন্দ্রনাথে খাওয়াদাওয়া করে নি। সে ঢাকা থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এখানে এসেছিলো। ওয়ান-ওয়ে রেন্ট ছিলো ওটা। এজন্যে ক্যাব-চালককে ভালো টাকাও দেয়া হয়।”

এসপি ভদ্রলোক কপাল ঘষলো হাত দিয়ে। “ম্যাডামের ব্যাপারে কি এমন কিছু জানতে পেরেছেন যার কারণে উনাকেই প্রাইম সাসপেক্ট মনে করছেন?”

এসপির দিকে তাকিয়ে আবারো মুচকি হাসলো ছফা। “আমি যা জানতে পেরেছি সেটা যদি শোনেন তাহলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে৷”।

সুন্দরপুরের এসপি ঢোক গিলে গোল গোল চোখে চেয়ে রইলো। কিছু একটা বলতে যাবে অমনি বেজে উঠলো তার মোবাইলফোনটা। বেচারার কপাল আজ সত্যি খারাপ। ফোনটা রাখা আছে ডেস্কের উপরে। ডিসপ্লেতে কলার আইডি দেখে ছফার অভিব্যক্তি কী রকম দুবোধ ঠেকলো তার কাছে।

“কলটা ধরবেন না?” বাঁকাহাসি দিয়ে বললো নুরে ছফা।

 দীর্ঘশ্বাস ফেললো মনোয়ার হোসেন। “ধরে বলবোটা কী?”

“জানি না। তবে না ধরলে তো মহিলা অন্য কিছু ভাববে।”

এসপি চুপ মেরে রইলো।

“আমার মনে হয় ফোনটা রিসিভ করাই ভালো। উনাকে বলে দিন, আপনি অন্য একটা কাজে খুব ব্যস্ত আছেন। ওসির সাথে আর কথা হয় নি। সন্ধ্যার দিকে ফোন করে জানাবেন। আশা করি তখন আর ফোন করার দরকার হবে না।”

ফোনের রিং বন্ধ হয়ে গেলো।

“আরেকবার যদি করে তাহলে বলবো…এখন কলব্যাক করে এটা বলা ঠিক হবে না। আমি তো খুব বিজি আছি, তাই না?”

 “আপনি একটু পরই উনাকে কলব্যাক করে এ কথাগুলো বলবেন।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো এসপি মনোয়ার হোসেন। তার সামনে যে লোক বসে আছে তার সাথে দ্বিমত প্রকাশ করলে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। এরইমধ্যে যথেষ্ট বিপাকে পড়ে গেছে। এই নুরে ছফা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ক্ষমতাবলে এখন ছড়ি ঘোরাচ্ছে তার উপরে। এর সাথে তাল মিলিয়ে না চললে বিপদ। একে চটানো হবে ক্যারিয়ার সুইসাইড করার শামিল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ক্ষমতাধর ব্যক্তি স্বয়ং আইজিসাহেবকে দিয়ে ফোন। করিয়েছেন। কপাল ভালো থাকলে হয়তো সুন্দরপুর থেকে ভুরুঙ্গামারি কিংবা খাগড়াছড়িতে বদলি না-ও হতে পারে।

 “আমাদের এমপি সাহেব কিনতু ইন্টারফেয়ার করতে পারেন…আই মিন, মিসেস জুবেরির সাথে উনার বেশ ভালো সম্পর্ক…উনি যদি ব্যাপারটা এমপিকে-”

হাত তুলে এসপিকে থামিয়ে দিলো ছফা। “এমপি আসাদুল্লাহকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। উপযুক্ত জায়গা থেকে উনার লাগাম টেনে ধরা হবে।”

এসপি চুপ মেরে গেলো। কথাটার মানে বুঝতে আর বাকি নেই।

“আপনার সাথে যে মিসেস জুবেরির দারুণ খাতির…এটা আমার কাজে ভালোই সাহায্য করবে,” মনোয়ার হোসেনকে চুপ থাকতে দেখে বললো ছফা।

 “না, আসলে তেমন খাতির নেই…” কাচুমাচু খেলো ভদ্রলোক। “ঐ আমাদের এমপির কারণে একটু যোগাযোগ রাখতাম আর কি।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “এখন বলুন, ঢাকা থেকে কেউ কি ঐ মহিলার সাথে দেখা করতে আসে এখানে?”

এসপি বুঝতে পারলো না কী বলবে। তবে ছফাকে সহযোগীতা না করার কথা এ মুহূর্তে চিন্তাও করতে পারছেনা।

“ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ নামের কেউ কি এখানে আসে?”

মনোয়ার হোসেন বুঝতে পারলো এই লোকের কাছে সত্যিটা না বলে এখন আর উপায় নেই। “আমার জানামতে কেবল উনিই আসেন…আর কারোর কথা আমার জানা নেই।”

মুচকি হাসলো ডিবির ইনভেস্টিগেটর। তার সহকারী ঠিকই বলেছে। অরিয়েন্ট হাসপাতালের অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হাসপাতালের একাংশের মালিক এবং স্বনামখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের সঙ্গে মুশকান সোহেলির বেশ সু-সম্পর্ক ছিলো। আর এখন এসপি বলছে, ঐ ডাক্তারই কেবলমাত্র সুন্দরপুরে আসে। তার মানে ডাক্তারসাহেব আরেকটা সোর্স অব ইনফর্মেশন হতে পারে।

.

অধ্যায় ২৮

কোনো জটিল আর কঠিন কেস সমাধান করার পরই কিছুদিন বই নিয়ে ডুবে থাকে সে। অদভুত আর রহস্যময় একটি লাশ নিয়ে যে জটিলতার মধ্যে নিপতিত হয়েছিলো বিগত কয়েকটা দিন, অবশেষে সেটার মীমাংসা করা গেছে। কিন্তু বইয়ের মধ্যে ডুবে না গিয়ে অন্য একটি কেস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কেএস খান। এটা খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা। তবে যে কারণে সে এখন মাথা ঘামাচ্ছে সেটা আরো বেশি ব্যতিক্রধর্মী।

দীর্ঘদিন পর তদন্তের সুবাদে ঢাকার বাইরে কক্সবাজারে গেছিলো। তদন্ত কী আর করবে, ওখানে পা রাখতে না রাখতেই সারা শরীর কাঁপিয়ে জ্বর চলে আসে। পর পর তিনদিন হোটেল-রুমে বন্দী হয়ে থাকে সে। বেলকনি থেকে সমুদ্র দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে নি। তার ছাত্র। আমিরুল অবশ্য যথাসাধ্য সেবা করেছে তার। কক্সবাজারের সবচেয়ে বড় ডাক্তারকে ডেকে এনেছিলো হোটেলে। যদিও এর কোনো দরকারই ছিলো না। নিজের শরীরকে সে ভালোমলোই চেনে। তিন-চারদিন ভুগিয়ে এক সকালে ঘুট করেই জ্বর তাকে ছেড়ে পালাবে-এ ব্যাপারে একদম নিশ্চিত ছিলো। অসুখ-বিসুখ হলো তার ইয়ার-দোস্তের মতো। নিত্যদিন আসবে, আবাজি করবে তারপর চলেও যাবে, স্ত্রী-সন্তানের মতো জীবনের সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে থাকবে না।

তো, তিনদিন পর জ্বরটা ঠিকই উধাও হয়ে গেলো। সেও দেরি না করে নেমে পড়লো কাজে। কারণ জ্বরের ঘোরেই তার মাথায় কুলু-বিহীন কেসগুলোর সমাধান চলে আসে চট করে। এই অদ্ভুত কাণ্ডটি বার বার ঘটে তার সাথে। সেদিক থেকে দেখলে, কোনো কেসের জটিলতম সময়ে তার জ্বর চলে এলে মনে মনে আশান্বিত হয়ে ওঠে সে।

হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেতেই দেখতে পেলো তার সামনের টেবিলে এক কাপ চা ধোঁয়া ছাড়ছে। একটু আগে আইনস্টাইনকে চা দিতে বলেছিলো। কাপটা তুলে নিয়ে লম্বা করে চুমুক দিলো।

তার প্রিয়পাত্র নুরে ছফা একটা কেস নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। একজন মানুষের নিখোঁজ হবার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করেছে সত্যিকারের নিখোঁজের সংখ্যা পাঁচজনের নীচে হবে না। এই পাঁচজনের মধ্যে কমপক্ষে দু-জনের শেষ গন্তব্য কোথায় ছিলো সেটা বের করতে সক্ষম হয়েছে সে। উত্তরবঙ্গের একটি মফশ্বল শহর সুন্দরপুরে ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি’র মতো অদ্ভুত নামের একটি রেসটুরেন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। রেস্টুরেন্টটির মালিক মুশকান জুবেরি সম্পর্কে এ পর্যন্ত যেসব তথ্য ছফা জানতে পেরেছে তাতে মনে হচ্ছে নিখোঁজ ঘটনাটির মতো ঐ মহিলাও কম রহস্যময়ী নয়। কিন্তু তার নিজের কৌতূহল হচ্ছে অন্য একজনকে নিয়ে। ছফা এখন যেখানে আছে সেই সুন্দরপুরে নাকি এমন এক গোরখোদক রয়েছে, যে মানুষ মারা যাবার আগেই টের পেয়ে যায়। অনেক সময়ই দেখা যায় নিজ উদ্যোগে সে কবর খুড়ছে, আর তার পর পরই শোনা যায় ঐ গ্রামে একজন মারা গেছে!

নুরে ছফা তাকে অল্পবিস্তর যেটুকু বলেছে তাতে দেখা যাচ্ছে রহস্যময় গোরখোদক বয়সে তরুণ, বিয়ে-শাদী করে নি এখন পর্যন্ত, কবরস্তানের ভেতরেই ছোট্ট একটা কুড়েঘরে থাকে। ওখানকার অনেকেই মনে করে এই গোরখোদক ছেলেটি কামেল কেউ হবে। তার অবশ্য তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। সে হলো যুক্তির মানুষ। গালগল্প আর অতিপ্রাকৃত কিছুতে কোনো কালেই তার বিশ্বাস ছিলো না। সবকিছুই যুক্তি দিয়ে বিচার করে। সে নিশ্চিত, গোরখোদকের অমন অদ্ভুত আচরণের পেছনে বাস্তবসম্মত কারণ রয়েছে। আর সেই কারণটা যতক্ষণ না বের করতে পারছে ততোক্ষণ তার স্বস্তি নেই।

ছফা তাকে আরো বলেছে, এই ছেলেটাকে মুশকান জবেরির বাড়ির নির্জন জায়গায় কবর খুরে কিছু মাটিচাপা দিতেও দেখেছে সে। ঐ সময় রহস্যময়ী মহিলাও উপস্থিত ছিলো তখন। সব মিলিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক একটি ঘটনা। আর এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে ছুট করেই তার মাথায় একটা সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছে। এটা হতে পারে অ্যাডভান্স কবর খোরার সম্ভাব্য যৌক্তিক ব্যাখ্যা। তবে তার জন্য কিছু জরুরি তথ্য জানা দরকার। এজন্যে নুরে ছফাকে ফোন করে বলে দিতে হবে।

“আপনে রাইতে কি খাইবেন?”

 আইনস্টাইনের কথায় ফিরে তাকালো কেএসকে। “রুটি। চায়ে চুমুক দিয়ে সংক্ষেপে জানালো সে।

“আরে, রুটির লগে কি খাইবেন ওইটা জিগাইছি।”

 “ও,” একটু ভাবলো কেএস খান। “তর যেইটা ভালা লাগে নিয়া আয়।”

“কলিজার ভূনা নিয়া আসুম?”

ছেলেটার দিকে তাকালো। তার চোখমুখে কেমন হাসিহাসি ভাব। বুঝতে পারলো, আজরাতে কলিজার ভুনাই খেতে হবে নইলে এই আইনস্টাইন সুগভীর এক আক্ষেপ নিয়ে ঘুমাতে যাবে।

“ঠিক আছে, কলিজার ভুনাই নিয়া আয়।”

হাসিমুখে ঘর থেকে চলে গেলো ছেলেটা।

নুরে ছফা কিছুটা বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করতে পারলো না, কারণ ফোনের ওপাশে যে মনুষটার সাথে এখন কথা বলছে তাকে সে কেবল শ্রদ্ধাই করে না, বরং অভিভাবকও মনে করে। এই মানুষটির সাথে তার বেশ মিল। তাদের দুজনের একটাই সমস্যা-নিজেদের নাম! উভয়ের প্যাশন। ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন। কেএসকের মতো ছফাও এখন পর্যন্ত কোনো কেসে ব্যর্থ হয় নি। আর তারা দু-জন নিছক চাকরি করার জন্য ডিবিতে যোগ দেয়। নি। এটা তাদের ধ্যান-জ্ঞান।

 “নুরে ছফা, আপনে দেখবেন, ঐ আন্ডারটেকার পোলাটা যেসব অ্যাডভান্স কবর খুদছে ওইগুলার আশেপাশে কি আছে বুঝতে পারছেন। আমার কথা?”

“জি, স্যার,” নুরে ছফা জবাব দিলো। একটু আগে কেএস খানকে সে ফোন করেছিলো জরুরি একটা প্রয়োজনে, অথচ মি. খান মুশকান জুবেরির ব্যাপারে আগ্রহ না দেখিয়ে উৎসুক হয়ে পড়েছে গোরখোদক ফালুর ব্যাপারে!

 “অ্যাডভান্স কবরগুলার পাশে যদি অন্য কোনো কবর থাকে তাইলে। দেখবেন ওইগুলা কতোদিনের পুরানা…আর ডিসটেন্সটাও কিন্তু খুব ভাইটাল…বুঝবার পারছেন তো আমার কথা?”

“জি, স্যার,” আবারো একই কথা বললো বটে আসলে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। “ডিসটেন্স মানে?…কিসের ডিসটেন্স, স্যার?”

“ঐ যে অ্যাডভান্স কবরের পাশে পুরাতন কবর যদি থাকে সেইটার কথা বলতাছি।”

আলতো করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ছফা। এসব তথ্য জানতে কেন উদগ্রীব হয়ে উঠেছে তার প্রিয় এই মানুষটি সে বুঝতে পারছে না। “ঠিক আছে, স্যার।”

“এইটা কইলাম খুব জরুরি..আপনে যত জলদি পারেন এই ইনফর্মেশনগুলা আমারে দেন।”

এইসব ইনফর্মেশন জরুরি! হতাশ হলেও মুখে বললো, “আচ্ছা, স্যার।”

“মনে হইতাছে ঐ আন্ডারটেকারের মিস্ট্রিটা প্রায় সলভ কইরা ফালাইছি।”

নুরে ছফার বিরক্তি আরো বেড়ে গেলো কথাটা শুনে, তবে যথারীতি সেটা প্রকাশ করতে পারলো না। “তাই নাকি, স্যার?”

“হুম। একটা হাইপো দাঁড় করাইছি…এখন ওইটার সাপোর্টে কিছু ইনফর্মেশন লাগবো।”

“স্যার?” ছফা নিজের দরকারটার কথা না বলে আর থাকতে পারলো না।

“বলেন, শুনতাছি তো…”

“আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। কাজটা আমার এই কেসের জন্য খুবই জরুরি।”

“এই নিয়া চিন্তা কইরেন না, আমি তো বলছিই, আপনেরে এই কেসে যতোটুকু হেল্প করনের দরকার আমি করুম। আপনে আগে ঐ আন্ডারটেকারের-”।

 “স্যার,” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলতে বাধ্য হলো নুরে ছফা। “আপনার জন্য ঐ ইনফর্মেশনগুলো কালেক্ট করার ব্যবস্থা করছি কিন্তু আমি যে কাজটার কথা বলছি সেটা অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে অনেক বেশি ইম্পোর্টেন্ট।”

 “ও।” ওপাশ থেকে কেবল এটাই বললো ডিবির সাবেক ইনভেস্টিগেটর।

“আপনি ছাড়া এটা অন্য কেউ ভালোভাবে করতে পারবো না।” “কাজটা কি, নুরে ছফা?”

.

ধ্যায় ২

আতর আলীর সিনা যতোটা চওড়া ছিলো তারচেয়েও বেশি চওড়া হয়ে গেছে। সেই চওড়া সিটা টানটান করে আয়েশি ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে সে। স্বয়ং নুরে ছফা, যে কিনা এখন আর সামান্য সাংবাদিক নয়, ডিবির বিরাট বড় অফিসার, তাকে একটু আগে ফোন করে একটা কাজ দিয়েছে। থানার পুলিশকে বাদ দিয়ে ছফাস্যার তাকে বলেছে ফালু ছেলেটার অ্যাডভান্স কবর খোরার ব্যাপারে একটু খোঁজ-খবর নিতে হবে। কথাটা শুনে আতর একটু অবাকই হয়। গতকাল সে যখন অ্যাডভান্স কবর খোরার কথা বলছিলো তখন ছফা কোনো আগ্রহই দেখায় নি। আজ হঠাৎ করেই আগ্রহ দেখানোর কারণ কি?

যাহোক, অতো শত ভেবে কাজ নেই। সময় হলে এই প্রশ্নের জবাব সে ঠিকই পেয়ে যাবে।

আতর বুঝতে পারছে তার এখন সুদিন। অনেকেই তাকে তোয়াজ করতে শুরু করে দিয়েছে। নুরে ছফা থানা থেকে চলে যাবার পরই এসআই আনোয়ার একান্তে ডেকে নেয় তাকে, নিজের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে দিয়ে নরম আর ভালো ব্যবহার করে তার সাথে। শেষে বেজার মুখ করে। বুঝিয়ে দিয়েছে, তার দিকটা যেনো আতর একটু দেখে। সে কি ওসিসাহেবের সামনে তার পক্ষ নিয়ে কথা বলে নি?

শুধু অনোয়ারই নয়, ওসি নিজেও তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে অনুরোধের সুরে বলেছে, সে যেনো তার হয়ে নুরে ছফাকে বুঝিয়ে বলে যা হয়েছে তার জন্য তারা লজ্জিত। সবটাই না-জেনে হয়েছে। অল্প কদিনের মধ্যে আরেকটা বাজে বদলির শিকার হতে চাইছে না বেচারা।

ব্যাপারটা এখন পরিস্কার, আতর আর সামান্য ইনফর্মারের অবস্থানে নেই। ঢাকা থেকে আসা মহাক্ষমতাধর নুরে ছফার সবচাইতে ঘনিষ্ঠ আর বিশ্বস্ত লোক সে।

এসআই আনোয়ার শুধু সিগারেট দিয়েই ক্ষান্ত হয় নি, আতরকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায় সুন্দরপুরের দক্ষিণ দিকে কালিন্দী বিলের কাছে। জায়গাটা নিরিবিলি। আয়েশ করে গাঁজা টানতে টানতে সুখ-দুঃখের কথা বলেছে এসআই। সে আরো কথা বলতে চেয়েছিলো কিন্তু আতর তাকে বলেছে জরুরি একটা কাজে তাকে এখন এক জায়গায় যেতে হবে। এসআই চলে যাবার পরই সে জমিদার বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

গেটের সামনে এসে জোরে জোরে দুটো টান দিয়ে গাঁজার স্টিকটা ফেলে দিলো আতর। বন্ধ গেটের ওপাশে যে বোবা দারোয়ান ফুটো দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে জানে। কানে শোনে না বলে বোবা ছেলেটা বেশিরভাগ সময়ই এটা করে থাকে। তুড়ি বাজিয়ে গেট খোলার ইশারা করতেই সঙ্গে সঙ্গে বড় গেটটার মধ্যে যে ছোটো গেটটা আছে সেটা খুলে মাথা বের করে ভুরু কুচকে তাকালো বোবা ইয়াকুব। ইনফর্মারকে দেখে সে খুবই অবাক হয়েছে।

আতর হাত দিয়ে ইশারা করে দেয়াশলাই কাঠি জ্বালানোর ভঙ্গি করলো। “আছে?”

ইয়াকুব মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো। নাই।

মুচকি হাসলো ইনফর্মার। “মাঙ্গেরপুত…পকেটে তো ফোকা রাখোস ঠিকই, দ্যাশলাই রাখোস না ক্যান?”

বোবা তার কথাটা শুনতে না পারলেও বুঝতে পারলো খারাপ কিছুই বলা হয়েছে। আতর শব্দ করে একদলা থুতু ফেলে অন্যদিকে পা বাড়ালে রেগেমেগে ছোটো গেটটা বন্ধ করে দিলো দারোয়ান।

আতর আরো জোরে হাঁটতে শুরু করলো। জমিদার বাড়িটার পর জোড়পুকুরে আর কোনো বসত-বাড়ি নেই। কয়েকটা আবাদি-অনাবাদি জমির পর আবার ভিটের দেখা পাওয়া যায়। ক্ষেতের আইল ধরে এগোতেই দেখতে পেলো রমাকান্ত মাস্টার ধীরপায়ে আইল ধরে এগিয়ে আসছে। চোখে চশমা নেই বলে বুড়ো মানুষটা নীচের দিকে চোখ পিটপিট করে চেয়ে চেয়ে পা ফেলছে।

“মাস্টরসাব, কই যান?”

আতরের কথায় অনেকটা চমকে উঠলেন মাস্টার। পিটপিট করে তাকালেন। “তুমি?”

“এটটু পুবপাড়ায় যাইতাছিলাম….কিন্তু এই ভরদুপুরে আপনে কই যাইতাছেন?”

মাস্টার যেনো একটু বিব্রত হলেন। কিছুটা দ্বিধাও দেখা গেলো তার মধ্যে। “এই তো…সামনেই…”

ক্ষেতের আইল থেকে নেমে দাঁড়ালো আতর, তার চোখেমুখে সন্দেহ। সামনে মাইনে? মনে মনে বললো সে। সামনে তো পুরা দুনিয়া পইড়া আছে।

রমাকান্তমাস্টার আর কোনো কথা না বলে হাটার গতি বাড়িয়ে দিলেন, যাবার সময় আতরের দিকে ফিরেও তাকালেন না।

আইলের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মাস্টারের গন্তব্য বোঝার চেষ্টা করলো ইনফর্মার। একবারের জন্যেও না থেমে, পেছন ফিরে না তাকিয়ে রমাকান্তকামার চলে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর আতর আলী অবাক হয়ে দেখতে পেলো মাস্টারের গন্তব্য আর কোথাও নয়, ঐ জমিদার বাড়ি! ধপ-ধপ করে যে ভোতা শব্দ হচ্ছে সেটা তার ভালোই লাগে। ছোটোবেলায় মা যখন ঘুম পাড়াতো তখন তার পিঠের উপরে মায়ের নরম হাত চাপড় মারলে এমনটি হতো। শব্দটার মধ্যে থাকতো সম্মোহনী শক্তি। ধীরে ধীরে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতো সে।

ধপ ধপ! ধপ!

একটু বিরতি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো ফালু। কবরটা এখনও খোরা শেষ হয় নি কিন্তু সারা শরীর ঘেমে একাকার। তার বলিষ্ঠ পেশীগুলো আরো ফুলেফেঁপে উঠেছে। দেখে মনে হচ্ছে তেলমাখানো শরীরের কোনো মল্লবীর। শীত হোক আর গ্রীষ্ম, মাথার উপরে সূর্য থাকলে একটু গরম লাগবেই। আর সেই সূর্যের নীচে দাঁড়িয়ে কেউ যদি মাটি কাটার মতো পরিশ্রমের কাজ করে তাহলে ঘেমে ওঠাটা খুব স্বাভাবিক। সাধারণ মাটি কাটার কাজের চেয়ে গোর খুরতে আরো বেশি পরিশ্রমের দরকার পড়ে। আজকের এই পরিশ্রমটা তার করতেই হতো না যদি গতরাতে ওরা চলে না আসতো।

যাহোক, সদ্য খোরা কবরের দিকে তাকালো সে। সাড়ে-তিনহাত গভীর করে মাটি খুরতে হবে। একটুও বেশ-কম করার উপায় নেই। এরইমধ্যে তিনহাত খোরা হয়ে গেছে, আর অল্প একটু খুরলেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। কপালের ঘামগুলো ডানহাতের আঙুল দিয়ে কেচে ফেলে দিলো। তাকে একটু দ্রুত করতে হবে। জরের আজান দিয়ে দিয়েছে। নামায শেষ হলেই জানাযা আর জানাযা শেষ হলে গোর।

উপুড় হয়ে আবারো কাজে নেমে পড়লো সে। বেতের টুকরিটা কবরের জমিনে রেখে দিয়েছে। কোদাল দিয়ে মাটি তুলে ওটা ভরাট করে কবরের বাইরে ফেলছে। সদ্য কবরটার একপাশে জমে আছে আলগা মাটির স্তূপ। ফালু কাজে ডুবে যেতেই আবারও সেই শব্দটা ফিরে এলো :

ধপ-ধপ-ধপ।

শব্দটার সম্মোহনী শক্তি সব সময়ের মতোই আবারো তাকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিলো।

“কার কব্বর খুদতাছোস?”

কবরের নীচ থেকে মুখ তুলে তাকালো ফালু। আতরকে দেখে অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। দু-হাত পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ইতরটার ভাব দেখে মনে হচ্ছে গ্রামপঞ্চায়েতের প্রধান সে।

“আবার ক্যাঠায় মরছে?”

“কেউ না,” তিক্তমুখে জবাব দিলো ফালু।

কথাটা শুনে রেগেমেগে তাকালো ইনফর্মার। “আবারও তুই ফাইজলামি শুরু করছোস? পাইছোস কি? নিজেরে কী মনে করোস? তুই কব্বর খুদলেই মানুষ মরবো?”

ফালু মুখ তুলে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে।

 “এতোই যহন জানোস, তয় ক না…আইজ ক্যাঠায় মরবো?”

গোরখোদক কিছুই বললো না। গতরাতে এই বদমাশটা অন্য একজনকে সাথে নিয়ে তার কাজে বাগড়া দিয়েছিলো। হ্রট করে চলে এসেছিলো ওরা। সে ভাবেও নি এতো রাতে কবরস্তানে কেউ চলে আসতে পারে। রাগে ফালুর গা জ্বলে যাচ্ছে। অবশেষে রাগ দমাতে না পেরে বলে উঠলো, “তুই মরবি! আর আমি নিজ হাতে তোরে এইহানে গোর দিমু!”

কথাটা শুনে আতরের বুক ধরফর করে উঠলো। হারামজাদা এসব কী বলছে? ওর সাহস তো কম নয়। আবার তুই-তোকারিও করছে! রাগে কাঁপতে শুরু করলো সে। চেঁচিয়ে বললো, “ওই, হারামির বাচ্চা! মুখ সামলায়া কথা কইবি। তুই আমারে চিনোস না?”

“তোরে চিনুম না ক্যান…তুই হইলি বিবিসি…সব খবর থাকে তোর কাছে।”

“ঠিক কইছোস!” চেঁচিয়ে উঠলো আতর। “আমার কাছে সব খবর থাকে.. তুই তর ঘরের চৌকির নীচে কি রাখোস না রাখোস তাও আমি জানি।”

কথাটা শুনে ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো গোরখোদক। সে দেখতে পেলো পেছন থেকে একটা হাত বের করে আনলো আতর, তার সেই হাতে মানুষের পায়ের সবচেয়ে বড় একটি হাঁড!

“তর ঘরের খাটের নীচে এইসব জিনিস রাইখা দিছস ক্যান? কাহিনী কি?”

ফালু রাগে ফুঁসতে লাগলো। এই বদমাশটা তার ঘরে ঢুকে কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা কঙ্কাল দেখে ফেলেছে! প্রমাণ হিসেবে সঙ্গে করে আবার একটা হাঁড়ও নিয়ে এসেছে!

“কী..জবান বন্ধ হইয়া গেলো নাকি? মনে করছোস, মুখ বন্ধ রাখলে। আমি কিছু বুঝবার পারুম না? দেখ না…তর কি হয়…সব বন্ধ হইয়া যাইবো। হোগার কাপড় মাথায় তুইলা দেীড়াইবি তুই

রাগে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো ফালু। কোদাল আর টুকরিটা নিয়ে কবর থেকে উঠে এলো, দাঁড়ালো আতরের মুখোমুখি। “তুই কি কইবার চাস?”

 “তর অ্যাডভান্স কব্বর খুদার গোমড় ফাঁস হইয়া যাইবো রে, ফালু…খাটের নীচে কি রাখছোস সব এহন জাইনা গেছি! ঐ বেটির লগে তর কি কাম তাও গুপন থাকবো না।”

চোখমুখ কুচকে চেয়ে রইলো গোরখোদক।

 “কাইল রাইতে ঐ ডাইনির বাড়িতে ক্যান গেছিলি? ওইহানে তর কি কাম, অ্যাঁ? ওই ছেদার মইদ্যে তুই কি করতে যাস?”

ফালু এবার বুঝতে পারলো কালরাতে যে লোকটাকে ধাওয়া দিয়েছিলো সে আর কেউ না, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই বদমাশ! “ওইহানে কি করতে যাই, জানতে চাস?” নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো সে।

অভিজ্ঞ ইনফর্মার খুব দ্রুত বুঝে গেলো গোরখোদকের আগ্রাসি মনোভাব ছেলেটা কিছু করার আগেই সে হাঁড়টা দিয়ে বাড়ি মারার চেষ্টা করলো কিন্তু তাকে একদম অপ্রসতুত করে দিয়ে হাঁড়টা ধরে ফেললো ফালু। অন্যহাতে খামচে ধরলো তার শার্টের কলার। একটা মোচড় মেরে হাঁড়টা তার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আতরের বাম-কানে আঘাত করে বসলো। টলে গেলো ইনফর্মার। তারপর দু-হাতে কলারটা ধরে এক হ্যাঁচকা টানে সদ্য খোরা কবরে ফেলে দিলো তাকে।

একটা আর্ত চিৎকার দিলো আতর। ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে সে। কবরের গর্তের মধ্যে পড়ে ব্যথায় ঝাঁকিয়ে উঠলো। মাথাটা ভো ভো করে ঘুরছে বলে ধাতস্থ হতে পারলো না। যে-ই না উঠে দাঁড়াবে অমনি ফালু তার মাথায় আরেকটা আঘাত করে বসলো। আতরের মনে হলো তার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়েছে। ঝাঁকিয়ে উঠলো সে। ঝাপসা হয়ে এলো দৃষ্টি। তারপরই টের পেলো তার উপরে চাক চাক মাটি এসে পড়ছে।

আমারে মাটিচাপা দিতাছে!

আতঙ্কের সাথেই ভাবনাটা পেয়ে বসলো তাকে। দুঃস্বপ্নের কথাটা মনে পড়ে যেতেই বুকে হাতুড়িপেটা শুরু হয়ে গেলো। “বাঁচাও বাঁচাও!” সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো সে। তার চোখেমুখে মাটির চাক এসে পড়াতে ঠিকমতো তাকাতে পারছে না। দু-হাতে চোখ ডলতে লাগলো। চোখের মধ্যে মাটির গুড়ো ঢুকে গেছে বলে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। “শুয়ারেরবাচ্চা!”

এতো দ্রুত মাটি এসে পড়ছে যে আতর আর কথা বলতে পারলো না। চোখে দেখতে না পেলেও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই আবারো শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করা হলো মাথায়। চিৎ হয়ে পড়ে গেলো সে। মরার উপরে খাড়ার ঘায়ের মতো আরো কিছু বড় বড় মাটির চাকা এসে পড়তে লাগলো। তার উপরে। চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, দু-হাত দিয়ে মাথাটা শক্ত করে ধরে রাখলো। প্রচণ্ড ব্যথায় মরে যাচ্ছে সে। মাটির চাকাগুলো উপর থেকে দ্রুত গতিতে পড়ছে। আলগা মাটির স্তূপের নীচে তলিয়ে যাচ্ছে সে। ঠিক তখনই দূর থেকে একটা শব্দ তার কানে যেতেই হাত-পা অসাড় হয়ে এলো।

সমবেত কণ্ঠে একদল লোক কোনো সুরা পড়ছে।

তার জানাযা পড়ছে ওরা?!

সে নিশ্চিত হতে পারলো না। বহুকাল আগেই নামায-কালাম ছেড়েছে। কোন্ সুরা কখন পড়া হয় সে জানে না। পরক্ষণেই মনে হলো, মুরদার আত্মার মাগফেরাত কামনা করার জন্য লাশের চারপাশে থাকা লোকজন এরকম সুরা পড়ে!

আতর টের পেলো তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। জ্ঞান হারানোর আগে শুধু একটা কথাই বলতে পারলো :

“বাঁচাও! বাঁচাও!”

কিন্তু সে নিশ্চিত হতে পারলো না, শব্দটা আদৌ তার মুখ দিয়ে বের হয়েছে কিনা! আর কোনো শব্দ বের হবার আগেই সে তলিয়ে গেলো গভীর অন্ধকারে।

.

ধ্যায় ৩০

 উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে ফালু।

তার কাঁধে বড় একটা ব্যাগ। পুরনো জিন্সপ্যান্ট আর রঙচটা টি-শার্ট পরে আছে এখন। প্যান্টটা হাটু পর্যন্ত গোটানো। অবশ্য এই বেশটা তার জন্য মোটেও নতুন নয়। এই তো গতসপ্তাহেই রাতের বেলায় এই পোশাকে গঞ্জে গেছিলো। ঢাকা শহরে গেলেও এই পোশাকে যায় সে। তবে ঐ মুশকান জুবেরি ছাড়া সুন্দরপুরে খুব কম লোকেই তাকে এই বেশে দেখেছে। ম্যাডাম আবার লুঙ্গি পরলে ভীষণ বিরক্ত হয়। তার বাড়িতে কাজ করতে গেলে লুঙ্গি পরে যায় না সে।

বদমাশ আতরকে মেরে কবরে ফেলে মাটিচাপা দেবার সময় দেখতে পায় বহূ দূরে, কবরস্তানে আসা-যাওয়ার একমাত্র মেঠোপথটি দিয়ে লোকজন মুর্দা নিয়ে চলে আসছে। দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে যায় তার ঝুপড়ি ঘরে, ঝটপট জামা পাল্টে দরকারি কিছু জিনিসপত্র, কাপড়চোপড় আর খাটের নীচ থেকে ঐ কঙ্কালটা ব্যাগে ভরে কবরস্তানের উত্তর দিক দিয়ে পালিয়ে যায় সে। ওইদিকটা মানুষজন চলাচলের অনুপযোগী, ঝোপঝাঁড় আর জায়গায় জায়গায় ডোবা-নালায়পূর্ণ বিস্তীর্ণ একটি প্রান্তর।

অনেকটা পথ দৌড়ে থমকে দাঁড়ালো সে। ফিরে তাকালো পেছনে। তাকে কেউ দেখে নি। একটা বড় গাছের নীচে বসে পড়লো। কোথায় যাবে। বুঝতে পারছে না। গঞ্জে যে তার একজন রক্ষিতা আছে, সেই সোমারাণীর কাছে যাওয়া যাবে না। ঐ মেয়ে যখন জানতে পারবে সে খুন করে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে তখন তাকে দুর-দুর করে তাড়িয়ে দিতে একমুহূর্তও দেরি করবে না। ঐ নষ্টা মেয়েমানুষ মুখে যতো কথাই বলুক, যত আদর-সোহাগই করুক, নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না। প্রথমদিকে না বুঝলেও ফালু এখন বেশ বুঝতে পারে এটা। অথচ কতো বোকাই না ছিলো সে। মেয়েটাতে এমন মজে গেলো যে, তাকে ছাড়া আর কিছুই বুঝতো না। দু-বছরেরও বেশি সময় পর্যন্ত মেয়েটার ঘোরে আটকে ছিলো, তারপরই বুঝতে পারে, গঞ্জের মেয়েমানুষের প্রেম শুধু টাকার কাছেই বিক্রি হয়।

এই মেয়েটার জন্য কী-ই না করেছে সে! লুকিয়ে লুকিয়ে গঞ্জে গিয়ে মেয়েটার সাথে ওসব করাটা যখন নেশা হয়ে গেলো তখন বাস্তবিক কারণেই টাকায় টান পড়লো। একজন গোরখোদকের আর কতই বা আয়রোজগার, তার পক্ষে তো গঞ্জের মেয়েমানুষের নানান ধরণের বায়না মেটানো সহজ কথা নয়। প্রথম প্রথম সে টাকার টান পড়লেই মাটিকাটার কাজ করে বাড়তি আয় করার চেষ্টা করতো। এভাবেই তার সৎবোনের মাধ্যমে মুশকান ম্যাডামের জন্য কাজ করতে শুরু করে সে। কিন্তু তাতেও কুলাতে পারতো না। ঐ সোমারাণী তার ঘামের সব অর্জন এক লহমায় লুটে নিতো। এরপর শুরু করে সবচাইতে অভিনব আর ভয়ঙ্কর একটি কাজ। যেমন বিপজ্জনক তেমনি দুঃসাহসী। এই কাজটা করার বুদ্ধি তার মাথায় এসেছিলো অনেকটা হুট করেই। প্রকৃতিতে যেমন অনাবৃষ্টি তেমনি গোরখোদকের কাজেও মন্দাকাল রয়েছে। একসময় সেই মন্দা শুরু হলে ফালু বিপাকে পড়ে গেলো। সপ্তাহের পর সপ্তাহ পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সুন্দরপুরে কেউ মরার নাম নিচ্ছে না! আজরাইল যেনো ভুলে গেছে সুন্দরপুরেও তার পদধুলি দেয়া উচিত।

এরকম মন্দার সময়ে একরাতে গঞ্জে গিয়ে সোমরানীকে না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসছিলো ফালু। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছিলো তখন। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য বড় বড় পা ফেলে মোক্তার বাড়ির ভিটার পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ একটা আর্তনাদ শুনে এগিয়ে যায়, দেখতে পায় বাড়ি থেকে একটু দূরে পায়খানার সামনে আশি বছরের বুড়ো সুবহান মোক্তার পা পিছলে পড়ে আছে। মাঝরাতে পেট খারাপ হলে বুড়ো বাধ্য হয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেছিলো, বৃষ্টির কারণে পা পিছলে যায়। কোমর ভেঙে বুড়ো অসফুটস্বরে গোঙানি দিলেও বাড়ির ঘুমন্ত মানুষজনের ঘুম ভাঙনের পক্ষে যথেষ্ট ছিলো না সেটা। ফালু প্রথমে ধরাশায়ি বুড়োকে মাটি থেকে তুলতেই গেছিলো কিন্তু মুহূর্তেই তার সিদ্ধান্ত বদলে যায়। একটা লোক আশি বছর ধরে বেঁচে আছে পরিবার-পরিজনের কাছে বোঝা হয়ে, প্রায়ই অসুখে-বিসুখে পড়ে, সে নিজেও মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুণছে কিন্তু সেইক্ষণ আর আসছে না। এরকম বুড়োরা মরে না বলেই তো ফালুর মতো গোরখোদকদের অনটনও ঘোচে না!

সুবহান মোক্তার অবিশ্বাসের সাথেই দেখতে পায় তাকে উদ্ধার করতে আসা ফেরেস্তাতুল্য যুবক নিমেষে আজরাইল বনে গেছে!

আশি বছরের বুড়োর টুটি চেপে ধরেই এক ঝটকায় ঘাড়টা ভেঙে ফেলে সে। তারপর ডানে-বামে কোথাও না তাকিয়ে সোজা হাটা দেয়। কবরস্তানের দিকে।

যথারীতি পরদিন সকালে নতুন গোর খোরার কাজ পেয়ে যায় ফালু, সেইসাথে কয়েক দিনের জন্য দূর হয়ে যায় তার অভাব। কিন্তু এরকম কাজ তো হরহোজ করা যায় না। রাতের পর রাত গ্রামের পথে ঘুরেও সুবহান মোক্তারের মতো শিকার আর খুঁজে পায় না। অচিরেই সোমারাণী বুঝতে পারলো ফালুর টাকা-পয়সায় টান পড়েছে আবার। একরাতে মুখে পান নিয়ে তার বুকে আঙুল চালাতে চালাতে আগ্লাদিসুরে জানতে চেয়েছিলো তার এমন হালত কেন। ওই সময় ফালুর পক্ষে কোনো কিছু লুকানো সম্ভব হয় নি। সে। যে সামান্য একজন গোরখোদক সেটা জানিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানায়, সুন্দরপুরের মতো এলাকায় ক-জনই বা মানুষ মরে, আর কতোই বা আয়রোজগার হতে পারে।

সব শুনে মুখের পান চিবোতে চিবোতে সোমারাণী বলেছিলো, সে কেন বাড়তি কামাইর চিন্তা করছে না। কথাটা শুনে অবাক হয়েছিলো ফালু। একজন গেড়ারখোদক কী করে বাড়তি কামাই করবে? সে কি সরকারী অফিসের কেরাণী যে, ফাইল আটকে ঘুষ নেবে?

সোমারাণী মুখ বেঁকিয়ে পানের পিক ফেলে বলেছিলো, তা কেন হবে। সে যে কাজ করে তাতেই বাড়তি কামাই করার রাস্তা বের করে নিতে পারে। ফালু কথাটা শুনে মাথামুণডু কিছুই বুঝতে পারে নি। ভেবেছিলো সোমারাণী যেরকম হেয়ালি কথাবার্তা বলে সবসময়, এটাও ওরকম কিছু। কিন্তু তাকে ভড়কে দিয়ে মেয়েটা বলে, সে কেন কবর থেকে কঙ্কাল তুলে বিক্রি করছে না? ওসবে তো বেশ আয়রোজগার হয় আজকাল।

কথাটা শুনে ফালুর বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিলো। মানুষের হাডিড গুডিডও বিক্রি করার জিনিস?! কোন পাগলে এসব কিনবে?

হাসতে হাসতে সোমারাণী তাকে জানায়, দিন-দুনিয়ার কোনো খবরই সে রাখে না। এক একটা কঙ্কাল পাঁচ-ছয়হাজার টাকায় বেচা যায়। সুন্দরপুরের বড় কবরস্তানের একচ্ছত্র মালিক হয়ে মাটির নীচে লাখ-লাখ টাকা রেখে সে ফকিরি হালতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ঠিক আছে, কঙ্কাল না-হয় তুললো কবর থেকে কিন্তু বিক্রি করবে কার কাছে?

পানখাওয়া লালচে ঠোঁট বেঁকিয়ে এই সমস্যার সমাধানও দিয়ে দেয়। সোমারাণী। তার কাছে কতো লোকই তো আসে। নানান পেশার মানুষ তারা। এদের মধ্যে এমন একজনও আছে যে বড়-বড় মেডিকেল কলেজগুলোতে নরকঙ্কাল বিক্রি করে ভালোই টু-পাইস কামাচ্ছে।

শুরু হলো ফালুর কঙ্কাল ব্যবসা। টাকায় টান পড়লেই পুরনো কবর থেকে কঙ্কাল বের করে বিক্রি করে দিতে শুরু করলো। কিন্তু এমন নিরাপদ কাজেও ঝামেলা দেখা দিলে অচিরেই। এক পুরনো কবর থেকে হাড়ি-গুড়ি সরানোর পর পরই কাকতালীয়ভারে কঙ্কালের বড়ছেলে এসে হাজির কবরস্থানে! ঐদিনটি নাকি তার মরহূম পিতার মৃত্যুবার্ষিকী! দীর্ঘ দশবছর পর বিদেশ থেকে দেশে ফিরে পিতৃশোকে উতলা হয়ে ছুটে এসেছে। এখন মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাবার কবরে আগরবাতি জ্বালাবে, ফাতেহা পাঠ করবে। কিন্তু একি অবস্থা তার পিতার কবরের?! এ তো মাটির গর্ত! ভেতরে কিছুই নেই!

ফালুর পক্ষে ঐ সময় যুতসই জবাব দেয়া সম্ভব ছিলো না, কিন্তু মরহুমের বড়ছেলের সঙ্গে আসা এক বয়স্ক আত্মীয় বাঁচিয়ে দেয় তাকে। পুরনো কবর, নিশ্চয় শেয়াল-খাটাশ গর্ত করে ঢুকে হাড়ি-গুড়ি নিয়ে সটকে পড়েছে।

এমন ব্যাখ্যায় প্রবাসী সন্তুষ্ট হয়েছিলো। হাডিড-গুডিডবিহীন মাটির গর্তের সামনে বসেই ফাতেহা পাঠ করে চুপচাপ বিদায় নেয় বেচারি। হাফ ছেড়ে বাঁচে ফালু। এই ঘটনার পর সে আর ঝুঁকি নেয় নি, আবার কঙ্কাল সরানোর মতো লাভজনক কাজ থেকেও বিরত রাখতে পারে নি নিজেকে। অনেক ভেবেচিন্তে চমৎকার একটি কৌশল বের করে। সরাসরি পুরনো কবর উন্মুক্ত করে কঙ্কাল সরানো বাদ দিয়ে দেয়, তার বদলে পাশে আরেকটি নতুন কবর খুরে সেই কবরের নীচ দিয়ে মাটি কেটে কঙ্কাল বের করে আনাটাই বরং নিরাপদ। এর ফলে কেউ বুঝতেই পারবে না পুরনো কবরের নীচে আদৌ কোনো হাডিউ-গুডিড অবশিষ্ট আছে কি নেই। কেউ তো আর কবর খুলে দেখে না, ভেতরে কঙ্কাল আছে কিনা।

কিন্তু এমন নিরাপদ কৌশল বিপদ ডেকে না আনলেও আপদ ঠিকই ডেকে আনলো তার জন্য। একদিন কঙ্কাল সরানোর জন্য পুরনো এক কবরের পাশে নতুন একটি কবর খুরছিলো সে, ঠিক সেই সময় নির্জন। গোরস্তানে এসে হাজির হয় গ্রামের এক লোক। তার ছোটোভাইটি অকালে মারা গেছে গত বছর। সেই ভায়ের কবর জিয়ারত করতে এসে দেখে ফালু নতুন কবর খুরছে। সঙ্গত কারণেই সে জানতে চায় তাদের গ্রামে কে মারা গেছে-কার জন্য কবর খুরছে?

মাটি কেটে পরিশ্রান্ত ফালু এমনিতেই ভড়কে গেছিলো লোকটার আগমনে, তার উপরে এমন বেমক্কা প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে যায়। জোর করে নিজের ভড়কে যাওয়াটা লুকাতে গিয়ে ঠাট্টাচ্ছলে বলে ফেলে, কেউ মারা যায় নি, তবে তার মন বলছে কেউ মরবে, তাই আগেভাগে একটা কবর খুরে রাখছে!

কথাটা শুনে ঐ লোক ভুরু কুচকে চোখমুখ বিকৃত করে চলে গেছিলো, ভেবেছিলো গোরখোদকের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু ঐদিন সন্ধ্যার পরই যখন তাদের গ্রামের এক বুড়ি সত্যি সত্যি মারা গেলো তখন লোকটা রটাতে শুরু করলো, ফালু এই মৃত্যুর খবর আগেভাগেই জেনে গেছিলো, সেজন্যে আগাম একটা কবর খুঁড়ে রেখেছিলো সে। পোলাটা নিশ্চয় কামেল কেউই হবে। কার ভেতরে কি আছে কে জানে? তাকে হেলাফেলা করা ঠিক হবে না।

কুসংস্কারগ্রস্ত গ্রামের সহজ-সরল মানুষ এটা লুফে নিলো। তারা তো এরকম কামেল লোকজনের আর্বিভাবের অপেক্ষায় মুখিয়েই থাকে সব সময়।

এরকম ঘটনা কাকতালীয়ভাবে আরো একবার হয়ে গেলে ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিতই হয়ে গেলো সুন্দরপুরে। আর অবাক হয়ে ফালু আবিষ্কার করলো, গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ তাকে সমীহ করতে শুরু করেছে। কারো বাড়িতে কেউ অসুখে পড়লে তাকে দাওয়াত করে নিয়ে গিয়ে ভালোমন্দ খাওয়ায়। হাতে কিছু টাকা-পয়সাও খুঁজে দেয়-যেনো আজরাইলকে আপাতত তাদের বাড়ির দিকে যাত্রা করা থেকে বিরত রাখে সে!

খুব দ্রুতই সুন্দরপুরে চাউর হয়ে গেলো ফালুর অ্যাডভান্স কবর খোরার কাহিনীটি।

এখন গাছের নীচে বসে দূর থেকে সে দেখতে পাচ্ছে বড় কবরস্তানে মানুষজনের ছোটাছুটি। তার আর বুঝতে বাকি নেই সবাই এতোক্ষণে জেনে গেছে আতরকে খুন করে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে।

তার চেহারা এতোটাই পরিচিত যে ইচ্ছে করলেও এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারবে না। গভীর রাত না নামলে পালানোটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। কিন্তু এই গাছের নীচে বসে থেকে তো রাতের জন্য অপেক্ষা করতে পারবে না।

কারো না কারোর চোখে ঠিকই পড়ে যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু সে-রকম জায়গা কোথায়?

ফালু চারপাশে তাকাতে শুরু করলো নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *