ন’পাড়ার ছেলেরা তাকে পেলে কেন মারবে তা ঠিক ঠিক বলতে পারবে না পটল। বোধ হয় সে নিতু, নন্দ আর গৌরাঙ্গর বন্ধু বলে। ন’পাড়ার তাপসকে ওরা কদমতলায় ইস্কুলের পথে তিনজনে মিলে মেরেছিল। সে দলে পটল ছিল না। কাজটা ভালও করেনি ওরা। মারপিটে ন’পাড়ার বদনাম আছে। মারপিট হয়ে যাওয়ার পরদিন কলোনিতে হামলা করেছিল অন্তত বিশ জন ছেলে। হাতে রড, লাঠি, ড্যাগার অবধি। বড়রা বেরিয়ে মাঝখানে পড়ে মিটমাট করে নেয়। কলোনির লোকও জানে ন’পাড়া গুন্ডার জায়গা। তাই কেউ গা-জোয়ারি দেখায়নি। কিন্তু বাইরে থেকে মিটলেও আসলে ব্যাপারটা মেটেনি। নিতু, নন্দ আর গৌরাঙ্গ দুদিন ইস্কুল কামাই দিয়েছে, তারপর গোঁসাইপাড়া ঘুরে অনেক দূর হেঁটে ইস্কুল যাচ্ছে। পটল অত জানত না। মারপিটের পরদিন কদমতলার কাছে কিছু ছেলে তাকে তাড়া করে, বাঁশ চালিয়ে সাইকেল সমেত তাকে ফেলেও দিচ্ছিল। তার এই পুরনো সাইকেলখানা সেদিন পক্ষিরাজের মতো না উড়লে মার খেয়ে পিষে যেত পটল। আর কিছু না জানুক পটল সাইকেলটা জানে। এ গাঁয়ে সাইকেলের ওস্তাদ হিসেবে তার নাম আছে, লোকে বাহবা দেয়। তাও এই ঝাঁ—কুরকুর সাইকেল। পেত যদি একখানা এস এল আর বা স্পোর্টস সাইকেল তাহলে আরও কত কী দেখাতে পারে পটল।
ন’পাড়া যেমন ভয়ের তেমনই আরও কিছু ভয়-ভীতির জায়গা আছে তার। ওই যে পঞ্চাননের ইটভাঁটি। ও রাস্তাটা তাকে এড়িয়ে চলতে হয়। পঞ্চানন ঘোষের কাছে ইট বাবদ এখনও সাতশো টাকা বাকি। পটলকে দেখলেই ডেকে তার বাপের উদ্দেশে খারাপ খারাপ কথা শোনায়।
এ সব এড়িয়ে, চোখ কান খোলা রেখে চললে এ জায়গা যে কত সুন্দর তা জানে পটল আর গোপাল। গোপাল কখনও মুখ ফুটে বলতে পারবে না, কত সুন্দর এই গ্রামখানা। গোপালের চোখ থেকে সেটা বুঝে নেয় পটল। গোপাল পাখির ডাক শুনতে পায় না, ঝিঝির ডাক শুনতে পায় না, সাইকেলের ঘন্টি শুনতে পায় না। তার বোবা আর কালা পাঁচ বছর বয়সী এই ভাইটি তবু অনেক কিছু টের পায়। সবচেয়ে বেশী টের পায় বিপদ। তাদের দুই ভাইয়ের ঘরে আর বাইরে অনেক রকমের বিপদ থাকে রোজ। মায়ের মেজাজ বিগড়োলে, বাবা মাতাল হয়ে ফিরলে, কাকীমার সঙ্গে মায়ের ঝগড়া লাগলে, কাকার সঙ্গে বাবার লেগে গেলে তাদের দুই ভাইয়ের ওপরেও কিছু ঝাল ঝাড়া হয়ে থাকে। ইদানীং বটতলার কয়েকটা লোক বাবার বন্ধু জুটেছে। সেটাও এক বিপদ, কারণ লোকগুলো এলেই তাকে বাবার খোঁজে বেরোতে হয়, নয়তো নিতাইকাকাকে গিয়ে খবর দিতে হয়। নিতাইকাকা হল এ গাঁয়ের গান্ধীবাবা। সকলের ভাল করে বেড়ায়, ঝগড়া-কাজিয়া থামায়, সবাইকে ভাল হতে বলে। নিতাইকাকা গাঁটগচ্ছা দিয়ে অন্যের সাহায্য করে, মড়া পোড়াতে যায় আর বক্তৃতাও দেয় মাইকে। তবু নিতাইকাকার মতো লোক থাকতেও বটতলায় বদমাইশি বাড়ছে, মদের ঠেক হচ্ছে, ন’পাড়ার ছেলেরা কলোনিতে ঢুকে মারপিট করে যাচ্ছে, চুরি ডাকাতি হচ্ছে, ব্ল্যাক হচ্ছে।
গান্ধীবাবাই কি পেরেছিল? এই যে দেশ ভাগাভাগি হল বলে তাদের যে সোনার দেশ ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল, তখন গান্ধীবাবা কাঁদেনি? আর সুভাষ বোস? আর শ্যামাপ্রসাদ? আরও কে যেন। সব ঠিকঠাক জানে না পটল। তবে এরকমই সে শুনেছে বটে তার ঠাকুর্দা আর বাবার কাছে।
তবে সাইকেল চালানোর সময় বেশী ভাবতে নেই। ভাবলেই বিপদ। চোখ কান একেবারে সজাগ রাখতে হয় রাস্তার দিকে। এ গাঁয়ের রাস্তাঘাট সব তার চেনা। সবসময় রাস্তা ধরে সাইকেল চালায় না পটল। তাতে অনেক ঘোরা পড়ে যায়, আর তাতে বাহাদুরীও নেই। বটতলার পানুর দোকান থেকে কেনা বনস্পতির বাটিটা তার বাঁ হাতে ধরা, ডান হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল, রডে গোপাল শক্ত হয়ে বসে আছে দু’হাতে হ্যান্ডেল ধরে। এই অবস্থায় সে বটতলার শীতলার থানের বাঁ দিকের রাস্তা ছেড়ে ঘোষপাড়ার মাঠে নেমে পড়েছে। চষা ক্ষেতের মতো উচু-নিচু আর ঢিবিতে ভর্তি মাঠ। বর্ষার জলে হড়হড়ে হয়ে আছে কাদা। চাকা বসে যায়, এক জায়গায় ঘুরতে থাকে।
কত কী হয়। পটল বলেই পারে। গোসাঁইপাড়ায় ঢুকবার মুখে দুধারে দু-দুটো পুকুর, মাঝখানে ক্ষয়া, পিছল, সরু একখানা রাস্তা। খুব ওস্তাদ সাইকেলবাজও এ রাস্তায় চালাবে না। নেমে হেঁটে পার হবে। পটল ঠিক পেরিয়ে যায়।
আজও পেরোচ্ছিল। কাল থেকে বৃষ্টি হয়নি। তবে আকাশ মেঘলা হয়ে থম ধরে আছে। ফ্যাকাসে মেঘ। কতকাল রোদের দেখা নেই। একটা দিন বৃষ্টি হয়নি বলে কাদাটা আঁট হয় আছে। আঁট কাদা আরও বিপদের জিনিস।
বাঁ ধারের পুকুর থেকে একটা সাপ উঠে ডানধারের পুকুরে নামতে যাচ্ছে। সেটা দেখতে পেয়েই বোধ হয় গোপাল গলায় একটা ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ তুলে সাবধান করছে তাকে। গোপাল ওভাবেই জানান দেয় বিপদের কথা, খিদের কথা, আনন্দের কথাও। ওই শব্দটাই তার সম্বল।
সাপকে বাঁচিয়ে চলার কোনও ইচ্ছেই নেই পটলের। সাপগুলো মহা খচ্চর। দু-দুটো পুকুর ভর্তি হাজারো জলঢোঁড়া চারাপোনা আর ছোটো মাছ সব খেয়ে ফেলে। গাঁয়ের লোক সাপ মারে না বলে ঝাড়েবংশে সাপগুলো বেড়েছে কম নয়। একটা দুটো মরলে কি যায় আসে। তাছাড়া হঠাৎ ব্রেক কষলে সাইলে উল্টে দুজনকে নিয়ে পুকুরে পড়বে। পটল ভচাক করে সাপের পেটের ওপর দিয়ে পেরিয়ে গেল। পিছু ফিরে দেখার উপায় নেই, সামনে সরু রাস্তা। এক চিলতে জায়গায় দু-দুটো চাকাকে সমান রেখে পেরোতে হবে। পৃথিবীর কঠিনতম কাজের একটা।
সমস্ত চৈতন্য আর চোখ আর মন একাগ্র রেখে রাস্তাটা শেষ করে এনেছিল প্রায় পটল। কিন্তু গোপাল তবু অস্ফুট শব্দটা করেই যাচ্ছে। ঘোঁৎ ঘোঁৎ। অন্য কেউ হলে গোপালের ওই বোবা শব্দকে গ্রাহ্যই করত না। কিন্তু পটল জানে, তার এই অবোধ ভাইটাকে লোকে যা ভাবে তা নয়। সে চোখ রাস্তা থেকে তুলে এক ঝলক সামনের দিকটা দেখবার চেষ্টা করল।
দেখল, নীল শার্ট পরা কে একজন দাঁড়িয়ে আছে পথের শেষ দিকটায়। কচুবনের আড়ালে তার নিচের অংশ ঢাকা। তার মুখটা দেখতে পেল না পটল।
কিন্তু শক্ত আর জোরালো ঢিলটা সোজা এসে তার বাঁ চোখের নিচে লাগতেই মাথা অন্ধকার হয়ে গেল তার। সাইকেল টলে গেল।
পুকুরেই পড়ত পটল। সাইকেলের সামনের চাকা ডাইনে বাঁয়ে ভয়ংকর মোচড় খেল। কিন্তু মাথার অন্ধকারটা এক ঝাঁকিতে কাটিয়ে নিল পটল। তারপর প্রাণপণে প্যাডেল মারল। দুটো গর্তের মতো উচু-নিচু জায়গা ঝকাং ঝকা করে পার হয়ে সোজা নীল জামার দিকে সাইকেলখানা বাড়িয়ে দিল সে।
হুড়মুড় করে কচুবনে গিয়ে আটকাল তার সাইকেল। ততক্ষণে নীল জামা পরা ছোকরাটি হাওয়া হয়েছে। আর বাঁ চোখের কোল থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরে পড়ছে জামায়, বনস্পতির বাটিতে।
সাইকেলটা কাত হয়ে থেমেছে। বাঁ পা বাড়িয়ে পড়ে যাওয়া আটকেছে পটল। ভয় খাওয়া মুখটা তার দিকে ফিরিয়ে চেয়ে আছে গোপাল।
ন’পাড়ার ছেলেটা একাই ছিল। দল জুটিয়ে আসেনি। ভাগ্যিস। তাই একখানা ঢিলের ওপর দিয়ে গেছে। পটল নেমে গোপালকে নামাল। তারপর সাইকেলখানা শুইয়ে রেখে পুকুরের জলে মুখের রক্ত ধুয়ে নিল। বনস্পতির বাটিটাও চুবিয়ে নিল জলে। বনস্পতি শক্ত জিনিস। জলে ধুলে ক্ষয় হয় না।
গোপাল তার দুটো অবাক চোখে চেয়ে আছে। গোলগাল, ন্যাদাভোঁদা ভাইটাকে দেখে বড় মায়া হল এখন। ঢিলটা ওরও লাগতে পারত। ভাগ্যিস ছোকরার হাতের টিপটা ভাল, তাই গোপালের লাগেনি।
পটলের রাগ হল না। রাগের চেয়ে অনেক বেশী তার ভয়। এতক্ষণে গোপাল আর সাইকেল সমেত তার জলে হাবুডুবু খাওয়ার কথা।
সাপটা খুব দাপাচ্ছে এখনও। মরেনি। এক চুলও এগোতে পারেনি। দাপাতে দাপাতে ওখানেই এক সময়ে মরে পড়ে থাকবে। ওই পাপেরই কি নগদ সাজা পেয়ে গেল পটল!
সাইকেল দাঁড় করিয়ে গোপালকে ফের রডে তুলে দিল পটল। তার ক্ষতস্থান খুব জ্বালা করছে, ফুলে উঠেছে এর মধ্যেই। চারদিকটা খুব ভাল করে দেখে নিল সে। এ দিকটায় পতিত জমি, আগাছা আর জঙ্গল। গোসাঁইপাড়া আর একটু এগিয়ে। পথটা খুব নির্জন।
কালঘড়ি না কি একটা জিনিস দেখেছে দাদু। সে জিনিস দেখলে লোকে নাকি আর বেশিদিন বাঁচে না। তার বাবা রামজীবনের যত দোষ থাক, কিন্তু নিজের মা-বাপকে বড় ভালবাসে। তাই নিয়ে বাড়িতে নানা অশান্তি হয়। কিন্তু মা-বাপের ওপর আর কারও কথাকে গ্রাহ্য করে না রামজীবন। দাদু মাঝে মধ্যে নানারকম বায়না করছে আজকাল। দিন তিনেক আগে পুলিপিঠে খেতে চাইল। বর্ষাকালে পিঠে করে না কেউ। তবু হল। আজ সকালে ঠাকুমাকে বলল, দুখানা লুচি করে দেবে? ঠাকুমা ধমক দিয়েছিল, কিন্তু বাবা বলল, না না, করে দাও। বুড়ো মানুষ, ভাল-মন্দ কিছু তেমন খাওয়াতে পারি না।
দাদু লুচির জন্য দাওয়ায় বসে আছে। আটা মাখা হচ্ছে। দেখে এসেছে পটল। আর দেরি করা ঠিক হবে না।
পটল সাইকেলে উঠে প্যাডেল মারতে লাগল। পিছনের চাকায় পাম্প কিছু কম বলে মনে হচ্ছে। গনার দোকানে আগে পাম্প করতে পয়সা লাগত না। আজকাল দশ পয়সা করে নিচ্ছে। একটা পাম্পার হলে…।
না, তাদের অত ফালতু পয়সা নেই।
বাড়ির দাওয়ায় যখন সাইকেলখানা ঠেস দিয়ে দাঁড় করাল পটল, তখন ফের রক্ত পড়ছে। তার খয়েরি জামার বাঁ দিকটায় মস্ত দাগ ধরেছে।
দরজার বাইরে থেকেই রান্নাঘরের ভিতরে বাটিটা ঠেলে দিয়ে পটল বলল, মা, এই যে লুচি ভাজার ঘি।
মা ফোঁস করে উঠল, লুচি খাওয়ার ইচ্ছে হলে বড়লোক ছেলের বাড়ি গিয়ে থাকলেই তো হয়। তিন দিনেই তো বড় গিন্নির মেজাজ সপ্তমে উঠেছিল। ঘাড় ধাক্কা দিতে পারলে বাঁচে। উঁচু বাড়িতে থাকলেই হল বুঝি। মনটা উচু করতে হয় না?
বড় ঘরের কুলুঙ্গিতে হাতকাটা তেল আছে। শিশিটা নামিয়ে কাটা জায়গায় তেলটা লাগাতে গিয়ে পটল টের পেল, ক্ষতটা বেশ গভীর। বাঁ দিকের গোটা মুখখানাই ফুলে বিষিয়ে আছে।
গোপাল তার হাঁটু ধরে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে দেখছে। সবসময়ে তার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে, সব টের পায়, শুধু কথা কইতে পারে না। শুনতেও পায় না কিছু।
হাঁটু গেড়ে বসে গোপালের করুণ মুখখানার দিকে চেয়ে হেসে পটল বলে, কিছু হয়নি রে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
লুচি ভাজার একটা উচাটন গন্ধে চনমন করে উঠল বাতাস। এই কচুঘেঁচুর সংসারে এমন বিদেশী গন্ধ বড় একটা পাওয়া যায় না। নাক উঁচু করে গন্ধটা নিল পটল। গোপাল শব্দ টের পায় না বটে, গন্ধ কিন্তু পায়।
দাদু উদাস মনে দাওয়ায় জলচৌকিতে বসে আছে। লুচি হচ্ছে। কিন্তু লুচির দিকে যেন ততটা মন নেই। সকালে লুচির কথা মনে হয়েছিল, এখন যেন ভুলে গেছে সে কথা। পাকা বাড়ির কংকালটার দিকে চেয়ে আছে।
দাদুর কাছাকাছি গিয়ে দাওয়ায় বসল পটল। কাছ ঘেঁষে গোপাল। লুচির ভাগ তারাও পাবে। সঙ্গে কিছু থাকতে পারে। না থাকলেও কিছু অসুবিধে নেই। শুধু শুধু লুচিও খেতে চমৎকার।
ও দাদু!
কি রে?
লুচির গন্ধ পাচ্ছো?
বিষ্ণুপদ মাথা নাড়ে, পাচ্ছি। হচ্ছে বুঝি?
বাঃ, হবে না! ঘি নিয়ে এলাম বটতলা থেকে।
বেশ বেশ।
তুমি কি এবার মরে যাবে?
আর কি! এবার গেলেই হয়। বাড়িটা হলে বেশ হত।
হবে তো! মিস্তিরি আসবে।
তোকে কে বলল?
শুনেছি।
বিষ্ণুপদ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, পারবে রামজীবন? শেষ অবধি পারবে তো! সাপটা যে ফণা তুলে আছে। কখন ছোবলাবে তার তো ঠিক নেই কিনা।
সাপ! কোন সাপের কথা বলছো?
মরণের কথা রে। যে শালা সারাটা জীবন ফণা তুলে রইল। সাপের ছায়া লম্বা হয়ে পড়ে আছে আমাদের ওপর। কবে কখন মর্জি হবে, দেবে বলে। তা সেই সাপের ছায়ায় বসে তো, কিছুই নিশ্চয় করে বলা যায় না। মানুষের সব ঠাট-ঠমক তার কাছে বড় জব্দ।
পটল কথাটা ভাল বুঝল না। চুপ করে রইল। সামনেই তাদের পাকা বাড়ি আধখানা উঠে থেমে আছে কবে থেকে। পঞ্চানন ঘোষ আর ইঁট দেবে কি? সাতশো টাকা এখনও বাকি। তবে কয়েক বস্তা সিমেন্ট এসেছে কয়েকদিন আগে। পটল যতদূর জানে, এ চোরাই সিমেন্ট। বটতলার গিরীনের চায়ের দোকানে কাজ করে পাঁচু। সেই বলেছে, একটা সিমেন্টের ট্রাক লুঠ হয়েছে ক’দিন আগে। পুলিশ এল বলে।
পুলিশ এখনও আসেনি। আসবে কিনা কে জানে। বাড়িটার ওপর দাদুর খুব টান।
তুমি কী একটা জিনিস যেন দেখেছে দাদু! কালঘড়ি না কী যেন।
কত কী দেখি। মানে বুঝতে পারি না। বুঝলি! তোদের যেমন মানে-বই আছে, শব্দের অর্থ, বাক্যের অর্থ দেওয়া থাকে, ঠিক তেমনি একখানা মানে-বই থাকলে ভাল হত। আজকাল তো কত সরল জিনিসকেও ভারি গোলমেলে লাগে। হ্যাঁ রে, বটতলা থেকে তোর বাবার খোঁজে কারা সব আসে? তারা কি ভাল লোক?
না দাদু। খুব হেক্কোড় মানুষ সব।
কথাটা কী বললি? হেক্কোড় না কি? ওটার মানে কি?
সবাই বলে ওরা সব হেক্কোড়। খারাপ লোক।
কিসের খারাপ করে তারা?
কে জানে! চাউনি দেখলে ভয় ভয় করে।
তা হবে। আগে দুনিয়ায় এত খারাপ লোক ছিল না। এখন খুব হয়েছে, না রে?
পটল মাথা নেড়ে বলে, সবাই ওদের খুব ভয় খায়। খাতির করে চলে।
বিষ্ণুপদ একটা শ্বাস ফেলে বলে, ওই বাস রাস্তাটা না হলেই ভাল ছিল। যতদিন হয়নি ততদিন গণ্ডগোল ছিল না। যখন প্রথম এসেছিলাম দেশ থেকে তখন কেবল চাষাভুষোর রাজত্ব। এক পাল এসে এখানে সেখানে বাঁশ গেড়ে বেড়া তুলে বসে গেলাম। ক্রমে জমিজিরেত একটু হল। কষ্ট ছিল, কিন্তু তেমন ভয়ডর ছিল না।
চোর ছিল না?
খুব ছিল। চোর ডাকাত ব ছিল। তবু ভয় ছিল না। কেন জানিস? এমন মদ আর জুয়ায় ছয়লাপ ছিল না চারদিকে। চোর ডাকাত বাইরে থাকবেই। সে থাকুক। ভয়টা হল, চোর ডাকাত যখন ভিতরে হয়ে ওঠে।
সেটা কেমন?
বললেই কি বুঝতে পারবি? চোর ডাকাতেরা আগে বাইরে থেকে আসত। আজকাল সব গা ঘেঁষেই বসত করে। এমন কি আমাদের মধ্যেই গজিয়ে ওঠে।
মেজো বউ রাঙা লুচির থালা নিয়ে বিরক্ত মুখে দাওয়ায় উঠে এসে বলল, লুচি খাবেন তো! বসুন।
বিষ্ণুপদ একটু অবাক হয়ে বলল, অবেলা হয়ে যাবে না?
খেতে চাইলেন যে!
ক’টা বাজে জানো?
ন’টা হবে বোধ হয়। নিন, গরম আছে।
বিষ্ণুপদ তবু হাত গুটিয়ে থাকে। আমতা আমতা করে বলে, তোমার শাশুড়ি কোথায় গেল?
দোকানে পাঠিয়েছি। ফোড়নের সর্ষে আনতে গেছে। থালাটা ধরুন, আমার মেলা কাজ পড়ে আছে।
ওদের দেবে না?
ওরা সকালে ভাত খেয়েছে।
দু’খানা করে দাও। এখান থেকেই দাও। এ তো মেলা লুচি দেখছি, একটা পল্টনের খোরাক।
আপনার ছেলে হুকুম দিয়ে গেছে যেন সাধ মিটিয়ে খাওয়াই। কম করতে ভরসা হয়নি, তাহলে তো এসে কিলোবে।
বিষ্ণুপদ লুচির থালাটা ধরে থাকে। রঙা চলে যাওয়ার পরও ধরে থাকে। খায় না। ইচ্ছেটা মরে গেছে।
ও দাদু, খাও।
কি জানি কেন, খেতে ইচ্ছে যাচ্ছে না। তোর ঠাকুমাকে ডাকবি একটু?
লুচি দেখেই বোধ হয় একটু চঞ্চল হয় গোপাল। ঘন ঘন ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করে। ওই শব্দ ছাড়া
আর কিছু জানে না। মাতাল রামজীবন মাঝে মাঝে মধ্যরাত্রে ছেলেটাকে ঘুম থেকে তুলে বড্ড মারে। মারে আর বলে, কথা ক’ হারামজাদা, কথা বের কর মুখ থেকে। বোবা হয়ে আমাকে জব্দ করবে ভেবেছো শালা? মারের চোটে তোর মুখ দিয়ে কথা বের করে ছাড়বো।
তারপর পেটায় আর পেটায়। কেউ থামাতে পারে না। সারা বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে যায়।
আর অত মারের চোটেও কাঁদতে পারে না গোপাল। শুধু গোঁ গোঁ শব্দ করে, আর ফোঁপায়। আর কাঁপে। থরথর করে কাঁপে।
মাও মারে। যখন তখন মারে। গোপালের কোনও বায়না নেই। তবে খিদে আছে। খিদে পেলে জিনিস ভাঙে। লাফায়। ছোটাছুটি করে বিপদ ডেকে আনে। তখন মারে মা।
গোপালকে বোঝে শুধু পটল। আর কেউ নয়। বড় হলে সে গোপালকে নিয়ে দূরে গিয়ে থাকবে। এ বাড়িতে থাকবে না। এদের সঙ্গে থাকবে না।
দাদু লুচি ভাগ করে দিল দুজনকে। দুটো করে।
দুপুরে রামজীবন ইরফান মিস্ত্রিকে নিয়ে ফিরল। খুব কথা হচ্ছিল দুজনে। ইরফান পাকা ঘরখানা ঘুরে ফিরে দেখছে।
কত দিনে পারবে ইরফান?
বাদলাটা না ছাড়লে তো কঠিন হবে রামজীবন!
তাই যদি হবে তো তোমাকে ডাকলুম কেন? তুমি ওস্তাদ লোক, খাড়া করে দাও।
ভারী জল না হলে হয়ে যাবে। নইলে বালি সিমেন্ট সব ধুয়ে যাবে। পয়সা বরবাদ।
হবে না কিছুতেই?
ইরফান দোনোমোননা করে বলে, ডবল খাটনি না পড়ে যায়। বালি সিমেন্ট সব রেডি আছে?
এনে ফেলব।
ইট ভিজিয়ে রাখবেন। রবিবার এসে হাত লাগাব। একটু কাগজ-কলম দিন। ইট সিমেন্ট আর বালির হিসেবটা লিখে দিয়ে যাই। লোহার শিক, বাঁশ এসবও লাগবে।
সে তো খোকাটিও জানে। লেখো, লিখে দিয়ে যাও।
রামজীবন চান করতে গেল। পটল দুনিয়া ভুলে ইরফানের কাছ ঘেঁষে বসে রইল।
মাটি থেকে ইঁট। ইঁট সাজিয়ে বাড়ি। একটা থেকে আর একটা, তা থেকে আর একটা কেমন হয়ে ওঠে। পটলের বড় ভাল লাগে। মাটি থেকে ইট। ইট থেকে বাড়ি।
আবার সেই বাড়িও পুরনো হয়। ভেঙে ভেঙে পড়ে। মাটিতে মেশে। মাটি হয়ে যায়। আবার মাটি থেকে ইট। ফের ইট সাজিয়ে বাড়ি।