পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তখন নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রচণ্ড প্রভাব। সশস্ত্র সংগ্রামের স্লোগান তখন তরুণদের মুখে মুখে। বিভিন্ন মহলের আশঙ্কা ছিল যে এই সংগ্রামের সঙ্গে বাংলাদেশের সংগ্রামের যোগাযোগ হলে এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ৭১ এর সংগ্রাম পরিণত হবে সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধে।
৭১-এর সংগ্রামে এই মোড় পরিবর্তনের ফলে শঙ্কিত হয় দু’টি মহল। একটি হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা পকিস্তানি এজেন্ট। অপরটি হচ্ছে নয়াদিল্লির ভারত সরকার।
পাকিস্তানি মহলটির ধারণা ছিল আন্তর্জাতিক চাপের ফলে ভারত বাংলাদেশের এই যুদ্ধকে সার্বিক সহযোগিতা দেবে না। এক সময় আপোষের প্রশ্ন উঠবেই। তখন খুব সুচতুরভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন বা বাংলাদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করা হবে। যুদ্ধ তীব্রতর হওয়ার ফলে এই মহলটি প্রমাদ গুণতে থাকে। তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে এবার তাদের সাধের পাকিস্তান থাকছে না। এ পরিস্থিতি ঠেকাবার জন্যে তারা বিভ্রান্তিমূলক প্রচার শুরু করে। তারা বলতে শুরু করে যে, এভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে শেখ সাহেবকে জীবিত পাওয়া যাবে না। পাকিস্তান সরকার তাকে ফাঁসিতে লটকাবে। তাই শেখ সাহেবকে বাঁচাতে হলে ৬ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে আপনারা কি চান? জীবিত শেখ মুজিবুর রহমান না বাংলাদেশ। জীবিত শেখ সাহেব এবং স্বাধীন বাংলাদেশ এক সঙ্গে পাওয়া যাবে না। তারা ভেবেছিল এ ধরনের প্রচার করতে পারলে মুক্তিযোদ্ধারা বিভ্রান্ত হবে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে একটা আপোষ মীমাংসায় পৌঁছানো যাবে। এই প্রচারের মূল নেতা ছিলেন মোশতাক আহমদ। তার এক সহযোগী আগরতলায় এ ধরনের কথা আমাকে বলেছিলেন। সেই ভভদ্রলোক এক সময় আমার সঙ্গে ছাত্রলীগ করতেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন নির্মল, তুমি একসময় ছাত্রলীগ করতে। সেই সুবাদে তোমার সঙ্গে আসম আবদুর রব ও শেখ ফজলুল হক মনির সুসম্পর্ক আছে। তুমি তাদের বুঝাতে পার যে এক সঙ্গে স্বাধীনতা ও জীবিত শেখ মুজিবকে পাওয়া যাবে না। সুতরাং যেভাবেই হোক পাকিস্তানের সঙ্গে আপোষ মীমাংসায় পৌঁছতে হবে। আমি অবাক হয়ে তাঁর কথা শুনছিলাম। আমি ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরেছিলাম। তবুও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম রব ও মনির সাথে এ নিয়ে আলোচনা করবার। ক’দিন পর সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের বাসায় মনির সঙ্গে আমার দেখা হয়। মুক্তিযোদ্ধা মহলে অনিল ভট্টাচার্য অনিল দা হিসেবে বিশেষ পরিচিতি। তার মেলার মাঠের বাসা প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের বাসায় পরিণত হয়েছিল। সেই বাসায় আমি মনির কাছে প্রশ্নটি তুললাম। মনির জবাব হচ্ছে, মামা-বাবার জীবনের জন্যে যুদ্ধ করছি না। যুদ্ধ করছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাবাও বেঁচে থাকবেন। কিছুদিন পরে শ্রীধর ভিলায় রবের সঙ্গে দেখা হলো। তাকে একথা বলায় সে প্রায় চিৎকার করে উঠল। বলল, পাকিস্তানি এজেন্টরা এখন নতুন পথ ধরেছে। মোশতাক সাহেবের সেই সহযোগীকে আমি এই কথা জানালাম না। শুধু বললাম, তুমি আমার কাছে একথা বলছ কেন? যদি তোমার সাহস থাকে এ প্রস্তাব নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থী শিবিরে যাও। ওরা তোমাকে ছিঁড়ে খাবে। এরপর আমি এ নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখি। নিবন্ধটি কোলকাতায় আরএসপির মুখপত্র সাপ্তাহিক গণবার্তায় প্রথম সংবাদ হয়ে ছাপা হয়েছিল। লেখার শিরোনাম ছিল ‘সাহস থাকে তো এ প্রস্তাব নিয়ে মুক্তিবাহিনী ও শরণার্থী শিবিরে যান। কোলকাতা থেকে একই ধরনের খবর পাওয়া গেল। মোশতাক সাহেবের এক সাগরেদ এক মার্কিন কূটনীতিকের সঙ্গে দেখা করেছে। এ নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে স্বাধীন বাংলা সরকারের মহলে। খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল।
এ ব্যাপারে আমি একেবারেই অনেক দূরের লোক। স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণে ভারতে গিয়েছি। বাংলাদেশে ফিরেছি বারবার। ঢাকায় যাতায়াত করেছি। আগরতলা এবং কোলকাতায় গিয়েছি। তবে স্বাধীন বাংলা সরকারের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।
একদিন বালিগঞ্জে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। পরে শুনেছি এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও নাকি বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট হয়। নেতাদের মধ্যে কলকাতায় ফনী মজুমদার এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। আগরতলায় দেখা হয়েছে খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে। কারো কথায় কোনো মিল খুঁজে পাইনি। কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ সাংবাদিক শিক্ষক এবং সংস্কৃতি কর্মীদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কখনো কখনো মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আবার কখনো শরণার্থী শিবিরে গিয়েছি। আমার কাছে সবকিছুই অগোছালো মনে হয়েছে। মনে হয়েছে এ যুদ্ধের যেন কোনো পূর্ব প্রস্তুতিই ছিল না। কে যেন আমাদের ওপর এ যুদ্ধটা চাপিয়ে দিয়েছে।
তবে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের সঙ্গে দেখা হলে খুব ভালো লাগত। কলকাতায় গিয়ে শুনেছি আমাদের ছেলেরাই ভারতের মাটিতে প্রথম মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প গঠন করেছে। এ ক্যাম্প ছিল নদীয়া জেলার গেদে সীমান্তে। যুদ্ধের প্রথম দিকে এ যুদ্ধ সম্পর্কে আমার সংশয় থাকলেও সেপ্টেম্বর অক্টোবরের দিকে পরিষ্কার হয়ে আসছিল যে বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। আমি আগেই বলেছি যে এই সেপ্টেম্বর অক্টোবরের দিকে যুদ্ধ তীব্র হতে শুরু করে। দিশেহারা হয়ে যায় পাকিস্তানের দালালেরা।
শঙ্কিত হয়ে ভারতের নয়াদিল্লি সরকার। প্রায় এক কোটি শরণার্থী। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সশস্ত্র নকশালদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ। বামপন্থীদের একটি প্রচণ্ড প্রভাব দিল্লি সরকারকেও শঙ্কিত করে তুলছিল। এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে পশ্চিমবাংলা থেকে নাগাল্যান্ড পর্যন্ত এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে। সৃষ্টি হতে পারে এক বৃহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পরিবেশ। ভারত সরকারের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয় এবং এই পরিস্থিতিতে ‘৭১ এর যুদ্ধ যতো শিগগিরই সম্ভব শেষ করে দেয়াই ছিল ভারত সরকারের লক্ষ্য এবং এ বিবেচনা থেকেই আমি বাড়িতে জানিয়েছিলাম, বছর শেষে আমি বাড়ি ফিরবই।
কিন্তু ইচ্ছে হলেই ভারত সরকারের পক্ষে যুদ্ধ শেষ করা সম্ভব ছিল না। তাদের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে। ভারত সরকার আদৌ নিশ্চিত হতে পারছিল না যে পাকিস্তান সরকার শেখ সাহেবকে নিয়ে কী করবে বা শেখ সাহেব মুক্তি পেলেও কি ভূমিকা গ্রহণ করবেন সে সম্পর্কেও সন্দেহ ছিল। এ সন্দেহ ছিল শেখ সাহেব সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের চরম অজ্ঞতার জন্যে। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাই শেখ সাহেবের চিন্তা-ভাবনা এবং সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আদৌ কোনো তথ্য দিতে পারেননি। এমনকি তাজউদ্দিনের সঙ্গে ভারত সরকারের প্রতিনিধির প্রথম সাক্ষাতকারের সময় তাজউদ্দিন সাহেব শেখ সাহেব সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারেননি। তখন শেখ সাহেব পাকিস্তান সরকারের হেফাজতে। এ খবর ভারত সরকার জানলেও তাজউদ্দিন সাহেবদের জানা ছিল না। ফলে প্রথম থেকেই ভারত সরকার বাংলাদেশের নেতৃত্ব সম্পর্কে খুব একটা আশ্বস্ত ছিল না। এরপর ছিল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। তাজউদ্দিন সাহেবের প্রধানমন্ত্রী হওয়া অনেক নেতাই ভালোভাবে নেননি। ছাত্রলীগ নেতারা প্রকাশ্যেই তাজউদ্দিন সাহেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। এ পরিস্থিতি আমাদের ভালো লাগেনি। কোলকাতায় পত্র-পত্রিকায় সমালোচনা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। ভারতের নেতাদের মনেও সংশয় দেখা দিয়েছে। এই দ্বিধা বিভক্ত আওয়ামী লীগের কোনো উপদলটি শেখ মুজিবের কাছের এবং অনুরক্ত। আমার মনে হয়েছে শেখ সাহেবের ভূমিকা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কোন্দলকে কেন্দ্র করে দিল্লি সরকারের যে সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত সে সংশয় দূর হয়নি।
শুনেছিলাম জুলাই মাসে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের সাংসদদের সঙ্গে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অনেক কথা হয়েছিল। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্বাধীন বাংলা সরকারকে স্বীকৃতি দানের দাবি উঠেছিল। ভারত সরকার তখন সে ঝুঁকি নিতে রাজি হয়নি। কারণ তখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হয় এবং ভারত সরকারের এই পদক্ষেপ জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্যের কাছে গ্রহণযোগ্য হতো না। এমনিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন বা মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামিক দেশগুলো পাকিস্তানের পক্ষে ছিল।
এ পরিস্থিতিতে শুনেছি শ্রীমতি গান্ধী পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশের সাংসদদের। তার প্রশ্ন ছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া হলে তিনি কী ভূমিকা নেবেন সে সম্পর্কে কেউ কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারে? অথচ তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত নেতা। কোনো পদক্ষেপ নিতে হলে ভারত সরকারকে শেখ সাহেবের ভূমিকা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ওই বৈঠকে শেখ সাহেবের ভূমিকা সম্পর্কে কেউই নাকি ভারত সরকারকে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেনি এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকারকে নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল। তবে এ সবই আমার শোনা কথা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এ সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে তাঁর দুটি বক্তব্য ছিল। তিনি বলেছিলেন এক কোটি শরণার্থী ভরণ-পোষণ করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। ভারতের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো ভারতকে কোনো চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। তাঁর দ্বিতীয় বক্তব্য ছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া হোক। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করা হোক। এটাই ভারত সরকারের একমাত্র আবেদন।
এ বক্তব্য নিয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করেন। সাধারণ মানুষের সমর্থন পেলেও কোনো সরকারের কাছ থেকেই তিনি সুস্পষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারেননি। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরকালে প্রকাশিত যুক্ত ইশতেহারে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমবারের জন্যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যবহারে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট পদগর্নির আলজিরিয়া সফরকালে যে যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয়, সেই ইশতেহারে পূর্ব পাকিস্তান শব্দই ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ একমাত্র রুশ-ভারত ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি ছাড়া বাস্তব ক্ষেত্রে কোনো কিছুই ভারতের পক্ষে ছিল না। এই পটভূমিতে ভারতকে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।
অক্টোবর পর্যন্ত আমি আগরতলায় ছিলাম। তখন আমাদের দলের আহ্বায়ক বাংলাদেশ হতে আগরতলা পৌঁছেছেন। আমার সঙ্গে আসা মোসাদ্দেক হোসেন স্বপন কমরেড মিসির আহমেদের সঙ্গে কলকাতায় চলে গেছেন। কোলকাতায় দলের পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেছেন এবং বিভিন্ন এলাকা সফর করছেন। কুমিল্লার কমরেড আলী আক্কাস সোনামুড়াতে আছেন। তিনি কুমিল্লার বাগমারা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। শিক্ষক সমিতির নেতা। তার এলাকা আলীশ্বরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তাঁরা সবাই আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতের ত্রিপুরায়। ভারতের ত্রিপুরায় তখন কী এক ভিন্ন রূপ। সকলেই বাঙালি। একদল বাঙালি ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। তাদের অধিকাংশ আত্মীয়-স্বজনই থেকে গিয়েছিল বাংলাদেশে। সেই আত্মীয়-স্বজনই একাত্তর সালে আশ্রয় নিয়েছে ত্রিপুরায়। ত্রিপুরার ভাষা একান্তভাবে কুমিল্লা ও নোয়াখালীর ভাষা। সকলের কাছেই মুক্তিযোদ্ধার আদরের ধন। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানুষগুলোকে তারা সাগ্রহে জায়গা দিয়েছে। তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেছে প্রতিদিনের দুঃখ ও কষ্ট। তাদের মনেও ক্ষীণ আশা জেগেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে হয়তো আবার দেশে ফিরতে পারব।
কিন্তু এ চিত্র যেন কিছুটা চির খেল অক্টোবরে। তখন আগরতলায় বোঝা যাচ্ছিলো যুদ্ধ এগিয়ে আসছে। দিনে দুপুরে ট্যাংক চলছে রাজপথে। অশ্বারোহী সৈন্য মার্চ করছে। সীমান্তে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ছে। মাঝে মাঝে পাকিস্তানি গোলা আগরতলা শহরে এসে পড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আগরতলা শহর। বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। আট মাস কেটে যাচ্ছে। আগরতলাবাসী অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। দীর্ঘদিন পরে তাদের হয়তো মনে হচ্ছে, এ যুদ্ধ তো তাদের নয়। অন্যের যুদ্ধের জন্যে তারা সবকিছু হারাচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। শহরে থাকার জায়গা নেই। পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মৃত্যুর ভয়। লক্ষ করা গেলো আগরতলা শহরে পাকিস্তানি গোলা পড়ার পর সকলেই যেন ভীত।
এমন পরিস্থিতিতে এক সন্ধ্যায় আবার পাকিস্তানি গোলা এসে আগরতলা শহরে একটি এলাকা বিধ্বস্ত করল। শহরে তখন নিষ্প্রদীপ মহড়া। আমার মনে হলো ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় একবার যাওয়া উচিত। আমাদের জন্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীরা অতিষ্ঠ। তাদের সহানুভূতি দেখানো প্রয়োজন। রাজপথে নেমে দেখলাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেরা সকলেই একই ধরনের চিন্তা করছে। তারাই এই গোলাগুলির মধ্যে সাহস করে রাজপথে নেমেছে। রাজপথ তখন লোকে লোকারণ্য। দীর্ঘক্ষণ রাজপথে ঘোরাঘুরি করে আমরা আশ্রয়ে ফিরলাম।
নভেম্বরের প্রথমে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে যুদ্ধ আসন্ন। এই যুদ্ধ নিয়ে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হবে কোলকাতায় অর্থাৎ স্বাধীন বাংলা সরকারের সদর দফতরে। সুতরাং আমাদের পক্ষে আগরতলায় থাকার কোনো অর্থ হয় না। আগরতলার সব দায়িত্ব কমরেড মিসির আহমেদকে বুঝিয়ে দিয়ে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমরা কলকাতা যাত্রা করলাম।
বিচিত্র এক দেশ ভারত। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাওয়া সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয় সাপেক্ষ। আগরতলা থেকে বিমানে এবং সড়কপথে কলকাতায় যাওয়া যায়। আবার আগরতলা থেকে একশ’ আটাশ মাইল সড়ক পথে গিয়ে ট্রেনে মেঘালয় এবং আসাম ঘুরে কলকাতায় যাওয়া যায়। আবার আগরতলা থেকে পণ্যবাহী ট্রাকের যাত্রী হয়ে গৌহাটি পৌঁছে ট্রেনে কলকাতায় যাওয়া যায়। বিমান যাত্রা ব্যয় সাপেক্ষ। আর একশ’ আটাশ মাইল দুরে ধর্মনগর গিয়ে ট্রেনে কলকাতায় যাওয়াও অনিশ্চিত। গৌহাটী যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রাকে। আমরা যাত্রী তিনজন– আমি, খান সাইফুর রহমান এবং ইঞ্জিনিয়ার চন্ডী চক্রবর্তী। এক সময় চন্ডী চক্রবর্তীর বাড়ি ছিল বাংলাদেশের কুমিল্লায়। তাদের পরিবারের সকলেই আরএসপির সদস্য বা সমর্থক। সেই সূত্রে চন্ডীর সঙ্গে আমাদের পরিচয়। চন্ডী আগরতলার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক। চন্ডীর মা বাবা কোলকাতায় থাকেন। চাকরির জন্যে চন্ডী থাকে আগরতলায়। চণ্ডী আমাদের সঙ্গে থাকায় আমাদের অনেক সুবিধা হলো।
যতদূর মনে আছে সেদিন ছিল শনিবার। বেলা দু’টোর দিকে আমরা ট্রাকে উঠলাম। ড্রাইভারের পাশে আমাদের বসার জায়গা। বসতে কোনো অসুবিধা নেই। দূর পাল্লার ট্রাকের ড্রাইভারের পাশে বসে যাতায়াত ভারতে স্বাভাবিক ঘটনা। বিশেষ করে আগরতরা গৌহাটী রুটে এটা প্রতিদিনের দৃশ্য। তাই ট্রাকে দীর্ঘপথ যাওয়া আমাদের কাছে তেমন অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। এ পথে জুন মাসে আমি একবার চড়ইবাড়ি এবং করিমগঞ্জ হয়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম।
এ তো যাত্রা নয়, যেন এক অভিযান। যাত্রা পথ অসমতল। ট্রাক পাহাড়ে উঠছে আর নামছে। ওঠা নামার যেন শেষ নেই। গভীর রাতে আমরা একটি বাজারে পৌঁছলাম। সেখানেই খাওয়া-দাওয়া সেরে রাতে ঘুমাতে হলো। ভোররাতে যাত্রা শুরু হলো নতুন পথে। এবার বদরপুরের পাহাড়। পাহাড়ের পাশে একটি মাত্র সড়ক। মুষলধারে বৃষ্টি হলে মাটির পাহাড় ভেঙে পড়ে সড়কে। সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। এ সড়কে দুটি গাড়ি পাশাপাশি চলতে পারে না। এ সড়কে ঢুকতে গেলে প্রবেশ পথে একদিকে বিরাট উঁচু পাহাড়। আর একদিকে হাজার হাজার ফুট নিচে খাদ। এই খাদের দিকে তাকানো যায় না। দূরে বাংলাদেশ সীমান্তের তামাবিল। খাদের দিকে তাকালে মনে হয় যে কোনো সময় গাড়ি হয়তো খাদে পড়ে যাবে।
তবে সে সময় গাড়িতে এত কথা ভাবার অবকাশ ছিল না। সহযাত্রী হিসেবে অপূর্ব ব্যক্তিত্ব কমরেড খান সাইফুর রহমান। তার জানার এবং কৌতূহলের কোনো সীমা নেই। সবকিছু যেন তার নখদর্পণে। মাঝপথে আমাদের ট্রাকে একজন যাত্রী উঠেছিল। খান সাহেবের ধারণা ওই যাত্রী মিজোরামের বিদ্রোহীদের কোনো লোক হবে। তখন মিজোরামেও বাংলাদেশের মতো অগ্নিগর্ভ। মিজোরামও স্বাধীনতা চাচ্ছে। এ ব্যাপারে খান সাহেব খুব কৌতূহলী। তার ইচ্ছে ওই যাত্রীর নিকট হতে অনেক কিছু জানা যাবে। কিন্তু ওই যাত্রী নিরব। সে কোনো কৌতূহলই দেখাল না। এক সময় গন্তব্যস্থলে নেমে গেল।
তবে এরা যে কী চায় সন্ধ্যার দিকে আমরা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলাম। আর মেঘালয়ের জেলা শহর জুয়াইতে একটি ঘটনা আমাদের বিস্মিত করেছিল। জুয়াই-এর পথে সামরিক বাহিনীর এক জোয়ান আমাদের ট্রাকে উঠেছিল। বসেছিল আমাদেরই পেছনে রাখা পণ্যের ওপর। কারণ ড্রাইভারের পাশে তার আসন হয়নি। তার সঙ্গে কোনো কথা হওয়ার সুযোগ ছিল না। জুয়াই শহরে ঢুকতে দূরে ট্রাফিক পুলিশ দেখে সেই জোয়ান তড়িঘড়ি করে ট্রাক থেকে নেমে গেল। সে বললো এভাবে ট্রাক যাওয়া ট্রাফিক আইন বিরোধী। এ অপরাধে ট্রাফিক পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারে। তাই সে নেমে দাঁড়িয়েছে।
আমরা অবাক বিস্ময়ে তার কথা শুনছিলাম। আমরা ভাবতেই পারছিলাম যে একজন সামরিক বাহিনীর জোয়ান ট্রাফিক পুলিশকে ভয় পেতে পারে। পাকিস্তানে বছরের পর বছর আমরা সামরিক আইন দেখেছি। আমরা দেখেছি ভয়ের শাসন। কাউকে তোয়াক্কা না করবার আস্ফালন। সেই সামরিক বাহিনীর জোয়ান একজন ট্রাফিক পুলিশকে দেখে ভয় পাচ্ছে। এ ধরনের আইনের শাসনের কথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম।
জুয়াই শহরে ঢুকতে শোনা গেল, ওই শহরে সান্ধ্য আইন জারি হয়েছে। সব দোকানপাট বন্ধ। খাসিয়াদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে বাঙালি অসমিয়াদের। এ ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক। আমাদের ড্রাইভার বাঙালি। ড্রাইভার একটি বাঙালি হোটেল খুঁজবার চেষ্টা করে। ভুলে আমরা একটি খাসিয়া হোটেলে ঢুকেছিলাম। তারা আমাদের পত্রপাঠ বিদায় দিল। বলল, পাশে বাঙালি হোটেল আছে।
আমরা বাঙালি হোটেলের সন্ধান পেলাম। বাঙালি হোটেলগুলো কিছুতেই দুয়ার খুলছে না। অনেক ডাকাডাকির পর ওরা দুয়ার খুলেই বলল, তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকুন। দুয়ার খোলা রাখলেই বিপদ। খাসিয়ারা সুযোগ পেলেই হোটেলে ঢুকবে। সারারাত মদ খাবে, মাতলামি করবে, পয়সা দেবে না। ওদের কিছু বলতে গেলে দাঙ্গা বেঁধে যাবে। সুতরাং হোটেলে ঢুকলেই দরজা বন্ধ করা হবে।
রাতে ওই হোটেলই কাটিয়েছি। ভেবেছি এ কোন জীবন! এই বাঙালিদের অধিকাংশই এককালের বাংলাদেশের লোক। দীর্ঘদিন পূর্বে এরা বৃহত্তর আসামে এসেছিল। বন কেটে বসতি গড়েছিল। স্কুল কলেজ করেছে। স্থানীয় অধিবাসীরা একদিন শিক্ষিত হয়ে দেখেছে সবকিছুর দখলদার বিদেশি বাঙালি। তাই স্লোগান উঠেছে ‘বাঙালি হটাও’। আমরা বাংলাদেশে স্লোগান দিয়েছি ‘অবাঙালি হটাও’। এই দুই শ্লোগানের সুর অভিন্ন হওয়ায় আমাদের সংগ্রামের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেক সময় সংকটে পড়তে হয়েছে।
কারণ আগের আসাম নেই। আসাম এখন ছয় ভাগে বিভক্ত–অসম, মিজোরাম, অরুণাচল, মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও মেঘালয়। এই ছয় ভাগের মানুষই তখন স্বাধীনতার দাবি করছে। তাদের সংগ্রাম বাঙালিদের বিরুদ্ধে।
সুতরাং তারা আমাদের সুনজরে দেখবে না তা বলাই বাহুল্য। তার প্রমাণ গৌহাটিতেও মিলেছিল।
গৌহাটি গিয়ে আর এক বিপদে পড়ে গেলাম। উঠেছিলাম এক রাজনৈতিক বন্ধুর বাসায়। বিপদ হলো দোকানে খেতে গিয়ে। অসমিয়ারা অদ্ভুত প্রকৃতির। ওরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলে। কিন্তু বাঙালিরা এলেই কথার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। নিখাদ অসমিয়ায় কথা বলতে শুরু করে। অসম্ভব হিংসে করে বাঙালিদের। নিজেদের ভাষায় যা খুশি তা বলতে শুরু করে। আমাদের সঙ্গে ইন্ডিয়ার চন্ডী। চন্ডী এক সময় আমাদের কাছে ওদের সম্পর্কে কটুক্তি করে। অসমিয়ারা মারমুখী হয়ে আসে। কোনোমতে, খাওয়া শেষ করে হোটেল থেকে আমাদের পালাতে হলো।
কিন্তু তাতেও নিস্তার নেই। ওরা আমাদের বাসা পর্যন্ত ধাওয়া করল। প্রতিবেশিদের ডাকতে হলো মীমাংসার জন্যে। আমরা পরিস্থিতি এড়াবার জন্যে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। চলে গেলাম গৌহাটি স্টেশনে। কোনোমতে ট্রেনে চেপে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
ট্রেন ছাড়বার পর মনে হলো, এ কোন পরিবেশে এসে পৌঁছলাম। আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে ভারতে এসেছি। আমরা তাদের আতিথ্য গ্রহণ করেছি। সর্বত্রই স্নেহ এবং ভালোবাসা পেয়েছি। কিন্তু এমন পরিবেশের মুখোমুখি হইনি। আগের রাতে জুয়াইতে খাসিয়াদের আক্রমণ এবং পরের দিন গৌহাটিতে অসমিয়াদের আক্রমণ আমাকে ভাবিয়ে তুলল। আমরা এসেছি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে। আর ওরা যুদ্ধে নেমেছে বাঙালিদের বিরুদ্ধে। ওদের আন্দোলন, বাঙাল খেদাও আন্দোলন। আমাদের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঠবে–ওরা তাহলে বাঙালিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে কেন? তাহলে ওদের কাছে কি বাঙালিরা আমাদের কাছে পাকিস্তানীদের মতো। বাঙালিরা কি এখানে শোষক? নাকি বহিরাগত এবং ভিন্ন ভাষাভাষি বলে ওই এলাকায় বাঙালিরা অবাঞ্ছিত?
ভারতের পূর্বাঞ্চলে এ পরিস্থিতির একটি তাৎপর্য আছে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এ অঞ্চলে বিভিন্ন উপজাতি স্বাধীনতা আন্দোলন করছে। এই আন্দোলনের সঙ্গে কখনো বামপন্থী ছাপ আবার কখনো ডানপন্থী নেতৃত্ব আছে। আমার মনে হয়েছে এই আন্দোলনে ডানপন্থী প্রভাব থাকার ফলে শোষণবিরোধী আন্দোলন জাত-পাত সম্প্রদায় এবং কখনো বহিরাগত বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আমার সেদিন মনে হয়েছে এ আন্দোলন সঠিক নেতৃত্ব না পেলে ভারতের সমগ্র পূর্বাঞ্চলে নেতৃত্বে প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে চলে যাবে এবং বিদেশীরা সে সুযোগ নেবে।
সারারাত আমাকে ট্রেনে এ ধরনের একটি চিন্তা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। কখন ঘুমিয়েছি কখন আবার জেগেছি। এক সময় চোখ খুলে দেখলাম, আমার সামনে অনেক তরুণ বসে আছে। পরনে লুঙ্গি এবং জামা। বড্ড ক্লান্ত, শ্রান্ত এবং বিপর্যস্ত। দেখেই মনে হলো ওরা মুক্তিবাহিনীর সদস্য। বলল, তারা তরঙ্গপুরে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ওদের দলটি যাবে ঈশ্বরদী বিমানবন্দর অকেজো করে দেয়ার জন্যে। কিন্তু ওদের তেমন অস্ত্র দেয়া হয়নি। বলা হয়েছে স্থানীয়ভাবে ওরা সাহায্য এবং সহযোগিতা পাবে। ওদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এক সময় বুঝতে পারলাম, ওরা ফ্রিডম ফাইটার্স অর্থাৎ এফএফ গ্রুপের লোক। ওরা বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট বিএএএফ অর্থাৎ মুজিববাহিনীর লোক নয়। মুজিববাহিনীর লোক হলে এমন বিপর্যস্ত হতে হতো না। ওরা অস্ত্র পেত। ওদের কোনোই অসুবিধা হতো না।
আগরতলা থাকতেই শুনেছি মুজিববাহিনীর কথা। শুনেছি এফএফের কথা। এফএফ-এ অনেক আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের কর্মী থাকলেও অন্যান্য দল এবং সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারাই ছিল এফএফের সদস্য। মুজিববাহিনী ছিল একান্তভাবে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সদস্য দ্বারা গঠিত। এই দুই বাহিনীর তফাৎ ছিল আসমান জমিন। আগরতলায় থাকতে এই অভিযোগ শুনেছি। এবার নিজের চোখে দেখলাম।
সামনে তরঙ্গপুর থেকে আসা এই মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার এবং চলবার মতো পয়সা পর্যন্ত নেই। এদের মধ্যে অনেকেরই বয়স ১৫ থেকে ২০। এরা কোনোদিন দেশের বাইরে যায়নি। আবেগের তাড়নায় মুক্তিযুদ্ধে এসেছে। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে নেমেছে। আমি ওদের প্রায় সকলের সঙ্গে কথা বললাম। ট্রেনে খাওয়ালাম। ওরা গভীর রাতে ফারাক্কা স্টেশনে নেমে গেল। আর ওই স্টেশনের নামটি আমাকে চমকে দিল। এখান থেকেই গঙ্গা কিছু দূরে গিয়ে পদ্মা নাম ধারণ করে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এখানেই সেই ফারাক্কা ব্যারেজ। আমাদের জীবন-মরণ সমস্যার অঙ্গ।
ফারাক্কায় মুক্তিযোদ্ধারা নেমে গেলে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম এই বাচ্চারা কী করবে। কিন্তু দু’দিন পরে কোলকাতা পৌঁছে ঈশ্বরদি বিমানবন্দরে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের খবর পেয়েছিলাম। তারপর আর ওদের খোঁজ নিইনি। আজ ২৬ বছর পর বলতে লজ্জা নেই যে, যাদের খোঁজ নেয়ার একান্তই প্রয়োজন ছিল, তাদের খোঁজ কোনোদিনই নিলাম না। তবে সেদিন কোলকাতায় পৌঁছানো তেমন সহজ হয়নি। পশ্চিম বাংলায় তখন। নকশাল আন্দোলন তুঙ্গে। গ্রামে গ্রামে পুলিশ। বীরভূমে নকশালদের প্রচণ্ড প্রভাব। এক সময় ট্রেন রামপুরা স্টেশনে থামল। একদল পুলিশ এসে আমাকে ঘেরাও করল। বলল তাদের সঙ্গে আমাকে যেতে হবে। আমার পরনে পাজামা পাঞ্জাবি এবং মুখ ভর্তি দাড়ি। পুলিশের কথায় আমি নাকি একজন নকশালদের নেতা। আমাকেই তারা খুঁজছে। তারা একান্তভাবেই নিশ্চিত, এই কক্ষে আমি উঠেছি এবং আমিই সেই লোক। পুলিশের কথা শুনে প্রথম খানিকটা চমকে গেলাম। বন্ধুরা অনেক যুক্তি দিল। আমিও অনেক কথা বললাম। কিন্তু পুলিশ নাছোড়বান্দা। ট্রেন তখন ছেড়ে দিয়েছে। পুলিশ বলল সামনের স্টেশনের তাদের সঙ্গে আমাকে নেমে যেতে হবে। আমি সামনের স্টেশন পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। এবার ট্রেন থামলে একজন অফিসারসহ আরেক দল পুলিশ উঠল। তারাও আমার কাছেই এল। তবে আমরা সবাই মিলে পুলিশকে বোঝাতে পারলাম, আমি সেই ব্যক্তি নই। আমি বাংলাদেশের লোক। নেমে যাবার আগে পুলিশ অফিসার বলল এই চেহারা এবং পোশাকে পশ্চিমবঙ্গে ঘোরাফেরা করা একান্তই ঝুঁকিপূর্ণ। পরবর্তী স্টেশনে পুলিশ নেমে যেতেই দেখলাম টয়লেট থেকে ঠিক আমার চেহারার এক যুবক বেরিয়ে এল। সবাই তাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। দেখলাম সে যুবক সব খবরই জানে। সে আমার কাছে এসে বলল, আমার জন্যেই আপনার অসুবিধা হয়েছে। আপনাকে আমার বলার কিছুই নেই। আমি অবাক বিস্ময়ে তরুণের দিকে তাকালাম। তার খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করিনি। সে তরুণ চারু মজুমদারের দলের সদস্য। সে কৃষি বিপ্লব করতে চায়। শ্রেণিশত্রু খতম করতে চায়। শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে চায়।
আমিও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। কিন্তু তরুণের এই পথ নিয়ে আমার সঙ্গে মতান্তর আছে। আমি মনে করি কৃষি বিপ্লব ক্ষমতাসীন সরকার উচ্ছেদের আন্দোলন থেকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কৃষি বিপ্লব করতে গেলে জোতদারের পক্ষে ক্ষমতাসীন সরকারের পুলিশ আসবে লাঠি, বেয়োনেট এবং গুলি নিয়ে। তাই ওই সরকারকে উচ্ছেদ করতে না পারলে জোতদারদের উচ্ছেদ করা যাবে না। সমগ্র সমাজ ব্যবস্থাটাকে হত্যা করতে না পারলে একজন জোতদারকে হত্যা করে সমাজ ব্যবস্থাকে পাল্টানো যাবে না।
এ হচ্ছে আমার বিশ্বাস। এ বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও আমি ওই তরুণের দিকে তাকিয়েছি। বারবার তাকিয়েছি। ভাবতে চেষ্টা করেছি। কী তাড়নায় ঘর ছেড়েছে। বাড়ি ছেড়েছে। সংসার ছেড়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে নেমেছে।
এই কথাগুলো চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর আমি বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গের কমরেডদের লিখে পাঠিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, দীর্ঘদিন আপনারা আন্দোলন করছেন। কিন্তু চারু মজুমদারের মতো এমন করে তরুণদের নাড়া দিতে পারেননি। উদ্বুদ্ধ করতে পারেননি এমন করে জীবন যুদ্ধে নামার জন্যে। চারু মজুমদারের পথ ভুল হতে পারে। ভ্রান্ত পথে গিয়ে অসংখ্য তরুণ প্রাণ দিতে পারে। কিন্তু একথা সত্য, চারু মজুমদার তরুণ সমাজের দুঃখ, বেদনা, ক্ষোভ এবং বিক্ষোভের কারণ সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি স্বল্পকালে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিলেন। আমাদের অন্যান্য বামপন্থী বন্ধুরা তত্ত্বের ব্যাখ্যায় সঠিক হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে সেই তত্ত্বের প্রয়োগ করতে পারেননি। জীবন দেয়া নেয়ার নেশা সৃষ্টি করতে পারেননি তরুণদের মনে। তাই সকল সমালোচনা সত্তেও চারু মজুমদারকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান এবং মর্যাদা দিতে হবে। সেকালে আমার বক্তব্য বিভিন্ন মহলে আলোচিত এবং সমালোচিত হয়েছে।
সে অনেক দিন আগের কথা। স্বাধীন হওয়ার অনেক পরেই একথা লিখেছিলাম, চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর। একাত্তরের নকশালপন্থী ছেলেদের সঙ্গে আলোচনা করার পর এ ধরনের একটি ধারণা আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। তবে সে ধারণার সঙ্গে আমার সেদিনের ট্রেনযাত্রা কিংবা রামপুরার ঘটনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। রামপুরার ঘটনার দীর্ঘক্ষণ পর কলকাতায় পৌঁছেছিলাম।
কলকাতায় আমার অনেক রকমের বিপদ। ২৩ বছর পর কলকাতায় গিয়েছি। মা, ভাই, বোনদের ধারণা ছিল আম সঙ্গে তাদের কোনোদিন দেখা হবে না। পাকিস্তান সরকার আমাকে পাসপোর্ট দেবে না। জীবনটা জেলখানায়ই কাটবে। আমি ভারতে গিয়েছি এ খবর কারও বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাদের কাছে আমি খরচের খাতায়। একদিন মধ্যম গ্রামে গিয়েছিলাম। পথের মাঝখানে এক খুড়তুতো বোনের সাথে দেখা। ২৫ মার্চের পর তিনি আমাদের খবর পাচ্ছিলেন না। ২৭ মার্চ থেকে তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বড় সড়কের পাশে বসে থাকেন। বাংলাদেশের কোনো লোক পেলে আমাদের কথা জিজ্ঞেস করেন। এমনি করে বসে থাকতে হয়েছে পরপর তিন মাস। মে মাসে আমি পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছলে খবর পেয়েছিলেন যে আমি এবং আমরা ভালো আছি। ঢাকুরিয়ায় আমার বড় বোনের বাসায় গিয়েছিলাম। প্রথমে তিনি আমাকে চিনতেই পারেননি। প্রায় বিদায় নিচ্ছিলেন দোরগোড়া থেকে। শেষ পর্যন্ত আমাকে চিনেছিল আমার এক ভাগ্নে। দিদির কথা হলো তিনি নাকি শুনেছেন আমি রাশিয়া চলে গেছি।
আমার এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। আমার বন্ধু বড় প্রকৌশলী। বরিশালে আমার সাথে এক কলেজে পড়ত। রাজনীতি করত বলে তার মায়ের আক্ষেপ ছিল। তার মায়ের ধারণা আমার জন্যে তার ছেলে রাজনীতি করে। তার ছেলে বোমার মামলায় পড়েছিল বরিশালে। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর তারা সপরিবারে ভারত চলে যায়। এবার দেখলাম আমার বন্ধুর মা ভিন্ন মানুষ। আমার জন্যে নিদারুন সহানুভূতি। ছেলেকে ডেকে বললেন নির্মলকে বল, এবার কোলকাতায় থেকে যেতে। যে দেশে গেলে জেলে থাকতে হয়, সে দেশে গিয়ে ওর লাভ নেই। আমি বললাম, আমি তো থেকে যেতে আসিনি। আমার শিকড় তো আমার জন্মভূমিতে। আমাকে সেখানে ফিরে যেতে হবে।
কাকুড়গাছিতে কাকার বাসায় গিয়েছিলাম। কাকীমা কেঁদে আকুল। তাঁর ধারণা ছিল আমার সঙ্গে কোনোদিন দেখা হবে না। বাগুইআটিতে ছোট কাকা থাকেন। দেখা হতেই বললেন, মুজিবর কোথায়? আমার কাকারা শেখ সাহেবকে মুজিবর বলে ডাকতেন। শেখ সাহেবের কথা বলতে বলতে তিনি কেঁদে ফেললেন। টুঙ্গীপাড়ায় শেখ বাড়ির সাথে আমার এই দুই কাকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এরা ডাক্তারি করতেন টুঙ্গীপাড়া থানার পাটগাতীতে।
তাদের প্রথম প্রশ্ন, শেখ সাহেব কোথায় আছেন, কেমন আছেন? তার বাড়ির অবস্থা কি? শেখ সাহেবের বাবা-মা কোথায়? তাদের খোঁজ-খবর নিয়েছি কি না? এই পরিবারের খোঁজ নিতেই আমি ২৫ মার্চের পর পাটগাতী গিয়েছিলাম। বন্ধুরা জোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাই তাদের সব প্রশ্নের জবাব আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব ছিল না।
আমার বড় ভাই থাকেন কোলকাতা থেকে ৯০০ কিলোমিটার দূরে মধ্য প্রদেশে। ওই সময় তার কাছে যাবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। মা থাকেন দুই ভাইয়ের সাথে পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে। আমার খবর পেয়ে মা দুই ভাইকে কোলকাতা পাঠিয়েছিলেন আমাকে নেয়ার জন্যে। ভাইদের সাথে দেখা হবে না। আমাকে যুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশে ফিরতে হবে। তোমার সাথে দেখা হলে তুমি আমাকে বাংলাদেশে ফিরতে দেবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ সাহেব আমার বাগুইআটির কাকাকে আনবার জন্যে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কাকা ছিলেন টুঙ্গীপাড়ার শেখ বাড়ির পারিবারিক ডাক্তার। আমি একমত হইনি। আমি বলেছিলাম কাকা ভারতীয় নাগরিক। বাংলাদেশে এলে অসুবিধায় পড়বেন। আর দেশের যে অবস্থা তাতে আমার মনে হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করা খুব কঠিন হবে। শেখ সাহেব কলকাতায় লোক পাঠিয়েছিলেন ছোট কাকার কাছে। ছোট কাকা আসেননি।
বারাসাতে আমার কাকাদের অনেক ছেলে-মেয়ে বসবাস করে। সেখানে গিয়ে বিপদ হয়ে গেল। সকলের কাছেই আমি গল্প। এদের সকলের জন্ম ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার পর। ওরা পূর্ব-পুরুষের ভিটির গল্প শুনেছে। আমার কাছে তারা অনেক কিছু জানতে চায়। সকলেই থাকতে চায় কাছাকাছি। কিন্তু আমার সময় কোথায়।
একদিন এক কাণ্ড ঘটল কোলকাতার কাছে যাদবদুরে। এক আত্মীয়ার সাথে বাসে যাচ্ছিলাম। মাঝখানে এক তরুণী ওই বাসে উঠল এবং কিছুক্ষণ পর নেমে গেল। আমার আত্মীয় বললেন, এই মেয়েটিকে আপনি চেনেন? ওই মেয়েটি আপনার এক কাকার কন্যা। অর্থাৎ আপনার বোন। আপনাদের কারো কাউকে চিনবার কথা নয়। আগে খেয়াল করলে আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতাম।
মাঝখানে একদিন শিয়ালদহ থেকে বাসে কাকুরগাছি যাচ্ছিলাম। বাসে একটি কণ্ঠ শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম। কণ্ঠ আমার এক সতীর্থের। ওর নাম দেবু। দেব্রত মুখার্জি। বরিশাল জেলার কলসকাঠিতে আমার সাথে সপ্তম শ্রেণিতে পড়তো। সপ্তম শ্রেণির পর দেবু আর ক্লাসে আসেনি। ১৯৪২ সালে আমি নবম শ্রেণির ছাত্র। তখন কংগ্রেসের আহ্বানে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়। কলসকাঠির ডাকঘরের সামনে জনসভা হয়। জনতা ডাকঘর পুড়িয়ে দেয়। তাকিয়ে দেখলাম প্রথম সারিতে দেবু। আমাদের দায়িত্ব ছিল তখন স্কুলে ধর্মঘট করা এবং পুলিশে খবর নেয়া। দেবু গ্রেফতার হয়ে গেল। কাগজে পড়েছি দেবুকে দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ১৯৪৪ সালে আমি বরিশাল কলেজে পড়তে গেলাম। দেবু তখন জেলে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ চলে যাবার আগে দেবুরা জেলখানা থেকে মুক্তি পায়। দেবু আর দেশে থাকেনি। দেবু দেশান্তরী। যে দেশ স্বাধীন করার জন্যে দেবুর দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল সেই দেবু নিজের দেশে থাকেনি। দেবু ভিন্ন দেশে দেশান্তরী। সেই দেশে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম ১৯৭১ সালে। দীর্ঘদিন পরে হলেও দেবুর কণ্ঠ আমার কানে বাজছিল। বাসে দেবু বাংলাদেশের পক্ষে তর্ক করছিল। দেবুর সে কণ্ঠ আমার বড় চেনা। কিন্তু দেবুর সাথে আমার কথা বলা হয়নি। হঠাৎ একটি স্ট্যান্ডে দেবু নেমে গেল। বলি বলি করেও দেবুর সাথে আমার কথা বলা হয়নি।
ভারত বিভক্তির ৫০ বছর। আর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ২৬ বছর পর এ কাহিনী। সেকালের মন না হলে একালের মানুষ আমার লেখায় আদৌ আকৃষ্ট হবে না। আজকের প্রজন্ম সেকালের কাহিনী জানে না। ১৯৪০ সালে যে শিশু জন্মেছে তারও স্মরণে নেই ৪৭-এর দাঙ্গা আর দেশান্তরী হওয়ার কথা। আজ পাকিস্তানের করাচিতে লাখ লাখ বাংলাদেশের বাঙালি। বনগাঁও সীমান্ত থেকে শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত দেশান্তরী বাঙালি হিন্দুদের একের পর এক কলোনি। পশ্চিম আর পুর্ব পাঞ্জাবে এপার আর ওপারের লোক। লাখ লাখ পরিবার বিভক্ত এবং ধর্মান্তরিত।
সেদিনের কথা। পাকিস্তানের পাঞ্জাব থেকে একটি পরিবার ১৯৪৭ সালে শরণার্থী হয়ে ভারতের পাঞ্জাবে এসেছিল। ফেলে এসেছিল বাচ্চা শিশুকে। ৫০ বছর পর সে বাচ্চাও প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেছে। দেশ ভাগের ৫০ বছর পর মাতা ও পুত্রের মিলন হয়েছিল। পাড়া প্রতিবেশি বলেছিল তোমার ছেলে তো মুসলমান হয়ে গেছে। মায়ের জবাব হচ্ছে–ওর ধমনীতে প্রবাহিত রক্ত তো আমার।
এত কথা আজকে ভাবলেও ১৯৭১ সালে ভাবিনি। ভাবিনি বলেই মাকে বলেছিলাম দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই তোমার সাথে দেখা হবে।
অনেক আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা না করেই ১৯ জুলাইতে যুদ্ধের মধ্যে ফিরেছিলাম বাংলাদেশে। তারপর নভেম্বরে আবার কলকাতায়। কলকাতায় গিয়ে এবারেও সকলের সাথে দেখা করা যাচ্ছে না। মন খুবই বিব্রত। আরএসপির আস্তানায় থাকি। রাজনীতিকরা জিজ্ঞেস করে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে তো। নাকি আপনাদের পাকিস্তানে ফিরে যেতে হবে। সব কথার জবাব দিতে পারিনি। আত্মীয়-স্বজনদের কাছে গেলেও একই কথা জিজ্ঞেস করে। তাদের আশা যুদ্ধ বেশি দিন চললে হয়তো আমার আর যাওয়া হবে না। আমি হয়তো চিরদিনের জন্যে ওদের কাছে থেকে যাব।
আমার দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব অন্যত্র। আমার মনে প্রশ্ন এই যুদ্ধ শেষ হবে কী করে? ভারত সরকারের শ্রেণি চরিত্র আমি জানি। ভারত একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করবে কোন স্বার্থে আমরা এ যুদ্ধকে বলছি মুক্তিযুদ্ধ। আমরা বলেছি শোষণমুক্ত বাংলাদেশের কথা। আমার দ্বন্দ্ব হচ্ছে–ভারত শোষণমুক্ত বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্যে সাহায্য করবে কেন? এ যুদ্ধ ক্রমাগত ভিন্ন রূপ নিচ্ছে। এলাকায় এলাকায় নিজস্ব বাহিনী গড়ে উঠেছে। এ বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই কঠিন হবে। এ সকল বাহিনী হয়তো একদিন মুক্ত অঞ্চল সৃষ্টি করবে। সত্যিই সেদিন হয়তো শুরু হবে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের সংগ্রাম।
কিন্তু ভারত সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কী করে দূরে বসে এ ছবি দেখবে। এ পরিস্থিতি নিশ্চয়ই তাদের কাছে কাম্য নয়। তাই এদের পাকিস্তানের সাথে একটি সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। হয়তো সমঝোতার ভিত্তিতে আমাদের দেশে ফিরতে হবে যুদ্ধ অসমাপ্ত রেখে। কলকাতায় গিয়ে মোশতাক সাহেবদের ষড়যন্ত্রের কথা শুনে এ কথাই আমার বারবার মনে হয়েছে। সকলকে মুখে বলেছি দেশ স্বাধীন করেই বাড়ি ফিরব। কিন্তু নিজে কষ্ট করে বুঝতে বা বোঝাতে পারিনি সেটা কিভাবে সম্ভব হবে। আমাদের বই পুস্তকে বুর্জোয়াদের এ ধরনের ভূমিকা তেমন উল্লেখ নেই। এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি কোনো দেশে। তাই বারবার মনে হয়েছে এবার আমরা স্বাধীন হলেও কোথায় যেন একটা কিন্তু থেকে যাবে।
একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে কোলকাতায় তখন তুমুল বিতর্ক। পশ্চিমবাংলায় তখন ভিন্ন রাজনীতি। নকশালবাড়িকে কেন্দ্র করে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়ে গেছে। সিপিআই (এম) থেকে বের হয়ে গিয়ে চারু মজুমদার ও কঙ্গল সাঁওতালের নেতৃত্বে সিপিআই (এমএল) গঠিত হয়েছে। এদের শ্লোগান কৃষি বিপ্লব। এদের কর্মসূচি শ্রেণিশত্রু খতম। এদের খতম অভিযানে ইতোমধ্যে অসংখ্য জোতদার নিহত হয়েছে। এদের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। আহ্বান জানান হয়েছে সারা ভারতবর্ষে নকশালবাড়ির লাল আগুন ছড়িয়ে দেয়ার।
নকশাল আন্দোলনের প্রভাব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও পড়েছে। এই আন্দোলন নিয়ে পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি শতধা বিভক্ত। এদের মধ্যে একটি উপদল নকশালবাড়ির অনুকরণে আন্দোলন গড়ে তুলবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শ্লোগান লেখা হচ্ছে দেয়ালে দেয়ালে।
পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া হয়েছে বিভিন্নভাবে। কংগ্রেস এই আন্দোলনকে দমনের জন্যে বদ্ধপরিকর। সিপিআই এ ব্যাপারে কংগ্রেসের সাথে একমত। আরএসপির বক্তব্য হচ্ছে নকশালবাড়ির পন্থা সঠিক নয়। বিচ্ছিন্নভাবে কৃষি বিপ্লব করা যাবে না। কৃষি বিপ্লব মূল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাথে জড়িত। তবে নকশালবাড়ি আন্দোলনে যোগ নিয়ে যারা প্রাণ দিচ্ছে সেই তরুণদের লাল সংগ্রাম জানাতেই হবে। কারণ ভুল পথে হলেও ওরা সমাজতন্ত্রের আন্দোলনেই প্রাণ দিতে নেমেছে।
তবে এই আন্দোলনের সময় সবচেয়ে বিপদে পড়েছে সিপিআই (এম)। পশ্চিমবাংলায় তখন যুক্তফ্রন্ট সরকার। কংগ্রেস বিরোধী এই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি। এই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যোতি বসু। অর্থাৎ নকশাল আন্দোলন দমনের দায়িত্ব জ্যোতি বসুর। অথচ রাজনৈতিক কারণে জ্যোতি বসুর পক্ষে নকশালদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া সম্ভব ছিল না। এ পরিস্থিতিতে পশ্চিমবাংলার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়। কংগ্রেস নতুন সরকার গঠন করে। কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী তখন সিদ্ধার্থশংকর রায়। সিদ্ধার্থশংকর রায়ের নেতৃত্বে নির্মমভাবে নকশাল বিরোধী অভিযান শুরু হয়। তবে শুধু নকশাল নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গে তখন ত্রাসের রাজত্ব। তখন কোনো বামপন্থী কর্মী ঘরে থাকতে পারছে না। গভীর রাতে এলাকার পর এলাকা ঘেরাও করা হচ্ছে। তরুণদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। সেই তরুণরা আর বাড়ি ফিরছে না। সারা পশ্চিমবঙ্গে সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ (সিআরপি) নামানো হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে সিআরপির নাম শুনলে শিশুরাও নাকি ভয়ে ঘুমিয়ে যায়। পশ্চিমবাংলার হাজার হাজার বামপন্থী তরুণ পুলিশের ভয়ে পশ্চিম বাংলা ছেড়ে গেছে। বামপন্থীদের বিরুদ্ধে এ অত্যাচার চালাচ্ছেন কংগ্রেস সরকার। আর এ কংগ্রেস সরকারের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আছেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। লাখ লাখ মানুষ পশ্চিম বাংলায় ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। অসংখ্য তরুণ পাকিস্তান সরকারকে হটানোর জন্যে ভারতে যায়। তাদের লক্ষ্য তারা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেবে। মুক্তিবাহিনী গঠন করবে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন করবে। তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করবে ভারত সরকার।
ভারতের বামপন্থীদের কাছে এ বক্তব্য ছিল একান্তই অবিশ্বাস্য। পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেস সরকার নির্বিচারে বামপন্থীদের হত্যা করছে। সমাজতন্ত্রীদের নিশ্চিহ্ন করছে। সেই কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দেবে এবং বাংলাদেশের একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে, এ ধরনের বক্তব্য পশ্চিমবাংলার বামপন্থীদের কাছে ছিল একান্তই অবাস্তব।
তাই প্রথমদিকে বামপন্থীরা দূর থেকে এই আন্দোলন দেখার চেষ্টা করেছে। নিজেদের তেমন সংশ্লিষ্ট করেনি। শরণার্থীদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়নি। বিশেষ করে তাদের বিস্মিত করেছে অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের আচার-আচরণ এবং নিত্যদিনের জীবন যাপন। বলা হচ্ছে এদের নেতৃত্বেই নাকি বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। এদের মধ্যে অধিকাংশ সদস্যই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো কথা বলতে পারে না। তারা জানে না তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন, কেন গ্রেফতার হয়েছে এবং আদৌও তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চান কি না। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সাথে ছাত্রলীগ নেতত্বের কোন্দলের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ভারতের মাটিতে। কোনো কোনো ছাত্রনেতা বেসামাল অবস্থায় সাধারণ নাগরিকদের হাতে প্রহৃত হয়েছে। একসময় পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের মধ্যে বলাবলি হয়েছে, এই নেতাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হবে। তরুণদের প্রশিক্ষণ দেয়া হোক। তাহলে হয়তো বা কোনো দিন বাংলাদেশের নতুন কিছু ঘটতে পারে। মোট কথা ভারত সরকারের সহযোগিতায় আর বাংলাদেশের এই নেতাদের নেতৃত্বে শোষণমুক্ত বাংলাদেশ হবে, এই ধরনের কথাবার্তা বামপন্থীদের কাছে ছিল একান্তই হাস্যকর। তাই প্রতি পদে পদে ওদেশের বামপন্থীরা আমাদের সমালোচনা করেছে। বলেছে, আপনারা দেশ ছেড়ে কেন এসেছেন? কেন নিজের দেশ থেকে মুক্তির সংগ্রাম গড়ে তোলেননি? ভারত একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। ভারতের নেতৃত্ব পুঁজিবাদী। এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র আপনাদের শোষণমুক্ত রাষ্ট্র করে দেবে, এই তত্ত্ব আপনারা কোথায় পেলেন? মার্কস, লেনিন, মাও সেতুং বা চে-গুয়েভারার কোন বইতে এ ধরনের কথা আছে। আপনারা এখানে বসে ভারত সরকারের লেজুড়বৃত্তি করছেন। আবেগতাড়িত বাঙালি আপনাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে আর এই সুযোগে কংগ্রেস নিজের আসন পাকাঁপোক্ত করার চেষ্টা করছে।
তাদের এই বক্তব্যে আদৌ ভুল ছিল না। ত্রিপুরা বা পশ্চিমবাংলায় বাঙালিরা না থাকলে আমাদের বুঝতে হতো কত ধানে কত চাল হয়। আমাদের পূর্ব এবং পশ্চিম প্রান্তে ত্রিপুরা ও পশ্চিবাংলায় কোটি কোটি বাঙালির জন্মভূমি। পূর্ব পাকিস্তান নামক বাংলাদেশ। অনেক চোখের জলে তারা পিতার ভিটি ছেড়ে গিয়েছে। তারা অনেক কিছু হারিয়েছে। তাদের নতুন নাম শরণার্থী বা উদ্বাস্তু। অর্থাৎ তারা অন্যের আশ্রয় চায় এবং যাদের নিজের কোনো বাসভূমি নেই। অধিকাংশ শরণার্থী উদ্বাস্তু পরিবার বিভক্ত হয়েছে দেশ বিভাগের ফলে। তাই তাদের কাছে পুঞ্জিভূত আবেগ। নিজের জন্মভূমির প্রতি টান। সেই জন্মভূমি আক্রান্ত হলে তারা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। কোনো যুক্তি তাদের মাথায় আসেনি। ওপারের লাখ লাখ বাঙালিকে তারা বুকে জড়িয়ে ধরেছে। নিজের বাড়িতে স্থান দিয়েছে। ভাগ করে খাবার খেয়েছে। নতুন প্রজন্মের শিশু স্কুল কলেজ ছেড়ে বের হয়েছে সাহায্যের সন্ধানে। নতুন স্বজনদের জন্যে। পৃথিবীতে এ ঘটনা কোনোদিন ঘটেনি। একটি আবেগের পরিবেশে এবং তুখোড় বামপন্থী ও সকল যুক্তি ভুলে বাঙালি হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে এ যুদ্ধের রূপ ভিন্নতর হতো।
আমাদের অনেক লেখক, অনেক গবেষক এবং অনেক নেতারা সেদিনের এ আবেগের দিকটি ভুলে গিয়ে যুদ্ধ মূল্যায়ন করতে চান এবং মূল্যায়ন করে থাকেন। তাঁদের কথায় মনে হয় ভারতবর্ষে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল স্বাভাবিক। ভারত সরকার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের সাহায্যে এসেছেন। তাঁরা উল্লেখ করতে চান না ত্রিপুরা ও পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের আবেগ এবং ভারত সরকারের ওপর সেই আবেগ ও সমবেদনার ভিত্তিতে সৃষ্ট চাপের কথা। এ আবেগের জন্যেই আমরা দিনের পর দিন বিতর্ক করতে পেরেছি। যে বাঙালি তরুণ আমাদের সংগ্রাম সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়েছে, আমাদের ভুল ধরিয়ে দিয়েছে সেই তরুণই পারিবারিক পরিবেশে ফিরে ভিন্ন। মানুষ হয়ে গেছে। সে তখন মার্কসবাদী, লেনিনবাদী বিপ্লবী নয়, একান্তই ভাত এবং মাছের বাঙালি।
এ দৃশ্য আমি ক্রান্তি প্রেসে দেখেছি। ক্রান্তি প্রেসের আরএসপির নেতারা থাকেন। এক সময় অনুশীলন সমিতি করতেন। বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার সহ্য করেছেন। ঘর করেননি। স্ত্রী পুত্ৰ-পরিবার নেই। আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ক্ষীণ। তাঁরা আমাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতেন এ যুদ্ধে জয়লাভ করলেও আপনাদের ভালো হবে না। কংগ্রেস নেত্রী শ্রীমতি গান্ধীর নেতৃত্বে শোষণমুক্ত স্বাধীন বাংলা গঠিত হতে পারে না। আপনাদের নেতৃত্ব একান্তই সুবিধাবাদী। দেশে ফিরে গিয়ে আপনাদের শোষণমুক্ত সমাজের জন্যে যুদ্ধ করতে হবে। আজকের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হবে। ক্রান্তি প্রেসে সামনের কক্ষে এই বিতর্কের মাঝখানে হঠাৎ পেছন থেকে মনি দা চিৎকার করে উঠলেন। মনি দা হচ্ছে মনিন্দ্র চক্রবর্তী। বাড়ি কুমিল্লায়। আরএসপির নেতা। আরএসপির কমিউন পরিচালনা করেন। মনিদা সারাদিন রেডিও শোনেন। মুক্তিবাহিনীর খবর রাখেন। মুক্তিবাহিনীর জয়লাভের খবর শুনলে চিৎকার করে উঠেন। উল্লাসে সবাইকে চা খাওয়ান। হয়তো মনে ভাবেন বাংলাদেশ স্বাধীন হলে জন্মভূমি কুমিল্লায় আবার ফিরে যেতে পারবেন। ওই কুমিল্লায় তার রাজনৈতিক হাতেখড়ি। ওই কুমিল্লা তাকে শিখিয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম। ব্রিটিশ চলে গিয়েছে। কিন্তু সে দেশ স্বাধীন করার জন্যে যিনি জীবনে সবকিছু হারিয়েছেন সেদেশে তার থাকা হয়নি। মনিদা দেশান্তরী। মনিদা আমাদের বিতর্ক শোনেন আর সারাদিন শোনেন রেডিওর খবর। আর মাঝে মাঝে চিৎকার করে ওঠেন।
১৯৭১ সালের সংগ্রামে এই ছিল এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। আমি বাঙালি। আমি বাংলাদেশ চাই। আমি চাই বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধে জয়লাভ করুক। কিন্তু আমি জানি এ যুদ্ধে বাঙালির মুক্তি আসবে না। এ যুদ্ধে শোষণমুক্ত বাংলাদেশ হবে না। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে এ যুদ্ধ সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু আমি এপারের বাঙালি। ওপারের স্বজনেরা বহু প্রত্যাশা নিয়ে এপারের আশ্রয় প্রার্থী। ওরা যেন এপারে এসে আমার মতো শরণার্থী আর উদ্বাস্তু না হয়। ওরা যেন সম্মান নিয়ে দেশে ফিরে যেতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশের যুদ্ধের ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিত্ব দ্বিধা বিভক্ত। আমার জন্মভূমির টান আমাকে আবেগমথিত করে। আমার যুক্তি ও প্রজ্ঞা আমাকে বিপরীত কথা বলে।
১৯৭১ সালের সংগ্রাম তত্ত্ব ও ব্যবহারিক জীবনের মাঝখানে ছিল এক পর্বতপ্রমাণ দেয়াল। আমি তত্ত্ব দিয়ে বুঝেছি এ সংগ্রাম সঠিক নয় বলে ব্যাখ্যা দিয়েছি। কিন্তু নিত্যদিনের জীবনে এ সংগ্রাম সফল করার জন্যে সর্বস্ব দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছি। তবুও বিতর্কের শেষ হয়নি। এ বিতর্ক তুঙ্গে উঠল ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হবার পর।
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বোঝা গেল যুদ্ধ এগিয়ে আসছে। সংবাদপত্রের খবরে বলা হলো ৪ ডিসেম্বর শ্রীমতি গান্ধী কলকাতায় আসছেন। তিনি ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ভাষণ দেবেন। অনেকে বলতে থাকলেন ওই জনসভা থেকে তিনি যুদ্ধের ঘোষণা দেবেন।
কদিন পরের খবর হলো শ্রীমতি গান্ধীর ৪ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ৩ ডিসেম্বর কলকাতায় জনসভায় ভাষণ দেবেন। এছাড়া অদ্ভুতভাবে আরেকটা কথা ছড়িয়ে গেল সারা কলকাতায়। বলা হতে থাকল পাকিস্তান ৩ তারিখ ভারত আক্রমণ করবে। এ কথা জেনে শুনেই শ্রীমতি গান্ধী কলকাতায় আসছেন। আগে নাকি জানা ছিল পাকিস্তান ৪ তারিখ আক্রমণ করবে। পরবর্তীকালে জানা গেল পাকিস্তানের ধারণা ভারত সরকার এ খবর পেয়ে গেছে। সুতরাং আক্রমণের তারিখ পরিবর্তন হয়েছে। আরো জানা গেল, পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্তের সাতটি বিমানবন্দরে হামলা চালাবে। এ খবর জানতে পেরে ভারত সরকার নাকি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। এ সকল বিমানবন্দর থেকে বিমান সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাখা হয়েছে নকল বিমান।
তখনো ভাবতেও চেষ্টা করিনি যে এত কথা আমরা কী করে জানতে পারলাম। আমরা সব কিছু জানতে পারছি আর পাকিস্তান কিছুই জানে না সে কেমন কথা। এ পরিবেশেই শ্রীমতি গান্ধী ৩ ডিসেম্বর কলকাতায় এলেন। শ্রীমতি গান্ধীর জনসভায় ভাষণ শুনতে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে গেলাম। জনসভার অধিকাংশ লোকই বাংলাদেশের। আমি ভেবেছিলাম আরো লোক হবে। জনসভায় গিয়ে মনে হলো বাংলাদেশের যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ হলেও শ্রীমতি। গান্ধী তখন তত জনপ্রিয় নন।
বিকেলের দিকে জনসভা শুরু হলো। খুব ধীরে শ্রীমতি গান্ধী বক্তৃতা শুরু করলেন। কিছুক্ষণ বক্তৃতার পর একজন বার্তাবহ শ্রীমতি গান্ধীকে কী যেন একটা খবর জানালেন। শ্রীমতি গান্ধী বক্তৃতা সংক্ষেপ করলেন। জনসভা শেষ হলো।
পরের দিন খবরে কাগজে দেখলাম যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শ্রীমতি গান্ধী কলকাতার জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার সময়ই তাঁর কাছে খবর আসে যে পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতীয় বিমান বন্দরে হামলা চালিয়েছে। জনসভা সংক্ষিপ্ত করে শ্রীমতি গান্ধী সামরিক বাহিনীর একটি বিমানে নয়াদিল্লি ফিরে যান। গভীর রাতে ভারতীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক বসে। বৈঠকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ এনে ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সংবাদপত্রের পাতায় কলকাতা তখন খুব গরম। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। কিন্তু ওই শহরে বাঙালিরা সংখ্যালঘু। তাই ব্যবসা বাণিজ্যে কলকাতায় বাংলাদেশের যুদ্ধের তেমন খবর নেই। খবর হচ্ছে পত্রিকার পাতায় এবং সন্ধ্যা বেলা সেনাবাহিনীর দফতরে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতর কলকাতায়। যুদ্ধের নেতৃত্বে আছেন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। সরকারিভাবে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সমবায়ে গঠিত মিত্র বাহিনী যুদ্ধ করছে। এই মিত্র বাহিনীর নেতৃত্বে আছেন আরোরা। তাঁর নির্দেশে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীও যুদ্ধ করছে। এই আরোরার দফতরে সন্ধ্যার দিকে সাংবাদিকরা জড়ো হচ্ছে। এই দফতর থেকেই সকল খবর জানানো হচ্ছে।
ক্রান্তি প্রেসে সকলে তখন উদ্বিগ্ন। মনিদা রেডিও নিয়ে বসে আছেন। প্রতি মুহূর্তে তিনি খবর নিচ্ছেন। রেডিওর খবর নিতে দেরি করলে মনিদার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে। শ্রীমতি গান্ধী পার্লামেন্টে এই ঘোষণা দেন। ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান ভারতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।
অপরদিকে নতুন খেলা শুরু হয় জাতিসংঘের সদর দফতরে। আর্জেন্টিনার পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এই প্রস্তাবে ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে নিজ নিজ দেশে সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিয়ে যাবার কথা বলা হয়। এরপর আরো আটটি প্রস্তাব করে বলেন যে ভারত থেকে অবিলম্বে শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হোক। মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ এ প্রস্তাব সমর্থন করেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয়। বলা হয় যে, পাকিস্তানিরা যখন নির্বিচারে বাংলাদেশীদের হত্যা করছিল তখন জাতিসংঘ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এখন পাকিস্তান বিপদে পড়ায় জাতিসংঘে এ প্রস্তাব উঠেছে। এ প্রস্তাব গৃহীত হলে পাকিস্তান লাভবান হবে। বাংলাদেশ এ প্রস্তাব মানবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় প্রস্তাবের বিরুদ্ধেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়োগ করে। ফলে প্রস্তাব দুটি বাতিল হয়ে যায়।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশের বিজয়ের খবর আসতে থাকে। আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান একটি গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান জানান পাকিস্তান বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্যে। এই আহ্বানে বলা হয়—’তোমাদের বাঁচার কোনো পথ নেই। বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্যে তোমাদেরকে ঘিরে রেখেছি। তেমরা যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে তারা তার প্রতিশোধ নেবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। অনেক দেরি হওয়ার আগেই তোমরা আত্মসমর্পণ করো। তোমাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা ও যুদ্ধাস্ত্রের শক্তি অকেজো হয়ে গেছে। এমনকি বাইরে থেকে বিমানের সাহায্য আসার সম্ভাবনা নেই। অতএব তোমরা অস্ত্র ত্যাগ করো। তোমাদের বাঁচার কোনো পথ নেই। একমাত্র পথ হচ্ছে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করা।’
ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ-এর আহ্বান বারবার বেতারে প্রচারিত হতে থাকে। তাঁর এই আহ্বানে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। পাকিস্তান বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়তে থাকে। ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর প্রধানরা আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার। কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন চরম ভারত বিদ্বেষী। তারা ন’মাসের যুদ্ধের সময় প্রতি পদে পদে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করে গেছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে বাংলাদেশের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর বৃহৎ দুই শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছিল। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল অবশ্যম্ভাবী। ঢাকার পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষ থেকে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দেয়া হলেও যুক্তরাষ্ট্র সরকার তা নাকচ করে দিয়েছে। কখনো ইয়াহিয়া খানকে হুমকি দিয়েছে। পাকিস্তান বাহিনীকে বাধ্য করেছে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধে মার্কিন ভূমিকা ছিল বাংলাদশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যে কোনো মুল্যে প্রতিহত করার।
যুদ্ধ শুরু হবার পর নতুন করে বিপদে পড়লাম। বিতর্ক শুরু হলো যুদ্ধের চরিত্র নিয়ে। এ যুদ্ধ কাদের যুদ্ধ? ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আদৌ হতে পারে কিনা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমরা শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রচার করেছিলাম। বিবৃতিতে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং বাংলাদেশের জনগণকে ভারতীয় বাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এই বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর আরএসপির তরুণ কর্মীদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তাদের সুস্পষ্ট মন্তব্য হচ্ছে ভারতীয় বাহিনী কোনো দেশের মুক্তিদাতা হতে পারে না। যুদ্ধে আপনাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে কিন্তু সে মুক্তির আকাক্ষা ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্বে অর্জিত হতে পারে না। মুক্তির দিক থেকে তাদের কথা ফেলে দেয়া যায় না। বক্তব্যের জবাবে আমার একটি ভিন্ন জবাব ছিল। আমরা বক্তব্য ছিল ৭১-এর যুদ্ধে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু এ যুদ্ধ আদৌ মুক্তিযুদ্ধ ছিল না। সঠিকভাবে বলতে গেলে এ যুদ্ধ ছিল পাকিস্তান থেকে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যুদ্ধ। এ যুদ্ধের শ্লোগান ছিল আমরা বাঙালি। বাঙালির জন্যে স্বাধীন রাষ্ট্র চাই। অবাঙালি আমাদের শত্রু। তাই তাদের খতম করো। অবাঙালি হানাহানি করে অসংখ্য মানুষের জীবনহানি ঘটিয়েছে। এ যুদ্ধ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যুদ্ধ বলেই এ যুদ্ধের কর্মসূচির মধ্যে সমাজ পরিবর্তনের কথা ছিল না। এ যুদ্ধের নেতৃত্বের কল্পনা ছিল দেশ। তাই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। অবাঙালির পরিবর্তে আমরা বাঙালিরা শোষণ ও শাসন করার জন্যে একটি রাষ্ট্র চাই। সেই রাষ্ট্রের নাম হবে বাংলাদেশ। আমার কাছে স্পষ্ট ছিল যে অবস্থা যেমন দাঁড়িয়েছে তাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ব্যতীত আপাতত এ সমস্যার কোনো সমাধান নেই। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় দেশ স্বাধীন করে দেশে ফিরতে হবে। এ মুহূর্তে বামপন্থীদের এককভাবে সংগ্রাম চালিয়ে নেয়ার শক্তি বা প্রস্তুতি নেই। এছাড়া বামপন্থীরা হাজার ভাগে বিভক্ত। তত্ত্ব দিয়ে যে যতই বোঝাক না কেন বামপন্থীরা কোনো অর্থেই তখন ঐক্যবদ্ধ ছিল না বা আদৌ কোনো নিয়ামক শক্তি ছিল না। অনেকেই বলে থাকেন এ যুদ্ধ দীর্ঘদিন চললে বামপন্থীদের হাতে এ যুদ্ধের নেতৃত্ব চলে যেত। অথচ তারা কেউই ভেবে দেখতে চান না যে পরিস্থিতি কখনো তেমন ছিল না। এ ধরনের একটা ধারণা সকল মহলেই ছিল। ভয়ও ছিল শাসক মহলে। কিন্তু কেউই বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তৎকালীন পরিস্থিতি ভেবে দেখতে চেষ্টা করেননি। অসংখ্য গ্রামের ছেলে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছিল। এলাকাভিত্তিক অনেক মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। বামপন্থীদের ঐক্য, শক্তিশালী সংগঠন ও প্রস্তুতি থাকলে বিকল্প কিছু ভাবা যেত। চারদিকে ভারত বেষ্টিত বাংলাদেশের একই সাথে ভারতীয় ও পাকিস্তান বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে যুদ্ধে জয়লাভ করার পরিস্থিতি তখন আদৌ ছিল না।
আমার এ বক্তব্যে অনেকে খুশি হননি। পরবর্তীকালে বামপন্থী মহলেও আমার বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হয়নি। আমার বক্তব্য এখনো বিতর্কিত। কিন্তু আমি এখনো মনে করি যে ৭১-এর যুদ্ধ ছিল অবাঙালির বিরুদ্ধে বাঙালির সংগ্রাম। শোষকদের বিরুদ্ধে শোষিতদের সংগ্রাম নয়। এ যুদ্ধে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল। নেতৃত্বের কাছে অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সে প্রত্যাশা ছিল একান্তই আবেগভিত্তিক। এ যুদ্ধ মুখ্যত আবেগ ও স্বতঃস্ফূর্ত হওয়ায় কেউ ৭১-এর যুদ্ধকে স্বাধীনতা যুদ্ধ, আবার কেউ বলেছে মুক্তিযুদ্ধ। কেউ ৭১-কে বলেছে হিড়িকের বছর, আবার কেউ বলেছে গণ্ডগোলের বছর। এই বিভিন্ন ধরনের সংজ্ঞা নিয়েই ৯ মাস যুদ্ধ চলেছিল ১৯৭১ সালে। সেই যুদ্ধের শেষ অংশে এসে হাজারো প্রশ্ন উঠেছিল বিভিন্ন মহলে।
এ যুদ্ধের শেষ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নতুন চাল চেলেছিল। হঠাৎ একদিন শোনা গেল মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করছে। ওয়াশিংটন থেকে সরকারিভাবে বলা হলো তকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আটকেপড়া মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধারের জন্যে সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় যাচ্ছে।
সপ্তম নৌবহরের খবরে সকল মহলই শঙ্কিত। এ যুদ্ধের সময়ই সপ্তম নৌবহর নিয়ে একটি বৈঠকের খবর শুনলাম ক্রান্তি প্রেসে। এ বৈঠক বসেছিল নয়াদিল্লিতে। বৈঠক ডেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। বৈঠকে ডেকেছিলেন লোকসভার প্রবীণ সদস্যদের। আরএসপির সর্বভারতীয় সম্পাদক কমরেড ত্রিদিব চৌধুরী এ বৈঠকে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। কমরেড ত্রিদিব চৌধুরী ১৯৫২ সাল থেকে ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্য। তিনি গোয়া মুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সালাজারের জেলে ১৯ মাস ছিলেন। তিনি বিরোধীদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করেছিলেন। ত্রিদিব চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী সেই বৈঠকে সেনাবাহিনীর প্রধান মানেকশকে ডাকা হয়েছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল মার্কিন সপ্তম নৌবহরের কথা। জেনারেল মানেকশ বলেছিলেন সপ্তম নৌবহরের আক্রমণের মুখে মিত্রবাহিনীর টিকে থাকবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তবে সপ্তম নৌবহর আক্রমণ চালালে রুশ নৌবহরও বসে থাকবে না এবং রুশ নৌবহর মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে অনুসরণ করছে। অর্থাৎ বিশ্ব তখন তৃতীয় মহাযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়াবে।
একথা আমি আগেই লিখেছি এবং এ সত্যই প্রমাণিত হলো যে রুশ নৌবহরের জন্যে মার্কিন সপ্তম নৌবহর কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। অর্থাৎ পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজী মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার কাছে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করেন।
কলকাতায় তখন উৎসবের বন্যা। ক্রান্তি প্রেসেও উৎসব। কিন্তু আমার মন ভালো ছিল না। আমি বুঝতে পারছিলাম না–এরপর কী হবে। এ যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। রাজনৈতিক বা মানসিকভাবে সংগঠিত ছিল না। তবুও ৯ মাসের মধ্যে অসাধ্য সাধন করেছে আমাদের তরুণরা। কিন্তু আমাদের সামনে আছে পর্বতপ্রমাণ সমস্যা। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে শিল্পায়ন হয়নি। যে শিল্প কারখানা ছিল তাও যুদ্ধের কারণে বিধ্বস্ত। এই বিধ্বস্ত দেশটিকে উদ্ধার করতে হলে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দরকার। অথচ প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগই ঐক্যবদ্ধ নয়। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ক্ষত-বিক্ষত। সৎ ও সাহসী হিসেবে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের সুনাম থাকলেও সকলের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য নন। ডানপন্থীদের কাছে তিনি বাম ঘেঁষা এবং মার্কিন বিরোধী। তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাকে নিয়ে সমস্যা দেখা দেবে। এ ধরনের নানা চিন্তায় আমি বিপর্যস্ত। বন্ধুরা বলছিল, আপনাদের দেশ স্বাধীন হলো। আপনি বাইরে ঘুরে আসুন। আমি সেদিন বাইরে যাইনি। ক্রান্তি প্রেসে শুয়ে দিন কাটিয়েছি। কোনো কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়ির অবস্থা কিছুই জানি না। ঢাকায় গিয়ে চাকরি করতে হবে। চাকরির ভবিষ্যতও জানি না। সবার আগে মায়ের সাথে দেখা করতে হবে। ২৩ বছর পর ভারতে এসেছি। এই ২৩ বছর মায়ের সাথে দেখা হয়নি। গত কয়েক মাস কলকাতায় আছি। কিন্তু বর্ধমানের আসানসোলে মাকে দেখতে যাইনি। বলেছি, দেশ স্বাধীন হলে মাকে দেখে দেশে ফিরব। স্থির করলাম নতুন ঝামেলা শুরু হওয়ার আগে আসানসোলে যাব। আসানসোলে দিন দুয়েক থেকে কলকাতা ফিরব। কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরব এক সপ্তাহের মধ্যে।
.
গোমতীর তীরে পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল হয়ে গেল। গোমতীর ওপারে কংসনগর। আবার সেই পুরান পথ। ফুলতলী ইমিসিং হয়ে দীঘিরপাড় যেতে হবে। পুরান পথে ফিরতে হবে ঢাকায়। গোমতীর কাছে এসে সিদ্দিক ফিরে যাবে। আমরা ফেরিতে পার হয়ে কংসনগর যাব। সিদ্দিক অনেক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। কিন্তু কোনোদিন আমার নাম জিজ্ঞেস করেনি। জিজ্ঞেস করেনি ঠিকানা। হয়তো শহিদুল্লাহর কাছে শুনেছে। আমি আজো জানি না শহিদুল্লাহ কী পরিচয় দিয়েছিল সিদ্দিকের কাছে। কিন্তু আমার জানার কৌতূহল হলো নাফিয়া সম্পর্কে। নাফিয়াকে না বলে চোরের মতো পালিয়ে এসেছি। তাই জানতে ইচ্ছে হলো ওদের কাহিনী। ওদের জমিজমা নেই জানি। কিন্তু কখনো বুঝতে পারিনি নাফিয়ার বিয়ে হয়েছিল কিনা। মোটামুটিভাবে আমাদের দেশের এ বয়সের মেয়েরা তখন এত প্রগলভ ছিল না। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এমন অসন্তোষও কারো দেখিনি।
তাই সিদ্দিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নাফিয়াকে বিয়ে দাওনি কেন? আমার কথায় সিদ্দিক মলিন হলো। বললো, ওকে আলীর চরে বিয়ে দিয়েছিলাম। ওর বর কাজ করত কক্সবাজারে। একাত্তরের অসহযোগের পর নাফিয়ার বর আলী আকবর আর ফিরে আসেনি। তাই মানুষের কাছে পরিচয় দিয়েছিলাম আপনারা আলীর চরের কুটুম্ব। নইলে আপনাদের বাঁচাতে পারতাম না। আলী আকবর ফিরে না আসায় নাফিয়া একটু পাগলাটে হয়ে গেছে। যে কোনো মুক্তিযোদ্ধা এলে আদর করে খাওয়ায়। রাত বাড়তে থাকলে তার পাগলাটে ভাব বাড়তে থাকে। চিৎকার করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ সেই ভোরে গোমতী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে নাফিয়ার কাহিনী শুনছিলাম। তারপর আবার গোমতী পাড়ি দিয়েছিলাম ২৫ বছর পর। দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। কারো কথাই মনে থাকলো না। কারো জন্যেই কিছু করিনি। আমাদের এই আচরণের আরেক নাম অকৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাসঘাতকতা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হাজারবার কুমিল্লা গিয়েছি। কখনো ভাবতে চেষ্টা করিনি গোমতী তীরের চন্ডীপুরের কথা।
তারপর ২৫ বছর। হঠাৎ বোধ হয় একদিন মনে হলো গোমতীর তীরে চন্ডীপুরে একটি দরিদ্র পরিবার ছিল। তারা আমাদের কোনোদিন চিনতে চেষ্টা করেনি। খোঁজ নেয়নি। মুক্তিযোদ্ধা বলে আশ্রয় দিয়েছিল। ২৫ বছর পরে মনে হলো আমাদের একটা দায়িত্ব ছিল। জানতে চেষ্টা করা উচিত ছিল নাফিয়ার স্বামী আলী আকবর বাড়ি ফিরেছিল কিনা। ইতিমধ্যে দৈনিক বাংলায় নাফিয়ার নাম করেই আমি নিবন্ধ লিখেছি। সে নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু কখনো জানতে চেষ্টা করিনি সিদ্দিক বা নাফিয়া কোথায় আছে। কেমন আছে। খেয়ে পরে আছে কিনা। আমি উচ্চমহলে একেবারে অপরিচিত ছিলাম না। আমার কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই এমনো নয়। তবুও কোনো কিছু করিনি ওই সব পরিবারের জন্যে।
তারপর ১৯৯৬ সাল। ঠিক ২৫ বছর পর। এক দুপুরে গোমতী নদী পাড়ি দিলাম। সঙ্গে দেবিদ্বারের দুটি ছেলে। গোমতী পাড়ের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমার সঙ্গে আমার দলের ছেলে মনির এবং তার এক আত্মীয়। ব্রাহ্মণপাড়া থানার চন্ডীপুর গ্রাম অতবড়ো তা আমার জানা ছিল না। ১৯৭১ সালে প্রাণের ভয়ে ছুটেছি। তখন মনে হয়েছে সিদ্দিকদের বাড়ি ১০ থেকে ১৫ মিনিটের পথ। আর তখন কেউ চেনাও ছিল না। এবার ভিন্ন পরিস্থিতি। কথায় কথায় জানাজানি হয়ে গেল আমি চণ্ডীপুর যাচ্ছি। আমার নাম মোটামুটিভাবে পরিচিত।
নতুন সড়কে হাঁটছি আর হাঁটছি। চৈত্রের রোদ্দুর তখন মাথার উপরে। আমার মনের কোণে এই বাড়ির একটি ছবি ছিল। পাটক্ষেত পার হয়ে একটি পুকুর। পুকুরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটি মসজিদ। তারপর সিদ্দিকের বাড়ি। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অনেক লোক জমে গেল। কিছুক্ষণ পরে ঠিকই আমি বাড়িটি চিনতে পারলাম। আমি সিদ্দিকের ঘরে ঢুকতেই সিদ্দিক চিৎকার করে উঠল। বলল, আপনি সেই লোক। আপনি ৭১ সালে আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। আমি অবাক হয়ে সিদ্দিকের দিকে তাকাচ্ছিলাম। ২৫ বছর আগে লুঙ্গি, হাওয়াই শার্ট আর একমুখ দাড়ি নিয়ে আমি সিদ্দিকের বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন একটি চুলও আমার পাকেনি। ৯৪ পাউন্ডের ছিপছিপে এক তরুণ। আমি ভাবছিলাম সিদ্দিক আমাকে চিনল কী করে? সিদ্দিকের বাড়িতে তখন এক বিদেশি মেহমান। তিনি বললেন, তারা নাকি আমার কথাই আলোচনা করছিলেন। তাদের ধারণা, আমি কোনো একজন বড় লোক হবই। আমাকে তারা বছরের পর বছর খুঁজছে। কিন্তু আমার নাম ধাম জানে না। কী করে খোঁজ করবে?
সারা বাড়িতে তখন আমার কথা রটে গেছে। ছেলে-মেয়ে, বুড়ো সবাই ভিড় জমিয়েছে। সকলের বাড়িতেই যেতে হবে। সকলের ঘরেই খেতে হবে। চারদিকে ভিড় আর ভিড়। বুঝলাম আমি দীর্ঘদিনের এক গল্প হয়ে আছি ওই এলাকায়।
কিন্তু আমার তখন সেদিকে তেমন মন ছিল না। আমি ২৫ বছর পূর্বের এক তরুণীকে খুঁজছিলাম। ভাবছিলাম ওরা আমাকে খোঁজ করেছিল কেন। তাহলে নাফিয়ার স্বামী আলী আকবর কি ফিরে আসেনি? আমি বারবার নাফিয়ার কথা জিজ্ঞেস করলাম। কেউ কোনো জবাব দিল না। আমি বললাম, সিদ্দিক, আমি নাফিয়ার বাড়ি যেতে চাই। সিদ্দিক কোনো জবাব দিল না। তার চোখে তখন জল নেমেছে।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু নাফিয়ার স্বামী আলী আকবর আর ফিরে আসেনি। ১৯৭২ সালে নাফিয়া টিবিতে আক্রান্ত হয়। গরিব সিদ্দিকের পয়সা ছিল না বোনের চিকিৎসার। তাই সে হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজছিল। বাধ্য হয়ে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল শ্বশুরবাড়ি আলীর চরে। ১৯৭৩ সালে প্রায় বিনা চিকিৎসায় নাফিয়া আলীর চরে মারা গেছে।
১৯৭১ থেকে ১৯৯৬। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী। আমি একজন সিদ্দিক ও নাফিয়ার খোঁজে গিয়েছিলাম। দেশে তখন অসংখ্য অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। কিন্তু সিদ্দিককে খুঁজে পেলেও নাফিয়াকে পাইনি। এ নিয়ে সিদ্দিকের খুব অভিযোগ ছিল না। দুঃখ ছিল। তারা ভেবেছিল আমাকে পেলে হয়তো নাফিয়ার মৃত্যু হতো না। এর চেয়ে বড় সত্য কথা হতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশে নাফিয়ার চিকিৎসার অসুবিধা হতো না। টাকার কোনো অভাব হতো না। অভাব ছিল আমাদের মতো রাজনীতিকদের কৃতজ্ঞতার এবং মানবিক আচরণের। আমরা সব কিছু পেতে চাই। সবকিছু দখল করতে চাই। আর যাদের কাঁধের ওপর ভর দিয়ে সবকিছু দখল করি তাদের একদিন লাথি মেরে পিছু হটিয়ে দিই। শুধু নাফিয়া কেন? একই আচরণ করেছি ইয়াকুবের সঙ্গে। ১৯৭১ সালের আগস্টে নাফিয়ার কাহিনী শুনতে শুনতে গোমতী পাড়ি দিয়েছিলাম। দুপুরে দীঘিরপাড় বাজারে এসে পৌঁছলাম। দুপুরে দীঘিরপাড় বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন ভিড় থাকে না। বাজার মোটামুটি ফাঁকা। ওখান থেকে আমাদের নৌকায় যেতে হবে। নৌকায় যেতে হবে গৌরীপুর।
খাবার জন্যে হোটেলে ঢুকলাম। হোটেল মালিক আগেরই চেনা। জিজ্ঞেস করল, ফিরে এলেন কেন? আমি বললাম কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ওপারে যাওয়া যাবে না। সব সীমান্ত পাকিস্তান বাহিনীর দখলে। আবার ঢাকা ফিরছি। ঢাকা থেকে রায়পুর লক্ষ্মীপুর হয়ে ওপার যাবার চেষ্টা করব। হঠাৎ হোটেল মালিক বলল–স্যার, আপনাকে ঘোষগাতি যেতে হবে। সেদিন আপনার সঙ্গে গাইড হিসেবে ইয়াকুব গিয়েছিল। ইয়াকুব কিন্তু আর ফিরে আসেনি। ওর বাড়িতে লোকজন কান্নাকাটি করছে।
আমি চমকে গেলাম। আমি বলদা বাজারে ইয়াকুবকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাকে ২০ টাকা দিয়ে বলেছিলাম বাড়ি চলে যাও। সকলের ধারণা ইয়াকুব টাকা নিয়ে তাড়াল্লার হাটে গিয়েছিল। সেদিন ভাড়াল্লার হাটে বিকেলের দিকে পাকিস্তান বাহিনী হামলা চালিয়েছিল। হয়তো ইয়াকুব প্রাণ হারিয়েছে।
আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। কী করে গোষগাতি যাবো। কী তাদের গিয়ে বলব। আর ঘোষগাতির কাছাকাছি কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্ট। শহিদুল্লাহও রাজি হলো না। তার ভয় ঘোষগাতি গেলে আমরা দুজনেই মারা পড়ব। ২৬ বছর আগের কথা লিখছি। এই ২৬ বছরে অনেকবার ইয়াকুবের কথা মনে হয়েছে।
মুখটা যেন আবছা আবছা মনে পড়ছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত ঘোষগাতি যাওয়া হয়নি। হোটেল মালিককে কথা দিলাম ঢাকা গিয়ে ব্যবস্থা করব।
তারপর দীঘিরপাড় থেকে গৌরীপুর। গৌরীপুর থেকে নৌকা বদল করে আবার বেলতলী। কিন্তু বেলতলীতে আবুল হোসেনের বাড়িতে জায়গা হলো না। সে বাড়িতে অনেক লোক। সে রাতে খাওয়া জুটল না। আমাদের যেতে বলা হলো ল্যাংটা ফকিরের মাজারে। সেখানেই ঘুমাবার ব্যবস্থা। একেবারে মাজারের পাশেই ঘুমাতে হবে। মাজারে একজন মাত্র খাদেম। দুপুর রাতে সে আমাকে ডেকে তুলল। বললো হুজুর আমিও মুক্তিযোদ্ধা। আমার বাড়ি হাজীগঞ্জ। আমি কলিমুল্লাহর লোক। সাম্যবাদী দলের নেতা কলিমুল্লাহ হাজীগঞ্জে বিশেষভাবে পরিচিত।
ভোরে মাজার থেকে বেলতলী বাজারে এলাম। সেখান থেকে লঞ্চে মুন্সীগঞ্জ হয়ে ঢাকা। আবার রায়েরবাজারের মোহাম্মদ হোসেনের বাড়ি থেকে বেরিয়েছি এপ্রিল মাসে। আগস্ট মাস পর্যন্ত কোনো খবর পাইনি। এদিকে অতীন দার পুত্রবধু অজন্তা একা আছে কুমিল্লায়। কেমন আছে কে জানে।
.
শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম মায়ের সাথে দেখা করে ঢাকায় ফিরব। যতদূর মনে আছে তারিখটি ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর। সন্ধ্যার দিকে আসানসোল পৌঁছুলাম। কার সাথে গিয়েছিলাম মনে নেই। আমার অদ্ভুত লাগছিল। ১৯৪৮ সালে মার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল। তারপর ২৩ বছর আমার ভারত যাওয়া সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে অনেক জল গড়িয়েছে পদ্মা-গঙ্গা-ভাগিরথীতে। আমাদের পরিবার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বাংলাদেশে আমাদের যৌথ পরিবার ছিল। দেশ বিভাগের পর সে পরিবার শতভাগে বিভক্ত। ভারতের পূর্বে আজকের বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় সব এলাকায় আমার স্বজনদের খুঁজে পাওয়া যাবে। আমি কোথায় যাব তা জানি না। এদেশে থাকতে সবাই মিলেমিশে ছিলাম। আমাদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্য ভারতে চলে গেছে। শুধু ভাগ হইনি আমি। ১৯৭১ সালে কলকাতায় গিয়ে আমি এই সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম। কলকাতায় আমার অসংখ্য আত্মীয়। কিন্তু আমি কার ভাগে পড়েছি জানি না। তাই অনেক ভেবে চিন্তে আমি কোনো আত্মীয়ের বাসায় উঠিনি। উঠেছি রাজনৈতিক মিত্রের আশ্রয়ে। কলকাতায় আরএসপির কমিউনে।
যারা দেশ ভাগের শিকার হয়নি তারা এই মর্মান্তিক জ্বালা বুঝতে পারবেন বা। রাজনৈতিক বিভাজন যে কত দুঃখ-বেদনার সৃষ্টি করতে পারে তা তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। দেশে আমি সকলের সাথে একা ছিলাম। বিদেশে সকলে বিচ্ছিন্ন। আমি কোন ভাগে জানা নেই। কোলকাতা শহরে আমার অসংখ্য আত্মীয় আছে। কিন্তু কাকে বাদ দিয়ে কার বাড়ি উঠব সে প্রশ্নের তখনো মীমাংসা হয়নি। আমার তখন অন্নদাশঙ্করের সেই বিখ্যাত কবিতাটি মনে পড়ত। যে কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, অবিভক্ত বাংলার সব ভাগ হয়ে গেছে, শুধু ভাগ হয়নি নজরুল। আমারও মনে হতো আমার সেই ঐতিহ্যবাহী যৌথ পরিবার ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। শুধু আমি ভাগ হইনি।
২৩ বছর পর প্রথম কোলকাতায় পৌঁছেছিলাম। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস। তখনো আমি মার সাথে দেখা করিনি। কারণ আমাকে বাংলাদেশে ফিরতে হবে। তখন বাংলাদেশ যুদ্ধ আর যুদ্ধ। ভেবেছি মায়ের সাথে দেখা হলে মা আমাকে বাংলাদেশে ফিরতে দেবে না। তাই বলেছিলাম দেশ স্বাধীন হলে মার সাথে দেখা হবে।
মা থাকেন বর্ধমানের আসানসোলে। কলকাতা থেকে দুশো কিলোমিটার। যতদূর মনে আছে ট্রেনের নাম কোলফিল্ড। অর্থাৎ কয়লার খনি। এ ট্রেন হাওড়া থেকে বিহারের ধানবাদ যায়। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এ ট্রেনে যাতায়াত করে। ভোররাতে ধানবাদ থেকে রওনা হয়ে ২৫০ কিলোমিটার দূরে কলকাতায় এসে অফিস করে। আবার সন্ধ্যায় একই ট্রেনে ফিরে যায়। তাই এ ট্রেনে ডেইলি পেসেঞ্জারের ভিড়।
ভিড়ের মধেই আমি ভাবছিলাম আমার কথা। ২৩ বছর পর মার সাথে দেখা হবে। দেখা হবে দুই ভাইয়ের সাথে। বড় ভাই থাকেন মধ্যপ্রদেশের কয়লাখনি এলাকায়। জায়গার নাম মনীন্দ্রগড়। আরেক ভাই থাকে বিহারের বোকারো। ইস্পাত কারখানার ইঞ্জিনিয়ার। তাদের সাথে এবার দেখা হবে না। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার পক্ষে বেশিদিন ভারতে থাকা সম্ভব নয়।
সন্ধ্যার পর ট্রেন আসানসোল পৌঁছলো। ভাইয়ের বাসায় পৌঁছে মনে হলো আমি একটি দর্শনীয় বস্তু। চারদিকে মানুষের ভিড়। এ ভিড় আমাকে দেখতে নয়। বাংলাদেশের কথা জানতে। বাংলাদেশে কী হয়েছে সকলে জানতে চায়। তাদের প্রথম প্রশ্ন, শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? আদৌ তিনি জীবিত কি না? তিনি কেমন দেখতে? আমি তাকে চিনি কি না? আমার ভাই শেখ সাহেবকে ভালোভাবে চেনেন। আমার ভাইও এক সময় টুঙ্গীপাড়া স্কুলে পড়তেন। কিন্তু তাঁর কথা কেউ বিশ্বাস করে না। তাঁর কথা বাসি হয়ে গেছে। সবাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চায় বাংলাদেশে কী হয়েছে। যারা এ কথা জানতে চায় তাদের নাড়ির টান আছে। মাত্র কয়েক বছর আগে তারা বাংলাদেশ ছেড়েছে। পিতার ভিটি তারা ভুলতে চেয়েছিল। কিন্তু সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে ৭১-এর যুদ্ধ। তারা ভাবতেই পারেনি যে এমন একটি ঘটনা ঘটবে। তাদের স্বপ্ন কোনোদিন বাংলাদেশ ছিল না। ৭১-এর সংগ্রাম তাদের মনে করিয়ে দিয়েছে একান্তভাবেই তারা পূর্ব বাংলার লোক। তারা পশ্চিমবাংলার লোক নয়।
তাদের এই জানার ইচ্ছায় ঐকান্তিকতা ছিল। দীর্ঘদিন পরে তারা ভাবতে চেয়েছিল তারা উদ্বাস্তু নয়। তাদেরও একটি দেশ আছে। সে দেশের নাম বাংলাদেশ। কিন্তু আমার তাদের কথা ভালো লাগছিল না। হয়তো আমি তাদের অনুভূতি অনুধাবন করতে পারিনি। তাই আমার শুধু মনে হতো–এতটাই যদি ভালোবাসা ছিল তাহলে দেশ ছেড়ে চলে এলেন কেন? আপনারা সকলে মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে হয়তো এ ঘটনা ঘটত না। আমি লক্ষ করেছি ভারতে গিয়ে আমার এ মানসিকতা নিদারুণভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছে। এমনো হতে পারে যে আমি তাদের দুঃখ বেদনা অনুভব করতে পারিনি। পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছর পর আমি জেলে গেছি। তারপর একটানা প্রায় ৫ বছর জেলে থেকেছি। এ সময় উভয় বঙ্গে ভয়াবহ দাঙ্গা বেধেছে। মানুষ ভিটা ছেড়েছে। প্রাণে বাঁচার জন্যে কোনোদিক তাকায়নি। ইচ্ছা থাকলেও নিজের জন্মভূমিতে থাকতে পারেনি। এ সময়টা আমি জেলে ছিলাম। তাই তাদের এ সময়ের দুঃখ কষ্টের কাহিনী আমি অনুধাবন করিনি। কোটি কোটি মানুষ এপার থেকে ওপারে গিয়েছে। শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করেছে। জলাভূমি আবাদ করে বসতি স্থাপন করেছে। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে সকল বাঁধন। প্রেম, ভালোবাসা, মায়া, মমতা সবকিছু বিক্রি হয়েছে টাকার বিনিময়ে। দীর্ঘদিন পর এসে আমি বুঝতে পেরেছি এই উদ্বাস্তুদের সংসারে একান্তভাবেই আমি বেমানান। আমার আত্মীয়-স্বজনের সাথে আমার কথাবার্তা ধ্যান-ধারণার কোনো মিল নেই। সর্বত্রই যেন আমি এক আগন্তুক।
বাসার সামনের ভিড় ঠেলে আমি এক সময় ঘরে ঢুকে গেলাম। আস্তে আস্তে মা আমার দিকে এগিয়ে এলেন। মা‘র চেহারা তেমন বদলায়নি। সবাই চুপচাপ তাকিয়ে ছিল। কেউ ভাবেনি তাদের সাথে আমার আর কোনোদিন দেখা হবে। কেউ জানত না বাংলাদেশের সৃষ্টি হবে। সবারই ধারণা পাকিস্তান সরকার কোনোদিন আমাকে পাসপোর্ট দেবে না। সুতরাং এ জীবনে কারো সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই–এ বিষয়ে সবাই নিশ্চিত ছিল।
মা বললেন, তোর চেহারাটা খারাপ হয়ে গেছে। আমি বললাম, তুমি বুঝলে কী করে। ১৯৪৮ সালে তুমি আমাকে শেষ দেখেছ। তখন আমার দাড়ি গোফ গজায়নি। এখন আমার মুখভর্তি দাড়ি। পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। আমার সব কিছু পাল্টে গেছে। মা হঠাৎ আমার পকেটে হাত দিলেন। আমি বললাম, পকেটে হাত দিচ্ছ কেন? মা বললেন, এক সময় তোর রুমালটা খুব অপরিষ্কার থাকত। তাই দেখলাম তোর রুমালের অবস্থা কী। আমি বললাম–সে যুগ কেটে গেছে। তখন তোমাদের সাথে থাকতাম। স্কুল কলেজে পড়তাম। তারপর ২৩ বছর কেটে গেছে। এই দীর্ঘদিন একান্তই একা জীবন কাটিয়েছি। কখনো জেলে, কখনো আত্মগোপন করে, আবার কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে। এখন আমি স্বাবলম্বী। নিজের কাজ নিজে করতে হয়।
তারপর রাত বাড়তে থাকল। আমাদের কথা তেমন জমল না। ফেলে আসা ২৩ বছরের কথা যেন হারিয়ে গেল। সেদিন অনেক কথা বলার ছিল। মনে হচ্ছিল যেন কেউ কোনো কথা স্মরণ করতে পারছি না। সব কথা ছিল আবেগের, দুঃখ এবং বেদনার। কোনো কথাই সেদিন সুস্পষ্ট রূপে বলা হলো না। শুধু এক সময় মা জিজ্ঞেস করলেন-কবে যাবি? কিছুদিন থাকবি তো? ২৩ বছর পর কোলকাতায় এলি। কিন্তু আমাদের সাথে দেখা করলি না। এখন কিছুদিন থেকে যা। শরীরটা ভালো হোক। তারপর বাংলাদেশে যাবি। আমরা তোকে বাংলাদেশে যেতে বাধা দেব না।
আমি বললাম, আমি পরশু চলে যাব। কোলকাতায় কয়েকদিন থাকব। রাজনৈতিক বন্ধুদের সাথে আলাপ করব। তারপর দেশে ফিরে যাবো। আমার কথা শুনে সবাই যেন অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ কোনো কথা বলল না। অনুরোধ জানাল না একটি দিনও বেশি থাকার জন্যে। মা জানতেন, তার এ ছেলেটি শৈশব থেকেই কারো কথা শুনতে অভ্যস্ত নয়। কোনো অনুরোধই তাকে ঠেকাতে পারবে না। সেদিন আমার যে আদৌ খারাপ লাগেনি তা নয়। কিছুটা দুঃখও পেয়েছিলাম। ভাবছিলাম নিজেকে এমন করে তৈরি করেছি যে আমাকে দ্বিতীয়বার কেউ কোনো অনুরোধও করবে না। কখনো কখনো ইচ্ছে থাকলেও আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার সাধ্য থাকে না।
দু’দিন পরে দুপুরের দিকে আবার আসানসোল স্টেশনে এলাম। বাসায় সকলেই চুপচাপ। মা বললেন, বাড়ি পৌঁছে চিঠি দিস। স্টেশনে আমাকে তুলে দিতে এল আমার ছোট ভাই। সে বলল, ঢাকায় ফিরে চিঠি লিখবেন। তার এই ঢাকা শব্দটি ট্রেনের কক্ষে একটি অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করল। সকল যাত্রী তখন আমার দিকে তাকাচ্ছে। তাদের প্রশ্ন, ঢাকা যাচ্ছে এ লোকটি কে? সকলেরই তখন কথা বলার পালা। পাশে এক ভভদ্রলোক বসেছিলেন। তার পাশে ২২/২৩ বছরের এক তরুণী। তাদের কৌতূহলের শেষ নেই। তরুণীর পিতার বাড়ি বরিশাল জেলায়। বরিশালে স্টিমারে কাজ করতেন তার বাবা। ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় তার বাবা নিহত হন। তরুণীর বয়স তখন দেড় বছর। সেই দেড় বছর বয়স থেকেই সে দেশ ছাড়া। বাংলাদেশের সাথে তার পরিচয় ভুগোলের মানচিত্রে। আর ৭১-এর যুদ্ধে। তাই তার চরম কৌতূহল বাংলাদেশ ও বরিশাল সম্পর্কে। ট্রেনের সমগ্র কক্ষের সকলের কৌতূহল হলো আমাকে নিয়ে। আমার মা আসানসোলে থাকে। কিন্তু আমি ঢাকায় থাকি কেন। কিভাবে আছি ঢাকায়। ঢাকায় ফিরে নতুন বিপদ আসবে না তো?
সেদিন ট্রেনের কক্ষে এ কথার জবাব দিতে পারিনি। তবে কলকাতায় পৌঁছে মনে হলো যুদ্ধে আমরা জিতেছি সত্য কিন্তু পরিবেশ আমাদের অনুকূলে নয়। পরদিন ভোরে আনন্দবাজার পড়ে মনে হলো কোথায় যেন একটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আনন্দবাজারে বলা হয়েছে, ভারত থেকে আইএএস অফিসার বিআর গুপ্তের নেতৃত্বে ১৩ জন আমলা বাংলাদেশে যাবে। তারা বাংলাদেশের ভেঙে পড়া প্রশাসন গড়ে তুলবে। এ খবর আমি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারলাম না। আমার দুঃখ হলো আমাদের বন্ধুরা বুঝতে পারছেন
যে এ খবরে বাংলাদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। কেউ বুঝতে পারছে না যে আমরা একটি ভিন্ন জাতি। কারো খবরদারি আমাদের পছন্দ নয়। এ জন্যেই আমরা পাঞ্জাবি অর্থাৎ অবাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। আমরা বলেছি আমাদের দেশ আমরাই গড়ব। আমরা অন্যের সাহায্য সহযোগিতা চাই কিন্তু খবরদারি চাই না। খবরদারি চাইলে পাঞ্জাবিদের সাথেই থাকতাম। মনে রাখতে হবে ধর্মের দিক থেকে বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই মুসলমান। স্বাভাবিক কারণেই পাকিস্তানের মুসলমানদের সাথে তাদের সুসম্পর্ক থাকারই কথা। কিন্তু শাসন-শোষণ ও খবরদারির প্রশ্নে বাঙালি মুসলমান অবাঙালি মুসলমানদের মানতে চায়নি। এটাই ছিল ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মূল কারণ। এই যুদ্ধে জয়লাভের পর যদি লক্ষ করা যায় যে আরেকটি দেশ সাহায্যের নামে আমাদের ওপর খবরদারি করছে তাহলে একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
এছাড়া পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভারতের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক ছিল না। এ সময় ভারতের সাথে পাকিস্তানের কাশ্মীর নিয়ে দু’বার যুদ্ধ হয়েছে। ২৩ বছরের এই বৈরী সম্পর্কের ইতিহাস নিশ্চয়ই ন’মাসেই মুছে যায়নি। যারা দেশ চালান এবং দেশ চালাতে সহযোগিতা করেন তাদের এ অপ্রিয় সত্যটি প্রথম থেকেই অনুধাবন করা উচিত ছিল। কিন্তু আনন্দবাজারের খবরে মনে হলো কেউ যেন এই অপ্রিয় সত্যটি মেনে নিতে চাইছে না। বাংলাদেশে ভারতীয় কর্মকর্তাদের উপস্থিতি আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে না তারা যেন তাও মেনে নিতে পারছে না।
দেশ বিভাগের ফলে ভারত ও পাকিস্তানের অসংখ্য পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আমিও তার শিকার ছিলাম। এখন কোটালীপাড়ায় আছি আমরা একটি ভগ্নাংশ মাত্র। আমাদের বিভাগপূর্ব কালের যৌথ পরিবার এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা ভারতে। দেশ বিভাগের এক বছরের মধ্যে আমি গ্রেফতার হয়ে যাই। জেলখানা থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায় ৫ বছর। বাড়ি ফিরে দেখলাম আমার এক কাকা ছাড়া আর সবাই দেশান্তরে। বাড়িতে ফিরলাম কিন্তু মায়ের সাথে দেখা হলো না। মা দেশান্তরী। মায়ের সাথে দেখা হলো ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর। দেশভাগ হওয়ার ২৩ বছর পর বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর।
বড় ভাইয়ের সাথে দেখা হয়নি। তিনি থাকেন মধ্য প্রদেশে। বড় ভাইয়ের সাথে দেখা হলো ১৯৭৮ সালে। ত্রিশ বছর পর। এ ঘটনার উল্লেখ করে আমি বলেছিলাম যারা দেশ বিভাগের শিকার হননি, তাঁরা এ মর্মান্তিক জ্বালা বুঝতে পারবেন না। তাঁরা বুঝতে পারবেন না ছিঁড়ে যাওয়া নাড়ির বন্ধন। বছর তিনেক আগে বড় ভাইকে দেখে এসেছিলাম। ভারতের মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুরে। একটি দেশের রাজনৈতিক বিভাজন একজন মানুষকে কিভাবে শেষ করে দিতে পারে আমার বড় ভাই তার প্রতিকৃতি।
আমার বড় ভাই কল্লোল যুগের শিল্পী। সেকালের প্রখ্যাত হাতে লেখা পত্রিকা ঝরণার সম্পাদক। এ ঝরণা ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রিয় পত্রিকা। বড় ভাইয়ের সমসাময়িক হচ্ছেন-বুদ্ধদেব বসু, প্রতিভা বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রণব রায়, কমল দাশগুপ্ত, গিরীন চক্রবর্তী, অখিল নিয়োগী, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, আমাদের পল্লীকবি জসিমউদদীন, রাধারাণী, নরেন্দ্র দেব প্রমুখ। তিনি ঘনিষ্ঠ ছিলেন দেশ সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সঙ্গে।
কিন্তু সব কিছু শেষ হয়ে যায় দেশ ভাগের সঙ্গে সঙ্গে। জীবিকার সন্ধানে যেতে হয় মধ্যপ্রদেশের কয়লাখনিতে। আত্মীয়-স্বজনহীন পরিবেশে এক মর্মান্তিক জ্বালা অবসর জীবনের। তার সব আছে, কিন্তু কিছু নেই। কথায় কথায় স্মৃতিচারণ। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কাহিনী, নরেন্দ্র দেব ও রাধারানীর বিয়ের কাহিনী, নবনীতার কাছে চিঠি লেখার কাহিনী। তিনি অবসর জীবনটা যেন কাটাতে চাচ্ছেন স্মৃতির অন্তরালে। কোথায় বাংলাদেশে বাড়ি ছিল। কোথায় কোনো গাছ ছিল। কোন সড়কের পাশে বাড়ি ছিল। এটাই যেন জীবনের একমাত্র চর্চা। তার এই স্মৃতির মধ্যে ভারত নেই। আমার বড় ভাই শিশির সেনগুপ্ত বাঁচতে চেয়েছেন বাংলাদেশের স্মৃতি নিয়ে। কিন্তু ১৯৪৮ সালের পর ফিরতে পারেননি উপমহাদেশের এ অংশে।
এবার নিজের কাহিনী নিয়ে লিখছি। এ লেখার একটা পটভূমি আছে। বড় ভাইয়ের কথা উল্লেখ করেছি। জানতাম না, তার সাথে আমার আর দেখা হবে না। দীর্ঘদিন পাকিস্তান সরকার পাসপোর্ট দেয়নি আমাকে। দেশ স্বাধীন হবার পর ভারত সরকার ভিসা দেয়নি সাত বছর। সে পর্যায় কাটিয়ে উঠে সাম্প্রতিককালে মাঝে মাঝে ভারত যেতে পারতাম। তবে সব সময়ই ভয় ছিল কখন সে সুযোগ হারাই। আমার কাছে সর্বশেষ খবর হচ্ছে বড় ভাই মারা গেছেন ২১ সেপ্টেম্বর। খবরটা আমার কাছে বিলম্বে পৌঁছেছে। তখন আমার কিছু করার ছিল না।
এ কথাগুলো একটা বিশেষ কারণে আমি লিখছি। আমাদের দেশে অনেক বিহারী আছে। ওরা এক সময় ভারত থেকে এসেছিল। জীবন জীবিকার সন্ধানে এসেছিল পাকিস্তানে। সে পাকিস্তান নেই। কিন্তু বিহারীরা আছে। ওরা বাংলাদেশে আছে। জেনেভা ক্যাম্পে। ওরা পাকিস্তানে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তান তাদের নিচ্ছে না। ওরা বাংলাদেশে থাকছে কিন্তু ওরা বাংলাদেশের নাগরিক নয়। বাংলাদেশ ওদের রাখতে চাচ্ছে না। পাকিস্তান ওদের নিচ্ছে না। ওরা না ঘাটকা, না ঘরকা। ভারতবর্ষ ভাগের ৬০ বছর চলে গেল। ওদের ঠিকানা ঠিক হলো না। পাকিস্তানের করাচিতেও এমন এক শ্রেণির মোহাজের আছে। প্রতি মুহূর্তে বেঁচে থাকার জন্যে তাদের সংগ্রাম করতে হয়। পৃথিবীতে ওদের কোনো নিজস্ব দেশ নেই। আমার ধারণা আমার ভাইয়েরও নিজস্ব কোনো দেশ ছিল না। ভারত নামক একটি দেশে থাকতেন। পশ্চিমবাংলা থেকে অনেক দূরে। নিজের ভাষায় কথা বলা যেত না। তাই বেঁচে থাকতে চাইতেন স্মৃতিতে। কিন্তু স্মৃতি কখনো ঠিকানা হয় না। স্মৃতি রোমন্থন করা যায়। কিন্তু স্মৃতি ভিত্তি করে বেঁচে থাকা যায় না। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যায়। আমার ভাইও তেমন করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিলেন। বেঁচে ছিলেন না দীর্ঘদিন ধরে। সে প্রেক্ষিতে আমার একটা অনুরোধ আছে। অনুরোধ হচ্ছে, যদি কোনো সময় কেউ ঢাকার মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পের কাছে যান, যদি কেউ সৈয়দপুর বা পার্বতীপুর যান। তখন এ মানুষগুলোর জন্যে একটু ভাববেন। যারা আমাদের ভাষায় কথা বলে না কিন্তু ওদের নিজেদের ভাষায় কথা বলার দেশ ছিল, বসতবাটি ছিল। ঐতিহ্য আর উত্তরাধিকার ছিল। ওরা সব কিছু হারিয়েছে। একটি দেশ রাজনৈতিকভাবে বিভাজনের জন্যে।
মায়ের সাথে দেখা করে কোলকাতায় ফিরে দেখলাম নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তখনো ভারতের মাটিতে। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ঢাকায় পৌঁছেনি। চারদিকে এক অস্বস্তি ও দুশ্চিন্তা। বোঝা যাচ্ছে সবকিছু ঠিক নেই। যুদ্ধের প্রেক্ষিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলেও যুদ্ধ শেষেই সে ঐক্যে ফাটল দেখা দিয়েছে। ভারতের মাটিতে তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী থাকলেও বাংলাদেশের মাটিতে তাকে অনেক সঙ্কট মোকাবেলা করতে হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় না আসায় সমালোচনার ঝড় উঠল। কড়া মন্তব্য করলো কোলকাতার ইংরেজি দৈনিক দি স্টেটসম্যান। যতদূর মনে আছে দেশ স্বাধীন হওয়ার ৯ দিন পর ২৫ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় ফিরে এল।
আমি তখনো কলকাতায়। আগরতলার বন্ধুরা বাংলাদেশে ফিরে গেছে। ফিরে গেছে উত্তরবঙ্গের কমরেডরা। কিন্তু সমস্যার দেখা দিয়েছে পরিচিত নেতাদের নিয়ে। কলকাতায় খবর হচ্ছে, একটি বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে মুজিব বাহিনী সৃষ্টি হয়েছে। এদের প্রথম কাজ হবে রাজাকার ও শান্তিবাহিনীর লোকদের নিঃশেষ করা। আর দ্বিতীয় কাজ হবে বামপন্থীদের নিশ্চিহ্ন করা। তাই অনেকেরই ধারণা সড়ক পথে আমাদের বাংলাদেশ আসা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে নেতাদের সতর্ক হতে হবে। সম্ভব হলে আসতে হবে বিমানে। কিন্তু ইচ্ছে হলেই বিমানের টিকেট পাওয়া সম্ভব নয়। স্বাভাবিক কারণেই তখন বিমানের টিকেট নিয়ে সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। সবশেষে সিদ্ধান্ত হলো আমি সড়ক পথেই যাব। আমার গায়ে হয়তো কেউ হাত দেবে না। অন্যসব নেতাদের ঢাকায় আসতে হবে বিমানে।
কিন্তু কী করবো ঢাকায় গিয়ে? আমরা মুসলিম লীগ নেতাদের চিনতাম। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও চিনি। এদের সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা আছে। নতুন কোনো কিছু করতে না পারলে ৯ মাসের সংগ্রামই অর্থহীন হয়ে যাবে। তাই সিদ্ধান্ত হলো–ঢাকায় ফিরে সংবাদ সম্মেলন করতে হবে। একাত্তরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলকে নিয়ে বিপ্লবী সরকার গঠনের দাবি জানাতে হবে। সুস্পষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে সরকার গঠন করতে হবে। আর আমাদের এ প্রস্তাব গৃহীত না হলে, এ কর্মসূচিতে আন্দোলন করতে হবে।
কলকাতায় রাজনৈতিক বন্ধুদের বললাম–আপনাদেরও সতর্ক হতে হবে। আমরা দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানের উপনিবেশ ছিলাম। আমরা এখন ভারতীয় উপনিবেশ হতে চাই না। আপনাদের দাবি তুলতে হবে-বাংলাদেশ থেকে মাড়োয়ারি ও মহাজন হাত গোটাও। বাংলাদেশে মাড়োয়ারি ও মহাজনদের তাণ্ডব শুরু হলে আর এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কারণ আমরা ৯ মাস কঠিন সংগ্রাম করেছি সত্য। কিন্তু সে সংগ্রামে সমাজ পাল্টায়নি। আমরা বামপন্থীরা সফল হইনি। আর আমাদের সফল হওয়ার কথা ছিল না। তাই সে পুরনো সমাজটাকে নিয়েই নতুন সংগ্রাম শুরু করতে হবে।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আমি সড়ক পথে কলকাতা ছেড়ে এলাম। আসার আগে আত্মীয়-স্বজন কারো সাথে তেমন দেখা হয়নি। মন আদৌ ভালো ছিল না। বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে কোনো কিছু ভাবতে পারছিলাম না। কলকাতার বন্ধুরা সকলেই খুশি। সবার ধারণা আমারও খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমি খুশি হতে পারিনি। অনেকেই আমার সাথে সীমান্ত পর্যন্ত এলো। আমি সীমান্তে পৌঁছে বাসে করে খুলনা পৌঁছলাম। তারপর স্টিমার। ওই স্টিমারেই দেড় দিন বসে ঢাকা। স্টিমারে অসংখ্য মানুষ। প্রায় সবাই ভারত থেকে ফিরছে। তাদের অনেকের মুখেই হাসি। কিন্তু কারো সাথে আমার কথা জমল না। এমনি করে ঢাকায় পৌঁছলাম।
কলকাতায় ২৩ বছর পর বড় বোনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল জুন মাসে। তিনি প্রথম আমাকে চিনতে পারেননি। মাত্র কিছুদিন আগে তাঁর মেঝ ছেলের বিয়ে হয়েছে বরিশালের গৌরনদী থানার মাহিলারা গ্রামে। বিয়ের পরপরই শুরু হয়েছে ৭১-এর সংগ্রাম। দিদির দাবি হচ্ছে তুমি যখন বাংলাদেশেই ফিরছ তখন এই পরিবারের খবর নিয়ে আসতে হবে। আমি মনে মনে হাসছিলাম। ১৯৭১ সালের জুন মাস। আমাকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করতে হবে। অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। আবার সকলের খবরও নিতে হবে।
নিজের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া। এপ্রিল মাসে বাড়ি ছেড়েছি। বাড়িতে যারা আছেন তারা প্রায় সবাই বৃদ্ধ। দুই ভাই, তাদের স্ত্রী, এককালের খুব বড় বাড়ি। কিন্তু একালের ছোট সংসার। এপ্রিলের বাড়ি ছাড়ার সময় বলে এসেছিলাম কেউ দেশ ছেড়ে যাবেন না। তারপর তিন মাস কেটে গেছে। সঠিক কোনো খবর জানি না। বিদেশি খবরে শুনেছি এলাকাটি তখনো মোটামুটি নিরাপদ। স্থানীয়ভাবে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছে।
তবু মনে হলো বাড়ির একটা খোঁজ নেয়া দরকার। শহিদুল্লাহকে বললাম, তুমি মাহিলারা হয়ে কোটালীপাড়া চলে যাবে। যে কোনো উপায় থোক বাড়ির খবর নিয়ে ঢাকায় পৌঁছবে। শহিদুল্লাহর কোনো ব্যাপারে আপত্তি ছিল না। শহিদুল্লাহ ঢাকা থেকে বরিশাল চলে গেল। শহিদুল্লাহর ফিরতে সপ্তাহখানেক হয়ে গেল। তার খবর হচ্ছে ঘাঘর বন্দর পুড়ে গেছে। আমাদের বাড়িতে তেমন ক্ষতি হয়নি। এক কাকা এবং এক ভাই ভারতে চলে গেছে এবং অন্য সকলে এখনো নিরাপদ আছে। কিন্তু শহিদুল্লাহ কিছুতেই মাহিলারা ঢুকতে পারেনি। বরিশাল থেকে বাটাজোড়, মাহিলারা, গৌরনদী হয়ে মাদারীপুর পর্যন্ত পাকা সড়ক। এ সড়কে সারাদিন সামরিক বাহিনীর গাড়ি চলাচল করছে। শহিদুল্লাহ মাহিলারা গিয়েছিল। কিন্তু কোনো হিন্দু বাড়ির খবর জিজ্ঞেস করার সাহস তার হয়নি। তার ধারণা সকলেই বাড়ি ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।
এবার শহিদুল্লাহর ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাবার পালা। কুমিল্লা বাগিচা গাঁওয়ে অতীন রায়ের বাড়ি। আগেই লিখেছি অগ্নিযুগের বিপ্লবী অতীন রায় দু’বার কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ২৬ মার্চ তাঁর একমাত্র পুত্র অসীমকে পাকিস্তান বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। অতীন দা আগরতলা চলে গেছেন। বাড়িতে একমাত্র পুত্রবধু অজন্তা। অজন্তাকে পাহারা দিচ্ছে পাকিস্তান বাহিনী। কখনো কখনো পাশের এক অ্যাডভোকেটের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। ঢাকায় শুনেছি অজন্তা নাকি তার স্বামীর উদ্ধারের জন্যে কুমিল্লা আদালতে মামলা দায়ের করেছে। শুনে আমি অবাক হয়েছি। তবুও ভেবেছি যে কোনো উপায়ে হোক অজন্তাকে আগরতলা নিয়ে যেতে হবে এবং এ জন্যে শহিদুল্লাহকে কুমিল্লা পাঠালাম।
শহিদুল্লাহ ভোরের দিক কুমিল্লা রওনা হয়ে গেলো। অনেক রাতে ফিরে এল হাঁপাতে হাঁপাতে। বললো, স্যার বড় বিপদ। নিজেই ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে কুমিল্লায় বাসে নামলে শহিদুল্লাহসহ আরো কয়েকজন যাত্রীকে সামরিক বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। প্রায় বিকেল পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের হাঁটু এবং কনুই পরীক্ষা করে দেখে ক্রলিং-এর কোনো দাগ আছে কিনা। শহিদুল্লাহ বেঁচে যায় কারণ পকেটে একটি আইডেনটিকার্ড ছিল। ওই কার্ডে লেখা ছিল সে একটি ইলেট্রিক দোকানের ম্যানেজার। শহিদুল্লাহর বক্তব্য ছিল তার দোকানের কর্মচারীরা গ্রামে পালিয়ে গেছে। সে তাদের ফিরিয়ে নেবার জন্যে গ্রামে যাচ্ছিল। কথায় কথায় জোহরের নামাজের সময় হয়ে যায়। শহিদুল্লাহ কৌশল করে নামাজ পড়বার জন্যে সেনাবাহিনীর কাছে একটি টুপি চায়। এতে সেনাবাহিনীর বিশ্বাস জন্মে যে শহিদুল্লাহ মুক্তিবাহিনীর লোক নয়। নামাজ পড়ার পরপরই অন্য সবাইকে রেখে সেনাবাহিনী শহিদুল্লাহকে ছেড়ে দেয়। তাকে একটি টুপি উপহার দেয়। শহিদুল্লাহ ঢাকায় ফিরে এসে বলে এখন আর ঢাকায় এভাবে থাকা নিরাপদ নয়। যে কোনো উপায়ে হোক আমাদের সীমান্ত পাড়ি দিতে হবে।
কিন্তু কোন পথে যাবো। ঠিক করলাম ১৪ আগস্ট ঢাকা ছেড়ে যাবো।১৪ আগস্ট পাকিস্তান দিবস। সকলে নানা অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকবে। ওই দিন তেমন কেউ খেয়াল করবে না। ১৪ আগস্ট আমি আর শফি নোয়াখালীর রায়পুরের লঞ্চে উঠলাম। আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে ঢাকা থেকে রায়পুর, রায়পুর থেকে লক্ষ্মীপুর, লক্ষ্মীপুর থেকে চৌমুহনী হয়ে আমাদের অন্যতম নেতা রুহুল আমিন কায়সারের বাড়ি যাব। তার বাড়ি বেগমগঞ্জ থানার হোসেনপুর। ওখানে আমাদের ছাত্র সংগঠন সমাজবাদী ছাত্র জোটের কিছু সদস্য আছে। তাদের নিয়ে আমি আগরতলা চলে যাব। শফি আমাকে হোসেনপুরে পৌঁছে দিয়ে ঢাকা চলে গেল। শফি হোটেল পূর্বাণীতে কাজ করে আমাদের দলের উদ্দেশ্যে।
কিন্তু আমাদের হোসেনপুর পৌঁছা খুব সহজ হলো না। ঢাকা থেকে লঞ্চে অসম্ভব ভিড়। রায়পুরের নদীতে দেখলাম অসংখ্য লাশ ভাসছে। রায়পুর নেমে দেখলাম সকলই যেন পাকিস্তানি। প্রায় সকলের বুকে লাগানো পাকিস্তানি পতাকা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাহারা দিচ্ছে। মনে হলো সবাই মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্র। তারা সকলের পরিচয় জিজ্ঞেস করছে। আমি সামনে হাঁটছি। আমার পেছনে শহিদুল্লাহ। তার হাতে একটি কালো ব্যাগ। পথে একটি মাদ্রাসার ছাত্র আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করল। আমার দাড়ি এবং লুঙ্গি আমাকে বাঁচিয়ে দিল। প্রায় চারদিক থেকে প্রশ্ন উঠল এই হুজুরকে নিয়ে হইচই কেন হচ্ছে।
আমরা রায়পুর থেকে লক্ষ্মীপুর এলাম। লক্ষ্মীপুর থেকে বাসে চৌমুহনী যেতে হবে। আমাদের বাসের যাত্রী প্রায় সকলেই রাজাকার। শফি বলল, দাদা, আপনি আদৌ কথা বলবেন না। আপনার কথায় পশ্চিমবঙ্গের টান আছে। আপনি কথা বললে বিপদে পড়ে যাবেন। আমি চুপচাপ থাকলাম। চৌমুহনী পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল।
এবার আমরা কোথায় যাব। আমরা হোসেনপুর চিনি না। সন্ধ্যা থেকে নাকি চৌমুহনীতে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়।
একজন যাত্রী বলল, আপনারা মসজিদে গিয়ে রাতটা কাটান। ভোরবেলা চলে যাবেন। আমি বললাম, প্রস্তাবটি ভালো। কিন্তু ভোরে ফজরের নামাজের সময় যখন আমি নামাজ পড়ব না তখন সবকিছু ফাঁস হয়ে যাবে। তাই চলো আমরা ভিন্ন পথ ধরি।
কিছু দূর যেতেই আর এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। তার চোখেমুখে সন্দেহ। বললো, নিশ্চয়ই আপনারা ভিনদেশী। বলল, আপনাদের কোনো অসুবিধা নেই। সোজা এগিয়ে গেলে মাঝে একটু পানি বাধবে। ওই পানি পার হলেই একটা বাড়ি আছে। ওই বাড়িতে আপনারা আশ্রয় পাবেন। আমরা সরল বিশ্বাসে ওই ভদ্রলোকের কথা শুনে সামনে এগোলাম। কিছুদূর যেতেই পেছন থেকে এক ভভদ্রলোক চিৎকার করতে করতে এলেন। তিনি বললেন, কোথায় যাচ্ছেন? ওটা তো রাজাকারের বাড়ি। ওখানে আপনাদের নিয়ে শেষ করে ফেলবে। আমি নাটেশ্বর যাচ্ছি। পানি ঝাঁপিয়ে আমার সঙ্গে যেতে হবে। নাটেশ্বর গিয়ে নৌকা পেলে আপনাদের হোসেনপুর পাঠিয়ে দেব।
সেদিন সন্ধ্যায় কেন যে ওই ভভদ্রলোককে বিশ্বাস করেছিলাম তা আজ আর মনে নেই। আমি আর শফি তার সঙ্গে পানি ঝাঁপিয়ে নাটেশ্বর পৌঁছলাম। নাটেশ্বরে নৌকা পেলাম। হোসেনপুরে পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গেল।
কিন্তু এবার কী করে সীমান্ত পাড়ি দেব। এবার নতুন সঙ্গী নিতে হবে। হোসেনপুর থেকে যেতে হবে গুণবতীর কাছে সাতবাড়িয়া আটগাঁও। ওখানে থাকতে হবে। খোঁজ নিতে হবে গুণবতী রেলস্টেশনের কাছাকাছি পাকিস্তান বাহিনী আছে কিনা।
দীর্ঘদিন পরের কথা। আজ অনেক কিছু মনে নেই। এক তরুণের কথা মনে আছে। নাম রুহুল আমিন। ডাক নাম পচা। পচা নোয়াখালীর ভাষায় বড্ড তাড়াতাড়ি কথা বলে। বারবার বলে, দিন রাত তার পার্টি আসছে। সকল পার্টিকে পার করতে হবে। সকল পার্টিই ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসছে। যতদূর মনে আছে সীমান্তে যাবার কালে উঠেছিলাম বনি আমিনদের বাড়ি। পরে আর কোনোদিন তার খোঁজ নিইনি। শুনেছি পচা যুদ্ধে মারা গেছে।
তবে আমার যাওয়া তেমন সহজ ছিল না। আমার সঙ্গে যাবে রুহুল আমিন কায়সারের বড় ভাইয়ের ছেলে স্বপন। বর্তমানে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোসাদ্দেক হোসেন স্বপন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কিন্তু সমগ্র বাড়ি অপ্রসন্ন। কেউ চাচ্ছে না স্বপন আমার সঙ্গে যাক। আর কেউই জানত না যে আমি ওই বাড়িতে গিয়ে আগস্ট মাসে হাজির হতে পারি। কিন্তু সে আমার সঙ্গেই যাবে। আমরা প্রথমবার সীমান্তে গিয়ে ফিরে এলাম। সীমান্তে পাকবাহিনী মোতায়েন। স্বপনদের বাড়ির লোক খুশি। তাদের ধারণা আমাদের বুঝি যাওয়া হচ্ছে না। আমাদের যেতেই হবে। তবে দ্বিতীয় দিন গিয়েও আটকে গেলাম। সাতবাড়িয়ায় একটি ঘরে অপেক্ষা করলাম। কারণ পথ পরিষ্কার নয়। সিদ্ধান্ত হলো দূর গ্রামের নিরাপদ এলাকায় ঘুরতে যাব। গ্রামের নাম ডুমুরিয়া। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ডৌবা। বিকেলের দিকে সে গ্রামে দেখি অবাক কাণ্ড। একদল তরুণকে বিদায় সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছে। ওরা মুক্তিবাহিনীতে যাবে। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্যে দলের পর দল তরুণ আসছে। সকলে নির্বাচিত হচ্ছে না। যারা নির্বাচিত হচ্ছে তাদের মুখে হাসি। যারা সুযোগ পাচ্ছে না তারা কাঁদছে। জানি
কেন দেশের কোনো বিপ্লবে এ এমন ঘটনা ঘটছে কিনা। আমি সেই পড়ন্ত বেলায় তাকিয়ে তাকিয়ে সেই হাসি আর কান্না দেখলাম। ওরা কেউ আমাকে চিনত না–আজো কেউ চিনবে না। অথচ আমি সেই দৃশ্যের এক সাক্ষী আজো বেঁচে।
পরদিন বিকেলে খবর এল পথ পরিষ্কার। কিন্তু নিজেদের উদ্যোগেই যেতে হবে। গুণবতী স্টেশনের দক্ষিণে রেললাইন পার হতে হবে। ওই রেললাইনে সন্ধ্যাবেলায় সান্ধ্য আইন জারি। এবার আমরা রওনা হলাম চারজন। আমি, স্বপন এবং কুমিল্লার লালমাইয়ের কাছে মগবাড়ির দু’ভদ্রলোক।
আমরা কিছুদূর যেতেই পিছন থেকে এক বুড়ি ছুটতে ছুটতে এলেন। পরনে সাদী থান। বললেন, বাবা রেললাইনে পাক সেনাবাহিনী। ও পথে যাবে না। আমার সঙ্গে আমাদের বাড়ি চলো।
বুড়ি তার বাড়িতে আমাদের বসিয়ে চলে গেলেন। দশ মিনিট পর ফিরে এলেন। দেখলাম দূর রেল লাইনে একদল ১০/১২ বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা পাহারা দিচ্ছে। দেখছে পাকবাহিনী আসছে কিনা। এই কিশোরদের পাহারার মধ্যে দিয়ে আমরা রেল লাইন পার হলাম। বুড়ি বললেন, বাবা জানি না তোমরা কার পুত্র। দিনমানে এ পথে আর লোক পাঠাবে না। বুড়ির সে কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজছে।
কিন্তু বিপদ শেষ হলো না। আমরা কোনো পথ চিনি না। কারো কাছে জিজ্ঞেস করাও বিপজ্জনক। শুনেছি চৌদ্দগ্রামের কাছে সীমান্ত পাড়ি দিতে হবে। ওপারে ভৈরব টিলায় রাতে আশ্রয় মিলতে পারে।
বিপদে পড়ে গেলাম, চৌদ্দগ্রামের কাছে গিয়ে। কাছে একটি স্কুল। ওই স্কুলের পাশে সড়ক। ওই সড়ক দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে উঠতে হবে। তারপর একটি ছোট খাল। ঘোট খাল পার হয়ে কাদামাটির জমি। তারপর ভারতীয় সীমানা।
স্কুলের পাশে যেতেই একদল লোক বলে উঠল উত্তরে দেওয়ান বাড়ি যান। আশ্রয় পাবেন। আমরা দেওয়ানবাড়ির দিকে মোড় নিতেই আর একজন বলে উঠল সাবধান ওদিকে যাবেন না। ওটা রাজাকারদের বাড়ি। ইতোমধ্যে সামনে একটা রিকশা এসে দাঁড়াল। রিকশাওয়ালা বলল, তাড়াতাড়ি সড়কে উঠে খাল পার হয়ে ওপারে যান। দূরে আর্মি দেখা যাচ্ছে।
তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বৃষ্টি পড়ছে। ওই বৃষ্টির মধ্যে কাদামাটিতে ছুটতে ছুটতে এক সময় ভৈরব টিলায় পৌঁছলাম। ভয় কমল। কিন্তু স্বস্তি পেলাম না। আবার বাংলাদেশ ছেড়ে ভারত। ইতিহাসে এর দৃষ্টান্তের অভাব নেই। বাংলাদেশে তো নেইই।
ভৈরব টিলায় নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। আমরা চারজন–আমি, স্বপন ও কুমিল্লার দু’জন সঙ্গী। তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ভৈরব টিলায় নতুন কিছু চালাঘর দেখলাম। ওই চালাঘর তৈরি করেছে বাংলাদেশের শরণার্থীরা। তারা আমাদের রাতে খেতে এবং থাকতে দিতে রাজি হলো। তবে পয়সা দিতে হবে। বাংলাদেশে এ অভিজ্ঞতা ছিল না। পয়সা দিয়ে রাতে খেলাম এবং ভৈরব টিলায় থাকলাম। টিলার অধিবাসীরা জানাল ভোরের দিকে আমাদের টিলা থেকে নেমে একিনপুর যেতে হবে। একিনপুর গেলে আগরতলা যাবার পথ যাওয়া যাবে।
ভোরে একিনপুর গিয়ে আটকে গেলাম। ভারতের সীমান্ত বাহিনী আমাদের তাদের ক্যাম্পে নিয়ে গেল। আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো। তাদের প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কোন রাজনৈতিক দল করি। আমাদের জিজ্ঞেস করা হলো, আমরা আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি বা ন্যাপ করি কিনা। তাদের প্রশ্নে মনে হলো, এই তিনটি দলই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। আমি আমার রাজনীতি ও সাংবাদিকতার পরিচয় দিলাম। কিন্তু খুব একটা কাজ হলো না। শুনলাম তারা কর্নেল ভট্টাচার্য নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলো আমি বাংলাদেশের কোনো নেতাকে চিনি কিনা। আমি বললাম, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে বামপন্থী নেতা কমরেড মনি সিং এবং তোয়হাসহ সকলকেই আমি চিনি। কিছুক্ষণ পর আমাদের ছেড়ে দেয়া হলো। কিন্তু আমাদের সঙ্গীদের ওখানেই আটকে রাখা হলো।
এবার একিনপুর থেকে চোত্তাখোলার পথে রওনা হলাম। চোত্তাখোলায় আওয়ামী লীগ নেতা খাজা আহম্মদ আছেন। ভাবলাম তাঁর কাছে থেকে একটি পরিচয় নিতে পারলে আর বিপদে পড়ব না। সেদিন আকাশে ছিল মেঘ রৌদ্রের খেলা। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। আবার রোদ উঠছে। পাহাড়ি পথ। কখনো নামছে আবার কখনো উঠছে। চোত্তাখোলায় পৌঁছে খাজা আহম্মদের দেখা পেলাম। তিনি আমাদের পরিচয়পত্র দিলেন। এবার আমরা রাজনগরের দিকে রওনা হলাম। রাজনগরে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প আছে। রাজনগর পৌঁছাবার আগে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা আমাদের আটক করল। খাজা আহম্মদের পরিচিতি পত্র গ্রাহ্যই করল না।
আমার ভয় হলো স্বপনকে নিয়ে। শুনেছি এখন ত্রিপুরায় পাকিস্তানি এজেন্ট গ্রেফতার করা হচ্ছে। আমি ভাবলাম শত হলেও আমার বাংলায় নাম। আমি কোনোমতে এড়িয়ে যেতে পারব। কিন্তু স্বপনের প্রকৃত নাম মোসাদ্দেক। এই আরবি নামটি জানতে পারলে স্বপনকে যে পাকিস্তানি এজেন্ট হিসেবে ধরা হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। স্বপনকে নোয়াখালীর বাড়ি থেকে যখন নিয়ে আসি তখন সে বাড়ির কেউই আমার প্রস্তাবে রাজি ছিল না। এখন স্বপনের কিছু হলে আমি তাদের কী জবাব দেবো। তাই ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর লোকদের আমি শুধু হাত পা ধরতে বাকি রেখেছিলাম। আমার লক্ষ্য ছিল যেকোনো মূল্যে স্বপনকে বাঁচাতে হবে। কিছুক্ষণ পর আমাদের ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ক্যাম্পের এলাকায় নিয়ে যাওয়া হলো। আমাদের মাঠের মাঝখানে দাঁড় করানো হলো। চারদিকে ঘিরে থাকল সামরিক বাহিনীর লোক। এ পরিবেশেও ভারতীয় বাহিনীর একজন জোয়ান অদ্ভুত একটা কথা বলল। তার কথা হচ্ছে ইধার তো হিন্দু-মুসলমান ফারাক নেহি হায়। তাহলে তোমাকে আটক করল কেন? আমার তখন পরনে লুঙ্গি, গায়ে হাওয়াই শার্ট এবং মুখভর্তি দাড়ি। ঘন্টাখানেক পর একজন ক্যাপ্টেন ছুটতে ছুটতে এল। সে বলল, আমরা খুবই দুঃখিত। তুমি বাংলাদেশে খুবই পরিচিত একজন ব্যক্তি। তোমরা চলে যেতে পার।
এবার কিছুদূরে এগোতেই মুক্তিবাহিনীর কিছু ছেলের সঙ্গে দেখা হলো। তারা আমাকে চিনত। তারা বললো আপনাকে আটক করা হয়েছে শুনে আমরা এসেছি। তারা ক্যাপ্টেনকে ডেকে বলল, কোনোদিন ঢাকা গেলে নির্মল সেনের সঙ্গে দেখা করতে আপনাদের অনুমতি লাগবে। আপনারা কাকে ধরেছেন? কিন্তু এরপরও বিপদ কাটল না। সন্ধ্যার দিকে শান্তিবাজারে পৌঁছলাম। পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। আমাদের পরিচয়পত্র কোনো কাজে এলো না। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাদের ছেড়ে দেয়া হলো। আমি থানার দারোগাকে বললাম, একটি সার্টিফিকেট লিখে দিন। কারণ সারাদিন এই হেনস্তা আদৌ ভালো লাগছে না। দারোগা রাজি না।
থানা থেকে ছাড়া পেলাম। কিন্তু কোথায় যাব? এ অবস্থায় আগরতলা যাওয়া যাবে না। ভাবলাম উদয়পুর যাব। উদয়পুরে ধীরেন দত্ত আছেন। পঞ্চাশের দশকে আমাদের সঙ্গে ঢাকা জেলে ছিলেন। শুনেছি উদয়পুরে তিনি একটি স্কুল দিয়েছেন পিতার নামে। ধীরেন বাবু ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই-এর লোক। তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং ভালো লোক হিসেবে পরিচিত। এই ভেবে উদয়পুরের বাসস্ট্যান্ডে গেলাম। দেখলাম একটি ট্যাক্সি উদয়পুর যাচ্ছে। ড্রাইভার আমাদের অসুবিধা বুঝল। বলল, ধীরেন বাবুকে আমরা চিনি। তাঁর বাসায় আপনাদের আমি পৌঁছে দিতে পারব। কিন্তু তাতেও বিপদ কাটল না। কিছুদূর যেতেই সামরিক বাহিনীর লোক ট্যাক্সি থামাল। বললো ট্যাক্সিতে বাংলাদেশের কেউ থাকলে তাদের নামতে হবে। আমি বললাম, আমি বাংলাদেশের লোক কিন্তু নামব না। যা খুশি করতে পারেন। এবার ড্রাইভার নিজেই নেমে গেল। গিয়ে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কথা বলল। আমাদের আর গাড়ি থেকে নামতে হলো না। গভীর রাতে উদয়পুর গিয়ে পৌঁছালাম। আমাদের দেখে ধীরেন বাবু অবাক হয়ে গেলেন। তার সঙ্গে শেষ দেখা ১৯৫২ সালে ঢাকা জেলে। তারপর দেখা হলো ১৯ বছর পর ১৯৭১ সালে। রাতে ওই বাসায়ই থাকলাম। উদয়পুরে আরএসপির সংগঠন আছে। সকালবেলা ধীরেন বাবু আরএসপির বন্ধুদের খবর দিলেন। এবার বাসা পরিবর্তন করতে হলো। আমরা আরএসপির তল্কালীন শিক্ষক নেতা মোহিত ধরের বাসায় উঠলাম। তখন চারদিকে বৃষ্টি আর বৃষ্টি। এদিকে পথের ক্লান্তিতে স্বপন অসুস্থ হয়ে গেছে। তার জ্বর হয়ে গেল। হাতের তালু ফুলে গেল। শেষ পর্যন্ত তার হাত অপারেশন করতে হলো! তাই বেশ কিছুদিন থাকতে হলো উদয়পুরে। আর বন্ধুদের কথা হচ্ছে আপনাদের আর একা একা পথে ছেড়ে দেয়া যাবে না। কাউকে সঙ্গে করে আগরতলা যেতে হবে। নইলে আবার বিপদে পড়তে পারেন। তাই আগরতলা পৌঁছতে পৌঁছতে আগস্ট মাস কেটে গেল। আর আগরতলা পৌঁছে দেখলাম পুরো পরিস্থিতি পালটে গেছে। সর্বত্রই যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি।
আগরতলা পৌঁছে বাড়ির খবর পেলাম। শুনলাম রাজাকাররা বৃদ্ধ কাকা ও তার ছেলেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা হচ্ছে যে ছেলেটি কাকাকে ধরেছিল তার জন্ম হয়েছিল কাকারই হাতে। আমার কাকা এবং কাকার ছেলে দুজনেই ডাক্তার। তবে দেশি রাজাকাররা খারাপ ব্যবহার করলেও ভালো ব্যবহার করেছিল বালুচ বাহিনীর লোকেরা। ডাক্তার বলে তাড়াতাড়ি তারা দুজনকেই ছেড়ে দিয়েছিল।
ইতিমধ্যে কোলকাতা থেকে চিঠি লিখেছে কাকার ছোট ছেলে। সে তার স্ত্রীকে নিয়ে ভারতে পৌঁছে জানতে চেয়েছে যুদ্ধের খরব। আমি তাকে জবাব দিয়েছিলাম এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। আর কেউ না গেলেও ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসে আমি ঢাকায় থাকবই। ভয় নেই।
.
আমার জবানবন্দি আমার জীবনী নয়। তবুও কখনো কখনো জবানবন্দিতে আমার জীবনের ছাপ পড়ছে। তবে তাও সাজানো গোছানো নয়। অনেক ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা থাকছে না। আমার কথা হচ্ছে–জবানবন্দি যেহেতু জীবনী নয়, তাই সর্বক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা থাকবে না।
আমার জবানবন্দির প্রথম পর্ব ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সে পর্বে অনেক কথা বলা হয়ে গেছে। তবে দ্বিতীয় পর্বে সে পর্বেরও কিছু উল্লেখ থাকবে। হয়তো পুনরাবৃত্তি হবে। এ ব্যাপারে আমি নিরূপায়।
প্রথম পর্বের শেষ দিকে আমি কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছিলাম। সেই ঘটনায় মধ্যে আছে ভারত থেকে আমাদের বাংলাদেশে ফেরার কথা। এখানে আমাদের অর্থ হচ্ছে আওয়ামী লীগ গোষ্ঠীর বাইরে রাজনীতিকদের কথা। ১৯৭১ সালের সংগ্রামে অনেক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছিল। তবে ভারতে তিনটি দলই সরকারিভাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এই তিনটি দল হচ্ছে–আওয়ামী লীগ, মোজাফফর ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টি। মওলানা ভাসানী স্বাধীন বাংলা সরকারের উপদেষ্টা মনোনীত হন। কিন্তু আমাদের প্রতি ভারত সরকার বা স্বাধীন বাংলা সরকারের তেমন সুনজর ছিল না। আমাদের দলের ছেলেরাই বাংলাদেশ সীমান্তে নদীয়া জেলার গেদেতে প্রথম ভারতের মাটিতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। এই শিবির পরিদর্শনে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন এসেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের শিবির স্বাধীন বাংলার সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ আমাদের অপরাধ ছিল আমরা শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের সদস্য। আর ঐ শিবিরটি পরিচালনা করেছেন ভারতে আমাদের বন্ধুপ্রতিম দল বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল অর্থাৎ আরএসপি। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্ট করে ঐ শিবিরটি আমাদের চালু রাখতে হয়েছিল।
একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতে মুজিববাহিনী গঠিত হয়। শোনা গিয়েছিল মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলা সরকারের কোনো অনুমতি
নিয়ে। মুজিববাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতারা। আরো শোনা গিয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন করা ছাড়াও মুজিব বাহিনীর আরো কিছু দায়িত্ব ছিল। সে দায়িত্ব হলো বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর রাজাকার, আলবদর, আল শামস, এবং শান্তি কমিটির সদস্যদের খতম করা। আর একই সঙ্গে বামপন্থীদের নিশ্চিহ্ন করা। এ খবর একটি আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল বামপন্থী মহলে। আমি আগরতলা থাকাকালে এক নেতৃস্থানীয় আমলা আমাকে বলেছিলেন, আপনি ভারতের পূর্বাঞ্চলে থাকবেন না। এটা উপদ্রুত এলাকা। আপনার রাজনীতি ভারত সরকারের পছন্দ নয়। গ্রেফতার এড়াতে হলে কোলকাতায় চলে যান।
একথা যে কতটা সত্য তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম আগস্টে দ্বিতীয়বার ভারতে ঢুকবার কালে। আমি এপ্রিলের শেষ দিকে প্রথমে বাংলাদেশ থেকে ভারত যাই। অর্থ ও মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের জন্যে জুলাইয়ের প্রথম দিকে বাংলাদেশে আসি। আগস্টের শেষের দিকে আবার ভারতে যাই। তখন ভারতে যাবার সব পথ বন্ধ। ঢাকা থেকে লঞ্চে রায়পুর। রায়পুর থেকে লক্ষ্মীপুর। তারপর বেগমগঞ্জ। বেগমগঞ্জ থেকে গুণবতী হয়ে চৌদ্দগ্রাম দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি। কিন্তু বিপাকে পড়ে যাই ত্রিপুরা সীমান্তে গিয়ে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ আমাকে আটক করে এবং থানায় নিয়ে জেরা করতে শুরু করে। থানায় প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে-’আপনি আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, বা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য কিনা। আমার পূর্বের লেখায় এ প্রসঙ্গে আমি অবতারণা করেছি। অনেক জবাবদিহির পর যে আমাকে উদয়পুরে পৌঁছাতে হয়েছে, তাও লিখেছি।
আমার নিজের জীবনের এ অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে মুজিব বাহিনী গঠনের খবর আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল বামপন্থী মহলে। তাই বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রশ্ন উঠেছিল দেশে ফিরব কোন পথে। সড়ক পথে। সড়ক পথে আদৌ ফেরা নিরাপদ কিনা। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়েছিল আমি একা সড়ক পথে বাংলাদেশে ফিরব। আমার কোলকাতার বন্ধুরা আমাকে প্রায় যশোর পৌঁছে দিয়ে গেল। আর যশোর পৌঁছেই একটি পোস্টার আমার চোখে পড়ল। পোস্টারটি মোজাফফর ন্যাপের। পোস্টারে লেখা তিনটি শ্লোগান-গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র। স্লোগান তিনটি দেখে আমি চমকে গেলাম। অথচ স্বাভাবিক নিয়মে এই তিনটি শ্লোগানে আমার আপত্তি থাকার কথা নয়। যদিও ৭১-এর সংগ্রামে এই তিনটি স্লোগান লক্ষ্য ছিল বলে সুনির্দিষ্টভাবে কখনো বলা হয়নি। সে সংগ্রামের লক্ষ্য গণতন্ত্র ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্মনিরপেক্ষতা গণতন্ত্রের অঙ্গ তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার ধারণা, গণতান্ত্রিক সমাজ কায়েম হলে ঘোষণা দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলতে হয় না। তবে এই ধর্ম নিয়ে এই উপমহাদেশে সমস্যা থাকায় ধর্মনিরপেক্ষতা একটি বিতর্কিত শব্দ। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত উপমহাদেশে অনেক রক্তপাত হয়েছে। তাই এ শব্দটি একান্তভাবে স্পর্শকাতার। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেও ভারতে ধর্মভিত্তিক দাঙ্গা কমানো যায়নি। পাকিস্তানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা বলে গালাগালি দেয়া হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতা নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। তাই আমার মনে হয়েছিল এ স্লোগানটি বাংলাদেশে নতুন সমস্যার সৃষ্টি করবে না তো?
আমাদের ৯ মাসের সংগ্রাম সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছায়নি। এ সংগ্রাম নিয়ে বিতর্ক ছিল না তাও বলা যাবে না। এটাও সত্য, একটি গোষ্ঠী এ শ্লোগান নিয়ে আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। ধর্মের নামে লুটতরাজ, রাহাজানি করেছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং আমলাদের একটা বড় অংশ জড়িত ছিল। এক শ্রেণির রাজনীতিক আদর্শের নামে এ সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল। ন’মাসের সংগ্রামে তারা নিশ্চিহ্ন হয়নি। মুছে যায়নি তাদের ধ্যান ধারণা। তাই আমার ধারণা পরবর্তীতে এ স্লোগানটি নতুন বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে। আমার মতে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশ সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয়।
ন্যাপের পোস্টারে সমাজতন্ত্র শব্দটিও আমাকে বিভ্রান্ত করেছিল। আমরা জাতিগতভাবে ১৯৭১ সালের সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। তেমন রাজনৈতিক প্রস্তুতিও ছিল না। সংগ্রামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের কথাও কোনোদিন জোরে সোরে উচ্চারণ করেনি। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে এ সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে, এ কথাও উচ্চারিত হয়নি ৭১-এর সংগ্রাম চলাকালে। আর আমার বিশ্বাস পোস্টারে লিখে দিলেই কোনো শ্লোগান অর্থবহ নয়। তাতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। কোন আদর্শে বিশ্বাস না করে সে আদর্শ বাস্তবায়নের কথা বললে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। অথবা আদর্শ পরিণত হয় নিছক ভাওতাবাজিতে। আমার রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে এটা স্পষ্ট ছিল, আওয়ামী লীগ কোনো শ্রেণি-সংগ্রামে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল নয় এবং তাদের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক সমাজ কায়েম করার কথাও স্বাভাবিক নয়। তবে নিঃসন্দেহে দল হিসেবে ন্যাপের এ স্লোগান দেবার অধিকার আছে। তবুও আমার কাছে বাস্তবসম্মত মনে হয়নি। আমার ভয় ছিল ঘর পোড়া গরুর সিদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাবার কথা।
সন্ধ্যার দিকে খুলনা পৌঁছলাম। বাসেই ক’জন শ্রমিক আমার হাতে কিছু কাগজ গুঁজে কাগজগুলো খুলনার ড. কাহার সাহেবের কাছে পৌঁছে দিতে বলে। সে কাগজেও সমাজ বদলের আহ্বান। কোনোমতে কাগজগুলো আগে পড়ে মার ঘাটের দিকে ছুটলাম। লক্ষ্য করেছিলাম কাহার সাহেব লোকটি ভীতু এবং সন্ত্রস্ত। মনে হচ্ছিল সে যেন কোনো একটি নিষিদ্ধ কাজ করছে। আমার খটকা লেগেছিল। তা হলে কি বাংলাদেশ স্বাধীন হবার শুরুতেই আবার আত্মগোপন করতে হবে নাকি।
স্টিমারে অসম্ভব ভিড়। ভারত থেকে মানুষ ফিরছে দেশে। অসংখ্য বরিশালের যাত্রী। পরে জানলাম ভাড়া দিতে হবে না। পৌঁছাতে ৩৬ ঘণ্টা লেগে গেল। কিন্তু কোথায়। যুদ্ধের পূর্বে সেগুনবাগিচা মরহুম কাজী মোতাহার হোসেন সাহেবের বাড়িতে ছিলাম। যুদ্ধের সময় একবার সেখানে এসে ফিরে গেছি। পরে শুনেছি আমার বইপত্রের কক্ষটি অন্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেখানে স্থান নেই আমার। বন্ধুরা কে আছে জানি না। স্টিমারে দৈনিক বাংলার সুপারেনটেনডেন্ট রংপুরের নজরুল সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। শুনেছি চাকরিতেও অসুবিধা। পাকিস্তান আমলের দৈনিক পাকিস্তান নাম পাল্টে দৈনিক বাংলা হলো। যুদ্ধের ন’মাস যারা চাকরিতে ছিল না এ সময় শূন্য পদে পদোন্নতি অর্থাৎ যুদ্ধের পূর্বে আমি সিনিয়র সাব-এডিটর ছিলাম সে পদটি ঐ ন’মাসে পদোন্নতি করা হয়েছে। এমনটি ঘটেছিল বার্তা সম্পাদক তোয়াব খানকে নিয়ে। তিনি ন’মাসে স্বাধীন বাংলা বেতারে ছিলেন। ঢাকায় ফিরে দেখলেন তার পদ শূন্য নেই। ফলে অনেক ঝামেলার পর তিনি হলেন নির্বাহী সম্পাদক।
এমন ঘটনা ভিন্নভাবে হলেও পাকিস্তান আমলে আমার ক্ষেত্রে ঘটেছিল। তখন তোয়াব খান দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদক। জনাব ফজলুল করিম প্রধান সহসম্পাদক। তার পরে আমি এবং গোলামুর রহমান চৌধুরী শিফট ইনচার্জ। এক সময় বেতন বোর্ডের মিটিংয়ে জনাব তোয়াব খান পশ্চিম পাকিস্তান গেলেন। ফজলুল করিম গেলেন লন্ডনে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্যে। প্রশ্ন দেখা দিল পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক কে হবেন। সাধারণ নিয়মে আমারই ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক হওয়ার কথা। কিন্তু তেমনটি ঘটল না। একদিন অন্যতম সহ-সম্পাদক সৈয়দ আব্দুল কাহার আমাকে বললেন, নির্মল দা, আপনাকে কিন্তু দায়িত্ব দেয়া হলো না। দায়িত্ব দেয়া হলো–গোলামুর রহমান চৌধুরীকে। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আহসান আহমেদ আসক গোলামুর রহমান চৌধুরীকে বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব দিলেন। হয়তো হিন্দু বলেই আপনাকে টপকে যাওয়া হলো।
এ ঘটনাকে আমি খুব গুরুত্ব দিলাম না। ভিন্ন কিছু ঘটবে তাও আমি মনে করিনি। শুধু ভেবেছি আমার সহকর্মী গোলামুর রহমান চৌধুরী যদি আমাকে বাদ দিয়ে দায়িত্ব নিতে পারে তাহলে আসক সাহেবের কী দোষ। আমি কাউকে বুঝতে দিলাম না, আমি দায়িত্বে নেই। এমন ভাব করলাম যেন আমিই ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক। এমনকি গোলামুর রহমানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভিয়েতনাম নিয়ে একটি টেলিগ্রাম বের করলাম। খবরটি ছিল হ্যাঁনয়ে বিমান হামলা বন্ধ করার জন্য প্রেসিডেন্ট জনসনের নির্দেশ। যদিও সব কাজই গোলামুর রহমান সাহেবই করেছিলেন। তবে অনেকের ইচ্ছা ছিল না এ ধরনের টেলিগ্রাম বের করার।
এ ছিল পাকিস্তান আমলের কথা। বাংলাদেশে এমন অবস্থা হবে তা বুঝতে পারিনি। প্রথম দিন দৈনিক বাংলায় গিয়ে হাজিরা দিয়ে চলে এলাম। কেউ তেমন উচ্চবাচ্য করলেন না। দৈনিক বাংলার সম্পাদক পরিবর্তন হয়েছে। আবুল কালাম শামসুদ্দিন বিদায় নিয়েছেন। সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হাসান হাফিজুর রহমান। আমি সকলের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম কেউ সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না। তবে কিছু কিছু বন্ধুকে আমি ফিরে আসায় খুব খুশি হতে দেখলাম। এদের মধ্যে আছেন হেদায়েত হোসেন মোরশেদ এবং মেসবাহউজ্জামান। তারা বলল, গণবাংলার নামে একটি নতুন পত্রিকা বের হচ্ছে। আপনাকে বার্তা সম্পদাক হতে হবে। আমি বললাম, না। আমার পেশা রাজনীতি, সাংবাদিকতা নয়। সুতরাং যতদিন চাকরি করি দৈনিক বাংলায় থাকব। বিকেলে আস্তানায় ফিরলাম। আস্তানা হচ্ছে রায়েরবাজার। রায়েরবাজার উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন কায়সার হচ্ছে। আমাদের দলের নেতা। ভারত থেকে ফিরে তাঁর বাসায় উঠেছিলাম। সেই বাসায়ই একদিন ভোরবেলা একটি অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হলাম। এ বাসায় প্রতিদিন এক লোক দুধ দিয়ে যায়। সে হঠাৎ আমাকে বলল, স্যার একটি রেডিও কিনবেন? রেডিওটির দাম সাতশ’ থেকে আটশ’ টাকা। আমি সত্তর টাকা বলেছি। আপনি আশি টাকা হলে নিতে পারেন। রেডিওর মালিক একজন বিহারী। মোহাম্মদপুরে থাকে। তাদের এখন বড্ড ভয় ও অভাব। দুধওয়ালা ওদের দশ হাজার টাকার ফার্নিচার এক হাজার টাকায় কিনেছে।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমি দুধওয়ালাকে বললাম, যারা আটশ’ টাকার রেডিও আশি টাকায় বিক্রি করে তাদের রেডিও বিনা পয়সায় আনলে কী হয়। তুমি আমার নাম করে ঐ বিহারীকে একটি ধমক দাও। তাহলে বিনা পয়সায় ঐ রেডিও দিয়ে দিবে। আমার কথায় দুধওয়ালা উৎসাহিত হলো। এবার আমি বাসার কাজে লোককে ডাকলাম। বললাম-ঐ ব্যাটাকে দড়ি দিয়ে বাঁধো এবং মোহাম্মদপুর থানায় দিয়ে এসো। আমার কথা শুনে লোকটি ছুটে পালিয়ে গেল। ঐ বাসায় থাকতে সে লোক কোনোদিন আমার চোখে পড়েনি।
প্রকৃতপক্ষে ঢাকায় ফিরে আমি হতচকিয়ে গিয়েছিলাম। ৭১ সালে আমি বারবার ঢাকায় এসেছি। সীমান্ত অতিক্রম করেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে গিয়েছি। শরণার্থীদের শিবিরে গিয়েছি। তখন সবকিছু আঁচ করতে পারিনি। শুধু বুঝেছি একটা যুদ্ধ হচ্ছে। এ যুদ্ধে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। দেশ স্বাধীন করতে না পারলে দেশে ফেরা যাবে না। এ নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার ভারতের মাটিতে। শরণার্থীদের শিবিরে একটি অদ্ভুত মনোভাব দেখেছি। হিন্দুরা স্বাধীনতার পক্ষে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একথাও ভাবছে, দেশ স্বাধীন হলে হয়তো তারা ভারতের মাটিতেই থেকে যাবে। মুসলমানদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাদের দেশ স্বাধীন করতেই হবে। সকলেরই চিন্তা দেশ কী করে স্বাধীন হবে? কবে হবে? কারা করবে? কোন বাংলাদেশ আমরা পাব। সেখানে গিয়ে দাঁড়ানো যাবে কি? এ প্রশ্নের মীমাংসা ভারতের মাটিতে হয়নি।
অসংখ্য তরুণ যুদ্ধে গিয়েছে। কেউ প্রাণ দিয়েছে। কেউ প্রাণ দেবার জন্যে বদ্ধপরিকর। কিন্তু ভবিষ্যৎ তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। কোন বাংলাদেশে ফিরবে তারা। সকলের সঙ্গে একটি মাত্র চিত্র আছে। চিত্র হচ্ছে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছিল। আওয়ামী লীগেরই সরকার গঠন করার কথা। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু পাকিস্তান সরকার নির্বাচনের রায় মেনে নেননি। পরিবর্তে ইতিহাসের জঘন্যতম অত্যাচার চালাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে। সকলকে ঘর ছাড়তে হয়েছে। ঘরে থাকা যায় না বলে। কেউ অস্ত্র হাতে নিয়েছে নিজ দেশে থেকে। কেউ ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়েছে। জানতে পেরেছে ভারত সরকার সহযোগিতা করছে। কারও মনে প্রশ্ন জাগেনি ভারত কেন সাহায্য করবে। কেন আমরা ভারত যাব। ভারতের সহযোগিতায় স্বাধীনতা পাওয়ার পর আমাদের অবস্থা কী দাঁড়াবে। কারও মাথায় এমন কোনো চিন্তাই আসেনি। সাধারণ স্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের এটাই ছিল মানসিক অবস্থা। তারা কখনো ভাবতে চেষ্টা করেনি যুদ্ধ পরবর্তীকালে তাদের কী ভূমিকা হবে। হয়তো একমাত্র মুজিব বাহিনী ছাড়া আর কোনো বাহিনীকে তেমনি করে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের কিছু উদ্যোগ থাকলেও সাধারণভাবে অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা ছিল দলবিচ্ছিন্ন। তাদের কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল না।
দেশ স্বাধীন হবার পর এ চিত্রটি আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকল ঢাকায় ফিরে। কলকাতায় থাকতে শুনেছি ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হবার সপ্তাহখানেক পর স্বাধীন বাংলা সরকারের সদস্যরা ঢাকায় এসেছেন। কেউ নির্দিষ্টভাবে জানে না কোথায় কী হচ্ছে। কেন হচ্ছে। কিভাবে হচ্ছে।
ঢাকায় তখন অস্ত্রের ঝনঝনানি। বড় চুল, কাঁধে এসএলআর হচ্ছে একজন মুক্তিযোদ্ধার ছবি। অনেকের আবার এক মুখ দাড়ি। পাড়ায় পাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। বিভিন্ন ইউনিটের নামে সাইনবোর্ড। কোথাও দাদা গ্রুপ। কোথাও মামা গ্রুপ। এমনি গ্রুপের কোনো হিসাব নেই। মুক্তিযোদ্ধা অর্থ হচ্ছে সমাজের একটি শক্তিশালী ব্যক্তি। সমাজের যা কিছু সে করতে পারে। চাকরি দখল কতে পারে। আমার কাছে সব চিত্রটাই গোলমেলে মনে হতে লাগল। এর মধ্যে একদিন আমার একজন ছাত্রের স্ত্রী আমার কাছে এসে হাজির। মেয়েটি অবাঙালি। আমার ছাত্র বাঙালি। সে বলল, মাস্টার মশাই আমি মেনে নিচ্ছি অবাঙালিরা ভালো নয়। তারা অনেক খারাপ কাজ করেছে। খুন করেছে। ভেবেছিলাম মুক্তিযোদ্ধারা ভালো। এখন দেখছি তাদের চরিত্রও তেমন প্রশংসা করার মতো নয়। বন্দুকের জোরে ওরা আমাদের বাড়ি কেড়ে নিচ্ছে। প্রতিরাতে নিয়ে যাচ্ছে তরুণীদের। মেয়েটির কথা আমার অবিশ্বাস হলো না। বললাম, এতবড় ঘটনার মধ্যে অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটতে পারে। তবে এটাই পুরো চিত্র নয়। কিন্তু নিজের মনকে বোঝাতে পারছিলাম না। আমি নয়াপল্টন এলাকায় থাকি। খোঁজ নিয়ে নিজেই জানলাম অনেক বাড়ি হস্তান্তরের কাহিনী।
মনটা বিক্ষিপ্ত। শুধু ভালো লাগছিল তাজউদ্দিন সাহেবের কিছু ঘোষণা। তিনি ঘোষণা করলেন, কারো বেতন দু’হাজার টাকার বেশি হবে না। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কোনো সাহায্য আমরা নেব না। আবার ভেবেছি তাজউদ্দিন সাহেব বুঝে কথা বলছেন কিনা।
আমার সামনে সমস্যা তিনটি–১, দলের রাজনীতি, ২. দৈনিক বাংলায় চাকরি, ৩, সাংবাদিক ইউনিয়ন। দল সম্পর্কে পূর্বেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। দল হচ্ছে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল। আমরা দলের পক্ষ থেকে একটি প্রচারপত্র বিলি করেছিলাম ১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর এবং তার ভিত্তিতে সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে। আমরা আমাদের প্রচারপত্রে ১১ দফা কর্মসূচি দিয়েছিলাম। যে কর্মসূচিতে বলা হয়েছিল—
১. মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি গণপ্রতিষ্ঠানের সমবায়ে বিপ্লবী সরকার গঠন করতে হবে।
২. সকল পর্যায়ে গণকমিটি গঠন করতে হবে।
৩. শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্যে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
৪. স্বাধীনতা সগ্রামে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবার এবং যারা মানসিক কিংবা শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়েছেন তাঁদের সুস্থ জীবনধারণের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
৫. ভিটামাটি ছাড়া প্রতিটি মানুষের পুনর্বাসন ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. সমস্ত বৃহৎশিল্প এবং গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত জাতীয় সম্পদ জাতীয়করণ করে জাতীয়করণলব্ধ উপস্বত্ত্ব ব্যাপক সামাজিক উন্নয়ন এবং পুনর্গঠনে নিয়োজিত করতে হবে।
৭. যুদ্ধবাজ ও মানবতাবিরোধী বন্দি খান সেনাদের ও তাদের সহযোগিদের গণআদালত গঠনের মাধ্যমে বিচার করতে হবে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানি তথা পশ্চিম পাকিস্তানি নাগরিক এবং পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাদেশের নাগরিকদের নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা বিধানকল্পে বিশ্বজনমত গঠন করতে হবে।
৮. সকল বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী ও পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজি ও সম্পত্তি বিনা। ক্ষতিপূরণে বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
৯. সকল কর্মক্ষম নাগরিকের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে এবং ভিক্ষাবৃত্তি বেআইনী ঘোষণা করতে হবে। কর্মে অক্ষম সকল নাগরিক এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল পরিবার পরিজনদের ভরণ পোষণের সম্পূর্ণ ভার রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে।
১০. সামাজিক ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণকল্পে কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় শ্রমজীবী মানুষের কার্যকর প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
১১. সামাজিক ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে জমির পরিমাণ বেঁধে দিতে হবে এবং উদ্ধৃত্ত জমি গরিব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিলি করতে হবে।
আমরা আরো বলেছিলাম শুধুমাত্র বিপ্লবী সরকার গঠন নয়, বিপ্লবী সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যে ইউনিয়ন হতে জাতীয় পর্যায়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানকারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমবায়ে গণকমিটি গঠন করতে হবে। এ কমিটিই শরণার্থীদের পুনর্বাসন, ক্ষত্রিস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসন সম্পর্কে বিপ্লবী সরকারের নিকট সুপারিশ করবে এবং বিপ্লবী সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সহযোগিতা করবে।
বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে হলে দেশি ও বিদেশি মালিকানায় সমস্ত বৃহৎ শিল্প সংস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত করতে হবে। পূর্বের মতো শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের উদ্যোগে শিল্পসংস্থা গড়ে তুলতে ব্যক্তি মালিকানায় স্থানান্তর করা চলবে না। একদিকে যেমন বেসরকারি উদ্যোগে বৃহৎ শিল্প গঠনের সুযোগ প্রদান ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গঠন একই সঙ্গে চলতে পারে না, অন্যদিকে তেমন রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে গণস্বার্থ বিরোধী কোনো বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রসারের সকল সম্ভাবনার অবলুপ্তি না ঘটলেও প্রকৃত শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে উঠতে পারে না।
আজকে অনেকের ধারণা, স্বাধীনতার পর বিপ্লবী সরকার গঠনের আহ্বান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) জানিয়েছিল। সে তথ্য সঠিক নয়। ১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর এ ঘোষণা আমরা দিয়েছিলাম। জাসদের জন্য তখনো কারো কল্পনায়ও ছিল না। আমাদের এ ঘোষণা বিশেষ করে ছাপা হয়েছিল দৈনিক বাংলায়।
আমার দ্বিতীয় সমস্যা, চাকরি ক্ষেত্রে একটি পরিবর্তন দেখা গেল। তখন গণবাংলা নামে একটি নতুন দৈনিক প্রকাশিত হতে যাচ্ছিল। দৈনিক বাংলা থেকে অনেক সাংবাদিক সে সংবাদপত্রে যোগ দেয়। অন্যতম সহকারি সম্পাদক জনাব সানাউল্লাহ নূরী গণবাংলার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ফলে দৈনিক বাংলার সহকারি সম্পাদকের একটি পদ শূন্য হয়। ঐ শূন্য পদে আমি নিযুক্ত হই। দীর্ঘদিন পর শেষ হয় আমার সহ-সম্পাদকের পালা। এবার আমি সহকারি সম্পাদক। এর আগে অনেক কলাম লিখে থাকলেও এবার শুরু হলো নিয়মিত কলাম লেখা। কিন্তু সঙ্কট দেখা দিল সাংবাদিক ইউনিয়ন নিয়ে। যে সঙ্কট স্বাধীনতার পরবর্তী দশ বছর আমাকে বিব্রত করেছে।
আমরা অর্থাৎ শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল প্রচারপত্র বিলি করলাম। বললাম বিপ্লবী সরকার গঠনের কথা। কিন্তু জনমনে তেমন ছাপ ফেলতে পারলাম না। সকলের একটি আশা। ভাবছে একটা কিছু হবে। কিন্তু কী হবে কার কোনো ধারণা কারো মাথায় এলো না। সবচেয়ে মুশকিল হলো শত্রু মিত্র চিহ্নিত করা। পৃথিবীর কোনো দেশে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়নি সে সমস্যার সৃষ্টি হলো বাংলাদেশ। মুখ্য হয়ে দেখা দিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের বিপক্ষের শত্রু নিয়ে আলোচনা। এমনটি ৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় ঘটেনি। সকলেই ব্রিটিশের বিপক্ষে ছিল। অনেকেই পাকিস্তান চায়নি। আবার অনেকেই অখণ্ড ভারত পায়নি। কিন্তু স্বাধীনতার পক্ষ এবং বিপক্ষ তখন বিভাজন হয়নি। একথা সত্য ৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হওয়ার পর ভারত পাকিস্তান উভয় দেশেরই সংখ্যালঘুরা নিগৃহীত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ দেশান্তরী হয়েছে। তাদের কষ্টের সীমা ছিল না। তবুও ৪৭ সালের ঘটনার সঙ্গে এই ঘটনার তফাৎ ছিল।
৭১ সালে দেশের লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার ফলে প্রায় কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। বাকি সকলেই তঙ্কালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে গিয়েছিল এবং এদের মধ্যে অধিকাংশই নিয়ত শঙ্কা এবং ভীতির মুখোমুখি হয়েছে। মৃত্যুর প্রহর গুনেছে। তাদের কোথাও বলার সাধ্য বা সুযোগ ছিল না। এদের অনেকের সন্তান হাজার হাজার তরুণ ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। যুদ্ধ করেছে। আবার অনেক স্বজন পূর্ব পাকিস্তান থেকেছে। কেউ বিশ্বাসে, আবার অনেকে বাধ্য হয়ে পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগিতা করেছে। পাকিস্তান বাহিনী তাদের নির্যাতন চালাবার জন্য গ্রামে গ্রামে রাজাকার, শহরে শহরে আলবদর ও আল শামস সৃষ্টি করেছে। এ কাজে সহযোগিতা করেছে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগসহ একাধিক রাজনৈতিক দল। গ্রামে শান্তি বাহিনী তৈরি করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের রুখবার জন্যে। এই রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করেছে। লুটপাট করেছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে। এদের অনেক আত্মীয় তখন মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে শত্রু মিত্র শনাক্ত করা কঠিন ছিল। এটা ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম ছিল না। এটা ছিল পাকস্তিান থেকে স্বাধীন হবার সংগ্রাম। পাকিস্তান শব্দটির সঙ্গে সাধারণ মুসলমানদের একটা ধর্মীয় অনুভূতির টান ছিল। অনেকে মনে করতো পাকিস্তান ইমানের অঙ্গ। পাকিস্তান আল্লাহর সৃষ্টি। মসজিদের যেমন ইমাম পরিবর্তন করা গেলেও মসজিদ ভাঙা যায় না, তেমনি পাকিস্তানের শাসক পরিবর্তন করা যায় কিন্তু পাকিস্তান ভাঙা যায় না। এ মানসিকতাও গ্রাম গ্রামান্তরে ছিল।
এ পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের সংগ্রাম এসেছিল। সে সগ্রামের প্রথম কথা ছিল বাঙালি নির্বাচনে জিতেছে। বাঙালি পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। সুতরাং বাঙালিকে পাকিস্তান শাসন করতে দিতে হবে। না দেয়া হলে আমরা স্বাধীন হয়ে যাব। আমরা তোমাদের সঙ্গে থাকব না। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই বুঝতে পারেনি এই স্বাধীন হবার অর্থটা। তাদের ধারণা ছিল একটা আপোষ হবেই। এক শ্রেণির তরুণ ছাড়া অনেকেই মনে করেছিল আপোষ হয়ে যাবেই। অন্তত ২২ মার্চ পর্যন্ত আলোচনা থেকে মনে হচ্ছিল একটা মীমাংসা হয়ে যাবে। কারণ আমাদের নেতারা তখনো মীমাংসা টেবিলে বসছেন। আলোচনা করছেন একটি সমঝোতার জন্যে। এই পরিবেশে আর যাই হোক অন্তত যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া যায় না।
অথচ এমনটিই ঘটেছিল ১৯৭১ সালে। ২২ মার্চ যাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলাম, মীমাংসা হচ্ছে বলে সরকারকে জানালাম তারা ২৫ মার্চ রাতে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোনো দিক থেকেই আমরা তখন প্রস্তুত ছিলাম না। রাজধানী ঢাকাসহ কিছু শহরে কিছু সোরগোল আর গ্রাম-গ্রামান্তরে ছাত্রদের কিছু প্রচারধর্মী কর্মকাণ্ড ব্যতীত এ যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। এ যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো রাজনৈতিক মানসিক প্রস্তুতি ছিল না।
কিন্তু একটি যুদ্ধ এসে গেল। অধছ কেউ জানে না এ যুদ্ধ কে চালাবে। যার নেতৃত্ব দেবার কথা প্রথমে তার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। পরে জানা গেল তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। পরবর্তী স্তরের সকল নেতাদের প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল নিজেদের বাঁচাবার এবং আশ্রয় খুঁজে বের করবার। সাধারণ মানুষের জানা ছিল না ভারতে যেতে হবে। তাদের জানার কথা নয় যে ভারত আশ্রয় দেবে। নির্যাতিত হিন্দুরা বাঁচার গরজে সীমান্তের দিকে ছুটেছিল। তাদের একটি ভরসা ছিল। কিন্তু মুসলমানেরা কেন ভারতে যাবে। কী করে যাবে। তারা ভারতে গেলে যে আশ্রয় পাবে তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়। কিন্তু এক পর্যায় দেখা গেল ভারত সকলের জন্যে দরজা খুলে দিয়েছে। আমি এপ্রিল মাসে আগরতলা গিয়ে এক কংগ্রেস নেতাকে এ প্রশ্ন করেছিলাম। বলেছিলাম পাকিস্তান আপনাদের এক নম্বর শত্রু। সে দেশের মানুষকে আপনারা আশ্রয় দেবেন কেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন দিল্লি গিয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে জিজ্ঞেস করুন। ভারতে বেশ কিছুদিন ছিলাম। সে প্রশ্ন কাউকে আর জিজ্ঞেস করিনি। অনেক তরুণকে দেখেছি ভারতের মাটিতে। তাদের যুদ্ধ করতে দেখেছি। তারাও যুদ্ধ শেষে দেশের মাটিতে আমার মতো ফিরে এসেছে। তারাও দেশে ফিরে বিভ্রান্ত হয়েছে। ভেবেছে দেশের শত্রু-মিত্র চিহ্নিত হবে কোনো মাপকাঠিতে। চিহ্নিত কিছু পরিবার ছাড়া অনেক পরিবারেই পাকিস্তানের বিপক্ষে ছিল বাবা আর পক্ষে ছিল। অনেক পরিবারে অনেকে পাকিস্তানের বিপক্ষে ছিল। আবার অনেকে যুদ্ধ করে প্রাণও দিয়েছে। একজন সাধারণ তরুণ প্রশিক্ষণ ছাড়া যুদ্ধে গিয়েছিল। সে জানত দেশ স্বাধীন না হলে দেশে ফেরা যাবে না। যুদ্ধের জীবন স্বাধীন বাংলাদেশের পরবর্তী জীবনটি তার চোখের সামনে ছিল না। তাই সে দেশে ফিরে আমার মতো হতচকিয়ে গেল।
এর মধ্যে দেখা গেল চিরাচরিত নিয়মে জঁদরেল পাকিস্তানপন্থিরা বেঁচে যাচ্ছে। নেতাদের সার্টিফিকেট কিনছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। আত্মীয়-স্বজন মুক্তিযোদ্ধা বলে পার পেয়ে যাচ্ছে। ধরা পড়ছে ছা-পোষা রাজাকার। যে পুলিশ তাকে রাজাকার হিসেবে রিক্রুট করেছিল তারাই তাদের রাজাকার বলে গ্রেফতার করছে। পুলিশ দারোগা থাকছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সচিবালয়ে যাদের মন্ত্রণালয়ে পাকিস্তান সরকার চলেছে তাদের যাচাই করা হলো না। কারণ তারা উপরের তলার লোক। অভিজাত, শিক্ষিত। তাদের বেলা সবাই হলো পরিস্থিতির শিকার। আর ৫ টাকার রাজাকার গ্রেফতার হলো নির্বিচারে। এর মধ্যেই শুরু হলো দখল। জঁদরেল নেতা এবং তাদের আত্মীয়রা কল কারখানা থেকে শুরু করে পাকিস্তানিদের বাড়ি ঘর সকল দখল করল। তার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বায়তুল মোকাররম থেকে শুরু করে সকল এলাকায় দোকানপাটের মালিক হলো বাঙালি কর্মচারিরা। কারণ অবাঙালি মালিক পলাতক।
এর প্রতিফলন অনিবার্যভাবে পড়ল অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনে। তারা প্রথমে চেয়ে চেয়ে দেখল নেতাদের কাণ্ডকারখানা। নেতাদের মতো তাদেরও হাতিয়ার আছে। তারা সেই হাতিয়ার ব্যবহার শুরু করল। দখল করতে শুরু করলো নারী, গাড়ি আর বাড়ি। এ অভিযোগই করেছিল আমার বাঙালি ছাত্রের অবাঙালি স্ত্রী। এদের সঙ্গে যোগ দিল এক শ্রেণির নতুন মুক্তিযোদ্ধা। এরা অধিকাংশই পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী। তারা ১৬ ডিসেম্বর অস্ত্র হাতে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেল। এদের বলা হতো ষোড়শবাহিনী (Sixteenth Division)। পাড়ায় পাড়ায় এরা হলো বড় মুক্তিযোদ্ধা।
এ পরিস্থিতির একটি চিত্র আছে সেকালের সংবাদপত্রে। তখন প্রতিদিন দৈনিক বাংলায় নিখোঁজ মুক্তিযোদ্ধার ছবি ছাপা হতো। কিছুকাল পরে প্রতিবাদ আসতে শুরু করল। প্রকৃতপক্ষে ওই ছবিগুলো ছিল রাজাকার আলবদরের। ওদের মুক্তিযোদ্ধা বানাবার জন্যে এই ছবি ছাপানো হতো। ওরা ওই ছবি ছাপাবার পর নিরুদ্দেশ জগৎ থেকে ফিরে আসত। আবার যারা ফিরত না তাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে তাদের আত্মীয়-স্বজন ফায়দা লুটবার চেষ্টা করত।
এ সময় একদিন রাতে অজস্র গুলির শব্দ শুনলাম। সারা ঢাকা শহর চমকাচ্ছিল। রাতের আকাশ রঙ পাল্টাচ্ছিল প্রতি মুহূর্তে। খবর এসেছে শেখ সাহেব নাকি মুক্তি পেয়েছেন। সারা শহরে উল্লাস। আমি কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। আমি বুঝতে পারছিলাম না দেশে কী হচ্ছে। সারাদেশে অস্ত্র। সকলের হাতে অস্ত্র। অন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে। এ অস্ত্রের ব্যবহার কারো কাছে বাঞ্ছিত নয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু কেউ সে কথা শুনছে না। ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রব বলেছেন, তাঁরা অস্ত্র জমা দেবেন না। তাদের নাকি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করার জন্যে আবার অস্ত্র ধরতে হতে পারে। তারা নাকি পাকিস্তান অভিমুখী অভিযান করতে পারেন। এ ধরনের কথাবার্তা আমার কাছে ছিল অর্থহীন বাগাড়ম্বর। কিন্তু কোথায় জানি একটা ভিন্ন অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম এরা কী চায়! ভারতের মাটিতে এদের ভূমিকা দেখেছি। ছাত্রলীগ নেতারা প্রকাশ্যেই তাজউদ্দিন আহমদের বিরোধিতা করেছে ভারতে। ভারতে স্বাধীন বাংলা সরকারের সঙ্গে একটি সমান্তরাল নেতৃত্ব ছিল ছাত্রদের। এই ছাত্রদের নেতৃত্বেই মুজিববাহিনী গঠিত হয়েছিল। এই মুজিববাহিনীর দায়িত্ব ছিল রাজাকার ও বামপন্থীদের চিহ্নিত করা। এ মুজিববাহিনী গঠিত হয়েছিল ভারতের মেজর জেনারেল ওবানের নেতৃত্বে। এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের অজ্ঞাতে এবং শেষ পর্যন্ত তাজউদ্দিন আহমদ মুজিব বাহিনীর বিরোধিতা করেছিলেন। এখানটাতেই আমার খটকা লেগেছিল।
আমার প্রশ্ন ছিল, তাহলে ভারত সরকার কী চায়? তাজউদ্দিন সরকারের পেছনে ভারত সরকার আছে। আবার তাজউদ্দিনের অনুমতি না নিয়ে মুজিব বাহিনী গঠন করেছে ভারতের সেনাবাহিনী। তাহলে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে সামরিক নেতৃত্বের কি কোনো পার্থক্য ছিল কৌশল নিয়ে?
কলকাতায় শুনেছি একটি নির্দিষ্ট লক্ষে মুজিববাহিনী গঠিত হয়েছে। ভারতের শাসক শ্রেণির কোনো কোনো মহলের ধারণা ছিল শেখ সাহেব শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে ফিরবেন না। শেখ সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে না এলে এক অভাবনীয় শূন্যতার সৃষ্টি হবে। সেই শূন্যতায় হাল ধরার জন্যেই মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছে। এই মহলের ধারণা এই শূন্যতায় মুজিববাহিনী হাল
ধরলে বামপন্থীদের হাতে ক্ষমতা চলে যাবে। এই বামপন্থীদের নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও মোজাফফর ন্যাপ। এ মহলের ধারণা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সবচে’ লাভবান হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি ও মোজাফফর ন্যাপ। পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে মাত্র একটি আসন পেয়েছিল মোজাফফর ন্যাপ। ছাত্র ফ্রন্টে তাদের কিছু প্রভাব থাকলেও কৃষক বা শ্রমিক ফ্রন্টে তাদের কোনো প্রভাব ছিল না। ৭১-এর যুদ্ধের সময় ভারতের মাটিতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে আসে। প্রয়াত কমরেড মনি সিং ও মোজাফফর ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ স্বাধীন বাংলা সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। অপরদিকে ভারতের সরকারি মহলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি অর্থাৎ সিপিআই-এ সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব ডিপি ধর এবং পিএন হাসকার দুই ক্ষমতাসীন ব্যক্তিত্ব। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে এদের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ফলে ভারত সরকারের কাছে এই দুটি দলের গুরুত্ব অনেক। হয়তো এ কারণেই আগস্টে আমার ভারত প্রবেশকালে ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাকে সীমান্তে আটক করে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি বা মোজাফফর ন্যাপের সদস্য কিনা। আমি যতদূর জেনেছি অনেক দেন দরবারের ফলে ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টি বিশেষ ট্রেনিং-এর সুবিধা পেয়েছে ভারতের মাটিতে। অপরদিকে পিকিংপন্থী বা অন্যান্য চরম বামপন্থী বলে কথিত দলের সদস্যরা প্রশিক্ষণ নিয়েও শেষ পর্যন্ত সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধা বলে স্বীকৃতি পায়নি। অর্থাৎ ভারতের মাটিতে ভারত সরকারের বাংলাদেশ সম্পৰ্কনীতির একাধিক রূপ দেখেছি :
১. সরকারিভাবে দৃশ্যত ভারত সরকার স্বাধীন বাংলা সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে।
২. সেনাবাহিনীর একটি অংশ তাজউদ্দিন সরকারবিরোধী ছাত্রলীগকে মদদ গিচ্ছে।
৩. দিল্লির একটি রাজনৈতিক আমলামহল বাংলাদেশের মস্কোর অনুসারি বামপন্থীদের সাহায্য সহযোগিতা করেছে।
বাংলাদেশে ফিরে তেমন একটি চিত্র আমার চোখে পড়েছিল। দেশে তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সরকার চলছে। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব সে সরকারের তোয়াক্কাই করছে না। কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। আর তখন লক্ষণীয় ছিল ভারতীয় দূতাবাসে কূটনীতিক নির্বাচন। এই দূতাবাসের অধিকাংশ কূটনীতিক ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে একসময় ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। ভারতের দূতাবাসের চেহারা দেখে মনে হতো শেখ সাহেব দেশে ফিরুক আর না ফিরুক বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে মস্কোপন্থীরাই নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়াবে। যেন সেই প্রস্তুতি নিয়েই ভারত তার বাংলাদেশের দূতাবাস সাজিয়েছে। এ কথাগুলো ছিল তখন আমার একান্ত চিন্তা। কাউকে বলতে পারছিলাম না। তবে মনে হচ্ছিল তাজউদ্দিন সাহেব বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। ছাত্রলীগ তাঁকে বরদাস্ত করবে না। তাঁকে বরদাস্ত করবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কারণ ছাত্র জীবনে তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা সকলেরই জানা ছিল। তবে আমি এতো কথা ভাবলেও সব কিছু গুছিয়ে নিতে পারছিলাম না।
জীবনে দু’বার স্বাধীনতা দেখেছি। প্রথম স্বাধীনতা দেখেছিলাম ১৭ বছর বয়সে। দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা দেখলাম ৪১ বছর বয়সে। প্রথম স্বাধীনতার ভয়াবহ স্মৃতি তখনও মন থেকে মুছে যায়নি।
১৯৪৭ সালে প্রথম স্বাধীনতা এসেছিল সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ বিভাগের মাধ্যমে। উপমহাদেশের দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের কাছে স্বাধীনতা ছিল ভয়, ত্রাস এবং শঙ্কার। কোটি কোটি মানুষের জীবনে সে স্বাধীনতা ছিল অমানবিক এবং দানবীয়। সেই স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভেবেছি এই স্বাধীনতার অর্থ কী। যে স্বাধীনতা মানুষকে ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করে, সেই স্বাধীনতার শিকার সাধারণ মানুষকে দেশান্তরী হতে দেখেছি। দেখেছি ভিন দেশ থেকে আরো একদল মানুষকে সর্বশান্ত হয়ে আমার দেশে আসতে। ওদের কারো চোখে কোনো আশা বা ভাষা নেই। সবই অনিশ্চিত। নিজের জননীকে দেখেছি দেশান্তরী হতে।
তবে সে দৃশ্য বেশিদিন দেখতে হয়নি। আমার স্বাধীন দেশটির নাম পাকিস্তান হওয়ায় আমার জেলে যাওয়া হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। স্বাধীন পাকিস্তানের মুক্ত বায়ুতে আমাদের থাকার অধিকার ছিল না। ১৯৪৭ সালের পর যারা জন্মেছেন তাদের সে পরিস্থিতি বোঝার কথা নয়। আমি ওই বয়সেও বুদ্ধি দিয়ে বুঝতাম যে ভারতবর্ষ নামক উপমহাদেশটি ভাগ হয়েছে ব্রিটিশের নেতৃত্বে। একটি ভাগের নাম ভারত। ওই ভাগটিতে কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান লুটেপুটে খাবে। অপর ভাগের নাম পাকিস্তান। সেখানে লুটেপুটে খাবে মুসলিম লীগ নামক একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এই দুটি প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশের সঙ্গে মিলেমিশে ভারত শাসন করেছে। এই উপমহাদেশে মানুষ নামে কোনো প্রাণী নেই। মুখ্যত হিন্দু মুসলমান নামে কোটি কোটি জীব আছে। এদের একটি অংশে শাসক ও শোষণ করার দায়িত্ব ব্রিটিশ দিয়েছে কংগ্রেসকে। অপর অংশের দায়িত্ব পেয়েছে মুসলিম লীগ। আমার রাজনীতিক জ্ঞান আমাকে শিখিয়েছিল এই শোষণ থেকে মুক্তি পেতে হলে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। লড়তে গেলে বেশিদিন বাইরে থাকা যাবে না। ওই পাকিস্তান সৃষ্টির পর মাত্র বছরখানেক জেলের বাইরে ছিলাম। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের সৃষ্টি। আর আমি গ্রেফতার হলাম ১৯৪৮ সালের ২০ আগস্ট। জেল থেকে বের হতে ১৯৫২ সাল কেটে গেল, অর্থাৎ জেলের বাইরে রাজনীতির ঝামেলা আমাকে পোহাতে হয়নি বছর চারেক।
তবে জানতাম যে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিতে নতুন কিছু ঘটবে না। ব্রিটিশ ধাচেই একটি রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা হবে। নেতৃত্ব থাকবে দুর্জন এবং দুর্বল ব্যক্তিদের হাতে। মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।
কিন্তু ১৯৭১ সাল তো ১৯৪৭ নয়। এই সংগ্রামের একটি ভিন্ন উত্তরাধিকার আছে। একটি ভিন্ন স্বপ্ন ও একটি ভিন্ন আকাক্ষা আছে। সেই স্বপ্ন ও আকাক্ষার ভিত্তিতে ৭১-এর সংগ্রামের জন্ম। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে দেশ স্বাধীন হলেই ওই সমস্যার সমাধান হবে তার স্বপক্ষে কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। কারণ এই যুদ্ধের নেতারা আমার চেনা। অসম্ভবভাবে জানা। ৭১ সালের ৯ মাসে আরো জানা হয়ে গেছে তাদের চরিত্র। ভিন্ন দেশের মাটিতে থেকে যারা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ক্লেদাক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে, তারা বাড়ি ফিরে কী করতে পারে তা বুঝতে বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। অথচ সেই অপ্রিয় সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করলে ৭১-এর যুদ্ধের কোনো অর্থ থাকে না। তবু আশা। ব্যাখ্যা এবং যুক্তিহীন স্বপ্ন। তবুও ভেবেছি দেখি শেখ সাহেব দেশে ফিরলে কী হয়। এমন সময় খবর এল শেখ সাহেব মুক্তি পেয়েছেন। ঢাকায় আসছেন ১০ জানুয়ারি।
শেখ সাহেব এলেন দশ তারিখে। রেসকার্সের জনসভায় তাঁর ভাষণ শুনতে গেলাম। শেখ সাহেবের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। শরীরটা দারুণ ভেঙে গেছে। মুখে নিদারুণ ক্লান্তির ছাপ। চারদিকে উদ্বেলিত জনতা যেন তাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। খুব মনযোগ দিয়ে তাঁর ভাষণ শুনলাম। মানুষ কান পেতে শুনল। মনে হলো মানুষ তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত ভাষণ পায়নি। তার কাছে যেন অনেক পাওয়া ছিল। ৯ মাস শেখ সাহেবের অনুপস্থিতিতে তারা সংগ্রাম করেছে। অনেক কিছু হারিয়েছে। ভেবেছে ৭ মার্চের মতো একটি অগ্নিঝরা ভাষণ তাঁর কাছ থেকে শুনবে। সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
আমি কিন্তু তেমনটি ভাবিনি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ অগ্নিঝরা হলেও আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। সেদিনের জনতা ক্ষুব্ধ ছিল। শেখ সাহেব সমালোচিত হয়েছিলেন স্বাধীনতা ঘোষণা না দেয়ার জন্যে। আমার কথা ছিল-৭ মার্চ ওর চেয়ে বেশি কিছু বলার তার ছিল না। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-ওই সময় এর চেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব বা স্বাভাবিক ছিল না। যাঁরা বলতে চান তিনি স্বাধীনতা চাইতেন না কিংবা স্বাধীনতার নামে ভাওতা দিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে আমি একমত নই। একটা কথা সবাইকে মেনে নিতে হবে, শেখ সাহেব যে কোনো অর্থেই ওই ভাষণ দিয়ে থাকুন না কেন, ওই ভাষণ থেকে পিছু হটবার তাঁর কোনো উপায় ছিল না। আমি তর্কের খাতিরে সমালোচকদের বক্তব্য মেনে নিতে রাজি–যাঁরা বলেন, তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতা করতে চেয়েছিলেন বা সমঝোতা করে প্রধানমন্ত্রী হলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হতোই। ইতিহাসের কোনো আন্দোলনই শুধুমাত্র নেতারা নির্ধারণ করে না। আন্দোলনের গতিপথে একসময় জনতাই নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়। সে জনতাকে নেতৃত্ব দিতে না পারলে একসময় নেতৃত্বই ছিটকে পড়ে যায়। জনতা নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলে।
যাঁরা বলেন, ৭ মার্চ রেসকোর্সে শেখ সাহেবের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়া উচিত ছিল, তারা কি পরবর্তী চিত্রটি ভেবে দেখেছেন? ধরা যাক, শেখ সাহেব রেসকোর্স ময়দানেই স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো পাকিস্তান বাহিনীর হামলা এবং সে হামলায় নিশ্চয়ই রেসকোর্সেই লাখ খানেক মানুষ মারা যেত। তারপর কি আপনারা অভিযোগ করতেন না শেখ মুজিবুর রহমান হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? তাই আমার সেদিন মনে হয়েছিল ওর চাইতে বেশি কিছু বলার অবকাশ সেদিন ছিল না।
এ পটভূমিতে আমি নিজেই বিভ্রান্ত ছিলাম। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি ভাষণ শেখ সাহেব দেবেন ১০ জানুয়ারি। ১০ জানুয়ারি ৭ মার্চ নয়। ৭ মার্চ যে আন্দোলনের শুরু ১৬ ডিসেম্বর সে আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে। নতুন রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। নতুন নেতৃত্ব নিতে হবে। নেতার প্রতিটি কথা দেশে বিদেশে পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করা হবে। বুঝতে চেষ্টা করা হবে তাঁর মন মানসিকতা এবং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নীতি। দেশে এসে তিনি ৯ মাসের বিস্তারিত বিবরণ শুনতে পারেননি। সার্বিকভাবে জানেন না স্বাধীন বাংলা সরকারের কার্যাবলি। তার অনুপস্থিতিতে কোনো নীতি চূড়ান্ত হয়নি। চূড়ান্তকরণের প্রশ্নই ওঠেনি। সবকিছু যেন নতুনভাবে শুরু হতে যাচ্ছে। মানুষ ভেবেছে শেখ সাহেব ফিরে এলে কি স্বাধীন বাংলার নতুন নীতি নির্ধারিত হবে? স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা শোনা যাবে? এ আশা নিয়েই সেদিন লাখ লাখ মানুষ রেসকোর্স ময়দানে এসেছিল। কিন্তু সে আশা পূরণ করার অবকাশ কি সেদিন ছিল?
৭ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমান এবং ১০ জানুয়ারির শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক অর্থে একই ব্যক্তি নন এমন একটি ধারণা নিয়েই আমি জনসভায় গিয়েছিলাম। সেদিনের শেখ সাহেবের ভাষণ শুনেছিলাম এবং লক্ষ করেছিলাম সাধারণ মানুষ যেন আরো কিছু চাইছে। শেখ সাহেব দীর্ঘ ভাষণ দিলেন না। শুধু তাঁর ভাষণের একটি বাক্য আমার কানে বাজল। তিনি বললেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে আমি প্রশংসা করতে পারলাম না। জনতা এ বাক্যটি ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছিল। তারা চেয়েছিল সরাসরিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করা হোক। কারণ ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সহায়তা না করলে এত রক্তপাত আর এত মৃত্যু বাংলাদেশে হতো না। সবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল বাংলাদেশে। জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করতে চাইলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাধা দিয়ে যুদ্ধকে দীর্ঘ করেছে। আর ওই সময় আলবদর বাহিনী হত্যা করেছে বাংলাদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের। এ ঘটনা ঘটেছিল ১৩, ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর। আর তার একমাস না যেতেই ১০ জানুয়ারি শেখ সাহেব ভাষণ দিলেন রেসকোর্স ময়দানে। সে ভাষণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জোরালো কথা না থাকায় সাধারণ শ্রোতারা যেমন ক্ষুব্ধ হলো, আমারও মনে হলো কিছুদিনের মধ্যেই নতুন কিছু ঘটতে যাচ্ছে আমাদের রাজনীতিতে। মন্ত্রিসভায় নিশ্চয়ই এবার মতানৈক্য দেখা দেবে। কারণ স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন বাংলাদেশে ফিরে ঘোষণা করেছেন–সাম্রাজ্যবাদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য নেয়া হবে না। তাজউদ্দিন সাহেবের মার্কিনবিরোদী ভূমিকা ছিল খুবই স্পষ্ট। এ ভূমিকা নিয়ে মন্ত্রিসভায় বিরোধিতা ছিল। তাঁর নীতির বিরোধিতা করেছেন খন্দকার মোস্তাক আহমদ। তৎকালীন ছাত্রলীগ তাজউদ্দিনকে বিরোধিতা করেছে পদে পদে। শেখ সাহেবের ভাষণ থেকে আমার মনে হলো সরকারের নেতৃত্বে তাজউদ্দিন থাকছেন না।
কিভাবে নতুন সরকার গঠিত হবে, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন এ চিন্তা তখনো আমার মনে আসেনি। শুধু এটুকু মনে হলো, মন্ত্রিসভার নেতৃত্ব পরিবর্তিত হবে। তাজউদ্দিনের নীতির পরিবর্তন হবে এবং কিছুদিন পরে সে ঘটনা ঘটল। শেখ সাহেব প্রধানমন্ত্রী হলেন। প্রেসিডেন্ট হলেন আবু সাঈদ চৌধুরী। তাজউদ্দিন থাকলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন একটি অধ্যায় সূচিত হলো।
এ সময় বাস্তব কারণে আমার নিজের ভূমিকা পরিবর্তন হলো। এ পরিবর্তনের কেন্দ্র হচ্ছে জীবিকার জন্যে গ্রহণ করা সাংবাদিকতা পেশা।
মুখ্যত রাজনীতি আমার পেশা। নিজের সিদ্ধান্ত ছিল কোনকালে কারো অধীনে চাকরি করব না। আর চাকরি বা আমাদের কে দেবে। ছাত্র পড়ানোই ছিল আমার একমাত্র পেশা। ১৯৫৮ সালে এ পেশা নিয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। দেশে সামরিক শাসন জারি হয়েছে। অধিকাংশ রাজনীতিক আত্মগোপন করেছেন। অনেকেই জেলে। বন্ধুদের বক্তব্য হচ্ছে কোনো চাকরি নিলে হয়তো গ্রেফতার এড়ানো যাবে। নইলে সামরিক সরকার একদিন গ্রেফতার করবেই। বন্ধু আহমেদুর রহমান তখন দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক। তিনি বললেন, ইত্তেফাকে চাকরি নিন। আমি ব্যবস্থা করব। ইত্তেফাকের তখন অন্যতম সহকারী সম্পাদক আব্দুল আউয়াল। আউয়াল এক সময় ছাত্রলীগের সম্পাদক এবং আমি দপ্তর সম্পাদক ছিলাম। আমার চাকরি হবার এক সপ্তাহের মধ্যে ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন গ্রেফতার হয়ে গেলেন। আমি গ্রেফতার হলাম একমাসের মধ্যে। জেল থেকে বের হলাম ১৯৬২ সালের জুন মাসে। ইত্তেফাকে সকলের চাকরি হলো। আমার চাকরি হলো না। চাকরি হলো জেহাদে। জেহাদ বন্ধ হয়ে গেল ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে। দৈনিক পাকিস্তান অর্থাৎ দৈনিক বাংলা প্রকাশিত হলো ১৯৬৪ সালের নভেম্বরে। দৈনিক পাকিস্তানে চাকরি হলো সহসম্পাদক হিসেবে। দেশ স্বাধীন হবার পর আমার পদে আর ফিরতে পারলাম না। তখন কাগজের নাম দৈনিক বাংলা। শেষ পর্যন্ত সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হলাম। সহকারী সম্পাদক ছিলেন শামসুর রাহমান, আহমেদ হুমায়ুন, মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ, ফজল শাহাবুদ্দিন প্রমুখ। তারা সবাই ছদ্মনামে উপসম্পাদকীয় লিখতেন। আমি নিজের নামে উপসম্পাদকীয় লিখতে রু করলাম। মাঝখানে একদিন একটি ঘটনা ঘটে গেল। এক তরুণ এসে দাবি করলো তার লেখা আমাদের ছাপাতে হবে। আমরা বললাম বাইরের কোনো লেখা ছাপা হয় না। সে দাবি করল আপনি নির্মল সেন নিজের নামে লিখতে পারলে আমি কেন নিজের নামে লিখতে পারব না। আর সেদিন থেকে নির্বাহী সম্পাদক তোয়াব খান আমাকে ছদ্মনামে লেখার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু নতুন নাম কোথায় পাব। পাশে সহ সম্পাদক সাদেকীন কাজ করছিল। সে বলল আমি একটি নাম দিচ্ছি। নাম হচ্ছে, অনিকেত। অর্থাৎ যার কোনো নিকেতন নেই–উদ্বাস্তু।
সে থেকেই অনিকেত নামে আমার লেখা শুরু দৈনিক বাংলায়। অনিকেত নামে এ লেখা প্রথম বন্ধ হয়েছিল ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বাকশাল গঠনের পর শেখ সাহেবের নির্দেশে। তবে তার আগেই আমার লেখা নিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনায়।
দৈনিক বাংলায় জানুয়ারিতে আমার লেখা নিয়ে প্রায় তোলপাড় হয়ে গেলো। তখন আমি নির্মল সেন নামেই লিখছি। আমার লেখা শিরোনাম ছিল ‘আমি ভয় পাই। আমার বক্তব্য ছিল আমাদের কাছাকাছি অনেক লোক এখন ঘুরছে। অনেক লোককে দেখছি নতুন পোশাকে। অনেকে সরকারের অনুগ্রহ পাচ্ছে। কিন্তু এরা তো চেনা মুখ। আমি স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসে বেশ কয়েকবার ঢাকায় এসেছি। টেলিভিশনে এদের মুখ দেখেছি। কণ্ঠ শুনেছি বেতারে। মিছিল দেখেছি ঢাকা শহরে। এরা তখন তাণ্ডব নৃত্য করেছে সারা বাংলাদেশে। সারা দেশে এক মৃত্যুর রাজত্ব। এই মানুষগুলো এ রাজত্বের নেতৃত্ব করেছে। কণ্ঠ দিয়েছে বেতারে। নাটক লিখেছে। অভিনয় করেছে স্বাধীনতাবিরোধী নাটকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমার শেষ কথা ছিল–এদের দেখে আমি নতুন করে ভয় পাচ্ছি। এদের আমি বিশ্বাস করব কীভাবে। তাই আমি ভয় পাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার দু’মাসের মধ্যে ভয় আমাকে আঁকড়ে ধরেছে।
প্রতিপক্ষের ভাষ্য হচ্ছে–নির্মল সেন আবার পরিস্থিতি ঘোলাটে করে দিছে। একদল মানুষ ভয় ভীতিতে বাধ্য হয়ে ওই ৯ মাসে অনেক কিছু করেছে। তারা গান গেয়েছে। নাটক করেছে। নেহাৎ বাঁচার জন্যে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ওই ভূমিকা নিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে এমনি নতুন করে উসকে দেয়া আদৌ সঠিক কি? এতে ঘরে ঘরে বিবাদ দেখা দেবে। বেতার টেলিভিশনের শিল্পীদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। নতুন করে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে।
এ ব্যাপারে আমার ভিন্ন বক্তব্য ছিল। আমি লিখেছিলাম দেশে আটকেপড়া মানুষগুলোর খবর আমরা জানি। ৯ মাসের যুদ্ধকালে আমি অন্তত ৫ বার ঢাকা শহরে ঢুকেছি। ভারতে গিয়ে আবার ফিরে এসেছি। অসংখ্য মানুষের খোঁজ নিয়েছি। এদের জন্যে আমার সহানুভুতি ছিল। কারণ এরা নিত্য মৃত্যুর শিকার। কখন মৃত্যুর পরোয়ানা আসবে কেউ জানে না। সীমান্তের ওপারে যারা গিয়েছেন তাদের জীবনে এই আশঙ্কাটি ছিল না। তাদের প্রতি মুহূর্তে পাকিস্তানি হামলার ভয় ছিল না। কিন্তু ঢাকায় ভয়টি ছিল প্রতিদিন। সুতরাং ভয়ের মুহূর্তে সবকিছুই করে ফেলা সম্ভব।
তবু আমার প্রশ্ন ছিল রচিত গান এবং ইতিহাসের সন্ধান সম্পর্কে। অবাঙালিরা বাঙালির ইতিহাসের সকল খবর জানত না। তাদের পক্ষে খুঁজে খুঁজে ইতিহাসের নোংরা আবর্জনা বের করা সম্ভব ছিল না। এ নোংরা এবং আবর্জনা আমাদের লোকেরাই অনুসন্ধান করে বের করেছে। গান লিখেছে, নাটক করেছে। সবকিছুই মিথ্যা নির্ভর। তারা না করলে বা অসহযোগিতা করলে হয়তো বা ৭১-এর সংগ্রামকালে তৎকালীন পাকিস্তান বেতার থেকে ঐ অশ্লীল গান এবং নাটক আমাদের শুনতে হতো না। আমার বক্তব্য ছিল এই মানুষগুলোকে নির্বিচারে সব সুযোগ দিলে পুরনো ঐতিহ্য বহাল থাকবে। কোনোদিন এরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবে না। বলবে, বন্ধুকের নলের ভয়ে এরা এসব কিছু করতে বাধ্য হয়েছে। নিজের করার কিছু ছিল না। এরা বারবারই বিশ্বাসঘাতকতা করে বেঁচে যাবে। আর একথাও মেনে নিতে হবে, এরা সকলেই বন্দুকের ভয়ে করেছে তা সত্য নয়। অনেকেই নিজের ইচ্ছেয় এবং নিজের বিশ্বাসে এই ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। যে কোনো কারণেই হোক এ ঘটনা নিয়ে তেমন পর্যালোচনা হলো না। যারা ক্ষমতার কাছাকাছি আছে, তারা যেমন ছিল তেমন থাকল। মাঝখান থেকে কিছু চুনোপুটি রাজাকার আলবদর হিসেবে বেতার ও টেলিভিশনের তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেল। নতুন যারা ক্ষমতায় এলেন তারাও প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন যে দালালিতে তারাও কম যান না। পূর্বতন সরকারের সবকিছু খারাপের মতো বর্তমান সরকারের সবকিছু ভালো বলেও তারা তীব্রস্বরে চিৎকার শুরু করলেন।
লেখাটি নিয়ে কোনো কোনো মহল আমাকে অভিনন্দন জানালেন। অনেকেই বিরূপ হলেন। পাকিস্তান আমলে এরা পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। তাদের বক্তব্য–অবস্থা এমন দাঁড়ালে তাদের চিরদিনই ভুগতে হবে। আর ক্ষমতাসীনদের বক্তব্য হচ্ছে–অবস্থা এমন দাঁড়ালে সুস্থভাবে সরকার চালানো যাবে না।
ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো আমার আরেকটি লেখা নিয়ে। তখন আমি অনিকেত নামে লিখছি। আমার লেখার বিষয় ছিল সরকারের একটি ঘোষণা ও বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যের দাম। সরকার ঘোষণা দিলেন হিন্দুদের সমস্ত লুণ্ঠিত দ্রব্যসামগ্রী ফেরত দিতে হবে। আমি লিখলাম, ঘোষণাটি ভালো কিন্তু এ ঘোষণা কার্যকর করা সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালের লুটপাটের পণ্য কেউ তার ঘরে জমা করে রাখেনি। ফরিদপুরের টিন বিক্রি হয়ে চলে গেছে দিনাজপুরে। আমার বাড়ির রেডিওটি আমার পাশের বাড়ির লোক নিয়ে থাকলেও নিশ্চয়ই লজ্জায় সে আমাকে রেডিওটি ফেরত দেবে না। অনেক এলাকায় ঘর পুড়েছে। সেই পোড়া ঘরে ছাই ব্যতীত ফিরিয়ে দেয়ার মতো কিছুই নেই। কিন্তু সবকিছু ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলে আইন আদালতের প্রশ্ন উঠবে। এক্ষেত্রে অভিযোগকারীদের মধ্যে শতকরা ৯৯ জন হবেন সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের লোক। এই মামলাকে ভিত্তি করে আরেকটি প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক চিন্তা ভাবনা সমান্তরালভাবে জন্ম নেবে। একদিন ভয়ে এবং শঙ্কায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা মামলা করলেও সাক্ষ্য দিতে যাবে না। মামলায় একতরফা সিদ্ধান্ত হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি বেকসুর খালাস পাবে। তারপর একদিন বুকটান করে এসে বলবে, কিরে ব্যাটা মালাউন, দেখি তোরে এখন কে রক্ষা করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমার সুপারিশ ছিল লুষ্ঠিত দ্রব্যাদি ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক। পুলিশকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া হোক।
আমার এ লেখা নিয়ে আমার সুহৃদ মহলেও বিতর্কের সৃষ্টি হলো। তারা অভিযোগ করলো আপনি কি লুটেরাদের বিচার চান না। আপনি কি চান না যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের সকল লুষ্ঠিত দ্রব্য ফিরে পাক। আপনার লেখায় তো মনে হচ্ছে আপনি রাজাকার ও হামলাকারীদের বাঁচিয়ে দিতে চাচ্ছেন। আমার সে কালের এ ধরনের লেখাগুলো নিয়ে এখনো আমাকে অভিযুক্ত করা হয়। আমি সেদিনও যে জবাব দিয়েছি, আজকেও আমার সেই জবাব দিতে হবে।
একথা সত্য, নয় মাসের সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষ অসাধ্য সাধন করেছে। একটি মানচিত্র পাল্টে দিয়েছে। কিন্তু আমার ধারণা এবং বিশ্বাস হচ্ছে ৭১-এর আন্দোলনে তীব্রতা ছিল আবেগের। রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের প্রশ্ন ছিল একান্তই গৌণ। প্রথমে কেউ চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। পাকিস্তান বাহিনী হামলা শুরু করার পরে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনেকেই কোনো কিছু না জেনে শুনেই ভারতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছে। তার কাছে কোনো সামগ্রিক চিত্র ছিল না। রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ না থাকার ফলে দেশ স্বাধীন করার প্রশ্নটিই ছিল মুখ্য। দেশের পরবর্তী রাজনৈতিক চিত্র আদৌ স্পষ্ট ছিল না কারো কাছে। আর ইতোমধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটে গিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি ঘরে। আমরা বাঙালির শাসন চাই কিন্তু সে জন্যে পাকিস্তান ভাঙতে হবে সে প্রশ্নটি মুখ্য ছিল না। আমি আগেও বলেছি এ প্রশ্নে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বিভাজন ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ি ফিরে দেখল তাদের অনেকের আপনজনই রাজাকার এবং শান্তি কমিটির সদস্য। অথচ তাদের সঙ্গেই তাদের ঘর করতে হবে। এদের সঙ্গে কী আচরণ করা হবে এই কথা কেউ বলল না। পাকিস্তানের সহযোগিতার জন্যে কিছু লোককে গ্রেফতার করা ছাড়া বিকল্প কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না। যে ছেলেটি বাড়ি ফিরে দেখল তার মা রাজাকারের সহযোগিতা করেছে, সেই মায়ের কাছেই তার আশ্রয় নিতে হলো। অনেক মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতা যুদ্ধের উন্মাদনায় কিছুদিনের জন্যে হলেও তার রাজাকার আত্মীয়-স্বজনকে ক্ষমা করতে চাইল না। অনেকেই নিজের স্বজনকে খুন করল। আবার কাউকে জেলে পৌঁছে দিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বা সামাজিকভাবে প্রতিরোধের কর্মসূচি বা সামাজিক সংস্কারের কর্মসূচি কোনো তরফ থেকেই দেয়া হলো না। মাঝখান থেকে আরেকটি প্রশ্ন বড় করে দেখা দিল। মুসলমান সমাজে জাত-পাতের বিভেদ গৌণ। চাচাতো বা মামাতো ভাই বোনের মধ্যে বিয়ে হয়। লক্ষ করা গেলো এ জন্যেই রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ না থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনে এক সময় সেই রাজাকার স্বজন হয়ে দেখা দিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তীব্র না হওয়ায় সে সেই রাজাকার স্বজনের সঙ্গেই সহাবস্থান শুরু করল। এক সময় এটাই হয়ে দাঁড়াল সবচেয়ে বড় যুক্তি। অর্থাৎ রাজাকার হলেও আমার স্বজন বলেই তাকে মুক্তি দিতে হবে। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে কেউ মুক্তিযুদ্ধে গেলে তার ভবিষ্যৎ কর্মপথ বেছে নিতে অসুবিধে হতো না। দুঃখজনক হলেও সত্য, আওয়ামী লীগসহ কোনো রাজনৈতিক দলই মুক্তিযুদ্ধের এ দিকটি কখনোই ভেবে দেখেনি। কেউ ভাবতে চেষ্টা করেনি, সামগ্রিকভাবে সমাজে মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্যতা গ্রহণযোগ্য করতে না পারলে শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের লুট করা দ্রব্য ফেরত দিতে বললে সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে সঙ্কট আরো গম্ভীর হবে বলেই আমার ধারণা ছিল এবং আমার লেখার শেষ পর্যন্ত একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো।
একই সময় আমি ভারতীয় পণ্যের দাম সম্পর্কে একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম। তখন কোলকাতায় সাপ্তাহিক দেশ-এর দাম ছিল ষাট পয়সা। ঢাকায় দেশ বিক্রি হতো এক টাকায়। আমি বলেছিলাম এ প্রবণতা ভালো নয়। মানের দিক থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মুদ্রা মান তখন এক ছিল। এ সত্ত্বেও কেন ভারতের পণ্য বাংলাদেশে বেশি দামে বিক্রি হবে, এটাই ছিল আমার প্রশ্ন। আমার ভয় ছিল অন্যত্র। আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেয়ার সময় বলতাম করাচির তিন টাকার চাল আমাদের ঢাকায় ৬ টাকায় কিনতে হয়। সুতরাং ওই পাকিস্তান আমরা চাই না। ওই পাকিস্তানে আমরা থাকব না। একই ধারায় যদি প্রশ্ন ওঠে ভারতীয় পণ্য এদেশে বেশি দামে বিক্রি হলে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। ওরা পাকিস্তানের মতোই আমাদের ঠকাচ্ছে।
আমার এই লেখা নিয়ে প্রশ্ন উঠল বিভিন্ন মহলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি তাকে সঠিকভাবে আমার কথা বোঝাতে পেরেছিলাম। কিন্তু রাজাকারদের গ্রেফতার করা বা মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়া নিয়ে আমার লেখা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল।
একদিন খবর পেলাম জহির রায়হান মিরপুরে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম। জহির আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। জহিরের বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে দীর্ঘদিন এক সঙ্গে জেল খেটেছি। সাংবাদিক ইউনিয়ন করেছি। তবে জহিরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ভিন্ন ধরনের। আমি যখন ছাত্রলীগ করতাম তখন আব্দুল গাফফার চৌধুরী ও জহির রায়হান ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত জহির সিনেমায় চলে গেল। সব নিয়েই জহিরের সঙ্গে আমার আলাপ হতো। তার সিনেমা নিয়ে একমত হতাম না। পাকিস্তান আমলে সর্বশেষ জেল খেটে বের হয়েছিলাম ১৯৬২ সালের জুন মাসে। পরদিন জহিরের কায়েতটুলির বাসায় গিয়েছিলাম। তর্ক বেধে গেল জহিরের ছবি ‘সঙ্গম’ নিয়ে। জহির বলল, উপায় নেই। আপনারা সাধারণ দর্শকের রাজনৈতিক চেতনা উন্নত করতে না পারলে ওরা বোম্বে মার্কা ছবিই দেখবে। আমাদের মতো মানুষের পক্ষে বারবার লোকসান দিয়ে ভালো ছবি করে টিকে থাকা সম্ভব হবে না।
সেই জহির অর্থাৎ জহির রায়হান ৭১-এর যুদ্ধের সময় কলকাতায় গিয়েছিলেন। তাঁর পেশা ছাড়েননি। স্টপ জেনোসাইড ছবি করেছিলেন। আমার প্রশ্নের কঠিন জবাব দিয়েছিলেন অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের নির্যাতিত জনতার চিত্র ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু জহির কোলকাতায় গেলেও শহীদুল্লাহ কায়সার ঢাকা ছাড়লেন না। কেন ছাড়লেন না আমি জানি না। ৭১ সালে আমি বারবার ঢাকা এসেছি। সকলের পরিবারের খবর নিয়েছি। শুনেছি শহীদুল্লাহ সাহেব ভালো আছেন। সর্বশেষ শুনেছি যুদ্ধের শেষ পর্বে আল বদরের হাতে খুন হয়েছেন শহীদুল্লাহ কায়সার। সেই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়েছিলেন জহির রায়হান। কে নাকি ফোন করে জানিয়েছিলেন শহীদুল্লাহ কায়সাকে মিরপুরে খুঁজে পাওয়া যাবে। পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিলেন জহির রায়হান। মিরপুর থেকে জহির রায়হান আর ফেরেননি।
কেন এমন হলো? কেন এমন হয়? সে প্রশ্ন তখন আমি ভাবতে চেষ্টা করিনি। হাতে কলম ছাড়া কিছু ছিল না। নিজেকে দারুণ অসহায় মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এ কোন স্বাধীনতা, কাদের স্বাধীনতা। কারা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কলকাঠি নাড়াচ্ছে। জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে সভা, সমিতি, মিছিল, কমিটি হয়েছে। কোনো ফায়দা হয়নি। সে প্রশ্নে পরে আসছি।
তাহলে জহির রায়হান কোথায় হারিয়ে গেলেন? কেন ফিরলেন না? কারা তাঁকে মিরপুরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল? সে রহস্যের সমাধান আজো হয়নি। এ নিয়ে অনেক কাহিনী আছে। কেউ কেউ বলতে চায় জহির রায়হানের কাছে আল-শামস, আল-বদর ঘাতকদের তালিকা ছিল। জহির রায়হান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে জন্যেই পাকিস্তানের সহচরেরা তাকে খতম করেছিল। মিথ্যা টেলিফোন করে নিয়ে গিয়েছে। মিরপুরের দুর্গম এলাকায় এবং সেখানেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
আজকের মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের একটি ভিন্ন ইতিহাস আছে। এ দু’টি এলাকা মোহাজেরদের পুনর্বাসনের কলোনি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। এ মোহাজেরের অধিকাংশ অবাঙালি। এরা ভারতের বিহার, উড়িষ্যা এবং উত্তর প্রদেশ থেকে এসেছে ভারত বিভাগের পর। এদের মধ্যে অনেকে চাকরিজীবী। এরা দেশ বিভাগের সময় পাকিস্তানে কাজ করার জন্যে অপসন দিয়েছিল। সে অপসন ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হয়েছিল সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে। বলা হয়েছিল–হিন্দু মুসলমান দুটি স্বতন্ত্র জাতি। এদের পক্ষে পাশাপাশি বসবাস করা সম্ভব নয়। তাই ভারতবর্ষ ভাগ করতে হবে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে গঠিত হবে ভারত। আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে গঠিত হবে পাকিস্তান। দেশ ভাগ হলেই নাকি সব সমস্যার সমাধান হবে। দুসম্প্রদায় দু’টি রাষ্ট্রে শান্তিতে বসবাস করবে।
কিন্তু দ্বি-জাতি তত্ত্ব দেশ ভাগের আগেই হোঁচট খেল প্রথম পদক্ষেপে। কারণ নতুন গঠিত ভারত ও পাকিস্তান থেকে সামগ্রিকভাবে হিন্দু ও মুসলমানদের এক রাষ্ট্র থেকে অপর রাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হলো না। অর্থাৎ ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানরা থেকে গেল। আর পাকিস্তানে থেকে গেল হিন্দুরা। অর্থাৎ মুসলমান মুক্ত ভারত বা হিন্দু মুক্ত পাকিস্তান গঠিত হলো না। নিশ্চয়ই তখন প্রশ্ন তোলা যেত, ৬ কোটি মুসলমান যদি ৩০ কোটি হিন্দুর সঙ্গে ভারতে থাকতে পারে তাহলে অবিভক্ত ভারতের ত্রিশ কোটি হিন্দুর সঙ্গে দশ কোটি মুসলমান কেন থাকতে পারবে না। একই যুক্তিতে বলা যায় যদি পাকিস্তানের আড়াই কোটি মুসলমানের সঙ্গে দেড় কোটি হিন্দু বসবাস করতে পারে তাহলে সমগ্র ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি কেন বাস করতে পারবে না?
কিন্তু তখন যুক্তির পরিবেশ ছিল না। ছিল সংশয় সন্দেহ আর ষড়যন্ত্রের যুগ। ব্রিটিশ বেনিয়া, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত বিভাগের। ভারতে কংগ্রেস, পাকিস্তানে মুসলিম লীগ আর সবার ওপরে রাজত্ব করছে ব্রিটিশ। এ তিন দল মিলে সুনিপুণভাবে ভারত বিভাগের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল। আর এ পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে সমগ্র ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। মানুষ হিসেবে মানুষের পরিচয় মুছে গিয়েছিল। এ উপমহাদেশে মানুষের প্রথম পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল হিন্দু, মুসলমান ও শিখ। সুস্থ মানবতার কোনো চিহ্ন আদৌ ছিল না। সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস চরমে উঠেছিল। এ পটভূমিতেই গঠিত হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান।
কিন্তু এ তত্ত্ব যে কত অলীক তা প্রমাণ হলো সরকার গঠন ও সরকারি কর্মচারিদের নিয়ে। সরকার গঠন করবে ভারতে কংগ্রেস এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ। এ দু’সরকারের কর্মকর্তা হওয়ার জন্যে পাকিস্তান থেকে হিন্দু নেতারা ছুটলেন ভারতে আর ভারত থেকে মুসলমান নেতারা ছুটলেন পাকিস্তানে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য হলো পূর্ববঙ্গের লোক। আজকের বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানিও ভারতে এসেছিলেন পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ থেকে। আর ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে মুসিলম লীগ নেতা লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হলেন। পাকিস্তানের হিন্দু নেতারা কোটি কোটি হিন্দুদের পাকিস্তানে রেখে নিজের আখের গোছাতে গেলেন ভারতে। একইভাবে ভারতের মুসলমান নেতারা কোটি কোটি অসহায় মুসলমানদের ভারতে ফেলে পাকিস্তানে গেলেন। এক অভূতপূর্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো সরকারি কর্মচারিদের ব্যাপারে। তাদের বলা হলো-তাদের পছন্দমতো তারা ভারত এবং পাকিস্তানে চাকরি করতে পারবে। এ ব্যবস্থাটিকে বলা হতো অপসন। অর্থাৎ ইচ্ছে হলে ভারতের মুসলমান সরকারি কর্মচারিরা অপসন দিয়ে পাকিস্তানে আসতে পারে। আবার পাকিস্তানের হিন্দুরাও একইভাবে ভারতে যেতে পারে।
চাকরিতে অপসন দিয়ে লাখ লাখ হিন্দু যেমন সেকালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে গিয়েছিল তেমনি লাখ লাখ মুসলমান ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল। অপসন দিয়ে যারা পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন তাদের বলা হতো মোহাজের। মোহাজেররা অধিকাংশ অবাঙালি। তকালীন পাকিস্তানে তাদের কোনো সহায় সম্পত্তি বা আত্মীয়-স্বজন ছিল না। তাদের দাঁড়াবার জায়গা ছিল না। ফলে তাদের জন্যে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হয়। সৈয়দপুর, খালিশপুর, পার্বতীপুর, পাকশী, খুলনা, যশোর এবং ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুরে এদের জন্যে মোহাজের কলোনি নির্মিত হয়। স্বাভাবিক কারণে এ কলোনির অবাঙালি অধিবাসীরা একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধিতা করেছে। নির্বিচারে মুক্তিযোদ্ধাদের খুন করেছে। লুটপাট করেছে এদের সম্পদ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ওরাই ছিল ঢাকার মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী।
আমার নিজের ধারণায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করাই এদের পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। এরা দেশ ভাগের পর বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানে এসেছিল। দেশ ভাগ না হলে তাদের ভিটে-মাটি ছাড়তে হতো না। পাকিস্তান তাদের অস্তিত্ব। পাকিস্তান না থাকলে তাদের অস্তিত্ব থাকে না। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৪ বছর বাঙালিরাও তাদের এক করে নিতে পারিনি। শুধুমাত্র ধর্মই যে সব কিছু নির্ধারণ করে না–প্রতি পদে পদে তা প্রমাণিত হয়েছে পাকিস্তানের ২৪ বছরে। তারই বিস্ফোরণ হয়েছিল ১৯৭১ সালে। কিন্তু অবাঙালিরা যাবে কোথায়? পাকিস্তান না থাকলে তাদের পূর্বপুরুষের ভূমি ভারতে ফিরে যেতে হয়। কিন্তু ভারতে ফিরে যাওয়া অনিবার্য কারণে সম্ভব নয়। তাহলে তাদের যেতে হয় পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে। কিন্তু সেখানেও তাদের থাকার কোনো জায়গা নেই। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে তারা অনাহুত। তাই পাকিস্তান থাকলে তাদের অস্তিত্ব বহাল থাকে। এ চিন্তা থেকেই সেদিন তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর পরের চিত্র হচ্ছে এখনো হাজার হাজার মোহাজের বাংলাদেশের বিভিন্ন শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তারা পাকিস্তানে যেতে চায়। অথচ পাকিস্তান তাদের নিচ্ছে না। পাকিস্তানের করাচি শহরে প্রতিদিন মোহাজেরদের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে। কারো জীবনে কোনো নিশ্চয়তা নেই। বেশ কয়েক বছর আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফ ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের অর্থাৎ মোহাজেরদের পাকিস্তানে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে প্রতিশ্রুতি আদৌ পালিত হবে কি না তাও নিশ্চিত নয়।
এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মধ্যে একটি মিনি পাকিস্তান ছিল বিশেষ করে মিরপুরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পরেও মিরপুরে কেউ ঢুকতে পারছিল না। মোহাজেররা নাকি তখনও সশস্ত্র প্রতিরোধ করেছিল। আর এ পরিস্থিতিতেই নাকি কে বা কারা জহির রায়হানকে সেখানে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। ফোনে নাকি বলা হয়েছিল-মিরপুরে গেলে শহীদুল্লাহ কায়সারের খবর পাওয়া যাবে। সে ফোন পেয়ে জহির রায়হান মিরপুর ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আর ফিরে এলেন না।
পরবর্তীকালে জহির রায়হান নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। একটি তদন্ত কমিটি নাকি একটি রিপোর্ট পেশ করেছিল। এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন প্রয়াত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবীর। জহির রায়হানের নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে আমরা অনেকেই লেখালেখি করেছি। সভা-সমাবেশ করেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো রিপোর্ট পাওয়ার কথা অস্বীকার করা হয়েছে।
তবে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও একটি প্রশ্নের জবাব আমি পাইনি। প্রশ্নটি হচ্ছে-জহির রায়হানের ব্যাপারে বিভিন্ন মহলের নিস্পৃহ আচরণ। একটি মানুষ যে এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। কেউ যেন তার খোঁজ রাখল না। আমরা ঘাতক দালাল নির্মূলের কথা বলি, গণআদালত করে গোলাম আযমের ফাঁসি দাবি করি। অথচ জহির রায়হানের নামটি চলচ্চিত্র জগৎ ছাড়া আর কোথাও উচ্চারিত হয় না। কেন হয় না, সে প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো কেউ এদেশে নেই।