ষষ্ঠ অধ্যায় – ধর্ম ও রাজনীতি (Religion and Politics )
ধর্মে রাজনীতি : রাজনীতির ধর্ম
ধর্ম ও রাজনীতির পারস্পরিক প্রভাবের কথা অনস্বীকার্য। এমনকি যে ধর্ম চরম বৈরাগ্যবাদী ও রাজনীতিবিমুখ সে ধর্মের অনুসারীরাও রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। কারণ তাদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে অন্যরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের সুবর্ণ সুযোগ পায়, উপরন্তু এসব নিরীহ লোককে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যও ব্যবহার করতে তারা দ্বিধাবোধ করে না। যেমন— যুদ্ধের সময় এসব শান্তিকামী লোকজন সাহায্য সমর্থনের জন্য প্রবল চাপের স্বীকার হয়। তবে যাই হোক প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে ধর্ম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
হিন্দুধর্মে রাজনীতির যে রূপটি আমরা দেখতে পাই তা হচ্ছে রাজতন্ত্র। এখানে ক্ষত্রিয় হবেন রাজা। রাজা শাসন করবেন ব্রাহ্মণের প্রণীত ধর্মীয় বিধানমতে। রাজা এবং রাজার নীতি হবে-
‘নৃপতি স্বয়ং পরের বিশ্বাসভাজন হবেন, পরকে কদাচ বিশ্বাস করবেন না। এমনকি পুত্রের প্রতিও বিশ্বাস করা প্রশস্ত নহে।’ –মহাভারত, শান্তি পৰ্ব, ৮৫।
‘ইন্দ্র, বায়ু, যম, সূর্য, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র ও কুবের এই অষ্ট দিকপালের সারভূত অংশ দিয়ে ঈশ্বর রাজাকে সৃষ্টি করেছেন।’ –মনু সংহিতা, ৭।
‘ধর্মের দ্বারা রাজা রাজ্য লাভ করেন এবং ধর্মানুসারেই রাজ্য পালন করেন।’ –বাল্মিকী রামায়ণ, উত্তর কাণ্ড ৭১।
‘রাজা নিজ নগরে ধবল গৃহাদি নির্মাণ করে তথায় ব্রাহ্মণ বাস করাবেন।’ —যাজ্ঞ বন্ধ, সংহিতা-২।
‘রাজা দেবতা ও ব্রাহ্মণদিগকে সর্বদা পুজা করবেন’। –বিষ্ণু সংহিতা ৩।
‘রাজাই সনাতন ধর্ম।’ – বাল্মিকী রামায়ণ, উত্তর কাণ্ড ৭১।
‘পিতা যেমন ঔরসজাত পুত্রকে প্রতিপালন করেন, রাজা তেমন ব্রাহ্মণকে
সর্বতোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করবেন।’ –মহাভারত, শান্তি পর্ব ১৬৫।
হিন্দু ধর্মে ব্রাহ্মণের অধিকার ও শ্রেষ্ঠত্ব সংরক্ষিত হয়েছে এভাবে—
‘তুমি কদাচ ব্রাহ্মণগণের দণ্ডবিধান করবে না, যেহেতু ইহলোকে ব্ৰাহ্মণগণই সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট হয়েছেন।’ –মহাভারত, শান্তি পর্ব ৫৬।
‘হউক প্রচ্ছন্ন বা প্রকাশ্য, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্র, যে কোন দ্যুতকারী যথোচিত মাত্রায় দণ্ডনীয়, ব্রাহ্মণেরা কায়িক শাস্তি পাবেন না; কিন্তু অর্থদণ্ড ভোগ করবেন। —মনুসংহিতা ৯।
‘ব্রাহ্মণকে আঘাত করলে তার রক্ত যত ধূলিকণা ভিজায় আঘাতকারী তত বৎসর নরকবাস করবে।’ —মহাভারত, শান্তি পৰ্ব ১৬৫।
হিন্দুশাস্ত্রে উল্লিখিত এসব বিধানে স্পষ্টতই দেখা যায়, রাজা হলেন দেবতাদের সারাংশ ও সনাতন ধর্ম এবং ব্রাহ্মণের সেবায়েত। বৈশ্য, শূদ্র নয়, ব্রাহ্মণকে নিয়েই রাজা ব্যস্ত। রাজা একনায়ক হলেও ব্রাহ্মণসেবা না করে তার নিস্তার নেই। তাই রামায়ণে আমরা দেখি, রাজা রাম ব্রাহ্মণের নির্দেশমত অন্যায়ভাবে শূদ্র হত্যা করেছেন এবং জঘন্যভাবে সীতার পরীক্ষা নিয়েছেন। মোদ্দা কথা হল, হিন্দু ধর্মে রাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। এখানে গণতন্ত্রের ঠাঁই নেই। শূদ্র বৈশ্যদের রাজাও হতে নেই আর রাজ্যের সম্পত্তি থেকে ব্রাহ্মণের ন্যায় সাদা বাড়িও পেতে নেই। ব্রাহ্মণের রাজতন্ত্র থাকলেও সেখানে শূদ্রের গণতন্ত্র নেই।
আমরা দেখতে পাই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ধর্মীয় প্রত্যয়নের উপর নির্ভরশীল। চীনের সম্রাট ছিলেন পবিত্র মর্যাদার অধিকারী এবং ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করা তার আমলাদের জন্য ছিল গৌরবের বিষয়। ব্রাহ্মণরাই ভারতে শাসক শ্রেণি সৃষ্টি করে। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জাপানে মন্দিরগুলোতে সরকারের প্রতি প্রার্থনা করে সমর্থন জানানো হত এবং সম্রাটের পূজা করত দেবতা হিসেবে। জাপান যুদ্ধে নিহতদেরও পূজা করা হত। স্বর্গীয় অধিকার বলে ফ্রান্সের রাজা দেশ শাসন করতেন। এমনি আজও যুক্তরাজ্যের রাণী অনেক স্বর্গীয় অধিকার সম্পর্কিত সুবিধা ভোগ করেন। George VI এর সিংহাসনে আরোহণের সময় Canterbury-র Archbishop তার প্রার্থনায় রাজনীতির সাথে ধর্ম মিশিয়ে ফেলেন। “হে ঈশ্বর, সকল বিশ্বাসীর মুকুট, আশীর্বাদ দাও…. পবিত্র কর তোমার ভৃত্য জর্জকে, আমাদের রাজাকে…..আমীন।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ধর্মে বিশ্বাসী লোকজনেরা মনে করত সরকারকে সমর্থন দেওয়াও তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব। এদিকে ধর্মও জনগণকে সরকারকে সমর্থন দেওয়াও তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব। এদিকে ধর্মও জনগণকে সরকারের প্রতি সমর্থন জানাতে অনেকটা বাধ্য করত। চীনা সম্রাটের দায়িত্ব ছিল বন্যা ও দুর্ভিক্ষ নিয়ন্ত্রণ করা এবং সীমানা রক্ষা করা। এসব দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে জনগণ মনে করত সে স্বর্গীয় আশীর্বাদ হারিয়ে ফেলেছে। সুতরাং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাটা এখন জায়েজ। ক্ষৈত্রিয়দের হিন্দুধর্ম শাসকের মর্যাদা দিয়েছে, তদুপরি ধর্মীয় প্রত্যাদেশ অনুযায়ী শ্রেণিপ্রথার কারণে তাদের ক্ষমতাও ছিল সীমিত। কারণ তাদের উপর রয়েছে ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য। এদিকে দুঃশাসন সত্ত্বেও ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই এর বিরুদ্ধে ধর্ম অনাস্থা জ্ঞাপন করেনি। তবে ধর্ম তাকে প্রজাদের প্রতি তার দায়-দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিত। লুই এর এই ধরনের অনাচার ছিল ধর্মীয়ভাবে প্রত্যায়িত। সে উত্তরাধিকার সূত্রে ফ্রান্স পায়, এটা তারই সম্পদ ঈশ্বর যা তাকে দিয়েছেন। সুতরাং নিজের ঐশী ভাবমূর্তি বজায় রেখে দেশ শাসন করাটাই তার দায়িত্ব ( W. H. Lewis, 1954, p. 3০)।[১৮] ধর্ম যেমন রাজার অধিকার নির্ধারণ করত তেমনি তার প্রজা কিংবা কিছুসংখ্যক প্রজার অধিকারও স্মরণ করিয়ে দিত। নিরেট রাজা হওয়া সত্ত্বেও লুই মূলত ধর্মীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাস্তবায়ন ব্রতী ছিল। তবে পরিণতিতে একটি বিশেষ শ্রেণি ছাড়া আর কেউ এই ব্যবস্থার সুবিধাগুলো পেত না।
[১৮. Durkheim-এর মতে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোও কোন না কোন মতে ধর্মপ্রায় (Parsons, 1951, Chaps. 7, 9 )।]
এই পর্যন্ত যা বলেছি তা ছিল ধর্মের সাথে রাজনীতির সুসম্পর্কের উদাহরণ। তবে মনে রাখতে হবে যে, সামাজিক সম্পর্কের একটি পরিবর্তনমুখী গতি রয়েছে। ধর্ম ও রাজনীতির মিথষ্ক্রিয়ায় ধর্মে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে তার আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে রাব্বী প্রথা প্রচলিত হওয়ার পূর্বে ইহুদি ধর্মের অবস্থান। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী ইহুদিদের ঈশ্বর ইয়ায়ো তাদের আদিপিতা ইব্রাহিম (আ.) এর সাথে একটা চুক্তিতে আবদ্ধ হন। যদি একমাত্র ইয়ায়োর ইবাদত করা হয় তাহলে তিনি ইব্রাহিম (আ.) এর বংশধরদের ফিলিস্তিন রাজ্য দিবেন এবং সাথে সুখ শান্তি। কিন্তু খ্রিষ্টপূর্ব ৭২২ খ্রিষ্টাব্দে আসিরিয়রা ইসরাইল দখল করে হাজারো ইহুদিকে দেশান্তরিত করে। ৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে মিশরের ফারাও জুদাহ রাজ্য দখল করে ইহুদিদেরকে সেবাদাসে পরিণত করে। ৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্যবলনীয়রা আবার জুদাহ দখল করে এবং ৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেম দখল করে মন্দিরসহ সম্পূর্ণ নগরী ধ্বংস করে দেয়।
ইহুদিদের এসব বিপর্যয় আগে থেকেই অনুমান করা অসম্ভব ছিল না, কারণ স্বভাবতই এসব পরাক্রমশালী সাম্রাজ্যের সামনে তাদের টিকে থাকা ছিল অসম্ভব। প্রয়োজন ছিল আপস করার। তাই ধর্মীয় প্রত্যাদেশেও পরিবর্তন আনা ছিল অত্যাবশ্যক। তাই এই ধর্মের নারীরা, আমোস, হোসেয়া, ইসায়াহ, সিকাহ, জেরেমিয়াহ, হেজকিয়েল এবং অন্যান্যরা রাজনৈতিক পরিস্থিতির ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হন। তারা তাদের ধর্মের ঈশ্বরকে বিশ্বজনীন ঘোষণা করেন এবং জনগণকে বোঝান তাদের রাজারা ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ মত না চলে বিজাতীয়দের বিয়ে করে বিজাতীয় দেবতাদের নিয়ে আসে এবং রাজা টিকাবার জন্য সন্ধি চুক্তির উপর অতি নির্ভরশীল হয়ে উঠে।
ওয়াদা ভঙ্গের কারণে খোদ ঈশ্বর তাদের উপর বিজাতীয় সম্রাটদের অত্যাচার চাপিয়ে দেন। এভাবেই তাদের ঈশ্বর সারাবিশ্বের ঈশ্বরে পরিণত হন। অথচ এই ঈশ্বরের আগে শুধুমাত্র ইহুদিদের গোত্রীয় খোদা ছিলেন এবং এর পেছনে দেখা যাচ্ছে রাজনীতিই মূল কারণ। এর পেছনে অবশ্য ইহুদি রাজ্যের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও দায়ী ছিল। নারীরা ছিলেন ঈশ্বরে অনুপ্রাণিত। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল অন্যরা। তারা সবসময় ধ্বংসের বাণী শোনাতেন। তাই রাষ্ট্রপক্ষ তাদেরকে জাদুবিদ্যার কারণে রাজার লোকজন তাদেরকে একটু ভয় করেই চলত। এদিকে জনগণই সর্বদা না হলেও প্রায়শ নারীদের পক্ষেই থাকত। কারণ নারীরা যাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেন, সেসব রাজাদের অনেকেই করভারে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। অনেক রাজাই বিলাসিতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া নারীদের চূড়ান্ত মর্যাদা খোদ ঈশ্বর কর্তৃক প্রত্যায়িত ছিল। এসব কারণে জনগণ তাদের বিরোধিতা করত না, অনেক ধর্মানুরাগী অভিজাতরাও তাদের ভক্ত ছিল।
এভাবেই রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিস্থিতি দ্বারা নারীগণ প্রভাবিত হয়েছিল। তবে একাত্মবাদের মূল কারণ হিসেবে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই চিহ্নিত করা ঠিক হবে না। ধর্মীয় অনুপ্রেরণার কারণে নারীগণ এসব দাবি করতেন যা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ছিল অবান্তর। গ্রিসেরও রাজনৈতিক কারণে অনেক দার্শনিক একাত্মবাদের কথা বলেন। রাজনৈতিক দূরাবস্থার ধর্মীয় সংস্কার চেয়ে নবীগণ রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন। তাদের দাবিতে রাজনৈতিক অনেক সংস্কারই ইতিহাসে দেখতে পাই এবং রাজনীতিতে নারীদের প্রভাব শুধু ইহুদি ধর্মেই নয়, খ্রিষ্ট ও ইসলাম ধর্মেও ছিল (Weber, 1952 Chaps, 11, 12)।
ধর্ম ও রাজনীতির মিথষ্ক্রিয়ার আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে প্রটেস্টান্ট সংস্কার। এই সংস্কারের মূলে ছিল ক্যাথলিকদের দুনিয়ামুখিতার প্রতি অসন্তোষ এবং রাজাদের পোপদের অতিরিক্ত প্রভাব থেকে মুক্তিলাভের গোপন ইচ্ছা। এসব কারণে সংস্কারের পক্ষে একটা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রাজনীতির সাহায্য নিয়েই আরো অনেকে নিজ নিজ ধর্মীয় মতবাদের প্রতিষ্ঠা করে। Anglican এবং Lutheranরা রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়াতেই নিজ নিজ রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ( Niebuhr, 1929, Chap. 5 )।
ইতিহাসের আলোকে ধর্ম ও রাজনীতির মিথষ্ক্রিয়ার অর্থ হচ্ছে চার্চের বিপর্যয়। এই বিপর্যয় শুরু হবার আগে পোপরা সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালনায় নাক গলাত। এখন পোপ প্রভাবিত এই প্রশাসন যদি গণরোষের শিকার হয় তখন বিরোধিরা ধর্মহীন নতুন কোন মতবাদের প্রচার করে অথবা নতুন কোন ধর্মীয় মতবাদের প্রচার করে। ফরাসী বিপ্লবের আগে ক্যাথলিক চার্চ এতটাই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল যে বিপ্লবিরা যেমন রাজার বিরোধিতা করে তেমনি চার্চেরও বিরোধিতা করে। ভলতেয়ার তার চিঠি শেষ করতেন ‘এই অকেজো জিনিস নিপাত যাক’ বলে। ক্ষমতায় এসে বিপ্লবিরা চিন্তা করল চার্চের প্রভাব ছিল রাষ্ট্রের যত্রতত্র, অনেক সম্পত্তির মালিক, শিক্ষা, বিচার ও কর ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনী পর্যন্ত ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। এমতাবস্থায় চার্চকে ছেড়ে দেওয়াটা সমীচীন হবে না। তাছাড়া অন্তত এটা নিশ্চিত যে, উচ্চপদস্থ পাদ্রীরা ছিল রাজদরবারের ঘোর সমর্থক। তাই পাদ্রীদের শেষ না করে রাজ বংশকে উৎখাত করা যাবে না।
ফরাসি বিপ্লবীরা নতুন এক ধর্মের সূচনা করে যার দেবতা হচ্ছে বুদ্ধি ও প্রকৃতি। এদিকে চরম নিষ্ঠুরতার সাথে পাদ্রী শ্রেণির বিনাশ সাধন করে। রুশ বিপ্লবীরাও নতুন এক ধর্মপ্রায় মতবাদের প্রচলন করে। যেমন ‘ইতিহাসের অনিবার্যতা’ হচ্ছে এক ধরনের বিশ্বাসগত মতবাদ। ক্ষমতায় এসে তারা Orthodox চার্চকে নিষ্ক্রিয়ই করে তোলেনি উপরন্তু নিজেদের ধর্মপ্রায় মতবাদ ছাড়া অন্যান্য সব ধর্মের অসারতা প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাহায্যে লক্ষ লক্ষ চীনা হত্যা করে (১৯৫০-৬৪) বিদ্রোহ দমন করা হয়। এই বিদ্রোহের মূল ছিল নতুন ধর্মীয় মতবাদ। প্রটেস্টান্ট মতবাদে প্রভাবিত হয়ে এই নতুন ধর্মের আধ্যাত্মিক নেতা চীনের ভেতর বিশাল এলাকা দখল করে অনাবিল শান্তির স্বর্গীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
উল্লেখিত নতুন এসব মতবাদের দুইটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য ছিল। একটি হচ্ছে প্রচলিত ধর্মের বিরোধিতা, আরেকটি হচ্ছে নতুন ধর্ম ও ধর্মপ্রায় মতবাদের প্রতিষ্ঠা। প্রথমটার পেছনে মূল কারণ ছিল প্রচলিত ধর্মের অপব্যবহার করে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থসিদ্ধি। তাই নতুন মতবাদের প্রথম কাজ হচ্ছে সনাতন ধর্মের উপর আক্রমণে উৎসাহিত করা এবং জনগণের পাপবোধটা দূর করা এবং নতুন বিপ্লবের কর্মসূচি প্রণয়ন করা। নতুন ধর্ম মতবাদের চেয়ে কর্মসূচির উপর জোর দেয় বেশি, কারণ নতুন ধর্ম আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেয়ে ফলাফল অর্জনে ব্যস্ত হয় বেশি। কারণ নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাদের কাছে আদর্শ বড় কিছু বা পরম পূজ্য কোন বিষয় নয়। পক্ষান্তরে, নতুন ধর্মের সূচনা হয় পূর্বনির্ধারিত কিছু আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে।
তবে শেষ মুহূর্তে দেখা যায়, নতুন মতবাদের সাথে স্বর্গমুখী সনাতন ধর্মের অনেক সাদৃশ্য থেকে যায়। কারণ নতুন মতবাদও স্বর্গমুখী ধর্মের ন্যায় নিজের অবস্থান মজবুত করার জন্য শেষমেশ রাজনীতির আশ্রয় নিতেই বাধ্য হয়। তাই বিশ্বজনীন হলেও ঘুরেফিরে তা ধর্মীয় রূপ লাভ করে। দেখা যায়, এই মতবাদও সবার স্বার্থরক্ষা না করে বিশেষ জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষের আবেগের সনাতন ধর্মের প্রতিষ্ঠানগুলোর এতটাই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় যে, অনুসারিরা এর বিরুদ্ধাচরণকে পাপ মনে করে। এমনকি এগুলোকে শত্রু মনে করলেও সমাজে নিজের অবস্থান ও স্বার্থের চিন্তা করে এই পাপ থেকে অযৌক্তিকভাবে হলেও বিরত থাকে। তাই নতুন মতবাদ শুরুতেই এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং তার যাজকদের দোষসমূহ জনগণকে বোঝাতে থাকে যাতে তারা তাদের পাপবোধ থেকে বেরিয়ে আসে। তবে নতুন মতবাদ এই কাজ শূন্য হাতে করে না, তারা জনগণের সামনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকল্পও তুলে ধরে যাতে তারা আক্রমণে আরো উৎসাহিত হয়। তাই দেখা যায়, নতুন মতবাদ নিজের প্রতিষ্ঠার জন্য মূলত সমাজ মনস্তাত্ত্বিক পরিকল্পনা আশ্রয় নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ম থেকে রাষ্ট্র আলাদা হওয়ার কারণে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচুর স্বাধীনতা ভোগ করে। সরকারি সাহায্যের উপরও তাদের নির্ভরশীলতা অনেক কম। তবে রাষ্ট্র থেকে আলাদা হওয়ার অর্থ এই নয় যে, জাতীয় রাজনীতিতে ধর্মের কোন প্রভাব নেই। অধুনা দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রনীতির অনেক কিছুই নির্ভর করছে ধর্মের উপর। যখন রাষ্ট্র এবং চার্চের দূরত্ব সরকারিভাবে স্বীকৃত তখন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রসার বৃদ্ধি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। ফরাসি বিপ্লবেরও বহুপরে ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্র থেকে চার্চকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পৃথক করা হয়। তারপর তৃতীয় গণতন্ত্রের যুগে চরমপন্থি সমাজবাদী দলের জন্য ধর্মই ছিল তাদের কর্মকাণ্ডের বিরাট চালিকাশক্তি। কারণ গণতন্ত্র সত্ত্বেও তারা ধর্মের প্রতি ছিল খোলাখুলিভাবে সন্দিহান। এই ধর্মের বাহকরাই ভেতরে ভেতরে তখনো রাজকীয় শক্তির তাবেদারী করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই সন্দেহ আবার বিদ্রোহের রূপ নেয় যখন ক্যাথলিক চার্চ স্কুলসমূহের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রেও অনুরূপ ক্যাথলিক বিরোধী সমস্যা দেখা দেয়। সেখানে প্রটেস্টান্টরাই হচ্ছে এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ। তাই ইটালী, আয়ারলান্ড, পোল্যান্ড এবং অন্যান্য এলাকা থেকে আগত ক্যাথলিকরা ছিল সংস্কৃতিতে পিছিয়ে। তবে কয়েক প্রজন্মের পর এরাও খাঁটি মার্কিন হয়ে যায়। ফলে তারাও রাজনীতি, ধর্ম ও অর্থনীতিতে নিজেদের অবস্থান মজবুত করার সুযোগ পেল।
মার্কিন রাজনীতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ধর্মীয় বিদ্যালয়গুলোর সাথে সরকারের সম্পর্ক। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ের মাধ্যমে লুসিয়ানা রাজ্যের আইনকে সমর্থন জানান যার মাধ্যমে সরকারি এবং ধর্মীয় উভয় ধরনের স্কুলে বিনামূল্যে বই সরবরাহ করা হবে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দেও অনুরূপ বিনামূল্যে যাতায়াত ব্যবস্থা সরবরাহ করার জন্য নিউ জার্সি রাজ্যকে সমর্থন জানানো হয় (McSorley, 1947, p. 5০9)। তবে এসব বিষয় ছিল ভীষণ বিতর্কিত। যুক্তরাষ্ট্রে এখনো ক্যাথলিক এবং প্রটেস্টান্টদের মধ্যে অপ্রকাশিত রেষারেষি চললেও এসব সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উভয় ধরনের মতবাদই সমান সাহায্য পেয়ে থাকে, অন্তত শিক্ষা ক্ষেত্রে। তবে অনেকেই এর বিরুদ্ধে তাদের আপত্তি জানান। এই আপত্তিগুলো ছিল মোটামুটি নিম্নরূপ :
১. মূলত কংগ্রেস কখনো এমন কোন আইন পাস করতে পারে না যার মাধ্যমে ধর্মের অবস্থান মজবুত হতে পারে। কিন্তু ধর্মীয় স্কুলগুলোতে সাহায্য দিয়ে তাই করা হচ্ছে।
২. সুপ্রিম কোর্টে এই আইনের প্রতি সমর্থন জানালেও তা প্রত্যাহার করে দিতে পারে। কিন্তু অদ্যাবধি তা করা হয়নি।
৩. এই আইন হয়ত বা লুজিয়ান বা নিউজার্সির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে।
৪. যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে তাহলে মার্কিন সমাজ এক আমূল পরিবর্তন আসবে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৫৮টি ক্যাথলিক এবং ৩০০ হাজার প্রটেস্টান্ট স্কুল ছিল। ক্যাথলিক ছাত্র সংখ্যা ছিল ২,৬৯,৭০৬ এবং প্রটেস্টান্ট ছিল ১৮,৭০০ ( BY. Landis, ed., 1954, p. 297 )। এদিকে উচ্চ শিক্ষা ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ইহুদি ধর্মীয় বিদ্যালয়গুলোর সংখ্যা বাড়তে থাকে তাহলে সমাজ বিভক্তির মাত্রাও নিঃসন্দেহে বেড়ে যাবে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, যদি ক্যাথলিক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়তেই থাকে তাহলে দেখা যাবে রাষ্ট্র থেকে চার্চকে পৃথক করার জাতীয় নীতি একসময় অকার্যকর হয়ে পড়বে।
ধর্মনিরপেক্ষতা : ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যা
ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি বাংলা ভাষার নবীন আগন্তুক। এতই নতুন যে, তা কোন বাংলা অভিধানে এখনো প্রবেশাধিকার পায়নি। শব্দটি ইংরেজি সেকুলারিজমের অনুবাদ। সেকুলারিজম শব্দটি ইংরেজি ভাষায় চালু হয়েছে উনিশ শতকের মধ্যভাগে। ওর মূলে আছে সেকুলার কথাটা। প্রাচীন ফরাসি থেকে শব্দটা মধ্যযুগের ইংরেজিতে গৃহীত হয়েছিল অন্তত পনেরো শতকে। যে ল্যাটিন শব্দটি থেকে এর উৎপত্তি, তার অর্থ মূলে ছিল প্রজন্ম বা যুগ। তার থেকে খ্রিষ্টীয় ধর্ম বিষয়ক রচনায় শব্দটি ব্যবহৃত হয় ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কহীন কিছু সংযোগ অর্থাৎ ইহলোক ও তৎসংক্রান্ত ব্যাপার বোঝাতে। যে বাড়িঘর উপাসনার জন্য নির্মিত নয়, তা সেকুলার; যে শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মের পাঠ দেয় না, তা সেকুলার, যে ভাবধারা পার্থিব বিষয়ে সীমাবদ্ধ, তা সেকুলার। অতএব, সেকুলারিজম বলতে বোঝায় ইহজাগতিকতা। বাঙালিদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) শিক্ষাচিন্তায় ছিল এই চেতনা।
১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন ডানবুরি ব্যাপ্টিসদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের নীতিব্যাখ্যা করে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটিকে ভিত্তি ধরে আমেরিকান সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করে প্রথম সংশোধন করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উদ্ভব ঘটে ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের পর। ভাষায় ও সাহিত্যে সেকুলারিজম (secularism) বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন ব্রিটিশ লেখক জর্জ জ্যাকব হলিওয়েফ ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে। এর এক শ’ বছর পর এই উপমহাদেশে সেকুলার শব্দটি রাষ্ট্রচিন্তায় প্রথম ব্যবহার করেন জওহরলাল নেহেরু ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে। ভারত বিভাগের পূর্বাহ্নে ও পরে মহাত্মা গান্ধীও শব্দটি ব্যবহার করা শুরু করেন। (দেখুন, অন্নদাশঙ্কর রায়ের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ : সেকুলার স্টেট, পৃ. ১৩৪)। ধর্মনিরপেক্ষতার স্বীকৃতিই হল ধর্মের প্রথম পরাজয়। ধর্মের আবির্ভাবের সাথে সাথেই সমস্ত সমাজে ও সমস্ত যুগে ধর্মকে অস্বীকারের প্রবণতাও দেখতে পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে আস্তিক্য ও নাস্তিক্যের ইতিহাস সমান দীর্ঘ। এই দীর্ঘ ইতিহাসে ধর্মকে গ্রহণ না করা বা ধর্মকে সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ করে দেয়ার যত চেষ্টাই হয়ে থাক, পরিণামে ধর্মেরই জয় হয়েছে। নাস্তিক্য কোথাও কোন প্রতিষ্ঠা পায়নি। ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মই হয়ে থেকেছে সব-কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। ধর্মনিরপেক্ষতাই প্রথম ধর্মের অস্বীকৃতি।
ব্যক্তি, সমাজ রাষ্ট্র এই তিনটি ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকাকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ব্যক্তির মনে ধর্মের আশ্রয় তার মানসিক ও সামাজিক গঠনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধর্মের আশ্রয় তার মানসিক ও সামাজিক গঠনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধর্মের অবস্থান সেই সমাজের সামগ্রিক কার্যকলাপের ওপর নির্ভরশীল। নাস্তিক্যের ধাক্কায় ব্যক্তি জীবনে ধর্মের দরজা অনেক সময় বন্ধ হয়েছে। কিন্তু নাস্তিক নাগরিক সামাজিক কার্যলাপ ও রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে নিজেকে ধর্মীয় ধারার অঙ্গীভূত করতে বাধ্য হয়েছে। বিজ্ঞান পর্যন্ত দীর্ঘকাল ঈশ্বরের মহিমার স্বরূপ উদ্ঘাটন করাকে তার লক্ষ্য হিসেবে মনে করেছে। বিজ্ঞানীরা এই অর্থে প্রায় সকলেই ছিলেন ধার্মিক। অনেক খ্রিষ্টান পাদ্রীর বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম তো ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায়। কাজেই মানুষের কাছে সমাজজীবনের কোন ক্ষেত্রই ছিল না ধর্ম থেকে মুক্ত। জন্মগ্রহণ, শিক্ষারম্ভ, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ, বিবাহ, সামাজিক অনুষ্ঠান ও মৃত্যুর প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্ম একেবারে সান্ত্রির মত দণ্ডায়মান। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস, বিধান মানুষের জীবনকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ হল এই ধর্মীয় বেষ্টনী থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের মুক্তি।
প্রশ্ন হল ধর্মনিরপেক্ষতা কি ধর্মহীনতা? শব্দগত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতা দুটি পৃথক কথা। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থে ধর্মশূন্যতা ও ধর্মহীনতা তো অবশ্যই আছে। রাষ্ট্র যেহেতু সর্বশক্তিমান সুতরাং সে ধর্মহীন হলে তার পক্ষে ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করাও সম্ভব। কিন্তু ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কথার ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রশক্তিকে ধর্মের বিরুদ্ধাচরণের ভূমিকায় নামা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। সামাজিকভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে ধর্ম আচরণের ওপর হস্তক্ষেপ না করার মধ্যেই ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ নিহিত। শুধু রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপকে বিবেচনা করলে, সেখানে যে ধর্ম নেই তা নিঃসন্দেহ। একমাত্র মাও সেতুংয়ের চীনে রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে নতুন অর্থ আনার চেষ্টা হয়েছিল। সেখানকার রাষ্ট্রীয় সনদে ধর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছিল, প্রত্যেকের ধর্ম আচরণের অধিকার থাকবে, ধর্ম আচরণ না-করার অধিকার থাকবে এবং ধর্মের বিরুদ্ধতা করার অধিকার থাকবে। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কোন রাষ্ট্র সংখ্যাগুরুর ধর্মের প্রতি আনুগত্য ও অন্যান্য ধর্মের প্রতি সহনশীলতাকে বোঝায়। কোন কোন রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে সব ধর্মের প্রতিই রাষ্ট্রীয় সহনশীলতাকে বোঝায়। এই জাতীয় চিন্তা আসলে ধর্মের গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে না-আসতে পারার ফলশ্রুতি। প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া এই জাতীয় ‘সর্ব ধর্ম গ্রহণীয় ধর্মনিরপেক্ষতা’ শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় রাষ্ট্রের চরিত্র অর্জন করে। যদিও আধুনিক কোন রাষ্ট্রের পক্ষেই পুরোপুরি ধর্মীয় রাষ্ট্র হওয়া আজ আর সম্ভব নয়। কারণ সব ধর্মই নিদারুণভাবে অনাধুনিক।
ইউরোপের রাষ্ট্রশক্তি চার্চের সঙ্গে সরাসরি দ্বন্দ্বে নামতে বাধ্য হয়েছিল। জমির মালিকানায় চার্চগুলি ছিল প্রধান ভূমিকায়। চার্চের জমিগুলো অধিগ্রহণকেই ইউরোপে বলা হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। ফ্রান্স ও জার্মানিতে এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ধর্মনিরপেক্ষতা জীবনের বাস্তব প্রয়োজনীয়তার উত্তরে এক বিশেষ নীতিবোধ হিসাবে দেখা দিল। ধর্মীয় কার্যক্রমের প্রাধান্যকে তা অগ্রাহ্য করে। অভিজাত শ্রেণি ও ধনীদের অত্যাচার ধর্মীয় গোঁড়ামির নানা সূত্র ধরে চার্চের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের উপর নেমে আসত। ফলে ধর্মনিরপেক্ষতা রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে আবির্ভূত হল।
নিরপেক্ষ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অপেক্ষারহিত; ওতে কর্মসম্বন্ধহীন, প্রয়োজনরহিত বা উদাসীন বোঝায়। ধর্মের সঙ্গে যে বিষয়ের সম্পর্ক নেই, তা ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তবে নিরপেক্ষতা শব্দের ব্যাপকতর প্রচলিত অর্থ পক্ষপাতহীনতা। তাই অনেকে মনে করেন, নাগরিকদের মধ্যে প্রচলিত একাধিক ধর্মের মধ্যে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হল। যেমন, টেলিভিশনে একই সঙ্গে কুরআন, গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল পাঠ করলে বোঝা গেল রাষ্ট্র কোনটির প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে না। আসলে রাষ্ট্রের পক্ষে কোন ধর্মের বা ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে সংস্রবহীনতাই হল ধর্মনিরপেক্ষতা।। আমাদের বহু নেতা ও মনীষী বহুবার বলেছেন যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।’ একথা ভারতীয় নেতা ও মনীষীর অনেকের মুখেও শোনা গেছে। কিন্তু এতে ঠিকমতো বোঝা যায় না রাষ্ট্র ধর্মীয় ব্যাপারে জড়িত হবে না, ধর্ম থাকবে মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের বিষয় হয়ে– এই হল রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথা।
কেউ কেউ বলেন, মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ না হলে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হবে না। একথা গ্রাহ্য নয়। যিনি ধার্মিক, তিনি অসাম্প্রদায়িক হতে পারেন, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভবপর নয়— অন্তত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। কেননা বেশিরভাগ ধর্মেই জোর দেওয়া হয়েছে পরলোকের ওপরে— সেখানেই অনন্ত জীবনলাভের সম্ভাবনা। খুব কম ধার্মিক মানুষই পরলোকের ভাবনা ত্যাগ করে ইহলোকমুখী হবেন।
কিন্তু ব্যক্তি যা পারে না, রাষ্ট্র তা পারে। ধর্মের বিষয়ে মাথা না গলিয়েও রাষ্ট্র চলতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সেভাবেই চলে। সেখানে ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। ব্যক্তির ধর্মপালনের স্বাধীনতা সেখানে থাকে— আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে আর দশটা স্বাধীনতার মত ধর্মীয় স্বাধীনতাও শর্তাধীন হয়ে থাকে। সেখানে রাষ্ট্রের লক্ষ্য হয়, নাগরিকের ইহজীবনকে সুখী ও সার্থক করে তুলতে সাহায্য করা।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু (১৮৯৭-১৯৪৫) দক্ষিণপন্থি কংগ্রেস জোট ছেড়ে তাঁর নতুন রাজনৈতিক দল ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’ গঠন পরবর্তী (২২শে জুন) এক ভাষণে বলেন :
‘ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে রাজনীতি হইতে বাদ দেওয়া উচিত।… ধর্মীয় কিংবা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত নয়, ইহা পরিচালিত হওয়া উচিত শুধু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক বিচারবুদ্ধির দ্বারা।’
সেকুলারবাদকে নিয়ে ভারতীয় সুপ্রিট কোর্টের ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের রায়ে বলা হয়েছে : …It may be that these words are used in a speech to promote secularism or to emphasise the way of life of the Indian people and the Indian culture or ethose, or the criticise the policy of any political party as discriminatory or intolerant । ‘Indian people’ ও Indian culture’। কথা দুটির তাৎপর্যের মধ্যেই রয়েছে ভারতীয় সেকুলারিজমের মূল আদর্শ। ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘It asserts the freedom of religion, and freedom from religion. Within a state that is neutral on matters of belief, and gives on state privileges or subsidies to religion…from religious test, or visiting a place of worship are examples of non-secular activities.’ কিন্তু বাস্তবে এর বিপরীত চিত্রই আমরা দেখি। আসলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই তাত্ত্বিক সেকুলারবাদ অনুপস্থিত।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছে। পঞ্চম সংশোধনীতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়েছে। সংবিধানে অনুচ্ছেদ (২ক) উল্লিখিত হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ এটি একটি কপট, অসৎ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতারণামূলক বাক্য। কেননা একটি ধর্মকে শ্রেষ্ঠ মর্যাদায় প্রতিপন্ন করে অন্যগুলোর সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করা যায় না। রাষ্ট্রের শিরোনামের অভ্যন্তরে যেমন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ শব্দটির অপপ্রয়োগ চলছে (কারণ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কেউ কারো প্রজা নয়), তেমনি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে সমঅধিকার নিশ্চিত করার কথাও একটি প্রতারণামূলক অপব্যাখ্যা।
ইসলাম কতদূর একটি বিশিষ্ট রাষ্ট্রের ধর্ম হতে অনুমোদন দেয়? ইসলাম একটি সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন ধর্ম, কোরানে বিধাতাকে বলা হয়েছে রাব্বুল আলামিন, সর্বমানবের বিধাতা; রাব্বুল মুসলেমিন নয়। মুসলমানের বিধাতা নয়। আর ইসলামের নবীকেও বলা হয় ‘রহমাতুল্লীল আলামীন’—সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ। এই তাৎপর্যে তিনি তো কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য সুনির্দিষ্ট নন— সকল বিশ্বমানবের আশীর্বাদস্বরূপ। এজন্য ইসলামের মহানবীকে দলীয়করণ করার প্রবল প্রতিবাদে নজরুলের কবিতায়ও উচ্চারিত হয়েছে: ‘কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি কো ইসলাম।’ কেননা ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলে, ইসলাম সে দেশের মুসলিমদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম অধিকারের অধীন হয়ে যাচ্ছে ইসলাম তার সর্বজনীনতা হারাচ্ছে। তার বিশ্বজনীনতা খর্ব হচ্ছে। ইসলাম তাই এক খলিফার অধীন বিশ্বে একটি মাত্র মুসলিম রাষ্ট্রের কল্পনা করা হয়েছে, যা আব্বাসী খলিফাদের শাসনের শেষদিকে নষ্ট হতে শুরু হয় এবং ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে তুরস্কের মুস্তফা কামালের খেলাফত বিলোপের পর এক খেলাফতের অধীনে নামমাত্র মুসলিম আনুগত্যও শেষ হয়েছে। কোন ভৌগোলিক সীমাবদ্ধ জাতীয় রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলামের নীতিমালার মধ্যে আসে না। ইসলামে এর কোন অনুমোদন নেই। দুঃখের বিষয়, এ বিষয়ে আমাদের দেশে ইসলামি আলেমরা নীরব।
রাষ্ট্রের দিক থেকে দেখা যাক। জাতিসংঘের ঘোষিত মানবাধিকার সনদে বলা আছে জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং এই সার্বভৌম জনগণ যখন তাদের রাষ্ট্র গঠন করে, তারা হয় নেশন বা জাতি এবং রাষ্ট্র হয় নেশন স্টেট বা জাতীয় রাষ্ট্র। সার্বভৌমত্ব হচ্ছে বহির্বিশ্বে ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোন বিশ্বাস বা মতবাদ কোন কিছুই সার্বভৌমত্বের ওপরে নয়, বরং সবই অধীন, এমনকি ধর্মও। যদিও ধর্মমত সার্বভৌম হয়ে থাকে, তবে রাষ্ট্রকে সেই মতের অধীন হয়ে চলতে হবে, বর্তমান জাতিসংঘের নীতিমালায় তা স্বীকৃত নয়। তারপর ধর্মনীতির ব্যাখ্যা বা তা কার্যকর করতে মানব সংগঠন বা ব্যাখ্যাকার দরকার হয়— সৃষ্টি হয় ধর্মতন্ত্র বা থিয়োক্রেসি। উদ্ভব হয় যাজক বা পুরুতশ্রেণির, যারা সরকার অর্থাৎ জনগণের প্রতিনিধির কর্তৃত্ব না মেনে আপন কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেয় তাদের ওপর। পরিণামে জনগণের ওপর আবির্ভূত হয় জনপ্রিতিনিধিত্বহীন বিভিন্ন প্রকার স্বৈরতন্ত্র, হয় একনায়কত্ব কিংবা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতন্ত্র। বর্তমান যুগে এই তন্ত্রের স্বীকৃতি নেই, আমাদের সংবিধানেও নেই, বরং আছে ৭ অনুচ্ছেদে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে।’ ইসলামের মত আপন নীতিমালাসম্পন্ন ধর্ম রাষ্ট্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। আবার সার্বভৌম রাষ্ট্র ইসলামের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। এর মীমাংসা হতে পারে রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতিকে ধর্ম থেকে পৃথক করে। বস্তুত রাষ্ট্র মানবের বা নাগরিকের আচরণের, তার শান্তি- শৃঙ্খলাজাত আচরণের নিয়ন্ত্রণ করে, কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা ধর্মীয় চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে না, যদি-না সেই বিশ্বাসী বা ধর্মাবলম্বী আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা সৃষ্টি করে। তা হলে কোন রাষ্ট্র যদি ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণা করে, সেই রাষ্ট্র ইসলামের নামে ধর্ম নয়, সাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠা করে।
তাছাড়া ধর্ম, ধার্মিক, ধর্মান্ধতার বহিঃপ্রকাশ এবং এসবের গূঢ় অর্থ নিয়ে আমাদের নাগরিক সমাজে চিন্তা-ভাবনা ও সিদ্ধান্তে সুস্পষ্ট কোন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নেই। ফলে শিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত সকলের চিন্তা জগতে বিশেষত ধর্ম চিন্তা নিয়ে একটি দ্বিবিভাজনমূলক ধারণার (dichotomous idea) অনুবর্তী হতে দেখা যায়। ফলে চিন্তাশীলতার ক্ষেত্রে সমাজে কোন সমন্বিত সহমত গড়ে ওঠেনি। কেননা-
১. ‘বিশ্বাস হিসেবে ধর্ম’ (religion as faith) এবং ‘মতাদর্শ’ হিসেবে ধর্ম’ (religion as ideology) এক কথা নয়;
২. ‘ধর্মপ্রাণ’ ও ‘ধর্মান্ধ’ এক কথা নয়;
৩. ‘ধর্ম বিশ্বাস’ ও ‘ধর্মীয় গোড়ামি’ এক কথা নয়;
৪. ‘ধার্মিক’ ও ‘ধর্মান্ধতা’ এক কথা নয়;
৫. ‘ধর্মভীরু’ ও ‘ধর্মীয় কসুংস্কারাচ্ছন্নতা’ এক কথা নয়;
৬. ‘ধর্ম’ (religion) এবং ‘ধর্ম নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি’ (perception of religion) এক কথা নয়;
৭. ‘ধর্মপ্রবণ’ ও ‘ধর্মীয় কুসংস্কারপ্রবণ’ এক কথা নয়।
তাই দ্বিবিভাজনের এ বিষয়টি ধারণাগত ও নীতিগত উভয় দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সন্ধিৎসু হলে দেখা যাবে ‘অ-সাম্প্রদায়িকতা’ (Secularism) ও ‘ধর্ম-নিরপেক্ষতাহীনতা’ সমার্থক নয়। (আবুল বারকাত, ধর্মভিত্তিক মৌলবাদ ও মৌলবাদী জঙ্গিত্ব : রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সূত্রবদ্ধকরণ)।
এইবার বর্তমান জগতে ধর্ম সম্বন্ধে চিন্তাবিদদের ধারণা কী, দেখা যেতে পারে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় বলা হয়েছে, ‘religion, man’s relation to that which he regards as holy. The holy need not be thought of a supernatural much less as personal, and if the word god be defined in personal or supernatural terms, it follows that religion includes far more than relation to God a god’। অর্থাৎ ধর্ম হচ্ছে মানব চেতনা বা পবিত্র বলে সম্পৃক্ত, পবিত্র বলতে অতিপ্রাকৃতিক বা কেবল ব্যক্তি সম্পর্ক বোঝায় না এবং ঈশ্বরকে যদি ব্যক্তিগত বা পারলৌকিক ধারণাগত জ্ঞান করা হয়, ধর্ম তবে এর সঠিক পরিধি নিয়ে সৃষ্ট। বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে মানবের চিন্তাজনিত বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত ভাবধারার দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়। তার বিশ্বাসের যুক্তিগত বা বাস্তবসম্মত যথার্থতার ওপর নয়। কোন ব্যক্তি আপন বিদ্যাবুদ্ধির সীমাবদ্ধতার মধ্যে জীবনযাপনে তার চিন্তা চেতনা যাকে পরম বা পবিত্র জ্ঞান করে, সেটাই তার ধর্ম বিশ্বাস। এই সংজ্ঞা অনুসারে ধর্মমত প্রধানত ব্যক্তিগত ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং ব্যক্তিবিশেষের পার্থক্যের মত সংখ্যা বহু এবং গোষ্ঠীগত একটা রূপ থাকলেও, তা ব্যক্তি পর্যায়ে থাকে। বিষয়টি এতই বাস্তব ধরা ছোঁয়ার বাইরে যে, রাষ্ট্রের আইনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এই বিশ্বাসের অস্তিত্ব রাষ্ট্রের জন্য অবান্তর না হলেও তার কার্যকারিতার জন্যে অপরিহার্য নয়। এক কথায়, ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। রাজনীতি থেকে পৃথক। সুতরাং রাষ্ট্র কাউকে বিশ্বাসের জন্য বন্দি করতে পারবে না, যাকে বলে বিবেকের বন্দি ( prisoner of conscience)। তেমনি কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাদের ধর্ম-বিশ্বাস রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। তাই মানবাধিকার ঘোষণার ১৮ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘Everyone has the right to freedom of thought, concience and religion. This right includes freedom to change his religion or belief and freedom either alone community with others and in public or private to manifest his religion or belief in teaching practice, worship or observance’- অর্থাৎ প্রত্যেক মানবের তার স্বাধীন চিন্তা, বিবেক ও ধর্ম বিশ্বাসের অধিকার আছে। এই অধিকারের মধ্যে সংশ্লিষ্ট আছে ধর্ম ও বিশ্বাস পরিবর্তনের স্বাধীনতা এবং একক বা যৌথভাবে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে তার ধর্ম বা বিশ্বাসের শিক্ষা, প্রথা, উপাসনা ও আচরণ জনসমক্ষে ব্যক্ত করার অধিকার। স্মরণ রাখতে হবে, জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য-বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম-জাতিসংঘের সনদের ৫৫ ও ৫৬ অনুচ্ছেদ মত এই ঘোষণাপত্রের মূলনীতি একক ও যৌথভাবে পালন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। ধর্মকে রাষ্ট্র কতটা ও কীভাবে ব্যহার করতে পারে, জাতিসংঘের সনদে তা যথেষ্ট স্পষ্টতার সাথে ব্যক্ত।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আর হীনস্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার— দুটোই বাংলাদেশে আছে, এবং হীন-স্বার্থান্বেষীরা সুবিধামতো দুটোকে একসঙ্গে গুলিয়ে দেয়। এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, প্রগতির পথ রুদ্ধ হয়, সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়, হীন স্বার্থান্বেষীরা লাভবান হয়, জাতির আর্থ- সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ব্যাহত হয়। গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী দ্বারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম যেভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তাতে সমস্যা অত্যন্ত জটিল রূপ ধারণ করেছে। এদেশের জনগণের উন্নতির উপায় করতে হলে এ সমস্যার মীমাংসা খুঁজতে হবে।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ভালো-মন্দ সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার করার পর আমাদের দেখা দরকার হীনস্বার্থান্বেষীদের হীনস্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহারের ব্যাপারটি। আজকের দিনে সমস্যা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে নয়; সমস্যা রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার নিয়ে। দেখা যায়, রাজনীতিতে যখন গণতন্ত্রের অপব্যবহার চলে, তখন তার পাশে ধর্মের অপব্যবহারও জোরদার হয়।
রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার এখন পরিকল্পিতভাবে বিশ্বব্যাপী চালানো হচ্ছে। তাই ব্যাপারটিকে পরিপূর্ণ গুরুত্ব দিয়ে বোঝা দরকার। হয়ত বৰ্তমান এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার, কিংবা বিশ্ববিস্তৃত মুক্ত বাজার অর্থনীতির, অথবা অবাধ প্রতিযোগিতাবাদের উপক্রমণিকা রূপেই রাজনীতিতে ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটানো হয়েছে এবং ধর্মকে পরিণত করা হয়েছে আদর্শগত প্রতারণার প্রধান হাতিয়ার। এক্ষেত্রে রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের ভূমিকা রহস্যজনক। আসলেই কি তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী? তাঁদের বিচারে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কী? গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের অবলম্বন ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের মূল্যবোধ আর নৈতিক চেতনার স্বরূপ কী?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, অন্ধ আবেগ দ্বারা চালিত না হয়ে মানুষ যেন প্রজ্ঞাসম্মত মহৎ জীবনযাপন করতে পারে, সেজন্য তাদের সহায়তা করার লক্ষ্যেই উদ্ভব ঘটে রাষ্ট্রের।…
বিখ্যাত রুশ বিপ্লবী এবং সম্মিলিত নৈরাজ্যবাদ তত্ত্বের প্রবক্তা মিখাইল আলেক্সভিচ বাকুনিন (১৮১৪-১৮৭৬) মনে করেন, ‘ধর্ম বোকার কাছে সত্য, জ্ঞানীর কাছে মিথ্যা এবং শাসকের কাছে অস্ত্র’ (The God and ‘State ঈশ্বর এবং রাষ্ট্র)। বাংলার লোকধর্মের অবিস্মরণীয় গবেষক অক্ষয়কুমার দত্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুসৃত লোক সম্প্রদায়ের ধর্ম বিশ্বাসের মনোজাগতিক বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন : ‘পৃথিবীতে ধর্মের কারণে যত যন্ত্রণা, যত নরহত্যা ও যত রক্তপাত হয়েছে, এতটা আর অন্য কিছুতে হয়েছে কিনা সন্দেহ। কি পুরোনো, কি নতুন, কি বিলুপ্তপ্রায়, কি উদীয়মান, সকল ধর্মই বিদ্বেষ কলুষে কলুষিত হয়ে অধর্মের ক্রোড়ে অধিষ্ঠিত ও পরিপালিত হয়ে এসেছে। (অক্ষয়কুমার দত্ত, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়)।
তাই বিভিন্ন ধর্মের ভেতর বাস করার কারণে অন্য ধর্ম সম্পর্কে জানা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশের প্রচুর মানুষ বিদেশে যাচ্ছে। অন্য দেশের সংস্কৃতি না জেনে সেখানে গেলে হোঁচট খাবে। সে দিক থেকে চিন্তা করলে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। প্রতিবছর আমাদের দেশে সনদধারী লোকের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বাড়ছে না। আমরা বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করছি। কিন্তু শিক্ষা বলতে যা বোঝায়, সে শিক্ষা আমাদের অন্তরে প্রবেশ করছে না। আমরা ডিগ্রিধারী, সনদধারী কিন্তু শিক্ষিত না। আমরা যদি শিক্ষিত হতাম, তাহলে আমরা অন্যায়কে ‘অন্যায়’ বলে ভাবতাম। আরেকজনের মাথায় আঘাত করতে পারতাম না। আমরা যদি নিজের ধর্মকে ভালো করে জানতাম, তাহলে অন্যের ধর্মের ওপর আঘাত আনতে পারতাম না। ঘৃণা করতে পারতাম না।
মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দীন মুহম্মদ বাবর (১৪৮৩ – ১৫৩০ ) তাঁর আত্মচরিত বিখ্যাত ফারসি গ্রন্থ বাবুরনামা। এটি ফারসি সাহিত্যেরও একটি অমূল্য সম্পদ। পুত্র হুমায়ূনের উদ্দেশ্যে তিনি যে উপদেশ-লিপিকা বা ওসিয়তনামা রেখে যান, তাতে আমরা আকবরের রাষ্ট্রনীতির অঙ্কুর বা পূর্বাভাষ দেখতে পাই। বাবর তাঁর ওসিয়তনামায় লিখেছেন :
‘সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্য এই ওসিয়ত লিখিত হল। হে আমার পুত্র, ভারত- সাম্রাজ্য বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকের দ্বারা অধ্যুষিত। খোদাকে ধন্যবাদ (তিনি বিচারক, মহান এবং সর্বোচ্চ) যে, তিনি এই ভারত-সাম্রাজ্যের শাসনভার তোমার হস্তে অর্পণ করেছেন। তোমার কর্তব্য হচ্ছে, সর্বপ্রকার গোঁড়ামি থেকে নিজের অন্তরকে মুক্ত করে, প্রত্যেক জাতির প্রতি সুবিচার করা—তাদের ধর্মের নির্দেশ অনুযায়ী। আর তোমার প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ, তুমি গরু কোরবানি (গোহত্যা) বর্জন করবে। কেননা, ভারতবাসীদের অন্তর জয় করবার এই হচ্ছে সহজপন্থা। আর তোমার এই উদারতার পরিচয় পেলে দেশের প্রজাপুঞ্জ তোমার একান্ত ভক্ত এবং অনুরক্ত হয়ে পড়বে। তুমি কোন জাতির বা ধর্মের মন্দির এবং ধর্মালয়ের কখনও কোন ক্ষতি করো না। ন্যায় বিচার করবে, কেননা তাহলে প্রজাদের নিয়ে তুমি সুখে থাকবে, আর প্রজারাও তোমার শাসনে সুখে থাকবে। ইসলামের সম্প্রসারণের শ্রেষ্ঠতর উপায় হচ্ছে দয়ার তরবারি, অত্যাচারের তরবারি নয়।
শিয়া এবং সুন্নিদের তর্কাতর্কি এবং কলহ-কোন্দলের মধ্যে থাকবে না। এই বিসম্বাদই হচ্ছে ইসলামের দুর্বলতা। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী প্রজাদের সেইভাবে মিলিত এবং সংমিশ্রিত করবে, যেভাবে বিশ্বের চারটি উপকরণ (জল, বায়ু, অগ্নি এবং মৃত্তিকা) সংমিশ্রিত হয়ে থাকে; অর্থাৎ রাষ্ট্রদেহে যাতে কোন ব্যাধি দেখা না দেয়, সেইদিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করবে। আর প্রপিতামহ তাইমুরের কীর্তিকলাপের কথা মনে রাখবে, কেননা, তাহলে তুমি রাজ্য শাসনের ব্যাপারে দক্ষতা লাভ করবে। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে উপদেশ দেওয়া।
–১লা জামাদি উল-আউয়াল ৯৩৫ হিজরী (১১ই জানুয়ারি, ১৫২৯ খ্রিষ্টাব্দ)।
মোহাম্মদ আবদুল হাই, বাংলাদেশে ফারসিভাষা ও সাহিত্যচর্চার ইতিহাস; ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস, ঢাকা, ২০১২।
ধর্মীয় চিন্তার স্বাধীনতা : পরিধি ও প্রশ্রয়
ফরাসি দার্শনিক ও চিন্তাবিদ জাঁ জ্যাক রুশোর সেই বিখ্যাত উক্তি আমরা এখানে স্মরণ করতে পারি : Man is born free, and every where he is in chains. One man thinks himself the master of others, but remains more of a slave than they are.
আধুনিক যুগের একটা মস্ত বড় প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন দার্শনিক ইকবাল। তা হচ্ছে, এ যুগে কি ধর্মের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভবপর? প্রশ্নের মীমাংসার আগে ইকবাল ধর্মীয় জীবনের অর্থের বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে তিনটি পর্যায় আবিষ্কার করেছেন। তাঁর মতবাদ অনুসারে প্রথম পর্যায়ে ধর্মীয় জীবনে রয়েছে অত্যন্ত জোরালো প্রত্যয়। ধর্মীয় জীবনের এ প্রবণতা সামাজিক জীবন গঠনের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হতে পারে, তবে ব্যক্তিজীবনের বৃদ্ধি বা প্রসারতার পক্ষে এ পর্যায় মোটেই অনুকূল নয়। এ পর্যায়ে ধর্মীয় নীতির কাছে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করার পর ধর্মীয় জীবন তার মূলনীতিকে দার্শনিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তৃতীয় পর্যায়ে ধর্মীয় জীবনে মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা দেখা দেয় এবং ধর্মীয় জীবনের অনুশীলনে লিপ্ত মানুষের মনে সেই আদিম সত্তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়। এ পর্যায়েই ধর্মের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জীবন ও শক্তি লাভের প্রবণতা দেখা দেয় এবং ব্যক্তি তার ব্যক্তিজীবনের স্বাধীনতা লাভ করে। ধর্মের এ তৃতীয় পর্যায় সম্ভবপর কি না ইকবাল তাঁর The Reconstruction of Religious Thought in Islam (ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন) গ্রন্থে সে প্রশ্নই উত্থাপন করেছেন এবং দেশ-বিদেশের নানা জ্ঞানীর মতবাদ নিয়ে আলোচনা করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে ধর্মের পক্ষে আধুনিক যুগেও টিকে থাকা সম্ভবপর।
আল্লামা ডক্টর মুহাম্মদ ইকবালের (১৮৭৭-১৯৩৮) মতে, দর্শনশাস্ত্রে আল্লাহকে বিশ্ব-কারণস্বরূপ গ্রহণ করে এর তাৎপর্য অনুসন্ধানে আত্মনিয়োগ করে এবং কালকে গ্রহণ করে কার্যকারণ সম্পর্কের সারস্বরূপ। এমতাবস্থায় তার পক্ষে আল্লাহকে বিশ্বজগৎ সৃষ্টির পুর্বে থেকে বিরাজমান এবং তার ওপর বাইরে থেকে ক্রিয়াশীল একটি ইন্দ্রিয়াতীত অস্তিত্ব হিসেবে মেনে না নিয়ে উপায়ন্তর থাকে না। কাজেই আল্লাহকে মনে করা হয়েছে কারণ-শৃঙ্খলের শেষতম গ্রন্থি— তথা, বিশ্বজগতে যা কিছু হচ্ছে, তা তার আসল কারক। (আল্লামা ডক্টর মুহাম্মদ ইকবাল, ‘মানুষের খুদি : তার স্বাধীনতা ও অমরতা’ শীর্ষক বক্তৃতা)।
জার্মানিতে যুক্তিবাদের উদ্ভব হয়েছিল ধর্মের সহায়ক হিসেবে। কিন্তু যুক্তিবাদী দর্শন অচিরেই বুঝতে পারল যে ধর্মের যেটা বিধি-ব্যবস্থার দিক, সেটা কার্যত প্রমাণ করা যায় না। কাজেই সে দর্শনের পক্ষে ধর্মশাস্ত্রের ডগমাভিত্তিক বিধিব্যবস্থাগুলোর একেবারে পরিহারের পথই শুধু খোলা ছিল। আর ডগমাকে বিদায় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক বিধান সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি দেখা দিল, তাকে হিতবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বলা চলে। এভাবে যুক্তিবাদ ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করা দূরের কথা, অবিশ্বাসের রাজত্বকেই কায়েম করে তুলল। জার্মানিতে ধর্মীয় চিন্তার যখন এই অবস্থা, তখনই হল দার্শনিক কান্টের আবির্ভাব। তিনি লিখলেন Critic of Pure Reason নামক একটি অমর গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি দেখালেন যে, মানুষ যে-যুক্তির এত বড়াই করে, তার ক্ষমতা একান্ত সীমাবদ্ধ। তাঁর সমালোচনার ফলে যুক্তিবাদীদের সমস্ত যুক্তি ও সিদ্ধান্ত ধূলিসাৎ হয়ে গেল। কাজেই কান্টকে তাঁর দেশের প্রতি আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম দান বলে আখ্যায়িত করা খুবই ঠিক হয়েছে।
ইসলামি জগতে ইমাম গাজ্জালির দার্শনিক সংশয়বাদও অনুরূপ বিপ্লবাত্মক। জার্মানির কান্ট-পূর্ব যুগের ন্যায় ইসলাম জগতেও যুক্তিবাদ এমন একটা রূপ নিয়েছিল, যার মূলে ঔদ্ধত্য ছিল প্রচুর, কিন্তু গভীরতা ছিল না আদৌ। এহেন যুক্তিবাদের মূলে ইমাম গাজ্জালি হানলেন দুর্বার আঘাত। তবু ইমাম গাজ্জালি ও কান্টের মধ্যে রয়েছে একটা মস্ত পার্থক্য। কান্ট আল্লাহ সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞানের সম্ভাবনাকে স্বীকার করতে পারেননি। এর জন্য দায়ী তাঁর অনুসৃত চিন্তাপদ্ধতি। গাজ্জালি দেখলেন যে যুক্তিতর্ক বা বিশ্লেষণী চিন্তার দ্বারা আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভের আশা বৃথা। তাই তিনি শুষ্ক চিন্তার সাহারা থেকে মরমিসুলভ অভিজ্ঞতার বাগিচায় হিজরত করলেন। সেখানে তিনি ধর্মের স্বাধীন সত্তার সন্ধান পেলেন। এই রূপে তিনি বিজ্ঞান ও তত্ত্বশাস্ত্রের নির্ভরতা ছাড়াই ধর্মের বেঁচে থাকার অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। ইমাম গাজ্জালি তাঁর মরমি অবিজ্ঞতার আলোতে প্রত্যক্ষ করলেন গোটা অসীমের রূপ। এই থেকে এই ধারণা তাঁর মনে শিকড় গেড়ে বসল যে মানুষের চিন্তাশক্তি একান্ত সীমাবদ্ধ, তা কোন চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে অসমর্থ। তাই তিনি চিন্তা এবং স্বজ্ঞার মধ্যে টানলেন একটা স্পষ্ট বিভেদরেখা। কিন্তু চিন্তা (thought) এবং স্বজ্ঞার (intuition) যে একটা অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে, তা তিনি ধরতে পারলেন না। এটাও তিনি খেয়াল করতে পারলেন না যে যেহেতু পরপর চলমান সময়ের সঙ্গে চিন্তা অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত, সে জন্যই মনে হয় চিন্তা অসীমও নয় আর তা কোন সিদ্ধান্তেও আসতে পারে না।
ধর্মদ্রোহী মুরতাদ আইন : শাস্ত্র বনাম সমাজ
Encylopedia Britanica, এর Religion শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে:
‘Religion, man’s relation to that which he regards as Holy. The Holy need not be thought of as supernatural, much less as personal; and if the word God be defined in personal or supernatural terms, it follows that religion includes far mare than the relation of God or a god. Similarly, the phrase relation to the holy may be conceived of in a varieth full forms. Worshipes probably the most basic of these, but moral conduct, right belief, and participation in religious life as practiced by believers and worshippers and as commanded by religious ages and scriptures.
ইংরেজিতে Religion শব্দটি প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহৃত, যার তাৎপর্যে বলা হয়েছে Human recognition of a personal God Entrusted to abiding a system of faith and worship। অনেকে মনে করেন Religion is the private relation between man and God। অন্য গ্রন্থের ক্ষেত্রে এ ধারণাটি বর্তমানে যথার্থ হলেও ধর্মকে এভাবে ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ করা ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত বিবেচনা। জীবন ব্যবস্থার ব্যবহারিক বিধান সম্পর্কে আল কুরআন বলছে :
‘হে ইমানদারগণ, তোমরা পূর্ণাঙ্গ ইসলামের মধ্যে দাখিল হও, এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না, কেননা সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।’ (২: 2০8 )।
মানুষের জীবন যেহেতু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ইত্যাদি বিষয়ের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, সেহেতু ইসলাম ঐ সমস্ত কিছুতে আল্লাহর আদেশ ও নির্দেশ মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রেখে দিয়েছেন, যেখানে প্রসাব-পায়খানার বিধানও মুসলমানকে মেনে চলতে হয়। তাই সেখানে সীমাবদ্ধতা আছে, যেটা অন্য ধর্মের বেলায় প্রয়োজন হয় না, অথবা সেভাবে তারা চিন্তাই করেন না। ইসলামের ঐ সীমাবদ্ধতাকে ইসলাম বিরোধী মানুষেরা মেনে নিতে রাজী নয়। এর কারণ হল প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের আদেশ-নিষেধ মেনে চললে তারা তাদের রিপুর চাহিদাকে মেটাতে পারে না এবং রাজনীতির চেতনায় যে বিলাসের বাহুল্য এবং ক্ষমতার আত্মঅহংকার সেখানে থাকে না। তাদের মনে ঐ অবস্থা দুটো কারণে ঘটে, তার একটি হল বিরুদ্ধবাদীদের মৌলিক বিশ্বাসে আল্লাহর সত্বাকে স্বীকৃতি না দেয়ার মানসিকতা এবং দ্বিতীয় বিষয়টি হল সৃষ্টি সংক্রান্তে তাদের জ্ঞানের অভাব। মানুষ তার অজ্ঞাতে ঐ দুটো কারণে শয়তানের সহায়তায় নিজেকে অহংকারের আমিত্ব দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে এবং যখন সীমাবদ্ধ বিধানে তার অপকর্মের প্রতিবন্ধকতা দেখতে পায়, তখন সে সীমাবদ্ধাকে তার যুক্তি দিয়ে, শক্তি দিয়ে এবং কৌশল দিয়ে সড়াতে চেষ্টা করে এবং এক পর্যায়ে তার অহং আত্মচেতনা ইসলামের সীমাবদ্ধ বিধানের প্রতি আক্রমণ করে বসে। আল-কুরআনে বলা হয়েছে— ‘মানুষ সীমালংঘন করে এ কারণে যে সে নিজেকে স্বয়ং সম্পূর্ণ দেখতে পায়।’ (১৬ : ৬-৭)
ঐ আয়াত থেকে বিবেচিত যে মানব গোষ্ঠী তারা বেশ ঝগড়াটে হয়ে ইসলামের মৌলিক বিধানের যে বিষয়গুলোর প্রতি কটাক্ষ বা উপহাসমূলক মন্তব্য রাখে তা নিম্নরূপ :
১. আল্লাহর অস্তিত্ব ও গুণাবলীর প্রতি সংশয় সৃষ্টিকরণ।
২. ইসলামের বিধানাবলী সম্পর্কে কটাক্ষ।
৩. অদৃশ্য বিষয়াদির প্রতি অস্বীকার।
৪. ইসলাম যা হারাম করেছে তা হালাল মনে করা।
৫. ইসলামের মৌলিক বিধানাবলীকে উপহাস।
৬. আল্লাহর রাসুলকে কটাক্ষ করা।
৭. ধর্মীয় গ্রন্থ কুরআনকে বিদ্রূপ করা এবং
৮. নাস্তিক্যবাদী চিন্তা-চেতনায় ঐ সকল বিষয়গুলোর উপর পর্যায়ক্রমে মন্তব্য করা।
ঐ কটাক্ষমূলক কাজগুলো যদি অসুলসমানের দ্বারা হয় তবে তাদের ইসলামের পরিভাষায় কাফির বলা হয়। এবং তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর নির্দেশ হল জিহাদ করা। ঐ কাজগুলো যদি কোন মুসলমানদের দ্বারা হয় তবে ইসলামের পরিভাষায় তাকে ‘মুরতাদ’ বলে এবং তার শাস্তি হল হত্যা করা। সেখানে Blasphemy ধরনের আইন দিয়ে ইসলামী শরীয়তের ‘মুরতাদ’ বিধানে পরিপূরক বা পূর্ণতা আসবে না। এখন দেখা যাক ‘মুরতাদ’ কাকে বলে।
মুরতাদ
‘মুরতাদ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল ফিরে যাওয়া। অর্থাৎ ইসলাম থেকে সড়ে দাঁড়ানো। যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করার পরে ঐ ধর্ম থেকে ফিরে যায় এবং ইসলামের বিরুদ্ধে পূর্বে আলোচিত আটটি বিষয়ের উপর ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলে তাকে ইসলামি শরিয়ত আইনে মুরতাদ বলে। হজরত মুহম্মদ (সা.) এর আমলে এবং তাঁর পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে মুরতাদ বিধি কীভাবে কার্যকর করা হত তা পবিত্র কোরআনের আলোকে তুলে ধরা যেতে পারে।
‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হ্যাংগামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি এই যে, তাদের হত্যা করা হবে অথবা শুলিতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদ সমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে।’ (সুরা মায়েদা : ৩৩)
পবিত্র হাদিসের দৃষ্টিতে মুরতাদ বিষয়ক কয়েকটি হাদিসের উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশিষ্ট সাহাবী হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন : “মুসলমানদের হত্যা করা কখনও হালাল নয় তবে তিন ধরনের ব্যক্তিকে হত্যা করা হবে। ১. কাউকে হত্যাপরবর্তী হত্যাকারীকে হত্যা করা ২. বিবাহিত ব্যক্তি যদি যেনায় লিপ্ত হয় ৩. ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান জামায়াত বা দলকে পরিত্যাগ করা হলে।’ ইবনে মাযা শরীফে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআনের একটি মাত্র আয়তাকেও অস্বীকার করে তার শিরচ্ছেদ করা হালাল হয়ে গেছে।’ (বোখারী শরীফ)। আবু দাউদ শরীফে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন— ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তাকে পরিত্যাগ করল তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দাও।’
খোলাফায়ে রাশেদীনের দৃষ্টিতে মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই ছিল। এ ব্যাপারে ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবুবকর (রা.)-এর ভূমিকা কী ছিল তা জালালুদ্দিন সুয়তী-এর লিখিত তারীখুল খোলাফা নামক গ্রন্থে হজরত উমর (রা.) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, হজরত মুহম্মদ (স)-এর ওফাতের পর মদীনার পার্শ্বে কিছু লোক যখন মুরতাদ হয়ে গেল, তখন খলিফা আবুবকর (রা.) তাদের প্রাণদণ্ড দেয়ার প্রস্তুতি নিলেন। তখন পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার প্রেক্ষিতে হজরত উমর (রা.) তাতে বাধা দিলেন হজরত আবুবকর (রা.) বলেন, ‘তা বহু দূরে, তা বহু দূরে। হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় গ্রহণ করেছেন, ওহী বন্ধ হয়ে গেছে তাদের ব্যাপারে পূর্ব সিদ্ধান্ত ব্যতীত ইসলাম ভিন্ন কোন বিধান ও সিদ্ধান্তের অবকাশ নেই। আল্লাহর কসম আমি তাদের সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত জিহাদ করতে থাকব যতক্ষণ আমার হাতে তলোয়ার ধরে রাখতে সক্ষম হব।’ অতঃপর তাঁর সিদ্ধান্ত সঠিক ও যথাযোগ্য হওয়ার স্পষ্ট হয়ে উঠলে হজরত উমর (রা.)ও তা মেনে নিলেন। হজরত আবু বকর (রা.) বহু মুরতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছেন। (তারীখুল খোলাফা-পৃ. ৫৬)।
উপরে উল্লিখিত ঘটনায় বোঝা গেল যে, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) পরবর্তী মুরতাদের প্রাণদণ্ডের বিষয় হজরত আবুবকর (রা.)-এর সাথে অভিন্ন মত পোষণ করে তাকে সহায়তা করেছিলেন। বিশিষ্ট হাদিসবীদ কাজী ইয়াজ (রা.) তাঁর শীফা নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, হজরত উমর (রা.)-এর কাছে কিছু মুরতাদ গ্রেফতার করে আনা হলে তিনি তাদেরকে তিন দিন পর্যন্ত পুনরায় ইসলাম গ্রহণের সুযোগ দিলে তা সত্ত্বেও তওবা করে ইসলাম গ্রহণ না করলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেন। ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.) মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন করতেন। একদা বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ (রা.) ইরাক থেকে মুরতাদদের একটি জামায়াত গ্রেফতার করে নিয়ে আসেন এবং তাদের শাস্তির ব্যাপারে পরামর্শ চেয়ে খলিফা ওসমান (রা.)-এর কাছে চিঠি লিখেন। তদুত্তরে হজরত ওসমান (রা) লিখেন “তাদের পুনরায় ইসলাম পেশ কর। তারা যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তাদেরকে ছেড়ে দাও। না হয় তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দাও।’ তেমনি ইসলামে চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)ও মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডকে প্রাধান্য দিতেন। ইমাম বোখারী (র.) স্বীয় হাদিস গ্রন্থে বোখারী শরীফে বর্ণনা করেন যে, হজরত আলী (রা.) নিজ খেলাফতকালে কিছু মরতাদকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন এবং হজরত আবুল তোফায়েল (রা.) বর্ণনা করেন যে, ‘হজরত আলী (রা.) যখন বনি নাজিয়ার সহিত যুদ্ধ করার জন্য মুসলমান ফৌজ পাঠালেন তখন তাদের মধ্যে আমি ছিলাম। আমরা ওখানে গিয়ে দেখলাম তাদের মধ্যে তিন প্রকার লোক রয়েছে। কিন্তু এমন লোক যারা প্রথমে নাসারা ধর্মাবলম্বী ছিল কিন্তু পরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে তার উপর অটল রয়েছে। আর কিছু লোক প্রথমে নাসারা ধর্মাবলম্বী ছিল কিন্তু পরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে তার উপর অটল রয়েছে। আর কিছু লোক প্ৰথমে নাসারা ছিল এবং বর্তমানেও নিজ ধর্মের উপর অটল রয়েছে এবং এমন কিছু লোক যারা নাসারা ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করে পুনরায় নাসারা ধর্ম গ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে তৃতীয় প্রকার লোকদেরকে আমাদের সেনাপতি তওবা করে পুনরায় ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলেন এবং তারা তা অসম্মতি প্রকাশ করলে আমাদেরকে তাদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন। আমরা বয়স্কদের হত্যা করে শিশু-কিশোরদের গ্রেফতার করে নিয়ে আসলাম।
ইসলামের পরবর্তীকালে চার খ্যাতনামা ইমামদের দৃষ্টিতেও মুরতাদ হত্যাযোগ্য হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। এই মর্মে চার মাযহাবের ইমামগণের ইজমার কথা উল্লেখ করে হানাফী মাযহাবের ভাষ্যকার ইমাম মুহম্মদ (রা.) তাঁর আল জামে উচ্ছগী নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন : ‘মুরতাদ আজাদ কিংবা তা না হোক তাকে ইসলাম পেশ করা হবে। পুনরায় ইসলাম গ্রহণে অসম্মতি প্রকাশ করলে তাকে তখন প্রাণদণ্ডে শাস্তি দেয়া হবে। তেমনি ইমাম মুহাম্মদ (রা.) তার বিশিষ্ট গ্রন্থ মুয়াত্তা মুহাম্মদ-এ লিখেছেন : ‘যদি রাষ্ট্র প্রধান আশ্বস্ত হন যেন মুরতাদ পুনরায় তওবা করে ইসলাম গ্রহণ করবে অথবা সে নিজেই বিবেচনার জন্য সময় সুযোগের প্রার্থী হয় তাহলে রাষ্ট্র প্রধান তিন দিন পর্যন্ত সময় দিতে পারেন। যদি এরকম না হয় তাহলে কোন সময়-সুযোগ ছাড়াই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারবেন। (মুয়াত্তা মুহাম্মদ-পৃ. ২৮২)।
ইমাম মালেক (র.) বলেন, ‘আমি মুরতাদকে হজরত উমর (রা.)-এর শাস্তি দেয়াই সর্বোত্তম মনে করি।’ তবে তিনিও মুরতাদকে তিন দিনের সুযোগ দেয়ার পক্ষে মত পোষণ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী (র.)-এর থেকে মুরতাদদের শাস্তির ব্যাপারে দুধরনের বক্তব্য বর্ণিত আছে। প্রথমত: ভেবে দেখার জন্য তাকে কোন সুযোগ দেয়া হবে না বরং মুরতাদ হওয়ার পরপরই তওবা করলে ভাল। না হয় তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হবে। দ্বিতীয়ত: অবস্থাবোধে তিন দিনের সময়ের মধ্যে তওবা না করলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।’ (শীফা-পৃ. ৩৬৮)।
মুরতাদের শাস্তি প্রসংগে হজরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন, ‘মান বাদ্দালা দ্বীনাহু ফাকতুলুহু।’ যে ব্যক্তি নিজের ধর্ম ত্যাগ করে তাকে হত্যা কর। অপর এক হাদিছে রয়েছে ‘ইসলাম ত্যাগ করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।’ অন্য এক হাদিছে হজরত মুহম্মদ (স.) যে সব কারণে হত্যা বৈধ বলেছেন, তন্মধ্যে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে উল্লেখ করেছেন। আব্দুল্লাহ বিন আবী সারাহ্ এক সময় মহম্মদ (স.) এর ব্যক্তিগত সেক্রেটারি ছিলেন। সে ইসলাম ত্যাগ করে কাফেরদের সাথে মিলিত হলে মক্কা বিজয়ের পর হজরত মুহম্মদ (স.) তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। হজরত যাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা.) বর্ণিত হাদিছে রয়েছে, ‘ওহুদের যুদ্ধের পর এক রমণী ইসলাম ত্যাগ করলে তাকে তওবার আহবান জানাতে বলেন, যদি সে রাজি না হয় তাহলে হত্যা করতে নির্দেশ দেন।’ উম্মে রুমান নামক জনৈকা মহিলা মুরতাদ হলে অনুরূপ নির্দেশ দেন। হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হাদিছে রয়েছে, খ্যাতিমান গোত্রের জনৈকা মহিলা মুরতাদ হলে অনুরূপ নির্দেশ দেন। হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হাদিছে রয়েছে, খ্যাতিমান গোত্রের জনৈকা মহিলা হজরত মুহম্মদ (স.) এর বিরুদ্ধে কুৎসা ও ধৃষ্টতাপূর্ণ ব্যঙ্গ-কাব্য লিখেছিল। অতঃপর সেই মহিলা লেখিকার ব্যাপারে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে হজরত আবুবকর (রা.) উম্মে কিরফা নামক জনৈকা মহিলা মুরতাদ হলে তাকে তওবা করতে বলেন। সে অস্বীকৃতি জানালে তাকে হত্যা করা হয়। ইতিপূর্বে রাশেদীনের আমলে আরও তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। হজরত আলী রা.)-এর সময় এক ব্যক্তি ইসলাম ত্যাগ করলে তাকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়। হজরত আলী (র.) বলেন— ‘মান সাব্বা নাবিয়ান কুতিলা।’ যে কেউ নবীকে তিরস্কার করলে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য। এ ব্যাপারে বোখারী শরীফের ‘কিতাবুল ইসতে তাবাতুল মু’য়ানেদীন ওয়াল মুরতাদ্দিন ওয়া বিতালুহুম’ অধ্যায়ে বিশদ আলোচনা আছে। উল্লেখিত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে মুরতাদের শাস্তি হত্যাদেশ এবং আইনের বাস্তবায়নের প্রয়োজনে ব্যক্তিটি ইসলামি রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হতে পারে।
খোলাফায়ে রাশেদীনের পরে মুরতাদ বিবেচনায় কাউকে বিচার করে হত্যা করা হয়েছে তেমনটির তথ্যসূত্রে আমরা পাইনা। তবে কিছু দিন আগে বিংশ শতাব্দিতে ইরানের বিপ্লবের পর স্যাটানিক ভার্সেস এর লেখক সালমান রুশদীকে ইরান সরকার মুরতাদ বিবেচনায় হত্যার হুকুম দিয়েছে। কারণ The Satanic Verses বইতে হজরত মুহম্মদ (স.) এবং কুরআন প্রসংগে রুশদী মন্তব্য করে লিখেছেন, ‘The prophet Mohammed could not tell the difference between the angle and the devil. The mother of Muslim one like prostitute in a brothel. Quran has satanic verses. Prophet Ibrahim referred as the bustard the companion Bilal. Salman and Khalid are could clowns failing
তার ঐ মন্তবের কারণে রুশদী একজন মুরতাদ এবং সে কারণে ইরানের দেয়া শাস্তির আদেশ শরিয়তসম্মত। কিন্তু বিশ্বের কোথাও ঐ মুরতাদের আইনের প্রয়োগ তেমন একটি নেই। তবে এর বিকল্প ফৌজদারী দণ্ডবিধি আইন এবং ইউরোপের কোন দেশে Blasphemy Act করে ধর্মদ্রোহীদের শাস্তি দেবার বিধান চালু আছে। Blasphemy আইন সম্পর্কে পরে আলোচনায় আসব। আপাতত ফৌজদারী দণ্ড বিধির বিধানটি আলোচনায় রাখা যেতে পারে। তবে এর আগে ইকতেলাফী বিষয়ের আরও কিছু তথ্য তুলে ধরা যেতে পারে, এবং যে কারণে মুসলিম বিশ্ব থেকে মুরতাদের শাস্তির বিষয়টি বিবেচনায় আসছে না এবং ঐ কারণে প্রশ্ন এসেছে যে, নেহাত ধর্ম ত্যাগের কারণে কোন মানুষকে হত্যার নির্দেশ দেয়া যাবে কিনা? তবে যে সব ক্ষেত্রে হত্যার আদেশ কুরআনে এসেছে তার মধ্যে ধর্মত্যাগীদের ব্যাপারে ঐ হত্যার আদেশ প্রযোজ্য নয়।
বাংলা পরিভাষায় ‘ধর্মত্যাগী’ এবং ‘ধর্মদ্রোহী’ এ দুই শব্দের আলাদা বিবেচনা রয়েছে। যদি ব্যক্তিটি ইসলামত্যাগী হন, সেখানে কথিত Freedom of Religion এবং Freedom of Expresion in Islam বিষয়ক ব্যাপারে মুসলিম ধর্মশাস্ত্রজ্ঞরা (Jurist) বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন এবং তাদের এহেন মতামতের ভিত্তি হচ্ছে— ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই।’ (২ : ২৫৬)
তবে ইতিপূর্বের মুরতাদের বিধিগুলো বিবেচনা করতে হজরত মুহম্মদ (স.) এবং পরবর্তী খলিফাদের দেয়া হত্যার আদেশাদি যে নেহাত ধর্মত্যাগীদের জন্য ছিল, তা নয়। বরং ঐ সকল ধর্মত্যাগীরা প্রকারান্তরে ধর্মদ্রোহী হয়ে ইসলাম, ইসলামী রাষ্ট্র এবং ইসলামের নবী মুহম্মদকে উৎখাতের জন্য যে সকল ষড়যন্ত্র করেছিল তারই কারণে শুধু খলিফারাই নয়; বরং স্বয়ং মুহম্মদকেও মুরতাদদেরকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন।
আল্লাহপাক কোরআনে ঘোষণা করেছেন যে-
‘আল্লাহর নিকট জীবন ব্যবস্থা হচ্ছে কেবল মাত্র ইসলাম।’ (৩ : ১৯)।
তাই যদি হয় তাহলে মুসলিম ধর্মশাস্ত্রজ্ঞদের (Muslim Jurist ) Freedom of Expresion is Islam লিখে Freedom of Religion কে বিবেচনা করার অবকাশ কোথায়?
সৃষ্টিলগ্ন থেকেই আল্লাহপাক মানুষকে তাঁর মনোনীত ধর্ম ইসলামকে মানুষের সত্তার সহজাত করে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে Freedom of Religion কে এবং Freedom of Expresion in Islamকেও স্বাগত জানানো যায় না। কারণ Freedom of Religion-এর সুবাদে একাধিক ধর্মের কথিত ওহী এসে মৌলিক ইসলামকেই অবমূল্যায়ন করে ফেলবে।
মানুষ যেহেতু শয়তানের প্ররোচনায় মৌলিক ধর্মকে ত্যাগ করে ফেরকা ও ফিতনা সৃষ্টি করে চলছে : সে জন্যই আল্লাহপাক প্রতি যুগে যুগে জীবন বিধান দিয়ে লক্ষ লক্ষ নবী পাঠিয়েছিলেন। আর এ ব্যাপারেও আল্লাহপাক সূরা বাকারার ৩৮ নং আয়াতে বলে দিলেন :
‘আমি (আল্লাহ) বললাম যে তোমরা সকলেই এখান থেকে (বেহেস্ত থেকে) নেমে যাও। অতঃপর আমার নিকট থেকে যে জীবন বিধান তোমাদের নিকট পৌঁছাবে, আর যারা আমার বিধান মেনে চলবে তাদের জন্য কোন চিন্তা-ভাবনার কারণ নেই।’ (২ : ৩৮)
সুতরাং এহেন আয়াত সামগ্রীর প্রেক্ষিতে একাধিক ধর্মের বিবেচনা কোথায়, যার জন্য Freedom of Religion এর বিবেচনা করতে হবে?
Dr. Hashem Kamali তার লেখা Freedom of Expresion in Islam নামক পুস্তকে Freedom of Religion অধ্যায়ে লিখেছেন :
Freedom of Religion: Freedom of Religion acquires special significance in the Shariah a system of law which recognises no clear division between legal and religious norms. Since the creed of Islam lies at the root of many a doctrine and institution of the Shariah, the freedom of whether or not to embrace and practise Islam is the most sensitive and controversial area of all individual liberties.
অর্থাৎ ‘মুসলিম শরীয়তে ধর্মের স্বাধীনতার একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে, যাকে একটি নিয়মানুগ আইন বা বিধি বলা যেতে পারে এবং এর ধর্মীয় বা আইনগত কোন কারণ দেখিয়ে এর পার্থক্যকে স্বীকার করা হয় নাই। যেহেতু ইসলামের ধর্মমত শরীয়ার অসংখ্য গভীর মতাদর্শের উপর নির্ভরশীল : সেহেতু ব্যক্তি স্বাধীনতার কারণে তার গ্রহণ এবং অনুকরণ ব্যক্তির বিতর্কিত আওতায় বিশেষ প্রতিক্রিয়াশীল।
উক্ত উদ্ধৃতিটুকু বিবেচনার একমাত্র শর্ত হল নীতিবাদীদেরকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে। আর সেটাকে Freedom of Religion বলা যায় না; বরং Freedom of Expresion in Islam বলা যেতে পারে। কিন্তু মুরতাদদের ব্যাপারে এর কোনটাই প্রযোজ্য নয়।
Blasphemy আইন
Wharton’s Law Lexicon এর ১৩৪ পৃষ্ঠায় Blasphemy Act প্রসংগে বলা হয়েছে :
An offence against God and religion, by denying to the Almighty His being and Providence or by contlemelious reproaches of our Saviors Christ. Also, all profane scoffing at the Holy scripture and exposing it to contempt and redicule. It is an indictable misdemenour at common law.
Very severely punishes any person who shall by writing printing teaching or advised speaking, dent the Christian Religion to be true, or the Holy Scruptures of the Old and New, Testement to be divine authority and is convicted thereof on indictment by the oath of two or more credible witnesses.
The Punishment is, for a first offence, disability for and for future of any offence celesiastical, civil, or military; for a second, disability to see in any action, or to be guardian of as child, of an executor or administrator, or capable of any legacy or deed of gift, or to bear any office within the real forever and also to suffer three years imprisonment ।
ওখানে বলা হয়েছে যে লেটিন Blasphemoo শব্দ থেকে Blasphemy শব্দ এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে ঈশ্বর এবং তার ধর্মের বিরুদ্ধ সংক্রান্ত অপরাধ। অর্থাৎ যারা ঈশ্বর, তার ধর্ম ও তার দূরদর্শিতাকে অথবা যিশু খ্রিষ্টের প্রতি অতিশয় ঔদ্ধত্বপূর্ণ এবং নিন্দাসূচক অর্থ বা আচরণ প্রকাশকরণ বিষয় সংক্রান্তের অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের জন্য গির্জা বা ধর্ম যাজকদের প্রতি অবজ্ঞাভরে উপহাস বা ব্যঙ্গ করা এবং বাইবেল শাস্ত্রের পবিত্র বাণীগুলোকে বিদ্রুপ সহকারে উপস্থাপন করা। ইংল্যান্ডের Common Law-তে ঐ ধরনের অসৎ কর্মগুলো বা আচরণগুলো অভিযুক্তযোগ্য। Blasphemy Act যদিও মূলত ধর্মত্যাগীদের অপরাধ সংক্রান্তের হলেও সাধারণ আইনের প্রতি পুঞ্জিবভনশীল। সামগ্রিকতার প্রেক্ষিতে খ্রিষ্টান ধর্মের কোন বিষয় এবং নতুন কিংবা পুরাতন পবিত্র বাণীগুলোর প্রতি কটাক্ষ করে কোন প্রকাশনা, লেখা শিক্ষা দেয়া বা উপদেশ আকারে বলা এবং ধর্ম শাস্ত্রের বাণীগুলো ঐশী বাণী নয় বা মিথ্যা ইত্যাদি ধরনের বক্তব্য অপরাধযোগ্য এবং সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি দুই অথবা দুইয়ের অধিক নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য প্রমাণে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া হয়।
ঐ Blasphemy আইনে অপরাধীদের কয়েক ধরনের শাস্তি হতে পারে। প্রথমত, ঐ ধরনের অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তার মৌলিক অধিকারের প্রতি ধর্মযাজক হওয়া সংক্রান্ত, সাধারণ অথবা আর্মি বিভাগের কোন অফিসিয়াল পদের অযোগ্য ঘোষণা করা।
দ্বিতীয়ত, যে ধরনের শাস্তি ঐ অপরাধীকে পেতে হয় তা হল মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত করা। যেমন ঐ অপরাধী তার অধিকারের প্রশ্নে কোন মামলা করার অধিকার থাকবে না, কোন নাবালকের অভিভাবক হবার যোগ্যতা থাকবে না, অথবা কোন প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহী অথবা প্রশাসনিক কোন পদের জন্য অযোগ্য ঘোষিত হওয়া, অথবা অপরাধী কাউকে যেমন কোন কিছু দান করতে পারে না; তেমনি অছিয়াত মূলে কোন সম্পত্তির মালিক হবার অধিকার বঞ্চিতকরণ; এবং ঐ ধরনের কোন সরকারি অথবা আধা সরকারি অথবা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের অফিসিয়াল পদে থাকার অধিকার থেকে চিরতরের জন্য নিষিদ্ধকরণ।
তৃতীয়ত, Blasphemy আইনের অভিযুক্ত কারাদণ্ড হিসাবে তিন বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেয়া যেতে পারে। পরবর্তীকালে ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের আইনকে সংশোধন করে শাস্তির আদেশ অত্যন্ত কঠোর করা হয়েছে। ব্রিটেনে শুধুমাত্র ক্যাথলিক খ্রিষ্টবাদ ও ক্যাথলিক গির্জাকে ধর্মদ্রোহীদের ভাষার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য প্রণীত আইনে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯২০ এর দশক পর্যন্ত দুইশত ব্যক্তিকে শাস্তি দানের ঘটনা ঘটেছে। সূত্র : মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, ধর্মদ্রোহী ব্ল্যাসফীমার ফৌজদারী ও মুরতাদ আইন (প্র.প্র. ২০০৭)।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান
মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেখানে ধর্মের ইতিহাস যতখানি পুরাতন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ইতিহাসও প্রায় ততখানিই পুরাতন। যখনই কোন জাতি অন্য জাতির উপর প্রভূত্ব বা প্রাধান্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়েছে, তখনই সে তার নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতি বিজিত জাতির উপর চাপিয়ে দিয়েছে। অতঃপর শাসন ও শোষণ অব্যাহত রেখেছে ধর্মের নামে। শাসকশ্রেণির সকল কাজকে তার স্বধর্মীয় পুরোহিতশ্রেণিও অকপটে বৈধতাদান করেছে। এভাবেই ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলে গির্জাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় যা দীর্ঘকাল যাবত বহাল থাকে। একারণেই লাতিন ভাষায় একটা কথা প্রচলিত আছে Cujus Regio, ejus religio-অর্থাৎ দেশ যার ধর্ম তার।
এরকম উদাহরণ আরও আছে। ৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমানরা জেরুজালেম ধ্বংস করে এবং ইহুদিরা বিতারিত হয়। কালক্রমে ইহুদিদের মন্দিরের উপর সম্রাট হাড্রিয়ান (১১৭-১৩৮ খ্রি.) রোমান মন্দির খাড়া করে এবং জুপিটারকে দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বার কচবার নেতৃত্বের ১৩২ খ্রিষ্টাব্দে ইহুদিরা রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হলে সেই বিদ্রোহ সর্বাত্মকভাবে দমন করা হয় এবং ইহুদিদের জেরুজালেমে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের আগে ইহুদিরা এই নগরে আর প্রবেশ করতে পারেনি। আরবরা যখন পারস্য জয় করে, তখন (৬৪১ খ্রি.) পারসিকদের মধ্যে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি, তারা ও অগ্নিপুজারীরা পালিয়ে ভারতে ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে ইমাম আবু হানিফাকে কারারুদ্ধ করা হয় এবং কারাগারে তাঁর মৃত্যু হয়। ইমাম মালেককে শিয়া প্রীতির জন্য খলিফা মনসুর নির্মমভাবে নির্যাতন করেন। ইমাম হাম্বলীকে খলিফা আল-মামুন নির্যাতন করে কারারুদ্ধ করেন। আব্বাসীয় শাসনামলে ৯২২ খ্রিষ্টাব্দে সুফি মনসুর হাল্লাজকে শূলে চড়ানো হয়। শামস তাবরিজের জীবন্ত অবস্থায় চামড়া ছাড়িয়ে নেয়া হয়। খলিফা ওসমান (রা.) ও আলী (রা.)-কে হত্যা করা হয়। ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্দ ও রাণী ইসাবেলা মুসলমানদের স্পেন থেকে বিতাড়িত করেন। মোগল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) দেশের শাসনকর্তা হিসেবে নতুন মতবাদ ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’ প্রবর্তন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বে আরবে চলছিল অজ্ঞতা, কুসংস্কার, শোষণ ও নিপীড়নের এক অন্ধকার যুগ যাকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বলা হয়। এই অন্ধকার থেকে মুক্তির উপায় সন্ধানকল্পে পবিত্র হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় হজরত মুহম্মদ (দ.) আল্লাহর ঐশী বাণী প্রাপ্ত হন। উক্ত ঐশী বাণীর ভিত্তিতে তিনি তৎকালীন আরবে যে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, তা ছিল বহুলাংশে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায়বিচারভিত্তিক। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত ঘটনাবলি ইসলামের মৌলিক আদর্শের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ভাষায়, ‘মুসলিম সমাজের গৃহবিবাদ ও আত্মকলহের উদাহরণ কোন কোন ক্ষেত্রে বিশ্ববাসীকে স্তম্ভিত করেছে। হজরত ওমর ফারুক (রা.) হজরত ওসমান গণি (রা.), হজরত আলী (রা.), হজরত ইমাম হাসান (রা.) ও হজরত ইমাম হোসেন (রা.)-এর শাহাদাতবরণ বিশ্বাবাসীর কাছে মুসলিমসমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। উমাইয়া বংশের তথাকথিত খলিফাদের অনাচার ও আব্বাসীয়দের পাশবিক প্রতিশোধমূলক কার্যকলাপ মুসলিম চরিত্রের দূরপনেয় কলঙ্ক। তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়, মুসলিম সমাজজীবনে এ অত্যাচার দেখা দিয়েছে ব্যক্তিগত বা বংশগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার দুরভিসন্ধির ফলে। বর্ণ ও রক্তের যে প্রতিমা ধ্বংস করার জন্য ইসলামের আবির্ভাব হয়েছিল, সে বর্ণ ও রক্তের পুতুলগুলোকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম সমাজে আত্মকলহ দেখা দিয়েছিল।’ (জীবনদর্শনের পুনর্গঠন, ইফা, ১৯৮০)।
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত প্রয়াত জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামী তাঁর রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্ম বনাম ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘ইসলামের মূল ভিত্তি কালেমা তাইয়েবাই ইসলামী রাজনীতির উৎস। কালেমার মূল ঘোষণা ও অন্তর্নিহিত বাণী হল— এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব গ্রহণ করা। গায়রুল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব পরিহার করা বা বর্জন করে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ জীবন যাপনের সকল ক্ষেত্রে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অনুসরণের অঙ্গীকারই কালেমার ঘোষণার দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য দিক। তাই এটাকে কোন অবস্থায়ই রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ নেই।’ (রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্ম বনাম ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, দ্বি. সং. ২০০৩, পৃ. ১৮)।
প্রফেসর স্যানেটিলানা বলেন, ‘Islam is the direct government of Allah, the rule of God, whose eyes are upon his people. The principle of unity and order which in other societies is called civitas, polis, state, is Islam is personified by Allah : Allah is the name of supreme power, acting in the common interest. Thus the public treasury is the treasury of Allah the army is the army of Allah, even the public functioneries are the employees of Allah.’ (Legacy of Islam, p. 286) ।
অবিভক্ত ভারতবর্ষে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
সেই প্রাচীন ভারতেই দেখা যায়, রামায়ণের রাম ধর্মের নামে পিতৃআজ্ঞা পালনে বনবাসে গমন করেন। রাবণ কর্তৃক সীতাহরণে বালকের ন্যায় রোদন করলেন পত্নীর প্রেমে। কিন্তু লঙ্কা জয় করে যখন অযোধ্যার রাজা হয়ে বসলেন, তখন সীতাকে ত্যাগ করতেও দ্বিধা করলেন না। নির্বাসিত সীতাকে আবার মনে পড়ল অশ্বমেধ যজ্ঞের সময়। কারণ, পত্নী ছাড়া যজ্ঞ অসম্পূর্ণ থাকে। তবুও সীতাকে সশরীরে আনলেন না, স্বর্ণ-সীতা তৈরি করে যজ্ঞ সম্পূর্ণ করলেন। মহাভারতেও একই রকম উদাহরণ পাওয়া যায়। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’ বলে কৌশলে ‘ধর্মযুদ্ধে’ দ্রোণাচার্যকে নিহত করালেন। এই দ্রোণাচার্য শিষ্যের স্বার্থের কারণে গুরুদক্ষিণা হিসেবে নিষাদ-বালক একলব্যের ডানহাতের বুড়ো আঙুলটি কেটে নিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি।
আর্যরা যখন ভারতবর্ষ আক্রমণ করে, তখন দ্রাবিড়দের অনার্য পরিচয়ে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। তখন সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতার সাথে আর্য ও অনার্য সংস্কৃতি সংমিশ্রণ ঘটেছিল। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেছেন, Out of this synthesis and fusion grew the Indian races and the basic Indian culture which had distinctive elements of both. (The Discovery of India, p. 52)। অর্থাৎ ভারতীয় জাতিগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির উৎপত্তি এই আর্য- অনার্যের সংমিশ্রণের মাধ্যমে, সেখানে উভয় জাতির উপাদান ও অবদান বর্তমান
ভারতে বর্ণাশ্রম রীতি প্রবর্তনের পর অভিজাতশ্রেণির লোকেরা নিম্নবর্ণের লোকদের শুধু যে শোষণ করতে লাগলেন তা নয়, তাদের ঘৃণা ও অবজ্ঞা করতেও শুরু করলেন। চতুর্বর্ণের বাইরে অন্ত্যজশ্রেণির লোকেরা এবং বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্মাবলম্বী লোকেরাও ছিলেন উচ্চবর্ণের অভিজাতশ্রেণির লোকদের কাছে ঘৃণা ও অবজ্ঞার পাত্র। প্রাচীন বাংলায় বহু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোক ছিল, ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাদের ভাল চোখে দেখত না। বাংলার শশাংক ও সেন রাজাদের বৌদ্ধ-বিদ্বেষ কারও অজানা ছিল না।
উপরের পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, প্রাচীন ভারতের আর্য-শাসকশ্রেণির হাতে যে ধর্মভিত্তিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির গোড়াপত্তন, তারই ধারাবাহিকতায় মোগল সম্রাট আরওঙ্গজেব (বাদশাহ্ আলমগীর উপাধিধারী) কর্তৃক আপন ভ্রাতাকে ‘মুরতাদ’ ফতোয়ারদানপূর্বক ভ্রাতৃহত্যার মাধ্যমে রাজ সিংহাসন দখল করার ঘটনা ঘটে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতবর্ষে তাদের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ নির্বিঘ্ন রাখার লক্ষ্যে স্থানীয় বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ ও সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়। ফলে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রতিক্রিয়ায় সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত হয় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সেই দাঙ্গা গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে।
১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ জুন সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হলে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তন ঘটে। উপমহাদেশের বহু ধর্ম ও বর্ণে বিভক্ত জনগোষ্ঠীর নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ধূর্ত ইংরেজ শাসকগণ ‘Divide and rule’ পদ্ধতির সাহায্যে ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। নিজেদের দেশে সংসদীয় শাসনপদ্ধতি কার্যকর থাকা সত্ত্বেও ভারতবর্ষে তারা একনায়কতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার কায়েম করে। একইভাবে নিজেদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা থাকলেও এ উপমহাদেশে তারা স্বীয় ঔপনিবেশিক শাসন পাকাপোক্ত করার জন্য কৌশলে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়। ইংরেজ শাসকদের অনুসৃত এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি গোটা ভারতবর্ষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু নেতৃত্বনির্ভর রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়। পরবর্তীকালে মুসলিম নেতৃত্বনির্ভর রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে ২৬ আগস্ট মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে গঠিত হয় জামায়াতে ইসলামী নামক আরও একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। এই দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মাওলানা মওদুদী তাঁর সিয়াসী কাশমকাশ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এই কাজের (হুকুমতে ইলাহী প্রতিষ্ঠার) জন্য একটি প্রবল সমালোচনামুখর, ধ্বংসাত্মক ও সংগঠিত আন্দোলনের প্রয়োজন যা একদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যকে নিজের বিশেষ চিন্তাধারার বুনিয়াদের উপর নতুন করে গড়ে তুলবে। এমনভাবে করতে হবে যাতে চিন্তাজগৎ পুরোপুরি, প্রভাবান্বিত হয় এবং মানুষ এই পদ্ধতিতে চিন্তাভাবনা ও অনুভব করতে আরম্ভ করে।’ (সিয়াসী কাশমকাশ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৬৩) এই দলগুলোর পারস্পরিক বিরোধ ও কোন্দলের কারণে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সুস্পষ্ট বিভক্তির সূচনা হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। পাশাপাশি সমাজের রক্ষণশীল অংশের প্রতিনিধিত্বকারী, যেমন, জমিদার, পুরোহিত, বণিক ও প্রতিক্রিয়াশীল লোকজন ব্রিটিশ শাসকের সমর্থন ও নানাপ্রকার সুযোগ সুবিধা পেতে থাকে। অপরদিকে উক্ত রক্ষণশীল অংশের প্রতিনিধিরাও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ব্রিটিশ শাসককে সাহায্য করতে থাকে। এছাড়াও ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে অ্যাক্ট পাশ হওয়ার পর থেকে বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রচারক ভারতে আসতে থাকে। তারা ভারতে বহু সংখ্যক স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে যেগুলো ভারতীয়দের খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে একশ্রেণির নব্য বণিক, জমিদার ও উচ্চবর্ণের হিন্দু নিজেদেরকে একচেটিয়া বাঙালি এবং মুসলমানসহ অন্যদের চাষা, চণ্ডাল, ছোটলোক ও বাজে লোক বলে ভাবতে শুরু করেন। বিশ্বের মোট বাঙালির অর্ধেকেরও বেশি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও এঁরা সাহিত্যের মধ্যে, সংস্কৃতির মধ্যে, রাজনীতির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এই প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকেন— ‘আপনি বাঙালি না মুসলমান?’ যেন বাঙালি ও মুসলমান হওয়া পরস্পরবিরোধী। যেন মুসলমান হলে বাঙালি হওয়া যায় না। (নজরুল ইসলাম, বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, প্র. প্র. ১৯৯৫)। বাঙালি হলে মুসলমান হওয়া যায় না। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম্’ গানএ আনন্দমঠ উপন্যাস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তাঁরা দেশটাকে হিন্দুর দেশই মনে করতেন। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র তো বলেই ফেললেন, “হিন্দুস্থান হিন্দুর দেশ, সুতরাং এদেশকে অধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার দায়িত্ব একা হিন্দুরই।’ (শরৎ সাহিত্য সমগ্র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২১৩৬)।
ভারতবিভাগের জন্য লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে দায়ী করা হয়। কিন্তু লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ভারতে আসার অনেক আগেই জওহরলাল নেহেরু, বল্লভভাই প্যাটেল, কৃপালনী, রাজেন্দ্র প্রসাদ, রাজা গোপালচারিয়া প্রমুখ দেশবিভাগ মেনে নিয়েছেন। রাজা গোপালচারিয়া ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রাজ কংগ্রেস বিধানমণ্ডলীর পার্টির সভা থেকে ভারতবিভাগের পক্ষে একটা প্রস্তাবও পাশ করেছিলেন। তাই বল্লভভাই প্যাটেলের মত নেতারা ভারতবিভাগের পরপরই বলতে পেরেছিলেন, ‘যারা পাকিস্তান চেয়েছিল, পাকিস্তান হওয়ার পর তাদের আর ভারতে থাকার অধিকার নেই।’ এই অন্যায় ও অসঙ্গত উক্তির আগে প্যাটেলের উচিত ছিল পাকিস্তানের সব হিন্দুরা যারা পাকিস্তান চায়নি, তাদের ভারতে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। তা যখন তিনি করেননি, এ ধরনের উক্তি করার নৈতিক কিংবা শাসনান্ত্রিক কোন অধিকার তাঁর ছিল না।
এ বিষয়ে খোদ ইতিহাসবিদগণের মধ্যেও কোন বিতর্ক নেই যে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান ও বিকাশের নেপথ্যে ঔপনিবেশিক শাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। Michael Parenti-এর ভাষায় ‘সাম্রাজ্যবাদ হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি জাতির কর্তৃত্বশালী অর্থনেতিক ও রাজনৈতিক উপাদানসমূহ তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য অন্য একটি জাতির ভূমি, শ্রম, কাঁচামাল ও বাজারগুলি জবরদখল করে নেয়া’। উদাহরণস্বরূপ দেশে দেশে জাতীয়তাবাদের উত্থান, নতুন নতুন নগরীর পত্তন, আধুনিক শিল্পায়ন, যাতায়াতের নতুন মাধ্যম, পশ্চিমী শিক্ষাব্যবস্থা, ক্রমবর্ধমান নগরায়ন, ক্রমবর্ধমান কর্মসংস্থান, নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং নয়া পুঁজিবাদী সমাজের উত্থানকে যেমন এ অঞ্চলে ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিবাচক ফল বলা যায়, তেমনি চূড়ান্ত পর্যায়ে হিন্দু- মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংঘাতকেও ঔপনিবেশিক শাসনের প্রধান নেতিবাচক প্রভাবের নমুনা বলা যায়। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা অর্থনৈতিকভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে দারিদ্র টিকিয়ে রাখতে এবং সামাজিকভাবে বর্ণ ও সম্প্রদায়ভিত্তিক একটি বহুধাবিভক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল যা আজও আমরা প্রত্যক্ষ করি। উপনিবেশভুক্ত দেশসমূহের এই বিরাজমান আর্থিক মন্দা কীভাবে সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শোষিত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, তা কার্ল মার্কস-এর বর্ণনায় চিত্রিত হয়েছে এভাবে, England, it is true, in causing a social revolution in Hindustan was actuated only by the vilest interests…
কার্ল মার্কস ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ‘ঐতিহাসিক দ্বৈত চরিত্র’ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, England has to fulfill a double mission in India; one destructive, the other regenerating. এ প্রসঙ্গে লুসিয়ান ডব্লিউ. পাই বলেছেন, Western traders and missionaries had touched the area and introduced many changes । (Karl Marx, The British Rule in India, Vol. Moscow. P. 317 )।
খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ হিসেবে সেন্ট অগাস্টিন (৩৫৪-৪৩০ খ্রিষ্টাব্দ) খ্যাত। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের প্রথম পাদে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রভাব বিস্তারের সাথে সাথে ইতিহাসের যে সকল বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল তার চরম ও পরম রূপলাভ করে তাঁর রচনাবলীতে। যুক্তিহীন বিশ্বাস প্রবণতার বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির সীমারেখা টেনে অগাস্টিন মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপনের প্রথম প্রয়াসী উদ্যোক্তা তিনি। অগাস্টিনের চিন্তাধারা মুখ্যত দুটি গ্রন্থের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এর প্রথম গ্রন্থটির নাম দি কনফেসনস (The Confessons, 4০1), দ্বিতীয় গ্রন্থটি হল দি সিটি অব গড (The City of God, 425 )।
পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি (১৯৪৭-১৯৭১)
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ইংরেজ-অনুসৃত ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর হীন রাজনৈতিক স্বার্থ ও দেশপ্রেমবর্জিত রাজনীতি সে উদ্যোগ গ্রহণে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপ্রধান মুহম্মদ আলী জিন্নাহর গণপরিষদে ঘোষণা করেন, ‘পাকিস্তানে হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না, মুসলমান মুসলমান থাকবে না, সবাই হবে পাকিস্তানী।’ তিনি ‘সংখ্যালঘুদের অধিকারের সনদ’ (Charter of Minority Rights) দিলেও সংখ্যালঘুরা পাকিস্তানে থাকতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান গণপরিষদেই ঘোষণা করেছিলেন, Pakistan is a Muslim State। দেশের উলেমাশ্রেণিও ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে একটি ধর্মভিত্তিক সংবিধান প্রণয়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। জমিয়তে উলামার মাওলানা আবুল হাসনাত, সৈয়দ আতাউল্লাহ শাহ বুখারী, জামায়াতে ইসলামীর মাওলানা আবুল আ’লা মওদুদী এবং তালিমাতে ইসলামিয়া বোর্ড কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানাতে থাকেন। তাঁদের দাবি সারবত্তা ছিল :
অমুসলিমদের জিম্মি হয়ে থাকতে হবে।
নির্বাচনে নারীর ভূমিকা থাকবে না।
রাষ্ট্রীয় প্রধানের মর্যাদা হবে খলিফার।
মাওলানা আবুল আ’লা মওদুদী দাবি করলেন, ‘প্রচলিত সব আইনকে ভেঙে শরিয়াহ্ আইনের সাথে সমন্বয় করতে হবে। সামরিকবাহিনীতে এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে কোন অমুসলিম কর্মচারী থাকবে না। আইন প্রণয়নে এদের কোন অংশীদারিত্ব থাকবে না।’ তালিমাতে ইসলামিয়া বোর্ড অভিমত ব্যক্ত করল, ‘নারী ও অমুসলিমদের ভোটের অধিকার থাকা চলবে না।’ (প্রাগুক্ত)।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় বছরের একটানা বিতর্ক ও রশি টানাটানির পর অবশেষে পাকিস্তানে একটি গণতান্ত্রিক ইসলামিক সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। পাকিস্তানকে ঘোষণা করা হয় ইসলামী গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। এই ধর্মভিত্তিক সংবিধানের কারণে পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান ও প্রসার ঘটে। জন্ম হয় অসংখ্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের। যেখানে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীসহ সর্বমোট ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪টি (মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, খেলাফত রাব্বানী পার্টি), সেখানে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনের সময় পাকিস্তানে ধর্মভিত্তিক রাজনেতিক দলের সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৮টিতে (মুসলিম লীগ কাইউম, মুসলিম লীগ কাউন্সিল, মুসলিম লীগ কনভেনশন, জামায়াতে ইসলামী, জামিয়াতে ওলামায়ে ইসলাম, মারকাজি জামিয়ত; তাহরিকে ইশতেকলাল, জামিয়ত হাজারভী)। অপরদিকে শাসকশ্রেণিও ধর্মের আবরণে তাদের সকল প্রকার শোষণ ও লুণ্ঠনকে বৈধতা দান করতে থাকে।
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদী পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে আসেন এবং তাঁর ভাষায় ‘হুকুমতে ইলাহী’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করেন। তিনি ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি কর্মচারীদের পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও যুবকদের পাক সেনাবাহিনীতে যোগদান করাকে নিরুৎসাহিত করেন এই যুক্তিতে যে, ‘যেহেতু শপথ গ্রহণের মাধ্যমে এই শাসনব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে হয়, যা আইনত প্রতিষ্ঠিত, সেজন্য যতদিন না বর্তমান শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি ইসলামিক হবে, ততদিন এই শপথ গ্রহণ বৈধ নয়।’ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, ‘বর্তমান সরকার অনৈসলামিক। এই জন্য আমরা মুসলমানদেরকে তার ফৌজ কিংবা রিজার্ভ বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিতে পারি না।’ (প্রাগুক্ত) সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে মাওলানা মওদুদী ও তাঁর দলের এ ধরনের ভূমিকায় দেশব্যাপী অসন্তোষের দাবানল জ্বলে ওঠে। ফতোয়া সম্বলিত জামায়াতে ইসলামীর পুস্তিকাটিও সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা অক্টোবর মাওলানাকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীকালে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ হিসেবে মেনে নেয়ার মুছলেকা দিয়ে মাওলানা মওদুদী কারামুক্তি লাভ করেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২ অক্টোবর পাঞ্জাব প্রদেশের চীফ সেক্রেটারির নিকট জেল থেকে প্রেরিত এক পত্রে মাওলানা মওদুদী জানান, ‘১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ মার্চ আমাদের ও সরকারের মধ্যকার মতবিরোধের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আদর্শপ্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ার পর কেবলমাত্র সরকারি চাকুরেদেরই নয়, বরং প্রতিটি মুসলমানের পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুভাকাঙ্ক্ষী, নিঃস্বার্থ শুভাকাঙ্ক্ষী হওয়া একান্ত কর্তব্য এবং এটা ঈমানের আবেদন বলে আমরা মনে করি।’ (প্রাগুক্ত)। কিন্তু পুনরায় ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা মওদুদী কাদিয়ানী সমস্যা নামক একটি গ্রন্থের মাধ্যমে সারা পাকিস্তানে কাদিয়ানীবিরোধী সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করেন। ফলে পাঞ্জাবে ও লাহোরে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। সরকার দাঙ্গা দমনের জন্য লাহোরের সামরিক আইন জারী করতে এবং মওলানা মওদুদীকে দ্বিতীয়বার গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে সামরিক আদালতে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদান করা হয়। পরে তা চৌদ্দ বছর কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করা হয়। মাত্র পঁচিশ মাস কারাভোগের পর ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ এপ্রিল তাঁকে মুক্তি প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহের ভূমিকা কেমন ছিল তা আগেই বর্ণনা করা হয়েছে। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল, তখন ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান অবজারভার-এ জামায়াতে ইসলামীর প্রধান মওলানা মওদুদীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি আওয়ামী লীগের নিন্দা করে বলেন, ‘কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যারা শাসনতন্ত্র তৈরি করতে যাচ্ছেন, তাদের এ কথা জানা দরকার যে তেমন কোন শাসনতন্ত্র সফল হবে না এবং সেজন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকেই দায়ী থাকতে হবে।’ (পাকিস্তান অবজারভার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১)। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি নিধন অভিযান শুরু করলে জামায়াতে ইসলামির প্রাদেশিক আমীর গোলাম আযম ৪ এপ্রিল তারিখে নুরুল আমীনের নেতৃত্বে জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে ‘অবিলম্বে সমগ্র প্রদেশে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস’ প্রদান করেন। ৬ এপ্রিল গোলাম আযম পৃথকভাবে টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে জানান যে, ‘ভারতের এই অভিসন্ধি নস্যাত করার জন্য প্রদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করবে।’ (দৈনিক পাকিস্তান, ৭ এপ্রিল, ১৯৭১)। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতাদানের উদ্দেশ্যে ১০ এপ্রিল গঠিত ‘শান্তি কমিটি’তে জামায়াতে ইসলামী প্রধান ভূমিকা পালন করে। ১৫ এপ্রিল তারিখে গঠিত প্রাদেশিক শান্তি কমিটির তিন নম্বর সদস্য নির্বাচিত হন গোলাম আযম। আহ্বায়ক ছিলেন কাউন্সিল মুসলিম লীগের খাজা খয়েরউদ্দিন। শান্তি কমিটির মাধ্যমে স্বাধীনতাযুদ্ধবিরোধী তৎপরতাকে সর্বাত্মক করার জন্য একই সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীও গড়ে তোলে। ৯৬ জন জামায়াত কর্মীর সমন্বয়ে খুলনার খান জাহান আলী রোডের আনসার ক্যাম্পে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে রাজাকার বাহিনীর প্রথম দলটি গঠন করেন জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল মওলানা এ কে এম ইউসুফ। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে এই রাজাকার বাহিনী হত্যা, নির্যাতন ও সন্ত্রাস সৃষ্টিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকেও ছাড়িয়ে যায়। স্বাধীনতাযুদ্ধকে নস্যাত করার লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামীর উল্লেখযোগ্য আরেকটি প্রচেষ্টা ‘আলবদর’ নামক সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রতিষ্ঠা। এই বাহিনী এপ্রিল মাসের শেষদিকে প্রথম গঠিত হয় জামালপুরে, যার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন গোলাম আযম এবং প্রকাশ্য নেতৃত্বে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর মতিউর রহমান নিযামী। এছাড়া তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যান্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, বিশেষত নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগ, শান্তি কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দখলদার পাক বাহিনীকে হত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনায় সহায়তা করে। (মাওলানা আবদুল আউয়াল, জামাতের আসল চেহারা, পৃ. ৬৭)।
বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে সালাত আদায়ের আনুষ্ঠাকিতা শুরু হয় ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতা-উত্তর এই মসজিদে জাতীয় মসজিদের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মসজিদ অভ্যন্তরে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত (১৯৬১ খ্রি.) ‘ইসলামিক একাডেমি’কে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ নামান্তর করে এর প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হন আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু আলেম-ওলামাদের সংগঠিত করে মহানবী (সা.)-এর জীবন ও কর্ম জনগণের মাঝে তুলে ধরার জন্য ঢাকায় একটি সিরাত মজলিস প্রতিষ্ঠা করেন। এই সিরাত মজলিসের উদ্যোগে ও তাঁর উপস্থিতিতে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের রবিউল মাসে বৃহত্তর আঙ্গিকে জাতীয় পর্যায়ে প্রথম ঈদ-এ মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন করা হয়। উমহাদেশে এটাই ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের প্রথম ঘটনা। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতি বছর পক্ষকালব্যাপী ঈদ-এ মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন করে আসছে। পাকিস্তান আমলে হজযাত্রীদের জন্য কোন সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে হজযাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করেন।
অবিভক্ত ভারতে ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পরবর্তী সময়ে এতদ্অঞ্চলের হজযাত্রীদের সমুদ্র পথে (বম্বে-কলম্বো-এডেন-জেদ্দা) জাহাজ চলাচলের সুবিধা ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে হাজিদের সমুদ্র পথে (চট্টগ্রাম-কলম্বো- এডেন-জেদ্দা) স্বল্প ব্যয়ে হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু সৌদি অনুদানে ‘হিজবুল বাহার’ নামে একটি জাহাজ ক্রয় করেন। পরে বিমান চলাচলের সুবিধা সম্প্রসারিত হওয়ায় জাহাজে ক্রমশ যাত্রী সংকট দেখা দেয়, সেই সাথে অন্যান্য সমস্যার কারণে সমুদ্র পথে হজগমনের সুবিধা থেকে হযযাত্রীরা বঞ্চিত হন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পরবর্তী-সরকার এই জাহাজটিকে ‘প্রমোদ-তরী’ হিসেবে ব্যবহার করে।
বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বন্ধ করে এই উদ্যানের নাম পরিবর্তন করে সোহওয়ার্দী উদ্যান নামকরণ করেন। বঙ্গবন্ধু তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে তুরাগ নদীর তীরবর্তী প্রায় পাঁচ হাজার একর সুবিশাল জায়গা বরাদ্দ করেন। সেই সাথে কাকরাইলের মারকাজ মসজিদ সম্প্রসারণ করে ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের আবাসন ও ইসলামি দাওয়াতি কাজে সফররত তাবলিগ কর্মীদের কার্যপরিচালনার জন্য সুব্যবস্থা করে দেন। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার পর সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম তাবলিগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আরব বিশ্বের পক্ষ সমর্থন করেন এবং খাদ্য সামগ্রীসহ মেডিকেল টিম ও স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী প্রেরণ করেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওআইসি সম্মেলনে তিনি মুসলিম উম্মার সপক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন।
জিয়াউর রহমানের শাসনামল ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত সংবিধানের প্রধান চারটি মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্র। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি হয়েছিল নিষিদ্ধ। যদিও সংবিধানের এই মূলনীতি নিয়ে নানাজনের নানা মত। ধর্মনিরপেক্ষতার যে সংজ্ঞা প্রধান করা হয়েছিল, তা কারও কারও কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ তা ধর্মনিরপেক্ষতার মূল অর্থকে বিকৃত করেছিল। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হলে রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদল ঘটে। উক্ত ঘটনার ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জিয়াউর রহমান ‘৭২-এর সংবিধানে পরিবর্তন ঘটান। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘সকল ধর্মের সমান অধিকার’, বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ এবং সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ যুক্ত করেন। সেই সাথে সংবিধানে সংযোগ করেন ‘বিস্মিল্লাহ হির রাহমানির রহিম।’ কিন্তু জনগণ এতে কোন রহম পায় নি। ক্ষমতায় এসে তিনি ‘দালাল আইন’ (Collaboration Act-1972) প্রত্যাহার করেন এবং সংবিধানের মূলনীতি থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাদ দেন। সংবিধানের এই পরিবর্তন সম্পর্কে প্রাবন্ধিক ফরহাদ মযহার বলেছেন, ‘খোদ রাষ্ট্রটিই সাম্প্রদায়িক। রাষ্ট্র যদি সাম্প্রদায়িক হয়, তাহলে সাম্প্রদায়িকতা কী করে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হতে পারে, এই যুক্তি আমার কাছে পরিষ্কার নয়। যদি আমরা সত্যি সত্যিই একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চাই, তাহলে আমাদের মনোযোগ ধাবিত হবে সংবিধানের দিকে।’ প্রকৃতপক্ষে এ সময় থেকে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনার অধিকার লাভ করে। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে ‘নরঘাতক’ গোলাম আযমকে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য অস্থায়ী ভিসা প্রদান করা হয়। কিন্তু ভিসার মেয়াদকাল উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও গোলাম আযম অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করে গোপনে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করতে থাকেন। অসুস্থ মা-কে দেখার অজুহাতে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো একত্রিত হয়ে ইসলামি ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামক মোর্চা গঠনপূর্বক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলি আওয়ামী লীগ আমলে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও সে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের যে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়া তারা নিজেরা সচেতনভাবে জারী করেছিল তারই পরিণতি ঘটেছিল জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনীতি ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ইত্যাদি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের পুনরাবির্ভাবে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষিত হয়। এই সুযোগে স্বাধীনতা বিরোধী দলগুলোও সামরিক সরকারের স্বীকৃতি নিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করে।
এরশাদের ‘স্বৈরশাসন’ আমল ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মে এক পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলে ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে ২৪ মার্চ তাঁকে গদিচ্যুত করে সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে সাত দল ও পনের দলের যুগপৎ সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন জামায়াতে ইসলামীও বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে অবস্থান নিয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। জামায়াতে ইসলামী ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে, বিশেষত ১৫ দল ও ৭ দলীয় জোট গঠনের পর থেকে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয় অন্যদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে শরীক হয়।
উল্লেখ্য যে, এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে (১৯৮১-১৯৯০) বিরোধী দলগুলি ‘স্বৈরাচার বিরোধী’ আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও ইসলামী দলগুলি তাদের স্বার্থ আদায়ে সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করে। এ সময় এরশাদ কর্তৃক ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ঘোষণা, বেতার ও টেলিভিশনে আজান প্রচার প্রবর্তন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সারাদেশে ইমাম প্রশিক্ষণ ও কওমী মাদরাসাসমূহে ঈর্ষণীয় অর্থ বরাদ্দসহ, সিরাতমিশন ও অন্যান্য ইসলামী সংগঠনগুলির সাথে স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়। এরশাদের শাসনামলেই (৩ জানুয়ারি, ১৯৮৩ খ্রি.) বাংলাদেশে মসজিদ-মন্দির উপাসনালয় করমুক্ত ঘোষিত হয়। নিজে রাষ্ট্রপতি পদ মর্যাদায় অতৃপ্ত হয়ে আরো অধিক মর্যাদা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় এক পর্যায়ে ‘কবি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ফলে স্বগোত্রীয় কবিরা যাঁরা তাঁকে ‘স্বৈরাচারী’ অভিধায় ভূষিত করেছিল তারাই আবার স্বস্বার্থে এই ‘ভণ্ড ইসলামী চিন্তাবিদ ও কবি’ বনাম রাষ্টপ্রধানের কাছ থেকে জমির প্লট বরাদ্দসহ নানাবিধ সুবিধা হাতিয়ে নেয়।
খালেদা জিয়ার আমল ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ১৮টি আসন পেয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। পরবর্তীকালে ২৯ ডিসেম্বর ১৯৯১ তারিখে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানী নাগরিক ঘাতক গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি’ এবং অবসরপ্রাপ্ত লে, কর্ণেল কাজী নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক এবং অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরীকে সদস্য সচিব করে গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। এই কমিটির ব্যানারে ২৬ মার্চ ১৯৯২ বেলা ১১-৩০ মিনিটে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতের মাধ্যমে পাকিস্তানী নাগরিক একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ঘাতক গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার অনুষ্ঠিত হয় এবং ১২টি সুনির্দিষ্ট অপরাধের অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনকালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশও সে আন্দোলনে শরীক হয়।
শেখ হাসিনার আমল (১৯৯৬-২০০১) ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী মাত্র ৩টি আসন লাভ করে। উক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল সরকারবিরোধী আন্দোলনে অবতীর্ণ হলে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ ইত্যাদি ধর্মভিত্তিক দলগুলোও শরীক দল হিসেবে উক্ত আন্দোলনে যোগদান করে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিএনপির সাথে জাতীয় পার্টি (না-ফি), জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও ইসলামী ঐক্যজোটের একটি মোর্চা গঠিত হয় যা ‘চারদলীয় জোট’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উক্ত চারদলীয় জোট সর্বমোট ২১৪টি আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৫৮টি আসন পেয়ে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
চারদলীয় জোট সরকার (২০০১-২০০৬) ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
২০০১ খ্রিষ্টাব্দে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ১০ অক্টোবর সরকার গঠন করে। জোটের শরীক দল হিসেবে জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার দুটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর (কৃষি মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়; পরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে শিল্প মন্ত্রণালয়) লাভ করতে সক্ষম হয়। জোটের শরীক অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলো কোন মন্ত্রণালয় পরিচালনার দায়িত্বভার না পেলেও সংসদীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া অন্যান্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, যারা চারদলীয়-জোট-বহির্ভুক্ত এবং অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন আসন লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তারাও বিরোধী দল হিসেবে সে সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ১৭ অক্টোবর ২০০৫ তারিখে বাংলাদেশে জঙ্গি ধর্মীয় সংগঠন ‘হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী’-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠি জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে জেএমবি’র বোমা হামলায় দু’জন সিনিয়র সহকারী জজ নিহত ও আরও তিনজন ব্যক্তি গুরুতর আহত হন। উক্ত ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ঝালকাঠি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত কর্তৃক সিদ্দিকুর ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইসহ সাতজন শীর্ষ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। অপর পাঁচজন হলেন আতাউর রহমান সানী, আবদুল আউয়াল, ফারুক হোসেন খান ওরফে খালেদ সাইফুল্লাহ, সুইসাইড বম্বার ইফতেখার হাসান আল মামুন এবং আসাদুল ইসলাম ওরফে আরিফ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-২০০৯) ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
চার দলীয় জোট সরকারের মেয়াদের শেষের দিকে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেকে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ২২ জানুয়ারি, ২০০৭ তারিখে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহমেদ ১১ জানুয়ারি, ২০০৭ তারিখে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর জনাব ফখরুদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠন করেন। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে নতুন কিছু মেরুকরণ দেখা দেয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত ‘হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী’ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখে ‘ইসলামী ডেমোক্রেটিক পার্টি’ (আইডিপি) নামে পুনরায় আত্মপ্রকাশ করে। দলটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন মাওলানা শেখ আবদুস সালাম। এছাড়া নাম সংশোধন করে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পায় চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ রেজাউল করীমের নেতৃত্বাধীন ইসলামী শাসনতন্ত্র (ইশা) আন্দেলন। দলটির নতুন নাম রাখা হয় ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’। দলটির জন্য প্রতীক বরাদ্দ করা হয় ‘হাতপাখা’। পাশাপাশি শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশও এ আমলে নিবন্ধন পায়। মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাকের নেতৃত্বাধীন দলের আরেকটি অংশও নিবন্ধন পায়। এই অংশের নাম রাখা হয় ‘খেলাফত মজলিশ’। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-কে তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে হয়। দলের নামও পরিবর্তন করতে হয়। দলের নতুন নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’। তাছাড়া চার দলীয় জোট সরকারের (২০০১-২০০৬) সময়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শায়খ আবদুর রহমানসহ ৬ জন জঙ্গীর ফাঁসি ২৯ মার্চ ২০০৭ তারিখে কার্যকর করা হয়।
শেখ হাসিনার আমল (২০০৯-২০১৪) ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের পরপরই ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে এপ্রিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। একই বছর জাতীয় সংসদে সন্ত্রাসবিরোধী আইন পাশ করা হয়। আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী এজেন্ডা ছিল যুদ্ধাপরাধীর বিচার। সে লক্ষ্যে নবনির্বাচিত সরকার অফিসিয়াল গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে The International Crimes (Tribunals) Act, 1972 (Act No. XIX of 1973) এর ৬ ধারা অনুযায়ী ২৫ মার্চ ২০১০ খ্রি. তারিখে একজন চেয়ারম্যান ও দুই জন সদস্যের সমন্বয়ে প্রথম এবং ২২ মার্চ ২০১২ খ্রি. তারিখে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার জন্য একজন চীফ প্রসিকিউটরসহ মোট ২৪ জন প্রসিকিউটর এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলা তদন্তের জন্য একজন কো-অর্ডিনেটরসহ মোট ২২ জন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ঢাকা বিভাগে ১১২টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৪টি, রাজশাহী বিভাগে ৬৬টি, খুলনা বিভাগে ১৮৪টি সিলেট বিভাগে ৫০টি, বরিশাল বিভাগে ৫১টি, রংপুর বিভাগে ৩০টি সর্বমোট ৫৭৭টি মামলা দায়ের করা হয়। এ সকল মামলার মধ্যে এই সময়কালে উভয় ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সর্বমোট ১০টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। তার মধ্যে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং তিনজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীগণ হলেন, জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, দুই সহকারী- সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আশরাফুজ্জামান খান ওরফে নায়েব আলী ও চৌধুরী মঈনদ্দিন। আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন হলেন, জামায়াত ইসলামীর প্রাক্তন আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বিএনপি নেতা কাজী আবদুল আলীম। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ১২ ডিসেম্বর আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন। গোলাম আজম আমৃত্যু কারাভোগরত অবস্থায় এবং এ কে এম ইউসুফ বিচারাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক এ সময় জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হয়। এ সরকারের মেয়াদে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ৫ ফেব্রুয়ারি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঢাকার শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের সংগঠন ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ আত্মপ্রকাশ করে। আত্মপ্রকাশের সময় থেকে গণজাগরণ মঞ্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে।
ক্রমশ এই কর্মসূচিগুলিতে সমমনা প্রায় সকল রাজনৈতিক দল তথা সামাজিক- সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মী-নেতৃবৃন্দের সমর্থন-অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। পশ্চিমবঙ্গসহ বিদেশে অবস্থানরত সহমতের প্রায় সকলেই এতে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়। এক পর্যায়ে দেখা যায়, ‘জাগরণ’-এর অন্যতম নেতা ডা. এমরান এইচ সরকার বিভিন্ন মহলের প্রলোভন-প্ররোচনায় নিমজ্জিত হয়ে ‘জাগরণের’ যাত্রা লক্ষ্যভ্রষ্টে নিপতিত হয়। এক পর্যায়ে ‘জাগরণের’ এই জনসমর্থন ‘ক্ষমতাসীন সরকার’ কর্তৃক অনেকটা ‘অধিগ্রহণ” করার কায়দায় ‘জাগরণের’ জনপ্রিয়তা নিজেদের অনুকূলে নিয়ে নেয়। অতপর ‘জাগরণের’ জনপ্রিয়তা ক্রমশ বিড়ম্বনার বিস্ময় সৃষ্টি করে এবং জনমনে উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত রেখেই বিলুপ্তি ঘটে।
দ্বিতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনার আমল (২০১৪-২০১৫) ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উপর্যুপরি দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। এ সময় যুদ্ধাপরাধ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পূর্বের অবস্থান ও ভূমিকা অব্যাহত রাখে। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুকে সভাপতি করে জঙ্গিবাদের অর্থের উৎস অনুসন্ধানে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। পূর্বের মেয়াদে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় যথাক্রমে ২১ নভেম্বর বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করা হয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গিবাদকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আখ্যায়িত করে তা মোকাবিলায় সব রাষ্ট্রকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিশ্বে মানবসভ্যতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে আজ আমরা সবচেয়ে বড় দুটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি, যার একটি সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গিবাদ, এটি বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের কোন ধর্ম নেই, সীমানা নেই। সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সব রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে হবে।’
তবে এতকিছুর পরও আমরা লক্ষ্য করি জঙ্গিবাদ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জই থেকে যায়। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা সর্বাধিক আলোড়িত ঘটনা। এই নিষ্ঠুর হামলায় দেশী বিদেশী বাইশ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়।
তৃতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনার আমল (২০১৮-) ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও উপর্যুক্তপরি তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। এই নির্বাচনে নিবন্ধনপ্রাপ্ত প্রায় সকল প্রতিনিধিই অংশগ্রহণ করে। কেউ একক, কেউ-বা বড়ো দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে, কেউ-বা স্বতন্ত্রভাবেও নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র সাংগঠনিক দুর্বলতা, সর্বোপরি বিজয়ী হলে সরকার প্রধানের পদ চূড়ান্তকরণের অমীমাংসা ইত্যাদি বহুমুখী জটিলতার কারণে আওয়ামী লীগের প্রশাসনিক শক্তির সহায়তার কাছে হেরে যায়। ভোটার উপস্থিতির সংখ্যাল্পতার এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২৫৭টি, জাতীয় পার্টি ২২টি, বিএনপি ৬টি, ওয়াকার্স পার্টি ৩টি, স্বতন্ত্র ৩টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ২টি, গণফোরাম ২টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ১টি ও জাতীয় পার্টি জে পি ১টি আসন লাভ করে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচনে নিষ্ক্রীয়ভাবে হেরে যাবার পরে এই দলের সাথে সংশ্লিষ্ট ইসলামিক দলগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। বিশেষত আল্লামা আহমেদ শফী’র নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলামের সাথে যুক্ত অপরাপর স্বগোত্রীয় ইসলামী দলগুলো সরকারের সাথে সখ্যতা বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়। এই সখ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ শেখ হাসিনাকে তাঁরা ‘কওমী মাতা’র খেতাব প্রদান করে। সেই সাথে সৌদি সরকারের অনুদানে নির্মিতব্য প্রত্যেক উপজেলায় ৫৬০টি ‘মডেল মসজিদ’ প্রকল্পে নীতি নির্ধারণী ভূমিকায়ও যুক্ত হয়।
যেহেতু বাঙালির ধর্মবোধে প্রজ্ঞাপূর্ণ জ্ঞান প্রচ্ছন্ন নয়— ‘সরল বিশ্বাস’ এর সঙ্গে সুবিধাপ্রাপ্তি সংযোগ ঘটাতে পারলে ধর্মবিশ্বাসীদের পরিতুষ্ট ও শান্ত করা সহজ হয়। এই সহজলভ্য ‘ছলনাময়ী’ রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জ্ঞানতাত্ত্বিক বিকাশ— ঘটে প্রজ্ঞার পরাজয়— ‘অদ্ভুদ আঁধারে’ নিমজ্জিত হয় সমাজ। এই ‘অদ্ভুদ আঁধার’ থেকে পরিত্রাণ পেতে ‘সূচেতনা’কে রাজনীতিতে ফিরে আসতে হয়। এতদ্ভিন্ন নির্বোধের ধর্মবোধতাড়িত ও সুবিধাভোগী দুর্বৃত্তায়নসম্পৃক্ত রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
বর্তমান অধ্যায়ে ধর্মে রাজনীতি অনুপ্রবেশ করেছে, না-রাজনীতিতে ধর্ম অনুপ্রবেশ করেছে তার সামাজিক-রাজনৈতিক পূর্বাপর ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ধর্ম যখন দুর্বল হয় তখন সে রাজনীতিতে আশ্রয় নেয় আর রাজনীতি যখন দুর্বল হয় তখন সে ধর্মের আশ্রয় নেয়। অর্থাৎ উভয়ের দুর্বলতায় একে অপরের পরিপূরকের ভূমিকা পালন করে। এমতাবস্থায় ধর্ম ও রাজনীতি উভয়েই স্বধর্মচ্যুত তথা মূল স্বভাব বৈশিষ্ট্য হারায় এবং প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। একারণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক পোষকতায় পক্ষপাতী। কিন্তু রাজনৈতিক ইতিহাসে এই সুবচন এখনো নির্বাসনে আছে। তই ধর্ম ও রাজনীতির পারস্পরিক প্রভাব এবং তার প্রয়োগ অপপ্রয়োগের যে-ইতিবৃত্ত এখানে উপস্থাপিত হয়েছে তাতে পাঠক তার প্রত্যাশিত সঠিক চিন্তা সম্প্রসারণে সহায়তা পাবেন। বর্তমান অধ্যায়ের আলোচনায় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রচিন্তকদের প্রকাশিত মৌলিক চিন্তার নির্যাস। তবে বাঙালি চিন্তকদের সাথে বিদেশী রাষ্ট্রচিন্তকদের চিন্তার সারাৎসার ও পর্যবেক্ষণমূলক অভিজ্ঞতার অভিমত সমূহও এখানে উঠে এসেছে। এতে সন্ধিৎসু পাঠকবৃন্দ এ বিষয়ে একটি তুলনামূলক চিন্তার অংশীদার হয়ে বাঙালির প্রচলিত রাষ্ট্রচিন্তায় ধর্মের অবস্থানকে সুনির্দিষ্ট করার সুযোগ পাবেন। যেহেতু মানবকল্যাণে ধর্মের মূল আদর্শের ব্যবহার আর ক্ষমতা ধরে রাখতে ধর্ম বিশ্বাসকে ব্যবহার একই অর্থে মান্যতা পেতে পারে না। কেননা ‘বিশ্বাস হিসেবে ধর্ম’ আর ‘মতাদর্শ হিসেবে ধর্ম’ একই তাৎপর্য বহন করে না। ধর্মদর্শনের এই মৌলিক পার্থক্য বিচারে অক্ষম মানুষের চিন্তার বিচ্যুতিই রাষ্ট্রীয় সর্বমানবিক বোধকে বিভ্রান্ত করে চলেছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে শাসকের স্বধর্মের সপক্ষে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানের পদক্ষেপ প্রতিহত করতে হবে। সর্বোপরি রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিযুক্ত করার সকল অন্তরায় সুনিশ্চিতভাবে দূরিভূত করতে হবে।
নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি
Muhammad Abdur Rahim, The Principles of Mohammedan Jurisprudence; Lahore, 1968
M. H. Quresh, Islamic Jurisprudence; Karachi, 197০
Thomas Scott, The Global Resurgence of Religion and the study of World Politics; Millenium, 24/2,1995
Mohammad Hasim Kamali, Principles of Islamic Jurisprudence; Islamic Texts Society, UK, 2003
Mohamed El. Awa, Punishment in Islamic Law, American Trust Publication, Nyrk, 2000
Dr. Hasan Zaman, Political Secience and Islam; Islamic Foundation Bangladesh, Dhaka, 1986
Stainly Woolpart, Jinnah of Pakistan; Oxford University Press, 1984
Aesha Jalal, The Sole Spoke Man: The Muslim League and Demand for Pakistan, Cambridge University Press, Karachi, 1985
Anita Indor Shing, The Origin of Partition of India (1936-1947 ); Oxford University Press, Delhi, 1987
Joya Chatariee, India Divided; University Press Limited, Dhaka, 1991
Henry Campbell Black, Black’s Law Dictionary; (6th edition ) St. Paul Minn, West Publishing Co. London, 199০
J, Carbon and E. Owens (eds.), The Sacred and the Sovereign : Religion amd International Politics; Washington D. C. : Georgetown University Press, 2003
D. F. Mullah, Principles of Hindu Law, Tripathi, Bombay, 1982
স্যার আবদুর রহীম, ইসলামী আইনতত্ত্ব (অনু. গাজী শামছুর রহমান); ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮০
অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাক, কুরআনের রাষ্ট্রনীতি; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ১৯৮৬
হারুনূর রশীদ, রাজনীতিকোষ; মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৯
আবুল কাসেম ফজলুল হক, রাষ্ট্রচিন্তায় বাংলাদেশ; কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০৪
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম তালুকদার, ধর্মদ্রোহী ব্ল্যাসফীমার ফৌজদারী ও মুরতাদ আইন; সজিব ল’ বুকস্, ঢাকা, ২০০৭
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ধর্ম, রাষ্ট্র, রাজনীতি; অনন্যা, ঢাকা ২০১০
সা’দ উল্লাহ, ধর্ম, রাজনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতা; অনন্যা, ঢাকা, ২০১০
শাহরিয়ার কবির, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মের নামে সন্ত্রাস; অনন্যা, ঢাকা, ২০১১
শাহরিয়ার কবির, বাংলাদেশে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা; অনন্যা, ঢাকা, ২০১১
শাহেদ ইকবাল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি; প্রকাশনা : সুবর্ণ, ঢাকা, প্র. প্র. ২০১৬
আকবর আলি খান, অবাক বাংলাদেশ : বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি; প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৭
পিনাকী ভট্টাচার্য, মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম; প্রকাশনায়: গার্ডিয়ান পাবলিকেশন, চতুর্থ সংস্করণ, ঢাকা, ২০১৮
মিখাইল বাকুনিন, ঈশ্বর এবং রাষ্ট্র (অনু.) অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৯