দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমুব বলে শুইনি। কেন জানি খুব ক্লান্ত লাগছিল। মা ডাকলেন, খেতে আয় বেনু। আমি বললাম, আসছি। বলেই বিছানায় শুয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। মা ডেকে তুললেন না। মা আগের মত নেই। একবার ডেকেই দায়িত্ব শেষ করেছেন। সারাদিন না খেলেও দ্বিতীয়বার ডেকে কিছু বলবেন না। তাছাড়া ভাইয়ার সঙ্গে মার আবার ঝগড়া হয়েছে। শীতল বাপড়া। এই ঝগড়ার পর মা আরো চুপ করে গেছেন। কারো সঙ্গেই কিছু বলছেন না।
ঝগড়ার কারণ অতি তুচ্ছ। সকালবেলা ভাইয়াকে চা দিতে দিতে মা বললেন, তুই কি একবার বগুড়া যাবি?
ভাইয়া চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, অবশ্যই যাব। কি ব্যাপার?
মা অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, স্বপ্নে দেখলাম তোর বাবা বগুড়ায়।
ভাইয়া গম্ভীর গলায় বলল, স্বপ্নের উপর নির্ভর করে এতদূর যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
আমার স্বপ্ন ঠিক হয়।
তুমি যে স্বপ্ন বিশারদ তাতে মা জানতাম না।
মা কঠিন গলায় বললেন, ঠাট্টা করছিস?
না ঠাট্টা করছি না। শুধু জানতে চাচ্ছি তোমার স্বপ্নের উপর নির্ভর করে এতদূর যাওয়াটা কি ঠিক হবে।
ঠিক না হলে যাবি না।
রাগের কথা না মা। যুক্তির কথা। বগুড়াতো ছোট্ট একটা জায়গা না। অনেক বড় জায়গা। সেখানে বাবাকে কোথায় খুঁজব? স্বপ্নে এ্যাড্রেস পেয়েছ?
তোকে কিছু খুঁজতে হবে না। স্বপ্নতো স্বপ্নই। স্বপ্নের আবার কোন মানে আছে।
বলতে বলতে মার চোখে পানি এসে গেল। মা আঁচলে মুখ ঢেকে তাঁর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। সেই দরজা রাত দশটার আগে খোলা হল না।
মাকে খুশি করবার জন্যেই ভাইয়া বগুড়া ঘুরে এল। হোটেলগুলিতে খোঁজ করল। থানার ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করল। কাজের কাজ কিছু হল না। ভাইয়া ফিরল ঘুসঘুসে জ্বর নিয়ে।
মার রাগ পড়ল না।
ভাইয়া যখন বলল, মা হাসি মুখে দুটা কথা আমার সঙ্গে বল। বগুড়া দেখে। এলামতো।
মা কিছুই বললেন না। ভাইয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এর পরের বার যদি এ জাতীয় স্বপ্ন দেখ তাহলে অবশ্যই আসল ঠিকানা জেনে নেবে।
যে কথা বলছিলাম সে কথায় ফিরে আসি। আপনি নিশ্চয়ই আমার কথা বলার ভঙ্গিতে বিরক্ত হচ্ছেন। আসলে আমি এক নাগাড়ে কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি না। প্লীজ কিছু মনে করবেন না।
ক্লান্ত হয়ে শুয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এসে গেছে। দিনে ঘুমুলে আমি সব সময় স্বপ্ন দেখি। সেদিনও স্বপ্ন দেখছি। দুঃস্বপ্ন। যেন একটা লোমশ ভালুকের মত লোক দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে পড়তে চাচ্ছে।
হাতুড়ি দিয়ে দরজায় প্রচন্ড জোরে বাড়ি দিচ্ছে। তার হাতুড়ির শব্দেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। জেগে উঠে শুনি সত্যি সত্যি দরজায় কে যেন টোকা দিচ্ছে। আমি উঠে গিয়ে দরজুা খুললাম। ভবঘুরে টাইপের একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে চাদর। লম্বা লম্বা চুল। চোখ লাল। আমি বললাম, কাকে চান?
রঞ্জু সাহেব বাসায় আছেন?
আমি না জেনেই বললাম, উনি বাসায় নেই। আমার ইচ্ছে করছিল না যে ভাইয়া লোকটার সঙ্গে কথা বলে। আমার মনে হচ্ছিল লোকটা ভাল না। হয়ত একটু আগে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি বলে এরকম মনে হচ্ছে।
কখন ফিরবেন?
জানি না কখন ফিরবে। ভাইয়ার সঙ্গে আপনার কি দরকার?
উনি আপনার ভাই?
হুঁ। আপনার প্রয়োজনটা কি?
একটা খবর ছিল।
কি খবর?
আড়ালে বলতে চাই।
আমি হকচকিয়ে গেলাম। আড়ালে বলতে চাই মানে? এমন কি খবর লোকটার কাছে আছে যা সে আড়ালে বলতে চায়? তাছাড়া এখন আমাদের আশে পাশে কেউ নেই। এরচে আড়াল কি হতে পারে?
খবর টা আপনার পিতা সম্পর্কে।
বলুন।
উনি কোথায় আছেন আমি জানি।
বলুন কোথায় আছেন।
নারায়নগঞ্জে থাকেন। একটা বিবাহ করেছেন। তাঁর একটা কন্যা সন্তান আছে।
আপনি কে?
আমি কে তা দিয়ে আপনার প্রয়োজন কি? আমার খবর সত্য। আমি রঞ্জু সাহেবকে খবর দিয়েছিলাম তিনি বিশ্বাস করেন নাই। গালাগালি করেছেন। কিন্তু খবর সত্য।
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এবং এই প্রথম বুঝলাম যে আমি আসলে খুব শক্ত নার্ভের মেয়ে। অন্য কেউ হলে হৈ চৈ শুরু করে দিত। আমি কিছুই করলাম না। চুপচাপ লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁত খুচাচ্ছে।
আপনার পিতা যাকে বিবাহ করেছেন তার নাম সরজুবালা। হিন্দু মেয়ে। বিবাহ হয়েছে চার বছর আগে।
এই সব খবর আপনি আমাকে দিচ্ছেন কেন? আপনার উদ্দেশ্য কি?
লোকটা বিড়ি ধরাল। উৎকট গন্ধ। ঢাকা শহরে আমি কাউকে বিড়ি খেতে দেখিনি। ঢাকা শহরের রিকশাওয়ালারা পর্যন্ত সিগারেট খায়। এই লোকটা বিড়ি টানছে। আর্মি কঠিন গলায় বললাম, আপনার উদ্দেশ্য কি?
আমি সামনের মাসের এক দুই তারিখে আবার আসব। তিন হাজার টাকা জোগাড় করে রাখবেন। আমি আপনাদের ঠিকানা দিব।
আপনার নিজের ঠিকানা কি?
আমার নিজের কোন ঠিকানা নাই। আপনারা টাকা জোগাড় করে রাখবেন। সামনের মাসের এক দুই তারিখে আসব।
লোকটা চলে যাবার পর আমি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মার ঘরে ঢুকলাম। মা ঘুমুচ্ছেন। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ছোট খাট একজন মহিলা। তাঁর চোখের কোনে পানির দাগ। কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি মার ঘর থেকে আপার ঘরে ঢুকলাম। আপা বলল,
কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
কারো সঙ্গে না। এক লোক ঠিকানা জানতে চাচ্ছিল।
ও আচ্ছা। চা খাওয়াতে পারবি রেনু?
পারব।
আমি চা বানিয়ে নিয়ে এসে দেখি আপা শাড়ি পাল্টাচ্ছে। চুল বেঁধেছে। আপাকে লাগছে ইন্দ্রানীর মত। আমি বললাম, কোথাও যাচ্ছ?
হুঁ।
কোথায়?
আমার এক বান্ধবীর জন্মদিনে।
আপা চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল। আমি তাকিয়ে আছি মুগ্ধ চোখে। এই সামান্য সাজেই কি সুন্দর যে আপাকে লাগছে। আল্লাহ কিছু কিছু মানুষকে এত সুন্দর করে কেন বাননি?
রেনু আমি কি ঠিক করেছি জানিস? এখন থেকে সব বন্ধিবীর জন্মদিনে টী পড়ে যাব। আমার এখন খুব দ্রুত বিয়ে হওয়া দরকার। ভাইয়ার মাথা খারাপ হবার বেশি দেরী নেই। পু রি মাথা খারাপ হয়ে গেলে আমার আর বিয়ে হার না। সুন্দরী মেয়ে বিয়ে না হওয়া মানে ভয়াবহ সর্বনাশ।
মাঝে মাঝে তুমি খুব স্বার্থপরের মত কথা বল আপা।
স্বার্থপরের মত না। আমি বুদ্ধিমতী মেয়ের মত কথা বলি। রূপবতীদের বুদ্ধিমতী হওয়াতে বাধার কিছু নেই। এই বাড়ি ছেড়ে দিতে হলে আমাদের অবস্থা কি হবে কখনো ভেবেছিস?
কিছু একটা হবেই।
কিছুই হবে না রেনু। যত দিন যাবে অবস্থা ততই জট পাকিয়ে যাবে। ঐ যে লোকটা তোকে বলল, বাবার খোঁজ পাওয়া গেছে। দেখা যাবে সেটাও সত্যি।
আমি চমকে উঠে বললাম, তুমি কথা শুনেছ?
শুনব না কেন? আমি তো বধির না। আমার কান খুব পরিষ্কার! ভাইয়ার সঙ্গে লোকটার যে কথা হয় তাও শুনেছি।
কিছুতো বলনি।
বলব কেন? আগে বাড়িয়ে আমি কিছু বলি না।
তোমার কি ধারণা লোকটা সত্যি কথা বলছে?
না–মিথ্যা বলছে। বিরাট ফুড বলেই ট্রাক চাচ্ছে। তবে সব মিথ্যার সঙ্গে খানিকটা সত্যি থাকে। এবসলিউট ট্রুথ বলে যেমন কোন জিনিস নেই; এ্যাবসলিউট ফলস বলেও কিছু নেই।
আপা উঠে দাঁড়াল। আমাকে বলল, তুই আমার সঙ্গে রাস্তার মোড় পর্যন্ত আয়। চায়ের দোকানের কয়েকটা ছেলে আমাকে খুব বিরক্ত করে। একা একা যেতে ইচ্ছা করে না।
আমি আপার সঙ্গে যাচ্ছি। আপা বলল, আয় আমরা হাত ধরাধরি করে হাঁটি। আমি আপার হাত ধরলাম। আপা গলার স্বর নীচু করে বলল, রেনু আমি প্রচন্ড আতংকের মধ্যে বাস করি।
কেন?
আশার সারাক্ষণই মনে হয় শেষ পর্যন্ত আমার ভাগ্য হবে আভার মত। সন্ধ্যাবেলায় সেজেগুজে সংসদ ভবনের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে হবে যাতে কোন পুরুষ মানুষ দয়া করে এগিয়ে আসে।
তুমি এসব কি বলছ আপা?।
না জেনে বলছি না রেনু। জেনেই বলছি। আভার সঙ্গে আমার একদিন দেখা হয়েছিল। সব সে খুলে বলল–কিছুই গোপন করল না। অসাধারণ একটা মেয়ে। ওর ঠিকানা আছে আমার কাছে। আমি কি ঠিক করেছি জানিস একদিন একগাদা গোলাপ ফুল নিয়ে আভার বাসায় উপস্থিত হব।
কেন?
একটা অসাধারণ মেয়ে। ফুল ছাড়া ওর কাছে যাওয়া যায় না। বেনু একটা কথা বলি, তোর কাছে যে লোকটা এসেছিল খবদার ভাইয়াকে এই সম্পর্কে কিছু বলবি না। বেচারা এমিতেই নানান সমস্যায় অস্থির হয়ে আছে। ওকে আর জড়ানো ঠিক হবে না।
ভাইয়াকে আমি কিছুই বললাম না। খুব স্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলাম। হৈ চৈ গপ গুজব আগের চেয়ে আরো বেশি করলাম। ভাইয়া কোত্থেকে দড়ি কাটার এক ম্যাজিক শিখে এসেছে। ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেল। আমরা খুব হাসাহাসি করতে লাগলাম। আমাদের দেখে কে বলবে যে আমাদের কোন দুঃখ কষ্ট আছে।
আপার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে একদিন গেলাম আভাকে দেখতে। আভা ঘরেই ছিল। আমাকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল–ও আল্লা রেনু, বেনু। মা দেখ দেখ রেনু এসেছে, বেনু। যেন আমি বিরাট বড় এক স্টার। আমার এ বাড়িতে আসা যেন ইতিহাসের বই এ লিখে রাখার মত ঘটনা।
কেমন আছ রেনু?
ভাল আছি।
তোমার ভাইয়া কেমন আছে?
ভাল আছে।
ও এখন শুধু পাগলদের সঙ্গে ঘুর ঘুর করে তাই না?
হুঁ।
আমি দুদিন দেখেছি। দুদিনই পাগলের সাথে। একদিন দেখি সে এক পাগলের গলা জড়িয়ে ধরে হাঁটছে। প্রায় চিৎকার করতে যাচ্ছিলাম অনেক চেষ্টায় নিজেকে সামলালাম। আমি ওর সামনে পড়তে চাই না।
কেন চান না?
আভা হাসতে হাসতে বলল, এক সময় আমার অনেক স্বপ্ন ছিল রেনু। এখন স্বপ্ন টপ্প নেই। তোমার ভাইয়ের দরকার স্বপ্ন আছে, এমন একটি মেয়ে। আমাকে দেখলে সে আবার আটকে যাবে। কাজেই তোমার যে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে এই খবর তুমি চেপে যাবে এবং চেষ্টা করবে যেন দুলু নামের মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ে হয়। মনে থাকবে?
আমি জবাব দিলাম না।
আভা ক্লান্ত গলায় বলল, পুরুষ মানুষ সম্পর্কে আমার মোহভঙ্গ হয়েছে রেনু। আমি আর কোনদিন কোন পুরুষকে বিয়ে করে সুখি হতে পারব না। মাকড়সা দেখলে আমাদের যেমন ঘেন্নায় শরীর কেমন করতে থাকে, পুরুষ মানুষ দেখলেও আমার এমন হয়। যাক এসব কথা, রেনু তোমার চোখ কিন্তু আরো সুন্দর হয়েছে। কোন কথা না বলে তুমি অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকি তো।
আভা আপার বাসা থেকে ফিরবার পথে আমার কেন জানি মনে হল ঐ মানুষটার সঙ্গে আমার দেখা হবে। দেখা হবেই। এবং অল্প কিছু সময় তিনি যদি আমার সঙ্গে কথা বলেন তাহলে আমার সব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যাবে। আমার মনে হতে লাগল তিনিও আভা আপার মত আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে বলবেন, আরে তোমার চোখ দুটিতো ভারি সুন্দর।
আমি ঐ রাস্তায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। সন্ধ্যা মিলিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল। গুন্ডাধরণের এক ছেলে আমার কাছে এসে বলল, এই যে আপামনি অনেকক্ষণ ধরে ঘোরাঘুরি করছেন। কেইস কি?
আমি বাসায় ফিরলাম। রিকশা করে কাঁদতে কাঁদতে ফিরলাম। কেন কাঁদছিলাম নিজেও জানি না। রিকশাওয়ালা দরদ মাখা গলায় বলল, কি হইছে আপনের? কি হইছে?
কি যে আমার হয়েছে তা কি আমি নিজেই জানি?