৬. তেসুতি কলের সাহেব

৩৬.

ফার্ডিনান্ড, তেসুতি কলের আর একজন সাহেব। ওয়াল্টারের অ্যাসিস্ট্যান্ট বলতে যাকে বোঝায়। সেও সাহেব, দেশীয় লোকেরা যে অর্থে সাহেব বলে। গোরা, প্যান্ট-কোট পরে আর ইংরেজি বলে। আসলে সে ফিরিঙ্গি। নাম ফার্ডিনান্ড। বয়স বছর চব্বিশ-পঁচিশ। কোঁকড়ানো কালো চুল, কালো চোখের মণি। ইওরোপ থেকে সে আসেনি। জন্ম কলকাতাতেই। ফার্ডিনান্ড মাকে চেনে, বাপকে কখনও চোখে দেখেনি। ছোটকালে তার মা বলত, বাপ মারা গেছে। যে ছিল তার জন্মদাতা, পিতা। শিশু বয়সে একজনকে সে বাবা বলত। সেই লোকটি ছিল তার মায়ের স্বামী। নাম ছিল তার ক্যাভাস, কাজ করত ভাটিখানায়। ফার্ডিনান্ডকে ভালবাসত খুব। নিজের জন্মদাতার সম্পর্কে শুনেছে ফার্ডিনান্ড, সে ছিল নাবিক। জাহাজে সে এসেছিল। দেড় মাস ছিল কলকাতায়। খিদিরপুরে, মিসেস রডার শুড়িখানায় সে রোজ আসত। থাকতও প্রায়ই সেখানে। ফার্ডিনান্ডের মায়ের বয়স তখন চৌদ্দ। মিসেস রডার খাস ঝি ছিল সে। নাম ছিল তার মেরি।

মিসেস রডার শুঁড়িখানায় অনেক মেয়ে ছিল। সি-মেনরা সব সময়েই আসত তার শুড়িখানায়। মেয়েমানুষ না রাখলে তার চলত না। মেরির উপর অনেকের টাঁক ছিল। কিন্তু খাণ্ডারনী রড়া বুড়ির ভয়ে, সেদিকে কেউ হাত বাড়াত না। উপযুক্ত পাত্র না পেলে, মেরিকে উৎসর্গ করার ইচ্ছে ছিল না তার।

ডাকাবুকো প্রকাণ্ড চেহারা আর বুনো শুয়োরের মতো গোঁয়ার নাবিক ফার্ডিনান্ড রড়া বুড়ির মনের মতো নাগর ছিল না। কিন্তু লোকটা ভয়ংকর ষণ্ডা। ইচ্ছে করলে এক নিমেষে গুঁড়িখানাটাকে সে তছনছ করতে পারত। ভানুমতী নামে এক চুরি করা বাঙালি মেয়ে ছিল রড়া বুড়ির কাছে। ফার্ডিনান্ড সেই মেয়েটির জন্য একলা লড়েছিল আধডজন সিমেনের সঙ্গে। সব কটিকেই শুইয়ে ছেড়েছিল সে। ভানুমতীর পরে মেরির উপর নজর পড়েছিল তার। রডা বুড়ি রুখতে পারেনি। পনেরো বছর না পুরতে মেরির ছেলে হয়েছিল।

সেই ছেলে তেসুতি কলের ফার্ডিনান্ড, ওয়াল্টারের অ্যাসিস্ট্যান্ট।

তারপরে মেরি চলে এসেছিল ক্যাভাসের সঙ্গে, শুড়িখানা ছেড়ে। বড় হয়ে ফার্ডিনান্ড সব কথা শুনেছে। আর চিরকাল ধরে স্বপ্ন দেখে এসেছে, সে তার বাবার দেশে যাবে।

নতুন জাহাজ আসার সংবাদ পেলে, মেরি ছুটে যেত ডকে। সঙ্গে ছেলে। কেন যেত মেরি? সেই ডাকাবুকো ষণ্ডা নাবিকের চেহারাও তত ভাল মনে নেই। পুরনো স্মৃতি হাতড়ে যখনি সে দেখতে গিয়েছে, চোখের সামনে ফুটে উঠেছে বিশাল চওড়া পাথরের মতো একটি লোমশ বুক। শক্ত মোটা ধূসর বর্ণের খোঁচা খোঁচা দাড়ির মধ্যে, রক্তাভ মোটা হিংস্র দুটি ঠোঁট ছোট্ট মেরিকে দম চেপে দিয়ে শুষে নিংড়ে নিতে চাইত। ধোপার কাপড় কাঁচার মতো আছড়ে আছড়ে ফেলত প্রকাণ্ড বুকে। মেরির তখন মনে হত, ঘাড় দুমড়ে মারা ছোট একটা মুরগির মতো লোকটা তাকে মেরে ফেলতে চায়। তাই সে চিৎকার করত, কাঁদত। কিন্তু লোকটা সে সব একেবারেই রেয়াত করত না। ঠিক যেমন মুরগির চেঁচামেচি পাখা ঝাপটাঝাঁপটি কেউ লক্ষও করে না।

কিন্তু মেরি মরত না। বরং, কয়েকদিন পরে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। নিয়মিত পীড়নের জন্য সে প্রস্তুত হত। ভয়ে সে চোখ বুজে থাকত। হাজার অনুরোধেও সে চোখ খুলত না। শত চেষ্টা করেও, লোকটা একদিনও তাকে হাসাতে পারেনি। কারণ মেরির যে কিছুতেই হাসি পেত না। তখন লোকটা রাগে ও ঘৃণায় তার মুখে গায়ে থুথু ছিটিয়ে দিত।

মেরি শুধু ভয়ে বিস্ময়ে কুঁকড়ে থাকত।

তারপর একদিন সে চলে গিয়েছিল। ছেলে হওয়া পর্যন্ত মেরির মনে হয়েছিল, সে মরে যাবে। কিন্তু পৃথিবীর সবটাই বিস্ময়ের। সে মরেনি। ছেলে হওয়ার পর মিসেস রডার শুড়িখানায় সে আরও অনেকের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছে। শেষ পর্যন্ত শুড়িখানা ছেড়ে চলে এসেছিল ক্যাভাসের সঙ্গে।

কিন্তু নতুন জাহাজ আসার সংবাদ পেলে আর স্থির থাকতে পারত না সে। ছেলে ফার্ডিনান্ডকে নিয়ে ছুটে যেত ডকে। আর একবার তাকে দেখতে চেয়েছিল মেরি। এই চাওয়াটা প্রেম নয়। কারণ মেরি ক্যাভাসকে ভালবাসত। পুরুষের অভাব ছিল না মেরির। কিন্তু কী এক বিস্ময়কর কৌতূহল ও আকর্ষণ তাকে টেনে নিয়ে যেত ডকে। একবার সে দেখতে চায় সেই লোকটিকে, একবার শুধু দেখতেই চায়। কে সেই লোকটা, কেমন দেখতে। এত পুরুষকে তার দেখা হল, কিন্তু প্রথম পুরুষটাকে একেবারে মনেই পড়ে না। যেন গলায় কাঁটা আটকে থাকার অস্বস্তি। শুধু একবার চোখে দেখতে পেলেই, সে কাঁটা নেমে যেত। কিন্তু অনেক জাহাজ আসত, অনেক যেত। সেই লোকটা আর কোনওদিন আসেনি। মেরির সে কৌতূহল মেটেনি কোনওদিন।

লোকটিকে সবাই ফার্ডিনান্ড বলে ডাকত। মেরিও তার ছেলেকে ফার্ডিনান্ড বলত।

সেই ফার্ডিনান্ড, ওয়াল্টারের অ্যাসিস্ট্যান্ট। অ্যাসিস্ট্যান্ট বললে ভুল হবে। কাজ জানে সে সামান্যই। খবরদারিটাই তার আসল কাজ। কটা রং, ধর্মে খ্রিস্টান, কথায় সাহেব। তাই তার মাইনে কিছু বেশি। আসলে ওয়াল্টারের সবরকম কাজই সে করে। দরকার হলে, বিছানাও পেতে দেয়, খানসামার সঙ্গে রান্নারও সাহায্য করে। ফরাসডাঙা থেকে বাজার করে আনে। ভাটিখানা আর গুঁড়িখানার পরিবেশে বেড়েছে ফার্ডিনান্ড। মায়ের জীবনটা দেখেছে। দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে সে ছোট থেকেই। দশ বছর বয়স থেকে, নিজের রুটি নিজেকেই রোজগার করতে হয়েছে। ইংরেজি আক্ষরিক শিক্ষাটা পেয়েছিল সে ক্যাভাসের কাছে। কিন্তু মায়ের মতো, তারও কৌতূহল ছিল, সেই অদেখা অচেনা নাবিককে দেখবার। তাই, অবুঝ বয়সে সে যেমন তার আসল বাবাকে দেখতে যেত ডকে, জ্ঞান হয়েও তেমনি অনেকবার গিয়েছে। যত অচেনা নাবিকেরা আসত তাদের সবাইয়ের মধ্যেই যেন সে তার জন্মদাতাকে দেখতে পেত। সেই সব বিদেশি নাবিকেরা তাকে আদর করত, পয়সা দিত। আর জিজ্ঞেস করত, ছোট ছেলেটি তার মায়ের কাছে তাদের নিয়ে যেতে চায় কি না।

তখন ফার্ডিনান্ড জিজ্ঞেস করত, তোমার নাম কী?

নাম শুনে বলত, না, মার কাছে তোমাকে নিয়ে যেতে পারব না। কারণ তুমি ফার্ডিনান্ড নও।

 নাবিকেরা অবাক হত, তারপরে ঠাট্টা তামাশা করত।

তখন থেকে ফার্ডিনান্ড স্বপ্ন দেখত, সে একদিন তার বাবার দেশে যাবে। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে, কোথাও আছে সেই বিচিত্র দেশ। যেখানে তার বাবা থাকে। মস্তবড় নাকি চেহারা। রড়া বুড়ি বলত, কুড়িটা সাদা শুয়োর এক করলে যা হয়, সেইরকম নাকি ছিল তার বাবা। পিপে পিপে মদ খেতে পারত, দশটা জোয়ানের মহড়া নিতে পারত একলা।

মেরিদের সমাজে ফার্ডিনান্ডের খাতিরও ছিল। কারণ, বাপ তার খাঁটি ইওরোপের লোক। কিন্তু বয়স বাড়তে লাগল। কোনও দিন বাবা এল না। বাবার দেশে যাওয়া হল না। মেরির লাথি গুঁতো, ক্যাভাসের করুণা তাকে খিদিরপুরের পাকা উঞ্ছ করে তুলেছিল।

আঠারো বছর বয়সে সে পুলিশে চাকরি পেয়েছিল।

কিন্তু সে চাকরি সে নিজেই ছেড়ে দিয়েছিল। মেরির কাঁধের উপর মূর্তিমান পাপের মতো চেপেছিল সে। শেষ পর্যন্ত ক্যাভাসও নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল।

বছর চারেক আগে, বড়দিনের আগের দিন, চাঁপদানির ক্রুকশন গিয়েছিল মেয়েমানুষের খোঁজে কলকাতায়। ক্রুকশন আস্তানাগুলি চিনত সবই। মেরিরও পরিচয় ছিল তার সঙ্গে। মেরি তাকে ধরেছিল, ছেলেটাকে যদি একটা কোনও চাকরি দিয়ে নিয়ে যায় ক্রুকশন, তবে বেঁচে যায়। কারণ, কলকাতার বাইরে থাকলে হয়তো ফার্ডিনান্ড একটু ভাল থাকতে পারে।

ক্রুকশন রাজি হয়েছিল আর শেষ পর্যন্ত গছিয়ে দিয়েছিল ফোর্ট গ্লাস্টারের ওয়াল্টারের কাঁধে। ওয়াল্টারের অবশ্য একজন শ্বেতাঙ্গ দরকার ছিল। কিন্তু এরকম লোক নয়। তবে মন্দের ভাল বলে ছেড়ে দেয়নি। সেই থেকে, ফার্ডিনান্ড ওয়াল্টারের বোঝা। ইতিমধ্যে অবশ্য ফার্ডিনান্ড মদ ও মেয়েমানুষের ব্যাপারে ঝানু হয়ে উঠেছিল।

মাঝে মাঝে কলকাতায় যায় বটে ফার্ডিনান্ড। কিন্তু ওয়াল্টারের কাছে সে প্রায় স্থায়ী হয়ে বসেছে। ফার্ডিনান্ডের একটি গুণ ছিল। যে কোনও খাঁটি ইওরোপীয়কে সে তার বাবার মতো দেখত। কেন, তা সে জানে না। যে কোনও বয়স্ক, ইওরোপের অধিবাসীর মধ্যেই সে যেন তার বাবাকে দেখতে পেত। আপনা থেকেই ভক্তি শ্রদ্ধা আসত তার মনে।

ওয়াল্টারকেও সে বাবার মতোই দেখত। শুধু লক্ষ্মী বাগদিনি কিংবা বিনু মুচিনির কাছে গেলে, কোনও কথা তার মনে থাকে না। এ দুজনেই তার সব রকমের সঙ্গিনী। তেসুতিকল শুধু নয়, সারা অঞ্চলের মেয়েরাই, ভান্ডা সায়েবের জ্বালায় অস্থির।

ফার্ডিনান্ড কেমন করে, অর্বাচীন দেশীয় জিহ্বায় ভান্ডা হয় সেটা চিন্তার বিষয়। কিন্তু ফার্ডিনান্ড ভান্ডা হয়ে গিয়েছে।

লক্ষ্মী বাগদিনি তার প্রথম জুটি জগদ্দলে। দ্বিতীয় জুটি শুণ্ডিনী বিনু মুচিনি। চোখে লাগার মতো মেয়ে চোখে পড়লে ফার্ডিনান্ড সহজে তাকে নিষ্কৃতি দেয় না। প্রায়ই অভিযোগ শুনতে হয় ওয়াল্টারকে। কারণ শুধু চোখ টিপে, কথা বলে, বৃন্দাবনি মশকরা জানে না ভান্ডা সায়েব। সরাসরি গায়ে হাত দিতে আসে।

যাদের ঘোরতর আপত্তি আছে, তারা পাগলা সায়েবের কাছে এসে কেঁদে পড়ে। তবে কখনও একেবারে বেসামাল হয়ে ওঠে না ফার্ডিনান্ড। ওয়াল্টারকে সে ভয় পায়। কারণ ওয়াল্টার শুধু খাঁটি ইওরোপের নোক নয়, শক্তিশালী লোকও বটে।

কিন্তু শ্রদ্ধা ও ভক্তির একটা মূল্য আছে বোধহয় সংসারে। বিরক্ত হয়ে অনেকবার তাড়াতে গিয়েও ফার্ডিনান্ডকে তাড়াতে পারেনি ওয়াল্টার। তার রুক্ষ স্কচ বুকে কোথায় যেন একটুখানি নরম জায়গা ছিল এই উঞ্ছ ফার্ডিনান্ডের জন্য।

ওয়ালিক জানত ওয়াল্টারের এই পুষ্যিটির কথা, তার চরিত্রের কথাও। যদিও টমাস ডাফের চিফ ওভারসিয়ারের জানা উচিত নয় ফোর্ট গ্লাস্টারের কোনও খারাপ কথা। কোনও কোম্পানিই তাদের সামান্যতম দুর্বলতার কথা, অন্য কোম্পানিকে দিতে নারাজ। জানলেও কখনও স্বীকার করবে না।

কিন্তু ওয়াল্টার আর ওয়ালিকের সম্পর্ক আলাদা। ওয়াল্টার নিজেই বলেছে সব কথা। আর ওয়াল্টার ঠিকই বলেছিল যে, ফার্ডিনান্ড নিশ্চয়ই তার তালে আছে। তারা যখন ম্যাকলিস্টারের জন্য অপেক্ষা করছে, ফার্ডিনান্ড তখন বিনু মুচিনির আড্ডায়। কারখানাতেই লোক আছে ওত পেতে। ম্যাকলিস্টার এলে, ছুটে গিয়ে সংবাদ দেবে তাকে।

বিনু মুচিনি ধমকাচ্ছে ফার্ডিনান্ডকে। অই গো, অই ভান্ডা সায়েব, ওঠ গো। সময় হল, পালাও এবারে। কারখানার ছুটি হবে এখুনি। সবাই এসে পড়বে।

ফার্ডিনান্ড নিখুঁত বাংলা বলতে পারে। ইংরেজির চেয়েও ওইটিই বোধহয় বেশি ভাল জানে। গোঙা স্বরে জবাব দিল, আজ কোনও শালার ছুটি হবে না। পাগলা সায়েব আটকে দিয়েছে তামাম মাগি-মদাকে। একটা বড় সায়েব আসবে আজ। তুই আর একটু ঠাণ্ডা রস দে আমাকে।

বিনুর কাঁচা মাটির মেঝেয়, বড় বড় গর্ত। তাতে গলা অবধি ডোবানো তাড়ির ভাঁড়। বরফের মতো দাঁত কনকনানো ঠাণ্ডা নয়, বুক জুড়িয়ে যাবার মতো শীতল সে পানীয়। ওই তাড়ির লোভ একলা ফার্ডিনান্ডের নয়, ওয়াল্টারেরও। এই চৈত্রে, আর আগামী বৈশাখ জ্যৈষ্ঠে, মাটির গর্তে ডোবানো তাড়ির ভাঁড়ের ভারী কদর।

বিনু বলল, তবে ছাড়, উঠি। নইলে দেব কেমন করে?

 দরজা খোলা-ই। বিনুর স্বামী ইন্দির বেরিয়েছে রসেরই খোঁজে। বড় মেয়েটা ঘুরতে গিয়েছে আদাড়ে বাঁদাড়ে। কোলের ছেলেটাকে কোমরে লম্বা দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে দাওয়ার বাঁশের খুঁটিতে। কালো কুটকুটে ছেলে বিনুর। কান্নাকাটির বালাই নেই। যেন শুয়োরের বাচ্চাটা ঠাণ্ডা মাটিতে আপন মনে খুঁটে খুঁটে ছড়িয়ে দেওয়া মুড়ি খাচ্ছে। হামা দিয়ে খেলছে।

ভান্ডা সাহেব জোর করে ঘরে টেনে নিয়ে গিয়েছে বিনুকে।

বিনু হেসে বাঁচে না। আমরণ। একী সায়েব গো। দিন নেই, দুপুর নেই, যখন খুশি টানাটানি করলে চলে নাকি? কিন্তু বিনুর ভালই লাগে। বিনু মুচিনির এ এক খেলা। প্রেম নয়। টকটকে ফরসা গোরা সায়েব তাকে জড়িয়ে ধরলে, তার নিজের কালো কুচকুচে শরীরের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের আর শেষ থাকে না। ঠিক যেন কষ্টিপাথরে সোনার মতো। ভান্ডা সায়েবের সঙ্গে তক্তপোশের উপর শুয়ে, বেড়ায় গোঁজা আয়নায় তাকিয়ে দ্যাখে বিনু। ভারী মজা লাগে। নিজের কালো কুচকুচে চোলাই-পটু হাতখানি ভাণ্ডার ধবধবে ফরসা বুকের উপর রেখে হেসে মরে যায় সে।

ফার্ডিনান্ড বলে, কী দেখিস তুই?

 বিনু হেসে বলে, কালো আর সাদা। মাইরি, কী বিচিত্তির গো! বড় সোন্দর লাগে দেখতে, না?

ফার্ডিনান্ডেরও খেলাটা মন্দ লাগে না। সে বিনুর মুখটা মুখের কাছে টেনে এনে আয়না ধরে সামনে। তারপর দুজনেই হাসে। ভান্ডার রক্তাভ ঠোঁট আর বিনুর বেগুনি ঠোঁট মেশামেশিতে পটুয়ার তুলির গাঢ় রঙের দাগের মতো দেখায়। আয়না ধরে দেখতে গিয়ে বিনু হেসে বাঁচে না।

রঙেরও কী বিচিত্র টান এই সংসারে। কালোর বিস্ময় গোরা আর গোরার বিস্ময় কালো।

তখন ভান্ডা বলে, জানিস, আমার বাপ খাঁটি সায়েব, সমুন্দরের ওপার থেকে এসেছিল।

বিনু বলে, আর তোমার মা?

সে এখানকার মেয়ে।

–আমার মতন?

–না, আমারই মতন গোরা। আমরা কালা আদমি নয়।

বিনু হুশ করে নিশ্বাস ফেলে বলে, আহা, মাইরি তোমার মতন যদি আমার একখান ছেলে হত, তো বেশ হত।

ভান্ডা বলে, কিন্তু তোর ছেলে আমাকে বাপ বললে আমি গলা টিপে মেরে ফেলব। বিনু বলে, আ মরণ! তোমাকে বাপ বলতে যাবে কোন দুঃখে। আমার ভাতার নেই?

হ্যাঁ, স্বামী ইন্দিরের জন্য গরব তো কিছু কম নেই বিনুর। তবে টকটকে গোরা একখানি ছেলের বড় সাধ হয় কালো মেয়েমানুষের। তা বলে ভান্ডাকে নিয়ে তো আর ঘর করবে না বিনু। ঘর ইন্দিরের, ইন্দিরেরই ঘরনি সে। এ অঞ্চলের সবার সেরা শুণ্ডিনী।

তবে, বোধহয় রস নিয়ে কারবার করলে, রসের মেজাজে একটু এদিক ওদিক হয়েই থাকে। রসের নিজের একটা মর্জি আছে। সেই মেজাজে ইন্দির চলে, বিনুও চলে। দশজনকে রস খাওয়ানো তো শুধু নয়, সঙ্গে বসে খাওয়াও বটে।

কিন্তু, ভান্ডা সায়েব তার কাছে এলে লক্ষ্মী বাগদিনি যে জব্দ হয়, তাতে একটু শান্তি পায় বিনু। কারণ কালিন্দী লক্ষ্মীর গায়ের সঙ্গে ভান্ডা গোরাকে দেখে, প্রথম ভান্ডার গায়ে গা দিতে সাধ হয়েছিল তার।

বিনু হাসছে খিলখিল করে। ভান্ডার সঙ্গে সেও গিলেছে। হাসি শুনলেই বোঝা যায়।

মায়ের হাসি শুনে, দাওয়ার ছেলেটাও কচি গলায় খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল। ছেলের হাসি শুনে ঘর থেকেই ডেকে বলল বিনু, ও সোনামানিক আমার, তুইও হাসছিস?

ছেলেটা হাত তুলে, দুর্বোধ্য গলায় ডেকে উঠল, গা গা গা মম।…..

বিনু আবার বলল, কই ছাড়, উঠি। ভাঁড় দিচ্ছি নতুন, খেয়ে এবারে যাও। তাড়িয়ালার আসার সময় হল।

কিন্তু অলস এই চৈত্র দুপুরে তাড়ির রস জমেছে ফার্ডিনান্ডের। বলল, তাড়ি লাগবে না, তুই থাক।

সায়েব, কলকেতার সায়েব এসে পড়েছে। ভান্ডা লাফ দিয়ে উঠল। শুণ্ডিনীর ঠাণ্ডা পুষ্ট ঢলঢলে শরীরের থেকে সাহেবের ডাক তার কাছে বড়।

.

৩৭.

তেসুতিকলের ঘাটে, বরানগর মিলের স্টিম লঞ্চ এসে ভিড়ল। ম্যাকলিস্টার এসেছে। বাউরিয়ার ম্যাকলিস্টার।

ওয়াল্টার ম্যাকলিস্টারের পরিচিত। অপরিচিত শুধু ম্যাকলিস্টারের সঙ্গী। ম্যাকলিস্টার আর তার সঙ্গী দুজনেরই মধ্য বয়স। দুজনেরই দাড়ি আছে। ম্যাকলিস্টারের চওড়া শরীর, চৌকো মুখ। সাদা হাফ শার্ট আর খাকি লং প্যান্ট সে পরে এসেছে। কিন্তু গলার টাই ঢিল করা, আর বুকের বোম খোলা। লোম ভেদ করে, এই চৈত্রেই গজিয়ে ওঠা ঘামাচিতে রক্তবর্ণ দেখাচ্ছে তার বুক। মাথায় সাদা হ্যাট। দাঁতে কামড়ে ধরা মোটা চুরুট। কোঁচকানো চোখের চারপাশে সহস্র ভাঁজ। ছোট ছোট নীল চোখে ঈগলের চাউনি।

ম্যাকলিস্টারের সঙ্গী, সাদা ফুলপ্যান্ট আর পাতলা ফিনফিনে সাদা সিল্কের ফুল শার্ট। লাল টাই উড়ছে বাতাসে। দাড়ি একটু বড় ম্যাকলিস্টারের চেয়ে একটু রোগা, তাই লম্বা মনে হয়। সোনার চেন দেওয়া পকেট ঘড়ি। মাথায় কালো টুপি, চোখে রিমলেস চশমা। চাউনি শান্ত ও গভীর।

ম্যাকলিস্টারের হাত পা বেশি নড়ছে, দ্রুত কথা বলছে। প্রথমেই সে পরিচয় করিয়ে দিল তার সঙ্গীকে, মি. ডি. বি. ওয়ালেস, বরানগর মিলের অন্যতম পাইয়োনিয়ার। আর ইনি মি. পি. ওয়াল্টার, ফোর্ট গ্লাস্টার স্পিনিং মিলের সর্বময় কর্তা।

বলে ওয়াল্টারের দিকে তাকিয়ে, ম্যাকলিস্টার আদর করে চোখ টিপল। আর সেই সঙ্গেই অ্যাপলজি, সর্বময় কর্তা বলায় যেন সে রাগ না করে। ওয়াল্টার কর্মচারী মাত্র। ফোর্ট গ্লাস্টারের আজ সর্বময় কর্তা বলতে যদি কেউ থাকে তবে সে ম্যাকলিস্টার। ওয়ালেস হাত বাড়িয়ে দিলেন ওয়াল্টারের দিকে। বললেন, অনেকবার শুনেছি আপনার কথা।

ওয়াল্টার ধন্যবাদ দিয়ে ওয়ালিক আর লিটলজনের পরিচয় করিয়ে দিল, মি. জর্জ ওয়ালিক, চিফ ইঞ্জিনিয়র অব শ্যামনগর জুট মিল। টমাস ডাফ যার এজেন্ট। আর ইনি মি. লিটলজন, রিপ্রেজেন্টেটিভ অব বেগ ডানলপ কোম্পানি।

পরিচয়ের পালা শেষ হল। মি. ওয়ালেস জর্জ ওয়ালিকের হাত ধরে বললেন, আপনার কথা আমি সবচেয়ে বেশি শুনেছি। টমাস ডাফের আপনি একজন মস্তবড় পাইয়োনিয়ার, ওলডেস্ট ওভারসিয়ার, অ্যান্ড ইন্ডিয়া অথরিটি।

ওয়ালিকের নাকের ডগা টুকটুকে হয়ে উঠল। বলল, অনেক বাড়িয়ে প্রশংসা করছেন। আপনি বোর্নিও কোম্পানির পুরনো পাইয়োনিয়ার। আপনাদের দেখে আমরা শিখেছি। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

ওয়ালেস, ওয়ালিকের হাত ধরে কয়েকবার বঝাঁকানি দিয়ে বললেন, কিন্তু বন্ধু, আমরা একসময় দুজনেই টমাস ডাফের ছাতার তলায় ছিলাম। বরানগর মিল একসময় তাদেরই এজেন্সিতে এসেছিল।

কোন বছরে যেন…?

ওয়ালিক বলে উঠল, এইটিন সিকসটি সেভেন আই থিঙ্ক?

বোনিও কোম্পানি ১৮৬৭-তে টমাস ডাফে এজেন্সিতে এসেছিল। ওয়ালিক তখনও এদেশে একেবারে আনকোরা। সেই বছরেই বাংলাদেশে টমাস ডাফ কোম্পানি তখন দরজা খুলেছিল। এখন বরানগর মিল জর্জ হেন্ডারসন অ্যান্ড কোম্পানির হাতে।

ওয়ালেস বললেন, ঠিক, ঠিক তাই। তার চার বছর আগেই তো সেই ভীষণ সাইক্লোনটা হয়ে গেল। হোয়াট এ হরিবল সাইক্লোন! আমাদের কারখানার আশপাশে গরিব নেটিভদের একটা বাড়িও বাঁচেনি। খবরের কাগজে দেখেছি, মিলিয়নস নেটিভ একেবারে আশ্রয়হীন হয়ে গেছল। আমাদের কারখানা বিল্ডিং তো সেবারেই জখম হল। আর… ওয়ালেসের চোখে স্মৃতির স্বপ্ন নেমে এল সহসা। চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিলেন। বললেন, সেই সাইক্লোনেই আমাদের বরানগর সালকিয়ার কাছে জলে ডুবে গেল। বরানগর হুগলি নদীতে সেটাই ছিল প্রথম স্মল স্টিম ক্র্যাফট, স্টিম লঞ্চ। বরানগর যখন গুড়গুড় করে চলত, নদীর দু পাড়ে লোক দাঁড়িয়ে যেত তাকে দেখবার জন্যে। নেটিভরা তার আগে কখনও স্টিমলঞ্চ দেখেনি।

ওয়ালিক তা জানে। বরানগর কোম্পানির নামে সেই ক্ষুদ্র স্টিম লঞ্চটির নামও বরানগর রাখা হয়েছিল। একবার দেখার সৌভাগ্যও হয়েছিল। ম্যাকলিস্টার বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, বোর্নিও কোম্পানির জলে ভাসানো গুবরে পোকাটা তো? ওটাকে আমিও অনেকবার দেখেছি।

ওয়ালেস করুণভাবে একটু হাসলেন। বললেন, আপনি ওটাকে গুবরে পোকার সঙ্গে তুলনা করছেন?

ওয়ালেস যে আহত হয়েছেন, তা বোঝা গেল। লিটলজন-এর মুখ লাল হয়ে ফুলে উঠল। ম্যাকলিস্টারকে প্রথম দেখা থেকেই তার বিরূপতা টের পাওয়া যাচ্ছিল। ওয়ালেস একটু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। সে মনে প্রাণে চাইল, সে লিটলজনের দৃষ্টি তার দিকে পড়ে। লিটলজনকে কিছু না বলার জন্যেই ইশারা করতে চায়। ম্যাকলিস্টারকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সে দুর্মুখ, কিছুটা অহংকারী ও বিদ্রূপপরায়ণ। অথচ আত্মবিশ্বাস পূর্ণমাত্রাতেই আছে। সেটা তার ভাবে ভঙ্গিতে ব্যবহারেই পরিস্ফুট। লিটলজন এক্ষেত্রে বেফাঁস কিছু বললে, ম্যাকলিস্টার তাকে তুলোধোনা করে ছাড়বে।

ওয়ালেস বললেন, গুবরে পোকার সঙ্গে তুলনা করতে পারেন, কিন্তু কোম্পানির দুর্দিন না হলে, ওটাকে কখনওই বিক্রি করা হত না। আমি জানি না, ক্যালকাটার সব থেকে পুরনো রিষড়া মিলকে আপনি কী বলবেন।

ম্যাকলিস্টার চোখ কুঁচকে হেসে, আঙুল নেড়ে বলে উঠল, আমি ওটাকে এ বিউটিফুল স্ক্র্যাপ হাউস বলব।

শুনে ওয়ালেস-এর মুখ আরও লাল হয়ে উঠল। লিটলজন আর সামলাতে পারল না। যথাসম্ভব রাগ চেপে সে বলে ফেলল, কেন? একদা এই রিষড়ার কারখানা জুট ইন্ডাস্ট্রির পথ দেখিয়েছিল বলে।

ম্যাকলিস্টারের ভ্রু কুঁচকে উঠল, ঠোঁট বেঁকে গেল। ঘাড় দুলিয়ে, আঙুল নেড়ে বলল, ইয়েস, ইয়েস মিস্টার রিপ্রেজেন্টেটিভ অব বেগ ডানলপ, ঠিক তাই। আমি ওটাকে ভালবাসি, তাই ওটাকে বিউটিফুল স্ক্র্যাপ হাউস বলব, মাফ করবেন, আমার ভালবাসার ভাষাটা হয়তো বেগ ডানলপের মতো নয়। রিষড়ার এই স্ক্র্যাপ হাউসই এই যে হুগলি নদীর দু ধারে আজ আমাদের ছুটিয়ে নিয়ে এসেছে, এ আনন্দের কথা আমি ভুলতে পারি না। আপনারা হয়তো মনে মনে রিষড়ার ওই পরিত্যক্ত মিলটাকে স্ক্র্যাপ হিপ বলবেন আর হাসবেন, কিন্তু আমি গৌরব করে বলব। খুব জোরে চিৎকার করে বলব, এ বিউটিফুল, গ্লোরিয়াস স্ক্র্যাপ হাউস। আমি মেকি কথা বলতে পারি না, বুঝেছেন? তাই বোর্নিও কোম্পানির সেই ছোট্ট স্টিম লঞ্চটাকে আমি ওই নামেই ডাকি, একটা ভাসমান গুবরে পোকা। আমি জানি, অনেক মূর্খ লন্ডনের টেমস আর ডান্ডির টে নদীর ধার থেকে সদ্য সদ্য এ দেশে এসে ওটাকে ভাসমান গুবরে পোকা বলেই নিষ্ঠুর ঠাট্টা করেছে, আমি বলি মহৎ আনন্দে, সেজন্যে আমাকে মিথ্যে কথা সাজিয়ে বলতে হয় না, বুঝতে পারছেন, মিস্টার রিপ্রেজেন্টেটিভ অব বেগ ডানলপ? ফিলাডেলফিয়ার যে কোনও ছোট শিশুকে আমার ভাল লাগলেই তাকে আমি সাদা ভাল্লুকের বাচ্চা বলতাম।

ওয়ালিক হেসে উঠল। ওয়ালেস এবং ওয়াল্টারও। ওয়ালেসের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ওঁর মুখের রক্তাভ মেঘ কেটে গেছে। বিস্ময়ে ও খুশিতে উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল ওঁর মুখ। আর ওয়ালিক তো প্রায় প্রেমিকের মতো তাকিয়েছিল ম্যাকলিস্টারের দিকে। কেবল লিটলজন-এর মুখটিই উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছে।

ম্যাকলিস্টার বলে চলল, কিন্তু, বাই দি ওয়ে, ফিলাডেলফিয়াতেই একদিন, এক মহিলা ভীষণ চটে গেলেন, তাঁর বাচ্চাকে আমি আদর করে সাদা ভাল্লুকের বাচ্চা বলেছি বলে। আমি তাড়াতাড়ি ক্ষমা চেয়ে বললাম, আমার খুবই অন্যায় হয়েছে, উনি যেন এটাকে নিছক আদর বলেই মনে করেন। ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন, ও, তুমি সত্যি আদর করে বলছ নাকি? কিন্তু ও যে সত্যি ভাল্লুকেরই বাচ্চা! আমি তো থ। ভাল্লুকের বাচ্চা! ভদ্রমহিলা বললেন, ও আমার ছোট বোনের ছেলে বটে, কিন্তু এই বাচ্চার বাবার নাম হোয়াইট বিয়ার জেরি। যে মারা গেছে।আমার তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল, দ্যাট বিগ জায়ান্ট, আনকঙ্কারার রেসলার হোয়াইট বিয়ার জেরি। সেই নাম করা কুস্তিগীর, যাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছল ম্যাসনদের বাগানের পাঁচিলের ধারে। সারা আমেরিকায় তখন তার নাম ডাক, ইউরোপে যাবার তোড়জোড় চলছিল। ঠিক সেই সময়েই, যাকে বলে একেবারে কুঠার ছিন্নভিন্ন অবস্থায় হোয়াইট বিয়ার জেরিকে মেরে ফেলা হয়েছিল। সে খবর আপনারা কাগজে পড়েছেন বোধহয়। আর, কারা মেরেছিল, সেটাও সকলেই জানত, যদিও আইনত তাদের শাস্তি দেওয়া যায়নি। নিশ্চয়ই কনডনস ব্রাদাররাই মেরেছিল। কারণ ওরা তিন ভাই-ই তখন সবথেকে নাম করা কুস্তিগীর ছিল। এবং ওদের সুনাম ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছিল জেরি, একমাত্র বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী।…আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, বলেন কী! আমি যে জেরির একজন রেগুলার ভক্ত ছিলাম। আর সেই জেরির বাচ্চা? মহিলাটি তো ভীষণ খুশি। বললেন, আপনি ওর বাবার ভক্ত ছিলেন? আমাদের জেরির? তবে আপনি আমার এই বোনপোকে ধরে আদর করছেন না কেন? আমি তৎক্ষণাৎ বাচ্চাটিকে বুকে নিয়ে, যাকে বলে একেবারে দমাদ্দম চুমো খাওয়া, তাই খেলাম।

ওয়ালিক আর ওয়াল্টার হোহো করে হেসে উঠল। ওয়ালেসও হেসে উঠলেন। লিটলজন হাসির মতো করে একটু ঠোঁট কোঁচকাল মাত্র।

কথা বলতে বলতে সবাই একটা আম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। দক্ষিণা বাতাস এখনও তেমন উত্তপ্ত হয়ে ওঠেনি। গঙ্গার উঁচু পাড়ের গাছতলার শীতল ছায়া বেশ উপভোগ করছিল। নানান সুরে আর স্বরে পাখিরা ডাকাডাকি করছে। কারখানার সীমানার বেশ খানিকটা দূরে দূরে,নীচের দিকের মাঠে অনেকে কাজ করছে। সামনে আসন্ন বর্ষা। মাঠে মাঠে পলি ধরে রাখার ব্যবস্থায় এখন থেকেই অনেকে ব্যস্ত। লাঙ্গল পড়বে শীঘ্রই। পলিমাটির ফসলের ভাগ্য যে পরম ভাগ্য। তারা সকলেই লক্ষ করেছিল সাহেবদের। স্টিম লঞ্চের শব্দের আকর্ষণেও অনেকে ইতিমধ্যে আশেপাশে উঁকিঝুঁকি মারছে। সাহেবের দল আর লঞ্চ দুই-ই দেখা হচ্ছে। বলাবলি করছে, নতুন সায়েব। কলকাতার ঠেঙে এয়েছে, না? দ্যাখ আবার কী মতলব নিয়ে এয়েছে। মতলবের আশঙ্কা হল, নতুন কারখানা এবং উচ্ছেদের ভয়।

ওয়াল্টার চাইল গঙ্গার ধার থেকে বাংলোতে অথবা কারখানায় যেতে। সে অনুরোধ করতে উদ্যত হতেই, ওয়ালেস হাত বাড়িয়ে ম্যাকলিস্টারের সঙ্গে করমর্দন করলেন। বললেন, মাইডিয়ার, আমি আপনাকে বুঝতে পারিনি বলেই ভুল করেছিলাম।

ম্যাকলিস্টার হাত ঝাঁকানি দিয়ে বলল, আ রে, সেজন্যে আপনি ভাবছেন কেন, আমি ভুল বোঝার সুযোগ আপনাকে বেশিক্ষণ দিতাম না। মি. লিটলজন আমার ওপর বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন বলে, আমি এত কথা বললাম। উনি যদি আমাকে বুঝে থাকেন, তা হলেই ভাল।

লিটলজনকে হাসির ভঙ্গিতে, অর্ধস্ফুট উচ্চারণে জানাতেই হয়, সে এখন সবই বুঝেছে। যদিও ওয়ালেসের মতো রীতিমতো শিক্ষিত ভব্য মানুষকে ম্যাকলিস্টারকে খাতির করতে দেখে সে একটু বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ।

ম্যাকলিস্টার বলে উঠল, কিন্তু যার বিষয়ে এত কথা আমরা বলছিলাম, সেটি এখন কোথায়? সেই গুবরে পোকাটি, কেমন আছে?

ওয়ালেস বললেন, ওঃ, বন্ধু, সে আমাদের ছেড়ে গেছে। তার সঙ্গে বোর্নিও কোম্পানির কত যে সুখ দুঃখের ঘটনা জড়িয়ে আছে। আপনারা শুধু সালকিয়ার কাছে ডুবে যাওয়ার খবরই জানেন। তার তিন বছর পরে, বালির কাছেও একবার গঙ্গায় ডুবে গেছল সে। তারপর দু-একটা নতুন স্টিম লঞ্চ এসে পৌঁছুতে লাগল, আমাদের সে ছোট্ট লঞ্চটির তেমন আকর্ষণ আর রইল না। অবিশ্যি, তার সঙ্গে এটাও মানতে হবে, আমাদের কোম্পানির অবস্থাও আগের থেকে খারাপ হয়ে আসছিল। ঢাকা জেলায়, নারায়ণগঞ্জের মেসার্স এম ডেভিড অ্যান্ড কোম্পানিকে গত বছর ওকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারাও বরানগর-কে রাখতে পারেনি। রিসেন্টলি ঢাকার নবাবকে বিক্রি করে দিয়েছে। খবর পেলাম, ঢাকা শহরের বুড়িগঙ্গা নদীতে নবাব সাহিব সেই লঞ্চে এখন হাওয়া খেয়ে বেড়ায়। হয়তো এখন তার নামও বদলে গেছে।

ওয়ালেসের বলার মধ্যে এমন একটা ভঙ্গি আর সুর ছিল, সকলেই যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠল। এরা সকলেই জুট ইন্ডাস্ট্রির পুরনো মানুষ, পাইয়োনিয়ারই বলতে হবে। এদের সকলেরই মনের একটা ঐক্য আছে। লিটলজন ছাড়া, বাকি চারজনের কেউ-ই তৈরি কারখানায়, তৈরি গদিতে এসে বসেনি। তারা কারখানা তৈরি করেছে। টিনের শেডের মধ্যে দিনের পর দিন বাস করেছে, যতদিন বাসস্থান তৈরি হয়নি। একদিক থেকে দেখতে গেলে, তাদের পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতার সম্পর্ক। তারা কেউ জর্জ হেন্ডারসন অ্যান্ড কোম্পানির, কেউ টমাস ডাফ, কেউ ফোর্ট গ্লাস্টার-এর। আর সময়টা হল উনবিংশ শতকের আট দশক। উৎপাদন, শ্রমিক, কারিগর আর বাজার দখল নিয়ে তাদের মধ্যে ভীষণ লড়াই। তারা কেউ কারুর উন্নতি সহ্য করতে পারে না। তবু আজ যখন তারা পরস্পর মিলিত হয়েছে, আর পুরনো দিনের একজন যন্ত্র (স্টিম লঞ্চ) কথা আলোচনা করছে, এখন তাদের মনের তারে একটা জায়গাতেই টঙ্কার লেগেছে।

লিটলজন মনে মনে হাসছিল। এদের কথায় নয়, সে মনে মনে ঢাকার নবাবের কথা ভেবে, বিদ্রূপ করে হাসছিল। বোর্নিও কোম্পানির মান্ধাতা আমলের ঝরঝরে স্টিম লঞ্চ এখন নবাবের বিলাস সামগ্রী হয়েছে। অথচ হিন্দুস্থানের নবাবদের, বিলাস এবং ভোগের কত আজগুবি গল্পই না সে শুনেছে। লিটলজন জানে না, এটা তার দুর্ভাগ্য। সে যা শুনেছে এবং পড়েছে, তা প্রত্যক্ষ করতে পায়নি। এবং এটাও ঠিক, সে নতুন এসেছে, তাই ওয়ালেসদের সঙ্গে তার মনের ঐক্য গড়ে ওঠেনি। যে কারণে সে বোর্নিও কোম্পানির মান্ধাতা আমলের ঝরঝরে স্টিম লঞ্চের উপর কোনও আকর্ষণই বোধ করছে না। সে যা বলেছে, নিতান্ত ভদ্রতার জন্যেই বলেছিল। ম্যাকলিস্টারকে ভাল লাগেনি বলেই বলেছিল। অন্যথায় এদের কোনও কিছুর সঙ্গেই তার প্রাণের সম্পর্ক নেই। এখন সে একজন বেগ ডানলপের কেতাদুরস্ত প্রতিনিধি। টমাস ডাফ তাকে সাহায্য করেছে। কোম্পানির ওভারসিয়ার ইঞ্জিনিয়াররা এসে শীঘ্রই পৌঁছুবে। ওদিকে, সিরাজগঞ্জের ধসে যাওয়া কারখানা থেকে যন্ত্রপাতি বোঝাই হয়ে আসছে পূর্ববঙ্গের কর্মচারীদের নিয়ে। সে নিজে বাস করছে গারুলিয়ার টমাস ডাফের বাংলোতে। এখনও লিটলজন দুর্ভাগ্যের কিছুই দেখতে পায়নি। যখন কাজ আরম্ভ হবে হাতে কলমে, টমাস ডাফ হঠাৎ সরে দাঁড়াবে এবং শত্রুর মতো কুঞ্চিত করে তাকাবে, লিটলজন যখন আবিষ্কার করবে, তার দু মাইল দক্ষিণে টমাস ডাফ, দু মাইল উত্তরে জার্ডিন স্কিনার, এবং সে দূরত্বটা আসলে দূরত্বই নয়, শ্রমিক শক্তির জন্যে নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করতে হচ্ছে, তখন হয়তো লিটলজনও এদের মতোই অনুভব করবে।

ওয়ালেস বলে উঠলেন, কিন্তু মি. ম্যাকলিস্টার, কাল রাত থেকে আজ পর্যন্ত, আমি একবারও আপনার মুখে ফিলাডেলফিয়ার কথা শুনিনি। আজই প্রথম শুনলাম। আপনি সেখানে কী করছিলেন?

ম্যাকলিস্টার বলল, সে কী মশাই, তা হলে আপনাকে তো আমি আসল কথাটাই বলিনি। আমি তো ফিলাডেলফিয়ারই ছেলে, ওরিজিনালি স্কচ। স্কটল্যান্ড থেকে যারা ভাগ্যান্বেষণে গিয়েছিল, আমার বাবা তাদেরই একজন। ভাগ্য কতদূর ফিরেছিল জানি না, ইন্ডিয়াতে আসবার আগে আমি ছিলাম ফিলাডেলফিয়ার একজন মোটর বাসের কন্ডাক্টর।

ওয়ালেস বললেন, কথাটা লোকের মুখে মুখে শুনেছি, কিন্তু সত্যি বলতে কী, বিশ্বাস করাই মুশকিল।

ওয়ালেস মিথ্যে বলেননি।

ভারতবর্ষে যাকে আজ ফোর্ট গ্লাস্টার কোম্পানির লিডিং স্পিরিট অব বিজনেস বলা হয়, সে ছিল ফিলাডেলফিয়ার একজন বাস কন্ডাক্টর!

সকলেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ম্যাকলিস্টারের দিকে। এটাও আবার লোকটার সেইরকম ঠাট্টা নয় তো! মজা করার জন্যেই বলছে নাকি?

ওয়ালেস জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি?

-সত্যি!

কোন সালে এসেছেন এ দেশে?

–আঠারো শো ঊনসত্তরে।

–কিন্তু আঠারো শো উনসত্তরে তো–?

 ম্যাকলিস্টার তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না না, সিকসটি নাইনে ফোর্ট গ্লাস্টার এখানে রেজিস্ট্রি করেনি, করেছে সেভেনটি টু-তে। তার আগে আমি টুডর আইস কোম্পানিতে ছিলাম। সেখানে থাকতে থাকতেই ফোর্ট গ্লাস্টারের সঙ্গে আমার একটু যোগাযোগ হয়। আমি বুঝতে পারছিলাম, কিছু একটা আরম্ভ করতে পারলে ফোর্ট গ্লাস্টার আমাকে সাহায্য করবে। আর বুঝতেই পারছেন, আমি বরফে জুড়িয়ে যাবার লোক নই। কিছু মনে করবেন না, মি. লিটলজনকে বাদ দিলে, আমরা সবাই স্কচ। আমাদের দৈহিক পরিশ্রম করবার ক্ষমতা একটু বেশি। তার ওপরে, আমার বাবার মতো, আমিও অ্যাম্বিসাস ছিলাম। কিছু একটা করবার জন্যে আমার ভিতরটা টগবগ করছিল। চুপ করে বসে থেকে ভাগ্যান্বেষণ হয় না। পূর্বপুরুষ স্কটল্যান্ড থেকে আমেরিকায় গিয়েছিল ভাগ্য ফেরাবার জন্যে, আমি এসেছি সুদূর বাংলায়। বাস কন্ডাক্টর শুনেই থ মেরে যাচ্ছেন, বাবা মা ভেবেছিল, আমার ভবিষ্যৎ, জুয়া খেলে আর মারামারি করে জেলেই কেটে যাবে। তা জুয়াটুয়া খুব খেলেছি, মারামারিও করেছি, আরও অন্যান্য যা যা দোষ থাকতে হয়, সবই ছিল।

ম্যাকলিস্টার তার স্বভাবজাত ভঙ্গিতে এক চোখ টিপে, প্রায় একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করল। সকলেই হেসে উঠল। এমনকী ওয়ালেসও মেতে গেলেন। আদর করে আর খুশিতে বলে উঠলেন, ইউ ডগ!

-ইয়েস, ভেরি মাচ ফন্ড অব বিচ।

ম্যাকলিস্টারের বলার ভঙ্গিতে আবার একটা হাসির রোল ফেটে পড়ল। স্বভাবতই যারা দূর থেকে সাহেবদের দেখছিল, তারা বলাবলি করল, গোরারা মাতাল হয়েছে। মদ খেয়েছে, না কি বলো হে?

লিটলজন যে এ সব কথা কখনও শোনেনি, বা শুনে খুশি হয়নি, তা নয়। কিন্তু মন গুনে যে ধন। সে খুশি হতে পারছে না। সে না শুনতে পাওয়ার মতো করে, অন্যদিকে অন্যমনস্ক হওয়ার ভান করে মুখ ফিরিয়ে রইল।

ওয়ালেস বললেন, তারপর?

ম্যাকলিস্টার গোড়ালি উঁচিয়ে শরীরটাকে কয়েকবার তুলে তুলে কুঁচকে বলল, তারপরেই আমার নজরে পড়ল বাউরিয়া এস্টেট। এইটিন এইটিন-এ যেখানে বিরাট জমি নিয়ে কটন মিল করা হয়েছিল। আমার সম্পর্কে যে বলা হয়, গোন্ডেন-পি-তে হাত দিতে চেয়েছিলাম আমি, সত্যি কথাই সেটা। আমার তখন সেটাই সিদ্ধান্ত। বাউরিয়ার সেই বিরাট জমি বাগান আর পরিত্যক্ত কারখানা আমি দেখলাম ঈগলের চোখে, আর আমার বুকের মধ্যে ওয়ারব্যান্ড বেজে উঠল। কিন্তু অনেকে আমাকে ভয় দেখাতে লাগল, বাউরিয়া এস্টেটে নাকি ভূত চরে বেড়ায়। রাত্রি হলেই মনে হয় কেউ যেন লোহার জুতো পায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর ইংরেজিতে চিৎকার করে কথা বলে। এটা যে শুধু নেটিভরাই বলত তা নয়। আমাদের অনেক পরিচিত বন্ধুবান্ধবেরাও বিশ্বাস করত, বাউরিয়া পোডড়া কারখানাটায় ভূত আছে। ফাঁক আপ ইওর ঘোস্ট।

ম্যাকলিস্টারের হেঁড়ে গলার খিস্তি শুনে আবার হাসি ফেটে পড়ল সকলের।

ম্যাকলিস্টার বলে চলল, আমি ইমিডিয়েটলি একটা সিন্ডিকেট তৈরি করে ফেললাম, একটা ছোট সিন্ডিকেট। আমার সঙ্গে একটা নেটিভ জুটল, তার নাম বেচারাম মুখার্জি। সত্যি বলতে কী, ও আমার বুদ্ধিদাতা বন্ধুই ছিল। একটু বেশি মদ গিলত। কিন্তু তুখোড় লোক। সাদা চামড়া বলে একটু ভয়টয় পায়, তা নইলে আমাকেই বোধহয় বিক্রি করে দিতে পারত। বেচারাম চারদিক থেকে লোক জোগাড়ে লেগে গেল। কাপড়ের কলের সেই পুরনো মেশিনই চালাতে শুরু করলাম, সেই পুরনো বিল্ডিং-এর মধ্যেই। মিথ্যে বলব না, বেচারাম না থাকলে, ও সব কিছুই পারতাম না। ওর কোনও ঘরবাড়ি ছিল বলে জানি না। একটা পুরো ভ্যাগাবন্ড, আমার সঙ্গে সবসময় থাকত। আমার সুকীর্তি বলুন আর অপকীর্তি বলুন, বেচারাম সবকিছুর সাক্ষী। তারপরে প্রায় বছরখানেক তো কটন মিল চলল, কিন্তু ব্যাপারটা খুব সুবিধের ঠেকল না। ওদিকে ফোর্ট গ্লাস্টারের একটু ভুরু কোঁচকাল। ঠিক এ সময়েই আমার কানে কানে একদিন বলল, স্যার, স্টার্ট এ জুটমিল। এটা এখন জুটের যুগ যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ আমার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। ডেভিলটা ঠিক বলেছে তো। আরম্ভ করে দিলাম নতুন বিল্ডিং। জুট! জুটমিল করতে হবে। বেচারাম নিজে গেল ইস্টবেঙ্গলে, যেখানে রিয়েল র জুটের কারবার। সেভেনটি থ্রিতেই বাউরিয়া জুটমিল স্টার্ট করে দিলাম, এবং প্রথম বছরেই, আমি টুয়েন্টি পার্সেন্ট ডিভিডেন্ড দিয়েছি শেয়ার হোন্ডারদের।

ওয়ালেস এবং আর সবাই মুগ্ধ বিস্ময়ে নানান শব্দ করে উঠল। যদিও এ সংবাদ সকলেরই কম বেশি জানা আছে।

ওয়ালেস বললেন, স্ট্রেঞ্জ! অন্তত বার দুয়েক আপনাকে আমি আমাদের বাংলোতে খ্রিস্টমাসের সময় দেখেছি। কিন্তু তখনও কিছুই জানতাম না। দিন, আর একবার আপনার হাতটা দিন।

ম্যাকলিস্টার ওয়ালেসকে তার হাত দিল, কিন্তু তার মাথাটা নুয়ে পড়ল। মুখে করুণ হাসি দেখা দিল। ওয়ালেসের হাতটা আস্তে আস্তে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ধীরে বন্ধু ধীরে। যতটা আমার ঘোড়া ছুটবে ভেবেছিলাম, তা হয়নি। পরের বছরেই দেখা গেল, উচ্ছ্বাসের কোনও কারণ নেই। ডিভিডেন্ড তো কমলই, শেয়ারের দর পর্যন্ত হুহু করে নেমে গেল। ব্যবসায় আমি সুবিধে করতে পারিনি। এমন অবস্থা হল, কারখানা বন্ধ করে দিতে হল কিছুকালের জন্যে। হাঁপাতে আরম্ভ করলাম। একশো টাকার শেয়ারের দর, ভাবতে পারেন, প্রায় আট টাকায় স্পর্শ করে ফেলল।

লিটলজনের ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপ দেখা দিল। বাকিরা সবাই একই বিস্ময়কর দুঃসংবাদে স্তব্ধ হয়ে গেল। ওয়ালিক বলল, কেন? এতদূর খারাপ হল কেন?

–ফলস অ্যাম্বিশন মাই বয়, ফলস অ্যাম্বিশন। গানি ব্যাগ-এর দিকে বেশি নজর দিয়ে কতকগুলো বাজে অর্ডার নিয়ে ফেলেছিলাম। আর সেই অর্ডারগুলোই আমাকে অসীম সমুদ্রে টেনে নিয়ে যায়। এখনও টেনে নিয়ে যাচ্ছে, এবং আমি এখনও জানি না, কোথায়, সমুদ্রের কোন সীমানায় সেই সাদা তিমি আছে, যাকে আমি আমার হার্টুন দিয়ে গাঁথব, শিকার করব।

ওয়ালেস ম্যাকলিস্টারের কাঁধে চাপড় মারলেন। বললেন, কিন্তু আপনি এখনও টেনে নিয়ে চলেছেন, এবং ফোর্ট গ্লাস্টারের হুগলি নদীর জলে ভেসে যায়নি।

ম্যাকলিস্টার মোটা গোঙাননা স্বরে বললেন, আই, ইয়েস-ইয়েস।

 ওয়াল্টার বলল, অন্য অনেকে হলে এতদিনে পালিয়ে চলে যেত।

-নো, দ্যাট কান্ট বি। তা আমি যাব না।

 রিচার্ড ম্যাকলিস্টার সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার শক্ত বলিষ্ঠ শরীর টান টান হয়ে উঠল। বলল, আমি শেষ অবধি দেখব, এবং ভাগ্যের সঙ্গে আমি পাঞ্জা ধরে বসে আছি। বাউরিয়া মিলকে আমি এসটাব্লিশ করে যাবই। আমি জানি না। তারপরেও সেখানে থাকব কি না। এটা আমি বুঝতে পারছি, কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে, আর সেটা আমার কাছে ধরা পড়বেই।

ওয়ালেস বললেন, আমি বলছি, আপনি তা পারবেন। আজ যতই দম আটকানো অবস্থা তোক বাউরিয়ার, সে দাঁড়াবেই। বোর্নিও কোম্পানির খারাপ অবস্থায় যখন আমাদের মিল চলে গেল টমাস ডাফের কাছে, তখন আমরাও হতাশায় ভুগেছি। তারপরে তাদের হাত থেকে জজ হেন্ডারসন কোম্পানি নিলে। আমরা খুব দুর্দশা থেকেই আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। আপনিও দাঁড়াবেন, নিশ্চয় দাঁড়াবেন।

ম্যাকলিস্টারের মুখে আবার তার স্বাভাবিক হাসি ফিরে এল। আবার তার চোখ আগের মতোই ঝকঝকিয়ে উঠল। বলল, থ্যাঙ্কস, স্যার মেনি থ্যাঙ্কস। বেচারামটা মরে গেল। ও আমার হাত দেখে বলেছিল, স্যার সাটানের দশা যাচ্ছে আপনার, জুপিটারকে সে চেপে রেখেছে। বছর দশেক বাদে যাতেই হাত দেবেন, শিওর সাকসেস।

লং লিভ বেচারাম!

ম্যাকলিস্টার হাত তুলে তার হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে উঠল। বাকি সবাই হেসে উঠল।

ওয়াল্টার বলল, কিন্তু এবার আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, হতে পারে এটা একটা সামান্য স্পিনিং মিল, তবু আপনাদের বিশ্রামের জন্যে একটা আশ্রয় সত্যি আছে। এবার দয়া করে, নদীর ধারের গাছের ছায়া ছেড়ে, একটু ঘরে চলুন আপনারা।

আর একবার সবাই হাসল। ম্যাকলিস্টার ওয়াল্টারের কাঁধে চাপড় মেরে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, চলো। আমি অবিশ্যি একটু বারমুখো।

ওয়াল্টারকে চোখ টিপল সে। তারপর ওয়ালিকের পাশে সরে যেতে যেতে বলল, কিন্তু আমরা কারখানাটা দেখব না? আই মিন, যাকে বলে পরিদর্শন? ওয়াল্টার সঙ্গে সঙ্গে খুব শালীন হয়ে উঠল। কারণ সে জানে, ফোর্ট গ্লাস্টার কোম্পানির পক্ষ থেকে আসলে, ম্যাকলিস্টার থ্রি প্লাই স্পিনিং মিলের বর্তমান অবস্থাই দেখতে এসেছে। এক্ষেত্রে সে ফোর্ট গ্লাস্টারের একজন মহারানির সামনে, সামান্য একজন ইঞ্জিনিয়ার মাত্র। সে বলে উঠল, নিশ্চয়ই স্যার, আপনি যখন খুশি দেখতে পারেন। আপনার অনুমতির অপেক্ষা মাত্র।

-সত্যি?

 বলে, ম্যাকলিস্টার ওয়ালেসের দিকে তাকিয়ে হাসল, আর ওয়ালিককে চোখ টিপে ইশারা করল। যেটা নাকি লিটলজনের কাছে ভালগার মনে হয়। ম্যাকলিস্টার চলতে চলতেই ওয়ালিককে বলল, তোমার প্রতিবেশী বন্ধু কেমন ঘাবড়ে গেছে দেখ। খাতাপত্র সব বোধহয় সামলে উঠতে পারেনি এখনও, না?

ওয়ালিক হাসল। বলল, না না, আমার কাছে সেরকম

 ম্যাকলিস্টার হা হা করে হেসে উঠল। ওয়াল্টার আশ্বস্ত হল। আর যাই হোক ম্যাকলিস্টারের হাসিতে কোনও সন্দেহের বিষ নেই।

ওয়ালেস বললেন, আমার তো মনে হয়, লাঞ্চ-এ বসবার আগেই একেবারে আমরা কাজকর্ম সেরে নিই। এর পরে কি আর তেমন মেজাজ থাকবে? অবিশ্যি সেটা মি. ওয়াল্টারই ভাল বলতে পারেন।

ওয়াল্টার জানে, ওয়ালেসের এ কথার মধ্যে অনেক অকথিত ইঙ্গিত রয়েছে। এখন যা ঘটতে চলেছে, সেটা ইনস্পেকশনই বলতে হবে। এ সব ক্ষেত্রে, আগেই কর্তাদের খাইয়ে দাইয়ে মন ভুলিয়ে, এমন অবস্থা করে দেওয়া হয়, খারাপ লাগলেও কিছু বলতে পারে না তারা।

ওয়াল্টার বলল, বলুন না, এখনই কাজ সেরে নেবেন। বরং লাঞ্চ-এর পরে আমরা একটু বেড়াতে যাব।

ম্যাকলিস্টার চিৎকার করে বললেন, ফাইন, ফাইন। বেঁচে থাক আমার তেসুতি কারখানার মাতব্বর।

অতএব, ওয়াল্টার কারখানার দিকেই সবাইকে নিয়ে চলল। ম্যাকলিস্টার তখন ওয়ালিককে নিয়ে পড়েছে। শোনা গেল, সে তখন ওয়ালিককে বলছে, কিন্তু আমি শুনেছি, তুমি আর টমাস ডাফের সামান্য ইঞ্জিনিয়ার নেই, ম্যানেজারের চেয়ারটা শিগগিরই তোমার দখলে যাচ্ছে। সে হিসাবে, তুমি আসলে আমার হিংসার পাত্র। কিন্তু মাই বিগ বেবি, তুমি যে খোকাই রয়ে গেছ এখনও?

ওয়ালিকের লজ্জা করছিল। বলল, কেন?

 ম্যাকলিস্টার তার মোটা ভ্রু নাচিয়ে মোটা গলায় বলল, দেশ থেকে তো বিয়ে করে আসোনি। আর এসেছিলে তিরিশ বছর বয়সে। বারো বছর দেশে যাওনি। ম্যানেজারি করছ কী করে?

গলা নামাবার চেষ্টা করলেও, ম্যাকলিস্টারের হেঁড়ে গলা নামে না। কথাটা বলে, একটি বিশেষ ইঙ্গিত করে, সে আবার চোখ টিপল।

ওয়ালিক হাহা করে হেসে উঠল। ওয়ালেস মৃদু হাসলেন। ওয়াল্টার তখন ফার্ডিনান্ডকে কী সব নির্দেশ দিচ্ছে। কেবল লিটলজন গম্ভীর।

ওয়াল্টারের এই নির্দেশের অপেক্ষাতেই ছিল ফার্ডিনান্ড। সে ছুটে গেল শপের মধ্যে। গিয়েই প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল, জোরসে কাম করো, জোরসে।..।

ওয়ালিকের চোখে তখন কীসের স্বপ্ন জেগে উঠেছে। যেন একটা গোপন শঙ্কিত আনন্দের ঝিলিক তার চোখে। সে শুধু মনে মনে বলল, কী করে আপনার দিন কাটে, কেমন করে হে ওয়ালিক!

.

৩৮.

হীরা দাঁড়িয়েছিল অফিসঘরের বারান্দায়। ও সাহেব দেখছে। কলঘরে গেলে পাগলা সায়েব এখন রাগ করতে পারে। ভান্ডা আসতে পারে তেড়ে। তাই অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু জীবনকৃষ্ণের মান যায় তাতে। আদুড় গা, বাগদি ছোঁড়াটা অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে, অফিসের ইজ্জত নষ্ট হয়। তা ছাড়া গঙ্গাস্নান অবশ্য এখনও করেননি জীবনকৃষ্ণ, কিন্তু বারেবারে ছোঁয়াছুঁয়ি করবারই যে কী দরকার?

পাশ্চাত্য বৈদিক জীবনকৃষ্ণ, খাস ভাটপাড়ার ভট্টাচার্য। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কোথাও এতটুকু জাতিগত বৈশিষ্ট্য খোয়া যায়নি। সামান্য ইংরেজি শিখতে হয়েছে, মুখে বলতেও হয়। দেশাচারের সঙ্গে এ ব্যাপারে তাঁকেও হাত মেলাতে হয়েছে। ইংরেজি শিক্ষার বিষয়ে, ভাটপাড়ায় তার চেয়ে অনেক বেশি লোক আছে। কালের উর্ধ্বে যেতে পারেন না জীবনকৃষ্ণ। ভগবান কালেশ্বর আজ অপ্রতিদ্বন্দ্বী দেবতা। তাই স্মৃতিশাস্ত্রের উপর মোটামুটি ভাল দখল থাকা সত্ত্বেও, ফোর্ট গ্লাস্টারের সুেতি কারখানায় তাঁকে কাজ নিতে হয়েছে। টোলে ছাত্র পড়িয়ে দিন ক্রমেই স্বপ্নেবিলীন হচ্ছে। কালেশ্বরের শরীরে ভবিষ্যতের অন্যরকম লিখন।

কিন্তু জীবনকৃষ্ণ এখনও চাদরেই গা ঢাকা দিয়ে রাখেন। শিখা সংক্ষিপ্ত হয়নি একটুও। প্রভাতের চন্দন ফোঁটা সারাদিনই কপালে উদিত থাকে, কখনও অস্ত যায় না। রাত্রের আহ্নিকের পর, আহার একবার। দুপুরে আর মাইলখানেক পথ হেঁটে ভাটপাড়ায় যান না। জগদ্দলেই গঙ্গাস্নান করে, পূজা আহ্নিক সেরে, গুটিকয়েক কলা আর ছানা সহযোগ সারেন। অফিসে কায়েত আছে। সাহেবদের ছোঁয়াছুঁয়ি প্রায়ই হয়। অনুগ্রহণে অশুচি বোধ করেন।

ওয়াল্টার আদর করে ডাকে পণ্ডিত বলে। জীবনকৃষ্ণ শুনে সুখী হন। সাহেব তাঁকে মর্যাদা দেয়। ওয়াল্টারের বিচার বুদ্ধির উপর অনেকখানি আস্থা তাঁর।

ওয়াল্টারও সত্যি খাতির করে পণ্ডিতকে। জীবনকৃষ্ণের মতো সাচ্চা বাবু একজনও নেই। বিশ্বস্ত তো বটেই, কোনওদিকে একটু ফাঁকি নেই। জীবনকৃষ্ণ নির্লোভ ব্রাহ্মণের প্রতিমূর্তি। কিন্তু বৈদিক শুচিতার কঠিন বন্ধনে কোথাও এতটুকু ফাটল ধরবার উপায় নেই। স্বয়ং ওয়াল্টারও জানে, জীবনকৃষ্ণ যখন গঙ্গাস্নান করে ফিরে আসবে, তখন যেন ওয়াল্টারের ছায়ার সঙ্গেও তাঁর ছোঁয়া না লাগে। সেরকম অবস্থায় ওয়াল্টার নিজেই সরে গিয়ে বলে, ছোঁয়াছুঁয়ি হলে তোমার তো আবার খাওয়া হবে না পণ্ডিত।

জীবনকৃষ্ণ বলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ সাহেব।

ওয়াল্টার হাসে। কখনও সে হাসিকে জীবনকৃষ্ণর বিদ্রূপ বলে মনে হয়নি, যেমন মনে হয় ফিরিঙ্গি ভান্ডাটাকে। ওটার কোনও জন্ম জাতের ঠিক ঠিকানা নেই, তাই ধর্মজ্ঞানও নেই। স্বয়ং ওয়াল্টারকে কেমন যেন ভক্তিমান বলেই মনে হয় জীবনকৃষ্ণের। মনে মনে তিনি আশীর্বাদ করেন ওয়াল্টারকে। সাহেবটার ভাল হোক! বিজাতীয় শ্রদ্ধাভক্তিও কত ছদ্মবেশ ধরেই না সংসারে বিরাজ করে। মহিষাসুরের মতো শত্রুরূপেও তো ভক্ত থাকে।

আজ সাদা গরদের চাদর জড়িয়ে এসেছেন জীবনকৃষ্ণা পাড়হীন ফরাসডাঙার আট হাত ধুতি। পায়ে তালতলার চটি। কপালের ফোঁটাটি আজ একটু বড় হয়েছে। একটু রক্ত চন্দনের ছিটেও যেন দিয়েছেন। বোধহয়, ওইটিই জীবনকৃষ্ণের প্রসাধন। মস্তবড় একটি ফুল শিখায় বাঁধা। জীবনকৃষ্ণ উদ্বেগে ধমকে উঠলেন হীরাকে, এই, ওরে এই ছোঁড়া, যা এখান থেকে যা। অন্য কোথাও গিয়ে দাঁড়া।

পাগলা সাহেবের প্রিয়পাত্র, অধিকারবোধ হীরারও তো কম নয়। আর মধুর শাগরেদ, বিনয় শেখেনি হীরা। বলল, কোথায় যাব?

জীবনকৃষ্ণ বললেন, যেখানে খুশি যা। এখানে দাঁড়াতে পাবি নে।

হীরার চোখেও ধার কম নয়। কাঞ্চি বাগদিনির ছেলে। স্বয়ং বাপ লখাই হার মানে তার কাছে। বলল, কেন?

কেন? গায়ে লাগল জীবনকৃষ্ণের। কঠিন গলায় বললেন, আবার কেন জিজ্ঞেস করছিস! বেরো, বেরো শিগগির!

হীরার আত্মসম্মানে লাগছে। ভালভাবে বললে হয়তো পালাত। কিন্তু পাগলা সাহেব কি তারও খাতিরের লোক নয়? বামুনটা হাঁকলেই তাকে পালাতে হবে কেন? সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

হীরার স্পর্ধায় জীবনকৃষ্ণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। বিপিন চক্রবর্তীকে বললেন, গুয়োটাকে কান ধরে নামিয়ে দিয়ে এসো তো বিপিন।

কিন্তু তার আর সময় ছিল না। সাহেবরা তখন কলঘর থেকে বেরিয়ে, এগিয়ে আসছে অফিসঘরের দিকেই।

সাহেবদের দেখে আর গলা চড়াতে পারলেন না জীবনকৃষ্ণ। চাপা গলায় খালি বললেন, দেখলে? দেখলে চক্কোত্তি, বাগদি ছোঁড়াটার ঠ্যাটামি দেখলে?

চক্রবর্তীর ঠোঁট নড়ল। কথা শোনা গেল না। গগন বোস আর এক কেরানি। ইংরেজি ভাল রকম জানে। কানে কালা। অধিকাংশ সময়েই চুপচাপ থাকে। ওয়াল্টার কাছে এলেও নড়েচড়ে না। জীবনকৃষ্ণ বলেন, গগন, সায়েবের সামনে ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বসে থেকো না বাপু। কাজ না থাকলেও একটু হাত পা নেড়ো।

গগন শুনতে পায় কি না কে জানো। নির্বিকার থাকে। কিন্তু ওয়াল্টার তাকে ঘাঁটায় না। একবার ধমকাতে গিয়ে, গগনের ধমক খেয়ে ওয়াল্টার থ হয়ে গিয়েছিল। গগন চিৎকার করে বলেছিল, তুমি বলবে, তবে আমি কাজ করব? হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক সাহেব? আমি কি ফাঁকিবাজ? তুমি কখনও আমাকে ধমকাবে না, বলে দিলাম।

ওয়াল্টার শুধু উচ্চারণ করেছিল, মাইগড! হি ইজ ম্যাড।

 কিন্তু গগন কখনও ফাঁকি দেয় না। ওয়াল্টারকে তা অবনত মস্তকে মেনে নিতে হয়েছে। আর খেপলে, গগনের চিৎকারে গগন ফাটে। সেজন্যে, সহজে কেউ তাকে ঘাঁটায় না। ওয়াল্টারের অবসর থাকলে, গগনের পিছনে লাগে মাঝে মাঝে। সকলেই লাগে সুযোগ বুঝে। এমনকী জীবনকৃষ্ণও সুযোগ বুঝে গগনকে খেপিয়ে আনন্দ পান। অবশ্যই যদি গগনের খেপে ওঠবার অবস্থা থাকে। সবসময় সে আবার খ্যাপে না। শত চেষ্টাতেও না। কানে না শুনাটা গগনের একমাত্র গণ্ডগোল নয়। তার জীবন ও মনের মধ্যেই কোথায় কতগুলি উদ্ভট অস্বাভাবিকতা বাসা বেঁধে আছে। কানে না-শোনাটা তার সঙ্গে মিশে, তাকে অদ্ভুত করে তুলেছে।

জীবনকৃষ্ণ একবার শেষ আশায় তাকালেন গগনের দিকে। যদি সে ঢিট করতে পারে হীরাকে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। সাহেবরা যে আসছে, সেদিকে পর্যন্ত তার খেয়াল নেই। তিন আঙুলে ছটাকখানেক নস্যি নিয়ে, চুপচাপ বসে আছে সে।

বরং হীরাই ভাবছে, পালাবে না থাকবে। এতগুলি সাহেব একসঙ্গে রয়েছে। তার ওপরে, কলকাতার সাহেব। সে অফিসবাড়ির বারান্দার দূর এক কোণে গিয়ে দাঁড়াল। মনে মনে আশাও পাগলা সাহেব ওকে দেখে ডাকবে।

.

কিন্তু ওয়াল্টারের সেদিকে খেয়ালই নেই। ম্যাকলিস্টারকে সে তখন সুতোর ভ্যারাইটি বোঝাচ্ছে। তিন-চার রকমের নলি তার হাতে। সাদা ধবধবে রুপোর মতো চকচকে সুতোর নলিটা সম্পর্কেই ম্যাকলিস্টারের কৌতূহল বেশি। তার দুই চোখও সুতোর মতো চকচক করছে। ম্যাকলিস্টার বলল, এই সুতোর সব লটটাই আপনি ডান্ডিতে পাঠিয়ে দেন?

কথাটা বারকয়েক জিজ্ঞেস করেছে সে ইতিমধ্যে। ওয়াল্টার আবার বলল, হ্যাঁ, ওগুলো আমি ডান্ডিতেই এক্সপোর্ট করি।

ম্যাকলিস্টারের লোমশ ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বলল, কিন্তু এটা হোম ফ্যাক্টরির অন্যায় লোভ। এই সুতো আপনার আমাদেরই দেওয়া উচিত। যদি শুধু সুতো বিক্রির জন্যে কনজিউমার্সদের কাছে যেত, আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু ডান্ডির কারখানায় এ সুতো দিয়ে ওরা ফাইনার কোয়ালিটির কাপড় তৈরি করছে নিশ্চয়। সমস্ত ক্রেডিটটা ওরাই পাচ্ছে। সুতোর গায়ে তো আর ক্যালকাটা ফোর্ট গ্লাসটার লেখা থাকছে না।

ওয়াল্টার বলল, তা কেন? নিশ্চয়ই লেখা থাকে।

ডাণ্ডির উদ্দেশ্যে একটা খিস্তি করল ম্যাকলিস্টার। ওয়াল্টারকে বলল, তোমার এ সুতো দিয়ে যখন কাপড় তৈরি হয়ে যায়, তখনও কী লেখা থাকে?

-না। তখন তো কাপড় হয়ে যায়।

 –তবে? তোমার সুতো দিয়ে কাপড় ম্যানুফাঁকচার করে ওরা, ক্রেডিটটা ওদেরই।

ওয়ালেস হেসে বললেন, আর সেই ক্রেডিটটা আপনি ওদের দিতে নারাজ। এই তো?

নিশ্চয়ই। আমাদের সুতো দিয়ে, আমরাই কাজ করব। ডাণ্ডির ফ্যাক্টরি জাহান্নামে যাক, আমাদের কি?

লিটলজন মনে মনে বলল, একেই বলে ইয়াংকি প্রবৃত্তি। কিন্তু ম্যাকলিস্টারের এ ক্ষোভের সঙ্গত কারণ ছিল। ওয়ালেস আর ওয়াল্টার কিংবা ওয়ালিকেরও তা অজানা নেই। এই ক্ষোভ কম বেশি তাদের তিনজনেরই আছে। ডান্ডি জুট ইন্ডাস্ট্রির মাতৃভূমি বলা যায়।

আধুনিক চটশিল্পের মাতৃভূমি, বাষ্পচালিত যান্ত্রিক শক্তি যার করায়ত্ত, এবং প্রধান অস্ত্র। এ ক্ষেত্রে বাংলার কুটিরশিল্পের কথা বলা হচ্ছে না। বাংলার নিজস্ব পাটশিল্প ও শিল্পীদের প্রায় একেবারে শেষ করে আনা হয়েছে। শুধু গোরু বাঁধবার দড়ি পাকাবার অবস্থায় এসে ঠেকেছে তাদের অবস্থা।

ডান্ডিই যদিও পথপ্রদর্শক, তবু ভারতের অগ্রগতি তাদের পক্ষে এখন ভীষণ মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে। এদেশের কোম্পানি আর এজেন্টরা সকলেই ইন্ডিয়ান ম্যানুফাকচারার বলে হোমে কুখ্যাত। এমনিতে, এদেশের গঙ্গার দুই তীর ধরেই কোম্পানিগুলির সঙ্গে পরস্পরের রেষারেষি লেগেই আছে। আর এদের সকলের সঙ্গে রেষারেষি লেগে গিয়েছে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার, ডান্ডির সঙ্গে। ডান্ডির কারখানায় তৈরি মালের বাজার নষ্ট করছে ভারতের তৈরি মাল। তাই ডান্ডির সঙ্গে ভারতের প্রতিযোগিতা বাড়ছে। প্রতিযোগিতা শত্রু টেনে আনছে। ডান্ডির মালের যেখানে লাভের পড়তা পড়ে না, সুদূর হিন্দুস্থান থেকে রপ্তানি করা মাল সেখানে মুনাফা লুটে নিয়ে চলে যাচ্ছে। ডান্ডি মনে করছে, ভারতের এজেন্টরা বিশ্বাসঘাতকতা করছে। আর ভারতের ম্যানুফাকচারাররা ভাবছে, বাজার দখল করতে না পারলে, এই দূর প্রাচ্যে কোম্পানিকে ডকে উঠতে হবে।

পৃথিবীর চটের বাজারে, এটাকে বাপ ব্যাটার লড়াই বলা যায়। আসল ভূতটি আছে সরষের মধ্যেই। স্বাধীন ব্যবসা আর যত খুশি মুনাফার রাস্তা ধরেই একদিন ডান্ডি বিজয় ডঙ্কা বাজিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। ইন্ডিয়ান ম্যানুফাকচারারদের হাতে আজ সেই রাস্তার পাইওনিয়রশিপ। কারণ, তাদেরই পথ চেয়ে বসে আছে আজ ইউনাইটেড কিংডম থেকে ফ্রান্স বেলজিয়াম জার্মানি রুমানিয়া আর স্পেন ইটালি। গ্রিস টার্কি থেকে স্ট্রেইটস সেটেলমেন্ট, এশিয়া আর ইউ.এস, চিলি পেরু উরুগুয়ে অস্ট্রেলিয়া। আফ্রিকার সুদূর জঙ্গলও বাদ যায় না।

ডান্ডি থেকে একদিন মহাগন্তব্যের পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই মহাগন্তব্য ভারত। বাংলার, হুগলি নদীর দুই কূল, চব্বিশ পরগনা হুগলি আর কলকাতা। মুনাফার তেজ আজ ডান্ডির চোখরাঙানিকে হেসে ওড়ায়। বরং রুদ্র হয়ে উঠতে চায়, ডান্ডির চ্যালেঞ্জকে ইন্ডিয়ান ম্যানুফাকচারাররা তাদের এক তুড়িতে, এক লহমায় পারে উড়িয়ে দিতে। ডান্ডি কেন ভুলে যায়, এই বাংলাদেশই পাটকে জন্ম দেয়, যেখানে ইন্ডিয়ান ম্যানুফাকচারাররা বসে আছে।

ডান্ডি হতাশ আর ক্রুদ্ধ। ভারতীয় কোম্পানিগুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রতিদিনই সেখানে বিবাদ। ডান্ডির পার্লামেন্ট প্রতিনিধিকে দিয়ে লন্ডনের পার্লামেন্টে তারা অভিযোগ তোলবার চেষ্টা করছে। ভারতের কোম্পানিরা বিশ্বাসঘাতক! আইন শৃঙ্খলা কিছুই তারা মানতে চাইছে না।

ম্যাকলিস্টারের সেখানেই জ্বালা। ডান্ডি ঘরে বসে আদু আদু করে কারবার চালাবে, আবার প্রতিযোগিতায় নামবারও সাহস করবে। এ কখনও হতে পারে না। ভারতে কাজ করবার যে সমস্ত সুযোগসুবিধে রয়েছে, তাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতেই হবে। একটি সুযোগও তারা হাতছাড়া করতে রাজি নয়। কী দরকার ডান্ডিতে কয়েকটা কারখানা রেখে। পাটেরই খাস দেশে বসে আছে যখন ম্যাকলিস্টাররা? তাদের অঙ্গুলিসংকেতে যখন সুদূর পূর্ববঙ্গের পাট চাষিরা মাঠে বীজ ছড়ায়। তাদেরই দালালের মুখ চেয়ে যখন কৃষকেরা হিসাব করে, শতকরা কত ভাগ জমিতে পাটের আবাদ হবে। আর গড়ে যে দেশে বছরে দশটা করে নতুন কারখানা খোলা হচ্ছে!

ওয়াল্টার ওয়ালেস ওয়ালিকদেরও এই জ্বালা আছে। দেশ ঘর বন্ধু আত্মীয় সব ছেড়ে এসেছে তারা। হাতে কলমে তারা বিশ্বজয় করছে এক দিক দিয়ে। ডান্ডির এ মাৎসর্য কেন?

বেগ ডানলপ এখনও কলকাতার উপকণ্ঠে চালু হয়নি। লিটলজন সবেমাত্র ইংল্যান্ড থেকে এসেছে। তার অন্তরের টান এখনও সাতসাগরের পারে। তাই তার মনে হচ্ছে, এ সবই ইয়াংকি প্রবৃত্তি। আসলে এটা যদি কোনও প্রবৃত্তি হয়, তবে তার নাম ইন্ডিয়ান ম্যানুফাকচারারস ইনস্টিংক্ট। তাই ম্যাকলিস্টারের কথায় ওয়াল্টার চুপ করে রইল।

কথা বলতে বলতে তারা অফিসের বারান্দায় উঠে এল। ম্যাকলিস্টার বলল, ওয়াল্টার, যদি কিছু মনে না করো, আমি তোমার ডান্ডি এক্সপোর্টের বহরটা দেখতে চাই।

ওয়াল্টার বলল, নিশ্চয়ই। খাতায় সব হিসাবই আছে।

 ম্যাকলিস্টার ওয়াল্টারের কাঁধে চাপড় মেরে বলল, এবং ঠিক হিসাবই আছে তাতে আমার একটুও সন্দেহ নেই।

ওয়াল্টার শুকনো হেসে বলল, ধন্যবাদ। হিসেবের গরমিল আমি অপছন্দ করি।

ম্যাকলিস্টার কখন ওয়াল্টারকে মিস্টার ছেড়ে শুধু ওয়াল্টার বলতে আরম্ভ করছে, নিজেরই মনে নেই। যার অর্থ বাংলায় দাঁড়ায়, তুমি করে বলা। তার মুখও একটু খারাপ। আদর করে যা বলল, তার বাংলা করলে বোধহয় এই দাঁড়ায়, এই দ্যাখো, আমার খচ্চর বুড়ো খোকাটি রেগে উঠছে আমার উপর। আরে জানি, আমি তা বলিনি। তুমি অত সিরিয়াস হচ্ছ কেন?

ওয়ালেস আর ওয়ালিক হেসে উঠল। লিটলজনের কাছে ভালগার লাগছিল এ সব। ফিলাডেলফিয়ার একজন ভ্যাগাবন্ড জুয়াড়ি বাস কন্ডাক্টর এ ছাড়া আর কী বলবে।

জীবনকৃষ্ণবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। গগনকে খোঁচা দিয়ে ইশারা করলেন উঠতে। গগন বোস উঠল, কিন্তু ধীরে সুস্থে।

ম্যাকলিস্টার জীবনকৃষ্ণের চেয়ারে বসে, আঙুলের ডগায় গাদা থুথু ভরিয়ে, পাতা উলটে যেতে লাগল। আর মাঝে মাঝে হুঁ হাঁ দিয়ে গেল।

ওয়ালেস চেয়ে নিলেন কারখানার স্ট্রেংথ বুক।

জীবনকৃষ্ণ টেবিলের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। ম্যাকলিস্টারকে জিভে আঙুল দিয়ে পাতা ওলটাতে দেখে, তাঁর পবিত্র শরীরটা ঘুলিয়ে উঠল। একে থুথু, তায় স্নেচ্ছের। শুয়োর পাখি পাখালি, সব কিছুই যে জিভ লেহন করে, ভোগ করে। ওই খাতা খুলে নিয়ে বসে যে আবার তাঁকেই কাজ করতে হবে! ওয়াল্টার তো এরকম করে না। আ ছি-ছি সাহেব একটি পাতাও বাদ দিচ্ছে না। প্রত্যেকটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। গোটা খাতাখানি কি গঙ্গায় চুবিয়ে আনা যাবে? তাতে লেখা সব ধুয়ে যাবে না। কিন্তু শুধু গঙ্গাজল স্পর্শ করলেই তো এ খাতা পবিত্র করা যাবেনা। ঘৃণায় কণ্টকিত হয়ে রইলেন জীবনকৃষ্ণ, আর মনে মনে ভাগ্যকে অভিসম্পাত দিতে লাগলেন। আঃ, হায় জীবিকা, পরম ঈশ্বর, হে কালেশ্বর, ভবিষ্যতে কি তোমার নাম হবে জীবিকেশ্বর।

একমাত্র বিপিন চক্রবর্তীই, ওয়ালেসের পাশে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে, জীবনকৃষ্ণের অবস্থাটা বুঝতে পারছিলেন। যদিও কারখানার শ্রমিক নরনারীদের সম্পূর্ণ নামের তালিকা, বয়স, বেতন, এ সবই গগন বোসের কাজ, এবং ওয়ালেস তার টেবিলেই বসেছেন, তবু বিপিনকেই সেখানে দাঁড়াতে হয়েছে। কারণ গগন ঘরের এক কোণে গিয়ে, চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেটা যে কোনও সম্ভ্রমজড়িত ভয়ে, তা নয়। যেন নিতান্তই চেয়ার-চ্যুত হয়ে উঠতে হয়েছে। অতএব কী করা যায়, নিরিবিলিতেই দাঁড়িয়ে, কিছু নস্যি নাসারন্ধ্রস্থ করে, একটু আমেজ করা যাচ্ছে।

ব্যাপার দেখে ছটফট করছে শুধু চাকর গোপাল। প্রথমটায় সে অল্টার আর অলিক সাহেবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেবেছিল, ওয়াদের বসবার কুরসি দিতে বুঝি সে ভুলে গেছে। তাড়াতাড়ি ডিঙি দিয়ে, উঁকি মেরে দেখছে, তা নয়। কুরসি দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু অল্টার বসেনি। অলীক কুরসির উপর এক পা রেখে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কালা, ন্যালাখ্যাবলার মরণ, গগনবাবু একী কাণ্ড করছেন। কলকেতার সাহেব বলে কথা। কারখানার ঘোঁৎঘাঁৎ দেখতে এসেছেন। আর উনি গিয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নস্যি টানছেন? অল্টার খেপে যায় যদি।

গোপাল আর থাকতে না পেরে, প্রায় দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে, ঘুরে গিয়ে গগন বোসের সামনে দাঁড়াল। চুপিচুপি বলল, বাবু ওখানে গিয়ে দাঁড়ান, নইলে সাহেব চটে যাবেন।

গগন বোস নির্বিকার ভাবলেশহীন চোখে তাকাল গোপালের দিকে। মনে হল, কিছু শুনতে পায়নি। গোপাল ইশারা করল, সাহেবদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। গগন বোস মুখ ফিরিয়ে নিল। যেমন নির্বিকার, তেমনি চুপ করে রইল। কেবল আর এক ধাবড়া নস্য নাকে টেনে নিল।

গোপাল মনে মনে বলল, শালা কালা, তায় পাগলা। বেশি লেখাপড়া শিখলেই কি মানুষ এরকম বেয়াড়া হয়ে যায়? না কি সরষের মধ্যেই ভূত! গগন বোসের রূপসি বউ নিয়ে পাড়ার লোকের মাথাব্যথা। রূপে নাকি বোসদের হাড় পাঁজর বের করা পুরনো অন্ধকার বাড়িটা আলোয় আলো। লেখাপড়াও নাকি জানে। তা হতে পারে। একে কায়েত, তায় আবার কলকাতার মেয়ে। এই আপিসের ওই বিপিন চক্কোত্তির মাই তো রটিয়ে বেড়ায়, সে বউ নাকি পেটিকোট পরে শাড়ির তলায়। আবার জামাও পরে। পরে, মজুমদারদের বাড়ি যায়। মজুমদারেরা তো কেরেস্তান, তাদের কথা আলাদা। আতপুর সেনপাড়ার সমাজের সঙ্গে তাঁদের ওঠা বসা নেই। কিন্তু বোসেদের তো তা নয়। গগনের বউ তবে যায় কেন?

গোপালের এক ভাবনা, নানান ভাবনায় ঘুলিয়ে গেল। তবু গগনকে কিছু বলতে সাহস হল না। বলা যায় না, পাগলার মরণ, যদি খিঁচিয়ে মিচিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, তা হলেই সর্বনাশ! থাক দাঁড়িয়ে, সাহেব দেখলে যদি কিছু বলে তো বলবে।

ইতিমধ্যে ভান্ডা ছুটে গিয়েছে কুঠিতে। সেখানে রসুইখানায় খানসামাকে তাড়া দিয়ে, ছুটে গেল গঙ্গার ধারে। কপালে হাত দিয়ে, রোদ আগলে উৎকণ্ঠিত চোখে তাকাল পশ্চিম পারে, সোজাসুজি ফরাসডাঙার দিকে। দু-একটি জেলে নৌকো জাল ফেলছে কিংবা গুটোচ্ছে। কিন্তু আসল ভাউলে কোথায়? যা দেখিয়ে ভান্ডা আজ ওয়াল্টার আর তার অতিথিদের অভ্যর্থনা করবে, চমকে দেবে?

মুখখানি শুকিয়ে উঠল ভান্ডার। কোনও চিহ্নই নেই ভাউলের। অথচ সমস্ত ব্যবস্থা সে করে এসেছে। কোনও ত্রুটি করেনি। আর এই অভ্যর্থনার মধ্যে ফার্ডিনান্ডের কোনও স্বার্থ চিন্তা নেই। ঘুষ নয়, এ অভ্যর্থনা। কয়েকজন খাঁটি ইওরোপীয়কে তার শ্রদ্ধা জানাতে চায় সে।

তারপর রাগ হতে লাগল ভান্ডার। দাঁতে দাঁতে চেপে প্রতিজ্ঞা করল, সন্ধ্যাবেলা সে ফরাসডাঙায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে আসবে। খুন করবে দু-একটাকে। আগাম টাকা খেয়ে চুক্তি ভঙ্গের শাস্তি কাকে বলে, দেখাবে। সে ফিরে যাবার উদ্যোগ করতেই, উত্তর দিকে, এপারে বাঁশঝাড়ের এলিয়ে পড়া ঝুপসির সীমানায় উঁকি দিল একটি ভাউলের গলুই। বুকটা দুলে উঠল তার আশা নিরাশায়। কিন্তু উত্তর দিক থেকে আসবে কেন? সে ছুটল। ভাউলেটা বেরিয়ে এল বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে। ফার্ডিনান্ড চেঁচিয়ে উঠল, হেই মাঝি, কীধরকা বোট?

মাঝি জবাব দিল উড়তি বাজারের।

পরমুহূর্তেই ছইয়ের ভিতর থেকে বেহালা নিয়ে বেরিয়ে এল মাস্টার হরিচরণ। প্রায় সাত ফুট লম্বা, এবড়ো খেবড়ো গাঁটওয়ালা বাঁশের মতো শরীর। রংটি মিশমিশে কালো। চুল বাবরি, কিন্তু তাতে কায়দা করে লাল সিল্কের রুমাল বাঁধা। পরনে কালো পাতলুন, ধারে ফিতের বর্ডার। ভান্ডাকে দেখে একগাল হেসে বলল, সেলাম সাহেব।

ভান্ডা কোমরে হাত দিয়ে খ্যাপাটে গলায় বলল, দেরি কেন এত?

মাস্টার হরিচরণের লাল টকটকে চোখ ঢুলুঢুলু। বলল, আর বলেন কেন হুজুর, জোয়ারের মুখে পড়ে, ব্যাটা আনাড়ি মাঝি সেই ভাটপাড়ায় গিয়ে উঠেছে। তারপর এই লগি মারতে মারতে আসা। কই রে বোটনা?

ছইয়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এক গোরা। হাতে তার পাইপ বাঁশি। লোকে বলে ভ্যাম্পো। কারণ ভ্যাম্পো ভ্যাম্পো করে বাজে বাঁশিটা। তারপর আরও দুজন গোরা বেরুল। একজনের ড্রাম আর একজনের ঝাঁঝর। অর্থাৎ বড় করতাল।

দেখেশুনে ভান্ডার মাথা ঠাণ্ডা হল। বলল, তোমার ফ্লুট কোথায়?

মাস্টার হরিচরণ বলল, আছে গো সায়েব, আছে। মাস্টার হরিচরণের কথার খেলাপ হবে না। তোমার মেহমানদের কদ্দূর?

ভান্ডা বলল, আর বেশি দেরি নেই। এখুনি এসে খেতে বসবে। নৌকো এখানেই ভেড়াও।

মাস্টার হরিচরণ সদলবলে নেমে এল। মাস্টার হরিচরণ যা তা লোক নয়। গোরা বাজনদার দলের সে মাস্টার। ফরাসডাঙার বড়সাহেব, অর্থাৎ গভর্নরের সে প্রিয় বাজনদার। সাহেবরা বলে তাকে ভায়োলিনিস্ট। কলকাতার ভাল সাহেব বেহালাবাজিয়ে না পেলে, বড়সাহেব তাকে এখনও ডাকে। দাঁইয়া মেমসাহেবের নাচঘরে সে মাইনে করা বাজিয়ে। তার মাইনেই সবচেয়ে বেশি। এই গোরারা তার শাগরেদ। কলকাতায় স্বয়ং পেয়ার সাহেবের কাছে বিলিতি সুর শিখেছে হরিচরণ। পেয়ার সাহেবের দলে বাজিয়েছে অনেকদিন। এখন তার নিজেরই গোরার দল আছে। মাইনে যদিও দাঁইয়া মেমসাহেবই দেয় গোরাদের, ছুটকো ছাটকা, এদিক ওদিক বায়না সবসময় হরিচরণের কাছেই আসে। হুগলি চব্বিশ পরগনার সব ইঙ্গবঙ্গ আসরেই ডাক পড়ে তার। পেয়ার (পিয়ার) সাহেবের শিখানো সোনাটা বলো সোনাটা আর দেশি সুরে ভৈরবী বলল ভৈরবী কোনওটাতেই মাস্টার হরিচরণের জুড়ি মেলা ভার। সেজন্যে দেশি বিদেশি সব আসরে তার সমান কদর। তবে ইজ্জতের প্রশ্ন আছে। যেখানে সেখানে যায় না হরিচরণ। দাঁইয়া মেমসাহেবের একটা মান সম্মান আছে। আর ফরাসডাঙার বড় সাহেব যার বাজনা শুনতে ভালবাসে, তার অত এদিক ওদিক করবার দরকার কী?

ভান্ডার কথায় হরিচরণ রাজি হয়েছে, তার কারণ খাঁটি সাহেবদের ব্যাপার। সেইজন্যেও বটে, আর বাইরে আসার জন্যও বটে। হরিচরণ পাতলুন আর হাতে গলায় ঝালর দেওয়া গলাবন্ধ কোট গায়ে দিয়ে এসেছে। তার তাঁবের গোরারাও এসেছে সেইভাবেই। পোশাকগুলি অবশ্য দাঁইয়া মেমের দেওয়া। মেমের রাতের রংমহলে, এই পোশাক পরেই বাজনা বাজাতে হয়।

মাস্টার হরিচরণের একটাই অসুবিধে। পায়ে জুতো রাখতে পারে না। পায়ের গরম মাথায় গিয়ে নাকি তার মাথা ঘোরে। তার দলের গোরারা অবশ্য জুতো পরে।

ভান্ডা তাদের নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দিল বাংলোর একটেরেতে, তার নিজের ঘরে। ওয়াল্টার যাতে কোনওরকমে টের না পায়।

.

অফিসের নথিপত্র দেখা শেষ হলে ম্যাকলিস্টারের দু চোখে বিস্ময়ের সীমা নেই। ওয়ারলেসেরও তাই। ম্যাকলিস্টার বলল, প্রতি মাসে ফিনিশ মালের এই বিরাট পরিমাণ! আই কান্ট বিলিভ!

ওয়ালেসেরও সেই অবস্থা। বললেন, আপনি তো একটা ডাকাত মি. ওয়াল্টার!

ওয়াল্টারের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে শুধু ধন্যবাদ দিতে লাগল দুজনকে।

ওয়ালিক বলল, আর এই বিরাট মালের সবচেয়ে ভাল কোয়ালিটিটাই চালান যায় ডান্ডির ফ্যাক্টরিগুলিতে।

ম্যাকলিস্টার তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, একসাক্টলি। আর আমরা ফোর্ট গ্লাস্টার স্পিনিং-এর সেকেন্ড গ্রেড থার্ড গ্রেড মালটা নিজেদের জন্য পাই।

শান্ত গম্ভীর ওয়ালেসও না বলে পারলেন না, এটা চলতে পারে না।

ম্যাকলিস্টারের সর্বাঙ্গে অস্থিরতা প্রকট হয়ে উঠল। সে খাতাপত্র ফেলে, মাথা নাড়তে নাড়তে শুধু অফিসে পায়চারি করে নিল কয়েকবার। তারপর ওয়াল্টারের সামনে এসে হাত তুলে বলল, ইউ মাস্ট ফিড ইওর-ওন ফ্যাক্টরি ইওর বেঙ্গল ফ্যাক্টরি, অ্যান্ড ফাঁক আপ ইওর হোম ফ্যাক্টরি। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, হোমে বসে আমাদের কর্তারা করছেন কী? তারা কি কানা নাকি? ফাইন কোয়ালিটির মাল বাজারে ছেড়ে ডান্ডি বাহবা লুটছে, আর আমরা ইন্ডিয়াতে খেটে মরছি। ইমপসিবল। সবথেকে মজার ব্যাপার, এখান থেকে রজুট অথবা ফিনিশ জুট, যা-ই যাক, সবই তো ট্যাকস ফ্রি। এক পয়সাও এক্সপোর্ট ট্যাকস দেয় না। তার উপরে ইন্ডিয়ার কাঁচামালের যা দর, সেই কোন ডান্ডিতে বসেও তারা, একই দরে মাল নিয়ে যাচ্ছে। না, না, ইমপসিবল, ইমপসিবল। তুমি এই সুতো এক্সপোর্ট বন্ধ করো ওয়াল্টার।

ওয়াল্টারের তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু তার কপালের রেখায় কয়েকটি দুশ্চিন্তার ছায়া পড়েছে অনেকক্ষণ থেকেই, ক্রমেই সেই ছায়া গাঢ় হয়ে আসছে। সে যেন কোথায় একটি অদৃশ্য লুব্ধ থাবা দেখতে পাচ্ছে এই স্পিনিং মিলের উপরে। তার কানের কাছে যেন কে ফিসফিস করছে, তোমার এই থ্রি প্লাই স্পিনিং মিলের আলাদা অস্তিত্ব হয়তো শীঘ্রই গ্রাস হবে। একটা বড় কারখানার গহ্বরে ঢুকে গিয়ে, নিতান্তই একটি ছোট স্পিনিং ডিপার্টমেন্ট দাঁড়াবে। এক বিরাট ক্ষুধার্ত হাঁ গিলতে আসছে, গিলতে আসছে।…

যতই শুনতে পাচ্ছে, ততই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে ওয়াল্টারের। দাঁতে দাঁত চেপে, মনে মনে সে শুধু বলছে, না। কখনওই না! কুমায়ুনের এক চা প্লাষ্টারের তাঁবেদার হয়ে এসেছিলাম আমি। নিজের ধুলোতঁড়ো যা ছিল, সব দিয়ে আমি স্পিনিং মিল প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। একটা বিশেষ দুঃসময়ে ফোর্ট গ্লাস্টার সাহায্য করেছিল আমাকে। তাই আমি ফোর্ট গ্লাস্টারের সঙ্গে ভিড়েছিলাম। কেটলিওয়েল বুলেন অ্যান্ড কোম্পানির সহৃদয়তার কথাও ভোলবার নয়। তবু এই স্পিনিং মিলের সবচেয়ে বড় অংশীদার আজও আমিই। যদি একে বড় করতে হয়, আমার শক্তিতেই করব। লিকুইডেশন নয়। জুট ক্লথ আর, গানি ব্যাগস ম্যানুফাঁকচার করার পুরোপুরি ফ্যাক্টরি আমি নিজেই করব। আমার ব্যুহে, প্রথম তলোয়ার খাপ থেকে আমিই খুলব। এই না আমার চিরদিনের সাধ, তেসুতি কল হবে পুরোমাত্রায় চটকল?

যুদ্ধক্ষেত্রের ঘাঁগি ঘোড়ার মতো বিপদের গন্ধ আগেই পাচ্ছে ওয়াল্টার। কিন্তু তার সোনার সওয়ার স্পিনিং মিলকে ফেলে সে কোথাও যাবে না। ফোর্ট গ্লাস্টারের নিরাপদ এজেন্সি আর অর্গানাইজেশন হাতছাড়া হলেও নয়। যত ক্ষতিপুরণই তারা দাবি করুক। এমনকী, কেটলিওয়েল, বুলেন অ্যান্ড কোম্পানি, যারা আদতে ফোর্ট গ্লাস্টারের সর্বময় কর্তা তারা টানাটানি করলেও আমি যাব না।

একমাত্র ওয়ালেসই বোধহয় ব্যাপারটা একটু আঁচ করতে পেরেছিলেন। ওয়াল্টারের কাঁধে আস্তে চাপড়ে, পকেট থেকে ঘড়ি খুলে দেখলেন। বললেন, মাই স্পিনিং হিরো, এত চিন্তিত কেন? লেট আস প্রসিড টু দি ডাইনিংরুম।

ব্যাপারটা সবাই আঁচ করতে পারছিল, লিটলজন ছাড়া। ম্যাকলিস্টার সেটা বুঝতে পেরেই বোধহয় বলল, চিন্তা? কেন, চিন্তা কেন? সার্থক কর্মীর আবার ভাবনা কীসের? ওয়াল্টার সত্যি পাগল। চলো দেখি এবার তোমার খাবার টেবিলে। সেখানেও তোমার কেরামতিটা দেখি একবার। বাট মাই ডিয়ার বয়, নট ইঞ্চ থ্রেড টু ডান্ডি এনি মোর! তোমার বাসনা পূর্ণ করার জন্যে, যা বলবে, আমি তাই করব। শুধু এই একটা ব্যাপারে তুমি একবার আমার হাতে হাত দাও।

ওয়াল্টার দ্বিধার সঙ্গে ম্যাকলিস্টারকে তার হাত বাড়িয়ে দিল। ম্যাকলিস্টার ঝাঁকিয়ে বলল, মেনি মেনি মেনি থ্যাঙ্কস। আমি আর একবার চেষ্টা করব, টুয়েন্টি পার্সেন্ট ডিভিডেন্ট যাতে শেয়ার হোল্ডারদের দিতে পারি।

তারপরে একযোগে সকলে জীবনকৃষ্ণবাবু এবং অন্যান্য বাবুদের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে বলল, গুড বাবু। ভেরি গুড। থ্যাঙ্কস টু ইউ অল। তোমাদের কাজ খুব ভাল। সুন্দর হাতের লেখা আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।ওয়ালেস ওয়াল্টারকে ডেকে, আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলেন, আমি যে খাতাপত্র দেখলাম, ওটা কার জিম্মায়?

ওয়াল্টার চারিদিকে তাকিয়ে গগনকে আবিষ্কার করল। সে তখনও এক পাশে তেমনি করে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখিয়ে ওয়াল্টার বলল, দ্যাট ফেলা, হোয়াই?

ওয়ালেস বললেন, খুব ভাল কর্মী বলতে হবে। কাজের পদ্ধতিটা খুবই ভাল। তোমার গোটা কারখানার সব বিষয় যেন ছবির মতো ওর নথিপত্রে ফুটে উঠেছে। আর আমি দেখলাম, একটাও ভুল ইংরেজি লেখেনি লোকটা। জুট মিলে এরকম লোক পাওয়া যায়, আমি জানতাম না।

ওয়াল্টার বলল, সে কথা ঠিক। কিন্তু ও তো কোথাও গিয়ে কাজ করতে পারবে না। এক ধরনের পাগল। দেখছেন না। আপনারা এসেছেন, তবু ওর খেয়াল নেই, আপনমনে এক পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে?

–কিন্তু পাগল এরকম কাজ করে কী করে? কী ধরনের পাগল?

–সেটা আমি আজ অবধি বুঝতে পারলাম না। ও আমাকেই ধমকায়।

–তাই নাকি?

ওয়ালেস হেসে উঠলেন। ওয়াল্টার চিৎকার করে ডাক দিল, হেই গাগান, কাম হিয়ার।

গগন ফিরে তাকাল না। বিপিন চক্রবর্তী তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে চিৎকার করে বলল, গগন, তোমাকে সায়েব ডাকছেন।

গগন চোখ তুলে ওয়াল্টারের দিকে তাকাল। ওয়াল্টার তাকে হাতের ইশারায় ডাকল। ওয়ালেসকে বলল, লোকটা আবার ডেফ, কানে শুনতে পায় না।

ওয়ালেস অবাক হলেন। গগন এসে সামনে দাঁড়াল। আঙুলে নস্যি ধরা আছে। ওয়ালেস গলা তুলে বললেন, বাবু, তোমার কাজ খুব ভাল। তুমি কত টাকা মাইনে পাও?

গগন যে কথা শুনতে পেয়েছে, তা তার মুখ দেখে মনে হল না। ওয়াল্টারের দিকে সে একবার তাকাল। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে উচ্চারণ করল, ফিপটিন রুপিজ।

ওয়ালেস একবার ওয়াল্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি তোমার বসকে অনুরোধ করছি, সে যেন তোমাকে কুড়ি টাকা করে মাইনে দেয়।

গগন বলে উঠল, কেন?

ওয়ালেস থ! কোথায় লোকটা কৃতজ্ঞ হয়ে উঠবে ভেবেছিলেন, বলে কিনা, কেন? বললেন, তোমার কাজ ভাল বলে? তুমি বেশি মাইনে চাও না?

গগন ওয়ালেসের সামনেই ফ্যাস ফ্যাস করে নস্যি টেনে বলল, সেটা কর্তাদের মর্জি।

ওয়াল্টার একটু অস্বস্তিবোধ করলেও বলল, গাগান, আমি তোমার মাইনে বাড়িয়ে দিলাম। বলে চোখ টিপে বোধহয় সংবর্ধিতই করল। কিন্তু ওয়াল্টারের এক চোখ বুজে ঘাড় নাচানো দেখলেই গগন চটে যায়।

সে সামনে থেকে চলে গেল।

 ওয়াল্টার হেসে উঠল। তার সঙ্গে সকলেই।

গগন হঠাৎ ফিরে চিৎকার করে বলল, এতে হাসবার কী আছে? আমি কি পাগল?

সবাই থমকে গেল। জীবনকৃষ্ণ ভাবলেন, এক্ষুনি একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। বাইরের সাহেবদের সামনেও গগনের কোনও সংবিৎ সুবুদ্ধি নেই?

এক মুহূর্ত ওয়াল্টার ওয়ালেস আর ম্যাকলিস্টারের দিকে তাকাল। তারপর সবাই মিলে আবার হেসে উঠল। ওয়াল্টার অতিথিদের নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়ে বলল, বড়াবাবু, গাগানকে একটু দেখো।

ম্যাকলিস্টার বলে উঠল, ওয়াল্টার, তোমার স্পিনিং মিলটা সবদিক থেকেই দেখছি একটা মজার রাজত্ব। তোমার গাগানকে দেখে আমার বেচারামের কথা মনে পড়ছে।

সকলে বেরিয়ে গেল। জীবনকৃষ্ণ ডেকে বললেন, গগন, তোমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি নেই হে?

 গগন আরও জোরে চিৎকার করে উঠল, আপনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না ভটচায মশাই।

অন্য কেউ হলে হয়তো জীবনকৃষ্ণ রাগ করতেন। কিন্তু গগনকে মাঝে মধ্যে খেপিয়ে তিনিও আনন্দ পান। বললেন, বাঃ, কথা বলব না কেন হে। গুণকেত্তন হল তোমার, মাইনে বাড়বে তোমার, আর আমরা কথা বলব না?

গগন চিৎকার করে বলল, টাকা দিয়ে আমি কী করব? টাকা চান, টাকা আপনারা নিয়ে নেবেন, আপনাদের দিয়ে দেব। আমার সঙ্গে লাগতে আসবেন না।

এমনি বিচিত্র রকমের কথাবার্তাই গগন বলে থাকে। গগনের প্রশংসায় বা মাইনে বাড়ায় যে জীবনকৃষ্ণ মনে মনে তেমন ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠেননি, তারও কারণ আছে। তিনি নিজে এবং বিপিন চক্রবর্তী অনেক টাকা গগনের কাছে ধারেন। ধার হিসেবেই যে সব টাকা গ্রহণ করেছেন, তা নয়। প্রয়োজন হলেই গগনের কাছে টাকা চান। থাকলে গগন কখনও না বলে না, এবং কখনও সে টাকা শোধ চায় না। কত টাকা দিয়েছে, তার হিসেবও সে রাখে না। গগন যে একরকমের লেখাপড়া জানা পাগলাটে লোক, এটাই সকলের ধারণা ও বিশ্বাস। টাকা দিয়ে দেওয়ার বিষয়টাও পাগলামিরই অন্তর্গত বলে জানেন জীবনকৃষ্ণ।

বিপিন চক্রবর্তী বললেন, তা বললে কি হয় গগন, আজ একটা আনন্দের দিন।

 গগন তাকেও জবাব দিল, আপনার সঙ্গে আমি কোনও কথা বলতে চাই না চক্কোত্তি মশাই।

 বলে সে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গোপাল সাহেবদের পিছু পিছু গেছে। নয়তো সেও একবার গগনের সঙ্গে লাগত। জীবনকৃষ্ণ আর বিপিন পরস্পরের দিকে তাকালেন। তাঁদের দুজনের মুখেই হাসি ছিল। কিন্তু সে হাসির মধ্যে আর তেমন সরসতা ছিল না। জীবনকৃষ্ণের যেটুকু বা ছিল, বিপিন চক্রবর্তীর তাও নেই। তিনি বলে উঠলেন, এটা কেমন হল ভটচাজ মশাই? কাজ করি সব সমান সমান, আর মাইনে বাড়ে গগনের?

জীবনকৃষ্ণ বললেন, বিচারের কথা তুলে না চক্কোত্তি, এ যুগে ও সব নেই। তবে গগন তোমার আমার থেকে ইংরেজিটা বেশি জানে তো।

–কিন্তু আপনার আমার কাজেও তো ভুলচুক নেই। সাহেবটা কী বলে গগনের প্রশংসা করছিল, বুঝতে পেরেছিলেন?

–না। তুমি বুঝতে পেরেছিলে?

বিপিন ঘাড় নেড়ে ঠোঁট উলটে বললেন, না, ঠিক ধরতে পারলাম না। এখন দেখছি পাগলেরই জয়জয়কার ভটচায মশাই। আমাদের সায়েবটিও পাগল, তার কারখানায়ও পাগলা কেরানির নাম ডাক। এখন থেকে তা হলে আমি আপনিও পাগল হয়ে যাই।

জীবনকৃষ্ণ বললেন, তাও আশ্চর্য নয় চক্কোত্তি। কপালে কী আছে, কে জানে।

কিন্তু জীবনকৃষ্ণের মনে তখন অন্য চিন্তা। বললেন, আচ্ছা, আমার টেবিলে যে সায়েবটা বসেছিল, ওটা কে? ওটাই কি আমাদের ফোর্ট গ্লাস্টারের বাউরিয়ার সায়েব নাকি?

–তা হতে পারে।

জীবনকৃষ্ণ বললেন, কিন্তু ও খাতাটা আমার ছুঁতে ঘেন্না করছে চক্কোত্তি। যে ভাবে আঙুলে জিভ ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে পাতা ওলটাচ্ছিল, এ, ওয়াক।…এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে বাপু।

–কী ব্যবস্থা করবেন?

–গগনকে দিয়ে গোটা খাতাটা নকল করিয়ে নিতে হবে।

চক্রবর্তী উৎসাহিত হয়ে বললেন, এটা মন্দ বলেননি। পাগলা রাজি হলে হয়।জীবনকৃষ্ণ বললেন, হওয়াতেই হবে। এখন তুমি খাতাটা তুলে, গগনের টেবিলে দিয়ে দাও। আর মাইনে বাড়ার কথা যে তুমি ভাবছ, সে তুমি নিশ্চিন্ত থাক, আমাদের অল্টার অত বোকা নয়। বাড়লে, তোমার আমারও বাড়বে, আমি নিজে বলব সে কথা। অল্টারের ধর্মজ্ঞান আছে।

বিপিন চক্রবর্তী তাড়াতাড়ি খাতাটি তুলে, গগনের টেবিলে রেখে দিলেন। জীবনকৃষ্ণ এবার তাকালেন বাইরের দিকে। সেই অবাধ্য হারামজাদা বাগদি ছোঁড়াটা কোথায়? তাঁর দুই চোখ প্রজ্বলিত হয়ে উঠল। সেই ব্যর্ঘক্ষত্রিয়ের অবাধ্যতা তিনি ভুলতে পারেননি।

.

৩৯.

অফিসঘর থেকে বেরিয়ে ওয়াল্টার চিৎকার করে ডাকল, ফার্ডিনান্ড। ফার্ডিনান্ড ছুটে এল। ওয়াল্টার বলল, হুইসল অর্ডার করো। লাঞ্চের ছুটি দিয়ে দাও।

প্রস্তুত হয়েই ছিল ফার্ডিনান্ড। সে ছুটে গিয়ে চিৎকার করে গোলামকে বাঁশি বাজাতে বলে দিল। তারপর অতিথিদের পিছন পিছন ঢুকল গিয়ে কুঠিতে।

বারান্দার এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল শুধু হীরা। পাগলা সায়েব তাকে দেখতে পেল না।

গোলাম হুইসল বাজিয়ে, স্টিম কোঁতল করল। অর্থাৎ কন্ট্রোল করল। শপ ঘরে আজ সকলে পাগলা সাহেবের মান রেখেছে। কেউ বেরোয়নি। এবার দলে দলে বেরিয়ে এল সবাই।

গঙ্গার ধার ঘেঁষেই ওয়াল্টারের ডাইনিং রুম। আজ নতুন জোড়া লাগানো হয়েছে। বড় বড় দুটি জানালা গঙ্গার দিকে। বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব কিছু। ওপারেই ফরাসি চন্দননগর।

অতিথিরা এসে বসতেই উর্দিপরা খানসামা সেলাম করে দাঁড়াল কাঠের পুতুলের মতো। হুজুরদের যা হুকুম হয়। টেবিল পুরোপুরি সাজানো আছে। খানার হুকুম হলে খানা, পিনার হুকুম হলে পানীয়। দুয়ের সরঞ্জামই প্রচুর। হেড খানসামা রসুল ওস্তাদ লোক। সে তিন রকমের মদের বোতল সাজিয়ে রেখেছে টেবিলের উপর। গেলাস রেখে দিয়েছে উপুড় করে। হুকুম হলেই বাক্স থেকে বরফ ভেঙে এনে গেলাসে পরিবেশন করবে।

ফার্ডিনান্ড এখানে বসবে না। সে রয়েছে রসুইখানায়। খাবারে তদারকিতে সে রসুলকে পরিচালনা করবে আজ।

ম্যাকলিস্টার কনিয়াকের বোতলটাই টেনে নিল আগে। রসুল ছুটে এসে গেলাস বাড়িয়ে ধরল। ইশারায় বাবুর্চিকে বরফ আর সোডার বোতল নিয়ে আসতে বলল।

ওয়াল্টার ম্যাকলিস্টারকে ধন্যবাদ দিয়ে সবাইকে বলল, আপনাদের যার যে পানীয় পছন্দ, অনুমতি করুন। কনিয়াক, স্কচ, হুইস্কি, ইন্ডিয়ান রাম। সবই আছে।

একমাত্র ওয়ালিক রাম-এর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাল। বাকিরা আপাতত কনিয়াক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। ওটার গায়ে আঠারো শো সালের ফ্রেঞ্চ ছাপ মারা আছে।

মাস্টার হরিচরণের দলকে ভান্ডা ডেকে নিয়ে এল, ডাইনিং ঘরের পাশের ঘরে। কিন্তু খুব আস্তে, পা টিপে টিপে। হ্যাঁ, এইবার পাশাপাশি দাঁড়াক হরিচরণেরা। অবশ্য একটু ভয় ভয়ও করছে ভান্ডার। বাজনা নিয়ে এসেছে। শুনে আবার ওয়াল্টার খেপে না যায়।

ভান্ডা ইশারা করল, শুরু করো।

কিন্তু ভান্ডার হুকুমেই মাস্টার হরিচরণ শুরু করতে পারে না। সে তখনও চোখ বুজে ভাবছে, কী শুরু করবে। এ হরিচরণ এখন আর সেই দাঁত বের করা, ভান্ডার তোষামুদে হরিচরণ নয়। ওর সামনে তিন গোরা একেবারে ফৌজি কায়দায় দাঁড়িয়ে আছে।

হরিচরণ ছড় তুলে নিল হাতে। গোরাদের ইশারা করল চুপ করে থাকতে। তারপর বেহালার বুকে যেন সোহাগ করে গালটি চেপে ধরল। মিষ্টি মিহি সুর উঠল কেঁপে কেঁপে। এই ফারফোড় গতটা শিখিয়েছিল তাকে পেয়ার সাহেব। ফারফোড় হচ্ছে ভাঙাচোরা। এক রকমের বাজনা নয়। প্রথমে বেহালা। একটু পরে পাইপ বাঁশি। তারপরে ড্রাম আর ঝাঁজর বাজাবে। সে আগে থেকেই ঘুঙুর পরে রেখেছে পায়ে। তালে তালে তাকে পা নাচাতে হবে।

বেহালায় সুর উঠতেই, ভান্ডা ঢিপঢ়িপে বুক নিয়ে ছুটে গেল রসুইঘরের দরজার পাশে। পাশ থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, কী ঘটে।

সুরটা শোনা যেতেই, সবাই জানালা দিয়ে তাকাল গঙ্গার দিকে।

ম্যাকলিস্টার বলল, ওপারে বাজছে না?

ওয়ালিক বলল, বোধহয়।

শুধু ওয়াল্টারের কান খাড়া হয়ে উঠল। মিথ্যে নয়, চন্দননগরের নানান শব্দ অনেক সময়েই এপারে আসে। কিন্তু সুস্পষ্ট ভায়োলিনের শব্দ আসছে কোথা থেকে। যেন মনে হচ্ছে, জানালার নীচে দাঁড়িয়ে কেউ বাজাচ্ছে। ওয়ালেস বললেন, নাইস। ঠিক সময়েই বাজছে। সুরটা চেনা চেনা লাগছে।

কিন্তু ওয়াল্টারের সন্দেহ তখন ঘনীভূত হয়ে এসেছে। কনিয়াকের পাত্র সম্পূর্ণ গলায় ঢেলে, কয়েক মুহূর্তে সামলে নিল। তারপর জানালায় উঁকি দিল। কেউ নেই। পাশের ঘরের দিকে এগুল সে।

ভান্ডার বুক কাঁপছে। দোহাই যিশু, লোকটা যেন না খ্যাপে। সে ছুটে পাশের ঘরে গেল।

 দরজাটা ধাক্কা দিতেই, ভান্ডা নিজে খুলে দিল। সামনেই হরিচরণ সদলে। কিন্তু হরিচরণের চোখ বোঁজা। সে ওয়াল্টারকে দেখতেই পেল না। আর বোটনা (কেন গোরার নাম বোটনা, আর কী মানে, কে জানে) পাইপ বাঁশিতে ফুঁ দিল তখুনি।

ওয়াল্টার থ। ব্যাপারটা বুঝতে তার এক নিমেষও লাগল না। ফার্ডিনান্ডের ব্যাপার এ সব। ড্রাম আর ঝাঁজরওয়ালা গোরা, সেই সঙ্গে পাইপ বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে গাল ফোলানো বোটনা একবার ওয়াল্টার আর একবার ভান্ডার দিকে তাকাতে লাগল।

ওয়াল্টারকে যমের মতো ভয় করে ভান্ডা। গায়ে হাত তুলতে তার বেশি সময় লাগে না। ওয়াল্টারের মারের অনেক দাগ ভান্ডার গায়ে আছে। আদরের দাগও যে নেই সে কথা বলা যাবে না। ওয়াল্টার ফিরল ফার্ডিনান্ডের দিকে। কাছে গিয়ে বলল, আমাকে বলনি কেন?

ভান্ডা হাত কচলে, মুখ লাল করে, ভয়ে ভয়ে বলল, এমনি। মানে, ভেবেছিলাম।

ওয়াল্টার বলল, বললে ক্ষতি ছিল না। আমার মনে ছিল না তাই। এ তো খুবই ভাল। মিসেস দাঁইয়ার নাচঘরের কনসার্ট তো নাম করা। আমি খুব খুশি হয়েছি। টাকাটা যেন তুমি দিতে যেয়ো না।

ভান্ডার বুকে তখন সমুদ্র ঝাঁপ খেয়ে পড়েছে আনন্দে। বলল, না না, আপনি দেবেন কেন স্যার। ওটা আমিই আপনাদের আনন্দ দেবার জন্য।

বাধা দিল ওয়াল্টার, না, আমি দেব। আমি খুব খুশি হয়েছি।

বলে সে চলে যাচ্ছিল। ফার্ডিনান্ড বলল, দরজাটা বন্ধ করে দেব?

–না গেস্টদের দেখতে দাও। দরজাটা খুলে দাও পুরোপুরি।

হুকুম মাত্র প্রায় দু গজি চওড়া দরজার পাল্লা খুলে দিল ফার্ডিনান্ড। ম্যাকলিস্টার দেখে চিৎকার করে উঠল, হেল্লো। এ কী ব্যাপার!

ওয়াল্টার হেসে জবাব দিল, ফার্ডিনান্ডের প্ল্যান।

সকলেরই গলার স্বর একটু চড়েছে, ওয়ালেস ছাড়া। সকলেরই গালে ও চোখে রক্তাভা ফুটেছে। সকলেই হেসে, ধন্যবাদ আর সুখ্যাতি করতে লাগল।

আবার মুহূর্তে পূর্ণ হয়ে গেল গ্লাস। ওয়ালিক গ্লাসসুদ্ধ হাত তুলে বলল, লং লিভ দি ফাউন্ডার অব ফোর্ট গ্লাস্টার স্পিনিং মিল।

ম্যাকলিস্টার হুররা দিল। পেটে পানীয় পড়ায়, লিটলজনও চুপচাপ রাগ রাগ অথচ বোকা বোকা ভাবটা কাটিয়ে উঠেছে।

ড্রাম আর ঝাঁজর বেজে উঠতেই, ওয়াল্টার চিৎকার করে বলল, ফার্ডিনান্ড, মিউজিক চলুক, দরজাটা বন্ধ করে দাও।

দরজাটা বন্ধ করে দিল ফার্ডিনান্ড। দিয়েই, খুশির চোটে অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে শুরু করে দিল।

হরিচরণেরা বাজাতে বাজাতেই হাসল।

 ভান্ডার তাতে কিছু যায় আসে না। সে নাচতেই লাগল কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে। অবাক হয়েছে, খুশি হয়েছে, খুশি হয়েছে কর্তারা! এইটুকুই সে চায়। এইটুকুই! সে জানে, এরা কীসে খুশি হবে। কারণ এদের রক্তের সঙ্গে তার রক্তের যে কোনও তফাত নেই, তা জানে ভান্ডা।

সে জানে, খাঁটি ইউরোপীয়ের সঙ্গে তার রক্তমাংসের সম্পর্ক। এরা তার বাবার জাত। বাবার জাত, বাবারই মতোই। এরা সবাই তার এক একজন বাবার মতোই। তার বাবার ছায়া আছে এদের মধ্যে।

সে একটি খাঁটি ছেলে এদের।

নাচতে নাচতে হাঁপিয়ে উঠল ভান্ডা। জানলার গরাদ ধরে দাঁড়াল সে। গঙ্গার দিকে তাকিয়ে সে শান্তি হয়ে উঠল।

একদিন সে তার বাবার দেশে যাবে। সেই দেশে গিয়ে একটি টুকটুকে মেয়েকে সে বিয়ে করে ফিরে আসবে। হয়তো তখন তাকে কেউ আর ট্যাঁস ফিরিঙ্গি বলবে না।…

কেবল চাটগেঁয়ে হেন্ড খানসামা রসুল তার সহকারীকে বলল, ভান্ডা ফাগলা হইয়া গেছে। হালায় বান্দার।

.

বোতল নিঃশেষ হয়ে চলেছে। হেড খানসামা রসুল তার সহকর্মীদের আবার নতুন করে খাবার গরম করার নির্দেশ দিল।

ওয়ালেসের গলা তরল হয়ে গিয়েছে। ভাষার চাকচিক্য কমেছে একটু। বললেন, সত্যি, কসম খেয়ে বলছি ওয়াল্টার, খুব আনন্দ পাচ্ছি। আমি ভাবতাম, একমাত্র বরানগর কোম্পানিই বন্ধুবান্ধবদের আনন্দ দিতে পারে। আমরা বরানগর কোম্পানির পুরনো বোর্নিও কোম্পানি ফেরতারা সব জায়গায় বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াতাম, বড়দিনের দিন সবাই বরানগর কোম্পানির নিমন্ত্রণের অপেক্ষায় বসে থাকে। বাজে কথা। আপনিও একজন ভাল হোস্ট।

ওয়াল্টার বলল, কী যে বলেন আপনি মি. ওয়ালেস। আপনাদের বরানগর কোম্পানির বড়দিনের উৎসব, একমাত্র কলকাতায় আমাদের গভর্নরের বাড়ির সঙ্গেই তুল্য।

ওয়ালেস বলে উঠলেন, না না, এরকম বলবেন না। ডোন্ট সে সো। ঠাট্টার মতো শোনাচ্ছে।

 ওয়াল্টার বলল, কিন্তু বিশ্বাস করুন মি. ওয়ালেস, আমি ঠাট্টা করিনি।

ম্যাকলিস্টারের কোলাব্যাং-এর মতো গলা শোনা গেল, সত্যি। রিয়েলি। বরানগর কোম্পানির বাংলোতেই আমি বড়দিনের সময় সবথেকে বেশি জাঁকজমক দেখেছি। প্রথম বেশি সংখ্যায় মহিলাদের দেখতে পেয়েছিলাম ওখানেই। তাঁরা সত্যি, আনন্দ বিলোতে একেবারে মুক্ত হস্ত।

লিটলজন এতক্ষণে একটা কথা খুঁজে পেল যেন। বলল, মহিলাদের কথা এতে আসছে কী করে?

ম্যাকলিস্টার অবাক হয়ে বলল, আসছে কী করে? কী করে আসছে না, শুনি? আমরা কি হোম থেকে এখানে সব প্রিস্টের দল এসেছি নাকি? চার্চ তৈরি করতে এসেছি আমরা, যে আমাদের মনগুলো সব শুকিয়ে যাবে?

ওয়ালেসই সমর্থন করলেন ম্যাকলিস্টারকে, সত্যি, ম্যাকলিস্টার। আপনি ঠিক বলেছেন। মহিলারা না থাকলে, উৎসব মরুভূমি হয়ে যায়। এ কথাটা আমরাও জানি, আমাদের গৃহিণীরাও জানেন। একসমাসের দিন, ভোরবেলা আমাদের বিবাহিত স্ত্রীদের পাঁজাকোলা করে ঘরে নিয়ে যেত। অসংখ্য লোকের সঙ্গে নাচতে হত বেচারিদের, কাউকে রিফিউজ করতেও পারত না। মেয়েই তো ছিল না। এখন তো অনেক বেড়েছে, বাড়ছেও। আমরা আজ নতুন ক্লাব ঘর করেছি। কিন্তু আমরা যখন স্ত্রীদের আনতে পারিনি, সেই সব দিনগুলোর কথা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। আমি আমাদের এই জুট ইন্ডাস্ট্রির লোকদের কথাই বলছি। আমরা, হোমের লোকেরাও যাদের ডান্ডির গাধা বলে মনে করে। যাই হোক, স্ত্রী দূরের কথা, শুনলে অবাক হবেন, ব্রান্ডির অভাবে তোক হোমে ফিরে গেছে। আপনারা আমাদের বেঙ্গল জুট ইন্ডাস্ট্রির পাইয়োনিয়র বলেন, আমাদের বোর্নিও কোম্পানিওয়ালাদের। কিন্তু বিশ্বাস করুন, রুটি মাংসের সঙ্গে পাটের ফেঁসে খেয়েই আমাদের মাথা এমন ধরে থাকত, মনে হত নেশা করেছি। কেউ কেউ দেশি লিকার আনিয়ে নিত। কিন্তু মুখে দিয়েই বমি করে ফেলতে হত। ওটা নেটিভরাই একমাত্র হজম করতে পারে।

ওয়ালেসের পুরনো কথা বলতে ভাল লাগছে বোঝা গেল। গলায় পানীয় ঢেলে, আবার বললেন, মি. অ্যাকল্যান্ডকে আমি দেখেছি। ভারতবর্ষে প্রথম জুটমিল প্রতিষ্ঠাতা মি. অ্যাকল্যান্ড। যার কোনও কিছুর অভাব ছিল না। কিন্তু ফিরে যেতে হল সবকিছু ছেড়ে। আমি জানি, কী হার্ড আর ক্রুয়েল এ দেশে থেকে কাজ করা, একটা কিছু দাঁড় করানো। আর এও জানি, একবার দাঁড়াতে পারলে কী আনন্দ কত প্রাচুর্য, কত মজা। রোমান্স! রোমান্স! জুটের সবটাই আশ্চর্য রোমান্স!

সকলেই নিশি পাওয়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওয়ালেসের কথা শুনছে। ওয়ালেসের চশমা খুলে গিয়েছে। বাতাসে চুল দাড়ি টাই, সবই উড়ছে। চোখে তার স্বপ্ন নেমেছে যেন। বললেন, আমি জানি, আপনাদের সকলেরই হার্ড লাইফ। আমরা সকলেই এক দিন পেটের জ্বালায় দেশ আর ঘর ছেড়েছিলাম। স্টিম আবিষ্কার হয়েছে, পাওয়ারলুম আবিষ্কার হয়েছে, তবু তাকে কাজে লাগানো যাচ্ছিল না দেশে। বেকারের দল আমরা এখানে সেখানে ঘুরে মরেছি। আজ অবশ্য এম্পায়ারের টাকার লপচপানি। ভাবুন সেই সব দিনের কথা, যখন প্যাকোপ্যাকোর ব্যাগ তৈরি হত, আর তাইতে মাল চালান যেত, মনে আছে আপনাদের?

ম্যাকলিস্টার বলল, আমার মনে আছে। এই প্যাকোপ্যাকো ব্রেজিলের নিচু জলো জমিতে জন্মাত, আর তার ফাইভার দিয়ে লোকাল লোকেরা সুতো তৈরি করত।

ওয়ালেস বললেন, থ্যাঙ্কস, আপনি জানেন। সত্যি তাই। অথচ তাতে একটি দেশেরও পুরোপুরি কাজ মিটত না। ব্যবসায়ীদের কিউবার পথ চেয়ে থাকতে হত। কিউবা দেশের মালভার নিচু জলায় একরকমের গাছ জন্মায়, তার ফাইভার দিয়ে সুতো হয়। সেইজন্য সেই সুতোকেও মালভা বলা হত। কিন্তু তাই দিয়েই বা কতটুকু কাজ হয়? তারপর আঠারোশো আটাশে প্রথম চট চোখে দেখল ইংল্যান্ডের লোকেরা। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজনের টনক নড়ল। শুরু হয়ে গেল এক্সপেরিমেন্ট। প্রথম দেখা বলতে আমি ব্যবসায়ীর চোখে দেখার কথা বলছি। এক্সপেরিমেন্টের ফল ফলল এইটিন থাটটিফোরে। ডান্ডি কারখানা স্টার্ট করে দিলে। কিন্তু দেশ ঘর ছেড়ে কারা এসেছে এই পাটের দেশে? ঝড় ঝঞ্ঝা অনাহার কাদের উপর দিয়ে গেছে? কারা সারা পৃথিবীতে বাজার তৈরি করেছে?

ম্যাকলিস্টার উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। সে টেবিলের উপর সজোরে ঘুষি মেরে বলল, আমরা। উই দি বাস কনডাক্টরস, ড্রাইভারস, বেগারস, এক্স কনভিক্টস। আমরা, যাদের ওরা হোমে ফিরে গেলে বলে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। ফাঁক আপ ওয়াল্টার, আর এক ইঞ্চ সুতোও ডান্ডিকে নয়, কম?

বলে সে আর একবার হাত বাড়িয়ে দিল ওয়াল্টারের দিকে। ওয়াল্টার তার হাত চেপে ধরল।

ওয়ালিকের মুখের শিরগুলি যেন ফেটে পড়বে, এমন ফুলেছে। মুখটা বড় দেখাচ্ছে তার। তার গলাও ম্যাকলিস্টারের মতো গোঙা শোনাল। বলল, আমি জানি সারা পৃথিবী আজ আমাদের কাছে চটের ক্রীতদাস। সবাই আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ডান্ডিকে আমরা নিংড়ে ছেড়ে দেব।

ম্যাকলিস্টার ভয় পাওয়া চোখে ফিসফিস করে বলল, কিন্তু বন্ধু, কথা আছে। ওরা পার্লামেন্টে প্রশ্ন তুলতে চায়।

ওয়ালিক বলল, কীসের প্রশ্ন?

-তোমাদের ইন্ডিয়ান ফ্যাক্টরিতে এত উৎপাদন হচ্ছে কী করে? র জুট তো ওরাও পাচ্ছে প্রচুর। ডান্ডিতে বসেই পাচ্ছে। কিন্তু ওদের ডেইলি যা মাল হয়, তোমরা তার ডবল করছ একটা কারখানায়, কী করে?

সকলেই চুপচাপ। ম্যাকলিস্টার বলল, ওয়াল্টার, তোমার কতগুলো হ্যাজাক আছে?

–ষোলোটা।

–ষোলোটা? আর ওগুলো নিশ্চয় তুমি ইয়ার্কি দেওয়ার জন্য কেনোনি। রাত্রে তোমাকেও কাজ চালাতে হয়। সবাইকেই চালাতে হয়। আমাকেও হয়। টমাস ডাফকে কি চালাতে হয় না?

ওয়ালিক বলে উঠল, নিশ্চয়।

ওয়ালেস বললেন, কেন, হোয়েসন ব্রাদার্স লাস্ট ইয়ারে ওদের হাওড়া মিলে যে ইলেকট্রিক লাইটের এক্সপেরিমেন্ট করল, সে খবরটা কি ডান্ডি জানে না? তারা কি ভাবছেন, খবর রাখে না, হাওড়া মিল এখন চল্লিশ জাবলাকফ ল্যাম্প-এর বৈদ্যুতিক আলো দিয়ে রাত্রেও কাজ চালাচ্ছে?

লিটলজন বলে উঠল, কিন্তু সে এক্সপেরিমেন্ট খুব সাকসেসফুল হয়নি শুনেছি। প্রায়ই যান্ত্রিক গোলযোগ উপস্থিত হয়।

ওয়ালেস বললেন, মে বি। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, বেঙ্গল ফ্যাক্টরিগুলো যে দিনে রাত্রে কাজ চালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, এ খবর সবাই পাচ্ছে।

ম্যাকলিস্টার প্রায় চিৎকার করে উঠল, হাজারবার চালিয়ে যাওয়া উচিত। এবং আমি মনে করি, হোয়েসন ব্রাদার্স-এর হাওড়া মিল, ইলেকট্রিফিকেশনের ব্যাপারে গ্রেট পাইয়োনিয়র। তাদের যান্ত্রিক গোলযোগ হচ্ছে বটে, কিন্তু চালিয়ে যাচ্ছে ঠিক। লং লিভ হাওড়া মিল। লং লিভ হোয়েসন ব্রাদার্স।…

ম্যাকলিস্টার গেলাস তুলে ধরল। বাকি সবাইও ধরল। কেবল লিটলজন-এর গেলাস একটু কম উঠল। এ ক্ষেত্রে ম্যাকলিস্টার একেবারে ভুল বলেনি। বৈদ্যুতিক আলোকে প্রথম কাজে লাগানোর চেষ্টা হোয়েসন ভাইদের হাওড়া মিলই করেছে। খরচের পরিমাণ তারা সামলে উঠতে পারবে কি না, সেটা এখনও অজানা। কিন্তু তারাই পথ দেখাচ্ছে। এ দেশের কোম্পানিগুলি এতে ঈর্ষান্বিত হলেও ভবিষ্যতের ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। হাওড়ার লাভ বা লোকসান হোক ওদেরই চাষের অভিজ্ঞতা থেকে বাকিরা নিশ্চিন্ত হয়ে বীজ বুনতে পারবে।

ম্যাকলিস্টারের গলার স্বর বদলাল। সে যেন হিংস্র চাপা গলায় টেবিলে খামচি কাটতে কাটতে বলল, কিন্তু পার্লামেন্টে ওরা সেইটাই প্রমাণ করতে চায়, তোমরা পনেরো ঘণ্টা ষোলো ঘণ্টা বে-আইনি কাজ করাচ্ছ নেটিভ লোকদের দিয়ে।

ওয়ালেস বলল, রাইট। সেইটাই ওরা চায়, ঠিক বলেছেন।

বাকিরা হেসে উঠল হোহো করে। ওয়াল্টার বলল, বে-আইনি কাজের অভাব কী? কে না করছে এদেশে বে-আইনি কাজ? এটা কি ইংল্যান্ড না স্কটল্যান্ড। এখানে ও সব পলেটিকসের প্রশ্ন তুলছে কে?

ম্যাকলিস্টার বলল, ডান্ডি তুলবে।

ওয়াল্টার খেপে উঠে বলল, ওর বাপ পারবে না সে অভিযোগ তুলতে। যে দেশে যে রকম চাল। নেটিভরা তো কোনও প্রতিবাদ করেনি কোনওদিন? ওরা পারে ষোলো ঘণ্টা কাজ করতে, তাই করে। আমাদের ঘোড়াকে আমরা কতক্ষণ চালাব, সেটাও কি পার্লামেন্ট হুকুম দেবে?

ম্যাকলিস্টার রেগে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, তুমি একটি ফুল। দেশের খবর কি কিছুই জান না? স্ট্রাইক, প্রোসেশন, আন্দোলন তো প্রায়ই হচ্ছে। সেখানে যখন মজুরি বেঁধে দিয়েছে পার্লামেন্ট থেকে, এখানেও দেবে।

–কে দেবে? নেটিভদের কি পার্লামেন্ট আছে?

 –ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টই নেটিভদের পার্লামেন্ট।

ওয়াল্টার চিৎকার করে উঠল, আমি তা মানতে চাইনে।

এই সেই ওয়াল্টার, সেনপাড়া জগদ্দলের লোকেরা যাকে পাগলা সাহেব বলে জানে। এবং সে যে এক ধরনের স্বেচ্ছাতান্ত্রিক ব্যবসায়ী জগতের পাগল, তাতে সন্দেহ নেই। সে বাঁশঝাড়ের তলায় বসে, এ দেশের লোকের ঘাড়ে হাত দিয়ে কথা বলতে পারে। কিন্তু ব্যবসায়ের বিষয়ে কোনও খাতির নেই।

ওয়ালেস হাসলেন। হেসে ওয়াল্টারকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, চটছেন কেন? ম্যাকলিস্টার বলছে ঠিকই। পার্লামেন্টের বুকনির কথা আপনি রাখুন না। ইন্ডিয়ান কোম্পানিগুলো কাদের? আমাদের দেশের লোকেরই তো? এটা নিশ্চিত জেনে রাখুন পার্লামেন্টে এমন কোনও কথা কেউ ওঠাতে পারবে না, যাতে এম্পায়ারের কলঙ্ক হতে পারে। ডান্ডিকে চুপ করতেই হবে, আর নেটিভ শ্রমিকদের খাটাবার অধিকারও আমাদেরই থাকবে, যতদিন না নেটিভরা কোনও গণ্ডগোল করে। জুট কিছু কম রাজস্ব দেয় গভর্নমেন্টকে, আর গভর্নমেন্টটা আমাদেরই। ব্যবসায়ে লোকসান গেলে, সকলেরই মেজাজ খারাপ হয়। আমাদের মেজাজ খারাপ করার কিছু নেই। একবার ভেবে দেখুন, ঊনসত্তর-সত্তর সালে আপনারা এক্সপোর্ট করেছিলেন, সাত মিলিয়নের মতো গানি ব্যাগ। ঊনআশি-আশি, ঠিক দশ বছর পরে করেছেন, প্রায় ছাপান্ন মিলিয়ন! কোথায় সাত আর কোথায় ছাপান্ন মিলিয়ন! ওদের মেজাজ খারাপ হবেই। আপনারা কাজ চালিয়ে যান!

ওয়ালিক মুগ্ধ মাতাল চোখে তাকিয়ে বলল, স্যার, আপনার দেখছি সব মুখস্থ।

ওয়ালেস বললেন, বিলকুল, বেঙ্গল জুট ইন্ডাস্ট্রির, আজ পর্যন্ত সবকিছুই আমার নখদর্পণে আছে। সত্যি কথা বলতে কী আমাদের ভয় পাবার কিছুই নেই। আমরা এ দেশের পাটের হোম ইন্ডাস্ট্রিকে প্রায় খতম করে এনেছি। হোমের শস্তা কটন গুডস আগেই ওদের মারতে আরম্ভ করেছিল। তারপর এল আমাদের পাওয়াল লুম। গত বছরের আগের বছর আমরা টোটাল জুটের মাল এক্সপোর্ট করেছি এক কোটি তেরো-চৌদ্দ লক্ষ টাকার। তার মধ্যে নেটিভ হ্যান্ডলুম-এর মাত্র আড়াই লক্ষ টাকা! এর পরে এরা আর পাটের কাপড় বুনবেই না, দেখবেন। ষোলো আনাই আপনাদের। অবিশ্যি, নেটিভ তাঁতিদের কিছুই নয়, তাঁত পাট সবই জেন্টু বড়লোকের। সেই লোকগুলোই এখন আমাদের পেছনে লাগছে এদেশে। ক্ষতি নেই। ওরা যে আমাদের কিছুই করতে পারছে না; তার প্রমাণ, আঠারো শো বাহাত্তর থেকে চুয়াত্তরের মধ্যে, চারটি নতুন কারখানা খোলা হয়েছিল। চুয়াত্তর থেকে পঁচাত্তর, মাত্র এক বছরের মধ্যে আটটা জুটমিল আপনারা খুলেছেন, হাওড়া ওরিয়েন্টাল, ক্লাইভ, বেলেঘাটা, সেন্ট্রাল, গ্যাঞ্জেস ইত্যাদি।…চাঁপদানিকেও আপনারা এর মধ্যে ধরুন। ডিয়ার ফ্রেন্ডস। জাস্ট ইমাজিন, আরও তেরোটা মিল তৈরি হচ্ছে, কোনওটা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। এই তেরোটার মধ্যে আমি বেগ-ডানলপের এখানকার ভাবী মিলটিকেও ধরেছি। কারণ বেগ-ডানলপের হোম কোম্পানি ইতিমধ্যেই এই মিলের নাম রেজেস্ট্রি করেছে, আমি জানি। মি. লিটলজনের যদি আপত্তি না থাকে, তবে আমি মিলের নামটাও ঘোষণা করতে পারি।

লিটলজন সে সুযোগ ওয়ালেসকে দিল না। সে নিজেই বলে উঠল, অ্যালায়েন্স জুট মিল।

ম্যাকলিস্টার মত্ত গলায় হাঁক দিয়ে উঠল, অ্যালায়েন্স! অ্যালায়েন্স! সত্যি, মি. ওয়ালেস, আমি যেন দিশেহারা হয়ে পড়ছি। আপনি আমাকে প্রায় পাগল করে দিয়েছেন। উই আর গোয়িং টু মেক দিস বেঙ্গল এ কান্ট্রি অব জুট ইন্ডাস্ট্রি।

ওয়ালেসের কনিয়াকের নেশা বেশ ধরেছে। ম্যাকলিস্টারকে টপকে, ওয়ালিকের গায়ে একটা চাঁটি মেরে বললেন, ইউ, আই, ইউ ডেভিল ওয়ালিক, তোমাদের বেবি মিল যে টিটাগড়ে স্টার্ট করতে যাচ্ছে, ইতিমধ্যেই জমি জমা দেখা শুরু হয়ে গেছে, সে কথাটা তুমি বলছ না কেন?

একযোগে সবাই প্রায় চিৎকার করে উঠল, ইজ ইট সো? ওয়ালেস বললেন, 

নিশ্চয়! যে তেরোটা মিলের কথা আমি বলছি, এর মধ্যে টমাস ডাফের নতুন মিলের হিসেবটাও আমি ধরেছি।

ম্যাকলিস্টার খাবলা দিয়ে ওয়ালিকের ঘাড়ে ধরল। বলল, ইউ ফাকিং ড্যামন ওয়ালিক, এসব তুমি বলনি কেন?

ওয়ালিক হাসতে হাসতে বলল, শুনুন শুনুন মি. ম্যাকলিস্টার, দু-চার দিনের মধ্যেই আপনারা জানতে পারতেন। কোম্পানি আমাকে মুখ বুজে থাকতে বলেছে বলেই চুপ করে আছি।

ওয়ালেস আবার বললেন, বুঝতে পারছেন না ওয়ালিককে দেখে। প্র্যাকটিক্যালি অফিস বয় থেকে ও টমাস ডাফের কনফিডেনশিয়াল পজিশনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কোম্পানির ইন্ডিয়া কনর্সান এখন ওকে বাদ দিয়ে ভাবাই যায় না।

লিটলজন তার মদরক্ত বিস্মিত মুখ তুলে বলল, ওঃ মি. ওয়ালিক, আপনি কতদিকে তাল দিচ্ছেন? আমাকে সাহায্য করছেন, আবার ওদিকেও চালাচ্ছেন?

ওয়াল্টার কিছু বলতে পারছিল না। তার বুকের ভিতরটা যেন ফেটে যাচ্ছে। এত মিল বাংলাদেশে দরজা খুলতে যাচ্ছে! ওয়াল্টারের স্বপ্ন কবে সফল হবে। কবে কবে হে ওয়াল্টার, কুমায়ুনের জঙ্গল থেকে এই হুগলি নদীর তীরে চলে আসার স্বপ্ন সফল হবে। ওয়াল্টারের পরিপূর্ণ জুট মিল, যেখানে গানি ব্যাগস, হেসিয়ান, ক্লথ তৈরি হয়ে একদিন বিশ্বজয় করতে বেরুবে।

ম্যাকলিস্টার উঠে পায়চারি আরম্ভ করল। বেয়ারা বাবুর্চিরা একটু ভয় পেতেই আরম্ভ করেছে। সাহেবরা মাতাল হয়ে গেলে, যা খুশি তাই করতে পারে। জিনিসপত্র ভেঙে, মারধোর করে, একটা হইচই লাগিয়ে দিতে পারে।

রসুল চুপিচুপি বলল, ছটখলের শাবউন বিয়াগগুন ফাঅল, ফাঅল…।

চটকলের সায়েবরা সব পাগল।

কিন্তু ম্যাকলিস্টার, ওয়ালেস যাকে মনে মনে, বিট অব এ মেকানিকাল জিনিয়স ভাবছেন, সেই ম্যাকলিস্টারের চোখে মুখে আনন্দ, কিন্তু একটা হতাশার ছায়া সে কিছুতেই মুখ থেকে সরাতে পারছে না। ফিলাডেলফিয়ার বাস কন্ডাক্টর, যে কুড়ি পার্সেন্ট ডিভিডেন্ড দিয়েছে একদা ফোর্ট গ্লাস্টারের শেয়ার হোল্ডারদের, সে আজ থমকে আছে। আর তোমার সামনে, নতুন নতুন কোম্পানি ডান্ডি থেকে পাল তুলে দিয়ে ছুটে আসছে, সাফল্যের পথে এগিয়ে চলেছে।

ওয়ালেস ডাক দিলেন, মি. ম্যাকলিস্টার, এ সব শোনার পরেও আপনি কেন হতাশ হচ্ছেন? গো অন, গো অন স্টেডি, আপনারও সাকসেস সামনেই আছে।

ম্যাকলিস্টার ছুটে এসে ওয়ালেসের হাত ধরল। প্রায় চুপিচুপি স্বরে বলল, আছে, না? আছে আছে, আপনার কথা শুনে সত্যি আনন্দ হচ্ছে, বিশ্বাস হচ্ছে। আমি আবার টুয়েন্টি পার্সেন্ট ডিভিডেন্ড দেব।

ওয়ালেস বললেন, নিশ্চয় দেবেন। জুটের এখন কিশোরী বয়স, প্রাক যুবতী, তার পূর্ণ যৌবন উথলে ওঠার সময় আসছে। তার মতো সুন্দরী মেয়ে ট্রয়ের রানির চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়। সে এখন আমাদেরই। আসুন, ইন্ডিয়ান জুট ইন্ডাস্ট্রির জন্যে আমরা এবার স্কচ পান করি।

সকলে হুররা দিয়ে উঠল।

রোমান্স! রোমান্স! জুট আজকে ভারতের বিচিত্র রোমান্স। আগামী বিংশ শতাব্দীতে তার রোমান্স আরও বাড়বে। গঙ্গার দুই কূল ভরে যাবে চটের কারখানায় কারখানায়।

মাস্টার হরিচরণের বাজনা চলেছে পুরো মাত্রায়।

.

৪০.

রসুল তার সহচরদের নিয়ে খাবার বিতরণ শুরু করল। রসুইখানায় এসে ভান্ডা দাঁড়িয়েছে। রসুলের সেটা ভাল লাগছে না। সে জানে, তার কী কর্তব্য। সাহেববাড়িতে সে নতুন কাজ করছে না, নতুন খাওয়াচ্ছে না। ভান্ডার এই অকারণ কাগিরি সে মানতে পারে না। রসুল তাই এক বোতল মদ তুলে দিল ভান্ডার হাতে। বলল, পি লিজিয়ে সাব।

কোন সাপের কী মন্ত্র, রসুল তা জানে। সাহেবদের কাছছাড়া হবার উপায় নেই। নইলে বাংলোর দুই ঝাড়ুদারনি, খাঁদনবালা আর পাঁচিকে ডেকে নিয়ে আসত। তারাই সরিয়ে নিয়ে যেতে পারত ভান্ডাকে। নয়তো বাংলোর চাকরানি ভুলি।

কিন্তু রসুল আজকের এই ভান্ডাকে ঠিক চেনে না। এই ভান্ডা এখন আর শুধু নারীভুক নয়। ওর ফিরিঙ্গি প্রাণে আজ পিতৃরক্তের স্বপ্ন, ওকে নেশাগ্রস্ত করে তুলেছে। তাই মদের বোতলটা নিয়েও ফার্ডিনান্ড লাফিয়ে উঠল না। ছিপি খুলে ঢক ঢক করে গলায় মদ ঢেলে, ঝিমঝিম স্বরে বলল, রসুল বকস, সাহাবলোগকো আচ্ছা করকে খিলাও, ঠিকসে খিলাও।

যেন সে বলবে, তবে রসুল সাহেবদের ভাল করে খাওয়াবে। মনে মনে বলল হালায় বান্দর, ছায়েবের জার। এদিকে মদের পাত্র সরিয়ে নেবার হুকুম হয়নি, স্যুপ খাওয়া হয়ে গেল। ওয়াল্টার ঘোষণা করল, ইন্ডিয়ান কারি পিলাউ, ইংলিশ ডিশ, দুরকমই আছে। অনুগ্রহ করে সবাই যেন রুচি ও ইচ্ছেমতো খান।

ওয়ালেস-ই বলে উঠলেন, লং লিভ ফোর্ট গ্লাস্টার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার।

আবার সবাই গেলাস তুলে ধরল। ম্যাকলিস্টার বলে উঠল, কিন্তু মিসেস ম্যানেজারের অভাবটা আমি বেশ বোধ করছি। ওয়াল্টার, তুমি যদি বলো, কলকাতায় পাত্রী দেখব। এখন অনেক মেয়ে, প্রচুর মেয়ে।

ওয়াল্টার বলল, হ্যাঁ, আমি বিয়ে করব, ফুল ফ্লেজেড মিল যখন চালাতে পারব, তখন আমি বিয়ে করব স্যার। তার আগে নয়।

ম্যাকলিস্টার বলল, নাঃ, তুমি দেখছি গোঁড়া আর গোঁয়ার স্কচ। ফুল ফ্লেজেড মিল হতে হতে যে তুমি থুথুড়ে বুড়ো হয়ে যাবে খোকন!

নেশায় এখন ওয়াল্টারের সব লজ্জা সংকোচ দ্বিধা কেটে গেছে। বলল, স্যার, আপনি আমার আগে থেকেই এ দেশে আছেন, নিজের হাতে মিল তৈরি করেছেন, কিন্তু আজ অবধি কোনও মহিলার পাণিপীড়ন করেছেন বলে আমরা শুনিনি। নিশ্চয়ই ফিলাডেলফিয়ায় বিয়ে করে আসেননি আপনি?

ওয়ালেস উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন, ভেরি গুড, ভেরি গুড মি. ওয়াল্টার, মি. ম্যাকলিস্টারকে এতক্ষণে আপনি একটা পাল্টা দিতে পেরেছেন।

ওয়ালিক বলে উঠল, এবং এর সন্তোষজনক জবাব পেলে, আমরা সকলেই বিশেষ সুখী আর কৃতজ্ঞ হব।

ম্যাকলিস্টার হা হা করে হেসে উঠল। বলল, আমাকে তোমরা এ কথা জিজ্ঞেস করছ? ওহে, যে কারণে বিয়ে, তার কিছুই আমি বাকি রাখিনি। তোমরা জান, বাউরিয়ায় বসে, আমি স্কচ হুইস্কি আর ফ্রেঞ্চ কনিয়াক পাইনি বটে, কিন্তু সাদা চামড়ার মেয়েদের একটা গোটা জেনানা আমি পুষেছি। এই হিন্দুস্থানে যাকে বলে হারেম। আমার মতো লোক বিয়ে করলেই সর্বনাশ হত। রোজ মারামারি কাটাকাটি হত। সব জেনেশুনে আমাকে কেন ঘাঁটাচ্ছ?

ম্যাকলিস্টার মিথ্যে বলেনি। একটা ঘটনা প্রায় সকলেরই জানা। স্কটল্যান্ডের পশ্চিমে, আটলান্টিকের ছোট ছোট দ্বীপের বন্দি শিবির থেকে, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরিত একশোটি মেয়েকে সে বাউরিয়ায় আমদানি করেছিল। স্বভাবতই সেই সব মেয়েরা প্রায় সকলেই গুরুতর অপরাধে অপরাধিনী ছিল। খুন, ব্যভিচার, এবং অন্যান্য সামাজিক অপরাধে, অপরাধিনী, নানান বয়সের সেই সব মেয়েদের এনে, বিশেষ করে উইভিং ডিপার্টমেন্টে ছড়িয়ে দিয়েছিল সে।

ওয়ালিক বলল, আমরা শোনবার জন্যেই আপনাকে ঘাঁটাচ্ছি স্যার।

ওয়ালেস বললেন, রিয়েলি, সেই আইলস অব আয়ারের মেয়েদের কথা আপনার মাথায় এল কী করে, আর গভর্নমেন্ট রাজিই বা হল কী করে?

ম্যাকলিস্টারের রক্তাভ চোখে ও মুখে যেন অনেকগুলি ব্যথিত ও উৎকণ্ঠিত দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। বলল, ড্যাম ইওর গভর্নমেন্ট, ওরা কী করে রাজি হয়েছিল আমি জানি না। একটা এক্সপেরিমেন্ট হিসাবেই হঠাৎ ব্যাপারটা আমার মাথায় এসে গেছল। আর, সম্ভবত আমাদের সরকার আর কর্তৃপক্ষেরও তাই, তারাও একটা এক্সপেরিমেন্টের জন্যেই বোধহয় রাজি হয়ে গেছল। কিন্তু আইরিশ ওসেন নয়, নর্দার্ন হাইল্যান্ডস-এর নীচে, আটলান্টিকের দ্বীপের জেলখানার কয়েদি ওরা। আমি অবিশ্যি প্রথমে ভেবেছিলাম, আটলান্টিকের ওই সব দূর দ্বীপের মতো, এই বাউরিয়াও ওদের কাছে একটা দ্বীপান্তরের নির্বাসনই হবে। বিদেশ বিভূঁই, অচেনা বাংলাদেশ, এখানে থেকে কাজকর্ম ভালই করবে। কাজকর্ম যে খারাপ শিখেছিল, তা নয়। কয়েকজন তো এক্সপার্ট উইভার ছিল, আর তারা সকলেই ডান্ডি এক্সপার্ট মেয়ে। আমি ওদের জন্যে, আমার বাংলোর কাছাকাছিই একটা ব্যারাক তৈরি করে দিয়েছিলাম। কাজও ওরা খুব ভাল করছিল। আর বুঝতে পারছেন মি. ওয়ালেস, ম্যানেজার ম্যাকলিস্টারের বাংলোটাও প্রায় ওদের দখলেই চলে গেছল। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যান্ড ওভারসিয়ারের দলেরাও হোমের মেয়েদের পেয়ে, কারখানার বাইরে আর পা-ই দিত না। তার মধ্যে দু-তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ওভারসিয়ার বিবাহিত ছিল। তাদের বউয়েরা তো রীতিমতো প্রমাদ গুনল। স্বামীদের দাবিয়ে রাখাই দায় হল বেচারিদের। সন্ধের পরেই ঘরের তালা বন্ধ করে দিত। যাতে কর্তারা ঘর থেকে বেরুতে না পারে। আর আমাকে যে কী গালাগালটা দিচ্ছিল, তা আমিই জানি। তারাই রটালে যে, আমি একটা একশো মেয়ের জেনানা খুলে বসেছি।

ওয়ালেস বললেন, একেবারেই রটনা? ঘটনা কি কিছুই ছিল না মি. ম্যাকলিস্টার?

ম্যাকলিস্টার বলল, ছিল না মানে? টেরিবলি ছিল স্যার, ডেঞ্জারাসলি ছিল। নইলে আর ওয়াল্টারকে বলছি কেন? প্রথমটায় আসকারা দিয়ে তারপরে আর শাসন করতে পারছিলাম না। সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে তো আর বাংলোতে রাত্রিযাপন করা যায় না। আর সেই সব মেয়ে, ও খ্রাইস্ট! নেটিভদের কাছ থেকে কলসি কলসি কান্ট্রি লিকার কিনে, গিলত, আর সারারাত্রি হুল্লোড় করত। সারাদিন কাজ করেও ঘুম ওদের চোখে ছিল না। নিজেদের মধ্যে মারামারি তো রোজ লেগেই ছিল। কারখানার মধ্যেই এক একদিন গোলমাল লাগিয়ে দিত। অবিশ্যি লক্ষ করে দেখেছিলাম, কয়েকটি মেয়ের ইনিশিয়েটিভেই ও সব ঘটছিল। সেই মেয়েটিকে একদিন ক্যালকাটা পুলিশের হাতে তুলে দিলাম। তারপরে ওরা একটু শান্ত হয়েছিল।…এখন থেকে ধরুন, সাত বছর আগে এইটিন সেভেনটি ফাইভের কথা বলছি, কয়েক মাস ওদের নিয়ে সবদিক থেকেই আমি খুব ভাল ছিলাম। কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই তো একটা ভুলের উপর গড়ে উঠেছিল। এইসব মিনিংলেস এক্সপেরিমেন্টের কোনও ফল পাওয়া যায় না। ওই সব লাইফ সেন্টেসেড মেয়েরা ইন্ডিয়াতে আসতে চেয়েছিল কোনও একটা আশা নিয়ে। অথচ কোনও আশাই তারা পায়নি। হয়তো তাদের লেবার চার্জটা নেটিভদের থেকে কিছু বেশি করা হয়েছিল, বাসস্থানের ব্যবস্থাও মোটামুটি মন্দ ছিল না। কিন্তু সেটাই জীবনের সব নয়। ইন্ডিয়ার জুট ইন্ডাস্ট্রির কী হবে না হবে, সেটা ওদের ভাববার কথা নয়।

লিটলজন বাধা দিয়ে বলে উঠল, আর একজন ম্যাকলিস্টারের ফিজিকাল আর্জ মেটানোর আশাতেই একমাত্র তারা আসেনি।

বাধা পেয়ে ম্যাকলিস্টার থমকে গেল। রক্তাভ চোখ তুলে তাকাল লিটলজনের দিকে। চকিত মুহূর্তের জন্যে ম্যাকলিস্টারের চোয়াল দুটি শক্ত হয়ে উঠল। ওয়ালিক শঙ্কিত হয়ে উঠল সকলের আগে। সে দেখল, ম্যাকলিস্টারের গেলাস ধরা থাবাটা শক্ত হয়ে উঠেছে। সে ওয়াল্টার আর ওয়ালেসের দিকে তাকাল। দুজনের সঙ্গেই চোখাচোখি হল তার। ওয়ালেস আর ওয়াল্টারের চোখেও উদ্বেগ ফুটে উঠেছে। ওয়ালিক তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াতে গেল। হয়তো এখুনি ম্যাকলিস্টার ঝাঁপিয়ে পড়বে লিটলজনের উপর।

কিন্তু ম্যাকলিস্টার সে রকম কিছুই করল না। সে গেলাসটা একবার শুধু ঠোঁটে ছোঁয়ালে, আবার নামিয়ে রাখল। মাতালের মতো আচ্ছন্ন মোটা শান্ত গলায় বলল, আপনি আমাকে অপমান করছেন, আমি বুঝতে পারছি মি. লিটলজন। জানি না, আপনার এত তিক্ততা কীসের। কিন্তু আমি রাগ করতে পারছি না। যদিও, সত্যি, আমি ওই সব মেয়েদের নিয়ে হিন্দুস্তানি নবাবদের মতো জীবনযাপনের কথা ভাবিনি। আপনার ভাষ্য অনুযায়ী, ফিজিকাল আর্জ মেটানোর জন্যে, দূর দেশ থেকে ওদের আমি টেনে আনিনি, তবু রাগ করতে পারছি না, কারণ, ব্যাপারটা সত্যি সে রকমই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আসলে আমি একটা বিশেষ কিছু করতে চেয়েছিলাম। একটা কিছু মাথায় এসে গেলে, আমি আর স্থির থাকতে পারি না। তার জন্যে আমার ইন্ডিয়ার ম্যানুফ্যাকচারার বন্ধুরা কেউ পাগল বলে আমাকে, কেউ শয়তান বলে। হয়তো আপনার কাছেও আমি শেষের গালাগালটাই পাব। কিন্তু আপনি জেনে রাখুন, ওদের ফিজিকাল আর্জের কাছে, একজন কেন, হান্ড্রেড ম্যাকিলস্টারসের আর্জও অতি তুচ্ছ। সেটা আমি প্রত্যক্ষ করেছি, ভয়ংকরভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। অস্বাভাবিক জীবনযাপনের ফলে, অনেকটা পশুর মতো হয়ে গেছে ওরা, অ্যান্ড আই মাস্ট কনফেস, আমি শেষ পর্যন্ত ওদের পশুত্বের শিকার হয়ে গিয়েছিলাম। আপনি আমাকে ইনসাল্ট করছেন মি. লিটলজন…।

ম্যাকলিস্টারের গলা ডুবে গেল। চোয়াল দুটি শক্ত হয়ে উঠল তার। নিজের থাবাটা সে রক্তাভ চোখে দেখতে দেখতে আবার বলে উঠল, কিন্তু আমি রাগ করতে পারছি না। আপনি কী বলছেন বা আমি কী হয়ে গিয়েছিলাম, সেটা বড় কথা নয়, তাই রাগ করতে পারছি না। কারণ ওদের আমি চিনতাম, বুঝতাম। ওদের সমস্ত উচ্ছ্বঙ্খলতার মূলে ছিল হতাশা। হিন্দুস্তানে আসা মানে একটা বিরাট পরিবর্তনের স্বপ্ন ছিল ওদের।

ম্যাকলিস্টার আবার থামল। সে যেন দাঁতে দাঁত চেপে গোঙাচ্ছে।

লিটলজন যেন ম্যাকলিস্টারের কথার কোনও অর্থই বুঝতে পারছে না, এমনি একটা ভাবলেশহীন মুখ নিয়ে সকলের দিকেই ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। যেন এ সবের সে কিছুই জানে না। তার মুখ ঘামে ভিজে উঠেছে, চিবুকের কাছে বেয়ে পড়ছে। আসলে সে ভয় পেয়েছে। ম্যাকলিস্টারের ভাবভঙ্গি দেখে ভিতরে ভিতরে একটা আতঙ্ক, তার নেশার উত্তেজনার সঙ্গে মিশে, সহসা স্নায়ুসমূহকে বিকল করে দিয়েছে।

ওয়ালেস গলায় জোর দিয়ে বলে উঠলেন, আমি জানি, আমি জানি মি. ম্যাকলিস্টার, আপনি একটা জেনানা খোলবার জন্যে ওই সব মেয়েদের নিয়ে আসেননি। বাউরিয়া ফ্যাক্টরিতে আপনি একটা অদ্ভুত উন্মাদনার সৃষ্টি করতে চেয়েছিলাম, একটা নতুন কিছু করে সবাইকে অবাক করে দেবার উত্তেজনাতেই এ রকম কাণ্ড করেছিলেন। তারপরে আপনি ওদের প্রতি স্নেহপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন, ওদের ভালবেসেছিলেন, ওদের বুঝতে পেরেছিলেন। আপনি ওদের কথা বলুন।

ম্যাকলিস্টার তার গেলাস তুলে চুমুক দিল। হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বলল–ওদের কথা, ওদের কথা খুব সহজ, আর সরল মি. ওয়ালেস। ইন্ডিয়াতে আসবার সময় ওরা জানত, নতুন কোনও দ্বীপে নয়, নতুন কোনও জীবনের পথেই ওরা চলেছে। হয়তো সেখানে ওরা সংসার পাততে পারবে, একজন পুরুষকে নিয়ে। যে কোনও একজন পুরুষ, সে কালা কিংবা ধলা, সে সব চিন্তা ওদের মাথায় ছিল না। কেউ কেউ অবশ্য ওদের ঠাট্টা করে ফাদারল্যান্ড থেকে বলে দিয়েছিল, যাও, হিন্দুস্থানে গেলে তোমরা সবাই নবাবের বেগম হয়ে যাবে। সোনার থালায় রুটি, আর সোনার গেলাসে মদ খাবে। সে সব ওরা বিশ্বাস করেনি। তবে ওরা খুন করুক, ডাকাতি করুক, বেশ্যাবৃত্তি করুক, ওরা যে মেয়ে, এ কথাটা ওরা কখনও ভুলতে পারে না। সব থেকে নটোরিয়াস, হল্লাবাজ মেয়েকেও দেখেছি, অন্তরে অন্তরে একটাই আকাঙ্ক্ষা, স্বামী পুত্র সংসার, যে কোনও অবস্থাতেই থোক। এই পাওয়ানা আর স্থিতির আশা যতই নষ্ট হয়েছে, ততই দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে ওরা। ওরা যখন প্রথমে আসে, সংবাদটা খুব ছোট করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুখপত্রে পাবলিশ করা হয়েছিল। ক্যালকাটার অনেক ইউরোপীয় ভদ্রলোকদেরই খুব উৎসাহ দেখেছিলাম। আর সেই সব জেন্টলম্যানরা যে এই সব মেয়েদের বিয়ে করবার জন্যে উৎসাহিত হয়েছিলেন, তা নয়। তারা জানতেন, ওই সব খুনি চোর উঞ্ছ মেয়েদের বিয়ে করা যায় না। তারা হারল হাউস খুলবেন ভেবেছিলেন। ক্যালকাটার আমাদের দেশীয় বিজনেসম্যানদের জানতে তো আমার বাকি নেই। বেশ্যাবৃত্তির কারবার করে, তারা কিছু কামিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। আমি আগের থেকেই তাই ঠিক করে রেখেছিলাম, ক্যালকাটা পোর্টে যেন মেয়েদের নামতে না হয়। তার জন্যে অবশ্য কর্তৃপক্ষ গোলমাল পাকাবার চেষ্টা করেছিল। বাট আই অ্যাম রিচার্ড ম্যাকলিস্টার, আমিও এখানে রোজগার করবার জন্যেই এসেছি। এনি ইনজিনিয়াস কাজ আমার দ্বারাও সম্ভব। কিন্তু আমার স্বগোত্রের মাংস আমি খেতে পারব না। ওই মেয়েরা আমারই স্বগোত্র। নিতান্ত অ্যাকসিডেন্টালি হয়তো আমি খুনি হয়ে উঠিনি, কিন্তু আমিও একটা ভ্যাগাবন্ড। তা ছাড়া মেয়েদের দেহ বিক্রির পয়সায় ভদ্রলোক হবার মতো বিজনেসম্যান হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ক্যালকাটা পোর্টে আমি ওদের নামতে দিইনি। কর্মচারীরা হুকুমনামা দেখে, তল্লাশি করে গিয়েছিল। পোর্টের ঘাটে অনেক। লোক দাঁড়িয়েছিল ভিড় করে। শিস দিয়ে, টুপি উড়িয়ে, মেয়েদের ডাকাডাকি করেছিল। মেয়েরাও জাহাজ থেকে মেতে উঠেছিল। ডেক থেকে তারাও চিৎকার করে, হাত তুলে নেচেকুঁদে একাকার করেছিল। দু-একটা মেয়ে তো গরমের নাম করে, যাকে বলে একেবারে স্টার্ক নেকেড হয়ে নানান অঙ্গভঙ্গি করতে আরম্ভ করেছিল। পোর্টে নামতে দেওয়া হয়নি বলে, জাহাজের ক্যাপ্টেন থেকে আমাকে একেবারে মা-বাপ উদ্ধার করে ছেড়েছিল।…কিন্তু যাক সে কথা। যে কথা বলছিলাম, ভাল কর্মী এবং ভাল গৃহিণী হওয়ার সব গুণই ওদের মধ্যে ছিল, আর ওই একটি আকাঙ্ক্ষা, সেটল, সেট উইথ এ ম্যান অ্যান্ড চিলড্রেন। ভাবলে অবাক হবেন, কয়েকটা মেয়েকে দেখেছি নেটিভ ওয়াকারদের সঙ্গে পর্যন্ত ভাব জমিয়ে, সংসার পাততে চেয়েছিল। কিন্তু সত্যি বলতে কী, সাদা চামড়া এমন একটা বেরিয়ার, নেটিভ ওয়ার্কাররা বিয়ে করা তো দূরের কথা, মেমসাহিবের গায়ে হাত দিতেই ওদের একটা কুসংস্কারের বাধা। তবু অন্তত দুটি মেয়ে আজ নেটিভের ঘর করছে, সে তত আমি চোখের সামনেই রোজ দেখতে পাচ্ছি।

শ্রোতারা সকলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। পান-ভোজনের কথা তারা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। ওয়াল্টার বলল, নেটিভের সঙ্গে ঘর করছে!

–ইয়েস, করছে। নেটিভ দুজনের একজন মুসলিম, আর একজন হিদেন।… কিন্তু এ তো মাত্র দুজন। বাকিরা আমি দেখলাম, আস্তে আস্তে বাউরিয়া ছেড়ে পালিয়ে যেতে লাগল। রাত্রের অন্ধকারে পায়ে হেঁটে, কিংবা নদী পথে নেটিভ বোটম্যানদের বোটে করে অনেকেই পালিয়ে চলে গেছে। ওরা এমনিতেই বেপরোয়া। অজানার প্রতি কৌতূহল আর সুখের হাতছানি ওদের টেনে নিয়ে গেছে। এবং এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, বেশি দূরে ওদের টেনে নিয়ে যেতে পারেনি। ক্যালকাটারই নানান অলিতে-গলিতে ওরা জীবন কাটাচ্ছে। হয়তো কেউ কেউ আবার অপরাধ করে জেলে গেছে। একজনের সংবাদ তো নিউজপেপারেই বেরিয়েছিল, গুরুতর অপরাধ, মার্ডার করেছিল সে। আপনারাও পড়েছেন নিশ্চয়, মিস রোজা নাম্নী এক শ্বেতাঙ্গিনী কর্তৃক একজন আর্মেনিয়ান রেলওয়ে গার্ড নিহত।

ওয়ালেস বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ পড়েছি, লাস্ট ইয়ারেই পড়েছি মনে হচ্ছে।

ম্যাকলিস্টার বলল, হ্যাঁ লাস্ট ইয়ারেরই ঘটনা। বয়স আর বর্ণনা থেকেই আমি চিনতে পেরেছিলাম, এ সেই দলের মেয়ে রোজা। এখনও আমার চোখে ভাসছে ওর চেহারাটা, শক্ত বলিষ্ঠ ছোটখাটো চেহারা, বেশ একটা মিষ্টিভাব, সেনসুয়াস, আই মিন ভোলাপচুয়াস, যেটা ওর ছেলেবেলার দুর্ভাগ্য থেকেই আয়ত্ত করেছিল। ওর গালে একটা কাটা দাগ ছিল, শুনে রাখুন, ওটা কোনও অস্ত্রের দাগ নয়, মানুষের দাঁতের দাগ। মাত্র ষোেলো বছর বয়সে জ্বণ হত্যার জন্যে প্রথম জেল খেটেছিল। তারপরে ইংল্যান্ডের রাজপরিবারে কোনও সৌভাগ্যবানের জন্ম উপলক্ষে কিছু কয়েদিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ওকেও দিয়েছিল। আবার ধরা পড়েছিল ও আর ওর মা, একসঙ্গে, চার্জ–মার্ডার! রোজার নিজের মুখেই শুনেছি, একজন পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টরকে ও আর ওর মা মারামারি করতে করতে মেরে ফেলেছিল। নইলে, সেই লোকটাই ওদের মেরে ফেলত। লোকটা ছিল ওর মায়ের একজন দোস্ত। নিষ্ঠুর আর শয়তানের শিরোমণি। তাতেই রোজার দ্বীপান্তর হয়েছিল। অ্যান্ড ইট ইজ অ্যানাদার মার্ডার বাই হার।

ওয়ালেস বললেন, এবারও সে কোর্টে বলেছে, আর্মেনিয়ান রেলওয়ে গার্ড ওকে ডেডলি ওয়েপন দিয়ে আঘাত করেছিল। ও নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে মেরেছে লোকটাকে।

ম্যাকলিস্টার বলল, সেটা মিথ্যে নয় মি. ওয়ালেস। কাগজের সংবাদেই ছিল, আহত অবস্থায় ওকে পাকড়াও করা হয়েছিল। শি ওয়াজ অ্যারেস্টেড ইন এ ব্লাডস্টেনড় কন্ডিশন। স্ট্রেঞ্জ! কতই বা বয়স রোজার। এখন বোধহয় হার্ডলি তিরিশ। আমি ওকে ভালই চিনি, ভালই…

ম্যাকলিস্টারের গলা ডুবে গেল। তার চোখে, বাউরিয়ার বাংলোর কোনও রাত্রে, তার নিজেরই শয্যাতে বোধহয় একটি মেয়ে ভেসে উঠল। যে মেয়েটার গালে কাটা দাগ, আর সেই কাটা দাগের উপর হয়তো তারই উন্মত্ত সোহাগের তপ্ত স্পর্শ ঝাঁপিয়ে পড়ছে। শ্রোতারা সকলেই যেন রোজাকেই সন্ধান করতে লাগল ম্যাকলিস্টারের মুখের রেখায় রেখায়, তার চোখের স্বপ্নের ভিতর দিয়ে।

ম্যাকলিস্টারের গলা ভেসে উঠল আবার, যেন কোনও গহ্বরের নিচু থেকে, এই রোজাকে ওরা দশ বছরের শাস্তি দিয়েছে। হয়তো আরও কেউ কেউ অন্যান্য অপরাধ করে জেলে গেছে। কেউ হয়তো হারলট্রি বেছে নিয়েছে। কেউ হয়তো সত্যি সুখের সংসারই পেতে বসেছে।

ওয়ালেস বললেন, বাউরিয়াতে কি এখন এদের কেউ নেই?

ম্যাকলিস্টার বলল, আছে, এখনও আট-দশ জন হবে। এবং আমার স্বীকার করতে বাধা নেই, তাদেরই একজনকে নিয়ে আমার এই দূর বিদেশের বাংলোর সংসার, তার নাম জুডিথ। মিস জুডিথ ম্যাকবি। সে উইভিং ডিপার্টমেন্টে চারটে তাঁত একসঙ্গে চালায়। আর ম্যাকলিস্টারের ঘর গৃহস্থালিও চালায়। মানুষের যে দুটো রূপ থাকে, জুডিকে না দেখলে আমি তা বিশ্বাস করতে পারতাম না। সে যতক্ষণ জামার উপরে কালো অ্যাপ্রন ঝুলিয়ে, পাকা তাঁতির মতো ছুরি হাতে নিয়ে কাজ করে, ততক্ষণ সে একরকম। সারা গায়ে ধুলো আর জুট ডাস্ট মাখা। হাস্যময়ী। এনার্জিটিক। নেটিভ ওয়ার্কারদের সঙ্গে হেঁকে ডেকে ছুটে কাজ করে। ছুটির পরে ব্যারাকে ঢুকে যখন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে পোশাক পরে, সেজেগুজে আসে তখন সে আর-এক রকম। গম্ভীর, বিষণ্ণ, স্বল্পবাক, আমাদের সামাজিক আদব কায়দায় আশ্চর্য দুরস্ত। একটুও বোঝা যায় না, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরিত একটি কয়েদি মেয়ে হিন্দুস্থানে এসেছে ফ্যাক্টরির কাজ করতে। কলকাতার যে কোনও ইউরোপীয়ান ভদ্রলোকের বাড়ির মহিলার মতোই তখন তার ব্যবহার। জুডির বয়সও রোজার মতোই হবে। রোজাকে যে রকম সুন্দরী বলে মনে হত, ঠিক সেরকম নয় জুডি। চেহারাটা এর তেমন ভাল নয়। যদিও দীর্ঘাঙ্গী আর স্বাস্থ্যবতী।…ন্যাচারলি, ও আমার সঙ্গেই খাওয়াদাওয়া করে। বাংলোর বেয়ারা খানসামারা দেখেছি, ওকে বেশ রিগার্ড করে। সেলাম ঠুকে মেমসাহিবের সম্মান দেয়। কিন্তু এই একটা ব্যাপারই ভারী আশ্চর্য, সন্ধ্যাবেলা ও অন্য মেয়ে হয়ে যায়। সারাদিন ধরে আমার যে উন্মাদনাটা থাকে, সন্ধ্যাবেলা জুডির সামনে আর সেটা থাকে না। একটু যে হাসাহাসি মাতামাতি করব, সেটা কিছুতেই হয় না। আমার যা স্বভাব আমার যা চরিত্র, সব কিছুই একটু হাইটেন্ড না হলে আমার ভাল লাগে না। কিন্তু জুডির সামনে আপনা থেকেইনম্র হয়ে উঠি, এবং সবথেকে আশ্চর্য, আমার মধ্যেও গাম্ভীর্য আর বিষণ্ণতা নেমে আসে। জুডির সান্নিধ্যেরই রেজাল্ট সে সব। অথচ, কী বলব, একটা অদ্ভুত আবেগ, আমার ভিতরে থরথর করতে থাকে। জুডিরও। আমি মনে করি, ওকে একটু আদর করি, যাতে ও শান্তি পায়, আনন্দ পায়। কিন্তু আমিই যেন অসহায় শিশুর মতো হয়ে পড়ি। ও আমার মাথাটা ওর কোলের উপর টেনে, ফিসফিস করে ডাকে, রিচার্ড! রিচার্ড!…

ম্যাকলিস্টার চুপ করল। সকলেই চুপচাপ, কিন্তু সকলেরই মধ্যে একটা নিঃশব্দ আবেগের তরঙ্গ খেলা করছে। আর সে সময়ে মাস্টার হরিচরণের বেহালাটায়ও টানা সুরের ঝংকারে বাজছে। ওয়ালেস নিচু গলায় বললেন, ইউ, মাই ওন্ড বয়, ইউ আর ইন লাভ!

ম্যাকলিস্টারের গলায় যেন একটা গম্ভীর আনন্দের তরঙ্গ দুলে উঠল। বলল, আই ডোন্ট নো মি. ওয়ালেস, আই ডোন্ট নো। শুধু এইটুকু বলতে পারি, বিষণ্ণতার মধ্যেও একটা গভীর আনন্দে আমরা ডুবে যাই, গভীর আনন্দ। শি ইজ এ জেম্‌! কিন্তু জুডিও একজন খুনি।

-খুনি!

সবাই যেন বিস্ময়ে প্রায় কেঁপে উঠল–শি ইজ মার্ডারার?

 ম্যাকলিস্টার বলল, মার্ডারার! ও ওয়েল এর মেয়ে, ওর প্রেমিককেই হত্যা করেছিল। অপরাধ, প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতা। লোকটা ওকে ডুবিয়েছিল। তবু খুনের ব্যাপারটা শুনে, আপনাদের মতো আমিও অবাক হয়েছিলাম। জুডিও বলেছিল, ওকে আমি ঘৃণা করে মারিনি, বিশ্বাস করতে পার। আমি তো ওর বিবাহিতা স্ত্রী ছিলাম না। সুতরাং আমাকে ছেড়ে যাবার অধিকার ওর ছিল। কিন্তু সেটা এত অসহ্য কষ্টকর ছিল, আমি কিছুতেই ভাবতে পারছিলাম না, ও আর একজনকে ভালবাসবে। দারুণ কষ্টে, বিষ খেয়ে মরব ভেবেছিলাম। কিন্তু আমি নিজেও আশ্চর্য, সেই বিষই আমি ওকে খাইয়ে দিয়েছি। আমারই চোখের সামনে ও মরেছে, আমি দেখেছি। পুলিশ যখন এসেছে, তখন আমি ওর মৃতদেহ নিয়ে বসেছিলাম, স্বীকারোক্তি করেছিলাম। পৃথিবীতে এমন যন্ত্রণাদায়ক বিস্ময় আর কী থাকতে পারে। যাকে আমি আমার সমস্ত কিছু দিয়ে চেয়েছি, হারাবার ভয়ে তাকেই আমি শেষ করেছি। ও যখন আমারই কোলে ঢলে পড়ল, তখন ওকে আমি পাগলের মতো আদর করেছিলাম। কী একটা তীব্র সুখ যে তখন অনুভব করেছিলাম, আর এমন একটা গভীর শান্তি, তা আমি ব্যাখ্যা করে বলতে পারি না। কিন্তু তখনও একটা বিষয় আমার অজানা ছিল। পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি করার পর আমার কয়েদের হুকুম হয়ে গেল। আমার ভিতরটা তখন এক ধরনের শূন্যতায় ভরা। যেটাকে আমি গভীর শান্তি মনে করেছিলাম। মনে মনে বলছিলাম। আর তো আমার দুঃখের কিছু নেই, আর তো আমার কিছু হারাবার ভয় নেই। যাকে নিয়ে আমার জীবনের আলো আঁধারের খেলা, তার তত আর কোনও অস্তিত্ব আমি রাখিনি। সে এখন কবরের তলায়।…এই কথা যখন মনে হল, তখনই যেন আমার ভিতরের অন্ধকার থেকে হঠাৎ জানতে পারলাম, কিন্তু আমি বেঁচে আছি, আমি বেঁচে আছি এখনও।

জুডিথের কথাগুলি বলতে বলতে ম্যাকলিস্টার নিজেই যেন যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠল। সে না থেমে বলে চলল, আপনারা যদি জুডির মুখ থেকে শুনতেন সেই সব কথা! কথাগুলো বলতে বলতে ও ওর নিজের গলাটা টিপে ধরে, বুকের কাছটা খামচাতে থাকে। আর তখন জুডি আমার নাম ভুলে যায়। ও আমাকে তখন লিজে বলে ডাকতে থাকে। ওর মুখটা যেন পুড়ে কুঁচকে ওঠে, হাঁপাতে হাঁপাতে, নিচু গলায় জুডি তখন বলে, জান লিজে, আমি বেঁচে আছি, এই কথাটা যেন ছোরা হাতে একটা খুনির অন্ধকার থেকে আচমকা বেরিয়ে আসার মতো। তোমাকে আমি শেষ করে দিয়েছি, কারণ তোমাকে হারাতে পারব না বলে, আর আমি বেঁচে আছি! আমি বেঁচে আছি। আমি পাগলের মতো মাথা কুটতে লাগলাম জেলের দেয়ালে। রক্ত বেরুল, কিন্তু ওয়ার্ডাররা ছুটে এল। ওরা আমাকে মরতে দিল না।… অবিশ্যি এ কথাগুলো জুডি রোজ রোজ বলে না, এক-একদিন হঠাৎ বলে ওঠে।

ওয়ালেস যেন আর ম্যাকলিস্টারের কথা শুনছিলেন না। ওঁর ঠোঁট দুটি নড়ছিল। আপন মনে যেন ফিসফিস করে কী বলছিলেন। ম্যাকলিস্টার থামতে, উনি অভিনয়ের সুরে আবৃত্তি করে বলে উঠলেন,…

হোয়্যার শুড ওথেলো গো?
নাউ হাই ডস্ট দাউ লুক নাউ? ও ইল স্টার্ড
ওয়েঞ্চ
পে অ্যাজ দাউ স্মক! হোয়েন উই শ্যাল মিট অ্যাট
কম্পট,
দিস্ লুক অব দাইন হার্ল মাই সোল্ ফ্রম
হেভেন,
অ্যান্ড ফিয়ে উইল স্ন্যাচ অ্যাট ইট, কোল্ড, কোল্ড,
মাই গার্ল!
 ইভেন, লাইক দাই চেস্টিটি।
ও! কার্সড, কার্সড, স্লেভ, হুইপ মি, ঈ ডেভিলস,…

ওয়ালিক যেন স্বপ্নের উত্তেজনায় নিচু রুদ্ধগলায় বলে উঠল, আনফরগেটেবল, স্যার আনফরগেটেবল, হ্যাটস্ অ!

মাথায় টুপি না থাকলেও, টুপি খুলে নত হওয়ার ভঙ্গি করল সে। ম্যাকলিস্টারের মুখেও যেন অলৌকিক স্বপ্নের ভাব। সে ওয়ালেসের একটা হাত দু হাতে ধরে বলে উঠল, ঠিক, জুডির যন্ত্রণার মধ্যে, ওথেলোর শেষ মুহূর্তের অতি ভয়ংকর যন্ত্রণারই একটা রূপ যেন ফুটে ওঠে। হোয়্যার শুড ওথেলো গো? ওথেলো নিজেকে স্ট্যাব করেছিল। জুডি আত্মহত্যা করবার সুযোগ পায়নি।

ওয়ালেস বললেন, জুডিথের কথা শুনতে শুনতে, ওথেলোর শেষ দিকের কথাগুলোই আমার মনে এল। কিন্তু লিজে কে? ওর প্রেমিকের নাম কি তাই ছিল?

ম্যাকলিস্টার বলল, হ্যাঁ। কিন্তু এখন আর জুডি আত্মহত্যা করতে চায় না। শি ওয়ান্টস টু লিভ। আমি বুঝতে পারি, ওকে বোঝে, বুঝে ওর সঙ্গে একটু সহৃদয় ব্যবহার করবে, এমনি একটি সান্নিধ্য ওর দরকার। ও বলে, রিচার্ড, নিবিড় ব্যথার মধ্যেই একটু আনন্দের খোঁজ পাওয়া যায়। ঈর্ষা মানুষকে ছাড়তে চায় না, অথচ ঈর্ষাই মানুষের শত্রু। এ প্রবৃত্তিকে আমি আমার অন্তর থেকে নিঃশেষে পুড়িয়ে দিতে চাই। আমি নান হতে পারব না। রিচার্ড, তুমি আমাকে যে ভাবে খুশি গ্রহণ করো, আমাকে নিয়ে যা খুশি তাই করো, তা হলেই আমি আমার এ মুক্ত জীবনটাকে একটু ভোগ করতে পারব। আমার নিজেকে বুঝতে পারব।

ওয়াল্টার এতক্ষণে মুখ খুলল। সে যেন এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। বলল, মি. ম্যাকলিস্টার, আপনি অনুমতি দিলেই আমি বাউরিয়া যাব একবার, আমি মিস জুডিথ ম্যাকবির সঙ্গে পরিচয় করতে চাই।

ম্যাকলিস্টারের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। সে তার স্বাভাবিক হেঁড়ে গলায় এবার বলে উঠল, সত্যি, তোমার বিয়ের কথা বলতে গিয়েই তো এত কথা উঠে পড়ল। নিশ্চয় নিশ্চয়, তুমি যেদিন খুশি বাউরিয়াতে আসবে, বাট মাই ওন্ড বয়, এ বিষয়ে আমি তোমাকে কথা দিতে পারি না যে, মিস ম্যাকবির সঙ্গেই তোমার বিয়ে দিতে পারব।

ওয়াল্টার অত্যন্ত ব্যস্ত গাম্ভীর্যে, লজ্জায় ও সংকোচে বলে উঠল, ও! হোয়াট এ ডিসগ্রেস অন মাই পার্টস। ছি ছি, আপনি কী বলছেন? আমি মোটেই তা বলতে চাইনি।

ওয়াল্টারের অবস্থা দেখে, ম্যাকলিস্টারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সবাই হেসে উঠল। ম্যাকলিস্টার বলল, আরে, তুমি এত লজ্জিত হচ্ছ কেন? তোমাকে ঠাট্টা করা হয়েছে। কিন্তু তুমি আমার কাছে যা জানতে চাইছিলে, তার জবাব পেয়েছ আশা করি। অ্যান্ড নাউ, হোয়াট অ্যাবাউট ইউ মাই বয়? আমি হয়তো চার্চে গিয়ে একজন মহিলার পাণিপীড়ন করিনি, কিন্তু অন্যভাবে করেছি। তুমি কি এখনও তোমার প্রমিস বজায় রাখতে চাও? পুরোপুরি একটা মিল তৈরি না করতে পারলে কি সত্যি তুমি বিয়ে করতে রাজি নও?

ওয়াল্টার যেন সত্যি সত্যি তার মনের গভীরে ডুব দিয়ে, নিজের মনকে আতিপাতি করে খুঁজল। কয়েক মুহূর্ত একেবারে স্তব্ধ থেকে বলল, স্যার, ম্যারেজ অ্যান্ড রোমান্স, ইট ইজ সামথিং এ। কিন্তু উইথ পাওয়ার লুমস, ফুল প্লেজেট জুট মিলের জন্যেই আমি নিজেকে উৎসর্গ করেছি।

আবার একটা হাসির রোল পড়ে গেল। ওয়ালেস বলে উঠলেন, হি ইজ রিয়্যালি অ্যান ইন্ডাষ্ট্রিয়ালিস্ট। বাংলাদেশে বসে এখন জুট বিবাহের চেয়ে বড়। জুট ইজ এ গ্রেটার রোমান্স দ্যান ম্যারেজ। থ্রি চিয়ার্স ফর জুট!

আর একবার সকলের গেলাস সুদ্ধ হাত ঊর্ধ্বে উঠল। ম্যাকলিস্টার বলল, সত্যি, জুট মিল ছিল বলেই মিস ম্যাকবির মতো একজন মেয়েকে পাওয়া গিয়েছে। আমার জীবন মরণ, এখন সবই এই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গেই জড়ানো।

ওয়ালেস বললেন, আমাদের সকলেরই। উই আর অল জুট ব্রাদার্স। হয়তো হিন্দুস্তানের ইতিহাসে, কিংবা আমাদের এম্পায়ারের অভিযানের কাহিনীতে, আমরা নিতান্ত অপাঙক্তেয় থেকে যাব। হিন্দুস্তানের হাজার গালগপ্পের মধ্যে আমাদের কথা হয়তো থাকবে না, বাট ইট ইজ টু, এখানেও অনেক ঘটনা, অনেক বিচিত্র চরিত্রের সমাবেশ হয়েছে। আমি যদি কখনও কোনও বই লিখি, আপনাদের সকলের কথাই আমি লিখব। এমনকী রোজা জুডিরাও বাদ যাবেন না।

এখানকার উপস্থিত সবাই জানে, মি. ওয়ালেস প্রায়ই জুট ইন্ডাস্ট্রি সংক্রান্ত বিষয় সংবাদপত্রে লিখে থাকেন। ওয়ালিক বলে উঠল, আপনি আমাদের পুরনো দিনের জুট ইন্ডাস্ট্রির কাহিনী শোনান।

ওয়াল্টার বাধা দিয়ে বলে উঠল, কিন্তু তার আগে আমি অনুরোধ করব, আপনারা খাবারগুলোর সদ্ব্যবহার করুন। বার্বোচিরা অনেকবার ইতিমধ্যে খাবার গরম করেছে।

সবাই একবাক্যে সায় দিল, এবং ভোজনে মনোনিবেশ করল। কিন্তু সকলেরই ঘর্মাক্ত কলেবর। কখন হঠাৎ হাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এতক্ষণ কথায়বার্তায় সেটা কারুর খেয়াল হয়নি। সমুদ্রের হাওয়ার মর্জি বোঝা দায়। কখনও সে ঝড়ের বেগে সারাটা দিনই এলোমেলো করে। কখনও একেবারে স্তব্ধ, গাছগুলি স্থির নিশ্চল। নিশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হয়।

ওয়াল্টার চিৎকার করে হাঁক দিল, হেই পানচু পাঙ্খাবালা!

বেয়ারা বাবুর্চিরা হঠাৎ সবাই ত্রস্ত্যব্যস্ত হয়ে উঠল। সকলেরই খেয়াল হল, মাথার ওপরে টানা পাখা রয়েছে। পাখার গায়ে, পাখা ছড়ানো পাখি আঁকা, চার পাশে ফুল লতাপাতার বেড়। কিন্তু পাখা অনড়। ফার্ডিনান্ডের গলা শোনা গেল, স্যার আই উইল কল হিম।

ফার্ডিনান্ডের কথা শেষ হল না। পাখা দুলে উঠল, এবং চোখের পলকে বেগ সঞ্চার করে, ঘামে ভেজা শরীরকে জুড়িয়ে দিল। দড়ির সঙ্গে পাখার গায়ে ঝাপটা খেয়ে কয়েকবার শব্দ উঠল, তারপরে আর শব্দ হল না। শব্দ হওয়াটা পাঙ্খবরদারের পক্ষে অপটুত্বের লক্ষণ। পাখার দড়িটা গিয়েছে, গঙ্গার ধারের জানালার দিকে। জানালার নীচেই ছোট একটি বেড়ার চালা। একজন মানুষ বসতে পারে সেই চালায়, উঠে দাঁড়াতে গেলেই মাথা ঠেকে যাবে। হাত ছড়াতে গেলে বেড়ায় ঠেকবে।

নিতান্ত রোদ বৃষ্টির হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে পাঙ্খবরদার যাতে পাখা টানতে পারে, সে জন্যই এ বেড়ার খুপরি। জানালার শিকের সঙ্গে ছোট কপিকল বেঁধে, দড়ি নামিয়ে দেওয়া হয়েছে খুপরিতে। পদ্মপুকুরের পাঁচু ডোম সাহেবের পাঙ্খবরদার। সাহেব বলে পাঙ্খবালা। পাগলা সাহেব তাকে রোজ মাইনে দেয়, নগদ দশ পয়সা। পৌষ মাঘ, দু মাস তার চাকরি থাকে না। কিন্তু হাত পাতলে পাগলা সাহেব খালি হাতে ফেরায় না। কেবল সন্দেহ হলে, চোখের দিকে তাকায়, বেশি সন্দেহ হলে নাকটা মুখের কাছে নিয়ে আসে। তাড়ি মদ কিছু খেয়ে এসেছে কি না দেখে নেয়। নেশা করা টের পেলে, পাগলা সাহেব পাছায় চাঁটি মেরে ভাগিয়ে দেবে। বলবে, টুমার মাগিকো ভেজ দো, টুমকো পাইসা নেই দেগা।

পাখা ঘরের খুপরির সামনে ইতিমধ্যে ভান্ডার আবির্ভাব হয়েছে। সে শুধু পাঁচুর, কুচকুচে কালো, বড় বড় নখ, শিরওঠা চরণ যুগল দেখতে পাচ্ছে। খুপরির সামনে উটকো হয়ে বসে সে দেখলে পাঁচু গঙ্গার দিকে তাকিয়ে পাখা টানছে। ভান্ডাকে দেখে পাঁচু তার প্রৌঢ় খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখে, সংকুচিত লজ্জায় হাসি ফুটিয়ে বলল, মাইরি, ঘুম শালা শত্ত্বরতা করলে।

ফার্ডিনান্ড নাক কুঁচকে, মুখ বিকৃত করে চাপা গলায় শাসিয়ে বলল, শালা তুম টডি পি-কে আয়া।

পাঁচুর হাসিমুখে, নাকের পাটা দুটি ফুলে উঠল। বলল, মাইরি বলছি ভান্ডা সায়েব, সকাল ঠেঙে এক ফোঁটা পেটে পড়েনিকো। তোমার মুখে তাড়ির গন্ধ, তাই মনে হচ্ছে, সকলেই খেয়েছে।

কথাটা মিথ্যে বলেনি পাঁচু। তাড়ির উপরেও বিলাতি মদ পড়েছে ফার্ডিনান্ডের পেটে। সেই গন্ধই পাঁচুর নাকে গিয়ে, তাকে আরও পিপাসিত করে তুলছে। তার বিগলিত হয়ে ভান্ডাকে এ কথা বলার আরও একটি সুগভীর উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্য, যদি ভান্ডাকে তাকেও এক আধ ফোঁটা পান করায়। এরকম দু-চারবার না হয়েছে, তা নয়। ভান্ডার তো এমনিতেই সর্বত্র অবাধ গতি। ডোমপাড়ায় কুঁড়ের সামনে, মদ খেয়ে সে অনেকদিন চিত্তির খেয়ে পড়ে থেকেছে। মতলব ওর অবিশ্যি কোনওদিনই ভাল নয়। পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে একটু আঁতাত সাঙাত করা। তবে হ্যাঁ, এ কুঠিতেও বিলিতি আরকের স্বাদ পেয়েছে পাঁচু ভান্ডার কল্যাণেই।

পাঁচুর ভাব দেখেই ফার্ডিনান্ড বুঝতে পেরেছে, সে কী চায়। বলল, শালা উল্লু, আভি পাঙ্খ খিচো জোরসে।

বলে সে উঠে দাঁড়াতে গেল। পাঁচু বলল, ও সায়েব তা তো টানছি। কিন্তু আজ এমন ফুর্তির দিনে, বড় বড় বিলেতি সায়েবরা এয়েছেন, খাওন-দাওন হচ্ছে, এটু পেসাদ পাব না?

ফার্ডিনান্ড উঠে দাঁড়াল। পাঁচু তার পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। চলে যেতে যেতে তার গলা শোনা গেল, এখন কাজ কর, বাদে হবে।

ভান্ডা চলে যাবার পর, ঝাঁপ খোলা খুপরির সামনে দিয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে, পাঁচু যন্ত্রের মতো পাখা টানতে লাগল। তার সারা মুখে, খালি গায়ে দরদর ধারায় ঘাম বইছে। ভান্ডার আশ্বাস পাওয়া হাসির রেশ মুখে লেগে রয়েছে এখনও। যদিও তার চোখ চলে গেছে, গঙ্গার ওপারে, ফরাসডাঙার। দিকে। ওপারের কয়েদখানার দালানটা সে গাছের আড়ালে আড়ালে দেখতে পাচ্ছে। উঁচু ভিতের এই কুঠির ঘরের কোনও কথাই জানালা দিয়ে খুপরিতে শুনতে পাওয়া যায় না। পাঁচু কিছু শুনছেও না। ওপারের জেলখানার দিকে তাকালেই ভেতরের চেহারাটা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নীল কুর্তা পরা সেপাইরা লাঠি নিয়ে ঘুরছে, কয়েদিরা কাজ করছে। কত রকমের কাজ, তাঁত বোনে, কাঠ কাটে, ঘানি টেনে তেল নিংড়োয়, বাগানে মাটি কাটে। পাঁচুর ভাগ্যেও তো কবারই খাটনি গেছে। অপরাধ শুধু মাতলামি আর বেয়াদপি। ওরা চোর বলেও শাস্তি দিয়েছে, অথচ চুরি কোনওদিনই পাঁচু করেনি। দলের লোকে টানাটানি করেছে বটে, কোনওদিন যায়নি। বড় বুক ধড়ফড়ায়। এমনিতেই ফরাসডাঙার তুড়ুমের বড় টানাটানি। পা দুখানি কাঠের হাঁড়িকাঠে ঢুকিয়ে দিয়ে, এমন কবজায় কষুনি দেয় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, মনে হয় গোড়ালির কাছ থেকে পায়ের পাতা দুখানি খসে যাবে। গোড়ালির কনুয়ের উপরে এমন কাপটি খেয়ে ধরে, আর হাতল ঘুরিয়ে কষে, পা অসাড় হয়ে যায়। বাপরে মারে কেঁদেও কূল পাওয়া যায় না। মাতলামির সময় মনে ছিল না? রেশম আর কাপড় কিনে যখন পাচার করছিলে, তখন মনে ছিল না? ফরাসডাঙার মদের বোতল যখন দড়িতে বেঁধে, নৌকোর সঙ্গে হালে আটকে জলে ডুবিয়ে আনছিলে, তখন এই তুতুম ঠোকার তুর্কি নাচের কথা মনে হয়নি?

হ্যাঁ, মনে কি থাকে! ঘরসংসার পেট চালাতে কত কী দরকার হয়। এটা এক সাহেবদের দেশ, এটা এক সাহেবদের রাজ্যি। দুই রাজ্যিতে দু রকম আইন, জিনিসপত্রের দামের হেরফের। ওই দেশে এক জিনিস পাওয়া যায়, এ দেশে আর এক জিনিস পাওয়া যায়। পারাপার করতে পারলেই যদি ট্যাঁকে দুটি পয়সা আসে, তবে কি সামলে থাকা যায়। ঘরে যখন হাঁড়িতে জল ফুটছে, দুটো চালের দেখা নেই!

পাঁচুর ধারণা, দেশটা চিরকালই সাহেবদের। তার আগে অবিশ্যি নাকি নবাবদের ছিল। তার নিজের আবার দেশ কী থাকতে পারে, সে জানে না।

পাখা টানতে টানতে এক ভাবনা থেকে আর এক ভাবনায় তার মন চলে যায়। মুখের মধ্যে ঘামের দরানি চলে গেলে, পাঁচ হাত কাপড়খানির একপাশে টেনে, গা মুখ মোছে। অন্যদিকে সকল লজ্জা অনাবৃত হয়ে যায়। হঠাৎ শঙ্কিত হয়ে ওঠে, পাখা ঠিক তেমন জোরে টানা হচ্ছে কি না। চোখে তো দেখতে পায় না। তাড়াতাড়ি হাত বদলায়, আরও জোরে টানে। এক ঘটি জল রাখে কাছে, হাত বাড়িয়ে ঢক ঢক করে গেলে। তবু হাত থামে না।

মনও থামে না। কই, ভান্ডা সায়েব তো আসে না। একটু পেটে পড়লে নতুন জোর পাওয়া যেত।…আচ্ছা, পাগলা সায়েব যদি আর দুটো পয়সা বাড়ায়, তবে রোজ বারো পয়সা হয়। হপ্তায় চালের দামটা উঠে যায় ঘরের সকলের জন্যে। আবার তো নতুন কারখানা হচ্ছে। পাড়া কে পাড়া বিক্রি হয়ে গেল। পাটকলের কোম্পানির সাহেবরা দু হাতে টাকা দিচ্ছে। একটা জমিই নাকি তিনবার বিক্রি হচ্ছে। ডোম পাড়াটাও বিক্রি হয় না। তা হলে পাঁচু, পাঁচুর বউ বেটা বেটিও কয়েকবার তার সাড়ে তিন কাঠা জমি বিক্রি করতে পারে। অন্তত টাকা পনেরো কাঠার দর কি আর দেবে না? ওঃ, অনেক অনেক টাকা। তা হলে তার ডাগর মেয়েটা একটু ঠাটে থেকে মান বাড়াতে পারে। বাপের আয় পয় থাকলে, মেয়ের দাম বাড়ে, তাকে সবাই নিতে চায়। ওদিকে ছেলেটাও ষাঁড়ের মতো হাঁকোড় পাড়ছে, কয়েক গণ্ডা টাকা পণ দিয়ে একটা বউ আনা যায়। আশ্ৰয়টা যাবে? তা যাক। কোম্পানি তো নাকি থাকবার ঘর করে দেবে।

পাঁচু আবার হাত বদলায়, আর বহুবিধ চিন্তায় নানান স্বপ্ন দেখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *