০৬.
কয়েকটা দিন কিকিরা যে কোথায়-কোথায় ঘুরে বেড়ালেন তিনিই জানেন। সকাল-বিকেল দু’বেলাতেই তাঁর টহল চলছিল।
সেদিন তারাপদ আর চন্দন এল বিকেলের দিকে, এসে দেখল, কিকিরা নিজের মনে পেশেন্স খেলছেন। আসলে অভ্যাসবশে খেলছেন, মনে-মনে কিন্তু ভাবছেন কিছু। এটা তাঁর অভ্যাস। ওদের দেখে তাস গুটিয়ে নিলেন কিকিরা।
চন্দন বলল, “কী ব্যাপার, আপনি ঘরে বসে আছেন? রাউন্ডে যাননি? মানে রোদে?”
ঠাট্টা করেই কথাটা বলেছিল চন্দন। তারাপদর মুখে সে শুনেছে, কিকিরা যেন জাল মোহন ধরার জন্য খেপে গিয়েছেন। হরদম ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাইরে। তারাপদ দুদিন এসে, দেখা পায়নি তাঁর, অপেক্ষা করে করে ফিরে গিয়েছে।
কিকিরা বললেন, “না, আজ বেরোইনি; ঘাড়ে রদ্দা খেয়েছি। ব্যথা।”
চন্দন বলল, “মানে? লোচন দত্তর পালোয়ান আপনাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে।”
“না না,” কিকিরা বললেন, “লোচন কেন হবে, এক বেটা ভূত। ট্রাম থেকে নেমেছি, কোত্থেকে একটা ভূত ছুটতে ছুটতে এসে ঘাড়ে পড়ল। তারপর হতভাগা লাফ মেরে চলন্ত ট্রামে উঠে পড়ে চলে গেল।”
“সে কী? আপনি তো ট্রামের চাকার তলায় চলে যেতেন স্যার?”
“নাইন্টি পার্সেন্ট চান্স ছিল। কিন্তু লেগ ব্রেক দিলাম…।”
“লেগ ব্রেক”, চন্দন অবাক-অবাক মুখ করে বলল, “ওটা তো ক্রিকেটের ব্যাপার। আপনি কি ক্রিকেটও খেলেছেন? বোলার ছিলেন?”
মাথা নাড়তে কষ্ট হল কিকিরার, তবু সামান্য মাথা নেড়ে বললেন, “নো সান্ডাল উড, নো। সাহেবদের ওই রাবিশ খেলা আমি কখনো খেলিনি। ওর চেয়ে আমাদের গুপো ডাংগুলি অনেক ভাল। …আমি আমার পায়ের কথা বলছিলাম। লেগটায় ব্রেক মেরে নিজেকে সামলে নিলাম। হাতে লাঠিও ছিল। “
চন্দন হাসতে-হাসতে বলল, “মাঝে-মাঝে আপনার লেগের ব্রেক ফেল করে যায়, এই যা দুঃখ! খানাখন্দে গিয়ে পড়েন।”
কিকিরা বললেন, “ভগবানের রাজ্যে সবই মাঝে-মাঝে ফেল করে হে। লেগও করে হার্টও করে।”
তারাপদ জোরে হেসে উঠল। চন্দনও হেসে ফেলল।
হাসি-তামাশা শেষ হলে তারাপদ বলল, “স্যার, আপনার কথামতন আমি লোচনবাবুর বন্ধু ভবানীর খোঁজ লাগিয়েছিলাম। ক্রিক রোয়ে আমাদের অফিসের বিশ্বাসদা থাকেন। সিনিয়ার লোক। উনি বললেন, ভবানী একটা জুয়াড়ি। চারদিকে দেনা করে বেড়ায়। ওর কথার কোনো দাম নেই। লোচনকেও চেনেন বিশ্বাসদা। দুই বন্ধুতে খুব ভাব। ভবানী বোধ হয় টাকা ধার নেয় লোচনের কাছ থেকে।”
কিকিরা বললেন, “লোচনের পার্টি বলছ! তা হতে পারে।”
“মোহন নামের ভেজাল লোকটা ভবানীকে কেন ধরল বলুন তো?”
“বোধ হয় বন্ধুকে দিয়ে বলালে লোচন আরও তটস্থ হবে–এই জন্যে। আর কী হতে পারে।”
চন্দন বলল, “আপনি কোথায়-কোথায় ঘুরছিলেন? পেলেন কিছু?”
কিকিরা যে এর মধ্যে লোচনের কাছে বার দুই গিয়েছেন–ওরা জানত। দত্তদের প্রেসেও কিকিরা উঁকিঝুঁকি মেরেছেন। মোহনের ফোটোও পেয়েছেন লোচনের কাছ থেকে। এই খবরগুলো তারাপদর জানা ছিল। তারাপদর মুখ। থেকে চন্দনও শুনেছে।
কিকিরা বললেন, “দুটো কাজ করেছি। একটাও অবশ্য পুরোপুরি সারা হয়নি, তবু হয়েছে খানিকটা।”
“যেমন?”
“উকিল এবং নাটক-পাগলা মিহিরবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কথাও হয়েছে অল্পস্বল্প। আগামীকাল আমায় যেতে বলেছেন বাড়িতে। …কাল ওঁর ক্লাবের ছুটি। কোনো কাজ নেই।”
“দ্বিতীয়টা কী?”
“মোহনের সেই বন্ধুর খবর জোগাড় করেছি।”
তারাপদ বলল, “খবর পেয়েছেন?”
“হ্যাঁ। ওর নাম অমলেন্দু। অমলেন্দু গুপ্ত। ডাকনাম–সিতু। লোচন পুরো নামটা বলতে পারেনি। বা চায়নি। বারবার বলেছে, মোহনের ওই বন্ধুটি নতুন। সে ভাল করে চেনে না। সেবারই প্রথম তাদের সঙ্গে গিয়েছিল।”
“আপনি খবর জোগাড় করলেন কেমন করে?”
“ঘুরে-ঘুরে। মোহনের অন্য বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে। অমলেন্দুর বাড়ির ঠিকানা ছিল দমদম চিড়িয়ামোড়। সেখানে সে একাই একটা ঘর ভাড়া করে থাকত। তার মা ছিল বর্ধমানের মানকরে। অমলেন্দু পেশায় ছিল ফোটোগ্রাফার। চাকরিবাকরি করত না। একটা দোকানে মাঝে-মাঝে বসত, আর নিজের ভোলা ছবি বিক্রি করত কাগজে, ম্যাগাজিনে। একা মানুষ, চলে যেত।”
চন্দন বলল, “তা সে দিল্লি চলে গেল কেন?”
“চাকরি পেয়েছিল। একটা ম্যাগাজিনে। ইংরিজি ম্যাগাজিন।”
“এখনো দিল্লিতে?”
কিকিরা মাথা নাড়লেন সাবধানে। “না, দিল্লিতে নেই।”
“কোথায় সে?”
“দিল্লির ঠিকানা যে বন্ধু জানত, সে বলল–মাস কয়েক আগেও অমলেন্দু দিল্লিতে ছিল। চিঠি পেয়েছে তার। তারপর চিঠিপত্র আর পায়নি। খবর নিয়ে জেনেছে দিল্লিতে সে নেই।”
বগলা চা নিয়ে এল।
তারাপদদের চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। বলল, পরে খাবার আনছে।
কিকিরা বললেন, “মোহনের খুবই বন্ধু ছিল অমলেন্দু। সকলেই বলল। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, লোচন দত্ত এই ছোকরার কথা অনেক কিছু চেপে গেল কেন? অমলেন্দুর কথা সে ভালো করেই জানত। জানে। অথচ এমন ভাব করল লোচন, যেন সে ভাল করে চেনেই না অমলেন্দুকে।”
চন্দন বলল, “অমলেন্দু যে দিল্লি চলে গেল–এটা কি সত্যি-সত্যি চাকরি পেয়ে? না, সে সরে গেল?”
“মানে? কী বলতে চাইছ?”
“বলছি, লোচন কি তাকে সরাবার ব্যবস্থা করল? ..যদি করে থাকে, কেন করল?”
কিকিরা বললেন, “সেটাই তো কথা হে! মোহন মারা যাওয়ার পর একজন গেল চা বাগানে, আর-একজন দিল্লিতে। এই দুজনেই বড় সাক্ষী। লোচন না হয় নিজের শ্যালকটিকে সরাল, অমলেন্দুকে সরাল কেমন করে?”।
তারাপদ বলল, “স্যার, লোচন এ-সব করবে কেন? করতে পারে, যদি সে দোষী হয়!”
“তা তো ঠিকই।”
“আপনি তবে বলছেন লোচন দোষী?”
কিকিরা বললেন, “মুখে বললে তো হবে না, প্রমাণ চাই। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, লোচনের মেজো শ্যালক কাজকর্ম তেমন কিছু করত না। লোচন তাকে নিজেদের বাড়ির কাজকর্মে খাটাত। তা শ্যালককে না হয় সে সরিয়ে দিল চা বাগানে। দিতেই পারে। শ্যালক তো তার ভগিনীপতির স্বার্থ দেখবে। কিন্তু অমলেন্দু? এটা আমি বুঝতে পারছি না। সে নিজেই চলে গেল কাজ পেয়ে? না, লোচন তাকে টাকাপয়সা দিয়ে বশ করল?”
চন্দন বলল, “তা আপনার পুরো হিসাবটাই হল, আপনি লোচনকে কালপ্রিট ভাবছেন?”
“হ্যাঁ।”
“যদি সে দোষী না হয়?”
“বলতে পারছি না। লোচনকে আমি সন্দেহ করছি। সে অনেক মিথ্যে কথা বলেছে। বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যানটা লোচনই করেছিল।”
“কে বলল?”
“লোচন নিজেই বলেছে। প্রথমে সে অন্য কথা বলছিল। কথায়-কথায় স্বীকার করে ফেলল, বেড়াতে যাওয়ার কথাটা তার মাথাতেই এসেছিল।”
“জায়গাটাও কি সে বেছে নিয়েছিল?”
“না বোধ হয়। তবে, যেখানেই যাক, তার একটা মতলব থাকতে পারে। সে শুধু সুযোগ খুঁজছিল। কোনোরকমে একটা সুযোগ পেলে সেটা কাজে লাগাবার চেষ্টা করবে।”
“আপনি স্যার, লোচনকে বড় বেশি সন্দেহ করছেন।”
কিকিরা মাথা হেলালেন। বললেন, “করছি, কারণ–মোহন মারা গেলে একমাত্র লোচনেরই লাভ। পুরো বিষয়-সম্পত্তি, ছাপাখানার মালিকানা তার। স্বার্থ তার। সন্দেহ তাকে ছাড়া অন্য কাকে করব?”।
চন্দন বলল, “কিন্তু যদি এমন হয়–এটা সত্যিই দুর্ঘটনা, মোহন অসাবধানে ছিল, পা হড়কে পড়ে গিয়েছে! নিত্যদিন কত অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে, আমরা তার কিছু খোঁজ তো রাখি। সাধারণ ব্যাপার, তবু অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেল।” বলে চন্দন একটু থামল, চা খেল দু চুমুক, তারপর হঠাৎ বলল, “এই যে আপনি ট্রামের চাকার তলায় চলে যাচ্ছিলেন, বরাতজোরে বেঁচে গেলেন, যদি বরাত একটু মন্দ হত–কী অবস্থা দাঁড়াত, স্যার?”
কিকিরা একটু হাসলেন। পকেটে হাত ডুবিয়ে বললেন, “আমার বাড়িতে কে বা কেউ একটা ফ্লাইং লেটার ফেলে গিয়েছে।”
“ফ্লাইং লেটার…!” তারাপদ যেন আকাশ থেকে পড়ল।
“উড়ো চিঠি।” বলতে বলতে পকেট থেকে একটা খাম বের করে এগিয়ে দিলেন তারাপদর দিকে।
তারাপদ হাত বাড়িয়ে খামটা নিল। সাদা খাম। মুখ ছেঁড়া। খামের ওপর কোনো নাম লেখা নেই। খামের মধ্যে একটুকরো কাগজ। তারাপদ কাগজটা বের করল। পড়ল।
“জোরে-জোরে পড়ো।”
তারপদ পড়ল “দাদু, আর নয়। নিজের চরকায় তেল দিন। বাড়াবাড়ি করলে বিপদে পড়বেন। পড়া শেষ করে সে অবাক হয়ে বলল, “এ কী! এ-চিঠি কেমন করে এল? কে দিয়ে গেল?” বলতে বলতে চিঠিটা চন্দনের দিকে এগিয়ে দিল।
কিকিরা বললেন, “আমার ফ্ল্যাটের সদর দরজার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিয়ে গিয়েছে।”
“কে, কবে?”
“কে, তা জানি না। চিঠিটা গতকাল পাওয়া গেছে।”
চন্দন রলল, “এ তো মনে হচ্ছে পাড়ার মস্তান টাইপের ছেলের কাজ। দাদু–আপনাকে দাদু বলেছে।”
কিকিরা মাথার সাদা চুল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে বললেন, “আদর করে বলেছে হে! একমাথা সাদা চুল। তা বলুক। কথাটা হল, আমি কার চরকায় তেল দিচ্ছি–এ-কথা সে জানে কেমন করে? লোচন ছাড়া অন্য যারা জানে তাদের মধ্যে রয়েছেন, অনিলবাবু, সতীশবাবু, প্রফুল্ল-ডাক্তার, তুলসীবাবু। ভবানীকে দেখিনি। আর মিহিরবাবুর সঙ্গে আমার এখনো সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়নি।”
তারাপদ বলল, “আপনার ঠিকানা এরা সবাই জানে?”
“লোচন জানে। আর কাউকে তো ঠিকানা বলিনি।”
“এ কি তবে লোচনের কাজ? সে কোনো ভাড়াটে লোক লাগিয়েছে!” তারাপদ ধাঁধায় পড়ে গেল। তাকাল চন্দনের দিকে। বলল, “ব্যাপারটা বড় অদ্ভুত তো! লোচন নিজেই খবরের কাগজে নোটিস ছাপছে, জাল মোহনকে ধরে দিলে তিরিশ হাজার টাকা পুরস্কার দেবে বলছে, আবার সেই লোকই। কিকিরাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছে। ব্যাপারটা কী! আমি তো কিছুই বুঝছি না।”
চন্দনও বুঝতে পারছিল না। বলল, “যে-লোকটা ট্রাম লাইনের কাছে আপনাকে ধাক্কা মেরেছিল–সে কি এইসবের মধ্যে আছে, কিকিরা?
কিকিরা বললেন, “বলতে পারছি না। লোকটাকে আমি দেখেছি। বাঙালি। তবে উটকো ধরনের। চেহারা দেখে গুণ্ডা বদমাশ মনে হয় না। আহাম্মক মনে হয়।”
“ও বাঙালি, আপনি কেমন করে বুঝলেন?”
“ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছিল। আমি সামলে নেওয়ার পর ও নিজেও সামলে নিল নিজেকে। তারপর “সরি’ বলে ছুটে গিয়ে ট্রামে উঠে পড়ল। “
“সরি কি বাংলা শব্দ, স্যার?”
“আজকাল সবাই সরি বলে। বাজারের মাছঅলারাও। ওর “ছরি’ বলা শুনে বাঙালি মনে হল।”
তারাপদ বলল, “ছেড়ে দিন বাঙালি-অবাঙালি! আদত কথাটা কী তাই বলুন? কী মনে হয় আপনার? এই উড়ো চিঠির মানে কী? লোচন কি আপনাকে নিয়ে খেলা করছে?”
কিকিরা কিছু বললেন না।
চন্দন বলল, “স্যার, আমার পরামর্শ হল–আপনি আর একলা-একলা খোঁড়া পা নিয়ে ঘোরাফেরা করবেন না। সঙ্গে আমাদের রাখবেন। তারাকে সঙ্গে না নিয়ে কোথাও যাবেন না। নেভার।”
কিকিরা বললেন, “কাল একবার মিহিরবাবুর কাছে যাব। তারাপদকে সঙ্গে নিয়েই।”