জ্ঞান ও প্রত্যক্ষণ
অধিকাংশ আধুনিক মানুষ নিশ্চিত বলে ধরে নেয় যে প্রায়োগিক জ্ঞান নির্ভর করে বা জন্ম নেয় প্রত্যক্ষণ থেকে। অবশ্য খুবই ভিন্ন রকমের একটি মত আছে প্লেটো এবং কিছু অন্যান্য ধারার দার্শনিকের মধ্যে, তা হলো : ইন্দ্রিয় থেকে উৎপত্তি হয় এমন কিছুই নেই জ্ঞান হিসেবে অভিহিত হবার যোগ্য এবং ধারণাগুলোর সম্পর্ক রয়েছে। শুধু প্রকৃত জ্ঞানের সঙ্গে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ২ + ২ = ৪ হলো খাঁটি জ্ঞান, কিন্তু তুষার সাদা এই ধরনের বক্তব্য দ্ব্যর্থতা ও অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ, দার্শনিকের সত্যের ভাণ্ডারে যার কোনো স্থান নেই। খুঁজলে, সম্ভবত এই দৃষ্টিভঙ্গিটি পারমিনাইডিস-এ পাওয়া যাবে, কিন্তু এর প্রকাশ্য রূপটির জন্য দর্শনের অঙ্গন ঋণী প্লেটোর কাছে। এই অধ্যায়ে আমি জ্ঞান ও প্রত্যক্ষণ একই জিনিস- এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে প্লেটোর সমালোচনা নিয়ে আলোচনা করব। এটি দখল করে আছে থিয়াটেটাস-এর প্রথমার্ধ।
সংলাপটি জ্ঞান-এর একটি সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া যায় নিয়ে। কিন্তু একটি নেতিবাচক উপসংহারে গিয়ে সেটি শেষ হয়েছে। প্রস্তাব করা হয়েছে অনেক সংজ্ঞার এবং সেগুলো বাতিলও করা হয়েছে। সন্তোষজনক বলে বিবেচনা করা যেতে পারে এমন কোনো সংজ্ঞাই দেয়া হয়নি। প্রস্তাবিত সংজ্ঞাগুলোর প্রথমটি এবং কেবল সেটি নিয়েই আমি আলোচনা করব-থিয়াটেটাসে উপস্থাপিত হয়েছে এইভাবে : আমার মনে হয়, যে ব্যক্তি একটা কিছু জানে, সে তার জানা বস্তুটি প্রত্যক্ষ করেছে এবং বর্তমানে আমি যত দূর দেখতে পাচ্ছি, জ্ঞান প্রত্যক্ষণ ছাড়া আর কিছু নয়। সক্রেটিস এই মতকে প্রোটাগোরাসের সেই মতবাদটির তুল্য বলে গণ্য করেন, যাতে বলা হয় যে, মানুষ সব বস্তুর মাপকাঠি; অর্থাৎ একটি বস্তু আমার কাছে তাই, যেমন ভাবে তা আমার সামনে হাজির থাকে এবং তা তোমার কাছে তাই, যেমনভাবে তা তোমার সামনে হাজির থাকে। সক্রেটিস আরো বলছেন, তাহলে, প্রত্যক্ষণ সর্বদাই এমন কিছু যা আছে এবং জ্ঞান হিসেবে তা অভ্রান্ত, অমোঘ। এর পরে যে তর্কটি এসেছে তার একটি বড় অংশ প্রত্যক্ষণের শ্রেণিকরণ সংক্রান্ত; তারপর যখন একবার তা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, তখন আর এ কথা প্রমাণ করতে দেরি হয় না, প্রত্যক্ষণ বলে যখন কিছু থাকে না তখন জ্ঞান সম্ভব হয় না।
সক্রেটিস প্রোটাগোরাসের মতবাদের সঙ্গে হেরাক্লিটাসের এই মতবাদটি জুড়ে দেন যে, সবকিছুই সর্বদা পরিবর্তিত হচ্ছে; অর্থাৎ সব বস্তু-যেগুলো আছে বলে আমরা আনন্দ পাই-আসলে, হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। প্লেটো ইন্দ্রিয়গ্রাহত্য বস্তুগুলোর বেলায় এই কথা সত্য বলে বিশ্বাস করেন, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানের বিষয়গুলোর বেলায় সত্য বলে মনে করেন না। যাই হোক, সংলাপটির আগাগোড়াই তার ইতিবাচক মতগুলোর পেছনেই পড়ে রয়েছে। জ্ঞানকে প্রত্যক্ষণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার মতবাদের সঙ্গে হেরাক্লিটাসের মতবাদকে-এমনকি তা যদি শুধু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলোর বেলায় প্রযোজ্য হয়-যুক্ত করলে যা পাওয়া যায় তা হলো, জ্ঞান হয় সেই সম্পর্কে, যা হয়ে উঠেছে; যা আছে, তা সম্পর্কে নয়।
খুবই সাদামাটা ধরনের একটি ধাঁধা আছে এই পয়েন্টে। বলা হচ্ছে, যেহেতু ৬ ৪ অপেক্ষা বড় এবং ১২ অপেক্ষা ছোট, সুতরাং ৬ একই সঙ্গে বড় এবং ছোট যা একটি দ্বন্দ্ব। এখন সক্রেটিস অপ্রাপ্তবয়স্ক থিয়াটেটাস-এর চেয়ে লম্বা, কিন্তু অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই সক্রেটিস থিয়াটেটাসের চেয়ে খাটো হয়ে যাবেন। সুতরাং সক্রেটিস একই সঙ্গে লম্বা এবং খাটো। মনে হয় সম্পর্কগত অনুপাত প্লেটোকে ধাঁধায় ফেলে থাকবে, যেমনটা হয়েছে হেগেলসহ বড় বড় দার্শনিকদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে। তবে এই ধাঁধাগুলো তর্কটির জন্য খুব একটি প্রাসঙ্গিক নয় এবং তা এড়িয়ে যাওয়া চলে।
ফিরে আসা থাক প্রত্যক্ষণের কথায়। প্রত্যক্ষণকে বিবেচনা করা হচ্ছে বিষয়বস্তু ও ইন্দ্রিয়ের মধ্যকার আন্তঃক্রিয়ার ফল হিসেবে, হেরাক্লিটাসের মতবাদ অনুযায়ী যে দুটোর উভয়ই সর্বদা পরিবর্তিত হচ্ছে এবং পরিবর্তনের মধ্যে উভয়েই প্রত্যক্ষণলব্ধ ধারণাটিকে বদলে দিচ্ছে। সক্রেটিস মন্তব্য করছেন যে যখন তিনি সুস্থ থাকেন তখন মদ তার কাছে সুস্বাদু মনে হয়, কিন্তু যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন মদ বিস্বাদ লাগে। এখানে প্রত্যক্ষকারীর মধ্যকার পরিবর্তন প্রত্যক্ষণলব্ধ ধারণার পরিবর্তনের কারণ হচ্ছে।
প্রোটাগোরাসের মতবাদের ব্যাপারে কিছু আপত্তি প্রাগ্রসর এবং এসবের কিছু আবার পরবর্তীকালে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। দাবি করা হয়, প্রোটাগোরাসের উচিত ছিল শূকর এবং বেবুনকেও সবকিছুর মাপকাঠি বলে স্বীকার করা, কেননা এই প্রাণীগুলোও প্রত্যক্ষকারী। স্বপ্ন এবং উন্মাদ অবস্থায় মধ্যকার প্রত্যক্ষণের ন্যায্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বলা হচ্ছে, প্রোটাগোরাসের কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে পোটাগোরাস অন্য কোনো লোকের চেয়ে বেশি জানতে পারেন না : প্রোটাগোরাস যে শুধু দেবতাদের মতো জ্ঞানী, তা নন, আরো গুরুতর কথা হলো, তিনি কোনো নির্বোধের চেয়ে বেশি জ্ঞানী নন। তারপর, যদি একজন মানুষের বিচার-বিবেচনা অন্য একজনের মতো সঠিক হয়, তাহলে যেসব লোক মনে কররেন প্রোটাগোরাস ভুল করেছেন, তাহলে তাদের এ রকম মনে করাও সঠিক হবে একই কারণে, যেমন প্রোটাগোরাস করেন।
সক্রেটিস সে মুহূর্তে প্রোটাগোরাসের জায়গায় নিজেকে স্থাপন করে এই আপত্তিগুলোর অনেকগুলোর উত্তর অন্বেষণ করেন। স্বপ্নের ক্ষেত্রে, প্রত্যক্ষণলব্ধ ধারণাগুলো উপলব্ধ বস্তুর মতো সত্য। শূকর আর বেবুনের প্রসঙ্গে তর্কে ব্যাপারটা নাকচ করে করে দেয়া হয় অশ্লীল বাজে কথা বলে। যদি মানুষ সবকিছুর মাপকাঠি হয় তাহলে একজন মানুষ ঠিক আরেকজন মানুষের মতোই জ্ঞানী হবে-এই তর্কের বেলায়, প্রোটাগোরাসের পক্ষ থেকে, সক্রেটিস একটি খুবই মজাদার উত্তর বাতলেছেন, তা হলো, একটি বিবেচনা অন্য একটি বিবেচনা থেকে বেশি সত্য হতে পারে না, কিন্তু একটি অন্যটির চেয়ে শ্রেয়তর হতে পারে, এই অর্থে হতে পারে যে তা থেকে শ্রেয়তর ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। এটা প্রয়োগবাদের প্রস্তাব। তবে এই উত্তর-যদিও সক্রেটিসই তা আবিষ্কার করেছেন-তাকে তুষ্ট করতে পারে না। যেমন-তিনি বেশ জোর দিয়ে বলছেন, যখন একজন ডাক্তার আমার অসুখ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তখন তিনি আসলেই আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি জানেন এবং যখন রাষ্ট্রের জন্য কী সিদ্ধান্ত সুবুদ্ধির কাজ হবে এই নিয়ে জনগণের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়, তখন বিষয়টি থেকে দেখা গেছে যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু মানুষের জ্ঞান অন্যদের চেয়ে বেশি। তাই আমরা এ উপসংহার থেকে বিচ্যুত হতে পারি না যে, একজন জ্ঞানী মানুষ একজন নির্বোধের চেয়ে শ্রেয়তর মাপকাঠি। এইসব কথা এই মতবাদের বিরোধিতা করছে যে, প্রত্যেক মানুষই, সবকিছুর মাপকাঠি এবং কেবলই পরোক্ষভাবে বিরোধিতা করছে যে জ্ঞান মানে প্রত্যক্ষণ। তবে একটি সরাসরি যুক্তি আছে, তা হলো প্রত্যক্ষণের সঙ্গে স্মৃতিকেও নিতে হবে। এটা স্বীকার করা হয়েছে এবং এখানে এসে প্রস্তাবিত সংজ্ঞাটি পরিবর্তিত হয়েছে।
এরপর আমরা হেরাক্লিটাসের মতবাদের সমালোচনায় আসছি। আমরা জানতে পেরেছি, ইসোসের সবচেয়ে বুদ্ধিমান তরুণদের মধ্যে যারা তার শিষ্য ছিল, তাদের চর্চা অনুসারে মতবাদটিকে প্রথমে চরমের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একটি বস্তু পরিবর্তিত হতে পারে দুই উপায়ে, সঞ্চরণ ক্ষমতা দ্বারা এবং তার গুণাবলির পরিবর্তন দ্বারা; আর নিরন্তর পরিবর্তনপরম্পরতার মতবাদটি থেকে এ কথা বলা হয় বলে মনে করা হয় যে, সবকিছুই সর্বদা পরিবর্তিত হচ্ছে উভয় উপায়ে। (মনে হয়, প্লেটো বা ইসোসের গতিময় তরুণদের কেউই খেয়াল করেননি যে চরমপন্থী হেরাক্লিটীয় মতবাদে সঞ্চরণ অসম্ভব। গতি দাবি করে যে একটি নির্দিষ্ট বস্তু ক কখনো এখানে থাকবে, কখনো সেখানে; কিন্তু যখন বস্তুটি স্থান পরিবর্তন করে তখনো তা অবশ্যই একই জিনিস থাকে। যে মতবাদটি নিয়ে প্লেটো ভাবছেন তাতে বস্তুর গুণ এবং স্থানের পরিবর্তন হয়, কিন্তু তার সারাংশের কোনো পরিবর্তন হয় না। এ প্রসঙ্গে প্লেটোর যুগের সবচেয়ে চরমপন্থী হেরাক্লিটাসপন্থীর চেয়ে আধুনিক কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা আরো দূর এগিয়ে গেছে। প্লেটো হয়তো এটাকে বিজ্ঞানের জন্য নিয়তির মতো অনিবার্য মনে করতেন, কিন্তু এটা সে রকম প্রমাণিত হয়নি।) আর সবকিছু যে সর্বদাই কিছু গুণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শুধু তা-ই নয়, বরং সবকিছু সর্বদা তাদের সব গুণাবলি পরিবর্তন করে চলেছে। তাই আমাদের বলা হচ্ছে, চালাক লোকেরা চিন্তা করে ইফেসাসে। এর পরিণতিগুলো বিব্রতকর। আমরা এমন কথা বলতে পারি না এই বস্তুটি সাদা। কারণ, বস্তুটি সাদা ছিল সেই মুহূর্তটিতে যখন আমরা বলা শুরু করি, আর আমাদের বাক্য শেষ হতে হতে সেটি আর সাদা থাকবে না। আমাদের এমন কথা বলা ঠিক হবে না, আমরা একটি বস্তু দেখছি, কারণ দেখা বিরতিহীনভাবে না দেখায় পরিবর্তিত হচ্ছে। যদি সবকিছুই সর্বতোভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে, তাহলে দেখা-কে দেখা না বলে না-দেখাই বলতে হয় এবং প্রত্যক্ষণ-কে প্রত্যক্ষণ না বলে অপ্রত্যক্ষণই বলতে হয়। আর যখন আমরা বলি প্রত্যক্ষণ হলো জ্ঞান, তখন একইভাবে বলতে পারি প্রত্যক্ষণ জ্ঞান নয়।
উপরের যুক্তটির অর্থ যা দাঁড়ায় তা হলো, অবিরাম পরিবর্তন পরম্পরার মধ্যে আর যাই থাকুক না কেন, শব্দাবলির অর্থগুলো অবশ্যই স্থির থাকতে হবে, অন্তত একটি সময়ের জন্য, কেননা তা না হলে কোনো উক্তিই সুস্পষ্ট বা নির্দিষ্ট হয় না, কোনো উক্তিই মিথ্যা বৈ সত্য হয় না। আলোচনা বা জ্ঞান সম্ভব হতে হলে কম- বেশি স্থির একটি কিছু থাকতেই হবে। আমার মনে হয় এটা স্বীকার করে নেয়া উচিত। তবে এই স্বীকৃতির সঙ্গেও বেশ বড় ধরনের পরিবর্তনশীলতা সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই পয়েন্টে এসে পারমিনাইডিস সম্পর্কে আলোচনায় একটি অসম্মতি জানানো হয় এই জন্য যে তিনি অতিমাত্রায় মহান ও বিশাল। তিনি একজন সম্মানিত ও সাংঘাতিক ব্যক্তিত্ব। তার মধ্যে এমন একধরনের গভীরতা ছিল যা আগাগোড়াই মহৎ। তিনি এমন একজন মানুষ যাকে আমি সবার চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করি। এইসব মন্তব্য দ্বারা প্লেটো একটি স্থিতিশীল বিশ্বের প্রতি তার অনুরাগ এবং হেরাক্লিটীয় পরিবর্তনশীলতার তত্ত্বের প্রতি তার ঘৃণা প্রকাশ করছেন, যেটি তিনি মেনে নিয়েছিলেন তর্কের খাতিরে। কিন্তু এই শ্রদ্ধা প্রকাশের পর তিনি হেরাক্লিটাসের বিকল্প হিসেবে পারমিনাইডিসকে বিকশিত করা থেকে বিরত হন।
এখন আমরা জ্ঞানের সঙ্গে প্রত্যক্ষণের অভিন্নতার তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্লেটোর চূড়ান্ত যুক্তিতে পৌঁছুই। তিনি শুরু করছেন এই কথা বলে যে, আমরা প্রত্যক্ষ করি চোখ বা কান দিয়ে নয়, বরং চোখ ও কানের মধ্য দিয়ে এবং তিনি আরো দেখান যে আমাদের কিছু কিছু জ্ঞান কোনো প্রকার ইন্দ্রিয়ের সাথে সম্পর্কিত নয়। যেমন আমরা জানতে পারি যে শব্দ ও রং পরস্পর আলাদা, যদিও কোনো একটি ইন্দ্রিয় উভয়কে প্রত্যক্ষণ করতে পারে না। অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব, সমরূপতা ও ভিন্নরূপতা, অনুরূপতা ও বিভিন্নতা প্রত্যক্ষণের জন্য বিশেষ কোনো ইন্দ্রিয় নেই, ঐক্য এবং সাধারণভাবে সংখ্যাকে। প্রত্যক্ষণের জন্যও তেমন কিছু নেই। একই কথা খাটে শ্রদ্ধেয় ও অশ্রদ্ধেয় এবং ভালো ও মন্দের বেলায়। মন কিছু কিছু জিনিস নিয়ে চিন্তা করে মনের নিজস্ব উপায়ে এবং কিছু কিছু দৈহিক ক্ষমতার মাধ্যমে। আমরা কঠিন ও নরম প্রত্যক্ষ করি স্পর্শের মাধ্যমে, কিন্তু তাদের যে অস্তিত্ব আছে এবং তারা যে পরস্পরের বিপরীত-এই বিচারটি করে মন। শুধু মনই অস্তিত্বকে ধরতে পারে, আর আমরা যদি অস্তিত্বকে ধরতে না পারি তাহলে আমরা সত্যে পৌঁছতে পারি না। অর্থাৎ, আমরা শুধু ইন্দ্রিয়ের মারফতে বস্তুকে জানতে পারি না, কারণ শুধু ইন্দ্রিয়ের মারফতে আমরা জানতে পারি না যে বস্তুর অস্তিত্ব আছে। সুতরাং জ্ঞান অনুভূতিগত প্রতিক্রিয়ার মধ্যে থাকে না, থাকে চিন্তা বা অনুধ্যানের মধ্যে। আর, প্রত্যক্ষণ জ্ঞান নয়, কারণ সত্যকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষণের কোনো ভূমিকা নেই, কেননা অস্তিত্বকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে তার কিছু করার নেই। জ্ঞান আর প্রত্যক্ষণ অভিন্ন-এই মতবাদটির বিরুদ্ধে যে তর্কটি উত্থাপিত হয়েছে তার মধ্যে কী গ্রহণযোগ্য আর কী বাতিলযোগ্য এই সমস্যাটির জট খোলা কোনোভাবেই সহজ নয়। প্লেটোর আলোচনায় তিনটি পরস্পর-সম্পর্কিত তত্ত্ব রয়েছে
(১) জ্ঞান হলো প্রত্যক্ষণ,
(২) মানুষ সবকিছুর মাপকাঠি এবং
(৩) সবকিছুই পরিবর্তনশীল অবস্থায় বিরাজমান
(১) তত্ত্বগুলোর প্রথমটি-শুধু যেটির সঙ্গেই তর্কটি প্রাথমিকভাবে সম্পৃক্ত-রচনাটির শেষ অনুচ্ছেদে ছাড়া অন্য কোথাও তেমন একটি আলোচিত হয়নি। এ সম্পর্কে আমরা একটু আগেই আলোচনা করেছি। রচনাটির শেষ অনুচ্ছেদে দাবি তোলা হচ্ছে যে, তুলনা, অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান এবং সংখ্যার ধারণা জ্ঞানের জন্য অপরিহার্য, কিন্তু এগুলো প্রত্যক্ষণের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে না, কারণ এগুলো কোনো ইন্দ্রিয়ের মারফতে সৃষ্টি হয় না। এগুলো সম্পর্কে যা বলতে হবে তা আলাদা কথা। শুরু করা যাক সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য দিয়ে।
রঙের দুইটি ছায়া যার উভয়টিকেই আমি দেখছি, একই রকম বা ভিন্ন রকম যা-ই হোক না কেন, তা এমন একটি কিছু, যাকে আমি আমার দিক থেকে একটি প্রত্যক্ষণের বস্তু বলে গ্রহণ করতে পারি না, বরং তাকে প্রত্যক্ষণের একটি বিবেচনা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আমি বলব, প্রত্যক্ষণের বস্তু জ্ঞান নয়; নেহাতই এমন কিছু যা ঘটে এবং তা সমানভাবে পদার্থবিদ্যা ও মনস্তত্ত্বের জগতের ব্যাপার। প্লেটোর মতো আমরাও স্বভাবত মনে করি প্রত্যক্ষণ বুঝি একজন প্রত্যক্ষকারী ও প্রত্যক্ষণের বস্তুটির মধ্যকার একটি সম্পর্ক আমরা বলি আমি একটি টেবিল দেখছি। কিন্তু এখানে আমি ও টেবিল হলো যৌক্তিক বিন্যাস। সদ্য ঘটনাবলির মর্মার্থ নেহাতই রঙের কিছু প্রলেপ ও জোড়াতালি মাত্র। এই সব রঙের প্রলেপের সঙ্গে থাকে স্পর্শের ছাপ, এগুলো কথার জন্ম দিতে পারে এবং স্মৃতির উৎস হতে পারে। প্রত্যক্ষণের বস্তু স্পর্শের ছাপ দ্বারা প্রসারিত হলে তা একটি বিষয় হয়ে ওঠে, যা বস্তুগত বলে মনে করা হয়; আর প্রত্যক্ষণের বস্তু কথা ও স্মৃতির দ্বারা বিস্তৃত হলে তা হয়ে ওঠে প্রত্যক্ষণ, যা একটি বিষয়ী অংশ এবং মানসিক বলে বিবেচিত। প্রত্যক্ষণের বস্তু স্রেফ একটা ব্যাপার যা সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়; আর কথা দ্বারা বিস্তৃত প্রত্যক্ষণের বস্তু হলো একটি বিবেচনা, যা সত্য বা মিথ্যা হতে পারে। এই বিবেচনাকে আমি বলি প্রত্যক্ষণের বিবেচনা। জ্ঞান হলো প্রত্যক্ষণ-এই উক্তিটির অর্থ এ রকম বলে বুঝতে হবে যে, জ্ঞান হলো প্রত্যক্ষণের বিবেচনা। কেবল এই আকারেই তা সঠিক বলে ব্যাকরণগতভাবে সিদ্ধ হতে পারে।
ফিরে আসা যাক সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের প্রসঙ্গে। এটা খুবই সম্ভব, যখন আমি দুটি রং সমান্তরালভাবে প্রত্যক্ষ করি, কারণ তাদের সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য তাদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্তের অংশ এবং তা প্রত্যক্ষণের বিবেচনার মধ্য দিয়ে জোরালোভাবে বিবৃত হয়। সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করার জন্য আমাদের কোনো ইন্দ্রিয় নেই-প্লেটোর এই যুক্তি বহিরাবরণকে অস্বীকার করে এবং মনে হয় যেন সব ইন্দ্রিয় দেহের বাইরের পৃষ্ঠে থাকে। সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যকে সম্ভবপর প্রত্যক্ষণজাত উপাত্ত হিসেবে নেয়ার যুক্তিটি এ রকম : মনে করা যাক, আমরা রঙের দুটি ছায়া ক ও খ দেখছি এবং বিবেচনা করছি যে ক খ-এর সদৃশ। তারপর মনে করা যাক-প্লেটো যেমনটি করেন-এইরূপ বিবেচনা সাধারণভাবে সঠিক, আর বিশেষ ক্ষেত্রে, আমাদের বিবেচ্য ঘটনাটির ক্ষেত্রেও সঠিক। তাহলে, সাদৃশ্য আছে বলে শুধু আমাদের বিবেচনাই নয়, ক ও খ-এর মধ্যে সাদৃশ্যের একটি সম্পর্কও রয়েছে। যদি শুধু আমাদের বিবেচনাই থাকত, তাহলে তা হতো একটি অযৌক্তিক বিবেচনা, যার সত্য বা মিথ্যা নিরূপণের ক্ষমতা নেই। কিন্তু যেহেতু সাদৃশ্য স্পষ্টতই সত্য বা মিথ্যা হওয়ার যোগ্য, তাই তা ক ও খ-এর মধ্যে বিদ্যমান এবং তা নেহাত মানসিক একটি কিছু হতে পারে না। ক খ এর সদৃশ-এই বিবেচনাটি ঘটনার গুণে সত্য (যদি তা সত্য হয়), ঠিক তেমনটাই সত্য যেমন ক লাল বা ক গোলাকার-এই বিবেচনাটি। মন রঙের প্রত্যক্ষণের সঙ্গে যতটা জড়িত, তার চেয়ে বেশি জড়িত সাদৃশ্যের প্রত্যক্ষণের সঙ্গে।
এখন আসছি অস্তিত্ব প্রসঙ্গে, যার ওপর প্লেটো বেশ জোর দিয়েছেন। তিনি বলছেন, শব্দ ও রঙের ক্ষেত্রে আমাদের একটি চিন্তা আছে, যাতে দুটোই একসঙ্গে যুক্ত যেমন, শব্দ ও রঙের অস্তিত্ব আছে। সবকিছুই অস্তিত্বের অধিকারী এবং এমন জিনিসেরও অস্তিত্ব আছে যাকে মন নিজে থেকেই-অস্তিত্বের কাছে না পৌঁছেও উপলব্ধি করতে পারে যে, সত্যে পৌঁছা অসম্ভব। এখানে প্লেটোর বিরুদ্ধে যুক্তিটি সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের প্রসঙ্গে যুক্তিটির চেয়ে বেশ আলাদা। এখানে দাবি করা হচ্ছে, অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্লেটো যা কিছু বলেন তার সবই বাজে ব্যাকরণ, বা আরো বাজে বাক্যপ্রকরণ। এই পয়েন্টটি গুরুত্বপূর্ণ, শুধু প্লেটোর ব্যাপারে নয়, দেবতার অস্তিত্বের পক্ষে অনটোলজিক্যাল যুক্তির মতো অন্যান্য ব্যাপারেও গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, আপনি একটি শিশুকে বললেন, সিংহের অস্তিত্ব আছে, কিন্তু ইউনিকর্ন-এর অস্তিত্ব নেই। আপনি আপনার কথাটি প্রমাণ করতে পারেন শিশুটিকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়ে দ্যাখো ওটা একটি সিংহ বলে। আপনি যদি একজন দার্শনিক না হন তাহলে আপনি আরো বলবেন তুমি দেখতে পাচ্ছ যে ওই সিংহটির অস্তিত্ব আছে। যদি আপনি একজন দার্শনিক হন এবং এ কথা বলেন, তাহলে আপনি একটি অর্থহীন উক্তি করলেন। সিংহদের অস্তি ত্ব আছে বলার অর্থ সিংহরা আছে, ক একটি সিংহ-এই উক্তিটি সত্য একটি মানানসই ক-এর জন্য। কিন্তু আমরা সেই মানানসই ক সম্বন্ধে বলতে গিয়ে এ কথা বলতে পারি না যে সেটির অস্তিত্ব আছে : আমরা শুধু পারি একটি সম্পূর্ণ বা অসম্পূর্ণ বর্ণনার ক্ষেত্রে এই ক্রিয়াপদটি প্রয়োগ করতে। সিংহ একটি অসম্পূর্ণ বর্ণনা, কারণ তা অনেক বস্তুর জন্য প্রযোজ্য : চিড়িয়াখানার সবচেয়ে বড় সিংহটি একটি সম্পূর্ণ বর্ণনা, কারণ তা শুধু একটি বস্তুর জন্য প্রযোজ্য।
এখন ধরা যাক, আমি একটা উজ্জ্বল লাল দাগের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি বলতে পারি এটি আমার বর্তমান প্রত্যক্ষণের বস্তু। আমি এও বলতে পারি আমার বর্তমান প্রত্যক্ষণের বস্তুর অস্তিত্ব আছে। কিন্তু আমি একদম বলতে পারি না এটির অস্তিত্ব আছে : কারণ অস্তিত্ব আছে শব্দটি শুধু তখনই তাৎপর্যপূর্ণ, যখন তা প্রয়োগ করা হয় একটি নামের বিপরীতে একটি বর্ণনার বেলায়। এই বক্তব্য অস্তিত্ব সম্পর্কে তর্কের মীমাংসা করে এইভাবে যে অস্তিত্ব বস্তুগুলোর মধ্যেকার এমন একটি জিনিস যা সম্পর্কে মন অবগত আছে।
আমি এখন আসছি সংখ্যার ধারণা প্রসঙ্গে। এখানে দুটি খুব ভিন্ন ভিন্ন রকমের ব্যাপার আছে যা বিবেচনার দাবি করে : একদিকে পাটিগণিতের প্রতিজ্ঞাগুলো, অন্যদিকে গণনার প্রায়োগিক প্রতিজ্ঞাগুলো। ২ + ২ = ৪-এই প্রতিজ্ঞাটি হলো প্রথম ধরনের, আমার দশটি আঙুল আছে-এটি পরবর্তী ধরনের।
আমি প্লেটোর সঙ্গে একমত হয়ে বলব যে পাটিগণিত এবং সাধারণভাবে গণিত-প্রত্যক্ষণ থেকে উদ্ভূত নয়। বিশুদ্ধ গণিত অর্থহীন পুনরাবৃত্তি নিয়ে গঠিত; মানুষ হয় মানুষ-এমন কথার মতো, তবে তা সাধারণত এর চেয়ে বেশি জটিল। একটি গাণিতিক প্রতিজ্ঞা যে সঠিক, এ কথা জানতে আমাদের বিশ্বকে জানবার দরকার নেই, শুধু গাণিতিক চিহ্নগুলোর অর্থ জানলেই চলে। আর আমরা যখন সংজ্ঞা (যার উদ্দেশ্য নেহাত সংক্ষেপকরণ) ছাড়াই চলতে পারি, তখন চিহ্নগুলো অথবা, নয়, সব এবং কিছু এই ধরনের শব্দ হিসেবে পাই, যেগুলো সক্রেটিস শব্দটির মতো বাস্তব জগতের কোনো কিছু নির্দেশ করে না। একটি গাণিতিক সমীকরণ দাবি করে যে চিহ্নগুলোর দুইটি গ্রুপ একই অর্থ বহন করে; এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিজেদের বিশুদ্ধ গণিতের মধ্যে ব্যাপৃত রাখি, এই অর্থ হবে এমন, যা বোঝা যাবে প্রত্যক্ষণের যোগ্য কোনো বস্তু সম্পর্কে কোনো কিছু না জেনেই। সুতরাং গাণিতিক সত্য-প্লেটো যেমনটি মনে করেন-প্রত্যক্ষণ-নিরপেক্ষ; তবে এই সত্য খুবই অদ্ভুত ধরনের এক সত্য এবং তা শুধু চিহ্নাবলির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট।
আমার দশটি আঙুল আছে-এ ধরনের গণনাবিষয়ক প্রতিজ্ঞা খুবই ভিন্ন রকমের একটি ক্যাটাগরি এবং স্পষ্টতই প্রত্যক্ষণের ওপর নির্ভরশীল, অন্তত আংশিকভাবে। আঙুলের ধারণা স্পষ্টতই প্রত্যক্ষণের বিমূর্তায়ন, কিন্তু দশ-এর ধারণা কীভাবে এলো? এখানে আমাদের মনে হতে পারে আমরা একটি প্রকৃত সার্বিক বা প্লেটোনিক ধারণায় পৌঁছে গেছি। আমরা বলতে পারি না দশ প্রত্যক্ষণ থেকে বিমূর্তায়িত হয়ে এসেছে, কেননা কোনো ধরনের বস্তু যাকে দশ হিসেবে দেখা চলে তা সমানভাবে অন্য কোনো রূপেও দেখা চলে। ধরা যাক, আমি একটি হাতের সব আঙুলের একত্রে নাম দিলাম ডিজিটারি। তাহলে আমি বলতে পারি আমার দুইটি ডিজিটারি আছে। এতে প্রত্যক্ষণের সেই একই সত্য বর্ণনা করা হয়, যা আমি আগে দশ সংখ্যাটির সাহায্যে বর্ণনা করেছি এভাবে, আমার দশটি আঙুল আছে-এই উক্তির মধ্যে প্রত্যক্ষণের ভূমিকা ছোট আর কল্পনার ভূমিকা বড়, কিন্তু এটি লাল-এই ধরনের উক্তির মধ্যে তা নয়, এখানে প্রত্যক্ষণের ভূমিকাই বড়। কথা হলো, ওই দুটি উক্তির মধ্যে প্রত্যক্ষণ ও কল্পনার মাত্রাগত পার্থক্য আছে। যেসব প্রতিজ্ঞার মধ্যে দশ শব্দটি থাকে, সেগুলো সম্পর্কে, পূর্ণাঙ্গ উত্তর, অর্থাৎ যখন এই প্রতিজ্ঞাগুলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, তখন দেখা যায় যে সেগুলো দশ শব্দটির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো উপাদান বহন করে না। দশ-এর মতো একটি বড় সংখ্যার ক্ষেত্রে এটা ব্যাখ্যা করা জটিল হবে, তাই এর বদলে বলা যাক, আমার দুইটি হাত আছে। এর অর্থ : এমন একটি ক ও এমন একটি খ আছে যে ক ও খ হুবহু অনুরূপ নয়, আর আছে একটি গ, তার অর্থ যাই হোক একটি কিছু গ হচ্ছে আমার একটি হাত-এ কথা বলা সত্য হবে তখন, এবং কেবল তখনই, যখন গ হয় ক বা গ হয় খ। এখানে দুই শব্দটি নেই। তবে সত্য যে দুটি বর্ণ ক ও গ আছে, কিন্তু তারা কালো বা সাদা বা অন্য কোনো রঙের-এটা জানার চেয়ে তারা দুইটি-এটা জানার বেশি প্রয়োজন আমাদের নেই।
সংখ্যাগুলো একটি বিশেষ অর্থে ফরমাল। যেসব ঘটনা এই বলে বিভিন্ন রকম প্রতিজ্ঞা খতিয়ে দেখে যে, বিভিন্ন রকম প্রতিজ্ঞার প্রত্যেকটির দুটি করে সদস্য আছে, সেগুলোর সবারই সাধারণ একটি রূপ আছে, কোনো উপাদান নেই। এই অর্থে সেগুলো স্ট্যাচু অব লিবার্টি বা চাঁদ বা জর্জ ওয়াশিংটন সম্পর্কে প্রতিজ্ঞাগুলো থেকে আলাদা। এ রকম প্রতিজ্ঞাগুলো দেশ-কালের একটি বিশেষ অংশকে নির্দেশ করে। স্ট্যাচু অব লিবার্টি সম্পর্কে সব প্রতিজ্ঞার মধ্যে দেশ-কালের কথাটাই সাধারণ। কিন্তু দুইটি অমুক অমুক বস্তু আছে-এ রকম প্রতিজ্ঞাগুলোর মধ্যে একটি সাধারণ রূপ ছাড়া আর সাধারণ কিছু নেই। যে প্রতিজ্ঞার মধ্যে লাল আছে, তার অর্থের সঙ্গে লাল-এর সম্পর্ক যতটা না জটিল, তার চেয়ে তা অনেক বেশি জটিল যে প্রতিজ্ঞার মধ্যে দুই আছে তার অর্থের সঙ্গে দুই-এর সম্পর্কটি। একটি অর্থে আমরা বলতে পারি যে দুই চিহ্নটির কোনোই অর্থ নেই, কেননা যখন তা কোনো সত্য উক্তির মধ্যে থাকে, তখন ঐ উক্তির অর্থের মধ্যে কোনো সঙ্গতিপূর্ণ উপাদান থাকে না। যদি চাই, আমরা আরো বলতে পারি, সংখ্যাগুলো শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় ইত্যাদি; কিন্তু আমাদের অবশ্যই এও বলতে হবে যে সংখ্যাগুলো হলো যৌক্তিক কল্পনা।
এরপর আরো একটি পয়েন্ট আছে। শব্দ ও রং সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্লেটো বলছেন, তারা উভয়ে একত্রে দুই এবং তাদের প্রত্যেক হলো এক। আমরা দুই নিয়ে আলোচনা করেছি। এখন আমরা এক নিয়ে আলোচনা করব। অস্তিত্বের প্রসঙ্গটির মতো এখানেও একটি ভুল আছে। এক বিধেয়টি বস্তুগুলোর বেলায় প্রযোজ্য নয়, শুধু একক শ্রেণিগুলোর বেলায় প্রযোজ্য। আমরা বলতে পারি পৃথিবীর একটি উপগ্রহ আছে। কিন্তু, চাঁদটি হয় এক-এ রকম বলা হবে বাক্যপ্রকরণের দিক থেকে ভুল। কেননা এ রকম একটি উক্তি দ্বারা কী বোঝানো যায়? আপনি এও বলতে পারেন চাঁদটি হয় অনেক কারণ চাঁদের অনেকগুলো অংশ আছে। পৃথিবীর একটি উপগ্রহ আছে-এ কথা বলা মানে পৃথিবীর উপগ্রহর ধারণাটিকে একটি গুণ দান করা, যথা এই গুণটি : এমন একটি ক আছে যে, খ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ। এই বাক্যটি সত্য হয় তখনই, কেবল তখনই, যখন খ হয় ক।
এটি একটি জ্যোতির্বিদ্যাগত সত্য, কিন্তু আপনি যদি পৃথিবীর একটি উপগ্রহ-এর বদলে চাঁদ বা অন্য কোনো সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য ব্যবহার করেন, তাহলে তার ফল হবে হয় অর্থহীন বা কেবলই একটি পুনরাবৃত্তি। সুতরাং এক কতিপয় ধারণার একটি গুণ, যেমন দশ আমার আঙুল ধারণাটির একটি গুণ। কিন্তু পৃথিবীর একটা উপগ্রহ আছে, যথা চাঁদ, সুতরাং চাঁদটি হয় এক-এ রকম তর্ক অ্যাপসলরা ছিলেন বারোজন, পিটার একজন অ্যাপসল ছিলেন, সুতরাং পিটার ছিলেন বাবো-এ রকম তর্কের মতোই বাজে তর্ক। তবে বারোর বদলে আমরা যদি সাদা বলি তাহলে তা সিদ্ধ হবে।
উপরের চিন্তা-ভাবনাগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, যেখানে লজিক ও গণিতের মতো ফরমাল ধরনের জ্ঞান থাকে-যা প্রত্যক্ষণ থেকে উদ্ভূত নয়-সেখানে প্লেটোর যুক্তিগুলো অন্যান্য সব জ্ঞানের বিষয়ে বিভ্রান্তিকর। অবশ্য এটা প্রমাণ করে না যে তার সিদ্ধান্তগুলো ভ্রান্ত; তা শুধু এই প্রমাণ করে যে, তিনি তার সিদ্ধান্তকে সত্য মনে করার কোনো বৈধ যুক্তি দেননি।
(২) এখন আসছি প্রোটাগোরাসের অবস্থানটিতে, যেখানে মানুষ সবকিছুর মাপকাঠি-অথবা যেমনটি তা ব্যাখ্যা করা হয়-প্রত্যেক মানুষই সবকিছুর মাপকাঠি। এখানে সাব্যস্ত করা জরুরি যে কোন স্তর থেকে আলোচনাটি অগ্রসর হবে। এটা স্পষ্ট যে, শুরুতেই আমাদের প্রত্যক্ষণের বস্তু ও অনুমানের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। প্রত্যক্ষণের বস্তুগুলোর মধ্যে প্রত্যেক মানুষ অনিবার্যভাবে তার নিজের দেখা বস্তুগুলো দ্বারা পরিবেষ্টিত : অন্যদের প্রত্যক্ষণের বস্তুগুলো সম্বন্ধে সে যা জানে, তা সে জানতে পারে নিজের প্রত্যক্ষণের বস্তুগুলো থেকে অনুমানের দ্বারা, শ্রুতি ও পাঠের মাধ্যমে। স্বপ্নচারী ও পাগলদের প্রত্যক্ষণের বস্তুগুলো প্রত্যক্ষণের বস্তু হিসেবে অন্যদের প্রত্যক্ষণের বস্তুর মতোই; তাদের সম্পর্কে একমাত্র আপত্তিটা হলো যেহেতু তাদের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক, তাই তাদের বিভ্রান্তিকর অনুমান দাঁড় করার ঝোঁক থাকে। কিন্তু অনুমানগুলো কীভাবে আসে? সেগুলো কি সমানভাবে ব্যক্তিগত ও স্বাধীন? এক অর্থে, আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে সেগুলো তাই। আমাকে যা বিশ্বাস করতে হবে, তা আমি বিশ্বাস করব এমন কিছু যুক্তির কারণে, যে যুক্তিগুলো আমাকে আকর্ষণ করে। এটা সত্য যে আমার যুক্তিটি অন্য কারোর উক্তি হতে পারে, কিন্তু সেটা একটি নির্ভুলভাবে যথার্থ যুক্তি হতে পারে, উদাহরণস্বরূপ, যদি আমি সাক্ষ্য-প্রমাণ শুনি এ রকম বিচারক হই। আর যে রকম প্রোটাগোরাসবাদীই আমি হই না কেন, একটি কোনো হিসাবের ব্যাপারে হিসাবরক্ষকের অভিমত আমার নিজের অভিমতের চেয়ে বেশি নির্ভুল বলে গ্রহণ করা যুক্তিসঙ্গত হবে, কেননা, আমি বারবার দেখেছি যে, যদিও আমি প্রথমে তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করি, পরে আরো একটু খেয়াল করলে দেখতে পাব যে হিসাবরক্ষকই সঠিক ছিল। এই বিবেচনায় আমি মেনে নিতে পারি যে অন্য একজন মানুষ আমার চেয়ে বেশি জ্ঞানী হতে পারে। প্রোটাগোরীয় অবস্থান ঠিকমতো ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে যে তা আমি কখনো ভুল করি না এ রকম দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সম্পর্কিত নয় যে, আমার ভুলগুলোর প্রমাণ অবশ্যই আমার দৃষ্টিগোচর হবে। আমার বিগত সত্তা বিবেচিত হতে পারে এমনভাবে, ঠিক যেমনভাবে অন্য একজন মানুষ বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু প্রত্যক্ষণের বস্তুর বিপরীত হিসাবে অনুমানকে বিবেচনা করা বিষয়ে এইসব বক্তব্য থেকে ধরে নেয়া যায় যে, নির্ভুলতার একটি ব্যক্তিনিরপেক্ষ মানদণ্ড আছে। কোনো অনুমান্য আমি ঘটনাক্রমে পেয়েছি-যদি অন্য যেকোনো অনুমানের মতোই সঠিক হয়, তাহলে প্রোটাগোরাসের কাছ থেকে প্লেটোর পাওয়া বুদ্ধিবৃত্তিক নৈরাজ্যই কার্যত চলে আসে। সুতরাং এই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটিতে প্লেটোকে সঠিক বলেই মনে হয়। কিন্তু অভিজ্ঞতাবাদীরা বলবেন যে প্রত্যক্ষণ হলো বাস্তব জিনিস সম্পর্কে অনুমানে নির্ভুলতার পরীক্ষা।
(৩) সার্বিক পরিবর্তনশীলতার মতবাদটি নিয়ে প্লেটো কৌতুক করেছেন, এবং এ কথা মনে করা কঠিন যে, তিনি এটির যে চরম রূপ দিয়েছেন, সেই রূপে কেউ কখনো তা গ্রহণ করেছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, যেসব রং আমরা দেখি সেগুলো অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে। লাল-এর মতো একটি শব্দ রঙের অনেক রকম তারতম্যের মাত্রার জন্য প্রযোজ্য। এবং আমরা যদি বলি আমি লাল দেখছি, আমাদের বলার সময়টা জুড়ে এই কথা সত্য হিসেবে না থাকার কোনো কারণ নেই। প্লেটো তার সিদ্ধান্তে পৌঁছান অবিরাম পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষণ ও অপ্রত্যক্ষণের মতো যৌক্তিক বৈপরীত্য প্রয়োগের মাধ্যমে। তবে এ রকম প্রক্রিয়া বর্ণনার জন্য এ রকম বৈপরীত্য জুতসই নয়। মনে করুন, একটি কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে একজন লোক একটি রাস্তা ধরে আপনার কাছ থেকে দূরে হেঁটে যাচ্ছে : লোকটা ক্রমশ আবছা থেকে আরো আবছা হতে থাকবে এবং এমন একটি মুহূর্ত আসবে যখন আপনি নিশ্চিত হবেন যে আপনি আর লোকটিকে দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু এর মধ্যে সংশয়ের একটি অন্তর্বর্তী সময় আছে। যৌক্তিক বৈপরীত্যগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে আমাদের সুবিধার জন্য, কিন্তু অবিরাম পরিবর্তন একটি পরিমাণগত ব্যবস্থা দাবি করে, যেটির সম্ভাবনা প্লেটো উপেক্ষা করেছেন। তাই, এই বিষয়ে তিনি যা বলেন, তার বেশিরভাগই অপ্রাসঙ্গিক।
এ কথা একই সঙ্গে মানতে হবে যে, কোনো আলোচনাই সম্ভব হতো না যদি না শব্দগুলোর অন্তত স্বল্পমাত্রায় স্থির অর্থ থাকত। অবশ্য এখানে আবার অতিমাত্রায় নিশ্চিত হওয়া সহজ। শব্দগুলো তাদের অর্থ পরিবর্তন করে, উদাহরণস্বরূপ আইডিয়া শব্দটাকে নেয়া যাক। এই শব্দটিকে প্লেটো যে অর্থ দিয়েছেন তার মতো একটি কিছু অর্থ এই শব্দটিকে দিতে আমরা শিখতে পারি শুধুই একটি শিক্ষা প্রক্রিয়ার দ্বারা। এটা অনিবার্য যে শব্দের অর্থাবলির পরিবর্তন শব্দগুলো যেসব পরিবর্তন বর্ণনা করে তার চেয়ে ধীরগতিসম্পন্ন হবে। সম্ভবত লজিক ও গণিতের বিমূর্ত শব্দাবলির বেলায় এ কথা খাটে না, কিন্তু, আমরা যেমনটি দেখেছি, এই শব্দগুলো প্রতিজ্ঞাগুলোর শুধু রূপের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে নয়। এখানে আমরা আবারও দেখতে পাই যে লজিক ও গণিত হলো জ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে অদ্ভুত রকমের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
পিথাগোরাসবাদীদের প্রভাবে গণিতের সঙ্গে অন্যান্য জ্ঞানকে অতিরিক্ত মাত্রায় মিশিয়েছেন প্লটো। তিনি একা নন, বড় বড় দার্শনিকদের অনেকেই এই ভুল করেছেন; তারপরও বলতেই হয়, একটি ভুলই ছিল এটা।