কয়দিন থেকে ছোটাচ্চুর কেমন জানি মন খারাপ। এই বাসার বাচ্চা কাচ্চারা ছোটাচ্চুকে কখনো মন খারাপ করতে দেখেনি, তাই সবাই কেমন জানি অবাক হয়ে গেছে, কী করবে বুঝতে পারছে না। ছোটাচ্চুকে সরাসরি এক-দুইবার জিজ্ঞেসও করা হয়েছে কিন্তু ছোটাচ্চু ঠিক করে উত্তরও দেয়নি। যেমন একদিন ছোটাছু তার বিছানায় পা তুলে গালে হাত দিয়ে বসে আছে, টুনি তার ঘরে ঢুকল। ছোটাচ্চু মাথা ঘুরিয়ে একবার টুনির দিকে তাকাল কিন্তু টুনিকে দেখল বলে মনে হলো না। টুনি ডাকল, “ছোটাচ্চু।”
ছোটাচ্চু উত্তর দিল না। টুনি তখন আবার ডাকল, “ছোটাচ্চু।” এবারে আগের থেকে একটু জোরে।
ছোটাচ্চু এবারে উত্তর দিল। বলল, “উঁ।” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “কে? টুনি?”যেন তাকে প্রথম দেখছে।
টুনি মাথা নাড়ল, তারপর ছোটাচ্চুর কাছে গিয়ে বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার কী হয়েছে?”
“আমার?” ছোটাচ্চু জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “আমার কী হবে? কিছু হয় নাই।”
“তাহলে তুমি কথা-টথা বলো না কেন?”
“কে বলে কথা বলি নাই? এই যে বলছি!”
“আগে প্রত্যেক দিন এসে তোমার অফিসে কী হচ্ছে সেগুলো বলতে, এখন কিছু বলো না।”
“কেন? আমি সেদিন বললাম না অফিসে কী হয়েছে। একটা খুব বড় ক্লায়েন্ট এসেছে, ওরা ভেবেছে চাঁদাবাজ”
টুনি মাথা নাড়ল, “না ছোটাচ্চু তুমি সেটা বলো নাই। চাঁদাবাজ ভেবে কী করেছে সেটা বলো নাই।”
ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “বলেছি।”
টুনি তার মুখ আরো শক্ত করে বলল, “বলো নাই।”
ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর ফোঁস করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ও আচ্ছা। বলি নাই!”
টুনি বলল, “তাহলে বলো কী হয়েছে।”
ছোটাচ্চু ঘ্যাসঘ্যাস করে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, “তুই তো আমাদের অফিসটা দেখেছিস। রিসেপশনে রঞ্জনা বসে আছে, তখন চ্যাংড়া মতো একটা মানুষ ঢুকেছে–দেখে মনে হয় লাফাংঙা ফালতু মানুষ। রঞ্জনা বলল-” ছোটাচ্চু হঠাৎ কথা থামিয়ে ছাদের দিকে তাকাল, তারপর তাকিয়েই রইল।
টুনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে থেকে জিজ্ঞেস করল, “কী বলল?”
ছোটাচ্চু ছাদ থেকে চোখ ফিরিয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বলল?”
“হ্যাঁ। রঞ্জনা আপু কী বলল?”
ছোটাচ্চু আবার ঘ্যাসঘাস করে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, “আজকে বলার ইচ্ছা করছে না। আরেক দিন বলব।”
টুনি কিছুক্ষণ ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “ছোটাচ্চু।”
“উঁ।“
“তোমার কী হয়েছে বলবে?”
“কিছু হয় নাই।”
“হয়েছে ছোট চাচ্চু। আমাকে বললো।”
“কিছু হয় নাই।”
“হয়েছে।”
ছোটাচ্চু বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই বড় বিরক্ত করছিস টুনি। এখন যা দেখি।”
ছোটাচ্চু সব সময় বাসার বাচ্চাদের ধমকা-ধমকি দেয়, বকাবকি করে, এমনকি মাঝে মাঝে ঘাড়ে ধরে ঝাঁকুনিও দেয়–কেউ কিছু মনে করে না। কিন্তু হঠাৎ করে আজকে ছোটাচ্চুর গলার স্বর শুনে টুনি কেমন যেন চমকে উঠল, সে আর কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
সেদিন রাত্রি বেলা বাচ্চারা সবাই একটা গোলটেবিল বৈঠকে বসেছে। সরাই যে একটা গোলটেবিল ঘিরে বসেছে তা নয়–সত্যি কথা বলতে কী, তারা যেখানে বসেছে সেখানে কোনো টেবিলই নেই, সবাই মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসেছে। তারপরেও এটাকে রীতিমতো গোলটেবিল বৈঠক বলা যায়। আলোচ্য বিষয় ‘ছোটাচ্চু’। সত্যিকারের গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতি থাকে, সবাইকে তার কথা শুনতে হয়–এখানে সেরকম কেউ নেই। বাচ্চারা সবাই একসাথে কথা বলে, যার গলা সবচেয়ে উপরে ওঠে সবাইকে তার কথা শুনতে হয়।
এটা মোটেও অবাক ব্যাপার না যে শান্তর গলা সবচেয়ে বেশি উপরে ওঠে, সে গলা উঁচিয়ে বলল, “পুরাপুরি ঘিংরি-ভিংরি।”
একজন জানতে চাইল, “ঘিংরি-ভিংবিমানে কী?”
শান্ত বলল, “মানে আউলা-ঝাউলা”
প্রমি ধমক দিয়ে বলল, “ঢং না করে কী বলতে চাস পরিষ্কার করে বল।”
শান্ত বলল, “আমি বলতে চাচ্ছি ছোটাচ্চুর কথা। ছোটাচ্চু পুরাপুরি ঘিংরি-ভিংরি। আউলা-ঝাউলা হয়ে গেছে।”
টুম্পা বলল, “ছোটাচ্চু এত সুইট ছিল, এখন কথা বলে না। মুখ ভোঁতা করে থাকে।”
একজন বলল, “খায় না।”
আরেকজন বলল, “না, না, অনেক বেশি খায়। কী খাচ্ছে জানে না–খেতেই থাকে, খেতেই থাকে। পেটের উপর একটা ত্যানা রাখলে ত্যানাটাও খেয়ে ফেলবে।”
আরেকজন বলল, “শেভ করে না। মুখে বিন্দি বিন্দি দাড়ি।”
আরেকজন বলল, “কিন্তু শেভ না করাটা এখন স্টাইল। সব নায়কদের মুখে এখন বিন্দি বিন্দি দাড়ি থাকে।”
আরেকজন বলল, “কিন্তু ছোটাচ্চুর দাড়ি স্টাইলের দাড়ি না। এইটা আউলা-ঝাউলা দাড়ি।”
ছোট একজন বলল, “সেই দিন এত বড় একটা মাকড়সা দেখেও চিৎকার করে নাই।”
সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল, “চিৎকার করে নাই?”
“না।”
“লাফ দেয় নাই? বাবারে বলে নাই? মাইয়ারে বলে নাই?”
ছোটজন বলল, “না, খালি মুখটা বাঁকা করে সরে গেছে।”
“কী সর্বনাশ! শান্ত বলল, “বলেছি না আমি, পুরা ঘিংরি-ভিংরি।”
প্রমি বলল, “আসল কথাটাই তো এখনো বলি নাই।”
সবাই জানতে চাইল, “আসল কথাটা কী?”
“সেই দিন ছোটাচ্চুর ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, তখন শুনি–”
“কী শুনো?”
“ছোটাচ্চু রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনছে।”
“সর্বনাশ। কোনটা শুনছে?”
“সবচেয়ে ডেঞ্জারাসটা, জেনেশুনে বিষ খাওয়ারটা!”
বাচ্চাদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ পড়ল। এটা মোটেও তাদের পরিচিত ছোটাচ্চু না। তাদের পরিচিত ছোটাচ্চু বেশিরভাগ সময় ইংরেজি গান শুনে। মাকড়সা দেখলে ‘বাবারে, খায়া ফেলল রে’ বলে চিৎকার করে লাফ দিয়ে সরে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে থাকে। তাদের ছোটাচ্চু উষ্কখুষ্ক চুল নিয়ে ঘরে বসে থাকে না। তাদের পরিচিত ছোটাচ্চুর মুখে আউলা-ঝাউলা বিন্দি বিন্দি দাড়ি থাকে না। তাদের পরিচিত ছোটাচ্চুর কিছু একটা হয়েছে, তারপর অন্য রকম ছোটাচ্চু হয়ে গেছে।
একজন জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু ছোটাচ্চুর কী হয়েছে?”
“ভাইরাস!” টুম্পা বলল, “আমি পড়েছি ভাইরাস দিয়ে এগুলো হয়?”
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “কোথায় পড়েছিস?”
টুম্পা বলল, “আমাদের স্কুলের বাথরুমের দেওয়ালে একজন লিখেছে।”
আরেকজন বলল, “স্কুলের বাথরুমে শুধু খারাপ খারাপ কথা লিখে।”
টুম্পা বলল, “মাঝে মাঝে ভালো কথাও লিখে।”
প্রমি বলল, “স্কুলের বাথরুমে লেখা জিনিস বিশ্বাস করার কোনো দরকার নাই। মন খারাপ হওয়ার ভাইরাস থাকতেও পারে। আমি জানি না।”
আরেকজন বলল, “সোজা চিকিৎসা। এন্টিবায়োটিক্স।”
প্রমি বলল, “এন্টিবায়োটিক্স ব্যাকটেরিয়ার জন্য। এটা দিয়ে ভাইরাস দূর করা যায় না।”
কে জানি গর্জন করে উঠল, “যায়।”
প্রমি বলল, “যায় না।”
তারপর ঝগড়া লেগে গেল, ঝগড়াটা থামাল শান্ত, কারণ সে গলা উচিয়ে বলল, “আসলে ছোটাচ্চুর কী হয়েছে বুঝতে পারছিস না?”
সবাই ঝগড়া থামিয়ে শান্তর দিকে তাকাল, “কী হয়েছে?”
শান্ত মুখ গম্ভীর করে বলল, “জীলে ধরেছে।”
“জীন?”
ও “হ্যাঁ। ছোটাচ্চু বাসায় আসতে অনেক দেরি করে না?”
“তাতে কী হয়েছে?”
“রাস্তার মোড়ে একটা গাব গাছ আছে। অনেক রাত্রে ছোটাচ্চু যখন সেই গাব গাছের নিচে দিয়ে আসে তখন একদিন জীন ধরেছে।”
একজন আপত্তি করল, “ঐটা মোটেও গাব গাছ না। ঐটা আম গাছ।”
শান্ত বলল, “একই কথা।”
“একই কথা না।”
তখন আবার ঝগড়া লেগে গেল, তখন ঝগড়া থামাল গুড়ু। সে রিনরিনে গলায় বলল, “ছেলেদেরকে জীনে ধরে না। মেয়েদেরকে জীনে ধরে। ছেলেদেরকে ধরে পরী।”
শান্ত মেঘস্বরে বলল, “তোকে কে বলেছে?”
“ঝুমু খালা।”
এসব বিষয়ে ঝুমু খালার থেকে বড় এক্সপার্ট পৃথিবীতে নেই। তাই সবাইকে মেনে নিতেই হলো যে ছোটাচ্চুকে জীনে ধরেনি, কিছু একটা ধরে থাকলে সেটা নিশ্চয়ই পরী। শান্ত পর্যন্ত মেনে নিল, বলল, “ঠিক আছে। তাহলে পরী ধরেছে।”
একজন জানতে চাইল, “পরী ধরলে কী করতে হয়?”
“তাবিজ দিতে হয়।”
“তাবিজ কোথায় পাব?”
“আসল সোলেমানী জাদু নামে একটা বই আছে। সেই বইয়ে সব রকম তাবিজ আছে। জীন-ভূত দূর করার তাবিজ। বউ বশ করার তাবিজ। বিছানায় পিশাব বন্ধ করার তাবিজ। অদৃশ্য হওয়ার তাবিজ।”
অনেকেই চোখ বড় বড় করে বলল, “অদৃশ্য হওয়ার তাবিজ আছে?”
“আছে। খুবই জটিল।”
হঠাৎ করে ছোটাচ্চুর সমস্যা থেকে আলোচনাটা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার দিকে ঘুরে গেল। প্রমি তখন সবাইকে ধমক দিয়ে আলোচনাটা আবার আগের লাইনে নিয়ে আসে। সে বলল, “আমার মনে হয় না ছোটাচ্চুকে জীন-পরীতে ধরেছে। কিছু একটা হয়েছে সেই জন্যে ছোটাচ্চুর মন খারাপ।”
একজন বলল, “ছোটাচ্চুর এখন মন খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নাই। ছোটাচ্চুর প্রাণের বন্ধু হচ্ছে মাহী কাঞ্চন। সব কনসার্টে মাহী কাঞ্চন ছোটাচ্চুকে নিয়ে যায়। আগে বড় মানুষেরা ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি নিয়ে ঠাট্টা করত। এখন করে না। এখন ছোটাচ্চুর নিজের অফিস আছে। দুইজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিটেকটিভ রেখেছে। বড় বড় লোকজন ছোটাচ্চুর কাছে বুদ্ধি নিতে আসে। ছোটাচ্চুকে তিনবার টেলিভিশনে দেখিয়েছে–”
একজন প্রতিবাদ করল, “চারবার–“
“তিনবার।”
“চারবার–একবার সাইড থেকে–”
এটা নিয়েও ঝগড়া শুরু হতে পারত কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঝগড়া হলো, কারণ সবাই মাথা নেড়ে স্বীকার করল ছোটাচ্চুর মন খারাপ থাকার কোনো কারণ নেই। গুচ্ছ মনে করিয়ে দিল ছোটাফ্লু এর মাঝে দুইবার তাদেরকে চায়নিজ আর একবার পিতজা খাওয়াতে নিয়ে গেছে।
আরেকজন বলল, “ডিসেম্বর মাসে কক্সবাজার নিয়ে যাবে।”
আরেকজন বলল, “জাল নোটের কেসটা শেষ করলে একটা গাড়ি কিনবে বলেছে–”
অন্যদেরও কিছু না বলার ছিল কিন্তু প্রমি হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “সব ঠিক আছে। ছোটাচ্চুর খুবই ভালো অবস্থা, তার মন খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নাই। কিন্তু সত্যি কথাটা হচ্ছে, ছোটাচ্চুর মন খারাপ কেন? কেন ছোটাচ্চুর মন খারাপ? কী নিয়ে মন খারাপ?”
সবাই এবার চুপ করে গেল, তারপর সবাই আস্তে আস্তে টুনির দিকে তাকাল। এতক্ষণ সবাই কিছু না কিছু বলেছে, শুধু টুনি একটা কথাও বলেনি। সবাই জানে এই বাস্ময় ছোটাচ্চুর সাথে সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক টুনির, কখনো ভালো কখনো খারাপ কিন্তু কোনো একটা সম্পর্ক যে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। সবাই টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। টুনি কিছু বলল নাউখন শান্ত জিজ্ঞেস করল, “টুনি, তুই কি কিছু জানিস, ছোটাচ্চুর কী হয়েছে?”
টুনি বলল, “উঁহু আমি জানি না। কিন্তু—
“কিন্তু কী?”
“অনুমান করতে পারি।”
একসাথে সবাই জিজ্ঞেস করল, “কী অনুমান করতে পারিস?”
টুনি তার চশমাটা নাকের উপর ঠিক করে বসিয়ে বলল, “আমার মনে হয় ছোটাচ্চুর সাথে ফারিহাপুর ব্রেক-আপ হয়ে গেছে।”
“কী হয়ে গেছে?”
“ব্রেক-আপ। ছাড়াছাড়ি। সেই জন্যে ছোটাচ্চুর মন খারাপ।”
“ছাড়াছাড়ি?” টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “বিয়ে করলে না ছাড়াছাড়ি হয়। তাদের তো বিয়ে হয় নাই।”
প্রমি টুম্পাকে বলল, “তুই ছোট, তুই এসব বুঝবি না।”
শান্ত বলল, “ব্রেক-আপ হয়েছে তো কী হয়েছে? আবার ফিক্স-আপ হয়ে যাবে। আর না হলে সমস্যা কী? দুনিয়াতে কি আপুদের অভাব আছে? ফারিহাপু চলে গেলে মালিহাপু আসবে। মালিহাপু চলে গেলে সাবিহাপু আসবে। সাবিহাপু চলে গেলে—”
প্রমি চোখে আগুন বের করে শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল, “চুপ কর গাধা কোথাকার। তুই ব্যাটা ছেলে মানুষ, তুই এগুলো বুঝবি না।” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “টুনি, তুই সত্যিই মনে করছিস ফারিহাপুর সাথে ছোটাচ্চুর ব্রেক-আপ হয়ে গেছে?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “আমি ঠিক জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় এইটাই কারণ।”
“তুই ঠিক জানিস?”
“না, কিন্তু বের করার জন্যে চেষ্টা করতে পারি।
সবাই তখন হইহই করে বলল, “এটা বের করো, এটা বের করো।” কাজেই গোলটেবিল বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো টুনি ছোটাচ্চুর কাছ থেকে বের করে আনবে ফারিহাপুর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়াটাই ছোটাচ্চুর মন খারাপের কারণ কি না।
.
পরদিন সকালেই টুনি ছোটার ঘরে হাজির হলো। ছোটাচ্চু বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে, পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে পা দুটো উঁচু করে রেখেছে। কোলে একটা মোটা বই, উঁকি দিয়ে বইয়ের নামটা পড়ার চেষ্টা করল, পড়তে পারল না, মনে হলো কঠিন জ্ঞানের একটা বই। মাথার কাছে ল্যাপটপে একটা গান বাজছে খুবই করুণ স্বরে। সেখানে একজন গান গাইছে, ‘এই জীবন রেখে কী হবে মরে গেলেই ভালো’ সেই রকম একটা গান।
টুনি দরজায় দাঁড়িয়ে একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে ভিতরে ঢুকে খুবই হাসি-খুশি গলায় ডাকল, “ছোটাচ্চু!”
ছোটাচ্চু একটু চমকে উঠে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “কে? টুনি?”
কিছুই যেন হয়নি, সবকিছু যেন ভালোভাবে চলছে সেরকম ভান করে টুনি ছোটাচ্চুর বিছানার দিকে এগিয়ে গেল, বলল, “কী হয়েছে জানো ছোটাচ্চু?”
ছোটাচ্চুর মুখ দেখে বোঝা গেল কী হয়েছে। সেটা নিয়ে ছোটাচ্চুর এতটুকু আগ্রহ নাই, মাছের মতো গোল গোল চোখ করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল।
টুনি তার গলার মাঝে অনেকখানি উত্তেজনা নিয়ে বলল, “টুম্পার ছেলের সাথে রিংকুর মেয়ের বিয়ে।”
টুম্পার বয়স দশ রিংকুর আট, তাই তাদের ছেলে এবং মেয়ের বিয়ের খবরটি শুনে ছোটাচ্চুর ভুরু কুঁচকানো উচিত ছিল। ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকাল না, কথাটা মেনে নিয়ে বলল, “ও।” তারপর আবার বইটার দিকে তাকাল, পড়ার ভান করতে লাগল।
টুনি হাল ছাড়ল না, বলল, “টুম্পার ছেলে মানে বুঝেছ তো? টুম্পার একটা ছেলে পুতুল আছে, নাম রাজা।”
ছোটাচ্চু বলল, “ও।”
টুনি বলল, “রিংকুর মেয়ে পুতুল। নাম কী জানো?”
যে কোনো মানুষের বলা উচিত “রানি।” ছোটাচ্চু কিছু না বলে মাছের মতো তাকিয়ে রইল। টুনি নিজেই বলল, “বিনু।”
ছোটাচ্চু বলল, “ও।”
টুনি বলল, “ফ্যামিলির প্রথম বিয়ে সেই জন্যে সবার খুব উৎসাহ। প্রথমে পান-চিনি তারপর গায়ে হলুদ। তারপর আকত–সবার ইচ্ছা যে তুমি হবে উকিল বাবা।”
অন্য যে কোনো সময় হলে ছোটাচ্চু উকিল বাবা হওয়া কিংবা না হওয়া নিয়ে অনেক রকম কথা বলত, আজকে কিছুই বলল না। মাছের মতো চোখ করে তাকিয়ে রইল। টুনি তবু হাল ছাড়ল না, বলল, “বিয়েতে কাকে কাকে দাওয়াত দিব সেটার লিস্ট করেছে। বাইরে থেকে কাকে কাকে দাওয়াত দিবে জানো?”
ছোটাচ্চু জানার কোনো আগ্রহ দেখাল না, চোখের পাতি না ফেলে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। টুনি মুখে একটা সরল ভাব ধরে রেখে বলল, “বাইরে থেকে দাওয়াত দিবে ফারিহাপুকে—”
ছোটাচ্চু একেবারে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো করে চমকে উঠল, প্রথমবার চোখের পাতি ফেলল, পিটপিট করে বলল, “কী বললি?”
“আর মনে করো শায়কা খালাকে দাওয়াত দিতে পারি–”
“আগে কার নাম বলেছিস?”
টুনি কিছুই বুঝে না এরকম ভান করে বলল, “কেন? ফারিহাপু।” ছোটাচ্চু বলল, “ফা-ফা-ফা–”
“হ্যাঁ। ফারিহাপু।”
ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ মুখ হাঁ করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, টুনি একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “কোনো সমস্যা ছোটাচ্চু?”
ছোটাচ্চু খুব জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, না, কোনো সমস্যা নাই।” তারপর হঠাৎ করে মাথা নাড়ানো থামিয়ে বলল, “ফারিহা?”
“হ্যাঁ। তুমি কি ফারিহাপুকে একটু বলে দেবে?”
ছোটাচ্চু কেমন যেন লাফ দিয়ে উঠল, বলল, “আমি?”
“হ্যাঁ। তুমি ছাড়া আর কে বলবে?”
ছোটাচ্চুর মুখ দেখে মনে হলো ছোটাচ্চু এখনো বুঝি পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারে নাই, আবার বলল, “আমি?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। তুমি।” টুনি এদিক-সেদিক তাকাল, বিছানার উপর ছোটাচ্চুর মোবাইল ফোনটা ছিল, সেটা হাতে নিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও ছোটাচ্চু। ফারিহাপুকে একটা ফোন করো।”
ছোটাচ্চু আবার বসে থেকে একটা ছোট লাফ দিল, বলল, “ফোন করব? আমি? এখন?”
“হ্যাঁ। সমস্যা কী?”
“কিন্তু কিন্তু কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
ছোটাচ্চু বিশাল একটা নিঃশ্বাস ফেলে ছাদের দিকে তাকাল তারপর বলল, “আমি পারব না।”
“তুমি পারবে না?”
“না।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন পারবে না ছোটাচ্চু?”
“ফারিহার সাথে আমার ব্রেক-আপ হয়ে গেছে।”
ছোটাচ্চু কী বলেছে বুঝতে টুনির কোনো সমস্যা হলো না কিন্তু তারপরেও জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“ব্রেক-আপ। ফারিহার সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক নাই। নো কানেকশান। নাথিং।”
টুনি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ছোটাচ্চু।”
ছোটাচ্চু বলল, “উঁ।”
“কে ব্রেক-আপ করেছে? তুমি না ফারিহাপু?”
ছোটাচ্চু টুনির দিকে কেমন জানি ঘোলা চোখে তাকাল, তারপরে বলল, “কীভাবে কীভাবে জানি হয়ে গেল। আমি একটু বলেছি তারপর ফারিহা তারপর আবার আমি। মাথা গরম করে তখন আবার ফারিহা বলল, বাংলা সাহিত্যে এখনো উত্তর আধুনিক কবিতা লেখা হয় নাই। আমি বললাম হয়েছে—”
“কী কবিতা?”
“উত্তর আধুনিক মানে পোস্ট মডার্ন।“
“তুমি কী বললে?”
“আমি বলেছি অবশ্যই হয়েছে। ফারিহা বলেছে হয় নাই। বলেছে এইগুলো ইউরোপিয়ান ঢং ছোটাচ্চুর নাকটা কেমন যেন ফুলে উঠল, বলল, “ফারিহার কত বড় অডাসিটি।”
“কী সিটি?”
“অডাসিটি। মানে দুঃসাহস। কত বড় দুঃসাহস সে এই দেশের পোস্ট মডার্ন মুভমেন্টকে অস্বীকার করে–” ছোটাচ্চু তার নাক ফুলিয়ে মডার্ন পোস্ট মডার্ন-এর পার্থক্য নিয়ে কথা বলতে লাগল। টুনি কিছু বুঝল, বেশিরভাগই বুঝল না। ধৈর্য ধরে কথাগুলো শুনল, তারপর বলল, “ছোটাচ্চু।”
ছোটাচ্চু বলল, “উঁ।”
“তুমি মডার্ন পোস্ট মডার্ন নিয়ে ঝগড়া করে ফারিহাপুর সাথে ব্রেক-আপ করেছ? তোমার মাথার মাঝে ঘিলু বলে কিছু নাই।”
“কী বললি?”
“আমি বলেছি তুমি হচ্ছ চূড়ান্ত বোকা। ফারিহাপুর মতো সুইট মেয়ে দুনিয়াতে আছে? ফারিহাপুর মতো স্মার্ট মেয়ে দুনিয়াতে আছে? ফারিহাপুর সাথে এক মিনিট কথা বললে আমাদের মন ভালো হয়ে যায়। আর তুমি ফারিহাপুর সাথে মডার্ন পচা মডার্ন নিয়ে ঝগড়া করো–”
“পচা মডার্ন না। পোস্ট মডার্ন।”
“একই কথা।”
ছোটাচ্চু গর্জন করে বলল, “এক কথা না।”
টুনি ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন তুমি এটা নিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করবে?”
ছোটাচ্চু কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল। একটু আঁ-উ করে থেমে গেল। টুনি থমথমে গলায় বলল, “ছোটাচ্চু।”
‘কী?”
“তোমাকে একটা কথা বলি?”
“বল।”
“তুমি এক্ষুনি ফারিহাপুর কাছে গিয়ে বলো তোমার ভুল হয়ে গেছে! আর কখনো তুমি ঝগড়া করবে না।”
ছোটাচ্চু গর্জন করে উঠল, বলল, ”নেভার। তুই জানিস ফারিহা আমাকে কী বলেছে? বলেছে আমি নাকি ব্রেন ডেড। কত বড় সাহস!”
টুনি ছোটাচ্চুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “ছোটাচ্চু। মানুষ রাগের মাথায় অনেক কিছু বলে, তুমি সব সময় রেগেমেগে আমাদের একশ’ একটা গালি দাও। তাই রাগ করে কী বলে সেইটা শুনতে হয় না। আর দুই নম্বর কথা হচ্ছে, ফারিহাপু তোমাকে যদি ব্রেন ডেড বলে থাকে ঠিকই বলেছে। তুমি আসলেই ব্রেন ডেড। তা না হলে কেউ কখনো ফারিহাপুর মতোন এরকম ফাটাফাটি একটা মেয়ের সাথে ঝগড়া করতে পারে? পারে না।”
ছোটাচ্চু গরম হয়ে বলল, “দেখ টুনি। ভালো হবে না কিন্তু টুনি টের পেল ছোটাচ্চুর গলায় বেশি জোর নেই, তাই কথা থামাল, বলল, “ফারিহাপুর সাথে ব্রেক-আপ করে তোমার কী লাভ হয়েছে? তোমার খাওয়া নাই, ঘুম নাই, তোমার চোখের নিচে কালি, তোমার মুখে বিন্দি বিন্দি দাড়ি, তোমার চুল আউলা-ঝাউলা-তুমি অফিসে যাও না, তোমার কাজকর্ম বন্ধ! আমাদের সবাই মিলে তোমাকে চোখে চোখে রাখতে হয় কখন তুমি সুইসাইড করে ফেলো–”
টুনির শেষ কথাটা অবশ্যি সত্য নয়, ছোটাচ্চু সুইসাইড করে ফেলবে সেটা তারা কখনো ভাবেনি। তারা সবাই মিলে ছোটাছুকে চোখে চোখে রাখছে সেটাও ঠিক না। কিন্তু কথা বলার সময় একটু বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বলতে হয়, তা না হলে কথার মাঝে জোর হয় না।
টুনি ভেবেছিল ছোটাচ্চু আপত্তি করে কিছু একটা বলবে কিন্তু কিছু বলল না, ছাদের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। টুনি গলার স্বর আরো গম্ভীর করে বলল, “ছোটাচ্চু, ফারিহাপু ছাড়া তুমি বাঁচবে না। আমরাও ফারিহাপু ছাড়া আর কাউকে চাই না। তাই তোমাকে আমরা দুই দিন সময় দিচ্ছি। এর মাঝে তোমাকে ফারিহাপুর সাথে মিলমিশ করে নিতে হবে।”
ছোটাচ্চু কেমন যেন ঘোলা চোখে টুনির দিকে তাকাল, তারপর বলল, “টুনি তুই ছোট, তুই বুঝবি না। বিষয়টা এত সোজা না যে বুড়ো আঙুল ছুঁয়ে আড়ি দিয়েছিলাম এখন কেনে আঙুল ছুঁয়ে ভাব করে ফেলব। বিষয়টা জটিল। মানুষের সম্পর্ক হচ্ছে কাঁচের গ্লাসের মতো, একবার ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না। সুপার গ্লু দিয়ে জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করা যায় কিন্তু সেটা শুধু আটকে রাখে জোড়া হয় না–” কথা শেষ করে ছোটাচ্চু এমন লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল যে মনে হলো বুকের ভেতর থেকে একটা সাইক্লোন বের হয়ে টর্নেডোর মতো ঘরে ঘুরপাক খেতে লাগল।
টুনি ছোটাচ্চুকে দেখে খুব মন খারাপ করে বের হলো। বড় মানুষদের মাথার মাঝে ঘিলু এত কম কেন?
.
সেদিন বিকালে আবার একটা গোলটেবিল বৈঠক শুরু হলো, আগের মতোই সবাই মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসেছে। সবার মুখ একটু গম্ভীর, একটু আগে টুনির মুখ থেকে সবাই পুরোটুকু শুনেছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শান্ত বলল, “অবস্থা ঘনঘটিয়াস।”
ঘনঘটিয়াস শব্দটার অর্থ কেউ জানে না, ধরে নিল এর অর্থ গুরুতর। কেউ কোনো কথা বলল না। তখন শান্ত আবার বলল, “এখন কী হবে?”
টুম্পা বলল, “এখন ছোটাচ্চু সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। বিশ বছর পর ফিরে আসবে। তখন ছোটাচ্চুর এই এই লম্বা চুল আর দাড়ি থাকবে।”
গুড্ডু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, “সত্যি। আমি পড়েছি।”
গুড্ডু বলল, “কোথায় পড়েছ?”
টুম্পা উত্তর দেবার আগেই শান্ত বলল, “কোথায় আবার–স্কুলের বাথরুমের দেওয়ালে।”
টুম্পা মুখ শক্ত করে বলল, “না। আমি এইটা বাথরুমের দেওয়ালে পড়ি নাই। আমি পড়েছি-”
প্রমি হাত তুলে বলল, “তোরা থামবি? সারাক্ষণ ফালতু কথাবার্তা।”
শান্ত বলল, “মোটেও ফালতু কথাবার্তা না।”
“এখন কী করা যায় সেটা বলবি কেউ?”
সবাই আবার টুনির দিকে তাকাল, একজন জিজ্ঞেস করল, “কী করা যায় বলবি?”
টুনি চশমাটা নাকের উপর ঠিক করে বসিয়ে বলল, “আমি শুধু ছোটাচ্চুর কথাটা শুনেছি। ফারিহাপুর কথা শুনি নাই। দুইজনের কথাই শুনলে কী করা যায় সেটা চিন্তা করা যেত।”
প্রমি জিজ্ঞেস করল, “ফারিহাপুর কথা কেমন করে শুনবি? ফোনে কথা বলবি?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। এইসব কথাবার্তা টেলিফোনে হয় না, সামনাসামনি করতে হবে।”
“কীভাবে করবি?”
“জানি না।”
ছোটাচ্চুর সাথে কথা বলাটা সহজ ছিল, সোজাসুজি তার ঘরে চলে গেছে। ফারিহাপুর কাছে তারা কেমন করে যাবে? কে যাবে? কী বলবে?
ঠিক তখন এই ঘরটাতে ঝুমু খালা উঁকি দিল, এতজনকে এভাবে বাস থাকতে দেখে সন্দেহের গলায় বলল, “ব্যাপারটা কী? তোমাদের মতলবটা কী?”
শান্ত বলল, “আমাদের কোনো মতলব নাই।”
“খামোখা মিছা কথা না বলে সত্যি কথাটা কও। মতলবটা বদ মতলব কি না এইটা বললেই হবে।”
টুম্পা মুখ শক্ত করে বলল, “মোটও বদ-মতলব না। আমরা ছোটাচ্চুকে নিয়ে কথা বলছি।”
ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “কী কথা?”
“ছোটাচ্চুর অনেক মন খারাপ, কেমন করে তার মন খারাপ দূর করা যায় সেইটা নিয়ে কথা বলছিলাম।”
“এইটা নিয়ে আবার কথা বলার কী আছে? ধইরা বিয়া দিয়ে দাও সব মন খারাপ দূর হয়ে যাবে। এটা হচ্ছে জটিল রোগের সোজা চিকিৎসা।”
এবারে কেউ কোনো কথা বলল না। ঝুমু খালা বলল, “তার তো মেয়ে ঠিক আছে! লম্বা মতন হাসি-খুশি মাইয়াটাফাজিলা না যেন কী নাম–”
“ফারিহা।”
“হ্যাঁ। ফারিহা। চাচিরে কও বিয়ার প্রস্তাব দিতে—”
প্রমি গম্ভীর গলায় বলল, “ছোটাচ্চু আর ফারিহাপুর ব্রেক-আপ হয়ে গেছে।”
ঝুমু খালার চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, বলল, “কও কী! বেরেক আপ? মানে ছাড়াছাড়ি?”
“হুঁ।“
ঝুমু খালার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। সে এবারে ঘরের ভেতর ঢুকে তাদের পাশে বসে পড়ল, হাতের ঝাড়টা পতাকার মতো ধরে রেখে বলল, “কী সর্বনাশা কথা! এখন কী হবে?”
প্ৰমি বলল, “সেই জন্যে আমরা সবাই বসেছি। কী করা যায় সেইটার কথা বলছি।”
ঝুমু খালার বুদ্ধির উপর শান্তর অনেক বেশি ভরসা। সে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কোনো আইডিয়া আছে ঝুমু খালা?”
ঝুমু খালা বলল, “এইটা আইডিয়ার ব্যাপার না। মিল-মহব্বত আইডিয়া দিয়া হয় না।”
“তাহলে কী দিয়ে হয়?”
“আমাগো গেরামে জরিনি বেওয়া থাকে। কমপক্ষে একশ’ চল্লিশ বছর বয়স। চোখে দেখে না, কানে শুনে না। মাথার চুল শণের মতো
সাদা। শরীরের চামড়ায় কুঁচ পড়েছে, মুখে দাঁত নাই, খালি মাড়ি। সেই জরিনি বেওয়া পান পড়া দেয়, সেই পান পড়া যদি একবার খাওয়াতে পারো দেখবা মিল-মহব্বত কারে কয়। একটা খাওয়াবা তোমার ছোটাচ্চুরে আরেকটা খাওয়াবা ফাজিলারে–”
“ফাজিলা না। ফারিহা।”
“ঐ একই কথা।” ঝুমু খালা বলল, “যদি দুইজনরে দুইটা পান পড়া খাওয়াতে পারো দেখবা পাগলের মতো দুইজন ছুঁইটা আসবে–”
টুনি বলল, “ঝুমু খালা, আমার মনে হয় এইটা পান পড়া দিয়ে হবে না।”
ঝুমু খালা তার ঝাড়টা মেঝেতে ঠুকে বলল, “একশবার হবে। হাজারবার হবে। জরিনি বেওয়ার পান পড়া কী চিজ, তোমরা জানো না।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু আমরা তো জরিনি বেওয়ার কাছে যেতে পারব না। আমাদের অন্য কিছু করতে হবে।”
ঝুমু খালা মেনে নিল। মাথা নেড়ে বলল, “সেইটা ভুল বলো নাই। সেইটা সত্য কথা। অন্য সিস্টিম করতে হবে।” সবাই দেখল ঝুমু খালা ঝাডুটা সামনে শুইয়ে রেখে অন্য সিস্টিম চিন্তা করতে শুরু করেছে।
এই বাসার ছেলেমেয়েরী ঝুমু খালার কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনাকে খুব গুরুত্ব দেয়। তাই সবাই কোনো শব্দ না করে ঝুমু খালাকে চিন্তা করতে দিল। ঝুমু খালা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করে চোখ খুলে বলল, “তোমাদের ছোটাচ্চুর মনরে কেমন করে নরম করা যাবে সেইটা এখন বলতে পারব না। তবে—”
সবাই ঝুঁকে পড়ল, “তবে?”
ঝুমু খালা মুখ গম্ভীর করে বলল, “ফাজিলার মন কেমন করে নরম করা যাবে সেইটা বলতে পারি।”
“ফাজিলা না, ফারিহা।”
“একই কথা।”
টুনি জানতে চাইল, “কী রকম করে?”
“তোমার ছোটাচ্চুর একটা কঠিন ব্যারাম দরকার। কঠিন অসুখ।”
“অসুখ?”
“হ্যাঁ। যেমন মনে করো কলেরা। না হলে যক্ষ্মা।”
বাচ্চারা চমকে উঠল, “কলেরা? যক্ষ্মা?”
ঝুমু খালা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। যখন তোমার ছোটাচ্চু অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকবে সেই খবর যখন ফাজিলা পাবে”
“ফারিহা।”
“হ্যাঁ ফারিহা। যখন খবর পাবে তখন তার মনের মাঝে একটা দরদ হবে। তখন ঝগড়া-ঝাটি ভুলে চলে আসবে। মহব্বত ফিরে আসবে, মিলমিশ হয়ে যাবে।”
শান্তকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল। মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু ছোটাচ্চুর অসুখ কেমন করে বানাব? কলেরা না হলে যক্ষ্মার জীবাণু আনতে হবে?”
ঝুমু খালা বলল, “মনের মতন অসুখ পাওয়া কঠিন। তবে আরেকটা কাজ করা যায়।”
“কী কাজ?”
“ঠ্যাং ভেঙে দিতে পারলেও কাজ হয়।“
সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল “ঠ্যাং ভেঙে দিব?”
ঝুমু খালা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। ঠ্যাং ভেঙে যদি বিছানায় শোয়াইয়া রাখো, তাহলেও কাজ হবে। কলেরা না হলে যক্ষ্মার সমান কাজ হবে। জরিনি বেওয়ার পান পড়া হলো এক নম্বর। ঠ্যাং ভাঙা হলো দুই নম্বর।”
.
ঝুমু খালা চলে যাওয়ার পর সবাই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। টুম্পা উশখুশ করে বলল, “তাহলে আমরা কি ছোটাচ্চুর পা ভাঙব?”
শান্ত বলল, “আমি চেষ্টা করতে পারি। সিঁড়ির উপর একটা কলার ছিলকা রেখে হাল্কা মতন ধাক্কা দিলে-”
প্রমি ধমক দিয়ে বলল, “তুই চুপ করবি? একজন মানুষের পা আবার কেমন করে ভেঙে দেয়? তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?”
শান্ত মিনমিন করে বলল, “কিন্তু ঝুমু খালা যে বলল!”
“ঝুমু খালা বললেই সেটা করতে হবে?”
“তাহলে কি কলেরা হাসপাতাল থেকে কলেরার জার্ম আনতে হবে?”
টুনি বলল, “আমার মনে হয় কী–”
সবাই টুনির দিকে ঘুরে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কী মনে হয়?”
“ঝুমু খালা কথাটা ভুল বলে নাই।”
“ভুল বলে নাই?”
“না। আমাদের ক্লাশে একটা ছেলে পড়ে, তার নাম হচ্ছে খলিল। খলিলের থেকে পাজি ছেলে এখন পর্যন্ত জন্মায় নাই। ক্লাশের কেউ তাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। সবার সাথে ঝগড়া, মারামারি। খলিল খালি দুষ্টু না, দুষ্টু আর পাজি। একদিন হঠাৎ–“
“হঠাৎ কী?”
“আমরা খবর পেলাম রিকশা একসিডেন্ট করে পা ভেঙে হাসপাতালে। তখন ক্লাশের সবাই বলতে শুরু করল, আহা বেচারা খলিল! সবাই তখন খলিলকে দেখতে হাসপাতালে গেল। তারে দেখে সবার কী যে মায়া হলো! কেউ খলিলের মাথা টিপে দেয়, কেউ হাত টিপে দেয়, কেউ বাতাস করে, কেউ দুধ খাওয়ায়—”
প্রমি মাথা নাড়ল, বলল, “তোর কথা ঠিক। মেয়েদের ভিতরে মায়া বেশি। কারো অসুখ হয়েছে শুনলে মায়া অনেক বেশি হয়। ছোটাচ্চুর যদি বড় কোনো অসুখ হতো তাহলে মনে হয় ফারিহাপু নরম হয়ে যেত। কিন্তু ইচ্ছা করলেই কি বড় অসুখ বানানো যাবে?”
টুনি বলল, “না। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“সত্যি সত্যি অসুখ হতে হবে কে বলেছে? আমরা ফারিহাপুকে গিয়ে বলি ছোটাচ্চু খুবই অসুস্থ—”
“আর ফারিহাপু যদি এসে দেখে কোনো অসুখ নাই?”
টুনি মাথা চুলকে বলল, “আমরা এমন একটা অসুখের কথা বলব যেটা হলে বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। মনে হয় পুরোপুরি সুস্থ—”
একজন বলল, “পেটের অসুখ?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। পেটের অসুখের মাঝে সম্মান নাই। সম্মানী অসুখ হতে হবে।”
“সম্মানী অসুখ কোনটা?”
“হার্ট এটাক। ব্রেন স্ট্রোক এগুলো সম্মানী অসুখ। সব বড়লোকদের এই অসুখ হয়। গরিবের পেটের অসুখ হয়।”
“ছোটাচ্চুর হার্ট এটাক হবে? ব্রেন স্ট্রোক?”
টুনি মাথা নাড়ল, “উঁহু। এইগুলো হাসপাতালে নিতে হয়।”
“তাহলে?”
“চিন্তা করে একটা বের করা যাবে। ইন্টারনেটে গুগল সার্চ দিলেই বের হয়ে যাবে।”
প্রমি জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু ফারিহাপুর কাছে কে যাবে? কেমন করে যাবে? গিয়ে কীভাবে বলবে?”
টুনি বলল, “চিন্তা করে ঠিক করতে হবে। আমাদেরকে এমনি এমনি যেতে দিবে না, আব্দু-আম্মুকে বলার জন্যে একটা ভালো স্টোরি বানাতে হবে। তা ছাড়া–”
“তা ছাড়া কী?”
“ছোটাচ্চু উত্তর আধুনিক না কি একটা নিয়ে বকাবকি করছিল। গণ্ডগোলটা লেগেছে সেখান থেকে। সেইটাও একটু বুঝতে হবে।”
শান্ত মুখ হাঁ করে বলল, “উত্তর আধুনিক? সেটা আবার কী?”
“এক রকম কবিতা।”
“কবিতার উত্তর-দক্ষিণ আছে?”
টুনি মাথা নাড়ল, “আমি জানি না। ছোটাচ্চু বলে উত্তর আধুনিক কবিতা আছে ফারিহাপু বলে নাই–সেই থেকে গোলমাল!”
“কী আশ্চর্য!”
প্রমি চোখ কপালে তুলে বলল, “এটা আবার কী রকম কথা। থাকলে আছে না থাকলে নাই, এ জন্যে ঝগড়া করতে হবে?”
টুনি বলল, “এই হচ্ছে বড়দের সমস্যা। একজন মানুষ যখন বড় হতে থাকে তখন তাদের মাথায় ঘিলু কমতে থাকে! তুমি যখন বড় হবে তখন তুমিও আস্তে আস্তে বোকা হয়ে যাবে।”
সবাই মাথা নাড়ল, শান্ত পর্যন্ত কথাটা মেনে নিয়ে বলল, “ঠিকই বলেছিস! আমিও দিনে দিনে বোকা হয়ে যাচ্ছি। আগে মেয়েদের দেখলে মেজাজ গরম হতো। আজকাল মেয়েদের দেখলে কেমন যেন ইয়ে–”
সবাই শান্তর দিকে ঘুরে তাকাল। প্রমি চোখ পাকিয়ে বলল, “কেমন যেন কিয়ে?”
শান্ত জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, না-সেরকম কিছু।”
টুনি নিঃশ্বাস ফেলে নিচু গলায় বলল, “শান্ত ভাইয়ার হরমোন কিক করতে শুরু করেছে মনে হয়!”
.
পরের দিন টুনি আর প্রমি ফারিহাপুর সাথে দেখা করতে গেল। কাজটা খুব সহজ হলো না, স্কুল ছুটির পর বন্ধুর বাসায় যাওয়া, ছবি আঁকার ক্লাশ, লাইব্রেরি থেকে বই আনা, সায়েন্স খাতা কেনা–এরকম বেশ কিছু ব্যাপারকে একসাথে সাজাতে হলো। বড় মানুষেরা একটু বোকা হয়, তাই খুব বেশি কঠিন হলো না। সেই তুলনায় ফারিহাপুর অফিসটা কোথায় সেটা বের করা মোটামুটি কঠিন কাজ ছিল, ছোটাচ্চুকে না জানিয়ে কাজটি করতে হয়েছে তাই কাজটি আরো কঠিন হয়ে গিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত প্রমি আর টুনি ফারিহাপুর অফিসে গিয়ে হাজির হলো দুপুরবেলা। ফারিহাপু অফিসে তার চেয়ারে বসে ছাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, টুনি আর প্রমি তার সামনে এসে দাঁড়ানোর পরও কিছুক্ষণ তাদের দেখতে পেল না! টুনি যখন গলা পরিষ্কার করে ডাকল, “ফারিহাপু”, তখন চোখ নামিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল, বলল, “আরে! তোমরা?”
টুনি বলল, “হ্যাঁ ফারিহাপু। আমরা তোমার কাছে এসেছি।”
“আমার কাছে?” ফারিহাপু টুনির কথা শুনে একটু অবাক হলো কিন্তু সেটা তাদের বুঝতে দিল না, বলল, “বসো, বসো।”
টুনি আর প্রমি সামনের চেয়ারে বসল। কীভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছিল না, ফারিহাপু অবশ্যি ভাব দেখাল যেন ছোটাছুর সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর ছোটাচ্চুর ভাগনি-ভাইঝির তার কাছে চলে আসা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “তারপর, তোমাদের কী খবর?”
দুইজনে মাথা নেড়ে বলল, “ভালো। খুবই ভালো।”
“গুড। ভেরি গুড।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “আপনার অফিস কেমন চলছে?”
ফারিহাপু গলা নামিয়ে বলল, “ফালতু, খুবই ফালতু।”
“কেন? ফালতু কেন?”
“এইটা একটা এনজিও, গরিব বাচ্চাদের সাহায্য করার এনজিও। সাহায্য না কচু–গরিব বাচ্চাদের নিয়ে বিজনেস করে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। চাকরি ছেড়ে দেব।”
“চাকরি ছেড়ে কী করবেন?”
“আর কোনো একটা চাকরি খুঁজে বের করব।”
টুনি মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে যদি ফারিহাপু আর ছোটাচ্চু দুইজন মিলে কাজ করত, কী মজাই না হতো। দুইজনে ঝগড়া করে এখন ঘাপলা করে রেখেছে। টুনি তার চশমাটা ঠিক করে গলা পরিষ্কার করে বলল, “ফারিহাপু, আমরা তোমাকে একটা দাওয়াত দিতে এসেছি।”
ফারিহাপু একটু অবাক হয়ে বলল, “দাওয়াত?”
“হ্যাঁ।”
“কিসের দাওয়াত?”
“বিয়ের দাওয়াত।”
“বিয়ের?” ফারিহাপুর চেহারাটা হঠাৎ কেমন জানি শীতল হয়ে উঠল, ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কার বিয়ে?”
“টুম্পার ছেলের সাথে রিংকুর মেয়ের বিয়ে?”
“টু-টুম্পাটা কে? রিংকু কে?”
প্রমি বলল, “আমাদের ছোট বোন। তাদের আসল ছেলে-মেয়ে, তাদের পুতুলের বিয়ে।”
ফারিহাপুর কয়েক সেকেন্ড লাগল বুঝতে, তখন তার চেহারাটা আবার স্বাভাবিক হলো। তারপর হি হি করে হাসতে লাগল! হাসতে হাসতে বলল, “বৃষ্টি না হলে ব্যাঙের বিয়ে দেয় বলে শুনেছি। কিন্তু পুতুলের বিয়ে–এইটা অনেক দিন শুনিনি।”
প্রমি বলল, “তোমাকে যেতেই হবে ফারিহাপু। সবাই খুব চাইছে।”
এবারে আস্তে আস্তে ফারিহাপুর মুখটা কেমন যেন দুঃখী দুঃখী হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর নিজের নখগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল, সেটা মোটেও হাসির মতো হলো না, তারপর টেবিলে ঠোকা দিতে দিতে বলল, “আসলে, ব্যাপারটা হয়েছে কী, আমি আসলে তোমাদের বাসায় যেতে পারব না। মানে–আসলে আমার না যাওয়াটাই ভালো।”
প্রমি আর টুনি খুব অবাক হবার ভান করল, বলল, “কেন?”
ফারিহাপু বলল, “তোমরা তো ছোট, তোমাদের ঠিক করে বোঝাতে পারব না। মানে তোমরা তো জানতে তোমাদের ছোটাচ্চু আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল।”
দুইজনে জোরে জোরে মাথা নাডুল। ফারিহাপু বলল, “ছোট বেলার বন্ধুত্ব একরকম, যখন মানুষ বড় হয়, ছেলে আর মেয়ের যদি বন্ধুত্ব হয় তখন অনেক সময় বন্ধুত্বটা আরো একটু গভীর হয়, বড় বড় কমিটমেন্টের ব্যাপার আসে—”
ফারিহাপুর কথা আস্তে আস্তে জটিল এবং দুর্বোধ্য হতে শুরু করেছে কিন্তু টুনি আর প্রমি সব বুঝে ফেলছে সেরকম ভান করে মাথা নাড়তে থাকল। ফারিহাপু বলল, “যদি বড় কমিটমেন্টে যেতে হয় তখন আরো ডিটেইলস চলে আসে। দুজন মানুষই যদি ইন্ডিপেন্ডেন্ট হয়, ভেজ যদি খুব স্ট্রং হয় ছোটখাটো ইস্যু ক্রিটিকাল হয়ে যায়”
ফারিহাপু কী বলছে প্রমি আর টুনি কিছুই বুঝতে পারছে না কিন্তু তারা সবকিছু বুঝে ফেলছে সেরকম ভান করে আরো জোরে জোরে মাথা নাড়তে থাকল। ফারিহাপু বলল, “কিন্তু ছোটখাটো ইস্যু আসলে ছোটখাটো না, এগুলো একজন মানুষের পার্সোনালিটি দেখায়। বন্ধুত্বের বেলায় পার্সোনালিটির উনিশ-বিশে কিছু আসে যায় না। কিন্তু বড় কমিটমেন্টের বেলায় এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষ কী গান শুনে, কার ছবি দেখে, প্রিয় লেখক কে–”
বড় মানুষদের এটা হচ্ছে সমস্যা–একবার কথা বলতে শুরু করলে আর থামতে পারে না। কাজেই ফারিহাপু কথা বলতেই থাকল, বেশিরভাগ জিনিস টুনি বুঝতে পারল না, প্রমি যেহেতু একটু বড় হয়েছে তাই সে হয়তো একটু একটু বুঝল কিন্তু ফারিহাপুর থামার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। যখন মাঝখানে একটু থামল তখন টুনি বলল, “কিন্তু আমরা ভাবছিলাম তুমি আমাদের বিয়েতে আসবে, ছোটাকে একটু দেখেও আসবে, ছোটাচ্চুর এত শরীর খারাপ–”
ফারিহাপু এবারে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী হয়েছে শাহরিয়ারের?”
“ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না তাই বোঝা যাচ্ছে না। ব্লাড ক্যান্সার সন্দেহ করছে।”
“ফারিহাপু একেবারে চিৎকার করে উঠল, “ব্লাড ক্যান্সার?”
টুনি বুঝল একটু বেশি হয়ে গেছে, এত কঠিন অসুখের কথা বলা ঠিক হয় নাই। কিন্তু এখন আর কিছু করার উপায় নাই–এভাবেই এগুতে হবে। সে মুখ শুকনো করে বলল, “খাওয়ার রুচি নাই, রাতে করে জ্বর ওঠে। সেই দিন–” টুনি ইচ্ছা করে থেমে গেল।
“সেই দিন কী?”
“নাহ্, কিছু না।” টুনি ইচ্ছে করে ভান করল যে, সে কিছু একটা জিনিস ফারিহাপুর কাছে লুকানোর চেষ্টা করছে।
ফারিহাপু হঠাৎ করে শোনার জন্যে ব্যস্ত হয়ে গেল, বলল, “সেই দিন কী হয়েছে বলো?”
টুনি বলল, “আমি ছোটাচ্চুর ঘরের কাছে দিয়ে যাচ্ছি–ছোটাচ্চু ঘুমিয়ে আছে, আমার মনে হলো ছোটাচ্চু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলছে, আমার মনে হয় কথাগুলো শোনা ঠিক হয় নাই। ঘুমের মাঝে তো একজন কত কথাই বলতে পারে।” টুনি আবার থেমে গেল।
ফারিহাপু জিজ্ঞেস করল, “কী বলছিল ঘুমের মাঝে?”
“তোমার নাম।”
“আমার নাম?” ফারিহাপুর গাল দুটো মনে হলো একটু লাল হয় উঠল।
“হ্যাঁ। আর বলছিল, আমি ভুল করেছি ফারিহা, তুমিই ঠিক।”
ফারিহাপু একটু ঝুঁকে পড়ল, “তাই বলছিল? কী ভুল করেছে?”
“কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারি নাই। মনে হলো উত্তর আধুনিক কী যেন–”
ফারিহাপু বলল, “উত্তর আধুনিক কবিতা। পোস্ট মডার্ন পোয়েট্রি।”
“হবে হয়তো।”
টুনি মুখ গম্ভীর করে বলল, “বলছিল, নাই নাই বাংলা সাহিত্যে নাই–”
“তাই বলছিল?”
“হ্যাঁ। তারপর বিড়বিড় করে কিছু খারাপ জিনিস বলল।”
ফারিহা জিজ্ঞেস করল, “কী খারাপ জিনিস?”
বলল, “ডেড। আমি ডেড। ব্রেন ডেড। বারবার বলল, ব্রেন ডেড।”
ফারিহাপু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে চুপচাপ বসে রইল। তখন প্রমি বলল, “আমরা আজকে যাই ফারিহাপু। তোমার অফিসের সময় নষ্ট হচ্ছে।”
ফারিহাপু বিড়বিড় করে বলল, কচু অফিস। ভুয়া অফিস। ফাউ অফিস। অফিসের খেতা পুড়ি।
টুনি আর প্রমি উঠে দাঁড়াল, “আমরা যাই।”
ফারিহাপু অন্যমনস্কভাবে বলল, “ঠিক আছে যাও।”
প্ৰমি বলল, “তুমি যদি টুম্পা-রিংকুর পুতুলের বিয়েতে আসো, সবাই খুব খুশি হবে।”
টুনি বলল, “তুমি যদি চাও তাহলে আমরা ছোটাচ্চুকে ব্যস্ত রাখতে পারি, যেন তোমার সাথে দেখা না হয়।”
ফারিহাপু কোনো কথা বলল না, ছোটাচ্চু যেরকম মাছের মতো তাকিয়ে থাকে অনেকটা সেইভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। টুনি বলল, “আর যদি তোমার সাথে দেখা হয়ে যায় তুমি প্লিজ অসুখের কথা জিজ্ঞেস কোরো না।”
ফারিহাপু এবারেও কোনো কথা বলল না। টুনি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে মুখ কালো করে বলল, “কাউকে নিজের অসুখের কথা বলতে চায় না। অসুখটা মনে হয় খুব ডেঞ্জারাস-ছোটাচ্চু মনে হয় বেশি দিন বাঁচবে না।”
.
প্রমি আর টুনি রাস্তায় নামার পর প্রমি টুনির ঘাড় খামচে ধরে বলল, “আমি জীবনে তোর মতো মিথ্যুক দেখি নাই। চোখের পাতি না ফেলে তুই এতগুলো মিথ্যা কথা কেমন করে বললি?”
টুনি বলল, “এইগুলো মিথ্যা কথা না। এইগুলো ছোটাচ্চু আর ফারিহাপুকে একত্র করার জন্যে একটা প্রজেক্ট।”
প্রমি মাথা নাড়ল, “তুই যাই বলিস, তোর মতো ডেঞ্জারাস মানুষ এই দুনিয়ায় নাই। যদি ফারিহাপু আর ছোটাচ্চু আসল ব্যাপারটা জানতে পারে তাহলে কী হবে চিন্তা করতে পারিস? তোকে তো খুন করেই ফেলবে আমাদের সবাইকেও খুন করে ফেলবে।”
টুনি বলল, “সেইটা পরে দেখা যাবে। এখন ভালো করে একটা পুতুলের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বাসায় পুতুল আছে না?”
প্রমি বলল, “খুঁজলে পাওয়া যাবে সব অবশ্যি মেয়ে পুতুল, চুল কেটে ছেলে বানাতে হবে।”
.
বিকালবেলা টুনি ছোটাচ্চুর সাথে দেখা করতে গেল। ছোটাচ্চু তার সেই মোটা বইটা নিয়ে বসে আছে, খুব বেশি পড়া হয়েছে বলে মনে হয় না। টুনি আজকে বেশি ভূমিকার দিকে গেল না, সরাসরি কাজের কথায় চলে এলো, বলল, “আজ সকালে ফারিহাপুর কাছে গিয়েছিলাম।”
মনে হলো কেউ ছোটাচ্চুকে দশ হাজার ভোল্ট দিয়ে ইলেকট্রিক শক দিয়েছে! ছোটাচ্চু বিছানার মাঝে বসে থেকেই একটা লাফ দিল, প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “কার কাছে গিয়েছিলি?”
“ফারিহাপুর কাছে।”
“কেন?”
“মনে নাই টুম্পার ছেলের সাথে রিংকুর মেয়ের বিয়ে? তুমি উকিল বাবা! ফারিহাপুকে বিয়ের দাওয়াত দিতে গিয়েছিলাম।”
ছোটাচ্চু বলল, “ফা-ফা–ফা-” কথা শেষ করতে পারল না কিন্তু টুনি অধৈর্য হলো না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ছোটাচ্চু শেষ পর্যন্ত “ফারিহা” উচ্চারণ করতে পারল, বলল, “ফারিহা আসবে?”
“মনে হলো আসতে চাচ্ছে–কিন্তু তুমি আবার কী মনে করো।”
ছোটাচ্চু ব্যস্ত হয়ে বলল, “আমি আবার কী মনে করব?”
“দেখলাম খুবই মন খারাপ।”
“মন খারাপ? কী নিয়ে মন খারাপ?”
“মনে হয় তোমার সাথে ব্রেক-আপ হয়ে গেছে সেই জন্যে।”
“সত্যি?” ছোটাচ্চুর চোখ কেমন যেন জ্বলজ্বল করতে থাকে।
“হ্যাঁ।” টুনি উদাসীন একটা ভাব করে বলল, “অনেক কথা বলল।”
“কী কথা?”
“সব কথা তো আমি বুঝি না। যেমন ধরো, উত্তর আধুনিক কবিতা।”
ছোটাচ্চু নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, “কী বলেছে উত্তর আধুনিক কবিতার কথা?”
“বলছিল গত কিছুদিনু অনেক কবিতা পড়েছে–পড়ে তার মনে হয়েছে তোমার কথা ঠিক। বাংলা সাহিত্যে মনে হয় উত্তর আধুনিক কবিতা আছে।”
“তাই বলেছে?”
“হ্যাঁ। আরো বলেছে মাথা থেকে হৃদয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তোমার মাথা যেরকমই হোক তোমার হৃদয়টা নাকি ফাটাফাটি।”
ছোটাচ্চু এবারে বিছানায় সোজা হয়ে বসে বলল, “তাই বলেছে? ফাটাফাটি শব্দটা ব্যবহার করেছে?”
“ফাটাফাটি শব্দ বলেছে কি না এখন আর মনে নাই। তবে বুঝিয়েছে ফাটাফাটি। তা ছাড়া–”
“তাছাড়া কী?”
“ফারিহাপুর আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। চাকরি ছেড়ে দেবে বলেছে।”
“চাকরি ছেড়ে দেবে? কেন?”
“তোমার সাথে ব্রেক-আপ হয়েছে বলে মনে হয়।”
ছোটাচ্চু অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল, তারপর বিশাল লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টুনি বলল, “ছোটাচ্চু তোমাকে একটা কথা বলি?”
“বল।”
“যদি সত্যি সত্যি ফারিহাপু চলে আসে তুমি কিন্তু ঝগড়া শুরু করে দিও না।”
ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “আমাকে দেখে কি তাই মনে হয় যে আমি শুধু ঝগড়া করে বেড়াই?”
“না তা অবশ্যি মনে হয় না, কিন্তু একবার যখন করে ফেলেছ আবার যেন শুরু না করো সেইটা বলছিলাম।”
“ঠিক আছে।”
“আরেক একটা কথা।”
“কী কথা?”
“আমি যে তোমার সাথে ফারিহাপুর কথাগুলো বলেছি ফারিহাপু যেন সেটা না জানে। আমাদের সাথে খোলামেলা কথা বলেছে–আমরা বলেছি তোমাকে কিছু বলব না।“
“ঠিক আছে।”
ছোটাচ্চু গম্ভীর হয়ে তার মোটা বইটা কোলে টেনে নিয়ে আবার পড়ার ভান করতে লাগল, টুনি তখন সাবধানে ঘর থেকে বের হয়ে এলো।
.
সেদিন সন্ধ্যেবেলা আবার গোলটেবিল বৈঠক, আজকে অবশ্যি টুনিই কথা শুরু করল। বলল, “অনেক সাবধানে একটা ফাঁদ পাতা হয়েছে। সেই ফাঁদে ছোটাচ্চু আর ফারিহাপু দুইজনেই পা দিয়েছে–এখন খুব সাবধান!”
টুম্পা উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে ফাঁদ পেতেছ টুনি আপু?”
“ছোটাচ্চুকে বলেছি ফারিহাপু ছোটাচ্চুর জন্যে পাগল। ফারিহাপুকে বলেছি ছোটাচ্চু ফারিহাপুর জন্যে পাগল। শুধু তাই না, ফারিহাপুকে বলেছি ছোটাচ্চু খুবই অসুস্থ, ব্লাড ক্যান্সার সন্দেহ করছে।”
“ব্লাড ক্যান্সার?” সবাই আঁতকে উঠল।
“যা। ছোটখাটো অসুখের কথা বললাম না।”
“এসে যখন দেখবে–”
টুনি থামিয়ে দিয়ে বলল, “এসে কী দেখবে কী হবে সেটা পরে দেখা যাবে। এখন টুম্পা আর রিংকুর পুতুলের বিয়েটা যেন ঠিকমতো হয়।”
শান্ত বলল, “পুতুলের বিয়ে না বলে জন্মদিনের কথা বললে হতো।”
একজন জিজ্ঞেস করল, “কার জন্মদিন?”
“আমার!”
প্রমি বলল, “তোমার জন্মদিনের এখনো ছয় মাস বাকি।”
শান্ত বলল, “তাতে কী আছে? একটুখানি মিথ্যা কথা বললে আমি কিছু গিফট পেতাম। সবাই মিলে তোরা যে পরিমাণ মিথ্যা কথা বলছিস তার তুলনায় এইটা কোনো মিথ্যাই না–”
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, আমরা শুধু মিথ্যা কথা বলার জন্য এইগুলো করছি না। আমরা অনেক বড় একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি–”
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “তা ঠিক।”
“কাজেই খুব সাবধানে কাজ করতে হবে। পুতুলের বিয়েটা ঠিকভাবে করতে হবে, যেন ছোটাচ্চু আর ফারিহাপু ধরতে না পারে, এটা মিছিমিছি।”
প্রমি বলল, “ধরতে পারবে না, আমি দেখব সব কিছু যেন ঠিক করে হয়।”
টুনি বলল, “যখন ফারিহাপু আর ছোটাচ্চু এক জায়গায় আসবে তখন খুব কায়দা করে আমাদের সবার সরে যেতে হবে, যেন তারা দুইজন একলা একলা থাকে, নিজেরা নিরিবিলি কথা বলতে পারে–”
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”
একজন জানতে চাইল, “যদি ফারিহাপু না আসে?”
টুনি বলল, “আসবে। ব্লাড ক্যান্সারের কথা কি এমনি এমনি বলেছি!”
.
টুনির ধারণা সঠিক, পরদিন বিকালবেলা ফারিহাপু এসে হাজির হলো। নীল রঙের একটা শাড়ি পরে এসেছে, কপালে টিপ, চুলে বেলী ফুলের মালা। তাকে যা সুন্দর দেখাচ্ছে সেটা আর বলার মতো না। বাচ্চারা তাকে ঘিরে লাফাতে লাগল, একজন বলল, “ফারিহাপু, তোমাকে যা সুন্দর লাগছে!”
ফারিহাপু একটু লজ্জা পেল, বলল, “বিয়েতে এসেছি তো তাই একটু সেজে এসেছি।”
“খুব ভালো করেছ, দেখছ না আমরাও সেজেছি!” কথাটা সত্যি, বাচ্চারাও সেজে এসেছে, আর কিছু থাকুক কী না থাকুক, সব মেয়েদের মুখে কটকটে লাল লিপস্টিক।
ফারিহার হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট, সেটা বাচ্চাদের হাতে দিয়ে বলল, “পুতুলের জন্যে কী গিফট আনব বুঝতে পারছিলাম না, তাই এই মিষ্টির প্যাকেটটা এনেছি, পুতুল খেতে পারবে তো?”
টুম্পা বলল, “আমাদের পুতুল সব খেতে পারে!”
ফারিহাপুর সাথে যখন কথাবার্তা হচ্ছে তখন টুনি সটকে পড়ে ছোটাচ্চুর ঘরে হাজির হলো। ছোটাচ্চু তার ঘরে নার্ভাসভাবে বসে আছে। টুনি গিয়ে অবাক হয়ে বলল, “কী হলো ছোটাচ্চু? তুমি বিয়েতে যাবে না?”
‘যাব।”
“তাহলে রেডি হয়ে নাও। এই ময়লা টি-শার্ট পরে যেতে পারবে। একটা পাঞ্জাবি না হলে ফতুয়া পরতে হবে।”
“পরছি।” ছোটাচ্চু একটু ইতস্তত করে বলল, “ইয়ে, মানে ফা-ফারিহা কি এসেছে?”
টুনি ছোটাচ্চুর কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “আর তুমি শেভ করো নাই কেন? তোমাকে দেখতে সন্ত্রাসীর মতো লাগছে।”
ছোটাচ্চু গালে হাত বুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ করছি।”
তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, “ফারিহা কি এসেছে?”
“হ্যাঁ। এসেছে। তাড়াতাড়ি চলো, মনে আছে, তুমি হচ্ছ উকিল বাবা!”
ছোটাচ্চু এবারে খুব তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গেল, টুনি তখন তার হাত ধরে টেনে বিয়ের আসরে নিয়ে যায়। একটা ছোট টেবিলে বিয়ের মঞ্চ তৈরি হয়েছে, সেখানে রিংকুর মেয়ে বিনু বিয়ের সাজ পরে বসে আছে। পুতুল হওয়ার কারণে নিজে থেকে নড়তে পারে না, কেউ একজন তাকে ধরে নাড়াচাড়া করাচ্ছে। বরযাত্রী এখনো আসেনি, বরযাত্রী চলে এলেই আসল অনুষ্ঠান শুরু হবে।
ঘরের মাঝামাঝি কয়েকটা চেয়ার বসানো হয়েছে, তার একটাতে ফারিহা বসে আছে। টুনি ছোটাচ্চুর হাত ধরে তাকে টেনে এনে ফারিহাপুর কাছে আরেকটা চেয়ারে বসিয়ে দেয়। ঘরের বাচ্চা-কাচ্চারা সবাই চোখের কোনা দিয়ে ছোটাচ্চু আর ফারিহাকে লক্ষ করছে কিন্তু আগে থেকে বলে দেয়া আছে কেউ যেন তাদের দিকে সরাসরি না তাকিয়ে থাকে, তাই সবাই বিয়ের হৈ-হুল্লোড়ে ব্যস্ত আছে, এরকম ভান করতে লাগল।
ফারিহাপুর কাছে চেয়ারে বসে ছোটাচ্চু গম্ভীর মুখে ফারিহাকে বলল, “কেমন আছ?”
ফারিহাপু বলল, “ভালো।”
ছোটাচ্চু বলল, “ও।”
তারপর দুইজন আর বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না। দুইজনই মুখ শক্ত করে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে রইল, তাদের দেখে মনে হতে থাকে তারা একজন আরেকজনকে চেনে না।
টুনি চোখের কোনা দিয়ে দুইজনকে লক্ষ করে তারপর দরজার দিকে তাকায়। সেখানে গুড্ডু দাঁড়িয়ে আছে। টুনি তাকে একটা সিগন্যাল দিল, তখন গুড্ডু ছুটতে ছুটতে ভিতরে ঢুকে চিৎকার করে বলল, “বরযাত্রী এসে গেছে। বরযাত্রী এসে গেছে।”
তাকে কী বলতে হবে আগে থেকে শেখানো ছিল কিন্তু উত্তেজনার কারণে পুরোটা বলতে পারল না, ‘গেট ধরতে হবে’ কথাটা বলতে ভুলে গেল। কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা হলো না, সবাই হইহই করে উঠল, একজন বলল, “চল গেট ধরতে হবে।” মুহূর্তের মাঝে ঘরের সব বাচ্চারা হাওয়া হয়ে গেল। পুরো ঘরের মাঝখানে দুটো চেয়ারে ফারিহাপু আর ছোটাচ্চু বসে আছে। ঘরে কেউ নাই, শুধু টেবিলে বিয়ের সাজে বসে থাকা বিনু চোখের পাতি না ফেলে তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল।
দুইজনের মাঝে ভয়ঙ্কর একটা অস্বস্তিকর নীরবতা, কী করবে কেউ বুঝতে পারছে না। তখন ফারিহাপু বলল, “তোমার শরীর এখন কেমন আছে?”
ছোটাচ্চু বলল, “ভালো।”
ফারিহাপু বলল, “ও, আচ্ছা।”
আবার দুইজন চুপ করে বসে রইল, কিছুক্ষণ পর ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “তোমার শরীর কেমন আছে?”
ফারিহাপু বলল, “ভালো।”
ছোটাচ্চু বলল, “ও, আচ্ছা।”
আবার কিছুক্ষণ কেটে গেল, তখন ফারিহাপু জিজ্ঞেস করল, “শুনেছিলাম তোমার শরীরটা নাকি ভালো নাই?”
ছোটাচ্চু চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করল, “কার কাছে শুনেছ?”
ফারিহাপু একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “টুনি আর প্রমি আমাকে বিয়ের দাওয়াত দিতে গিয়েছিল, তারা বলছিল।”
“তারা কী বলছিল?”
“তোমার শরীরটা নাকি ভালো নাই।”
“আমার শরীর ভালো আছে।”
ফারিহাপু বলল, “ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে?”
ছোটাচ্চু একটু গলা উঁচিয়ে বলল, “কেন খামোখা ডাক্তারের কাছে যাব?”
ফারিহাপু একটু আহত দৃষ্টিতে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর কোনো কথা না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ তার নখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার কাজ কেমন চলছে?”
“ভালো।”
ছোটাচ্চু বলল, “ভালো?”
ফারিহাপু বলল, “মোটামুটি।”
তারপর জিজ্ঞেস করল “তোমার কাজ কেমন চলছে?”
ছোটাচ্চু বলল, “মোটামুটি।”
ফারিহাপু বলল, “তোমার নতুন স্টাফ কেমন?”
“ভালো।”
ফারিহাপু বলল, “ও।”
তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তোমার মনে হয় একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার।”
ছোটাচ্চু এবারে কেমন যেন রেগে গেল, বলল, “কেন তুমি একটু পরপর ডাক্তারের কথা বলছ?”
“কারণ শরীর খারাপ হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়।”
“আমার শরীর খারাপ হয় নাই।”
“এই সব অসুখ তাড়াতাড়ি ধরতে পারলে ভালো করে ফেলা যায়।”
ছোটাচ্চু এবারে অবাক হয়ে বলল, “কোন সব অসুখে?”
“তোমায় যেটা সন্দেহ করছে।”
“আমায় কোনটা সন্দেহ করছে?”
ফারিহাপুর হঠাৎ করে মনে পড়ল, টুনি তাকে বলে দিয়েছিল সে যেন ছোটাচ্চুকে তার অসুখের কথা জিজ্ঞেস না করে–কিন্তু এখন মনে হয় একটু দেরি হয়ে গেছে!
ছোটাচ্চু আবার জিজ্ঞেস করল, “আমার কোনটা সন্দেহ করছে?”
ফারিহাপু বলল, “থাক। ছেড়ে দাও।”
“না। কেন ছেড়ে দেব? তোমাকে বলতে হবে।”
ফারিহাপু একটু অবাক হয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রইল, “বলল, তুমি আমার সাথে এরকম করে কথা বলছ কেন?”
“কী রকম করে কথা বলছি?”
“রেগে রেগে। যেন আমি তোমাকে দেখতে এসে দোষ করে ফেলেছি।”
“তুমি আমাকে মোটেই দেখতে আসো নাই। তুমি পোলাপানের পুতুলের বিয়েতে এসেছ।”
ফারিহাপু ঠাণ্ডা গলায় বলল, “তুমি আমার সাথে যেরকম ব্যবহার করেছ আমার কোনোদিন তোমার সাথে কথা বলাই ঠিক না। শুনলাম খুব শরীর খারাপ তাই ভাবলাম–”
ছোটাচ্চুর হঠাৎ কেমন যেন সন্দেহ হলো, ফারিহাপুর দিকে ঘুরে বলল, “একটু পরে পরে বলছ আমার খুব শরীর খারাপ। টুনি-প্রমি কি শরীর খারাপ বলেছে?”
কাজটা ঠিক হবে কি না ফারিহাপু ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু তারপরেও মাথা নাড়ল, “বলেছে।”
“কী বলেছে?”
“বলেছে–” ফারিহাপু আবার থেমে গেল।
“কী বলেছে?”
“বলেছে তোমার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে।”
“ব্লা-ড-ক্যা-ন্সা-র!!” বলে ছোটাচ্চু একটা গগনবিদারি চিৎকার দিল। ঘরের বাইরে জানালার নিচে উবু হয়ে বসে টুনি ছোটাচ্চু আর ফারিহাপুর কথাগুলো শোনার চেষ্টা করছিল, ছোটাচ্চুর এই গগনবিদারি চিৎকার শুনে সে বুঝে গেল তাদের এই বিশাল পরিকল্পনা (কিংবা ষড়যন্ত্র) ফাঁস হয়ে গেছে।
ফারিহাপু একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে? তোমার ব্লাড ক্যান্সার হয় নাই?”
“ব্লাড ক্যান্সার কেন–আমার ব্লড ডিসেন্ট্রিও হয় নাই।”
“তাহলে যে বলল—”
“আর কী কী বলেছে ঐ মিচকি শয়তান ঐ পিছলা পাঙাস মাছ?”
“বলেছে তুমি ঘুমের মাঝে আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করো—”
ছোটাচ্চু গরম হয়ে বলল, “আর কী বলেছে?”
“বলেছে যে তুমি বলেছ বাংলা সাহিত্যে পোস্ট মডার্ন পোয়েট্রি নাই–”
ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে বলল, “আমি বলি নাই।”
“তুমি ঘুমের মাঝে বলেছ।”
“আমি ঘুমের মাঝে বলি নাই।”
ছোটাচ্চু আর ফারিহাপু একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ছোটাচ্চু একটা চাপা গর্জনের মতো শব্দ করল, বলল, “আর তুমি কি শুনতে চাও ঐ ফাজিল ডাবল ক্রস বাইম মাছ আমার কাছে কী বলেছে?”
ফারিহাপু একটু ভড়কে গিয়ে বলল, “কী বলেছে?”
“বলেছে তুমি দিন-রাত কবিতা পড়ে এখন জানতে পেরেছ যে বাংলা সাহিত্যে উত্তর আধুনিক কবিতা আছে।”
ফারিহাপু বলল, “আমি বলি নাই।”
আরো বলেছে, “আমার সাথে ব্রেক-আপ হওয়ার কারণে তোমার এত মন খারাপ যে তুমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছ-”
“আমি চাকরিটা ছেড়ে দিব কিন্তু অন্য কারণে।”
ছোটাচ্চু বলেছে, “আর বলেছে”
“কী বলেছে?”
“বলেছে তুমি বলেছ আমার হৃদয়টা ফাটাফাটি–”
“ফাটাফাটি?”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “ঐ পাজির পা ঝাড়া মিচকি শয়তান পিছলা পাঙাসগুলো কী করেছে দেখেছ? তুমি দেখেছ?”
ফারিহাপু মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু হিংস্র বাঘের মতো গর্জন করে বলল, “আজকে আমি খুন করে ফেলব। সবগুলোর মাথা টেনে ছিঁড়ে ফেলব, ধড় থেকে আলাদা করে ফেলব–” তারপর হুংকার দিয়ে ডাকল, “টুনি–প্রমি–শান্ত-কোথায় তোরা?”
প্রথমে কোনো সাড়া-শব্দ নেই। ছোটাচ্চু দ্বিতীয়বার হুংকার দেওয়ার পর আস্তে আস্তে সবাই মাথা নিচু করে ঘরের ভিতর ঢুকল। ঘরে ঢুকে মেঝের দিকে তাকিয়ে সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল।
ছোটাচ্চুর নাক দিয়ে গরম বাতাস এবং চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছিল, সে বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোদের এত বড় সাহস? আমাদের কাছে মিথ্যা কথা বলিস? আমাদের সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলিস? এই বয়সে এই রকম মিথ্যা কথা বলা শিখেছিস, বড় হয়ে তোদের কী হবে? হার্ডকোর ক্রিমিনাল হবি?”
কেউ কোনো কথা বলল না, বড়রা যখন রেগে যায় তখন তাদের রাগটা বের হতে দেওয়ার জন্যে সুযোগ দিতে হয়। তখন কথাবার্তা বলা ঠিক না।
ছোটাচ্চু আবার বলল, “কোথা থেকে এই দুই নম্বরি কাজকর্ম শিখেছিস? আমি কিছু বলি নাই দেখে বেশি লাই পেয়ে গেছিস? খুন করে ফেলব সবগুলোকে। মাথা টেনে ছিঁড়ে ফেলব–আমার সাথে রংবাজি? আমার সাথে গিরিংবাজি? আমার সাথে মামদোবাজি?”
ছোটাচ্চু টানা চিৎকার করতে থাকল, শেষ পর্যন্ত যখন দম নেবার জন্যে একটু থেমেছে তখন টুনি দুর্বলভাবে বলল, “ছোটাচ্চু তুমি এত রাগ হচ্ছে কেন? তোমার কপাল ভালো যে আমরা অরিজিনাল প্যানে যাই নাই। দুই নম্বর প্ল্যানটা নিয়েছি।”
ছোটাচ্চু একেবারে হকচকিয়ে গেল, বলল, “অরিজিনাল প্যান? সেটা আবার কী?”
“অরিজিনাল প্ল্যানটা আরো ডেঞ্জারাস ছিল। ঝুমু খালার প্ল্যানগুলো সবসময় ডেঞ্জারাস হয়।”
“ঝুমু খালা? এর মাঝে ঝুমু খালা কোত্থেকে এসেছে?”
টুনি বলল, “এইসব ব্যাপারে ঝুমু খালা খুব ভালো প্ল্যান দিতে পারে।”
ছোটাচ্চু গরম হয়ে বলল, “একটু পরিষ্কার করে বলবি, কোন সব ব্যাপার?”
টুনি ঠাণ্ডা গলায় বলল, “না বোঝার কী আছে? তুমি না এত বড় ডিটেকটিভ, তুমি বুঝতে পারছ না কোন সব ব্যাপার?”
ছোটাচ্চু এবারে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল, ব্যাপারটা কী বুঝে গেল, তখন তাদের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগল। যার অর্থ এখন প্রতি-আক্রমণ করার সময় হয়েছে, টুনি প্রথমে প্রতি আক্রমণ শুরু করল, বলল, “তোমরা বড় মানুষেরা ঝগড়া করবে আর আমাদের সেটা সামলাতে হবে?”
আরেকজন বলল, “তোমরা জানো আমরা তোমাদের জন্যে কত কষ্ট করেছি?”
আরেকজন বলল, “এত বড় হয়েছ, এখনো ছোট বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করো, তোমাদের লজ্জা করে না?”
ছোট একজন বলল, “ছোট বাচ্চারা মোটেই ঝগড়া করে না। বড় মানুষেরা ঝগড়া করে।”
আরেকজন বলল, “ঝগড়া করেছ তো করেছ, এখন মিটমাট করে ফেলবে না?”
আরেকজন বলল, “একজন ছেলে দেবদাস আরেকজন মেয়ে দেবদাস।”
“ঝগড়া করার কোনো কারণ আছে? উত্তর না কি দক্ষিণমুখী কবিতা নিয়ে ঝগড়া।”
“কবিতা উত্তরমুখী হলে হবে, দক্ষিণমুখী হলে হবে–তোমরা সেটা নিয়ে কেন ঝগড়া করবে?”
শান্ত বলল, “দুনিয়া থেকে কবিতা জিনিসটাই উঠিয়ে দেওয়া দরকার। দুনিয়ার সব ঝামেলা করে কবিতা। সব কবিদের ধরে ফাঁসি দিয়ে দেওয়া দরকার।”
কবিতা কখন ঝামেলা করল এবং কবিদের ফাঁসি দিয়ে সেই সমস্যা কীভাবে মেটানো যাবে সেটা কেউ বুঝতে পারল না, এবং সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাল না। প্রতি-আক্রমণের সময় এগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না, সবাই মিলে হইচই চিৎকার করতে থাকে।
হঠাৎ করে রিনরিনে গলায় গুচ্ছু বলল, “এখনই একজন আরেকজনকে ধরে চুমু খাও”
ছোটাচ্চু চোখ বড় বড় করে গুড়ুর দিকে তাকাল, বলল, “এই পাজি ছেলে, তুই চুমু খাওয়ার কী বুঝিস?”
“আমি সিনেমায় দেখেছি।”
“কী সিনেমা দেখিস আজকাল?”
“বড়দের সিনেমা।”
“তুই বড়দের সিনেমা দেখিস? সাহস তো কম না–”
“ছোটদের সিনেমা নাই, আমি কী করব?”
টুনিও তখন সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এলো, বলল, “গুড্ডু যখন আম্মুর সাথে ঝগড়া করে তখনো তো আম্মু গুচ্ছুকে আদর করে চুমু খায়। সেজন্যে বলেছে।”
বাচ্চারা হঠাৎ করে লক্ষ করল ফারিহাপু মুখে আঁচল দিয়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করছে। শুধু তা-ই না, ছোটাচ্চু খুব রেগে আছে। সেরকম ভঙ্গি করলেও মুখের মাঝে একটা চাপা হাসি উঁকি দিতে শুরু করেছে। সবাই বুঝতে পারল খুব দ্রুত বিপদ কেটে যাচ্ছে।
ফারিহাপু এতক্ষণ কথা বলে নাই, এই প্রথম কথা বলল, “তোমাদের অরিজিনাল প্ল্যানটা এখনো শোনা হয়নি।”
শান্ত বলল, “এটা না শোনাই ভালো।”
“শুনি তবুও।”
টুনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তোমরা যখন ঝগড়া করেছ তখন তোমাদের যেরকম মন খারাপ হয়েছিল আমাদের তার থেকে বেশি মন খারাপ হয়েছে। তোমাদের ঝগড়া কীভাবে মিটানো যায় সেটা নিয়ে আমাদের একটা মিটিংয়ে ঝুমু খালা ছিল। ঝুমু খালা বলেছে তাদের গ্রামে একশ’ কুড়ি না হলে একশ’ চল্লিশ বছর বয়সের জরিনি বেওয়া থাকে, তার পান পড়া দুইজনকে দুইটা দিলে সাথে সাথে মিলমিশ হয়ে যাবে।”
প্রমি বলল, “কিন্তু আমরা সেই পান পড়া কোথায় পাব?”
টুনি বলল, “আমি অবশ্যি ভাবিজ, কবজ, পান পড়া বিশ্বাস করি। মনে নাই–”
টুনি কী মনে করানোর চেষ্টা করছে ছোটাচ্চু খুব ভালো করে বুঝতে পারল, তাই তাড়াতাড়ি বলল, “হ্যাঁ, মনে আছে, মনে আছে—”
“তাই আমরা অন্য কী করা যায় চিন্তা করছিলাম।”
প্রমি বলল, “ঝুমু খালা বলল, মেয়েদের মন খুব নরম হয় তাই যদি ছোটাচ্চুর কঠিন কোনো অসুখ হয় তাহলে ফারিহাপু সবকিছু ভুলে ছুটে এসে মিলমিশ করে ফেলবে।”
শান্ত বলল, “কঠিন অসুখ হচ্ছে কলেরা না হয় যক্ষ্মা। সেই রোগের জীবাণু কই পাব?”
টুম্পা বলল, “তখন ঝুমু খালা বলল, বড় অসুখ যদি না করানো যায় তাহলে ঠ্যাঙ ভেঙে দিলেও হবে।”
ছোটাচ্চু এবারে একটা চিৎকার করে উঠল, “ঠ্যাং ভেঙে দিবে?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। সেইটা ছিল অরিজিনাল প্ল্যান। সিঁড়ির মাঝে কলার ছিলকে রেখে তোমাকে একটা ধাক্কা দিবে, কলার ছিলকের উপর পা পড়ে সিঁড়ি দিয়ে তুমি গড়িয়ে পড়বে।”
টুম্পা মনে করিয়ে দিল, “শান্ত ভাইয়া সেইটা করবে!”
টুনি বলল, “তোমার খুশি হওয়া উচিত ছিল যে, আমরা অরিজিনাল প্ল্যানটা কাজে লাগাই নাই। তার বদলে এই প্ল্যানটা কাজে লাগিয়েছি।”
ফারিহাপু বলল, “শোনো, তোমাদের একটা কথা বলি। ভবিষ্যতে যদি কখনো অন্য কাউকে এরকম কিছু করতে হয়, খবরদার ব্লাড ক্যান্সারের কথা বলবে না।” ফারিহাপুর মুখটা হঠাৎ কেমন যেন দুঃখী দুঃখী দেখাতে থাকে, মনে হয় বুঝি কেঁদে ফেলবে। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল, তারপর প্রায় ভাঙা গলায় বলল, “তোমরা চিন্তাও করতে পারবে না গত চব্বিশ ঘণ্টা আমার কী গিয়েছে” ফরিহাপু আবার ঠোঁট কৃার্মড়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে থাকে।
প্রথমে টুনি ছুটে গিয়ে ফাৱিহাপুর সামনে গিয়ে বসে তার হাত দুটো ধরে ফেলল, তারপর ফিসফিস করে বলল, “আমার খুব খারাপ লাগছে ফারিহাপু, আমরা তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছি–প্লিজ ফারিহাপু তুমি মন খারাপ কোরো না, তুমি আমাদের উপর রাগ হয়ো না–আমরা বুঝতে পারছিলাম না কী করব–
টুনির দেখাদেখি অন্য সবাই তখন ফারিহাপুর কাছে গিয়ে তাকে ঘিরে বসে ধরে বলল, “প্লিজ ফারিহাপু প্লিজ”
আর তখন ফারিহাপু বাচ্চাদের মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল, আর তাকে কাঁদতে দেখে অন্যরাও কাঁদতে শুরু করল।
ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ এই দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর কেশে গলা একটু পরিষ্কার করে বলল, “ইয়ে মানে, ব্লাড ক্যান্সারের কথাটা বলেছে আমাকে নিয়ে–কান্দাকাটি যদি করতে হয় তাহলে আমাকে ধরে কান্দাকাটি করবি, ফারিহাপুকে ধরে কাঁদছিস কেন?”
প্রমি বলল, “তুমি যদি এটা বুঝতে তাহলে এই অবস্থা হতো না। সব দোষ তোমার।”
“আমার?”
“হ্যাঁ।” টুম্পা বলল, “নিশ্চয়ই তোমার বুকে লোম নাই। নিষ্ঠুর মানুষের বুকে লোম থাকে না।”
“তোর বুকে লোম আছে ফাজিল কোথাকার?”
“আমি ছোট। তা ছাড়া আমি মেয়ে। বুঝেছ?”
যখন সবাই কান্নাকাটি থামিয়ে চোখ-নাক-মুখ মুছে একটু শান্ত হলো তখন ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে অনেক হয়েছে–এখন তাহলে পুতুলের বিয়ে শুরু হোক।”
তখন সব বাচ্চারা একে অন্যের দিকে তাকাল, কেউ কোনো কথা বলল না। ছোটাচ্চু বলল, “কী হলো? পুতুলের বিয়েটাও কি মিছিমিছি? ষড়যন্ত্রের অংশ?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “এটা একটুখীনি ষড়যন্ত্রের অংশ হলেও পুতুলের বিয়েটা মিছিমিছি ছিল না। এটা সত্যিকারের বিয়ে ছিল। কিন্তু–”
“কিন্তু কী?”
আবার সবাই থেমে গেল, একে অন্যকে গুঁতো দিয়ে বলতে লাগল, “তুই বল–তুই বল–”
ছোটাচ্চু বলল, “কী হলো? বলবি কী হয়েছে?”
শেষ পর্যন্ত টুনি গলা পরিষ্কার করে আবার বলতে শুরু করল, “আসলে হয়েছে কী–যখন রিংকুর ছেলে বরযাত্রী হয়ে এসেছে তখন সবাই মিলে আমরা গেট ধরেছি। তখন বরযাত্রীর পক্ষ থেকে শান্ত বলেছে, যৌতুক না দিলে সে বিয়ে দেবে না।”
ছোটাচ্চু বলল, “ছেলের মা হচ্ছে রিংকু তাহলে শান্ত কেন যৌতুক চায়? এটা তো রীতিমতো সন্ত্রাসী কাজকর্ম।”
টুনি বলল, “তুমি ঠিক বলেছ ছোটাচ্চু। শান্ত ভাইয়া আসলে সন্ত্রাসী লাইনেই যাচ্ছে। আমরা তাকে বলেছি যৌতুক হচ্ছে বেআইনি। যৌতুক চাইলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে-কিন্তু শান্ত ভাইয়া বলল যৌতুক না দিলে সে বিয়ে হতে দিবে না। তাই শেষ পর্যন্ত আমরা যৌতুক দিতে রাজি হলাম”
ফারিহাপু বলল, “কী সর্বনাশ! যৌতুক কী দিতে হবে?”
শান্ত অপরাধীর মতো মুখ করে বলল, “বেশি কিছু না ফারিহাপু, মাত্র একশ’ টাকা।”
“তাও রক্ষা।”
টুনি বলল, “পুতুলের বিয়ে, সবকিছুই মিছিমিছি তাই আমরা ভেবেছি টাকাটাও মিছিমিছি। তাই কাগজ কেটে আমরা মিছিমিছি একশ’ টাকার নোট বানিয়ে শান্ত ভাইয়াকে দিয়েছি, তখন শান্ত ভাইয়া বলল, মিছিমিছি একশ টাকা দিলে হবে না, সত্যি সত্যি একশ’ টাকা দিতে হবে–”
ছোটাচ্চু আর ফারিহাপু চোখ কপালে তুলে বলল, “সত্যি সত্যি একশ’ টাকা! কী সর্বনাশ!”
শান্ত বলল, “এত বড় বিয়ে, কোনো খরচপাতি হবে না এটা ঠিক না। সেই জন্যে”
টুনি বলল, “আমরা রাজি হই নাই। তখন শান্ত ভাইয়া পুতুলটা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল–আমরাও ধরেছি যেন নিতে না পারে। তখন—” টুনি আবার থেমে গেল।
“তখন কী?”
“তখন পুতুলের মাথাটা ছিঁড়ে আলগা হয়ে গেল। মাথাটা শান্ত ভাইয়ের কাছে, শরীরটা আমাদের কাছে!”
“এখন কী হবে?”
“বিয়েটা পিছিয়ে দিতে হবে।” রিংকু মুখ গম্ভীর করে বলল, “শান্ত ভাইয়া মাথাটা ফিরিয়ে দিলে আমার ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করব। মাথাটা সেলাই করে লাগানো হবে।”
ফারিহাপু জানতে চাইল, “হাসপাতালের সার্জন কে?”
“ঝুমু খালা। ঝুমু খালা এক নম্বর সার্জন।”
“সেলাই করে লাগাতে পারবে?”
“পারবে।”
ছোটাচ্চু গম্ভীর মুখে শান্তর দিকে তাকাল, “শান্ত।”
“বলো ছোটাছু।”
“এক্ষুনি রিংকুর ছেলের মাথা ফিরিয়ে দে। যদি কোনোদিন যৌতুক চাস তাহলে তোর খবর আছে।”
শান্ত পকেট থেকে পুতুলের মাথাটা বের করে রিংকুর হাতে দিয়ে বলল, “আসলে আমি ঠাট্টা করছিলাম! এরা ঠাট্টাও বুঝে না।”
ছোটাচ্চু বলল, “এরপর আর এরকম ঠাট্টাও করা যাবে না। মনে থাকবে?”
“থাকবে।”
ফারিহাপু বলল, “তাহলে এখন কি সব শেষ?”
প্রমি বলল, “না শেষ না। এখন খাওয়া-দাওয়া হবে।”
“মিছিমিছি নাকি সত্যি সত্যি?”
“সত্যি সত্যি। ঝুমু খালা খাবার তৈরি করেছে।”
ছোটাচ্চু দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “এই ঝুমু খালা কেমন করে এই বাসায় থাকে আমি দেখব। কী ডেঞ্জারাস মেয়ে–আমার ঠ্যাঙ ভেঙে ফেলার বুদ্ধি দেয়!”
ফারিহাপু হি হি করে হেসে বলল, “উদ্দেশ্যটা মহৎ! মহৎ উদ্দেশে কাজ করলে কোনো সমস্যা নাই।”
ছোটাচ্চু বিড়বিড় করে বলল, “আমি মহৎ উদ্দেশের খেতা পুড়ি।”
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, এই বাসায় তোমার যেটুকু গুরুত্ব, কুমু খালার গুরুত্ব তার থেকে অনেক বেশি। ঝুমু খালা ইচ্ছে করলে তোমাকে বাসা থেকে বের করে দিতে পারবে। তাই খামোখা ঝুমু খালার পিছনে লাগতে যেয়ো না।”
ছোটাচ্চু বলল, “সেইটাই হয়েছে মুশকিল। এই বাসায় আমার কোনো গুরুত্ব নাই!”
.
সবাই মিলে বিয়ের খাওয়া খেলো, ডাল পুরি, কাবাব আর পায়েস। সাথে ফারিহাপুর আনা মিষ্টি। তারপর ফারিহাপু বাসায় যাবার জন্যে রেডি হলো। অনেক দিন পর ভাব হয়েছে তাই ছোটাচ্চু ফারিহাপুকে এক সেকেন্ডের জন্যে চোখের আড়াল হতে দিচ্ছে না। ফারিহাপু যখন বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হবে তখন ছোটাচ্চু বলল, “আমি তোমাকে পৌঁছে দেই?”
ফারিহাপু বলল, “পৌঁছে দিবে? ঠিক আছে, পৌঁছে দাও!”
ছোটাচ্চু তখন তার ঘরে গেল মানি ব্যাগ, টেলিফোন আনতে। টুনি তখন ফারিহাপুর হাত ধরে বলল, “ফারিহাপু।”
“বলো।”
“তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ?”
“না রাগ করিনি।”
“তোমাকে একটা কথা বলি?”
“বলো।”
“ছোটাচ্চু মানুষটার বুদ্ধি খুব বেশি নাই, কিন্তু মানুষটা খুব ভালো।”
“জানি।”
“তুমি না থাকলে ছোটাচ্চুর কিন্তু কোনো বুদ্ধির সাপ্লাই থাকবে না।”
“সেটা হয়তো সত্যি নাও হতে পারে।”
“না ফারিহাপু এটা সত্যি। তাই–”
“তাই কী?”
টুনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ছোটাচ্চু তোমার সাথে যত ঝগড়াই করুক তুমি কখনো ছোটাচ্চুকে ছেড়ে যেও না। প্লিজ!”
ফারিহাপু মুখ টিপে বলল, “আর কিছু?”
“হ্যাঁ। আমরা কিন্তু তোমাকে সব সময়ই ফারিহাপুই ডাকব।”
ফারিহাপু একটু অবাক হয়ে বলল, “তাই তো ডাকবে!”
“মানে বলছিলাম কী–” টুনি বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “তোমাকে কিন্তু ছোটাচ্চি ডাকব না!”
ফারিহাপু টুনির দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল, তারপর হি হি করে হাসতে থাকল।
Thanks a lot
ভাই হ্যারি পটার সিরিজের বইগুলা কবে পাবো?