০৬. চিরবিদায়

নতুনবউঠান, একদিন দুপুরে তোমার ওই ভিজে হারটি আমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলে। আজ তোমাকে বলি—তোমার মধ্যে আমি পেয়েছি বৈষ্ণবকাব্যের রাধাকে। সেই তারল্য। সেই চাপল্য। সেই হাসি। সেই চোখ।

একদিন চণ্ডীদাসের রাধা বৃষ্টির মধ্যে কৃষ্ণকে বলল, কানাই, তোমার এই নৌকাটিকে যমুনার জলে ডুবিয়ে দাও। আর পাছে যমুনার জলে আমি ভিজে যাই, তুমি আমাকে কোলে করে যমুনা পার হও।

নতুনবউঠান, রাধা বলতে আমি যা কিছু ভাবতে পারি, তুমি তার সবটুকু। নৌকা ডুবিয়ে আমি কবে পাগলের মতো নেমে পড়েছি যমুনার জলে—তোমারই জন্যে নতুনবউঠান!’

ঠাকুরপো, তুমি একদিন এ-চিঠি লিখেছিলে আমাকে! আর আজ তোমার কবিতায় আমার। আদরের, আমার শরীরের, তোমার-আমার কোনও নির্জন স্মৃতির চিহ্নমাত্র নেই। আজ আমি পুরাতন। আজ আমাকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে তোমার জীবনে নতুন খেলার জন্যে। আজ আমার সামনে শুধুই অন্ধকার। তবে তাই হোক ঠাকুরপো, জ্বলুক-পুড়ুক আমার শরীর। তারই সঙ্গে জ্বলে-পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক তোমার এই চিঠিটিও।

আদরের ঠাকুরপো, আবার আমার জীবনের শেষ প্রহরের ছন্নছাড়া মন পথ হারিয়ে চলে এল। নতুন এক মনকেমনে। তখন তুমি ছিলে অন্য মানুষ। আমার প্রাণের মানুষ তো। শুধু আমারই ছিলে তখন। তোমার দ্বিতীয়বার বিলেত যাওয়ার কথা উঠতেই একা থাকার যন্ত্রণার ভয়ে আমি চেষ্টা করলাম আত্মহত্যার। মরলাম না। কিন্তু তৈরি হল আমার নতুন বদনাম। নতুন লজ্জা। আমার পক্ষে ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ অসহনীয় হয়ে উঠল। আমি তোমার নতুনদাদাকে নিয়ে চলে এলাম চন্দননগরে। সেখানে ভাড়া করা হল নীল ব্যবসায়ী মোরান সাহেবের বিরাট কুঠিবাড়ি। সেখানেই উঠলাম আমরা দু’জনে বুঝলাম দু’জনেও একা হওয়া যায়। তোমার নতুনদাদা থাকেন তাঁর নিজের জগতে। আর আমি তোমার জন্যে সারাক্ষণ দুঃসহ মনকেমন নিয়ে, আমার নিজস্ব বেদনা ও অপমানবোধ নিয়ে, নির্বাসিত থাকলাম আমার জগতে। তোমার জাহাজ চলল তোমাকে নিয়ে মাদ্রাজে, সেখান থেকে শুরু হবে তোমার দ্বিতীয়বার বিলেতযাত্রা।

কিন্তু বিলেত গেলে না তুমি! মাদ্রাজে জাহাজ থেকে নেমে চলে এলে আমার কাছে। ঠাকুরপো, তুমি এলে, আমার শরীর-মনে জোয়ার এল। মনে হল, পৃথিবীটা কী সুন্দর। আমার হৃদয়বাড়ি ফিরল নির্বাসন থেকে।

কিন্তু কেন তুমি বিলেত গেলে না ঠাকুরপো? পাছে ঠাকুরবাড়ির মহিলামহলের বিষাক্ত পরিবেশে একাকিত্বের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আমি আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করি—তাই তো? তুমি ফিরে এলে আমার আশ্রয় হয়ে! কিন্তু বাঁচাতে কি পারলে আমাকে? আমার প্রেমই আমার নিয়তি—তুমি বাঁচাবে কীভাবে!

ঠাকুরপো, যদি বলি বিলেতের পথ থেকে তোমার এই ফিরে আসার মধ্যেই নিহিত ছিল আমার। মরণের বীজসহ্য করতে পারবে? না না, আমি চলে যাওয়ার পরে কোনওরকম অপরাধবোধে ভুগে কষ্ট পেয় না তুমি। কষ্ট দিও না তোমার একরত্তি নতুন বউটিকে। এ-আমার ভাগ্য তোমার তো কিছু করার নেই। তোমার ভালোবাসাই তো তোমাকে টেনে এনেছিল আমার কাছে। বাকিটুকু তো তোমার-আমার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল না।

ঠাকুরপো, তোমার অনেক আগে আমার প্রেমে পড়লেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। তিনি তোমার নতুনদাদার বন্ধু। তাঁর সূত্রেই বিহারীলাল আসেন এ-বাড়িতে। বন্ধুত্ব হল আমার সঙ্গেও। আমি ছিলাম তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠিকা, শ্রোতা। তিনি শুধু তাঁর নতুন লেখা আমাকে শোনাতেই ভালোবাসতেন না, ভালোবাসতেন আমার হাতের রান্না খেতে।

একদিন আমাকে বললেন, ‘তোমার হাতের স্পর্শ আছে বলেই তোমার হাতের রান্না এত ভালো।

কথাটা আমার মধ্যে ঠাকুরপো তৈরি করল নতুন তরঙ্গ। এমন কথা এ-বাড়িতে কারও মুখে আগে কখনও শুনিনি। তোমার নতুনদাদার জন্যে তো আমি কত নতুন-নতুন রান্না করি। তিনি সেই। রান্না খেয়ে কোনওদিন আমাকে আমার আঙুলের স্পর্শের উল্লেখ করেননি। এই দেখো, বিহারীলালের কথা বলতে গিয়ে একটু বাড়াবাড়িই করে ফেললাম আমি তোমার কথাটা ভুলেই গেলাম। ঠাকুরপো, তুমি তো কতবার আমাকে বলেছ, আমি যেদিন সামান্য লঙ্কা দিয়ে তোমার। জন্যে মেখে দিই পানতাভাত সেদিন আর কথা থাকে না! সে তো আমার অঙ্গুলিস্পর্শের গৌরব ঠাকুরপো, তাই না?

একদিন বিকেলবেলা বিহারীলাল এলেন যেন আমার সঙ্গেই কথা বলতে। তখনও তোমার নতুনদাদা কাছাড়িবাড়িতে, নীচের তলায়। আমি ছিলাম নির্জন।

বিহারীলাল বললেন, ‘তুমিই আমার সারদামঙ্গল’ কাব্যের সরস্বতী। তিনটি প্রেরণার স্রোত এসে মিশেছে আমার সারদামঙ্গলে। তিনটি স্রোতই হল বিরহের স্রোত মৈত্রীবিরহ, প্রীতিবিরহ, সরস্বতীবিরহ। তুমিই বসে আছ এই তিন বিরহস্রোতের কেন্দ্রে। ‘ ঠাকুরপো, বিহারীলালের কথাটা যে খুব ভালো বুঝতে পারলাম, তা নয়। কিন্তু বুকের মধ্যে কেমন একটা করতে লাগল। দেখলাম, বিহারীলালের চোখ আবেগে ছলছল করছে। বুঝলাম আমাকে ভালোবেসে উনি কষ্ট পাচ্ছেন। ওঁর জন্যে কষ্ট হল। আবার ভালোও লাগল ঠাকুরপো। আমাকে ভালোবেসে আমার বিরহে কেউ কষ্ট পেতে পারেন! বিহারীলালের কথায় কেন যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম।

সেই সময়ে আমি একটা আসন বুনছিলাম। কার্পেটের আসন। যখনই একলা লাগত, কাজ নেই হাতে, সময় কাটাবার উপায় ছিল ওই আসনটির কাছে ফিরে যাওয়া। মনে মনে চাইতাম, এই। আসনবোনার কাজটি যেন কোনওদিন না শেষ হয়। তোমার নতুনদাদা ঘরে আসেন-ান, দেখেন। খাটের এক কোণে বসে আমি আসন বুনি, কোনওদিন জিগ্যেস পর্যন্ত করেননি কার জন্যে এই আসন। আসনবোনার কাজটির মধ্যেও যে মিশে যেতে পারে মন, ভালোবাসা—এসব কথা তাঁর মনে উদয় হয়নি হয়তো কখনই।

সেদিন বিহারীলালের কথা শোনবার পরেই কী যে একটা কাণ্ড ঘটে গেল মনের মধ্যে! যে মানুষটির মধ্যে তৈরি হয়েছে আমার করস্পর্শের জন্যে এমন আকুল আকাঙ্ক্ষা, তাঁকে এমন কিছু একটা উপহার দিতে আমার মন চাইল, যার মধ্যে চিরদিন থেকে যাবে আমার মন, আমার ভালোবাসা, আমার হাতের ছোঁয়া। দৌড়ে আমার ঘরে এসে ওই আসনটির কোণে বুনতে শুরু করলাম বিহারীলালের নাম। ক’দিন পরে আসনটি তুলে দিলাম আমার প্রিয় কবির হাতে সেইদিন আমি প্রথম ‘অসতী’ হলাম ঠাকুরপো, কারণ ওই আসনটিই ছিল বিরাহীলালের প্রতি আমার প্রেমপত্র।

আসনটি উনি দু’হাতে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন আমার পানে। আমি লজ্জায় ওঁর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আমার মধ্যে যে একেবারেই কোনও অন্যায়বোধ ছিল না, তাও নয় ঠাকুরপো। কিন্তু সেই পাপবোধ, অন্যায়বোধ ছাপিয়ে উঠেছিল আমার এত বছর ধরে চেপে রাখা অভিমান—ছাপিয়ে উঠেছিল আমার ভালোবাসা। সেদিন থেকে আমার প্রতি বিহারীলালের ব্যবহারও গেল বদলে। তিনি চোখ তুলে তাকাতেই পারতেন না আমার দিকে। ক্রমে আমাদের বাড়িতে আসাও কমিয়ে দিলেন। তবে, যখনই লিখতেন। কোনও নতুন কবিতা, চলে আসতেন আমাদের সাহিত্যসভায়। অনেকেই থাকতেন সেই মজলিসে। অবশ্যই থাকতেন তোমার নতুনদাদা। থাকতেন মেজবউঠাকরুণ। কিন্তু আমার মনে হত, হয়তো আরও অনেকেরই মনে হয়েছে একই কথা—বিহারীলাল শুধু আমারই জন্যে লেখেন তাঁর প্রেমের কবিতা। শুধু আমাকেই শোনান। সভায় উপস্থিত বাকিদের কথা তাঁর বোধহয় মনেই থাকে না।

তুমি তখন বিলেতে। ক্রমে আমার মধ্যে তৈরি হল এক গভীর অভাববোধ—কীসের অভাব, সবই তো আছে, তবু অভাববোধ, বিষণ্ণতা, মনকেমন। ঠাকুরপো, মনকেমন তোমার জন্যে। তোমার চিঠি আসে বিলেত থেকে। আসে তোমার কবিতা। আমার মন, আমি বুঝতে পারি, ধীরে-ধীরে সরে যাচ্ছে বিহারীলালের জগত থেকে তোমার জগতে। কেন এমন হচ্ছে, তাও বুঝতে পারি

আমি। এক সময়ে তোমাকে বলতাম, ঠাকুরপো, তুমি কোনওদিন বিহারীলালের মতন লিখতে পারবে না। শুনে তুমি যত না দুঃখ পেতে তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে যেত আরও ভালো লেখার ঝোঁক—বিহারীলালের মতো লেখা নয়। তাঁর প্রভাবমুক্ত অন্য রকম, আরও ভালো লেখা। আমি তখুনি বুঝতে পেরেছিলাম, তোমার প্রতিভা জাতেগোত্রে আলাদা। কিন্তু জানতে দিইনি। তোমাকে—জানতে দিয়ে পাছে তোমার মাথা খেয়ে বসি।

তোমার বিলেত থেকে আসা চিঠিগুলিই আমাকে প্রথম বুঝিয়ে দিল, বিহারীলালের জগতের অনেক দূরে, অনেক বাইরে পা ফেলেছ তুমি বুঝতে পারলাম ঠাকুরপো, তুমি অনেক দূরের যাত্রী, তোমার এ-যাত্রা থামার নয়, যতই তুমি এগোবে, ততই পিছিয়ে যাবে তোমার সামনে। দিগন্তরেখা। বুঝতে পারলাম, তুমি অনন্তের পথিক। ঠাকুরপো, জোড়াসাঁকোর বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে এক বিপন্ন বন্দিনী আমি। তবু পাড়ি দিতে চেয়েছিলাম তোমার সঙ্গে। হতে চেয়েছিলাম তোমার সহযাত্রিণী। কখন আসবে বিদেশ থেকে তোমার চিঠি, শত বাঁধা ডিঙিয়ে অবশেষে পৌঁছবে আমার হাতে–তোমার প্রবাসের পত্রের জন্যে সারাক্ষণ অপেক্ষা করত মন।

তোমার কোনও কোনও চিঠি যত ভালো লাগত, ততটাই–না, তার চেয়েও বেশি কষ্টও দিত আমাকে। আজ মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যেও লিখতে। বিহারীলাল কখনও। আমাকে এইভাবে কষ্ট দিতে পারতেন না। তিনি আমাকে ছাড়া আর কোনও নারীর কথা ভেবেছেন বলেই তো মনে হয় না আমার। প্রেমের ব্যাপারে তিনি নিতান্ত সেকেলে। তুমি। ঠাকুরপো ততটাই আধুনিক। ভালোবাসার মেয়েটিকে তোমার জীবনে অন্য নারীসঙ্গের কথা বলে তার মধ্যে ঈর্ষা জাগিয়ে তুমি আধুনিকতার আনন্দ পাও—এ স্বভাব তোমার, একনিষ্ঠ। বিহারীলালের নয়। তোমার এই স্বভাব আমাকে দুঃখ দেয়। আবার এই স্বভাবই আমাকে তোমার দিকে অমোঘ টানে টেনেছে—যত তুমি অন্য নারীর কথা আমাকে জানিয়েছ ইশারায়, ইঙ্গিতে, ততই মনে হয়েছে তোমাকে সবদিক থেকে নাগপাশের মতো জড়িয়ে ধরে সম্পূর্ণ গ্রাস করে। ফেলি। আজ সেই নাগপাশ থেকে তোমাকে চিরমুক্ত করে দিয়ে যাব। আমাকে তুমি ভুলে যাও ঠাকুরপো।

ঠাকুরপো, ইংল্যান্ড থেকে আমাকে লেখা তোমার একটি চিঠি আমার চোখের সামনে রয়েছে। একটির পর একটি এই রকম চিঠি আমার যন্ত্রণা, আমার একাকিত্ব বাড়িয়ে দিল একদিকে। অন্যদিকে আমার হৃদয়ে আর কারও জন্যে এতটুকু জায়গা রাখল না। সবটুকু জিতে নিল তোমার চিঠি—তুমিই হয়ে দাঁড়ালে আমার জীবনের একমাত্র অধীশ্বর। কবি বিহারীলালকে এতদিনে বড্ড সেকেলে লাগতে লাগল আমার, দেখলাম তোমার সঙ্গে তাঁর কোনও তুলনাই চলে না, তিনি আস্তে-আস্তে নিঃশব্দে ঝরে গেলেন আমার জীবন থেকে।

আবার দ্যাখো, খেই হারিয়ে চোখের সামনে প্রবাস থেকে লেখার তোমার ওই চিঠিটা থেকে কতদূরে সরে এলাম—সেই চিঠিতে তুমি লিখেছ:

‘প্রাণের নতুনবউঠান,

সেদিন ফ্যান্সি-বল-এ অর্থাৎ ছদ্মবেশী নাচে গিয়েছিলাম। কত মেয়ে-পুরুষ নানা রকম সেজেগুজে সেখানে নাচতে গিয়েছিল। প্রকাণ্ড ঘর, গ্যাসের আলোয় আলোকাকীর্ণ, চারদিকে ব্যান্ড বাজছে, ছ-সাত-শো সুন্দরী, সুপুরষ। ঘরে ন স্থানং তিলধারয়েৎ। চাঁদের হাট তো তাকেই বলে। এক-একটা ঘরে দলে-দলে স্ত্রী-পুরুষ হাত ধরাধরি করে ঘুরে-ঘুরে নাচ আরম্ভ করেছে, যেন জোড়া-জোড়া পাগলের মতো। এমন ঘেঁষাঘেঁষি যে কে কার ঘাড়ে পড়ে ঠিক নেই। একটা ঘরে শ্যাম্পেনের কুরুক্ষেত্র পড়ে গিয়েছে, মদ্যমাংসের ছড়াছড়ি, সেখানে লোকারণ্য। এক একটা মেয়ের নাচের বিরাম নেই, দু-তিন ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত তার পা চলছে। মন অধিকার। করবার যত প্রকার গোলাগুলি আছে বিবিরা তা অকাতরে নির্দয়ভাবে বর্ষণ করছেন। কিন্তু ভয়। কোরো না নতুনবউঠান, আমার মতো পাষাণ হৃদয়ে তার একটু আঁচড়ও পড়েনি। একজন দিশি মেয়ে সেজে গিয়েছিলেন—তাঁকে ভিড়ের মধ্যেও আলাদা করে দেখতে পেলাম। একটা শাড়ি, একটা কাঁচুলি তাঁর প্রধান সজ্জা, তার ওপরে একটা চাদর পরেছিলেন, তাতে ইংরিজি কাপড়ের চেয়ে তাঁকে ঢের ভালো দেখাচ্ছিল। এই ছদ্মবেশী নাচের পার্টিতে আমি সেজে ছিলাম বাংলার জমিদার। জরি দেওয়া মখমলের কাপড়, জরি দেওয়া মখমলের পাগড়ি, ইত্যাদি। এই পর্যন্ত বেশ ছিল। কিন্তু জনকতক ব্যক্তি আমাকে জোর করে দাড়িগোঁফ পরালেন। আর দু-একজন মহিলা আমাকে বললেন, দাড়ি-গোঁফে বেশ মানিয়েছে আমাকে, ভারী ভালো দেখাচ্ছে। কিন্তু নতুনবউঠান, যে-সকল সুন্দরীদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে এখানে, তাঁরা কেউই দাড়ি গোঁফধারী আমাকে চিনতে না পারায় আমি কাছে যেতেই তাঁরা সরে পড়তে লাগলেন! শেষ পর্যন্ত দাড়ি-গোঁফ উৎপাটন করে আমাকে নিজরূপে প্রকাশিত হতেই হল নতুনবউঠান। ‘

ঠাকুরপো, তোমার এ-চিঠি পেয়ে আমি মজা পেয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু বুকের মধ্যে হু-হু করেও উঠেছিল। আমি স্পষ্ট যে দেখতে পাচ্ছিলাম, ওই শাড়ি আর কাঁচুলি পরা বিদেশিনী সুন্দরীর সঙ্গে তুমি নাচ্ছ তোমার সঙ্গে নাচতে-নাচতে খুলে গিয়েছে তার পোশাকের ওপরে ঢাকনার মতো চাদরটি—তুমি আর সে পাগলের মতো শুধু নাচ্ছ, তোমরা এত ঘেষাঘেঁষি যে দুজনকে কিছুতেই আলাদা করতে পারছি না আমি। একলা ঘরে এ-চিঠি বুকে জড়িয়ে ধরে কত কেঁদেছি ঠাকুরপো। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করেছে তোমার কাছে–চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়েছে, ফিরে এসো ঠাকুরপো!

বিলেত থেকে তুমি যেসব চিঠি লিখেছ আমাকে, তাদের অনেকটাই জুড়ে আছে তোমার মুক্ত নারীসঙ্গের আনন্দ—যেমন নারীর সঙ্গ তুমি এদেশে চাইলেও পাবে না, লিখেছ তাদেরই কথা। এই সুন্দরী বিদেশিনীদের ভিড়ে আমি কোথায় হারিয়ে গেছি ঠাকুরপো! এসব চিঠি-পড়তে পড়তে খালি মনে হত, তোমার জীবন থেকে একেবারে মুছে গিয়েছি আমি। আমি সহ্য করতে পারতাম না। আর সেইজন্যই বেশি করে চাইতাম তোমার সঙ্গক্রমশই বুঝতে পারছিলাম। তোমার কোনও বিকল্প নেই আমার জীবনে। মনে মনে ভাবতাম, একবার ফিরে এসো, তোমাকে সবদিক থেকে জড়িয়ে-জড়িয়ে আমি গ্রাস করে ফেলব—কোনও মুক্তির পথ থাকবে না তোমার।

কেন ঠাকুরপো, কেন কেন তুমি লিখেছিলে এ-রকম চিঠি? তোমার আধুনিক মন আমাকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে পাগল করে তোমার প্রেমে পতঙ্গের মতো আটকে ফেলতে চেয়েছিল? তুমি লিখেছিলে লন্ডন থেকে–

‘গত মঙ্গলবারে একজনের বাড়িতে একটি নাচের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। আমি পরেছিলাম নাচপার্টির উপযুক্ত পোশাক। আমার শার্টটি ছিল একেবারে নিষ্কলঙ্ক ধবধবে সাদা। তার ওপরে। প্রায় সমস্ত বুকখোলা এক বনাতের ওয়েস্টকোট। ওয়েস্টকোটের মধ্যে সাদা শার্টের সমুখ। দিকটা বেরিয়ে। গলায় সাদা নেকটাই। হাতে ছিল একজোড়া সাদা দস্তানা। নতুনবউঠান, দস্তানা বিলেতের শীতের জন্য নয়। যে-মহিলাদের হাতে হাত দিয়ে নাচব, আমার খালি হাত লেগে তাদের হাত যাতে ময়লা না হয়, সেই জন্য দস্তানা। রাত সাড়ে ন’টায় গিয়ে পৌঁছেছিলাম নাচ পার্টিতে—ঘরের মধ্যে রমণীদের রূপের আলো গ্যাসের আলোকে ম্রিয়মাণ করে দিয়েছে!

নতুনবউঠান, সেই নাচঘরে ঢুকে মনে হল, রূপের উৎসব পড়ে গিয়েছে। ঘরের ভিতরে প্রবেশ করা মাত্রই চোখে বাঁধা লেগে গেল। ঘরের একপাশে পিয়ানো, বেহালা, বাঁশি বাজছে, ঘরের চারিধারে কৌচ চৌকি সাজানো, ইতস্তত দেয়ালের আয়নার ওপর গ্যাসের আলো ও রূপের প্রতিবিম্ব পড়ে ঝকমক করছে।

নতুনবউঠান, একটা কথা তোমায় না বলে পারছি না। এ-আমার স্বীকারোক্তি। নাচবার ঘরের মেঝেটি ছিল কাঠের। তার ওপর কার্পেট পর্যন্ত পাতা নেই। সে কাঠের মেজে এমন পালিশকরা যে পা পিছলে যায়। তবে তোমার এই দেওরটি ক্রমেই আবিষ্কার করেছে যে, ঘর যত পিছল হয়, ততই নাচবার উপযুক্ত হয়। কেননা একমাত্র পিছল ঘরেই আমার অপটু নাচের গতি সহজ হয়, পা কোনও বাঁধা পায় না, আপনা-আপনি পিছলে যার কাছে যেতে চাই তার কাছেই চলে আসে।

নতুনবউঠান, সাহেবমেমেদের রোম্যান্টিক কল্পনার তারিফ না করে পারছিনে। ঘরের চারিদিকে যে-বারান্দাগুলি আছে তাই গাছপালা দিয়ে ঢেকে কৌচ চৌকি রেখে বানানো হয়েছে প্রণয়ীদের। জন্য মনোরম কুঞ্জ। এর বেশি আর বলছি না, বাকিটুকু তুমি কল্পনা করে নিতে পারো। নাচতে নাচতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে ওই মনোরম প্রেমকুঞ্জই বিশ্রামের উপযুক্ত জায়গা—বিশেষ করে বয়েস যাদের অল্প, তাদের জন্যই এই প্রেমকুঞ্জের বিশেষ আয়োজন।

এই প্রণয়কুঞ্জেই আকস্মিক দেখা পেয়েছি তার! তাকে দেখে একেবারে চমকে উঠেছি আমি— এই শত শ্বেতাঙ্গিনীদের মধ্যে একটি ভারতবর্ষীয়া শ্যামাঙ্গিনী রয়েছে। দেখেই তো আমার বুকটা একেবারে নেচে উঠল। তার সঙ্গে কোনওমতে আলাপ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেম। কতদিন। শ্যামলা মুখ দেখিনি! সত্যি বলছি বউঠান, তোমার মুখটা তোমার চোখ দুটো তাই এই শ্বেতাঙ্গিনীদের দেশে বারেবারে মনে পড়ে। তবে এই শ্যামাঙ্গিনীর মুখটি তোমার মতো নয়, এর মুখে আমাদের বাঙালি মেয়েদের ভালোমানুষি নম্রভাবে মাখানো। তোমার চোখেমুখে। নতুনবউঠান যে ধীময় দুষ্টুমির ভাবটি আছে, তা নেই এই শ্যামাঙ্গিনীর মুখে। মেয়েটির চুল বাঁধা আমাদের দেশের মতো। সাদা মুখ আর উগ্ৰ অসংকোচ সৌন্দর্য দেখে দেখে আমার মনের ভিতরটা ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল—এতদিনে তাই বুঝতে পারলেম। নতুনবউঠান, বিকেল চারটে বাজতে চলল, তবু অন্ধকার হয়ে আসছে। আজ সারাদিন মেঘ, বৃষ্টি, বাদল, অন্ধকার, শীত। আমাদের দেশে যখন বৃষ্টি হয়, তখন মুষলধারে বৃষ্টির শব্দ, মেঘ, বজ্র, বিদ্যুৎ, ঝড়—তাতে একটা কেমন উল্লাসের ভাব আছে। এখানে তা নয়, এখানে টিপটিপ করে সেই একঘেয়ে বৃষ্টি ক্রমাগতই অতিনিঃশব্দ পদসঞ্চারে চলছে তো চলছেই। আমাদের দেশে স্তরে স্তরে মেঘ করে। এখানে আকাশ সমতল, মনে হয় না মেঘ করেছে, মনে হয় কোনও কারণে আকাশের রঙটা ঘুলিয়ে গিয়েছে, সমস্তটা জড়িয়ে স্থাবর-জঙ্গমের একটা অবসন্ন মুখশ্রী। তারই মধ্যে আমার হঠাৎ মনে পড়ছে প্রণয়কুঞ্জে হঠাৎ দেখা সেই শ্যামাঙ্গিনীর মুখ!’

ঠাকুরপো, এ-চিঠির শেষে তুমি ‘পুনশ্চ’ দিয়ে লিখেছ—’নতুন বউঠান, ইটালি থেকে তোমাকে চিঠি লিখতে পারিনি। মনে পড়ে গেল, ইটালির মেয়েদের বড় সুন্দর দেখতে। অনেকটা আমাদের দেশের মেয়ের ভাব আছে। সুন্দর রং কালো কালো চুল, কালো ভুরু, ভালো চোখ, আর মুখের গড়ন চমৎকার। ‘ আমাকে তোমার অন্য নারীসঙ্গের কথা জানিয়ে আঘাত করতে তোমার ভালোলাগত ঠাকুরপো—এই ছিল তোমার আধুনিকতার নিষ্ঠুরতা। আমি যত এইভাবে আঘাত পেয়েছি, ততই হয়তো তোমাকে আরও তীব্রভাবে ভালোবেসেছি। তুমি যে বিহারীলাল নও, তোমার প্রেমে যে খোঁচা আছে, তির্যক আঘাত হানতে পারো তুমি—এসব যত জেনেছি। ততই যেন আরও জানবার জন্য মন আমার তৃষ্ণার্ত হয়েছিল। বিহারীলালকে আসন উপহার দেওয়ার পর তিনি লিখলেন—তোমার আসনখানি /আদরে আদরে আনি / রেখেছি যতন করে। চিরদিন রাখিব।

ঠাকুরপো তোমার কাছ থেকে ছোট-ছোট আঘাত পেতে-পেতে বিহারীলালের গদগদ সমর্পণের ভাবটিকে আমার ক্রমে সেকেলে লাগছিল—এ-কথা অকপটে স্বীকার করছি। কিন্তু তুমি যখন। সুদূর বিলেত থেকে বিদেশিনীদের রূপের কথা লিখতে, তখন আমার বুকের মধ্যে ঈর্ষার যন্ত্রণাও অনুভব করেছি। কী যে ভয় করত আমার—তুমি যদি আর আমার না থাকো! কী নিয়ে থাকব। আমি ঠাকুরপো!

ঠাকুরপো, একলা থাকতে-থাকতে আর নানারকম গঞ্জনা শুনতে-শুনতে এক সময়ে ভাবতে শুরু করেছিলুম, এই রকমই মেয়েমানুষের জীবন। তোমার নতুনদাদা মাঝে মধ্যে আমায় ঘোড়ায়। চড়িয়ে গড়ের মাঠে নিয়ে যেতেন বটে, তবে সেটা ছিল তাঁর বড়মানুষি খেয়াল। আমার মনের খবর, আমার গভীর কিছু চাহিদার খবর তিনি রাখতেন বলে মনে হয় না।

তুমি যেই বিলেত থেকে ফিরে এলে ঠাকুরপো অন্য সুর বাজল আমার জীবনে। কেন যে তুমি আমার জীবনে এইভাবে উজানের মতো এসেছিলে। তুমি ওইভাবে মহাসমারোহে আমার জীবনে না এলে তোমার চলে যাওয়াটা আমাকে এতখানি নিঃস্ব করে দিত না।

একটি দুপুরবেলার কথা আমি ভুলব না কোনওদিন। সেদিন আমার খুব জ্বর ছিল। তুমি পাশে বসে পাখার হাওয়া করছ আমাকে। আমি জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে আছি।

তুমি হঠাৎ বললে, ‘এতদিন আমার জীবনে নারী বলে যেন কিছুই ছিল না। নারী বলে যে কিছু আছে তা তো এতদিন বুঝতেই পারিনি। সে একরকম মন্দ ছিল না। নতুনবউঠান, যেই তুমি। এলে আমার জীবনে, তোমার ভিতর দিয়েই যেন নারীকে চিনলুম। ‘ তোমার কথা শুনে আমার চোখে জল এল ঠাকুরপো। আমি গরিব ঘরের মেয়ে। খুব যে আদর যত্নের মধ্যে বড় হয়েছি, তা তোনয়। ভালোবাসার জন্য বড্ড তেষ্টা ছিল মনের মধ্যে। বিয়ের পরে তোমাদের বাড়ির বউ হয়ে এসে একমাত্র তোমার কাছেই জীবনে প্রথম আদরযত্ন, ভালোবাসা পেয়েছিলাম। তোমাকে তাই প্রথম থেকেই আমি কাছে টেনে নিয়েছিলাম। তার মধ্যে কোনও মিথ্যা ছিল না।

তোমার কথার উত্তরে সেদিন বলেছিলাম—

‘আমার ভিতর দিয়ে তুমি যে নারীকে চিনতে পেরেছ, সে-নারী তো কেবল আমি। আমাকে জানলে মেয়েজাতটাকেই জানা হয়ে গেল, এমন ঠুনকো কথা তোমাকে মানায় না ঠাকুরপো। তাছাড়া, আমি অতি সাধারণ এক গৃহবধূ—তার মধ্যে নারীজাতির কতটুকুই বা প্রকাশ পেতে পারে?’

তুমি উত্তরে বলেছিলে, ‘নতুনবউঠান, তুমি জানো, মাকে আমি বেশি পাইনি। তোমার মতো আমার ছোটবেলাটাও কেটেছে আদরযত্নের অভাবে। মায়ের ঝোঁক ছিল জ্যোতিদাদা আর। বড়দার ওপরেই। আমি ছিলুম তাঁর কালো ছেলে। মা যেদিন আমাদের জীবন থেকে চিরদিনের জন্যে বিদায় নিলেন, তুমি এলে আমার জীবনের সবটুকু জুড়ে। ‘

তোমার কথা শুনে আমি বলেছিলাম, ‘ঠাকুরপো, তোমাকে আমি আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম সব দিক থেকে তুমি যাকে বলেছ নাগপাশের বন্ধন। ধীরে ধীরে আমার শরীর-মন তোমার ডাকে সাড়া দিল। কিন্তু তা বলে তুমি যদি বলো আমার ভিতরেই তুমি জানতে পেরেছ সমগ্র নারীজাতিকে, সেই ভার আমি বহন করতে পারব না ঠাকুরপো। আমি অতি সাধারণ মেয়ে।

তুমি বললে, ‘নতুনবউঠান, তুমি আমার জীবনে আসার আগে কিন্তু বুঝিনি মেয়েরা কত ভালোবাসা, কত আদর ঢেলে দিতে পারে একটা পুরুষের জীবনে। আমি এ-বাড়ির কালো ছেলে। সেই কালো ছেলেকে তুমি এমন ভালোবাসলে কী করে?’

এ-কথা শুনে আমি তোমার হাতটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আমার বুকের মধ্যিখানটিতে রেখে দিলাম অনেকক্ষণ। মনে হল সেখানকার জ্বালা একটু কমছে।

ঠাকুরপো, ১৮৭৮ থেকে ১৮৮০—এ-দু’বছরে আমি একটি কথা ক্রমে বুঝতে পেরেছিলাম, তোমাকে না পেলে আমার পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। এই দু-বছর তুমি ছিলে বিলেতে। আর আমি ছিলাম দিনরাত তোমার বিরহে। যত দিন গিয়েছে, তত বেশি কষ্ট পেয়েছি। এত কষ্ট হয়তো পেতাম না, যদি আমার একটি সন্তান থাকত। তাকে অবলম্বন করেই না হয় বাকি। জীবনটুকু কাটিয়ে দিতাম। ঠাকুরপো, সন্তান না-হওয়ার সব দায়িত্বই, সব অক্ষমতাই আমার ওপর বর্তালো। কোনও ডাক্তারিপরীক্ষা হয়নি, অথচ আমাকেই বহন করতে হল বন্ধ্যাত্বের বদনাম। তোমাকে সব কথা বলতে পারব না, কিন্তু এই বদনাম সহ্য করার নিঃসঙ্গ অপমান থেকে কেউ আমাকে বাঁচালেন না—তোমার নতুনদাদাও নন! আমার যে সন্তান হল না তার জন্য জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির নির্মম পরিবেশে আমিই দায়ী রয়ে গেলাম চিরকাল!

ঠাকুরপো, তুমি যখন বিলেতে, তখন কিছুদিনের জন্য আমার কোলজুড়ে, বুকজুড়ে পেলাম। তোমার ন’দিদি স্বর্ণকুমারীদেবীর ছোট্ট মেয়ে ঊর্মিলাকে। সে সারাদিন থাকত আমার কাছেই। যেন আমিই তার মা। আমি তাকে খাওয়াতাম, পড়াতাম, শোয়াতাম, খেলতাম তার সাথে। আমি তার মামি। হয়ে উঠলাম না। মাতৃত্বের সেই স্বাদ ক্ষণিকের জন্য এসেছিল আমার জীবনে তা কোনওদিন আমার পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

সেটা ছিল ১৮৭৯-র ৩১ ডিসেম্বর—আমার জীবনের এক ভয়ঙ্কর দিন। তোমার চিঠি এসেছিল বিকেলের ডাকে। এই তো সেই চিঠি—একেবারে আমার চোখের সামনে–

‘নতুনবউঠান,

এদেশে যে মেয়েরা সুন্দরী তাঁরা জানেন, তাঁরা সুন্দরী। বিলেতে আত্মসৌন্দর্য-অনভিজ্ঞা যুবতী দেখবার জো নেই। এখানে সৌন্দর্যের পূজা হয়। আমাদের দেশের পুরুষ এইভাবে নারীর তনুশ্রীর প্রকাশ্য পূজা করতে হাজার কুণ্ঠায় ভোগেন। তাই আমাদের দেশের সুন্দরীরা বিশ্বাস করতে শেখেননি তাঁরা সুন্দরী। তাঁদের শারীরিক আবেদনের অনেকটাই তাই মাঠে মারা যায়। বিলেতে ঠিক উলটো। এখানে রূপ কোনওমতে গুপ্ত থাকতে পারে না। রূপাভিমান সুপ্ত থাকতে পারে না। চারদিক থেকে প্রশংসার কোলাহল তাকে জাগিয়ে তোলে। রূপের আলো দেখবা মাত্র ভক্তদের পতঙ্গহৃদয় চারদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে তাকে ঘিরে ফেলে ও রূপসী যেদিকে যান সেই ফড়িঙের দল তার চতুর্দিকে লাফিয়ে চলতে থাকে। বল-রুম নৃত্যে সুন্দরী রমণীর দাম অত্যন্ত। চড়া। নাচে সেই রমণীর সান্নিধ্যসুখ পাওয়ার জন্যে দরখাস্তের স্রোত বইতে থাকে। তাঁর হস্তচ্যুত রুমাল কুড়িয়ে দেওয়ার জন্যে পুরুষের শত শত মুগ্ধ হাত প্রস্তুত। তাঁর তিলমাত্র কাজ করে দেওয়ার জন্যে শত পুরুষ কায়মনোবাক্যে দিবারাত্রি নিযুক্ত। নতুনবউঠান, এই তো গেল রূপসীদের চড়া দামের কথা। এবার আমার মতো রূপবান তরুণদের প্রসঙ্গে আসা যাক। বলরুম-নৃত্যে তোমার এই দেওরটিরও যথোচিত আদর আছে। আমি এখানকার কিছু-কিছু ড্রয়িংরুমের ডারলিং হয়ে উঠেছি—এ-কথা বললে খুব একটা মিথ্যে বলা হবে না। তবে একথা বলছিনা যুবতীরা ইতিমধ্যেই আমাকে তাদের আদর দিয়ে-দিয়ে অনর্থ করে তুলেছে—যদিও অদূর ভবিষ্যতে সেই সম্ভাবনা নেই এমন কথাও বলছি না।

নতুনবউঠান, আমি নিশ্চিত এ-কথা শুনে তোমার এখানে আসতে অত্যন্ত লোভ হবে। তোমার মতো শ্যামল সুন্দরী বিলেতের মতো রূপমুগ্ধ দেশে এলে এখানকার হৃদয়রাজ্যে এত ভাঙচুর লোকসান হতে পারে যে, সে একটা নিদারুণ করুণরসোদ্দীপক ব্যাপার হয়ে উঠবে। হে আমার বউঠাকরুণ, এদেশে এমত অবস্থায় তোমার হৃদয়টিকেও যে খরচের খাতায় লিখতে হবে! এদেশে এলেই বুঝবে, এখানে রূপের মতো সুপারিশপত্র আর নেই। আমাদের দেশের রূপবতীদের ভাগ্য নিতান্তই মন্দ। তাদের রূপ অন্দরমহলের চৌহদ্দি পেরতে পারে না। বাইরের জগতে সেই রূপের কোনও অধিকার নেই। আধিপত্য নেই।

এবার এদেশে আমার অবস্থার একটু বিশদ বিবরণে আসা যাক। বিলেতে আমার বিশেষ ভাব হয়েছে দুই সুদর্শনা ‘মিস’-এর সঙ্গে। একটি নিমন্ত্রণসভায় এই দুই রূপসীশ্রেষ্ঠ ‘মিস’ কেমন চুপচাপ গম্ভীর হয়েছিলেন। ছোট ‘মিস’ একটা কৌচে গিয়ে হেলান দিয়ে বসলেন, আর বড় ‘মিস’ দেয়ালের কাছে এক চৌকি অধিকার করলেন। এদের এই গাম্ভীর্যের কারণ হয়তো এই যে আমি ছাড়া ঘরে আর কোনও যুবক ছিল না। তরুণনেত্র তাঁদের রূপ ও সাজসজ্জা যেমন উপভোগ করতে পারে এমন তো আর চশমাচক্ষু পারে না। যাইহোক, আমি যতদূর সম্ভব ‘মিস’-দ্বয়কে। আমোদে রাখবার জন্যে নিজেকে নিযুক্ত করলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমি কথোপকথন শাস্ত্রে তেমন বিচক্ষণ নই। এখানে যাকে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব বলে, তাও নই। অনর্গল গল্প হাসি আসে না। আকারে-ইঙ্গিতে কথার আভাসে আমি রূপসীকে জানিয়ে দিতে পারি না যে, আমার চকোরনে তাঁর রূপের জ্যোৎস্না ও আমার কর্ণচাতক তাঁর বাক্যধারা পান করে স্বর্গসুখ ভোগ করছে।

তাই মিস-দ্বয়কে একটি গান গেয়ে শোনালাম।

আমার গান দুই ‘মিস’-এরই ভালো লাগল বলে মনে হল। ছোট ‘মিস’ আমাকে গানটি ইংরিজিতে অনুবাদ করে বলতে অনুরোধ করলেন। আমি অনুবাদ করলেম–বউঠাকরুণ, গানটি হল— প্রেমের কথা আর বোলো না।

ঠাকুরপো, তোমার এই দীর্ঘ চিঠিটি পড়তে-পড়তে আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, তুমি যেন আর আমার সেই চেনা মানুষটি নও। বিলেত তোমাকে অনেক বদলে দিয়েছে। এদেশে ফিরে এসে তোমার এই নতুনবউঠানকে আর ভালো লাগবে না। এক পাগল হাওয়ার বাদল দিনে তুমিই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলে ঠাকুরপো, আমার চোখের চাওয়ার হাওয়া দোলায় তোমার মন। বলেছিলে, আমি আছি বলে তোমার ভাষায় লাগে সুরের আবরণ। বলেছিলে, আমার ছোঁয়ায় তোমার হৃদগগণে দেখা দেয় সোনার মেঘের খেলা। নীলনয়নাদের দেশ থেকে ফিরে বাংলার এই কালো মেয়ের চোখের চাওয়ায়, শরীরের স্পর্শে আর কি কিছুই পাবে তুমি? এইসব কথা ভাবতে-ভাবতে আমি অমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। ছোট্ট উর্মিলা যে কখন আমার চোখের আড়ালে চলে গেছে, খেয়াল করিনি। সে নড়বড়ে পায়ে ছাদের পিছনে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নীচে যাচ্ছিল। টাল সামলাতে পারল না। পড়ে গেল গড়াতে-গড়াতে। মাথায় লাগল আঘাত। হঠাৎ নীচে কাজের লোকদের চেঁচামেচিতে আমার ঘোর ভাঙল। আমি দৌড় নীচে গেলাম। উর্মিলা ততক্ষণে নিথর হয়ে গেছে। তার প্রাণটুকু বেরতে বেশি সময় লাগেনি। সেই থেকে নিজের কাছে বড় অপরাধী হয়ে আছি। দায়ী করছি নিজেকে। আমার পাপের জন্যই কি মরতে হল ঊর্মিকে? ঠাকুরপো, তোমার প্রতি আমার এই প্রেম—এ অন্যায়, অন্যায়। একদিন উর্মিকে মরতে হল। আজ আমাকে মরতে হচ্ছে। হয়তো তুমিও কষ্ট পাবে, তছনচ হবে আজীবন।

আমার প্রাণের রবি, বেলা পড়ে আছে। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধের দিকে। আমার জীবনের শেষ সূর্যাস্ত, শেষ সন্ধে। সেই সকাল থেকে লিখছি। মনের মধ্যে ক্রমশ জমে উঠছে মেঘ, স্মৃতির বিদ্যুৎ চমকে উঠছে ঝোড়ো বাতাসে। মনে পড়ছে, দু-বছর পরে ফিরে এলে তুমি বিলেত থেকে। শেষ হল আমার বিরহের বেলা, আকাশকুসুম চয়ন। জোয়ার এল আমার জীবনে–তোমাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দের জোয়ার। তুমিও যেন গানে সুরে কবিতায় প্রেমের উজান হয়ে ফিরে এলে। আমরা আমাদের প্রাণের খুশি কিছুতেই চেপে রাখতে পারিনি। প্রকাশ ঘটল তার। আকাশে-বাতাসে, লতায়-পাতায়, দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি হঠাৎ উপচে পড়ল তোমার-আমার প্রাণের সুন্দনে। তুমি তখন উনিশ। আমি একুশ। ঠাকুরপো, শুধু তুমি তো ফিরে এলে না, আমার মনে হল, তুমি আমার জীবনে ফিরিয়ে আনলে সেই চাঁদ, সেই ছাদ, সেই দক্ষিণে বাতাস। তুমি লিখতে লাগলে রোজ নতুন-নতুন গান আমারই জন্যে, আমারই প্রেরণায়! দুপুরবেলা আমার পাশে খাটে বসে বসে কত কবিতা লিখতে তুমি—ছবির মতো ভেসে উঠছে সেই সব স্মৃতি। মনের মধ্যে ক্রমেই ঘন হচ্ছে মনকেমনের বাদল। ওই ঘন মেঘ আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে অন্য কথা—তোমার ফিরে আসার পর গড়ে উঠল তোমার আমার এক গাঢ় গহন গোপন ভুবন। সেই পৃথিবী শুধু তোমার-আমার, আর কেউ নেই সেখানে, কারোর প্রবেশাধিকারই নেই।

তোমার-আমার প্রেমের প্রথম প্রকাশ ঘটল একটি বাগানের মধ্যে। সেই বাগানের গাছে-গাছে। ফুটে উঠল আমাদের ভালোবাসা, ফুলে-ফুলে রঙিন হয়ে থাকল আমাদের প্রাণের বাসনা। তুমি সেই বাগানের নাম দিলে নন্দনকানন—আমার ঘরের সামনে ছোট্ট ছাদটিতে দু’জনে মিলে তৈরি করলাম সেই বাগান।

আমরা দু’জনে কত সন্ধে-রাত কাটিয়েছি সেই নন্দনকাননে। দিনের শেষ সেখানে যেতাম গা ধুয়ে প্রসাধন শেষ করে তোমার গান শোনার জন্যে তৈরি হয়ে। সেখানে পাততাম মাদুর। মাদুরের ওপর তাকিয়া। খোঁপায় লাগাতাম বেলফুলের মালা। বেঁধে দিতাম তোমার কবজিতে বেলফুলের রাখি। আর বেলফুলের একটি গড়ে মালা ভিজে রুমাল দিয়ে ঢেকে রেখে দিতাম রূপোর রেকাবিতে। যেদিন হত পূর্ণিমা, সেদিন যে কী রূপ খুলত এই পরিবেশের! সব মনে পড়ছে আমার।

দক্ষিণের আকাশ থেকে উড়ে আসত হু-হু বাতাস। হঠাৎ গান গাইতে-গাইতে তোমার আবির্ভাব হত—যেন দেবদূত! তোমার সেই গান ছড়িয়ে পড়ত আকাশভরে, তারায়-তারায়।

একদিন হঠাৎ তুমি বললে, ‘নতুনবউঠান, শুধু গান শুনলেই হবে না গো, গলা মেলাও আমার সঙ্গে।

আমি পড়ে গেলাম মহা বিপদে। সংকোচ গলা চেপে ধরল আমার। বললাম, ‘ঠাকুরপো, এ তোমার অন্যায় অনুরোধ, তোমার কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মেলানোর কণ্ঠ কোথায় আমার?

তুমি বললে, ‘নতুনবউঠান, ভেব না তোমার গান আমি লুকিয়ে চুরিয়ে শুনিনি। একটা কথা তোমাকে জানাই বউঠান, আমার গান তোমার মতন করে পৃথিবীর আর কোনও মেয়ে গাইতে পারে না। সুর যে তোমার রক্তে। তুমি সুর পেয়েছ জন্মসূত্রে, তোমার ঠাকুরদা জগন্মোহন গঙ্গোপাধ্যায় রাগসংগীতের সাধক, তোমার কণ্ঠে উপচে পড়ছে সুর–কণ্ঠ মেলাও আমার সঙ্গে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে শুরু হোক সংগীতচর্চার নতুন যুগ। ‘

ঠাকুরপো, একমাত্র তোমারই জন্যে আমি গেয়েছি—গেয়েছিল আমার প্রেম, আমার আদর। আমার প্রাণে যতটুকু সুর ছিল সব দিয়েছিলাম তোমাকেই। সে-গান কতদিন হল বন্ধ হয়ে গেছে। ঝরে গেছে নন্দনকাননের প্রাণ। অথচ একদিন আমার গান শেষ হতেই আমার দুটি হাত ঘনভাবে ধরলে তুমি তোমার হাতের মধ্যে, তোমার বুকের ওপর, যেন তোমার প্রাণের ওপর। রাখলে আমার হাত, বললে, ধরণীতলে যে-ভাষায় শুধু তুমিই কথা বলতে পারো, ‘নতুনবউঠান, কোমল তব কমলকরে, পরশ কর পরানপরে। ‘

মনজুড়ে মনকেমনের মেঘের মধ্যে আবার চমকে উঠল বিদ্যুৎ। ঠাকুরপো, আবার মনে পড়ে গেল অন্য এক পূর্ণিমার রাত, ওই নন্দনকাননেই। চারধারে চাঁদের আলো। চারধারে ফোটাফুলের মেলা। তারই মধ্যে এসে দাঁড়ালে তুমি—দীর্ঘাঙ্গ, ঋজু, সুঠাম। তোমার নতুনদাদা খুবই রূপবান পুরুষ। কিন্তু তোমার রূপে আগুন আছে রবি-সে-আগুন তোমার প্রাণের, তোমার গানের, সে-আগুন ছড়িয়ে যায় সবখানে, সেই আগুনেই পুড়েছি আমি, আরও কত নারী পুড়বে তোমার চলার পথে-পথে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে নন্দনকানন। তুমি এসে দাঁড়ালে। সেখানে। মনে হল, পূর্ণিমার গায়ে আগুন লাগালে।

সেই আগুন আমার চোখে চোখ রাখল। সেই আগুন আমার কাঁধে হাত রাখল। সেই আগুন তার বুকের মধ্যে আমাকে বলল—’নতুনবউঠান, তোমাকে আমার হৃদয়কথা জানিয়ে একটি গান লিখেছি আজ, তাকে বসিয়েছি ‘ছায়ানট’ রাগিনীতে। ‘ সেই আগুন সত্যিই গেয়ে উঠল—

পৃথিবীতে শুধু আমারই জন্যে :

তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে কভু হব নাকো পথহারা।।
যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো,
আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা।।
তব মুখ সদা মনে জাগিতেছে সংগোপনে,
তিলেক অন্তর হলে না হেরি কূল-কিনারা।
কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।।

রবি, তোমার কণ্ঠে এ-গান আমার চেতনার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শুনবে আমার বিশ্বাসহীন, বিক্ষত হৃদয়। তোমার মনে আছে কী বলেছিলে, কেমনভাবে বলেছিলে তুমি আমাকে গানের কথাগুলি? আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে, তোমার বুকের ওপর মাথা রেখে, তোমার আগুনে পুড়তে পুড়তে বিশ্বাস করেছিলাম রবি, আমি সত্যিই তো তোমার জীবনের ধ্রুবতারা, আর কোনও পথ তোমাকে ডাকবে না, ডাকলেও সাড়া পাবে না তোমার, জীবনসমুদ্রে তোমাকে আমি, আমাকে তুমি, হারাব না কোনওদিন। বিশ্বাস করেছিলাম, তুমি যেখানেই যাও যার কাছেই থাকো, তোমার জীবনে আমার প্রকাশ আর কখনও অন্য কোনও প্রেম আচ্ছন্ন করে দেবে না। বিশ্বাস করেছিলাম, ঠাকুরপো, তুমি বোঝো আমার দহন, আমার কান্নার মর্যাদা আছে একমাত্র তোমার প্রেমে আমার নয়নজলের আলো সত্যিই তুমি বুঝি দেখতে পাও। ঠাকুরপো, আমার সহজ সরল ভালোবাসা বিশ্বাস করেছিল, আমি তোমার জীবন থেকে যদি মুহূর্তের জন্যেও সরে যাই, জীবনসমুদ্রে হারিয়ে ফেলবে তুমি কূলকিনারা। আমার মুখ সর্বদা জেগে আছে সংগোপনে। তোমার মনের মধ্যে, সেখানে অন্য কোনও মুখ যদি হঠাৎ দেখা দেয়, তুমি লজ্জায় মরে যাবে ঠাকুরপো–এ-কথা বিশ্বাস করেছিলাম আমি।

আমি কেমন কবে বিশ্বাস করব বলো, মাত্র ক’মাসের মধ্যে তুমিই বদলে যাবে এতটা—লিখতে পারবে—

হেথা হতে যাও পুরাতন।
হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে!

আমার হৃদয় শুধু বলছে, অসম্ভব এ অসম্ভব। ঠাকুরপো, আজও তো শ্রাবণের মেঘ কালো হয়ে নামে বনের মাথায়। আজও তো খর বিদ্যুৎ খানখান করে রাতের বক্ষ, আজও তো বুকের মধ্যে শুনেত পাই বারুণীনদীর তরল রব, শুনতে পাই রিমঝিম ঘন বর্ষণে সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে কাজরি গাথা, আজও তো তোমার বাহুতে মাথা রেখে তোমার সঙ্গে আবার দেহে মনে এক হয়ে যেতে ইচ্ছে হয় ঠাকুরপো—তবু আমার টুকরো-টুকরো হৃদয় শুধু বলছে, অসম্ভব সে অসম্ভব! ঠাকুরপো কেন এমন হল? কেন তুমি কথা রাখলে না? আমি যে তোমাকে বড্ড বিশ্বাস করেছিলাম রবি।

প্রাণের রবি, তুমি ফিরে এলে বিলেত থেকে। ঠাকুরবাড়িতে এল গান-বাজনার, আনন্দের সৃজনের, মননের নতুন যুগ। ১৮৮২-র মধ্যে সত্যিই ঠাকুরবাড়িতে ঘটল সংস্কৃতির নবজাগরণ। আর তোমার প্রেমের প্রেরণায় সেই সমারোহের কেন্দ্রে সরে এলাম আমি! শ্যাম গাঙ্গুলির তিন নম্বর মেয়ে। যার না আছে শিক্ষার গৌরব। না আছে রূপের জৌলুস। রবি, তুমি আমাকে ভালোবাসলে বলেই তো তোমার হাত ধরে আমি দাঁড়ালাম সেইনবজাগরণের প্রাণদুহিতা হয়ে। তোমার সুরে-গানে-কবিতায়-নাটকে হইচই ফেলে দিলে তুমি–তোমার প্রাণের বন্যায় ভেসে গেল যেন সারা বাংলাদেশ। আর আমি তোমার অলৌকিক সুজনস্রোতে জলকন্যার মতো ভাসতে লাগলাম। মনে হল সবাইকে বলি, দুয়ো দুয়ো দুয়ো। তুমি একদিন বাড়ির থিয়েটার মঞ্চের পরদার আড়ালে আমার কানের লতিতে ছোট্ট কামড় বসিয়ে বললে, ‘নতুনবউঠান, তুমিই আজ থেকে বঙ্গমজলিসের মক্ষ্মীরানি—এ তোমার পাকা আসন। জেনে রেখো। ‘

এতদিন যিনি কেন্দ্রে ছিলেন, যিনি তাঁর বিলিতি শিক্ষাদীক্ষার গৌরবে ভেবেছিলেন এটি তাঁরই পাকা আসন, তিনি মেজবউঠাকরুণ।

ঠাকুরপো, যেদিন জ্ঞানদানন্দিনীর চোখে দেখলাম আগুন—রাগ, অভিমান, ঈর্ষার আগুন—যে আগুন ক্ষণে ক্ষণে বর্ষিত হতে লাগল আমারই ওপর, সেদিন যে ভয় করেনি, তা নয়। মনে হয়েছিল এ-বাড়িতে যদি কেউ আমার সর্বনাশ চান তো তিনি! তবু তুমি ছিলে আমার একান্ত আশ্রয়, আমার পরম ভরসা। আমি সবাইকে দেখিয়ে দিতেও চেয়েছিলাম, যে-মেয়েটিকে ওঁরা কোনওদিন দিলেন না ঠাকুরবাড়ির যোগ্যতার মর্যাদা, যে-মেয়েকে অপমানিত হতে হয়েছিল পদে পদে, সেই মেয়েই পারল ঠাকুরবাড়ির ভাবনাভুবনের চাবিটি তার আঁচলে বাঁধতে। তুমি আমার হাত ধরেছিলে বলেই আমার সমস্ত সাধারণত্ব পেরিয়ে আমি উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। ইচ্ছাপূরণের এক অলীক তুঙ্গে। তখন কী জানতাম ঠাকুরপো, আমি আসলে পুঁতেছি আমার বিজয়বৈজয়ন্তী চোরাবালির ওপর!

তোমার নতুনদাদা লিখলেন নতুন নাটক অলীকবাবু। সেনাটকে আমি সুযোগ পেলাম একেবারে নায়িকার ভূমিকায়। জ্ঞানদানন্দিনী মোটেই ভালো চোখে দেখলেন না ব্যাপারটা। কিন্তু তাঁর তো আর নায়িকা হওয়ার বয়েস নেই। তাঁকে মেনে নিতেই হল নায়িকা হিসেবে আমাকেই। তাঁর প্রিয় দেওর ‘নতুন’-কে তিনি নিশ্চয় দু-চার কথা বলেছিলেন আমার বিরুদ্ধে–কিন্তু তেমন কোনও কাজ হয়নি তাঁর কথায়।

কিন্তু ওই নাটকে আমার প্রেমিক, অলীকবাবুর ভূমিকায় যে তুমি! আজ চিরকালের জন্যে চলে যাবার দিনে মনে হচ্ছে, সেটা ছিল একটা সূক্ষ্ম ফাঁদ। এবং আমি—একা আমি সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলাম। নিজের সর্বনাশ আমি নিজেই ডেকে এনেছি ঠাকুরপো। তোমাদের কারও গায়ে কোনও আঁচড়, কোনও আঁচ লাগবে না কোনওদিন।

সেদিন বিকেলবেলা চলছে অলীকবাবু নাটকের মহড়া। মহড়ায় উপস্থিত স্বয়ং নাট্যকার। এসেছেন মেজবউঠাকরুণ নিজে। চেয়ারে বসেছেন তিনি। তাঁরই পায়ের কাছে, তাঁর হাঁটুতে হেলান দিয়ে বসেছেন আমার স্বামী। বোঝা যায়, তাঁদের বসার ভঙ্গি থেকে, তাঁদের নিবিড় অন্তরঙ্গতা।

ইতিমধ্যে প্রায় প্রতিদিন নাটকের মহড়া দিতে-দিতে প্রায় প্রতিদিন তোমার প্রেমিকার ভূমিকায় অভিনয় করতে-করতে, ক্রমশ আমিও ভুলতে শুরু করেছি যে আমি তোমার নায়িকা শুধুমাত্র এক সন্ধের মঞ্চে—তাই বাইরের সব ফাঁকা। কিছুতেই তা হতে পারে না—আমি তো তোমার সঙ্গে অভিনয় করিনি ঠাকুরপো—সত্যিই তো অত মানুষের সামনে মঞ্চের ওপর সেদিন আমার। হৃদয়ের বরমাল্য পরিয়ে দিয়েছিলাম তোমার গলায়—আমার সর্বনাশের পথে সেইদিনই পা ফেলেছিলাম নিশ্চিতভাবে।

মহড়ায় মেজবউঠাকরুণ আর আমার স্বামীকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে মাথায় দপ করে। জ্বলে উঠল আগুন। দেখলাম, মেজবউঠাকরুণ আমার দিকে বাজপাখির মতো তাকিয়ে আছেন। তখনও বুঝতে পারিনি, আমি তাঁর শিকার—সত্যি সত্যিই ঘনিয়ে আসছে আমার মৃত্যুর মুহূর্ত, এই নাটকের মহড়ায় রোপিত হয়েছিল আমার ধ্বংসের বীজ।

ঠাকুরপো, আমি মেজবউঠাকরুণকে যেন শুনিয়ে-শুনিয়ে সেদিন তোমার হাত ধরে, তোমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে উচ্চারণ করলাম আমার স্বামীর লেখা এই লাইনগুলি।

’আমি জগতের সমক্ষে, চন্দ্রসূর্যকে সাক্ষী করিয়ে, মুক্তকণ্ঠে বলিব, লক্ষবার বলিব, তুমিই আমার স্বামী, শতবার বলিব, সহস্রবার বলিব, লক্ষবার বলিব, আমি তোমার স্ত্রী।

অন্যদিনও মহড়ার সময়ে কতবার বলেছি এই লাইনগুলি। কিন্তু সেদিন বলেছিলাম এমন আকুলতার সঙ্গে যে তুমিও তাকিয়ে রইলে আমার দিকে আমার কথা শেষ হওয়ার পরেও যাওয়ার দিনে বলে যাই, তোমার সেই নীরব আর্তিময় আঁখিপাতের মায়া ভুলতে পারিনি।

আমি তাকালাম মেজবউঠাকরুণের দিকে। চোখে তাঁর কী ঘৃণা! কী রাগ! কী ঈর্ষা! মনে হল, তুমি কি পারবে আমার হাত ধরে দাঁড়াতে এই ভয়ংকর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে! সেই প্রথম ভয় দেখা। দিল আমার মনে-মৃত্যু ভয়।

মেজবউঠাকরুণ উঠে গেলেন মহড়া থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে গেলেন তোমার নতুনদাদাও।

ক’দিনের মধ্যেই বাবামশায়ের কাছ থেকে আদেশ এল—আদেশ এল তোমার মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকেও—তোমাকে দ্বিতীয়বার বিলেত যেতে হবে ব্যারিস্টার হওয়ার জন্যে! আমি বুঝলাম, মেজবউঠাকরুণের অব্যর্থ চাল—আমার দাঁড়াবার কোনও জায়গা থাকল না। বাবামশায়ের আদেশ তো চাপা হুঙ্কার। রবি, তোমারই বা শক্তি কোথায় টুঁ শব্দটি করার!

ইতিমধ্যে ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ দ্রুত বদলাতে লাগল। গানবাজনার সমাবেশ সরে গেল। মেজবউঠাকরুণের বাড়িতে। তোমার নতুনদাদাকেও ধীরে ধীরে সরিয়ে নিলেন তিনি আমার। কাছ থেকে, তাঁর প্রশ্রয়ে ও আশ্রয়ে। থিয়েটারের জগতের দিকে পা বাড়ালেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ল নটীদের সঙ্গে। ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলে ব্যবহার আরও নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। শুধু তোমার ভালোবাসার জোরে, তোমাকে কাছে পাওয়ার আনন্দে আমি বেঁচে রইলাম।

এই অবস্থায় তোমাকে দ্বিতীয়বার বিলেত পাঠাবার কথা উঠল। এই তো ফিরলে দু-বছর পরে। কী কষ্ট পেয়েছি দু-বছর তোমাকে একবারও না দেখে। আবার বিচ্ছেদ? একাকিত্ব? মনকেমনের কষ্ট? বুঝলাম, তোমাকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। ওই যন্ত্রণা আরও একবার সহ্য করার শক্তি আমার মধ্যে নেই। তোমাকে বললাম সে-কথা। কত করে অনুরোধ করলাম, যেও না ঠাকুরপো। আমাকে ছেড়ে যেও না। বাঁচব না আমি তোমাকে ছেড়ে।

তবু তোমাকে নিয়ে তোমার জাহাজ ছাড়ল বিলেতের পথে।

আমার রাগ হল। আমার অভিমান হল। অপমানিত মনে হল। আমার মনে হল, তোমাকে ভালোবেসে কষ্ট পাওয়ার শক্তি আমার ফুরিয়ে গেছে।

আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে-চেষ্টা আমার ব্যর্থ হল। সবাইকার চাপা হাসি আর করুণার মধ্যে আমি ফিরে এলাম জীবনে। কারও বুঝতে বাকি রইল না তোমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ির কষ্ট সামলাতে না পেরে আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম।

আমার পক্ষে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আর থাকা সম্ভব নয়। এ কথা বুঝেছিলেন আমার স্বামী। তিনিই আমাকে নিয়ে গেলেন চন্দননগরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে। তিনি আশা করেছিলেন হয়তো সেখানে গঙ্গার বাতাস আমার হৃদয় জুড়াবে। জুড়ালো হৃদয় জুড়ালো। গঙ্গার বাতাস লেগে নয়। যখন ফিরে এলে তুমি। বিলেত না গিয়ে, মাদ্রাজে জাহাজ থেকে নেমে সোজা। চলে এলে চন্দননগরে। ঠাকুরপো, তোমাকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরে মনে হল কিছুক্ষণের জন্যে জীবনের বর্ণ-গন্ধ ফিরে এল। একথাও তখন নিশ্চিতভাবে আমি বুঝেছিলাম তোমার এই ফিরে আসার ফল ভালো হবে না। বাবামশায়ের শাসন আমাকে চুরমার করবে। তোমার জীবনও সুখের হবে না। বাবামশায় বেশিরভাগ সময়েই থাকেন হিমালয়ের পাদদেশে, ঈশ্বরচিন্তায় মগ্ন হয়ে। কিন্তু তাঁর নেপথ্য শাসনেই চলে ঠাকুরবাড়ি, তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারও নেই। সেকথা বোঝে বাড়ির ইট-কাঠ-পাথরও।

আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের ক’দিন কেটেছিল তোমার সঙ্গে, ঠাকুরপো তোমার নীরবচ্ছিন্ন সংসর্গে, চন্দননগরে। তোমার সঙ্গে এমন মনোবাসের কোনও সুযোগ পাইনি আমি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।

মনে পড়ছে, সকাল থেকে বৃষ্টি সেদিন। তুমি আমাকে শোনাবে বলে সুর বসালে বিদ্যাপতির ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’ পদটিতে। বৃষ্টিপাত মুখরিত জলধারাচ্ছন্ন সেই মধ্যাহ্নে আমরা দু’জনেই গানে-সুরে-প্রেমে হয়ে গেলাম খ্যাপার মতো। ঠাকুরপো, তোমাকে কত আদর করেছিলাম, মনে আছে তোমার? আমরা দু’জনেই গান গাইতে-গাইতে বাগানের গাছপালার সঙ্গে সারা দুপুর ভিজেছিলাম। বৃষ্টি যেমন বাগানটিকে আচ্ছন্ন করেছিল, ঠিক তেমনি কি আমিও আচ্ছন্ন করিনি তোমাকে? মনে পড়ে তোমার? না কি নতুন বউ পেয়ে সব ভুলেছ?

কোনও-কোনও দিন আমরা সূর্যাস্তের সময় নৌকা করে বেরিয়ে পড়তাম।

একদিন তুমি বললে, ‘নতুনবউঠান, দ্যাখোদ্যাখো, পশ্চিম আকাশে সোনার খেলনার কারখানা একেবারে নিঃশেষে দেউলে হয়ে গিয়ে পূর্ববনান্ত থেকে চাঁদ উঠে আসছে। ‘

আমি বললাম, ‘ঠাকুরপো, এই মুহূর্তে আমি ধরণীর সবথেকে ভাগ্যবতী নারী। তোমার মতো পুরুষের সঙ্গে এমন সোনালি সন্ধ্যায় আর কোন নারী কবে কোন যুগে এমন ভেসে গিয়েছিল বলো?’

তুমি বললে, ‘ভাগ্যবান তো আমি নতুন বউঠান। একটু পরেই আমরা বাগানের ঘাটে ফিরে নদীতীরের ছাদটার ওপর বিছানা করে বসব—তুমি আর আমি। তখন জলে-স্থলে বিরাজ করবে শুভ্র শান্তি। নদীতে নৌকা প্রায় থাকবেই না। অন্ধকারে তীরের বনরেখা হয়ে উঠবে নিবিড়।

কথা শেষ করে ঠাকুরপো তুমি তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে অনেকক্ষণ। আমার হঠাৎ মনে হয়েছিল, তোমার-আমার ইচ্ছে ছড়িয়ে আছে পশ্চিম দিগন্তে সূর্যডোবার রঙে।

ঠাকুরপো, সেদিনের সূর্যাস্তের রঙের সঙ্গে আজকের সূর্যাস্তের কোনও মিল নেই। আজ আমার জীবনের শেষ সূর্যাস্তের পরে নামবে নিবিড় অন্ধকার—সে অন্ধকার মৃত্যুর। সেই অন্ধকারের। মধ্যে শেষ হয়ে মিলিয়ে যাবে চন্দননগরের সব স্মৃতি—সেই দু’জনের কল্পনার রাজ্য, সেই মৃদু হৃদয়কথা কিংবা দু’জনে কোনও কথা না বলে শুধুইনীরবে বসে থাকা, সেই ভোরবেলার বাতাস, সেই সন্ধেবেলার গঙ্গা, নদীর ওপর সেই ঘনঘোর বর্ষার মেঘ, তোমার কণ্ঠে বিদ্যাপতির গান— সব মিলিয়ে যাবে মৃত্যুর নিবিড় অন্ধকারে।

রবি, যদি আমার মৃত্যুর অনেক বছর পরে তুমি কোনওদিন ফিরে আসো চন্দননগরের ওই বাড়িতে! যদি গিয়ে দেখো বেমেরামতি অবস্থায় সে-বাড়ি ভেঙে গিয়ে বনজঙ্গলে ঢেকেছে! সেদিনও হয়তো নতুন বর্ষা নেমেছে, সেদিনও হয়তো মেঘের ছায়া ভেসে চলেছে স্রোতের ওপর ঢেউ খেলিয়ে-খেলিয়ে—তোমার কি মনে পড়বে আমার চোখ দু’টি তখনও, গুনগুনিয়ে উঠবে। তোমার মনের মধ্যে এই গান—তোমার দু’খানি কালো আঁখি পরে বরষার কালো ছায়াখানি। পড়ে? তোমার মনের মধ্যে সেদিনও কি জেগে উঠবে বিদ্যাপতির পদ, ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর?’

ঠাকুরপো, কী সব পাগলের মতন বকছি বলো তো? মনটা আমার একেবারে শিথিল হয়ে গেছে যে—আর যে লিখতে পারছি না ঠাকুরপো।

একটু আগেই আমি একটি একটি করে সবগুলো খেয়েছি। অনেকদিন ধরে জমিয়ে তোলা আফিমের গুলিগুলো। আর আমার পক্ষে ফিরে আসা সম্ভব নয়। সত্যিই চললাম।

মনে পড়ছে মোরানসাহেবের বাগানবাড়িতে রঙিন শার্সিতে ওই ছবিটা—পুরুষ আর নারী, দু’জনে দুলছে নিভৃত নিকুঞ্জে। তুমি বলেছিলে, নতুনবউঠান, দ্যাখো, ঠিক তুমি আর আমি।

মনে পড়ছে চন্দননগরের বাড়ির ছাদে সেই নির্জন গোল ঘরটা। সেই ঘর আমি নিজে হাতে সাজিয়ে দিয়েছিলাম তোমার জন্যে। তুমি বলেছিলে, ‘এই আমার কবিতার ঘর। লিখব আমি, শুনবে তুমি। ‘

তারপর কেমন ঘোর লেগে গেল তোমার। আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ালে।

আমি ধীরে তোমার বুকের মধ্যে মুখটি খুঁজে ভুলে গেলাম আর সব কিছু। তুমি কি নিবিড় কণ্ঠে বললে :

‘অনন্ত এ আকাশের কোলে
টলমল মেঘের মাঝার
এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর
তোর তরে কবিতা আমার। ‘

ঠাকুরপো, সেদিন কি তোমার সত্যিই মনে হয়েছিল আমিই তোমার কবিতা? তোমার বুকের মধ্যে যে কবিতার ঘরটি আছে, সেটি আমারই ঘর—আর কারও নয়! ঠাকুরপো, কোনওদিন সেই ঘরটি আর কোনও মেয়েকে আমি ছেড়ে দিতে পারব না, কিছুতেই না।

চন্দননগর থেকে কলকাতায় ফিরলাম আমরা। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি আমাদের দু’জনের জন্যেই যেন বদলে গেছে এই ক’দিনে। শুধু চাপা গুঞ্জন, বাঁকা দৃষ্টি। বিশেষ করে আমার পক্ষে জোড়াসাঁকোর বাড়ি দুর্বিষহ হয়ে উঠল। এই মধ্যে তুমি ‘ভারতী’ পত্রিকায় লিখলে সেই মারাত্মক লেখা—

‘সেই জানালার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের
গাছগুলি মনে পড়ে সেই অশ্রুজলে সিক্ত
আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে।

আর একজন যে আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে। সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়েছিল, সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই তো যথার্থ কবিতা লিখিয়াছিল।

এ লেখা প্রকাশিত হওয়ার পরেই আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলাম, আমার বাঁচার আর পথ নেই— তুমিই সে-পথ বন্ধ করে দিলে।

এর পরেই বাবামশায় তলব করলেন তোমাকে মুসৌরিতে। বললেন, তোমাকে অবিলম্বে বিয়ে করতে হবে। তুমি মাথা পেতে মেনে নিলে সেই অমোঘ আদেশ। ঠাকুরপো, টুশব্দটি করার সাহস হয়নি তোমার। না কি, তুমিও মনে মনে চেয়েছিলে বিয়েটা সেরে ফেলতে। যাইহোক, শুরু হল তোমার জন্যে মেয়ে দেখার পর্ব। আর কোথায়? সেই যশোরে!

ঠাকুরপো, কঠিনতম আদেশটি তোলা ছিল আমার জন্যে। তোমার কনের দেখার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর! আর সঙ্গে থাকবে তুমি! বাবামশাই স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মৃত্যুদন্ড কী। অনায়াসে আমাকে দিয়েছিলেন! আমার মৃত্যু ঘটেছিল যশোরেই।

দক্ষিণডিহি, চেঙ্গুটিয়া কত জায়গা থেকে যে কত মেয়ের খবর আসত। দৌড়ে যেতাম। সঙ্গে কখনও-কখনও তুমিও থাকতে। তোমার অমন ভাবলেশহীন মুখ আমি কখনও দেখিনি ঠাকুরপো। তোমার ভাবটা ছিল এমন, যে মেয়েকে আমি পছন্দ করব, তুমি বিয়ে করতে প্রস্তুত তাকেই। তোমার মুখে পছন্দ-অপছন্দের কোনও আভাস পেতাম না আমি। অনেক মেয়ে দেখা হল। আমার তো কাউকেই পছন্দ হল না। ভাবলাম, গেল বুঝি বেশ কিছুদিনের জন্য তোমার বিয়েটা পিছিয়ে। হঠাৎ বুকের উপর থেকে যেন একটা ভারী পাথর গেল নেমে। ভেতরে-ভেতরে কী যে পুলক জাগল ঠাকুরপো, তোমাকে বোঝাতে পারব না। তোমাকে বলেছিলাম, ঠাকুরপো, এবছর যশোরে সুন্দরী মেয়ের আকাল পড়েছে। কী আর করবে বল? মন খারাপ কোরো না। বিয়েটা তোমার এ-বছর হচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে। আমার সেই খুশিখুশি কথাগুলো কি মনে আছে তোমার?

বিনা মেঘে আকস্মিক বজ্রাঘাৎ ঘটালেন মেজবউঠাকরুণ। তিনি বললেন, রবির বিয়ে এবছর হবেই। কাউকে না পেলে আমাদের কাছারির কর্মচারী বেনী রায়ের মেয়ে ভবতারিনীর সঙ্গেই রবির বিয়ে দিয়ে দেব। যশোরের ফুলতুলি গ্রামের মেয়ে ভবতারিনী। মেজবউঠাকরুণ বললেন, হাতের কাছে যশোরের মেয়ে থাকতে কেন খুঁজে মরছি চারধারে। ঠাকুরবাড়ির বউয়েরা অধিকাংশই তো যশোরের মেয়ে—ও মেয়ে ভালো মেয়ে হবেই। কথাটা বলেই মেজবউঠাকরুণ তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। তাঁর সেই চাউনি জীবনের এই শেষ দিনেও ভুলতে পারিনি ঠাকুরপো।

বুকের ওপর আবার সেই ভারী পাথরটা ফিরে এল। নিশ্বাস যেন আটকে গেল। এক ছুঁয়ে আমার সেই খুশিভাব নিবে গেল। মনে হল আর কোনও পালাবার পথ নেই আমার। সেই মুহূর্তে অমোঘ নিয়তি ঠেলে দিল আমাকে মৃত্যুর দিকে। পঁচিশ বছর বয়েসে মরতে ইচ্ছে করছে না ঠাকুরপো। কিন্তু বাঁচব কেন? কীসের জন্যে? কাকে ভালোবেসে?

বেনী রায়ের ন’বছরের মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের ঠিক হতেই আমি দীর্ঘ দিনের জন্যে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ভগবৎ ডাক্তারের হাতে পড়ল আমার চিকিৎসার ভার। ডাক্তার ভাবল গোলমাল বুঝি সবটাই আমার শরীরের। কেন আমার শ্বাসকষ্ট। কেন আমার ক্রমশ রোগা আর দুর্বল হয়ে। যাওয়া। কেন আমার খেতে ইচ্ছে করে না, কেন সব সময় বিষণ্ণতায় ভুগছি আমি। এই অসুস্থতার আসল কারণটা কোনও দিন ঠাওর করতে পারেননি ভগবৎ ডাক্তার। খালি ওষুধের পর ওষুধ। লিখেছেন। কেউ জানতেও পারেনি, আমি সে সব ওষুধ নর্দমায় ঢেলে দিয়েছি।

আবার চোখের সামনে চলতে লাগল তোমার বিয়ের আয়োজন। ঠাকুরবাড়ির আর সব মেয়ে বউয়ের সঙ্গে আমাকেও মিলতে হল তোমার বিয়ের আয়োজনে। তোমার বউয়ের শাড়ি-গয়না পছন্দের সময়েও আমাকে ডাকলেন মেজবউঠাকরুণ। আমি মরতে-মরতে সব দায়িত্ব পালন করতে লাগলাম।

এরপর একদিন বিকেলবেলা তুমি এলে আমার ঘরে। যেমন এক সময়ে আসতে রোজ। আমাকে পড়ে শোনাতে তোমার নতুন কবিতা, গেয়ে শোনাতে তোমার নতুন গান। সেদিন বিকেলে। একখানি চিঠি দিলে আমার হাতে। খুলে দেখি এক অভিনব নেমন্তন্নের চিঠি—তুমি নিজেই লিখেছ—

‘আগামী রবিবার ২৪শে অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক। আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে ও আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন।

ইতি, অনুগত শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘

চিঠিটা প্রথমবার পড়ার পর আমার মাথা ঘুরতে লাগল। আমি খাটের ওপর বসে পড়লাম। তারপর চোখে জল এল। দ্বিতীয়বার পড়ার পর কিছুতেই কান্না সামলাতে পারিনি। সেই কান্না গভীর দুঃখের, তবু সেই কান্নাতে কোথায় যেন একটু ক্লান্ত আনন্দও মিশে গেল। বললাম, ঠাকুরপো, নিজের বিয়ে নিয়ে এমন নিদারুণ নিষ্ঠুর ঠাট্টা কেউ করতে পারে!

তুমি খাটের কাছে এগিয়ে এলে, আমাকে টেনে নিলে তোমার বুকের মধ্যে। আমার নিঃশব্দ কান্নায় ভিজে গেল তোমার বুক। তারপর কোনও কথা না বলে বেরিয়ে গেলে আমার ঘর থেকে। এরপর আর কোনওদিনই আমার ঘরে এলে না। তোমার বিয়ে হয়ে গেল ১৮৮৩-র ৯ ডিসেম্বর। —আজ থেকে চার মাস আগে। আমার প্রাণের ঠাকুরপো, তোমার নতুনবউঠানের দিন ফুরালো। তার জীবনের শেষ দিন। আর তো সময় নেই আমার। মাথা ঘুরছে। চোখ বুজে আসছে। দৃষ্টি ক্রমেই ঝাপসা। আর বুকের ভেতরটা ঘামে ভিজে যাচ্ছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল যে।

আমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। আমি টেবিলের ওপর সাজিয়ে রেখেছি আমার সেলাইয়ের বাক্সটি।

আমি জানালার পাশে ফুলগাছের টবটিতে শেষবারের মতো জল দিয়েছি।

আমি আমার নাম-লেখা হাতপাখাখানি—ওটা রেখে গেলাম বালিশের ওপর।

গল্পের বইখানা, যেটি পড়ছিলাম ক’দিন ধরে, শেষ করতে পারলাম না, মাঝের পাতায় একটি চুলের কাঁটা গুঁজে রাখলাম—ওখানেই থামতে হল যে।

আর তোমার-আমার চিঠিগুলো সব ছড়ানো থাকল টেবিলের ওপর—আর তো লুকোবার কিছু নেই।

ঠাকুরপো, ওদের জ্বলতে দিও আমার সঙ্গে চিতায়।

কোনও প্রমাণ রেখোনা ঠাকুরপো-কোনও প্রমাণ রেখোনা আমাদের সম্পর্কের।

ঠাকুরপো, আর প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তবু লিখে গেলাম—আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়।

দায়ী নন বাবামশায়, স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি জোর করে তোমার বিয়ে দিয়ে আমার কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নিলেন।

দায়ী নন আমার মেজজা জ্ঞানদানন্দিনী যিনি কোনওদিনই আমাকে তোমার নতুনদাদার যোগ্য স্ত্রী ভাবতে পারলেন না। দিলেন না এতটুকু সম্মান।

দায়ী নন তোমার নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যাঁর জোব্বার পকেটে আমি পেলাম এক বিখ্যাত নটীর প্রেমপত্র। সেই প্রেমপত্রের নীচে কোনও নাম ছিল না।

ঠাকুরপো, তুমিও নও দায়ী—তোমার জীবনে শুরু হল নতুন খেলা, জায়গা তো ছেড়ে দিতেই হবে পুরাতনকে। তুমিই তো লিখেছ ঠাকুরপো,

‘ঢাকো তবে ঢাকো মুখ, নিয়ে যাও দুঃখ সুখ
চেয়োনা চেয়ো না ফিরে ফিরে,–
হেথায় আলয় নাহি, অনন্তের পানি চাহি
আঁধারে মিলাও ধীরে ধীরে। ‘

তাই হোক ঠাকুরপো, আঁধারেই মিলিয়া যাব আমি। কিন্তু তুমি দায়ী নও কোনওভাবেই।

ঠাকুরপো, আমার মৃত্যুর জন্যে দায়ী আমার অমোঘ নির্বোধ নিয়তি। পাপ যাকে বিদ্ধ করে না। পুণ্য যাকে বদলাতে পারে না।

‘আমাকে মনে রেখো রবি’, এ-কথাটুকু বলার স্পর্ধাও আমার নেই। আমার সব গেছে গো সব গেছে।

রবি—শুধু ভালোবাসাটুকু যায়নি। আজও তোমাকে খুব ভালোবাসি। এইটুকু বিশ্বাস কোরো।

তোমার নতুনবউঠান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *