০৬.
চারিদিক অন্ধকার।
নুহাশের ভয় ভয় লাগছে। ভূতের সব কটা গল্প একমঙ্গে মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে খাটের নিচে ঘাপটি মেরে একটা কন্ধকাটা ভূত বসে আছে। পৃথিবীতে যত ভূত আছে-কন্ধকাটা হল তার মধ্যে সবচে ভয়ঙ্কর। এর মাথা নেই। শরীরটা বিশাল কিন্তু হাত দুটি সেই তুলনায় খুব সরু, প্রায় সুতার মত। কথা বলে ফিসফিস করে।
দেয়ালে টকটক শব্দ হচ্ছে। কে করছে? তাকালেও কিছু দেখা যাবে না, কারণ অন্ধকার। জমাট অন্ধকার। খাটের নিচে খচমচ শব্দ হচ্ছে কেন? নুহাশ চাপা গলায় বলল, কে? কে?
কেউ জবাব দিল না। খচমচ শব্দটাও এখন হচ্ছে না। নুহাশ বাতি জ্বালাল। তার ঘুম আসছে না। বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না। গল্পের বই পড়া যায়। কিন্তু মা সবগুলি গল্পের বই প্যাকেট করে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। প্যাকেট এখনো ভোলা হয় নি।
খেলনাগুলি নিয়ে কিছুক্ষণ কি খেলবে? একা একা খেলতেও ইচ্ছা করছে না। এই এক আশ্চার্য ব্যাপার, কখনো একা খেলা যায় না। খেলার জন্যে সব সময় একজন কাউকে দরকার। বড়রাও খেলতে পারে। যেমন বাবা। বাবার সঙ্গে নুহাশ অনেক ধরনের খেলা খেলে। সবচে বেশি খেলে রান্নাবাটি। পৃথিবীতে যত খেলা আছে তার মধ্যে রান্নাবাটি খেলা হল সবচে ভাল খেলা। মিছিমিছি রান্না করতে হয়। মিছিমিছি রান্না খেয়ে মিছিমিছি বলতে হয়–রান্না খুব ভাল হয়েছে। এইসব কথা বলতে হয় সত্যের মত করে। বলার সময় হাসা যাবে না। বাবা খুব ভাল মিছিমিছি কথা বলেন। মনে হয় সত্যি কথা বলছেন। ঐদিন সে বাবার সঙ্গে রান্নাবাটি খেলা খেলল। নুহাশ বলল, ওগো তরকারীটা কেমন হয়েছে দেখ তো।
বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, ভাল হয়েছে। লবণ একটু কম হয়েছে। রঙটা এমন হলুদ হলুদ হল কেন? তরকারীতে রঙ না হলে আমি খেয়ে আরাম পাই না। হলুদ বেশি দিয়েছ না-কি? মরিচ বেশি দেয়া দরকার ছিল। তাহলে রঙ হত।
মরিচ ইচ্ছা করে কম দিয়েছি। মরিচ বেশি হলে বাচ্চারা খেতে পারে না।
ওদের জন্যে আলাদা রান্না করলেই পার।
আমি একা মানুষ। এক হাতে কদিক সামলাব?
কেন, কাজের ছেলেটা তো আছে।
ও কি কিছু জানে না-কি! হাত ধরে ধরে কাজ শেখাতে হচ্ছে। ঐদিন সেটের একটা কাপ ভেঙে ফেলল।
সে কি?
ভেঙেও আবার মিথ্যা কথা বলে। আমাকে বলে, আম্মা, আমি হাত দিয়া ছুঁইয়াও দেহি নাই।
কানে ধরে বার করে দাও। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল।
তুমি তো বলেই খালাস। কানে ধরে বের করে দিলে আরেকটা পাব কোথায়? তোমার নিজের জন্যেই তো একজন ফুল টাইম কাজের লোক দরকার। দিনের মধ্যে দশবার সিগারেট আনাচ্ছ। আচ্ছা, তোমার সিগারেট যা লাগে এক সঙ্গে আনিয়ে রাখতে পার না? যতবার সিগারেট ধরাবে ততবার এক কাপ করে চা লাগবে। এত কিছু করলে আমি সংসার দেখব কিভাবে? আমার তো চারটা হাত না। দুটা মোটে হাত।…
নুহাশের চোখে প্রায় পানি এসে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বাবার সঙ্গে আর কোনদিনও রান্নাবাটি খেলা যাবে না। কোনদিন না। কত দিন যে সে বাবাকে দেখে না। বাবার বিখ্যাত অনুস্বার কবিতা শুনে না। কি যে সুন্দর ঐ কবিতাটা।
নুহাশের চোখে এবার সত্যি সত্যি পানি এল। সে চোখ মুছে মেজোমামার দেয়া খেলনার প্যাকেট খুলতে বসল। এই প্যাকেটটা এখনো খোলা হয় নি। প্যাকেটে কি আছে সে জানে। আলাদিনের আশ্চার্য চেরাগ। তবে খেলনা চেরাগ। সত্যিকারের চেরাগ থাকলে তো ভাল হত। সে দৈত্যটাকে বলতো–তুমি এক্ষুণি বাবা-মাকে একসঙ্গে করে দাও। এক্ষুণি। এক্ষুণি। এক্ষুণি।
আলাদিনের চেরাটা বেশ ভারী। দেখে মনে হয় লোহার তৈরি। জায়গায় জায়গায় পাথর বসানো। ধরবার হাতলও আছে। নুহাশ বাত হাতে হাতল ধরে, ডান হাতে প্রদীপের একটা পাশ ঘষল। ওমি প্রদীপের মুখ দিয়ে প্রথমে সাদা ধোঁয়া, তারপর কালো ধোঁয়া বের হতে লাগল। শব্দ হতে লাগল কটকট, কটকট। নুহাশ যদি না জানত এটা একটা খেলনা প্রদীপ তাহলে অবশ্যই ভয়ে চিৎকার করে উঠত। সত্যিকার প্রদীপের ভেতর থেকে নিশ্চয়ই এরকমই কালো ধোঁয়া বের হয়।
ও আল্লা, ধোঁয়া তো বেরুচ্ছেই। আরো ঘন হয়ে বেরুচ্ছে। মনে হচ্ছে। ধোয়াটা জমাট বাঁধছে। জমাটবাঁধা ধোঁয়া দিয়ে মানুষের মত কি যেন তৈরি হচ্ছে। নুহাশ হাত থেকে খট করে প্রদীপ ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়া বের হওয়া বন্ধ হল। তবে ধোয়া জমাট বেঁধে মানুষের মত হয়ে গেল। মানুষের মত না, অবিকল মানুষ। শার্ট প্যান্ট পরা। চোখে চশমা, পকেটে একটা বল পয়েন্ট কলম। রোগা পটকা ধরনের একটা মানুষ। ধবধবে সাদা গায়ের রঙ। কিন্তু চুলের রঙ সোনালী। লোকটা বিরক্ত হয়ে বলল, খট করে প্রদীপটা যে ফেলে দিলে, এর মানে কি? ব্যথা লাগে না বুঝি?
নুহাশ আতঙ্কে অস্থির হয়ে বলল, তুমি কে?
লোকটা আরো বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি তুমি করছ কেন? আপনি করে বল।
আপনি কে?
আমি কে তা তো বুঝতেই পারছ। তুমি তো কচি খুকী না। আমি হলাম আলাদিনের চেরাগের দৈত্য।
নুহাশ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আপনাকে দৈত্যের মত লাগছে না।
চেহারা দিয়ে দৈত্য বোঝা যায়? দৈত্যের পরিচয় হল ক্ষমতায়। বল তোমার কি চাই। দেরি করবে না। ঝটপট বল। ঝটপট!
যা চাই তাই দিতে পারবেন?
বোকার মত কথা ভুলবে না। যা চাইবে তাই কি করে দেব? আকাশের চাঁদ চাইলে কি এনে দিতে পারব? চাঁদের ওজন কত জান? পাঁচ দশমিক সাত গুণন টেন টু দি পাওয়ার আঠারো কিলোগ্রাম।
আপনি কি সত্যি সত্যি আলাদিনের দৈত্য?
অবশ্যই। চেরাগের ভেতর ধোয়া হয়ে শুয়ে থাকি। কেউ ঘষলে বের হয়ে আসি। খুকী, তোমার কাছে চিরুনি আছে? চুলটা আঁচড়ে নেয়া দরকার। এলোমেলো হয়ে আছে।
নুহাশ চিরুনি বের করে দিল। দৈত্য চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, চট করে বল তোমার কি দরকার। এনে দিচ্ছি। আজগুবি কিছু চেয়ে বসবে না। কৎবেল খেতে চাও? কৎবেল খেতে চাইলে কোন গাছ থেকে একটা পেড়ে নিয়ে আসব। তবে বৃষ্টি হলে পারব না। বৃষ্টি হয়ে গাছ পিছল হয়ে থাকে। গাছে উঠতে পানি না।
আপনি যে সত্যি সত্যি দৈত্য এটা বিশ্বাস হচ্ছে না।
চোখের সামনে দেখলে ধোঁয়া থেকে তৈরি হয়েছি। তারপরেও বিশ্বাস হচ্ছে না? এই হচ্ছে মানবজাতির সমস্যা। এরা কিছুই বিশ্বাস করে না।
দৈত্য বিছানায় বসে, পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছল।
নুহাশ বলল, এটা তো খেলনা প্রদীপ। এর ভেতর দৈত্য আসবে কিভাবে?
না জেনে কথা বলবে না তো খুকী। আলাদিনের প্রদীপের মত দেখতে যত প্রদীপ বানানো হয় সবগুলির ভেতর দৈত্য থাকে। এই হচ্ছে নিয়ম! তবে যে-কেউ ঘষলে দৈত্য বের হবে না। মন্দ মানুষের হাতে প্রদীপ কাজ করে না। ভাল মানুষ হতে হবে। বুঝতে পারছ?
না বুঝে নুহাশ মাথা নাড়ল। দৈত্যটা মনে হচ্ছে খুব রাগী। তাকে রাগাতে ইচ্ছা করছে না।
ও খুকী, তোমার কাছে সিগারেট আছে? সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে।
আমার কাছে নেই। আব্বর কাছে আছে। সিগারেট খেলে তো ক্যানসার হয়।
পান আছে? জর্দা দিয়ে একটা পান দাও তো।
পানও নেই।
দৈত্যটা ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলল। বিরক্ত মুখে বলল, খুকী তাড়াতাড়ি বল তোমার কি চাই। তোমার কাজটা করে দিয়ে তারপর ঘুমুতে যাব। আরেকটা কথা, প্রদীপটা তুমি খোলামেলা জায়গায় রাখবে। ফ্যানের কাছে রাখলে খুব ভাল হয়। বাক্সের ভেতর রাখবে না, বাক্সের ভেতর রাখলে গরমে আমার ঘুমের অসুবিধা হয়। এখন চট করে বল কি চাই।
আমার বাবাকে এনে দিন।
তোমার বাবাকে এনে দেব মানে? উনি কোথায়?
মার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে তো। দুজন আলাদা থাকেন।
মানুষগুলিকে নিয়ে কি যে যন্ত্রণা! শুধু ঝগড়া করে। তোমার বাবা থাকে কোথায়?
জানি না। তবে বদরুল চাচার বাসায় থাকতে পারে।
বদরুল চাচার বাসা কোথায়?
জানি না।
না জানলে খুঁজে বের করব কিভাবে?
আপনি দৈত্য। আপনার কত ক্ষমতা।
ক্ষমতা আছে ঠিকই। তাই বেল দশ লক্ষ লোকের ভেতর একজনকে খুঁজে বের করা মুশকিল। তার উপর সব মানুষ দেখতে এক রকম। দুটা চোখ, দুটা কান, দুটা কান … শুধু স্বভাব ভিন্ন। সাধু স্বভাব, চোর স্বভাব, কেজো স্বভাব …।
আপনি বাবাকে খুঁজে বের করতে পারবেন না?
অবশ্যই পারব। না পারার তো কিছু নেই। দৈত্যরা অসাধ্য সাধন করতে পারে, তবে সময় লাগবে। অনেক অনেক সময় লাগবে। চট করে করা অসম্ভব।
কত সময় লাগবে?
দুই তিন মিনিট তো লাগবেই।
তাহলে আপনি এক্ষুণি নিয়ে আসুন। কিভাবে তাঁকে আনবেন? বাবা কিন্তু খুব ভারী। একশ ত্রিশ পাউন্ড ওজন।
তুমি কি ভাবছ আমি তাকে কোলে করে নিয়ে আসব? মানুষের বাচ্চাগুলি এরকম বোকা থাকে তা তো জানতান না। আমি তোমার বাবাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসব। সে এখানে চলে আসবে মনের ভুলে।
কখন আসবে?
বললাম তো দেরি হবে। এই সব জিনিস চট করে হয় না। অনেক সময় লাগে। দুমিনিটের আগে এই কাজ করা অসম্ভব। দুমিনিট ধৈর্য ধরতে হবে।
আচ্ছা আমি ধৈর্য ধরছি।
পানি খেয়ে নেই। দেখি এক গ্লাস পানি দাও তো। আবার বলে বসবে না পানি নেই।
ঠাণ্ডা পানি?
না ঠাণ্ডা পানি না। নরমাল পানি দাও। আমার টনসিলের প্রবলেম আছে। একবার একটা আইসক্রিম খেয়ে এক মাস ভুগেছি। দিন রাত কাশি– খক খক খক্।
দৈত্য পানি খেয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছল। তারপর যাই বলে অদৃশ্য হয়ে গেল। নুহাশের মনে হল পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্ন। স্বপ্ন ছাড়া কিছুই না। তার উচিত বিছানায় শুয়ে পড়া। কিন্তু যদি সত্যি হয়? সত্যি হতেও পারে। নুহাশ চুপচাপ বসে রইল। আর কি আশ্চর্য, দুমিনিটের মাথায় কলিং বেল বাজতে লাগল। যেন কেউ খুব ব্যস্ত হয়ে কলিং বেল টিপছে।
রেবেকা বলল, কে কে?
নুহাশ তার বিছানায় বসে বসেই শুনল, মা তার ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে এসেছেন। মুনার-মাও এসেছে।
রেবেকা বলল, পিপ হোল দিয়ে আগে দেখে নাও কে এসেছে। অপরিচিত কেউ হলে খুলবে না। মুনার-মা পিপ হোলে চোখ রাখল।
ও আম্মা, মনে হইতেছে খালুজান।
খালুজান মানে?
বসার ঘরের দরজা খোলা হল। নুহাশ আর কিছু শুনছে না। সে শক্ত হয়ে বসে আছে। এক সময় নুহাশ শুনল তার মা বলছেন–তুমি, তুমি কোত্থেকে? বাসার ঠিকানা পেলে কোথায়? কে তোমাকে ঠিকানা দিয়েছে?
মিনহাজের হকচকিত অবস্থা। কিছু বলতে পারছে না। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তার কপালে ঘাম। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘনঘন। রেবেকা বলল, কথা বলছ না কেন? বাড়ির ঠিকানা কোথায় পেলে?
আমি জানি না।
আমি জানি না? আবার রসিকতা? বাড়ি খুঁজে বের করলে কিভাবে?
মিনহাজ বিব্রত গলায় বলল, আমি নিজেই কিছু বুঝতে পারছি না। রফিকের বাসা খুঁজতে বের হয়েছিলাম। মালিবাগের এক ফ্ল্যাটবাড়িতে সে থাকে। আচ্ছা, এটা কি মালিবাগ?
না, এটা মালিবাগ না। এটা যে মালিবাগ না তা তুমি ভাল করেই জান।
বিশ্বাস কর আমি জানি না। রফিকের বাসাতেই আমি কলিং বেল টিপছিলাম। দরজায় লেখা ছিল-রফিকুল ইসলাম-৩১/বি মালিবাগ।
তোমার এ জাতীয় অদ্ভুত গল্প আগেও অনেক শুনেছি। আর শুনতে ভাল লাগছে না। রাত হয়ে গেছে–তুমি তোমার বন্ধুকে খুঁজে বের কর। আমরা ঘুমুতে যাব।
এটা মালিবাগ না?
না। এটা পুরানা পল্টন।
ব্যাপারটা কি করে ঘটল আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। বিশ্বাস কর আমি রিকশা থেকে নামলাম রেল ক্রসিং-এর কাছে। মালিবাগ রেল ক্রসিং
তোমার বানানো গল্প সারাজীবন ধরে শুনেছি–আর না …
নুহাশ! নুহাশ কোথায়?
নুহাশ আছে নুহাশের ঘরে।
ওকে একটু দেখে যাই।
ও ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে ডাকা যাবে না।
চলে যেতে বলছ?
হ্যাঁ, বলছি।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।
বৃষ্টি তো তোমার খুব পছন্দের জিনিস। বৃষ্টিতে সারাদিন ভেজার জন্যে-মনে নেই তুমি তোমার বন্ধুদের নিয়ে শালবনে গেলে। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে রাতে জ্বর নিয়ে ফিরলে।
আমি বরং সোফায় শুয়ে থাকি। আমার মাথা ঘুরছে। কোন একটা সমস্যা হয়েছে। আমি কি করে এখানে এলাম বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আজ রাতটা থেকেই যাই?
না। তোমার যন্ত্রণা সহ্য করতে আমি আর রাজি না।
দেখ রেবেকা, আমার গায়ের সব লোম এখনো খাড়া হয়ে আছে। এখনো বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা কি। সমস্যাটা কি।
বন্ধুর বাসায় যাও। বন্ধুর সঙ্গে সমস্যা নিয়ে আলাপ কর।
আচ্ছা, যাই তাহলে। এটা কোন জায়গা বললে?
পুরানা পল্টন।
ও আচ্ছ, পুরানা পল্টন। কি অদ্ভুত কাণ্ড! রেবেকা যাই।
হ্যাঁ যাও। গুড নাইট।
.
নুহাশের বিছানায় দৈত্য পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তার মুখ বিষণ্ণ। দৈত্য বলল, খুকী তোমার কি যেন নাম বললে?
নুহাশ।
হু, নুহাশ। মনে থাকে না। স্মৃতিশক্তি পুরোপুরি গেছে। বয়সের জন্যে এটা হয়েছে। আমাকে দেখে যত কম বয়স মনে হয়, আসলে তা না। দশ হাজার একশ তেত্রিশ বয়স। যাই হোক, শোন নুহাশ, তোমার বাবাকে এনেছিলাম। লাভ কিছু হল না। কি করা যায় বল তো?
আমি জানি না।
একটা কিছু বুদ্ধি বের কর।
আমি ছোট মানুষ। আমার মাথায় কোন বুদ্ধি আসছে না।
ছোটদের মাথাতেই বেশি বুদ্ধি আসে। বুদ্ধি থাকে না বড়গুলির মাথায়। মানুষ যত বড় হয় তত বুদ্ধি কমে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ব্রেইন পচে গোবর সার হয়ে যায়। তা না হলে তোমার বাবা-মা এমন ঝগড়া করে?
নুহাশের চোখে পানি এসে গেছে। সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে যাতে দৈত্য তার চোখের পানি দেখতে না পারে।
নুহাশ!
জ্বি।
কাঁদছ না-কি?
জ্বি– কাঁদছি।
কান্না বন্ধ কর। কেঁদে কখনো কিছু হয় না। বুদ্ধি বের করতে হবে। তোমার মাকে ভয় দেখালে কেমন হয়? সারারাত মারাত্মক ভয় দেখাব। ঠাণ্ডা পানি মাথার উপর ঢেলে দেব।
তাতে কি হবে?
ভয়ে হালুয়া টাইট হয়ে যাবে। তখন বুঝতে পারবে একা একা থাকা সম্ভব না। তোমার বাবাকে নিয়ে আসবে।
নুহাশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বাবাকে না এনে মা যদি অন্য। একটা লোককে বিয়ে করে ফেলে, তখন কি হবে?
দৈত্য মাথা দুলাতে দুলাতে বলল, হ্যাঁ এটা বিবেচনাযোগ্য সমস্যা। এই লাইনে চিন্তা করি নি। বয়সের কারণে আমার নিজের ব্রেইনও পচে গোবর হয়ে গেছে। তোমার মাকে ভয় দেখানো যাবে না। ভাল করতে গিয়ে হয়ে যাবে মন্দ। অন্য কিছু করতে হবে। আজ রাতটা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করি কাল সমস্যার সমাধান করব। তুমি ঘুমিয়ে পড় খুকী।
আমার ঘুম আসছে না।
ঘুম তো আমারো আসছে না। ভাল ঘুম না হলে বুদ্ধি খুলবে না। কি করা যায় খুকী বল তো?
আমার সঙ্গে রান্নাবাটি খেলবেন?
রান্নাবাটি আমার কেমন খেলা?
আমি মিছিমিছি রান্না করব। সেগুলি আপনি খাবেন। খেয়ে বলবেন– মজা হয়েছে।
মন্দ না। খেলাটা ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। আস খেলা যাক।
নুহাশ সাদা কাগজ কুচিকুচি করে কাগজের ভাত রান্না করল। হলুদ কাগজ কুচিকুচি করে কাগজের ডাল রান্না করল। সবুজ কাগজ কুচিকুচি করে তৈরি হল সবজি। দৈত্যকে খেতে দেয়া হল। সে পুরোটা মুখে কচকচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলল। নুহাশ হতভম্ভ!
দৈত্য বলল, খেতে তো আসলেই ভাল লাগছে। বিশেষ করে সবজিটা খুবই চমৎকার হয়েছে। সবজি কি আরো আছে?
জ্বি-না।
আরো খানিকটা রেঁধে ফেল। দারুণ টেস্ট হয়েছে।
আপনি তো সত্যি সত্যি খেয়ে ফেলেছেন। মিথ্যা করে খেতে হয়।
দৈত্য অবাক হয়ে বলল, মিথ্যা করে আবার কিভাবে খায়? তোমার কথাবার্তা তো ভারী অদ্ভুত। যাই হোক, দয়া করে আরো খানিকটা সবজি রান্না কর। সবজি খেয়ে ঘুমুব। এমিতেও আমাদের সবুজ সবজি খাওয়া দরকার। ভিটামিন আছে।