ভোরে শোয়েবের ডাকে সুমন, ঝন্টু আর রবির ঘুম ভাঙলো। ঝন্টু লক্ষ্য করলো শোয়েবের চোখে রাত জাগার ছাপ। বললো, তুমি নিশ্চয় সারা রাত এক ফোঁটাও ঘুমোওনি শোয়েব ভাই?
শোয়েব ম্লান হেসে বললো, ঘুম না এলে ঘুমোবো কিভাবে? একটু থেমে আপন মনে বললো, মনে হয় না আর কখনও স্বাভাবিক পরিবেশে ঘুমোতে পারবো।
শোয়েবের কথা হেসে উড়িয়ে দিলো ঝন্টু, তুমি যে কী বলল শোয়েব ভাই! তোমার সঙ্গে আমরা আরও তিনজন আছি, রাজা ভাইকে ধরলে চার জন। এটা কি মগের মুলুক!
রাতের অন্ধকারে কোনও সাধারণ বিপদকেও অনেক বড় মনে হয়, যা দিনের আলোয় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যায়। তারপরও শোয়েব কিছুতেই দুশ্চিন্তার ভারি বোঝ মাথার ওপর থেকে নামাতে পারছিলো না। সুমন বললো, আমাদের এখনই রওনা হওয়া দরকার। কক্সবাজার পৌঁছে বাবাকে ফোন করে সব জানাতে হবে। আমাদের গাড়িটা উদ্ধারের জন্য ডিসিকে বলতে হবে।
রবি বললো, গাড়ির ভেতর শোয়েব ভাইর দরকারী সব কাগজ রয়েছে।
কাগজগুলো নিয়ে শোয়েব খুবই চিন্তিত ছিলো। ওর ভয় হচ্ছিলো টের পেলে ওরা গাড়িটা আস্ত রাখবে না। ভয়ের ভাবনা চেপে রেখে ঝন্টুদের বললো, চলো সবাই। সুমন ঠিকই বলেছে। দুপুরের আগেই আমাদের কক্সবাজার পৌঁছাতে হবে। তৈরি হওয়া মানে পাশের খালের পানিতে মুখ হাত ধুয়ে ব্যাগটা কাঁধে ফেলে দক্ষিণে যাত্রা আরম্ভ করা। আধঘন্টার ভেতর ওরা খিদে পেটে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দক্ষিণ মুখো হাঁটা আরম্ভ করলো।
ঘন্টা খানেক হাঁটার পরও ওদের চোখে কোনও জনবসতি চোখে পড়লো না। ঝন্টু বলেছিলো বড় রাস্তার কাছাকাছি হাঁটতে। শোয়েব আপত্তি করেছে। বড় রাস্তা দিয়ে ওদের লোকজন নিশ্চয় সকাল থেকে যাওয়া আসা করছে। ওদের কারও চোখে পড়লে পালাবার আর উপায় থাকবে না।
রবি জিজ্ঞেস করলো, শোয়েব ভাই, আমরা ঠিক পথে যাচ্ছি তো? ক্ষিদের চোটে পেটের নাড়িভুড়ি হজম হয়ে যাচ্ছে।
শোয়েব চিন্তিত গলায় বললো, এদিকে আমি আগে কখনো আসিনি। তবে ম্যাপ সম্পর্কে আমার ধারণা খারাপ না। দক্ষিণে হাঁটলেই কক্সবাজার পৌঁছানো যাবে।
জঙ্গলের ভেতর উত্তর দক্ষিণ সবই আমার কাছে সমান মনে হচ্ছে। মন্তব্য করলো সুমন।
সকাল বেলা দক্ষিণে হাঁটতে গেলে সূর্য তোমার বাঁ পাশে থাকবে। বিপদ হবে সূর্য যখন মাথার ওপর থাকবে। তার আগে কোনও না কোনও গ্রাম চোখে পড়বেই। জঙ্গলের ভেতর গাছপালা কোথাও ঘন, কোথাও হালকা। মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গাও ওদের পেরুতে হচ্ছিলো। বোঝা যায় এক কালে সেখানে জঙ্গল ছিলো, লোকজন গাছ কেটে সাফ করে ফেলেছে। কাটা গাছের গোড়া দেখে মনে হয় কিছু সদ্য কাটা। সুমন বললো, জঙ্গলের ভেতর যারা চুরি করে গাছ কাটে ওদের গুলি করে মারা উচিৎ।
শোয়েব মৃদু হেসে বললো, গুলি পরে করলেও চলবে। আপাতত ওদের কারও বাড়িতে আশ্রয় পাওয়া দরকার। ক্ষিদে আমারও কম পায়নি।
সুমন ভুরু কুচকে বললো, তুমি বলতে চাইছে গাছ কাটা শয়তানদের বাড়িতে আশ্রয় নেবে?
শোয়েব কিছু বলার আগে রবি বললো, যে শয়তানই হোক যদি খেতে দেয় আমি ওর বাড়ি যেতে রাজি।
আমি কোনও চোরের বাড়িতে খাবো না।
ঠিক আছে, তুই কক্সবাজারে গিয়ে পোলাও কোর্মা খাস। আমরা সামনে যাকে পাবো তার কাছেই খাবার চাইবো।
ক্ষিদে সুমনেরও লেগেছিলো। তারপরও খাওয়ার জন্য রবির হ্যাংলায়মা ওর ভালো লাগলো না। ঝন্টুর ভাব সাব দেখে মনে হচ্ছে সেও রবির দলে। সুমন এ নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে শোয়েবের পেছনে চুপচাপ হাঁটতে লগালো।
ঘন জঙ্গল পেরিয়ে ওরা খোলা এক মাঠে নেমেছে, ঠিক তখনই দূরে বন্দুকের গুলির শব্দ হলো। চারজন এক সঙ্গে থমকে দাঁড়ালো। সকলের চোখে প্রশ্ন। বুঝতে পারলো না আর সামনে এগুনো ঠিক হবে কি না। মিনিট খানেক পর আবার গুলির শব্দ হলো। শোয়েব চাপা গলায় বললো, পিছিয়ে এসো। খোলা জায়গায় থাকা ঠিক হবে না।
সুমন, ঝন্টু আর রবি কোনও কথা না বলে শোয়েবকে অনুসরণ করলো। সূর্য তখন ঠিক মাথার উপর। বাতাস না থাকাতে বেশ গরমই লাগছিলো। চৈত্রের রোদে অনেকক্ষণ একটানা হাঁটার পর থমকে দাঁড়ানোতে সবাই কুল কুল করে ঘামতে লাগলো। সবচেয়ে বেশি ঘামছিলো রবি যত না গরমে তার চেয়ে বেশি ভয়ে। কেউ কোনও কথা বলছে না দেখে ও চাপা গলায় বললো, তোমার কী মনে হচ্ছে শোয়েব ভাই? কারা গুলি করছে?
বুঝতে পারছি না কারা বিভ্রান্ত গলায় জবাব দিলো শোয়েব।
সুমন বললো কোনও শিকারী টিকারী নয়তো?
এই জঙ্গলে শিকার করার মতো কোনও জন্তু নেই। পূর্ব দিকের পাহাড়ের ওপার থেকে গুলির শব্দ এলে না হয় বুঝতাম কেউ শুয়র মারতে বেরিয়েছে।
পাহাড়ের ওপারে কারা শুয়র মারবে? প্রশ্ন করলো ঝন্টু।
পাহাড়ের উপজাতিদের অনেকে শুয়র খায়। ওরাই মারে।
গুলির শব্দ আসছিলো পশ্চিম দিক থেকে। মিনিট পাঁচেকের ভেতর আরও চার রাউন্ড গুলির শব্দ হলো। শোয়েব বললো, চলো আমরা পুব দিকে সরে যাই।
পুব দিকে মাইল দুয়েক দূরে উঁচু পাহাড়। জঙ্গল ওদিকে ক্রমশঃ ঘন হয়ে গেছে। জঙ্গলের ভেতর বুনো লতা, বেতের কাটা আর ঝোঁপ ঝাড় ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে সুমন বললো, আমরা যে উল্টো দিকে যাচ্ছি আবার পথ চিনে ফিরে আসতে পারবো তো শোয়েব ভাই?
আকাশের সূর্য দেখে দিক ঠিক করবো। জবাব দিলো শোয়েব। আমি দেখতে চাই গুলি যারা ছুঁড়ছে তারা ওদের লোক কি না।
ওদের মানে?
কেন, জামাতীদের।
তোমার কি মনে হয় ওরা জঙ্গলের ভেতর আমাদের অনুসরণ করছে?
করাটা বিচিত্র কিছু নয়।
ওরা জানবে কী করে আমরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কক্সবাজার যাচ্ছি।
ওদের আন্ডার এস্টিমেট কোরো না। ওরা এতক্ষণে বুঝে গেছে আমরা হাইওয়ে ধরে কক্সবাজার বা চট্রগ্রাম যাচ্ছি না। তাহলে সম্ভাবনা একটাই, আর সেটা হলো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাওয়া। এটা ওদের না বোঝার কথা নয়।
ওরা যত হাঁটছিলো থেমে থেমে গুলির শব্দ ক্রমশঃ এগিয়ে আসছিলো। ঝন্টু বললো, ওরা আমাদের নিশ্চয় দেখতে পায়নি। অকারণে ওরা গুলি ছুড়ছে কেন?
ঝন্টুর কথা শুনে শোয়েব থমকে দাঁড়ালো। ওর চেহারা দেখে মনে হলো ভীষণ ভয় পেয়েছে। ফিশ ফিশ করে বললো, দাঁড়াও, মনে হচ্ছে ওরা আমাদের পুব দিকে ঠেলে দিতে চাইছে। ওরা নিশ্চয় টের পেয়েছে। আমরা যে এদিকে কোথাও আছি।
উত্তেজিত গলায় সুমন বললো, ওরা যদি আমাদের পুব দিকে সরিয়ে নিতে চায় আমরা সেদিকে যাচ্ছি কেন? আমাদের উচিৎ দক্ষিণে যাওয়া।
দক্ষিণে গেলে ফাঁকা মাঠে গিয়ে পড়বে। তখন আর ওদের কষ্ট করে খুঁজতে হবে না।
ঝন্টু বললো, এখানে একটু দাঁড়াও শোয়েব ভাই। বুঝতে দাও গুলি করতে করতে কেউ এদিকে আসছে কিন না।
শোয়েব মাথা নেড়ে সায় জানালো। বেশ কিছুক্ষণ গুলির শব্দ শোনা গেলো না। রবি হাঁপ ছেড়ে বললো, মনে হচ্ছে যারা গুলি করছিলো ওরা চলে গেছে।
শোয়েব বললো, চলে যেতে পারে, আবার এদিকেও আসতে পারে। যদি মনে করে …..।
শোয়েবের কথা শেষ না হতেই, মনে হলো পুব দিক থেকে শুকনো পাতা মাড়িয়ে ঝোঁপ ঝাড় ঠেলে কি যেন ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। ওদের চারজন সভয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। মোটা এক সেগুন গাছের আড়ালে ছিলো ওরা। শব্দ শুনে মনে হচ্ছিলো কোনও বন্য প্রাণী ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। রবি কি যেন বলতে যাচ্ছিলো, শোয়েব ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বললো।
কিছুক্ষণ পর সামনে ঝোঁপ ঠেলে যাকে বেরিয়ে আসতে দেখলো তার জন্য ওরা বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলো না। শোয়েবেরই বয়সী হবে, হালকা পাতলা রোগাটে গড়নের এক তরুণ ভীত সন্ত্রস্ত চোখে পেছনে আর ডাইনে বাঁয়ে তাকাতে তাকাতে ওদের দিকে এগিয়ে আসছিলো।
পরনে কালো প্যান্ট, গায়ে নীল জিনসের জ্যাটেক, চোখে বেশি পাওয়ারের চশমা, চুল উসকো খুসকো, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি–ছেলেটা সেগুন গাছের গায়ে ধাক্কা খেতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। থমকে দাঁড়িয়ে প্রথমে চোখের সামনে গাছটাকে দেখলো। তারপরই শোয়েবদের ওপর চোখ পড়লো। শোয়েবরা চার জন বিস্মিত চোখে ছেলেটাকে দেখছিলো। ওদের চোখের সামনে ছেলেটার মুখ কাগজের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। মনে হলো চিড়িয়াখানার হিংস্র বাঘের খাঁচায় বুঝি ওকে কেউ নামিয়ে দিয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে যেন ও জ্ঞান হারাবে।
প্রথমে কথা বললো শোয়েব–আমাদের দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মনে হচ্ছে আপনি বিপদে পড়েছেন?
ছেলেটা কোনও রকমে ঢোক গিলে বললো, হ্যাঁ, আমাকে কিছু বাজে লোক তাড়া করছে।
বাজে লোক মানে ডাকাত?
সাধারণ ডাকাত নয়। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর।
খুলে বলুন। অধৈর্য গলায় জানতে চাইলে শোয়েব। একটু ইতস্তত করে ছেলেটা বললো, এরা একটা পালিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে জড়িত।
পার্টি মানে? জামাতের কথা বলছেন?
হ্যাঁ জামাত শিবিরের গুন্ডারা আমাকে ধাওয়া করছে। ওর কথা শুনে ঝন্টু, রবি আর সুমন নিজেদের ভেতর দৃষ্টি বিনিময় করলো। শোয়েব বললো, শিবির কেন আপনাকে ধাওয়া করবে? আপনি কে?
আমার নাম মাহবুব। আমি কক্সবাজার কলেজের ছাত্রলীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট। দুদিন আগে ওরা আমাকে জোর করে ধরে এনে রাবেতা কমপ্লেক্স-এ একটা ঘরের ভেতর আটকে রেখেছিলো। আমি কাল রাতে জানালার শিক আলগা করে পালিয়ে এসেছি।
আপনাকে ধরে এনেছিলো কেন?
ওরা আমাদের কলেজের শহীদ মিনার ভেঙে ফেলেছিলো। তারপর আমরা অন্য সব ছাত্র সংগঠন মিলে ওদের মেরে কলেজ থেকে বের করে দিয়েছিলাম। আমাকে একা বেকায়দায় পেয়ে ধরে এনেছিলো। একটু থেমে মাহবুব বললো, আপনারা কারা?
শোয়েব সামান্য হেসে মাহবুবের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো আমি আর আপনি একই নৌকার যাত্রী। আমার নাম শোয়েব। চিটাগং ইউনির্ভাটিতে পড়ি। শিবিরের গুন্ডারা আমাকেও খুঁজছে।
কেন? অবাক হয়ে জানতে চাইলো মাহবুব।
ওদের মৃত্যুবাণ আমার হাতে। এই বলে শোয়েব ওকে সংক্ষেপে ওর পালাবার কারণ বললো। তারপর সুমন, ঝন্টু আর রবিকে ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো।
মাহবুব সবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সামান্য হেসে বললো, এমন দুঃসময়ে আপনাদের পেয়ে মনে হচ্ছে আল্লা বুঝি আকাশ থেকে ফেরেশতা পাঠিয়ে দিয়েছেন।
শোয়েব দু পা এগিয়ে মাহবুবকে বুকে জড়িয়ে ধরলো এখন থেকে আমরা বন্ধু। কী বলল মাহবুব?
মাহবুব আবেগ রুদ্ধ গলায় বললো, আমাকে বন্ধু ভাবার জন্য অনেক ধন্যবাদ শোয়েব।
সুমন মৃদু হেসে ঝন্টুকে বললো, আমরা তাহলে শোয়েব ভাইর মতো মাহবুব ভাইকেও তুমি বলবো।
নিশ্চয়ই তুমি বলবে। মাহবুবের মুখেও হাসি ফুটলো–আমার এখনও মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি।
রবি হেসে বললো, স্বপ্নের ভেতর ক্ষিদে পায় না মাহবুব ভাই। তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে দুদিন তুমি কিছু খাওনি।
ঠিক ধরেছো। কাল সন্ধ্যায় শুধু এক কাপ চা আর দুটো রুটি খেতে দিয়েছিলো।
তুমি সকালে ওদের নাশতার জন্য অপেক্ষা না করে রাতে পলিয়ে গেছে। তোমাকে উপোষ রাখার জন্য ওদের দায়ী করতে পারতে না মাহবুব।
আল্লা মালুম, আজ সকালে নাশতা দিতো-না হাত পায়ের রগ কেটে রাস্তার ধারে ফেলে রাখতো।
ওদের হাতে ধরা পড়লে আমাদেরও একই দশা হবে।
মাহবুবের দেখা পাওয়ার আগে থেকেই গুলির শব্দ থেমে গিয়েছিলো। শোয়েব ওকে প্রশ্ন করলো ওরা কি জেনে ফেলেছিলো তুমি যে এই জঙ্গলে লুকিয়েছ?
মনে হয় না। আমি তো শেষ রাতে পালিয়েছি। ওদের কারও নজরে পড়ার কথা নয়। হতে পারে ওরা ধারণা করেছে আমি জঙ্গলে লুকিয়েছি।
শোয়েব মাথা নাড়লো–তাই হবে। সাড়া শব্দ না পেয়ে ওরা ভেবেছে তুমি বোধহয় অন্য কোথাও লুকিয়েছে।
ঝন্টু বললো, এখন কী করবে শোয়েব ভাই? সুমন বললো, দলে যখন ভারি হয়েছি হাইওয়ের দিকেই যাই না কেন শোয়েব ভাই?
মাহবুব ভীত গলায় বললো, না সুমন। দলে আমরা যত ভারিই হই না কেন, আমদের কাছে অস্ত্র নেই। ওদের সবার কাছে অটোমেটিক পিস্তল নয় বন্দুক রয়েছে।
হাইওয়েতে নিশ্চয় এখন গাড়ি চলাচল করছে। পেট্রল পুলিশও থাকতে পারে।
ম্লান হেসে মাহবুব বললো, পুলিশের ভেতরও ওদের লোক রয়েছে। কে জানে ওরা আমাকে খোঁজার জন্য পুলিশ লাগিয়েছে কি না।
মাহবুবের কথা সমর্থন করলো শোয়েব তুমি ঠিক বলেছো মাহবুব। আমরা এখানে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিশ্চিত হতে চাই ওরা জঙ্গলে আছে না চলে গেছে। ওরা চলে গেলে আমরা জঙ্গলের ভেতর দিয়েই কক্সবাজারের দিকে হাঁটবো।
কক্সবাজার এখান থেকে কত দূর হবে মাহবুব ভাই? জানতে চাইলো রবি। বেচারা ক্ষিদেয় একেবারে অস্থির হয়ে পড়েছিলো।
একটু ভেবে মাহবুব বললোঃ তিন চার মাইলের মতো হবে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গেলে ঘন্টা দুয়েক লাগবে।
তার আগে পথে কি কোনও গ্রাম-টাম পড়বে না?
তা পড়বে। স্কুলে থাকতে এদিকে স্কাউটিঙে আসতাম।
তুমি স্কাউট ছিলে? উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো ঝন্টু।
মাথা নেড়ে সায় জানালো মাহবুব–তার মানে তুমিও স্কাউট?
হাঁ মাহবুব ভাই। গর্বিত গলায় ঝন্টু বললো, আমাদের হচ্ছে ফিফথ ঢাকা ট্রুপ।
শোয়েব হেসে বললো, তাহলে স্কাউটরা, তোমরাই আমাদের পথ দেখাও।
ওর কথার ধরনে মাহবুবও হেসে ফেললো–মনে হচ্ছে তুমি দলপতির দায়িত্ব থেকে স্বেচ্ছায় সরে যেতে চাইছো শায়েব?
অসহায় ভাব করে শোয়েব বললো, দু দুটো জলজ্যান্ত স্কাউট থাকতে আমি কি করে দলনেতা হই।
তাহলে চলে যাওয়া যাক। দলপতির মতো গলাটা গম্ভীর করে বললো মাহবুব।
তথাস্তু। বলে শোয়েব ওকে অনুসরণ করলো। সুমন, ঝন্টু আর রবি মৃদু হেসে নিজেদের ভেতর দৃষ্টি বিনিময় করলো। ওরা লক্ষ্য করেছে মাহবুবকে পেয়ে শোয়েবের ভয় অনেক কেটে গেছে।
ঘন্টা খানেক হাঁটার পর ওরা দূরে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় দুটো ছনের ঘর দেখতে পেলো। মাহবুব বললো, তোমরা এখানে অপেক্ষা করো। বেশি লোক দেখলে ওরা ঘাবড়ে যেতে পারে।
শোয়েবদের দাঁড় করিয়ে রেখে মাহবুব গেলো খাবারের খোঁজে। দূর থেকে ওরা লক্ষ্য করলো মাহবুবকে দেখে ঘরের ভেতর থেকে মঙ্গোলিয়ান চেহারার মাঝবয়সী এক লোক বেরিয়ে এলো। মাহবুব লোকটার সঙ্গে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বললো। তারপর লোকটা ঘরের ভেতরে গিয়ে একটা পলিথিনের ব্যাগ ভর্তি কিছু জিনিস এনে মাহবুবের হাতে তুলে দিলো। দুজন আরও কিছুক্ষণ কথা বললো। মাহবুব পকেট থেকে সম্ভবত টাকা বের করে দিলো লোকটাকে। তারপর শোয়েবদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।
রবি উত্তেজিত গলায় বললো, মাহবুব ভাই ঠিকই ম্যানেজ করে ফেলেছে।
কাছে এসে মাহবুব বললো, কিছু চিড়া আর বুনো কলা পাওয়া গেছে।
দারুণ বলেই হাত বাড়িয়ে দিলো রবি–জলদি বের করো মাহবুব ভাই। ক্ষিদের চোটে জান বেরিয়ে যাচ্ছে।
শোয়েব বললো, আগে কলা খাওয়া যাক। চিড়া খেলেই পানির তেষ্টা লাগবে।
ওপাশটায় একটা পাহাড়ী ঝর্ণা আছে। পুব দিকে ইশারা করে মাহবুব বললো, ওদিকে চলল। এখানে থাকা নিরাপদ নয়।
মাহবুবের সঙ্গে ঝর্ণার দিকে হাঁটতে হাঁটতে শোয়েব বললো, নিরাপদ নয় কেন বলছো মাহবুব?
বলছি! আগে গলাটা ভিজিয়ে নিই। অল্প কিছুক্ষণ হাঁটার পরই ঝর্ণাটা ওদের চোখে পড়লো।
ঝর্ণার চেহারা দেখে সুমন, ঝন্টু, রবি কেউই খুশি হতে পারলো না। ঝর্ণা না বলে সরু নালা বললেই ঠিক হতো। মাহবুব নিচে নেমে এক আজলা পানি তুলে মুখে দিয়ে বললো, চমঙ্কার ঠান্ডা পানি। এসো সবাই।
ওরা চারজন কয়েক আজলা ঝর্ণার পানি গিলে, মুখ হাত ধুয়ে ঠাণ্ডা হয়ে বসলো। মাহবুব যে কলাগুলো এনেছিলো–আকারে ছোট হলেও খেতে বেশ মিষ্টি। চিড়ার সঙ্গে কলা খেতে খেতে মাহবুব বললো, লোকটা বললো সকালে নাকি দুজন লোক এসে তোমাদের খোঁজ করে গেছে।
মানে? অবাক হয়ে জানতে চাইলো শোয়েব।
বেলা দশটার দিকে দুটো লোক এসেছিলো। ওদের বাড়িতে। লোক দুটোর মুখে চাপদাড়ি আর সঙ্গে বন্দুক ছিলো। জিজ্ঞেস করেছে তিনটা কমবয়সী আর একটা জোয়ান ছেলেকে ওরা কেউ এদিক দিয়ে যেতে দেখেছে কিনা। বলেছে যদি খবর দিতে পারে তাহলে একশ টাকা বখশিশ দেবে।
বলো কি মাহবুব? শোয়েবের গলা দিয়ে চিড়া নামতে চাইলো না। কোথায় খবর দিতে বলেছে?
দক্ষিণে আধ মাইল দূরে ওদের ক্যাম্প আছে। লোকটা চেনে। বললো, ক্যাম্পে নাকি জোয়ান ছেলেরা অস্ত্র চালানো শেখে।
কী সাংঘাতিক! আঁতকে উঠলো রবি–আমরা তো একটু হলে ওদের ক্যাম্পে গিয়ে উঠতাম!
এখন কী হবে মাহবুব? উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলো শোয়েব।
আমাদের আরও পুব দিকে সরে যেতে হবে। এই ঝর্ণা ধরে মাইল খানেক গেলে একটা সুরু রাস্তা পড়বে। কাঠুরিয়ারা ওই পথ দিয়ে শহরে যায়।
পথের আশেপাশে শিবিরের ক্যাম্প নেই তো?
লোকটা তো বললো নেই।
তাহলে চলল, বসে থেকে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। বেলা থাকতে থাকতে আমাদের কক্সবাজার পৌঁছানো দরকার।
চিড়া আর কলা খেয়ে ওদের সবার পেট ঠান্ডা হয়েছিলো। আরেক দফা ঝর্ণার পানি খেয়ে ওরা পুব দিকে হাঁটলো। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে।
মিনিট পনেরো হাঁটার পর জঙ্গল আবার ফাঁকা হয়ে এলো। আশে পাশে গাছ কাটার চিহ্ন চোখে পড়লো। সুমন বললো, এই জঙ্গলে গাছ কাটা নিশ্চয় বেআইনি মাহবুব ভাই?
মাহবুব বললো, ঠিক ধরেছো। এগুলো চোরদের কাজ।
আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওদের চোখে পড়লো কয়েকটা লম্বা ছন আর বেড়ার ঘর। বেশ দূরে ফাঁকা জায়গায় ইতস্তত ছড়ানো। তবে আশেপাশে কোনও মানুষ নেই।
মাহবুব বললো, তোমরা এখানে দাঁড়াও। দেখে আসি গ্রামের ওপর দিয়ে যাওয়াটা নিরাপদ হবে কি না।
আগের মতো ওদের দাঁড় করিয়ে রেখে মাহবুব গ্রামের দিকে এগিয়ে গেলো। সুমনরা লক্ষ্য করলো এদিকের ঘরগুলো সব মাচার ওপর। তলাটা ফাঁকা। শোয়েবের কাছে রবি জানতে চাইলো, ঘরগুলো মাটির অতো ওপরে কেন?
বন্য জন্তু জানোয়ারের হামলা থেকে বাঁচার জন্য উপজাতীয় লোকেরা এভাবে ঘর বানায়।
সুমন লক্ষ্য করলো মাহবুব ইতস্তত না করে সোজা একটা ব্যারাকের মতো ঘরে সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে উঠে গেলো, যেন ওর অনেক পরিচিত। ও ঘরে ঢুকেছে এক মিনিটও হয়নি তীব্র শব্দে একটা হুইসেল বেজে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে আরো কয়েকটা হুইসেল বাজলো।
শোয়েব, সুমন, ঝন্টু আর রবি হতবাক হয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখলো, যেন মাটি কুঁড়ে উঠে এসেছে দশ বারো জন ভয়ঙ্কর দর্শন লোক। সবার হাতে স্টেনগান ধরা, পরনে কালো পোষাক,মুখে দাড়ি। একজন চিৎকার করে বললো, সবাই হাত তুলে দাঁড়াও। নইলে মেশিন গানের গুলিতে শরীর ঝাঁঝড়া হয়ে যাবে।
শোয়েবরা কোনও কথা না বলে মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়ালো। চারজন লোক এসে ওদের শক্ত করে পিছ মোড়া করে বেঁধে ফেললো।