কিন্তু কী হবে আমার এ সব কথা ভেবে। আমার সমস্ত ঘা তো শুকিয়ে গিয়েছিল খুকুকে পেয়েই। কী মাস ছিল সেটা? সিক্সটি ফোরের নভেম্বর? অগ্রহায়ণ মাস মনে আছে। কানুর সঙ্গে ওদের জোড়াদিঘি পাড়ার বাড়ি থেকে ফেরবার সময়, খুকুকে প্রথম দেখেছিলাম। বেলা শেষের লাল রোদ, না খুকু নিজেই আগুনের মতো লাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার আগে কানুর কাছ থেকে প্রায়ই খুকুর কথা শুনতাম। খুকুর সঙ্গে ওর ভালবাসার কথা–হ্যাঁ, আমি তা-ই জানতাম, খুকু কানুর প্রেমিকা। খুকুর মায়েরও সায় ছিল, আর সেই সুযোগে, কানু নাকি খুকুর সঙ্গে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। কানুর কথা থেকে মনে হত, খুকুর মায়ের সঙ্গেও ওর ভাবটা যেন গলাগলি করার মতো।
আমি শুনেই যেতাম, ভাবতাম না কিছুই। ও সব কথা শোনবার বা জানবার তেমন কোনও ইচ্ছা বা কৌতূহল কোনওকালেই আমার ছিল না। কেন? আমি ত্রিলোচন চাটুয্যের ছেলে বলে? মেয়েদের ওপরে কি আমার ঘেন্না ধরে গিয়েছিল? তা যদি হবে, তবে জোড়াদিঘি পাড়ার বেলা শেষের রোদে দুই সুপুরি গাছের মাঝখানের আগুনের মতো মূর্তি আমার ভিতরে আগুন জ্বালিয়েছিল কেমন করে? আমি তো কিছু ভেবে তাকাইনি। কেবল জ্যোৎস্না নামটা শুনে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, ওই মেয়ের নাম জ্যোৎস্না কেন? কেন রোদ নাম রাখা হয়নি? এমনকী শীতের রোদও ওকে বলা যায় না। খর জ্যৈষ্ঠের রোদ বলা চলে। কেন ও ওর কালো চোখে, ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, ও যেন ওর সমস্ত শরীর দিয়ে আমাকে ডাকছে।
আমি জানি না, সেটাও কি একটা নিয়তি, কানু খুকুকে দেখে, আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল? কেনই বা খুকু ওদের বাড়ির ভিতরে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল? সামাজিকতা? ভদ্রতা? কত দূর পর্যন্ত তার গতি? আমি কি জানতাম, খুকুর আগুনে গলে গিয়ে আমি স্রোতের মতো যে বাড়িতে এক বার ঢুকেছিলাম, আর কোনও দিনই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পারব না? কানুও। কি জানত?
জানত না। জানলে, কানু কোনও দিনই খুকুর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিত না। কয়েক মাসের মধ্যেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কানু আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। তবু তখনও আমি একলা মজুমদার বাড়ি যেতাম না। যখনই যেতাম, কানুর সঙ্গে যেতাম। কানুকে নিজেই বলতাম, চল, খুকুদের বাড়ি যাই।’…কারণ খুকু তখন আমাকে চুম্বকের মতো টানত। কানু ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলত, কেন? মনে হচ্ছে খুকু তোর নাভির নীচে পাক দিচ্ছে?..
কানুর ওই কথাটার মানে আমি বুঝতে পারতাম না। আর খেয়াল করিনি, ওর ঠোঁট বাঁকানো হাসিতে আমার ওপর ঘৃণা রি-রি করছিল, ঘাড়ের শিরা মোটা হয়ে ফুলে উঠেছিল। পরে টের পেয়েছিলাম একেবারে গায়ে গতরেই। সন্ধ্যার পর একদিন কানুকে খুকুদের বাড়ি যাবার কথা বলতেই, ও প্রথমে। আমার পাছায় কষে একটা লাথি মেরেছিল। তারপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ে, চোয়ালে এক ঘুষি, আর যাচ্ছেতাই খিস্তিখেউড়। আমি থ মেরে গিয়েছিলাম। ঘটনাটা ঘটেছিল রায়পুকুরের ধারে মাঠে, প্রায় অন্ধকারে। কেউ দেখতে পায়নি। পেলে কী লজ্জায় পড়তে হত? অথচ কানুর শরীরটা আমার থেকে অনেক ছোটখাটো রোগা। আমি যদি ওকে পালটা মারতাম?
কিন্তু কানুকে মারার কথা আমার মনেই হয়নি, কেবল বলেছিলাম, এ কী রে কানু, আমাকে মারলি?
মারব না তো শালা তোকে আদর করব?’ কানু আরও খাপচুরিয়াস হয়ে বলেছিল, শালা লম্পট বদমাইশ, খুকুদের বাড়ি কেন যেতে চাস আমি জানি নে? শুয়োরের বাচ্চা, তুই জানিসনে, খুকুর সঙ্গে আমার আছে? আমার খেয়ে, শালা আমার বুকে বসে দাড়ি ওপড়ানো? আমার জিনিসের দিকে হাত বাড়ানো? শালা, ওই হাত কেটে দেব।
কিন্তু ব্যাপারটা কি সত্যি তা-ই ছিল! খুকু হাত না বাড়ালে, আমার কি হাত বাড়াবার সাহস ছিল? তা ছাড়া হাত বাড়ানোর মানেই বা কী? আমি কি হাত বাড়িয়ে খুকুকে সেই সময় কখনও জড়িয়ে ধরেছিলাম? একটাও চুমো খেয়েছিলাম? বরং খুকু যেন নিতান্ত চলতে গিয়েই, গায়ের সঙ্গে একটু ছোঁয়া লাগিয়ে যেত। নিতান্ত হাত ধরার জন্যই, সকলের সামনে ধরত। অবিশ্যি কখনও কখনও সন্ধ্যার আবছায়ায় ও দূর থেকে, সকলের আড়ালে, আমার দিকে তাকিয়ে হাসত। যে-হাসির একটাই মনে করা যায়। লজ্জা আর ভাল লাগা। আমি তখন মনে মনে সত্যি ওকে জড়িয়ে ধরতে চাইতাম, চুমো খেতে ইচ্ছা করত। কানু হয়তো সে সব কখনও দেখেছিল। কিন্তু কানু আমাকে ওইরকম আচমকা মারবে, ভাবতেও পারিনি। অথচ আমি ওর ওপরে রাগ করিনি, বরং মনে মনে কষ্ট পেয়েছিলাম, আর ওর কাছ থেকে চলে আসবার আগে বলেছিলাম, ঠিক আছে, আর কোনও দিন তোর খুকুদের বাড়ি যাব না। তোর সঙ্গেও আমার শেষ।
শেষ? হ্যাঁ, কানুর সঙ্গে শেষ হয়েছিল সত্যি, কিন্তু খুকুর সঙ্গে না। কারণ মাসখানেক পরে খুকু একদিন বিকালে আমাদের বাড়ি এসে হাজির হয়েছিল। বাগানের দরজা দিয়ে এমন সহজভাবে বাড়ির মধ্যে ঢুকেছিল, যেন মোটেই নতুন আসেনি। আমি সেই সময়েই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমেছিলাম। মা নিজের ঘরে ছিল। বিনতি পাড়ায় কোথাও বেরিয়েছিল। অবাক আমিও কম হইনি, কারণ ধরেই নিয়েছিলাম, জীবনের একটা পাট চুকে গিয়েছে। খুকু এগিয়ে আসতে আসতে বলেছিল, কী দুদেদা, আমাদের বাড়ি আর যান না কেন?
মা বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। আমি ঠিক হাসতে পারছিলাম না, মনে মনে খুশি হলেও, ভাবছিলাম, খুকু নিশ্চয়ই কানুর সঙ্গে আমার ঘটনাটা শোনেনি। মা আমার দিকে তাকিয়েছিল। স্বাভাবিক। আমি আগে খুকুকে বলেছিলাম, মানে–যাইনা মানে, সময় হয় না।’…মাকে বলেছিলাম, এর নাম জ্যোৎস্না মজুমদার, জোড়াদিঘি পাড়ায় বাড়ি।
জোড়াদিঘি পাড়ায় মজুমদার! মায়ের ভুরু কুঁচকে উঠেছিল, ঝুলনতলায় যাবার সময় জোড়াদিঘি পাড়া দিয়ে যাই, অনেক বাড়িই চিনি, কিন্তু মজুমদার বাড়ি চিনিনে তো?
খুকু হেসে বলেছিল, আমাদের বাড়ি ছিল ইস্টবেঙ্গলে। আমার ঠাকুরদা পার্টিশনের অনেক আগে এখানে এসে বাড়ি করেছিলেন। ও মাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল।
মা খুকুর হাত ধরে, সিঁড়ির গায়ে ঠামার কুটনো কোটার ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। বোধ হয় পরিচয় পর্ব সারা হয়েছিল। মা খুকুর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বুঝতে পেরেছিল। তারপরেই বাড়ি যাবে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে, বিরাট লম্বা থামওয়ালা বারান্দার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কী বিরাট বাড়ি! একটু দেখতে ইচ্ছে করছে।
মা বলেছিল, যা না দুদে, জ্যোৎস্নাকে ওপরে নিয়ে বাড়িটা দেখা।
সব ঘটনাটা সাজানো মনে হয়েছিল। আমি খুকুকে নিয়ে ওপরে গিয়েছিলাম। ও ছাদে যেতে চেয়েছিল। ওপরের সিঁড়ির দরজার তালা খুলে ছাদে গিয়েছিলাম। খুকু ছেলেমানুষের মতোই গোটা ছাদটার চারদিকে ঘুরে দেখেছিল। আমি তখনও অবাক চোখে ওকেই দেখেছিলাম। আর ও যেন আমাকে দেখতেই পাচ্ছিল না, এমন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ আমার সামনে এসে বলে উঠেছিল, কী ব্যাপার, আমাদের বাড়ি আর যাওয়া হয় না কেন?
ওইরকম কথাকেই তো ভাববাচ্য বলে। কিন্তু খুকু আমাকে দুদেদা ‘আপনি’ করেই বলত। ভাববাচ্যে সেই প্রথম, আর আমি ওর কথায় চমকিয়ে উঠে শব্দ করেছিলাম, অ্যাঁ?’
সত্যি কথা শুনতে চাই, কী হয়েছে? খুকু খুব কাছে এসে আমার চোখের দিকে তাকিয়েছিল, নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে নইলে একেবারে যাওয়া বন্ধ করে দেবার কারণ কী?
খুকুর আগুনের আঁচে আমি গলে ওর ভিতরে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের বাড়ির নিরালা মাঠের মতো ছাদে ও আমার গায়ের কাছে দাঁড়িয়ে, যেন ভাবতে পারছিলাম না। কী মাস ছিল সেটা? বাতাস ছিল খুব, খানিকটা এলোমেলো। আমি ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না, জিজ্ঞেস করেছিলাম, কানু কিছু বলেনি?
বলেছে, আর সেটাই আমি যাচাই করতে এলাম। খুকু একটু মুখভার করে বলেছিল, আমাদের বাড়ি যেতে নাকি ভাল লাগে না? আমার মা বাবা দাদা বোনদের কারোকেই নাকি ভাল লাগে না?
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কার?
খুকু আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিল। আমি আরও অবাক হয়ে বলেছিলাম, আমার?
তাই তো কানুদা বলেছে।
মিথ্যে বলেছে। কানুই বরং তোমাদের বাড়ি আমার যাওয়া পছন্দ করে না, মানে চায় না আমি যাই!
খুকুর কালো চোখের পাতা কুঁচকে উঠেছিল, মুখটাও একটু শক্ত দেখাচ্ছিল, আমি এইরকমই কিছু সন্দেহ করেছিলাম। কী বলেছে সে?
আমি সে সব কথা বলতে পারিনি। মারধোর খিস্তিখেউড় সে সব কথা বলা সম্ভব ছিল না। বলেছিলাম, কী আর বলবে? কানু জানিয়ে দিয়েছিল আমি যেন তোমাদের বাড়ি আর না যাই।
কানু বলল, আর আমাদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিতে হল? খুকুর শক্ত মুখে রক্তের ছটা লেগেছিল, কেন, ও কে এ কথা বলার?
আমার পক্ষে সে কথার জবাব দেওয়া আরওই কঠিন ছিল। ও কে, বা খুকুর কে, তা খুকুরই তো জানবার কথা। আমি কোনও জবাব দিইনি। বরং খুকুই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কানু নিশ্চয়ই বলেছে, আমি ওর সঙ্গে প্রেম করি?
খুকুর মুখে ওইরকম স্পষ্ট কথা শুনে, আমিই ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিলাম, কোনও জবাব দিতে। পারিনি। খুকু বলেছিল, বুঝেছি। কিন্তু আমার তো যদুর মনে পড়ে, আমিই একজনকে রাস্তা থেকে আমাদের বাড়িতে ডেকে নিয়েছিলাম।
একজন বলতে খুকু আমাকেই বুঝিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ, কিন্তু কানুর বন্ধু হিসেবেই তো ডেকে নিয়েছিলে। ও-ই তো আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।
তাই আমরা কেউ নই? কানু যা বলবে তাই মেনে নিতে হবে? খুকু যেন আমাকেই বিধিয়ে বিধিয়ে কথাগুলো বলেছিল, আলাপ তো কত লোকের সঙ্গেই কত লোকে করিয়ে দেয়, তা বলে তাদের বন্ধুত্ব মেলামেশা ভাব ভালবাসা…।
খুকুর গলার স্বর যেন বাতাসের ঝাপটায় আটকিয়ে গিয়েছিল।
আমি খুকুর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম, মনে হয়েছিল যেন ওর ঠোঁট দুটো বাতাসেই থরথর করে কাঁপছে, মুখ আরও লাল, চোখ দুটো ছলছল করছিল। খুকুর গলা আসলে কান্নায় বন্ধ হয়ে এসেছিল। আমার নিজেরই এমন কষ্ট হয়েছিল আর অবাক হয়েছিলাম কোনও কথা বলতে পারিনি, কেবল ওকে ডেকে উঠেছিলাম, খুকু!
খুকু দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। আমি ওর মোটা বেণীর পাশে লাল ফরসা ঘাড়ের শিরায় যেন রক্ত চলাচল করতে দেখেছিলাম। আসলে মনে হচ্ছিল ওর চোখের জল কলকলিয়ে উঠছিল। আমি আবার প্রায় গোঙানোর মতো করে ডেকে উঠেছিলাম, খুকু!
খুকু মুখ ফেরায়নি। আমি ওর ঘাড়ে, সেই রক্ত চলাচলের শিরায় হাত রেখেছিলাম, বলেছিলাম, খুকু, আমি তোমাদের বাড়ি যাব।
কবে? খুকু মুখ না ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।
আমি বলেছিলাম, তুমি যেদিন বলবে।
আজ এখুনি, আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে যেতে হবে। খুকু দাবি করেছিল। ওর স্বর কি ভেজা ছিল?
আমি বলেছিলাম, তাই যাব।
খুকু আমার দিকে ফিরে দাঁড়িয়েছিল। ওর চোখ শুকনো ছিল, কিন্তু কালো চোখ দুটো যেন আরও কালো হয়ে ঝকঝক করছিল। ওর লাল ঠোঁটে হাসি। কী মাস ছিল সেটা? এলোমেলো বাতাসে ওর টেনে বাঁধা বেণী দোলানো চুলও কয়েকগাছি উড়ে কপালে পড়েছিল। আঁচল বুকে ধরে রাখা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল মাথা ঠুকে মরে যাব। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। মরে যাব? মরে তো গিয়েছিলাম। এখন কি আমি জীবিত? না, এটা আমার প্রেত?
খুকু আমার দিকে ফিরেছিল, তখনও ওর ঘাড়ে আমার হাত। আমি বুঝতে পারছিলাম না, ওর সেই আশ্চর্য বুক দুটো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ফুলে ফুলে আমার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে আসছিল কিনা। নাকি ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেই কিছু একটা ছিল। মনে হচ্ছিল, বাতাসে আমার ঠোঁটও কাঁপছে। খুকু ঘাড় কঁকিয়ে বলেছিল, চলো।
চল! মানে খুকু আমাকে তুমি করে ডেকেছিল? চলো! কোথায়? জোড়াদিঘি পাড়ায়?
হা হা হা করে আমার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা করছিল, চলো চলো, দিল্লি চলল! কোথায় তুই কানু? এবার এক বার এসে শক্ত মুখে আমার সামনে দাঁড়া, এক বার পা তোল, এক বার হাত তোল, তোকে আমি গুঁড়িয়ে ফেলব। হ্যাঁ, ওইরকম আমি মনে মনে বলেছিলাম। খুকু আমার বুকের জামা টেনে ধরে সিঁড়ির দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, চলো, সন্ধে হয়ে আসছে।
আমার যে তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল? ঠাকুরদার ঘরের পশ্চিমে, বড় আম গাছটার আড়াল থেকে টকটকে লাল খোঁচা খোঁচা আলো এসে পড়েছিল খুকুর গায়ে। আমি দু হাত দিয়ে খুকুর গলা জড়িয়ে ধরেছিলাম। খুকু বলেছিল, এখানে না, আমাদের বাড়ি গিয়ে।
গম্বুজের নীচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলে যেমন সেই কথার প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যেতে থাকে সেই ভাবেই আমার কানে বেজেছিল, আমাদের বাড়ি গিয়ে আমাদের বাড়ি গিয়ে–আমাদের বাড়ি।
তারপর থেকে খুকুদের বাড়ি না, আমাদের বাড়ি। খুকুর মা প্রথম দিকে আমাকে ঠিক পছন্দ করত না। আমি বুঝতে পারতাম তাকে মাসিমা না ডেকে বউদি বলে ডাকলেই বেশি খুশি হত। দেখতে তো খুকুর থেকে খুব কম সুন্দরী ছিল না। সে চাইত তার সঙ্গে বসে গল্প করি আড্ডা দিই। খুকুর বাবা লোকটি অতি মাত্রায় বৈষয়িক ছিল। সবসময়েই জমিজমা নিয়ে চিন্তা করত, বাইরে বাইরে ঘুরত আর–আর হ্যাঁ, সিক্সটি সিক্সেও খুকুর আর একটি টুকটুকে বোন হয়েছিল। জমি আর ফসল, বউ আর। বাচ্চা, সবই একাকার। খুকুর ওপরের ভাই আমার থেকে ছোট ছিল। সেও তার বাবার মতো, হাফ বাবা। বিয়ে করেনি, কিন্তু জমিজমা নিয়ে খুব ভাবত, আর বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। খুকুর পরে আরও দুই বোন, দুই ভাই, একেবারে শেষেরটি আবার এক বোন।
আমি জানতাম–জানতাম? নাকি ভাবতাম, খুকুর ভালবাসা ছিল ডেসপারেট? আসলে, খুকুই আমাকে সাহস জুগিয়েছিল। ওর বাবা মা আমাদের বিরাট বাড়ি বিজলি আলো পাখা, এ সব দেখে খানিকটা খুশি ছিল। তা ছাড়া, তাদের ধারণা ছিল, আমাদের সম্পত্তির পরিমাণ কম না। আমি বাবা মায়ের এক ছেলে। বাবাকে নিয়ে কিছুটা মাথাব্যথা ছিল। খুকু ও সব আমল দেয়নি।
আমাদের বাড়িতে ভিতরে ভিতরে আপত্তি ছিল। দাদু তো আমাকে ডুবিয়েই দিলেন। মায়ের মনও খচখচ করছিল। কৃষ্ণনগরের বড় পিসিমা সরাসরি খুকুকে বিয়ের কথায় আপত্তি জানিয়েছিলেন, কিন্তু আমার বউয়ের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ গহনা উপহার দিয়েছিলেন। বিয়েতে আসেননি। ছোট পিসিমার আপত্তি থাকলেও বিয়েতে এসেছিলেন, খুকুকে বেশ কিছু গহনা দিয়েছিলেন। জ্যাঠাইমা একেবারেই আপত্তি করেননি। বড়দা মেজদাও না। অবিশ্যি বড়দার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আর আমার বাবা?
জীবনের সেই কিছুকাল, বাবাকে আমার অন্য মানুষ মনে হয়েছিল। যদিও বাবা আমাদের সঙ্গে খেত না, তবু একটা সুখী সংসারের চেহারা দেখা গিয়েছিল। আমার বিয়ের দিন, বড়দা মেজদার সঙ্গে বাবাও। বরকর্তা হিসাবে খুকুদের বাড়ি গিয়েছিল। আমার বন্ধুরা সবাই নিমন্ত্রিত ছিল, একমাত্র কানু ছাড়া। আমি কানুকে নিমন্ত্রণ করতে চেয়েছিলাম, খুকু বলেছিল, না, কানুকে নিমন্ত্রণ করা হবে না। খুকুদের বাড়ি থেকেও করা হয়নি। কেন, সেটা আমি পরে বুঝেছিলাম।
বিয়ে! বিয়ের সেই রাত! তারপরে কালরাত্রি। তারপরে বউভাত। বউভাত? না, ফুলশয্যা? কিছুই শিখিনি, তবু এখনও ইচ্ছা করে, দারুণ একটা বর্ণনা দিই ফুলশয্যার, বর্ণনা অবিশ্যি আমি দিতে পারব না। জানি না, খোদ মহাদেবও দুর্গার সঙ্গে ওইরকম ফুলশয্যা করেছিল কি না। বর্ণনা দেব কী করে? ঘোর উন্মত্ততার কোনও বর্ণনা দেওয়া যায় কি?
বিয়ের এক মাস পরে, খুকুকে নিয়ে পুরীতে গিয়েছিলাম। কী বলে ওটাকে, হানিমুন? না, হনিমুন? কিন্তু খুকুর সঙ্গে মিশে আমার জানা হয়ে গিয়েছিল, যেখানে খুকু, সেখানেই পুরুষের ভিড়। আমি সমুদ্রের জলে খুকুর হাত ধরে, নুলিয়ার হাত ধরে স্নান করতে করতে, কখন এক সময়ে দেখতাম, খুকু অচেনা একজনের হাত ধরে দূরের জলে সাঁতার কাটছে। রাগে আমার বুকের মধ্যে জ্বলে উঠত, অথচ প্রাণটা যেন বড় কষ্টে দুমড়ে যেত। আমি খাবি খাওয়া মাছের মতো খুকুর কাছে ছুটে যেতাম, ওকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে আসতাম। কিন্তু খুকুর কি কিছু আসত যেত? পুরীতে এক গাদা লোক আমাকে দাদা দাদা’ বলে, ভাই ভাই’ বলে, আসলে খুকুকেই ঘিরে থাকত। নেহাত বাবা বাবা’ বলে কেউ ডাকত না, ডাকলে অবাক হবার কিছু ছিল না।
এখন বুঝতে পারি, খুকুর সঙ্গে মেশবার পর থেকেই ওকে আমি আগলে নিয়ে থাকতাম। আর ওই সবই ছিল, খুকুর কাছে একটা খেলার মতো। ও কি বুঝতে পারত না, ওর কাছে যা খেলা, আমার কাছে তা মরার যন্ত্রণা? না, ও বুঝতে পারত না, কারণ মেঘ হলে বৃষ্টি হয়, জলা জায়গায় জঙ্গল লতাপাতা আপনি আপনি জন্মায়, ডোবায় জন্মায় ব্যাঙাচি শামুক গুগলি, ওর কাছে ওই সবই ছিল সেই রকম। তৈরি করা কলমের গাছ, যত্ন করে কাটা পুকুর। সে রকম কিছু না। কী বলে ওই সবকে? নেচার? হ্যাঁ, নেচার। খুকুর নেচারই ছিল ওইরকম। আমি বুঝতে পারতাম, খুকু নিজেকে সামলাতে পারে না।
পুরীতে একটা অন্য মন নিয়ে গিয়েছিলাম, তা ছাড়া, বাইরের ব্যাপার, তাই মনে আমার চোট একটু বেশি লেগেছিল। কিন্তু খুকু আমাকে আশ্চর্য রকম ভাবে শান্ত করে দিত। এমন হাসত, এমন আদর করত, আমার নিজেরই মনে হত, অর্থহীন আমার রাগ, সবটাই আমার ভুল। নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হত, লজ্জা করত। ভাবতাম, খুকুর মনটা কত বড়, কত সাফসুরত। ভয় হত, আমি কি বায়ুগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম? আমার নিজের মধ্যেই তা হলে আসল ঘুঘুর বাস? মানে, যাকে বলে দুর্বলতা? আমি কি অন্য মেয়েদের কথা ভাবতাম, মনে মনে চাইতাম?
বুঝতে পারিনি কোনও দিন। জানি না, খুকুর মতো রূপসী কোনও মেয়েকে পেলে আমি কী করতাম। কিন্তু পাইনি, চেয়েছি কি না, তাও বুঝতে পারি না। যেমন ইদানীং আমাকে অনেকেই ইশারা-ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, আমি কীভাবে চালাচ্ছি। ইশারা ইঙ্গিতগুলো তেমন অস্পষ্ট না। খোলাখুলিই প্রায় জিজ্ঞেস করে কী রে দুদে, বেশ্যাবাড়িটাড়ি যাচ্ছিস নাকি? নাকি, আশেপাশেই কোনও মেয়েকে ম্যানেজ করে চালিয়ে যাচ্ছিস? নইলে আছিস কী করে?…যেন আমি একটা ভাদুরে কুত্তা। আসলে কেন ওইরকম জিজ্ঞেস করে, তা বুঝতে পারি। খুকুর মতো মেয়ে যার বউ ছিল, খুকুর মতো মেয়েকে নিয়ে যে ঘর করত, তার পক্ষে, তিন বছর বেলকাঠ ব্রহ্মচারী হয়ে থাকা কী করে সম্ভব?
সত্যি, আমি নিজেই উল্লুক, না কি ওরাই উল্লুক, বুঝতে পারি না। ওরা যা বলে, মানুষের জীবনের পক্ষে সেটাই কি সত্যি? আর আমি গাড়লের মতো জীবনটা কাটাচ্ছি? কারণ, আমি যে সত্যি কোনও মেয়ের কাছে যাওয়ার কথা ভাবি না, যাওয়া বা ভাবা দূরের কথা, আমার তো সে রকম কিছু মনেই আসে না। তা হলে আমি কি ইয়ে নাকি–ওই যাকে বলে অ্যাবনরমাল? ওদের কথা শুনলে সেই রকমই মনে হয়। যেন ওইরকম কিছু না করাটাই অসম্ভব।
অবিশ্যি, আমি নিজেই কি জানি না, আমার শরীর আর মন বলে বস্তু আছে। আমার সব কিছু জানা আছে, পাওয়া আছে, আর সেই জানা আর পাওয়া আমার রক্তের শিরায় শিরায় রয়েছে। তবে কেন আমার ইচ্ছা করবে না! আমার ভয়ংকর আর প্রচণ্ড ইচ্ছা করে, মনে হয় স্বর্গ মর্ত্য পাতাল উথাল পাথাল করি। কিন্তু কোথায়, কাকে? আমার-হা! আমার সবই যে এখনও খুকু আঁকড়িয়ে ধরে আছে। আমার মুক্তি কোথায়? তাই ভাবি, কী করে বুক চাপড়িয়ে বলব, খুকুর মতো রূপসী মেয়ে পেলে আমি কী করতাম জানি না? কিন্তু চাওয়া পাওয়ার কথা তো আমার মনেই আসেনি।
অথচ, সিক্সটি এইটে, আমার বিধাতার জন্মের পরে, জোড়াদিঘি পাড়ায় শ্বশুরবাড়িতে যখন প্রথম কানুকে দেখেছিলাম, খুকুর সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে, আর আমি রেগে গিয়েছিলাম, খুকু কত অনায়াসে হেসে বলেছিল, হাজার যোক অনেক দিনের চেনাশোনা, কতকাল আর ঝগড়া বিবাদ টিকিয়ে রাখা যায়, বল। এখন তো সব চুকেবুকেই গেছে। নিজের থেকেই এসেছে, কথা বলেছে, তাড়িয়ে তো দেওয়া যায় না।
সত্যি, খুবই সহজ আর স্বাভাবিক কথা। কানুও আমার সঙ্গে হেসে কথা বলেছিল, পুরনো বন্ধুর মতোই। তবু, যে সব কথা জেনে শুনেই আমি খুকুকে বিয়ে করেছিলাম, সেই কথাগুলোই কেন হাজারটা গাঁইতির মতো বুকে বিধেছিল? কানুর সেই সব কথা তো আমি ভুলিনি, ওর আর খুকুর প্রেমের খুঁটিনাটি বৃত্তান্ত। সেই সময় যে সব কথা ভাল করে শুনতে ইচ্ছা করত না, মনে কোনও দাগও কাটত না, সেই সব কথাগুলোই কেন বুকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উঠেছিল। খুকুকে আমি বিয়ের পরে সবই বলেছিলাম, ও সবই অস্বীকার করেছিল। অত্যন্ত খারাপ কথায় কানুকে গালাগাল দিয়েছিল। চুমো খাওয়া দূরের কথা, কানু নাকি খুকুর হাত পর্যন্ত কোনও দিন ধরতে পারেনি। জানি, ওটা নিতান্তই কথার কথা। আমার সামনেই কানু খুকুর হাত ধরে অনেক বার টানাটানি করেছিল।
সবই তো আমার জানা ছিল। সব জেনে শুনেই খুকুকে আমি বিয়ে করেছিলাম। তবু কানুর সেই পুরনো প্রেমকাহিনী কেন আমাকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। অথচ খুকু বিয়ের পর সবই অস্বীকার করেছিল। আমি কি তা হলে ওকে বিশ্বাস করিনি? যে কোনও শপথ করে বলতে পারি, ওকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু আবার যখন কানুকে খুকুদের বাড়িতে দেখেছিলাম, ওদের হেসে কথা বলতে দেখেছিলাম, তখন সব কিছু ছেড়ে কেবল কানুর গাঢ় প্রেমের কথাগুলোই আমার প্রাণে ছুরির মতো বিধেছিল। অথচ খুকু কত অনায়াসেই একটা স্বাভাবিক ব্যাপার আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল।
আমার অবস্থাটা হয়েছিল এঁড়ে লাগা ছেলের মতো। হিংসায় জ্বলতাম, অথচ এঁড়ে লাগা ছেলে যেমন মায়ের কোল, বুকের দুধ কিছুতেই ছাড়তে পারে না, আমার সেই রকম অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু এঁড়ে লাগা ছেলে যেমন তার ছোট ভাইকে সুযোগ পেলেই আঁচড়ে কামড়ে দিত, আমি সেই রকম করতে পারতাম না। মনে মনে করতাম।
বিয়ের আগে জানতাম, খুকু গান গাইতে পারে। বিয়ের পরে জেনেছিলাম, খুকু নাচতে পারে, আবৃত্তি করতে পারে, অভিনয় করতে পারে। দোতলায় আমার বন্ধুদের সঙ্গে সে সব কথা প্রায়ই আলোচনা হত। বন্ধুরা সবাই চাইত, খুকুকে আমি থিয়েটারে অভিনয় করতে দেব। অবিশ্যি আমার দেবার কিছু ছিল না, খুকু নিজেই আমাদের এলাকার নামী অনুষ্ঠানে গান করত, আবৃত্তি অভিনয় করত। নাচতও। যে সব মেয়েদের রূপ আছে, আর খুকুর মতো স্বাধীনতা আছে, তাদের কি আপনা থেকেই নানা গুণ গজিয়ে উঠতে থাকে? আর ওই ব্যাপারগুলো নিয়েই আমার মায়ের সঙ্গে বনাবনি হয়নি। খুকু অনায়াসেই ওর আর আমার সংসার আলাদা করে নিয়েছিল। দোতলায় একটা ঘরকে রান্নাঘর করে নিয়েছিল। সেটা সেভেনটির ঘটনা।
নারীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ? আমি কী করে মাকে সমর্থন করতে পারি? আসলে সেটাও ছিল, খুকুকে আমার একরকমের আগলে রাখার চেষ্টা। খুকুকে ধরে রাখার চেষ্টা। হা চেষ্টা! হারাবার ভয়কে কি চেষ্টা বলে! সেই ভয়েরই বা নাম কী? ভালবাসা? আহ্, শব্দটাকে সালফিউরিক অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া যায় না?
কী চমৎকার বাড়ির চেহারাটা দাঁড়িয়েছিল! বাবার কারখানার সংসার, আমার আর খুকুর সংসার। মা বিতির আর এক সংসার। খুকু একটি বছর বারোর মেয়েকে রেখেছিল, ছেলেকে দেখবার জন্য, সংসারের কাজের জন্যও বটে। বুঝতে পারিনি, সেভেনটি থেকেই আমার জীবনে আর একটা পটের শুরু হয়েছিল। তখন রাষ্ট্রপতির শাসন চলছিল। নকুল, পঞ্চানন, নির্মলরা ধাওয়ানকে দু বেলা খিস্তি দিচ্ছিল, আর রাগে টগবগ করছিল। অন্য দিকে নকশালরাও মাথা তুলছিল। মারামারি খুনোখুনি নিত্যকার ব্যাপারে দাঁড়াচ্ছিল। আর আমি এক একটা উলটো পালটা কথা বলে নিজের বন্ধুদের কাছেই মার আর খিস্তি খাচ্ছিলাম।
আসলে আমি তো পলিটিকসের কিছু বুঝতাম না, অথচ আনতাবড়ি কথা বলতে যেতাম। অবিশ্যি যে সব ঘটনা দেখলে বা শুনলে, আমার নিজের বন্ধুদেরই কেমন রাগী দাঙ্গাবাজ মনে হত, সে সব কথা বলে ফেলতাম। কিংবা, যেমন গৌর সেনের মতোই নির্মলকে কারখানার ম্যানেজারের গাড়িতে চাপতে দেখে, কথাটা না বলে পারিনি। গৌর সেন আর নির্মল তো আমার কাছে এক না। গৌর সেন আমার কাছে মূর্তিমান শয়তান। আমি তাকে দিয়েই কংগ্রেসের বিচার করি। নির্মলকে তা পারতাম না। কিন্তু এ সব কথা আমার বলা উচিত ছিল না। আসলে কী বলা উচিত, আর উচিত না, এ বোধবুদ্ধি কোনও কালেই আমার ছিল না। না হলে, খুনোখুনির ব্যাপারে লুঠতরাজের ব্যাপারে, আমি বন্ধুদের সঙ্গে শত্রুদের মিলিয়ে তুলনা দিতে যেতাম? মার খিস্তি তো আমাকে খেতেই হবে।
আসলে মানুষের জীবনকে আমি কী চোখে দেখতে চাই, আমার নিজেরই কোনও ধারণা ছিল না। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে নিজেদের সংসার, বন্ধুবান্ধবদের কীর্তিকলাপ, মিথ্যা কথা, শঠতা, খুনোখুনি, লুঠতরাজ, জালজুয়াচুরি, ওই সব দেখে শুনে, আমি একটা নির্ভেজাল ইয়ে–যাকে বলে, অনেস্ট লাইফের কথা ভাবতাম। অথচ আমাকে যদি কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, নির্ভেজাল অনেস্ট লাইফ কাকে বলে, আমি কিছুতেই ব্যাখ্যা করতে পারব না। একমাত্র জটাইকে আমি একটু মনের কথা বলতে পারতাম, কারণ ওর রাগ কম ছিল, আর গায়ে হাত তুলত না। ও আমাকে বলত, তোর কথা শুনলে মনে হয়, তুই একটা মূর্খের স্বর্গে বাস করছিস। আমাদের দেশের যা সিস্টেম, মানে ধনতান্ত্রিক দেশ যাকে বলে, সেখানে নির্ভেজাল অনেস্ট লাইফ বলে কিছু থাকতে পারে না। ধনতন্ত্রের উৎখাত হলেই তা সম্ভব।
তা-ই হয় তো হবে, জটাই যখন বলছে, এইরকম ভাবতাম, কিন্তু মনটা কেমন খুঁতখুঁত করত। জানতাম না, ওই সময়ে যা চলছিল, তার দ্বারা ধনতন্ত্রের উৎখাত সম্ভব কি না, আর বর্তমান সমাজে সত্যি মানুষের পক্ষে সৎ থাকা সম্ভব কি না। মোটের ওপর সেভেনটির শেষ দিক থেকেই, জীবনটা এমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল, মনে হয়েছিল, আমি যেন একটা পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছি। খুকু কোথায় কখন বেরিয়ে যেত, সঠিক কিছুই জানতাম না। ও কাজের জন্য বছর বারো বয়সের যে-মেয়েটাকে রেখেছিল ও কিছুই বলতে পারত না। মা আর বিতির সঙ্গে আমার কথা বন্ধ ছিল, তাদের কাছ থেকেও কিছুই জানবার উপায় ছিল না। খুকু মাঝে মাঝেই চাকরি করার কথা বলত, আর চাকরি নাকি খুঁজে বেড়াত।
সেভেনটি ওয়ান আমার কাছে মারাত্মক বছর। না, দেশ জুড়ে খুনোখুনির জন্য না, সে সব তো দলগুলোর ব্যাপার। আমি দেখছিলাম খুকুর রূপ যেন আরও ফেটে পড়ছিল, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওর মেজাজ খিটখিটে হয়ে উঠছিল। সকলের সঙ্গে না, আমাকেই বিশেষ করে ওর খিটখিটে মেজাজের কথা শুনতে হত। কারণ সংসারের চেহারাটা দেখে আমার ভাল লাগত না। অধিকাংশ দিনই কারখানা থেকে বাড়ি ফিরে দেখতাম, বিধাতা ধুলোবালি মেখে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে, বারো বছরের মেয়েটা সংসারের কাজে মুখ গুঁজড়ে পড়েছে, আর খুকু সারাদিন পরে বাড়ি ফিরে পাখার তলায় খাটে শুয়ে ঘাম শুকোচ্ছে। কী দরকার ছিল রোজ রোজ খুকুর বাইরে যাবার? কেন চাকরি খুঁজতে হচ্ছিল? কোথায় কাদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করছিল? ওই সব কথা তুলতে গেলেই খুকু বিরক্ত হত।
খুকুর বিরক্তি, দুজনের মধ্যে অশান্তি কোনওটাই আমি চাইতাম না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি অশান্ত হয়ে উঠছিলাম। কারণ আমি প্রতি পদে বুঝতে পারছিলাম, খুকু বদলে যাচ্ছে, একটু একটু করে আমার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। ও না বললেও, আমি জানতাম, কানু ওর কলকাতা যাবার নিত্যসঙ্গী। কানুকে আমার মেনে নিতেই হয়েছিল, যদিও খুকুর কথা মতো, ওকে আমি কোনও দিনই আমাদের বাড়িতে আসতে বলিনি। কিন্তু, সেভেনটিওয়ানের ইলেকশনের পরে, একদিন শরীর খারাপ নিয়ে অসময়ে বাড়ি এসে আমি দুজন ষণ্ডা মার্কা ছেলেকে আমার ঘরের খাটে বসা’ দেখে, অবাক হয়েছিলাম। অবাক হওয়ার কারণ ছিল। একজনকে আমি চিনতাম, কলকাতার এক তল্লাটে বছরে একবার বিরাট কালী পূজা আর বড় বড় ফাংশান করে বেড়াত। এক শ্রেণীর লোচ্চা যাদের বলে, অথচ গৌর সেনদের সঙ্গে খুব মাখামাখি ছিল। অবিশ্যি পোশাক-আসাক খুবই ভাল ছিল, যাকে বলে ফরেন মেড কাপড়ের জামা প্যান্ট আর সেই নামকরা সেন্টের গন্ধে ঘরটা ভরে ছিল।
ছেলে দুটো নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করছিল, আর দামি সিগারেট টানছিল। আমাকে দেখে কেমন যেন থিতিয়ে গিয়েছিল, অবিশ্যি কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তারপরেই একজন বলে উঠেছিল, দাদা আজ এ সময়ে?
আমি কিছু বলবার আগেই, পাশের ঘর থেকে খুকু বেরিয়ে এসেছিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ও সাজগোজ করতে ব্যস্ত ছিল। হেসে বলেছিল, তুমি আজ এ সময়ে?
শরীরটা ভাল নেই, মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে। আমি কাঁধের ব্যাগটা কোণের ঘোট টেবিলে রেখেছিলাম।
খুকু বলেছিল, তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি গৌতমদা–গৌতম কুণ্ডু, এই জোজোদা– জোজো মুখার্জি।
দুজনেই কপালে হাত ঠেকিয়ে আমাকে নমস্কার জানিয়েছিল, আমিও জানিয়েছিলাম, আর জোজো মুখার্জি, সেই লোচ্চাটা বলেছিল, দাদাকে আমি চিনি, দু-একবার দেখা হয়েছে, আলাপ পরিচয় হয়নি।
আমি ওদের ষণ্ডা মার্কা বলেছি বটে, কিন্তু ওদের থেকে আমার চেহারাটা ছোটখাটো ছিল না। আমি হাসি হাসি মুখ করেছিলাম। খুকু বলেছিল, তুমি এসে পড়লে, তাই দেখা হয়ে গেল। আমি এখুনি বেরিয়ে যাচ্ছিলাম।
কোথায় যাচ্ছ? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।
খুকু বলেছিল, রবীন্দ্রসদনে।
জোজো বলেছিল, রবীন্দ্রসদনে আজ আমাদের একটা ফাংশন আছে, রুমা সেখানে নাচবে।
রুমা! আমি ওদের সকলের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম।
খুকু হেসে উঠে বলেছিল, হ্যাঁ, সবাই মিলে আমার নামটা বদলে দিয়েছে, জ্যোছনা নামটা বড় সেকেলে।
নামটা বেশ সুন্দর নয়? গৌতম আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল।
আমার বন্ধুরা আমাকে প্রায়ই আতাক্যালানে বলত। কথাটার মানে জানি না, কিন্তু ওই সময় আমার নিজেকে আতাক্যালানে মনে হয়েছিল। আমার সঁতে দাঁত চেপে বসছিল, কিন্তু আমি প্রায় হেসেই বলেছিলাম, তাই তো মনে হচ্ছে।
ওরা বেরিয়ে যাবার পরে, আমি বারো বছরের কাজের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যে-লোক দুটোকে দেখলাম, এরা কি আগে এসেছে?
মেয়েটা প্রথমে একটু আমতা আমতা করেছিল, তারপরে বলেছিল, হ্যাঁ, কয়েকদিন এসেছে।
সেই প্রথম সন্দেহের বিষ আমার মনে ঢুকেছিল, যদিও খুকুকে আমি তা বুঝতে দিইনি। মায়ের সঙ্গে আলাদা হয়ে যাবার পরিণতিটা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কী হবে এ সব কথা ভেবে? খুকু ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছিল। ক্রমে বাড়ি ফিরতে রাত্রি করছিল, আর কিছু বলতে গেলেই বিরক্ত খুকু রেগে উঠছিল। সেভেনটি টু-তে খুকু একটা চাকরি পেয়েছিল, কোনও এক বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে। আমি সেই অফিসেও গিয়েছি। ছোটখাটো কোম্পানির কর্তাটিকে আমার ভালই লেগেছিল। একদিন আমাকে ভদ্রলোক বলেছিলেন, রুমা আমার এখানে ঠিক কাজের উপযুক্ত নয়। আপনার অসুবিধে না থাকলে ওকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে নিতেই বলতাম।
তার মানে খুকু আমার সংসারে অভাবের কথা বলে চাকরি নিয়েছিল। তা নিয়ে খুকুর সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। একলা হলেই আমি ভাবতাম, কী হয়েছে খুকুর? কেন সরে যাচ্ছে আমার কাছ থেকে? কেনই বা এসেছিল? কী চায়?
কোনও জবাবই নিজের কাছে পেতাম না। অশান্ত হয়ে কেবল বিধাতাকে বুকে চেপে নিয়ে বেড়াতাম আর মনে হত, ওর ছোঁয়ায় বুকের কোথায় একটা শান্তি চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে। কিন্তু সে-শান্তিও বজায় রাখা যায়নি, কারণ সেভেনটিথ্রি-তে কারখানায় সেই অভিশপ্ত ক্লোজার হয়েছিল। তার মানে আমি বেকার, সারাদিন বাড়িতে। খুকু বেরিয়ে যেত সকাল নটায়। আমিও বাড়িতে থাকতে পারতাম না। দুপুরে খেয়ে বেরিয়ে যেতাম। যাব না যাব না করেও খুকুর অফিসে চলে যেতাম। ওদের মেয়ে-পুরুষ বন্ধুদের একটা দল ছিল। আমি টিফিনের সময়টা যেতাম, ওদের সঙ্গে চা খেতে যেতাম বাইরের রেস্টুরেন্টে। খুকু মোটেই খুশি হত না। বোধ হয় কেউ-ই খুশি হত না। ওর ছেলে বন্ধুরা তো না বটেই।
কিন্তু বেশি দিন ওই অবস্থা চলেনি। খুকুর অফিসে আমার যাওয়া নিয়ে, একদিন রাত্রে খেতে বসে, খুকু সামান্য কথায় এত রেগে গিয়েছিল, ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, আর স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, ওর অফিসে যাওয়াটা মোটেই পছন্দ করে না।
আমার ভিতরটা দপ করে জ্বলে উঠেছিল, কিন্তু বিধাতা ভয় পেয়ে কেঁদে উঠেছিল, আমি কোনও কথা বলিনি। তবে খুকুর অফিসে যাওয়া বন্ধ করেছিলাম। করলে কী হবে? বিষের জ্বালা আমার প্রাণে। আমি টেলিফোন করতাম। খুকু বিরক্ত হয়ে কথা বলত। তারপরেই তো এসেছিল সেই ভয়াবহ রাত্রি। কলকাতায় গিয়ে দুপুরে টেলিফোন করে জেনেছিলাম, খুকু সেইদিন অফিসেই যায়নি। ফিরেছিল রাত্রি দশটার পরে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত রাত্রে ফিরলে যে?
কী করব? রাত সাতটা অবধি অফিসে খাঁটিয়ে মেরেছে। খুকু স্বচ্ছন্দে বলেছিল, তারপরে বেরিয়ে, তথ্যকেন্দ্রে একটা নাটক দেখতে গেছলাম। অফিসের মেয়েরা জোর করেই ধরে নিয়ে গেছল।
আমি পাশের ঘরে খুকুর দিকে তাকিয়েছিলাম। ও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, মাথার চুলের বিনুনির ফিতে খুলছিল। আয়নায় ওর মুখটা কী আশ্চর্য সুন্দর দেখাচ্ছিল। কী যেন সেই একটা গান। আছে?…হ্যাঁ, বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিলে’…সেই রকম শুধু ডাগর না, ডাগর কালো চোখ দুটো খুকুর যেন কী এক ভাবনায় অন্যমনস্ক ছিল। মিথ্যের ছাপ একটুও ছিল না। লোকে কী করে বলে, চোখে মুখে মিথ্যের ছাপ ফুটে ওঠে? তারা বোধ হয় কোনও দিন খুকুর মতো মেয়েকে দেখেনি। রূপসী খুকুকে কী নিপাপ, একটু ক্লান্ত আর তাই আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল। কিন্তু আমি যে নিজেকে চিনতাম না, তার প্রমাণ, আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম, তুমি মিথ্যে কথা বলছ। তুমি আজ অফিসেই যাওনি।
খুকু যেন চমকে আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছিল, আর দেখতে দেখতে ওর চোখ দুটো জ্বলে উঠেছিল, মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে বলেছিল, মিথ্যে বলেছি, বেশ করেছি, তুমিই বা টেলিফোন করে জানতে গেছিলে কেন?
কেন যাব না? আমি খুকুর শাড়ির আঁচল টেনে ধরেছিলাম, কেন মিথ্যে বলবে? কোথায় ছিলে সারাদিন–এই রাত পর্যন্ত?
খুকু জোরে আঁচলটা টেনে ছাড়াবার চেষ্টা করে বলেছিল, যেখানে খুশি ছিলাম, তোমাকে বলব কেন?
বলতে হবে। আমি খুকুকে আঁচল টেনে আমার বুকের ওপর এনে ফেলেছিলাম।
খুকু নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে, হঠাৎ পা দিয়ে আমার হাঁটুতে মেরেছিল, সাপের মতো হিস হিস করে বলেছিল, বলব না।
আমি ঠাস করে ওর গালে চড় কষিয়েছিলাম। ও তৎক্ষণাৎ আমার বুকে কামড়ে দেবার চেষ্টা করে এমন চিৎকার করে উঠেছিল, যেন ওকে খুন করা হচ্ছিল, আর দেওয়ালে জোরে হাতের কবজি দিয়ে মেরে, শাখা ভেঙে ফেলেছিল। তারপরে চুড়ি আর বালাসহ নিজের মাথায় কপালে মেরে চিৎকার করেছিল। পাশের ঘরে খাটে বিধাতা কেঁদে উঠেছিল। মুহূর্তেই আমার একটা চমক লেগেছিল, আমি খুকুকে বুকে জড়িয়ে ধরে, অনুশোচনায় আর কষ্টে ডেকেছিলাম, খুকু, আমার অন্যায় হয়ে গেছে, চুপ করো। বিধু উঠে পড়েছে।
খুকু কিছুই শোনেনি। দৌড়ে গিয়ে খাটের ওপর পড়ে চিৎকার করেছিল। আমি আগে গিয়ে সিঁড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছিলাম। আমি জানতাম নীচের তলায় মা বিনতিবাবা আর সেই মালতি নামে মেয়েটা একটা ভয়ংকর কিছুর জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি ভাবছিলাম, খুকু নীচে দৌড়ে চলে যাবে।
সেই রাত্রে খুকু চলে যায়নি, পরের দিন সকালেই বিধাতাকে নিয়ে, শান্তভাবে জোড়াদিঘি পাড়া গিয়েছিল। এমনকী আমাকে বলেও গিয়েছিল, আমি কয়েক দিন বাপের বাড়ি থাকব।
আমি বাধা দিইনি। বরং খুকুর নিজেরই বালা আর চুড়ির ঘায়ে কপালে মুখে রক্তজমাট দাগগুলো। দেখেছিলাম। তখন জানতাম না, সেই খুকুর শেষ যাওয়া, আর কপাল মুখের দাগগুলো আমারই মারের চিহ্ন হিসাবে দেখানো হয়েছিল। কেউ অবিশ্বাস করেনি। তিন দিন পরে আলিপুরের এস ডি ও-র লিখিত অর্ডার নিয়ে থানা থেকে এস আই এসেছিল। বাইরে রিকশায় খুকু ওর ভাইয়ের সঙ্গে বসেছিল। এস আই-এর সঙ্গে সেপাইরা আমার ঘর খালি করে খাট আলমারি ড্রেসিংটেবিল, সবই নিয়ে গিয়েছিল, কারণ ওগুলো নাকি ওর বাবার দেওয়া ছিল। অথচ ওর বাবা কিছুই দেয়নি, সব আমি আস্তে আস্তে কিনেছিলাম, দেনা করে ধার শোধ করেছিলাম। খুকু যাবার দিন সকালেই সমস্ত গহনা নিয়ে গিয়েছিল। আমি টের পাইনি। তারপরেই মারধোর অত্যাচার এবং আমার বন্ধুদের সঙ্গে খুকুকে জোর করে দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত করে, টাকা রোজগারের চেষ্টায় ডিভোর্সের মামলা।
আমি চোখ মেলে তাকালাম। অন্ধকার। পাখাটা ঘুরছে। উঠে দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় এসে দেখলাম, আকাশে অজস্র তারা, বাগানটা অন্ধকার। মা কী করছে? এখন তো বিনতিও আর নেই, এ বছরের গোড়াতেই ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
আমার চোখের সামনে সেই দিনটা ভেসে উঠছে। মামলার নোটিস পাবার দু মাস পরে আমি বিধাতাকে আনবার জন্য জোড়াদিঘি পাড়া সাইকেল নিয়ে গিয়েছিলাম। আনতে পারিনি। বিধাতাকে কোলে নিয়ে, খুকুদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে, সাইকেলটা ধরে দাঁড়াতেই, খুকুর বাবা একটা শাবল আমাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মেরেছিল। ওর মা চিৎকার জুড়েছিল। আমার হাত থেকে ফসকে সাইকেলটা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। শাবলটা আর একটু হলে বিধাতার গায়ে লাগত। বিধাতা আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। আমি আবার যখন সাইকেলটা নিচু হয়ে তুলতে যাচ্ছিলাম, তখন খুকুর দাদা একটা লম্বা লোহার শিক দিয়ে, আমার উরুতে আর পায়ে মারতে আরম্ভ করেছিল। আমি বাধ্য হয়ে বিধাতাকে কোল থেকে নামিয়ে খুকুর দাদার দিকে তেড়ে গিয়েছিলাম। খুকুর দাদা বাড়ির ভিতরে ছুটে গিয়েছিল আর খুকু সেই ফাঁকে বিধাতাকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। চিৎকার চেঁচামেচিতে পাড়ার লোক জমে গিয়েছিল। আমি ফিরে এসেছিলাম, বলে এসেছিলাম, কিন্তু ছেলে আমি একদিন নিয়ে যাবই আর তোমাদের জোড়াদিঘি পাড়া ছাড়া করব।
পাড়া ছাড়া করতে পেরেছিলাম, কিন্তু বিধাতাকে পাইনি। আমি জানি, খুকু এখন যাদবপুরে ওর বাবার বাড়িতে থাকলেও একজন বিপ্লবী অভিনেতার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকে। মামলার মনে মামলা চলছে।
খুকু! কেন আমাকে এত ঘৃণা? আমি কী করেছি?
আমি বারান্দা থেকে ঘরে এসে ঢুকলাম। সুইচ টিপে আলো জ্বালালাম। পাখাটা ঘুরছে। ঘুরুক। পাশের ঘরে গিয়ে আলো জ্বালালাম। দেওয়ালে আমার ছায়া, বিরাট আর কিস্তৃত। খুকু! কেন চলে গেলে? শরীরের সাধ মেটাতে, আমার এই শরীরটা তোমার কোনও সাধ মেটাতে পারেনি? আমি পাশের টুলে ভাঁজ করে রাখা ট্রাউজারটা পায়ে গলিয়ে কোমরে বোম আটকালাম। খুকু, কীসের অভাব ছিল তোমার? আদর যত্ন ভালবাসার? আমি তো কিছু রেখে ঢেকে তোমাকে দিইনি। রূপসী। মেয়েদের কি ওটা স্বভাব? নাকি তাদের দাবি, তাদের অধিকার, তারা যেদিকে খুশি হাত বাড়াবে, যেমন খুশি ভোগ করবে?
কিন্তু রূপসী মেয়েও তো দেখেছি। সকলে তো ওই রকম করে না। ওই রকম মন তুমি কোথায় পেয়েছিলে, কেমন করে? তুমি কি স্বর্গের বেশ্যা? শুনেছি, তারা সতী না, অসতী না, কেবল দেবভোগ্যা মোহিনী। হ্যাঁ, এ রকম অনেক মেয়েকেও দেখি। কিন্তু খুকু, আমি স্বর্গের দেবতা না, আমি দুদে চাটুয্যে। আমি সেইরকম মানুষ, যে নীলা বউদির মতো বিশ্বাস করে না, একজনকে দিয়ে আর একজনের জায়গা ভরাট করা যায়।
আমি জামাটা গায়ে চাপালাম। দেওয়ালের হুক থেকে সাইড ব্যাগটা কাঁধে নিলাম। খুকু, যে জায়গা পূর্ণ হবার না, অথচ সেই জায়গার শুন্যতা অন্যখানে পূর্ণ করে থাকবে, তাও হয় না। আমি নিচু হয়ে, ট্রাঙ্কের পিছন থেকে সালফিউরিক অ্যাসিডের শিশিটার বন্ধ মুখ ভাল করে দেখে নিলাম, তারপরে সাইড ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলাম। খুকু, মামলা চলুক, কিন্তু আমার কাছে আইনের কোনও মূল্য নেই। বিচার আর জীবন অর্থহীন। কোথায় যেন পড়েছিলাম, আইন একটা গাধা। আমার মনে হয়, চোখ নাক মুখ নেই, এ রকম একটা পশু। নির্ভেজাল অনেস্ট লাইফ, রাজনীতি, গণতন্ত্র সবকিছু বুকের ওপরে, তোমার মুখের চামড়া অ্যাসিডে পুড়ে কঙ্কাল বেরিয়ে পড়বে। আর আমি এক বার বিধাতাকে শেষবারের জন্য বুকে নিয়ে আদর করব। কুলুঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে, খুচরো কয়েকটা টাকা আর পয়সা পকেটে নিয়ে, আলো পাখার সুইচ অফ করে দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
নীচে লম্বা বারান্দাটা অন্ধকার, থামগুলো ভূতের মতো দাঁড়িয়ে। মায়ের ঘরের দরজা ভেজানো। নিশ্চয় সারা দিন উপোস করে শুয়ে আছে। বাইরের ঘরে আলো, বাবা একপাল স্ত্রীলোক নিয়ে বসে আছে, এখনও কাজ চলছে। আমাকে দেখতে পাচ্ছে না।
আমি বাগানের দরজা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। চোখের সামনে খুকুদের যাদবপুরের বাড়িটা ভাসছে। আমি আগেই দেখে রেখেছি। বিরাট একটা পুকুর, ফণা তোলা সাপের মতো ঠাস বুনোট কচুরিপানা। আশেপাশে কয়েকটা বাড়ি, এখনও ফাঁকা ফাঁকা, রাস্তায় আলো আসেনি। নিচু পাঁচিল দিয়ে বাড়িটা ঘেরা। পাকা দেওয়াল, মাথায় টালি।
ডাউনের বাস ধরে আধ ঘণ্টারও আগেই, খুকুদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। চারদিকে জমাট অন্ধকার। ছড়ানো ছিটানো বাড়িগুলোর আলো দেখে, অন্ধকার নদীতে নৌকোর মতো দেখাচ্ছে। আমি খুকুদের বাড়িটার চারপাশে এক বার পাক দিলাম। দাঁড়ালাম একটা কাঁঠাল গাছের ঝুপসি অন্ধকারে, প্রায় খুকুদের পাঁচিলের ধারে, যেখান থেকে বাড়ির ভিতরটা দেখা যায়। খোলা উঠোন, ছড়ানো সন্ধ্যাকলির ঝাড়, বারান্দায় টিমটিমে আলো, খুকুর বাবা একটা চেয়ারে বসে আছে। খুকু কোথায়? বিধাতা?
পাতিহাঁসের প্যাক প্যাক শব্দ ভেসে এল। দেখলাম, একটা টিমটিমে গোলবাতি এগিয়ে আসছে। সাইকেল রিকশা। তাঁ, অন্ধকারেও আমার চোখ বাঘের মতো দেখতে পাচ্ছে, খুকু রিকশায় বসে আছে। আমি ব্যাগের মধ্যে হাত ঢোকালাম। রিকশা খুকুদের বাড়ির দরজার কাছে দাঁড়াল।
সেই বিপ্লবী অভিনেতাটি কোথায়, এই এমারজেনসির সময় যে বিপ্লব, অভিনয়, সবই সময়ের সুযোগের অপেক্ষায় তুলে রেখে, এশিয়ার সূর্যের চ্যালাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দু পয়সা রোজগার করছে। অবিশ্যি ওর বিপ্লবী দাদারা এখন ওর সঙ্গে সম্পর্ক স্বীকার করে না। স্বাভাবিক। বেকায়দার ব্যাপার। কিন্তু রিকশায় দুজনকে একসঙ্গে পেলে ভাল হত। তা হলে একসঙ্গেই। খুকু ভাড়া মিটিয়ে নামল। আমি ব্যাগের ভিতর থেকে বোতল হাতে তুলে নিলাম। আমার দাঁতে দাঁত চেপে বসছে। খুকু কি একটু টলছে? মদ খেয়ে ফিরেছে?
ওরে বিধে, তোর মা এসেছে। খুকুর বাবা বারান্দার চেয়ার থেকে বলে উঠল। শুকনো প্রাণহীন স্বর, যেন একটা আপদকে ডেকে দিচ্ছে।
খুকু উঠোনের মাঝখানে। বিধাতা ঘর থেকে ছুটে এল বারান্দায়। বিধু! মাথায় এক গোছা রুক্ষু চুল কপালে নেমে এসেছে। উঠোনে নেমে এল, খুকুর কোমরে হাত দিল। খুকুর কাঁধেও একটা ব্যাগ। ও কি টলছে? ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে কী যেন বের করে দিল বিধুর হাতে। বিধু দেখল, কল, হাসল। লজেন্স? ঘুষ? অ্যাসিডের বোতল ধরা হাতটা শক্ত হয়ে উঠল।
ঘরে এসো মা। বিধাতা ডাকল।
খুকু বলল, তুই যা, আমি বাগানে একটু বসি।
কেন? আমার অ্যাসিড ছুঁড়ে মারার সুবিধার জন্য? বাগান কোথায়? একটা পোড়ো উঠোনের মতো দেখাচ্ছে। কেবল কয়েকটা সন্ধ্যাকলির ঝাড়, ফুল ফুটে আছে। বাতাস কি একটুও নেই? ঘামছি কেন? খুকু সন্ধ্যাকলির ঝাড়ের কাছে গিয়ে, পিছনে পা গুটিয়ে বসে পড়ল। বিধাতা ঘরের দিকে চলে যেতে যেতে আবার ওর মায়ের কাছে ফিরে এল, মায়ের হাত ধরে টানল, ডাকল, চলো না ঘরে। সরে যা বিধু! খুকু যেন অস্পষ্ট স্বরে কী বলল, বিধাতা ঠিক যেন আমার দিকে ফিরে তাকাল। আমাকে দেখতে পাচ্ছে নাকি? কিন্তু না, ও ঘরের দিকে ফিরে যাচ্ছে। আমি ভয়ে মুখে হাত চাপা দিলাম। কী একটা শব্দ বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমার হাত কাঁপছে। বোতল ধরা হাত, আর মুখে চাপা হাত। বারান্দার টিমটিমে আলোয় না, খুকুর আলোয় ফোঁটা সন্ধ্যাকলি দেখা যাচ্ছে, আর আমার মনে হচ্ছে আকাশ থেকে তারারা চারদিকে নেমে আসছে।
আশ্চর্য, একি সত্যি নাকি? জীবনের সব মিথ্যাগুলো, অর্থহীনতাগুলো অজস্র তারায় যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, আর একদল বুনো ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে, অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে। আমার হাত কাঁপছেনা, আমি রাস্তা দিয়ে চলতে আরম্ভ করেছি। অ্যাসিডের বোতলটা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। দাঁতের বদলে দাঁত, নখের বদলে নখ, জানের বদলা জান-কত কী শুনে এলাম, তবু আজ পর্যন্ত কারোকে মারের বদলে মারতে পারলাম না কেন? অথচ মারতে পারা কত সহজ, কিন্তু আমি তো ভাবতে পারছি না বিধাতা বেঁচে থাকবে না। খুকু কি কোনও একদিন কিছু ভাববে না, অন্য রকম কিছু? জীবন তো এক রকম থাকবে না, আমার বন্ধুদেরও না। ওরাও কি কখনও অন্য রকম কিছু ভাববে না– ভবিষ্যতে কোনও দিন? যেমন এখন আমার মনে হচ্ছে, কারখানা খুললেও নতুন একটা কাজের সন্ধান আমাকে কাল সকাল থেকেই করতে হবে। যে কোনও শর্তে যে কোনও বন্ধুর সাহায্যেই, কারখানায় মাল বানানো যায় না। বেঁচে থাকার অধিকারেরও একটা যুক্তি তো থাকা উচিত।
আকাশের তারারা কেমন করে নেমে আসছে? বুনো ঘোড়ার দল অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে? এভাবে ফিরে যেতে হবে ভাবিনি। কিন্তু আমি, আমার এই ফিরে যাওয়া, এই নিয়েই তো আমি। মা বেচারি সারাটা দিন খায়নি।
পিছনটা টানছে। সাপের ফণার মতো ফোঁসফোঁসানো কচুরিপানার ওপারে বিধাতা আর খুকু। টানুক, টানবেই, কিন্তু এখন আমার বাড়ি যাওয়া উচিত।