৬. ক্ষুদ্র গুহা

ক্ষুদ্র গুহার মধ্যে নেফার হামাগুড়ি দিয়ে মিনটাকার কাছে গেল এবং তাকে তার বাহুতে টেনে নিল। সে তার সাথে কথা বলার ও তাকে সান্ত্বনা সাহস দিতে চেষ্টা করল। কিন্তু দুজনেরই মাথা কাপড়ে ঢাকা এবং বাতাসে সব শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে। মিনটাকা তার মাথা নেফারের কাঁধে রাখল এবং তারা একে অপরকে আঁকড়ে ধরল সজোরে। গর্জনরত অন্ধকারে তারা যেন সমাহিত। প্রত্যেকটি গরম শ্বাস তারা কাপড়ের মধ্য দিয়ে হেঁকে টানছে এবং প্রতিবারে একটু করে দম নিচ্ছে তারা, যা সাদা সুন্দর বালি তাদের ঠোঁটের মধ্যে দিয়ে যাওয়াটা প্রতিরোধ করছে।

কিছুক্ষণ পর বাতাসের গর্জন তাদের বধির করে দিল এবং তাদের অন্য অনুভূতিগুলো ভোঁতা করে দিল। কোন বিরতি বা ক্লান্তি ছাড়াই তা বয়ে চলল অবিরত। সময়ের আবর্তন পরিমাপ করার জন্য তাদের কোন পথ ছিল না, শুধুমাত্র তাদের চোখের পাতার মধ্যে দিয়ে আলো ও আধারের ন্যূনতম সচেতনা ব্যতীত। দিনের আগমন নির্দেশ করতে সেখানে একটা ক্ষীণ আলোর আভা ছিল; যখন রাত নামত তখন তা ঘোর অন্ধকারে বিলীন হয়ে যেতো। নেফার কখনোই এমন পূর্ণ ও অসীম অন্ধকারকে সহ্য করতে পারেতো না যদি সে মিনিটাকার দেহের খুব কাছে থাকতো। অন্য সময় হলে ভাবতো সে হয়তো পাগল হয়ে গিয়েছে।

প্রতিবার যখন দীর্ঘ সময়ের জন্যে মিনটাকা তার দিকে ঝুকতো তখন সে তার নিজের বাহু দিয়ে তার বাহু চাপ দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করতো। হয়তো কখনও নেফার ঘুমিয়ে পড়তো কিন্তু সেখানে কোনো স্বপ্ন থাকতো না, শুধুমাত্র খামসিনের গর্জন ও অন্ধকার ছাড়া।

আরো অনেকক্ষণ পর সে তার পা নড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু সে পারল না। অজানা আতংকে সে ভাবল সম্ভবত সে তার দেহের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। অর্থাৎ সে দুর্বল ও মারা যাচ্ছে। সে তার পুরো শক্তি দিয়ে আবার চেষ্টা করল এবং কোনভাবে তার পা ও পায়ের পাতা নড়াল, তখন সে বুঝল সে বালির ফাঁদে পড়েছে যা তাদের আশ্রয়ের জেবরা দেয়ালের ছোট ছোট ফুটো দিয়ে ঢুকেছে। এরই মধ্যে তা তার কোমর সমান উঁচু হয়ে গেছে। তারা ধীরে ধীরে জীবন্ত সমাহিত হতে যাচ্ছে। ঐ কুচক্রী মৃত্যুর চিন্তা তাকে ভয়ে পূর্ণ আতংকিত করে তুলল। তার নগ্ন হাত দিয়ে সে তার পা নাড়নোর মতো সামর্থ হওয়ার জন্য যথেষ্ট বালি সরাল এবং মিনটাকার জন্যে একই কাজ করল।

সে বুঝল অন্যরাও জানাকীর্ণ গুহার ভিতরে একই কাজ করছে, বালি দূরে সরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তা পানির মতো চুয়াচ্ছে। এটা তাদের উপর ঘূর্ণায়মান ধুলার ঘন মেঘ হয়ে ন্যস্ত হয়েছে যেন।

এবং ঝড় বেড়েই চলল।

দুই দিন তিন রাত ধরে ক্লান্তহীন ভাবে বাতাস বয়েই চলল। এই সময়টাতে নেফার কোনো রকমে তার মাথা ও হাত নড়ানোর মতো যথেষ্ট বালি সরাতে পারল, কিন্তু তার দেহের নিমাংশ শক্ত ভাবে বন্দী হয়ে গেছে। বালি খনন করে সে নিজেকে করে বের করতে পারল না, কারণ সেখানে এমন কোন স্থান ছিল না যে সে বালি সরিয়ে রাখবে।

সে একটা হাত তুলে তা বাড়িয়ে আঙুল দিয়ে শক্ত পাথরটার অবস্থান বুঝার চেষ্টা করল এবং বুঝল এটা একটু গম্বুজাকৃতির। ইতোমধ্যে বালি গুহার প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিয়েছে যার ফলে আর বালি ঢুকছে না। কিন্তু সে তখনো শুনতে পেল ঝড়টা সীমাহীন ভাবে গর্জন করছে।

সে অপেক্ষা করল। মাঝে মাঝে সে অনুভব করল মিনটাকা তার পাশে নিরবে কাঁদছে। নেফার তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল তার বাহুতে আলতো চাপ দিয়ে। যেহেতু বাতাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে ফলে স্থানটি দূষিত, গন্ধময় ও জীর্ন হয়ে গেল। ভাবল শীঘ্রই তারা আর জীবিত থাকবে না, কারণ প্রতিটি নিশ্বাস এখন একটি লড়াই এ পরিণত হয়েছে, তবুও তারা এখন পর্যন্ত জীবিত।

পানির থলেতে যতোটুকু অবশিষ্ট ছিল তা তারা পান করে ফেলেছে, তলায় এখন একটু রয়েছে। সবাই এখন প্রচন্ড তৃষ্ণার্ত। এ গদাগদির মধ্যেও তারা এতটুকু ঘামছিল না, কারণ গরম-শুষ্ক বালি ও বাতাস দ্রুত শুষে নিচ্ছিল তা। নেফার অনুভব করল তার জিভ ধীরে ধীরে মুখের তালুর সাথে আটকে যাচ্ছে। তারপর তা শুষ্ক হতে শুরু করল ফলে তার শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়াটা কষ্ট সাধ্য হয়ে প্রায় অম্ভব হয়ে পড়ল, বিশাল স্পঞ্জের মতো যেন কিছু তার মুখ পূর্ণ করে রয়েছে।

ভয় ও তৃষ্ণায় সে সময়ের বহতা হারিয়ে ফেলল; এবং মনে হল বছর পার হয়ে গিয়েছে। নেফার নিজেকে ইন্দ্রীয় সচেতনহীন অবস্থা থেকে টেনে তুলল যা তাকে ক্রমশ গ্রাস করে ধরেছিল। সে বুঝল কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। সে বুঝার চেষ্টা করল ওটা কি। কিন্তু তার মনটা ছিল অসাড় ও প্রতিক্রিয়া হীন। মিনটাকা তার পাশে স্থির হয়ে বসে আছে। নেফার তাকে ভয়ার্ত ভাবে চাপ দিল। জবাবে সে নড়াচড়া ও মৃদু কম্পন অনুভব করল।

সে এখনো জীবিত। তার দুজনেই জীবত, কিন্তু সমাহিত, শুধুমাত্র নিজেদের দেহের কিছু ছোট অংশ নড়াচড়া করতে সক্ষম।

নেফার অনুভব করল আবার তাকে ঘিরে ফেলছে যেন কোন জল কুন্ডলী, বিশাল উন্মুক্ত নদীর মাঝে যার অবস্থান। সে নিজেকে অন্ধকার থেকে জোর করে টেনে তুলল এবং শোনার চেষ্টা করল। কিন্তু সে কিছুই শুনল না যা তাকে জাগিয়েছে। কোন শব্দ ছিল না। খামসিনের হুংকারের উচ্চশব্দ গভীর নিরবতা দিয়ে গেছে। একটা বদ্ধ কবরের নীরবতা, সে ভাবল, এবং ভয় পূর্ণ শক্তিতে ফিরে এল আবার।

সে আবার লড়াই করতে শুরু করল, বালি থেকে বের হবার রাস্তা তৈরির চেষ্টা করল। অবশেষে কোন রকমে সে তার ডান হাত মুক্ত করে হাতটা বাড়াল এবং মিনটাকার ঢাকা মাথাটা খুঁজে পেল। সে তার মাথায় হাত বুলালো এবং নীরবতার মাঝেও তার কাতর কণ্ঠের কান্না শুনল। তাকে আশ্বস্ত করতে সে কথা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু তার স্ফীত শুষ্ক জিভ তাকে কোনো শব্দ বের করতে দিল না। এর পরিবর্তে সে তখন হাত সরিয়ে হিল্টোকে স্পর্শ করার উদ্দেশ্যে সামনে বাড়ালো, যে তার অপর পাশে বসে আছে। হয় হিল্টো চলে গেছে অথবা তার হাতের সীমার বাইরে আছে, কারণ সে কিছুই স্পর্শ করল না।

একটু সময় বিশ্রাম নিয়ে আরেকবার নিজেকে টেনে তুলল নেফার এবং গুহার প্রবেশ মুখের বালি পরিষ্কার করার চেষ্টা করল। কিন্তু ভেতরে অল্প স্থানই ছিল বালুগুলো সরিয়ে রাখার জন্যে। প্রতি বারে এক মুঠো করে সে তা সরাল এবং ধাক্কা দিয়ে তাদের ক্ষুদ্র কক্ষের এক কোনায় রাখল। শীঘ্রই সে তার ডান হাতের সীমার সবচেয়ে দূরে পৌঁছে কাজ করতে সামর্থ্য হল, প্রতিবার অল্প করে বালি তুলে ফেলছিল। এটা ছিল একটা হতাশজনক প্রয়াস কিন্তু সে জানে তাকে অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে। নইলে আশা ছেড়ে ভাগ্যের হাতে জীবন সমর্পণ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

হঠাৎ সে অনুভব করল বালির ধারা তার নিচে নেই। এমনকি তার মাথার কাপড়ের ভাজের মধ্য দিয়ে সে সতেজ বাতাসের ঝটকা অনুভব করল যা গুহার মধ্যে নব জীবন সঞ্চারিত করল এবং সে তার চোখের পাতার উপর আলোর ক্ষীণ প্রভা সম্পর্কে সচেতন হল। বহু কষ্টে সে তার মুখের উপর থেকে কাপড়টা খুলে ফেলতেই আলোটা আরো জোরালো হল এবং বাতাস তার শুষ্ক মুখ ও যন্ত্রণায় কাতর ফুসফুসে মিষ্টি দোলা দিয়ে গেল। সে তার একটি চোখ অর্ধেক খুলল, সাথে সাথে আলোতে সে প্রায় ধাধিয়ে গেল। তার দৃষ্টি মানিয়ে গেলে সে দেখল বাইরের দিকে একটি গর্ত সে করেছে যা তার বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনীর বৃত্ত থেকে বড় না, কিন্তু বাইরে সম্পূর্ণ নীরবতা। ঝড় থেমে গেছে।

উত্তেজিত ও নতুন আশা নিয়ে সে কাপড়টা টান দিল যা মিনটাকার মাথা ঢেকে রেখেছে। সাথে সাথে সে তাকে সতেজ বাতাসে দমের নিঃশ্বাস নিতে শুনল। নেফার কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু আবারও তার কণ্ঠ তাকে নিরাশ করল। সে নড়ার চেষ্টা করল, ভারি বালির ভয়ংকর থাবা থেকে পালাতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার দেহ এখনো বগল পর্যন্ত বালির নিচে বন্দী।

তার অবশিষ্ট সমস্ত শক্তি নিয়ে, সে নিরবে নিজেকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করে গেল, কিন্তু পরিশ্রম শীঘ্রই তাকে নিঃশেষিত করল এবং তার গলা তৃষ্ণায় জ্বালা ও ব্যথা করতে লাগল। সে ভাবল এখন মারা যাওয়া কি নিষ্ঠুর হবে না! যখন বাতাস ও আলোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে ঐ ক্ষুদ্র ছিদ্র তাকে উপহাস করছে।

সে ক্লান্তিতে চোখ আবার বন্ধ করল ও খুলল। অনুভব করল আলোতে অন্য একটা পরিবর্তন যেন হয়েছে, এবং তার চোখ আবার খুলল তখন সে। অবিশ্বাস্য অনুভূতি নিয়ে সে দেখল একটা হাত বালুর ভেতর থেকে বেরিয়ে তার ভোলা মুখের দিকে এগিয়ে আসছে। বৃদ্ধ হাত, শুষ্ক চামড়া বয়সের গভীর দাগে ঢাকা।

নেফার! সে একটা কণ্ঠ শুনল; এতো অপরিচিত, এতো কর্কশ এবং এতে পরিবর্তিত যে মুহূর্তের জন্য সে সন্দেহ করল এটা ম্যাগোস কিনা। নেফার, আমার কথা কি তুমি শুনতে পাচ্ছো?

নেফার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু এবারও কোন কথা বলতে পারল না। সে হাত বাড়াল ও টাইটার আঙুল স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ মানুষটির আঙুল তার আঙুলগুলোকে বিস্মিত শক্তিতে জড়িয়ে ধরল।

শক্ত করে ধরে রাখো। আমরা তোমাকে খুঁড়ে বের করবো।

তখন সে অন্য কণ্ঠগুলোও শুনল, তৃষ্ণায় রুক্ষ ও ক্ষীণ ও পরিশ্রমে কাতর। তারপরও সবাই তাদের হাতগুলো দিয়ে খাবলে বালি সরাতে লাগল যা তাকে আটকে রেখেছিল। অবশেষে তারা তাকে তুলে ধরল এবং টান দিকে নরম ও ভয়ংকর বালির কজা থেকে মুক্ত করল।

নেফার পিছলে সরু ফাটল দিয়ে বের হল যা পাথুরে গিরিটায় সে জন্ম দিয়েছে। তারপর হিল্টো ও ম্যারন পুনরায় প্রবেশ করে মিনটাকাকে নরম ও অন্ধকার বালির গর্ভ থেকে উজ্জ্বল সূর্যালোতে টেনে বের করল।

তারা তাদের দুজনকে দাঁড় করালো এবং পড়ে যাওয়া হতে তাদের ধরে রাখল, কারণ তাদের পায়ে কোন শক্তি ছিল না। নেফার এক পাশে কাত হয়ে মিনটাকার কাছে গেল এবং নিরবে তাকে জড়িয়ে ধরল। মিনটাকা কাঁপছিল যেন তার ম্যালেরিয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পর নেফার তার মুখটা দুই হাতে তুলে ধরে ভয় ও করুণা নিয়ে তা লক্ষ্য করল। তার চুল বালিতে সাদা, তার চোখের ভ্রু পুরু হয়ে আছে ঐ বালিতে। তার চোখগুলো গাঢ় লাল গহ্বরে পরিণত হয়েছে যেন এবং ঠোঁট ফুলে কালো হয়ে গেছে। ফলে যখনই সে কথা বলার চেষ্টা করল, ওগুলো ফেটে গেল এবং এক ফোঁটা রক্ত; রুবির ন্যায় লাল দেখাতে, তার চিবুক দিয়ে গড়িয়ে পড়ল।

পানি, নেফার অবশেষে কোন রকমে উচ্চারণ করল। তাকে (মিনটাকাকে) অবশ্যই পানি পান করাতে হবে।

সে তার হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়ল এবং পাগলের মতো বালি খুঁড়তে করতে লাগল। ম্যারন ও হিল্টোও তার সাথে হাত মেলালো এবং তারা পানির থলেটা উন্মুক্ত করল। ওটা টেনে বের করে তারা দেখল যে বেশিরভাগ পানিই যা ওটার মধ্যে অবশিষ্ট ছিল বাষ্পে পরিণত হয়েছে অথবা চাপে তা থেকে বেড়িয়ে গেছে। এখন প্রত্যেকের জন্য কয়েক বার মুখ ভরে পান করার মতো অবশিষ্ট আছে কেবল, তবে ঐ পরিমাণ তাদের আরো কিছুক্ষণ বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট। নেফার তার জল শূন্য দেহে শক্তি ফিরে আসা অনুভব করল এবং প্রথম বারের মতো নিজের দিকে মনোযোগ দিল।

সময়টা ছিল সকালের মাঝামাঝি। সে জানে না কোন সকাল বা কত দিন তারা সমাহিত ছিল। এখনো স্থির বাতাসে স্বর্ণের ধুলার ন্যায় বালির একটা পাতলা আবরণ ভেসে বেড়াচ্ছে।

সে তার চোখের উপর হাত রেখে মরুভূমির বাইরে তাকাল এবং কিছুই চিনতে পারল না। জায়গাটা পুরোপুরি বদলে গেছে। উঁচু বালিয়াড়িগুলো চলে গিয়ে অন্য পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যা ভিন্ন আকৃতির ও ভিন্ন বিন্যাসের। যেখানে পর্বত ছিল সেখানে উপত্যকা এবং এখন যেখানে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে তা সমতল ছিল। এমনকি রং-টা পর্যন্ত বদলে গেছে। চাপা রক্তবর্ণ ও ভাঙ্গা নীলের স্থানে লাল ও সোনালি হলুদ বর্তমান।

সে বিস্ময়ে তার মাথা নাড়ল এবং টাইটার দিকে তাকাল। ম্যাগোস তার লাঠিতে ভর দিয়ে বেঁকে আছে, নেফারকে দেখছিল সেই মলিন, পুরানো কিন্তু। বয়সহীন চোখ দিয়ে।

টর্ক? নেফার কোনভাবে বলল।কোথায়?

সমাহিত, টাইটা উত্তর দিল এবং এখন নেফার দেখতে পারল যে সেও লাকড়ির লাঠির মতো শুষ্ক হয়ে গেছে এবং একই যন্ত্রণায় ভুগছে যেমনটা তারা ভুগছে।

পানি? নেফার ফিসৃফিস্ করে বলল, তার স্ফীত ও রক্তাক্ত মুখ স্পর্শ করল।

এসো, টাইটা বলল।

নেফার মিনটাকার হাত নিল এবং ধীরে ধীরে তারা ম্যাগোসকে অনুসরণ করে পিঙ্গল বর্ণের বালির মধ্যে বেরিয়ে এল। প্রচন্ড তৃষ্ণা ও সূর্যালোক টাইটার উপর যেন জেকে বসেছে, তথাপি তার চলার গতি ধীর ও দৃঢ়। অন্যরা তার পিছনে টল মল পায়ে এগিয়ে চলল।

টাইটাকে মনে হল উদ্দেশ্যহীন ভাবে সুন্দর বালির নতুন উপত্যকার মধ্য দিয়ে তাদের নিয়ে চলছে। হঠাৎ সে তার সামনে তার লাঠিটা তুলে ধরে ওটা ঝাড় দেওয়ার মতো গতি তৈরি করে একি ওদিক ঘুরালো। একবার, তারপর আবার হাঁটুতে ভর দিয়ে সে নিচু হয়ে কপাল দিয়ে মাটি স্পর্শ করল।

সে কি করছে? মিনটাকা ফিসফিসিয়ে বলল। যে টুকো পানি তারা পান করেছে তা তাদের ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল না এবং সে আবার দুর্বল হয়ে পড়ছে। সে কি প্রার্থনা করছে?

নেফার শুধু তার মাথা নাড়ল। সে অপ্রয়োজনীয় কোনো কথা বলে শক্তি ব্যয় করল না। টাইটা ধীরে এগিয়ে চলল এবং প্রসঙ্গত তার লাঠি দিয়ে সে একই রকম ঝাড় দিয়ে যাচ্ছে, নেফারের পানি গনকের কাজটার কথা মনে পড়ে গেল।

আরো একবার টাইটা হাটুগেড়ে বসল এবং তার চেহারা মাটির কাছাকাছি রাখল। এবার নেফার তাকে আরো মনযোগ দিয়ে দেখল এবং লক্ষ্য করে দেখল যে

সে. প্রার্থনা করছে না বরং বালির স্তরের কাছের মাটি শুঁকছে। তখন সে বুঝল আসলে সে কি করছে। সে টর্ক বাহিনীর সমাহিত রথের সন্ধান করছে, সে ফিসফিস করে মিনটাকাকে বলল। তার লাঠিটা হচ্ছে একটি ঐন্দ্রজালিক দন্ড এবং সে বালির নিচে পচনের গন্ধ খুঁজছে।

টাইটা হঠাৎ অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়াল এবং হিল্টোর উদ্দেশ্যে মাথা নাড়াল। এখানে খনন কর, সে আদেশ দিল।

তারা সবাই জনাজীর্ণ হয়ে সামনে হামাগুড়ি দিল এবং বাটির মতো করে হাত দিয়ে বালি খুঁড়তে লাগল। তাদের বেশি দূর যেতে হল না। এক হাত গভীরে তাদের হাত শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেল এবং তারা কাজের গতি তখন প্রায় দ্বিগুণ করল।

দ্রুত তারা একটা রথের চাকার কিনারা বের করল যা রথটার পাশেই পড়ে ছিল। পাগলের মতো খননে তাদের আরো কয়েক মিনিট গেল এবং তারা একটি পানির থলে টেনে বের করল। তারা ওটার দিকে হতাশা নিয়ে তাকিয়ে রইল কারণ ওটা ফেটে গেছে, সম্ভবত যখন রথটা উল্টে গিয়েছিল। থলেটা শুকনো, যদিও তারা পাগলের মতো ওটা পিষল তবুও তা থেকে এক ফোঁটা মূল্যবান তরল বের হল না।

নিশ্চয়ই আরেকটা থাকবে। নেফার শুষ্ক স্ফীত ঠোঁটের মধ্যে দিয়ে বলল। আরো গভীরে খনন করো।

তারা বালিতে তাদের শক্তির শেষ হতাশ জনক বিস্ফোরণে থাবা দিল এবং যখন গর্তটা আরো গম্ভীর হল মৃত ঘোড়ার দুর্গন্ধ তখন জোরালো হল এবং বমির উদ্রেক হল। ওগুলো তাপের মধ্যে এই দিন গুলোতে পড়েছিল।

হঠাৎ নেফার গর্তের গভীরে হাত ঢুকাল এবং কিছু একটা নরম ও নমনীয় বস্তু অনুভব করল। সে ওটার চাপ দিল এবং তারা সবাই পানির গর গর শব্দ শুনল। সে আরো আলগা বলি সরিয়ে ওগুলোর মধ্যে থেকে একটা ফোলানো পানির থলে তুলে আনল। তাদের তৃষ্ণা তখন আরো বেড়ে গেল ও কাতর স্বরে আর্তি জানাল সবাই। টাইটা ছিপি খুলে চামড়ার মগে কিছু পানি ঢালল যা পানির থলের পাশে গর্তের মধ্যে পড়ে ছিল।

পানির তাপমাত্রা ছিল রক্তের উষ্ণতার সমান। টাইটা মগটি মিনটাকার ঠোঁটের কাছে নিয়ে ধরল। সে তার চোখ বন্ধ করে পরমানন্দে পানি পান করল।

প্রথমেই বেশি নয়; টাইটা তাকে সর্তক করল, তার কাছ থেকে মগটা নিয়ে নেফারকে দিল। তারা পর্যায়ক্রমের পান করল। তারপর আবার মিনটাকা পান করল এবং মগটা আরো একবার ঘুরল সবার হাতে হাতে।

এরইমধ্যে টাইটা আরো অনুসন্ধান চালানোর জন্য তাদের ত্যাগ করল। অল্প সময়ের মধ্যেই সে আবার তাদের খনন করতে ডাকল। এইবার তারা সৌভাগ্যবান; অল্প বালির নিচে শুধুমাত্র রথই না সেখানে পানির তিনটি থলেও ছিল এবং একটাও নষ্ট হয়নি।

এবার ঘোড়াগুলো; টাইটা তাদের বলল এবং তারা একে অপরের দিকে দোষীর মতো তাকাল। ওগুলোর কথা তারা ভুলে গিয়েছিল, পানির থলেগুলো নিয়ে তারা পা টেনে টেনে বালির মধ্যে দিয়ে পর্বতের পাদদেশে ফিরে চলল। সরু গিরিখাতটায় যার মধ্যে তারা ঘোড়াগুলোকে বেঁধে রেখেছিল অবশ্যই খামসিনে পূর্ণ শক্তি সত্ত্বেও বাঁধার দেওয়ার জন্য তা ভালোভাবে কাজ করে থাকবে। তারা খননে কাঠের কোদাল ব্যবহার করল যা তারা সমাহিত রথের মালপত্রের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল। যাইহোক, গন্ধ তাদের সতর্ক করল কি আশা করতে হবে। পশুটা মৃত এবং ওটার পাকস্থলি গ্যাসে ফুলে বেলুনের মতো হয়ে আছে। তারা পশুটির আশা ত্যাগ করে পরের পশুটার জন্য খনন করল।

এবার তারা আরো বেশি ভাগবান। এটা একটা ঘোটকী, ঘোড়াগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ইচ্ছুক এবং শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যবান যা তারা চোরাবালির ওখান থেকে ধরে এনেছিল। প্রাণীটা জীবিত, কিন্তু কোনমতে। তারা তার বাঁধনটা কেটে দিল যা তাকে নিচে ধরে রেখেছিল, কিন্তু প্রাণীটা এতো দুর্বল ছিল যে চিকিৎসা ছাড়া নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারল না। সবাই তাকে ধরে তুলল। দুর্বল ভাবে পশুটা দাঁড়াল এবং কাঁপছিল ও দুলছিল। আবার মনে হল পড়ে যাবে, কিন্তু মিনটাকা যখন তার সামনে পানির বালতিটা ধরল তখন সে লোভীর মতো তা পান করল এবং মনে হল তৎক্ষণাৎ উন্নতি হল তার।

এরই মধ্যে লোকেরা অন্য ঘোড়াগুলোর জন্য খনন শুরু করেছে। তারা আরো দুটি তৃষ্ণার্ত অথবা দম আটকে যাওয়া মৃত ঘোড়া পেল, কিন্তু অন্য দুটা এখনো জীবিত। প্রাণীগুলো সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিল যখন তাদের পানি দেওয়া হলো।

তারা মিনটাকাকে তিনটি দুর্বল ঘোড়া দেখাশুনা করার জন্য রেখে রথের কাছে ফিরে গেল। এবার গবাদিপশুর খাবার খুঁজতে বালি খোঁড়া আরম্ভ করল তারা। অবশেষে শস্যের থলে ও অন্য একটা পানির থলে নিয়ে তারা ফিরল।

তুমি দেখছি তাদের সাথে ভালোই ভাব জমিয়েছো; নেফার মিনটাকাকে বলল, ঘোটকীর ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে। কিন্তু ভয় হচ্ছে চলার মতো তাদের সামর্থ আছে কিনা।

সে তার দিকে তীব্রভাবে ঘুরল; আমি তাদের সবগুলোকে সুস্থ করে তুলব। আমি দেবীর সাথে শপথ করেছি। আমি নিশ্চিত বাইরে বালির নিচে আরো শত শত গবাদিপশুর খাবার ও পানির থলে রয়েছে। আমাদের এখানে আরো অনেক দিন থাকতে হতে পারে। আর যখন আবার যাত্রা করবো তখন এই সাহসী জন্তুগুলো আমাদের এখান হতে বাইরে নিয়ে যাবে।

নেফার তার কুঞ্জিত শুষ্ক ঠোঁটের মধ্য দিয়ে তাকে উপহাস করল। আমি তোমার আবেগী স্বভাবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল।

তাহলে আমাকে আর তিরস্কার করো না; সে তাকে সর্তক করল। নইলে তুমি এর আরো অনেক প্রমাণ সামনে দেখবে। এই প্রথম বারের মতো খামসিন শেষ হওয়ার পর মিনটাকা হাসল। এখন যাও অন্যদের গিয়ে সাহায্য কর। আমাদের তো আর পানির বিশাল সরবরাহ নেই।

নেফার তাকে ছেড়ে বালির মধ্য দিয়ে চলে গেল যেখানে টাইটা ভূমিতে আরো অনুসন্ধার চালাচ্ছে। হিকস্‌দের সবগুলো রথই হালকা ভাবে বালিতে ঢাকা ছিল না যেমন করে তারা প্রথমটা খুঁজে পেয়েছিল। অনেকগুলো উঁচু নতুন বালিয়াড়ির নিচে ঢাকা পড়েছে।

তারা অনুসন্ধান চালিয়ে পাথুরে গিরি থেকে আরো অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেল এবং বালির নিচে অনেক মরদেহ পেল যাদের ফীত পেট থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। শীঘই তারা যেখানে মিনটাকা সেবিকার ভূমিকায় ঘোড়াগুলোর যত্ন নিচ্ছিল তার সীমার বাইরে চলে গেল।

*

সব শব্দ থেমে গেলে টর্ক নিজের সম্বতি ফিরে পেল। তারপর একটু এগুবার জন্যে নড়ার চেষ্টা করতেই সে ঝাঁকিয়ে উঠল ব্যথায়। বালির পাহাড় যেন তার উপর চেপে বসে আছে। মনে হলো তার পাঁজর ভেঙে যাবে এবং ফুসফুস থেকে বাতাস বের করে দিবে, তবুও সে জানত ঝড় থেকে বাঁচার জন্যে এ স্থানটি ইশতার তাদের জন্য পছন্দ করেছে। ভাগ্যবশত অথবা নিয়তি যাই বলা হোক অন্য কোন জয়গায় হলে হয়ত তারা চির দিনের জন্যে সমাহিত হয়ে যেতো।

এখন সে উঠার জন্য লড়াই করল; ডুবুরির মতো আলো ও বাতাস যেন গভীর পুকুরের গভীরতা থেকে তার কাছে আসছে। বালির মধ্যে দিয়ে কষ্ট করে যখন সে সাঁতার কাটল, তখন তা হলো এক জ্বলন্ত যন্ত্রণা। সে লড়াই চালিয়ে গেল যতোক্ষণ তার কাপড়ে ঢাকা মাথাটা বালির বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এল। নতুন এক জগৎ তার সামনে উন্মোচিত হল তখন। চিকচিক আলোয় তার চোখ পিটপিট করে উঠল। ঝড়ো বাতাস থেমে গেছে কিন্তু বাতাসে উড়ন্ত ধুলা সুন্দর করে উজ্জ্বল হয়ে জ্যোতি ছড়াচ্ছে। সে ঐ ভাবেই কিছুটা সময় বিশ্রাম নিল সে যততক্ষণ না তার কাঁধের ব্যথা একটু কমল। তারপর সে বালির স্তরের এক পাশে উঁচু হয়ে থাকা ঢিবিটা ধাক্কা দিয়ে সরাল যা তার দেহের নিমাংশ ঢেকে রেখেছিল এবং ডাকার চেষ্টা করল, ইশতার! তুমি কোথায়? কিন্তু তার কণ্ঠ যেন কিছু চেপে ধরে আছে। ধীরে ধীরে সে মাথা ঘুরিয়ে যাদুকরকে দেখল। তার কাছাকাছি বসে রয়েছে, পিঠটা পাথুরে পর্বতের দিকে মুখ করা। তাকে কবর থেকে তুলে আনা শব দেহের মতো দেখাল যা কয়েক দিনের মৃত দেহের ন্যায় শীর্ণ। আর তখন ইশতার তার একটা ভালো চোখ খুলল।

পানি? টর্কের কণ্ঠটা শুধু একটু বোঝা গেল। কিন্তু যাদুকর তার মাথা দোলালো।

তাহলে আমারা ঝড়ের মধ্যে বেঁচে আছি, এই বালির কবরে মরতে মরতে। টর্ক বলার চেষ্টা করল, কিন্তু কোন শব্দ তার বিধ্বস্ত গলা ও মুখ দিয়ে বের হলো না।

সে আরো কিছুক্ষণ শুয়ে রাইল। ইচ্ছে করছে চোখ বন্ধ করে তার ঘুমিয়ে পড়তে এবং আর কখোনই জেগে না উঠতে। ভাবনাটা তাকে তাড়িত করল এবং জোর করে সে তার শক্ত চোখের পাতা খুলল, অনুভব করল কাঁকড় তার পাতার নিচে অক্ষিগোলকের সাথে ঘষা খাচ্ছে।

পানি সে বলল। পানি খোঁজ।

পাথরকে ভিত্তি ধরে সে একদিকে কাত হয়ে পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াল এবং দুর্বলতায় দুলে উঠল ও ঘামতে লাগল।

ইশতার তাকে দেখল, একটা অন্ধ চোখে তাকে কোন সরীসৃপ অথবা মরদেহের চোখের মতই লাগছে। টর্ক মাতালের ন্যায় সামনে এগোতে শুরু করল। প্রতি পদক্ষেপে সে বাঁধা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। পাহাড়ের পাদদেশ বরাবর তারা রাস্তা করে নিল যতোক্ষণ না সে বাইরে মরুভূমিতে তাকাল। বালিয়াড়গুলো আদিম ও নিখুঁত, একজন তরুণীর দেহের মতই ইন্দ্রিয় সুখাবহ রূপ নিয়ে বাঁকানো।

মানুষ বা রথের কোনো চিহ্ন নেই। তার যুদ্ধ বাহিনী সমগ্র মিশরে সবচেয়ে সুন্দর, কোন চিহ্ন ছাড়াই তারা বিলীন হয়ে গেছে। সে তার ঠোঁট অবলেহন করতে চাইল। কিন্তু বালুতে মাখামাখি মুখে তার কোন থু থু ছিল না। সে অনুভব করল তার পা নিচে ভেঙে পড়তে চাইছে এবং জানে যদি পড়ে যায় তাহলে কখনোই সে আর উঠতে পারবে না। তারা কোথায় যাচ্ছে সে জানে না। তার মাথায় এখন একটাই চিন্তা, শুধু এগিয়ে যাওয়া।

তখন সে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনল এবং জানত তার হ্যাঁলুসিনেশন হচ্ছে। তারপর আবার নিরবতা। সে মনোযোগ দিল। কণ্ঠস্বরগুলো আবার এল। এবার ওগুলো আরো কাছে এবং আরো পরিষ্কার। তার দেহে সে অপ্রত্যাশিত এক শক্তি প্রবাহতা অনুভব করল। কিন্তু যখন সে ডাকার চেষ্টা করল তার শুকনো গলা থেকে কোনো শব্দ বের হল না। আরো একবার সব নিরব হল। কণ্ঠস্বরগুলো থেমে গেছে।

সে আবার সামনে বাড়ল, তারপর হঠাৎ থেমে গেল। একটি নারী কণ্ঠ, কোনো ভুল নেই। একটি মিষ্টি, পরিষ্কার গলা।

মিনটাকা! নামটা নিরবে তার স্ফীত ঠোঁটের উপর সৃষ্টি হল। তারপর আরেকটি কণ্ঠ। এবার একজন পুরুষের। সে শব্দগুলো বুঝতে পারল না বা বক্তাকে চিনতে পারল না। কিন্তু যদি সে মিনটাকার সাথে হয় তবে সে অবশ্যই আসামীদের একজন হবে যাদের টর্ক অনুসরণ করছে। শত্রু!

টর্ক নিজের দিকে তাকাল। তার তলোয়ারের বেল্টটা হারিয়ে গেছে এবং সেই সাথে তার হাতিয়ারটাও। সে নিরস্ত্র; আর তার পরিহিত কাপড়ে এতো বালি লেগে আছে যে তা তার শরীর একটা পশমের শার্টের ন্যায় গরম করে রেখেছে। একটি অস্ত্রের জন্য সে তার চারপাশে তাকাল, একটি লাঠি কিংবা একটা পাথর, কিন্তু কিছুই ছিল না। সব কিছু বালিতে ঢাকা পড়েছে।

সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এবং কণ্ঠগুলো আবার এলো। মিনটাকা ও লোকটি পাহাড়ের মধ্যে একটা গিরিখাতে রয়েছে। যখন সে ইতস্তত করছিল তখন সে বালির কচকচ আওয়াজ শুনল, কারো পায়ের নিচে লবণের ক্রিসটাল ভাঙ্গলে যেমন হয়। ঐ লোকটি গিরিখাত থেকে নেমে আসছে যেখানে টর্ক দাঁড়িয়ে আছে সেই বরাবর। টর্ক পাথুরে দেয়ালের পিছনে আড়াল নিল এবং একজন লোক গিরিখাতের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, বিশ কদম দূরে যেখানে টক লুকিয়ে আছে তার কাছেই। অপরিচিত লোকটি দৃঢ় পদক্ষেপে বালিয়াড়ির দিকে যাত্রা করল। খুবই পরিচিত, কিন্তু পরিচয় লুকিয়ে লোকটা টর্ককে এড়িয়ে গেল। তারপর ঘুরে গিরিখাতের দিকে ডেকে বলল, নিজেকে অসঙ্গত ভাবে কষ্ট দিও না, মিনটাকা! তুমি একটা যন্ত্রণাদায়ক অগ্নি পরীক্ষার মধ্যে সময় পার করছ। তার পর সে হাঁটা শুরু করল।

টর্কের মুখ তার পিছনে হাঁ হয়ে গেল। ও তো মৃত, ভাবল সে। এ হতে পারে না। নাজার কাছ থেকে আসা বার্তাটি ছিল পরিষ্কার…। সে সম্ভাবনাটা বিচার করল। একটা জ্বিন বা কোন খারাপ আত্মা সম্ভবত নেফার সেটির রূপ ধারণ করেছে এবং তাকেই সে মরুভূমির দিকে যেতে দেখছে। তারপর সে ঝাপসা চোখে দেখল অন্য তিন জনের সাথে সে যোগ দিচ্ছে। তাদের মধ্যে ওয়ারলকের নির্ভুল অবয়টা সে চিনতে পারল; টর্ক বুঝল, অবশ্যই সে সব কিছুর মূলে, কোনো অদ্ভুত ও রহস্যজনক ভাবে ফারাও নেফার সেটির পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছে। কিন্তু এখন তার না আছে সময় কিংবা ইচ্ছা এই বিষয়ে ভাবার। তার মনে শুধু একটাই এখন চিন্তা এবং তা হচ্ছে পানি।

যতোটা সম্ভব সে পারল সঙ্গোপনে হামাগুড়ি দিয়ে গিরিখাতে প্রবেশ করল যেখানে মিনটাকার কণ্ঠটা শুনেছে এবং পর্বতের কোনা থেকে উঁকি মেরে ভেতর দেখল। প্রথম দর্শনে সে তাকে চিনতে পারল না; একজন চাষির মতো নোংরা হয়ে আছে সে। তার চুল ও ছিন্ন বস্ত্র বালিতে শক্ত হয়ে আছে। চোখ কোঠরে বসা ও লাল। সে একটা ছোট ঘোড়ার পালের সামনে হাঁটুগেড়ে বসে আছে, ওটাকে পানি করানোর উদ্দেশ্যে একটা পানির পাত্র ধরে রয়েছে হাতে।

পানিই একমাত্র বস্তু যার বিষয়ে টর্ক ভাবতে পারল। সে এই দূর থেকেই তার গন্ধ নিতে পারল এবং তার পুরো দেহ একটা ব্যাকুল কামনায় ছেয়ে গেল। টলতে টলতে মিনটাকার দিকে এগিয়ে গেল সে। মেয়েটির পিঠ তার দিকে ঘুরানো এবং নরম বালি তার আসার শব্দ ঢেকে দিল। মিনটাকা তার সম্পর্কে সচেতন হল না যতোক্ষণ না তার বাহু ধরল সে। ঘুরে তাকে দেখতে পেয়েই মিনটাকা একটা চিৎকার দিল। ততোক্ষণে টর্ক তার হাত থেকে পানির পাত্রটা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং তাকে নিচে ফেলে দিল। যেহেতু পানি পান করতে হাতটা প্রয়োজন তাই সে তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে হাঁটুগেড়ে তার ছোট পিঠের উপর চড়ে বসল তাকে বাধ্য রাখতে, যাতে পাত্র থেকে পানি পান করতে সহজ হয়।

সে বড় বড় ঢোক গিলে গলগল শব্দ করে পান করতে লাগল এবং ঢেকুর তুলল। একটু থেমে তারপর আরো কিছু পান করল। মিনটাকা তার নিচে মুচড়াচ্ছিল এবং চিৎকার করল, নেফার। টাইটা! আমাকে বাঁচাও।

টর্ক আবার ঢেকুর তুলে মিনটাকার চেহারা বালির মধ্যে চেপে ধরল তাকে চুপ করাতে এবং পাত্র থেকে শেষ বিন্দুটা পান করল। মিনটাকার তার চার পাশে তাকাল, তার উপর টর্ক এমন ভাবে গুটিসুটি মেরে বসে আছে ঠিক এটা সিংহ তার শিকারের উপর যেমনটা থাকে। গিরিখাতের দেয়ালের সাথে পানি থলেগুলো দেখতে পেল টর্ক, সেই সাথে বলুম এবং তলোয়ারও পাশে রয়েছে।

সাথে সাথে টর্ক দাঁড়িয়ে ওগুলোর দিকে যেতে শুরু করল। তৎক্ষণাৎ মিনটাকা লাফ দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু টর্ক তাকে আবার লাথি মেরে ফেলে দিল। আর কোন সুযোগ পাবে না, বেশ্যা কুত্তি; কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল টর্ক এবং ঘন বালি মাখা এক মুঠো চুল ধরে তাকে বালির মধ্যে দিয়ে পিছলে টেনে নিয়ে চলল সে যতোক্ষণ না পানির থলের কাছে পৌঁছল। সেখানে পৌঁছে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। তারপর স্যান্ডেল পরিহিত তার বিশাল পা দিয়ে আবার চেপে ধরল তার পিঠ। হাত বাড়িয়ে পানির থলেটা নিয়ে দুই হাঁটুর মধ্যে খানে মিনটাকাকে চেপে ধরে সে কাঠের ছিপি খুলল। ঠোঁটের কাছে তা তুলে গরম ও লোনা পানির ধারা তার গলা দিয়ে বয়ে যেতে দিল।

যদিও মুখটা বালির মধ্যে চেপে ধরা ছিল তবুও মিনটাকা বুঝল যে টর্ক পানি পানের জন্য কামাতুর হয়ে আছে। সন্তুষ্টি লাভ ও পুরো মনযোগ তার উপর আসার আগেই তাকে যা করার করতে হবে। মিনটাকা জানে তার সহ্যের সীমার চাইতে বেশি অপমান টর্ক সহ্য করেছে এবং আরেক বার তার হাত থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগেই সে তাকে এখানেই হত্যা করবে।

পাগলের মতো সে পাথরের দেয়ালে সাজানো হাতিয়াড়ের বান্ডিলের দিকে হাত বাড়াল। তার আঙ্গুলগুলো একটি বল্লমের ফলার কাছাকাছি রয়েছে। টর্ক তখনো তার মাথা পিছনে হেলে পান করে চলেছে। কিন্তু টর্ক তার নড়াচাড়াটা অনুভব করল। সে পানির থলেটা নামাল, আর ঠিক তখন মিনটাকা তার পেট ও কুচকিতে ছোট কিন্তু ভয়ংকর অস্ত্রটা দিয়ে আঘাত করার জন্য মোচড় দিল। যাই হোক আক্ৰমণটা লক্ষ্য স্থির হয়েছিল, নিচ থেকে তা হওয়ায় শক্তি ছিল কম।

টর্ক চকচকে ব্রোঞ্জের তীক্ষ্ণ প্রান্ত ঝলকাতে দেখল শুধু। একটি হতভম্ব চিৎকার করে সে লাফ দিয়ে পিছু সরে গেল আঘাতটা এড়িয়ে যেতে। বিশ্বাস ঘাতক নোংরা মেয়ে মানুষ। সে পানির থলেটা ফেলে দিয়ে তাকে ধরতে সামনে এগোল দ্রুত। কিন্তু সেই সময় তার উপর থেকে ওজন সরে গেলে মিনটাকা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সে তার হাত থেকে গলে দৌড়ে প্রবেশ দ্বার দিয়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করল প্রাণপণে। কিন্তু টর্ক তার রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছে এবং তার দীর্ঘ বাহু বাড়িয়ে তাকে ধরতে হাত বাড়াল, তার কাপড়ের আঁচল ধরে ফেলল সে। কিন্তু লাফিয়ে এক পাশে সরে গেল মিনটাকা। আঁচলের লিনেন সুতায় টর্কের আঙুল ছিঁড়ে গেল এবং সে মোচড় দিয়ে তার থেকে সরে দাঁড়াল। কিন্তু গিরিখাতের মধ্যে তখনো মিনটাকা বন্দী অবস্থায়। একটা কর্কশ শব্দ করে তাকে টর্ক ধরতে এল কিন্তু মিনটাকা তখন পর্বতের দেয়ালের দিকে দৌড় দিল এবং ওটা আরোহণ করতে শুরু করল, একটা বিড়ালের ন্যায় নমনীয় ও দ্রুত গতিতে।

টর্ক তাকে ধরার আগে সে তার নাগালের বাইরে চলে গেল, উপরে উঠে গেল দ্রুত। এদিকে টর্ক তাকে অনুসরণ করার আশা ততোক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। সে বলুম ছুঁড়ে মারল, কিন্তু সে তার বাম হাত ব্যবহার করছে এবং নিক্ষেপের শক্তিটা ছিল অল্প।

মিনটাকা মাথা নিচু করতেই বল্লমটা তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল ও তার সামনে পাথরে ঢুকে গেল। ভয় পেয়ে সে আরো দ্রুত উঠতে লাগল। টর্ক টলতে টলতে অন্য একটা বল্লম তুলে নিল এবং পুনরায় নিক্ষেপ করল যা তার এক হাত দূর দিয়ে চলে গেল ব্যর্থ হয়ে। টর্ক রাগ ও হতাশায় বিরক্তি প্রকাশ করল এবং তৃতীয় বল্লামটা টেনে নিল। কিন্তু মিনটাকা তখন হামাগুড়ি দিয়ে তার দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। সে নিজেকে একটা পাথরের সাথে আড়াল করে লুকিয়ে রইল। সেখান থেকে সে টর্ককে তার উদ্দেশ্যে গালিগালাজ করতে ও কসম খেতে শুনল। এমনকি তার দুরাবস্থার মধ্যেও তার নোংরা শব্দ তাকে অসুস্থ করে তুলল যা সে বলছিল উদ্দেশ্যে করে।

অন্য একটি বলুম যেখানে মিনটাকা শুয়ে আছে তার উপর দিয়ে উড়ে গেল এবং তার ঠিক উপরে পাথরের মুখে লেগে ঠনঠন শব্দ তুলল। খাড়া তাক বরাবর পড়ছিল ওটা এবং পুনরায় গিরির মেঝেতে পড়ার আগেই মিনটাকা তা ধরে ফেলল। সে তাকের কিনারা দিয়ে উঁকি দিল ও পিছু হটার জন্য প্রস্তুত। অনিশ্চিতভাবে টর্ক তার দিকে তাকিয়ে আছে, তার আঘাত প্রাপ্ত হাত তার পাশে ঝুলছে। তার মাথা দৃশ্যত হলে দেখা গেল রাগে ও আঘাতের ব্যথায় তার চেহারা বিকৃত হয়ে আছে এবং সে সামনে বাড়ল যেন তার দিকে চড়তে চায়।

মিনটাকা তখন তাকে বলুমের তীক্ষ্ম মাথাটা দেখাল, হা, উপরে এসো; সে তাকে শাসালো, এবং এটা তোমার ঐ শূকরের মতো পেটে ঢোকাতে দাও।

থেমে গেল টর্ক। তাকে আরো এক হাত চড়তে হবে এবং নিজেকে অক্ষত একটা হাত দিয়ে রক্ষা করতে হবে। সে দেখল তার হুমকি সত্য। যখন সে ইতস্তত করল, মিনটাকা তখন চিৎকার করতে লাগল। নেফার! টাইটা! হিল্টো! আমাকে বাঁচাও।

তার কণ্ঠ পর্বতে প্রতিধ্বনিত হয়ে গিরিখাতে বেজে উঠল বারবার। টর্ক তার চারপাশে হতাশ হয়ে তাকাল, আশা করল অস্ত্রহাতে শত্রুরা তার দিকে ছুটে আসবে এখনই। হঠাৎ করেই টর্ক একটা সিদ্ধান্ত নিল। সে পানির থলে তুলে ওটা তার কাঁধে ঝোলালো, ভেব না তুমি আমার কাছ থেকে চিরদিনের মতো পালিয়ে যেতে পারলে। একদিন আমি তোমার দেহের সকল আনন্দ মিটিয়ে দিব এবং তারপর তোমাকে আমি একটা খেলনার মতই আমার সৈন্য বাহিনীর কাছে তোমাকে তুলে দেবো। তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল সে এবং তারপর ঘোটকীটার উপর উঠার চেষ্টা করল। কিন্তু প্রাণীটা এতো দুর্বল ছিল যে তার বিশাল দেহ বইতে পারল না এবং তার নিচে পড়ে গেল।

টর্ক তখন তার নিজের পায়ের উপর ভর করে উঠে দাঁড়িয়ে পা টানতে টানতে গিরি থেকে বেরিয়ে গেল।

মিনটাকার একটু সন্দেহ হল তার এ চলে যাওয়া হয়তো কোন চাল হবে। সে পর্বতের নিরাপদ উঁচু স্থানটা হতে নামার সাহস করল না। সে বন্য ভাবে চিৎকার করে গেল, নেফার! আমাকে সাহায্য কর।

সে তখনো চিৎকার করছিল যখন নেফার দৌড়ে তার নিচে পাথুরে গিরিতে ফিরল, হাতে তার একটা তলোয়ার ধরা, হিল্টো ও ম্যারন তার পিছনে কাছাকাছি।

কি হয়েছে? নেফার জানতে চাইল, যখন সে পর্বত থেমে নেমে তার বাহুতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

টর্ক! সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল তাকে নিরাপদে ধরে রাখায় স্বস্তি পেয়ে। টর্ক জীবিত। সে এখানে ছিল।

সে বোকার মত কি হয়েছে খুলে বলল। তার তথা শেষ হবার আগেই নেফার অন্যদের আদেশ দিল নিজেদের অস্ত্রে সজ্জিত হতে।

টকর্কে ধাওয়া করতে যাবার প্রস্তুতি নিতে।

*

টাইটা তাদের সাথে যোগ দিতে ফিরে এসেছে। সে মিনটাকার সাথে থাকল যখন বাকি তিন জন টর্কের পায়ের ছাপ অনুসরণ করছিল, এতো সতর্ক ভাবে যে যেন তারা একটা আহত সিংহকে অনুসরণ করছে। তারা পর্বতের ভিত্তি ধরে এগেলো যতক্ষণ না তারা চিড়টায় পৌঁছল যেখানে টর্ক খামসিনের ক্রোধ থেকে বাঁচার জন্যে আশ্রয় নিয়েছিল। নেফার এলোমেলো বালি পরীক্ষা করল এবং সংকেতগুলোর অর্থ করল। তারা দুইজন। সে বলল, তারা ঝড়ে সমাহিত হয়েছিল যেমনটা আমরা হয়েছি। তারা নিজেদের খুঁড়ে বের করেছে। একজন এখানে অপেক্ষা করেছিল। পশমের একটা সুতা তুলে নিল সে যা পাথরের সাথে দৃঢ়ভাবে লেগে ছিল এবং ওটা আলোর মধ্যে ধরে বলল, কালো। এ ধরনের কালো রং মিশরীয়রা কদাচিৎ পরিধান করে। প্রায় নিশ্চিত এটা যাদুকর মেডির।

সম্মতি জানিয়ে মাথা দুলালো হিল্টো। ইশতার হয়তো ঝড় থেকে বাঁচার জন্য কোন ডাইনী বিদ্যা প্রয়োগ করছে। এটা নিশ্চিত যে সে টকর্কে রক্ষা করেছে ঠিক যেভাবে টাইটা আমাদের রক্ষা করেছে।

এখানে, নেফার উঠে দাঁড়াল এবং চিহ্নটা নির্দেশ করল। পানির থলেটা নিয়ে টর্ক যাদুকরকে খুঁজতে ফিরেছিল এবং তারা এই পথে চলে গিয়েছে।

তারা মরুভূমিতে অল্প কিছু দূর পর্যন্ত পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করল। তারা পশ্চিমে গিয়েছে। অ্যাভারিস ও নীলের দিকে ফিরে গেছে। তারা কি কখনো ওখানে পৌঁছতে পারবে?

না যদি আমি তাকে ধরে ফেলি। নেফার গম্ভীরভাবে বলল এবং বল্লমটা শক্ত হাতে নাড়াল যা সে বহন করছিল।

মহামান্য! হিল্টো আনুগত্য কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলল, তাদের পানির থলে রয়েছে এবং এতোক্ষণে তারা এখান থেকে অনেক দূর চলে গেছে। পানি ছাড়া আপনার অনুসরণ করার সাহস করা ঠিক নয়।

নেফার ইতস্তত করল। যদিও হিল্টো যা বলল তাতে সে যুক্তি দেখল তবুও টর্ককে পালিয়ে যেতে দেওয়াটা তাকে যন্ত্রণা দিল। মিনটাকা যা তাকে বলেছে তাতে টর্ক আঘাত প্রাপ্ত এবং প্রতিপক্ষ হিসেবে খুব বিপদজনক হবে না, তারপরও নেফার এখনো দুর্বল।

শেষ পর্যন্ত সে এক দিকে ঘুরল এবং দৌড়ে সব চেয়ে কাছের বালিয়াড়ির চূড়ায় উঠল। চোখের উপর হাত রেখে সে পশ্চিম দিকে তাকাল–আদিম, বাতাস বাহিত বালির উপর পায়ের চিহ্নের রঞ্জু বরাবর যতোক্ষণ না দূরে অর্ধ ক্রোশ বা বেশি দূরে সে দুটি ক্ষুদ্র অবয়ব খুঁজে পেল, ধীর ভাবে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে তারা। ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতেব সে তাদের দেখল যতোক্ষণ না তারা আন্দোলিত তাপের মরীচিকায় অদৃশ্য হল।

সময় আবার আসবে, নেফার ফিসফিস করল, আমি তোমার জন্য আসব। আমি হুরাসের পবিত্র দুইশ নামে শপথ করছি। আরো ষোলটা সমাহিত রথ তারা খুঁজে পেল এবং উন্মোচন করল সবগুলো। এরকম পানি ও খাবারের প্রচুর সরবরাহে ঘোড়া ও মানুষগুলো সেরে উঠল দ্রুত। সেই সাথে তারা টর্কের সৈন্যবাহিনীর আরো অনেক মৃত দেহ বের করেছে। তাদের থেকে তারা নিজেদের পোশাক পরতে সক্ষম হল। নেফার মিনটাকার পায়ের মাপের একজোড়া স্যান্ডেল বদলে দিল, তার আঘাত প্রাপ্ত পা প্রায় পুরোপুরি ঠিক হয়ে গেছে।

দশম দিনে তারা যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল। চারটা রয়ে যাওয়া ঘোড়া চিলা বালির মধ্য দিয়ে রথ টেনে নেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না তাই নেফার তাদের মালবাহী ঘোড়া হিসেবে ব্যবহার করা সিদ্ধান্ত নিল; এবং তারা যতোটা বহন করতে পারে ততোটা পানির থলে তাদের পিঠে দিল।

রাতে নামলে ঘোড়াগুলো নিয়ে তারা বালিয়াড়িতে যাত্রা শুরু করল। খামসিন ভূমিকে এতোটাই বদলে দিয়েছে যে টাইটাকে তারার সাহায্য নিতে হল। তারা ঐ সারা রাত দৃঢ়ভাবে তারা দেখে চলতে থাকল এবং তার পরের রাতও চলল একইভাবে। দ্বিতীয় দিনের উষার পূর্বে তারা পুরানো ক্যারাভানের রাস্তায় পৌঁছল। এর কয়েক জায়গায় খামসিনে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তারা আরো বেশি দূর যাওয়ার পূর্বেই আলো জোরালো হলো এবং তারা পাথরের নুড়িটা দেখল যা সামনের রাস্তার সংযোগস্থল নির্দেশ করে। তারা আবিষ্কার করল ঝড় শেষ হবার পর এ পথে তাদের আগে আরো কারো পদ চিহ্ন পড়েছে। দুই জোড়া পদ চিহ্ন এ পথ দিয়ে পশ্চিমের রাস্তা ধরে চলে গিয়েছে যা নীলের উপত্যকা ও অ্যাভারিসের দিক নির্দেশ করে। টাইটা ও নেফার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল তা।

এটা টর্কের। এই রকম পা আর কারো নেই, নীলের বজরার সাইজ। মিনিটাকা ঠিক। সে আঘাতপ্রাপ্ত, ডানপাশে। হাঁটার সময় সেই চিহ্ন ফেলে গেছে। টাইটা চিহ্নটা পড়ল। এখনও আমি অন্যটার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। আমাদের দেখতে দাও সে কিছু সূত্র ফেলে গেছে কিনা যা তার পরিচয় প্রকাশ করবে। তারা চিহ্ন অনুসরণ করল যতোদূর পর্যন্ত চিহ্নটা শিলাস্তূপে বিদ্যমান ছিল।

আহ! এখানে। শিলাস্তূপের কাছাকাছি কেউ একজন সম্প্রতি বালিতে পাথরের একটি জটিল প্যাটার্ন তৈরি করেছে। এখন আর সন্দেহ নেই। এটা যাদুকর ইশতার। রাগান্বিতভাবে টাইটা পাথরগুলো ছড়িয়ে দিল। এটা তার নোংরা মারডুক খাদকের প্রতি একটা আহবান। বলেই সে একটা অপেক্ষাকৃত ছোট পাথর রাস্তায় নিক্ষেপ করল যা টর্ক ও ইশতার ওখানে স্থাপন করেছে। যদি ইশতারের সাথে কোন বাচ্চা থাকত তবে সে হয়তো তা বলি দিত। মারডুক মানুষের রক্তের জন্য তৃষ্ণার্ত।

C৮

এখানে, চিহ্নিত শিলাস্তূপের কাছে, নেফার একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। যদি আমাদের পূর্বে দীর্ঘ যাত্রা করতে হয় তবে আমাদের খাবার ও স্বর্ণের প্রয়োজন হবে। আমাদের অ্যাশিরিয়ান দরবারে ভিখেরি ও অবাঞ্ছিতের ন্যায় গিয়ে উপস্থিত হলে চলবে না।

টাইটা মাথা ঝাকলো সম্মতি প্রকাশ করে। মিশরে এমন অনেক ক্ষমতাবান লোক রয়েছে যারা আমাদের পূর্ণ সাহায্য করবে যদি তারা শুধু এটুকু জানে যে তাদের ফারাও এখনও জীবিত।

হিল্টো ও ম্যারনকে থেব ফিরে যেতে হবে, নেফার বলল। আমি নিজে যেতাম কিন্তু পুরো দুনিয়া আমাকে ও মিনটাকাকে খুঁজছে। সে তার একটা রাজকীয় আংটি খুলে তা হিল্টোর হাতে তুলে দিল। এটি হবে তোমার পরিচয়ের চিহ্ন। এটা আমাদের বন্ধুদের দেখাবে। তুমি অবশ্যই আমাদের জন্য লোকজন, স্বর্ণ, রথ ও ঘোড়া নিয়ে ফিরবে। যখন আমরা রাজা সারগনের কাছে যাবো তখন তাকে দেখানোর জন্যে আমাদের অবশ্যই এমনভাবে যেতে হবে যে আমরা এখনো মিশরকে চালনা করি।

আপনি যে ভাবে আদেশ দিলেন সে ভাবেই আমি করব, মহামান্য।

যতোটা দরকার তার চেয়ে বেশি সতর্ক থাকবে। তোমাকে অবশ্যই খবর সংগ্রহ করতে হবে। নকল ফারাও এর সব বিষয়ে জানবে।

আমি রাতেই রওনা দিচ্ছি, ফারাও! হিল্টো সম্মত হল।

পুরো দীর্ঘ উষ্ণ দিনটি তারা চাঁদোয়ার নিচে ছায়ায় শুয়ে পরিকল্পনা করে কাটাল যা তারা একটা সমাহিত রথ থেকে উদ্ধার করেছে। যখন সূর্য দিগন্তে ডুবে গেল এবং তাপ হারাতে শুরু করল তখন তারা আলাদা হয়ে গেল। হিল্টো ও ম্যারন পশ্চিম দিকে থেবসের দিকে এবং টাইটা, নেফার ও মিনটাকা গেল পূর্ব দিকে।

আমরা তোমাদের জন্যে গালালার ভগ্নাংশে অপেক্ষা করব। হিল্টোর উদ্দেশ্যে নেফারের শেষ কথা ছিল এটি। তারপর তারা তাকে ও ম্যারনকে বড় রাস্তা নিতে দেখল এবং পড়ন্ত সন্ধ্যায় তারা অদৃশ্য হয়ে গেল দ্রুত।

টাইটা, মিনটাকা ও নেফার ক্যারাভান ধরে গালালার দিকে পথ নিল। বিশ দিন পর মাত্র কয়েক ফোঁটা পানি থলেতে অবশিষ্ট নিয়ে তারা তাদের সে নিদর্শন ভগ্নস্থানে পৌঁছল।

*

সপ্তাহ পার হয়ে মাস হয়ে গেল এবং তারা গালালায় অপেক্ষা করেই চলল। টাইটা তার দিনগুলো একেকটি পাহাড়ে কাটাতে লাগল, যেগুলো শহরটা ঘিরে আছে। নেফার ও মিনটাকা মাঝে মাঝে তার দেখা পেত। দূর থেকে তাকে দেখতে যখন সে উপত্যকা ও গিরিখাতগুলোতে ঘুরঘুর করতো। প্রায়ই তারা তাকে তার লাঠি দিয়ে পাথর চাপড় দিতে ও খোঁচাতে দেখতো। অন্য সময় সে শহরের দেয়ালের বাইরে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া কুয়াটার পাশে বসে থাকতো, গভীর খাড়া নিচের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত শুধু।

যখন নেফার তাকে পরোক্ষভাবে প্রশ্ন করল, সে তা এড়িয়ে যেতে চাইল। এক দল আর্মির পানি দরকার। এই ছিল যা সে বলল।

আমাদের খুব অল্পই পানি আছে; নেফার জানাল, একজন আর্মি তো কথা পরের কথা। টাইটা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং পাহাড়ের দিকে চলে গেল তার লাঠি পাথরে চাপড়াতে চাপড়াতে।

মিনটাকা ভগ্নাংশের মধ্যে তাদের জন্য একটা কক্ষ তৈরি করল এবং নেফার তার উপরে ছাদ দিল ছেঁড়া কাবাকো দিয়ে। হিকস্ রাজকন্যা হিসেবে মিনটাকাকে কখনো খাবার রান্না করতে বা ঘর ঝাড় দিতে হয়নি, তাই তার প্রথম চেষ্টাটা ছিল বিব্রতকর। মুখ ভর্তি খাবার চিবাতে চিবাতে একবার টাইটা বলল, আমরা যদি টর্কের আর্মি ধ্বংস করতে চাই তবে সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হবে তোমাকে তাদের কাছে বাবুর্চি হিসেবে পাঠানো।

যদি তুমি ততোখানি দক্ষ হও, তবে তো তুমিই তোমার রান্নার দক্ষতা দিয়ে আমাদের সম্মানিত করতে পারো।

হয় তাই করতে হবে, নয় অনাহারে কাটাতে হবে, টাইটা সম্মত হল এবং তাকে আগুনের কাছে নিয়ে গেল। নেফার তার পুরনো শিকারীর ভূমিকায় গেল এবং মরুভূমিতে তার প্রথম দিন শেষে ফিরল একটা সুঢৌল তরুণ গজলা হরিণ ও চারটি চমৎকার পাখির ডিম নিয়ে। তবে একটু পচা ছিল তা। মিনটাকা তার অংশের ডিমের ওমলেট শুঁকে দেখল, যা টাইটা তৈরি করেছে এবং ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। এই কি একই ব্যক্তি যে আমার রান্নার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল? সে আগুনের আড়াআড়ি নেফারের দিকে তাকাল। তুমিও তার চেয়ে কম দোষী নও, নেফার। ডিম পর্যন্ত চিনতে পারলে না। পরের বার আমি তোমার সাথে যাব নিশ্চিত করতে যেন অল্প হলেও খাওয়ার যোগ্য কিছু আনা যায়।

একটা অগভীর ওয়াদির মধ্যে তারা পাশাপাশি শয়ন করল যা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে খাজ কেটে চলে গিয়েছে এবং সেখান হতে এক পাল দাজলা হরিণকে দেখল তারা।

ওগুলো পরীদের মতো সুন্দর! মিনটাকা ফিসফিস করে বলল, কত সুন্দর!

যদি তোমার অস্বস্তি লাগে, আমি তীর নিক্ষেপ করছি; নেফার তাকে বলল।

না; সে তার মাথা নাড়ল। আমি বলিনি যে আমি তা করব না। তার কণ্ঠে দৃঢ় সংকল্প এবং এতো দিনে সে তাকে যথেষ্ট জেনেছে তার সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন বিদ্ধ না করতে। পুরুষ হরিণটা তার দল থেকে এগিয়ে গেল। তার পিঠ কমনীয় দারুচিনি রঙের এবং তলপেটটা ছিল দিগন্তে ওঠা কোন বজ্রের মাথার ন্যায় রূপালি সাদা। সূঁচালো ক্র্যাকৃতির কান দুটোর মধ্য স্থানে তার শিং দুটো বীনা আকৃতির ও মসৃণ। সে তার দীর্ঘ বাঁকানো ঘাড়ের উপর তার মাথাটা ঘুরালো এবং তার ছোট দলটার দিকে তাকাল। একটা বাচ্চা লাফাতে শুরু করল তার লম্বা পায়ের উপর। পুরুষটা তার নাক উঁচিয়ে এটার পাশ গিয়ে তার লাফানো ধুর স্পর্শ করল। এটা হল সতর্কীকরণ আচরণ।

এই ছোট প্রাণীটা শুধু অনুশীলন করছে এবং দেখাচ্ছে। নেফার হাসল।

পুরুষ হরিণটা এই প্রদর্শনীতে আকর্ষণ হারাল এবং সামনে এগেলো যেখানে তারা ওত পেতে শুয়ে আছে। সে পাথুরে ভূমি দিয়ে তার রাস্তা নিল ও বিচক্ষণ মাধুর্যতায় কয়েক কদম পর পর থামছে চিন্তিত ভাবে বিপদের আশংকায় আশপাশ দেখার জন্য।

সে আমাদের দেখে নি, কিন্তু সে শীঘ্রই দেখবে, নেফার ফিসফিস করে বলল। আমাদের পাশে টাইটা নেই যে তাকে ধোকা দিবে।

সে আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে; মিনটাকা ফিসফিস করে বলল।

পঞ্চাশ কদম, আর নয়, তীর নিক্ষেপ কর নইলে সে যে কোন সময় চলে যেতে পারে। মিনটাকা অপেক্ষা করল যততক্ষণ না পুরুষ হরিণটা আরো একবার তার মাথা ঘোরালো। তারপর সে ধীরে ধীরে তার হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে ধনুকটা তুলে নিল। এটা একটা ছোট বাকানো অস্ত্র যা তারা সমাহিত রথ থেকে এনেছে। সে তীরটা ছুঁড়ল এবং তা মলিন মরুর আকাশে একটু বাঁক নিল।

তার বড় কালো চোখগুলো দিয়ে গজলা হরিণটি তৎক্ষণাৎ তাদের উঠার ছোট নড়াচড়া ধরে ফেলেছে। সে তার মাথা ঘুরিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তীর ছাড়ার মুহূর্তে ধনুকের গুণের আওয়াজে সে সামনে লাফ দিল, তীরটা তখনো বাতাসে। সে দৌড় দিল, ধুলোর ক্ষুদ্র ঝাঁপটা উঠিয়ে। তীরটা পাথরে লেগে ঝনঝন শব্দ করল, এক মুহূর্ত আগেও প্রাণীটা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল। মিনটাকা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং তাকে যেতে দেখে নেফার হাসল। শিকার ধরতে না পারায় তার মাঝে কোন হতাশা দেখা গেল না।

তার দৌড় দেখো, আবাবিল পাখির মতোই উড়ে চলছে।

টাইটা নেফারকে শিখিয়েছে প্রকৃত শিকারী তার শিকারকে ভালোবাসে ও সম্মান করে। ঐ প্রাণীগুলোর জন্যে তার সহানুভূতি দেখে মিনটাকার প্রতি নেফারের আরো বেশি ভক্তি ও প্রশংসা বৃদ্ধি পেল। সে তার দিকে ঘুরল, এখনো সে হাসছে। আমি দুঃখিত আমার হৃদয়, তোমাকে আজ রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থাতেই বিছানায় যেতে হবে।

না, টাইটা রান্নার আগুনে এই বাতাস থেকেও খাবার তুলবে।

তার দুজনে তীরটা কুড়াতে গেল। মিনটাকা একটু আগে ওটার কাছে পৌঁছালো। সে ওটা তোলার জন্য ঝুকতেই তার ছোট ছিন্ন স্কার্টের পিছনের দিক উঠে গেল। তার ঊরু মসৃণ ও বাদামী এবং নিতম্বটা সুষম গোলাকার। তার ত্বক মলিন ও নিখুঁত যেখানে সূর্য কখনো স্পর্শ করেনি, পূর্বের সিল্কের মতই কমনীয়।

সে সোজা হয়ে এক ঝটকায় ঘুরল তার চোখের অভিব্যক্তি ধরার জন্য। যদিও সে কুমারী, তার নারীসুলভ স্বভাব পূর্ণ বিকশিত। সে তার নিষ্পাপ ভঙ্গিটা দেখতে পেল যা তার মাঝে এক ধরনের আবেগ তৈরি করল এবং ওটা তাকে নাড়াও দিল। সে তাকে কতটা চায় তা দেখে সেও তাকে গভীর ভাবে চাইল যা ছিল যন্ত্রণাদায়ক। সে অনুভব করল তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার ভালোবাসায় বিগলিত হয়ে যাচ্ছে। শান্ত ভাবে দুলতে দুলতে সে তার দিকে এগুলো। কিন্তু নেফার শারীরিক ইচ্ছায় উষ্ণ, একটা লজ্জা অনুভব করল যা তাকে আবার প্রায় বিমোহিত করে তুলল। সে তার কাছে করা তার ওয়াদাটা স্মরণ করল, আমি বরং মরে যাব তবুও আমার শপথ ভাঙ্গবো না এবং তোমার অসম্মান করবো না। নেফার তাকে বলেছিল এবং এই স্মৃতি তাকে তার দিক থেকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করল। সে দেখল তার হাত কাঁপছে এবং তার কণ্ঠ কর্কশ শুনাল যখন সে বলল, চোখ অন্যদিকে সরিয়ে, আমি জানি অন্য পালটা কোথায়, কিন্তু আমাদের জলদি যেতে হবে যদি আমরা তাদের অন্ধকারে আগেই খুঁজে পেতে চাই। নেফার তার দিকে পিছু না তাকিয়ে রওয়ানা দিল এবং একটা বিতৃষ্ণা অনুভব করল। এই ভূমিতে মিনটাকা বেশিই কিছু চেয়েছে। সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে নেফারকে অনুসরণ করল। তার অদ্ভুত অনুভূতিগুলো সে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে যা তাকে প্রায় ঘিরে ধরেছিল। কিন্তু এতো সহজে সব সরে যাওয়ার নয় :

সে দ্রুত তার নাগাল ধরল এবং তাকে পিছনে ফেলে কয়েক কদম দুলকি চালে এগিয়ে গেল। নেফারের দৃষ্টি তার পিঠে মনোযোগ দিল। সে দেখল কীভাবে তার ঘন কালো কোকড়া চুল কাঁধের উপর লাফাচ্ছে। সে অবাক হয়ে দেখল তার কাঁধ বেশ প্রশস্ত হয়েছে সেই সময় থেকে যখন সে তার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ করেছিল। তারপর সে আরো নিচের দিকে তাকাল এবং অনুভব করল তার গাল গরম হয়ে পড়ছে যখন সে দেখল তার নিতম্ব তার খাটো পাতলা কাপড়ের নিচে আন্দোলিত হচ্ছে। নিজের অনুভূতিতে সে নিজেই লজ্জা পেল।

তাড়াতাড়িই তারা দীর্ঘ ওয়াদির কিনারে পৌঁছে গেল যা পর্বতের সাথে দৃঢ় ভাবে এটে আছে। নেফার মাথা ঘুরিয়ে তাকে দেখার জন্য ঘুরল এবং তার দেহ নিরীক্ষণ করতে লাগল। ঠিক একই সময়ে মিনটাকাও তার চোখের দিকে তার দৃষ্টি তুলল।

পর্বতের নিচে শত শত কবর আছে। আমি এগুলো প্রথম দেখেছিলাম যখন আমার পিতা আমাকে এই পথে নিয়ে এসেছিল, ঠিক তার… সে থেমে গেল। শেষ দিনটা যখন সে ট্যামোস-এর সাথে ব্যয় করেছিল সেই দিনের স্মৃতিতে দুঃখী হয়ে গেল।

কাদের কবর? মিনটাকা জিজ্ঞেস করল যন্ত্রণায় কিছু থেকে তার মনযোগ সরানোর জন্য।

টাইটা বলে তারা হাজার বছরের পুরানো, চিওফস ও চেফ্রেন-এর সময় থেকে যারা গিজার বিশাল পিরামিড তৈরি করেছিল।

তাহলে তারা প্রায় ম্যাগোসের মতোই বৃদ্ধ। মিনটাকা মুচকি হেসে বলল।

তুমি কি কখনো ওগুলো খুঁড়েছো? সে তাকে প্রশ্ন করল।

নেফার তার মাথা নাড়ল, যখন আমি এখানে প্রথম আসি, আমি প্রায়ই তা করার কথা ভাবতাম, কিন্তু কখনো কোন সুযোগ ছিল না।

তাহলে চল এখন আমরা তা করি, মিনটাকা বলল।

নেফার দ্বিধান্বিত। আমাদের দড়ি ও প্রদীপ থাকতে হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে মিনটাকা চূড়া থেকে নামতে শুরু করে দিয়েছে এবং সেও বাধ্য হল তাকে অনুসরণ করতে।

ভিত্তি মূলে পৌঁছে তারা শীঘ্রই দেখতে পেল যে বেশির ভাগ কবর তাদের আয়ত্তের বাইরে, খাড়া পর্বত মুখের অনেক উপরে যাদের নিচে ভয়ংকর খাদ।

কিছুক্ষণ পর নেফার একটা প্রবেশ পথ খুঁজে পেল এবং ভাবল তারা হয়তো পৌঁছতে সক্ষম হবে। তারা একটা অংশে উঠল যেখানে চূড়ার মুখ ভেঙে পড়েছে এবং একটা সরু তাকেতা পৌঁছেছে। ওটা দিয়ে তারা সতর্ক ভাবে এগিয়ে চলল, নেফার সামনে। অবশেষে সে অন্ধকার প্রবেশ দ্বারে পৌঁছতে পারল এবং ওটার মধ্য দিকে উঁকি দিতে ঝুকল। অবশ্যই এটা মৃতদের আত্মা দিয়ে প্রহরারত। সে কৌতুকের মতো করে এটা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু মিনটাকা তার আসক্তি বুঝতে পারল এবং সেও এটা দ্বারা আক্রান্ত হল।

অবশ্যই! মিনটাকাও কৌতুক করল, কিন্তু তার পিছনে সে শয়তানের বিরুদ্ধে চিহ্ন আঁকল।

এখানে খুব অন্ধকার; নেফার চিন্তিত ভাবে বলল। আমাদের উচিত হবে কাল একটা তেলের প্রদীপ নিয়ে এখানে আসা।

মিনটাকা তার কাঁধের উপর দিয়ে সামনে তাকাল। একটা ছোট পথ একটু উপরে বাঁকানো শক্ত পাথরের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। এমনকি শতাব্দী পর শতাব্দী অতিক্রান্ত হবার পরও দেয়ালের চিত্র কর্মগুলো এখনো স্পষ্ট দৃশ্যত।

দেখ। মিনটাকা একটা স্পর্শ করল। এটা একটা জিরাফের ছবি এবং এটা একজন মানুষের।

হ্যাঁ। নেফার দাঁত বের করে হাসল, এবং একজন খুব বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষ। এতে কোন ভুল নেই।

মিনটাকা সংযত হওয়ার ভান করল কিন্তু তার হাসি লুকাতে পারল না। প্রাচীন শিল্পী অবয়বটাকে একজন বিশাল খোঁজা সদস্যের চরিত্র দান করেছেন।

এখানে। সে স্থানটার আরো গভীরে প্রবেশ করল। এই যে লেখা। এইগুলোর অর্থ কি হবে তা নিয়ে আমি বিস্মিত।

কেউ কখনো জানবে না; নেফার বলল এবং হেঁটে তাকে অতিক্রম করে গেল, প্রাচীন এ লিপির সূত্র অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। আমাদের ফিরে যাওয়া

উচিত।

মেঝেটা বাতাস বাহিত বালির একটি স্তরীভূত অংশে অশুভ অন্ধকারে অস্পষ্ট।

আমরা আরও একটু নিরীক্ষণ করতে পারি; মিনিটাকা একঘেয়ে ভাবে বলল।

আমার মনে হয় না এটা একটা ভালো ধারণা।

এখানে। মিনটাকা তাকে ধাক্কা দিয়ে অতিক্রম করল, আমাকে আগে যেতে দাও।

দাঁড়াও; সে তাকে থামাতে গেল, কিন্তু সে হেসে এগিয়ে গেল। নেফার তার চাকুর বাটে একটা হাত রাখল এবং তাকে অনুসরণ করল। তার উদাহরণ ও জিদের কাছে সে লজ্জিত ও পরাজিত।

প্রতি পদক্ষেপে সামনের অন্ধকার ভারি হল। এমনকি মিনটাকাকেও থামতে হল এবং অস্বাভাবিকভাবে সামনে উঁকি দিল সে। বালির মেঝে থেকে একটা ক্ষুদ্র পাথরের পাতলা টুকরো তুলে নেয়ার জন্য সে ঝুকল এবং কাঁধের উপর দিয়ে তা সামনে মধ্যবর্তী গোপন স্থানের অন্ধকারে নিক্ষেপ করল, একটা পাথুরে দেয়ালে লেগে তা ঝনঝন করে উঠল। কিছুই না; নেমে আসা নীরবতায় সে বলল, কিন্তু সম্মুখে আরেক পদক্ষেপ সে নেয়ার আগেই কিছু একটা সামনের অন্ধকারে নড়ল যেন। তারা একটা খসখস আওয়াজ শুনল যা আরো বেশি জোরে শোনাল এ সরু স্থানে। দুজনে নিজেদের স্থানে জমে গেল, এবং অন্ধকারে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনা গেল সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রতিধ্বনি তুলল দলবদ্ধ ভাবে। খসখসানি হয়ে গেল তীব্র গর্জন এবং অন্ধকার থেকে বেরিয়ে সরাসরি একটা চি চি শব্দ তীব্র বেগে ছুটন্ত অবয়বের উড়ন্ত মেঘ হয়ে সজোরে তাদের চেহারা বরাবর নিক্ষিপ্ত হল, যাদের পাখাগুলো তাদের বিস্মিত চেহারায় চাবুক মারল যেন।

মিনিটাকা চিৎকার দিয়ে ঘুরে নেফারের দিকে দৌড় দিল এবং দুই হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরল। সেও তাকে আঁকড়ে ধরল এবং শক্ত করে ধরে রাখল। বালির মেঝেতে তাকে টেনে নামাল।

বাদুর; সে তাকে বলল। ওগুলো বাদুর।

আমি জানি! মিনটাকা শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল,

তারা তোমাকে আঘাত করবে না।

আমি জানি। তার কণ্ঠ আরো বেশি শান্ত কিন্তু সে তার গলা থেকে তার হাত সরানোর কোন প্রয়াস দেখালো না। নেফার তার চেহারা তার ঘন কোঁকড়ানো চুলের মধ্যে ডুবালো। সুবাসটা সুন্দর, নতুন কাটা ঘাসের সুবাসের মতো যা।

মিনটাকা সুখানন্দে নরম, বিড়বিড় আওয়াজ করল, তাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরল এবং মৃদু ছন্দে তার আরো নিকটে এল।

মিনিটাকা, সে তাকে আলতো করে সরাতে চাইল। আমি তোমাকে কথা দিয়েছি যে এটা আর কখনো হবে না।

আমি তোমাকে ঐ ওয়াদা থেকে মুক্ত করলাম। তার কণ্ঠ এতো নরম যে তা শোনাই গেল না। সে তার মুখ তার আরো কাছে উঠাল, তার নিঃশ্বাস উষ্ণ, মিষ্টি ও সুঘ্রাণ যুক্ত। তার ঠোঁট কোমল ও পূর্ণ এবং কাঁপছিল যে সে প্রায় কেঁদেই ফেলবে।

আমি জীবনে যতো কিছু চেয়েছি তার চেয়ে বেশি চাই আমি তোমার স্ত্রী হতে। বলেই সে তাকে চুমু খেল। তার ওষ্ঠ নিজের দখলে নিল। যা ছিল আর্দ্র ও এতো উষ্ণ যে মনে হল যেন তাতে তার ঠোঁট পুড়ে যাবে। সে নিজেকে তার মাঝে হারিয়ে ফেলল। তৃষ্ণার্ত ভাবে সে তাকে চুমু খেয়েই চলল। কামাতুর আওয়াজ তার কণ্ঠে ছন্দ তুলল, মিনটাকা তাকে আরো কাছে টেনে নিল। বুঝাতে চাইল যে আসলেই সে তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে এবং পেতে চায়। টর্কের সাথে তার তিক্ত স্মৃতিটা সর্বদাই তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। হঠাৎ করেই যেন তার সব মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল।

নেফারও তার আবেগে সাড়া দিল। মিনটাকা অনুভব করল তার হাতটা ক্রমশ নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে এবং নিতম্বের কাছে এসে থেমে গেছে। মিনটাকা আরো সজোরে তার স্তন নেফারের বুকে চেপে ধরল।

আমাকে স্পর্শ করো; সে তার মুখে বলল। হ্যাঁ, আমাকে স্পর্শ কর। আমাকে ধরো।

আদর করো, আরো বেশি আমাকে ভালোবাসো।

কামাবেগটা এতো দ্রুত উভয়ের দেহে ও মনে ছড়িয়ে পড়ল যে তাদের প্রতিটি কোষে তা স্পন্দন তুলল। নেফার অবশেষে দীর্ঘ চুম্বনের ইতি টানল। মিনটাকা অনুভব করল তার ঠোঁট ঝিনঝিন করছে। সহজাত প্রবৃত্তিতে মিনটাকা বুঝতে পারল এখন নেফার কি চায়। সে তার জামা খুলে নিজেকে উন্মোচিত করল। নেফারের মাথা তার বুকে টেনে নিল। নেফারও তৃষ্ণার্ত শিশুর ন্যায় তার স্তন চোষে গেল। মিনটাকার দেহে একটা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল, সে উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল। অবচেতন ভাবে সে তার জামা খুলতে লাগল একে একে তারপর নেফারের সব কিছু। তার সমস্ত শরীরে হাত বুলাতে লাগল। হঠাৎ তার হাতে দন্ডের ন্যায় কিছু ঠেকল, এতো জীবন্ত যে তা তাকে আরো উত্তেজিত করে তুলল। নেফারকে এক ধাক্কায় একটু সরিয়ে দিল তা ভালো করে দেখতে।

তুমি খুব সুন্দর। সে দম নিল; খুব মসৃণ, শক্তিশালী। সে তাকে আবার চুমু খেল ও কাছে টেনে নিল। নিচে টেনে নিয়ে তাকে সে তার পেট উঁচু করে ধরে রাখল। তারপর দুপা ছড়িয়ে তাকে আমন্ত্রণ জানালো, তার অনভিজ্ঞতায় সে তা করতে বাধ্য হল।

নেফার ঘোড়ায় চড়ার মতো তার উপর চড়ে বসল। মিনটাকা অনুভব করল একটা শক্ত কিছু তার নিমাঙ্গে প্রবেশ করছে সজোরে। ভালোলাগা ব্যথার এক মিশ্র অনুভূতিতে সে ঝাঁকিয়ে উঠল।

নেফারও তার সাথে অনেক উঁচুতে ও খুব দ্রুত উঠতে লাগল যততক্ষণ না সে জানল যে সে তার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। তারপর অবিশ্বাস্যভাবে তারা ঐ সীমা ও তার বাধার আরো অনেক দূরে গেল। তারপর অবশেষে অনুভব করল এটা তাকে পৃথিবীর সব বন্ধন থেকে মুক্ত করল এবং তাকে স্বর্গের সুখে ভাসাল। তাদের কণ্ঠে এক বিজেতার চিৎকার শুনা গেল। অনেকক্ষণ পরে যখন তারা এক সাথে এই দূরের উচ্চতা থেকে বাস্তবে ফিরল, তারা এক জন অন্যজনের বাহুতে শুয়ে রইল। তাদের ঘাম ও তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস মিশে একাকার তখন।

আমি চাই নি এটা কখনো শেষ হোক, মিনটাকা অবশেষে ফিসফিস করে বলল। আমি তোমার সাথে এই ভাবে সারাজীবন থাকতে চাই।

আরো কিছুক্ষণ পর সে ধীর গতিতে উঠে বসল এবং গুপ্ত জায়গাটার খোলা মুখের দিকে তাকাল। ইতোমধ্যে অন্ধকার হতে শুরু করেছে, নেফার বলল অবাক কণ্ঠে। দিনটা খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেল।

মিনটাকা হাঁটুর উপর ভর দিয়ে দাঁড়াল, তারপর স্কার্টটা ঠিকঠাক করে নিল। নেফার তার আঁচলের উপর তাজা দাগটা স্পর্শ করল। তোমার কুমারীত্বের রক্ত, সে ভয়ে ফিসফিস করে বলল।

তোমাকে দেওয়া আমার উপহার। সে উত্তর দিল। একমাত্র তোমারই জন্যেই আমার ভালোবাসার প্রমাণ এটি।

সে হাত বাড়িয়ে তাকে ধরল এবং তার স্কার্টের আঁচল থেকে তার কনিষ্ঠ আঙুলের নখের সমান-রক্তমাখা একটু কাপড় ছিঁড়ে নিল।

কি করছ? জিজ্ঞেস করল মিনটাকা।

আমি এটা চিরদিন রেখে দেব এই চমৎকার দিনের স্মরণে। সে তার গলায় পরা লকেটি খুলে কাপড়ের টুকরাটা তার কালো চুলের গোছর সাথে রেখে দিল।

তুমি কি সত্যি আমাকে ভালোবাস, নেফার? সে জিজ্ঞেস করল যখন সে তাকে লকেটটা বন্ধ করতে দেখল।

আমার ধমনীতে যতো রক্ত বইছে তার প্রতিটি ফোঁটা শুনলে যা হবে তার চেয়েও বেশি। অনন্ত জীবনের চেয়েও।

*

যখন তারা প্রাচীন ভবনের কক্ষটায় এল যা তারা ঠিক-ঠাক করে বসবাসের উপযোগী বানিয়েছে, দেখল টাইটা আগুনের কুন্ডলীর কাছে বসে কয়লার উপর রাখা একটি হাঁড়ি নাড়ছে। সে মিনটাকার দিকে তাকাল, সে খোলা দরজায় তার পিছনে দিনের শেষ আলোয় এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র। তার স্কার্ট এখনো ভেজা যা সে কুয়ার অপ্রতুল পানি দিয়ে ধুয়েছে এবং তা তার উরু পর্যন্ত ঝুলে আছে। আমি দুঃখিত আমাদের ফিরতে দেরি হয়ে গেল, টাইটা! সে লাজুকভাবে বলল। আমরা মরুতে গজলা হরিণ অনুসরণ করছিলাম।

মিনটাকা আগে কখনো তাদের ফিরতে দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমা চায় নি এবং টাইটা তাদের দুজনের দিকে ভালোভাবে তাকাল। নেফার তার উপর দিয়ে বিমূঢ় অভিব্যক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। তাদের ভালোবাসার প্রবাহটা এতো শক্তিশালী যে তা তাদের চতুর্দিকে ঝিকমিক করা প্রভার মতো আলো বিস্তার করতে লাগল এবং টাইটা বাতাসে তার গন্ধ পেল একটা বন্য ফুলের গন্ধের ন্যায়।

তাহলে যা অবশ্যম্ভাবী ছিল অবশেষে তা ঘটল; সে গম্ভীরভাবে ভাবল। একমাত্র বিস্ময় যে তা এতো দেরিতে হল। সে বিরক্তি প্রকাশ করল, কোন মন্তব্য করল না। এটা নিশ্চিত যে তোমরা তাদের ধরতে পার নি। তারা কি খুব জোরে দৌড়ে পালিয়েছে না তোমরা অমনোযোগী ছিলে? তারা অস্বস্তিকরভাবে দাঁড়িয়ে রইল, দ্বিধা ও অপরাধে ঢাকা যা। তারা জানে কারণটা তার কাছে স্পষ্ট।

টাইটা রান্নার হাঁড়ির দিকে ঘুরল। তথাপি কমপক্ষে আমাদের মধ্যে একজন সরবরাহকারী রয়েছে। আমি একজোড়া বন্য পায়রাকে ফাঁদে ফেলতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের অন্তত না খেয়ে ঘুমোতে যেতে হবে না।

.

সামনের দিনগুলো আনন্দের এক সোনালি আভায় কেটে গেল তাদের। তারা ভাবল তারা চতুর হচ্ছে, এবং টাইটার উপস্থিতিতে আলাদা থাকছে। একজন অন্যজনের থেকে চোখ সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে গেল এবং স্পর্শ করত যখন তারা ভাবত সে দেখছে না।

মিনিটাকা তার নিজের জন্য একটা খালি কক্ষে একটা সাজ-ঘর তৈরি করেছে যা তাদের প্রধান কক্ষ থেকে দূরে। প্রতিরাতে নেফার অপেক্ষা করত যততক্ষণ না টাইটা নরম সুরে নাক ডাকা শুরু করত। তখন নেফার চুপিচুপি উঠে হামাগুড়ি দিয়ে এই ছোট কক্ষে আসতো। প্রতিদিন সকালে মিনটাকা তাকে সকালের অনেক আগেই উঠিয়ে দিত এবং তাকে তার নিজের বিছানায় প্রধান কক্ষে পাঠিয়ে দিত; তারা ভাবত টাইটা তখনো ঘুমাচ্ছে।

তৃতীয় সকালে টাইটা দুর্বোধ্য ভাবে ঘোষণা করল, মনে হচ্ছে এই কক্ষে ইঁদুর অথবা অন্যান্য অদ্ভুত প্রাণী বসবাস করছে। কারণ আমি তাদের চুপচাপ ও ফিসফিসানিতে ঘুমাতে পারছি না। তাদের দুজনকে তখন হচকিত দেখাল এবং সে বলে চলল, থাকার জন্যে আমি আরো অধিক শান্তিময় স্থান পেয়েছি।

সে নিজের বিছানা এবং মালপত্র একটা ছোট ভগ্নাংশে নিয়ে গেল। প্রতি সন্ধ্যায় তারা এক সাথে খাবার খাওয়ার পর সে সেখানে বিশ্রাম করতে চলে যেতে।

এদিন গুলিতে প্রেমিক যুগল মরুতে ঘুরে বেড়াল, কথা বলে সময় কাটাল। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হাজার পরিকল্পনা করল, সিদ্ধান্ত নিল কখন ও কিভাবে তারা বিয়ে করবে, কয়জন ছেলে ও কয়জন মেয়ে সে তাকে দিবে এবং প্রতি জনের জন্যে নাম খুঁজে এক স্বপ্নীল সময় অতিবাহিত করতে লাগল দুজনে।

তারা একে অন্যের মধ্যে এতোটাই হারিয়ে গেল যে তারা ভুল গেল এই নির্জন মরুর বাইরের দুনিয়ার কথাটা। এক সকালে তারা ভগ্ন শহরটা ছেড়ে এক কুন্ডলী রশি ও দুটা তেলের প্রদীপ নিয়ে পাহাড়ে এল। এবার তারা দৃঢ় সংকল্প আরো গভীরে পুরানো কবরগুলো আবিষ্কার করতে। একটা ঘুরো পথে তারা পর্বতের চূড়ায় পৌঁছে যায়, সেখানে তারা দম নেওয়ার জন্য থামল এবং নীল, গোপন পাহাড়ে ভোরের আগমনের চমৎকার দৃশ্য দেখার জন্য বসল।

দেখ! মিনটাকা হঠাৎ চিৎকার দিল, তার বান্ধন থেকে বেড়িয়ে যেতে শুরু করল এবং পশ্চিম দিকে পুরানো জনপদ বরাবর নির্দেশ করল যা মিশরের দিকে চলে গেছে। নেফার লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং তাদের নিচে উপত্যকার অদ্ভুত ক্যারাভানের দিকে যানগুলোর আগমনের দিকে চেয়ে রইল। পাঁচটা ভগ্নপ্রায় যান। আগে চলছে, পিছিয়ে পড়া এক সারি মানুষ তা অনুসরণ করছে।

ওখানে অবশ্যই একশত লোক হবে, কমপক্ষে, মিনিটাকা বিস্মিতভাবে বলল। তারা কারা হতে পারে?

আমি জানি না। নেফার গম্ভীরভাবে স্বীকার করল। কিন্তু আমি চাই তুমি দৌড়ে টাইটার কাছে যাও এবং তাদের আগমনের কথা টাইটাকে সতর্ক কর। এদিকে আমি লুকিয়ে তাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছি।

মিনটাকা তর্ক করল না, বরং গালালার উদ্দেশ্যে সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিল। সে দৌড়ে পাহাড়ের কালো খাজ দিয়ে নামল, একটা বন্য আইবেক্সের ন্যায় ক্ষিপ্রগতিতে পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে এগিয়ে চলল। নেফার রাশি ও প্রদীপ লুকিয়ে রাখল তারপর তার ধনুকে গুণ লাগিয়ে খাপের তীরটা পরীক্ষা করল। পাহাড়ের চূড়ার দিক থেকে হামাগুড়ি দিয়ে দৃষ্টির আড়ালে গেল। সে একটা উপযুক্ত জায়গায় পৌঁছে সেখান থেকে নজর রাখতে লাগল নিচে ধীরে আসা ক্যারাভানের দিকে।

এ ছিল এক করুণ দৃশ্য। বহরটা কাছাকাছি আসতেই নেফার দেখল প্রথম দুটো যান যুদ্ধ রথের মতো স্কুল ও হৈ-চৈ ভরা। ওগুলো টানা হচ্ছে শুকনো পরিশ্রান্ত ঘোড়া দিয়ে। যানগুলো দুজন লোক বহন করার মত নকশা করা কিন্তু প্রতিটায় চার থেকে পাঁচজন করে অবস্থান নিয়েছে। তাদের পিছনে আসছে নানা রকমের ওয়াগন ও এক্কা গাড়ি, প্রথম রথগুলো থেকে তাদের অবস্থা মোটেও ভালো নয়। নেফার দেখল যে ওগুলো অসুস্থ অথবা আঘাতপ্রাপ্ত লোকে ভরা, করুণভাবে গাদাগাদি করে আছে সবাই অথবা অন্য কিছু না পেয়ে খড়ের গাদায় শুয়ে আছে কেউ কেউ। ওয়াগনের পিছনে লম্বা এক সারি হন্টনরত মানুষ পিছিয়ে পড়েছে, কয়েকজন লাঠিতে ভর দিয়ে খোঁড়াচ্ছে অথবা লাঠির উপর ঝুঁকে আছে। অন্যরা স্ট্রেচার বহন করছে যার উপর অন্য অসুস্থ বা আঘাতপ্রাপ্ত লোক শুয়ে রয়েছে।

হুরাসের নামে, তাদের যুদ্ধের ময়দান থেকে ফেরারি লোকেরা মতই দেখাচ্ছে। নেফার বিড়বিড় করল, সে তার চোখ টান করল সামনে রথের লোকদের ঠিকভাবে দেখার জন্য।

হঠাৎ সে পাথরের পিছন থেকে উঠে দাঁড়াল যা তাকে লুকিয়ে রেখেছিল এবং উত্তেজনায় চিৎকার দিয়ে উঠল, ম্যারন! সে অবশেষে লম্বা অবয়বটা চিনতে পেরেছে যে প্রথম রথের লাগাম ধরে আছে। ম্যারন লাগাম টেনে ঘোড়াগুলোকে থামাল এবং চোখে ছায়া দিয়ে উদিয়মান সূর্যের চোখের ভেতর দিয়ে তাকাল। তখন সেও চিৎকার দিল এবং হাত নাড়াল যখন সে আকাশের সীমায় উঁচুতে নেফারকে দেখতে পেল। নেফার দৌড়ে খাঁজ বেয়ে নামল এবং পিছলে গেল খোলা নুড়ি পাথরে। অবশেষে ম্যারনের নিকট পৌঁছে তাতে সজোরে আলিঙ্গন করল, হাসল এবং একই সাথে দুজনে কথা বলল।

তুমি কোথায় ছিলে?

মিনটাকা ও টাইটা কোথায়?

তারপর হিল্টো দ্রুত নেফারের কাছে এল এবং রাজকীয় সম্বোধন করল। তার পিছনে পরিশ্রান্ত ও আঘাতপ্রাপ্ত লোকেরা জড়ো হল। তাদের মুখগুলো পরিশ্রান্ত ও রোগা এবং রক্ত ও পুঁজ তাদের নোংরা ব্যান্ডেজ ভেদ করে বের হয়ে আছে এবং শুকিয়ে তা মচমচে হয়ে গেছে। এমনকি ওয়াগন ও স্ট্রেচারের লোকেরা যারা দাঁড়াতেও অক্ষম নিজেদের ভুল দেখছে ভেবে নেফারের দিকে ভয়ে তাকাল।

দ্রুত পর্যবেক্ষণে নেফার দেখতে পেল এই লোকগুলো যোদ্ধা, কিন্তু যুদ্ধে আহত, তাদের দেহ ও স্পৃহা ভাঙ্গা।

হিল্টো নেফারকে অভিবাদন জানিয়ে তাদের দিকে ঘুরে চিৎকার করে বলল, এই যা আমি তোমাদের কাছে ওয়াদা করেছিলাম। এখানে তোমাদের সম্মুখে তোমাদের প্রকৃত ফারাও নেফার সেটি দাঁড়ানো। ফারাও মৃত নন! ফারাও জীবিত!

নিশ্চুপ ও উদাসীন, অসুস্থ ও মনোবলহীন লোকগুলো অনিশ্চিতভাবে নেফারের দিকে চেয়ে রইল।

মহামান্য, হিল্টো তাকে ফিসফিস করে বলল, দয়া করে এই পাথরের উপর দাঁড়ান যাতে তারা আপনাকে পরিষ্কারভাবে দেখতে পায়। নেফার লাফ দিয়ে পাথটার উপর উঠল এবং মনোযোগ দিয়ে সামগ্রিকভাবে তাদের অবলোকন করল। তারাও চুপ করে তার দিকে চেয়ে রইল, অধিকাংশই পূর্বে কখনো তাদের রাজাকে চোখে দেখেনি। এমনকি অল্প কয়েক জন যারা তাকে রাজপ্রাসাদের অনুষ্ঠানে দেখেছে তারাও অনেক দূর থেকে দেখেছে। তখন সে দেখতে একটা পুতুলের মতো ছিল, গলা থেকে পা পর্যন্ত দামী কাপড় ও গহনায় ঢাকা, তার মুখে প্রসাধনের সাদা মুখোশ শক্ত হয়ে বসত, রাজকীয় গতিতে যা সাদা মহিষ টানত। তারা সেই দূরবর্তী অস্বাভাবিক অবয়বের সাথে এই লম্বা সুন্দর তরুণ মানুষটিকে মিলাতে পারল না। পৌরুষদীপ্ত ও শক্ত সামর্থ তার চেহারা সূর্যে পোড়া এবং তার অভিব্যক্তি জীবন্ত ও সচকিত। সে এখন বাচ্চা ফারাও নয় যাকে তারা শুধু নামে সম্মান করতো।

তারা তখনো অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়েছিল ও সন্দেহের দৃষ্টি বিনিময় করল, তখন অন্য একটা অবয়ব মনে হলো বাতাস থেকে সৃষ্টি হল। একটা জ্বীনের মতো সে পাথরের উপর নেফারের পাশে উদয় হয়েছে। এ লোকটিতে তারা ভালোভাবেই জানে, সম্মানে ও চেহারায় দুভাবেই।

ও টাইটা, ওয়ারলক, সবাই ভয়ে জোরে শ্বাস নিল।

আমি জানি তোমরা কি দুর্দশা সহ্য করেছে, টাইটা তাদের এমন কণ্ঠে বলল যা সবার কান পর্যন্ত পৌঁছল, এমনকি ওয়াগনের অসুস্থ ও আঘাতপ্রাপ্তদের কাছেও।

আমি জানি তোমরা আততায়ী ও দখলদার স্বৈরচার রুখতে কি মূল্য দিয়েছে। আমি জানি তোমারা এখানে এসেছে তোমাদের প্রকৃত রাজা এখনো জীবিত কিনা তা খুঁজতে।

তারা সম্মতিতে গুঞ্জন তুলল এবং হঠাৎ নেফার বুঝল তারা কারা। এরা হচ্ছে নাজা ও টর্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীকারীদের মধ্যে বেঁচে যাওয়া কয়েকজন। হিল্টো তাদের কোথায় পেয়েছে এ রহস্যজনক, কিন্তু এসব ভগ্ন অবশিষ্টাংশ লোকগুলো এক সময় ছিল যুদ্ধের সৈন্য, সম্মানী রথী ও যোদ্ধা।

এ হচ্ছে যেখান থেকে আবার শুরু হবে, টাইটা তার পাশে থেকে নরম সুরে তাকে বলল, হিল্টো তোমার ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনীর বীজ নিয়ে এসেছে। তাদের উদ্দেশ্যে কথা বল।

নেফার তাদের আরো কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল, তাদের সামনে দাম্ভিক ও লম্বা হয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। সে সেনাদল থেকে একজনকে বেছে নিল, যে অন্যদের থেকে বয়স্ক, চুলে মাত্র পাক ধরেছে তার। লোকটির চোখ তীক্ষ্ম ও অভিব্যক্তি বুদ্ধি দীপ্ত। ছেঁড়া কাপড় ও অর্ধাহার দেহ সত্ত্বেও তার মাঝে কর্তৃত্ব ও আদেশের একটা ভাব বিদ্যমান। আপনি কে, সৈন্য? আপনার পদবি ও আপনার রেজিমেন্ট কি?

লোকটি তার মাথা তুলে তার রোগা কাঁধটা প্রসারিত করল, আমি শাবাকো, দশ হাজার বাহিনীর সর্বোত্তম। রেড রোড পাড়ি দিয়েছি। যুদ্ধের ময়দানে দক্ষ স্মাট রেজিমেন্টের কমান্ডার।

একজন সিংহ পুরুষ! নেফার ভাবল, কিন্তু বলল, আমি আপনাকে অভিবাদন জানাই, শাবাকো। তারপর নেফার তার স্কার্ট উপরে তুলে তার উরুর উপরের চিহ্নটা প্রকাশ করল, আমি নেফার সেটি, উচ্চ ও নিম্নরাজ্যের প্রকৃত ফারাও।

কাকতাড়ুয়া বাহিনীর মধ্য দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ও গুঞ্জন বয়ে গেল যখন তারা রাজকীয় চিহ্নটা চিনতে পারল। প্রকৃত প্রজার ন্যায় তারা আনুগত্যে নিজেদের মাটিতে নিক্ষেপ করল।

বাক হার! পবিত্র একজন, প্রভুদের প্রিয়।

আমরা আপনার আনুগত প্রজা, ফারাও। আমাদের জন্য প্রভুদের কাছে অনুনয় করবেন।

মিনটাকা টাইটার সাথে এসেছে এবং নিচে দাঁড়িয়ে। নেফার নিচে নামল এবং তার হাতটা নিল। সে তাকে তার পাশে পাথরের উপর তুলে আনল। আমি আপনাদের রাজকন্যা মিনটাকে দিলাম, যে অ্যাপেপির বংশধর। মিনটাকা, যে হবে আমার রাণী এবং আপনাদের সর্বোচ্চ সম্মানী মহিলা।

হিল্টো ও শাবাকো আপনাদের নির্দেশ দিবে, নেফার ঘোষণা করল। বর্তমান সময়ের জন্য গালালা হবে আমাদের ঘাটি যতক্ষণ না আমরা থেবস ও অ্যাভারিসে বিজয়ীর ন্যায় ফিরছি।

সবাই উঠে দাঁড়াল, এমনকি মারাত্মক আহতরাও তাদের স্ট্রেচার থেকে উঠার চেষ্টা করল, এবং তারা তাদের সম্বোধন করল। তাদের কণ্ঠ পাতলা এবং মরুর বিশালতায় প্রায় হারিয়ে গেল, কিন্তু শব্দটা নেফারকে গর্বিত করল ও তার সংকল্প ও সিদ্ধান্তকে নতুন শক্তি দিল। সে প্রথম রথে উঠল। ম্যারেনের কাছ থেকে লাগাম নিয়ে তার ছোট্ট ছিন্ন ভিন্ন সেনাবাহিনীকে তার ভাঙ্গা রাজধানীতে পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলল ধীর লয়ে।

*

ভগ্ন শহরে তাদের ব্যারাক স্থাপন করা শেষ হলে নেফার শাবাকো, হিল্টোকে এবং অন্য অফিসারদের ডেকে পাঠাল। প্রথম রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত এবং পরের অনেক রাতের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সে তাদের সাথে বসত। তাদের বিদ্রোহের কারণ, যুদ্ধ ও দুই ফারাও এর যুদ্ধ শক্তি এবং তাদের পরাজয়ের কথা বিস্তারিত শুনে গেল। তারা তাকে ভয়ংকর শাস্তির কথা বলল যা টর্ক ও নাজা বিদ্রোহীদের উপর চালিয়েছে যারা তাদের হাতের মুঠিতে পড়েছিল।

নেফারের আদেশে তারা নতুন মিশরীয় আর্মির যুদ্ধ কৌশল বর্ণনা করল; কমান্ডারদের নাম, সদস্য এবং তাদের রেজিমেন্টের নাম ও মোট লোক সংখ্যা, রথের ও ঘোড্রার সংখ্যা যা নাজা ও টর্কের দখলে আছে সবকিছুর পরিসংখ্যান সে নিল। পলাতকদের মধ্যে তিনজন সেনা অনুলেখক ছিল এবং নেফার তাদের কাজে লাগিয়ে দিল সাথে সাথে। তারা এসব বিষয় লিখে রাখল ও শত্রুদের রক্ষী, সেনাদের ও দুর্গের তালিকা লিখে রাখল মাটির ফলকের উপরে।

এ সময় মিনিটাকার সাহায্যে টাইটা একটি আরোগ্যশালা স্থাপন করল, যেখানে সকল আহত ও অসুস্থ লোকদের রাখা হল। হিল্টো তার সাথে ১২ জন বা ওরকম সংখ্যক মহিলা এনেছিল। পলাতকদের কয়েকজনের স্ত্রী ছিল তারা। শুধুমাত্র ক্যাম্প অনুযায়ী টাইটা তাদের সেবিকা ও বাবুর্চি হিসেবে নিল। টাইটা সারাদিন ভাঙ্গা হাড়

ঠিক করা, ভাঙ্গা তীরের মাথা মাংস থেকে বের করা, তার স্বর্ণের ছুরি দিয়ে তলোয়ারে কাটা সেলাই করার কাজ করে গল এবং কোন ক্ষেত্রে এমনকি ফাটা, চাপা খুলিতে অস্ত্রোপাচার করল যা যুদ্ধকালীন সময় শক্ত কাঠের গদার সজোর আঘাত পেয়ে হয়েছে।

যখন আলো ক্ষীণ হতো এবং আর অসুস্থদের সাথে কাজ করতে পারতো না তখন সে নেফার ও তার কমান্ডারদের সাথে যোগ দিতো। তারা শক্ত ভেড়ার চামড়ার ওপর আঁকা মানচিত্রে ঝুঁকে পরিকল্পনা করে ও বিন্যাস করে রাত অতিবাহিত করতে তেলের প্রদীপের আলোতে। যদিও নেফার তাদের মনোনীত সর্বোচ্চ কমান্ডার, বাস্তবিকভাবে সে ছিল যুদ্ধ কৌশলের একজন ছাত্র এবং ঐসব বৃদ্ধ সৈন্যরা ছিল তার নির্দেশক, তাদের কাছ থেকে সে যা শিখল তা অমূল্য।

স্বাভাবিকভাবে মধ্যরাত হয়ে গেলে নেফার এই সকল গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শেষ করতো এবং চুপি চুপি মিনিটাকার কাছে বিছানায় যেতো যেখানে সে তার জন্যে ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করে থাকতো। তারা তখন ভালোবাসা ও এক সাথে ফিসফিস করে কথায় মত্ত হয়ে যেতো। যদিও উভয়েই তাদের পরিশ্রমে ক্লান্ত থাকতো তবুও তারা একজন অন্যজনের বাহুতে ঘুমানোর আগেই প্রায়ই ঊষা নিরব মরুভূমিতে উঁকি মারতো।

সব মিলিয়ে মোট দেড়শ থেকে কম মানুষ ও পঞ্চাশ থেকে কম সংখ্যক ঘোড়া ছিল তাদের। কিন্তু প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে শহরের তিক্ত কুয়াগুলো এ সংখ্যক লোককে সমর্থন করতে পারবে না। প্রতিদিন তারা তা শূন্য করল এবং প্রতিরাতে ওগুলো পূর্ণ হতে বেশি সময় লাগত। এমনকি পানির মানও কমতে লাগল, এটা প্রতিদিন আরো তিতা ও লোনা হয়ে গেল। এমনকি ঘোটকীর দুধ না মিশিয়ে অল্পই তা পানের যোগ্য রইল।

তারা বাধ্য হল পানির ব্যবহার কমাতে। ঘোড়াগুলোর সমস্যা হল বেশি, ঘোটকীগুলো তাদের দুধ হারাল। এখনো মাটির নিচে পানির ক্ষরণ কম।

শেষ পর্যন্ত নেফার তার কমান্ডারদের নিয়ে একটা জরুরি সভা ডাকল। এক ঘন্টার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষে হিল্টো গম্ভীরভাবে তার সার-সংক্ষেপ করল, যদি না হুরাস আমাদের জন্যে একটা অলৌকিক ঘটনা না ঘটান তাহলে কূপগুলো পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে এবং আমরা বাধ্য হবো শহরটা ত্যাগ করতে। তখন আমরা কোথায় পালাবো?

তারা নেফারের দিকে তাকাল, যে আশা নিয়ে টাইটার দিকে তখন ঘুরল। যখন পানি শুকিয়ে যাবে, আমরা কোথায় যাবো, ম্যাগোস? সে প্রশ্ন করল।

টাইটা তার চোখ খুলল, এই দীর্ঘ বির্তকের সময় সে নিরবে বসেছিল এবং সবাই ভেবেহেঁসে ঝিমোচ্ছ। আগামীকাল প্রথম আলোতে, আমি প্রতিটি লোককে

চাই যারা হাঁটতে পারে ও কোদাল ব্যবহার করতে পারে। সবাই শহরের ফটকের সামনে জড়ো হবে।

কি উদ্দেশ্যে? নেফার জিজ্ঞেস করল। টাইটা তখন একটি রহস্যজনক হাসি দিল।

ঊষার ঠাণ্ডায় ছাপান্ন জন তোক প্রাচীন ফটকের সামনে অপেক্ষা করছিল যখন টাইটা এগিয়ে এল। সে তার সকল প্রতীক ও চিহ্ন পরিধান করে আছে: মাদুলি, বে এর উপহার এবং তার অন্য সব নেকলেস, ব্রাসলেট ও তাবিজ। সে তার চুল ধুয়েছে যা চমকাচ্ছিল এবং মিনটাকা ওগুলো বেণী করে দিয়েছে। সে তার সাপের মাথার মতো বাঁকানো দন্ডটি হাতে ধরে রয়েছে। নেফার তার পাশে, একটা গম্ভীর ভাব ও বিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে। টাইটা জড়ো হওয়া লোকদের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। যেহেতু সে আদেশ দিয়েছিল তাই তারা সবাই খনন করার যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছে। কাঠের কোদাল ও শাবল, ধাতুর অগ্রভাগ সম্বলিত খনন করার যন্ত্রপতি, কাঠের টুকরো তাদের হাতে শোভা পাচ্ছে। টাইটা সন্তুষ্টিতে মাথা ঝাঁকাল, তারপর পায়ে পায়ে উপত্যকার দিকে রওনা দিল।

নেফারের এক কথায় লোকগুলো তাদের যন্ত্রপাতি কাঁধে নিল ও বৃদ্ধ লোকটিকে অনুসরণ করতে লাগল। স্বভাবিকভাবেই সবাই মিলিটারি গঠনের ন্যায় পদক্ষেপে চলছে। যাই হোক তাদের বেশি দূর যেতে হল না, কারণ টাইটা পাহাড়ের পাদদেশে থামল এবং উচ্চতা দেখল।

নেফারের মনে পড়ল এই সেই জায়গা যেখানে টাইটা গত কয়েক মাসে অনেক সময় ব্যয় করেছে। প্রায়ই সে ও মিনটাকা তাকে এখানে বসে থাকতে দেখেছে, নীল মাথা টিকটিকির ন্যায় চোখ বন্ধ করে সূর্যের মধ্যে সে ঝিমুত, তার লাঠি দিয়ে পাথরের মধ্যে এখানে চাপড়াতে ও খুঁচিয়েছে।

প্রথম বারের মত নেফার এ দিককার পাহাড়ের গঠন লক্ষ্য করল এবং বুঝল এগুলো অন্যদের থেকে আলাদা। পাথরগুলো ভঙ্গুর ও ধূসর। চুনাপাথরের ধারা ভঙ্গুর শিলায় ঢুকে গেছে। একটা গভীর স্তর, ভগ্ন ও তির্যকভাবে খালি। পোড়া পাথরের মুখে দিয়ে বয়ে গেছে এবং কিনারে বিভিন্ন রঙের শিলা স্তর। তখন সে অন্য কিছু খেয়াল করল। সম্প্রতি কেউ একজন কিছু পাথরের উপর দাগ দিয়েছে, দুর্বোধ্য হায়ারোগ্লিফিক চিহ্ন দিয়ে যা সাদা পেস্ট দিয়ে আঁকা, সম্ভবত তা ভাঙ্গা চুনাপাথরের সাথে কুয়ার পানি মিশিয়ে তৈরি করা। সেখানে মাটির উপর পাথরের কিছু স্তূপ জমা করে রাখা।

নেফার, লোকদের অবশ্যই পাঁচটি দলে বিভক্ত হতে হবে। টাইটা তার উদ্দেশ্যে বলল। কথা মতো তারা প্রস্তুত হলে টাইটা প্রথম দলটাকে সামনে এগোনের আদেশ দিল। এখানে পাহাড়ের পাশে একটা কূপ খনন শুরু কর। সে হায়ারোগ্লিফিক চিহ্নের দিকে নির্দেশ করল যেটা উল্লম্ব স্থানের খোলামুখ নির্দেশ করেছে যেখানে সে তাদের খনন শুরু করাতে চায়।

লোকগুলো একে অন্যের দিকে তাকাল, হতভম্ব ও অনিশ্চিত, কিন্তু যখন টাইটা কিছু না বলে তাদের দিকে রাগত দৃষ্টিতে তাকাল, শাবাকো তখন তা সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে সামলে নিল। তোমরা ম্যাগোসের কথা শুনেছ? কথা মতো কাজ করতে যাও, এখনই এবং ভালোভাবে।

কাজটা ছিল যথেষ্ট কষ্টসাধ্য, যদিও নিচের পাথরগুলো যে বরাবর টাইটা পছন্দ করেছে সেই বরাবর ভাঙা ছিল। তাদের প্রতিটি খন্ড চাপ দিয়ে খুলতে হল, তারপর খোলা মাটি খনন করল যা তার নিচে ছিল। চারপাশে ধুলোর মেঘ উঠল এবং শীঘ্রই তা তাদের দেহে মেখে গেল। এমনকি যদিও তাদের হাত গদা ও তলোয়ার ব্যবহারে শক্ত তবুও তাদের হাতের তালুতে ফোস্কা পড়ল, ছিলে গিয়ে রক্ত পর্যন্ত ঝরল। তারা লিনেন কাপড়ে তা বেঁধে অভিযোগ ছাড়াই কাজ করে গেল। সূর্য উঠার সাথে সাথে তাপ দ্রুত বাড়তে লাগল এবং শাবাকো প্রথম দলটাকে খনন থেকে বিরতি দিল ও পরবর্তী দলটাকে পাঠাল।

সূর্য মাথার উপর উঠলে তারা দুপুরে এক ঘণ্টা বিশ্রাম নিল। টাইটা তখন অগভীর গুহায় চলে গেল এবং পাথরের মুখ পরিদর্শন করল মনোযোগ দিয়ে। কোন মন্তব্য ছাড়াই সে সূর্যালোকে বেরিয়ে এল এবং শাবাকোকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আদেশ দিল। এটা চল, যতোক্ষণ না অন্ধকার নামল। শাবাকো তখন তাদের মুক্তি দিল এবং তাদের সামান্য রাতের খাবার খেতে পাঠাল। কুয়ার পানির ন্যায় খাবার ও শস্য দ্রুত শেষ হয়ে আসছিল।

ঠাণ্ডার সুবিধা নিয়ে, তারা ঊষার আগেই কাজ শুরু করল পুনরায়। নামতে নামতে তারা পাহাড়ের পাশে মাত্র বিশ কিউবিট খনন করার পর সেখানে শক্ত নীল, অতি স্বচ্ছ পাথরের শক্ত স্তরে আঘাত করল অবশেষে। ব্রোঞ্জের ডগাওয়ালা কাঠের ফলা ওটার উপর কোন দাগ ফেলতে পারল না এবং লোকগুলো অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করল। আমরা কি যোদ্ধা না খনি খননকারী? একজন বৃদ্ধ প্রবীন যোদ্ধা মিনমিন করল তার ফোস্কা পড়া হাত পরীক্ষা করতে করতে।

আমরা কি জন্যে খনন করছি? আমাদের নিজেদের কবর? অন্য জন প্রশ্ন করল, তার হাতের সম্মুখ ভাগের গভীর কাটা ব্যান্ডেজ করতে করতে, যা অসতর্কভাবে খুড়তে গিয়ে হয়েছে।

আমরা কি ভাবে শক্ত পাথরের মধ্যে দিয়ে খনন করব? অন্য এক জন গড়িয়ে পড়া ঘাম মুছল।

টাইটা তাদের নিচের উপত্যকায় পাঠালো যেখানে মরা অ্যাকাসিয়া গাছের ঘন বন পানির কাছে নিরব নিদর্শনের হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেগুলো অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে। তারা শুকনো ডাল কাটল এবং আঁটিগুলো খননের কাছে বয়ে নিয়ে এল। টাইটার নির্দেশনায় তারা শক্ত পাথরের উপর লাকড়িপ করল এবং তাতে আগুন জ্বালাল। তারা সারারাত আগুন জ্বলতে দিল, কিছুক্ষণ পর পর লাকড়ি দিল এবং পরবর্তী সকালে, যখন তাপে পাথর লাল হয়ে জ্বলছিল, তখন তারা তা মরে যাওয়া কূপের পানি পূর্ণ থলের দ্বারা নেভাল। হঠাৎ পানি ঢালায় হিস্ করে বাষ্পের মেঘে তুলে পাথরটা ফেটে গেল, ভেঙে গেল ও বিস্ফোরিত হল।

একজন লোক একটা উড়ন্ত তীক্ষ্ণ ভগ্নাংশ দিয়ে আঘাত পেল এবং তার ডান চোখ হারাল। টাইটা ওটার বাকি অংশ বের করে সেলাই করে লোকটির চোখের পাতা বন্ধ করে দিল।

এই ধরনের দুর্ঘটনার জন্য প্রভু আমাদের দুটো চোখ দিয়েছেন। সে রোগীকে আশ্বস্ত করে বলল। তুমি একটা চোখ দিয়ে তেমনটাই দেখবে যেমনটা তুমি দুই চোখে দেখতে।

তারা ভাঙ্গা পাথরটা ঠাণ্ডা হতে দিল তারপর চাপ দিয়ে তার বিশাল কালো টুকরোটা খুলল। এর পিছরে পাথর এখনো শক্ত ও অভেদ্য। তারা লাকড়ির সতেজ ডালপালা ওটার উপর স্তূপ করল এবং কষ্টকর, বিপদজনক কাজটা পুনরায় করল। একই ফল পেল। নির্মম কষ্টের খাটুনিতে দিনে তারা কয়েক কিউবিট পর্যন্ত অর্জন করল।

এমনকি নেফারও নিরুৎসাহিত হয়ে গেল এবং মিনটাকাকে তা বলল যখন তারা ঐ রাতে একসাথে অন্ধকারে শুয়ে ছিল। অনেক কিছু আছে যে আমি বুঝতে পারছি না, আমার হৃদয়; সে তার মাথা দোলালো ও ফিসফিসিয়ে বলল।

আমরা এমন কি জানিও না কেন সে আমাদের দিয়ে এই গর্ত খনন করাচ্ছে এবং যখন আমি তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করি তখন সে আমাকে তার ঐ হিংস্র দৃষ্টি উপহার দেয়, একটা বৃদ্ধ কচ্ছপের মতো যা দেখতে। লোকগুলো যথেষ্ট করেছে এবং আমিও।

মিনটাকা ফিক করে হেসে উঠল। বৃদ্ধ কচ্ছপ! তোমার নিশ্চিত হওয়া উচিত যে সে ওটা শুনেনি। সে তোমাকে একটি ব্যাঙ বানিয়ে দিতে পারে এবং আমার মোটেই তা পছন্দ নয়।

পরের দিন খুব সকালে, ক্লান্ত অসন্তুষ্ট দলটা অনিচ্ছা ও ক্লান্তিতে ধীরে ধীরে উপত্যকায় উঠল এবং টানেলের মুখে জড়ো হয়ে ম্যাগোসের আগমনের অপেক্ষা করল।

তার নাটকীয়তা ও স্বাভাবিকতা নিয়ে টাইটা তার পিছনে সূর্যদয়ের প্রথম রশি নিয়ে ঢালে এল। তার চুলের রূপালি ঝোপে ধীরে ধীরে আলো ছাড়িয়ে পড়ছিল তখন। এক কাঁধে সে এক রোল লিলেন কাপড় বহন করছিল। নেফার ও অন্য অফিসাররা তাকে স্বাগত জানাতে দাঁড়াল কিন্তু সে তাদের স্যালুট এড়িয়ে গেল এবং শাবাকোকে নির্দেশ দিল গর্তের মুখে লিলেনটা পর্দার মতো ঝুলিয়ে দিতে। তা করা হলে সে পর্দায় ঢাকা সরু স্থানে প্রবেশ করল এবং বাইরে জড়ো হওয়া লোগুলোর মধ্যেতখন নিরবতা নেমে এল।

মনে হল এটা দীর্ঘ অপেক্ষা কিন্তু বাস্তবে এক ঘণ্টারও কম কারণ দিগন্তে সূর্য মাত্র এক হাত উঠেছে, তখন পর্দাটা এক পাশে সরে গেল এবং টাইটা গুহার মুখে এসে দাঁড়াল। হয় ভাগ্যক্রমে অথবা ম্যাগোসের নকশায় সূর্যালোক সরাসরি খনিকূপ আলোকিত করল। খনিকূপের মুখ উজ্জ্বলভাবে আলোকিত এবং লোকেরা আশাতীতভাবে সামনে এগোল। তারা দেখল যে এখন মহান প্রভু হুরাসের আঘাত প্রাপ্ত চোখের একটা প্রতিরূপ নীল পাথরে অঙ্কন করা।

টাইটার অভিব্যক্তি ছিল বিমোহিত যখন সে মন্ত্র পড়তে শুরু করল স্বর্গের হুরাসকে আহ্বান করতে। অপেক্ষারত জনতা হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল এবং এক সাথে বলল,

স্বর্গের হুরাস, মহান পিতা; শক্তিতে অজেয়! তার শত্রুদের প্রভু! তার উদয়ে পবিত্র! বিশ্বের আহত চোখ! আমাদের প্রয়াসে আশীর্বাদ করো।

শেষ স্তবকের পর টাইটা ঘুরে গেল এবং প্রতিটি চোখ উৎসুকভাবে তার উপর নিবন্ধিত তখন। বড় পদক্ষেপে মধ্যবর্তী স্থানটায় নেমে শেষ প্রান্তের উন্মোচিত পাথরের নীলাভ ধূসর দেয়ালের সামনে এসে দাঁড়াল সে। শিলা পাথরের ক্ষুদ্র স্বচ্ছ টুকরো ওটার মধ্যে রাখা এবং ঝলমল করল যখন সূর্য তাদের উপর খেলা করল।

খিদাস! টাইটা চিৎকার করল এবং দেয়ালটায় তার লাঠি দিয়ে আঘাত করল। প্রবেশ দ্বারের লোকগুলো সংকুচিত হয়ে পিছিয়ে গেল, কারণ এটা ছিল ক্ষমতার শব্দ।

ম্যানসোর!

তারা ভয় পেল এবং সে আবার আঘাত করল।

নকুব! সে তৃতীয় বারের মতো সে আঘাত করল এবং শেষ বার আঘাত করে পিছিয়ে এল।

কিছুই ঘটল না এবং নেফার ডুবন্ত হতাশা ও নিরাশা অনুভব করল। টাইটা অনড় দাঁড়িয়ে রাইল। ধীরে ধীরে সূর্য আরো উঁচুতে উঠল এবং ছায়া পাথুরে দেয়ালে পড়ল।

হঠাৎ নেফার উত্তেজনার এক শিহরণ অনুভব করল এবং তার চারপাশের লোকজন নড়ে উঠল ও ফিসফিস করতে লাগল। পাহাড়ের মুখের মধ্যবর্তী স্থানে, অংকিত চোখের নিচে একটা কালো ভেজা দাগ দৃশ্যত হলো তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল এবং আর্দ্রতার এক ফোঁটা চুঁইয়ে পড়ল, সূর্যালো তাতে একটা ক্ষুদ্র মণির ন্যায় জ্বলজ্বল করল। তারপর তা টিপটিপ করে দেয়াল বেয়ে নেমে এল এবং মেঝের ধুলোয় দলা পাকিয়ে এগুতে লাগল।

টাইটা ঘুরল ও খনি কুপ থেকে বেরিয়ে গেল। তার পিছনে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ হচ্ছিল। একটা শুকনো ডাল ভাঙ্গার ন্যায় এবং পাহাড়ের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটা সুন্দর চিড় লম্বালম্বি ভেঙে গেল। পানি মেঝেতে ঝরে পড়ল, ফোঁটার পর ফোঁটা পড়ার গতি দ্রুত টুপটপে উন্নিত হলো।

অন্য একটা শব্দ, মাটির হাঁড়ির টুকরা আগুনের শিখায় মট করে ভাঙ্গার মতন এবং এক খন্ড পাথর দেয়াল থেকে খসে পড়ল। হলুদ কাদার রেখা সেখান দিয়ে চুঁইয়ে বের হল। তারপর একটা গর্জন দিয়ে সমগ্র পাহাড়ের মুখ ধসে পড়ল কাদার তীব্র প্রবাহ নিয়ে এবং স্বচ্ছ উজ্জ্বল পানির একটা প্রবল বিস্ফারিত ঝর্ণার উদয় হলো সেখানে, হাঁটু পর্যন্ত গভীর যা।

ধুলোয় মাখা লোকদের মাঝ থেকে বিস্ময়, প্রশংসা ও অবিশ্বাস্যের চিৎকার উঠল, হঠাৎ ম্যারন দৌড়ে সামনে গেল এবং মাথা পর্যন্ত প্রবাহমান ধারায় ডুবিয়ে দিল। তারপর সে দুই হাত পূর্ণ করে পানি তুলে তা গলধঃকরণ করল। মিষ্টি! সে চিৎকার করে উঠল। এটা মধুর মতো মিষ্টি।

লোকজন তাদের কাপড় ফেলে দিল এবং নগ্ন হয়ে দৌড় দিল ঝর্ণায়, পানির ঝাঁপটা দিল, কাদা ছোঁড়াছুড়ি করল, একে অন্যকে পানিতে চুব দিল এবং হাসি দিয়ে চিৎকার করল। নেফার লোভ সামলাতে পারল না। সে সকল গাম্ভীর্যতা ঝেড়ে লাফ দিয়ে ম্যারনের উপর পড়ল এবং পানির নিচে তার সাথে কুস্তি করতে লাগল পরমানন্দে।

ঝর্ণার তীরে দাঁড়িয়ে বিশৃঙ্খলার দিকে সহৃদয় অভিব্যক্তি নিয়ে নিচে তাকিয়ে রইল টাইটা, তৃপ্ত অভিব্যক্তি নিয়ে। তারপর সে মিনটাকার দিকে ঘুরল, তোমার মন থেকে চিন্তাটা সরিয়ে রাখ।

কোন চিন্তা? মিনটাকা নির্দোষ ভান করল।

এটা একটা অবমাননা হবে একজন মিশরের রাজকন্যাকে এই কর্কশ নগ্ন সৈন্যদের সাথে লাফালাফি করতে পাওয়া। সে তার হাত ধরল এবং পাহাড়ের নিচে পথ দেখাল। কিন্তু সে বিষণ্ণ ও ব্যাকুলভাবে আনন্দোৎসবের দিকে ফিরে তাকাল।

তুমি এটা কীভাবে সম্ভব করলে, টাইটা? সে জিজ্ঞেস করল। তুমি কীভাবে ঝর্ণাটাকে দৃশ্যত করলে? এটা কোন ধরনের যাদু ছিল?

স্বাভাবিক জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণের যাদু। পানি ওখানে শতাব্দী ধরে ছিল, শুধু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল খনন করে নিচে নামিয়ে আনার।

কিন্তু প্রার্থনা ও শক্তির শব্দগুলোর ব্যাপার কী? ওগুলোর কি কোন প্রভাব ছিল না?

মাঝে মাঝে মানুষের উৎসাহের দরকার হয়। সে মুচকি হাসল এবং তার নাকের পাশটা স্পর্শ করল। একটা ছোট্ট যাদু ঝিমিয়ে পড়া উদ্যমতার জন্য সর্বোত্তম টনিক।

*

তারপরের কয়েক মাস প্রতিটি লোক পাহাড়ের পাশ থেকে পানির প্রবাহ কুয়া পর্যন্ত আনার জন্য খাল খননের কাজ করে গেল। ফলে তা বসতিটির জন্য মজুদ জলাধার হয়ে গেল। যখন তা ছাপিয়ে পড়ল তখন টাইটা উপত্যকার নিচু শেষ অংশের পুরানো জমিগুলো অবলোকন করল যেগুলো এখন পাথুরে উৎপাদন। যাই হোক পুরানো সেচের গর্তগুলোর সীমারেখা এখনো দেখা যায়। তাদের স্তর পুরানো অধিবাসীদের দ্বারা বের করা। তাদের সীমারেখা বের করতে ও তাদের মধ্য দিয়ে অতিরিক্ত পানি বইয়ে দিতে অল্পই কষ্ট হল তাদের।

মরুর মাটি ছিল উর্বর দেবীর আশির্বাদে কোন ভারি বৃষ্টিপাত দ্বারা তা নিষ্কাশিত হয় নি। অবিরাম সূর্যালো এবং পানির প্রচুরতার এক অলৌকিক প্রভাব আছে এখানে। তারা শস্য রোপণ করল। সকল মিশরীয়রা প্রাকৃতিকভাবে ও ঐতিহ্যগতভাবে কৃষক ও মালী, তারা তাদের দক্ষতা জমি ও শস্যের উপর ব্যয় করল। কয়েক মাসের মধ্যে তারা প্রথম শস্য কাটার দুররা উৎসব পালন করল। তারপর তারা তাদের পশুর জন্য ঘাস বপন করল, যা তাদের বর্তমান প্রয়োজনের অনেক বেশি ছাড়িয়ে গেল। মহিলারা গবাদিপশুর খাবার বন্টন, শুকানো ও সাজানোর কাজে যোগ দিল এবং বছরের মধ্যে একদল যুদ্ধ সেনা ধারণের জন্য তাদের যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদন হলো যদিও তখনো তাদের ঘোড়া ছিল কম।

প্রায় প্রতি বছর ফেরারি লোকেরা শহরে ছেড়ে নকল ফারাও এর স্বৈরাচারী শাসন থেকে পালিয়ে মরু পাড়ি দিয়ে এখানে এসে যোগ দিতে লাগল। তারা একা অথবা ছোট দলে আসল, ক্লান্ত, তৃষ্ণায় ও ক্ষুধায় প্রায় মুমূর্ষ অবস্থায় আসতো। পাহাড় বরাবর তাদের অধিগ্রহ করার জন্যে প্রহরী রাখা হল এবং তারপর প্রথমে তাদের হিল্টোর কাছে পাঠানো হতো। সে তাদের ফারাও নেফার সেটির প্রতি অনুগত থাকার শপথ করাতো। তারপর তাদের রেশন অনুমোদন করত এবং উপযোগিতার উপর নির্ভর করে তাদের প্রশিক্ষণ রেজিমেন্টে পাঠিয়ে দিত অথবা তাদের মাঠে কাজ করতে পাঠাতে কিংবা পুরানো শহরের ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনগুলো পুনঃনির্মাণে লাগিয়ে দিত। যাই হোক এসব গৃহহীন ও নাম পরিচয়হীনরাই একমাত্র সদস্য ছিল না, নকল ফারাও-এর আর্মি থেকে পরিত্যক্ত একটা দল তাদের বলুম নিয়ে বীর দর্পে এগিয়ে এল এবং দেয়ালের নিকটবর্তী হয়ে নেফার সেটির প্রশংসায় চিৎকার করতে লাগল। তারপর বিশটি রথের একটা দল, আনখা রেজিমেন্টের কর্নেল যার নাম টিমোস প্রথমে রথ চালিয়ে অস্ত্র নিয়ে এল এবং ফারাও নেফার সেটির রেজিমেন্টে উৎসাহ নিয়ে শপথ করল। টিমোস গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর নিয়ে এসেছে। সে জানালো নাজা ও টক অবশেষে ব্যাবিলিয়ন ও অ্যাশিরিয়ার রাজা সারগনের বিরুদ্ধে তাদের যুগ্ম আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত।

গত কয়েক মাস ধরে দুই ফারাও তাদের তিন হাজার রথের প্রশিক্ষণ অ্যাভারিসে দিয়েছে এবং এখন তারা প্রায় তাদের প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে। তারা ভূমির সেতুর অতিক্রম করবে যা মিশরকে বিশাল তিক্ত হ্রদ ও টিমাশ হ্রদ-এর পূর্বদিকের ভূমির সাথে যোগ করেছে। ইতোমধ্যে তারা এক সারি সৈন্য পাঠিয়েছে ব্যাবিলিয়নের সীমানা বরাবর। তারপর যখন রাস্তা পরিষ্কার হবে তখন তারা গাড়ি ও ওয়াগনে করে দশ হাজার পানির পাত্র পাঠাবে এবং কৌশলে বসানো মজুদ গুদাম ঘরের শক্ত ভূমিতে ওগুলো স্থাপন করবে। দেশটি ছিল উর্বর ও পানিপূর্ণ।

তারা পূর্ণিমায় ভূমির সেতু পার হওয়ার পরিকল্পনা করেছে। রাতের আলো ও ঠাণ্ডা ব্যবহার করে দ্রুত ইশমাইলিয়া এবং খাতমিয়া পাস পেরিয়ে বীরসেবার দিকে যাবে, যেখানে তাদের অনুগত বাহিনী অপেক্ষায় থাকবে।

নেফার ও টাইটা নকল ফারাওদের অতর্কিত হামলা থেকে গালালা রক্ষা জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। তারা জানে এতো দিনে পুরানো শহরে তাদের উপস্থিতি তারা দৃঢ়ভাবে আশা করেছে। নাজা ও টর্ক প্রথমে তাদের দিকে এগুবে, মেসোপটেমিয়ার অভিযানের আগেই। তাই তারা এ স্থগিতাদেশ দেখে অবাক হল।

তারা হুমকিটা গুরুত্বপূর্ণভাবে নেয়নি যে তাদের বর্ডারের খুব কাছে আমাদের অবস্থান। নেফার মহোল্লাসে বলল। যদি এখন তারা আমাদের আক্রমণ করতো এ দুর্বল অবস্থায় আমাদের উড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ থাকতো না।

সম্ভবত তারা তাদের হিসাবে ঐ সম্ভাবনাটা নিয়েছিল, টাইটা সম্মত হলো। সম্ভবত তারা মেসোপটেমিয়া দখলের দিকে বেশি মনোযোগী এবং যে কোন সমর্থন শেষ করে দিতে চায় যা আমরা পূর্ব থেকে পেতে পারি। তারা তখন আমাদের ঘেরা অবস্থায় পাবে। আমার মনে তারা ভুল হিসেব করেছে। কারণ তারা আমাদের আরো শক্তিশালী হওয়ার জন্য কম করে হলেও আরো একটি বছর সময় দিতে যাচ্ছে।

আমরা কি নিশ্চিত হতে পারি যে এটা পরিবর্তিত হবে না? নেফার চিন্তিত প্রশ্ন করল। পূর্বের অভিযান কি একটা ভান? সম্ভবত তাদের প্রকৃত আক্রমণটা আমাদের উপরই আসবে। আমাদের মিথ্যা নিরাপত্তায় ঘুম পাড়ানোর পর।

এই সম্ভাবনা সবসময়ই আছে। টর্ক একটা স্বড় কিন্তু নাজা বিশেষভাবে চতুর ও শঠতাপূর্ণ। সে কোন ধাপ্পাবাজির চেষ্টা করবে।

আমাদের অভিযান মূলত আর্মি প্রহরায় রাখতে হবে। নেফার সিদ্ধান্ত নিল। আমি একদল সৈন্য নিয়ে যাব উত্তরে ইশমাইলিয়ার মধ্যে রাস্তা দেখতে এবং নিশ্চিত হতে চাই যে তারা ঐ রাস্তা অতিক্রম করছে।

আমিও তোমার সাথে যাবো। টাইটা সম্মত হলো।

না, ম্যাগোস, নেফার আপত্তি করল। তোমার এখানে বেশি দরকার আমাদের প্রতিরক্ষাকে সজাগ রাখতে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে যদি নাজা তিন হাজার রথ আমাদের দিকে পরিচালনা করে, তবে লোকজনকে তৎক্ষণাৎ লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত করা। এছাড়াও আরেকটা কাজ আছে যাতে আমাকে তোমার দরকার। সে ইতস্তত করল … মিনটাকার খেয়াল রাখা। আমার বিশ্বাস সে এখানকার অন্য মহিলাদের সাথে অসন্তুষ্ট থাকবে এবং বোকার মতো কোন কাজ করতে পারে।

টাইটা হাসল। রাজকন্যার ক্ষেত্রে দুর্ব্যবহার সবসময়ই একটা পৃথক সম্ভাবনা। আমি খুব ভালোভাবেই জানি আমার দায়িত্ব কোথায়। যদিও নেফার অনেকক্ষণ ও জোরালোভাবে তর্ক করল, টাইটা অনড় রইল এবং শেষ পর্যন্ত নেফার স্বস্তি পেল, জেনে যে বৃদ্ধ লোকটা সবসময়ের মতই তার পাশে থাকবে, যেমন ছিল।

এমনকি তাদের দলে সর্বশেষ আগত সেনাদল সহ তারা মাত্র ৩২টি রথ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে পারল এবং একশরও কম ঘোড়া ছিল ওগুলো টানার জন্যে উপযুক্ত।

গালালা প্রতিরক্ষার জন্য তারা অর্ধেক রথ রেখে গেল যাদের নেতৃত্বে থাকবে শাবাকো। হিল্টো ও ম্যারনকে সাথে করে তারা ষোলটা যুদ্ধ রথ নিয়ে বিশাল তিক্ত হ্রদের পূর্বদিকে ছুটল ইশমাইলিয়ার প্রধান সড়ক অধিগ্রহণ করতে। নতুন চাঁদের মাত্র এক দিন পূর্ণ হয়েছে। রাতগুলো অন্ধকার ও আরামদায়কভাবে ঠাণ্ডা। তাই তারা ভালোভাবে এগিয়ে গেল এবং অজানা বুনোপথে তারা যাত্রা শেষ করল চাঁদ চার ভাগের দ্বিতীয় ভাগে থাকার আগেই।

*

গালালা ছাড়ার পনের তম দিনের ভোর বেলা তাদের ইশমাইলিয়ার পূর্বে পাহাড়ের উপর লুকিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা গেল। এখান থেকে দূরে শহরটা দেখতে পাওয়া যায়। প্রধান সড়কটি তাদের প্রহরার নিচ দিয়ে গেছে এবং দুই ফারাও এর আর্মিদের এই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। ইশমাইলিয়া ছিল মিশরের সীমার সুরক্ষিত এলাকা এবং ক্যাম্পেইন শুরুর স্বাভাবিক স্থান।

মনে হয় আমাদের বুদ্ধিটা যথেষ্ট ভালো, নেফার নিচে টাইটাকে ডেকে বলল। সে সামনের পাহাড়ের ঢালের একটা লম্বা সিডার গাছে চড়েছে এবং সেখান থেকে সে সমতলের অনেক ক্রোশ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে দেখতে পারল। শহরটা ব্যস্থতায় পূর্ণ। ঘোড়ার লাইন এবং দুর্গের দেয়ালের বাইরে তাঁবুর একটা শহর দেখা যাচ্ছে। সে তার চোখের উপর হাত রাখল আরো ভালোভাবে দেখতে। ডেল্টা থেকে রাস্তা দিয়ে ধুলার ঝড় আসছে। মিশরের সকল ওয়াগন ও রথের এগিয়ে আসার মতো দেখাচ্ছে।

ঐদিন সকালের বাকিটা সময় সে ম্যাগোসকে তার দৃশ্যত সব কিছু বলে চলল যতোক্ষণ না তাপ তেতো হয়ে উঠল ও শহরের বাকি কর্মতৎপরতা নিদ্রালু দুপুরে ঢাকা পড়ে গেল। তখন সে নেমে এল এবং দলের বাকিদের মতো ছায়া খুঁজতে গেল। অপেক্ষার পর পড়ন্ত বিকেলে বাতাস ঠাণ্ডা হলে তারা নিজেদের ঘোড়াগুলোকে খাবার দিতে ও পানি পনি করানোর জন্য তুলল। তারপর নেফার তার প্রহরার স্থানে চড়ল আবার। তৎক্ষণাৎ প্রতীয়মান হলো যে তারা ঠিক সময়েই পৌঁছেছে। পূর্ব দিকে রাস্তাটা বিশাল সৈন্য বাহিনীর জীবনাশক্তির একটা স্পন্দনে ভরে গেছে। দল পর দল, ৫০টি শক্তিশালী রথ ইশমাইলিয়ার প্রবেশ পথ দিয়ে বেঁকে প্রবেশ করল। প্রতিটির পিছনে ওয়াগন অনুসরণ করছে তাদের মালপত্র ও গবাদিপশুর খাবার ভর্তি যান। তাদের গোপন স্থানের পাশ দিয়ে ঝর্ণা ধারার ন্যায় এগিয়ে যেতে লাগল তারা। অগ্রবর্তী দলটা যেখানে নেফার বসেছিল তার এতো কাছে দিয়ে গেল যে তারা সবাই স্বতন্ত্র রইল।

সেনা দলটা অসীম নদীর মতো বয়ে গেল, ব্রোঞ্জের হাতিয়ারগুলো প্রতিফলনে ঝিকঝিক করছে, এর ধুলো ঘন মেঘ হয়ে এতো উপরে উঠল যেন তা সূর্যকে ঢেকে ফেলার হুমকি দিল।

চারটা দল অগ্রণীদল গঠন করল এবং তার পর এল একটা ফাঁকা স্থান। স্পষ্টতভাবে এটা ধুলা সরে যাওয়ার জন্যে এবং রাজকীয় দলটার অস্বস্তি উপশম করানোর জন্য তা করা হয়েছে।

পরবর্তীতে দুটি রথ পাশাপাশি এল। উভয় রথই এতো ভারি ও স্বর্ণের পাতে ঢাকা ছিল যে প্রতিটায় ছয়টা ঘোড়া দরকার হলো তা টানার জন্যে। নেফারের মনটা পিত্তরসের ন্যায় বিতৃষ্ণ হয়ে গেল যখন সে চালকদের চিনতে পারল।

সবচেয়ে কাছের রথটার লাগাম টর্কের হাতে। তার চওড়া কাঁধ ও দাড়ির কালো ঝোপে কোন ভুল নেই যে সে-ই। সে একটা স্বর্ণের হেলমেট পরিধান করে আছে যা দেখতে মৌচাকের মতন। ফেনার ন্যায় সাদা অস্ট্রিচের পুচ্ছের ঝুটি দিয়ে তা সাজানো।

তার কাঁধে ঝুলছে দ্বিগুণ বড় ঢাল, প্রতিটি পাত তার বৃদ্ধাঙ্গুলের মতো পুরু, এতো ভারি যে এটা বলা হয় থাকে তার আর্মির মধ্যে একমাত্র সেই তা ব্যবহার করতে পারে, ঠিক যেমন বিশাল যুদ্ধ ধনুকটা তার ডান হাতের পাশের তাকে রাখা।

অন্য আরেকটি বিশাল রথে রয়েছে ফারাও নাজা কাইফান। সে স্বর্ণের ও দামী পাথরের একটা বর্ম পরিধান করেছে যা লাল সূর্যের আলোতে চমকাচ্ছে। ধুলার মেঘ দিয়ে সে বেরিয়ে এল। মাথায় সে পড়েছেন মিশরের নীল মুকুট এবং তার পাশে ছিল রুপা ও ইলেকট্রনের খাপে ভরা সবুজাভ নীল রত্ন ও লেপিজ লাজুলিতে খচিত বিখ্যাত নীল তলোয়ার, যা সে নেফারের পিতার দেহ থেকে লুণ্ঠন করেছে।

অদ্ভুতভাবে যদিও সে শারীরিক উচ্চতায় টর্কের থেকে কম, তবুও নাজা দুজনের মধ্যে বেশি হুমকি স্বরূপ।

স্বর্ণের রথগুলো অতিক্রম করল এবং নেফাররা ধুলোর মেঘে হারিয়ে গেল। নেফার সিডার গাছের শাখার সাথে মিশে রইল যখন রণ সাজে সজ্জিত দলটা নিচ দিয়ে বেড়িয়ে গেল।

সূর্য দিগন্তের নিচে পিছলে গেল, কিন্তু তখনো যথেষ্ট আলো ছিল এই সীমহীন মিছিলের পরবর্তী অংশ চিহ্নিত করার জন্যে। নেফার নতুন মজা ও আকর্ষণ নিয়ে সোজা হল তা দেখতে।

প্রধান সড়কের উপরি ভাগ যা ইতোমধ্যে শত শত রথ ও ওয়াগনের ঢাকা দাগে পিষ্ট তা দিয়ে দোলতে দোলতে ও গড়াতে গড়াতে দুটি মহিষে টানা পালকি এল। ওগুলো এতো বিশাল ও তাদের সিল্কের পর্দাগুলো এতো বিশাল এবং স্বর্ণের ঝালর ও নকশা দিয়ে সাজানো যে নেফার বুঝল ভেতরের যাত্রীরা রাজ হারেমের মহিলা হবে। নেফার কল্পনা করতে পারল না টর্ক তার স্ত্রীদের বা উপপত্নীদের তার সাথে ক্যাম্পেইন করতে নিয়ে যাচ্ছে। সে শুনেছে টর্ক তার আনন্দের জন্য বন্দীদের উপর নির্ভর করে যাদের সে দখলকৃত শক্রদের শহর থেকে আনে এবং ছেলে অথবা মেয়েদের সাথে একই সমান আনন্দ উপভোগ করে থাকে।

ঠিক তখন পালকির পর্দা এক পাশে সরে গেল, একটা মেয়ে লাফ দিয়ে ধুলার রাস্তায় নামল এবং মহিষগুলোর পাশ বরাবর লাফালো। যদিও সে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে যখন সে তাকে শেষ বার দেখেছিল, তবুও তার সন্দেহ রইল না যে এই সুন্দর সৃষ্টি হচ্ছে মেরিকারা, তার ছোট বোন। সে বাচ্চাদের ন্যায় পাশে চুল বেঁধেছে, তার চুল তার কাঁধে পর্যন্ত কর্তন করা এবং তার আইভ্রর সমতলে পুরু সোজা প্রান্ত ধরে তা কাটা। তার ঝুটি হারানোর অর্থ হল সে নারীত্বে পদার্পণ করেছে। নেফার একটা ব্যথা অনুভব করল যে তার হাস্যকার ছোট বোনটা আর বাচ্চা নেই। তখন তার মনে পড়ল মেরিকারাকে তার বিছানায় নিতে নাজার আর কোন বাধা নেই। সে শুনেছে নাজা একটা কামুক প্রকৃতির লোক এবং তার ছোট বোনকে সে বলঙ্কার করছে এই ধারণা নেফারকে এতো বেশি বিদ্রোহী করে তুলল যে সে তার গলার পেছনে পচা মাছের স্বাদ পেল, তিক্ত।

সে মেরিকারার সথে কথা বলার একটা বিমোহিত আশা অনুভব করল, জানতে চায় সে সুখী কিনা, যদি কিঞ্চিৎও তা না থাকে তবে সে তাকে অধিক সহজ করে দেওয়ার জন্যে তা করতে পারে। তারপর তার মনে হলো তাকে উদ্ধার করে তাকে গালালায় নিয়ে যাবে। সে জানে এসব চিন্তা বিপদজনক এবং তার সঙ্গীরা তাকে এই রকম আত্মঘাতী কল্পনা থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে।

পালকির পিছনে খুব কাছাকাছি সে দেখল নকল ফারাও-এর যুদ্ধের সিন্দুক বহন করা এক্কা গাড়িটা। এখানে একটা উদ্দেশ্য ছিল যা অন্যরা বুঝবে। ওগুলো ছিল অলংকারহীন এক্কা, মলিন গম্ভীর নীল রঙে অংকিত। কিন্তু মজবুত। কার্গোর বিশাল ওজন ঠেকানোর জন্য দৃঢ় ভাবে তৈরি করা। ধাতু পরিহিত চাকা রাস্তার উপরিভাগে গভীর ভাবে কেটে যাচ্ছে। ট্রাকের মেঝের পিছনের দরজাগুলো ছিল চেইন দিয়ে আটকানো ও বন্ধ এবং অস্ত্রধারী সৈন্য ওগুলোর পাশে হাঁটছে। এসব হলো ধন-সম্পদ পরিবহনের আদর্শ যান, যা ছাড়া কোন আর্মি কুচকাওয়াজ করে না। নেফারের জানা মতে ওগুলো স্বর্ণের বার বহন করছে। যেগুলো বার, আঙুলের আংটি ও ক্ষুদ্র গুটিকায় রূপান্তর করা। এগুলো সৈন্যদের বেতন দিতে ব্যবহার হতে পারে এবং ছোট রাজ্য ও জমিদারদের ক্রয় করার জন্য, ব্যাবিলিয়ন ও অ্যাশিরিয়ান মিত্রদের কিনতে এবং শত্রুবাহিনীর গুপ্তচর ও তথ্যদানকারীদের ঘুষ দেওয়ার জন্যে।

নেফার সিডার গাছের ডাল থেকে পিছলে মাটিতে নেমে এল। টাইটা সেখানে নিরবে ঘুমাচ্ছিল, কিন্তু নেফার তার বাহু স্পর্শ করার আগেই সে তার চোখ খুলল। নকল ফারাও-এর যুদ্ধের সিন্দুক; তাকে ফিফিসিয়ে বলল নেফার। একটি সেনাবহিনী বা সিংহাসন কেনার জন্যে যা যথেষ্ট।

*

পরের অনেক রাত পর্যন্ত নেফার ও ম্যাগোস চাঁদনী ছায়া থেকে সৈন্য সারির সাথে দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটল, এক্কার সাথে সামান্তরাল ভাবে চলল যা ধনরত্ন বহন করছিল, রক্ষীদের রুটিন ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করে গেল মনযোগ দিয়ে। প্রথম থেকেই তারা বুঝল যে এক্কা গাড়িগুলো জব্দ করা অসম্ভব হবে এবং পুরো আর্মি তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে ওগুলো নিয়ে পালিয়ে যাওয়াটাও অসম্ভব।

ষাঁড়গুলো যে গতিতে চলছে তাতে আমরা ওগুলোকে নিয়ে এক ক্রোশ যাবার আগেই নাজার রথ আমাদের ধরে ফেলবে; নেফার চিন্তিত ভাবে বলল। তাদের থেকে আমাদের আরও একটু চতুর হতে হবে; টাইটা সম্মত হলো। একমাত্র সময় হলো যখন আমরা সিন্ধুকগুলোর সাথে কিছু করতে সক্ষম হতে পারি তা হচ্ছে দিনের বেলায় যখন তারা পিছিয়ে থাকবে তখন।

প্রহরীদের বিষয়ে কি হবে?

ওহ! টাইটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল। রক্ষীরা একটা সমস্যা বটে।

*

প্রতি দিন ক্রমশ সূর্য যখন উঁচুতে উঠছিল ও তাপ প্রবাহ বেড়ে চলল পুরো বাহিনীর গতি ততোই ধীর হডে পড়ল। রাজ স্ত্রীদের ক্ষুদ্র দল এবং সেই সাথে ধন-রত্ন বহনকারী যানগুলোর দূরত্ব তাদের মূল বাহিনী থেকে বাড়তে লাগল ও পিছিয়ে পড়ল ক্রমশ। বিশ্রাম নিতে থামার পর প্রথমে তারা তাদের বহনকারী প্রাণীগুলোর হার্নেস খুলে দিল ও তাদের পানি এবং খাবার খেতে দিল। তারপর আগুন জ্বালানো হল মধ্যাহ্নের খাবার তৈরির উদ্দেশ্যে। খাবারের পর্ব শেষে হেজারেট, মেরিকারা এবং তাদের দাসীরা তাঁবুতে বিশ্রাম নিতে গেল। যে লোকদের প্রহরার দায়িত্ব ছিল না তারা সারা রাতের এ দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তিতে দ্রুত ছায়ায় গা এলিয়ে দিল।

এদিকে নেফার ও টাইটা তখন তাদের দলের বাকিদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উপত্যকা ঘুরে কন্টক ঝোঁপ পেরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে শত্রু দলের ক্যাম্পের দিকে এগুতে লাগল।

তাদের কি বিচ্ছিন্ন করার কোনো উপায় নেই? নেফার জিজ্ঞেস করল।

এ কাজের জন্য আমাদের ক্যাম্পের ভেতর থেকে কারো সাহায্যের প্রয়োজন। টাইটা জবাব দিল।

মেরিকারা? নেফার তীক্ষ্ণ দৃষ্ট হেনে তার দিকে তাকাল।

হ্যাঁ, মেরিকারা। টাইটা সম্মতি জানিয়ে বলল।

আমরা কীভাবে তার কাছে বার্তা পাঠাবো? নেফারকে হতভম্ব দেখাল। কিন্তু টাইটা হাসল ও লসট্রিসের কবজটা স্পর্শ করল যা তার নেকলেস ঝুলানো। সে তার চোখ বন্ধ করল। একটু পর নেফার দেখল সে ঘুমিয়ে পড়েছে। বৃদ্ধ লোকটি জানে কীভাবে তাকে ক্ষিপ্ত করা যায়।

অবশেষে তার বয়স তাকে ধরেছে, নেফর রাগান্বিত হয়ে ভাবল এবং তাকে জাগাতে প্রায় ঝাঁকি দিচ্ছিল তখন সে ক্যাম্প থেকে একটা আওয়াজ শুনল এবং সে উপরের দিকে তাকাল।

মেরিকারা তার তাবু থেকে বেরিয়ে এসেছে। সে নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছিল কারণ তার চেহারা লাল এবং বালিশের দাগ মুখে আঁকা। সে আড়মোড়া ভাঙ্গল ও হাই তুলল। সে শুধু একটা নীল লিলেনের স্কার্ট পড়েছে যার ভাজগুলো তার হাঁটুর নিচে ঝুলে আছে, উর্ধ্বাংশ খালি। মেরিকারা তার তাবুর প্রবেশ দ্বারে রক্ষীর সাথে তর্ক করল এবং তার কণ্ঠ উদ্ধত, ফলে নেফার প্রতিটি শব্দ শুনতে পেল। আমি ঘুমাতে পারব না এবং আমি একটু হাঁটতে যাচ্ছি। রক্ষীরা তাকে থামাতে চেষ্টা করছে, কিন্তু সে তার মাথা ঝাকল, কাঁধের উপর তার চুলও তখন নাচল। না, আমি তোমাকে আমার সাথে পাহাড়াদার হিসেবে যেতে দিব না। আমি একা থাকতে চাই। রক্ষীটা জোর করল এবং সে তার দিকে রাগান্বিত ভাবে তাকাল। সরে দাঁড়াও বেয়াদব, নইলে আমি তোমার ব্যবহার আমার স্বামীকে জানাবো। বিষণ্ণভাবে রক্ষী তার আদেশ মানল ও তার বর্শা নামাল। কিন্তু উদ্বিগ্নভাবে পিছু থেকে ডেকে বলল, দয়া করে মহারাণী বেশি সময় থাকবে না অথবা বেশি দূরে যাবেন না। ফারাও যদি এই বিষয়ে জানে তবে এর চাইতে আমার জীবনে করুণ কিছু আর হবে না।

মেরিকারা তাকে এড়িয়ে গেল, ঘোড়ার গাড়ি ও ঝোঁপের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল যা ক্যাম্পটা ঘিরে আছে। সে শুধু একবার পিছনে তাকাল নিশ্চিত হতে যে তাকে কোনো অনুসরণ করা হচ্ছে না। তারপর সংকেত স্থলের দিকে যেখানে নেফার ও টাইটা শুয়ে আছে সরাসরি সেখানে এল।

নেফার দেখল তার নীল চোখ বিমোহিত ও তার মনোরম চেহারায় একটা অবিনিষ্ট অভিব্যক্তি, যেন সে কোনো গান শুনছে এবং তা সে একাই শুনছে। স্পর্শ করার মতো কাছাকাছি হতেই নেফার তাকে আস্তে করে বলল, মেরিকারা ভয় পেয়ো না, আমি নেফার!

সে একজন ঘুমে হাঁটা লোকের ন্যায় জাগতে শুরু করল এবং তার দিকে অপলক চেয়ে রইল। তারপর তার চেহারা এক অসীম আনন্দে আলোকিত হলো এবং সে তাকে আলিঙ্গন করতে লাফ দিয়ে সামনে এগুলো।

থাম! নেফার আদেশ দিল। আমাদের রক্ষীদের কাছে ধরিয়ে দিও না।

তাকে নিয়ে নেফারের গর্ব হলো, কারণ সে তার কথা শুনল এবং তৎক্ষণাৎ থেমে গেল। সে সব সময়ই বুদ্ধিমতী বটে। সে দ্রুত চারপাশে চোখ বুলালো এবং তার কণ্ঠ কাপল যখন সে আস্তে আস্তে বলল, আমি খুব ভালো ঘুমাচ্ছিলাম কিন্তু হঠাৎ জেগে গেলাম এবং জানলাম যে আমাকে অবশ্যই মরুতে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা প্রায় যেন একটা কণ্ঠ আমার মাথার ভেতর আমাকে ডাকছিল। সে টাইটার দিকে তাকাল। ওটা কি তোমার কণ্ঠ ছিল ম্যাগোস? তারপর তার চোখ আবার নেফার দিকে ফিরে এল। প্রিয় ভাই তুমি জান না তোমাকে আমার কত মনে পড়েছে। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তুমি মারা গেছ এবং আমি তোমার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে আমার মাথায় ছাই নিয়ে শোক করেছি। এই দেখ কাটা দাগ যেখানে আমি তোমার জন্য রক্ত ঝড়াতে আমার হাত কেটেছিলাম।

আমি জীবিত, মেরিকারা। আমাকে বিশ্বাস কর, এটা কোনো ছায়া নয় তুমি যা দেখছ।

আমি জানি, নেফার। সারা দুনিয়া এখন জানে তুমি কিভাবে মিনটাকাকে অ্যাভারিসের মরুতে নিয়ে গেছ এবং আমার হৃদয় বলেছে একদিন তুমি আমার জন্যও আসবে। সে সুখের কান্নায় হাসল। আমি জানতাম তুমি আসবে।

হ্যাঁ! নেফার বলল, আমরা তোমাকে আমাদের সাথে নিয়ে যাব। কিন্তু প্রথমে তোমাকে আমাদের সাহায্য করার জন্য কিছু করতে হবে।

তোমার ও টাইটার জন্যে যে কোনো কিছু, সে তৎক্ষণাৎ রাজি হলো।

দ্রুত ও জরুরিভাবে কথা বলে টাইটা বলল তাকে কি করতে হবে এবং তারপর সে তাকে দিয়ে তার পুনরাবৃত্তি করাল। মেরিকারা একদম নির্ভুল ভাবে সব বলল।

তুমি একটা চালাক মেয়ে আমার ছোট্ট সোনামণি। টাইটা বলল। এটাই তা যা আমরা চাই তুমি কর। সে তাকে একটা ছোট প্যাকেট দিল। এই যে পাউডার, মনে রেখ প্রতি পাত্রে তোমার নখ পরিমাণ শুধু।

প্রথমে তুমি আমাকে চালাক বললে এবং তারপর তুমি আমার সাথে এমন ব্যবহার করলে যেন আমি বোকা, সে বিরক্তি প্রকাশ করল।

আমাকে ক্ষমা করুন, মহারাণী। টাইটা ক্ষমা ভঙ্গি করল।

আমাকে আর কখনো ও নামে ডাকবে না। এবং আমি বিরক্ত, কোন সাপকে বিয়ে করা আমি ঘৃণা করি এবং এখন আমি জানি সে আমাকে কি করতে যাচ্ছে। আমি তা আরো বেশি ঘৃণা করি।

তোমাকে সহজে খুশি করা যায় না, মেরিকারা। এখন রক্ষীরা তোমাকে খুঁজতে আসার আগেই ক্যাম্পে ফিরে যাও।

সে দ্রুত ঝুঁকে নেফারকে তার ঠোঁটে চুমু দিল। কাল পর্যন্ত, আমার প্রিয় ভাই।

*

পরের দিন দুপুরে মিশরীয় বিশাল আর্মি উঁচু মালভূমির নিচে ক্যাম্প করল যেখানে বালুময় মরুভূমি ও শুকনো ভূমিটা শেষ হয়েছে। তারা প্রায় সংযোগস্থল সম্পন্ন করেছে এবং কাল তারা যাবে উপরে অধিক ঠাণ্ডা স্থান দিয়ে যেখানে থেকে মরুদ্যানগুলো একদিনের পথ, যেখানে বন ও জমি রয়েছে; আঙ্গুর জন্মে এবং সারা বছর পাহাড়ী ঝর্ণা বয়ে যায়।

রাজ স্ত্রীদের রক্ষীরা যখন দিনের জন্য ক্যাম্প করতে শুরু করল তখন তারা দেখল যে তরুণ রাণী মেরিকারা খিটখিটে ও স্বেচ্ছাচারীত্ব দেখাচ্ছে, তার স্বাভাবিক মিষ্টি ও মাধুর্যময়তা একেবারেই নেই। সে তার তাবু তার বোন রানী হেজারেটর কাছ থেকে দূরে স্থাপন করতে চাইল এবং যখন এটা শেষ হল সে জোর করল যেন তারা যানগুলো সরিয়ে দেয় যেগুলো যুদ্ধের সিন্দুকসমূহ বহন করছে। ওগুলোকে সরু ওয়াদির মধ্যে মূল ক্যাম্প থেকে ২০০ কদম দূরে সরাতে বলল। বৃথাই রক্ষীদের কমান্ডার বলল যে ওয়াদির স্তর নরম ও বালুময় এবং ভারি যানগুলোর চাকা গভীরভাবে গেঁথে যাবে।

আমি তোয়াক্কা করি না ওগুলো পুরোপুরি বালিতে ডুবে গেল কিনা; সে তাকে বলল। আমি ঐ কুৎসিত যানগুলো দেখে দেখে এবং মহিষগুলোর ডাক শুনে ক্লান্ত। ওগুলো আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাও।

কমান্ডার ভাবল ফারাও নাজা কাইফান এর কাছে আবেদন করতে তার ছোট স্ত্রীর এই অযৌক্তিক আদেশকে দূর করার জন্য। তারপর বিষয়টা সে ভাবল যে সৈন্য বাহিনী মরুতে প্রায় চার ক্রোশ স্থান জুড়ে বিস্তৃত। এটা বাহিনীর মাথায় ফারাও এর কাছে পৌঁছাতে এক ঘণ্টার কঠোর যাত্রা হবে এবং তারপর ফিরে আসাটা হবে এরকম কষ্টকর। এই দিনটা চলে যাওয়া দিনগুলো থেকে অধিক গরম এবং তাছাড়া মেরিকারা তারই এক দাসী মেয়ের সাথে তার গোপন সাক্ষাৎ করার কথাটা জানে যে একটা মোহিনী ছোট কালো নুবিয়ান যে কিনা প্রশিক্ষিত বানরের চাইতে বেশি কৌশলী। তা প্রকাশ পেলে তাকে বিপদে পড়তে হবে। সে গাড়িগুলোকে ওয়াদির তলদেশে সরালো, বিবেকের তাড়নায় সেখানে রক্ষী প্রহরা দ্বিগুণ করল।

নিজের মন মতো সব পেয়ে মেরিকারা আবার প্রিয় বালিকা হয়ে গেল যাকে তারা সবাই খুব ভালোবাসে। আমি দুঃখিত, আমি তোমার সাথে কঠোর আচরণ করছি, মারাম। এটা অবশ্যই এই ভয়ংকর তাপের জন্য যা আমাদের সবাইকে আক্রমণ করেছে। সে রক্ষীদের গার্ডকে তার লোকের সামনে মিষ্টি করে বলল। আমি আমার ব্যক্তিগত ভান্ডার থেকে মিশাকে দিয়ে তোমার জন্য পাঁচ পাত্র মদ পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমাদের সতেজ করার জন্য। নিশ্চয়ই তুমি তা তোমার লোকদের সাথে সমান ভাগ করবে কারণ আমি তাদের অতিরিক্ত কাজ করিয়েছি ও সমস্যাও দিয়েছি।

মিশা, খোদাই করা নিশ্চল মূর্তির মতন নুরিয়ান দাসীটি দ্রুত এক জোড়া বাহনে করে মোরামের তাঁবুতে মদের পাত্র নিয়ে এল এবং লোকেরা তাদের অংশ নেওয়ার জন্য লাইন ধরে দাঁড়াল। রাণী মেরিকারা উপর প্রভুর আশীর্বাদ ও তার সুস্বাস্থ্য কামনা করল সবাই যখন তারা ফেনায়িত মদের প্রথম ফোঁটা পান করল।

মেরিকারার কাছে তার ওয়াদা সত্ত্বেও মদটা এতো বেশি চমৎকার ছিল যে মোরাম তার নিজের অংশের চেয়ে বেশি পান করল। যখনই তারা তার তাবুতে একা হল মোরাম ও মিশা তাদের গোপন অভিলাষে মত্ত হল। কিন্তু মোরাম ধীরে ধীরে কাত হয়ে পড়ে গেল। সমঝোতা পৌঁছার আগেই দ্রুত ঘুমিয়ে গেল সে। মিশা বিস্ময়ে তার দিকে চেয়ে রইল। এই ক্ষুদ্র কিন্তু ব্যস্ত জীবনে এরকমটা তার সাথে পূর্বে কখনো হয়নি। মোরামের নাক দিয়ে আওয়াজ বেরিয়ে আসল যা দূরে বজ্রপাতের ন্যায় বারবার প্রতিধ্বনিত হলো। মিশা লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে তার স্কার্ট নামাল একং তার ঘুমন্ত দেহে একটা হিংস্র লাথি মারল। তারপর ঝড়ের বেগে তাঁবু থেকে বেরিয়ে তার মালকিনের কাছে ফিরে এল। রাজকীয় তাবুর প্রবেশ দ্বারে প্রহীরটাও একইভাবে মরার মতো ঘুমাচ্ছিল।

সবগুলো শূকর, অসভ্য ভাষায় গালি দিল মিশা এবং তার লম্বা ও সুঠাম ডান পা দিয়ে সকল শক্তিতে তাকেও লাথি মারল।

*

নেফার শুকনো নদী তট দিয়ে তার ছোট দলটাকে পথ দেখাল। তারা তীরের কাছাকাছি রইল এবং তাদের পায়ের আওয়াজ ঢেকে দিল নরম বালি।

চারটা ধন-রত্নের গাড়ি পাশাপাশি রাখা এবং ওগুলোর চাকা এক সাথে বাঁধা যাতে তাদের দস্যু বা ডাকাতেরা দ্রুত নিয়ে যেতে না পারে।

আটজন অস্ত্রধারী প্রহরী তাদের চারপাশে দেওয়া হয়েছে এবং প্রত্যেকে বালির উপর মরার মতো পড়ে রয়েছে মমি হবার অপেক্ষায়। টাইটা একে একে সবার কাছে গেল ও তাদের গলার কাছে হাত দিয়ে নাড়ি দেখল। তারপর অচেতন লোকদের চোখের একটা পাতা টেনে পরীক্ষা করল। অবশেষে সে নেফারের উদ্দেশ্যে মাথা দুলিয়ে প্রথম গাড়ির পিছনের দরজায় গেল সন্তর্পণে।

সে তার ঝোলা থেকে একটা লম্বা ব্রোঞ্জের প্রেষণী বের করে গভীর মনোযোগ দিয়ে ভারি ব্রোঞ্জের তালার উপর কাজ করল। কয়েক মিনিটের মধ্যে পট করে তালার আংটা খুলে গেল। টাইটা ভারি ধাতব দরজাটা খুলল চারটা ছোট বাক্স প্রকাশ করার জন্য যা ওয়াগনের মেঝেতে আংটার সাথে নিচে বাঁধা। রত্নের সিন্দুকগুলোর ঢাকনা কাদার আস্তর দ্বারা বন্ধ ও ফারাও নাজা কিয়াফানের সীলমোহর খোদাই করা।

টাইটা সীলটা উঠানোর জন্য তার ছুরির ফলা ব্যবহার করল, এবং ওগুলো তার থলের ভেতর ফেলল যাতে পরবর্তীতে যখন গাড়ির দরজা খোলা হবে তখন কোন প্রমাণ না থাকে। সে তার চাকুর ডগা ব্যবহার করে বাঁধনগুলো কাটল যেগুলো চাকাটাকে বেঁধে রেখেছে। তারপর তা উঠাতেই দেখল সিন্দুকগুলো ছোট চামড়ার থলেতে পূর্ণ। টাইটা একটা তার হাতে নিয়ে ওজন দেখল এবং হাসল। সে থলেটির মুখ খুলল ভেতরকার দামী ধাতুর নির্ভুল ঝলকানি দেখার উদ্দেশ্যে।

যখন সে ব্যস্ত ছিল তখন নেফার এবং ম্যারন ওয়াগনের চাকার দাগের নিচে অগভীর গর্ত খুড়ল। টাইটা নেফারের হাতে চামড়ার থলেটা দিল, যা সে গর্তের তলদেশে রাখল। সর্বমোট টাইটা প্রথম সিন্দুক থেকে পঞ্চাশটা সবচেয়ে ভারি থলে বাছাই করল। তারপর পুনরায় ঢাকনা লাগিয়ে দিল সে। নতুন কাদা ব্যবহার করে সে ঢাকনাটা আবার সীল করে দিল যা সে তার সাথে এনেছে। খোদাইকৃত রুবির আংটি দিয়ে সে সীলমোহর দিল যা নাজা তাকে উপহার হিসাবে দিয়েছিল যখন সে থেবস ত্যাগ করেছিল। সে কাদার উপর রাজচিহ্ন এঁকে দিল। তারপর সে চারটি সারির পরের সিন্দুকের কাছে গেল ও একই কাজ করল দক্ষ হাতে।

আমরা যথেষ্ট নিচ্ছি না; ম্যারন বিড়বিড় করে উঠল অসন্তোষ প্রকাশ করে। আমরা নাজা ও টর্কের জন্য অর্ধেকেরও বেশি ফেলে যাচ্ছি।

লোভ আমাদের সর্বনাশ ঢেকে আনবে, টাইটা বিরক্তি প্রকাশ করল। শেষ বক্সটার ঢাকনা চাপ দিয়ে খুলতে খুলতে সে বলল, এই পদ্ধতিতে তারা জানবে না যে কোন ঘাটতি আছে যতক্ষণ না বেতন প্রদানের জন্যে পুনরায় এই বাক্স খুলবে এবং গণনা না করবে, যা আরো কয়েক মাসেও হয়তো হবে না।

বাকি চারটা গাড়ির প্রতিটি বাক্স থেকে তারা একই ভাবে পঞ্চাশটি করে চামড়ার থলে তুলল এবং ওয়াদি তটের নরম বালিতে পুঁতে রাখল। যদিও সতর্কতা যতোটা অনুমতি দিল তারা ততটা দ্রুত করল তবু সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ল যখন তারা শেষ সিন্দুকটা পুনরায় সীল করে দিল। শেষ গাড়িটার পিছনের দরজা বন্ধ করার সময় একজন ঘুমন্ত প্রহরী নড়ে উঠল, বিড়বিড় করল এবং উঠে বসার চেষ্টা করল। টাইটা তার কাছে গেল এবং তার দ্রুর উপর আলতো করে হাত রাখল। লোকটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তখন শুয়ে পড়ল আবার। টাইটা তখন টেনে মুখ খুলে তার জিহ্বার নিচে এক চিমটি সাদা পাউডার রাখল।

আমাদের এখন দ্রুত করতে হবে। তাদের জেগে উঠার সময় হয়ে গেছে।

শেষ ওয়াগনের নিচের গর্তের তলদেশে তারা থলের সারির উপর বালি ছড়িয়ে দিল এবং তারপর এলোমেলো পদচিহ্ন আঁকল যাতে মসৃণ বালি সন্দেহাহীন না হয়।

আমরা কি পরিমাণ নিয়েছি তুমি মনে কর? নেফার জিজ্ঞেস করল।

যততক্ষণ না আমরা ওজন করছি তা বলা অসম্ভব। টাইটা জবাব দিল। কিন্তু আমার অনুমান যে আমরা কমপক্ষে তিন লাখ নিয়েছি। একটি সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে ও সজ্জিত করতে যথেষ্ট। হাতের কাজ করতে করতে নেফার বিড়বিড় করল।

শেষবারের মতো তারা দ্রুত কিন্তুপরীক্ষা করল গাড়িগুলো ও তাদের চারপাশের স্থান। যখন তারা নিশ্চিত হল যে দূর থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না তখন প্রহরীদের গভীর ঘুমে রেখে তারা ওয়াদি থেকে বেরিয়ে এল এবং মালভূমিকে নিচে রেখে পাহাড়ের পাদদেশে ফিরে গেল। সেখানে তারা হিল্টোকে রথের কাছে রেখে গিয়েছিল। এ সুবিধাজনক স্থান থেকে তারা তাদের লুণ্ঠন করা সমাহিত স্বর্ণ নজর রাখতে পারবে। তারা লক্ষ্য করল যে ওয়াদিতে কোন চিৎকার বা অস্বাভাবিক কর্ম ব্যস্ততার কোন লক্ষণ নেই। সম্ভবত প্রহরীরা খুব দোষী অনুভব করছে যখন তারা তাদের দায়িত্বের অবহেলার রিপোর্ট করতে লাগল।

ঠিক অন্ধকারের পূর্বে নেফাররা দেখল গাড়ি টানার মহিষগুলো ও চারটা যানকে নদী তট থেকে টেনে বের করছে সৈন্যরা এবং রাজ পালকির পিছনে অবসন্ন ভাবে সেগুলো চলতে লাগল যখন ভুয়া ফারাও-এর লোকেরা তাদের রাতের যাত্রা শুরু করল পুনরায়।

এ স্থানটা পেরুতে আরো পাঁচ দিন ও রাত লাগল মিশরের বিশাল সেনাবাহিনীর। প্রথমে রথ বাহিনী, তারপর গুলতিধারী বাহিনী, ধনুকধারী ও বর্শাধারী বাহিনী চলল পর্যায়ক্রমে। ওগুলোর পিছনে এল পদ চলিত দাসদের হাঁটার দল যারা ভবন তৈরি এবং দখলকৃত শহরে দেয়াল ভাঙ্গার কষ্টকর কাজের জন্য ব্যবহৃত হবে। তারপর এল কারিগরেরা যারা রথ তৈরি করবে এবং কাঠ মিস্ত্রিরা, বর্ম ও তীর প্রস্তুতকারকেরা এবং তাদের পর ক্যাম্পের লোকেরা, স্ত্রী-রা, প্রেমিকারা এবং বেশ্যারা তাদের দাসদের চাকরদের ও শিশুদের নিয়ে তাদের অনুসরণ করল। ব্যবসায়ীরা ওয়াগনভর্তি মালপত্র ও বিলাসপণ্য সহকারে চলছে। প্রতিটি সম্ভাব্য জিনিস সৈন্যদের কাছে তারা বিক্রি করবে যখন তারা লুণ্ঠন ও ডাকাতি করে ধনী হবে।

তবুও এই বিশাল বাহিনী থেকে পাহাড়ের উপরের দর্শনার্থীরা দেখল কেউ শুকনো ওয়াদিতে প্রবেশ করল না যেখানে স্বর্ণগুলো সমাহিত। যদিও প্রতিদিন সহীসরা ও সৈন্যবাহিনী কাছেই ক্যাম্প করল তবুও কেউ ওয়াদির কাছে ঘেঁষল না। এমনকি পায়খানা বা ক্যাম্প করার জন্যেও না।

যখন ঐ বিশাল বাহিনীর শেষ রথ অবসন্নভাবে চলে গেল এবং খাতমিয়ার পাথুরে রাস্তা মধ্য দিয়ে উঠে গেল এবং শেষ পথভ্রষ্ট দলটা পর্যন্ত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে গেল তখন পর্যন্ত নেফার ও টাইটা নিশ্চিত ছিল যে আর্মির বেতন প্রদানের কর্মচারীটির দ্বারা রত্নের গাড়ির বাটগুলোর অল্প ওজন আবিষ্কৃত হয় নি।

অবশেষে রাস্তা শূন্য হলে রাতের বেলা তারা পাহাড় থেকে নেমে এল এবং রথগুলো ও ঘোড়াগুলো তারা বাঁধা অবস্থায় ওয়াদির উঁচু তীরে রাখল, দ্রুত পালাতে প্রস্তুত। নেফার ও ম্যারন বালিতটে নেমে গেল এবং চাঁদের আলোয় রত্নের গাড়ি ও প্রাণীগুলোর ফেলে যাওয়া দাগ সহজেই চোখে পড়ল তাদের। কাঠের কোদাল দিয়ে কয়েক বার ঠেলা দেওয়ার পরই ম্যারন খুশিতে শিস দিয়ে প্রথম স্বর্ণের থলেটা টেনে বের করে আনল। যখন তারা গর্ত থেকে প্রতিটি থলে তুলল ও গুনল তখন নিশ্চিত হল যে একজনও তাদের দেখছে না। তারপর তারা ওগুলোকে ওয়াদির তীরে নিয়ে এল, থলেগুলোর ভারে তারা টলমল করছিল এবং অপেক্ষারত রথের পাশে তা সাজিয়ে রাখল। মনোরম ৮০০ চামড়া পূর্ণ থলের সুন্দর স্বর্ণের তূপ করল তারা।

অনেক বেশি! আমরা এগুলোর সব বহন করতে সক্ষম হব না; নেফার সন্দিহান ভাবে বলল।

এটা এই খারাপ দুনিয়ার একটি স্বাভাবিক নিয়ম। টাইটা তার মাথা ঝাঁকালো। স্বর্ণ কখনো বেশি হয় না।

হালকা যুদ্ধের রথ মালামালের গাড়ির ন্যায় তৈরি হয় নি, কিন্তু তারা ওগুলো পূর্ণ করল যতোক্ষণ না অক্ষদন্ড অস্বাভাবিকভাবে ঝুলে পড়ল ও চাকা আর্তনাদ করল, এখনো তারা গাড়িতে তার অর্ধেকও নেয় নি। ঘোড়াগুলোকে তাদের পথ দেখাল, তারা অতিরিক্ত ভরা রথগুলোকে পাহাড়ের মধ্যে নিয়ে গেল, তারপর পরের বার নিতে ফিরে এল। সবগুলো নিতে আরো দুইবার আসতে হল তাদের।

তারা রত্নগুলোকে পাঁচটি সমান ভাগ করল এবং চার ভাগ গোপন স্থানে সমাহিত করল। চিহ্নসমূহ ভালোভাবে ঢাকতে খুব সতর্ক থাকল এবং কোন সংকেত রাখল না। এভাবে যদি একটা ভান্ডার আবিস্কৃতও হয় তবে তারা সব হারাবে না। পঞ্চম ভাগ তারা তেরটা রথে বোঝাই করল এবং নেফার হিল্টোর নেতৃত্বে তাদের গালালায় ফেরত পাঠাল। একবার তারা শহরে পৌঁছলে হিল্টো তখন অবশিষ্টগুলো নিতে ভারি ওয়াগন নিয়ে ফিরবে।

নেফার বাকি তিনটা রথ রেখে দিল। ওগুলো সে নিজে, টাইটা ও ম্যারন চালাবে, দুই দল আলাদা হয়ে গেল। হিল্টো আবার দক্ষিণে বোঝাইকৃত যান নিয়ে এবং নেফার তার ছোট দলটাকে পূর্বদিকে নিচ্ছে–দুই ফারাও এর আর্মির পিছনে।

*

নেফার দিনের বেলা এগিয়ে চলল, জানে যে সেনাদের অনুসরণ করছে তারা ক্যাম্পে বিশ্রাম নিবে এবং দিনের আলোতে সামনে তারা কোন অদৃশ্য বিপদে হঠাৎ পড়বে না।

তারা পাসের মধ্য দিয়ে মালভূমিতে চলছে যেখানে তারা প্রচুর পানি পেল, যদিও এর বেশিরভাগ হাজার হাজার পশু ও লোকজন দ্বারা নষ্ট হয়েছে যারা তাদের সামনে এগিয়ে চলছে। তারা শত শত ক্যাম্পের স্থান পেরোলো, নিভে যাওয়া আগুন ও আশ্রয়ের পালকির অক্ষদন্ড ও ছড়ানো ময়লা দ্বারা যা চিহ্নিত। সেখানে ঘোড়র কবরও ছিল কারণ একদল আর্মি চলার সময় অবিরাম ক্ষয়রোগে ভুগে। কিছু কিছু ইতোমধ্যে হায়েনা ও খেকশিয়াল খুঁড়ে ফেলেছে। মৃত দেহগুলোকে টেনে বের করেছে যার আংশিক পচে গিয়েছে।

আমাদের তাকে প্রয়োজন, একজন তরুণ মহিলার দেহের সামনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নেফার বলল, সম্ভবত সে আর্মিদের বেশ্যার একজন। কি ভাবে মারা গিয়েছে তা বলার কোন উপায় নেই কারণ শকুনগুলো প্রায় তা শেষ করেছে যা হায়ানা শুরু করেছিল। শবটার চোখ ও ঠোঁট নেই এবং খুলিটা তাদের দিকে দাঁত বের করে হাসছে তার রক্তে কালো হাওয়া দাঁতের মধ্য দিয়ে।

প্রভুদের সব ভালোবাসায়, ম্যারন চিৎকার দিল। আপনি কি আপনার সব অনুভূতি হারিয়েছেন? ঐ জিনিসটা চারপাশে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

তাকে ঢাকতে আমাকে সাহায্য কর। নেফার তার প্রতিবাদ উপেক্ষা করল। সে ছেঁড়া লিনেনের এক খন্ড খুঁজে পেয়েছে। এতে ছিন্ন ও নোংরা যে এমনকি বেদুঈনরাও এটা কোন কাজের জন্যে খুঁজে পায়নি যারা আর্মিদের পিছনে খোঁজাখুজি করছিল। তারা দুজনে মৃত মহিলাদের অবশিষ্ট অংশ ধরে উপর তুলল এবং ঠিক ভাবে তাকে আবৃত করল। তারপর তার জোরালো ব্যক্ত বিতৃষ্ণায় সত্ত্বেও বান্ডিলটা মেরেনের রথের পিছনে বাধল তারা।

যদিও তারা ভোর থেকে ধুলোয় ঢাকা রাস্তায় চলছে তবুও পিছনের রক্ষী সেনা দলকে ধরার পূর্বে মধ্য সকাল হয়ে গেল তাদের। সমগ্র অভিযাত্রী সৈন্যরা ইতোমধ্যে ছাউনিতে চলে গেছে এবং রান্নার আগুনের ধূয়া সামনের রাস্তা বরাবর শত শত আলাদা আলাদা ক্যাম্প নির্দেশ করছে।

নেফার তাদের ঘুরানো রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেল। তারা মালপত্র এবং গাড়ি এড়ানোর জন্য ঘুরে এল, রাস্তার দৃষ্টি সীমার বাইরে রইল। সামনে ভালোভাবে দেখে তারা সতর্কভাবে আগ বাড়ছে। ঘটনাক্রমে তারা রত্নের গাড়ির বহরের ও রাজ-স্ত্রীদের পালকির কাছে পৌঁছে গেল যা একটা জলপাই গাছের ঝোপে থামানো। নেফার হামাগুড়ি দিয়ে ওগুলোর কাছাকাছি একটা গাছে উঠল। সেখান থেকে সে লুকিয়ে কাঁটার ঝোপে ঘেরা ক্যাম্পের ভেতর দেখতে পারল। রাণী মেরিকারার তাঁবু হেজারেটের তাঁবুর কাছ থেকে একটু দূরে স্থাপন করা কিন্তু দুই বোন একটা লিনেনের চাদোয়ার নিচে বসে আছে, সূর্য থেকে সুরক্ষিত এবং খাবার খাচ্ছে যা তাদের পরিবেশন করতে দাসীরা মাত্র আগুন থেকে নামিয়ে এনেছে।

তাদের কথাবার্তা শোনার মত কাছে নেফার ছিল না। হেজারেট তার দিকে মুখ বারে বসা, কথা বলছে ও আনন্দে হাসছে। সে আরো সুন্দর হয়েছ যখন শেষ বার নেফার তাকে দেখেছিল তার চেয়েও। এমনকি এ রকম সাধারণ পরিবেশেও সে খুব সতর্ক ভাবে প্রসাধন ব্যবহার করেছে, যাতে তাকে ম্যামফিসের হাহোরের মূর্তির ন্যায় লাগছে। সে দামী অলংকারে সজ্জিত একটা পোশাক পরিধান করেছে এবং তার ঘন কালো চুল সুন্দরভাবে তেল দেওয়া ও কোঁকড়ানো করে বাঁধা। মিশা, লম্বা কালো দাসী মেয়েটি চমৎকার পশ্চাদ্দেশ নিয়ে তার কাঁধের উপর ঝুঁকে আছে তার স্বর্ণের পাত্রটি পূর্ণ করার জন্য। একটু লাল মদ হেজারেটের পোষাকের সামনে ছলকে পড়ে গেল। সে লাফ দিয়ে দাঁড়াল এবং মিশার মাথায় রূপা ও অস্ট্রিচের পালকের পাখা দিয়ে আঘাত করল। মেয়েটি দুহাত দিয়ে মাথা ঢেকে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল কিন্তু তার আঙ্গুলের মধ্য দিয়ে রক্তের ধারা বেরোতে দেখা গেল এই দূর থেকেও। মেরিকারা তার বড় বোনকে থামানোর চেষ্টা করল কিন্তু হেজারেট মিশার মাথায় এক নাগারে আঘাত করে চলল যতোক্ষণ না পাখাটার হাতল দুভাগ হয়ে গেল। তারপর ভাঙ্গা প্রান্তটা মেরিকারার দিকে সজোরে নিক্ষেপ করে গটগট করে চলে গেল সে। হুমকি দিল এবং তার কাঁধের উপর দিয়ে বিশ্রি ভাষায় গালি দিল।

মেরিকারা দাস মেয়েটিকে ধরে দাঁড় করিয়ে নিজের তাঁবুতে নিয়ে গেল। নেফার তেঁতুল গাছে উপরের শাখায় লুকিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছু সময় পর মিশা তার মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে তাঁবু ত্যাগ করে কাঁদতে কাঁদতে গাছ পালার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। নেফার নড়ল না, যতক্ষণ না তার তাঁবুর প্রবেশ দ্বারে দৃশ্যমান হল মেরিকারা।

শেষবার যখন তারা কথা বলেছিল নেফার তখন তাকে যে কোন কাজ করতে ও কাছে আসার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছিল। এখন সে তার চারপাশে সতর্কভাবে দেখল তাবুর দরজায় দাঁড়ানো রক্ষীর সাথে কথা বলল এবং ঘোরাঘুরি শুরু করল, দৃশ্যত কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই ক্যাম্পের পরিধির চারপাশে। পরিষ্কার ভাবে সে নেফারের নির্দেশনা গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে এবং ঝোঁপের চতুর্দিকে তার উদ্ধারকারীকে এক ঝলক দেখার জন্যে খুঁজছে। একমাত্র সে-ই নড়াচড়াকারী ব্যক্তি; অন্যরা বেশির ভাগ সূর্য ও তাপ থেকে আশ্রয় নিচ্ছে এবং এমনকি রক্ষীরাও তার প্রতি মনোযোগ দিল না।

নেফার তার থলে থেকে একটা ছোট রূপার পলিশ করা আয়না হাতে তুলে নিল, সূর্যের প্রতিফলন দেখাল। মেরিকারা সাথে সাথে থেমে গেল, চোখের উপর হাত রেখে আলো আসার পথে চোখ সরু করে তাকাল। নেফার আরো তিনবার করল তা। পূর্ব কথিত সংকেত এবং সে এমনকি এতো দূর থেকেও তার হাসিটা দেখল যা সূর্যের রশ্মির মতই উজ্জ্বল, যা তার মনোরম চেহারায় নৃত্য করে উঠল।

*

মেরিকারা দুল্যমান নৃত্যরত পালকিতে রাজ হাঁসের পালকের কুশনে শুয়ে আছে। পাশেই একটা গালিচার উপর মিশা তার পায়ের কাছে একটি ঘুমন্ত কুকুরের ন্যায় দেহটা বাঁকিয়ে কুকড়ে আছে, কিন্তু সে জাগ্রত ও সচকিত ছিল। পালকির পর্দাটা কতক উঠানো যাতে রাতের ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকতে পারে। সে সেনাদের কুচকাওয়াজের শব্দ শুনছিল: খুরের ঠনঠন শব্দ, ওয়াগনের কড় কড় ও ঝন ঝন শব্দ, গাড়িটানা ষাঁড়গুলোর ডাকাডাকি, ওয়াগনের যাত্রীদের কান্না এবং পালকির পাশে রক্ষীদের ভারি পদ শব্দ মিলে মিশে একাকার। হঠাৎ সামনে হৈ চৈ বাধল, চাবুকের শাই শাই ও আকস্মিক তীক্ষ্ম শব্দ ভেসে এল। পাথরে চাকার ঠুকনো শব্দ, বয়ে চলার পানির আওয়াজ এবং পশুগুলোর চলায় ওখানে ছল ছলৎ শব্দ হচ্ছে। তখন মেরিকারা তার বোনের ঝগড়াটে কণ্ঠ শুনল, ওখানে কি! কি হচ্ছে?

মহারাণী, আমরা একটা ছোট ঝর্ণা পার হচ্ছি। আমি আপনার কাছে অনুনয় করছি নামার জন্য, নাইলে পালকি উল্টে যাবে। আপনার নিরাপত্তাই আমাদের লক্ষ্য।

সে শুনল হেজারেট তিক্ত ভাবে এই বিড়ম্বনার জন্য অভিযোগ করছে এবং মেরিকারা এই মতানৈক্যের সুযোগ নিল। সে মিশাকে ফিসফিসিয়ে তার শেষ নির্দেশনা দিল। তারপর পালকি থেকে নামল তারা। দাসরা প্রদীপ নিয়ে নদীর তীরে পথ দেখাতে অপেক্ষা করছিল, হেজারেট ইতোমধ্যে সেখানে অপেক্ষা করছে।

আমি ঘুমাচ্ছিলাম এমন সময় তারা আমাকে জাগাল, সে মেরিকারাকে বলল। আমি এই আনাড়ি ক্যারাভান চালকটার নামে আমার স্বামী উচ্চ মিশরের ফারাও এর কাছে রিপোর্ট করবো।

আমি নিশ্চিত এটা তোমার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হবে, তার পিঠ থেকে ছাল তুলে ফেলাটা, মেরিকারা সম্মত হল, মিষ্টি উপহাস সহকারে। হেজারেট তার মাথা দুলালো ও ঘুরে গেল।

ঐ মুহূর্তে একটা নাইটিংগেল আমি ডাক দিয়ে উঠল উজান থেকে। মেরিকারা শব্দটায় কেঁপে উঠল। ছোট থাকতে নেফার তাকে এই ডাকটা ও পাখির গান কিভাবে অনুকরণ করতে হয় তা শিখাতে বহুবার চেষ্টা করছে, কিন্তু সে কখনো তা শিখতে পারে নি। পাখিটা তিনবার ডাকল, কিন্তু একমাত্র সে তা লক্ষ্য করল। অন্যরা তখন বেঢপ পালকিগুলো পারাপার করতে ব্যস্ত। তাদের সামনের হাজার হাজার যান জলাভূমির তলদেশে আটকে আছে এবং পারাপার শেষ হতে মধ্যরাত পেরিয়ে গেল এবং তারা শেষ রত্নের গাড়িটা সজোরে টানছে পাড়ে উঠানোর জন্য। জোরে টান দাও! আদেশ ও চাবুকের তীক্ষ্ণ আওয়াজ অন্য তীরের উপর আছড়ে পড়ল।

তখন ক্যারাভানের প্রধান রাজ স্ত্রীদের জন্য দুটি বহনকারী বিশাল চেহারার চেয়ার নিয়ে এল। তারা আসনে বসল এবং দাসদের দল তাদের বয়ে নিল। যখন তারা অন্য তীরে পৌঁছল তখন সেখানে আরো হৈচৈ ও দ্বিধা জমে উঠল কারণ একটা রত্নের গাড়ির চাকা হারিয়েছে এবং সামনের রাস্তা আটকে দিয়েছে। এই দুর্ঘটনার ধাক্কায় দাসরা যারা হেজারেটকে বহন করছিল কিছুটা ভারসাম্য হারাল। ফলে চেয়ারের পাদানি উপচে পানি তার পায়ের উপর দিয়ে বয়ে গেল যা তার স্যান্ডেল ভিজিয়ে দিল। হেজারেট তখন জোরালো ভাবে আদেশ করে বলল যেন ঐ দাসদের ওখানেই শাস্তি দেওয়া হয়। কর্ম সর্দারের চাবুকের আওয়াজ ও দুরাচারীদের আর্তনাদ ও চিৎকার চেঁচামেচির সাথে যোগ হলো।

এগুলো ছাপিয়ে মেরিকারা আবার নাইটিংগেল-এর ডাক শুনল এইবার আরো নিকটে এবং ঝর্নার একই পাশে। আমাকে নিরাশ করো না, সে মিশাকে বলল।

আমার জীবন আপনার, মালকিন। মেয়েটি উত্তর দিল এবং মেরিকারা তাকে চুমু খেল।

তুমি তা আগেও প্রমাণ করেছ এবং আমি তা কখনও ভুলব না। সে মিশার কাছ থেকে ঘুরল এবং শান্ত ভাবে অন্ধকারে হাঁটা শুরু করল।

শুধুমাত্র হেজারেট তাকে একটু লক্ষ্য করল। তুমি কোথায় যাচ্ছো, মেরিকারা?

খারাপ পরীদের তাড়াতে। তাদের শিশুকালের সুভাষণ ব্যবহার করল মেরিকারা। হেজারেট আর কিছু না বলে পাদানিতে পা রেখে তার নিজের পালকিতে চড়ল এবং পর্দা টেনে দিল।

রাস্তা থেকে আড়াল হতেই মেরিকারা থেমে তার নিজের অদক্ষ পাখির ডাক দিল। তৎক্ষণাৎ একটা শক্ত হাত তার ঊর্ধ্ব বাহুটা ধরল এবং তার ভাইকে তার কানে ফিসফিস করে বলতে শুনল, দোহাই থাম, ছোট্ট সোনামণি। এখান থেকে বীরসেবা পর্যন্ত সকল নাইটিংগেলকে দেখছি তুমি ভয় পাইয়ে দেবে।

সে ঘুরে তার সব শক্তি দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল ও এতো আবেগ আপ্লুত হয়ে গেল যে কোন কথা বলতে পারল না। আলতোভাবে নেফার বন্ধনটা খুলে তাকে অন্ধকারে নদীতে নিয়ে চলল। নেফার দ্রুত চলছিল এবং শব্দ না করে। মনে হল তার বুঝি সিংহের ন্যায় রাতের দৃষ্টি আছে কারণ সে কখনো হোঁচট খেল না বা ইতস্তত করল না। সে কোন কথা বলছিল না শুধুমাত্র ফিসফিসিয়ে মাঝে মাঝে সতর্ক করছিল যখন কোনো গর্ত বা বাধা এল রাস্তায়। মেরিকারা তাকে অন্ধের মত অনুসরণ করে গেল। অর্ধরাতের পর সে থামল তাকে বিশ্রাম দিতে।

মিশা কি জানে কি করতে হবে? নেফার জিজ্ঞেস করল। সে পালকির পর্দা বন্ধ রাখবে এবং জিজ্ঞেস করলে সবাইকে বলবে যে আমি ঘুমাচ্ছি এবং বিরক্ত হতে চাই না। কেউ জানবেই না যে আমি চলে গেছি।

যতোক্ষণ না তারা কাল থামছে; নেফার শুধরে দিল। আমাদের মাত্র ওটুকু সময়ই আছে পালানোর জন্য। তুমি চলার জন্যে প্রস্তুত? আমাদের এখানে নদী পার হতে হবে।

খুব সহজে সে তাকে কোলে তুলে বহন করে পার করল। মেরিকারা তার ভাই কতটা শক্তিশালী হয়েছে দেখে অবাক হয়ে গেল। তার হাতে তাকে একটা পুতুল মনে হচ্ছিল। বিপরীত পারে তাকে সে নামালো এবং তারা চলতে লাগল আবার। একটু পর সে তার নাকে হাত দিল। ঐ জঘন্য গন্ধটা কিসের? সে বিতৃষ্ণা নিয়ে জিজ্ঞেস করল।

এটা তুমি; নেফার তাকে বলল। এমন একজন যে তোমার স্থলাভিষিক্ত হবে। কথাটা শেষ হওয়ার পূর্বে দুটি কালো অবয়ব তারার আলোয় তাদের সামনের পথে পা বাড়িয়ে বেরিয়ে এল এবং মেরিকারা ভয়ে একটু আওয়াজ করে উঠল।

এরা টাইটা ও ম্যারন, তাকে নিশ্চিত করতে বলল নেফার। তারা তাকে ছোট ছোট গাছের ঝোঁপের মধ্যে নিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেল। তারপর নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে ম্যারন লিলেনে ঢাকা শবটা খুলল যা সে বহন করছিল? ক্ষীণ হলুদ আলোয় মেরিকারা বিভীষিকাময় বস্তুটি মাটিতে ছড়িয়ে থাকতে দেখে নেফারকে ভয়ে আঁকড়ে ধরল। একটা মৃত দেহ এতো ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে বলা মুশকিল এটা কোনো মানুষ এবং মহিলা।

এখন দ্রুত? নেফার তাকে বলল। তোমার সব গহনা ও কাপড় আমাকে দাও।

মেরিকারা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে সবকিছু নেফারের হাতে তুলে দিল। পরিবর্তে টাইটা অতিরিক্ত এক প্রস্ত কাপড়, জামা, স্কার্ট ও স্যান্ডেলের একটা বান্ডিল দিল তাকে।

নেফার মরদেহটার পাশে হাঁটুগেড়ে বসে মৃত মেয়েটার গলায় নেকলেসের সূতা বাধল এবং আংটি ও চুরিগুলো কংকালসার আঙ্গুল ও কব্জিতে পড়িয়ে দিল। সে মেরিকারার স্কার্ট ও নিতম্বের পোশাক ওটার শক্ত পায়ে পরাতে পারল না। অগ্যতা সে তা ছিঁড়ে ময়লা মাখাল। তারপর সে তার নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল ছুরি দিয়ে কাটল এবং সুন্দর কাপড়ের উপর সতেজ রক্ত ঝড়ালো। নিকটে থাকা ক্ষুধার্ত হায়েনা দলের সমোচ্চারিত চিৎকার ও ডাকাডাকি ভেসে এল সাথে সাথে তখন।

মেরিকারা কেঁপে উঠল। তারা দেহটার গন্ধ পেয়েছে।

তারা নাজাকে বিশ্বাস করানোর জন্য খুব অল্পই প্রমাণ রেখে যাবে। সবাই ভাববে যে তোমাকে বন্য পশুরা খেয়ে ফেলেছে। সে উঠে দাঁড়াল। এখন আমাদের যেতে হবে।

ঝর্ণার উজানে একটু দূরে রথগুলো অপেক্ষা করছিল। নেফার তাদের চিহ্ন মৃত মেয়েটার দেহের কাছাকাছি ফেলে যেতে চাইল না। সে মেরিকারাকে তার পাশে পাদানিতে তুলে পূর্ব দিকে তাকাল। ভোরের তারা, সে শান্ত ভাবে বলল। এক ঘণ্টার মধ্যে আলো ফুটবে। আমরা বাকি অন্ধকারে দ্রুত এগিয়ে যাবো।

যখন উষা ফুটল, গোলাপ ও মিষ্টি হলুদ ফুলের সুবাস তাদের পিছনের আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। তারা তখন মালভূমির ঢালে অর্ধেক পথ নিচে নেমে গিয়েছে এবং তাদের নিচে মরুভূমি ছড়িয়ে আছে বিস্তৃত প্রান্তর জুড়ে।

এ এমন মহিমান্বিত দৃশ্য যে না চাইতেও তারা ঘোড়ার লাগাম টানল এবং শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয়ে সোনালি বালুর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল অপলক দৃষ্টিতে, ম্যারন ছাড়া বাকি সবাই। বাতাসে যারা প্রভুদের সান্নিধ্য পেতে অর্ধ পৃথিবী জুড়ে ভ্রমণ করেছে তাদের নামে সে পূজা করল। তারপর মেরিকারার দিকে তাকিয়ে রইল যে প্রথম রথে তার ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। দীর্ঘ রাতের যাত্রায় সে তার কাছ থেকে অন্ধকার দিয়ে লুকানো ছিল। কিন্তু এখন সকালের সূর্য তার উপর পড়তেই সে তাকিয়ে রইল মুগ্ধ নয়নে। সে তার জীবনের বেশির ভাগ সময় তাকে জেনেছে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, দুষ্ট বালিকা হিসেবে। দুই বছরের মধ্যে এই প্রথমবার সে তার দিকে দৃষ্টি দিল। সময় তার মাঝে এক অলৌকিক পরিবর্তন এনেছে। এখন প্রতি মুহূর্তে তার প্রতিটি নড়াচড়া ও তার মাথার প্রতিটি ঘূর্ণন মাধুর্যময়। তার চেহারার কোনো অংশ সরু, দেহের প্রতিটি বাঁক মনোরম। তার ত্বক ক্রিম ও মুক্তার ন্যায়। তার চোখ যে কোন পান্নার চেয়ে সবুজ ও উজ্জল। তার কণ্ঠ ও হাসি সবচেয়ে মনোহরিণী সঙ্গীত যা সে এ পর্যন্ত শুনেছে।

টাইটা তার অভিব্যক্তি ধরল এবং মনে মনে হাসল। এমনকি সবচেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতিতে জীবন নিজেকে নতুন করে লড়াই করতে শেখায়, সে ভাবল। তারপর উচ্চস্বরে বলল, মহামান্য! আমাদের এখানে দেরি করা ঠিক নয়। ঘোড়াগুলোর পানি দরকার।

পাহাড়ের পাদদেশে তারা প্রধান সড়ক ছেড়ে দক্ষিণে বিশাল তিক্ত হ্রদ বরাবর রওনা দিল। তারা চলতে থাকল যততক্ষণ না তারা প্রথম পানি পাত্রের গুপ্ত ভান্ডারে এসে পৌঁছল যা তারা তাদের ফিরতি যাত্রার জন্য ফেলে গিয়ে ছিল এবং দেখল হিল্টো সেখানে ছিল তাদের পূর্বে। তার রথের দাগ থেকে তারা বলতে পারল যে তার রথগুলো স্বর্ণের বাটে বোঝাই ফলে খুব ধীরে তা চলছে এবং সে সামনে খুব বেশি দূরে নয়।

তারা স্বস্তি পেল যে সে সব পানি শেষ করেনি বরং চারটা জার অস্পর্শ রেখেছে যা তাদের ঘোড়াগুলোর জন্যে যথেষ্ট। এ দিয়ে তারা পরবর্তী মরুদ্যান যিনাল্লাতে পৌঁছতে পারবে।

যদিও মেরিকারা নেফার ও টাইটার সংস্পর্শে উৎফুল্ল ও প্রাণবন্ত ছিল, কথা বলল ও হাসি তামাশা করল তবুও সে কোন কারণে ম্যারনকে খেয়াল করল না অথবা তার দিকে তাকাল না। যখন সে বুঝল যে তা করা নিরাপদ চুপিসারে একবার তার দিকে চোখ তুলে তাকাল। যদিও তা বেশিদিন আগে নয় সে তাকে প্রভুত্বের তাচ্ছিল্য নিয়ে বিবেচনা করেছে, তবুও ম্যারন এখন খুব দমিত তার সাথে সরাসরি মুখোমুখি হতে। কারণ সে হল রাণী, যদিও হোক না ভূয়া: ফারাও এর। এখন তার চোখে সে কমপক্ষে একজন দেবী।

এক শত বার হবে তারা থেমেছে আর এখন সে নিজেকে তার দিকে সরাসরি নিষ্পাপভাবে চোখ রেখে ছড়ানো একাসিয়া গাছের অপ্রতুল ছায়ায় বিশ্রাম নিল। এবার মেরিকারা তার দিকে চোখ তুলল এবং মাথা বাঁকাল। তখন একটা রাজকীয় আনুগত্য প্রকাশ করল ম্যারন। অভিবাদন মহারাণী, আমি আনন্দিত আপনাকে নিরাপদ দেখে। আমি আপনার নিরাপত্তা নিয়ে মারাত্মক ভাবে চিন্তিত ছিলাম।

সে তার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল, খুঁজল ও হিসেব করল তার বর্ধিত উচ্চতা এবং তার কাঁধের আত্মবিশ্বাসী শক্তিশালী গঠনটা। সে দেখল তার চুল কত ঘন ও বড় হয়েছে। এই দিনে শুধু এ প্রথমবার নয় সে তার শ্বাস-প্রশ্বাসে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা খেয়াল করল। ম্যারন ক্যামবাসিয়েস, তার গলা কেঁপে উঠল;

শেষ বারের হিসেবে তোমার সাথে আমার একটা লেনদেন বাকি আছে। তুমি আমার প্রিয় ঘুড়িটা ভেঙে দিয়েছিলে। আমি কি আবার তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি?

আপনার জীবন দিয়ে। সে আন্তরিক ভাবে বলল।

*

ঘোড়াগুলো ক্লান্ত ছিল ও বিশ্রাম নিল। চলার সময় হলে মেরিকারা তার ভাইকে আকস্মিকভাবে বলল, তোমার ঘোড়াগুলো সারারাত আমার অতিরিক্ত ওজন বহন করেছে। আমার মনে হয় আমার এখন তাদের মুক্তি দেওয়া উচিত।

তুমি তা কিভাবে করবে? তাকে হতভম্ভ দেখাল। আমি অন্য রথে চড়ব, সে বলল এবং যেখানে ম্যারন তার জন্য অপেক্ষা করছিল সেখানে গেল।

পরের দিন তারা যিনাল্লার মরুদ্যানে পৌঁছাল এবং সেখানে হিল্টোর দলটা তাদের আগে গিয়ে অবস্থান নিয়েছে। এবার নেফার রথের মধ্যে লোকজন ও বাটগুলো সমানভাবে ভাগ করে দিল এবং তারা আরো ভালো গতিতে গালালার দিকে এগিয়ে চলল তখন।

*

মিনটাকা হাথোর মন্দিরের ছাদের উপর ছিল, যা সে এবং আরো কয়েকজন মহিলা ও কয়েক জন বৃদ্ধ লোক মিলে দেবীর জন্যে তৈরি করেছে যাতে তারা তার উপস্থিতিতে তাদের পূজা করতে পারে। ভবনটা হয়তো হাজার বছরের পুরানো হবে, নির্ণয় করার কোন রাস্তা নেই। অনেকগুলো প্রাচীর চিত্র তখনও চমৎকার অবস্থায় ছিল এবং শুধুমাত্র একটু কষ্ট করে তা উপরে উঠানোর দরকার। ছাদটা ছিল আরেক চিন্তার বিষয়। যাহোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উপাদানগুলো দিয়ে খুব ভালোভাবেই দেয়ালের বড় গর্তগুলো ঢাকা গেল। শুধু পচা কাঠের তূপগুলো সরানোর দরকার ছিল যা পূজারীদের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে। মিনটাকা এই কাজের দেখাশুনা করল। সে অন্য মহিলাদের মত সাধারণ কাপড় পরিধান করেছে যা ছিল খুব পুরানো এবং তাদের মত সেও রোদে পুড়ে বাদামী হয়ে গিয়েছে। এই জীবনটা তার রাজকীয় যাপন থেকে অনেক আলাদা এবং সে তার নতুন স্বাধীনতা ভালোই উপভোগ করছে। বিশেষ করে তার নতুন সাধারণ সঙ্গীদের বন্ধুত্ব ও সহচার্যে।

অনভ্যস্ত কাজের ফাঁকে তার ব্যথিত পিঠটা সোজা ও প্রসারিত করে সে উঁচু দেয়ালের উপর সহজভাবে নিজের ভারটা সামলালো, তারপর চোখের সামনে ছায়া দিয়ে নতুন শস্য ক্ষেতের উপর দিয়ে দূরে তাকাল এবং সেচের গর্তের প্যাটার্ণগুলো টাইটার ঝর্ণার পানিতে ঝিকমিক করতে দেখল যা পানিতে পূর্ণ। গরুর পাল ও মোটা লেজের এক পাল ভেড়া সবুজ ছোট মাঠে ঘাস খাচ্ছে কিন্তু খুব অল্প কয়েকটি ঘোড়া সেখানে রয়েছে। গালালার অন্য প্রতিটি মানুষের মতো সেও এই অপূর্ণতা খুব গভীরভাবে অনুভব করল।

সেই সাথে তার অতিক্রান্ত দীর্ঘ ও নিঃসঙ্গ দিনগুলোর প্রতিটি মুহূর্তও ছিল যখন থেকে নেফার শহর ছেড়েছে। সে চোখ ফিরিয়ে নিচের উপত্যকায় তাকাল, শূন্য নিষিদ্ধ পাহাড়গুলোর মধ্যে ওটা শহরের চারপাশের ঝাঁক বাঁধা সবুজ মঠের সাথে বিষণ্ণভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এ হল সেই পথ যে দিক দিয়ে নেফার আসবে। কোন আশা ছাড়াই সে নীল দূরত্বটা পরিমাপ করল, সে সম্প্রতি প্রায়ই হতাশ হয়ে যায়।

হঠাৎ আলোর ঝলকানির বিপরীতে সে তার চোখ সরু করল এবং তার হৃদ্স্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল। কিছু একটা সেখানে আকাশের অনেক উঁচুতে বিশালত্বের বিপরীতে ক্ষুদ্র বাতাসে ভাসমান একটা পালকের মতো অলীক ও বায়বীয় একটা ধুলোর শয়তান ঝলক তুলল, সম্ভবত একটা বাওকুড়ানী মরুর গরম বাতাসে সৃষ্টি হয়েছে।

সে অন্য দিকে তাকাল এবং তার ঘনকালো ভ্রু থেকে ঘাম মুছল, চোখগুলোকে বিশ্রাম দিতে। তারপর পুনরায় তাকালে ধুলার মেঘটা আরো নিকটে মনে হল এবং সে আশায় বুক বাধল। সেই সময়ে র‍্যাম বাঁশি সতর্ক করতে জোরে একবার বেজে উঠল। পাহাড়ের চূড়ার প্রহরীরাও এটা দেখেছে। তার আশপাশের অন্যরা কাজ থামিয়ে তখন উপত্যকায় উঁকি দিল। নিচের রাস্তা থেকে ছেলেমেয়েদের উত্তেজিত চিৎকার এল, বধূরা দৌড়ে ঘরে গেল, রথীরা বাজারের বাইরে যেখানে তাদের যান ছিল সেখানে চলল। সবাই সুখের উত্তেজনায় কর্মব্যস্ত।

মিনটাকা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে উঁচু বেদি থেকে নেমে এল যা মন্দিরের বাইরের দেয়াল ঢেকে আছে। বাগানের ফল চোর ধরতে যেমন ব্যস্ত তেমন ব্যস্ততায় সে দৌড় দিল। শাবাকো ট্যানোসের যুদ্ধ স্মৃতিসৌধ পেরিয়ে প্রধান ফটকের দিকে তার রথ দ্রুত চালাচ্ছে।

শাবাকো! সে দৌড়ে তাকে ধরতে গেল। শাবাকো তার সাথে সাক্ষাৎ করতে এক পাশে সরে এল এবং সে থামাতেই মিনটাকা পাদানিতে তার পিছনে লাফিয়ে উঠল। তারা দ্রুত ফটক দিয়ে প্রবেশ করল, চাকার দাগের পথ দিয়ে।

এটা কি তারা, শাবাকো? বল আমাকে, তারা কি?

আমি তাই বিশ্বাস করি মহামান্য, সে চিৎকার করে বলল, বাতাসের গতি ছাড়িয়ে।

তাহলে তুমি এতো ধীরে চলছো কেন?

তাদের সম্মুখের ছোট পাহাড়ে একটা যান দেখা গেল। মিনটাকা ড্যাশ বোর্ডে ঝুঁকে রথীকে চেনার চেষ্টা করল, কিন্তু সে তখনো অনেক দূরে।

দেখুন মালকিন! সে নীল ছোট পতাকা উড়াচ্ছে। শাবাকো রং করা কাপড়ের একটা টুকরোর দিকে নির্দেশ করল যেটা রথের উপর একটা লম্বা বাঁশের উপর পড়ে দুলছে।

এটা নেফার! ওহ্ দেবীকে সকল প্রশংসা, এটা সে!

মিনটাকা তার মাথার কাপড় টেনে খুলে তা নাড়ালো। নেফার দ্রুত গতিতে চলে এল তার কাছে।

আমাকে নামতে দাও! সে শাবাকোর কাধ ধরে বলল, তার আদেশ জোরালো করার জন্য। তার ঘোড়াগুলো দুলকি চালে ধীর করল শাবাকো। মিনটাকা রথটা থামার আগেই লাফ দিল। তারপর সে তার দুই বাহু প্রসারিত করে দৌড় দিল এগিয়ে আসা রথের সাথে সাক্ষাৎ করতে।

পিছনে আসতে আসতে টাইটা ভাবল যে তার ব্যাকুলতায় নেফার হয়তো রথটা থামাবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে সরে এল এবং যখন রথটা গতি হারাল সে ককপিটের পাশ দিয়ে অনেক খানি ঝুঁকে গেল এবং মিনটাকার জন্যে হাত বাড়াল, বিশ্বস্তভাবে সেও নিজেকে তার বাহুর বৃত্তে নিক্ষেপ করল। যদি সে ইতস্তত করত বা পিছিয়ে যেত তবে সে ছুটন্ত ঘোড়াগুলোর নিচে পিষ্ট হত অথবা ধাতুর চাকার নিচে পড়ত নিশ্চিত। কিন্তু সে তাকে ধরে তুলে নিল, তাকে উঁচু করে দুলালো এবং সেও তার বাহুতে হাসল।

*

নেফার পুরানো শহরের মঞ্চে তার সভাসদদের সমাবেশ ডাকল এবং তাদেরকে সব কিছু বিস্তারিত বর্ণনা দিল। সে রত্নের গাড়ি থেকে বাটগুলো তোলার বিস্তারিত বর্ণনা করল এবং ব্যাকুলভাবে তা শুনল সবাই। তারপর সে তাদের নিকট মেরিকারাকে উপহার দিল এবং বিবৃত করল কিভাবে তাকে নাজা ও টর্কের নাকের ডগা দিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে। তারা চিৎকার করে উঠল তখন,বাক হার! এবং তাকে সম্মান জানাতে উঠে দাঁড়াল।

তারপর নেফার অনুলেখকদের ডেকে তার সভাসদদের সামনে স্বর্ণের বাটগুলো মাপল একে একে। শেষ গণনা হল অর্ধ লাখের বেশি, আমার লর্ড! আমরা যা অর্জন করেছি তা এর মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ। হিল্টো অবশিষ্টগুলো নিরাপদে আনতে ওয়াগন নিয়ে যাবে। সে আগামীকাল যাবে কিন্তু তার সাথে যাওয়ার জন্য লোক দরকার।

মনে হল গালালার প্রতিটি সক্ষম দেহ স্ব-ইচ্ছায় যেতে উদ্যমী, কিন্তু যখন শাবাকো এবং সর্বাধিক পরিক্ষিত ও অভিজ্ঞ যোদ্ধাদের বাদ দেয়া হল তখন তারা তিক্ত প্রতিবাদ করল। ফারাও কি আমাদের এখানে এই গালালায় বসিয়ে রাখবেন বৃদ্ধ মহিলাদের মতো ঘরে বসে স্বপ্ন দেখতে? শাবাকো জিজ্ঞেস করল।

নেফার হাসল। আপনাদের জন্য আমার কাছে আরো কঠোর কাজ আছে। কিন্তু এখন অনেক বেলা হয়েছে এবং একটা বিজিত ভোজ আমাদের জন্য প্রস্তুত। আমরা শীঘ্রই যুদ্ধ সভায় মিলিত হবো, আমি এ ব্যাপারে আপনাদের আমার কথা দিলাম। সে তাদের নিশ্চিত করল এবং সভা ভেঙ্গে দিল। তারা ক্ষোভে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল, কিন্তু তাদের মেজাজ আবার পুনঃজ্জীবিত হল নতুন তৈরি সতেজ মদের প্রথম পত্র পান করার পর।

নেফার দুটি বলদ ও এক ডজন নাদুস নুদুস ভেড়া জবাই করার আদেশ দিয়েছে এবং তার ফেরার পর থেকে মহিলারা একটা উজ্জীবিত ভোজ প্রস্তুত করতে প্রতিটি মিনিট ব্যয় করেছে। শহরের প্রতিটি পুরুষ ও মহিলাদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে এবং এমনকি পাহাড়ের চূড়ার দূর্গ ও দর্শন স্থানের প্রহরীদেরও তাদের অংশ পাঠানো হল। ঝর্ণাটা খনন করার মতই স্বর্ণ জেতাটা একটা অর্জন ছিল যা পুরো গোত্রটাকে আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।

এই উপলক্ষ্যটা স্মরণীয় করার জন্য টাইটা একটি বীরত্বগাঁথা কবিতা লিখল এবং তার সকল সৃজনশীল কাজের ন্যায় এটাও একটা নিদর্শন, মোহিত সফলতা হল। যখন সে শেষ করল তারা তাকে বসতে দিল না, বরং চিৎকার করে ও তাদের পাত্র টেবিলে বাজিয়ে তাকে আরো ৬০ লাইন পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য করল সবাই। তখনই তারা পুরো মহাকাব্যটা মুখস্থ করল এবং সঙ্গীতজ্ঞরা এর একটা সুর দিল সাথে সাথে। সবাই মিলে বিশুদ্ধ আনন্দে তৃতীয় ও শেষ পরিবেশনায় যোগ দিল।

তারপর নেফার যে কোন একজন নাগরিককে যে বক্তৃতা দিয়ে চায় দাঁড়াতে আহ্বান জানালো। বক্তৃতায় কিছুটা অসংলগ্ন ছিল কিন্তু ভালোভাবেই গৃহীত হল, অন্যরা আনন্দে উদ্বেল ছিল অথবা এতো মর্মভেদী ছিল যে অধিকাংশ মহিলা ও অনেক পুরুষ পর্যন্ত আবেগে কাঁদল। এই আবেগে আপ্লুত পরিবেশে মেরিকারা মিনটাকার কোলে মাথা রেখে তার ভাইয়ের সাথে কথা বলল। তাদের চারপাশের হট্টগোল এতো বেশি ছিল যে শোনানোর জন্য তাকে তর কণ্ঠ উঠাতে হল। রাজকীয় ও মহান ভাই। সে তাকে খোঁচা মারল কারণ সেও মদের উপাদান কিছুটা পরীক্ষা করে দেখেছে। আমি তোমার কাছে ছোট্ট একটা জিনিস চাই।

ছোট্ট বোন, কেউ আর ক্ষুদ্র নেই, তোমার যা খুশি চাও এবং যদি তা আমার ক্ষমতার মধ্যে হয় তবে তুমি তা পাবে।

এটা সম্পূর্ণ তোমার ক্ষমতার মধ্যে। সে বোকার মতো বলল। নিচে টেবিলে ম্যারনের দিকে সে তাকাল। তার উৎসুক দৃষ্টি তখন তার উপর নিবদ্ধ। সে তার চোখ নামাল এবং আবেগের গোলাপী আভায় লাল হয়ে গেল। তুমি জান যে শিশু বয়স থাকতেই আমার বিয়ে হয়েছিল আমার সম্মতি ছাড়া ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আমি চাই তুমি আমাকে মুক্ত করে দাও যাতে আমি আমার নিজের পছন্দের স্বামীর কাছে যেতে পারি। এটা হবে আমার জন্যে সবচেয়ে দামী উপহার যা তুমি আমাকে কখনো দিয়েছে।

তা কি সম্ভব? নেফার তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হয়ে গেল, এবং টাইটার দিকে তাকাল। তা কি আমার ক্ষমতার মধ্যে যে কোন স্বামী ও স্ত্রীকে আলাদা করে দেবো প্রভুদের সম্মুখে?

তুমি ফারাও, টাইটা উত্তর দেওয়ার পূর্বেই মেরিকারা বলে উঠল। ঠিক যে ভাবে টর্ক মিনটাকাকে তালাক দিয়েছে, সে ভাবে তুমি আমাকে নাজা থেকে আলাদা করতে সক্ষম।

টর্ক মিনটাকাকে তালাক দিয়েছে? নেফার জানতে চাইল, এতো তীক্ষ্মভাবে যে যারা শুনল চুপ হয়ে গেল।

তুমি কি জান না? মেরিকারা প্রশ্ন করল। ক্ষমা করো, তোমার কাছে এরকম সাধারণ ও অচিন্তনীয়রূপে প্রকাশ করার জনে। আমি ভেবেছিলাম এরকম স্মরণীয় সংবাদ এখানেও পৌঁছে গেছে। নেফার মিনটাকার হাত ধরল ও তার মাথা নাড়ল এতোটাই আবেগাপ্লুত যে কথা বলতে পারল না। মেরিকারা প্রাণবন্ত হয়ে বলে চলল, ওহ, হ্যাঁ! তার নিজের পবিত্র দিনে তার নতুন মন্দিরে ফারাও টর্ক একটা ভেড়া বলি দিয়ে তিনবার উচ্চারণ করেছে, আমি তাকে তালাক দিলাম। মেরিকারা হাততালি দিল। এবং প্রমাণিত! ভয়ংকর কাজটা শেষ।

নেফার মিনটাকাকে আরও একটু তার কাছে টেনে নিল এবং টাইটার দিকে তাকাল। বৃদ্ধ লোকটি আইনটা যে কোন মিশরের অনুলেখকদের চেয়ে ভালো জানে এবং নেফারের নীরব জিজ্ঞাসায় সে নিরবে মাথা ঝাঁকাল।

মেরিকারা কথা বলেই চলছিল। অবশ্যই, সঙ্গে সঙ্গে তালাকের পর সে আরেকটা ভেড়া বলি দিল এবং ব্যভিচার ও প্রভুদের বিরুদ্ধে অসদাচরণ করার জন্যে মিনটাকাকে মৃত্যুদন্ড দিল।

নেফার ঘুরে মিনটাকার চোখের গভীরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সেও তাকিয়ে রইল, তারা মেরিকারার প্রকাশিত তথ্যটা বিবেচনা করতে লাগল। ধীরে ধীরে নেফারের চেহারায় একটা অদ্ভুত অভিব্যক্তি ছড়িয়ে পড়ল, একজন দোষী ব্যক্তির ন্যায় তার দন্ডাদেশটা শুনে। তুমি মুক্ত আমার, ভালোবাসা। সে বলল, এবং তোমার স্বাধীনতা আমাকেও মুক্তি দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *