ক্যাম্প-বেডের উপর বসে আছে গ্যারি। ফার্স্ট এইড বক্স থেকে মলম নিয়ে ওর ক্ষতের উপর লাগিয়ে দির বেলা। শনে’র ঘুসি খেয়ে গ্যারির হাত আর উর্ধাঙ্গে জিরাফের মতো দাগ পড়ে গেছে। ফুলে ঢোল হয়ে গেছে নাক আর ঠোঁট।
“মনে হয় ভালই হয়েছে” হেসে ফেলল ইসাবেলা, “আগে তোমার নাকটা অর্ধেক ছিল; এখন পুরো মুখ জুড়েই নাক দেখা যাচ্ছে।”
মিটিমিট হেসে গ্যারি বলে উঠল, “মাস্টার শন’কে তো এক হাত নিয়েছি। এবার দেখছি তোমাকে শিক্ষা দেবার পালা এসেছে।”
ভাইয়ের মাথায় কি করল বেলা। টেডি বিয়ার, তুমি জানো হোলি কতটা লাকি যে তোমাকে পেয়েছে।” লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল।
গ্যারি। ভাইয়ের প্রতি স্নেহে বেলা’র বুক ভরে গেল।
***
একটু পরপরেই ব্যথায় কাতরাচ্ছে শন আর হেসে গড়িয়ে পড়ছেন অটো।
“এই যে নাও!” বেডসাইড টেবিলের উপর রাখা টাম্বলার গ্লাসে ঢেলে দিলেন তিন আঙুল পরিমাণ হুইস্কি “ব্যথার জন্য এটা ক্লোরোফর্মের কাজ করে।”
কাত হয়ে গ্লাসটাকে নিয়ে সবটুকু হুইস্কি গলায় ঢেলে দিল শন! “ষাড়ের দৌড় আর-জাম্বো পুঁতো খেলেও এবারে! ওই টুডি সামালকে মেরি মা।”
হাতে সার্জিক্যাল টেপ নিয়ে থেমে গেল স্টুডি। হেসে শনের ঠোঁটে কিস্ করল।
“চুপ করে বসে থাকো। আমি সব ঠিক করে দেব।”
“হুম, এ কাজে তো তুমি দক্ষ।” স্বীকার করল শন। টেপ বাড়িয়ে দিল কিং-সাইজ বেড়ে। শনের পিছনে বসে থাকা এরিকার দিকে।
“আর কোনো গুঁতোগুতি করা চলবে না।” তীব্র শব্দে হেসে ফেলল এরিকা। আরেক হাতের নিচ দিয়ে টেপ চলে এলো ট্রডির কাছে।
আবারো হাসতে লাগলেন অটো হায়দার। “তুমি কী এভাবেই পড়ে থাকবে? আর দুই মাদী শিয়ালকে কে সামলাবে? আমি একা?” শন তার বহুদিনের পুরোন দোস্ত। চারজন মিলে-অটো, স্টুডি, এরিকা আর শন-শুধু শিকারই করে না আরো অনেক বেশি মজা করে।
“তোমার আর কিছু বাকি নেই। কিন্তু তোমার ভাই, বাপরে, ঠিক একটা ষড়। চোখ পাকালো ট্রডি। “ও যেমন ভালো ফাইট করে তেমনি কি বিছানাতেও ভালো?”
মুহূর্ত খানিক ওর দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলল শন, আমার ভাই কিন্তু যেমন তেমন না। বিয়ে করার সময় তো বলতে গেলে কুমারীই ছিল। সন্দেহ আছে তোমাকে খুশি করতে পারবে কিনা।”
“আমরা দেখিয়ে দিব। কী করতে হবে। এরিকা আর আমি।” প্রমিজ করল ট্রুডি।
“তোমার কী মনে হয় অটো?” ক্লায়েন্টের দিকে তাকাল শন। “ওদেরকে আজ রাতের জন্য ধার দেবে? মাঝরাতের আগেই আবার তোমার তাবুতে ফিরিয়ে দিয়ে আসব।”
মাথা নাড়লেন অটো,
“মাই ফ্রেন্ড। তুমি এত মজার সব জোকস বলল না! গালর্স তোমরা কী বলো?
আহত বুক খামচে ধরে ওদের সাথে হেসে ফেলল শন।
আজ কী ঘটে গেছে তা সবার চেয়ে ওই ভালো বুঝেছে। ভাই সুলভ হাতাহাতি নয়; যেন ফাইনাল ব্যাটল লড়েছে অধিকার পেতে মরিয়া দুটো আঁড়।
ও হেরে গেছে আর বেদনাটাও অনেক ভারী।
জানে আর কখনোই চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। গ্যারি ওকে সবদিকে হারিয়ে দিয়েছে। বোর্ডরুম থেকে শুরু করে পেশির’র যুদ্ধে। শন শুধু এখন একটাই কাজ পারে। ওর ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করা।
***
স্বপ্ন দেখছে গ্যারি। কিন্তু এতটাই স্পষ্ট যে মনে হচ্ছে সত্যি। একদল নৃত্যরত বনপরীর হাত থেকে বাঁচার জন্য তৃণভূমির উপর দিয়ে যেন ছুটছে গ্যারি। কিন্তু এত কষ্ট হচ্ছে! যেন গরম গুড়ের ভেতর ডুবে যাচ্ছে পা।
তৃণভূমির ওপারে হোলি আর দাঁড়িয়ে থাকা সন্তানদেরকেও দেখতে পাচ্ছে। হোলি চিৎকার করে কিছু বললেও বুঝতে পারছে না গ্যারি। কাঁদছে। ওর স্ত্রী।
যতবার ওর কাছে যেতে চাইছে, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরছে বনপরীদের উষ্ণ হাত। ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল হোলি আর বাচ্চারা। ছোট্ট বাবুটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তৃণভূমির ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল সকলে।
মন চাইল চিৎকার করে ওদেরকে অপেক্ষা করতে বলে; কিন্তু নিজের ভাবনা চিন্তাও কেমন যেন এলোমেলো ঠেকছে। হঠাৎ করে কী হলো। আর পালাতে চাইছে না গ্যারি। ঘুমের মাঝেও বুঝতে পারল যে এটা স্বপ্ন; অথচ চাইছে যেন এ ঘোর না ভাঙ্গে কোনদিন।
চারপাশ থেকে ওকে ঘিরে ধরল নরম তুলতুলে উষ্ণ শরীর। নাকে ধাক্কা খেল নারী দেহের মিষ্টি গন্ধ। শুনতে পাচ্ছে হাসির রিনরিনে আওয়াজ।
হোলি আর বাচ্চারা চলে গেছে, ওদেরকে ভুলে লালসায় ডুবে গেছে গ্যারি।
এরপর হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বুঝতে পারল যে এটা স্বপ্ন নয়; ওর বিছানায় সত্যি সত্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা হাত। মুখের উপর সমূদ্রের জালের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে সিল্কি চুল। নরম শরীর দু’টো ওকে পেচিয়ে ধরেছে বনদেবীদের মতন।
খানিকক্ষণ শুয়ে থেকেই তড়াক করে এক লাফ দিয়ে বসে পড়ল গ্যারি। ওপাশে পাথরের মতো জ্বলছে নগ্ন নারী দেহ।
বিছানার কিনারে বসে আছে শন। বুকে সাদা টেপ হলেও মুখে হাসি। “ফার্স্ট প্রাইজটা তুমিই পেয়েছ গ্যারি; এনজয় ল্যাড এনজয়!”
“ইউ বাস্টার্ড!” ওকে ধরতে এগিয়ে গেল গ্যারি।
কিন্তু দ্রুত পায়ে সরে পড়ল শন। মেয়ে দুটোও তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে গেল। বিড়াল চানার মতো করে দু’হাতে দু’জনকে ধরে তুলে ফেলল গ্যারি। তাঁবুর বাইরে নিয়ে আসতেই চিৎকার জুড়ে দিল নার্সদ্বয়।
ড্রেসিং গাউনের বেল্ট লাগাতে লাগাতে তাবুর বাইরে বেরিয়ে এলেন শাসা,
“কী হয়েছে?”
“আমার ডার্লিং ব্রাদার, বিছানাতে সাপ ছেড়ে দিয়েছে। ওগুলোকে তাড়িয়ে এলাম।” নম্রভাবে উত্তর দিল গ্যারি।
“ধুর!” বলে উঠলেন শাসা, “অযথাই সুযোগ হারালে।”
মিটিমিটি হাসতে হাসতে ছেলের পিছু নিলেন শাসা।
ঘুম কাতুরে চোখ নিয়ে লেসের শর্ট নাইটি পরে নিজের ভঁবু থেকে বের হয়ে এলো বেলা,
“গ্যারি, কী হয়েছে?”
“আমিও তো তাই ভাবছি।”
“দু’জন গ্যারি? একটু বেশিই হয়ে গেল না?”
“শন’কে জিজ্ঞেস করো, এটা ওর আইডিয়া।”
“এখন কী করবে? আমি আসব?”
“সানন্দে। হোলি’র কাছে তুমি আর বাবা রিপোর্ট করো।”
ছোট্ট দলটাকে নিয়ে ক্যাম্পের বাইরে পানির কিনারে চলে এলো গ্যারি। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে বাইরে; পায়ের নিচে বরফ ভাঙছে।
“প্লিজ, আমরা কেবল মজা করতে চেয়েছিলাম।” গ্যারির হাতের নিচে ঠকঠক করে কাঁপছে ট্রডি।
“সত্যিই মজা করেছি।” কাঁদো কাঁদো স্বরে জানাল এরিকা।
“প্লিজ যেতে দিন।” বাতাসে যেন সাইকেল চালাচ্ছে এমন ভাবে দুলছে ওর পা।
“আমিও মজাই করছি।” বলে উঠল গ্যারি। কিন্তু মনে হয় তোমাদের চেয়ে আমারটাই ভাল হবে।”
প্রথম থ্রোটা তেমন ভালো হলো না। মাত্র বিশ ফুট। কিন্তু এরিকা ভারী হওয়াতে এমনটা হয়েছে। ট্রডি গিয়ে পড়ল পাক্কা ত্রিশ ফুট দূরে চিল্কারে কান পাতা দায় হলেও ঠাণ্ডা পানিতে পড়ার সাথে সাথে থেমে গেল সবকিছু।
গায়ে কালো মাটি মেখে ভয়ংকরভাবে কাঁপতে কাঁপতে উঠে এলো দু’জনে।
“এবারে” বলে উঠল গ্যারি, “দেখ, সত্যিকারে মজা কাকে বলে?”
***
ব্রেকফাস্টে দেরি করে ফেলল শন। ডাইনিং টেন্টে ঢুকতে গিয়েও থেমে গেল। চোখ সরু করে তাকাল চারপাশে।
ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই মেরামতো করে ফেলেছে ভূতেরা। ভাঙ্গা ফার্নিচারগুলো মেরামত করা হয়েছে। ট্রডি আর এরিকাও ধুয়ে ফেলেছে মাটি। কিন্তু এসবে মনোযোগ দিচ্ছে না শন।
তাকিয়ে আছে লম্বা টেবিলের মাথায় নিজের চেয়ারের দিকে। এটা ওর ক্যাম্প। বহুদিন ধরেই এ জায়গাটা ওর। সবাই জানে। ক্যানভাসের চেয়ারের পেছনেও ওর নামটাই প্রিন্ট করা আছে।
অথচ এখন কিনা সেখানে বসে আছে গ্যারি। চশমা ঠিক করে নিয়েছে। নাকের ফোলা ভাবটাও কমেছে। শাওয়ার নেয়াতে চুল এখনো ভেজা। বড়সড় আত্মতৃপ্ত মানুষটা বসে আছে শনের চেয়ারে।
চোখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকাল গ্যারি। নাস্তায় নিয়েছে ইম্পালা লিভার, অনিয়ন আর স্ক্যমবেলড এগস। “মর্নিং, শন,” আনন্দ চিত্তে চিৎকার করে উঠল গ্যারি,” এসে পড়েছ যখন আমাকে এক কাপ কফি এনে দাও।”
হঠাৎ করেই টেবিলের সকলে একেবারে চুপ করে গেল। সবাই তাকিয়ে আছে শনের দিকে। ধীরে ধীরে হেসে ফেলল শন।
“চিনি কতটা দেব?” আইজ্যাকের হাত থেকে কফি-পট নিয়ে এলো।
‘দুই-চামচেই কাজ হবে।” আবারো খেতে শুরু করল গ্যারি। টেবিলের অন্যরাও স্বস্তি পেল। সকলেই খেতে শুরু করল।
ছোট-ভাইকে কফির মগ এনে দিল শন। মাথা নাড়ল গ্যারি, “থ্যাংক শন। বসো।” পাশের খালি-চেয়ারটা দেখিয়ে দিল গ্যারি, “কয়েকটা ব্যাপারে আলোচনা করতে হবে।”
‘আলোচনাটা শোনার জন্য মরিয়া হয়ে গেল বেলা; কিন্তু সমানে কিচির মিচির করে চলেছে দুই নার্স। শাসা আর অটোর সাথে টাংকি মারছে। জানে এই ক্যাম্পে কয়েকদিন পরেই যে মিটিং হবে তার কথা বলছে গ্যারি। যেটির ভিজিটরস আর প্রতিটা ডিটেইল নিকি আর বেলার জন্য অত্যন্ত দামি।
“আর এই ইটালিয়ান নারী? আগেও তো তোমার ক্লায়েন্ট হিসেবে এখানে এসেছিল। কেমন উনি?” বেলা গ্যারির প্রশ্নটা শুনতে পেল। কাঁধ ঝাঁকাল শন।
“এলসা পিগুটেলি? সুইস ইটালিয়ান। গুলি চালাতে ওস্তাদ। ট্রিগার টিপলেই কিছু না কিছু পড়বে। কখনো মিস্ করতে দেখিনি।”
খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে মাথা নাড়ল গ্যারি, “আর কিছু?”
“বেশ রগচটা। সবকিছু নিজের মতো করেই চায়। মনে হয় মাথার পেছনেও চোখ আছে। কিছু লুকাতে পারবেনা। বিল খানিকটা বাড়াতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ঠিকই ধরে ফেলছে।”
আবারো মাথা নাড়ল গ্যারি। “আশ্চর্য হবার কিছু নেই। ইউরোপের অন্যতম ধনবান নারী। ফার্মাসিউটিক্যালস আর কেমিকেল’র ব্যবসা আছে। হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং। জেট ইঞ্জিন, আর্মামেন্টস্ সাত বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই খেলা দেখাচ্ছে। অসম্ভব রকম বিখ্যাত।”
“গত সিজনে আহত একটা জাম্বোর উপর ফুল আউট চার্জের সময়ে মাত্র বিশ কদম দূর থেকে ব্রেইনের একেবারে সামনের অংশে গুলি করেছেন মহিলা। অথচ এরপর আমার উপরে সে কী চোটপাট। আমিই নাকি তাঁর হাতিকে মেরেছি। বেশ কঠিন ধাতু দিয়ে গড়া।”
“আর কিছু? কোন দুর্বলতা? মদ?” জানতে চাইল গ্যারি।
মাথা নাড়ল শন্। “প্রতি সন্ধ্যায় এক গ্লাস করে শ্যাম্পেন। প্রতিবার ডম পেরিগননের ফ্রেশ বোতল। এক গ্লাস খেয়ে বাকিটা দিয়ে দিতেন। প্রতি বোতল পঞ্চাশ ডলার।”
“আর কিছু?” মোটা চশমা’র ভেতর দিয়ে গ্যারি’কে একদৃষ্টে তাকাতে দেখেই হেসে ফেলল শন।
“কাম অন গ্যারি। আন্টির বয়স না হলেও-পঞ্চাশ।”
“আসলে উনার বয়স বেয়াল্লিশ।” জানিয়ে দিল গ্যারি।
কাঁধ ঝাঁকাল শন। “ওকে। আমি অফারটা দিয়েছিলাম। এটা সার্ভিসের অংশ। কিন্তু তিনি হেসেছেন। জানিয়েছেন, শিশুকে লাঞ্চনার দায়ে গ্রেফতার হতে চান না।”
মাথা নাড়ল শন। শারীরিকভাবে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করতে চায় না।
“পিটি! আমরা উনার সাথে ব্যবসা করতে চাই। তা যা কিছু সম্ভব করতে হবে।” বলে উঠল গ্যারি।
“আজ বিকেল পাঁচটায় উনাকে নিয়ে আসব।” প্রমিজ করল শন। “তারপর তুমি যা খুশি করো।”
সকলে মিলে এয়ারস্ট্রিপে এলো অটো আর নার্সদেরকে বিদায় জানাতে। জার্মান মেয়ে দুটো যে গ্যারি’কে ক্ষমা করে দিল তাই নয়, মনে হলো ওদের শ্রদ্ধাও জিতে নিল গ্যারি। যাবার আগে ওর চুল টেনে। কি করে এমন অবস্থা করল যে লজ্জায় লাল হয়ে গেল গ্যারি।
গর্জন করতে করতে এয়ারস্ট্রিপ ছেড়ে উঠে গেল বীক্রাফট। দু’শ ফুট ওপরে উঠে আধ মাইল দূরে গিয়েও আবার ঘুরে সোজা ওদের দিকে ধেয়ে এলো প্লেন। মাথার উপর মাত্র বিশ ফুট উপরে ঝুলে রইল। পাগলের মতো হাত নাড়ছে প্লেনের পেটে বসে থাকা স্টুডি আর এরিকা।
“কাউবয়!” টয়েটার হুইলে উঠে বসল গ্যারি, “আসবে বেলা?”
“আমি বাবার সাথে আসছি।” উত্তরে জানাল বেলা। জানে ভাইয়ের চেয়েও বাবারর পেট থেকে কথা বের করা বেশি সহজ হবে।
ক্যাম্প থেকে তখনো প্রায় অর্ধেক দূরত্বে, এমন সময় সুযোগ পেল বেলা,
“তো এই এলসা পিগনাটেলীকে বাবা? আগে তো কখনো উনার কথা শুনিনি?”
বিস্মিত হয়ে গেলেন শাসা, “তুমি কিভাবে জানলে?”
“আমাকে বিশ্বাস করো না? আমি তো তোমার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট নাকি?” অত্যন্ত বুদ্ধি করে বাবাকে অপরাধবোধে ফেলে দিল বেলা।
বুঝতে পারলেন শাসা, বলে উঠলেন, “মাফ করো, বেলা। এমন না যে তোমাকে বিশ্বাস করি না।”
“উনার কারণেই তো আমরা এখানে এসেছি, তাই না?”
তারপরেও মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলেন শাসা।
“এলসা পিগনাটোলি গত তিন সিজন ধরে এখানে আসছেন। সিংহ আর চিতা বাঘ শিকার করতে অসম্ভব পছন্দ করেন। তুমি তো জানোই এসব কাজে শন কতটা দক্ষ।”
“আমরা নিশ্চয় উনার শিকার করা দেখতে আসিনি?” বাবাকে জোর দিল বেলা।
“এলসাল’র সম্পত্তির ভেতরে কেমিকে ফ্যাক্টরী’ও আছে কীটনাশক, প্লাস্টিক, পেইন্টস। আর এসবের পেটেন্টের ব্যাপারেই আমাদের যত আগ্রহ।”
“তাহলে গ্যারি’ই তো জেনেভা কিংবা রোমে, উনি যেখানে থাকেন, চলে। যেতে পারে?”
“লুজানে’তে থাকেন মহিলা।”
“তাহলে টারজানের মতো জঙ্গলে আস্তানা গাড়ার কী দরকার? রহস্যটা কী? লোক পাঠালেই তো হত?”।
ট্রাকের গতি ধীর করে নদীর দিকে মনোযোগ দিলেন শাসা। ফোরহুইল ড্রাইভ নিয়ে সোজা বিপরীত দিকে না উঠা পর্যন্ত কোনো কথা বললেন না।
“ঠিক আছে, সবকিছুই বলছি তোমাকে। এসব কীটনশাক নয়, আসলে আমাদের আগ্রহ পিগটেলি ইন্ডাস্টিজ আর আর্মসকোর নিয়ে।”
“আহ, তার মানে অস্ত্র-শস্ত্র?”
“মেয়ের দিকে তাকালেন শাসা। পাগড়ির মতো করে রঙিন স্কার্ফ পেচানো বেলা’কে দেখে অপরাধবোধে দগ্ধ হলেন শাসা। মেয়েটা তো তার নিজেরই অংশ। কেমন করে তিনি ওকে অবিশ্বাস করতে পারলেন!
“নিউক্লিয়ার বোমা নিশ্চয় নয়?” বলে উঠল বেলা, “তোমার কাছে তো এটা এখনি আছে।”
“না, নিউক্লিয়ার নয়।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শাসা। “তুমি তো জানই যে তোমার মতো আমিও এসব মারণাস্ত্র পছন্দ করি না যাই হোক। এদের অস্তি তুই যথেষ্ট।”
“কিন্তু যদি হাতের নাগালে থাকে। তাহলে কোনো না কোনো পাগল ঠিকই ব্যবহার করে ফেলবে।” মাথা নাড়লেন শাসা। কিন্তু ডার্লিং আমার দায়িত্ব হলো দেশকে নিরাপত্তা দেবার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করা।”
“এরকম আর কিছুর কি সত্যি দরকার আছে?” জোর দিল বেলা।
“ছোট্ট একটা শত্রুর দল, আমাদের দেশটাকে নিয়ে সবার ভেতরে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। তরুণদের মাঝে আমাদেরকে দানব বানিয়ে ব্রেইনওয়াশ করছে। শীঘ্রিই হয়ত এরাই ক্ষমতায় বসে যাবে। এরাই হবে আগামীকালের সিদ্ধান্ত প্রণেতা। কোনো একদিন হয়ত দেখা যাবে আমেরিকান নেভাল টাস্কফোর্স এসে আটকে দেবে আমাদের উপকূল। এমনকি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা আর কমনয়েলথ এর সমর্থন নিয়ে ভারতীয় বাহিনীও এসে চড়াও হতে পারে।
“ওই পাপা, এসব তো বহুদূরের ব্যাপার, তাই না?”
“হুম। কিন্তু লন্ডনে থাকার সময়ে তুমিও তো ব্রিটিশ লেবার পার্টি নেতাদের সাথে দেখা করেছ; আমেরিকান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির টেডি কেনেডি’র সাথে কথা বলেছ। মনে আছে উনি কী বলেছিলেন?”
“হ্যাঁ। মনে আছে।”
“আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেউ যেন নাক গলাতে না পারে সর্বদা সেই চেষ্টা করতে হবে।”
“আমাদের কাছে তো ইতিমধ্যেই তা আছে।” মনে করিয়ে দিল বেলা।
“নিউক্লিয়ার অস্ত্র বেশ মূল্যবান। আর এর প্রভাব ঠেকানোটাও দুঃসাধ্য। তাই বিকল্প কিছু ভাবতে হবে।”
“এলসাই কি এর জোগানদার হবেন? কেন?”
“সিগনোরা পিগনাটোলি বেশ সহানুভূতিশীল। তিনি ইটালিয়ান সাউথ আফ্রিকা সোসাইটির’ও সদস্য। উনার পিতা ১৯৩৫ সালে জেনারেল ডি বোনোর স্টাফ ছিলেন। পশ্চিম মরুভূমিতে রোমেনের নেতৃত্বে যুদ্ধ করে বেনগাজীতে বন্দি হয়েছিলেন উনার স্বামী। আফ্রিকার প্রতি তার ভালোবাসা ভদ্রলোক নিজের স্ত্রীর মাঝেও বপন করে গেছেন। আমাদের সমস্যাও তাই তিনি ভালই বোঝেন। এই মিটিং এর পরামর্শও তিনিই দিয়েছেন।”
আরো কিছু প্রশ্ন করতে চেয়েছিল বেলা; কিন্তু মনে হলো থাক। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।
চুপচাপ বসে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল বেলা।
“এই মিটিং সম্পর্কে মাত্র চারজন লোক জানেন। সিগনোরা পিগনাটেলি’তো নিজের স্টাফদেরকেও বিশ্বাস করেন না। গ্যারি আর আমি ছাড়া এই মিটিং এর কথা আর একজনেই মাত্র জানেন-প্রধানমন্ত্রী।”
নিজের বিশ্বাসঘাতকতায় অসুস্থ বোধ করল বেলা। মন চাইল বাবাকে নিষেধ করে যেন তাকেও না বলেন। কিন্তু নিকি’র কথা মনে পড়তেই পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল বেলা।
“পাঁচ বছর আগে, নার্ভ গ্যাস তৈরির জন্য পশ্চিম ইউরোপের দু’টি কেমিকেল কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছিল ন্যাটো। কিন্তু স্ক্যান্ডিনেভিয়া আর হল্যান্ডের সোশ্যালিস্ট সরকারের চাপে গত শরতে এ চুক্তি ক্যানসেল হয়ে যায়। তবে কাজ অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ায় একটা কোম্পানি গ্যাস উৎপাদন ও পরীক্ষা করে দেখেছে।”
“কারা? পিগনাটোলি কেমিকেলস্?” ইসাবেলার প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়লেন শাসা, বেলা আবার জানতে চাইল,
“ন্যাটোর মাপকাঠিগুলো কী কী?”
‘ট্রান্সপোর্ট আর স্টোর করার জন্যে সেইফ হবে। পিগনাটোলির উদ্ভাবিত পৃথক দুটি পদার্থ যদি একসাথে মেশানো হয় তাহলে তা আমেরিকান এক্সিকিউশন চেম্বারে ব্যবহৃত সায়ানাইড গ্যাসের চেয়েও বিষাক্ত হবে।”
ফুলে ফুলে ভরা কিগেলিয়া গাছের নিচে ট্রাক পার্ক করলেন শাসা।
হাতে তুলে নিলেন, শনের ডাবল ব্যারেলড পয়েন্ট পাঁচ সাত সাত গিবস রাইফেল।
“চলো জলহস্তীদের দেখে আসি।” বাবা’র পিছু নিল বেলা। রাইফেলের ইনস্যুরান্স করা আছে; কেননা আফ্রিকাতে মাপ, সিংহ আর ষাঁড়ের চেয়েও বেশি মারাত্মক জলহস্তী।
মরা গাছের গুঁড়ির উপরে পাশাপাশি বসে পড়ল পিতা-কন্যা। হাতের কাছেই রাইফেলটাকে রেখে দিলেন শাসা। খানিক পরেই নদী তীর থেকে নেমে গেল মদ্দা জলহস্তী। পানির উপরে শুধু চোখ জোড়া ভেসে রইল।
“সায়ানাইড গ্যাসের চেয়েও এগারো গুণ বেশি বিষাক্ত।” মন্তব্য করলেন শাসা’ “বেশ ভয়ংকর, না?”
“তাহলে কেন এটা দরকার বাবা?” কাঁধ ঝাঁকালেন শাসা।
“ঘৃণা থেকে নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য।” পায়ের কাছ থেকে নুড়ি পাথর নিয়ে জলহস্তীটার দিকে ছুঁড়ে মারলেন শাসা। বিশ ফুট দূরে পড়লেও পানির ভেতরে পুরোপুরি ডুবে গেল জলহস্তী। শাসা আবারো বলে উঠলেন, “গ্যাসের কোড নেইম হল সিনডেক্স-২৫। দ্রুত আর নিঃশব্দে হত্যা করা ছাড়াও এটার আরো অনেক গুণ আছে।”
“কী বলছ তুমি?” বিড়বিড় করে উঠল বেলা।
“গন্ধ বিহীন গ্যাসটার কল্যাণে কিছু বুঝে উঠার আগেই মৃত্যু ঘটবে। তবে চাইলে যে কেউ যে কোনো গন্ধ মেশাতে পারে-যেমন টসটসে আপেল, জেসমিন কিংবা চ্যালেন ফাইভ।”
“তুমি তো এমন ভয়ংকর ছিলে না, বাবা।”
কিছুই বললেন না মেয়েকে। “অবশ্য মিক্সিং এর তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেলে আর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না এই গ্যাস। ফলে সুবিধা হলো বিপক্ষেরও আর্মির উপরে গ্যাস ছেড়ে দিলেও তিন ঘণ্টা পরেই তোমার নিজের বাহিনী দিয়ে সে জায়গা দখল করে নিতে পারবে।”
“বেশ মজা তো।” ফিস করে বলে উঠল বেলা।
“রাজনৈতিক ভাবে সম্ভাব্য সবকিছু নিশ্চয়ই ভেবে রেখেছেন মিঃ প্রাইম মিনিস্টার?”
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন শাসা। বেলা আবারো জানতে চাইল, ন্যাটো চুক্তি প্রত্যাহার করে নেয়ার পর একমাত্র পিগনাটেলি কেমিক্যালস এই সিনডেক্স-২৫ উৎপাদন করছে?”
“না, ওরা পরীক্ষা করে দেখেছে। কিন্তু ন্যাটোর চুক্তি শেষ হবার পরেই সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে। অরিজিন্যাল স্টকও নষ্ট হয়ে গেছে।”
বাঁকা চোখে বাবার দিকে তাকাল বেলা। “নষ্ট হয়ে গেছে?” বেশ ক্ষণস্থায়ী গ্যাস। মাত্র ছয় মাস অটুট থাকে সমস্ত গুণ। তাই তারপরেই আবার নতুন করে তৈরি করতে হয়।”
“ক্যাপরিকর্ণ কেমিকেলস্-এর জন্যে বেশ লাভজনক হবে।” মেয়ে’র মন্তব্য এড়িয়ে গেলেন শাসা।
“প্ল্যান্টের জন্যে ব্লু-প্রিন্ট-সাপ্লাই করবেন সিগনোর পিগটেলি। উৎপাদন প্রক্রিয়াও বেশ জটিল হবে।”
“কবে থেকে উৎপাদন শুরু করবে তোমরা?” ইসাবেলা’র প্রশ্ন শুনে মিটিমিটি হাসলেন শাসা।
“ধীরে ব্যস ধীরে। মহিলা এহেন প্রস্তাবে রাজি হবেন কিনা সেটাই তো এখনো নিশ্চিত নয়। এ ব্যাপারে মাত্র কথা শুরু হবে আজ।” হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন শাসা। “লাঞ্চ টাইম প্রায় হয়ে গেছে; অথচ ক্যাম্প এখনো আধা ঘণ্টা দূরত্বে।”
***
শনে’র আগমন সংবাদ পেয়ে সন্ধ্যা থেকেই এয়ারস্ট্রিপে জড়ো হয়েছে সকলে।
হাত দিয়ে চোখের উপর ছায়া বানিয়ে উইন্ডস্কিনের ভেতর দিয়ে শনের ডান দিকে বসে থাকা আরোহীকে দেখতে পেলেন শাসা। দুজনে একই দুনিয়ার বাসিন্দা হলেও অদ্ভুত ব্যাপার হলো যে শাসা আর এলসা। আগে কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন প্রোগ্রামে দু’জন একই সাথে উপস্থিত থাকলেও কখনো দেখা হয়নি। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। দু’জনের সম্পদ আর ক্ষমতা।
সেনটেইন আর ইসাবেলা প্রোগ্রাম গিলে খায় এমন সব চকচকে উইমেন ফ্যাশন ম্যাগাজিনে এলসা’র ছবি দেখেছেন শাসা। গত বিশ বছর ধরে উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে আসছে কোর্টনি ইন্ডাস্টিজ। তাই এই মিটিং এর আগে স্পেশাল সার্ভিসের তৈরি করা ফাইল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে এসেছেন শাসা।
বীচক্রাফর্টের ইঞ্জিন বন্ধ করল শন। মাটিতে নেমে এলেন এলসা পিগটেলি। লম্বা গড়নের এলসা’র চালচলন ঠিক তরুণ জিমেন্যাস্টদের মত; ব্রুনো পিগনাটেলি’কে বিয়ে করার আগে ভেস সেন্ট লরেন্টের মডেল হয়েছিলেন-এই নারী।
পূর্ব প্রস্তুতি থাকলেও মনে মনে বোকা বনে ইলেকট্রিক শক খেয়েছেন। গলা আর হাত দুটো কেমন যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। গ্যারি। ইসাবেলা, ভুত্যের দল পেরিয়ে এবারে শাসা’র উপরে স্থির হলো এলসা’র দৃষ্টি। 1
এলসা পিগটেলি’র কেশরাজি এতটাই কালো যে নীল আভা ছড়াচ্ছে। মাথার পেছনে কয়েলের মতো বেঁধে রাখাতে স্পষ্ট হয়ে আছে উন্নত কপাল। পূর্ণ যৌবনা এই নারীর ঠোঁট দুটো বেশ নরম।
মডেল সুলভ ভঙ্গিমা নিয়ে শাসা’র দিকে এগিয়ে এলেন এলসা, “শাসা কোর্টনি” হাসতেই ফুটে উঠল পরিষ্কার চোয়াল। আগামী জুলাইতে তেতাল্লিশতম জন্মদিন হবার কথা থাকলেও এখনো নিভাজ নিখুঁত চামড়া।
“সিগনোরা পিগনাটেলি” এলসা’র হাত ধরলেন শাসা। ঠাণ্ডা আর দ্রুত গতি’র হলেও হাত বেশ শক্তিশালী উজ্জ্বল চোখ জোড়া থেকে ঝরে পড়ছে বুদ্ধির দীপ্তি। ঘন পাপড়ির নিচ থেকে বাদামি সোনারি আভা বিকিরণ করছে চোখের মণি।
“আরো আগেই আমাদের দেখা হওয়া উচিত ছিল।” শাসা’র অদ্ভুত ইটালীয় ভাষা শুনে চোস্ত ইংরেজিতে উত্তর দিলেন এলসা, “ওহ, দেখা তো হয়েছে।”
“কোথায়?” বিস্মিত হয়ে গেলেন শাসা।
“উইন্ডসর পার্ক। দ্যা গার্ডস্ পোলো ক্লাব।” মজা পেলেন-এলসা, “ডিউক অব এডিনবার্গের নিমন্ত্রিত দলের দুই নম্বর খেলোয়ার ছিলেন আপনি।”
“মাই গুডনেস, সেটা তো দশ বছর আগের কথা।”
“এগারো।” শুধরে দিলেন এলসা।” পরিচয় না থাকলেও ম্যাচের পরে ব্যুফেতে দেখা হয়েছিল তিন সেকেন্ডের জন্য। আমাকে স্মোকড স্যামন স্যান্ডউইচ অফার করেছিলেন।”
“আপনার স্মৃতি শক্তি তো দেখছি অসাধারণ।” হার মানলেন শাসা।
“তো স্যান্ডউইচ নিয়েছিলেন?”
“ইস্ কেন যে আপনার মনে নেই।” অন্যদের দিকে তাকালেন এলসা,
“তুমি নিশ্চয়ই গ্যারিক কোর্টনি? প্রথমে গ্যারি তারপর ইসাবেলা’র সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন শাসা।
একগাদা লাগেজসহ চারটা গার কে ট্রাকে তুলে নিল পরিচারকদের দল। মানুষ কেবল প্রাইভেট জেটে ভ্রমণের সময় এতসব ভারী লাগেজ নিয়ে আসে।
“আপনি আমার সাথে আসুন, সিগনোরা” নিজের হান্টিং ভেহিকেলের উঁচু ড্রাইভার সিটে চড়ে বসল শন। কিন্তু ওর কথায় কর্ণপাত না করে দ্বিতীয় ট্রাকে শাসা’র পাশে গিয়ে চড়ে বসলেন এলসা। ইসাবেলা ওদের পিছু নিতেই ওর হাত ধরে থামাল গ্যারি।
“কাম অন বেলা; এবারে বড়ো হও!” বিড়বিড় করে উঠল গ্যারি, “থ্রি ইজ ক্রাউড।”
হা হয়ে গেল বেলা। এটা তো মাখাতেই আসেনি। গ্যারির হাতে হেলান দিয়ে বলে উঠল, “আমি তো বুঝতেই পারি নি যে তোমার ম্যাচ মেকিং এ ট্যালেন্টও আছে ভাই।”
***
সূর্য ডোবার সময়ে টিউলিপ শেপড গ্লাসে করে এলসা পিগনাটেলি’কে এক গ্লাস ডম পেরিগগন এনে দিল আইজ্যাক। রেগুলার ক্লায়েন্টদের সমস্ত অভ্যাসই ওর জানা আছে।
ক্যাম্প ফায়ারের চারপাশে হাফ সার্কেল করে বসল সকলে; নিজের দু’জন ট্র্যাকারকেও ডেকে নিল শন। অ্যাভারেজ ক্লায়েন্টরা বিশেষ করে যারা প্রথমবারের মতো আসেন, তারা শন্ আর তার ট্র্যাকারদের সোয়াহিলি শুনে মুগ্ধ হন।
মাও মাও বিপ্লবের দিনগুলোতে কেনিয়াতে থাকাকালীন সময় থেকেই এ দু’জন শনের সাথে আছে। এদের একজন লম্বা, নাইলোটিক গড়ন, আরেকজন পুঁতির মতো চকচকে চোখের এক ভূত।
অরণ্যের ডোরোবো উপজাতির জীবিত সদস্যদের একজন হলো মাতাতু।
যাদুটোনার জন্য বিখ্যাত এ সম্প্রদায়ের মাত্র কয়েকজনেই বেঁচে আছে। শই মাতাতু নাম দিয়েছে। কারণ ওর আসল নাম বলতে গেলে দাঁত ভেঙে যাবার সম্ভাবনা আছে। শনের জীবনের প্রায় অর্ধেক কাল জুড়েই ওর সাথে আছে মাতাতু। এলসা’কে ওর ভাষা অনুবাদ করে দিল শন “এক সপ্তাহ আগে আমি পাঁচটা চিতাবাঘের টোপ ফেলেছি। নদীর ধারে দু’টো আর বাকিগুলো ন্যাশনাল পার্কের কাছে।”
মাথা নাড়লেন এলসা; আগে ও আসায় এলাকাটা তিনি ভালই চেনেন।
মাতাতু’র দিকে ফিরে আরেকটা প্রশ্ন করল শন। ছোটখাটো ডোবোবো এত বড় একটা উত্তর দিল যে বোঝাই যাচ্ছে সকলের মনোযোগ উপভোগ করছে।
“আজকেও টোপগুলোকে চেক করে এসেছে মাতাতু! আপনার ভাগ্য ভালো সিগনোরা। নদীর ধারের টোপে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। মাতাতুর ধারণা এটা বেশ ভালোই হবে। সপ্তাহ খানেক ধরে ঝুলছে হরিণের টোপগুলো। ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও ভালো আছে। যদি আজ রাতেও আসে টুম ব্যাটা। তাহলে কাল সন্ধ্যাতেই গিয়ে হাজির হব।”
“হুম” মাথা নাড়লেন এলসা। “গুড”
“তো কাল সকালে টোপগুলোকে চেক করে আরো কয়েকটা ইম্পালা হরিণ মেরে নেব। যদি প্রয়োজন পড়ে তো ব্যবহার করা যাবে। লাঞ্চ করে খানিক রেস্ট নিয়ে বিকেল তিনটায় বের হয়ে যাব।”
“টোপ চেক্ করা, হরিণ মারা সবকিছু তুমিই করবে।” জানিয়ে দিল এলসা, “কারণ সকালবেলায় আমার মিটিং আছে।” পাশের চেয়ারে বসে থাকা শাসা’র দিকে তাকিয়ে হাসলেন পিগনা টেলি, “আমাদেরকে অনেক কিছু আলোচনা করতে হবে।”
***
সকালের বেশির ভাগটাই খেয়ে নিল আলোচনা। খুব সাবধানে সবকিছু ঠিক করল গ্যারি। শনের সাথে টয়োটা নিয়ে বেলা’কেও পাঠিয়ে দিল। ক্যাম্প থেকে খানিক দূরে মাসাসা গাছের নিচে তিনটা চেয়ার আর ফোল্ডিং টেবিল পেতে দিল আইজ্যাক।
দুনিয়ার আর কোনো জায়গাতেই এতটা নিরাপত্তা পাওয়া যাবে না। শাসার কাছে পুরো ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত ঠেকল। এত সুন্দর একটা জায়গা আর আলোচনার বিষয়টাও ততটাই ভয়ংকর।
অন্যদিকে গ্যারি কিংবা শাসা’র আশানুরূপ কিছুই ঘটলনা। এলসা পিগটেলি সাথে করে হ্যান্ডসাম একটা অ্যাটাচি কে নিয়ে এলেও এটার তালা আর খোলাই হলো না।
বোঝাই যাচ্ছে এখনো সিনডেক্স-২৫ এন্টারপ্রাইজের ব্যাপারে মন ঠিক করতে পারেননি এলসা। একই সাথে বেশ কিছু বিষয়ে সন্দেহও করছেন।
“ন্যাটো তাদের চুক্তি প্রত্যাহার করাতে আমি যার পরনাই খুশিই হয়েছি। কেননা এমন কোন দুনিয়াকে আমি অস্ত্র দিতে চাই না, যার উপরে আমার কোন প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।”
পুরো সকাল জুড়েই মহিলার ভয় দূর করার চেষ্টা করল গ্যারি আর শাসা।
“যদি আপনার উৎপাদন শুরু করে দেন; তাহলে এ গ্যাসের স্যাম্পেল অ্যানালাইস করা কোনো ন্যাটো এক্সপার্ট নির্ঘাৎ টের পেয়ে যাবে এর উৎপত্তিস্থল আর সমস্ত দোষ এসে পড়বে পিগটেলি’র ঘাড়ে…”
এখনো নাছোড়বান্দা এলসা। আলোচনা চলতে চলতে চেয়ার ঘুরিয়ে শাসা’র মুখোমুখি হয়ে গেলেন মহিলা। নিজের সমস্ত মন্তব্য আর প্রশ্ন কেবল শাসা’র দিকেই ছুঁড়ে দিচ্ছেন।
যেন গ্যারি’র কোনো অস্তিত্বই নেই। সবার আগে গ্যারিই ব্যাপারটা ধরে ফেলল। বুঝতে পারল-শাসা’র কাছ থেকেই নির্ভরতা চাইছেন এলসা পিগটেলি। অত্যন্ত সাবধানে তাই একেবারে চুপ করে গেল গ্যারি। তাকিয়ে দেখল দুজনের প্রেমকাতর চাহনি, যদি বুঝতে পারল না যে ঠিক কী ঘটছে।
***
টয়েটোর ফিরে আসার শব্দে সকলের ঘোর ভাঙ্গল। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠলেন শাসা।
“ওহ্, ঈশ্বর, প্রায় লাঞ্চটাইম হয়ে গেছে। আর এখনো আমরা কিছুই ঠিক করতে পারি নি।”
“আমাদের হাতে এখনো দু’সপ্তাহ আছে।” মনে করিয়ে দিলেন এলসা, কাল সকালে আবার এখান থেকেই শুরু করব।”
তিনজনে মিলে ডাইনিং টেন্টে ফিরে এসে দেখল ক্রিস্টালের জগে পিমস নাম্বার ওয়ান মিক্স করছে শন; নিজের রেসিপি নিয়ে সে রীতিমতো গর্বিত।
“গুড নিউজ আছে সিগনোরা” খুশি খুশি গলায় বলে উঠল, শন, “পিমস্ দিয়েই উৎসব শুরু করা যাক?
হাসি দিয়ে শনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন এলসা। আমি শুধু লেবু দিয়ে পানি খাবো। কিন্তু গুড নিউজটা কী?”
“চিতাবাঘটা কাল রাতেও এসেছিল। সবকিছু দেখে মনে হয়েছে সূর্য ডোবার ঘণ্টাখানেক আগে আসে। দু’দিনেই বেশ সাহসী হয়ে উঠেছে।”
ধন্যবাদ শন্। তুমি সবসময় আমার জন্য ভালো ভালো শিকার নিয়ে আসো। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি নয়। আজ মাত্র সাফারির প্রথম দিন।”
“লাঞ্চের পরে নার্ভাস ঠিক রাখার জন্য খানিক ঘুমিয়ে নিন। আমরা তিনটায় বেরোব।”
রুপার ট্রে’তে করে এলসা’র মিনারেল ওয়াটার এনে দিল আইজ্যাক বরফ দিয়ে পিমস পান করল অন্য সকলে। টোস্ট করল শন।
“গাছের নিচে মরে পড়ে থাকা চিতাবাঘের উদ্দেশ্যে।”
কিন্তু এর সাথে সাথেই ইয়াং কোর্টনিদেরকে ভুলে অন্তরঙ্গভাবে আলাপ শুরু করে দিলেন শাসা আর এলসা। বড় ভাইয়ের হাত ধরে আড়িপাত সুযোগ নষ্ট করে দিয়ে বাইরে বের করে আনল গ্যারি।
“তুমি কেমন আছো, শন?”
“ভালই তো।” ভাইয়ের উদ্বেগ দেখে অবাক হয়ে গেল শন্।
“কিন্তু তোমাকে তো ভাল দেখাচ্ছে না।” মাথা নাড়ল গ্যারি, “বোঝাই যাচ্ছে যে তুমি ম্যালেরিয়ায় ভুগছ আর পাজরের ব্যথা।”
“এর মানে কী?” বিরক্ত হল শন।
“আজ সন্ধ্যায় সিগনোরার সাথে তুমি শিকারে যেতে পারবে না।”
“কে বলেছে পারব না। টোপাতো আমি পেতেছি আর বাঘটা-”
“সন্ধ্যাবেলা এক বোতল ক্লোরো কুইন নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকবে। কেউ কিছু জানতে চাইলে বলবে একশ চার ডিগ্রি জ্বর।”
“লিসেন, বিগ শট, তুমি আমার হাতিটাকে ভাগিয়েছে। এবারে চিতাবাঘটাও শেষ করে দিও না।”
“বাবা যাবেন ক্লায়েন্টের সাথে।” সাফ জানিয়ে দিল গ্যারি। “তুমি ক্যাম্পেই থাকবে।”
“বাবা?” দীর্ঘ এক মুহূর্ত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল শন্। “দুজনের খুব জমে গেছে, অ্যাঁ?”
‘তুমি সব সময় এভাবে কথা বলো কেন?” ঠাণ্ডা স্বরে জানতে চাইল গ্যারি, “মহিলার সাথে আমরা ব্যবসা করতে চাই আর বাবা চেষ্টা করছেন এক ধরনের বিশ্বস্ততার সম্পর্ক গড়ে তুলতে, ব্যস এইটুকুই।”
“আর যখন এই দুই ভূত মিলে চিতা বাঘের দফা-রফা করবে তখন শ গিয়ে তা পরিষ্কার করবে, তাই না?
“তুমিই তো বলেছ যে পিগটেলি কখনো মিস করেন না। আর বাবাও তো তোমার মতই দক্ষ শিকারি। আর এছাড়া তুমি নিশ্চয়ই আহত চিতাবাঘ চাও না, তাই না নির্ভীক শন কোর্টনি?”
খানিক পরে উত্তর দিল শন, “ঠিক আছে। আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি” হেসে ফেলে বলল, “না গ্যারি, আমি কোন কিছুকেই ভয় পাই না; মনে রেখো কথাটা।”
***
ক্যাম্প বেডের উপর বই নিয়ে শুয়ে আছেন শাসা। একমাত্র সাফারি ক্যাম্পে এলেই আনন্দের জন্য কোনো কিছু পড়ার সুযোগ পান; নয়ত সারাক্ষণ তো ব্যবসা কিংবা রাজনৈতিক লেখাই পড়তে হয়। এই নিয়ে চতুর্থবারের মতো পড়ছেন অ্যালান মুরহেডের লেখা ব্লু নাইল; তারপরেও গোগ্রাসে গিলছেন এর প্রতিটি শব্দ। এমন সময় তাঁবুর মাঝে উঁকি দিল গ্যারি।
“আমাদের ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছে বাবা; শনের ম্যালেরিয়া হয়েছে।”
হন্তদন্ত হয়ে বসে বই ফেলে দিলেন শাসা। “খুব খারাপ নাকি?” জানে শন্ কখনোই রোগ-বালাইয়ের ধার ধারে না। অথচ এদিকে আবার জাম্বোজি’তে কী নাকি একটা ‘পি ফালসিপারাম: দেখা দিয়েছে। “আমি এখনি ওর কাছে যাচ্ছি।”
“ডোন্ট ওরি বাবা; ক্লোরোকুইন খেয়ে ও এরই মাঝে শুয়ে পড়েছে। তাই ও’কে আর ডিস্টার্ব করো না।”
“স্বস্তি পেলেন শাসা। অন্যদিকে হালকা চালে গ্যারি জানাল, “কিন্তু আজ সন্ধ্যায় সিগানোরা পিগনাটেলি’র সাথেও তো কাউকে না কাউকে যেতে হবে। আমার চেয়ে তোমার অভিজ্ঞতাই বেশি।”
***
বন্য আবলুস কাঠের নিচু একটা ডালের উপর বানানো হয়েছে হাইড-আউট। মাটি থেকে মাত্র দশ ফুট উপরে। শন্ এটাকে উঁচুতে বানিয়েছে বাঘের হাত থেকে বাঁচার জন্য নয়; বরঞ্চ টোপ আটকানো গাছটাকেও স্পষ্ট দেখা যাবে।
বেশ যত্ন করেই টোপ আটকেছে শন। সব দেখে সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়লেন-শাসা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সন্ধ্যার পূর্বমুখী বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে যাবে শিকারির গায়ের গন্ধ। আর চারপাশে ঝোঁপ-ঝাড় থাকতে চিতা বাঘটাও নিশ্চিন্তে চলে আসবে।
টোপ আটকানো গাছটা থেকে এই হাইড-আউটের দূরত্ব কাটায় কাটায় পয়ষট্টি গজ। টেপ দিয়ে মাপ দিয়ে দেখেছে শন। এর আগে মেইন-ক্যাম্পের বাইরে পয়ষট্টি গজ দূরের টার্গেট ফুটো করে দিয়েছিলেন এলসা।
হাইড আউটটা খুড়ে ছাওয়া আরামদায়ক ছোট্ট একটা ট্রি-হাউজ। ভেতরে আছে দুটো ক্যাম্প চেয়ার। মাতা আর সামবুরু ট্র্যাকার ব্লাঙ্কেট আর স্লিপিং ব্যাগসহ স্ন্যাকস বক্স আর গরম কফি ভর্তি থার্সোস রেখে গেছে।
সূর্যোদয় পর্যন্ত থাকতে হতে পারে; তাই সঙ্গে অত্যন্ত শক্তিশালী বারো ভোল্টের গাড়ির ব্যাটারীর ফ্লাশলাইটও আছে। ট্র্যাকারদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য আছে টু-ওয়ে রেডিও।
হাইড আউটের গোছগাছ শেষ করে মই বেয়ে নিচে নেমে এলো মাতাতু; তারপর টয়োটার পাশে দাঁড়িয়ে শাসা’র সাথে শেষ মিনিটের কথাবার্তা সেরে নিল।
“আমার মনে হয় অন্ধকার নামার আগেই চলে আসবে চিতাবাঘ।” সোয়াহিলি ভাষায় বলে উঠল মাতাতু; “ক্ষুধা থাকায় লোভ সামলাতে পারবে না।”
“যদি না আসে তাহলে আলো না ফোঁটা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। রেডিওতে না ডাকা পর্যন্ত এখানে আসবে না। ঠিক আছে? এবার যাও, মাতাতু।
“ভালো থাকবেন, বাআনা। আশা করি মেমসাহিব চমৎকার ভাবেই মেরে ফেললেন। এই শয়তানটা আমার লিভার খাক চাই না।”
শিকারি দু’জন হাইড আউটে ঢুকে না পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল ট্র্যাকারেরা; তারপর টয়েটো নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে গেল। দুই মাইল দূরত্বে পার্ক করে অপেক্ষা করবে গানফায়ার কিংবা রেডিও কলের জন্য।
ক্যাম্প চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছেন শাসা আর এলসা। পেছনেই ছড়ানো আছে স্লিপিং ব্যাগ। দু’জনেরই গায়ে লেদার জ্যাকেট, শুধু যে শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য তা নয়; এমারজেন্সিতে তীক্ষ্ণ নখের আঁচর থেকেও এড়িয়ে বাঁচা যাবে।
ফায়ারিং অ্যাপাচারে লম্বা রাইফেলের নল ঢুকিয়ে অপেক্ষা করছেন এলসা। যে কোনো নড়াচড়া দেখলেই বন্দুক কাঁধে তুলে নিতে প্রস্তুত। দু’জনের কনুই প্রায় পাশাপাশি থাকলেও এখনো স্পর্শ করেনি।
টয়েটোর শব্দ দূরে মিলিয়ে যেতেই ঝপ করে নৈঃশব্দের চাদর নেমে এলো চারপাশে। এতটাই নিশ্চুপ যে শোনা যাচ্ছে সব তুচ্ছ শব্দও; মাথার উপরে পাতার গায়ে বয়ে যাওয়া বাতাস; নদীর তীরে কোনো একটা পাখির ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ; বহুদূরে কোথাও একঘেয়ে স্বরে ডেকে চলেছে একটা মদ্দা বেবুন।
দু’জনের সাথেই বই থাকলেও কেউ খুলেও দেখেনি। শাসা এতটাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন যেন বহুদিনের পুরনো আর বিশ্বস্ত কোনো বন্ধুর সাথে বসে আছেন। হঠাৎ করে এলসা’র দিকে তাকাতেই দেখলেন হাসছেন পিগনাটেলি।
দুজন দুজনের চেয়ারের হাতল তুলে ফেললেন। এমনভাবে একে অন্যের হাত ধরে বসে রইলেন যেন টিনএজার। নিজেকে দেখে শাসা নিজেই অবাক হয়ে গেলেন; বহু বছর ধরেই এরকমভাবে আর কাউকে অনুভব করেননি।
অরণ্যের মাঝে রাত কাটালেও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন শাসা। চোখের সামনে দিয়ে সেলুলয়েডের মতো ভেসে গেল। একের পর এক স্মৃতির ছবি। এ জীবনে বহু নারীর সঙ্গ পেয়েছেন কিন্তু মাত্র কয়েকজনের কথাই এখনো মনে রেখেছেন।
প্রথম যেবার সেনটেইনের কাছে হাতে-নাতে ধরা পড়েছিলেন, লাইজল আর কার্বোলিক সাবান মেশানো পানিতে চুবিয়ে রেখেছিল মা। মনে পড়তেই হেসে ফেললেন শাসা।
আরেক জনের স্মৃতি এখনো বেশ জ্বলজ্বল করে মনের মাঝে; তারা; তার সন্তানদের মা। কিছু সময়ের জন্য হলেও একত্রে বেশ সুখের দিন কাটিয়েছেন। তারপরেই বনে গেছেন শত্রু।
তারা’র পরে আরো শ’খানেক নারীর সাথে অন্তরঙ্গতা হলেও কেউই তাঁর একাকীত্ব ঘোচাতে পারেনি।
আর একেবারে সম্প্রতি তরুণী নারী দেহের মাঝে অবিনশ্বরতা খুঁজতে গেলেও হার মেনেছেন শাসা। অর্থহীন সঙ্গীতের মাঝে হারিয়ে গিয়ে এরা হয়ত নিজেরাই জানে না যে কী খুঁজছে। তাই তিনি আবারো একা হয়ে গেলেন।
একজন সৎ ভাই থাকলেও তাকে সহোদর হিসেবে কখনো ভাবেননি শাসা আর সেনটেইনও তাকে একমাত্র সন্তান হিসেবেই মানুষ করে তুলেছেন।
পরিচারকদের দল, ব্যবসায়ের অংশীদার, নিজের ছেলে-মেয়ে পরিচিত অপরিচিত এমন অসংখ্য মানুষের ভিড়ে কেবল মাত্র একজনের সাথেই তিনি সবকিছু শেয়ার করতে পারেন। সর্বক্ষণ যিনি তাঁকে ভালোবাসা আর উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন।
মা; কিন্তু সেনটেইনেরও ছিয়াত্তর চলছে। আর নিজের একাকীত্বে আজকাল নিজেই চমকে উঠেন, সামনের দিনগুলোর কথা ভাবলেই কেমন যেন বিবশ হয়ে আসে সবকিছু।
ঠিক সেই মুহূর্তে পাশে বসে থাকা নারী এমনভাবে তার হাতে চাপ দিল যেন বুঝতে পেরেছে শাসা’র অন্তরের বেদনা। মাথা ঘুরিয়ে সেই মধুর মতো সোনালি রঙা চোখ দুটোর দিকে তাকাতেই দেখা গেল কোনো রকম অস্বস্তি ছাড়াই তাকিয়ে আছেন এলসা। কেটে গেল সব বিষণ্ণতা; এতদিনে শান্তি খুঁজে পেয়েছেন শাসা।
ছোট্ট ট্রি-হাউজের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে আফ্রিকান চাঁদের নরম আলো। এমন একটা মুহূর্ত যখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখে পুরো দুনিয়া আর রঙ ছড়ায় অরণ্য।
সামনের দিকে ঝুঁকে খুঁড়ের দেয়াল ভেদ করে ফায়ারিং অ্যাপারচারের ভেতর দিয়ে তাকালেন শাসা। খানিকটা শব্দ শুনেই বলে উঠলেন, “সাবধান! একটা কিলার ক্যাটকে দেখতে পাচ্ছি।”
শুনতে পেলেন এলসা। আফ্রিকান বন্য জগৎ সম্পর্কে তিনিও জানেন। তাই বুঝতে পারলেন শাসার কথা। আস্তে আস্তে করে কাঁধে তুলে নিলেন রাইফেল। সোনালি একটা ছায়ার মতই নিঃশব্দে গোপনে এগিয়ে আসছে চিতাবাঘ। কেউই শুধু চোখের পাতা ফেলা ছাড়া আর কোনো ধরনের নড়াচড়া করছে না। এমনকি নিঃশ্বাস পর্যন্ত মেপে মেপে ফেলছেন; কানের কাছে ড্রাম বাজাচ্ছে হৃদপিণ্ড।
দ্রুত আলো সরে যাওয়ায় ফাঁদ পাতা গাছটার চারপাশে চক্রাকারে ঘুরছে চিতাবাঘ। কল্পনার চোখে যেন জটাকে পরিষ্কার দেখতে পেলেন শাসা।
গুলি ছোঁড়ার মতো আলো প্রায় নেই বললেই চলে। হঠাৎ করেই গাছে উঠে গেল চিতা। কোনো রকম শব্দ হল না। এত দ্রুত ব্যাপারটা ঘটে গেছে যে মনে হলো দুজনেরই হৃদপিণ্ড অচল হয়ে গেছে। এরপরই শুরু হলো উন্মাদের মতো দুরু দুরু কাঁপুনি।
ডালের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে চিতা। অন্ধকারের মাঝে আরো গাঢ় অন্ধকার তৈরি করেছে এটার দেহের গড়ন। পলিশ করা ওয়ালনাট কাঠ দিয়ে তৈরি রাইফেলের বাটে গাল ঠেকিয়ে অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিলেন এলসা। এবারে চিতাটা’কে স্পষ্ট দেখা আর যাচ্ছে না।
রাইফেল নামিয়ে রাখলেন এলসা। মাথা ঘুরিয়ে এলসার কানে কানে ফিসফিস করে উঠলেন শাসা, “কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।” শাসা’র গাল স্পর্শ করে নিজের মত দিলেন এলসা।
বাইরে শোনা যাচ্ছে হরিণটাকে আটকে রাখা শিকল ধরে টানার শব্দ। কল্পনার চোখে চিতাটাকে দেখতে চাইলেন শাসা। ঠিক যেন ডালের উপর পেট দিয়ে শুয়ে আছে জটা; এক পা আগে বাড়িয়ে হুকের মতো হরিণটাকে আকড়ে ধরে নিজের কাছে টেনে এনে খেতে লাগল ক্ষুধার্তের মত।
অন্ধকারের মাঝে স্পষ্ট শোনা গেল মাংসের গায়ে চোখা দাঁত বসিয়ে ছিঁড়ে খাওয়ার শব্দ।
রাতটা অসম্ভব দীর্ঘ হলেও একটুও ঘুমাতে পারলেন না শাসা। শিকারি হিসেবে উনার দায়িত্ব হলো চিতা বাঘটার দিকে লক্ষ রাখা। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা। পরেই কাঁধে ধাক্কা খেল এলসার ঘুমন্ত মুখ। আস্তে করে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন শাসা; যেন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন এলসা।
ক্লান্ত, ছোট্ট একটা শিশুর মতই অঘোরে ঘুমালেন এলসা। শাসা’র গালে এসে লাগছে নিঃশ্বাসের উষ্ণতা। নিজের হাত দুটো একেবারে অবশ হয়ে গেলেও একটুও নড়লেন না শাসা।
অন্যদিকে বাইরে থেমে থেমে একটু পরপরই হাড় চিবোচ্ছে চিতা। একবারও শব্দ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভয় পেয়ে গেলেন শাসা। চলে গেল নাকি! কিন্তু নাহ, একটু পরেই আবার শিকল টানার শব্দ হলো।
তিনি চাইলেই স্পটলাইট ফেলে চিতার চারপাশে আলোকিত করে তুলতে পারতেন; কিন্তু শাসা’র মাথায় এরকম কোনো দুই নম্বরী বুদ্ধি আসেইনি।
শাসা নিজে কিন্তু ফাঁদ পেতে পশু মারা পন্দ করেন না। এভাবে কখনোই শিকার করেন নি।
জীবনে তিনি যত চিতা কিংবা সিংহ মেরেছেন সব সময় পায়ে হেঁটেই ওগুলোকে অনুসরণ করেছিলেন। অবশ্য এতে করে শ’খানেক ব্যর্থতার দায় বহন করতে হয়েছে। তবে সফল ডজন খানেক শিকারই এখন পর্যন্ত জ্বলজ্বল করছে স্মৃতির মণিকোঠায়।
তাই বলে এলসা কিংবা অন্য ক্লায়েন্টরা টোপ ফেলে শিকার করলেও কিছু মনে করেন না শাসা। এরা কেউই তার মতো আফ্রিকান নয়; এছাড়া বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করেই এ সুবিধা ভোগ করেন। কিন্তু তিনি আলাদাভাবেই ভাবেন।
অন্ধকার হাইড আউটে এলসার পাশে বসে কেন যেন মনে হলো যে তিনি আর কোনদিন শিকার করতে পারবেন না। তিনি তার শেষতম হাতি, সিংহ আর চিতা মেরে ফেলেছেন। চিন্তাটা মাথায় আসতেই একই সাথে আনন্দ আর বিষণ্ণতা উভয়ই অনুভব করলেন। কল্পনা করলেন ভবিষ্যতে এই নারীকে পাশে নিয়ে আনন্দ ভ্রমণগুলো কেমন কাটবে! রাশিয়া, কানাডা, ব্রাজিল আর তানজানিয়া; পোলার বিয়ার থেকে শুরু করে পঞ্চাশ ইঞ্চি চওড়া শিং অলা ষাড় শিকার করতেই বা কতটা রোমাঞ্চ উপভোগ করবেন। এসব সুখচিন্তা করতে করতেই কেটে গেল সারা রাত।
খানিক বাদে নদী তীর থেকে ভেসে এলো এক জোড়া রবিনের ডুয়েট কোরাস! ঠিক যেন বলতে চাইছে “করো না! এটা করো না।”
উপরের দিকে তাকিয়ে প্রভাতের আগমনী আলো দেখতে পেলেন শাসা। আর ঠিক পনের মিনিটের মাঝেই গুলি ছোঁড়ার মত আলোকিত হয়ে যাবে চারপাশ।
এলসা’র গাল ধরে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলেন শাসা। অথচ সাথে সাথে জেগে গেলেন মহিলা। তার মানে বহু আগেই ঘুম ভাঙ্গলেও তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলেন শাসা’র সান্নিধ্য।
“চিতাটা কী এখনো আছে?” প্রায় শাসা’র কানে কানে জানতে চাইলেন এলসা।
“জানি না।” একই রকম মোলায়েম স্বরে উত্তর দিলেন শাসা। প্রায় দুই ঘন্টা আগে শেষ শব্দ শুনেছেন। “তৈরি হয়ে যান।”
চেয়ারে বসে সিধে হয়েই রাইফেলের হাতল ধরলেন এলসা। এতক্ষণে রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে শাসার হাতে আর কাঁধে। অথচ কেমন যেন আনন্দে ভরে উঠল বুক।
আবলুস গাছের ঘন পাতার চাঁদোয়া সরিয়ে উঁকি দিলেন শাসা। নাহ, ফাঁদ পাতা গাছটার ডালগুলো তো শূন্যই মনে হচ্ছে। এলসা’র জন্য দুঃখ হলো। চলে গেছে চিতা।
মাথা ঘুরিয়ে যেই না বলতে যাবেন তখনই আবার উত্তেজনায় দুরু দুরু করে উঠল বুক।
ইম্পালা হরিণটার বেশির ভাগ অংশই উধাও হয়ে গেছে। কিন্তু একই সাথে সাপের মতো কিছু একটাও ঝুলছে। প্রথমে বুঝতে না পারলেও হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলেন, “লেজ চিতা’র লেজ।” ছবির ধাঁধা মেলাবার মতো করেই মিলে গেল পুরো চিত্র।
গলা আগে বাড়িয়ে ডালের গায়ে সমান হয়ে শুয়ে আছে চিতা। পেটভর্তি খাবার থাকায় একেবারে অলস ভঙ্গিতে চিবুক ঠেকিয়ে পড়ে আছে। কেবল লেজটা ঝুলছে।
এলসাও বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু আস্তে করে উনাকে থামালেন শাসা। বাইরে আরেকটু আলো ফোঁটার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু টেনশনে পড়ে গেছেন এলসা।
একটু পরেই বেশ আলো দেখা গেল চারপাশে। চিতাটাকে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাথাখানিক তুলে কিছু একটা শোনার জন্য কান পেতে ছিল। চোখে এসে পড়েছে আলো আর ঠিক যেন শাসাদের দিকে তাকিয়েই রাজকীয় ভঙ্গিতে চোখ পিটপিট করে তাকাল। পুরো ভঙ্গিমাটা এতটাই সুন্দর যে শাসা’র বুকে মোচড় দিয়ে উঠল।
এবারে সময় হয়েছে। এলসা’র হাতে আলতো করে টোকা দিলেন শাসা। রাইফেলের টেলিস্কোপিক সাইটের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছেন এলসা। শাসা মনে মনে আশা করলেন গুলিটা যেন ঠিক চিতার হৃদপিণ্ডে গিয়ে ঢোকে।
কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল।
পুরো শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়াল চিতা। আড়মোড়া ভাঙ্গতেই বেঁকে গেল পেছন দিক। “নাউ!” আস্তে করে নিঃশব্দে এলসা’কে আদেশ দিলেন শাসা। “গুলি করুন!”
হাই তুলল চিতা। দেখা গেল গোলাপি জিহ্বা।
“নাউ!” টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে শাসা মনে মনে চাইলেন এলসা’কে দিয়ে গুলি ছুঁড়তে। কথা বলতে কিংবা স্পর্শ করতে ভয় পাচ্ছেন। পাছে এলসা’র একাগ্রতা ভঙ্গ হয়।
হঠাৎ করেই লেজ নাড়িয়ে কোনো রকম পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই এক লাফ দিয়ে বিশ ফুট উঁচু থেকে মাটিতে নেমে এলো চিতা। একটুও কোনো শব্দ হলো না।
ঝাড়া এক মিনিট ধরে নিঃশব্দে বসে আছেন শাসা আর এলসা। অবশেষে ছোট্ট একটা ক্লিক করে সেফটি ক্যাচ অফ করে রাইফেল নামিয়ে রাখলেন এলসা। চোখ ঘুরিয়ে শাসার দিকে তাকালেন। প্রভাতের আলোয় দেখা গেল মুক্তোর মতো অশ্রুবিন্দু “এত সুন্দর!” ফিসফিসিয়ে উঠলেন এলসা, “আমি মারতে পারব না, অন্তত আজকে তো নয়ই।”
সাথে সাথে বুঝে ফেললেন শাসা। আজ তাদের দিন। দু’জনেই দুজনের প্রেমে পড়ে গেছেন।
“চিতাটাকে তোমাকে উৎসর্গ করলাম।” জানালেন এলসা।
“আমাকে এতটা সম্মান দেবার জন্য-” এলসা’কে কিস করলেন শাসা। প্রায় শিশুর মতই সরলভাবে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন দুজনে। এই মিলন হল আত্মিক। তাই আজকের মতো আশীর্বাদ ধন্য এই দিনে কোনো হত্যা নয়।
***
ঠিক যেন কাকতালীয় ভাবে সম্পূর্ণ সেরে উঠল শন। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে শিকারীদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। সাফারি কোম্পানির খ্যাতিই নির্ভর করে ক্লায়েন্টের অর্জনের উপর।
তাই টয়োটা ঢুকতেই আশা নিয়ে পেছনে তাকালেও অসন্তুষ্টিতে বেঁকে গেল মুখ। প্রথমেই কথা বলল মাতাতু’র সাথে। বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল জোরাবো ট্র্যাকার,
“শয়তানটা দেরিতে এসে তাড়াতাড়ি চলে গেছে।”
“আই এম সরি, সিগনোরারা।” ট্রাক থেকে এলসা’কে নামতে সাহায্য করল শন্।
“এটাই তো শিকার।” বিড়বিড় করে উঠলেন এলসা। মহিলার এমন দার্শনিক মার্কা চেহারা আগে আর কখনো দেখেনি শন। সাধারণত ব্যর্থ হলেই তার মতই ক্ষেপে উঠেন।
“যেমনটা পছন্দ করেন, সেভাবে হট শাওয়ার তৈরি করা আছে। নাশতা’ও এসে যাবে।”
ডাইনিং টেন্টে এলসা আর শাসা’কে ঢুকতে দেখেই সকলের চেহারায় ফুটে উঠল সান্তনা। দু’জনেই স্নান সেরে পরিষ্কার পোশাক পরেছেন। শাসা’তো একেবারে শেভ করে লোশনও লাগিয়েছেন।
“ব্যাড লাক্ বাবা; সো সরি সিগনোরা” সকলে মিলে বলে উঠলেও শাসা আর এলসা’র তৃপ্তি মাথা চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেল প্রত্যেকে। যাই হোক এমনভাবে নাশতা সারা হলো যেন বিশ্ব রেকর্ড হয়ে গেছে, চিতা মারা প্রতিযোগিতাতে।
“ব্রেকফাস্টের পরেই আমরা মিটিং শুরু করতে পারি।” পরামর্শ দিল গ্যারি।
“আর আমিও নতুন করে ফাঁদ পাতবো।” যোগ দিল শন্।
“মাতাতু বলেছে। চিতা’রা কখনোই আতঙ্কিত হয় না। তাই আজ রাতে আবার চেষ্টা করা যাবে। এইবার আপনার সাথে আমি যাবো। যার যার কাজ আসলে তাকেই করতে দিতে হয়।”
কিছু না বলে শাসার দিকে তাকালেন এলসা। তারপর চোখ নামালেন কফি-কাপে।
“আসলে, হয়েছে কী শুরু করলেন শাসা, “সত্যি কথা বলতে, আমি আর এলসা মানে সিগনোরা পিগটেলি আর আমি…” শব্দ খুঁজতে লাগলেন শাসা। হা করে বেকুব বনে যাওয়া বাবার দিকে তাকিয়ে রইল তিন ইয়াং কোর্টনি।
“তোমাদের বাবা আমাকে ভিক্টোরিয়া ফলস দেখাবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন।” শাসা’কে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন এলসা। কোন মতে বাঁচলেন শাসা।
“আমরা বীচক্রাফট নিয়ে যাবো।” তাড়াতাড়ি অজুহাত বানালেন, “সিগনোরা পিগটেলি কখনো জলপ্রপাতটা দেখেননি। তাই এ সুযোগটাই ভাল মনে হলো।”
পরিবারের অন্য সদস্যরাও হাফ ছেড়ে বাঁচল। “বাহু, আইডিয়াটা তো চমৎকার। এত সুন্দর একটা জায়গা, আপনার বেশ ভালো লাগবে। সিগনোরা।”
“মাত্র এক ঘণ্টার জার্নি।” মাথা নাড়ল গ্যারি। “আপনারা ভিক ফলস্ হোটেলে লাঞ্চ করে নাশতার আগেই এখানে ফিরতে পারবেন।”
“আর তারপরে চারটায় আবার চিতার খোঁজে হাইড আউটে যেতেও কষ্ট হবে না।” এমত হল শন্। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে এলসা’র সম্মতির জন্য।
আবারো চকিতে শাসা’র দিকে তাকালেন এলসা। বড় করে শ্বাস নিয়ে শাসা জানালেন, “আমরা আসলে ভিক ফলস হোটেলে দুই-একদিন বেড়াব।”
আস্তে আস্তে বিভিন্ন ধরনের চিন্তা এসে ভর করল তরুণ মুখগুলোতে।
“ঠিক তাই। ঘুরে দেখতে তোমাদের তো সময় লাগবে। সবার আগে সম্বিত ফিরে পেল বেলা।
“বেলা ঠিকই বলেছে। তিন থেকে চারদিন লেগে যাবে সবটুকু ঘুরে দেখতে।”
“গ্যারি সপ্তাহ লেগে যাবে বললেই তো পারো।” শনে’র দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল গ্যারি আর বেলা।
***
পরিষ্কার ঠাণ্ডা বাতাসের মাঝে ছড়ানো ছিটানো মেঘপুঞ্জ ভেদ করে আট মাইল দূরে দেখা দিল ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। দুই হাজার ফুট উঁচুতে সোজা আকাশের বুকে উঠে যাওয়া রুপালি পর্বতমালা ঠিক তুষারের মতই সাদা দেখাচ্ছে।
সামনেই সূর্যের আলো পড়ে চমকাচ্ছে বিশাল জাম্বোজি। একটু পরেই দেখা দিল প্রধান গিরি সংকট। নিচে তাকিয়ে নদীটা দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন শাসা আর এলসা। এক মাইলেরও বেশি চওড়া বড় সড় নদীটা তীব্র বেগে এসে নেমে গেছে ঝাড়া সাড়ে তিনশ ফুট নিচে। ফেনা আর ফেনা চারপাশে; ফোয়ারার মতো আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ছে পানি। গভীর খাদের কিনারে কালো পাথরের দুর্গ দু’ভাগ করে দিয়েছে নদী। এর উপরে টাওয়ারের মতো উঁচু হয়ে আছে ফোয়ারার মেঘ; চট করে তাকালে রংধনুর সাত রঙ দেখা যাবে।
জলপ্রপাতের নিচে নদীর সবটুকু পানি সেকেন্ডে আটত্রিশ হাজার কিউবিক ফুট হিসেবে পাথরের চূড়া দিয়ে ধেয়ে এসে পড়ছে গিরিখাদের ভেতরে।
ডান হাতি মোড় নিয়ে এয়ারক্রাফট চালাচ্ছেন শাসা; যেন নিচের দৃশ্য পুরোটাই উপভোগ করতে পারেন এলসা।
প্রতিবার ঘূর্ণনের সাথে আরো নিচে নেমে আসছে বীচ ক্রাফট। একবার তো রুপালি পানির ফোয়ারা এয়ারক্রাফটের গায়ে এমন ভাবে আচড়ে পড়ল যে খানিকের জন্য মনে হলো দুজন অন্ধ হয়ে যাবেন; আবার উর্বকাশে সূর্যের আলোয় উঠে গিয়ে রংধনুর হার দেখতে পেলেন শাসা আর এলসা।
গ্রামের বাইরে ছোট্ট এয়ার স্ট্রিপে ল্যান্ড করলেন শাসা। ইঞ্জিন বন্ধ করে তাকালেন এলসা’র দিকে। বিস্মিত চোখ জোড়া প্রায় ধর্মীয় ভাবাবেশের মতই বিভোর হয়ে আছে। “এবারে আফ্রিকা ক্যাথেড্রালে তোমার উপাসনার পালা।” মোলায়েম গলায় জানালেন শাসা।
“এই একটামাত্র জায়গায় খুঁজে পাবে পুরো মহাদেশের সত্যিকারের রহস্য আর বিশালতা।”
***
ভাগ্য ভালো যে হোটেলে লিভিংস্টোন সুইট খালি পেয়ে গেলেন শাসা আর এলসা।
প্রাচীন আমলের নকশা মেনে তৈরি করা হয়েছে পুরো দালান। দেয়ালগুলো পুরু আর রুমগুলোও বেশ বড় বড়; একই সাথে ঠাণ্ডা আর আরামদায়য়কও বটে।
ডেভিড লিভিংস্টোনের প্রথমবার আবিষ্কারের মাত্র কিছু বছর পরেই-জলপ্রপাতটা খুঁজে পান অভিযাত্রী থমাস বেইনস; উনার আঁকা ড্রইং এর প্রিন্ট আউট দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো সুইট। সিটিং রুমের জানালা দিয়ে তাকাতেই গিরি সংকর আর উপরকার রেলওয়ে সেতু দেখা গেল। পুরো কাঠামোটা এতটা হালকা দেখাচ্ছে যে ঠিক যেন একটা উড়ন্ত ঈগলের পাখা।
সুইট থেকে বের হয়ে হাতে হাত রেখে পায়ে হাঁটা পথ ধরে দুজনে ঘুরে দেখল গিরিখাদ, রেইন ফরেস্ট পানির ফোয়ারা। নিরন্তর পানি পাওয়ায় এখানকার উদ্ভিদ প্রজাতি অত্যন্ত সবুজ। আছড়ে পড়া পানির ভার কাঁপছে পায়ের নিচের জমিন। পানির ছিটে এসে ভিজিয়ে দিল দুজনের পোশাক, মাথা, চুল। আনন্দে হেসে ফেললেন শাসা আর এলসা।
একেবারে কিনারের কাছে পড়ে থাকা পাথরের উপর দু’জনে পাশাপাশি বসে গিরিখাদের উপর পা ঝুলিয়ে দিলেন; ঠিক নিচেই সবুজ রঙা ঘূর্ণি বানিয়েছে উন্মত্ত জল।
“দেখো!” আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন শাসা। সূর্যের কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে ছোট্ট একটা শিকারি পাখি; ছুরির ফলার মতো পাখাগুলো সোজা তীরবেগে নেমে আসছে নিচে।
“টাইটা’র বাজপাখি।” উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন শাসা, “আফ্রিকার সবচেয়ে রেয়ার পাখিগুলোর একটি।”
উড়ন্ত অবস্থাতেই শিকার ধরে নিল বাজপাখি, পালক ছড়িয়ে সাথে সাথে মেরেও ফেলল। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল বহু নিচে।
কুমিরের লেজের স্টেক দিয়ে ডিনার সারলেও স্বাদটা মনে হলো লবসটারের মতোই। কিন্তু স্যুইটে ঢুকতেই রাজ্যের লজ্জা এসে ঘিরে ধরল দু’জনকে। সিটিং রুমে বসে ক্যানাকে খেলেন শাসা। অবশেষে সাহস করে বেডরুমে ঢুকতেই দেখতে পেলেন বালিশের উপর শুয়ে থাকা এলসা। চকচকে কালো চুল ছড়িয়ে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে; কিন্তু হঠাৎ কেন যেন আতঙ্কে জমে গেলেন শাসা। শেষ বার দুয়েকের ঘটনাতে আত্মবিশ্বাসের অনেকখানিই টলে গেছে। আর বয়সও তো কম হল না।
অন্যদিকে হেসে ফেললেন এলসা। হাত দুটো তুলে আমন্ত্রণ জানালেন শাসা’কে। মনে মনে নিজেকে সামলালেন শাসা। চিন্তার কিছু নেই; এমনভাবে আর কোনো নারীকে দেখে এত আকর্ষণ বোধ করেননি আগে।
সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গার পরে পরস্পরকে একে অন্যের বাহুতে আবিষ্কার করলেন দুজনে। ততক্ষণে উঁচু জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে রোদ।
আত্মতৃপ্তিতে হেসে ফেললেন এলসা : “মাই ম্যান।”
***
একদিন পার হয়ে গেলেও শেষ হলো না তাদের হানিমুন। গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে লাগল দিনের পর দিন। ছোট ছোট তুচ্ছ কাজগুলোও দুজনে মিলে একত্রে করে ফেলেন। এতদিন যেগুলো নিয়ে শাসা কোন চিন্তাই করতেন না। কিংবা সময়ও পেতেন না।
প্রতিদিনি দেরি করে ঘুম থেকে উঠেও বাকি সময়টা পুলের পাশে বসেই কাটিয়ে দেন শাসা আর এলসা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরস্পরের সান্নিধ্যে বসে বই পড়ে পার করে দেন আর সান ট্যান অয়েল লাগাবার অযুহাতে স্পর্শ করেন একে অন্যের দেহ।
এলসা’র পরিপূর্ণ নারী দেহে খুঁত বলতে শুধু সন্তান ধারণের চিহ্নগুলোই ফুটে আছে। কিন্তু এতে আরো বেশি করে আকৃষ্ট হন শাসা। ফুটে উঠেছে তার অভিজ্ঞতা আর জীবনবোধের নিদর্শন।
কথা বলার সময়ে যা আরো বেশি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। গল্প করতে করতে কোথা দিয়ে যে অলস সময় ফুরিয়ে যায় কেউই টের পান না।
ব্রুনোর ক্যানসারে মৃত্যু আর তাঁর নিজের অসহায়তার কথা বলে যান এলসা। এরপর কেটে গেছে সাতটি বছর। ভেবেছিলেন সেই একাকীত্ব বুঝি আর কখনোই পূরণ হবে না; এরপর শাসা’র হাত ধরে বুঝিয়ে দেন যে, এবারে তিনি হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার সন্ধান পেয়েছেন।
ছেলেমেয়েদের কথা জানিয়ে ছেলের ব্যাপারেও আপেক্ষ করেন পিতার মতো পরাক্রশালী হয়নি ব্রুনেনা।
নিজ পুত্রদের কথা স্মরণ করেন শাসা। দু’জনেই ভালবাসেন গান, বই আর থিয়েটার। দু’জনেরই আছে ঘোড়া আর শিকার প্রীতি। সবশেষে একে অন্যের কাছে স্বীকার করেছেন অর্থ আর ক্ষমতার প্রতি পরস্পরের দুবর্লতা।
কোনো কিছুই বাদ না দিয়ে এক পর্যায়ে তো এলসা বলেই ফেললেন যে, “আমার মনে হচ্ছে তুমি আর আমি মিলে চমৎকার একটা জুটি হবো।”
“আমিও তাই বিশ্বাস করি” গভীরভাবে বলে উঠলেন শাসা; যেন পরস্পরের কাছে প্রতিজ্ঞা করছেন।
“ওহ, ঈশ্বর!” সত্যিকার অর্থেই অবাক হয়ে গেছেন শাসা, “আজ বৃহস্পতিবার। চারদিন কেটে গেছে যে আমরা এখানে। বাচ্চারা নিশ্চয়ই চিন্তায় পড়ে গেছে।” খোলা ছাদে বসে নাশতা করছেন দু’জনে।
“আমার মনে হয় ওরা অনুমান করে নিয়েছে। শাসা’র জন্য আমের টুকরো কাটতে গিয়ে চোখ তুলে তাকালেন এলসা। হাসলেন।” আর আমার তো মনে হয় তোমার ভয়ংকর ছেলে-মেয়েগুলোকে বাচ্চা বলারও কিছু নেই।”
“ভ্যান উইক কালকেই চিজোরো’তে পৌঁছে যাবেন।” মনে করিয়ে দিলেন শাসা।
“জানি।” বড় করে শ্বাস টানলেন এলসা, “কিছুতেই যেতে মন টানছে না; তারপরেও উনার সাথে দেখা করতে হবে।”
***
স্যার ক্লারেন্স ভ্যান উইক একজন খাঁটি আফ্রিকান। ব্রিটিশ রাজত্বের অংশ থাকাকালীন তাঁর চিফ জাস্টিস বাবা পেয়েছিলেন এই টাইটেল আর উত্তরাধিকার সূত্রে তা বর্তেছে ভ্যান উইকের উপর।
স্যার ক্লারেন্স উটন আর স্যান্ডহার্সের ছাত্র’ও ছিলেন। ইয়ান স্মিথ সরকারের মন্ত্রী হলেন স্যার ক্লারেন্স।
চিজোরা’তে যাবার পথে সালিসব্যুরো থেমে এই মিটিং-এর আয়োজন করেছেন শাসা আর গ্যারি। আলোচনা ছাড়াও শিকারি স্যার ক্লারেন্সের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থাও করে রাখা হয়েছে।
রোডেশিয়ান এয়ারফোর্স হেলিকপ্টারে চড়ে চিজোরা’তে পৌঁছেছিলেন স্যার ক্লারেন্স। সাথে আরো দু’জন সহকারী আর এক জোড়া বডিগার্ড। শন’কে আগে থেকেই খবর দিয়ে রাখার সালিসবুয়ো থেকে বাড়তি স্টাফ, রসদ আর ইকুপমেন্ট নিয়ে আসা কোনো সমস্যাই হলো না।
মাসালা গাছের নিচে বড় কনফারেন্স টেবিল পেতে দিয়ে স্যার ক্লারেন্স আর তার দলের জন্যে বাড়তি চেয়ারও আনা হলো। বাবার পার্সোনাল অ্যাসিসট্যনান্ট হিসেবে যোগ দিল ইসাবেলা।
ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার স্যার ক্লারেন্স শাসা কিংবা শনের চেয়েও লম্বা। তার রাজনৈতিক আর আর্থিক মেধার পাশাপাশি নারী প্রীতিও সকলেরই জানা।
মাসালা গাছের নিচে বসে দেশের সম্পদ, উৎপাদন, কমিশন আর হ্যান্ডলিং ফিস্ নিয়ে আলোচনা করলেন সকলে।
রোডেশিয়া’র খনিজাত দ্রব্য, তামাক, আর ক্রোমের মতো দুর্লভ পদার্থ বিশ্ব বাজারে ছড়িয়ে দেবার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে গ্যারি কোর্টনি আর কোর্টনি এন্টারপ্রাইজেস। মূলত রোডেশিয়ার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এক্ষেত্রে একেবারেই কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। এক্ষেত্রে আরো সাহায্য করছে ডারবান আর কেপ টাউন পর্যন্ত চলে যাওয়া রেলপথ।
এবারে এর সাথে যুক্ত হলো আরো নতুন সব উচ্চাকাক্ষা। পিগনাটেলি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কাজকর্ম খুব সাবধানে পরীক্ষা করার পর এই এন্টি সাংশনস অ্যাকটিভিটিজে যোগ দেবার জন্য এলসা পিগনাটেলি’কে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাক্যের পর পিগটেলি ইন্ডাস্ট্রিজ হলো ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম টোবাকো কোম্পানি। এছাড়াও টারান্টো আর কানাডাতেও খনি আর স্টেইনলেস স্টিল মিল আছে।
ফলে রোডেশিয়া’র পণ্যের জন্য এ বাজার অত্যন্ত লাভজনক হলেও দর কষাকষি থামছে না।
অত্যন্ত সভ্য আর বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হলেও কেউই নিজেদের এক ইঞ্চি জমি ছাড়তেও রাজি নয়। বিস্মিত হয়ে গেল বেলা।
সুন্দরী এলসা পিগনাটেলি ভালভাবেই জানেন কিভাবে নিজের সৌন্দর্য কাজে লাগাতে হয়।
স্যার ক্লারেন্স অত্যন্ত ভদ্র হলেও প্রতিটি পাই পয়সার হিসাব করছেন নিখুঁত তালে।
অন্যদিকে টেবিলে নিজের জায়গায় চুপচাপ বসে দরকষাকষির পুরো দায়িত্ব গ্যারির হাতে ছেড়ে দিয়েছেন শাসা। যাই হোক মাঝে মাঝে আবার মন্তব্য করে সাহায্য করছেন খেই হারিয়ে ফেলা আলোচনাকে পথভ্রষ্ট হবার হাত থেকে বাঁচাতে।
আলোচনাকৃত অর্থের পরিণাম শুনে বেলা’র দম বন্ধ হবার যোগাড়। তিন বিলিয়ন ওভারস থেকে আড়াই পারসেন্ট শেয়ার পাবে কোর্টনি এন্টারপ্রাইজ। কোনো রকম বিনিয়োগ ছাড়াই আগামী বারো মাসে ভরে উঠবে তাদের ডালা। শ্রদ্ধা মেশানো দৃষ্টি নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল বেলা।
আলোচনা শেষে লাঞ্চটাও হলো বেশ জমকালো আর অত্যন্ত উপাদেয়। অ্যালোয়েট হেলিকপ্টারে করে স্যার ক্লারেন্স উকৃষ্ট রোডেশিয়ান বীফও নিয়ে এসেছেন। পুরো সকাল জুড়েই বার-বি-কিউ নিয়ে ব্যস্ত ছিল শন আর তার শেফ।
খাবার টেবিলেও ইসাবেলার প্রতি নিজের আকর্ষণ নিয়ে কোনোই রাখ ঢাক করলেন না স্যার ক্লারেন্স। অন্যদিকে এমন একজন মানুষের মনোযোগ পেয়ে ইসাবেলাও খুশি। পছন্দ করে ফেলল স্যার ক্লায়েন্সের ঢেউ খেলানো ঘন কালো চুল, চোখ আর বুদ্ধিমানের মতো রসিকতা করার ক্ষমতা।
চোখ নামিয়ে স্যার ক্লারেন্সের পায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল বেলা। মাথা খারাপের মতো হলেও মনের মাঝে উঁকি দিয়ে গেল নানা সম্ভাবনা।
প্রায় সাথে সাথে মনে পড়ে গেল ন্যানীর সতর্কবাণী।
“কোর্টনিদের রক্ত বেজায় গরম। তোমাকে তাই সাবধানে থাকতে হবে মিসি আর ভুলে যেও না যে তুমি একজন নারী।”
বেলা জানে যে স্যার ক্লারেন্স বিবাহিত; কিন্তু বহুদিন হয়ে গেল, সে নিজেও কোনো পুরুষের বুকে মাথা রেখে শোয়নি। সুতরাং দেখা যাক!
লাঞ্চ শেষ করে আবারো কনফারেন্স টেবিলে ফিরে এলেন সবাই। আর বেলা’র কাছে মনে হল ডম পেরিগনন তাদেরকে মাতাল করে দেবার পরিবর্তে আরো বেশি করে চাঙ্গা করে দিয়েছে।
ঠিক চারটায় ঘড়ির দিকে তাকাল গ্যারি। “সবকিছু তাহলে আগামীকাল সকালের জন্য মুলতবি করা যাক।”
গোলগলা ঘুঘু মারার জন্য সকলে মিলে ট্রাকে করে পুলের কাছে চলে এলো।
সামনের ট্রাকে ইসাবেলার পাশে উঠে বসলেন স্যার ক্লারেন্স। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে লাফ দিয়ে নেমে দ্বিতীয় ট্রাকে গ্যারি’র পাশে গিয়ে উঠে বসল বেলা। স্যার ক্ল্যারেন্স’কে নিয়ে না হয় একটু খেলা করেই দেখা যাক না কী হয়! অন্যদিকে উচ্ছ্বাস ঝড়ে পড়ছে, গ্যারির কণ্ঠে। বোনের কাঁধের উপর এক হাত তুলে দিয়ে বলে উঠল,
“গড আই লাভ ইট। নিষেধাজ্ঞা আরোপের জাতিসংঘের এই আহাম্মকি সিদ্ধান্ত বেশ রোমান্টিক তাই না। নিজেকে যেন ক্যাপ্টেন ব্লাড মনে হচ্ছে। ইয়ো হো হো অ্যান্ড আ বোতল, অব রাম। দেশপ্রেমের সাথে সাথে পকেটে ঢুকে যাবে। পচাত্তর মিলিয়ন পাউন্ডস হার্ড ক্যাশ, ট্যাক্সম্যানেরা যার খোঁজও পাবে না। বেশ মজা না?”
হেসে ফেলল বেলা, “তুমি আর কত ধনী হতে চাও?”
এবারে হাত সরিয়ে নিল গ্যারি, “তুমি কি বলতে চাও যে আমি অর্থ লোলুপ? সেটা না বেলা, আমি শুধু এই মহান খেলার একজন খেলুড়ে। পুরস্কারের জন্যে খেলছি না, জেতার আনন্দেই খেলছি। জীবনের অনেকটা সময়েই কেবল ব্যর্থতা পেয়েছি। এখন আমাকে জিততেই হবে।”
“তাই তো” এবারে বেলাও বেশ সিরিয়াস হয়ে উঠল,
“তুমি সম্পদ নিয়ে খেলছ আর হাজার হাজার মানুষ বাধ্য হবে তোমার ইগো সামলাতে।”
“যদি আমি জিতে যাই; তাহলে ওরাও জিতে যাবে। নিষেধাজ্ঞা আরোপকারীগণ নিজেদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের জন্য সাধারণ মানুষকে অনাহার আর অভাবের দিকে ঠেলে দেন। তাই আমার মতে, এটা হল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। ওদের চেষ্টা ভণ্ডুল করে দিয়ে আমি দুঃস্থদের হয়েই লড়াই করছি।”
“ওহ, গ্যারি নিজেকে হোয়াইট নাইট ভেব না প্লিজ-”
“অবশ্যই, আমি তাই-না।” বেলা’কে থামিয়ে দিল গ্যারি। আমি হচ্ছি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার হোয়াইট নাইট, বুঝলে? দক্ষিণ আফ্রিকার উভয় সংকট কাটাবার একমাত্র উপায় হলো জনগণের অবস্থার উন্নতি সাধন বিশেষত শিক্ষা আর সম্পদ প্রাপ্তি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, প্রথা নয় বরঞ্চ মেধার জোরে গড়ে তুলতে হবে সমাজ। কৃষাঙ্গদেরকে বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করতে হবে। এমন একটি সমাজ যেখানে সবাই তার প্রাপ্য সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেই মতো অর্জন করবে-এটাই হলো পুঁজিবাদী।”
“গ্যারি, তোমাকে তো কখনো এভাবে আর কথা বলতে শুনিনি।”
“লিবারেল কিংবা ক্যাপিটালিস্ট নই। বর্ণবাদ একটা প্রাগৈতিহাসিক সামন্ত ব্যবস্থা। যে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরাপকারীদের চেয়েও এটাকে আমিই বেশি ঘৃণা করি। মধ্যযুগের ইউরোপে সামন্ততন্ত্রকে ধ্বংস করেছিল পুঁজিবাদ। শ্রম আর পণ্যের অবাধ বাজার হরণকারীকে পছন্দ করে না পুঁজিবাদ। তাই সুযোগ পেলে বর্ণবাদেকেও ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াকে মানতে চান না নিষেধাজ্ঞা আরোপকারীদের দল। তাদের উত্তম অভিপ্রায়ের পন্থা হলো ভুল।”
হা করে তাকিয়ে রইল বেলা, “এভাবে তো কখনো ভাবিনি।”
“দারিদ্রতাই দমননীতি তৈরি করে। গরিবদেরকে দমিয়ে রাখা সহজ। কিন্তু একজন শিক্ষিত আর সমৃদ্ধিশালী কাউকে চিরতরে দমিয়ে রাখা অসম্ভব।”
“তার মানে তুমি রাজনৈতিকভাবে নয় বরঞ্চ অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথাই বলছ?”
“ঠিক তাই।” মাথা নেড়ে হা হা করে হেসে উঠল গ্যারি।
“আর বছরে পচাত্তর মিলিয়ন পাউন্ড কামিয়ে আমি তার উদাহরণও সেট করে দেব।”
শনের পিছু পিছু ট্রাক নিয়ে পুলের কাছে চলে এলো গ্যারি।
দুই মাইল দূরের নদীর পরিষ্কার পানি অসম্ভব পছন্দ করে ঘুঘু পাখি। সূর্যাস্তের ঘণ্টাখানেক আগে তাই বাতাসে ধূসর নীল ধোয়ার মতো করে ঝাঁকে ঝকে ধেয়ে আসে এদিকে।
পানি থেকে পাঁচ কিংবা ছয়শ মিটার দূরে বন্দুক রেডি করল শন্। কিন্তু পাখিগুলোকে ভড়কে দিতেও চায় না। তার বদলে চায় পাখিগুলো যেন নির্বিঘ্নে পানি খেতে নদীতে এগিয়ে যায়।
জোড়ায় জোড়ায় সেট করা হল বন্দুক। আশা করা যায় প্রতিটি বন্দুক পঞ্চাশটা করে পাখি মারতে পারবে; তবে কেবল ফ্লাইং ডাভস।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে শাসা’র সাথে জোড়া বাধলেন এলসা; আকাশ বাতাস ছাপিয়ে শোনা গেল একে অন্যকে উৎসাহ দেয়ার চিৎকার; “বেলো! মন্টো বেলো!”
“জলি গুড শট! ওয়েল ডান!”
গ্যারি আর শন একসাথে পশ্চিমে পড়ে থাকা লম্বা কাঠের আঁড়ালে চলে গেল। একবার শন্ মিস্ করাতে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে হেসে ফেলল গ্যারি; নিয়ে এলো বেঁচে যাওয়া পালক ছেঁড়া পাখিটাকে। মাথার চুল ঝাঁকিয়ে গ্যারিকে অগ্রাহ্য করতে চাইল শন; কিন্তু ক্রোধে কালো হয়ে গেল মুখ।
বাকিদের কাছ থেকে দূরে দক্ষিণ দিকে স্যার ক্লারেন্সের সাথে এলো ইসাবেলা। গুলি ছুঁড়তে ব্যবহার করছে বাবার দেয়া বিশ গজ হল্যান্ড এন্ড হল্যান্ড। কিন্তু প্রায় এক বছর যাবৎ প্র্যাকটিস না থাকাতে তেমন সুবিধে করতে পারছে না।
পর পর তিনটা পাখি মিস করে একটাতে গুলি লাগাতে পারল বেলা; কিন্তু নিজের উপরই বিরক্তি লাগল, আহত পাখি একদম সইতে পারে না, “ধুত্তোরি!”
জোড়া পাখি মেরে বেলার দিকে এগিয়ে এলেন স্যার ক্লারেন্স। “বলছি কি, তোমাকে যদি কয়েকটা টিপস্ দেই, তাহলে কিছু মনে করবে?”
বেলা হাসি দিতেই ওর পেছনে চলে এলেন স্যার ক্লারেন্স। “ডান হাত দিয়ে বন্দুক ধরতে হবে।” বেলা’কে প্রায় জড়িয়ে ধরে হাত দুটো নিজের বিশাল মুঠিতে নিয়ে নিলেন স্যার ক্লারেন্স। “কিন্তু মনে রাখবে সব কাজ করবে বাম হাত। ডান হাত শুধু ট্রিগার টিপবে।”
বেলা’র কাঁধে বন্দুক তুলে দিলেন, “মাথা তোল। দুই চোখ মেলে তাকাও। পাখিটাকে দেখো, বন্দুক নয়।”
আফটার শেভ লোশন’ও ঢাকতে পারেনি স্যার ক্লারেন্সের পুরুষালি গন্ধ।
“ওহ, তাই নাকি?” আস্তে করে নিজের পেছন দিক আন্দোলিত করে তুলল বেলা।
“ঠিক তাই।” ভারী কণ্ঠে উত্তর দিলেন স্যার ক্লারেন্স, “এই তো তুমি বুঝতে পেরেছ।”
“ওহ, ঈশ্বর আমাকে বাঁচাও!” মনে মনে নানা’র মতো স্বগতোক্তি করে উঠল বেলা। “থাক আজকের জন্য যথেষ্ট।” আস্তে করে স্যার ক্লারেন্সের বাহুজোর থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল বেলা।
“আমি একবার চেষ্টা করে দেখি” বলেই এত পরিষ্কারভাবে গুলি ছুড়ল যে ঘুঘুটা ডানা ঝাঁপটানোর সময়টাও পেল না।
“ইউ আর ন্যাচারাল” বিড়বিড় করে উঠলেন স্যার ক্লারেন্স; হাসি চাপতে চট করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল বেলা।
“তোমার ভাইদের কাছে শুনেছি তুমি নাকি ঘোড়া চালাতেও ওস্তাদ।” বেলা’র পিছ নিলেন স্যার ক্লারেন্স। “কয়েকদিন আগেই একটা অসাধারণ আরবীয় স্ট্যালিয়ন কিনেছি। আফ্রিকাতে আর দ্বিতীয়টা আছে কিনা সন্দেহ। তোমাকে খুব দেখাতে ইচ্ছে করছে।”
“ওহ?” তেমন একটা আগ্রহ দেখাল না বেলা; শর্ট গান লোড করতে বেশি ব্যস্ত, “কোথায় আছে?”
“রুসাপে’তে আমার র্যাঞ্চে। কাল বিকেলে ফেরার সময় চাইলে অ্যালোয়েট আমাদেরকে ওখানে নামিয়ে দেবে।”
“হয়ত ভালই লাগবে” একমত হলো বেলা।” আপনার স্ত্রীর সাথেও দেখা হয়ে যাবে।”
একটুও অপ্রস্তুত হলেন না স্যার ক্ল্যারেন্স, “ধূর, আমার স্ত্রী’তো এখন ইউরোপে বেড়াচ্ছে। এবার হেসে ফেলল বেলা।
“আমাকে একটু ভাবতে হবে স্যার ক্লারেন্স।”
এবারে হেসে ফেললেন স্যার ক্লারেন্সে, “ওখানে এমন কিছু নেই যা তুমি হ্যাঁন্ডেল করতে পারবে না, মাই ডিয়ার।”
ওদিকে ঝড়ের মতো চিন্তা করে চলেছে বেলা। মনে মনে ভাবছে। অ্যান্টিসাংশন স্ট্র্যাটেজিসহ রোডেশিয়ার সম্পূর্ণ কাহিনী জানতে পারলে না জানি কি পুরস্কার দেবে তার রহস্যময় প্রভু। “কর্তবের খাতিরে সবকিছুই সই।” নিজেকে আশ্বস্ত করল বেলা।
“ব্যাগ ভরে গেছে।” চিৎকার করে এলসা’কে জানালেন শাসা। শটগান গুটিয়ে নিয়ে নিলেন হাতের মাঝে। কৃষাঙ্গ দুই শিশুকে ডেকে আদেশ দিলেন এলসা, “পাকামাইসা! দুটোকে তুলে নাও!”
শেষ দুটো পাখিকে তুলে আনার জন্য দৌড় লাগাল ছেলেরা। পার্ক করে রাখা ট্রাকের দিকে এগিয়ে গেলেন শাসা আর এলসা। ইতিমধ্যে গাছের মাথায় নেমে এসেছে সূর্য।
“অলরাইট” হঠাৎ করেই যেন কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন এমন ভাবে বলে উঠলেন এলসা,
“মাফ করো-” অবাক হয়ে গেলেন শাসা, “কী হয়েছে?”
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি।” ঘোষণা করলেন এলসা, “ শতসাপেক্ষে তোমাকে সিনডেক্স ২৫-এর ফর্মুলা আর প্ল্যান্টের ব্লু-প্রিন্ট দেয়া হবে।”
আস্তে করে শ্বাস ফেললেন শাসা, “আমি তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার জন্য সবটুকু চেষ্টা করবো।”
সন্ধ্যাবেলা বাকি সদস্যদের কাছে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্যাম্প-ফায়ারের পাশে এলে বসেছেন শাসা আর এলসা। নিজের শর্তগুলো জানিয়ে দিলেন সিগনোরা।
“ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে গ্যারান্টি দিতে হবে যে, প্রধানমন্ত্রী কিংবা অফিস উনার প্রত্যক্ষ কর্মকর্তা ব্যতীত কেউ সিনডেক্স ব্যবহার করতে পারবে না।”
চারপাশে তাকিয়ে কেউ আড়ি পাতছে কিনা নিশ্চিত হয়ে নিলেন শাসা। “আমি তোমার নামে শপথ করে বলছি, প্রধানমন্ত্রীর লিখিত সম্মতিপত্র নেয়া হবে।”
“এবারে আসা যাক ব্যবহার নীতির ক্ষেত্রে, সিনডেক্স কখনো দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো জনগণের উপর ব্যবহার করা যাবে না।” খুব সাবধানে বলে চললেন এলসা, “অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কিংবা গৃহযুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না। এমনকি ভবিষ্যতেও কোনো গৃহযুদ্ধ অথবা ঠেকানোর জন্য কোনো আন্দোলনের উপরেও ব্যবহার করা যাবে না।”
“আমি রাজি।”
“তবে হ্যাঁ, বিদেশি কোনো সামরিক বাহিনীকে পর্যদুস্ত করার জন্য চাইলে ব্যবহার করা যাবে; তখনই যখন প্রথাগত অস্ত্র দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবে।”
“আমিও একমত।”
“আরেকটা শর্ত আছেএকটু বেশিই ব্যক্তিগত।”
“বলো।”
“লুজানে’তে তুমি নিজে এসে সবকিছু ঠিক করে যাবে।”
“তাহলে তো আমার চেয়ে বেশি খুশি আর আর কেউ হবে না।”
সাফারিতে আজকেই শেষ সকাল। লাগেজ প্যাক করে চিজোরা ছাড়ার জন্য সকলেই প্রস্তুত। নিজ নিজ তাঁবুর বাইরে তৃপ হয়ে পড়ে থাকা লাগেজগুলো একটু পরে ক্যাম্প স্টাফেরা এসে নিয়ে যাবে।
ব্যবসা শেষ; চুক্তিগুলোও সাইন করা হয়ে গেছে। এলসা গিগনাটেলি রোডেশিয়ান তামাক আর ক্রোমের মার্কেটিভের ব্যাপারে সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন। অন্যদিকে শিপিং আর ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকা বন্দরে পণ্য খালাসের দায়িত্ব নিয়েছে গ্যারি।
পুরো দলটাকেই স্যালিসব্যরিতে পৌঁছে দেবে রোডেশিয়ান এয়ারফোর্স হেলিকপ্টার। কিন্তু ত্রিশ মিনিট আগেই ক্যাম্পের কাছে নামার কথা থাকলেও এখনো আসেনি হেলিকপ্টার। সবাই তাই খানিটা চিন্তিত।
পিমস্ নাম্বার ওয়ানে চুমুক দিতে দিতে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সবাই এসে দাঁড়িয়েছে ক্যাম্প ফায়ারের কাছে।
একসাথে দাঁড়িয়ে আছে বেলা আর শন
“তুমি কেপ টাউনে আসবে না?” বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করল বেলা।
“এই সিজনের শেষে চেষ্টা করবো, যদি তুমি আমার জন্যে সুন্দরী নারী লাইন বসাতে রাজি থাকো। “তোমারও সাহায্য লাগে?” ভাইয়ের সাথে মজা করল বেলা। হেসে ফেলল শন্।
“দেখো আমি তো বাবার মতো খারাপ নই। বিধবাটার সাথে এখন ইউরোপে দৌড় দেবে।”
দু’জনেই তাকাল শাসা আর এলসা’র দিকে।
বাবা’র পক্ষ নিয়ে বলতে চাইল বেলা, ড্যাডি তো এখনো বেশ আকর্ষণীয়-”
“থামো, বেলা।” বোনের হাতে চাপ দিল শন। “স্যার ক্লারেন্সের কথা ভাবো। লোকে তাকে এমনি এমনি ক্যান্টরিং ক্লারেন্স মানে ঘোড়া দৌড়ানো ক্ল্যারেন্স ডাকে না!”
মনে হলো নিজের নামের খ্যাতি অটুট রাখতে বদ্ধপরিকর স্যার ক্লারেন্স। হঠাৎ করেই ছুটে এসে বেলাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে গেলেন।
“অন্যদেরকে স্যালিসব্যুরিতে নামিয়ে দেব।” বেলা’র কাছে ঝুঁকে বিড়বিড় করে জানালেন স্যার ক্লারেন্স। “তারপর হেলিকপ্টার আমাদেরকে র্যাঞ্চে নিয়ে যাবে। ঠিক আছে?”
“হুম ঠিক আছে।” মিষ্টি স্বরে রাজি হয়ে গেল বেলা, “পাপা কিংবা লেডি ভান উইক না থাকলেই বেশি মজা হবে।”
“ঠিক তাই।” একমত হলেন স্যার ক্লারেন্স; আরো কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। শ’নের তাঁবুতে কর্কশ শব্দে বেজে উঠল রেডিও।
দৌড়ে গিয়ে রিসিভার তুলে নিল শন্।
“টাগবোট, দিস ইজ বিগ ফুট, গো এহেড।”
“বিগ ফুট, আমাদের প্ল্যান খানিকটা চেঞ্জ হয়েছে। প্লিজ মিনিস্টারকে জানিয়ে দিন যে হেলিকপ্টার নিয়ে অপারেশনে যেতে হবে। মোল মিনিটের মাঝে অন্য হেলিকপ্টার পৌঁছে যাবে। আমার কপ্টারে দশ জন স্কাউট আছে। ওভার।”
“রজার টাগবোট। আমরা পিক আপের জন্যে তৈরি থাকবো।”
“যুদ্ধ যে এত বাজে!” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন স্যার ক্লারেন্স। রেডিও’র আলাপচারিতা সবকিছুই সকলে শুনতে পেয়েছে। “আরেকটা চপার না আসা পর্যন্ত এখানেই বসে থাকতে হবে।”
“কী হয়েছে?” জানতে চাইল বেলা।
“সন্ত্রাসী হামলা।” ব্যাখা করলেন স্যার ক্লারেন্স। “সম্ভবত শ্বেতাঙ্গদের কোনো খামারে আক্রমণ হয়েছে। ওদের পিছু ধাওয়া করছে হেলিকপ্টার। এসব বেজন্মাদের তো এমনিই ছেড়ে দেয়া যায় না-কৃষকদের মনোবল ঠিক রাখতে হবে।”
রোডেশিয়ান এয়ারফোর্সে মিলিটারি হেলিকপ্টারের কমতি’র কথা না বলে কাঁধ ঝাঁকালেন স্যার ক্লারেন্স।
“মনে হচ্ছে ভাগ্যও আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।”
“হয়ত তাহলে আমাদের ট্রিপটাকেও স্থগিত-” তাবু থেকে শনকে বেরোতে দেখেই থেমে গেল বেলা। হালকা পারস্যুট হার্নেশ পরে আছে শ ক্যানভাসের পকেটে অ্যাম্বুনিশন গ্রেনেড আর পানির বোতল রাখার জায়গা আছে। এক কাঁধে ঝুলছে এফ এন রাইফেল। চিৎকার করে উঠল শন “মাতাতু, গণ্ডারের চামড়া জলদি, এখানে আয়। এবারে আমাদের সত্যিকারের কাজ পেয়েছি। বদমাইশগুলোর পিছু নিতে হবে।”
মুখে একরাশ হাসি নিয়ে হাজির হয়ে গেল জোয়োবো ট্র্যাকার। “আজ রাতে ক্যাম্প ফায়ারে কয়েকটা জানালার (ZANLA) রোস্ট খাওয়া যাবে।”
“তুমি তো খালি সে মজাতেই আছে। শয়তানের বাচ্চা, হাসতে হাসতে অন্যদের দিকে তাকাল শন।
“সরি, গাইজ। সালিসব্যুরিতে ফেরার রাস্তা তোমাদেরকেই খুঁজে নিতে হবে। আমি আর মাতা প্রেম করতে যাচ্ছি।” এবারে গ্যারির উদ্দেশ্যে বলে উঠল, “তুমি ওদেরকে বীচক্রাফটে করে নিয়ে যাও। লাগেজ থাকাতে কয়েকবার যাওয়া আসা করতে হবে। কিন্তু হেলিকপ্টারের আশায় বসে থাকার চেয়ে তো সেটাই ভালো। কান পেতে কি যেন শুনল শন্।” ওই তো আসছে।”
খুব দ্রুত গিয়ে সকলের সাথে হাত মেলালো শন।
“আগামী সিজনে আবার আপনার সাথে দেখা হবে। সিগনোরা? পরের বার, প্রমিজ করছি এত বড় একটা চিতা…”
“ডিয়ার ড্যাড। ঝামেলা থেকে দূরে…” এবারে এলসা পিগটেলিকে ইশারা করে বাবাকে বলে উঠল শন।
“বাই, লিটল সিস্টার” ইসাবেলাকে বিদায় জানাতে গেল শন; কিন্তু ভাইকে আঁকড়ে ধরে বেলা,
“সাবধানে থেকো শন। নিজের দিকে খেয়াল রেখো।”
বোনকে জড়িয়ে ধরে এসব অনর্থক কথা শুনে যেন হাসল শন্। “স্যার ক্লারেন্সের কাছ থেকে আসা ইনকামিং ফায়ারের জন্য তুমিই বরঞ্চ বেশি বিপদে আছে।” মিটমিটিয়ে হাসল শন্।
আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই গাছের উপরে কালো পোকার মতো দেখা গেল হেলিকপ্টার।
ছোট ভাইয়ের সাথে হাত মেলালো শন্। “ধুত্তোরি গ্যারি, কে চায় তোমার চাকরি-যখন আমি এসব করতে পারি?”
ইসাবেলার গলা ধরে এলো। তার লম্বা চাওড়া বীরের মতো ভাই ছোট খাটো মাতাতুর কাঁধে এমনভাবে হাত রাখল যেন এই দুই শিকারি যোদ্ধার মাঝে ভরসা নামক বিশেষ একটা সম্পর্ক আছে।
ধুলার মেঘ উড়িয়ে আকাশে উঠে গেল হেলিকপ্টার। চলে গেল দক্ষিণ পশ্চিমে।
***
হেলিকপ্টারের মেইন কেবিনে পাশাপাশি বসে আছে দশজন স্কাউট। সবারই কাছে ভারী সব অ্যামুনিশন, ওয়াটার বোটল, গ্রেনেড।
সকলেই জানে যে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষাঙ্গ যখন কমরেড হিসেবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে তখনই ফুটে উঠে মানুষ হিসেবে আসল সৌন্দর্য। যোদ্ধা হিসেবেও একে অন্যের দক্ষতা দেখাতে তখন মরিয়া হয়ে উঠে সবাই।
ব্যালান্টাইন স্কাউটেরা রোডেশিয়ার সবচেয়ে উত্তম ফাইটিং ফোর্স হলেও কথাটা স্বীকার করতে চায় না স্পেশাল এয়ার সার্ভিস, সেলাস স্কাউট কিংবা রোডেশিয়ান রেজিমেন্ট।
কেবিনে উঠে সকলকে দেখেই চিনতে পারল শন; নাম ধরে ধরে ওদের খোঁজ খবর নিল। শ্রদ্ধাভরে উত্তর দিল স্কাউটের দল। স্কাউটদের মাঝে শন আর মাতাতু এমনিতেই বেশ বিখ্যাত। তার উপরে আবার তরুণ সৈন্যদেরকে প্রশিক্ষণও দিয়েছে শন্ আর মাতুত।
স্কাউটদের প্রতিষ্ঠাতা আর কমান্ডিং কর্নেল রোলান্ড ব্যালানটাইন শনকে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড বানাবার জন্যে বহু চাল চেলেছেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। তাই যে কোনো প্রয়োজনেই দুজনকে ডেকে পাঠাতে দ্বিধা করেন না।
কর্নেলের পাশে ধপ করে বসে পড়ল শন। সিট বেল্ট বেঁধে নিয়ে মুখে ক্যামোফ্লেজ ক্রীম ঘষতে ঘষতে চিৎকার করে উঠল, “গ্রিটিংস, স্কীপার। এবারে কী করেছে শয়তানগুলো?”
“গতকাল সন্ধ্যার দিকে কারোই’র একটা তামাক খামারে ঢুকে পড়েছে বদমাইশের দল। গেইটের কাছে কৃষককে আটকে ফেলে গুলি করে। ঠিক সেই সময় খামারির স্ত্রী আবার বারান্দায় এসেছিল স্বামীকে অভর্থনা জানানোর জন্য। তবে মহিলা একাই সারা রাত ওদেরকে ঠেকিয়ে রেখেছে- এমনকি রকেট ফায়ার ছোঁড়া হলেও ভয় পায়নি। সাহস বটে! মাঝরাতের খানিক পরে বাধ্য হয়ে পিছিয়ে এসেছে।”
“কত জন?”
“বিশজনের বেশি।”
“কোন দিকে?”।
“উপত্যকার উত্তরে।”
“যোগাযোগ?”
“এখনো না।” মাথা নাড়লেন রোল্যান্ড। ক্যামো ক্রিম মাখা সত্ত্বেও ঢাকতে পারেননি উজ্জ্বল আর সুদর্শন দেহসৌষ্ঠব। শনের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় কর্নেল বুশ ওয়ার শুরুর কিছুদিনের মাঝেই সাহসিকতার জন্য বিখ্যাত হয়ে গেছেন।
“লোকাল ইউনিট অনুসরণের চেষ্টা করলেও খারাপ আবহাওয়ার কারণে এগোতে পারছে না।”
“বোমা ফাটিয়ে শয়তানগুলো নিশ্চয় স্থানীয় কৃষাঙ্গদের মাঝে মিশে যেতে চাইবে, ট্রাইবাল ট্রাস্ট এরিয়াই এক্ষেত্রে ওদের লক্ষ্য হবে। আমাদেরকে ফলোআপ ইউনিটের কাছে নিয়ে চলো স্পিকার।” ভবিষ্যৎবাণী করে উঠল শন।
“হুম, যে কোনো মুহূর্তেই রেডিওতে আপডেট পাবো-” ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার সত্যি সত্যি রেডিও হ্যান্ডসেট নিয়ে হাজির হলো, “কাম অন।” সেফটি বেল্ট খুলে বেঞ্চের ফাঁকে চলে গেলেন কর্নেল। শন নিজেও তার পিছু নিয়ে কান পেতে শুনতে চাইল মাইক্রোফোনের আলাপচারিতা। “বুশ বা দিস্ ইজ স্ট্রাইকার ওয়ান।” মাউথপিসে কথা বলছেন রোল্যান্ড।
“কোনো যোগাযোগ হয়েছে?”
“স্ট্রাইকার ওয়ান, নেগেটিভ। আবার বলছি নেগেটিভ।”
“কোনো পদচিহ্ন খুঁজে পেয়েছ বুশ-বাক?”
“অ্যাফারমেটিভ; কিন্তু অতর্কিত আক্রমণ করা হচ্ছে বারবার। তার মানে সন্ত্রাসী দলটা পিছু ধাওয়াকারীদেরকে সরিয়ে দিতে চাইছে। “রজার, বুশ বাক, আমাদের ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা মাত্রই হলুদ ধোঁয়া ছাড়বে।”
“কনফার্ম ইয়েলো স্মোক, স্ট্রাইকার ওয়ান।“
পয়তাল্লিশ মিনিট পরেই জঙ্গলের ঘন সবুজ ছাদের উপর ক্যানারি হলুদ ধোয়ার সিগন্যাল দেখতে পেল পাইলট। গাছের উপর গিয়ে পুলিশ ইউনিটকে খুঁজতে লাগল হেলিকপ্টার। এক নজর দেখেই বোঝা গেল যে এরা কারোই গ্যারিসনের সৈন্য। মাসিক বেতনভুক্ত এসব শহুরে সৈন্য ডাক পেলেই কেবল দায়িত্ব পালন করতে আসে; সন্ত্রাসী দলে’র পিছু নেয়া এদের কর্ম না।
ছয় ফুট উপর থেকে একসাথে মাটিতে লাফিয়ে নামল শন আর মাতাতু; ঠিক যেন এক জোড়া বিড়াল। খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে কাভার নিল দু’জনে; দুইশ ফুট উপরে পাখা ঘুরিয়ে চলে গেল হেলিকপ্টার।
পনের সেকেন্ডের মাঝেই নিশ্চিত হওয়া গেল যে ড্রপ এরিয়াকে নিরাপত্তা দিয়ে ঘিরে রেখেছে পুলিশ। লিডারের দিকে এগিয়ে গেল শন।
“ওকে সার্জেন্ট, বোতল খুলুন। ড্রিংক ম্যান ড্রিংক।”
অতিরিক্ত ওজনের সার্জেন্টের লাল মুখটা সূর্যের তাপে একেবারে পুড়ে গেছে। শার্টের উপর সাদা সাদা রিং হয়ে জমে আছে নোনা ঘাম। বোঝা গেল ডিহাইড্রেশন সম্পর্কে কিছু জানেন না; ঘণ্টাখানের মাঝেই চোখে মুখে অন্ধকার দেখবেন।
“পানি শেষ।” বলে উঠল তিতিবিরক্ত সার্জেন্ট। ওয়াটার বোতল ছুঁড়ে দিয়ে শন জানতে চাইল, “পদচিহ্ন কোথায় পাওয়া গিয়েছিল?”
সামনের দিকে ইশারা করলেন সার্জেন্ট কিন্তু এরই মাঝে পায়ের ছাপ খুঁজে পেয়েছে মাতাতু। মাথা নামিয়ে এমনভাবে দেখতে লাগল যা খুঁজে পাওয়া তার মতো ট্যালেন্টেড কারো পক্ষেই কেবল সম্ভব। পঞ্চাশ কদম পর্যন্ত অনুসরণ করে দৌড়ে দৌড়ে ফিরে এলো শনের কাছে।
“পাঁচজন। একজনের আবার বাম পা আহত হয়েছে…”
“ফার্মারের বউ নিশ্চয় এমন ধাওয়া দিয়েছে যে।”
“…কিন্তু চিহ্নগুলো একেবারে ঠাণ্ডা। স্প্রিং হেয়ার খেলতে হবে।” মাথা ঝকালো শন। সে আর মাতাতু আগেও কাজে লাগিয়েছে এই স্প্রিং হেয়ার কৌশল। আর মাতাতুর মতো দক্ষ কোনো ট্র্যাকারই পারে এথেকে আসল জিনিস খুঁজে পেতে।
তবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে সন্ত্রাসীদের দলটা উত্তরে জাম্বোজি আর ট্রাইবাল ট্রাস্ট অঞ্চলের দিকেই গেছে; যেখানে খাবার আর পানির পাশাপাশি আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসাও করানো যাবে। একে-৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেলের নল দেখলে সবাই বাধ্য হবে তাদেরকে সাহায্য করতে।
তার মানে শনদেরকেও এখন উত্তরেই যেতে হবে। কিন্তু সামনে পড়ে আছে অত্যন্ত বন্য এক অরণ্য। দুর্গম এই অঞ্চলে কেউ লাইন থেকে কয়েক ডিগ্রি সরে গেলেই হলো, তার নাম-নিশানাও আর পাওয়া যাবে না।
খোলা জায়গায় দৌড়ে গিয়ে হাত দিয়ে ক্রুশ বানিয়ে মাথার উপর ঘুরতে থাকা অ্যালোয়েটকে সিগন্যাল দিল শন। সাথে সাথে হেলিকপ্টার থেকে উত্তর পাওয়া গেল,
“ওকে সার্জেন্ট” চিৎকার করে উঠল শন, “তাদের পিছু নিন। আমরাও সামনেই যাচ্ছি। রেডিওতে কন্ট্রাক্ট করবেন-আর পানি খেতে যেন ভুলবেন না।”
“রাইট অন, স্যার!” হেসে ফেলল সার্জেন্ট। শনে’র সঙ্গ পেয়ে উজ্জীবিত হয়ে উঠছে পুরো দল।
“ওদেরকে নরক দেখিয়ে দিন-স্যার!” শন’কে আকুতি জানালো সার্জেন্ট। অ্যালোয়েটের খোলা হ্যাচ থেকে হাত নাড়ল শন্।
বুকে চিনচিনে ব্যথা হওয়ায় পাজরের ক্ষত সামলাতে হাফ ডজন কোডেইন ট্যাবলেট গিলে নিল শন। মাতাতু’র সাথে হামাগুড়ি দিয়ে তাকিয়ে আছে পাঁচশ ফুট নিচের জঙ্গলের দিকে। এমনিতে উচ্চতা ভীতি থাকলেও এরকম উত্তেজনার মুহূর্তে সবকিছু ভুলে যায় ডোরোবো ট্র্যাকার।
এখন তো খোলা হ্যাচের এতটাই কিনারে চলে গেছে যে কোমর ধরে রেখেছে শন্ যেন আবার টুপ করে পড়ে না যায়। নাকের নিচে পাখির গন্ধ পেলে যেভাবে কেঁপে উঠে শিকারী কুকুর, ঠিক সেভাবেই কাঁপছে মাতাতু।
হঠাৎ করেই কিছু একটা ইশারা করতে, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারকে হাঁক দিল। শন, “দশ ডিগ্রি বামে ঘুরে যান।”
ইন্টারকমে পাইলটকে জানিয়ে দিল ইঞ্জিনিয়ার।
মাতাতু’র কথা মতো পশ্চিমে ঘুরে গেলেও নিচে তাকিয়ে চোখে পড়ার মতো কিছুই দেখতে পেল না শন। একইরকম পাথুরে একঘেয়ে বনানী।
কিন্তু দু’মিনিট পরেই আবারো মাতাতু’র ইশারা মতো নির্দেশ দিল শন। “পাঁচ ডিগ্রী ডানে ঘুরে যাও।”
বাধ্য ছেলের মতো ঘুরে গেল অ্যালোয়েট। নিজের যাদু দেখাচ্ছে মাতাতু। পাঁচশ ফুট উপর থেকে গাছের চাঁদোয়া ভেদ করে কাউকে দেখা না গেলেও ঠিকই টের পাচ্ছে মাতাতু; আর বিগত বছরগুলোতে আরো শ’খানেক সফলতার নজির না থাকলে অন্ধের মতো এরকম বিশ্বাস করত না শন।
মাস্টারের দিকে তাকিয়ে হাসছে মাতাতু; উত্তেজনায় তির তির করে কাঁপছে ঠোঁট; গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে চোখ ভর্তি জল।
“নিচে!” আবারো ইশারা করল মাতাতু।
“ডাউন!” ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারকে আদেশ দিয়েই রোলান্ড ব্যালানটাইনের দিকে তাকালো শন্।
“হট গানস!” নিজের লোকদেরকে সিগন্যাল দিলেন রোলান্ড। শক্ত বেঞ্চের উপর সোজা হয়ে বসে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হয়ে গেল সকলে। যার যার অস্ত্র তুলে নিয়ে লক অ্যান্ড লোড করে নিল প্রত্যেকে।
খটখটে শুকনো মাটির ছয় ফুট উপরে চক্কর কাটতে লাগল হেলিকপ্টার। একসাথে লাফিয়ে নামল শন আর মাতাতু। ক্লিয়ার করে ফেলল ড্রপ জোন।
কাভার দিয়ে কাঁধে এফ এন ঝুলিয়ে চারপাশে ঝোঁপ দেখে নিচ্ছে শন। হ্যাচওয়ে থেকে নেমে এলো একের পর এক স্কাউট। নাক ঘুরিয়ে চলে গেল শূন্য হেলিকপ্টার।
সেকেন্ডের মাঝেই সৈন্যরা যার যার পজিশন নিয়ে নিল হাতমুঠি করে শন’কে সিগন্যাল দিলেন রোল্যান্ড, “গো!”
খানিক দূরত্ব বজায় রেখে একসাথে আগে বাড়ল শন আর মাতাতু। ছড়িয়ে পড়ে কাভার দিল স্কাউটেরা সকলেরই সবকটি আঙুল ট্রিগারে প্রস্তুত। ফানেলা আকৃতির খাড়া পাথরের ঢালে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো মাতাতু। বহু শতাব্দীর ঝড়-জল এসে তৈরি করে দিয়েছে প্রাকৃতিক সিঁড়ি। আর হাতির পাল নিয়মিত যাতায়াত করা’তে মাটিও প্রায় সমান হয়ে গেছে।
আঙুল ভাঁজ করে পূর্ব দিকে এগিয়ে যাবার জন্য শনের মতো দক্ষ ট্র্যাকারই প্রয়োজন এখন।
সূর্যের আলোয় আড়াআড়িভাবে এগিয়ে যাচ্ছে শন। পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে নিচে; মাটির দিকে। জানে ওকে কাভার দিচ্ছে বিশ্বস্ত স্কাউটেরা; শন্ নিজে ওদেরকে ট্রেনিং দিয়েছে।
কিছু একটা খুঁজে পেতেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল সারা দেহে। গোলাকার একটা পাথর নিজ জায়গা থেকে খানিকটা সরে পড়েছে। তবে তৎক্ষণাৎ মাতাতু’কে ডাকল না শন।
“আগে আমি চেক করে দেখি; নয়ত সপ্তাহভর ক্ষেপাতে থাকবে পিচ্ছি। শয়তানটা?”
তার মাথার সমান সাইজের বোল্ডারটা আঙুলের টোকা দিতেই নড়ে উঠল। তার মানে এরই মাঝে অন্য কেউ এসেও একটাকে নাড়িয়ে গেছে। হুইসেল দিতেই আলাদীনের দৈত্যের মতো এসে হাজির মাতাতু। কিছুই বলতে হয়নি, যা দেখার দেখে বুঝে গেল মাতাতু।
নিজেদের পায়ের ছাপ ঢাকতে সন্ত্রাসীর দল পাথরের বোল্ডারগুলোকে ব্যবহার করলেও কেউ একজনের ভারে জায়গা থেকে খানিকটা সরে গেছে একটা পাথর।
ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে আগে বাড় মাতাতু। শখানেক কদম গিয়েই সাদা বালিতে দেখতে পেল পায়ের ছাপ। নির্ঘাৎ পা হড়কে পড়ে গিয়েছিল আহত কেউ। রঙের এই তারতম্য শুধু দক্ষ কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে বালির আর্দ্রতা, সূর্যের তাপ, হাওয়ার গতি আর সবচেয়ে বড় কথা সময়।
“দুই ঘণ্টা” ঘোষণা করল মাতাতু। বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিল শন।
“আমরা ওদের চেয়ে দুই ঘণ্টা পিছিয়ে আছি।” রোলান্ডকে রিপোর্ট করল শন।
“কিভাবে বুঝতে পারল?” বিস্ময়ে মাথা নাড়ছেন রোল্যান্ড। “এখানে নিয়ে এলো তারপর সময়টাও ঠিকঠাক বলে দিল। পনের মিনিটে আট ঘণ্টার কাজ এগিয়ে দিয়েছে। কিভাবে শন?”
“বাজি ধরুন” একমত হলো শন।
“ও হচ্ছে একটা চকলেট মোড়া যাদুকর। অলৌকিক সবকিছুই ওর জানা আছে।”
“আবারো কি স্প্রিং হেয়ার খেলতে হবে?” রোল্যান্ড সোয়াহিলি না জানায় ভাষান্তর করে দিল শন।
খুশি খুশি মাথা নাড়ল মাতাতু। কর্নেলের প্রশংসা পেয়ে তো বেজায় খুশি।
“মাটিতে অনুসরণের জন্য চারজন রেখে যান।” পরামর্শ দিল শন। “জলের রেখা ধরে গেলে উপরে গিয়ে পায়ের ছাপ খুঁজে পাবার জোর সম্ভাবনা আছে।”
রোলান্ডের আদেশ পেয়ে সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে গেল চারজন স্কাউট। হেলিকপ্টার আসতেই চড়ে বসল শসহ বাকি সৈন্য।
আবার উত্তরমুখে উড়ে চলল অ্যালোয়েট। কিন্তু দশ মিনিট যেতে না যেতেই শনের হাত ধরে টান দিল মাতাতু, “টার্ন! টার্ন ব্যাক!”
শনের আদেশ মতো আকাশেই ঘুরে গেল হেলিকপ্টার, খোলা হ্যাচ থেকে প্রায় ঝুলে কেবল এপাশ ওপাশ মাথা নাড়াচ্ছে আর এই প্রথমবারের মতো দ্বিধা দেখা গেল ডোয়রীবো ট্র্যাকারের চোখে।
“ডাউন” হঠাৎ করেই চিৎকার জুড়ে দিল মাতাতু। ঘন-জঙ্গল ভেদ করে সামনেই দেখা যাচ্ছে কিডনির মতো গড়নের অগভীর ভূমি।
খুব সাবখানে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো অ্যালোয়েট। গর্তের পাশে ল্যান্ডিং জোন দেখিয়ে দিল মাতাতু।
উই-টিবিতে ভর্তি মাটির ঝোঁপ-ঝাড়গুলোও বেশ ঘন। ঠিক যেন একটা কবরস্থান। এখানে ল্যান্ডিং ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। পিচ্ছি শয়তানটা এ কোন জায়গা বেছে নিল, মনে মনে রাগ করল শন।
হেলিকপ্টার মাঝ আকাশে থাকতেই রোল্যান্ডের দিকে তাকাল শন, “হট গানস্ ম্যান!”
মাতাতুর সাথে মাটিতে লাফিয়ে নেমেই উইটিবির পেছনে কাভার নিল শন।
অন্য স্কাউটদের দিকে দৃকপাত না করেই তাক করল এফএন; বুড়ো আঙুল দিয়ে ধরে রেখেছে সেফটি লক। ল্যান্ডিং জোনের পাঁচ মাইলের মাঝে কোনো সন্ত্রাসী থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত সীমিত হলেও এটাই ওদের ল্যান্ডিং ড্রিল।
“একটার’ও পাত্তা নাই।” আপন মনে ভাবল শন; আর ঠিক তখন শুরু হল গুলি বর্ষণ।
বামপাশের কাঁটাঝোঁপ থেকে ছুটে আসছে একে’র গুলি। মাথার উপর দিয়ে অবিরাম শিষ কেটে যাচ্ছে মৃত্যুদূত। শ’নের থেকে মাত্র ইঞ্চি খানেক দূরের উই ঢিবি থেকে ছিটকে উঠল ধুলা আর লাল মাটির দলা।
হেলিকপ্টারের হ্যাচ গলে মাটিতে নেমে আসা শেষ স্কাউটের পেট এফোড় ওফোড় করে দিল একে রাইফেলের গুলি। গড়িয়ে গিয়ে তিন কদম পেছনে পড়ে গেল অসাড় দেহ। গোলাপি মাংসের দলা হয়ে চলে গেল ঝোঁপের আড়ালে।
চট করেই বুঝতে পারল শন; মাতাতু একেবারে খোদ শয়তানগুলোর মাঝে এনে ফেলেছে। চিন্তাবাদ দিয়ে এফএন দিয়ে গুলি ছুড়ল শন্। পিচ্ছি শয়তানটা এবারে দেখিয়েছে বটে!
একই সাথে কনট্যাক্টদের কথাও ভাবছে। কোনো ভুল নেই যে তারাও ভড়কে গেছে। তাই ডিফেন্স কিংবা অ্যামবুশ কিছুরই সময় পায়নি।
অভিজ্ঞতা থেকে শন জানে যে শোনা গেরিলারা সৈন্য হিসেবে একেবারে ফাস্ট ক্লাস, বলব, সাহসী আর প্রাণ দিতেও পিছপা হয় না। কিন্তু দুর্বলতাও আছে। প্রথমত তাদের ফায়ার কন্ট্রোল ভালো না আর দ্বিতীয়ত খুব দ্রুত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না। শন ভালো করেই জানে যে, মিনিট খানেকের মধ্যেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে কাঁটা ঝোঁপের পেছনে লুকিয়ে থাকা গেরিলা দল।
কোমরের বেল্ট থেকে ফসফরাসের গ্রেনেড় টেনে নিল শন। পিন খুলতে খুলতেই রোল্যান্ডের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে জানাল, “কাম অন রোল্যান্ড, কিছু বোঝার আগেই ঘাসগুলোকে সমান করে দিতে হবে।”
একই চিন্তা নিশ্চয়ই রোল্যান্ডের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। “টেক দেম বয়েজ! অন দ্য চার্জ!”
লাফ দিয়ে দাঁড়িয়েই হাত ঘুরিয়ে গ্রেনেডটাকে ছুঁড়ে মারল শন। ত্রিশ গজ দূরে পড়েই কাটা ঝোঁপটাকে ফসফরাসের সাদা মেঘে ঢেকে দিল গ্রেনেড। পুরো এলাকায় শুরু হলো অগ্নি বৃষ্টি।
সামনের দিকে ছুটল শন, পায়ের কাছে কালো ছায়ার মতো অনুসরণ করছে মাতাতু।
রাইফেল-টাইফেল ফেলে প্রাণ ভয়ে দৌড়াচ্ছে সন্ত্রাসী দল। শ’নের দশ কদম সামনে ঝোঁপের ভেতরে উবু হয়ে বসে আছে এক কিশোর। পরনে রঙচটা ব্লু জিন্স আর নরম ক্যামোফ্লেজ ক্যাপ। হাতে আর মাথায় ধোঁয়া উঠা কালো দাগ; গন্ধ মনে হচ্ছে মাংসের বার-বি-কিউ করা হচ্ছে।
গুলি ছুড়ল শন; কিন্তু খানিকটা নিচে লাগায় বাম কোমরে আঘাত পেয়ে পড়ে গেল ছেলেটা। রাইফেল ফেলে দিয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বলে উঠল,
“না, ম্যাম্বো! ডোন্ট কিল, মি! আমি খ্রিস্টান-ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে ছেড়ে দাও!”
“মাতাতু” কোন দিকে না তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল শন’
“কুফা!”
পঙ্গু গেরিলার উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মাতাতু। এফএনের ম্যাগাজিন প্রায় খালি হয়ে যাওয়ায় গুলি নষ্ট করতে চায় না শন্। তারচেয়ে ছুরি দিয়েই কাজ চালিয়ে দেবে মাতাতু। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ফলাটাতে শান দেয় ডোরাবো ট্যাকার। ছোট্ট এই কিশোর ওদের কোনো কাজে লাগবে না; উপরন্তু মেডিকেল অ্যাটেনশনও পাওয়া যাবে না।
দুই মিনিটেরও কম সময়ে ময়দান ছেয়ে ফেলল স্কাউটের দল। পুরোটাই হয়ে গেল এক তরফা। মনে হল বন্য কুকুরের সামনে পড়েছে একদল পিকেনিজ কুকুর ছানা।
“পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে।” আদেশ দিলেন রোল্যান্ড ব্যালানটাইন। শনের কাছ থেকে বিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে রাইফেলের মাজল তাক করেছেন আকাশে। “ওয়েল ডান, শন। তোমার ছোট্ট কালো বামনটা খেল দেখিয়েছে একখানা।” আড়চোখে তাকালেন মাতাতুর দিকে।
কোমরের গুলি খাওয়া সন্ত্রাসীর মৃতদেহ রেখে উঠে দাঁড়াল মাতাতু। গলার একপাশ দিয়ে ছুরি ঢুকিয়ে টেনে নিয়ে গেছে কানের করোটিড আর্টারি পর্যন্ত।
ঊরুতে নিজের ছুরির ফলা মুছতে মুছতে শনের পাশে এসে দাঁড়াল মাতাতু। রোল্যান্ড ব্যালান্টাইনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। ভালই বুঝেছে যে কর্নেল কী বলেছেন।
ফসফরাসের আগুন লেগে মাংস আর কাপড়ের দলা হয়ে পড়ে আছে আরো কয়েকজন গেরিলা। একবার’ও না তাকিয়ে পাশে দিয়ে হেঁটে গেলেন রোল্যান্ড ব্যালান্টাইন।
***
কিন্তু হঠাৎ করে নড়ে উঠল একজন। গুঁড়ো হয়ে যাওয়া বুকের নিচে লুকিয়ে রেখেছে একটা তোকারেভ পিস্তল। শরীরের শেষ শক্তিটুকু একত্র করে রোলান্ডের দিকে তাক করল নিশানা।
“রোল্যান্ড!” দেখতে পেয়েই চিৎকার করে উঠল শন। রোল্যান্ড নড়ে উঠলেও দেরি হয়ে গেল; মাত্র তিন ফুট দূরত্ব থেকে এখনি ধ্বংস হয়ে যাবেন রোল্যান্ড।
কিন্তু তার আগেই কোমরের কাছে ধরা এফএন থেকে ফায়ার করল শন্। গুলি গিয়ে লাগল গেরিলা’র মুখে। টসটসে পাকা একটা তরমুজের মতো করে বিস্ফোরিত হয়ে গেল পুরো চেহারা। অসাড় আঙুল থেকে পড়ে গেল তোকারেভ।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ এক মুহূর্ত মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে রইলেন রোল্যান্ড। ঝাঁকি খাচ্ছে লোকটার পা; ভয়ংকরভাবে ফুলে উঠা চোখ দু’টোতে দেখছেন নিজের মৃত্যুযন্ত্রণা।
দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে শনে’র দিকে তাকালেন।
“তোমার কাছে ঋণী হয়ে গেলাম। আস্তে করে বলে উঠলেন রোল্যান্ড। “যখন ইচ্ছে চেয়ে নিও।” এরপরই অন্যদিকে ঘুরে চিৎকার করে স্কাউটদেরকে বিভিন্ন আদেশ দিলেন। মাথার উপর ঘুরতে থাকা অ্যালোয়েট থেকে নেমে এলো সবুজ রঙা বডি ব্যাগস।
***