কোম্পানির দুর্গোৎসব
‘The church, the mart, the court of law,
The-, everywhere is deserted;
The very crows have ceased to (caw).
And Echo’s broken-hearted;
The palaced town in silence stands
For none are left in it to jaw;
Being off for the DOORGA-PUJA.’
ইংরেজ কবির লেখা ইংরেজি পদ্য। উপলক্ষ: দুর্গোৎসব। কলকাতার জেন্টুদের ঐতিহাসিক ভোজোৎসব। কিন্তু এ কবিতায় তার সমাচার নেই। এ কবির সুর যেন ভিন্ন। তর্জমা করে বললে, তাঁর পদ্যাংশটির মোটামুটি মানে দাঁড়ায়: গির্জায় লোক নেই, কোর্টে লোক নেই। চারদিক নিস্তব্ধ। দোকান বাজার সব খাঁ খাঁ। কোথাও কোনও জনমানবের সাড়া নেই। এমনকী কাকপক্ষীটির পর্যন্ত রা নেই। কেন না কলকাতায় এখন দুর্গোৎসব।
দুর্গোৎসবের কলকাতার এই চেহারাটা আদি চেহারা নয়, আধুনিক কালেরও নয়। পুজোয় দিনকয় ছুটির সুযোগে সাহেবরা এবং তাঁদের পিছু পিছু এদেশের বড়মানুষেরা সবে যখন শহর খালি করে সিমলা-দার্জিলিং যাতায়াত শুরু করেছেন, এই বিষাদ-সংগীতটি সেকালেরই রচনা। অর্থাৎ, এটি ঊনবিংশ শতকের শেষ দিককার ঘটনা। তার আগে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৮৪০ সালের বিখ্যাত দশ নম্বরি আইন পাস হওয়া পর্যন্ত দুর্গোৎসব ছিল রাজা-প্রজানির্বিশেষে কলকাতার শ্রেষ্ঠতম সামাজিক উৎসব। এ উৎসবে নেটিভদের তখন যত আনন্দ, তার চেয়ে বেশি যেন কোম্পানির। এসপ্ল্যানেড থেকে এন্টালি, লাটবাহাদুর থেকে সাব অলটার্ন—স্বপ্নেও কেউ ভাবতে পারতেন না তখন পুজোয় কলকাতা ছাড়বার কথা। বিবি বাচ্চা সহ সেজেগুজে তাঁরা বসে থাকতেন, কবে চিৎপুরের নেমন্তন্ন আসবে তারই অপেক্ষায়।
নেমন্তন্নেও ত্রুটি ঘটত না কখনও। মাথালো মাথাললা বাড়িতে ‘টিকিট’ যেত। অর্থাৎ কার্ড। আর বাবুর সঙ্গে যাঁদের সাক্ষাৎ বা ব্যবসায়িক পরিচয় নেই, তাদের জন্যে প্রকাশিত হত উদার বিজ্ঞাপন। সে বিজ্ঞাপনে আয়োজনের তালিকাটি যেমন আকর্ষণীয়, আহ্বানটিও তেমনই আন্তরিক। কারণ, বাবুরা জানতেন, উপলক্ষ দুর্গা হলেও এ উৎসব আসলে কোম্পানিরই উৎসব। এর আদিতে যেমন কোম্পানিরই দেওয়া ধন, অন্তেও তেমনি একমাত্র বাসনা কোম্পানির প্রসাদ অর্জন।
কথাটার মধ্যে কোনও বাড়াবাড়ি নেই। এটি ইতিহাসেরই সত্য। কোম্পানির আমলের আগেও দুর্গাপুজো অবশ্যই হত বাংলাদেশে। এমনকী, হত মুসলমান আমলেও। ‘যবনাধিকার কালে পশ্চিম অঞ্চলে অল্প হইল এ প্রদেশে বহুতর হিন্দু জমিদার আর রাজাই বা কহ ইঁহারা থাকাতে উক্ত কর্ম লোপ হয় নাই বিশেষ নদীয়া নাটোর বর্ধমান এই তিন চারিজনের রাজ্যের অধিকারে প্রায় বঙ্গদেশে বিভক্ত ইঁহারদিগের অধিকারের মধ্যে যে ব্যক্তিত্ব কিঞ্চিৎ সংস্থান হইত তিনি পূজা না করিলে রাজারা তাঁহারদিগকে ডাকাইয়া আজ্ঞা দিতেন পূজা অবশ্যই করিবা।’ (সমাচার চন্দ্রিকা, ২ নভেম্বর, ১৮৩৩)।
সুতরাং বাংলাদেশে পূজা হত। কারণ, অর্থাভাবে কেউ অপারগ হলে রাজারা তাদের অর্থ দিতেন কিংবা জমি। কিন্তু সে সব পুজো আর কলকাতার পুজোর মধ্যে রাত আর দিন ফারাক। প্রাক-কোম্পানি যুগের পুজো ছিল সর্বত্র প্রতিমা না হউক ঘটপটাদি এবং ‘শ্রীশ্রীশালগ্রাম শিলাদির’ পুজো। আর আদর্শ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। ‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রথমত এই উৎসবে বড় জাঁকজমক করেন এবং তাঁহার ঐ ব্যাপার দেখিয়া ক্রমে ক্রমে ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের আমলে যাঁহারা ধনশালী হইলেন তাঁহারা আপনারদের দেশাধিপতির সমক্ষে ধনসম্পত্তি দর্শাইতে পূৰ্ব্বমত ভীত না হওয়াতে তদ্দৃষ্টে এই সকল ব্যাপারে অধিক টাকা ব্যয় করিতেছেন।’ (সমাচার দর্পণ, ১৭ অক্টোবর, ১৮২৯)।
অর্থাৎ কৃষ্ণচন্দ্র পথ দেখালেন আর তারই ফলে কলকাতায় কোম্পানি ‘ঘট’ হলেন রাজরাজেশ্বরী প্রতিমা। পুজো—উৎসব। এবং নবকিষণের বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে চললেন লর্ড ক্লাইভ।
তা ছাড়া ‘হিদেনদের’ পুজো রাতারাতি কোম্পানির পুজোয় পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পিছনে আরও একটা কারণ ছিল তখন। মনে রাখতে হবে, কোম্পানি তখনও এদেশের পুরো রাজা নয়, হবু রাজা মাত্র। সুতরাং ভোটের আগে মন্ত্রীদের মতো শাসকের চেয়ে সেবায়েতের ভূমিকাটাই তখনও তাদের নজরে বেশি জরুরি। ফলে আধা-শাসক হলেও তারা তখন এদেশের যাবতীয় ধর্মাচারের পুরো-পৃষ্ঠপোষক। নেটিভদের পুজোয় বা আনন্দভোজে যোগ দেওয়া তো সাধারণ শিষ্টাচার। কোম্পানি তখন সরকারিভাবে হিন্দুদের মন্দির তদারকি করতেন, ভক্তদের প্রণামী সংগ্রহ করতেন। কমিশনে লোক লাগিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে তীর্থযাত্রী টেনে এনে মন্দিরের আয় বাড়াতেন। প্রতিদিন ঠিকমতো পূজা বা ধুনো দেওয়া হচ্ছে কিনা সাহেব কর্মচারীদের কর্তব্য ছিল সেসব খবরদারি করা।
এ সব ছাড়াও আরও কিছু কিছু সরকারি কর্তব্য ছিল সেকালে। যেমন ১৯১৭ সালের আইন অনুযায়ী নেটিভদের বিশেষ বিশেষ পর্বের দিনে দেবতার সম্মানার্থে কোম্পানির ফৌজকে এসে সামরিক কায়দায় সেলাম জানাতে হত, কামান দাগাতে হত। কখনও কখনও বিগ্রহের পিছু পিছু মার্চ করতে হত মাইলের পর মাইল।
মাঝে মাঝে মন্দিরে বড় বড় রাজপুরুষেরা আসতেন। বিশেষত কোম্পানির পক্ষে কোনও সংকটকালে। এসে পুজো দিতেন, প্রতিমার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেন। ডালি উপহার দিতেন। এমনকী আমাদের এই কালীঘাটেও ছিল এসব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ওয়ার্ড সাহেব লিখেছেন: ‘আমি এমন বিবরণ পেয়েছি যে ইউরোপিয়ানরা নিয়মিতভাবে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন এবং দশ হাজার টাকা অবধি তাঁরা সেখানে পূজা অর্চনায় খরচ করেন। হালেই অনারেবল কোম্পানির একজন কর্মচারী মোকদ্দমা জিতে কালীঘাটে তিন হাজার টাকা পুজো দিয়ে এসেছেন।’
শুধু কালীঘাটে পুজো নয়, কোম্পানির আর এক কর্মচারী দুর্গোৎসবই করতেন নিজের টাকায়। তিনি হান্টারের ‘Annals of Rural Bengal’-এর সেই বিখ্যাত ম্যানুফ্যাকচারার জন চিপস। বীরভূমের জনপ্রিয় ‘শ্ৰীযুত চিকবাহাদুর’। চিপস যখন ১৭৮২ সালে কোম্পানির রাইটার হিসেবে কলকাতায় পা দেন—তখন তাঁর বয়স মাত্র ষোল বছর। ক’বছর যেতে না যেতেই শোনা গেল, তিনি কোম্পানির অডিটার জেনারেল নিযুক্ত হয়েছেন। ক্রমে (১৭৮৭) তিনি নিযুক্ত হলেন বীরভূমে কোম্পানির প্রথম কমার্শিয়াল এজেন্ট। কোম্পানির তখন সেখানে তুলা, রেশম, লাক্ষা, রঙ ইত্যাদির জমজমাটি কারবার। চিপস তার সঙ্গে জুড়লেন, ব্যক্তিগত ব্যবসা। কোম্পানির আপিস ছিল সোনামুখীতে, আর চিপসের আবাস শান্তিনিকেতনের কাছাকাছি সুরুলে। রায়পুরের লর্ড সিংহদের বংশের শ্যামকিশোর ছিলেন চিপসের দেওয়ান।
দিন যায়। কিন্তু চিপসের ব্যবসা আর কিছুতেই জমে না। সাহেবের মনে তাই বড় দুঃখ। শ্যামকিশোর পরামর্শ দিলেন ‘ঘাবড়ানোর কী আছে সাহেব? তুমি এক কাজ করো, দুর্গোৎসব করো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মায়ের কৃপায় তোমার কোনও দুঃখ থাকবে না।’
দুর্গোৎসব সম্পর্কে কোম্পানির অফিসিয়াল মেজাজের কথা চিপস জানতেন। তিনি সানন্দে শ্যামকিশোরের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। সুরুলে কোম্পানির কুঠিতে ধুমধাম করে পুজো হল। দেখতে দেখতে চিপসের ভাগ্যও নাকি গেল ফিরে। তারপর থেকে ফি বছরই পুজো করতেন তিনি। অবশ্য মহারাজা নবকৃষ্ণ বা সুখময়ের পুজো নয়। চিপস সাহেবের এই বাবদ বছরে খরচ হত মাত্র পঞ্চাশ টাকা। পুজোর খরচ মাত্র সতের টাকা। বাকি টাকায় গাঁয়ের লোকেরা নতুন কাপড় পেত, আর মহাষ্টমীর দিন ভরপেট ভোজ।
চিপস মারা যান ১৮২৮ সালে। কলকাতায় পুজোর সেটা পড়তি কাল। চিৎপুর জোড়াসাঁকোর, সুবর্ণযুগে তখন তামাটে রঙ ধরে এসেছে। সে পরিণতি দেখবার আগে সেই সোনালি দিনের কলকাতার পুজোকে একবার দেখে নেওয়া যাক।
আগেই বলেছি, কলকাতার পুজো মানে তখন পরোক্ষে কোম্পানিরই পুজো। পুজোর মরসুম পড়তেই তাই ইংরেজি কাগজে কলামের পর কলাম জুড়ে বের হত কোথায় কীসের প্রস্তুতি হচ্ছে, তার বিস্তারিত বিবরণ। ১৮১৯ সালের ক্যালকাটা জার্নাল থেকে তার নমুনা দিচ্ছি একটু:
পুজো আসছে। মহারাজা রামচন্দর রায় এবং বাবু বোষ্টম ডস্ মুল্লিকের বন্ধুরা—‘may indulge in an anticipation of the highest gratification from the arrangements which these gentlemen have respectively made, to render their mansions the scene of jocund festivity and varied amusements.’ এই প্রেসিডেন্সিতে ইতিপূর্বে কেউ কখনও দেখেনি এমনি সব সুগায়িকাদের বিপুল অর্থব্যয়ে আনা হচ্ছে। নিকি নাচবে।…পূর্বদেশীয় আর একটি ‘লিয়াস’ আসছে। সে মনোহারিণী নুরবকস।…ঘরবাড়ি যেভাবে সাজানো হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করা আমাদের ক্ষমতার বাইরে।…ইত্যাদি।’
পুজোর পরেই আবার রিপোর্ট বের হল। এবার রিভিউ। গৃহকর্তারা নিশ্চয় ওঁত পেতে বসে থাকতেন ছাপার হরফে ইংরেজি কাগজে কবে সেই সার্টিফিকেটটি বের হবে তার জন্যে। যে প্রতিযোগিতার মধ্যে আয়োজনাদি হত, তাতে এসব কাগজের ক্লিপিং নিয়ে সমর্থকদের মধ্যে বাকযুদ্ধাদিও হত নিশ্চয়। যা হোক, ক্যালকাটা গেজেট যথাসময়ে জানালেন—‘আমরা শুধু এটুকুই বলব যে—‘their endeavour to please, kept pace with their intentions’। যে ঘরগুলোতে ইউরোপিয়ানদের অভ্যর্থনা করা হয়েছিল সেগুলো সত্যিই ‘সুপার্বলি ডেকরেটেড। প্রাচ্যের জাঁকজমকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপিয়ান রুচি’…ইত্যাদি। আর নাচ? রামচন্দরের বাড়িতে যেমন নিকি নেচেছে, তেমনি রূপচাঁদ রায়ের বাড়িতে নেচেছে বুনু। জনৈকা কাশ্মীরি সুন্দরী।
শুধু কাশ্মীর নয়, নর্তকীদের আরও দূর দূর দেশ থেকেও আনা হত তখন। ১৮২৬ সালের গভর্নমেন্ট গেজেটে লিখছে: ‘গোপীমোহন দেবের বাড়িতে নাচবার জন্যে সুদূর ব্রহ্মদেশ থেকে একদল সুন্দরী এবং সুগায়িকা নর্তকী আনা হয়েছে।’ নাচের সঙ্গে পূজায় আর একটি উপচার ছিল সঙ। তারা কখনও রণ-পা চড়ে নেচে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত, কখনও বা বসে বসে কাচের বোতল চিবাত। কোনও কোনও সাহেব সন্দেহ করেছেন, তাঁরা চলে আসার পর নাটমন্দিরের দরজা বন্ধ করে এই সব সঙেরা নিশ্চয় তাঁদের এবং তাঁদের বিবিদের ভাবভঙ্গি নকল করে বাবুদের মজা দিত।
নাচ-গান, খানাপিনা ছাড়া পূজায় আর একটি বড়মানুষি ছিল ঋণের দায়ে আটক কয়েদিদের মুক্ত করা। সেকালে ঋণের টাকা মিটিয়ে দিলেই এক শ্রেণীর কয়েদিরা ছাড়া পেত। কোনও কোনও বাবু পুজোয় সাধ্যমতো তাদের মুক্ত করতেন। বিশেষ করে ইংরেজ কয়েদিদের। ফলে পুজোর মরসুমে নাকি স্মল কজেস কোর্টে অধমর্ণদের ভিড় লেগে যেত। তারা এক্ষুনি জেলে যেতে চায়, পুজোর আগে। কারণ, তাতে অচিরেই মুক্তির আশা। অনেক বাবু তাই বাধ্য হয়েই তাঁদের মনোবাসনা গোপন রাখতেন। কেন না, নয়তো ট্যাঁকে টান পড়ার সম্ভাবনা।
কিন্তু তবুও শেষরক্ষা করা গেল না। পুরোপুরি দু’ পুরুষও ট্র্যাডিশন বাঁচিয়ে চলতে পারল না কলকাতা। ক’ বছরের মধ্যেই শোনা গেল, মন্দার খবর। ১৮২৯ সালে কাগজে লেখে, ‘পূর্বে এই দুর্গোৎসবে যেরূপ সমারোহ নৃত্যগীতাদি এক্ষণে বৎসর ২ ক্রমে ঐ সমারোহ ইত্যাদির হ্রাস হইয়া আসিতেছে। এই বৎসরে দুর্গোৎসবে নৃত্যগীতাদিতে যে প্রকার সমারোহ হইয়াছে ইহার পূর্বে ইহার পাঁচগুণ ঘটা হইত এমত আমাদের স্মরণে আইসে।’
‘বঙ্গদূত’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী তবুও সে বছর, ৪/৫ স্থানে বৃহৎ সমারোহ হইয়াছিল বিশেষত ‘মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুরের দুই বাটীতে নবমীর রাত্রে শ্রীশ্ৰীযুত গবরনর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক বাহাদুর ও প্রধান সেনাপতি শ্ৰীশ্ৰীযুত লার্ড কাম্বরমীর ও প্রধান প্রধান সাহেব লোক আগমন করিয়াছিলেন।…অন্যত্র অত্যল্প।’ তবে সেবারে অন্য একটি নতুন দর্শনীয় বস্তুও ছিল। সেটি ‘সিংহ দেওয়ানের বাটীতে পূজার চিহ্ন যোড়াসাঁকোর চতুরাস্ত্র পথে এক গেট’ নির্মাণ।’
তিন বছর পরে, ১৮৩২ সালের খবর জাঁকজমক আরও পড়তির দিকে। কলকাতার পুজোর সমারোহ কমতে কমতে সেবারে গোটা তিন পড়ন্ত বাড়ির দালানে এসে ঠেকল। ‘সমাচার চন্দ্রিকা’র মতো রক্ষণশীল কাগজকেও স্বীকার করতে হল—‘শ্রীশ্রীপূজার সময়ে যে প্রকার ঘটা কলিকাতায় হইত এক্ষণে তাহার ন্যূন হইয়াছে, কেননা ৺গোপীমোহন ঠাকুর ও মহারাজা সুখময় রায়বাহাদুর ও বাবু নিমাইচরণ মল্লিক প্রভৃতির বাটীর সম্মুখে রাস্তায় প্রায় পূজার তিন রাত্রিতে পদব্রজে লোকের গমনাগমন ভার ছিল যেহেতুক ইঙ্গরেজ প্রভৃতির লোকের শকটাদির ও যানবাহনের বহুল বাহুল্যে পথ রোধ হইত।’
সুতরাং যেসব বাড়িতে আগে সাধারণের ছাড়পত্র ছিল না এবং রবাহূতেরা বাবুদের উদ্যোগ দেখতে গিয়ে ‘দারোয়ানের হাতে উত্তম-মধ্যম খেয়ে ঘরে ফিরত ‘জ্ঞানান্বেষণ’ জানালেন: ‘(এবার) সেই সকল বাড়ীতে ইতর লোকের স্ত্রীলোকেরাও স্বচ্ছন্দে প্রতিমার সম্মুখে দণ্ডায়মানা হইয়া দেখিতে পায় এবং বাইজীরা গলি গলি বেড়াইতেছেন তত্রাপি কেহ জিজ্ঞাসা করে নাই…এবং যাহারদের বাড়ীতে পাঁচ সাত তরফা বাই থাকিত এ বৎসর সেই বাড়ীতে বৈঠকিগানের তালেই মান রহিয়াছে।’ (জ্ঞানান্বেষণ, ১৩ অক্টোবর, ১৮৩২)।
১৯৩২ সালে আরও একটা মন্দার খবর ছিল। সেটি কুমারটুলির। বরাবরের মতো পূজা না হওয়ায় সে বছর প্রতিমাও তেমন বিক্রি হয়নি। এ বিভ্রাটের ফলে সে বছর কলকাতায় উৎপত্তি হল এক নতুন রেওয়াজের। রাতের অন্ধকারে পাড়ার ছেলেরা সে সব প্রতিমা পাচার করে দিতে লাগলেন গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ সেই প্রতিমার পূজা না করিয়া তাহাতে যে সরস্বতীর মূর্তি ছিল তাহাই খুলিয়া রাখিলেন। কারণ, ‘শ্রীপঞ্চমীতে উপকার দর্শাইবে।’ বেলঘরিয়ায় এক ভদ্রলোক সে উপকারটুকুও চাইলেন না। তিনি প্রতিমাটি ছুড়ে ফেলে দিলেন পুকুরে। একদল বললেন, উচিত কাজ হল। অন্য দল বললেন, ‘না, এ মহাপাতকের কাজ।’ তাই নিয়ে দুই দলে রীতিমতো খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেল একটা।
এবং অবশেষে শুরু হল সেকালের নিয়মে খবরের কাগজে কাগজে কলম-যুদ্ধও, ‘সমাচার দর্পণ’ লিখলেন শুধু কৃপণদেরই এভাবে সাজা দেওয়া হয়, তাঁরা তা মনে করেন না। ‘কখন কখনও অতি পরিমিতব্যয়ি সদ্বিবেচক যিনি স্বীয় যোত্ৰ বুঝিয়া সাধারণ কৰ্ম্মে ব্যয় করেন ইদৃশ ব্যক্তির উপরও কতকগুলো পাগল বালকেরা এইরূপ ভার দিয়া ক্লেশ দেয়।’ সুতরাং দর্পণ মনে করে বাংলাদেশে যত শারদীয় পূজা হয়, তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশই ‘বলপূর্বক হয়।’
রক্ষণশীল দলের মুখপত্র ‘চন্দ্রিকা’ তাই শুনে খেপে গেলেন। তাঁরা লিখলেন: ‘(এভাবে) পূজা করিয়া একেবারে কাঙ্গাল হইয়াছে এমত কখন শুনা যায় নাই।’ সুতরাং দুর্গোৎসব বন্ধ করার চেষ্টা করে হাস্যাস্পদ না হয়ে দর্পণ ‘বরঞ্চ রাস্তায় ২ ঘর করিয়া বিদ্যাদানচ্ছলে যাহারা দেশের সর্বনাশ করিতেছেন তাহারদিগকে দেশ হইতে দূর করিবার চেষ্টা করুন।…বাটীতে প্রতিমা রাখিয়া গেলে তাহাতে যদি কাহার ক্ষতি বোধ হয় সে বড় ৫০/৬০ টাকাই ক্ষতি হউক কিন্তু ইহকাল পরকাল ভাল হয়’ ইত্যাদি।
কিন্তু চন্দ্রিকার এই যুক্তির বাঁধ যুগের বেগে বালির বাঁধের মতো হারিয়ে গেল। দেখতে দেখতে কোম্পানির মতো কলকাতার চেহারা হয়ে উঠল ভিন্নতর। ১৮৩৯-এ ‘জ্ঞানান্বেষণ’ কাগজ জানালেন: ‘বর্তমান বর্ষীয় শারদোৎসবোপলক্ষে নৃত্য সং দর্শনার্থ খ্রিস্টিয়ানগণের মধ্যে অত্যল্প মনুষ্য আগমন করিয়াছিলেন এতদ্দর্শনে আমরা অতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছি। আর যখন সর্বসাধারণে একেবারে এতদ্বিষয়ে উৎসাহ পরিত্যাগ করিবেন তখন আমরা আরও অধিক সন্তুষ্ট হইব।’
এই হাওয়া-বদলের কারণগুলো যে সেকালে অজ্ঞাত ছিল, এমন নয়। তৎকালের কোনও কোনও কাগজেই সুন্দর ব্যাখ্যা আছে তার। ‘জন বুল’ কাগজের মতে, ‘পূজায় এই ভাটার কারণ ১। এক্ষণে সাহেব লোকেরা বড় তামাশার বিষয়ে আমোদ করেন না। ২। কাহার কাহার তাদৃক ধন এখন নাই…কলিকাতাস্থ অনেক বড় বড় ঘর এখন দরিদ্র হইয়া গিয়াছে যাঁহারা ইহার পূর্বে মহাবাবু এবং সকল লোকের মধ্যে অতিশয় প্রসিদ্ধ ছিলেন তাহাদের মধ্যে অনেকেরই এখন নামমাত্র আছে। কেহ সুপ্রিম কোর্টে মোকদ্দমা করণে নিঃস্ব হইয়াছেন…কেহবা অধিকারের যে অংশ করণেতে বাঙালিরা ক্রমে ক্রমে হ্রাস প্রাপ্ত হন তাহাতে নির্ধন হইয়া গিয়াছেন।…(তদুপরি) ৩। উৎসবের হ্রাস হওনের আর এক কারণ জ্ঞান বৃদ্ধি।’
উদাহরণ দিয়ে যুক্তিগুলোকে প্রমাণিত করার প্রয়োজন নেই। আমরা শুধু এখানে দুর্গোৎসবে ইংরেজদের উৎসাহহীনতার কারণগুলোই সংক্ষেপে বলব। হিন্দুদের উৎসবে খ্রিস্টানদের যোগ দেওয়া সংগত কিনা, কলকাতার ইংরেজদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক একটা আগাগোড়াই ছিল। ১৭৯২ সালে ‘ক্যালকাটা ক্ৰনিক্যাল’ রায় দিয়েছিলেন— ‘Call it diversion and the pill goes down.’ কিন্তু ১৮২৬ সালে ‘ক্যালকাটা গেজেটে’র পক্ষে এই ঔদার্য দেখানো সম্ভব হল না। তাঁরা ক্রিটিকাল হয়ে উঠলেন। কেননা তাঁদের মতে দুর্গোৎসব: ‘a very heterogeneous sort of business.’ এতে মুসলমানেরা নাচে, বাদ্যি বাজায় সাহেবরা কোল্ড বিফ্ বিয়ার খায়।’ তিন বছর পরে তাঁরা জানালেন নিছক দর্শক হিসেবে যদি কোনও খ্রিস্টান এতে যেতে চান, তবে তাঁদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু হিন্দুদের পক্ষে এভাবে যদৃচ্ছ টাকা ওড়ানো কি ঠিক?
হিন্দুদের মধ্যেও এ প্রশ্ন উঠল। ১৮৩১ সালে ‘সমাচার দর্পণে’ই এক দর্শক পত্রাঘাত করলেন: ‘গোমাংসের নাম শ্রবণে পিধান করেন এমত অনেক দক্ষিণাচারি বাবুর দিগকে দেখিয়াছি তবে কি নিমিত্ত তাহারা দুর্গাচান বাটীতে বিফস্টেক ও মটন চপ ও বৎস মাংস ও ব্যান্ডি সাম্পেন সেরি ইত্যাদি নানাপ্রকার মদিরা আনয়ন করেন।’
এই দুই শ্রেণীর সমালোচকদের ওপর ছিলেন আবার মিশনারি সাহেবেরা। তাঁরা আন্দোলন শুরু করলেন। কেউ কেউ কুৎসার পথও ধরলেন। তাঁরা রটালেন খ্রিস্টান অফিসারদের পৌত্তলিকতা- প্রীতির পিছনে রয়েছে নেটিভ স্ত্রীলোকদের প্রেরণা। : রেভারেন্ড পেগ নামে এক পাদরি সাহেব এসেছিলেন কলকাতায় ১৮২১ সালে। ’২৬ সালে দেশে ফিরে জোর আন্দোলন শুরু করলেন তিনি। ‘India cries to British Humanity’ নামে একখানা মুদ্রিত আবেদনও তিনি প্রচার করলেন বিলেতে।
এসব আন্দোলন এবং সেই ‘জ্ঞান বৃদ্ধির’ কারণে ক্রমে কলকাতার দুর্গোৎসব ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল। ১৮৩৩ সালে ইয়ং বেঙ্গল সোজাসুজি জানতে চাইলেন, ‘একথা জিজ্ঞাসা করিতে পারি…যে সকল ভারি ভারি বিষয়ে তাঁহারদিগের সাহায্য করা এবং তত্ত্ব নেওয়া আবশ্যক সে সকল বিষয়ে মনযোগ না করিয়া নাচ প্রভৃতি তুচ্ছ বিষয়ে কি জন্যে ব্যয় করিতেছেন তাহার কি সর্বসাধারণের উপকারযোগ্য কোন বিষয় দেখিতে পান না?’ তাঁরা কলকাতার বড়মানুষদের সামনে ‘কী কী বিষয়ে খরচ করিতে হয়’ সে বিষয়ে একটা ফর্দ উত্থাপন করলেন। তার মধ্যে আছে ‘বিলাতে গমনোপযুক্ত জাহাজ নির্মাণ’, ‘নানাবিধ শিল্প যন্ত্র স্থাপন’ এবং ‘চাষ বৃদ্ধি’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
সে বছরই বের হল কোম্পানির বিখ্যাত ঘোষণা। হিন্দুদের মন্দিরাদি থেকে সরকারিভাবে হাত উঠিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা। ক’বছরের মধ্যেই ১৮৩৭ সালে বন্ধ হয়ে গেল হিন্দুর উৎসবে তোপ দাগানো এবং অবশেষে ’৪০ সালে এল বিখ্যাত দশ নম্বরি আইন। সে আইনের মর্ম: নেটিভরা প্রজা, আমরা রাজা। তাদের ধর্ম তাদের, আমাদের ধর্ম আমাদের।
সুতরাং কোম্পানির দেওয়া প্রাণবায়ু হারিয়ে, কলকাতার পুজোর ফানুসটি চুপসে আবার যে-কে সেই হয়ে গেল। এবং তাই নিয়ে শুরু হল একালের পুজো। বারোয়ারির পালা।
বারোয়ারির তেরোকথা
১৮৪০ সালের কথা। কলকাতা থেকে একখানা পালকি চলেছে বেহালার দিকে। সুন্দর দামি পালকি। চার পাশে ভেলভেটের ঘেরাটোপ। নীচে রেশমি ঝালর। ‘হেঁইয়া হো, হেঁইয়া হো’ করতে করতে ছুটে চলেছে চারটে জোয়ান বেহারা। যেন বেহারা নয়, চারটে ঘোড়া। কালীঘাট পিছনে পড়ল, আলিপুরও চলে গেল। দেখতে দেখতে পালকি এসে পৌঁছল বেহালা। সাবর্ণ চৌধুরীদের বিরাট বাড়িটা ডাইনে রেখে বেহারারা বাঁয়ের পথ ধরল। বাঁয়ে বারোয়ারিতলা।
বারোয়ারিতলাতে যেমনি পা দেওয়া, অমনি পিছন থেকে হুকুম এল, থামাও পালকি। হুকুমের প্রকৃতিটা এমন যে, স্পষ্ট বোঝা যায়, তাকে অমান্য করার অর্থ অনর্থ। বেহারাদের পা থেমে গেল। ঘাড় থেকে পালকি নামিয়ে কপালের ঘাম মুছল তারা। সমস্ত কাজটা এমনভাবে করল, যেন জানা কথা এটা করতে হবে।
হুকুমদারেরা ততক্ষণে হা হা হি হি করতে করতে এসে হাজির। যা বলেছিলাম মাইরি, দেখছিস না, ব্যাটাছেলে কেউ নেই, এই ভিতরে কে রে? কোন লক্ষ্মী মাঈ বুঝি? মাইজিকো বোলাও রূপেয়া নিকালনেকি।
‘বেহারা কহিল, তাহারদিগের সঙ্গে কর্তপক্ষ কেহ আইসেন নাই এক কূলবধূকে লইয়া যাইতেছে তিনি বেহারার সহিত কথা কহিবেন না এবং তাঁহার সঙ্গে টাকা-পয়সাও নাই তবে, তাহারা টাকা কোথায় পাইবে।’
আবার হো-হো করে হেসে উঠল যুবকদল। এসব কৈফিয়ত বেহালার বারোয়ারিতলায় অচল। সাবর্ণ চৌধুরীরা ক’ বছর আগেও ছিলেন কলকাতার মালিক। খোদ কোম্পানি তাঁদের কথা অমান্য করার আগে তিনবার ভাবত। জানিস তো আমরা চৌধুরী বাড়ির ছেলে। বেহালার চৌধুরী বাড়ি। তোদের মাঈজিকে বল, চৌধুরী বাড়ির ছেলেরা যখন ধরেছে, তখন কিছু না দিলে ছাড়ান নেই। আঁচলের গিঁটখানা খুলে দিতে হলেও তারা নেবে।
বেচারা ইতস্তত করছে দেখে বাবুরা আবার অট্টহাসি হেসে উঠলেন। তারপর শাসানো গলায় হুকুম দিলেন, তোদের বধূকে বের কর, তাঁর সঙ্গে টাকাপয়সা আছে কি না আমরা দেখব।
‘বেহারা কহিল, তাহারা ডুলির ঘটাটোপ উঠাইতে পারিবেক না, তোমরা পার ঘটাটোপ উঠাইয়া বধূর মুখ দেখ।’
এ সুযোগটারই অপেক্ষায় ছিল যেন ছেলেগুলো। একসঙ্গে চারদিক থেকে ঘেরাটোপে তাদের নির্লজ্জ উদ্ধত হাত পড়ল। মান্যবংশের ছেলে যে, কিন্তু এ কী। যেন কালকেউটের গর্তে ভুল করে হাত দিয়ে বসেছে ছেলের দল। ভেলভেটের আবরণখানা উঠতেই চোখের বাতিগুলো যেন এক ফুঁয়ে নিভে গেল ওদের। পালকিতে শাড়ি-পরা বউটির মুখের দিকে তাকিয়ে কারও চিনতে অসুবিধে হল না যে, ইনি দুর্ধর্ষ পেটন সাহেব। চব্বিশ পরগনার জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট পেটন।
‘তখন সাহেবের মুখ দেখিয়া সকলের মহা হৃদকম্প হইল এবং কে কোন দিকে পলায়ন করিবেন চক্ষে পথ দেখিলেন না। তৎপরে সাহেব নারীবেশ ছাড়িয়া বিচারকর্তা হইয়া দাঁড়াইলেন এবং তৎক্ষণাৎ কয়েক ব্যক্তিকে ধরিয়া লইয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।’
বেহালার বারোয়ারিতলায় ছদ্মবেশে পেটন সাহেবের এই অভিযানের কারণ: একটা পুরানো অভিযোগকে নিজের চোখে পরখ করে দেখা। ‘সমাচার দর্পণে’ অনেক দিন ধরেই লেখালিখি হচ্ছিল যে, বারোয়ারির পাণ্ডাদের উপদ্রবে বেহালার পথ দিয়ে চলা ভার হয়ে উঠেছে। বিশেষত, ‘মান্য সাবর্ণ মহাশয়দিগের যুবা সন্তানেরা বারোয়ারী পূজার নিমিত্ত অনেক লোকের উপর অত্যাচার করিতেছিলেন…স্ত্রীলোকের ডুলি পালকি দৃষ্টি মাত্রই বারোয়ারীর দল একত্র হইয়া তৎক্ষণাৎ আটক করিতেন এবং তাহাদিগের ইচ্ছামত প্রণামী না পাইলে কদাপি ছাড়িয়া দিতেন না। স্ত্রীলোকের সাক্ষাতে অবাচ্য উচ্চবাচ্য যাহা মুখে আসিত তাহাই কহিতেন তাহাতে লজ্জাশীলা কুলবালা সকল টাকা-পয়সা সঙ্গে না থাকিলে বস্ত্রালংকারাদি প্রদান করিয়া মুক্ত হইতেন ইত্যাদি প্রকার অত্যাচার করিয়া বেহালানিবাসী যুব লোকেরা অতিশয় সাহসিক হইয়াছিলেন।’
পেটন সাহেবের নারীবেশে অভিযান এই সাহসকেই একটু যাচাই করে দেখার জন্যে। বলা বাহুল্য, অতঃপর বেহালার যুবকদের আর সে সাহসের কথা শোনা যায়নি। সাবর্ণ চৌধুরীদের ঐতিহাসিক কাহিনীর মতো, তাদের উত্তরপুরুষদের এই বীরত্বের কাহিনীটিও ইতিহাসের পাতা থেকেই খুঁজেপেতে শোনা।
এবার আসুন কলকাতায়।
‘সিঙ্গিবাবু সে সময় অফিসে বেরুচ্ছিলেন, অধ্যক্ষেরা চার পাঁচজন তাঁহাকে ঘিরে ধরে ধরেছি, ধরেছি, বলে চেঁচাতে লাগলেন। রাস্তায় লোক জমে গেল, সিঙ্গিবাবু অবাক—ব্যাপারখানা কি— তখন একজন অধ্যক্ষ বললেন, ‘মশায়। আমাদের অমুক জায়গায় বারোয়ারি পুজোয় মা ভগবতী সিঙ্গির উপর চড়ে কৈলাস থেকে আসছিলেন, পথে সিঙ্গির পা ভেঙে গেছে, সুতরাং তিনি আর আসতে পাচ্ছেন না, সেইখানেই রয়েছেন, আমাদের স্বপ্ন দিয়েছেন যে, যদি আর কোন সিঙ্গির যোগাড় করতে পার, তাহলেই আমি যেতে পারি। কিন্তু মহাশয়। আমরা আজ একমাস নানা স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কোথায়ও আর সিঙ্গির কথা পেলাম না, আজ আপনার দেখা পেয়েছি কোন মতে ছেড়ে দেবো না।…’
সিঙ্গিবাবু খুশি হয়ে বিলক্ষণ দশ টাকা সাহায্য করলেন।
কলকাতার আদায় জবরদস্তির আদায় নয়, কৌশলের আদায়। কোথায়ও জুলুম, কোথায়ও কৌশল। নানা রকমের কৌশল। একটি শুনুন: ‘কলকাতার পশ্চিমে শিবপুর গ্রামে এক ব্যক্তি এক দুর্গা প্রতিমা নির্মাণ করিয়া পূজায় তাবদ্দ্রব্য আয়োজন করিয়া ঐ প্রতিমাতে সূর্তি (লটারি) দিয়াছে প্রত্যেক টিকিট একটাকা করিয়া আড়াই শত টিকিট হইয়াছে। যাহার নামে প্রাইজ উঠিবে সেই ব্যক্তির নামে সংকল্প হইয়া ঐ প্রতিমা পূজা হইবেক।’ (সমাচার দর্পণ, ১৮২২)।
বারোয়ারি মানে বারো রকমের কল। পাড়ার কল, ক্লাবের কল, সাহিত্য সংস্কৃতির কল, নাচের কল, পলিটিকসের তথা ইলেকশনের কল। বারোয়ারি বারো কল। হুতোম তাই বলতেন, ‘বারো ইয়ারি’, আমরা বলি বারোয়ারি। বলি, ‘বারোয়ারি, কিন্তু গলির মোড়ে মোড়ে ফেসটুন লিখি ‘সর্বজনীন’। অর্থাৎ, পুজোটা আসলে বারোজনের ব্যাপার হলেও, কাগজে-কলমে সর্বজনের বলে ঘোষণা করাটাই সংগত মনে করি। কারণ, যুগটা সর্বজনের। গণতন্ত্রের যুগ। গণতন্ত্রের যুগ বলেই চাঁদাটা জনগণকে দিতে হয়, মায় তিরিশ টাকা মাইনের দোকান ‘কর্মচারীকে’ এবং কমপক্ষে তিন জায়গায়, যদিচ আদায় ওয়াশীল খরচা, তবুও বারোজনেরই দায়িত্ব। সে মহাদায়িত্ব বহনের জন্যেই পাড়ায় দ্বাদশ ছেলের ঘাড়ে এমন বাঁকা। তাঁরা গণতন্ত্রের বাহন। অন্তত, তাঁরা তাই বলেন, আমরা বলি—বাহন আমরা, আরোহী তারা। তর্ক করলে হয়তো সেই রথ এবং পথের গোল বেধে যাবে। সুতরাং এটা ধরে নেওয়াই ভাল, আমাদের বিবাদ দেখে গণতন্ত্রের অন্তর্যামী হাসছেন। বারোয়ারি লীলায় তিনি না হেসে পারেন না।
দু’ চারটে মাত্র সেকেলে কথা শোনাচ্ছি। এটি চুঁচুড়ার খবর। ১৮৩৭ সালে জনৈক সংবাদদাতা লিখছেন, আমি কলিকাতা ছাড়িয়া চুঁচুড়াতে আসিয়া দেখিলাম এক চতুর্ভুজ্য দুর্গা বৃষ্টিতে গলিতাবস্থা হইয়াছেন…। দুর্গার এই দুর্দশার কারণ পুজারীদের মধ্যে দল ছিল দুটো। দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী নয়, বৈষ্ণব আর শাক্ত। বৈষ্ণবেরা অহিংস। তারা পুজোয় বলি দিতে দেবে না। শাক্তরা বলি না দিতে দিলে আবার পুজোই করবে না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে বিচার গেল। তিনি বললেন, আগে বৈষ্ণবেরা নিজেদের মতো করে পুজো করুক, তারপর শাক্তরা করবে। তাই হল। কিন্তু ‘এক্ষণে বিসর্জনের বিষয়ে মহা গোল উপস্থিত হইয়াছে, তাঁতীরা কহে তাহারা অগ্রে পূজা করিয়া ঘট বিসর্জন দিয়াছে এখন শুঁড়িরা দেবীকে গঙ্গায় দিবে। শুঁড়িরা বলে সকলে মিলিয়া বায়োয়ারী পূজা করিয়াছে—তবে তাহারা এক দলে কেন বিসর্জনের খরচ দিবে।’ অতঃপর সংবাদদাতা লিখছেন: ‘এই বিষয়েতে বোধ হয় দুই দলে দাঙ্গা উপস্থিত হইবে।’
‘হবে’ নয়, দাঙ্গা হয়ে গেল। তবে চুঁচুড়ায় নয়, জয়নগর শ্যামপুরে। ব্রাহ্মণ কর্তৃক বারোয়ারি পূজায় এক অসমম্বিতে তাঁতীকে সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে নিমন্ত্রণ করায় ‘জয়নগরস্থ তাবৎলোক এক পরামর্শ হইয়া সে তাঁতীর সহিত সামাজিকতা না করিতে স্থির করাতে উভয়পক্ষীয় লোকেরা পরস্পর রাগান্ধ হইয়া লাঠিয়াল সংগ্রহ করিয়া পূজার দিবস খণ্ডপ্রলয়ের মত অতিশয় মারামারি হইয়াছিল, তাহাতে অন্য বলিদান ও রক্তপাতের অপেক্ষা প্রায় রহে নাই ও বারএয়ারী পূজাতে বারএয়ারী মারামারি প্রসিদ্ধ হইয়াছে।’
এই প্রসিদ্ধি বোধ হয়, আজও বিন্দুমাত্র কমেনি। বারোয়ারির সঙ্গে মারামারির দুর্গার সঙ্গে অসুরের মতোই গায়ে গায়ে আসে। তবে উপলক্ষ এবং উপচারের একটু রকমফের হয়েছে, এই যা। এখন বৈষ্ণব আর শাক্তের বিবাদের স্থানে এসেছে এ পাড়া আর ও পাড়ার বিবাদ, কিংবা এ-ক্লাব আর ও-ক্লাবের রেষারেষি। এবং লাঠির জায়গায় এসেছে সোডার বোতল, বোম, বা ‘পেটো’ ইত্যাদি অপেক্ষাকৃত আধুনিক উপচার।’
‘বারোয়ারি’ গণতান্ত্রিক ব্যাপার। গণতন্ত্রে যদি দলাদলি চলে, তবে বারোয়ারিতে তা না চলার কোনও কারণ নেই। দলাদলি তাই এই সুপ্রাচীন দেশে বারোয়ারির মতোই প্রাচীন। ১৮১৯ সালের খবর শুনুন: ‘উলাগ্রামে উলাইচণ্ডীতলা নামে এক স্থানে বার্ষিক চণ্ডীপূজা হইবেক। এবং ঐ দিনে ঐ গ্রামের তিন পাড়ায় বারএয়ারি তিন পূজা হইবেক দক্ষিণ পাড়ায় মহিষমর্দিনী পূজা ও মধ্যপাড়ায় বিন্ধ্যবাসিনী পূজা ও উত্তরপাড়ায় গণেশজননী পূজা। ইহাতে ঐ তিন পাড়ার লোকেরা পরস্পর জিগীষাপ্রযুক্ত আপন আপন পাড়ার পূজা ঘটা করিতে সাধ্য পর্যন্ত কেহই কসুর করে না।’
তবে ঘটায় শান্তিপুরের সঙ্গে কেউ নয়। হুতোম লিখেছেন: ‘একবার শান্তিপুরওয়ালারা পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে এক বারো-ইয়ারি পূজা করেন, সাত বৎসর ধরে তার উজ্জুগ হয়, প্রতিমাখানি ষাট হাত উঁচু হয়েছিল। শেষ বিসর্জনের দিনে প্রত্যেক পুতুল কেটে কেটে বিসর্জন করতে হয়েছিল, তাতেই গুপ্তিপাড়াওয়ালারা মা’র অপঘাত মৃত্যু উপলক্ষ্যে গণেশের গলায় কাচা বেঁধে এক বারোয়ারি পূজো করেন তাহাতেও বিস্তর টাকা ব্যয় হয়।’
‘চুঁচুড়ার বারোয়ারি পুজো দেখলে লোকের এত জনতা হত যে, কলাপাত টাকায় একখানি বিক্রি হত, চোরেরা আণ্ডিল হয়ে যেত, কিন্তু গরীব দুঃখী গেরস্তোর হাঁড়ি চড়ত না।’
কিন্তু বনেদিয়ানায় চুঁচুড়া থেকে গুপ্তিপাড়ার খ্যাতি বেশি। কারণ, গুপ্তিপাড়া বারোয়ারির জন্মস্থান। ১৮২০ সালের তিরিশ বছর আগে, অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে এখানেই জন্ম নিয়েছিল বারোয়ারির গণতন্ত্র। বোধ হয়, কলকাতার পাকা ভিতে দাঁত ফুটানো অসম্ভব বিবেচনা করেই গুপ্তিপাড়ার নরম মাটি ফুটে বের হয়েছিল গণতন্ত্রের ধ্বজা। তার গায়ে বারো জনের নাম। এই বারো জন অধ্যক্ষ ব্রাহ্মণ হলেও নির্বাচিত প্রধান। গোটা গুপ্তিপাড়ার মুখপাত্র তাঁরা। তাঁদের সই নিয়ে চাঁদার খাতা হাতে দেশ-দেশান্তরে লোক ছুটল চাঁদা কুড়াতে। কেউ ফিরল, কেউ ফিরল না। কারও কারও খাতা গেল আবার হারিয়ে। তা হলেও আদায় মন্দ হল না একেবারে। সাত হাজার টাকা। এ টাকায় দশাসই প্রতিমা তো একখানা হলই, গান-বাজনার ব্যবস্থাও হয়ে গেল। বাংলাদেশের নামজাদা গানাদার যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এলেন। এলেন বাঈজিরাও। চারদিকে গুপ্তিপাড়ার খ্যাতি। বারোয়ারির জয়ধ্বনি। গুপ্তিপাড়া থেকে বারোয়ারি এল বল্লভপুর, কোন্নগর, উলো, চাকশুদা এবং শ্রীপুর। অবশেষে কলকাতা। কলকাতা এখন বারোয়ারির মহাপীঠ। এ মহানগরীতে এককালে জয়ঢাক বাজত গুটিকয় বনেদি বাড়ির পূজামণ্ডপে, কিন্তু আজ সেখানে চামচিকে আর কবুতরের বাসা। পূজার দায়িত্ব এখন গলিতে গলিতে প্রতিজনের। কারণ, কলকাতার পুজো আজ সর্বজনের। এই গলি-ঢালা জনতার আমরাও এক এক অংশ, এক এক জন। সুতরাং, গণতন্ত্রের নামে কুৎসা রটানোটা আমাদের পক্ষে অনুচিত। তবুও একটা কথা না বলে পারছি না। কথাটা আমার নয়, আমার গলির তেরো নম্বর থেকে তিনশো তেরো নম্বর বাড়ির তেত্রিশশো মানুষের একজনের কথা। সেবার বারোয়ারির গেটের একপাশে দাঁড়িয়েছিল লোকটা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল যে জিনিসটা, সেটি প্রতিমা নয়—ভলান্টিয়ার। ভলান্টিয়ার এবং তাদের ক্যাপটেন কমান্ডাররা তার কাছে যেন প্রতিমার চেয়েও অদ্ভুত। ওদের ওপর চোখ রেখেই সে বলছিল, বাবুদের বাড়ি যখন পুজো হত, তখন দায়িত্বটা ছিল একজনের, আনন্দ সর্বজনের। আর এখন পয়সার দায়িত্ব সর্বজনের, আনন্দটা ওই উদ্যোক্তা বারোজনের নয় কি?
লোকটা জানে না যে, গণতন্ত্রে এটাই রীতি। জানে না, একজনের হাত থেকে মা’র এই বারোজনের হাতে আসাটা ঘটনা হিসেবে কত ঐতিহাসিক।
প্রাণকৃষ্ণ হালদারের দুর্গোৎসব
‘কীর্ত্তির্যস্য স জীবতি। পরম্পরা শুনা গেল যে সংপ্রতি মোকাম চুঁচুড়া শহরের মধ্যে শ্ৰীযুত বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদার মহাশয়ের বাটীতে দুর্গোৎসব অতি বাহুল্যরূপে হইয়াছিল তাহার শৃঙ্খলা এবং ব্যয় দেখিয়া সকলেরই চমৎকার বোধ হইয়াছে স্বর্ণ ও রৌপ্য নিৰ্ম্মিত খাল গাড়ু ঘটি বাটি ইত্যাদি সামগ্রী প্রস্তুত হইয়াছিল এবং গীতিবাদ্য রোশনাই ও বাটীর সজ্জা যেখানে যাহা সাজে সেই স্থানে তাহা অনায়াসে দিয়াছিলেন তাহা সৰ্ব্বত্র এক দৃষ্টান্ত স্থলের ন্যায় হইয়াছে। শুনা যাইতেছে যে এমত বৃহদ্যাপারে যে কোন অংশে ত্রুটি হয় নাই ইহাতে বাবু মহাশয়েরা ও অধ্যক্ষ সকলে অবশ্য ধন্যবাদের ভাগী হয়েন। কলিকাতা ভবানীপুর চুঁচুড়া নপাড়া চন্দননগর প্রভৃতি নানা দিগ্দেশীয় ব্রাহ্মণ ও কায়েস্থাদি এবং ইংরাজ প্রভৃতির নিকট নিমন্ত্রণ পত্র প্রেরিত হইয়াছিল…।’
সংবাদটি ছাপা হয়েছিল শ্রীরামপুর মিশনারিদের কাগজ ‘সমাচার দর্পণ’-এ। তারিখ ২৯ অক্টোবর, ১৮২৫ সাল। অর্থাৎ একশো ষাট বছর আগে। কলকাতায় তখন জাঁকের পুজোর মরসুম চলেছে। ঘড়া ঘড়া টাকার পুজো। কে কত বড়মানুষি দেখাতে পারেন, তাই নিয়ে শহরের বনেদি পরিবারগুলোর মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলেছে তখন। তারই মধ্যে শহর থেকে দূরে চুঁচুড়ায় আবির্ভূত হয়েছেন নতুন প্রতিযোগী প্রাণকৃষ্ণ হালদার। ইংরেজিতে নিজের নাম লিখতেন যিনি বাবু প্রাণকিশোন হলডার।’
‘সমাচার দর্পণ’-এর এই সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন থেকে বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদারের দুর্গোৎসবের কিছুটা আসা মেলে বটে, কিন্তু তাঁর বড়মানুষির বহর ঠিক বোঝা যায় না। তার জন্য উঁকি দিতে হবে সমসাময়িক ইংরেজি কাগজ ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এর পাতায়। সেখানে ১৮২৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ছাপা হয়েছিল একটি অবিশ্বাস্য নিমন্ত্রণপত্র। শিরোনাম: গ্র্যান্ড নচেস। অর্থাৎ বিরাট নৃত্যসভা। তার পরের ছত্রগুলোর বক্তব্য: চুঁচুড়ার বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদার শহরের ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা, এবং জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছেন, দুর্গোৎসব উপলক্ষে তিনি তাঁর চুঁচুড়ার বাড়িতে এক মহতি নাচের আসরের আয়োজন করেছেন। আসর চলবে ২০ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর। যাঁরা আমন্ত্রণপত্র পেয়েছেন বাবু সবিনয়ে ওই সময়ে সেইসব ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলাদের সাহচর্য প্রার্থনা করছেন। যাঁরা ‘টিকিট’ বা নিমন্ত্রণপত্র পাননি, অর্থাৎ বাবুর সঙ্গে যাঁদের সাক্ষাৎ আলাপ-পরিচয় নেই, তাঁরাও স্বাগত। বাবুর তরফে তাঁদের আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি ঘটবে না। নিমন্ত্রণপত্রটিতে সোজাসুজি বলে দেওয়া হয়েছে, অভ্যাগতরা প্রত্যেকে ‘টিফিন’ পাবেন। তা ছাড়া পাবেন ডিনার। খাদ্যের সঙ্গে থাকবে ঢালাও মদ্যও।
শহরের অনেক সাহেব মেম নিশ্চয় সেদিন সেজেগুজে চুঁচুড়া-যাত্রী। তাঁদের পিছু পিছু হয়তো কলকাতার অনেক বাবু বিবিও। বিশেষত, যাঁদের বাড়িতে পুজো নেই। কিংবা বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদার যাঁদের প্রাণের বন্ধু। কী সাহেব, কী বাঙালিবাবু, প্রাণকৃষ্ণের পরিচিতরা জানেন, তাঁর সঙ্গে বড়মানুষিতে পাল্লা দিতে পারেন কলকাতার এমন বাবু অল্পই আছেন। থাকলেও বড়জোর পাঁচ-সাতটি ঘর। তা ছাড়া, পুজোর জাঁকজমকই কি বড়মানুষির একমাত্র পরিচয়? প্রাণকৃষ্ণ আরও অনেক ব্যাপারেই অগ্রগণ্য। তাঁর ডাকে সাড়া না দিয়ে পারা যাবে কেন?
‘সমাচার দর্পণ’ থেকেই কিছু টুকরো খবর। ১৮২৭ সালের ২০ অক্টোবর ‘দর্পণ’ লিখছে: শুনিলাম শহর চুঁচুড়া নিবাসি দ্বিজমিষ্টভাষী শ্ৰীযুতবাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদার মহাশয় বহুতর ধন ব্যয়পূৰ্ব্বক নানা রোগের ঔষধ প্রস্তুত করিয়া দীনদরিদ্র রোগিদিগকে ঐ ভেষজদানদ্বারা আরোগ্য করিয়া দিতেছেন বিশেষ শুনিলাম ধনবান অর্থাৎ যাঁহারা ধনব্যয়দ্বারা ঔষধ প্রস্তুত করিতে পারেন এমন ব্যক্তিকে দেন না কিন্তু কাঙ্গাল রোগগ্রস্ত যত লোক যায় তাবৎকেই দিয়া থাকেন ইহাতে অবারিতদ্বার।…’
বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদার সর্বব্যাপারেই স্বনামধন্য বাবু। ১৮২৭ সালের ১ জানুয়ারি, অর্থাৎ নিউ ইয়ার্স ডে’তে কলকাতায় রাজা বৈদ্যনাথের বাড়িতে এক মল্লযুদ্ধের আয়োজন হয়। তাতে শহরের অনেক বড়ঘরের পোষা পালোয়ানরা যোগ দিয়েছিল। মেজর ব্যাম্বেল, জর্জ পামারের মতো বিলাসী সাহেবরাও এসেছিলেন তাঁদের মল্লবীরদের সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু সবাইকে হারিয়ে সে পুরস্কার জিতে নেয় চুঁচুড়ার বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদারের পালোয়ান বর্তন সিং। নগদ পাঁচশো টাকা পুরস্কার পেয়েছিল সে। সেইসঙ্গে বিস্তর করতালি। বিজয়গৌরবে চুঁচুড়া ফিরে গিয়েছিলেন বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদার।
সুতরাং, পুজোয় প্রাণকৃষ্ণ হালদার যে বিলাসিতার রেকর্ড প্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন, তাতে আর বিস্ময় কী! কিন্তু বিস্ময়কর হল দু’বছর পরের ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ প্রকাশিত একটি ছোট্ট খবর। সেদিন ১২ মার্চ, ১৮২৯ সাল। ‘গেজেট’ লিখছে: বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদার দ্বীপান্তরে চলেছেন। সাত বছরের জন্য আদালতের রায়ে তাঁকে চালান দেওয়া হচ্ছে প্রিন্স অব ওয়েলস দ্বীপে। অপরাধ— জালিয়াতি। সংবাদ জানিয়ে কাগজটি লিখছে, চুঁচুড়ার প্রাণকৃষ্ণ হালদার বিখ্যাত ধনী ব্যক্তি। তাঁর বিলাসিতার কাহিনীও সর্বজনবিদিত। তিনি বন্ধু ও অতিথিদের নাচ এবং খানাপিনার আপ্যায়ন করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কে জানে, মাত্রাহীন বিলাসিতাই তাঁর কাল হল কি না। আমরা আশা করব, তাঁর এই বেদনাদায়ক পরিণতি থেকে অন্যরা শিক্ষালাভ করবেন।
কয়দিন পরে ২৯ মার্চ (১৮২৯) ওই কাগজেই ছাপা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের রায়। তাতে জানা যায়, মিথ্যা কাগজ দিয়ে বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদার নানা জনের কাছ থেকে ৫০/৬০ লক্ষ টাকা ধার করেছিলেন এবং পরে ধার শোধ করতে অসম্মত হন। তাঁর মতো একজন শিক্ষিত, মান্য, এবং ধনী ব্যক্তির এই আচরণ আদালতের বিচারে জঘন্য অপরাধ বলে গণ্য হয়। জুরিরা অবশ্য তাঁকে অপরাধী বলেননি। প্রাণকৃষ্ণ হালদারের দেশি-বিদেশি বন্ধুরাও তাঁর সপক্ষে আদালতের অনুকম্পা প্রার্থনা করেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, হালদারকে মার্জনা করা হোক। বিশেষত তিনি একজন সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ। তিনি দ্বীপান্তরী হলে তাঁর পুত্ররাও জাতিচ্যুত হবে। কিন্তু বিচারক অনড়। তাঁর বক্তব্য: বড়মানুষ বলেই প্রাণকৃষ্ণ হালদারের আরও সাজা হওয়া সঙ্গত। অতএব দণ্ড ধার্য হল সাত বছরের জন্য দ্বীপান্তর।
তারপর থেকে আর চুঁচুড়ার বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদারের জাঁকের পুজোর কোনও খবর নেই। অবশ্য বাবু’র খবর খুঁজে পাওয়া যাবে মাঝে মধ্যে।
২৭ জুলাই, ১৮২৯। ‘ক্যালকাটা গেজেট’ জানাচ্ছে, বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদারের কিছু বিষয়সম্পত্তি নিলামে উঠেছে কলকাতায়। নিলাম ডেকেছেন মেসার্স ম্যাকেঞ্জি লায়াল অ্যান্ড কোং। বাবুর বিষয়সম্পত্তির তালিকাও ছিল একটি বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে। তাতে দেখা যায়, খাস কলকাতা শহরেই বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদারের মস্ত মস্ত বাড়ি ছিল আটখানা। তা ছাড়া চুঁচুড়ায় আরও পাঁচ-ছ’ খানা। সেই সঙ্গে চন্দননগরের একখানা বিশাল বাগানবাড়ি। কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারের তিনতলা বাড়িটি ছিল একবিঘা চোদ্দ কাঠা জমি জুড়ে। রাসেল স্ট্রিটের একখানা বাড়ি ছিল আট বিঘা পনেরো কাঠা জমি নিয়ে। এমনি সব ঘরবাড়ি।
সেসব নিলামে তুলেও যে হালদার পরিবার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিলেন না, সেটা জানা যায় ‘সমাচার দর্পণ’ থেকে। ১৮৩০ সালের ১৩ মার্চ ‘সমাচার দর্পণ’ লিখছে:
‘বিজ্ঞাপন। বহুমূল্যের তালুক নীলামে বিক্রয় হইবেক। সকলকে জ্ঞাত করা যাইতেছে যে জিলা হুগলি ও চব্বিশ পরগনার মধ্যে শ্রীযুক্ত বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদারের দরুণ তালুক আগামী ১৮৩০ সালের ১৮ মার্চ বৃহস্পতিবার শ্রীযুক্ত মিসোর্স টালা এণ্ড কোম্পানি সাহেবরা তাঁহাদিগের নীলাম ঘরে নীলামে বিক্রয় করিবেন।…
প্রাণকৃষ্ণ হালদার দৃষ্টান্ত মাত্র। দ্রুত উত্থান এবং ততোধিক দ্রুত পতনের এমনই সব অবিশ্বাস্য কাহিনী ছড়িয়ে রয়েছে কোম্পানির আমলের ইতিহাসের পাতায়। পুজোয় চূড়ান্ত বিলাসিতা দেখিয়ে একদিন যাঁরা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন, কলকাতা এবং আশেপাশে, কয়েক দশকের মধ্যেই দেখা গেল, একে একে তাঁরা কুর্নিশ করে বিদায় নিচ্ছেন আসর থেকে। আর, তাঁদের সেই শূন্যস্থান পূরণ করতেই ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন জাঁকের পুজোর এককালের বিস্ময়-বিমূঢ় দর্শকরা, যাঁদের অনেকের ছাড়পত্র পর্যন্ত ছিল না পূজামণ্ডপে দাঁড়িয়ে ঠাকুর দেখার।
পুড়ে ম’লাম, পতি পেলাম না
নামটা জানি না। কিন্তু ঘটনাটা জানি। মেয়েটি ছিল কুলীন ঘরের মেয়ে। সুলক্ষণা, সুদর্শনা। সুতরাং বিয়েও হল কুলীন ঘরে। স্বামীর নাম কমলাকান্ত চট্টোপাধ্যায়। বাড়ি ‘মোং কোন্নগর গ্রামে।’
কলকাতার মেয়ে কোনও দিন কোন্নগর গাঁ দেখেনি। কমলাকান্ত তাকে দেখাননি। সেও মনে মনে কোনও দিন দেখতে চায়নি। কেননা, সে শুনেছে কমলাকান্তের ‘বত্রিশ বিবাহ’। বত্রিশ সতীনের সংসার ও মেয়ে কোনও দিন চোখে দেখেনি। না দেখলেও সে জানে, ও সংসার সোনা দিয়ে গড়া নয়। সতীনের সংসার সোনার সংসার হয় না।
সুতরাং, বিয়ের পর বর চলল নিজের বাড়ি, মেয়ে রইল বাপের ঘরে। কমলাকান্ত গেলেন কোন্নগরে আর তাঁর বত্রিশতমা গৃহিণী রইলেন কলকাতায়।
দিন যায়। মাঝে মাঝে শ্বশুরকুলের খবর পাওয়া যায়। কখনও চিঠি আসে, কখনও লোকমুখে সংবাদ। ‘বিগত…তারিখে কোন্নগর গাঁ নিবাসী কমলাকান্ত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের দ্বাদশতমা সহধর্মিণী শ্রীমতী অমুকবালা বা অমুক সুন্দরী ইহলোক ত্যাগ করিয়া স্বর্গধামে গমন করিয়াছেন।’
কলকাতার মেয়ে এ খবরে কাঁদে না। কমলাকান্তই আজ তার স্মৃতিতে ঝাপসা। সুতরাং, তাঁর শোকে, অদেখা সপত্নীর মৃত্যুতে তার কান্না আসে না। কাঁটা দূর হল বলে হাসতেও ইচ্ছে করে না। কেননা, সতীনেরা যে ‘কাঁটা’ এ মেয়ে তাও জানে না। সুতরাং, চিঠি পড়া শেষ হওয়া মাত্র সে চলল গামছা কাঁধে স্নানে। কুলীন ঘরের মেয়ে জানে, আজ থেকে তার অশৌচ।
দশ-দশবার এমনি খবর এল। দশ-দশবার তাকে এমনি অশৌচ পালন করতে হল। অবশেষে ২১ কার্তিক, ১২৩০ সালে এল কাঁদবার মতো খবর। কোন্নগর গ্রামের কমলাকান্ত চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং এবার দেহরক্ষা করেছেন।
যোগ-বিয়োগ অন্তে কমলাকান্তের তখন বাইশ স্ত্রী বর্তমান। অবশ্য দু’জন মাত্র তার বাড়িতে। বাদবাকিরা যে যার ঘরে। দেশ দেশান্তরে, সব ঘরে খবর গেল। খবর এল কলকাতায়ও।
কলকাতার মেয়ে কুলীন ঘরের মেয়ে, কুলীন ঘরের বউ। এবার সে কাঁদল। কেঁদে কেঁদে বলল, ‘আমি সহমৃতা হব।’ মা-বাবা আপত্তি করলেন না। পাড়া-প্রতিবেশীরা ধন্য ধন্য করলেন। তাদের জয়ধ্বনির মধ্যেই কলকাতার মেয়ে চলল কোন্নগর। সে ‘সতী’ হবে। স্বামীর চিতায় পুড়ে মরবে।
ক’দিন বাদেই খবরের কাগজে বের হল সে সংবাদ। ১৮২৩ সাল, ১৫ নভেম্বর। কমলাকান্তের পরিচয় দিয়ে ‘সমাচার দর্পণ’ জানালেন: ‘২১ শে কার্তিক বুধবার ঐ চট্টোপাধ্যায় পরলোক-প্রাপ্ত হইলে তাহার সকল শ্বশুরবাটীতে অতি ত্বরায় তাহার মৃত্যু সংবাদ পাঠান গেল, তাহাতে কলিকাতার এক স্ত্রী ও বাঁসবাড়ীয়ার এক স্ত্রী ও নিকটস্থ দুই স্ত্রী এই চারিজন সহমরণোদ্যতা হইল।’
অবশ্য সেদিনই তাদের মরা হল না। কারণ, ‘সদর হইতে হুকুম আনাইতে দুই দিবস গত হইল।’ দুই দিন দাউ দাউ করে চিতা জ্বলল। তৃতীয় দিনে কমলাকান্তের সঙ্গে পুড়ে মরলেন চার-চারটি মেয়ে। দু’জন আবার এমনই মেয়ে, কমলাকান্তকে জীবনে দেখেছে যারা মাত্র একদিন।
ঘটনাটা ১৮২৩ সালের। অর্থাৎ, ‘সতীদাহ’ উচ্ছেদের মাত্র ক’ বছর আগের ঘটনা। ইতিমধ্যে সরকারি মহলে এই প্রথাটিকে উপলক্ষ করে বিস্তর বিতর্ক হয়ে গেছে এবং ১৮১৩ সালের এপ্রিলে এ সম্পর্কে কিছু কানুনাদিও তৈরি হয়ে গেছে। তার মধ্যে অন্যতম হল: কাউকে জবরদস্তি করে সতী বানানো চলবে না। আফিং খাইয়ে বা অচৈতন্য করেও কাউকে চিতায় ভোলা চলবে না। তদুপরি মনে রাখতে হবে, যে নারী অন্তঃস্বত্ত্বা বা যার বয়স ষোল বছরের কম, তার নিজের বাসনা থাকলেও সতী হওয়া চলবে না। কেননা, ‘তা ধৰ্মত নিষিদ্ধ।’
চার বছর পরে, ’১৭ সালে বিতর্কটা আরও একটু জোরালো হল। ফলে, আইনটাও কিছু পালটাল। এবার ঠিক হল, যে নারীর কোলে চার বছরেরও কম বয়স্ক শিশু, সে স্বামীর সহগমন করতে পারবে না। এ ছাড়া, যার ছেলেমেয়ের বয়েস চার বছরের চেয়ে বেশি, কিন্তু সাত বছরের চেয়ে কম, সেও মরতে পারবে না, যদি পিছনে ছেলেমেয়ে দেখাশুনা করার মতো কেউ না থাকে। তদুপরি সে বছর ব্রিটিশ-ভারতে পুরোপুরি নিষিদ্ধ হয়ে গেল ‘অনুমরণ’।
নয়তো দেখা যেত, কমলাকান্তের যে ষোলজন স্ত্রী দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে রয়েছে, তাদের অনেকেই কোন্নগরে লোক পাঠাচ্ছেন স্বামীর একখানা খড়ম কিংবা লাঠি অথবা যে কোনও স্মৃতির সন্ধানে। সাড়ম্বরে সেই প্রতিনিধিকেই মাথায় নিয়ে চিতায় লাফিয়ে পড়তেন তাঁরা।
আশঙ্কার কথা নয়, এটাও ঘটনা। সেকালে বহু রাজপুত মেয়ে এভাবে মরেছে। মরেছে, বাংলাদেশের মেয়েরাও। লক্ষণ সেনের রানি থেকে বহু রাম-শ্যামের স্ত্রীরা। স্বভাবতই অনেকে ভুল করেও মরেছে। মরার পর খবর এসেছে, স্বামী তখনও জীবিত। ‘অনুমরণ’ তাই নিষিদ্ধ হয়ে গেল।
কিন্তু চলল ‘সহমরণ’।
এই আত্মহত্যার নেশা শুরু হয়েছিল কবে, কেউ জানে না। কেউ বলে ঋগ্বেদের কালে, কেউ বলে, তারও আগে। কেউ বলেন, এ অনার্য ভারতের আদিম অভ্যাস। কেউ বলেন, এর আদি সাইথিয়া, কারও কারও মতে স্ক্যান্ডিনেভিয়া। ইউরোপ, আফ্রিকা, সেকালের আমেরিকা, একালের এশিয়া কমবেশি পৃথিবীর সর্বত্র সহমরণের কাহিনী আছে। ইংরেজরা এদেশে এসে দেখলেন, রৌদ্রকরোজ্জ্বল হিন্দুস্তান আসলে চিতার ধোঁয়ায় এক অন্ধকার দেশ। ১৭৭৮ সাল। উইলিয়াম জোনসের চিঠিতে সে কাহিনী প্রথম পৌঁছাল বিলেতে।
শুরু হল অনুসন্ধান। অবশ্য বেসরকারিভাবে। দেখা গেল, মহাভারতে পাণ্ডুর স্ত্রী সতী হওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি করছেন এবং শ্রীকৃষ্ণের চার জন স্ত্রী তাঁর সহগামী হয়েছেন। ঋগ্বেদেও একটি শ্লোকের সন্ধান পাওয়া গেল।
এদিকে বিদেশি সূত্রেও খবর মিলল কিছু কিছু। গ্রীক ঐতিহাসিকেরা জানালেন, আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় গ্রিক সৈন্যরা পঞ্জাবে বিস্তর মেয়েকে স্বামীর সঙ্গে পুড়ে মরতে দেখেছে। সেন্টজেরোম, মার্কোপোলেও একই কথা বললেন। তাঁরাও এখানে-ওখানে এ ঘটনা দেখেছেন।
জনৈক পর্তুগিজ জানালেন, বিজয়নগরে এক রাজার সঙ্গে তিনি এগারো হাজার মেয়েকে মরতে দেখেছেন। অবশ্য ঐতিহাসিকেরা বলেন, এটা অতিশয়োক্তি। তবে ১৬১১ সাল থেকে ১৬২০ সালের মাঝামাঝি এমন ঘটনা দক্ষিণ ভারতে কিছু কিছু ঘটেছে, যেখানে এক আগুনে দু’ হাজার বা তিন হাজার মেয়ে ছাই হয়ে গেছে।
দক্ষিণ ভারত ‘সতীর’ আসল ক্ষেত্র নয়, তাদের মহাশ্মশান উত্তর আর উত্তর-পশ্চিম ভারত।
জয়সলমীর যখন পুড়েছে (১২৯৫), তখন তার সঙ্গে চব্বিশ হাজার মেয়ে স্বেচ্ছায় পুড়ে মরেছিল। তাঁরা ‘সতী’ নয়, ‘জওহর ব্রতী’। টড লিখেছেন, সতী-অধ্যায়েও রাজস্থান ভারতের সেরা স্থান। ১৭৮০ সালে যোধপুরের রাজা অজিত সিং যখন মারা যান, তখন তাঁর সঙ্গে চিতায় উঠেছিলেন ষাট জন রানি। বুঁদির রাজা বুধ সিং যখন মারা গেলেন, তখন সহগামিনী হলেন আশিজন।
সেই মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে চিতোরে এবং রাজস্থানের পথে-প্রান্তরে আজও দাঁড়িয়ে আছে, একের পর এক ‘মহাসতী’। সতীদের নামে উৎসর্গীকৃত স্মৃতিস্তম্ভ সেগুলো।
মধ্য এবং উত্তর ভারতের স্তম্ভগুলো সে তুলনায় অনুচ্চ। তাদের নাম ‘বীর কল’। বীরের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তার গায়ে খোদাই করা হয় তার দুটি পা কিংবা একটি হাত। নীচে অন্য সারিতে থাকে তার জন্যে যে মেয়েরা আত্মাহুতি দিয়েছে, তাদের মূর্তি।
তবে মধ্য ভারতে এ ধরনের মূর্তির চেয়ে জনপ্রিয় চিহ্ন সতীর হাতের ছাপ। শ্মশানযাত্রার আগে সতীর হাতে সিঁদুর মাখিয়ে বাড়ির দেওয়ালে একটা ছাপ রাখা হল। আর মেয়েটি পুড়ে মরার পর সেই ছাপ ধরে ধরে খোদাই করা হল তার হাতখানা। সিঁদুর-রঞ্জিত সেই হাতের নিশানায় অতঃপর সেই বাড়ি আশেপাশের তীর্থ। বিকানীরের রাজবাড়ির দেওয়ালে জেনারেল হার্ভে পর পর এমনই সাঁইত্রিশখানা হাত গুনেছিলেন।
বাংলাদেশে এসব প্রথা নেই। এখানে ওখানে ছড়ানো কিছু কিছু সতী-ভিটে, নয়তো সতী-পুকুর ছাড়া এখানে সতীর পরস্পরগত স্মৃতি বিশেষ কিছু নেই। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের কলমে লেখা বর্ণনা রয়েছে বিস্তর। শুধু বিস্মিত, চমকিত বিদেশি ভ্রমণকারীদের বিবরণই নয়, ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিককার কলকাতা এবং আশেপাশের খবরের কাগজগুলোর পাতা ওলটালেও তা চোখে পড়ে। যথা:
‘সহগমন!—শুনা গেল যে, বংশবাটিনিবাসি পঞ্চানন বসু নামক এক বর্ধিষ্ণু প্রাচীন কায়স্থ জ্বরবিকারে অসুস্থ হইয়া ৩ চৈত্র পরলোকগামী হওয়াতে তাহার দুই স্ত্রী তৎসহগামিনী হইয়াছেন।’ (সমাচার দর্পণ, ১০ এপ্রিল, ১৮২৪)।’
একটি নয়, দুটি নয়, পাতায় পাতায় এমনই সব সমাচার। ১৮০৩ সালে শ্রীরামপুর থেকে কেরী সাহেব কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। কলকাতাকে কেন্দ্র করে চারদিকে তিরিশ মাইল এলাকা ছিল তাঁর অনুসন্ধানক্ষেত্র। খবর নিয়ে দেখা গেল, এখানে আগের বছর সহমৃতা হয়েছে এমন মেয়ে সংখ্যায় চারশো আটত্রিশ জন।
পরের বছর দশজন নির্ভরযোগ্য লোককে আবার কাজে নামানো হল। এবার ঠিক হল, ছ’ মাসের পাকা হিসেব জোগাড় করতে হবে। তাতে দেখা গেল সংখ্যাটি তিনশোয় দাঁড়িয়েছে।
ক’ বছর পরে দেখা গেল এ সংখ্যা ক্রমেই যেন আরও বাড়তির দিকে। ১৮১৩ সালে কড়াকড়ি করে আইন চালু হয়েছিল। ’১৪ সালে যদিও এ আইনের ফল দেখা হয়নি। ’১৫ সাল থেকে সরকার হিসেব রাখতে শুরু করলেন। তাতে জানা গেল, ’১৫ সালে বাংলামুলুকে ‘আগুনখাকী’ মেয়ের সংখ্যা ছিল ৩৭৮ জন, ’১৬ সালে ৪৪২ জন, ’১৭ সালে ৭০৭ জন, ’১৮ সালে ৮৩৯ জন, ’১৯ সালে ৫৬০ জন, ’২০ সালে ৫৯৮ জন, ’২১ সালে ৬৫৩ জন, ’২২ সালে ৫৮৩ জন, ’২৩ সালে ৫৭৬ জন, ’২৪ সালে ৫৭২ জন, ’২৫ সালে ৬৩৯ জন, ’২৬ সালে ৫১৮ জন এবং নিষিদ্ধ হওয়ার আগের বছর অর্থাৎ ’২৮ সালে ৪৬৩ জন।
এর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশই যে খাস কলকাতার চিতায় আত্মাহুতি দিয়েছে, সে কথা বলাই বাহুল্য। প্রথম চার বছরের হিসেব নিয়ে দেখা গেছে, মোট ২৩৬৬ জন সতীর মধ্যে কলকাতাবাসিনী ১৪৮৫ জন।
এই বিপুল সংখ্যক মেয়েকে জবরদস্তি হত্যা করে হয়েছে বলে যদি কেউ ভেবে থাকেন, তবে তিনি ভুল করবেন। ’১৩ সালের আইনের কথা আগেই বলেছি। সে আইনে বলপ্রয়োগ করার উপায় ছিল না। আফিং খাওয়াবার পথও ছিল না। অবশ্য স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান রাজকর্মচারীরা যে আইনের ধারাগুলো আক্ষরিক মেনে চলতেন, এমন কথাও বলছি না। তাঁদের চোখের সামনেই বে-আইনি কাজ অবশ্যই হত। কিন্তু সে সামান্য। চিতা থেকে আর্তনাদ করে লাফিয়ে পড়া সতীকে ধরে এনে আবার চিতায় ঠেলে দেওয়ার কাহিনী অবশ্যই আছে, কিন্তু ইংরেজরা নিজেরাও স্বীকার করেছেন তা নগণ্য। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির পুলিশ সুপার মি. ডব্লিউ ইউয়ারের মতে তার পরিমাণ দশজনের মধ্যে মাত্র একজন।
স্লিম্যান সাহেব নিজে লিখেছেন, ১৮২৬ সালে তিনি নিজে একজন সতীর সতীত্ব পরখ করে দেখেছেন। মেয়েটিকে সাহেব অনেক বোঝালেন। কিন্তু তাকে কিছুতেই সংকল্পচ্যুত করা গেল না। সে বলল, ‘আমাকে বুঝিয়ে কী লাভ সাহেব, আমি আমার স্বামীর সঙ্গেই মরে রয়েছি। এই দেখ, আমার নাড়ি পর্যন্ত চলছে না।’ স্লিম্যানের সঙ্গীরা পরখ করলেন। দেখা গেল, মেয়েটির কথা ঠিকই। সত্যিই নাকি ওর রক্ত-চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সাহেব বললেন, একদিন ওকে পাহারায় আটকে রাখো। দেখো, মতিগতি পালটায় কি না। কিন্তু হায়, এ চেষ্টাও বিফল হল। স্লিম্যানের চোখের সামনেই পরের দিন ও মেয়ে ‘সতী’ হয়ে গেল।
১৮২৮ সালের ‘ক্যালকাটা রিভিউ’-এ এমনি আরও একটা ঘটনার খবর আছে। সেটা ঘটেছিল হাওড়ার সালকিয়ায়। ১৮২১ সালের ১৮ আগস্ট তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’-এও এমনই সংবাদ পাবেন পাঠকেরা। ’২২ সালের ২৭ এপ্রিলের কাগজের সংবাদটি আরও লোমহর্ষক। গয়ার এক বাঙালি-গিন্নি সহমরণে উদ্যত হয়েছেন শুনে ‘গয়ার জজ শ্ৰীযুত মেং কিরিষ্টফর স্মিথ সাহেব গিয়া তাহাকে অনেক নিষেধ করিলেন। তাহাতে সে ব্রাহ্মণী আপন অঙ্গুলি দগ্ধ করিয়া পরীক্ষা দেখাইল। তাহা দেখিয়া জজ সাহেব আজ্ঞা দিলেন তোমার যে ইচ্ছা তাহা করহ।’
সে মেয়ে তো মারা গেল। কিন্তু এখন যদি কেউ ভাবেন, স্বামীহীনা মেয়েদের মৃত্যু ছাড়া সামনে দ্বিতীয় কোনও পথ খোলা ছিল না বলেই তারা এভাবে আত্মহত্যা করেছে, তবে ইতিহাস বলবে, সে কথা সব সময় সত্য নয়।
সত্য বটে, মৃতার তালিকায় ভবিষ্যৎহীন বৃদ্ধা এবং প্রৌঢ়ারা একটা উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায় ছিলেন, কিন্তু সাধারণত যে বয়সে মানুষের কাছে জীবনটা নেশার মতোই লোভের বস্তু বলে মনে হয়, সে বয়সের মেয়েরাও সে দলে একেবারে কম ছিলেন না। ১৮১৫ থেকে ’২০ সালের মধ্যে এই কলকাতায় যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কুড়িজনের বয়েস ছিল ষোল। চব্বিশজনের বয়েস ছিল তারও কম। তিনজন আট বছরের শিশু। ১৮১৮ সালে যাঁরা সতী হন, তাঁদের মধ্যে ঊনপঞ্চাশজনই ছিলেন কুড়ির নীচে এবং একশো পঁচিশজনের বয়স ছিল কুড়ি থেকে তিরিশের মধ্যে।
১৮২৩ সালের শান্তিপুরের একজন ‘অষ্টাদশ বৎসর বয়স্কা পরমাসুন্দরী’ স্ত্রীর খবর শুনুন। ‘শান্তিপুরের থানাদার নানা লোক সমেত মানা করিতে সে স্থানে পহুঁছিল এবং ঐ স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিল যে, তুমি কেন এই মৃত ব্যক্তির সহিত দগ্ধা হইতে বাসনা করিতেছ। কি দারিদ্র্যর ভয়ে কিংবা পরিবারের বিদ্রূপের ভয়ে এই কর্মে প্রবৃত্তা হইয়াছ।’ এ যুক্তি ব্যর্থ হল। এবং অনেক কথোপকথনের পর ঐ স্ত্রীর দুই ক্ষুদ্র বালককে তাহার সম্মুখে আনাইল, কিন্তু ঐ বালকদিগকে দেখিয়াও ঐ স্ত্রীর হৃদয়ে মাতৃস্নেহ জন্মিল না।…ইহাতে ঐ থানাদার কহিলেক যে আমি নাচার হইলাম তোমার ইচ্ছা।’ (সমাচার দর্পণ, ১৬ আগস্ট, ১৮২৩)।
এমনকী দেখা গেছে, জোর করেও সব সময় এসব মেয়েকে চিতার মুখ থেকে ফেরানো যায় না। ক্লাইভ আর নবকৃষ্ণ একবার একটিকে চিতা থেকে তুলে নিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। কিন্তু বাঁচাতে পারেননি। না খেয়ে, না খেয়ে সে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল। পরবর্তী কালে সতীদাহ উচ্ছেদ হওয়ার পরও কলকাতার খবরের কাগজে এ ধরনের খবর পাওয়া গেছে। মরতে যে চায়, আইন তাকে বাঁচাবে কী করে?
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এভাবে মরতে চায় ওরা? ইতিহাস বলে, সে কারণ বহুবিধ। তার মধ্যে হিন্দুর সনাতন ধর্মবিশ্বাস একটি। ম্যাকসমূলার থেকে রামমোহন পর্যন্ত সেই ধর্মের বিচার করেছেন অনেক। শাস্ত্র-নিন্দাও হয়েছে কম নয়। কিন্তু একটি তথ্য আমরা সেদিন ভুলে গিয়েছিলাম। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম ঋগ্বেদে ‘অগ্রে’ কথাটি যদি সত্যিই ‘অগ্নে’তে পরিবর্তিত হয়ে গিয়ে থাকে, তবে তার জন্য শুধু দু’জন ব্রাহ্মণই দায়ী নন, দায়ী আমাদের গোটা সমাজই।
সমাজ এমন নৃশংস কাজে সম্মতি দিল কী করে, তা জানতে হলে আমাদের অনুসন্ধান চালাতে হবে আরও গভীরে। পন্থাটা যদৃচ্ছ হলেও কেউ কেউ তা করেছেন। তাঁরা বলেন, ভারতবর্ষ সতীর জন্যে খ্যাত বটে, কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভারতের বিপুল নারী-সমাজের একটা ভগ্নাংশই মাত্র সতী হয়েছে এখানে। এবং খবর নিলে দেখা যাবে, যাঁরা সতী হয়েছেন, তাঁরা অধিকাংশই বড়ঘরের মেয়ে, কিংবা এমন সম্প্রদায়ের, যাঁরা সমাজের অন্যান্য শাখা থেকে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে ভাবেন। রাজপুত রাজাদের প্রাসাদে, বিজয়নগররাজের অন্দরে তাই ‘সতী’ বেশি।
রাজবাড়িতে সতী বেশি, কারণ রাজাদের লোভ বেশি, সম্মানবোধ বেশি। একজন বৃদ্ধ নরপতি মৃত্যুশয্যায় যখন ভাবেন: তাঁর এই প্রাসাদ-বোঝাই রানীরা অতঃপর যথেচ্ছাচারিণী হবেন, তখন মনে তিনি শান্তি পান না। তাই সতীদের নামে মিনার গড়ার জন্যে বরাদ্দ থাকে তাঁর বাজেট। অবশ্য রাজনৈতিক কারণও যে কিছু কিছু না থাকে এর পিছনে, তা নয়। অনেকেই পুরুষ দাসদেরও মৃত্যুর নির্দেশ দিয়ে যেতেন। প্রাসাদের পরামাণিকও বাদ পড়ত না। ১৮১৮ সালে জয়পুরের মহারাজা তাঁর পরপারের যাত্রায়, মিশরের ফারাওদের স্টাইলে আঠারটি রানির সঙ্গে আঠারটি ভৃত্য তো নিয়েছিলেনই, সঙ্গে নিয়েছিলেন একটি পরামাণিকও। আর একজন নির্দেশ দিয়ে গেলেন: রাজ অন্তঃপুরে যে বৃদ্ধা ব্রাহ্মণী পানীয় জল সরবরাহ করে, তাকেও যেন বাদ না দেওয়া হয় চিতার আগুন থেকে।
ছোট ঘরে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ভয় ছিল না। তবে সম্পত্তি নিয়ে কাড়াকাড়ির ভয় ছিল। পুত্রেরা শাস্ত্রসম্মতভাবে মাকে যখন বিদায় দিতে পারছেন, তখন শাস্ত্র খুলে নতুন ছত্র খুঁজে লাভ কী। ব্রাহ্মণ চব্বিশ ঘণ্টা শাস্ত্র মন্থন করছেন। এঁরা সেই পথ ধরে এগিয়ে চললেন। ব্রাহ্মণের উৎসাহ এতে কম নেই। কেননা, সতীর বিধানটা তাঁর মুখ দিয়ে নির্গত হয় বলেই তিনি সমাজে ক্ষমতাবান পুরুষ। তা ছাড়া, ‘সতী হব’ বললেই হওয়া যায় না। তার আগে কিছু কিছু অবশ্যকরণীয় আছে। তাতে তাঁর প্রাপ্তিযোগ।
সুতরাং ব্রাহ্মণ বিধান দিতেন, দেশের রাজা সে বিধান রক্ষা করতেন, প্রতিবেশীরা চিতা সাজাতেন এবং বিগত মানুষটির পুত্র নিজের হাতে তাঁর জীবিত মাকে দগ্ধ করার জন্যে সে চিতায় অগ্নিসংযোগ করতেন। আশপাশের পাঁচ গাঁয়ের লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখতেন, খোল বাজাতেন, কীর্তন করতেন। এদের কী বলব আমরা—‘বর্বর’? তা হলে স্পেনে যারা হাসতে হাসতে ষাঁড়ের শিংয়ে মানুষ ঝুলতে দেখে কিংবা এই কলকাতায়ই যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুই বীরের পিস্তল লড়াই দেখেছে, তারাও কি তাই নয়?
সুতরাং, ভারতবর্ষ যেদিন মুখে মুখে গর্ব করে বলল, ‘মরবে বধূ উড়বে ছাই, তবে তার বালাই গাই’, সেদিন সে সত্যিই বর্বরের দেশ ছিল কি না সে কথা তর্কসাপেক্ষ। যদিও সে তর্কে আমাদের হার নিশ্চিত। ইউরোপ ডাইনি পুড়িয়েছে যেভাবে ভারতে হয়তো ঠিক সেভাবে ‘সতী’কে দাহ করা হয়নি, কিন্তু পুড়িয়ে যে মারা হয়েছে তাতে ভুল নেই। মেরেছে আমাদের তথাকথিত ধর্ম, সংস্কৃতি এবং অশিক্ষাজনিত কুসংস্কার।
তর্ক আজ অবান্তর। এমনকী, ইংরেজরাও তা কোনও দিন তোলেননি। আলবুকার্ক তাঁর রাজ্য থেকে সতীদাহ উচ্ছেদ করেছিলেন, ১৫২০ সালে। তৃতীয় শিখ গুরু অমর দাস (১৫৫২-৭৪) উচ্ছেদ করেননি বটে, কিন্তু তিনি এই প্রথাকে নিন্দা করেছিলেন। আকবর আরও একটু এগিয়েছিলেন। রাজধানী থেকে প্রবল বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি নাকি ছুটে গিয়েছিলেন যোধপুর রাজের পুত্রবধূকে চিতার আগুন থেকে বাঁচাতে। এই একটি মেয়েকে তিনি বাঁচিয়ে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর কালে অগণিত মেয়ে সতী হয়েছিলেন। কারণ, স্বেচ্ছায় কেউ তা হতে চাইলে বাদশাহর তাতে অমত ছিল না। আসলে শাস্ত্রের দোহাই পেড়ে ধর্মের নামে, দেশাচার লোকাচার মিথ্যাচারের ভিত্তিতে নারীর মধ্যে যে ভাবলোক গড়ে তোলা হয়েছিল তাতে সহমরণ তাঁর কাছে ছিল প্রকৃত পাতিব্রাত্য। ইংরেজ কেমন করে জানবে এই নারীকে আফিং খাইয়ে চিতায় তোলার দরকার নেই, দেশ এবং সমাজ যুগযুগান্ত ধরে আফিং খাইয়েই লালন করেছে তাঁকে। তাঁর হৃদয়মন মৃত্যুর জন্য নেশাগ্রস্ত।
ইংরেজরাও মোটামুটি গ্রেট মুঘলের সেই পথ ধরেই এগিয়ে চলেছেন। ১৮০৮ সালে তাই হুগলির কালেকটর সাহেব তাঁর এলাকার সতীর বিবরণ পাঠিয়ে লিখলেন—‘I have the pleasure to forward the prescribed annual report of Suttee’ etc. মনে রাখতে হবে, কয়েকশ’ মেয়ের হত্যা কিংবা আত্মহত্যার বিবরণের ভূমিকা এটি।
এই ভূমিকা নিয়েই এই দেশের ইংরেজ সরকার চললেন অনেক কাল। ’১৭ সালে কানুন হল। ’১৮ সালে তাঁর ‘প্রবর্তক নিবর্তক সম্বাদ’ নিয়ে এগিয়ে এলেন নেটিভ রামমোহন। তাঁর প্রায় দশ বছর পরে ১৮২৭ সালে গভর্নর জেনারেল হয়ে এলেন লর্ড বেন্টিঙ্ক। ‘সতীদাহ আইন’ পাশ হল তারও দু বছর পরে, ’২৯ সালে। উনিশ শতকের গোড়ার এই ঊনত্রিশটি বছরে দু’ তরফের ইতিহাসই যথেষ্ট ঘোরালো। এখানে সেই ওলট-পালট চিন্তাধারার জট খুলবার জায়গা নেই। শুধু এইটুকুই বলে রাখছি, এ সময়ে এই হতভাগ্য দেশে শুধু রামমোহনই জন্মাননি, এলাহাবাদের ত্রিবেণী সঙ্গমে হিন্দুস্থানি মেয়েরা ভূত দেখতেও শুরু করেছে। রাত্রি যখন অন্ধকার, কুলকুল করে তিনদিকের নদী যখন এক হয়, তখন সেই ভূত ভূভারত কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘পুড়ে ম’লাম’ পতি পেলাম না বাপ।’
সুকেস স্ট্রিটের দ্বাদশসংখ্যক ভবন
কলকাতায় অগণিত রাজপথ, অসংখ্য ঘরবাড়ি। সাবেকি কলাগেছে থামওয়ালা বাড়ি থেকে আইভিলতাখচিত সম্পন্নের প্রাসাদ, গরিবের রকমারি কুটির, মধ্যবিত্তের বারোয়ারি আস্তানা—এ শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অজস্র মানুষের ঠিকানা। যুগের পর যুগ, পুরুষানুক্রমে জীবনপ্রবাহ বয়ে চলেছে সেখানে। অষ্টপ্রহর ঘরে ঘরে চলেছে বিচিত্র জীবন-নাটক। অনেক হাসি, অনেক কান্না, অনেক জয় পরাজয় অথবা লাভ-লোকসানের ইতিকথা। প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি ঘর, কুলীন অথবা অ-কুলীন, তাদের প্রত্যেকের ইট-পাঁজরে লেখা আছে অনেক ওয়াটারলু জিতবার অথবা হারাবার, অনেক গৌরীশংকর পৌঁছবার অথবা পথ থেকে ফিরবার কাহিনী।
কিন্তু সে কাহিনীর অধিকাংশই একান্ত ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক। বড়জোর আপিসের কাউকে বা দূর সম্পর্কের কোনও নির্ভরযোগ্য আত্মীয়কে বলা যায়। প্রতিবেশীদের ডেকে এনে শোনানো যায় না। সভা ডেকে গলা ফাটিয়ে বলা যায় না, কাগজ ছাপিয়ে দেশ-দেশান্তরে বিলি করা যায় না। কলকাতার অধিকাংশ বাড়িই তাই চলমান ইতিহাস হয়েও, আস্তানা মাত্র। বয়সে প্রবীণ হয়েও বাড়ি মাত্র, সর্বজনপাঠ্য ইতিহাস নয়।
কিন্তু ‘সিমুলিয়ার সুকেস স্ট্রিটের ১২ সংখ্যক ভবনটি’ অনায়াসে বলতে পারে, এই আমি ইতিহাস। শুধু কলকাতার একটি অমিতবীর্য মানুষেরই নয়, গোটা বাংলাদেশের ইতিহাস।
সে এক অবিস্মরণীয় দিন। সুকিয়া স্ট্রিটের ‘দ্বাদশ সংখ্যক ভবনে’ সেদিন বাংলাদেশের জীবনের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
ব্রাহ্মণ এবং পণ্ডিতেরা চিঠি পেয়েছিলেন সংস্কৃত কবিতায়। ডাকে এবং হাতে বাংলাদেশের বিশিষ্ট আটশো জনের কাছে সেই বিস্ময়কর সংবাদ পৌঁছেছিল বাংলা গদ্যে। ছাপানো হরফে সামান্য কয়টি কথা:
‘শ্রীশ্রীলক্ষ্মামণিদেব্যাঃ বিনয়ং নিবেদনম্। ২৩শে অগ্রহায়ণ রবিবার বিধবা কন্যার শুভবিবাহ হইবেক, মহাশয়েরা অনুগ্রহপূর্বক কলিকাতার অন্তঃপাতী সিমুলিয়ার সুকেস স্ট্রিটের ১২ সংখ্যক ভবনে শুভাগমন করিয়া শুভকর্ম করিবেন। ইতি তারিখ ২১ শে অগ্রহায়ণ, শকাব্দ: ১৭৭৮।’
এক নিশ্বাসে পড়ে যাওয়ার মতো একটিমাত্র বাক্য। কিন্তু তবুও চিঠিখানা হাতে নিয়ে সেদিন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছিল অনেকের। কেননা, ১২ নং সুকেস স্ট্রিট থেকে যে সমাচার এসেছে, তাতে আমন্ত্রিত হওয়ার মতো মানুষ সেদিন বাংলাদেশে খুবই কম।
বিধবা কন্যার শুভবিবাহ? বিদ্যাসাগরের চটি বইখানা হাতে নিয়ে আঁতকে উঠেছিলেন রাধাকান্ত দেব। সে ১৮৫৩ সালের কথা।
দিনরাত সংস্কৃত কলেজের লাইব্রেরি মন্থন করছেন বিদ্যাসাগর। তাঁর মনে যে যন্ত্রণা, শত বছর কিংবা হাজার বছর আগেকার এই বহুদর্শী শাস্ত্রজ্ঞদের কারও মনে কি ক্ষণকালের জন্যেও জাগ্রত হয়নি সেই বেদনা? কারও দৃষ্টিতে কি একবারের জন্যেও পড়েনি, আট দশ বছর বয়সের এই মেয়েগুলোর মুখ? বিদ্যাসাগর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন না সে কথা। কোথাও না কোথাও আছে। আছেই।
অবশেষে একদিন চমকে উঠলেন বন্ধুরা। সহসা লাইব্রেরি-ঘরে চিৎকার শোনা গেল, ‘পেয়েছি, পেয়েছি’।
বিধবার মনোবেদনার সপক্ষে শাস্ত্রীয় সাক্ষ্য পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে সমাজের দরবারে বিদ্যাসাগর পেশ করলেন তাঁর বহুদিনের হৃদয়-সঞ্জাত বক্তব্য। বিধবা-বিবাহ বিষয়ে তাঁর ঐতিহাসিক প্রস্তাব।
সে প্রস্তাব বিবেচনার জন্য সভা বসল শোভাবাজারে। রাজা রাধাকান্ত দেবের বাড়িতে। প্রস্তাবের সপক্ষে তর্ক করে বিজয়ী হলেন ভবশংকর বিদ্যারত্ন। রাধাকান্ত একজোড়া মূল্যবান শালে পুরস্কৃত করলেন তাঁকে।
কিন্তু সে ঘটনাই বিজয় নয়। যুদ্ধের সবে শুরু মাত্র। দেখতে দেখতে রাধাকান্ত দেবই যে শুধু বিরোধী পক্ষের সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন তাই নয়, শাল-বিজয়ী ভবশংকর সেই শালখানা গায়ে দিয়েই পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁর। এমনকী বিদ্যাসাগর তাকিয়ে দেখলেন, মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ মশাই পর্যন্ত আর তার পিছনে নেই। অথচ বিধবা বিবাহের প্রথম ব্যবস্থাপত্রখানা নিজের হাতে লিখেছিলেন তিনি।
দ্বিতীয় বইটি বের হল ১৮৫৫ সালের শেষভাগে। সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে দেশময় ছড়িয়ে পড়ল উত্তেজনার আগুন। কেউ পক্ষে, কেউ বিপক্ষে।
কলেজ থেকে রাত্রে বাড়ি ফেরবার পথে ঠনঠনের কালীতলায় এসে থমকে দাঁড়ালেন বিদ্যাসাগর। ঘৃণায় মোচড় দিয়ে উঠল তাঁর ছোট দেহটি। ষণ্ডামার্কা ক’টা লোক ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। মুহূর্তে এদের উদ্দেশ্য কী, জানতে বাকি রইল না তাঁর। এরা এই অন্ধকার রাজপথে তাঁকে হত্যা করে হিন্দুধর্মকে বাঁচাতে চায়।
এভাবে পথ থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি হওয়ার মতো মানুষ ছিলেন না বিদ্যাসাগর। তা ছাড়া, তিনি এর জন্যে তৈরি হয়েই ছিলেন। সুতরাং, তিনি শুধু বললেন, ‘কৈ রে ছিরে, সঙ্গে আছিস কি?’ ছায়ার মতো পিছনে পিছনে আসছিল একটি লোক। হাতে তার পাকা বাঁশের লাঠি। শোনা গেল, সে বলছে, তুমি চল না, কে আসে কে যায়, সে আমি দেখব। তুমি চলে যাও, সঙ্গে আমি আছি।’ শ্ৰীমন্তের এ কথার পরমুহুর্তে কালীতলার পথ পরিষ্কার হয়ে গেল।
অনেক ষড়যন্ত্র। বিধবা বিয়ে দেওয়ার পর রাজনারায়ণ বসু শুনলেন, একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বলছেন, ‘রাজনারায়ণবাবু জানেন না যে, তিনি বাঙ্গালা ঘরে বাস করেন, তখন আমরা অনায়াসে তাহা পোড়াইয়া দিতে পারি। আমি ও সেকেন্ড মাস্টার উত্তরপাড়া নিবাসী বাবু যদুনাথ মুখোপাধ্যায়—আমরা দুইজনে একদিন জঙ্গলে গিয়া দুই মোটা লাঠি কাটিয়া লইয়া আসি, যদি দাঙ্গা হয় তবে সেই সময় ব্যবহার করা যাইবে।’
দাঙ্গা হয় হবে, কিন্তু বিধবা বিবাহ চালু যদি করতেই হয়, তবে চাই আইনের সম্মতি। বিদ্যাসাগর ‘ভারতবর্ষীয় ব্যবস্থাপক সভা’ সমীপে দরখাস্ত পাঠালেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন সিংহ, দ্বারকানাথ মিত্র, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বর গুপ্ত, রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতি বাংলার এক হাজার বিশিষ্ট ব্যক্তি স্বাক্ষর করলেন সেই আরজিতে। বর্ধমানের এবং নবদ্বীপের মহারাজা এবং বাংলাদেশের বিশিষ্ট জমিদাররা স্বতন্ত্রভাবে আবেদন পাঠিয়ে সমর্থন জানালেন তাঁদের। ১৮৫৫ সালের ৪ অক্টোবর কলকাতার পঁচিশ হাজার নাগরিক সমবেত হয়ে দাখিল করলেন সেই ঐতিহাসিক আবেদনপত্র।
বিরোধীপক্ষও এসে হাজির হলেন যথাসময়ে। তাঁদের দরখাস্তে ছত্রিশ হাজার সাতশো তেষট্টি জনের সই।
তবুও ব্যবস্থাপক সভার লড়াইয়ে জিতে গেলেন সংখ্যালঘিষ্ঠ দল। ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই পাস হয়ে গেল বিধবা-বিবাহ আইন। চারদিকে বিদ্যাসাগরের জয়-জয়কার। শুধু বাংলাদেশে নয়, দক্ষিণে বা পশ্চিমে হিন্দুস্থানের প্রতিটি গাঁয়ে-গঞ্জে একমাত্র আলোচ্য তখন বিদ্যাসাগর আর বিধবা বিবাহ।
উমেশচন্দ্র মিত্র বিধবা বিবাহ নাটক লিখলেন, দাশু লিখলেন পাঁচালী। দেখতে দেখতে পক্ষে-বিপক্ষে পুস্তিকা কবিতায় ছেয়ে গেল দেশ। গাঁয়ে গাঁয়ে তখন সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘বেঁচে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে।’ তার তখন সবচেয়ে পছন্দ শান্তিপুরের বিদ্যাসাগর বা বিধবা বিয়ে ডিজাইনের শাড়ি। বাংলাদেশ তখন বিদ্যাসাগর আর বিধবা বিয়ে ছাড়া কিছু জানে না। কিছু ভাবতে পারে না।
কিন্তু বিদ্যাসাগর মশায়ের নিজের ভাবনা অন্য। তিনি জানেন, বিধবা বিয়ের চেষ্টা এই প্রথম নয়। রঘুনন্দন নিজের বিধবা মেয়ের বিয়ের জন্য প্রাণপাত চেষ্টা করে গিয়েছেন এদেশে। অক্লান্ত উদ্যোগ দেখিয়েছেন ঢাকার রাজা রাজবল্লভ। আরও অনেকে চেষ্টা করেছেন। এমনকী, মাত্র কয় বছর আগে (১৮৩৭) সালে এই কলকাতা নগরের অন্যতম ধনাঢ্য মতিলাল শীল কুড়ি হাজার টাকা পণ ঘোষণা করে ‘ইংলিশম্যান’ কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে পাত্ৰ সন্ধান করেছেন একটি বিধবা বালিকার জন্য। শোনা যায়, টাকার বিনিময়ে সে পাত্র তিনি কিনতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর তেমন পাত্র চান না। তিনি বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ করেছেন। তিনি প্রকৃত পাত্র চান, আইনের মর্যাদা রাখতে পারে এমন ছেলে।
অবশেষে লক্ষ্মীমণি দেবীর নিমন্ত্রণপত্র থেকেই দেশের লোক জানতে পেলেন, বিদ্যাসাগর তাঁর সেই মনের মতো পাত্র পেয়েছেন।
ছেলেটি যশোরের খাটুয়া গ্রাম নিবাসী সুবিখ্যাত রামধন তর্কবাগীশের পুত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। মদনমোহন তর্কালংকার মশাইয়ের অবসর গ্রহণের পর থেকে তিনি তৎকালের অন্যতম সম্মাননীয় পদ মুর্শিদাবাদের জজ-পণ্ডিতের আসনে প্রতিষ্ঠিত।
কুলগৌরবে পাত্রীটিও যথেষ্ট অভিজাত। মেয়েটির নাম কালীমতী দেবী। বাবার নাম ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়। নিবাস বর্ধমানের পলাশডাঙা গ্রাম। কালীমতীর বয়স যখন চার বছর, তখন সেকালের নিয়মে তার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
স্বামী হলেন নবদ্বীপের রাজার গুরুবংশীয় শ্রীযুক্ত রুক্মিণীপতি ভট্টাচার্যের পুত্র হরমোহন ভট্টাচার্য। কিন্তু আকস্মিকভাবে দু’ বছরের মধ্যেই বিধবা হল কালীমতী। তখন তার বয়স মোটে ছ’ বছর।
ছ’ বছরের মেয়ে কিছুদিন পরেই বিধবা সেজে আবার ফিরে এল মা-বাবার কোলে। কিছুদিন পরে বিদায় নিলেন বাবা। এখন সংসারে কালীমতীর আছে বলতে—মা।
মদনমোহন তর্কালংকারের বাড়িতে মাঝে মাঝে মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে আসেন মা লক্ষ্মীমণি দেবী। মেয়ের দুঃখের কথা তর্কালংকারের কাছে বলেন। তর্কালংকার শোনেন, ভাবেন। অবশেষে প্রস্তাব দিলেন শ্রীশকে। শ্ৰীশ রাজি হলেন। স্থির হয়ে গেল বিয়ের দিন। তারিখ ২৩ অগ্রহায়ণ, রবিবার, ১২৬৩ সন।
নিমন্ত্রণপত্রে জানা গেল, বিবাহ-বাসর ‘সিমুলিয়ার সুকেস স্ট্রিটের ১২ সংখ্যক ভবন।’ সুকিয়া স্ট্রিটের ওই বিশেষ খণ্ডটির নাম আজ বদল হয়ে গেছে। এখন তার পরিচয় কৈলাস বসু স্ট্রিট। প্রতিদিন বহু লোকের আনাগোনা সেখানে। কিন্তু তাদের অতি অল্পজনই চেনেন সেই ঐতিহাসিক দ্বাদশ সংখ্যক ভবনটি। কারণ, আজ আর তার সংখ্যা দশের ঘরে নেই। নামবদলের মতো কালের নড়াচড়ায় বদলে গেছে তার পরিচয়-অংকটিও। সুতরাং যদি এরই মধ্য থেকে কেউ বাংলাদেশের প্রথম বিধবা বিবাহ বাসরটিকে খুঁজে পেতে চান, তবে জিজ্ঞেস করে এদিকে সেদিকে ঘুরে তাঁকে দাঁড়াতে হবে ‘৪৮ এ’ এবং ‘৪৮ বি’ নম্বর আঁটা যমজ বাড়িটির সামনে।
সেকালে এই বাড়িটির গৃহপতি ছিলেন কলকাতার একজন বিশিষ্ট নাগরিক। নাম রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা ভাষার অধ্যাপক ছিলেন তিনি। বিধবা-বিবাহ আন্দোলনে রাজকৃষ্ণবাবু ছিলেন বিদ্যাসাগর মশাইয়ের একজন অন্তরঙ্গ সহযোগী।
সেই বিখ্যাত আবেদনপত্রে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যেও তিনি ছিলেন অন্যতম। মেয়ে কালীমতীকে নিয়ে বর্ধমান থেকে মা এসে উঠলেন তাঁর বাড়িতে। অর্থাৎ আজকের ‘৪৮ এ এবং ৪৮ বি নম্বর কৈলাস বসু স্ট্রিটে।
অপেক্ষাকৃত বৃহদায়তন চিলেকোঠাটি বাদ দিলে একটু সেকেলে ধরনের একখানা দোতলা বাড়ি। দোতলায় টালি-ছাওয়া বারান্দা, নীচে গ্যারেজ।
সে দিনের কথায় ফেরা যাক। পাত্র এসে উঠেছিলেন বউবাজারে, বিখ্যাত রামগোপাল ঘোষ মশায়ের বাড়িতে। গোধূলি লগ্নে বিয়ে। আগেই পালকিতে চাপলেন বিদ্যারত্ন। সঙ্গে চললেন বরযাত্রীরা। বরযাত্রী মানে, কলকাতার বাছা বাছা বাঙালি নায়কেরা। পালকি ধরে আগে আগে হেঁটে চললেন বিদ্যাসাগর স্বয়ং। ডাইনে বাঁয়ে বরানুগমন করলেন রামগোপাল ঘোষ, দ্বারকানাথ মিত্র, শম্ভুনাথ পণ্ডিত, হরচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ বিখ্যাত সব ব্যক্তিত্ব।
রাস্তা লোকে লোকারণ্য। দুই পাশে কাতারে কাতারে অপেক্ষা করছে হাজার হাজার নারী-পুরুষ। সবাই একনজর দেখতে চায় এই সাহসী বরটিকে। দু’ পা চলেই থেমে থেমে দাঁড়াতে হল পালকি-বাহকদের।
কোথাও জয়ধ্বনি, কোথাও বিদ্রুপ, ব্যঙ্গ। ধীরে ধীরে পিছনে ইতিহাস সৃষ্টি করে এগিয়ে চলল পালকি। বরযাত্রীদের মনে যুগপৎ আনন্দ ও শঙ্কা। গোলমাল হয় যদি এই চিন্তায় অবশ্য আগেভাগেই পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন বিদ্যাসাগর। দেখা গেল, সরকার কোনও ত্রুটি রাখেননি নিরাপত্তা ব্যবস্থার। দীর্ঘ পথে দুই হাত ছাড়িয়ে ছাড়িয়েই একজন করে কনস্টেবল দণ্ডায়মান।
ফলে নিশ্চিতমনে মাঝপথেই শোভাযাত্রা থেকে বিদায় নিলেন বিদ্যাসাগর মশাই। বর এবং বরযাত্রীরা এসে পৌঁছাল সুকিয়া স্ট্রিটের মোড়ে।
সেখানে তখন এক দৃশ্য। গাড়ি, পালকি আর পদাতিকে গোটা সুকিয়া স্ট্রিট এক বিরাট জনসমুদ্র। আর কখনও একসঙ্গে এত লোক জমায়েত হয়নি এই পথে। না আগে, না পরে। ছয় মাসও হয়নি পাস হয়েছে বিধবা-বিবাহ আইন। আর এরই মধ্যে খাস কলকাতায় বিধবার বিয়ে? নগর যেন ভেঙে পড়ল সুকিয়া স্ট্রিটে।
অতি কষ্টে জনতার ভিড় ঠেলে বর এসে বসলেন বিয়ের আসরে। তখন সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিতদের মধ্যে অনেকেই উপস্থিত। সংস্কৃত কলেজ থেকে জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন এসেছেন। এ ছাড়াও নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন ভরতচন্দ্র শিরোমণি, প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ, তারানাথ তর্কবাচস্পতি প্রভৃতি খ্যাতনামা অধ্যাপক এবং শাস্ত্রজ্ঞগণ।
মঙ্গলশঙ্খ উলুধ্বনির মধ্যে ঘোষিত হল বিবাহ বাসরে পাত্রীর আগমনবার্তা। গায়ে মূল্যবান স্বর্ণালংকার, পরিধানে মনোহর পরিচ্ছদ। দশ বছর বয়স্কা কালীমতী দেবী আসনে বসলেন। বিদ্যাসাগর নিজের অর্থে, নিজে দেখেশুনে কিনে এনেছেন কালীমতীর বস্ত্রালংকার।
মন্ত্রপাঠ শেষ হল। হিন্দুর চিরাচরিত শাস্ত্র থেকেই সংগৃহীত বিবাহমন্ত্র। নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হল কলকাতার প্রথম বিধবা-বিবাহ। ১২৬৩ সালের ২৩ অগ্রহায়ণ, রবিবার। সেদিন ইংরেজি ৭ ডিসেম্বর, ১৮৫৬। সিমুলিয়ার সুকেস স্ট্রিটের ১২ সংখ্যক ভবনের গৌরব-অধ্যায়। বিদ্যাসাগর জিতলেন। প্রগতি বিজয়ী হল। একটি দশ বছরের মেয়ের মলিন মুখে হাসি ফুটল।
সেকালের একজন প্রকাশক
সিপাহি বিদ্রোহের বছর দুয়েক পরের কথা। চিৎপুর দিয়ে চলতে গেলেই পথচারীদের নজরে পড়ত, সিংহ-বাড়ির সামনে মস্ত একটা ভিড়। সেকালে কলকাতায় বড়মানুষের অভাব ছিল না। তাঁদের তামাশাও ছিল রকমারি। কিন্তু এই ভিড়টা একটু নতুন ধরনের। সকাল নেই, সন্ধে নেই, হই-চই লেগেই আছে। কৌতূহলী হয়ে যাঁরা উঁকি দিতেন একবার, তাঁরাও দাঁড়িয়ে যেতেন। লোভ সংবরণ করতে পারতেন না। কারণ, যে বস্তুটিকে ঘিরে এই ভিড়, সেটি ‘মহাভারত’। মহাভারতের বাংলা অনুবাদ। সিংহবাড়ির কালীপ্রসন্ন নিজের পয়সায় ছেপে তাই বিলোচ্ছেন। বর্ধমানের মহারাজা যেমন বিলিয়েছিলেন, তেমনি। বিনে পয়সায়।
যাঁদের ‘মহাভারতে’র অমৃত কথা শোনার মতো সময় এবং বিদ্যে কোনওটাই নেই, তাঁরাও দাঁড়ান। যদি মিলে যায়, মন্দ কী। বাজারে ছেড়ে দিলে পঞ্চাশ ষাট টাকা অন্তত আসবে। স্বভাবতই এঁদের ভিড় ঠেলে অনেক পড়ুয়ার হাতই বই অবধি পৌঁছল না। কালীপ্রসন্নের মহাভারত লুঠের মালের মতো দেখতে দেখতে ভিড়ে হারিয়ে গেল। শূন্য হাতেই ঘরে ফিরতে হল অনেক আগ্রহী পাঠককে।
কালীপ্রসন্ন সিংহের ঘরে বসেই একটি ছেলে নিত্য ফিরে-যাওয়া মানুষগুলোকে দেখতেন। ছেলেটির নাম প্রতাপ। পুরো বললে প্রতাপচন্দ্র রায়। প্রতাপ ঘটনাটা দেখেন আর ভাবেন। কেউ কেউ তাঁর কাছেও হাত পাতেন। কারণ, সবাই জানে, সিংহবাবুর কর্মচারী হলেও বাড়ির ছেলের মতো। কালীপ্রসন্ন এই জোয়ান ছোকরাটাকে নিজের ছেলের মতো ভালবাসতেন।
কথাটা মিথ্যে নয়। কালীপ্রসন্ন প্রতাপকে সত্যিই ভালবাসতেন। অনাথ প্রতাপকে তিনি যখন ঘরে তুলেছিলেন, তখন তার মাইনে ছিল সাত টাকা, আর ক’দিনের মধ্যেই সেই মহাভারত বিলোনের কালে প্রতাপ পায় পুরো দশ টাকা। আর পায় অপরিমিত স্নেহ। টাকার হিসাবে যার কোনও পরিমাপ হয় না। কিন্তু ‘মহাভারত’ সম্পর্কে সে নিরুপায়। কালীপ্রসন্নের মতো প্রতাপও আগ্রহীদের অনুরোধ রাখতে পারেন না। কারণ, বই সংখ্যায় গোনাগুনতি হলেও, অনুরাগী যে অফুরন্ত।
ক’ বছর পরে। পুণ্যশ্লোক কালীপ্রসন্ন সিংহ শত্ৰুমিত্রকে কাঁদিয়ে বিগত হয়েছেন। প্রতাপ এখন আর সিংহবাড়ির ছেলে নয়। সে দোকানি। চিৎপুর রোডের ওপর তখন নর্মাল স্কুল। নর্মাল স্কুলের গায়ে প্রতাপের ছোট দোকান। বাল্যশিক্ষা, বর্ণবোধ, শিশুবোধক ইত্যাদি ক’খানা শিশুপাঠ্য বই, আর শ্লেট, খাতা পেনসিল, বিস্কুট ইত্যাদি বিক্রি হয় সেখানে।
তিনটে বছরও পুরো গেল না। দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠল সেই ছোট্ট দোকানটা। প্রতাপ এখন সম্পন্ন মানুষ। কিন্তু আগের ইতিহাস দেখতে গেলে, কোনও কালেই এই ছেলেটি সম্পন্ন ছিল না। বরাবরই সে গরিব। বাড়ি ছিল বর্ধমানের শংখগড় অর্থাৎ সাঁকোগ্রাম। বাবা রামজয় রায়। দারিদ্র্য এমনভাবে পদানত করেছিল তাঁকে যে ছেলে জন্মানোর পর ক’মাসও ঘরে রাখতে পারেননি তিনি। চোখ বুঁজে তাকে তুলে দিয়েছিলেন গাঁয়ের এক নিঃসন্তান বিধবার হাতে। নতুন মা কৃষ্ণমণি আরও গরিব। প্রতাপকে নিয়ে তিনি চলে এলেন কালনায়। প্রতাপ সেখানে পাঠশালায় পড়ে। নতুন মা বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করেন।
সেই পাঠশালা থেকেই যোল বছর বয়সে প্রথম কলকাতা। কালীপ্রসন্ন সিংহের স্নেহ। তারপর এই দোকান এবং স্বাচ্ছন্দ্য। প্রতাপ বিয়ে করলেন এবার। স্ত্রী গোলাপসুন্দরী সুলক্ষণা। তাঁর ভাগ্যে দিনে দিনে প্রতাপের ব্যবসা বাড়তির দিকে।
পুরনো ভাবনা এবার একটু অনুকূল হাওয়া পেয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। প্রতাপ স্থির করলেন, শুধু বই বিক্রি নয়, এবার তিনি সরাসরি বই ছাপবেন। এবং আর কোনও বই নয়, ছাপাবেন ‘মহাভারত’। কালীপ্রসন্ন সিংহের দরজা থেকে ক’বছর আগে ফিরে-যাওয়া মানুষগুলোর ছবি ভেসে উঠল তাঁর চোখে। নাঃ, যে করে হোক ‘মহাভারত’ ছাপতে হবে তাঁকে।
রোগটা সম্পন্ন গৃহস্থের নয়। বর্ধমানের মহারাজা কিংবা প্রকৃত ধনপতি কালীপ্রসন্নের মতো মানুষের। কিন্তু ইচ্ছে থাকলে প্রতাপের মতো সাধারণ মানুষেরও উপায় হয়। অচিরেই বের হল প্রতাপের প্রথম ‘মহাভারত’। ১৮৬৯ সালের জুনে প্রথম খণ্ড। পরবর্তী সাত বছরে বাকিটুকু। ছাপা হল তিন হাজার। দাম বেয়াল্লিশ টাকা। কিছু লাভ না করলেও এটাই সংগত দাম হয়।
ইতিমধ্যে গোলাপসুন্দরী মারা গেলেন। সংসারে নিজের বলতে প্রতাপের এখন রইল একটিমাত্র কন্যা। মেয়েটিকে পাত্রস্থ করে দেশভ্রমণে বের হলেন তিনি। যেখানেই যান, সেখানেই তাঁর ‘মহাভারতে’র কথা। অনেকে আক্ষেপ করলেন। বেয়াল্লিশ টাকা দাম তেমন কিছু নয়। কিন্তু তাই বা ক’জনের আছে?
নতুন ভাবনা মাথায় নিয়ে প্রতাপ কলকাতায় ফিরলেন। তাঁর এখন বসে খাওয়ার মতো অর্থ আছে। আর রোজগার না করলেও বাকি দিন চলে যাবে। একটা ছাপাখানাও হয়েছে। এমত অবস্থায় ইচ্ছে করলে তিনিও পারেন বই কি। হ্যাঁ, কালীপ্রসন্নের মতোই বিনা পয়সায় মহাভারত বিলোতে পারেন। যাঁর চাই তাঁকেই। ঘরে এক হাজার বই তখনও ছিল। একদিনে সেগুলো বিলি হয়ে গেল।
এবার দ্বিতীয় সংস্করণ। তারপর তৃতীয় হবে, চতুর্থ হবে, প্রতাপ ভাবলেন। কত সংস্করণ একা ছাপতে পারেন তিনি? তাঁর একার সামর্থ্য কতটুকু? প্রতাপ স্থির করলেন, তার চেয়ে এই দাতব্য প্রস্তাবকে সর্বদেশের দায়িত্বে পরিণত করাই সংগত। তিনি ‘দাতব্য ভারত কার্যালয়’ নামে এক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলেন। দেশের লোকের অর্থসাহায্যে এ দেশের প্রাচীন সাহিত্যকে সর্বসাধারণের কাছে প্রচার করাই এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য। ৩৬৭ নম্বর আপার সারকুলার স্ট্রিটে ‘দাতব্য ভারতে’র আপিস বসল।
দেশীয় রাজ্য, রাজা মহারাজারা অর্থসাহায্য করলেন। হায়দরাবাদের নিজাম থেকে কাশিমবাজারের মহারানি স্বর্ণময়ী, পুটিয়ার শরৎসুন্দরী এবং আরও অনেকে হাত খুলে সাহায্য করলেন। সাতসমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে এল সংস্কৃত-অনুরাগী বিদেশি বন্ধুদের উৎসাহ। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির স্বনামখ্যাত ডাঃ রস্ট, অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার, সার এডুইন আরনল্ড এবং আরও অনেকে চিঠি লিখে অভিনন্দন জানালেন এই প্রতিষ্ঠানকে। কারণ যে এতে শুধু প্রাচীন বিদ্যার প্রসার ঘটবে তাই নয়, বিলীয়মান সংস্কৃত পুঁথিগুলোও ছাপার হরফে দীর্ঘতর জীবন পাবে। ভারতের মতো তাঁদের পক্ষেও সেটা খুবই আনন্দের ঘটনা হবে।
সাত বছর নিয়মিতভাবে চলল ‘দাতব্য ভারত কার্যালয়ে’র কাজ। প্রতাপচন্দ্র সাত বছরে বের করলেন মূল সংস্কৃত মহাভারতের তিনটে সংস্করণ, বাংলায় চারটে সংস্করণ, হরিবংশ এক সংস্করণ। প্রত্যেক সংস্করণে বইয়ের সংখ্যা তিন হাজার। সব বিনামূল্যে বিলি হল। এবার ‘রামায়ণ’ গেল প্রেসে।
‘রামায়ণ’ যখন ছাপা হচ্ছে, তখন প্রতাপের মাথায় ‘মহাভারতে’র ইংরেজি অনুবাদের চিন্তা জুড়ে বসেছে। প্রস্তাব শুনে বিদেশিদের অপরিসীম আনন্দ।
অন্যদেরও প্রবল উৎসাহ। কিন্তু অনুবাদের পক্ষে ‘মহাভারত’ এক দুরূহ ব্যাপার। আঠারোটি খণ্ডে রচিত এই বইটি পৃথিবীর বৃহত্তম বই। এর ছাত্র সংখ্যা ২,২০,০০০, শ্লোকসংখ্যা তার অর্ধেক অর্থাৎ এক লক্ষ দশ হাজার। শ্লোকের আবার পাঠান্তর আছে, অর্থভেদ আছে। তা ছাড়া, টাকা চাই। প্রতাপ স্থির করেছেন, ডিমাই অক্টেভো দশ ফর্মায় এক-একখানা খণ্ড করবেন। একশো খণ্ডে সম্পূর্ণ হবে বই। অর্থাৎ পাতা লাগবে আট হাজার। আট হাজার পাতার এই বিরাট বই ওজন করলে যেমন হবে আধ মনের ওপর, তেমন টাকাও লাগবে এক লক্ষের কম নয়।
এদিকে ম্যাকস্মূলার উপক্রমণিকা বা প্রথম অধ্যায়টির একটা অনুবাদ পাঠিয়েছেন প্রতাপকে। অনুবাদ করেছিলেন তাঁর এক ছাত্র জনৈক তরুণ জার্মান। তবে অনুবাদ তিনি শেষ করতে পারেননি। অনেকেই এমনি শুরু করেছিলেন। ভারতে থাকাকালে সার এডুইন আরনল্ডও কয়েক হাজার শ্লোক অনুবাদ করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। অংশবিশেষ অনেকেই করেছেন, কিন্তু কোনও ইউরোপীয় এখনও মহাভারত শেষ করেননি। এদেশের পণ্ডিতেরা তাই সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। পণ্ডিত দুর্গাচরণ এই বিশাল কাজের দায়িত্ব নিলেন। বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন গ্রাজুয়েটও নাকি কোনও কোনও অধ্যায়ে সাহায্য করেছিলেন তাঁকে।
যা হোক, ক্রমে সকলের সাহায্য এবং জগৎজোড়া অভিনন্দনের মধ্যে ১৮৮৩ সালের ১৮ মে বের হল ‘মহাভারতে’র ইংরেজি অনুবাদের প্রথম খণ্ড। অবশ্য পদ্যে। বাংলা দেশের প্রকাশনের ইতিহাসে এই দিনটি স্মরণীয়। কারণ, যুগ্মভাবে বাঙালির এটি একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি। ভূমিকায় প্রতাপচন্দ্র জানালেন: এই খণ্ডটি মাত্র ১২৫০ কপি ছাপা হয়েছে। তার মধ্যে ২৫০ কপি এদেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরিত হবে। ৩০০ কপি দেওয়া হবে ভারতীয় শাসন-কর্তৃপক্ষকে। কারণ, গভর্নর-জেনালের লর্ড রিপন এবং ডাফরিন থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারীরা অকাতরে তাঁকে অর্থে এবং উৎসাহে আনুকূল্য প্রদর্শন করেছেন। কথাটা যে সত্য একটা ঘটনার উল্লেখেই তা বোঝা যাবে। ১৮৮৮ সালের ৫ জানুয়ারি ফোর্ট উইলিয়ম থেকে কর্নেল নেভিল চেম্বারলেন প্রতাপচন্দ্রকে এক চিঠিতে জানাচ্ছেন যে, প্রধান সেনাপতি সার ফ্রেডারিক রবার্টস তাঁর ‘মহাভারতে’র ইংরেজি অনুবাদ সম্পর্কে অত্যন্ত উৎসাহিত। এবং ‘His Excellency feels sure that you will be glad to hear that Colonel to meet your wishes…Col. Jarrett lives at 17, Elysium Row, so you might like to communicate with him on the subject.
যা হোক, স্থির হল অবশিষ্ট বইয়ের মধ্যে ২৫০টি বিলি করা হবে ইউরোপ আমেরিকার বিদ্বজ্জনদের মধ্যে, আর ২৫০ কপি থাকবে রিজার্ভ। এ ছাড়া যে আরও ২৫০ কপি থাকবে, সেগুলো বিক্রি হবে। এদেশে হলে ৫০ টাকায়, বিদেশে হলে ৬৫ টাকায়। যাঁরা এতেও কিনতে পারবেন না তাঁদের অবস্থা বুঝে যথাক্রমে ১২ এবং ২৫ টাকায় দিয়ে দেওয়া হবে। কাউকে বিফল করা হবে না।
চারদিকে হই-হই পড়ে গেল। মহারানি ভিকটোরিয়া প্রতাপকে অভিনন্দন জানালেন। অভিনন্দন জানালেন, গ্ল্যাডস্টোন, মার্কিস অব হ্যারিংটনের মতো ম্যাকস্মূলার, আরনল্ড, সিলভাঁ লেভি, হান্টার প্রমুখ বিদ্বজ্জনেরা। লন্ডনের ‘দ্য টামইস’ পত্রে বের হল দীর্ঘ সমালোচনা। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’, ‘ডেলি টেলিগ্রাফ’ প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত দৈনিক পত্র এবং পৃথিবীর নানা দেশের গবেষণা পত্র প্রতাপের জয়ধ্বনিতে ভরে উঠল। এ দেশেও কম আলোড়নের সৃষ্টি হল না। ডাঃ শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রায় কৃষ্ণদাস পাল বাহাদুর, বিদ্যাসাগর মশাই, শিশিরকুমার এবং মতিলাল ঘোষ, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ সুনামধন্যেরা প্রতাপকে তাঁদের আন্তরিক অনুরাগ জানালেন। দ্য স্টেটসম্যান-এর বিখ্যাত সম্পাদক রবার্ট নাইট এবং অন্যান্য পত্রিকার সম্পাদকেরাও তুল্যভাবে সম্মানিত করলেন তাঁকে। প্রকাশক প্রতাপ তখন কলকাতায় রীতিমতো একটা চাঞ্চল্যকর নাম।
তারপর মাসে মাসে নিয়মিতভাবে এক খণ্ড করে বের হয় মহাভারতের ইংরেজি অনুবাদ। প্রতি খণ্ডের জন্যে নতুন অর্থ চাই। প্রতাপের আবেদন আর চাঁদার খাতা হাতে চারিদিকে এজেন্টরা ঘুরে ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করেন। বাংলার জেলায় জেলায়, সারা ভারতবর্ষে। কলকাতায় ‘মহাভারতে’র ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে। এমন উদ্যোগ করে বই প্রকাশ বোধ হয় আর কোনও দিন হয়নি কলকাতায়।
টাকা আসে, বই বের হয়। এমনি করে বছর বারো চলে গেল। অতঃপর মহাভারত ৯৪ খণ্ডে এসে ঠেকল। পারিপার্শ্বিকে ইতিমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। পণ্ডিত দুর্গাচরণ বিগত হয়েছেন। প্রতাপের একমাত্র কন্যা বিধবা হয়ে আবার তাঁর ঘরে ফিরেছেন। প্রতাপ আবার দার পরিগ্রহ করেছেন। এবং ইতিমধ্যে তাঁকে তৎকালের শ্রেষ্ঠ সরকারি সম্মান ‘সি.আই.ই.’-তে ভূষিত করা হয়েছে। এত পরিবর্তনের মধ্যেও অনুবাদের কাজ চলছিল ঠিকই। কিন্তু এবার বোধ হয় সব যায়। কারণ, পুরো এক বছর প্রতাপ শয্যাগত। শেষে ১৮৯৫ সালের ১০ জানুয়ারি শেষ নিশ্বাস পড়ল এই স্মরণীয় উদ্যোগী পুরুষের। দ্বিতীয়া স্ত্রী সুন্দরীবালা স্বামীর মৃত্যুশয্যায় কথা দিয়েছিলেন, যেমন করে হোক শেষ খণ্ডটি পর্যন্ত প্রকাশের ব্যবস্থা করবেন।
আমাদের সৌভাগ্য, তিনি কথা রেখেছিলেন। সুন্দরীবালার নামেই ১৮৯৯ সালের জুলাইয়ে বের হল মহাভারতের শেষ খণ্ড—শততম খণ্ড। বিধবা সুন্দরীবালা তাঁর স্বামীব্রত উদ্যাপন করলেন। ‘ডেড ম্যানস ভিকটরি’ নাম দিয়ে ভারতপ্রেমিক সার এডুইন আরনল্ড সেদিন এঁদের দুজনকে উপলক্ষ করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন গোটা ভারতবর্ষকে। কারণ ভারতবর্ষের ‘মহাভারত’ যেমন অবিস্মরণীয় সাহিত্যকীর্তি, প্রতাপচন্দ্র রায়ের মতো মানুষও তেমনি এদেশের স্মরণীয় ঘটনা।
শুধু সেকালে নয়, বোধ হয় একালেও।
‘কাজী’ থেকে ‘মাননীয় বিচারপতি’
শতবার্ষিকীর দিনে হাইকোর্টের কথা বলতে গিয়ে কেন যেন মনে পড়ে গেল সেই বাঙালি কবিটির কথা, যিনি একদা ‘দ্বারসায়র’ বা ‘দায়রা সেশন’ উপলক্ষে একটি পদ্যে বাঙালির মনে ভবিষ্যৎ হাইকোর্টের ভিত্তি স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। পাবনা জেলার নাকালিয়া গ্রামের কবি জনৈক রামপ্রসাদ মৈত্র সেদিন নগরের সভাকবিদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুরে গেয়েছিলেন:
‘অপূর্ব শুনহে সবে স্বর্গের যতেক দেবে
বিলাতে হইয়া সাহেবরূপী।
ছাড়িয়া আহ্নিক পূজা,
পরিধান কূর্তি মোজা
হাতে বেত শিরে দিল টুপি
বাঙালির অভিলাষে।’
কবির মতে ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের দিন থেকে নয় এদেশে ইংরেজ আমল শুরু হয়েছে সাত বছর পরে ১৭৭২ সাল থেকে। কেননা, সে বছর থেকেই জেলায় জেলায় ইংরেজি আমলের ‘দ্বারসায়র’ বা দায়রা সেশন।
কবিতাটির রচনাকাল বাংলা ১২২০ সালের কার্তিক। সুতরাং বলা নিষ্প্রয়োজন, হাইকোর্ট তখনও ভূমিষ্ঠ হয়নি। কিন্তু তা হলেও এ কবিতায় তার সম্ভাবনার যে ইঙ্গিত রয়েছে, তেমন বোধ হয় কোনও সরকারি দলিলেও নেই। কেননা, প্রায়শ ইতিহাস পাঠক হিসেবে আমরা যে ভুলে পড়ি পাবনার কবি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। ইংরেজের আদালত তাঁর কাছে বিচারালয় মাত্র নয়, ইংরেজ রাজত্বের ইংরেজ প্রভুদেরই প্রতীক মাত্র।
‘দিনেক দুই গতে
হুকুম জারি ফৌজদারীতে
যে মত প্রতিমা পূজা হয়।
তবে শুন তার মজা যে মত হইল পূজা
প্রতিমা হইলা সাহেব আসি
কাদিরা আসন কারি সমুখেতে মেজ ধরি
পূজা লন পূর্ব মুখে বসি॥’
হাইকোর্টে এই নবদেবতারই অধিষ্ঠান পরবেরই সর্বশেষ অধ্যায়, স্বপ্নাদিষ্টকাল ইংরেজ সাম্রাজ্যে সাধকদের শেষ মন্দির। ওই অট্টালিকার কাহিনী শুধুই ইট কাঠ পাথরের কথা নয়, তথাকথিত ইংলিশ জাস্টিস বা বিলিতি ন্যায়ধর্মের কাহিনীও নয়। এর সঙ্গে জড়িত ইংরেজের জটিল সাম্রাজ্য-সাধনার স্বাভাবিক অথচ জটিল ইতিহাস।
প্রধানত রাজস্ব আদায়ের চিন্তা থেকেই একদিন উদ্ভূত হয়েছিল আইন এবং আদালতের প্রশ্ন নয়তো বার্নিয়ারের মতো দর্শক হিসেবেই শুরু নয়, ইংরেজের এই কলকাতা শহরে নিজেরাও যে ‘কাজী’র মতো বিচার করেছেন কলকাতার প্রথম সাহেবি আদালত ‘মেয়রস কোর্টে’ এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য আদালতগুলিতে তার নজির যথেষ্ট। ফাঁসি দেওয়ার অধিকার ছিল না বলেই ছিঁচকে চোরের জন্যে শাস্তি ছিল তখন মৃত্যু না হওয়া অবধি বেত্রাঘাত। একজন ইংরেজ ঐতিহাসিক স্বীকার করেছেন: নৃশংসতায় বিশেষ দীক্ষা না থাকলেও এর সঙ্গে মুঘলাই বিচারের পার্থক্য বোঝা সত্যিই কষ্টকর।
ইংরেজাধীন কলকাতায় তখন বিচারালয়ের অভাব ছিল না। ‘কোর্ট অব রিকোয়েস্ট’ নামে আদালত ছিল একটা। সরকার মনোনীত চব্বিশ জন মহাশয় ব্যক্তি ছিলেন সেখানে বিচারক। আজকে যেখানে লালবাজার সেখানে প্রকাশ্য রাস্তার ওপরে ছিল তাঁদের আদালত। সে আদালতে রায় যাঁরা দিতেন, তাঁরা স্থানীয় লোক ছিলেন বটে, কিন্তু যাঁদের আশ্রয়ে সে সব অমানুষিক রায় কার্যকর করা হত, মনে রাখতে হবে, তাঁরা ছিলেন কুঠিয়াল ইংরেজ।
স্থানীয় দেশীয়দের এই নিম্ন আদালতটির পরেই ছিল সাহেব পরিচালিত কলকাতার বিখ্যাত ‘মেয়রস কোর্ট’। তার বিচারকদের মধ্যে থাকতেন স্বয়ং নগরাধিপ শেরিফ, সাতজন খাঁটি ইংরেজ এবং বত্রিশ জন দেশীয় খ্রিস্টান। তবে তাঁদের প্রত্যেককেই প্রোটেস্ট্যান্ট হতে হত। তাঁদের বিচারধারার কথা আগেই বলা হয়েছে।
মেয়রস কোর্টের পরেই ছিল কলকাতার জমিদারদের নিজস্ব আদালত কোর্ট অব আপিল বা গভর্নরের বিচারসভা। শহরের অন্যতম বিখ্যাত জমিদার হলওয়েলের (১৭৫২-৫৬) নিজের জবানিতে তাঁর বিচারক জীবনের কাহিনী: জমিদার দেওয়ানি এবং ফৌজদারী এই দুই রকমের বিচারই করে থাকেন। ‘He tried in a summary way, had the power of the lash, fine and imprisonment, he determined all matters of meum and tuum, and in all criminal cases proceed to sentence and punishment immediately after hearing, except when the crime requires the lash to be inflicted until death…’ সেখানে প্রধান ‘কাজী’, অর্থাৎ স্বয়ং গভর্নরের সম্মতি লাগত।
১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের পরক্ষণেই বোঝা গেল, এই ব্যবস্থা ইংরেজের সুনামের পক্ষে হানিকর না হলেও ইংরেজ রাজত্বের পক্ষে মোটেই শুভকর নয়। সুতরাং, অচিরেই দেখা গেল, তাঁরা বিচারধারা পরিবর্তনে মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। দেওয়ানি রাজস্ব আদায়ের অধিকার মাত্র। তার সঙ্গে বিচার-অধিকারের ‘আইনগত’ কোনও যোগ নেই। কিন্তু ইংরেজরা বণিকের মানদণ্ডকে রাজদণ্ডে পরিণত করতে সংকল্পবদ্ধ, সুতরাং, দু’টি বছর কাটতে না কাটতেই দেখা গেল, তাঁরা নামান্তরে ন্যায়দণ্ড হাতে তুলে নিয়েছেন। সে ১৭৭২ সালের কথা, সেদিনই অগণিত গণদেবতার মনে মনে ভারতের মাটিতে ভবিষ্যৎ হাইকোর্টের সম্ভাবনা বীজ হিসেবে রোপিত।
পাবনার কবির মতো অনেককে চমকিত করে সে বছর প্রতি জেলায় দু’টি করে বিচারালয় প্রতিষ্ঠিত হল। একটি দেওয়ানি আদালত, অন্যটি ফৌজদারি। দেওয়ানি মূলত রাজস্ব ভাবনা থেকে জাত বিচারালয়। সুতরাং, জেলায় যিনি কালেকটর, তিনিই নিযুক্ত হলেন দেওয়ানি আদালতের বিচারক। তাঁর সাহায্যকারী হিসেবে পাশে রাখা হল স্থানীয় নমুনা, একজন করে দেওয়ান। কবির কথায়:
বুঝিলাম হক বটে জজ সাহেব। ধর্ম বটে চিত্রগুপ্ত সঙ্গেতে দেওয়ান।’
সর্বোচ্চ দেওয়ানি আদালত হিসেবে সে বছরই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হল সদর দেওয়ানি আদালত। আজকের চৌরঙ্গির সদর স্ট্রিটের একটি বাড়িতে পুণ্যাহ হয়েছিল তার। তারপর স্থানাভাব হেতু সেটি স্থানান্তরিত হয়—আজ যেখানে ভবানীপুরের মিলিটারি হাসপাতাল—সেখানে। হাইকোর্টের প্রতিষ্ঠা দিবস পর্যন্ত সেখানেই ছিল বিখ্যাত সদর দেওয়ানি আদালত। উল্লেখযোগ্য, দেওয়ানি বিচারের প্রায় ষোল আনা অধিকার হাতে তুলে নিলেও ৭২ সালের সেই ব্যবস্থায় ফৌজদারি বিচার ছিল, বলতে গেলে প্রায় সম্পূর্ণত দেশীয়দের এক্তিয়ারে। সেখানে কাজি, বকসী, নাজির, মোল্লা এবং গঙ্গাজলীদেরই আধিপত্য। শুধু জেলা আদালতগুলিতে নয়, সর্বোচ্চ ফৌজদারি, ধর্মাধিকরণ ‘সদর নিজামত আদালতের’ ক্ষেত্রেও তাই ছিল নিয়ম। সদর দেওয়ানি আদালতের দফতর ছিল যেমন কলকাতায়, সদর নিজামত আদালতের দফতর তেমনি মুর্শিদাবাদে। কলকাতায় বিচারপতি ছিলেন যেমন গভর্নর এবং কাউন্সিল সদস্যগণ, মুর্শিদাবাদে তেমনি নায়েব নাজিম। বলা বাহুল্য, রাজস্ব আদায় চিন্তা না হয়ে ইংরেজি-ন্যায় প্রবর্তন-ধ্যান হলে, এই দ্বৈত ভঙ্গিতে কিছুতেই সেদিনের ইংরেজদের রাজি করানো যেত না।
রাজস্ব ব্যবস্থাকে সুবিন্যস্ত করার চিন্তায় তখন নিত্যনতুন বিচারবিধি, নিত্যনতুন বিচার বন্দোবস্ত। ১৭৭৪ সালে জেলা-আদালতগুলোর অধিকার আবার ছেড়ে দেওয়া হল ‘আমিল’দের উপর। তারপর ১৭৮১, ৮৬, ৮৭, ৯০ সালে দফায় দফায় রকমারি হতে হতে অবশেষে ১৭৯৩ সালের বিখ্যাত কর্নওয়ালিস-বিধি।
’৪৭ সালে কর্নওয়ালিস ঢাকা, পাটনা এবং মুর্শিদাবাদ বাদ দিয়ে জেলা আদালতগুলোকে আবার কালেকটরের অধীন করলেন। ক্রমে সদর নিজামত আদালত মুর্শিদাবাদ থেকে আবার (আর একবার হেস্টিংসও তা করেছিলেন কলকাতায় স্থানান্তরিত করলেন এবং জেলায় ফৌজদারি আদালতগুলো উঠিয়ে দিয়ে কলকাতা মুর্শিদাবাদ, পাটনা এবং ঢাকায় চারটে ‘সার্কিট কোর্ট’ স্থাপন করলেন। তাঁরা বছরে দুবার নিজ নিজ এলাকায় বিচার করতে বের হতেন। এক কথায় আগে যা ছিল অনিশ্চিত পরিবেশ এবং পরিস্থিতির সঙ্গে কোনওমতে খাপ খাইয়ে, কার্যোদ্ধারের চেষ্টায় গোঁজামিল মাত্র, কর্নওয়ালিস তাকেই এবার দৃঢ় ইস্পাত মুষ্টিতে আনলেন। তিনিই হাইকোর্ট তথা আইনের শাসনকে চাক্ষুস করে তুলেছিলেন।
তবে হাইকোর্টের সুউন্নত সেই শীর্ষের সঙ্গে সঙ্গে ’৭২ থেকে ’৯৩ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ’৯৩ থেকে ১৮২৮ বা তৃতীয় পর্যায়ের ১৮২৯ থেকে ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত অসংখ্য পদক্ষেপের ইতিবৃত্ত জড়িত থাকলেও এ বাড়ির অবয়বে সবচেয়ে স্পষ্ট যে ইংরেজি-ন্যায়ের কঙ্কালটি, তার নাম সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্ট কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় সদর দেওয়ানি আদালতের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ১৭৭৪ সালে। এর জন্মসূত্র সর্বজনবিদিত বেগুলেটিং অ্যাক্ট। সেই নতুন চার্টার অনুযায়ী কলকাতার ইংরেজ আদালত ভেঙে গেল এবং তার জায়গায় ছাড়পত্র পেল নতুন আদালত ‘সুপ্রিম কোর্ট’।
জাহাজটার নাম ছিল ‘আর্ল অব আসবার্নহাম’। ১৭৭৪ সালের ১৪ অক্টোবর ইম্পে, হাইড, চেম্বার্স এবং লেমাস্ত্রে (Lemaistre) এই চার-চারজন বিচারককে নিয়ে সেই জাহাজ নোঙর করল এসে কলকাতার উপকূলে, খিদিরপুরে। কলকাতা সভয়ে এবং সশ্রদ্ধায় দেখল, তাঁদের হাতে স্বয়ং ইংলন্ডেশ্বরের নিয়োগপত্র।
এক সপ্তাহ পরেই, অক্টোবরের ২২ তারিখে শুরু হল কলকাতায় সুপ্রিম কোর্টের জীবন। সদ্যোজাত আদালতের জন্যে উপযুক্ত কোনও বাড়ি ছিল না শহরে। সুতরাং মেয়র বাহাদুরের পুরানো কোর্ট বাড়িটাই ছেড়ে দেওয়া হল ওঁদের। সেই বাড়িটা ছিল ওল্ড কোর্ট হাউসের প্রান্তে লালদিঘির যে কোণটিতে আজ সেন্ট অ্যানড্রুর গির্জা, ঠিক সেখানটায়। বাড়িটার মালিক ছিলেন তখন সেন্টজন চার্চ কর্তৃপক্ষ। আদালত বাবদ কোম্পানি তাঁদের ভাড়া দিতেন। তা ছাড়া অন্য ভাড়াটেও ছিল। ওপর তলায় প্রায়ই জলসা এবং খানাপিনা হত।
ইম্পে প্রধান বিচারপতি। তিনি মেজাজি লোক ছিলেন। মেকলে তাঁর সম্পর্কে লিখে গেছেন: ‘The Chief-Justice was rich, quiet and infamous. His conduct was a piece with almost every part of it that comes under the notice of history. No such judge has dishonoured the English ermine since Jeffreys drank himself to death in the tower.’
তরুণ প্রধান বিচারপতির বয়স তখন মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর। অন্য তিন জন ‘পিউনি’ জজের মধ্যে হাইড ছিলেন পরম বিলাসী। ইম্পে স্বয়ং তার সম্পর্কে লিখছেন:
‘…He is an honest man but a great coxcomb. His tongue can not be still, and he has more parde and pomp than I have seen in the East…’
সুতরাং, মাস কাটাতে না কাটাতেই তাঁরা বিরক্ত হয়ে উঠলেন। দীর্ঘ চিঠি গেল কর্তৃপক্ষের কাছে, যার প্রথম বক্তব্য আমাদের মাইনে তো দিচ্ছেন, কিন্তু টাকার বদলে শিলিং দেবেন ক’খানা তা অনুগ্রহ করে বলুন দেখি, শুনি। দ্বিতীয়ত, অগৌণে জানাবেন, এ বাড়িটি কবে বদলাচ্ছেন। কর্তৃপক্ষ সেদিনই উত্তর দিলেন: জানো তো, কোম্পানির যথেষ্ট অর্থকষ্ট রয়েছে।
অর্থকষ্ট: সুতরাং সাত বছর একটানা এই বাড়িতেই ছিল সুপ্রিম কোর্ট। তারপর বহু কষ্টে খবর পাওয়া গেল আর একটি বাড়ির। গঙ্গার কাছাকাছি চৌরঙ্গির ওপরে সে বাড়িটার মালিক জনৈক আর্চিবল্ড কের। তিনি জানিয়েছেন মাসে সতেরশো টাকা ভাড়া পেলে তিনি বাড়ির আসল অংশটুকু ছেড়ে দিতে রাজি আছেন। সঙ্গের গুদামগুলো সহ নিলে ভাড়া পড়বে দু’ হাজার টাকা। বিচারপতিদের সে বাড়ি পছন্দ নয়। সারাই করে নিতে পারলে হয় বটে, কিন্তু তাহলেও খরচ পড়ে যায় প্রায় ষাট হাজার টাকা।
সুতরাং, উপায়ান্তরহীন কোম্পানি অগত্যা বাধ্য হয়ে ভাড়াই নিয়ে নিলেন বাড়িটা। ভাড়া: মাসে দু’ হাজার টাকা। ১৭৮২ সনে সে বাড়িতেই উঠে এল কলকাতার তৎকালীন মহাধিকরণ ‘সুপ্রিম কোর্ট’। দশ বছর পরে ১৭৯২ সালে ভেঙে ফেলা হল লালদিঘির কোণের পুরনো বাড়িটা। সেই বাড়ি—যেখানে ১৭৭৫ সালে একদিন মাঝরাত্তির অবধি মোমের আলোয় বিচার হয়েছিল মহারাজ নন্দকুমারের, যেখানে মাদাম গ্রান্ডের প্রীতির মূল্য হিসেবে পঞ্চাশ হাজার সিক্কা টাকা গুনে দিয়েছিলেন কাউন্সিলার ফিলিপ ফ্রান্সিস, এবং যেখানে সাধারণ ‘মাছ চুরি’ ‘দুধ চুরির’ জন্যে ফাঁসির দড়িতে জীবন দিয়েছে অগণিত ‘ব্রজমাধব’ ‘হরিচরণ’। ইতিহাস অতঃপর এখানেই, তৎকালের চৌরঙ্গির এই এক কোণে জমে উঠেছে।
সবিস্তার সুপ্রিম কোর্টের বাড়িটির ইতিহাস আজ বলতে হল, কারণ দর্শকেরা যাকে বলতেন কলকাতার দীনতম কুঠি, সুপ্রিম কোর্টের সেই বাড়ির ভিতেই আজকের হাইকোর্ট। ১৮০১ সালে ওয়েলেসলি আশি হাজার টাকায় বাড়িটা কিনেছিলেন। এবং তারও তেষট্টি বছর পরে কেরি সাহেবের সেই বাড়িই নতুন করে জন্মলাভ করেছিল হাইকোর্টের পতাকা মাথায় নিয়ে। যার ভিত্তিপ্রস্তর পড়েছিল ১৮৬৪ সালের মার্চ মাসে আর নব-দ্বারোদ্ঘাটন ১৮৭২ সালের মে মাসে। ইপ্রেস-এর টাউন হলের আদলে গড়া সেই সুন্দর গোথিক-শৈলীর সৌধটির স্থপতি ছিলেন ওয়াল্টার গ্রানভিল। তার স্তম্ভ, স্তম্ভশীর্ষ, খিলান, টাওয়ার সবই দর্শনীয়।
সেকালেও এটা আইনের পাড়া। কোর্ট-বাড়ির পুব দিকে ছিল একটা সরু গলি। তার পরেই সেকালের বিখ্যাত অ্যাডভোকেট ক্লার্ক সাহেবের বাড়ি। ক্লার্ক সাহেব কলকাতার বার লাইব্রেরির (জুন ১৮২৫) প্রতিষ্ঠাতা। তা ছাড়াও ‘বরফ কুঠি’, মেটকাফ হল, এবং মেকলের ইংরেজি-বিদ্যা-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসাবে তিনি সুচিহ্নিত। তাঁর বাড়ির পরেই তখন এসপ্ল্যানেড। আশপাশে অন্যান্য বাড়িওয়ালার মধ্যে ছিলেন অ্যাডভোকেট জেনারেল কলভিল এবং সুপ্রিম কোর্টের মাস্টার, উইলিয়াম ম্যাকফারসন। সর্বোপরি, গার্ডেনরিচ থেকে প্রতিদিন এ বাড়িতেই হেঁটে এসে আপিস করতেন স্যার উইলিয়াম জোনস্।
সবার আগে নগরের শেরিফ। তার পর ডেপুটি-শেরিফ এবং তাঁদের পার্শ্বচরগণ। তাঁদের কারও হাতে তলোয়ার, কারও হাতে ন্যায়দণ্ড, কারও হাতে সমুদ্র-শাসনের প্রতীক নোঙর। প্রতি বছর ফৌজদারি অধিবেশনের সূচনায় হাইকোর্ট ভবনে বিচিত্র এই শোভাযাত্রাটি দেখা যেত। শেরিফ এবং তাঁর অনুচরদের পরেই সেই নাতিদীর্ঘ সারিটিতে থাকতেন মাননীয় বিচারপতিগণ।
সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি সহ বিচারক ছিলেন চারজন। নব প্রতিষ্ঠিত হাইকোর্টে নিযুক্ত হলেন প্রধান বিচারপতি ছাড়া আরও বারোজন। তাঁদের মধ্যে আটজন ছিলেন কোম্পানির পুরানো বিচারসভা ‘সদর দেওয়ানি আদালত’ থেকে নিযুক্ত। অবশিষ্ট চারজনের দু’জন এলেন সুপ্রিম কোর্ট থেকে এবং দুজন স্থানীয় ‘বার’ থেকে।
ক’ বছর পরে নতুন ফতোয়া-বলে (লেটারস পেটেন্ট, ২৮ ডিসেম্বর, ১৮৬৫) নতুন করে আবার ‘বেনচ্’ সাজানো হল। হাইকোর্টের জন্যে এবার বিচারপতির ব্যবস্থা করা হল পনেরো জনের। স্থির হল, প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতির ছ’জনকে অবশ্যই ব্যারিস্টার হতে হবে। মোট সংখ্যার তিনজনকে সরাসরি বিলেত থেকে নিযুক্ত করা হবে, পাঁচজনকে নিযুক্ত করা হবে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্য থেকে বা কোভেনেন্টেড সার্ভিস থেকে, তিনজন স্থানীয় ‘বার’ থেকে এবং বাকি তিনজন ভারতীয়দের মধ্য থেকে। শেষোক্ত ঘটনাটি যে ভারতে সাম্রাজ্য জয়ের মতো সহজে সম্পন্ন হয়নি, সে কথা নতুন করে বলা অনাবশ্যক।
সে যা হোক, হাইকোর্ট তখন শ্রেষ্ঠতম বিচারালয়, যাবতীয় উচ্চ আদালতকে ধূলিসাৎ করে তার জন্ম হয়েছে, দেশের চরম ন্যায়দণ্ড তার হাতে। সুতরাং শেরিফের সেই জাঁকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রা ধীর পায়ে করিডর ধরে এগিয়ে চলত বিচার কক্ষের দিকে। রক্তবর্ণ পোশাকে সজ্জিত বিচারকরা উপযুক্ত গাম্ভীর্য সহকারে ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়াতেন মঞ্চোপরি স্থাপিত সুউন্নত আসনগুলোর সামনে। তাঁরা আসন পরিগ্রহ করা মাত্র ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিট কাঁপিয়ে চৌরঙ্গির ওই কোণে সুগম্ভীর একটা হাঁক শোনা যেত, ‘ওয়ে! ওয়ে! ওয়ে!’ মার্শাল মুখে হাত দিয়ে গলা ফুলিয়ে হাঁক দিচ্ছে অল পারসনস দ্যাট হ্যাভ এনিথিং টু ডু বিফোর মি লর্ড দ্য কিংস জাস্টিস অব ওইরেজ অ্যান্ড টার্মিআব অ্যান্ড জেনারেল গোয়াল ডেলিভারি অ্যান্ড অ্যাট দিজ অ্যাডমিরিলিটি সেসানস ড্র নিয়ার অ্যান্ড গিভ ইওর অ্যাটেন্ডেন্স…’—ওয়ে!-ওয়ে-ওয়ে! (Oyez! Oyez! Oyez!)
বাক্যটার সঠিক মানে কী ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটে ইতস্তত ছড়ানো, আইনের আঙিনায় সমবেত ভারতবর্ষ তা জানত না, শুধু এটুকুই জানত, কোর্ট বসেছে। হাইকোর্ট হল সেই বিচিত্র আদালত, যা আমাদের ছিল না এবং আমরা মনে মনে যা চেয়েছিলাম।
বায়ুর গতি ধরে মত গঠন করলে অবশ্য অন্য কথা। কিন্তু এলোমেলো ইতিহাসের সেটাই সিদ্ধান্ত, মনের কথা। ওঁরা দিয়েছিলেন বলেই আমরা দু’হাত বাড়িয়ে নিইনি, আমরা চেয়েছিলাম বলেই দু হাত ভরে নিতে পেরেছি।
কী ছিল সেদিনের সুপ্রিম কোর্টের? কতখানি আইনের বিচার ছিল সদর মফস্বলের দেওয়ানি আদালতগুলোতে? সুপ্রিম কোর্টের বিচারমঞ্চ থেকে ঘোষিত প্রথম দিনের একটি রায়: ওর হাত পুড়িয়ে দেওয়া হোক। তার পর কলকাতার সাধারণ কয়েদখানায় ওকে এক বছর কয়েদ রাখা হোক। এবং তারপর ওকে ছেড়ে দেওয়া হোক। উল্লেখযোগ্য, আসামি শেখ মোহম্মদের অপরাধ ছিল নরহত্যা। সেদিনই আর এক আসামি ছিল রাধামণি। তার অপরাধ ছিল—রায় ঘোষিত হল: আসামিকে লালবাজারের মোড়ে ‘পিলারিতে’ দেওয়া হোক। তারপর তাকে বড়বাজারে নিয়ে গিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে এবং দক্ষিণ থেকে উত্তরে চাবুক মারতে মারতে ঘোরানো হোক।
কলকাতার সাধারণ মানুষ সদ্য প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট থেকে যে ন্যায় বিচার পেয়েছিল, এসব তার নমুনা মাত্র। কিন্তু তার চেয়েও গুরুতর সমস্যা দেখা দিল সুপ্রিম কোর্টের ভিত্তি নিয়ে।
আগেই বলা হয়েছে কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট বসেছিল ইংরেজের নিজস্ব আদালত প্রাচীন মেয়রস কোর্টের বিকল্প হিসেবে। মেয়রস কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭২৬ সালে রাজা প্রথম জর্জের অনুমতিক্রমে। ১৭৭২ সালে দেওয়ানি বিচারের নব্য ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রাখার জন্যে, তার জায়গায় কোম্পানির নিজ এক্তিয়ারের অন্তর্গত মানুষের প্রয়োজনে অধিকতর শক্তিশালী একটি আদালতের কথা উঠল। সে বছর হাউস অব কমনসে সে দাবি বিশেষ আমল পেল না বটে, কিন্তু এক বছর পরেই ১৭৭৩ সালের ১০ জুন হাউস অব কমন্সে গৃহীত হল লর্ড নর্থের সেই বিখ্যাত বিল। সেই বিল আইনে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৭৭৪ সালের ২৬ জুন আবির্ভূত হল বিখ্যাত সুপ্রিম কোর্ট।
মেয়রস কোর্টের বিকল্প সুতরাং নবপ্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্টের এক্তিয়ার নির্দেশ করা হল বাংলা, বিহার এবং ওড়িশার ব্রিটিশ প্রজাদের যে কোনও অপরাধ, ফোর্ট উইলিয়াম তথা ইংরেজাধীন কলকাতার নাগরিকদের অপরাধ এবং গভর্নর জেনারেল ছাড়া কোম্পানির যে কোনও কর্মচারীর অপরাধের বিচার। স্থির হল ১৭২৬ সালের ইংরেজি আইন অনুযায়ী এই বিচার সম্পন্ন হবে। দাবির টাকার পরিমাণ চার হাজারের বেশি হলে খাস ইংল্যান্ডের রাজ দরবারে আপিল করা চলবে। অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্ট জন্মসূত্র, জন্মলক্ষণ এবং প্রতিশ্রুত জীবন অনুযায়ী সব দিক থেকেই ইংরেজি ব্যাপার।
সুতরাং, কাজে নামামাত্র গোল বেঁধে গেল। নয়া ধর্মাধিকরণের ভিত্তিগত দুর্বলতা ধরা পড়ে গেল। উপলক্ষ: কাশিজুরার জমিদার।
জনৈক কাশীনাথবাবু সুপ্রিম কোর্টের দরবারে আর্জি পেশ করলেন: কাশিজুরার জমিদার মহোদয় তাঁর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছেন, কিন্তু এখন আর ফিরিয়ে দেবার নাম নেই। কথা ছিল, টাকার অঙ্ক যদি পাঁচশোর বেশি হয় এবং বিবাদী দুই পক্ষ যদি একমত হয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন, তবে তাঁরা কোম্পানির খাস প্রজা না হলেও সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের ন্যায় বিচারের আলোক দেখাতে পারেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ সদ্য জাহাজ থেকে নেমেছিলেন। সুতরাং কাশীনাথবাবুর অভিযোগ অনুসারে তাঁরা তলব করে বসলেন কাশিজুয়ার রায়বাহাদুরকে। তিনি সে সমন হাতে নিলেন না। কেননা, গভর্নর জেনারেলের হুকুম আছে, জমিদাররা, বিশেষ করে যাঁরা কোম্পানির কর্মচারী নন, তাঁদের উপর সুপ্রিম কোর্টের কোনও অধিকার নেই। সুতরাং, সমন নিয়ে রাজাকে দ্বিতীয়বার খুঁজতে গিয়ে শেরিফ এবং তাঁর লোকজনেরা কাশিজুরা থেকে বেদম প্রহার খেয়ে ফিরে এলেন। বাধ্য হয়েই সুপ্রিম কোর্ট এবার আদেশ দিলেন, তাঁর জমিজমা সম্পত্তি সব বাজেয়াপ্ত করতে। রাজা যতক্ষণ আদালতে ধরা না দিচ্ছেন, ততক্ষণ তাঁর ছাড়া নেই।
শেরিফ কলকাতা থেকে পঞ্চাশ ষাট জন নাবিক, ভবঘুরে ইত্যাদির সৈন্যবাহিনী সাজিয়ে আদালতের হুকুমনামা নিয়ে কাশিজুরা যাত্রা করলেন। সে খবর কানে আসা মাত্র গভর্নর জেনারেল মেদিনীপুরের সেনাধ্যক্ষকে আদেশ পাঠালেন, শেরিফকে বন্দি করতে। তিনি কোম্পানির কর্মচারী, সুতরাং রাজধানীর আদেশ উপেক্ষা করলেন না। শেরিফ বন্দি হলেন। সে খবর পেয়ে সুপ্রিম কোর্ট আবার নতুন আদেশ জারি করলেন। তাঁরা ঘোষণা করলেন যাঁরা শেরিফকে বন্দি করেছে তাঁরা আদালতকে অপমান করেছে। সুতরাং তাঁদের যাবতীয় সম্পত্তি আটক করা হবে এবং যথাযোগ্য আইন অনুযায়ী তাঁদের বিচার হবে। বলা বাহুল্য, সে রায় কার্যকর করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের ছিল না। আদালতের লোকেরা আবার লাঞ্ছিত অপমানিত হয়ে মেদিনীপুর থেকে ফিরে এল। দেখতে দেখতে পরিস্থিতি এমন জটিল হয়ে উঠল যে, সুপ্রিম কোর্ট শুধু যে দেশীয়দের মধ্যে হাসির উপলক্ষ হল তাই নয়, তার ভিত নিয়েও সন্দেহ দেখা দিল। বিচক্ষণ হেস্টিংস সে ভরাডুবি থেকে ইংরেজের ইজ্জতকে বাঁচাবার চেষ্টায় অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার ইলাইজাকে নিযুক্ত করে বসলেন, কোম্পানির আদালত সদর দেওয়ানি আদালতেরও প্রধান বিচারপতি। তাতে অবশ্য তখনকার মতো দুই কুঠির বিবাদ-বিসম্বাদের মীমাংসা হল বটে, কিন্তু প্রধান বিচারপতির মাহাত্ম্য যে খর্বিত হল, সে কাহিনী সুবিদিত। কেননা, নতুন পদ বাবদে যে ‘ঘুষ’ ইলাইজা পকেটে পুরেছিলেন, সেটা তো ফিরিয়ে দিতে হলই, সেই অপরাধে স্যার ইলাইজার বিচারও হয়ে গেল। ভারতীয় আদালতের ইতিহাসে সেটিই সম্ভবত প্রধান বিচারপতির প্রথম ও শেষ বিচার।
তবে কী গঙ্গাতীরে কী টেমস নদীর উপকূলে, সুপ্রিম কোর্টের দীর্ঘ অষ্টাশি বছরের জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিচার অবশ্যই মহারাজা নন্দকুমারের বিচার। সে বিচার-কাহিনী আজও মুখে মুখে এদেশে প্রবাদ হয়ে আছে। বাংলায় তখন সবচেয়ে উত্তপ্ত আলোচ্য নন্দকুমারের বিচার, আর সবচেয়ে জনপ্রিয় ছড়ার বিষয় ইংরেজের আইন:
‘আজগুবী এক আইন হয়েছে
কৌলচলিদের সাথে হেস্টিন
ঝগড়া বাঁধিয়েছে
হায়রে হায় একি হোল
বামুনের ফাঁসি হোল,
নন্দকুমার মারা গেল
গুরুদাস ধুলোয় পড়েছে।’
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, ঐতিহাসিক মোকদ্দমার দীর্ঘস্থায়ী চাঞ্চল্যের একটা কারণ ‘বামুনের ফাঁসি’ হলেও সাধারণ লোকের মনে সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না যে নন্দকুমারকে হত্যা করেছে যে রজ্জু সেটি আইন নয়, ‘কৌলচলিদের সাথে হেস্টিনের ঝগড়া বা ভিতরকার ষড়যন্ত্র। স্যার জেমস স্টিফেন, রবার্টস প্রভৃতি ইংরেজ ঐতিহাসিকরাও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যাচাই করে দেখেছেন, সেটা অমূলক সন্দেহ নয়। কেননা, ১৭৭৫ সালের মে মাসে মোহনপ্রসাদ যে উইলটি উপলক্ষ করে মহারাজার বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন, তা ছিল পাঁচ বছর আগেকার। দ্বিতীয়ত, নন্দকুমার ভারতীয় ছিলেন। তৃতীয়ত, যে আইন অনুযায়ী নন্দকুমারের ফাঁসি হয়েছিল, সেটি ভারতে প্রয়োগ করবার অধিকার পাওয়া গিয়েছিল কমপক্ষে পাঁচ বছর পরে। চতুর্থত, প্রথা বিস্মৃত হয়ে বিচারকরা সেদিন নিজেরাই আসামিপক্ষের কাউন্সেলকে জেরা করেছিলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। পদে পদে আইন লঙ্ঘনের এইসব নজির দেখিয়েই স্টিফেন সুপ্রিম কোর্টের সেই কলঙ্কিত অধ্যায়টির নাম দিয়েছিলেন, ‘মিসক্যারেজ অব জাস্টিস।’ রবার্টস সেদিনের কাউন্সিল সদস্যদের মৌনতা সম্পর্কে লিখেছেন:
‘It casts the darkest and most sinister shadow over the reputation of the men, who used him (Nuncoomar) for their own purpose and then callously and contemptuously flung him to the wolves.’
ময়দানের ওপারে সদর দেওয়ানি আদালতেও, বলতে গেলে তখন প্রায় একই ইতিহাস। ওখানকার আদালত শেষে মাঠ পেরিয়ে লোকেরা আসতেন। আসতে আসতে ‘জজেস ওয়াক’ নামে জজ সাহেবদের জন্যে স্বতন্ত্র রাস্তাটার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতেন, কানে কানে ইংরেজি আইনের পোশাকি মাহাত্ম নিয়ে হাসাহাসি করতেন, তারপর এসে ভিড় করতেন এপারে সুপ্রিম কোর্টের উঠোনে। উভয় অঙ্গন ঘিরেই তখন প্রবল গুঞ্জরণ।
সুতরাং অবশেষে কর্নওয়ালিস থেকে স্যার জন শো অবধি পর পর কয়েকজন গভর্নর জেনারেলের উদ্যোগে সংস্কারের পর সংস্কার হতে হতে শেষ পর্যন্ত কথা উঠল, পুরানোকে সমূলে বিদায় দিয়ে নতুনকে প্রতিষ্ঠা করবার। হাইকোর্ট সেই জরুরি প্রয়োজনেরই উত্তর। তার প্রতিষ্ঠার পিছনে কোম্পানির অধিকার বিস্তৃতির ধারাবাহিক ইতিহাস যেমন আছে, যেমন আছে ইংরেজি বিচারপ্রথা চালু করবার চেষ্টা, তেমনি ভারতীয়দের মনে পশ্চিমী ন্যায় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ফাটলগুলোকে বোজানোর চেষ্টাও। মনে রাখতে হবে, হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার আগে সিলেক্ট কমিটি সুপ্রিম কোর্টের কার্যধারা অনুসন্ধান করে যেমন নির্দ্বিধায় মন্তব্য করেছিলেন:—
‘The court has been generally terrible to the natives and has distracted the Govt of company.’
তেমনি ইংরেজের আদালত দেখে পাবনার গ্রাম্য কবি মন্তব্য করেছিলেন: ‘কাজের কিছু নাহি ছল, দুধের দুগ্ধ জলের জল জজের আমলার ধর্ম বটে।’ তা ছাড়া, এই হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার আগে খাস বিলেত থেকে শুধু যে দু-দু’টি আইন কমিশন (১৮৩৪ এবং ১৮৫৩) বসেছিল তাই নয়, ভারতে মহাবিদ্রোহ নামে একটি প্রলয় হয়েছিল, যার বেপরোয়া তলোয়ারের মুখে প্রকারান্তরে ঘোষণা ছিল: ধর্মরাজ্য, ন্যায়ের শাসন।
শতবর্ষ পরে, আলোয় আলোয় স্বপ্নের মতো একশো আশি ফুট উঁচু মহাধিকরণের চুড়োটার দিকে তাকাতে গিয়ে তার ভিতের নীচে অবলুপ্ত সেদিনের সেই ইতিহাসের কথাটাই কেন যেন আরও বিশেষ করে মনে পড়ে।
লালবাজার: লাল পাগড়ি
লালবাজার। লালবাজারের নাম শোনামাত্র যাদের হাত থেকে বাজারের থলিটা খসে পড়ে যায়, তাঁদের কথা হচ্ছে না। এমনকী ‘লালবাজার’ শুনলেই যাঁদের নানাবিধ (তথাকথিত) কালো আইনের কথা মনে পড়ে যায়, তাদের কথাও না। আমরা বলছি, লোকে যাঁদের বলে পাঁচজন, সেই বউবাজার-চিৎপুরের ট্রামযাত্রীদের কথা। কলকাতার সাধারণ মানুষের কথা। লালবাজার তাদের কাছে বাজার নয়, একটা ইটের বাড়ি। লাল বাড়ি। চিৎপুর আর বউবাজারের মোড়ের এ সি ডি সি কন্ট্রোল রুম, লক-আপ, ওয়ারলেস ভ্যান, পুলিস-কুকুর ‘লাকি’, ‘মিতা’ প্রভৃতিরা থাকেন।
কলকাতার বাইরে যাঁরা থাকেন, লালবাজার তাঁদের কাছে আরও রহস্যময়। অনেকটা সেই অদেখা মস্কোর রেড স্কোয়ারের মতো। শুনলে মনে হয়, সব কিছুই বোধ হয় সেখানে লাল। ঘাস, মাটি, জমি, ফুল, ফল, বেড়া সব। এমনকী, সম্ভবত উপরের আকাশটুকুও।
তবে লোকাল ট্রেনের চাকার সীমানায় যে বৃহত্তর কলকাতা, তার বাসিন্দারা সে বাড়িটা সত্যিই লাল কি না, সেটা সঠিক না জানলেও একটা বিষয়ে নিশ্চিত যে, কলকাতায় নামলেই এখানে ওখানে ছড়ানো-ছিটানো শিমুল ফুলের মতো যে লাল পাগড়িগুলো চোখে পড়ে, তারা সকলেই নিশ্চয় এক মঠের শিষ্য। এবং নিশ্চয়ই লালবাজারই সেই মঠ, সেই বিহার।
ডাকু নয়, খুনি নয়, একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করা পণ নয়, ছাপোষা মানুষ যাঁরা, পেনাল কোড যাঁদের কাছে মস কোডের মতো এক ধরনের টেলিগ্রাফের টরে টক্কা, এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ যাদের কাছে বলপ্রয়োগের জন্যে তৈরি জোয়ানবাহিনী, একশো বছর পরে মোটামুটিভাবে আজও তাদের কাছে লালবাজারের এই-ই পরিচয়। আজও লালবাজার বলতে তাঁদের চোখে ভাসে একটা লাল বাড়ি আর অগুন্তি লাল পাগড়ি। শুধু লাল বাড়ি আর লাল পাগড়ি। কিন্তু তাই কি?
লাল পাগড়ি চিৎপুর আর বউবাজারের মোড়ের ওই লাল বাড়ির অন্যতম পরিচয় সন্দেহ নেই, কিন্তু তবু লালবাজারের কথা শুনলেই কেন যেন আমার মনে পড়ে যায় একটি রক্তবর্ণ মানুষের কথা, মাইকেল গ্রেসের কথা।
সে অনেক, অনেককাল আগের কথা। হিসেব করলে, লাল পাগড়ির শতবার্ষিকীর দিনে গ্রেস সাহেবের কমপক্ষে পৌনে দুই শতাব্দী উদ্যাপনের দিন হয়ে যায়। কলকাতার প্রথম বাজার লালবাজার তখন লাল পাগড়ির হাট নয়, সত্যিই ‘বাজার’। এবং সত্যি সত্যিই সে বাজার তখন লালে লালে লালাকার। যেন লাল কলাবতীর ঝাড়। ও পাশে লাল দিঘি, লাল মন্ত্ৰীশাল, এ পাশে লাল গির্জা তথা মিশন চার্চ মাঝখানে বসন্ত-দিনে লাল আবিরের মস্ত বাজার। বাঙালি গবেষকরা বলেন: লালদিঘির মতো, এ ফাগ গায়ে মেখেই লালবাজার তখন ‘লাল বাজার’। লং সাহেবের মতে অবশ্য লালবাজার ‘লাল’ হয়েছে মিশন চার্চের লাল রঙ দেখে।
সম্ভবত ওঁরা দুজনেই সঠিক। কিংবা হয়তো বা সত্য সেই ইতিহাসে অনুল্লেখিত তৃতীয় জন যার নাম পালকিওয়ালা। সোয়ারি সাহেবরা ছিলেন ওদের কাছে লাল মানুষ বা রাঙা মানুষ। সুতরাং তারা যখন লাল, তখন তাদের হাট কি কখনও নীল বাজার হয়? কাছেই নীল হাট যে বিল্ডিং সেটি নীল-দর্পণের কালের স্মারক হলেও, বাড়িটি হাল আমলের।
কারণ যাই হোক, লালবাজার তখন দ্বিতীয় লন্ডন। এখানে থিয়েটার হল আছে, ক্লাব আছে, এখানে হোটেল আছে। সে হোটেলের নাম লন্ডন ট্যাভার্ন। তা ছাড়া, এখানেই কলকাতার জমিদারের কাছারি, কালেক্টরের অফিস, এখানেই বিখ্যাত মেয়রস কোর্ট বা কলকাতার প্রথম জেলখানা এবং এখানেই পালকি চড়ে আপিস করতে আসতেন ‘হেড কনস্টেবল’ মাইকেল গ্রেস। কলকাতার প্রথম লাল পাগড়ি, পহেলা পুলিশ।
সে ১৭৮৫ সালের কথা।
তার আগেও পুলিশ ছিল কলকাতায়। তবে তারা পুলিশ নয়, চৌকিদার, কতোয়াল। জমিদারের হয়ে তারা কর আদায় করত, ‘শান্তি রক্ষা’ করত। ১৭০৫ সালের একটা সরকারি চিঠিতে জানা যাচ্ছে, কতোয়ালের কপালে আগুন। তার ‘কাছারি’টি পুড়ে গেছে। একটা বিহিত করা আবশ্যক। উত্তরে বোর্ড লিখেছে, ইচ্ছে হলে ইটের বাড়িই করে দিতে পারো ওকে, তবে দেখবে, খরচ যেন কিছুতেই দেড়শো টাকার বেশি না হয়। স্বয়ং পুলিশ কমিশনারের যেখানে এই অবস্থা, সেখানে তদানীন্তন পুলিশ কর্মীদের সমাচার অনুমেয়। মাচান বেঁধে তখন বকসারের লোকেরা এসে কলকাতায় চৌকি দিত।
১৭৩৭ সালে একবার ভীষণ ঝড় হয়েছিল কলকাতায়। সেবার চিঠি গেল: বকসারিদের এগারোটি চৌকি ভেঙে গেছে, অবিলম্বে সেগুলো সারাই করা আবশ্যক। কেননা, অন্যথায় পুলিশের কাজ অচল হয়ে পড়বে।
পুলিশের তখন অনেক কাজ। প্রধান কাজ: খাজনা আদায়। সে আদায়ের কৌশলও কলকাতাচিত। বোল্ট সাহেব লিখেছেন: ‘It is a common thing to see the sepoys who are guards at differnt places, take from the poor as they pass, something of everyones basket.’ সুতরাং, আজকের পথের কোটাল ঐতিহ্যহীন নন!
এমনকী বহু বছর পরে, ১৮২৪ সালে কলকাতা পুলিশের নামে শোনা গেছে এ ধরনের অপবাদের কাহিনী। ‘বঙ্গদূত’ কাগজের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সে বছর কলকাতায় পুলিশ নিয়ে কমিশন বসেছিল একটা। কেননা ‘কিয়ৎকাল হইল ম্যাজিস্ট্রেটদিগের অমনযোগ ও পুলিশের চৌকিদারদিগের দৌরাত্ম্য বিষয়ক অপবাদে সম্বাদপত্র পরিপূর্ণ হইতেছিল।’ কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল, তারা এমন নব্য ব্যবস্থা প্রবর্তন করবেন, যাতে ‘পুলিশ সম্পর্কীয় দৌরাত্ম্য সম্যক রহিত হয় এবং পুলিশের যথার্থ তাৎপর্য দুষ্টের দমন ও প্রজালোকের নিরুপদ্রবে কালযাপন তাহাও সিদ্ধ হয়।’ তা কতদূর সিদ্ধ হয়েছে বুঝতে হলে, জনসাধারণের মনের গহনে ডিটেকটিভ না পাঠিয়ে সরাসরি একবার পাবলিকের কাছে জানতে চাইলেই বোধ হয় আজকের কমিশনের পক্ষে সত্য নির্ণয় সহজতর হয়। নয় কি?
সে যাই হোক, খাজনা আদায়ের মতো দুষ্টের দমনও যে পুলিশের তখন অন্যতম কর্তব্য ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ করার কোনও হেতু নেই। কেননা, কালেকটার এবং তাঁর ডেপুটি ব্ল্যাক জমিদারের বৈঠকখানার আদালত ছাড়াও এই লালবাজারের অদূরে ছিল ওল্ড কোর্ট। সেই কোর্ট থেকেই ওল্ড কোর্ট হাউস। রাস্তাটা থাকলেও মহা মহা তস্য মহা, মহাধিকরণের সেই বাড়িটা আর আজ নেই, যেখানে বহু দোষী-নির্দোষ ঘড়ি-চোর, থালা-চোর, সাহেবের ছেঁড়া জুতা, মেমসাহেবের বাজারের পয়সা চোরের বিচারালয়। তার ভিতেই আজ দণ্ডায়মান সেন্ট অ্যান্ড্রুর গির্জা। আজ আর দেখে বোঝবার উপায় নেই, এর মজবুত ভিতের নীচেই, কলকাতার মাটির গভীরে শায়িত আছে বেচারা ব্রিজমোহন। সেই ব্রিজমোহন, পঞ্চাশ টাকা দামের একটি ঘড়ি চুরির দায়ে যার একদিন প্রাণদণ্ড হয়েছিল এখানে দণ্ডায়মান কোর্ট বাড়িটি থেকে।
অদূরেই লালবাজার কয়েদখানা। চৌদ্দ ফুট উঁচু চাকা-লাগানো একটা কাঠের বাক্স। কয়েদখানা থেকে বের হয়ে দু’পাশের ঘরবাড়ি, লোকজন কাঁপিয়ে এসে দাঁড়াত কোর্টের সামনে। তার ভিতরে অপরাধী। না, এভাবে আনা হয়েছে বলেই তার মরে যাওয়ার কোনও কারণ নেই। কেননা, গাড়ির উপরে দুটো ফুটো আছে। শ্বাস টানার ক্ষমতা আছে যাদের, তাদের পক্ষে বাতাস সে পথেই পর্যাপ্ত।
বিচার-শেষে কলকাতার সেইসব অশিষ্ট নাগরিকদের টেনে নিয়ে যাওয়া হত আর একটু দূরে, চৌরাস্তার মোড়ে। সেখানেই ‘পিলারি’, শাস্তি মঞ্চ। বউবাজার-চিৎপুরের লোকে লোকে রাস্তা সেদিন অরণ্য হয়ে উঠত, কলকাতার জনতা কলকাতা পুলিশকে চাক্ষুস দেখতে পেত। এই পীড়ন যন্ত্রটিকে বাংলায় বলা হত—তুডুম ঠোকা।
‘হেড কনস্টেবল’ গ্রেস লালবাজারের সেই অন্ধকার দিনের মানুষ নন, তিনি কিছুকাল পরের ‘লাল পাগড়ি’। তাঁর কার্যারম্ভের বছর ১৭৮৫৷
গ্রেস সাহেবের লালবাজার যে-কলকাতার পুলিশ হেড কোয়ার্টাস, তার লোকসংখ্যা ছিল চার লক্ষের ওপর। কিন্তু ‘লালপাগড়ি’ ছিলেন কত জানেন? গ্রেসকে নিয়ে মাত্র চারজন। বাকি তিনজন মাইকেল ফ্ল্যাভিন, টমাস সিম্পসন এবং জন রূপ। ওরা ‘কনস্টেবল’। গ্রেস ‘হেড কনস্টেবল’। তাঁদের ওপরওয়ালা বলতে আর যিনি আছেন শহরে, তিনি কলকাতার শেরিফ।
কোম্পানির ম্যাজিস্ট্রেটরাও ছিলেন বটে শহরে। পুলিশকে খাটাতেনও তাঁরাই। কেননা, শুধু বিচার নয়, অপরাধ নির্ণয়, অনুসন্ধান ইত্যাদিও ছিল তাঁদের কাজ। কিন্তু তাঁরা নিজেরাই তখন শেরিফের এক্তিয়ারভুক্ত। সুতরাং, লাল পাগড়ি ম্যাজিস্ট্রেট নিরপেক্ষ। হেড কনস্টেবল গ্রেস নিজেই নিজের প্রভু, নিজের ভৃত্য।
ভৃত্য বলছি, কারণ, নিজের ভৃত্য না হলে কখনওই চার মানুষে এতগুলো কাজ সম্ভব হয় না। গ্রেস আপিস করতেন, খাতা লিখতেন, কোর্টে কয়েদিসহ হাজিরা দিতেন, দণ্ডদানের ব্যবস্থা করতেন এবং কী নয়। বিশেষ করে লালবাজারের ঐতিহাসিক জেলখানাটি ছিল তাঁরই পরিচালনাধীনে।
পুলিশ বাড়িটা ছিল জন পামার নামে এক ব্যবসায়ীর বাড়ি। পামার হেস্টিংসের বিশেষ বন্ধু ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর বাড়ির উলটো দিকেই ছিল জেলখানা। মানে, লম্বায় একশো ফুট আর চওড়ায় চল্লিশ ফুট একখানা বাড়ি। ভিতরে ছিল পুকুর। কয়েদিরা সেখানেই স্নান করত, কাপড় কাচত। গরমের দিনে পুকুরের ধারে সাহেব কয়েদিরা নিজেদের খরচায় সারি সারি ছাউনি তুলত। খাবারও খেতে হত তাদের নিজেদের পয়সায়। তবে মাঝে মাঝে বাইরে থেকেও আসত। বন্দিরা কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলতেন না। যথা: এই গরমে আমাদের যাঁরা কোল্ড বিয়ার পাঠিয়েছেন, তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ।
লালবাজার কয়েদখানায় একটা অসুবিধে ছিল। মেয়ে আর পুরুষের জন্যে এখানে স্বতন্ত্র কোনও ব্যবস্থা ছিল না। অন্তত ১৭৬৭ সালের একটি বিবরণে তাই বলে। তবে বাড়ি একটা হলেও গেট ছিল দুটো। একটা ঋণের দায়ে আটক (পলিটিক্যাল নায়কদের জন্য নয়) কয়েদিদের জন্যে, অন্যটা স্রেফ অন্যদের জন্যে। উল্লেখযোগ্য, ১৭৮৩ সালে বেঙ্গল গেজেটের বিখ্যাত সম্পাদক জেমস অগস্টাস হিকি এখানে যাপন করেছিলেন তাঁর বন্দি জীবন।
এ ছাড়াও আর একটি কয়েদখানা ছিল তখনকার কলকাতায়। সেটি কতোয়ালের কয়েদ। সেখানে যারা থাকত, তারা প্রধানত ব্ল্যাক টাউনের নাগরিক এবং অপরাধী হিসেবে মামুলি। উত্তর কলকাতায় তাদের সেই কারাগারকেই বলা হত নাকি—হরিণবাড়ি। এই দুটি পৃথক কয়েদখানা মিলেই ১৭৮১ সালে তৈরি হয়েছিল ময়দানের জেলখানা ওরফে বিরজি জেল, ওরফে হরিণবাড়ি। আজ সেখানে ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল।
যা হোক, লালবাজারের এই লক আপ নিয়েই লালদিঘির তীরে গ্রেস সাহেবের দিন দিব্য চলে যেত। ১৮০৩ সালে কনস্টেবল একটু বাড়ল। তাদের সংখ্যা দশ হল। তিন বছর পরে আরও একজন যোগ হল। এবার থেকে এগারো। ১৮১৫ সালে আরও এক বেড়ে বারো হল। ব্যস, সেখানেই শেষ। তারপর ১৮৫০ সাল অবধি হেড কনস্টেবল অনেক অদল বদল হয়েছেন, কিন্তু ফৌজ বারো জনের সংখ্যা ছাড়ায়নি। কেননা, সেটা সহজ ছিল না।
১৮৫৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রস্তাব উঠেছিল একবার। ক্লার্ক অব দ্য ক্রাউন লিখেছিলেন, আমাদের এখানে অন্তত ছ’ জন কনস্টেবল দরকার। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে হেড কনস্টেবল উত্তর পাঠালেন, ‘পাব কোথায়? আর পেলেই বা টাকা দেবে কে?’
দু’জন কনস্টেবলের জন্যে সুপ্রিম কোর্ট তখন মাসে মাসে বত্রিশ টাকা দিতেন ম্যাজিস্ট্রেটকে। অথচ একজন কনস্টেবলের মাইনেই বত্রিশ টাকা। অর্থাৎ কিনা যাঁরা আছে, তাঁদেরই মাইনে জোটে না। রোববারে রোববারে ভিড় নিয়ন্ত্রণ বাবদ দুটো চার্চ থেকে একজনের মাইনে পাওয়া যায়। বাদবাকিদের কী করে চলে সে জানেন শুধু তাঁরাই, যাঁরা লালবাজার চালান। সুতরাং, প্রস্তাব হল সুপ্রিম কোর্ট যদি বত্রিশকে বাড়িয়ে তিপ্পান্ন টাকা করতে পারে, তবে আমরা একজন পুলিশ বাড়াতে পারি।
এই ছিল সেদিনের লালবাজারের হালচাল। কোথায় তখন রাশি রাশি লাল পাগড়ি, কোথায় সারি সারি গাড়ি, কোথায় স্কন্ধে স্কন্ধে খচিত তারকা। প্রথম পুলিশ কমিশনার এসে ওয়ানচোপ। তিনি সিপাহি বিদ্রোহের পরের মানুষ। তাঁর আগে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সব সুপারিন্টেন্ডেন্ট। তারও আগে হেড কনস্টেবল। তবুও এঁদের মধ্যে অনেকেই আজও বেঁচে আছেন কলকাতার স্মৃতিতে। মট সাহেব আছেন, আছেন রবার্টস, এলিয়ট হগ। এঁরা প্রত্যেকেই লালবাজারের লোক এবং প্রত্যেকেই স্বনামধন্য। রবার্টস কনস্টেবল হিসেবে জীবন শুরু করে ঠিক একশো বছর আগে ‘চেয়ারম্যান অব জাস্টিস’ হয়েছিলেন। আর এলিয়ট? যদিও আমেদ জমাদারের নামের রাস্তাটি তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে, তবুও এলিয়ট নিশ্চয় তাতে রাজি হতেন না। কলকাতায় তাঁর নামে, তাঁর জীবৎকালেই গদ্য রচিত হয়েছিল। কারণ, ডাকাত দমন করে তিনি নগরে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন।
উপসংহারে লালবাজার আর লাল পাগড়ির আর একটা অবদানের কথা। অনেকেই জানেন না, ‘লাল ফিতে’ নামক অত্যাশ্চর্য বস্তুটাও এই লালবাড়িটারই অবদান। প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৮২২ সালের একটা চিঠিতে। শব্দটা ছিল, নাম্বারড অ্যাজ পার মার্জিন, সেই থেকে নাকি রাইটার্স বিল্ডিংসে চিঠিতে চিঠিতে লেখা হয়ে চলল, ইন দ্য মার্জিন অথবা ‘নাম্বারড অ্যাজ পার মার্জিন’। লাল ফিতের জগতে লালবাজারের (?) দ্বিতীয় অবিস্মরণীয় দান ‘আই অ্যাম টু সে।’
বিলেতের ইংরেজেরাও স্বীকার করেন, এই বাক্যাংশটি যিনি প্রথম লিখেছিলেন, তিনি একাধারে শেক্সপিয়র আর টমাস হার্ডি।
লাল পাগড়ি জিন্দাবাদ!
হারিয়ে যাওয়া দুটি চিড়িয়াখানা
‘—তার চেয়ে বরং চলো বারাকপুর।’ নিরিবিলি ঠাঁই সন্ধানীরা এখনও মাঝেমধ্যে পালিয়ে যান বারাকপুর। বারাকপুরের গান্ধীঘাট, আসলে বেলুড়, দক্ষিণেশ্বর কিংবা শিবপুরের গঙ্গাতীরের মতোই আকর্ষণীয়। কিন্তু হেনরি মেরেডিথ পার্কারের কবিতার নায়ক মিঃ সিম্স-এর কাছে বারাকপুর অপ্রতিরোধ্য ছিল অন্য কারণে। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর ছুটিতে তিনি হুগলি নদী বেয়ে হাজির হতেন বারাকপুরে। তারপর সারাদিন ঘুরে বেড়াতেন সেখানকার চিড়িয়াখানায়—‘অ্যান্ড ভিজিট দ্য মিন্যাজ্যারি অ্যান্ড ইন হিজ প্লেজেন্ট ওয়ে ডিক্লেয়ার দ্যাট অল দ্য বিয়ারস ওয়ার বোর্স—অ্যালাস, অ্যান্ড ওয়েল এ-ডে।’
চিড়িয়াখানার কথা পরে। তার আগে সংক্ষেপে বারাকপুরের কথা। বারাকপুরের নাম ছিল এক সময়—চানক। না, জোব চার্নকের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই তার। সাহেবরা বিস্তর ঘাটাঘাটি করে দেখেছেন, কলকাতাওয়ালা চার্নকের সঙ্গে চানকের ঘনিষ্ঠতার কোনও নির্ভরযোগ্য সূত্র তাঁরা বের করতে পারেননি। তার চেয়ে নাকি চাণক্য থেকে চানক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। চানক আবার ছোলাও বটে। ছোলা, সবাই জানেন, ঘোড়া এবং মানুষ দুইয়েরই প্রিয় দানা। প্রিয় চানাচুরও কি চানক-সংহিতা টীকা মাত্র! সে যাই হোক, ‘বারাকপুর’ নাম থেকেই বোঝা যায়, চার্নকের সঙ্গে কোনও সংসর্গ দোষ না ঘটলেও সাহেবদের সঙ্গে এই স্থানটির যোগ ছিল আন্তরিক। বারাকপুর শব্দটা স্পষ্টতই দো-আঁশলা। ওয়াটগঞ্জ বা খিদিরপুরের মতোই সংকর।
কোম্পানির ফৌজি ব্যারাক স্থাপিত হয় সেখানে ১৭৭২ সালে। তাকে ঘিরেই ক্রমে বারাকপুরে দ্বিতীয় রাজধানী, লাট সাহেবের বাগানবাড়ি ইত্যাদি। ম্যাকফারসন এবং কর্নওয়ালিস-এর আমল থেকেই বারাকপুরে কলকাতা নিবাসী লাট বাহাদুরের ‘কানটি সিট’, বা বাগানবাড়ি। তবে বারাকপুরের সত্যিকারের প্রাণপ্রতিষ্ঠাতা লর্ড ওয়েলেসলি। কলকাতার রাজভবনের মতোই বারাকপুরের প্রাসাদও তাঁরই কীর্তি। শুধু প্রাসাদ কেন, বাগান, চিড়িয়াখানা, সব। সার জন শোর ওখানকার বাংলোটাকে তুলে দিয়েছিলেন জঙ্গিঘাট বা কমান্ডার ইন-চিফ-এর হাতে। ওয়েলেসলি সুকৌশলে চাপ দিয়ে সেটি আবার ফিরিয়ে আনেন লাট বাহাদুরের হাতে। গোপনে এক ব্যক্তিগত চিঠিতে সহাস্যে এবং সগর্বে তিনি সে কাহিনী শুনিয়ে গেছেন তাঁর এক বন্ধুকে।
বারাকপুরে ব্যারাক ছাড়া তখন ছিল একটা ‘কটেজ’। অন্তত ওয়েলেসলির চোখে কমান্ডার ইন-চিফ-এর বাড়িটা ‘কুটির’ বলেই মনে হয়েছিল নাকি। ১৮০৮ সালে তিনি কটেজ ভেঙে গড়লেন একটা ‘বাংলো’। এটা লাট বাহাদুরের সাময়িক আস্তানা। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উদ্যোগ শুরু হল। এক বিরাট প্রাসাদ গড়ার কাজ। তার ভিতটুকু হয়েছিল মাত্র। খরচের বহর দেখে কোম্পানির ডিরেক্টররা আঁতকে উঠলেন। পরের বছরই (১৮০৫) তাঁরা ঘরের ছেলেকে ফিরিয়ে নিলেন ঘরে। ওয়েলেসলি বিদায় নিলেন। কিন্তু তার আগেই এই ময়দানব বারাকপুরে বাংলোর নামে বিশাল একটি অট্টালিকা ছাড়াও আড়াইশো একর জমি জুড়ে গড়ে তুলেছেন সুবিন্যস্ত বাগান এবং প্রমাণ-সাইজের একটি চিড়িয়াখানা।
সুতরাং গভর্নর জেনারেলদের বাগানবাড়ি হিসাবে বারাকপুর রয়ে গেল। রয়ে গেল কোম্পানির বাগান এবং চিড়িয়াখানাটিও। ১৮১০ সালে মারিয়া গ্রাহাম নামে এক ভদ্রমহিলা বারাকপুরে বেড়াতে এসে লিখে গেছেন: চাঁদের আলোয় ওয়েলেসলির অসমাপ্ত প্রাসাদটিকে মনে হয় যেন প্রাচীন কোনও ধ্বংসাবশেষ। প্রাসাদের জন্য সংগ্রহ করা মালমশলা সব পরে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল নিলামে। লাট বাহাদুররা ওয়েলেসলির সাময়িক আস্তানাটিকেই গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন স্থায়ী আবাস হিসাবে। তবে সখেদে, এমন কিন্তু মনে হয় না। কেননা পরবর্তী লাট বাহাদুরদের প্রত্যেকেই দেখি, বারাকপুরের নামে পাগল। লর্ড মিন্টো ১৮১২ সালে সাড়ম্বরে সেখানে নিজের বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করেছেন। বিকালে আপ্যায়ন করা হয়েছিল নাকি সাতশো অতিথিকে। কত সাহেব মেম যে ওখানে হনিমুন যাপন করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। একটা বাড়ির নামই হয়ে গিয়েছিল নাকি ‘হানিমুন কটেজ’। অবশ্য বারাকপুরে বিয়োগান্ত কাহিনীও অনেক। দু-দু’ বার সিপাহিদের চোখে আগুন দেখা গেছে সেখানে। কখনও কখনও রাজভবনেই হানা দিয়েছে মৃত্যু। লেডি ক্যানিং দেহরক্ষা করেছেন বারাকপুরেই। এখনও সেখানে রয়েছে তাঁর কবর।
তবু বাবুদের বাগানবাড়ির মতোই বারাকপুরের প্রথম এবং প্রধান পরিচয় আনন্দ নিকেতন হিসাবে। সাধারণত শুক্রবার লাট বাহাদুর নদীপথে পাড়ি জমাতেন বারাকপুরে, কলকাতায় ফিরে আসতেন মঙ্গলবার। ঘাটে বাঁধা থাকত রাষ্ট্রীয় প্রমোদতরী ‘সোনামুখী’। এটি তৈরি করিয়েছিলেন লর্ড হেস্টিংস। তাতে বৈঠকখানা, ড্রেসিংরুম, মার্বেল-বাথ সব ছিল। সোনামুখীর পিছু পিছু চলত সবুজ আর সোনালি রঙের অগুনতি নৌকো। মাঝিমাল্লার গায়ে লাল কোর্তা। লাট সাহেবের নিজস্ব নৌবহর। তা ছাড়া রয়েছে নিজস্ব ১৪৬ হাতির বাহিনী, অশ্বারোহী চারশো অনুচর। সুতরাং সঙ্গে যদিও সব সময় শ চারেক ভৃত্য নিয়ে চলাফেরা করতে হত, তবু বারাকপুর-কলকাতা বা কলকাতা-বারাকপুর করতে কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। অকল্যান্ড-ভগিনী এমিলি ইডেন লিখেছেন: বারাকপুরে পৌঁছে দেখি, আমার ঘরের সামনে উবু হয়ে ঠিক তেমনই কাজ করে চলেছে বুড়ো দরজি। ক’ঘণ্টা আগে কলকাতায় ঠিক এই অবস্থায়ই দেখে এসেছিলাম ওকে। যেন ম্যাজিক। ফেরার পরও তাই। ফিরতে না-ফিরতে টেবিলে আঠারো জনের ব্রেকফাস্ট তৈরি।
লাটবাহাদুররা যখন বারাকপুরে বসে রাজকার্য করতেন, তাঁর পরিবার-পরিজন অতিথি অভ্যাগতরা তখন সময় কাটাতেন নানা আমোদ-প্রমোদে। এক আমোদ ছিল নশো বিঘা জমি জুড়ে সাজানো বাগানে ঘুরে বেড়ানো। নশো বিঘা বা তিনশো একর কেন, কার্জন লিখেছেন, প্রথমে আড়াইশো একর নিয়ে লাট সাহেবের এই খাস তালুকের পত্তন হলেও শেষ পর্যন্ত তার আয়তন দাঁড়িয়েছিল সাড়ে তিনশো একরে। সুতরাং সেজেগুজে প্রজাপতির মতো লঘুপাখায় উড়ে বেড়াতে কোনও অসুবিধে নেই। চরণকমল যদি অবসন্ন হয়ে আসে, তবে চেয়ে নাও একখানা হাতি। বড়লাটের আট থেকে বারোটা হাতি সব সময়ে মোতায়েন থাকত বারাকপুরে। অনেক সাহেব-মেমই জীবনে প্রথম হস্তিদর্শন করেছেন সেখানে। বিশপ হিবারের সেই প্রথম হাতির পিঠে চড়া। ফরাসি পর্যটক ভিকতর জ্যাকমোঁর ক্ষেত্রেও তাই। হাতি সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য—চলমান পর্বত। হাওদায় সব সময় তাঁর কোটের কোণ ধরে বসে থাকতেন নাকি লেডি বেন্টিঙ্ক। তদুপরি বাগানে উপরি পাওনা হিসাবে রয়েছে বিশাল চিড়িয়াখানা। পরবর্তী কালের দর্শকদের কারও কারও ধারণা ছিল, হয়তো এ চিড়িয়াখানা কোনও শৌখিন লাট বাহাদুরের খেয়ালিপনার ফল। এবং দেশীয় রাজারাজড়াদের দেওয়া উপহারই এর আদি মূলধন। সেটা ভুল অনুমান। আসলে ওয়েলেসলির ইচ্ছা ছিল কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পড়ুয়াদের জন্য একটা ন্যাচারাল হিস্ট্রি ইনস্টিটিউশন গড়ে তোলা। গার্ডেনরিচে সেজন্য জমি নেওয়ার কথাও ভাবছিলেন তিনি। এজন্য কিছু জীবজন্তু নাকি সংগ্রহ করা হয়েছিল। কার্জন খুঁজে বের করেছেন ১৮০০ থেকে ১৮০৪ সালের মধ্যে তাদের ভরণপোষণ খাতে ওয়েলেসলি খরচ করেছিলেন সাড়ে তিনশো পাউন্ড। সেই বাগানই শেষ পর্যন্ত স্থান বদল করে বারাকপুরে। এক দীর্ঘ ‘মিনিট’-এ সবিস্তার তিনি খুলে বলেছেন তাঁর পরিকল্পনা: এখানে পশুপাখি সংগ্রহ করে তাদের বিবরণ লেখা হবে, প্রতিকৃতি আঁকা হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি কৃষির উন্নতির জন্যও বারাকপুরে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন, এই ছিল নাকি তাঁর ইচ্ছা। কোম্পানির ডিরেক্টররা ওয়েলেসলির টাকা খরচের বহর দেখে আঁতকে ওঠেন। সে কারণেই হয়তো মিটিংগুলোতে নানা যুক্তির অবতারণা। অন্তত কার্জনের তাই ধারণা। কৃষিপ্রকল্পের উপকারিতা সম্পর্কে ওয়েলেসলির সওয়াল উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, ‘দিস আই অ্যাম সিওর ওয়াজ ইনটেনডেড টু ফ্ল্যাটার দ্য কোর্ট।’
সে যাই হোক, আইডিয়া মাথায় আসামাত্র কাজে নেমে পড়া ওয়েলেসলির স্বভাব। তিনি দেশের সর্বত্র রাজকর্মচারীদের চিঠি পাঠালেন, স্থানীয় জীবজন্তুর নমুনা সংগ্রহ করে পাঠাও। সার্কুলার গেল দেশের বাইরে কিছু ইংরেজ উপনিবেশেও। ডাঃ ফ্রান্সিস বুকানন নিযুক্ত হলেন সংগ্রহশালার তত্ত্বাবধায়ক এবং গবেষক। তিনি অভিজ্ঞ এবং উৎসাহী পশুতত্ত্ববিদ। তাঁকে সাহায্য করার জন্য নিযুক্ত হলেন একজন চিত্রকরও। চিড়িয়াখানার বাজেট মাসে হাজার সিক্কা টাকা। পশুপাখির ভরণপোষণের খরচ পাঁচশো টাকা, চিত্রকরের মাইনে একশো টাকা, একজন কেরানির জন্য চল্লিশ টাকা, চিত্রকরের রং তুলির উনষাট টাকা, আর নতুন জন্তু কেনার জন্য মাসে তিনশো টাকা। দেখতে দেখতে দেশের নানা জায়গা থেকে আসতে আরম্ভ করল বিচিত্র সব জন্তু জানোয়ার। কিছু কিছু এল দেশের বাইরে থেকে। অচিরেই বারাকপুরের চিড়িয়াখানা জমজমাট। বুকানন আর তাঁর চিত্রতারকারা সযত্নে সাজাতে লাগলেন তাঁদের অ্যালবাম। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে ওয়েলেসলির দেওয়া সেই অ্যালবামগুলো এখনও সযত্নে রক্ষিত। মিলড্রেড আর্চার জানাচ্ছেন, গাছপালা এবং জীবজন্তুর প্রায় তিন হাজার রঙিন ছবি সেই সংগ্রহে। তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশই হয়তো বারাকপুরে আঁকা। সেখান থেকেও কোম্পানির কর্তাদের পাঠানো হত চিত্রবন্দি জীবজন্তুর ছবি। নীচে বাংলা, হিন্দি এবং উর্দুতেও লেখা হয়েছে পরিচয়। অনেক ছবিতে রয়েছে দেশি চিত্রকরের স্বাক্ষর। যেমন হলধর, না কি হালদার হবে এটি?
১৮০৪ সালে ওয়েলেসলি বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু পরিস্থিতি অন্যরকম। পরের বছর ছুটি নিলেন ডাঃ বুকানন। তিনি আর বারাকপুরে ফিরলেন না। তারপর কিছুকাল দায়িত্ব চালিয়ে গেলেন কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির এক সদস্য উইলিয়ম লয়েড গিরনস আর একজন স্বেচ্ছাসেবী ডাঃ ফ্লেমিং। নিয়মিতভাবে ছবি যেতে থাকল। ১৮০৮ সালে অবশ্য সে ধারাবাহিকতার ছেদ।
চিড়িয়াখানা কিন্তু তারপরও রয়ে গেল। বলতে গেলে নানা সুদিন-দুর্দিনের মধ্যে বারাকপুরের এই চিড়িয়াখানা বেঁচে ছিল প্রায় পৌনে একশো বছর। ১৮৯০ সালে মারিয়া গ্রাহাম সেখানে বাঘ, ভল্লুক ছাড়াও পেলিক্যান, ফ্লেমিংগো, জাভার পায়রা, ইত্যাদি হরেক পশু-পাখি দেখেছেন। ১৮১৪ সালে লেডি নুজেন্ট দেখেছেন কালো চিতা, উটপাখি আরও কত কী। ১৮১৭-১৮ সালে ৬০৩০ সিক্কা টাকা খরচ করে গড়া হয়েছিল নতুন পক্ষিশালা। ১৮২২ সালে নতুন করে কিছু জন্তুর খাঁচা। দুই-ই লর্ড হেস্টিংস-এর আমলে। ১৮২৩ সালে লর্ড আমহার্স্ট বিশপ হিবারকে বলছেন কী না ছিল এখানে? তিব্বতের বাইসন, দক্ষিণ আফ্রিকার গাধা, ক্যাংগারু, কী নয়। আফ্রিকার ক’টা সিংহ আর কিছু বাঘ দেশীয় রাজাদের দান করে দেওয়া হয়েছে। কেননা, দেখাশোনা করে কে? কিছুকাল পরে ফরাসি দর্শক জ্যাঁকমো লিখছেন: লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই এই চিড়িয়াখানা সম্পর্কে। আর তাই দেখে এক বিমর্ষ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের মন্তব্য: সাম্রাজ্যের দিন অতঃপর শেষ হল। আসলে বেন্টিঙ্ক খরচ বাঁচাতে চাইছিলেন। এমা রবার্টস লিখেছেন চিড়িয়াখানার জন্য তিনি মাসে পাঁচশো টাকাও খরচ করতে রাজি নন। দু’হাতে তিনি জীবজন্তু বিলিয়ে দিচ্ছেন।
লর্ড অকল্যান্ডের আমলে তাঁর বোনদের উৎসাহে চিড়িয়াখানা আবার ফিরে পেল প্রাণ। ১৯৩৭ সালে এমিলি ইডেন জানাচ্ছেন, চিড়িয়াখানা ‘রীতমত ভর্তি।’ বেবুন, জিরাফ, কালো ভল্লুক, সাদা বাঁদর, দুটো গণ্ডার আরও কত কী। কলসওয়ার্দি গ্রান্ট ষণ্ডামার্কা গণ্ডার দুটির ছবি এঁকে গেছেন। বিশাল কচ্ছপেরও উল্লেখ আছে তাঁর বিবরণে। একটি গণ্ডার নাকি ছিল খুনি গণ্ডার। একদিন সে পার্কে বেরিয়ে আসে। পথ দিয়ে তখন দু’জন সিপাই যাচ্ছিল। তাদের একজন বলল, এই শালা। বলেই ছুট। অন্যজনের বয়স কম। সে বলল, পালাব কেন? আমাকে যদি আক্রমণ করে, আমি ব্যাটাকে ছাড়ব না। বলা নিষ্প্রয়োজন, এই অসম লড়াইয়ের অস্ত্রহীন মানুষটি গণ্ডারের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। ক্যানিংয়ের আমলেও টিকে ছিল চিড়িয়াখানাটি। কাবুলের শাসক দোস্ত মোহম্মদ নাকি সেবার জিরাফ দেখে অবাক। তারপর আর বারাকপুরে অবাক করা কোনও দৃশ্য রইল না। লর্ড লিটনের আমলে ওয়েলেসলির চিড়িয়াখানার কাহিনী ফুরিয়ে গেল চিরকালের মতো। কায়ক্লেশে জীবজন্তু তখনও যা ছিল, লিটন তা তুলে দিলেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত আলিপুর চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষের হাতে। জীবজন্তুরা ঠিকানা বদল করেছিল সেদিন। সে দিক থেকে অবশ্য বারাকপুরের স্মৃতি এখনও রক্ষা করছে আলিপুর। আলিপুর চিড়িয়াখানার শতবার্ষিকী উপলক্ষে বারাকপুরের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ছে হারিয়ে যাওয়া আরও একটি চিড়িয়াখানার কথা। সেটি কোনও লাট বাহাদুরের কীর্তি নয়, রাজ্যহারা লখনউ-রাজ ওয়াজির আলি শাহর আশ্চর্য উপহার।
ওয়াজিদ আলি শাহর দুঃখের কাহিনী সকলের জানা। নতুন করে সে-বিবরণ এখানে অবান্তর। হুতোম লিখছেন: ‘সাপুড়েরা যেমন প্রথমে বড় বড় কেউটে সাপ ধরে হাঁড়ির ভিতর পুরে রাখে, ক্রমে তেজমরা হয়ে গেলে খেলাতে বার করে, গভর্নমেন্টও সেই রকম প্রথমে বাদশাকে কিছু দিন কেল্লায় পুরে রাখলেন, শেষে বিষদাঁত ভেঙে তেজের হ্রাস করে খেতে ছেড়ে দিলেন।’ বলা নিষ্প্রয়োজন, এ সব ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের সময়কার কথা। মেটিয়াবুরুজে ওয়াজিদ আলি শাহর খেলা ছিল তিনটি। এক নতুন নতুন সৌধ গড়ে তোলা। দ্বিতীয় গানবাজনা। আর তৃতীয় এই চিড়িয়াখানা। আবদুল হলিম ‘শারর’ নামে লখনউর এক বিখ্যাত লেখক তাঁর এই সব সখের কথা বিস্তারিত লিখে রেখে গেছেন আমাদের জন্য। মুনিরা খাতুন আর গুরুদাস ভট্টাচার্যের উৎসাহে আজ বাংলায়ও তা লভ্য। তা থেকেই মেটিয়াবুরুজের চিড়িয়াখানার বিবরণ কিছু শোনা যাক।
‘ইমারতের পর বাদশাহর শখ ছিল জানোয়ারের। এই শখটিকে তিনি এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তামাম দুনিয়ায় তার সমান্তরাল দৃষ্টান্ত তো নেইই, হাজার চেষ্টাতেও কেউ তার অর্ধেক পর্যন্তও পৌঁছতে পারবে না।’
‘নুর মঞ্জিলের সামনে লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা লম্বা-চওড়া পথ। তার মধ্যে বিচরণ করত শত শত চিতা, হরিণ ইত্যাদি অরণ্য পশুর দল। ঠিক মাঝখানে শ্বেতপাথরে বাঁধানো একটা পুকুর, সর্বদা ভরাভর্তি। তার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল শুতুরমুর্গ, কিশোরী ফিলমর্গে সারস, কায়া, বগলা, করকর চকোর হাঁস এবং আরও নানান জাতের পাখি ও কচ্ছপ। পুকুরের একধারে খাঁচায় থাকত বাঘ। চারণভূমির পাশে, লোহার রেলিং ঘেরা সারবন্দি ঘরে কুড়ির বেশি জাতের, এবং খোদা জানেন, কোথাকার বাঁদর নিয়ে এসে রাখা হয়েছিল।… জলাধারে স্থানে স্থানে মাছ পোষা হত। ইশারা করলেই জড়ো হত, খাবার দিলে নেচেকুঁদে, বাহার দেখাত। সবচেয়ে দর্শনীয় ছিল সর্পগৃহ। শাহান শাহ মঞ্জিলের সামনে একটা দীর্ঘ ও গভীর জলাশয়, তার চার পাশে পাড় পিছল করে নেওয়া, ঠিক মাঝখানে সামনের দিকে ঝোঁকানো একটা কৃত্রিম পাহাড়। পাহাড়ের ভেতর সংখ্যাহীন নালী, দুই এক জায়গায় ওপর থেকে জলস্রোত বইয়ে দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার সাপ। সাপ পোষার এ হেন ব্যবস্থা এর আগে আর কোথাও হয়নি। এই খাস ওয়াজিদ আলি শাহের আবিষ্কার। ইউরোপের পর্যটক অবাক হয়ে দেখত, ছবি এঁকে ও বর্ণনা লিখে নিয়ে যেত।’
এ ছাড়া ছিল ‘পিতল পিঞ্জর’ নামে পাখির ঘর। হাজার হাজার পাখি সেখানে ছিল। আর ছিল আফ্রিকার জিরাফ, বোগদাদি উট, হাতি ভালুক কী নয়। শারর লিখেছেন: ‘এদের সংগ্রহের জন্য তিনি বেপরোয়া অর্থব্যয়ও করেছেন। কেউ নতুন কোনও পাখি বা পশু আনলে যে দাম চাইত, পেয়ে যেত। শোনা যায়, বাদশাহ একবার একজোড়া রেশমপরা পায়রা চব্বিশ হাজার টাকায় এবং একজোড়া সাদা ময়ূর এগারো হাজার টাকায় কিনেছিলেন। সুতরাং শারর শুনলে নিশ্চয় অবাক হতেন না যে, ওয়াজিদ আলি পঞ্চাশ হাজার টাকায় একজোড়া শকুন কিনেছেন। সে খবরও বের হয়েছিল কিন্তু কলকাতায় ‘হরকরা’ কাগজে ১৮৬৭ সালের মে মাসে। হাতে সব টাকা ছিল না। সুতরাং বকেয়া মেটাতে শেষ পর্যন্ত নাকি একটা সোনার পালংক গলিয়ে ফেলতে হুকুম দিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য তা ছাড়া আর উপায় কী, লখনউর বাদশাহের তখন রাজ্য নেই, তিনি পেনসন-নির্ভর অথচ তাঁর চিড়িয়াখানারই খরচ মাসে হাজার হাজার টাকা।
চিড়িয়াখানায় ‘জানোয়ার বাজই ছিল নাকি আটশোর বেশি। কবুতর বাজ তিনশো। ওয়াজেদ আলির মৃত্যুর পর তাঁর সম্পত্তি যখন নিলামে ওঠে তখন এই চিড়িয়াখানার অংশবিশেষ কিনে নিয়েছিলেন নাকি চোরবাগানের মল্লিকরা। সেদিক থেকে মেটিয়াবুরুজের স্মৃতি বহন করছে হয়তো মার্বেল প্যালেসও। বারাকপুরের স্মৃতি যেমন বেঁচে আছে আলিপুরে।
পর রুচি পিনহা
সময় সাড়ে ন’টা থেকে দশটা। তার আগে আসার কোনও দরকার নেই। কারণ, যাঁদের দেখতে আসছেন আপনি, তাঁরা তখনও সব গ্রিন রুমে। কেউ বাগবাজারের গলিতে জামা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, কতক্ষণে বউমা কোটটায় বোতাম লাগানো শেষ করবেন তারই অপেক্ষায়। কেউ পার্কসার্কাসে ঝগড়া বাধিয়ে বসেছেন ধোপার সঙ্গে। কাল সন্ধে বেলায় ইস্ত্রি করতে দিয়ে গেছেন জামাটা, অথচ এখনও নাকি হয়নি। তা রাগ হবার কথা কিনা বলুন। মুরারিপুকুরের খোলা-বাড়ির কেরানিবাবুটিও রেগেছেন। বুড়ি মা, নতুন বউ—সবাই তছনছ করে ফেলেছেন গোটা বাড়ি, কিন্তু কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না চিরুনিটা। এদিকে ন’টা বাজে।
তা বাজুক। আপনার তাড়াহুড়ো করবার কিছু নেই। ড্রপসিন উঠবে সেই সাড়ে ন’টায়। তার আগে নয়। ঠিক সাড়ে ন’টায় এসে পৌঁছবেন বড়বাবু বা কিপলিং সাহেবের ‘ডিপার্টমেন্টাল ডেটি’টি। পৌনে দশটায় মেজবাবুরা। দশটা বেজে দু’মিনিটে সদ্য চাকুরি-পাওয়া কনিষ্ঠ কেরানি পঞ্চক। সওয়া দশটায় টাইপিস্ট মেয়েটি। সাড়ে দশটায় ইউনিয়নের কর্মীরা।
তার পরেও অবশ্য আসবেন অনেকে। কিন্তু সে সওদাগরি হাউসে নয়, সরকারি আপিসে। সেখানে আপিস বসবেই এগারোটার পরে। তার আগে যাঁরা আসেন, তাঁরা সব ক্লাস ফোর অফিসার। অর্থাৎ, বেয়ারা চাপরাশি লিফটম্যান প্রভৃতি। নচেৎ ফাইল-নিউরোসিস কোনও বৃদ্ধ কেরানি। ছোকরারা যাঁকে বলে ‘দাদু’। আসল কেরানিরা আসতে শুরু করবেন এগারোটায়। এক্সপার্টরা আসবেন বারোটা থেকে একটায়। সুতরাং, এঁদের দেখতে হলে একটা থেকে দেড়টার মধ্যে একবার সরেজমিনে ঢুঁ দেওয়াই ভাল। দেড়টার পরে গিয়ে কিন্তু লাভ নেই। কারণ, টিফিনের পরে ওঁদের আবার ট্যুরে বেরুবার সময়।
অবশ্য এঁরা বেরিয়ে গেলেও ক্ষতি নেই আপনার। সাড়ে ন’টা থেকে সাড়ে দশটায় আপনি যা দেখবেন, এঁরা তার চেয়ে বেশি কিছু আপনাকে দেখাতে পারবেন না। এঁদের ওয়ার্ডরোবে সত্যিই নতুন কিছু নেই। একমাত্র যা আছে তা হল খদ্দরের প্যান্ট। উঁচু মহলে এ জিনিসটি ইদানীং একটু খাতির পাচ্ছে বলেই গবেষকদের ধারণা। খদ্দরের প্যান্ট এবং হাওয়াইয়ান শার্টের কম্বিনেশন আমাদের পোশাকের ভাণ্ডারে ব্যুরোক্রাটদের একটা নতুন অবদান। অবশ্য তাঁদের মধ্যে যাঁরা এখনও অনারেবল মিনিস্টারকে পুরোপুরি অ্যাকোমডেট করতে পারেননি, তাঁরা আজও নিম্নার্ধে ট্রপিক্যাল পরেন, ঊর্ধ্বাঙ্গে বাফ্তার হাওয়াই। (বাফ্তা খাদি, সন্দেহ নেই।)
মোট কথা, টুকরো হলেও বিশুদ্ধ খাদি। খাদির এই বর্তমান খাতির অবশ্যই লক্ষণীয়। এককালে আমাদের উপন্যাসের নায়কেরা জন্মদিনে নায়িকাকে খদ্দরের শাড়ি উপহার দিতেন, সিনেমার ‘হিরো’রা প্রেমের উচ্চাদর্শ সম্পর্কে বক্তৃতা করতেন মাথায় গান্ধীটুপি পরে। আর এখন সেক্রেটারি কি ডিরেকটররা সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করছেন, খদ্দরের হাওয়াইয়েন শার্টে। ইতিমধ্যে অনেকেই পৌঁছে গেছেন খাদির টাইতেও।
সে যা হোক, আপনি সময়মতো দাঁড়িয়ে যান। সাড়ে ন’টা থেকে সাড়ে দশটা। বাঙালির পোশাক দেখতে চান তো, এই ব্রাহ্মমুহূর্ত। ডালহৌসির যে কোনও কোণে দাঁড়িয়ে যান। এই সময়টায় আপনার পোশাক কী হবে, তাও বলতে পারি। কিন্তু সে কথা থাক। এটা তো সবার জানা কথা, আপনি শুধু দেখতে আসছেন না, দেখাতেও আসছেন। তা দেখবার যাঁরা, তারা দেখুক। বোম্বাইয়ের সিনেমা সেট থেকে উড়ে এসে এখানে পড়েছেন বলে যদি কেউ ভাবেন, যদি কেউ ভাবেন ফিজি দ্বীপের ট্যুরিস্ট, ভাবুন। ক্ষতি নেই। উপস্থিত আপনি দেখুন। দেখবেন, আপনার সামনে চলেছে এক বিচিত্র ফ্যাশন প্যারেড। কিংবা বলতে পারি ‘ফ্যান্সি বল’। কারও পোশাকের সঙ্গে মিল নেই কারও। প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র, প্রত্যেকেই পোশাকে ইনিডিভিজুয়্যাল। অবশ্য সমাজবিদ্যামতো এত বেশি নিশ্চয়ই নয়। বড়বাবুকে দেখুন। পায়ে ব্রাউন রঙের গ্লেজকিডের পামপ শু, উরুর সঙ্গে গার্টার দিয়ে টানা দেওয়া হাফ মোজা। ন’গজ চুয়াল্লিশ ইঞ্চি মিহি ধুতি। কোঁচাটি জুতো থেকে আধ হাত উপরে। গায়ে গলাবন্ধ সাদা কোট। বড় বড় পকেট, বড় বড় পিতলের বোতাম। জীবন্ত ‘হবসন-জবসন’। ইতিহাসের একটি আস্ত অধ্যায়। একাধারে তিনি ইংরেজ এবং বাঙালির সার্থক সমন্বয়। পায়ে তাঁর মোজাহীন শু। ফিতেগুলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কৌশলে গোছানো। জুতো পরতে বা খুলতে ওদের কোনও ঝামেলা নেই। মেজবাবুর ইংলিশ-কফ শার্টের আধখানা ধুতির নীচে নির্বাসিত। গলার শেষ বোতামখানা করছে টাইয়ের কাজ। অবশ্য মাফলারও আছে তাঁর। কিন্তু উপস্থিত সেটি কোর্টের পকেটে। অন্য পকেটে ব্যালান্স রাখছে বাজারের থলিটি। বাজারে যদি ওঁকে লক্ষ করেন, তবে দেখবেন, উনি জামা এবং কোর্ট থাকা সত্ত্বেও পয়সা বের করছেন কোমরে গুটানো রুমাল থেকে। আর নোটের প্রয়োজন যদি হয়, তবে থলিতে নামতে হবে ওঁকে। প্রথমে কোটের আস্তরন পেরিয়ে পৌঁছতে হবে শার্টে, তারপর শার্টের বোতাম খুলে নীচের বেনিয়ানে। তাও হাতে বেনিয়ান ঠেকা মানে টাকা পাওয়া নয়। টাকা থাকে তারই নীচে বেনিয়ানের উলটো দিকের গুপ্ত পকেটে, মেজবাবুর চামড়ার সঙ্গে মিশে কলজে ঘেঁষে।
কেরানিদের মধ্যে এসব বনেদিয়ানা নেই। তাঁদের বৈশিষ্ট্য, আট আনা চুলে-গোঁফে হাঁটার ভঙ্গিতে এবং কথা বলার স্টাইলে, বাকি আট আনা পোশাকে। তবুও অবহেলা করবেন না ওঁদের। কারণ, বঙ্গীয় ফ্যাশান জার্নালের এঁরাই লেটেস্ট নাম্বার। সিনেমার নায়কদের সর্বশেষ হালচাল থেকে রোয়াকের মতিগতি একমাত্র ওঁদের পোশাকেই স্বল্পায়াসে লভ্য। ওঁরা পেশায় কেরানি বটে, কিন্তু জাতিতে কালচারাল। সুতরাং নিউকাটের চেয়ে কোলাপুরি কিংবা হাওয়াইয়ান ওঁদের বেশি পছন্দ। প্যান্টের পরেই ওঁরা পরতে ভালবাসেন পাজামা এবং অবশেষে ধুতি। ধুতি হলে মিহি হাওয়া চাই। পাঞ্জাবিটা রঙিন খদ্দর হ্যান্ডলুম হলেও চলবে, কিন্তু ধুতিখানা শ’ দেড়শ’ টাকা জোড়ার কমে নয়। ইউনিয়নের তিনি অ্যাকটিভ মেম্বার কি না তা বুঝতে হলে লক্ষ করতে হবে, জামাটায় শতকরা কত ভাগ বোতাম কম এবং পাঞ্জাবি হওয়া সত্ত্বেও তাতে সোস্যালিস্টিক কোনও টাচ আছে কি না। অর্থাৎ যদি তাতে কোনও বুক-পকেট না থাকে এবং যুগপৎ পাঞ্জাবি হওয়া সত্ত্বেও তাতে একটি আধ ইঞ্চি বহরের কলার থাকে, তবে জানবেন তিনি যথার্থই আর পাঁচজন কেরানির মতো নন।
তিনি যে আর পাঁচজন বাঙালির মতো নন একথা যাঁরা বুক ঠুকেই বলতে পারেন, তাঁরা বঙ্গদেশেই ইনটেলেকচুয়ালকুল। সাধারণভাবে এঁদের পোশাক ধুতি পাঞ্জাবি হলেও, তা একেবারে বৈচিত্র্যহীন নয়। কেউ কেউ লখনউ-কাট ফুলদার পাঞ্জাবি পরেন, কারও কারও আবার নিজস্ব কাট আছে। যথা, বোতামের ঘরগুলো চিনা কায়দায় হবে এবং বোতামগুলো হবে কাপড়ের। কেউ কেউ বোতামের বদলে সুতোর বন্ধন পছন্দ করেন এবং প্লেন পাঞ্জাবির বদলে গিলে করা পাঞ্জাবি।
অবশ্য এমন কথা মনে করার কারণ নেই যে, বঙ্গদেশে পোশাক সম্পর্কে উদাসীন কবি-সাহিত্যিক একেবারে নেই। নিশ্চয়ই আছে। এখানে শুধু স্বাতন্ত্র্যবাদীদের কথাই বলা হয়েছে মাত্র। এঁদের বাদ দিলে কোট-প্যান্ট-টাই, সাফারি স্যুট, পাজামা-পাঞ্জাবি, মাল-কোচা হাওয়াইয়ান শার্ট ইত্যাদি সবই আছে এদেশে। এমনকী হাতের কাছে যা পাওয়া যায় এমন রেডিমেড ভক্তও। সুতরাং সাড়ে ন’টা থেকে সাড়ে দশটায় ডালহৌসিতে দাঁড়িয়ে আপনি যা দেখেছেন, সর্বত্র শুধু এক দৃশ্য-বৈচিত্র্য।
এই বৈচিত্র্য যে আকস্মিক নয়, সে কথা বলাই বাহুল্য। সত্য বটে, বাঙালির ঘরে মুরগির মতো লুচিও সাম্প্রতিক ঘটনা এবং এটাও মিথ্যে নয় যে, মহাযুদ্ধ বস্ত্রাভাব ইত্যাদি নৈসর্গিক কারণগুলো কমবেশি ‘দো-নলা’ ওরফে পা-জামার জনপ্রিয়তার কারণ। কিন্তু তার আগেও কি সত্যিকারের কোনও ন্যাশনাল ড্রেস ছিল আমাদের?
বাঙালির কোনও ন্যাশনাল পোর্ট্রট গ্যালারি নেই। সুতরাং চট করে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না। পুরানো পরিবারগুলোতে যেসব ছবি আছে বলতে গেলে তা সব এক মডেলের। কুশাসনে প্রায় নগ্নদেহে নাদুসনুদুস ভুঁড়িখানা গুছিয়ে মুদ্রিত নেত্রে বসে আছেন গৃহকর্তা। সামনে তার শঙ্খ, গঙ্গাজল পাত্র-পুষ্প, কোষাকুষি ইত্যাদি।
বলা বাহুল্য, এটা কোনও ড্রেস নয়, এমনকী, ডাইনে বাঁয়ে দু’খানা তাকিয়া বসিয়ে হাতে একখানা গড়গড়ার নল জুড়ে দিলেও না।
অথচ, এই সনাতন বাঙালিকে বাদ দিলে আর যা আমাদের ভাণ্ডারে থাকে তা অফিসিয়াল ড্রেস মাত্র। সে পোশাকে দ্বারকানাথ, রাধাকান্ত দেব কিংবা রামমোহনের পার্থক্য খুঁজে পাওয়া ভার। দেখলে মনে হয় কনভোকেশন ড্রেসের মতোই এগুলোও যেন কোনও ইউনিফর্ম।
ইতিহাস বলে, এগুলো বাঙালির পোশাক নয়, নবাবি বাংলার পোশাক। ঠিক তেমনি উনবিংশ শতকের কলকাতার বাবু যে পোশাকে আজ ঐতিহাসিক হয়েছেন, সেটিও এক নয়া-নবাবিয়ানার পোশাক মাত্র। হুতোম, প্যারীচাঁদ বা ভবানীচরণের কিংবা শিবনাথ শাস্ত্রী মশাইয়ের লেখায় আপনারা অহরহ তাদের সে বেশ-বিলাস দেখেছেন। উপস্থিত আমি শুধু তাদের ধুতিটার কথাই বলব। আমার কথা নয়, সমসাময়িক জনৈক ক্রিটিকের বর্ণনা। ক্রিটিক ‘বাবুর’ পোশাক দেখে লিখছেন: ‘সুপুরুষ হইতে মহা সাধ মনে ভাবেন বড় মানুষের ঘরে জন্মিয়াছি যদি সৌন্দৰ্য্য না দেখাই তবে লোকে ছোটলোক কহিবেক—ইহাতে করিয়া স্বর্ণ মুক্তা হিরা প্রভৃতির আভরণ, অর্থাৎ দো-নরি তে-নরি পাঁচ-নরি হার বাজুবন্ধ উপলক্ষ্যে ইস্টকবচ গোট চাবির শিকলি ইত্যাদি গহনা ও কালাপেড়ে রাঙ্গাপেড়ে শালপোড়ে কাঁকড়াপোড়ে লিখক কহে ইচ্ছা হয় ছাইপোড়ে ধুতি পরিধান করেন। এ সকল স্ত্রীলোক ব্যবহার করিয়া থাকে।’ ইত্যাদি।
এ পোশাকটি আজ দুর্লভ হলেও একেবারেই যে অচল, এমন কথা বলা যায় না। কোথাও কোথাও কখনও এ পোশাক আপনার চোখে পড়বে অবশ্যই, কিন্তু ‘উড়ে কোঁচা’ ধুতি কিংবা ‘জামা নিমা কাবা কোরতা’ ইত্যাদি হিন্দুস্থানীয় পরিচ্ছদও বাঙালির নিজস্ব পোশাক নয়। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে বাঙালির নিজের কোনও পোশাক নেই। যখন যে পাত্রে রাখা হয়েছে তাকে, তখন সে পাত্রেরই আকার ধরেছে সে।
পার্কগুলোকে একটা চক্কর দিয়ে আসুন, কাকে প্রতিনিধি বলবেন বাংলা দেশের? বটকৃষ্ণ পাল মশাই নিশ্চয় নয়। তা হলে আপনার শীতের পোশাকটাই মাটি হয়ে যাবে যে। গিরিশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র, বিদ্যাসাগর আজ আর মনে ধরবে না। বরং তার চেয়ে, একটু কেটে হেঁটে নিলে দিব্যি চলেন সুরেন্দ্রনাথ এবং আশুতোষেরা।
সত্যি কথা বললে, জিতেছেন এঁরাই। কনভারশন যে বেগে শুরু হয়েছে তাতে বাংলাদেশকে সাহেব সাজাতে আর ক’বছর লাগবে, মিলওয়ালাদের সেটাই গবেষণার বিষয়। অবশ্য মাঝে মাঝে হাওয়াই, হনলুলু, মোড় ঘোরাতে চেষ্টা করবে সত্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে ইংরেজরাই জিতবে, এ বিষয়ে শত্রু-মিত্র একমত।
শুনলে অবাক হয়ে যাবেন, এ বিজয় ঠিক এলাম, দেখলাম, জয় করলাম নয়। বেঁচে থাকার জন্যে রীতিমত লড়াই করতে হয়েছে র্যাঙ্কিনকে। দু’ তরফা লড়াই। একদিকে সনাতন বঙ্গদেশ, অন্যদিকে বিজয়ী সরকার।
সনাতন বঙ্গদেশ ভ্রূকুটি করে খবরের কাগজে প্রশ্ন তুললেন: ‘ইংরেজী পোশাক পরিধান করিবার কারণ কি, তাহা কিছু বুঝিতে পারি না, যদি বল উত্তম পোশাক এই নিমিত্ত বালককে দিয়াছেন। আমি মনে করি হিন্দুস্থানী পোশাকাপেক্ষা ইংরেজী পোশাক বাঙালীর নিমিত্ত উত্তম কোনমতে নহে। সে যাহা হউক যদি এ পোশাক বাল্যাবধি পরিধান করিতে লাগিল, তবে তাহাকে সে পোশাক চিরকাল ভাল ও সুখজনক বোধ হইবেক, তবে বরাবরই পরিবেক। যখন মস্থ যোয়ান হইয়া ওই পোশাক পরিয়া বাটীর মধ্যে যাইবেক, তখন তাহাকে দেখিয়া যদি পরিবারেরা ভয়যুক্ত না হউক, কেননা ঘরের নকল সাহেব জানেন, যদি ভিন্ন তোক দেখে তবে অন্য লোকের সাক্ষাৎ কহিবেক যে অমুক লোকের বাটীর ভিতর একজন সাহেবকে যাইতে দেখিলাম ইত্যাদি কলংক হইতে পারে।’
সুতরাং পত্রলেখক চ্যালেঞ্জ করলেন, ‘যদি তাহারদিগের মতে (ইংরেজি পোশাকের) কিছু গুণ থাকে, তাহা লিখিয়া আমার থোথা মুখ ভোঁতা করিয়া দিবেন।’
কিন্তু কেউ এগিয়ে এলেন না তাঁর জবাব দিতে। কারণ, জবাব দেওয়ার বাস্তবিকই কিছু নেই। বাংলাদেশ তখনও ইন্ডাস্ট্রিয়াল হয়নি যে, বলবে: কলে-কারখানার কাজে ইংরেজি পোশাকে সুবিধে। মধুসূদন গুপ্ত যে পোশাকে প্রথম শবচ্ছেদ করেছিলেন, কলকাতায় সে পোশাক দেখবার পর কোনও ডাক্তার বলতে পারেন না যে, ওই বিশেষ বিদ্যাটি ইংরেজি পোশাক ছাড়া অচল। আবহাওয়ার কৈফিয়ত দেবেন? তারই বা সুবিধে কোথায়? কাউন্সিলের সাহেব মেমবাররা পর্যন্ত এদেশের জলের গুণে মসলিনের বেনিয়ান শার্ট, লম্বা পাজামা (লং ড্রয়ার) এবং কোজ্ঞি টুপি ধরেছেন, মেমসাহেবরা ধরেছেন ঢিলে ফ্রক। এমতাবস্থায় বাঙালি কী করে জল-হাওয়ার কৈফিয়ত দেন?
কৈফিয়ত না থাকলেও, রাজার পোশাকে সাধ যায় সবারই। বাঙালিবাবুরাও তাই ইংরেজি বিদ্যার সঙ্গে ইংরেজি পোশাক ধরলেন। শুধু নিজেরা নন, চাকর-বাকরদেরও সাজানো চাই ইংরেজি কায়দায়। কিন্তু মহামান্য কোম্পানি বাহাদুর বাদ সাধলেন। ১৭৮৬ সালের ৭ এপ্রিল ফোর্ট উইলিয়ম গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে সেক্রেটারিমশাই এক সার্কুলার জারি করে কলকাতাবাসীকে জানালেন যে, ‘মহামান্য গভর্নর বাহাদুর এবং তাঁর কাউনসিল জানতে পেরেছেন যে, এই শহরের কিছু কিছু বেনিয়ান এবং ধনী ব্যবসায়ীদের মধ্যে সম্প্রতি তাদের ভৃত্যদের কোম্পানিরই সিপাই এবং লস্করদের মতো করে সাজাবার একটি অভ্যাস ধীরে ধীরে ব্যাপ্তিলাভ করছে। এতদ্দ্বারা আমি জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে, এটা বে-আইনি। ইত্যাদি।
আর একটা বে-আইনি ব্যাপার ছিল তখন সাহেবের সামনে জুতো পরা। লর্ড অকল্যান্ড ১৮৩৬ সালে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে কলকাতার চিনাদের বাঁচালেন। (এবং ভবিষ্যতে চেক এবং ইংরেজ ব্যবসায়ীদের মার্কেট তৈরিতেও সাহায্য করলেন)। লাটভবনে প্রথম যেদিন সাহেবিজুতোয় বাঙালিবাবু দর্শন দিলেন, সেদিন নাকি এক দেখবার মতো দৃশ্য। বাঙালির কাষ্ঠ-পাদুকায় অভ্যেস ছিল। বড় ঘরে তালতলার চটি এবং রকমারি লখনউ-কাটেরও গতায়াতও ছিল কিছু কিছু। কিন্তু ইংরেজি জুতো? এমিলি ইডেন লিখেছেন, ‘সে এক দৃশ্য। নতুন আঁটোসাঁটো জুতোয় পা কেটে গেছে। তবুও খোঁড়াতে খোঁড়াতে লাট বাহাদুরকে সেলাম জানাতে আসছেন একের পর এক জেন্টু।’
বলা বাহুল্য, আজ আর আমরা খোঁড়াই না। এমনকী ছ’ইঞ্চি উঁচু হিল-এ আমাদের কেটি মিটারও গট গট করে চলে আজ।
প্রসঙ্গত কেটি মিটারদের বস সম্পর্কে দু’ একটি কথা বলা দরকার। এজন্যে নয় যে, কেটি আজ সংখ্যায় কোটি কোটি। তার চেয়ে জরুরি ঘটনা হচ্ছে এই যে, আমাদের যত রং-বেরঙের রকমারি সাজ, তার প্রধানতম কারণ ওঁরাই। কেননা, ওরা ‘কাউ বয়’ ভালবাসেন বলেই আমরা গোপাল সাজি।
অবশ্য এ কথা বলে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের মেয়েদের শাড়িটি সত্যি সত্যিই এ দেশের নিজস্ব জিনিস। গবেষকরা আমাদের জানিয়েছেন, বাংলার শাড়ি হল সুতোয় বোনা বাংলার নদী মাত্র। দু’পাশের পাড় দুটি নদীর একূল ওকূল, বিস্তীর্ণ আঁচলটি মোহনা। তারই মধ্যে বহমান উজ্জ্বল, তরঙ্গায়িত দেহখানা।
শাড়ি আজ সেই অর্থ হারিয়েছে এমন বলব না। তবে এলোপাথাড়ি সামাজিক ভূমিকম্পে গতিপথ পরিবর্তন করেছে অবশ্যই। সেকালে বাঙালি মেয়ে যে কৌশলে শাড়ি পরতেন, আজকের ঠাকুমারাও তা পরেন না। পরতে ভালবাসেন না। কারণ, ইতিমধ্যে নুরজাহানের যুগ যেমন পেরিয়ে গেছে, তেমনি ভিক্টরীয় তথা ব্রাহ্মসমাজি যুগও। এখন শাড়ি আর শুধু শাড়ি নয়, আরও গুটি কয় বস্ত্রখণ্ডের একটি মাত্র।
শাড়ির দ্বিতীয় পরিবর্তন যেটি ঘটেছে, সেটি দৈর্ঘ্যে হাতখানেক বা বহরে ইঞ্চি কয়েক বৃদ্ধি নয়, সেটি তার সূক্ষ্মতা। মসলিনের চেয়ে নাইলন সিফন হালকা নয় সত্য, কিন্তু প্রথমোক্তটি কোনওকালেই সর্বজনের ভূষণ ছিল না এ দেশে। শুনলে তাক লেগে যাবে, মোটা ‘সাটী’ থেকে চন্দ্রকোনার হালকা শাড়িতে আসতে বাংলা দেশকে গালে হাত দিয়ে ভাবতে হয়েছে কমপক্ষে একশো বার।
গোটা দেশে সে এক হই-চই কাণ্ড। খুব বেশি দিন আগেকার কথা নয়। ১৮৩৫ সালে খবরের কাগজে কস্যশ্চিত বিদেশিনী প্রশ্ন তুললেন: ‘এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকের পরিধেয় অতি সূক্ষ্ম এক বস্ত্রই সাধারণ ব্যবহার্য ইহা অনেক দোষাভাসের ও ভিন্ন দেশীয় লোকেরও ঘৃণাৰ্হ এবং নব্য ব্যবহারই অনুভব হয়।’ ফেনি পার্কস কলকাতায় এক বাঙালি বড়মানুষের অন্দরমহল ঘুরে এসে লিখেছিলেন, এখন বুঝতে পারি ওঁরা কেন মেয়েদের বাইরে আসতে দেয় না। তিনি প্রকারান্তরে বলেছেন—এই পোশাক পরা আর না পরা সমান।
কিন্তু কর্তারা তখন দূতী বিলাসের যুগে পড়েছেন। সেখানে অনঙ্গমঞ্জুরী ‘সুবর্ণের গোল মাল পরিয়াছে পায়। পরেছে ঢাকাই শাড়ী অঙ্গ দেখা যায়।’
১৮৫১ সাল পর্যন্ত, প্রায় কুড়ি বছর ধরে দূতীবিলাস চলল বাংলাদেশে। ঢাকা, চন্দ্রকোনা, শান্তিপুর মিহি শাড়ি বুনে চলল বিপুল বেগে। সঙ্গে ততোধিক বেগে চলল তার বিরুদ্ধতা।
শুধু তাই নয়। বর্ধমানের মহারাজা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। তিনি তাঁর রাজ্য থেকে মিহি শাড়ি নির্বাসনে পাঠালেন। প্রজাদের পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হল, যদি কেউ মিহি কাপড় পরে, তবে তার দণ্ড হবে।
কঠিন প্রতিজ্ঞা। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, বর্ধমানাধিপের এই একুশে আইনের ফল কী হল? তবে তাকে উত্তরের জন্যে একবার তাকাতে বলব নিজের ঘরের আলনাটির দিকে, কিংবা একবার এসে দাঁড়াতে বলব সন্ধ্যায় চৌরঙ্গিতে, অথবা খাড়া দুপুরেই কোনও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের শো-কেসটির মুখোমুখি। বসন, তা শাড়ি হোক, সালোয়ার-কামিজ হোক, জিনস আর শার্ট হোক, কিংবা অন্য কিছু—সবই আজ আবর্তিত দেহ তরঙ্গ ঘিরে। আবর্তিত এবং হিল্লোলিত।
মৎস্য-পুরাণ
‘মৎস্য কাটিয়া থুইল ভাগ ভাগ।
রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে নলতার আগ॥
মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাছ গাছা।
ঝাঁজ কটু তৈলে রান্ধে খরসুন মাছ॥
ভিতরে মরিচ গুঁড়ো বাহিরে জুড়ায় সুতা।
তৈলে পাক করিয়া রান্ধে চিংড়ির মাথা॥
ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল।
কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল॥’
উপরের লাইন ক’টি থেকে যে রান্নাঘরটির গন্ধ আপনার নাকে এসে লাগছে, সেটি বরিশাল জেলার অন্তর্গত।
বরিশালের গৃহস্থ বধূরা যখন পরম সন্তোষে পা ছড়িয়ে বসে মাছের এই বাটিগুলো সাজাচ্ছেন, চৈতন্যদেবের তখনও জন্ম হয়নি। এমনকী, এই সেদিন ঢাকার বসাকমশাই যখন ‘বাল্যশিক্ষার’ মাছের ফর্দটি মিলাচ্ছেন, তখনও বোধ হয় তিনি ভাবতে পারেননি যে, অদূর ভবিষ্যতেই এমন দিন আসবে, যখন তাঁর পাঠকদের এক-জনমে এতগুলো মাছের মৌখিক অভিজ্ঞতা তো পরের কথা, চাক্ষুষ দর্শন লাভের সৌভাগ্যও আর মিলবে না। ‘চাঁদা, বাচা, চিংড়ি, বাতাসি, বোয়াল’ ইত্যাদি কবিতার মতোই স্পর্শাতীত হয়ে থাকবে তাঁদের জীবনে। কারণ অচিরেই শোনা গেল, বিজয়গুপ্তের বরিশালের সেই রান্নাঘরের কপাট পড়েছে, এবং যশোহরের কই ও পদ্মা-গঙ্গার ইলিশ বাংলাদেশের কই ঐতিহ্যের তালিকায় উঠেছে। ‘বাল্যশিক্ষার’ সমস্ত শিক্ষাকে ভুলে গিয়ে বাঙালি কবি তখন সুর ধরেছেন:
‘জোলা মরে তাঁতে
কাঙ্গালী বাঙ্গালী মরে মাছে আর ভাতে।’
নতুন কবিতা, নতুন সুর। কিন্তু অনেক কবিতার মতোই বোধ হয় এই কবিতাটিও মিথ্যে। বাঙালি যদি মাছ খেয়ে মারা যেত, তবে বাংলাদেশ শহিদের গৌরব পেত। তাতে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু ঘটনা তা নয়। ইতিহাসে এমন অনেক কথা আছে, যেগুলো আসলে প্রবাদ নয়, অপবাদ। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটিও তাই। ভাত বাঙালি কোনও দিন খায়নি, খেতে পায়নি। ‘মৎস্য মারিব খাইব সুখে’ বাঙালির উচ্চাকাঙ্ক্ষা মাত্র। এক ইংরেজ আমলেই বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে আঠারো বার, আর প্রায়-দুর্ভিক্ষ—যার অফিসিয়াল নাম ‘স্কারসিটি’, সেটি অসংখ্যবার। মাছের ঘটনাও তাই। পৃথিবীতে যেসব জাত ‘মেছো’ বলে খ্যাত, তাদের সঙ্গে পংক্তিভোজনে বাঙালির বসাই চলে না। ইংরেজরা মাথাপিছু বছরে মাছ খায় ৪৯ পাউন্ড বা প্রায় আধ মন। ডেনমার্কের লোকেরা ২৪ পাউন্ড আর আমরা বাঙালিরা মাত্র ৯ পাউন্ড। এমনকী, আমাদের ভোজবাড়ির চ্যাম্পিয়নদের কনজামশনও হপ্তায় দু’ আউন্সের বেশি নয়। সুতরাং ‘ভেতো বাঙালি’ এবং ‘মেছো বাঙালি’ দুই-ই মিথ্যে রটনা।
তবে শীতের কোনও সন্ধ্যায় বউবাজারের কোনও উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে বৈঠকখানার গলিপথের দিকে ধাবমান কেরানি বাঙালির দিকে এক নজর তাকালে কিংবা গুপ্তকবির রচনাবলির একখানা মাত্র কবিতা, ‘এন্ডাওয়ালা তপসে মাছ’ মন দিয়ে পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায়, মাছে বাঙালির মন আছে। অন্তত, মাছ সম্পর্কে সে উদাসীন নয়।
কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তের বাংলাদেশে তখন নতুন অনুরাগীরা এসে দেখা দিয়েছেন, তাঁরা অনুরাগের মূল্য দিতে জানেন।
‘ব্যয় হেতু কোনমতে না হয় কাতর।
থানায় আনায় কত করি সমাদর॥
ডিস্ ভরে কিস্ লয় মিস্ বাবা যত।
পিস্ করে মুখে দিয়ে কিস্ খায় কত॥
গুপ্তকবির সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিরা বিশেষত কলকাতার বাঙালিরা বুঝতে পারলেন, এ হেন মৎস্য-প্রীতির সঙ্গে তাঁদের পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা অবান্তর। সুতরাং তাঁরা ভেটকি, চিংড়ি, ইলিশের বাজার ছেড়ে কুচো চিংড়ি এবং চুনো পুঁটি ইত্যাদিকে অবলম্বন করলেন এবং বিদেশি মৎস্য-বিলাসীও দেশি তপসেকে নিয়ে পড়লেন।
এই তপস্বী মাচ্ছি (Topsee Muchee) বা তপসে মাছ ছিল অষ্টাদশ শতক এবং উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতার ইংরেজের আরাধনা। এর নাম এবং স্বাদ নিয়ে তাদের সাহিত্যে আলোচনা গবেষণার অন্ত নেই। একজনের মতে: যেহেতু আমের মরসুমে এর আবির্ভাব, সেই হেতু বাংলার এই White ban-এর নাম ম্যাঙ্গোফিশ। তা ছাড়া এর গন্ধের সঙ্গেও আমের গন্ধের বিলক্ষণ মিল আছে। গুপ্তকবির মতে:
‘এমন অমৃত ফল ফুলিয়াছে জলে।
সাহেবরা সুখে তাই ম্যাঙ্গো ফিশ বলে॥’
সাহেবরা বলেন, আমাদের তপসে নামের অর্থও তাঁরা জানেন। একজন লিখেছেন, “The natives have named them Tapaswi (Penitent) fish (abbreviated by the Europeans to Tapsi) form their resembling a clan of religious penitents, who never shave, but whom like the mango fish, disappear during the rainy season.’
বর্ষা শুরু হলেই তাই কাড়াকাড়ি পড়ে যেত একে নিয়ে। কলকাতার বাজার লুটেপুটে খেয়ে সাহেবরা বড় বড় নৌকা নিয়ে পাড়ি জমাতেন। উলুবেড়ের এদিকে নাকি ম্যাঙ্গোফিশ আর আসে না। একগাদা ‘কৈহ্যায়’ (Qui Hye) বা চাকর-খানসামা নিয়ে তাঁরা হানা দিতেন ফোর্টফলস্টার, ফলতা প্রভৃতি অঞ্চলে। দশ-পনেরো মাইল জুড়ে চলত তাঁদের ‘তপস্বীর সন্ধান’।
তবে এই সামান্য জল-বিহার তো তুচ্ছ। জনৈক রিটায়ার্ড কর্নেলের মতে ‘এক ডিস তপসে মাছ খেতে পেলে—বিলেত থেকে কলকাতার ক’মাসের সমুদ্রযাত্রার ধকলও কিছু নয়।’ আর একজন বলেন, ‘Perhaps there is not in the world a greater delicacy than the Mango fish of the Hoogly.’ তপস্বীর আর এক বিদেশি ভক্ত গর্ব করে লিখছেন, ‘It is true that I have destroyed my liver in Calcutta, but I have eaten Topsi mutchees!’ অর্থাৎ সত্য বটে কলকাতায় আমি আমার লিভারটিকে নষ্ট করেছি, কিন্তু তপসে মাছও তেমনি খেয়েছি।’
এভাবে খেতে খেতে ইংরেজের লিভার যখন নষ্ট হয়ে এসেছে, বাঙালি তখন মাছের অভাবে যায় যায়। খালি তপসে? সাহেবেরা খায় না কী? সিংহল থেকে রাশি রাশি শামুক ঝিনুক আনায়, তাই খায়। বাড়িতে চৌবাচ্চা করে ঝিনুক পোষে, মুক্তা যদি পায়, বিবিদের গলায় পরায়, নয়তো মাসটুকু খায়। এমনকী, কাঁকড়াও উধাও বাজার থেকে। কাঁকড়ার সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে ঘুরে শৌখিন বাঙালি অগত্যা এসে হাজির হলেন ইংরেজি হোটেলে। তিনি জানেন, কাঁকড়াই বলো, আর চিংড়িই বলো, এখানে সব আছে। ভাঙা ইংরেজিতে তিনি সাহস করে জিজ্ঞাসা করেন:
‘Why not? We serve anybody, sit down!’
বাটলাররা হাসাহাসি করে। কিন্তু মাছে বাঙালির মন মজেছে। এখন তার মান অপমান সবই সমান। হাসতে হাসতে মাথা নিচু করে বাবু বসে পড়লেন।
হাজার হোক, রাজা প্রজা সম্পর্ক। বাঙালির এই দুরবস্থা সাহেবদের সহ্য হল না। তাঁরা স্থির করলেন, এর যা হোক একটা বিহিত তাঁরা করবেন। কিন্তু কীভাবে? সরকারি শাসনশালায় ‘মস্তিষ্ক’ বরাবরই ছিল। তাদেরই একজন সরকার বাহাদুরকে কানে কানে বললেন: খাল বিল সেচে খাওয়া তো সাঙ্গ, হুগলিও চষে সারা, এবার গভীর জলে চলুন। নিমকহারাম বাঙালির পেটে কিছু নোনা জলের মাছ পড়ুক।
গভীর জলের মাছ।
কলকাতায় রব পড়ে গেল। বৈঠকখানা, চিৎপুর, টেরিটিবাজারে জেলেদের মুখে শোনা গেল, এবার কলকাতায় আর মৎস্য-কষ্ট থাকছে না। সাগর থেকে মাছ শিকার করে এনে সাহেবরা এবার বাঙালির পেট ভরাবেন।
এটা ১৮২৯ সালের কথা। তখন কংগ্রেসি মন্ত্রিসভা তো দূরের কথা, কংগ্রেসেরই জন্ম হয়নি। বাংলার সরকার গভীর জলের মাছ নিয়ে পড়লেন। প্রস্তাব উঠলেই কোনও সরকার কাজে নেমে পড়েন না। তার আগে তাঁদের কমিটি বসাতে হয়। এবারও কমিটি বসল। তাঁদের অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু: কলকাতায় যথার্থই মাছের অভাব আছে কি না, তা নির্ণয় করা এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে গভীর জলের মাছ শিকারের প্রস্তাবটি বিবেচনা করা।
কমিটি কলকাতার বাজারগুলো তন্নতন্ন করে খুঁজলেন, মাছ দেখলেন, হিসেব নিলেন। তারপর বের হল তাঁদের রিপোর্ট। এপ্রিলে তাঁরা কাজে নেমেছিলেন, ২২ সেপ্টেম্বরের গভর্নমেন্ট গেজেটে ছাপা হল তাঁদের মৎস্যপুরাণ। স্ট্যাটিসটিকসের ফিগারে কিছু এদিক ওদিক হলেও তাঁদের রিপোর্টটি কলকাতায় মাছের বাজার বিষয়ে সনাতন বলে দাবি করতে পারে। তাই সংক্ষেপে সেটি উল্লেখ করছি এখানে।
কমিটির মতে: (১) কলকাতার বাজারে চাহিদা অনুপাতে ভাল এবং পুষ্টিকর মাছের সরবরাহ অত্যন্ত কম। (২) গরিবেরা এখানে উচ্চ দামে বাজে মাছ কিনতে বাধ্য হয়, যদিও এ দামে তাদের পক্ষে ভাল মাছ পাওয়া উচিত। (৩) কলকাতার বাজারে যে সব মাছ আমদানি হয়, যানবাহনের অভাবে তার অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যায়। (৪) জেলেদের অবস্থা যার পর নাই খারাপ। তারা মাছের ব্যবসায়ের ক্রমবর্ধমান লাভের কিছুই পায় না। সুতরাং উত্তম মাছ সরবরাহের দিকে তাদের কোনও উৎসাহ নেই। (৫) কলকাতার বাজারে দৈনিক গড়ে মাছ বিক্রি হয় ১৭৮০ সিক্কা টাকা ৩ আনার। (৬) এখানে মাছের কারবারে লাভের পরিমাণ টাকায় ছ’আনা। (৭) দাম বাড়ানো কমানোর ব্যাপারে যৌথভাবে ব্যবসায়ীদের কোনও চেষ্টা এখানে নেই। অর্থাৎ শেষেরটিকে ‘হ্যাঁ-বাচক ধরলে এবং ৬ নং তথ্যে ছ’আনার বদলে টাকায় একশো ষোলো আনা করলে কলকাতার সেদিনের মাছের বাজারের সঙ্গে আজকের কোনও পার্থক্য নেই।
তারপর কমিটি হিসেব-টিসেব করে বার করলেন, কলকাতায় বছরে মাছ বিক্রি হয়, ১,৮২,৫০০ সিক্কা টাকার। জাহাজ কিনে মাছ ধরার ব্যবস্থা করতে খরচ পড়বে ২ লক্ষ টাকা। তার উপর মাসে মাসে লোকের মাইনে, জাহাজ চালানোর খরচও আছে, তাতে লাগবে কমপক্ষে মাসে ১০,০০০ টাকা বা বছরে ১,২০,০০০ টাকা। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। যা মাছ ধরা পড়বে, তার থেকে এটা বাদ দিন। দেখবেন, মোট ৬২,৫০০ টাকা বা শতকরা ৩১ টাকা লাভ হচ্ছে সরকারের। সুতরাং তাঁরা বললেন, গভীর জলেরর মাছ ধরার চিন্তা অত্যন্ত সাধু চিন্তা এবং অত্যন্ত গভীর বুদ্ধির পরিচায়ক।
কিন্তু কী ঘটে গেল, কে জানে। রাইটার্স বিল্ডিং থেকে পরিকল্পনাটি আর সমুদ্র অবধি গেল না। এদিকে বৈঠকখানা, বাগবাজারের দু’ পুরুষ কেটে গেল। সেকালে যারা গভীর জলের নোনা মাছ খাবেন বলে মনস্থির করেছিলেন, তাঁদের নাতিরা জানতে পেলেন, এবার সত্যিই সরকার মাছ ধরতে সাগরে চলেছেন। এবার আর জেলেদের মুখের সংবাদ নয়। ১৯২০-২১ সালের কথা। খবরের কাগজেই বার হল—বঙ্গ সরকার জাহাজ কিনেছেন। মাছ ধরার জাহাজ। তার নাম ‘গোল্ডেন ক্রাউন’ বা ‘সুবর্ণ তাজ’।
যদিও কিছুদিন পরেই আবার খবর পাওয়া গেল: ‘না, মাছ ধরায় সুবিধা হচ্ছে না। সরকার বোধ হয় জাহাজটা বিক্রিই করে দেবেন। সমর্থকদের মুখে অনেকটা কালো ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে ‘সুবর্ণ তাজ’ বিক্রি হয়ে গেল। বেসরকারি জেলেরাই মুচকি হেসে আবার দায়িত্ব নিল কলকাতার, তথা বাঙালির।
তার পরের ইতিহাস তো সবারই মুখস্থ। ছ’ জাহাজের বহর ‘কল্যাণী’র কল্যাণে মাছ না পেলেও ইতিমধ্যেই গভীর জলের খবর অনেক পেয়েছেন আপনারা। ইতিহাসের পথ ধরে সাগরের দিকে চলেছেন আমাদের দেশি সরকার। তাঁদের জাহাজও মাঝে মাঝে বিগড়াবে, মাঝে মাঝে মাছের আয়ে তেলের খরচ পোষাবে না বলে শোনা যাবে, মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে জাপানিরা চলে যেতে চাইবে। কিন্তু তাতে কী? সরকারের সংকল্প সাধু। এমনকী, একদিন যদি ‘গোল্ডেন ক্রাউনের’ মতো ‘কল্যাণী’রও বিক্রির খবর শোনেন বাজারে, মন খারাপ করবেন না।
জানবেন, তার জন্য সরকার দায়ী নয়, দায়ী ইতিহাস আর কলকাতা শহর। ইতিহাসের দোষ এই যে, মাঝে মাঝে সে ‘রিপিট’ করে। বিশেষত কলকাতায় যেন তার এই প্রবণতা স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি।