কিন্তু কোথায় তার সেই জীবন?
মাধব ঘোষের বাসার তিন কুড়ি লোক এই হতভাগ্যকে ঘিরে বসে নিখুঁত নিমর্মতায় জানিয়ে দেয়, নেই সে বস্তু। বুঝিয়ে দেয়, ছিলই না কোনোদিন।
থাকলে কখনও এমন কর্পূরের মতো নিমেষে উবে যায়?
দুটো মাস তর সইল না—সুখদা সখেদে বলে, এতগুলো মানুষের উপরোধ অনুরোধ ঠেলে সবাইয়ের নাকের ওপর দিয়ে ছোঁড়ার হাত ধরে গটগটিয়ে বেরিয়ে গেল!
রেলেকাটা মানুষটার কথা কেউ তুলল না। তারা যে স্পষ্ট দেখে এসেছে অজিতের মড়া, সে কথা বলল না।
অজিতের জন্যে তারা শয়নে স্বপনে পথ চেয়ে বসেছিল সেই কথাই বলল।
অনেকক্ষণ বিহ্বলতার ঘোর ছিল, তারপর–
অজিত ভাবল, আশ্চর্য আমি! সামান্য একটু চোর অপবাদে দেশত্যাগ করেছিলাম, গায়ে ছাই মেখে পথে পথে ঘুরেছিলাম, আর এখন স্ত্রী কুলত্যাগ করেছে শুনেও দিব্যি বসে আছি। এতগুলো লোককে মুখ দেখাচ্ছি। এরা চা দিয়েছিল, তাও খেয়েছি। এরা বলেছে, সে কি কথা, যাবে কোথায়? কেনই বা যাবে? আবার বেথা কর, ঘরসংসার কর, তাও শুনছি বসে বসে।
অনেকক্ষণ পরে নিশ্বাস ফেলে বলল, নগেনবাবু সেখানে গিয়েছিলেন বললেন না?
গিয়েছিলেন তার কি? সে বাসায় কি আর আছে নাকি? যেই জানাজানি হয়ে গেছে, ছেড়ে দিয়ে বেলেঘাটায় না কোথায় চলে গেছে। বলে পর্যন্ত যায়নি। পাড়ার লরি গাড়ির ড্রাইভার গিয়েছিল, বাড়ি উঠনো জিনিস নিয়ে, সেই বুঝি বলেছিল। কিন্তু তার খোঁজ করে আর কি হবে? দাসগিন্নি আক্ষেপের নিশ্বাস ফেলেন, মিথ্যে একটা খুনোখুনির দায়ে পড়া বৈ তো নয়! পুরুষের রক্ত তো গায়ে আছে? তার চেয়ে
কিন্তু অজিত কি খুনোখুনির কথা ভাবছে?
না।
তেমন প্রতিহিংসার তীব্রতা খুঁজে পাচ্ছে না অজিত মনের মধ্যে। সে শুধু একবার দেখতে চায় মলিনাকে দেখতে চায়, কি রকম চেহারা হয়েছে মলিনার।
কি রকম হয়ে যায় হঠাৎ অসতী হয়ে যাওয়া মেয়েমানুষ!
আর সেই অন্যরকম হয়ে যাওয়া মলিনাকে একবার শুধু প্রশ্ন করতে চায়-”মলিনা তুমি এই?…বলতে চায়—”মলিনা, এইটাই কি তুমি? তবে আগের সেই মানুষটা?…যে আমার জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকত? আমার অস্তিত্ব নিয়েই বেঁচে থাকত?
সে কে?
মানিকতলার সেই সরু গলির অন্ধকার একতলার ছোট রান্নাঘরটায় বসে মলিনাও ভাবছিল, সে তবে কে?
মাধব ঘোষের বাসায় দাওয়ায় বসে যে মলিনা রান্নার সরঞ্জাম আর মহিমা নিয়ে বসত, সেই মলিনাই কি আমি?
তবে অজিত ভটচায নামের সেই মানুষটা এসে খেতে না বসলেও কিছু এসে যাচ্ছে না কেন আমার? কেমন মনে হচ্ছে না সব মিথ্যে?
রাজ রোজ নতুন নতুন রান্নায় উৎসাহ আসে কোথা থেকে আমার? আর একটা মায়াবী রাক্ষস যখন উৎসাহের জোয়ার বইয়ে সেই রান্না তারিফ করে খায়, তখন আমার প্রাণটা পুলকে ভরে ওঠে কেন?
কই কিছুতেই তো মায়াবীটাকে আমার ভাই বলে মনে হয় না! বারেবারে কেন অজিত ভট্টচাযের মুখের সঙ্গে মুখটা গুলিয়ে যায় ওর?
তবে কি তরোয়ালের খেলায় হার হবে আমার? কেটে টুকরো হয়ে যাব তার ধারে?
আর ওই ছেলেটা!
সে যে সারারাত জেগে পায়চারি করে, সেকথা টের পাওয়া যায় পাশের ঘর থেকে। আর সকালে এসে সেই না-ঘুমানো ক্লিষ্ট মুখে হাসি ফুটিয়ে সে শুধু বলে, আজ কি রাঁধবে বল? কি আনব?
ওর পয়সা নেই।
এই বাসাটুকু ভাড়া করতে আর দুটো লোকের ভাত যোগাতেই সারা হয়ে যায় ও। তবু ছোটোখাটো ঘর সাজানোর জিনিস এনে জড় করে ও, আনে গেরস্থালীর অদরকারি টুকিটাকি।
বারণ করলে হাসে।
বলে, সংসার জিনিসটা যে কি, তার স্বাদ তো জানিনি কখনও। তাই সাধ হল।
মলিনা হাসি মুখে সেই হাসিমুখটা সহ্য করবে? মলিনা কিছু না দিয়ে শুধু নিয়েই চলবে?
কেন?
অজিত ভটচায নামের সেই ছায়াটার অনুশাসনে?
কিন্তু এই মলিনা তো মাধব ঘোষের বাড়ির সেই মলিনা নয়!
এ তো অন্য আর একজন। এ তো একটা থিয়েটারের অ্যাকট্রেস!
অবিরত অন্যের লেখা পার্ট প্লে করে চলেছে। তাই হঠাৎ একদিন যখন বাড়িওলা মানিক দাসের গিন্নি বেড়াতে আসেন, অথবা সরেজমিনে তদন্ত করতে আসেন বাড়ি কেমন ভাবে রেখেছে, আর দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন, তখন মলিনা অম্লান বদনে বলে, ওই তো, ওই পরিষ্কার পরিষ্কার বাতিকেই মলাম মাসিমা! বলব কি দুটি মানুষই সমান! চিরটাকাল ওই বাড়ি পরিষ্কারই ধ্যান-জ্ঞান।
যেন দুটি মানুষে চিরটাকাল একসঙ্গে থেকেছে।
দাসগিন্নি সে কথা বুঝতে পারবেন এমন হতে পারে না। তিনি শুধু বলেন, এই রকমই চেয়েছিলাম আমরা। শুধু স্বামী-স্ত্রী, কোনো ঝামেলা নেই।
এই চলছে।
এই অভিনয় উৎরোনো।
তবে আর কি করে বলা যায় সেই মলিনাই এই লীনা?
ছিল মলিনা ভটচায, হতে হয়েছে লীনা মিত্র। নাপিত পুরুত ডেকে বদল নয়। রেজিস্টারি অফিসে গিয়ে বদলও নয়, শুধু শুধু বদল, অভিনয়ের বদল।
আর সেই বদলের সঙ্গে সঙ্গে ওর কথার ধরন বদলাচ্ছে, চিন্তার ধারা বদলাচ্ছে।
বারো ঘরের ভাড়াটেদের মধ্যে যখন থেকেছে উঁচুনাকী মলিনা, তখন চিন্তার ধারা ছিল তার শুধু ওদের থেকে বিশিষ্ট হওয়া! ওরা রাতদিন গাধা-খাটুনী খাটে, রাতদিন একবস্ত্রে কাটায়, যে বস্ত্রে চিমটি কাটলে ময়লা ওঠে, অসহ্য হলে সাবান সোডার জলে সেদ্ধ করে নিজেরাই কেচে নেয় ওরা। পুরুষদের জামাটা কাপড়টাই শুধু ধোবার বাড়ির মুখ দেখে।
মলিনার গায়ে সর্বদা ব্লাউস সায়া, আর তাদের গায়ে ময়লার ছোপ ধরতে না ধরতে ধোবার বাড়ি চালান হয়।
সংসারের গাধা-খাটুনী কি মলিনাই খাটত না? কিন্তু নিঃসন্তান জীবনের সুবিধায় অবলীলায় সব করে নিত। তারপর ফিটফাট হয়ে বেড়াত।
চুলে গামছা চেপে চেপে পাতা কাটত মলিনা, রাঙতা দেওয়া টিপ কিনে পরত।
তখন মলিনার কথার ধরন প্রায় ওদের মতোই ছিল। স্বপ্নার মা, দাসগিন্নি, সুখদা।
এখন যেন আর একটা ভাষা এসেছে মলিনার মুখে। মেয়েমানুষদের সঙ্গচ্যুত হয়ে গিয়ে মেয়েলি ধরনের কথাগুলো বুঝি ভুলেই গেছে মলিনা। ভুলে যাচ্ছে আটপৌরে কথা।
কথা বলছে পোশাকী ভাষায়।
সে কথার ভঙ্গিতে রহস্যের ব্যঞ্জনা।
ছুটির দিনে সুধানাথ যদি কোথাও থেকে ঘুরে এসে বলে, আর একবার চা হলে কেমন হয়?
মলিনা বলে, খাওয়ার সঙ্গী চাইলে হবে না, না হলে হবে।
সুধানাথ বলে, অমন চায়ের মুখে ছাই।
মলিনা বলে, এ তো ভারী আবদার! সঙ্গী তা হলে জোটাও?
সুধানাথ গম্ভীরভাবে বলে, ভগবান তো দয়াপরবশ হয়ে দিয়েছেন জুটিয়ে।
মলিনা বলে, ভগবানের বালাই নিয়ে মরি। শ্মশান থেকে একখানা আধপোড়া কাঠ এনে তাকে পুতুল বানিয়ে ধরে দিয়েছেন সঙ্গী বলে।
সুধানাথ বলে, হতভাগার ভাগ্যে সেটুকুও সইলে হয়। দুর্ভাগাদের তো পোড়া শোলমাছও জলে পালায়।
মলিনা ভঙ্গি করে বলে, অধিক দুর্ভাগাদের আবার তাও পালায় না, গলায় কাঁটা বিঁধিয়ে ঝুলে থাকে।
.
হয়তো সুধনাথকে বলে মলিনা, তা তুমি সুষ্ঠু নিরিমিষ খাবে কেন? মাছ আনো বাপু, ঝাল ঝাল করে সর্ষের ঝোল বেঁধে দিই–
সুধানাথ বলে, আমার শর্ত তো জানো?
জানি। তা বলে পাগলের পাগলামী মানতে রাজী নই। মাছ না আনলে রাগারাগি করব।
করো! সেটাই বা মন্দ কি! তবু বোঝা যাবে বাড়িতে দুটো জ্যান্ত প্রাণী আছে।
বেশ তা হলে আগে যেমন করতে, তাই কর। সকালে সাত্ত্বিক আহার, রাত্তিরে রেস্টুরেন্টের মাংস পরোটা!
দায় পড়েছে আমার রাত্তিরে খাই খাই করে দু মাইল ছুটতে।
মলিনা রাগ করে বলে, তার মানে আমাকে চির অপরাধিনী করে রাখা। দেখানো যে, দেখো তোমার জন্যে কত সর্বত্যাগী হয়েছি আমি।
সুধানাথ কিন্তু এতেও রাগ করে না। বলে, বাঃ তোমার তো বুদ্ধিটা খুব প্রখর! ভেতরের রহস্য এতো বুঝে ফেলেছ?
তা হয়তো সুধানাথের কথার বাঁধুনীতে মলিনাও শিখেছে বাঁধুনী।
আর চিন্তাতেও বুঝি সেই নতুনত্বের বাঁধুনী।
এখন আর মলিনা ঘুম থেকে উঠে ভাবে না, আজ কয়লাগুলো সব ভেঙে ফেলব, আজ জড়ো করা জামাকাপড়গুলো সাবানে কেচে ফেলব, আজ কেটে-রাখা ব্লাউসটা সেলাই করে ফেলব। অথবা এ ভাবনাও আসে না তার, ছাপা ছিটের শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে, কেটে জানলার দুটো পর্দা বানালে হয়, বাসনওয়ালি এলে জিগ্যেস করতে হবে ছেঁড়া পাঞ্জাবী নেয় কি না।
না, এসব চিন্তা আর নেই এখন মলিনার।
মলিনা এখন ঘুম থেকে উঠে এই ধরনের কথা ভাবে, আজ দুখানা মোচার বড়া করতে হবে, আমার জন্যে মানুষটা নিরিমিষ খেয়ে সারা হচ্ছে।…
মুখ ফুটে সেদিন বলেছিল, ওর মা মরে পর্যন্ত নাকি সরুচাকলি খায়নি, দুটো চাল ডাল ভিজিয়ে রাখতে হবে, আজই করে দেব।
সামান্য দুটো নিরিমিষ রান্না, তাই খেয়েই কত খুশি, যেন বর্তে যাচ্ছে। অথচ তার বিনিময়ে কত দিচ্ছে তার হিসেব করবারও সাহস নেই মলিনার।
শুধুই কি খাওয়া পরা?
শুধুই আশ্রয়? শুধুই কি অর্থসামর্থ্য?
জীবনটা বিকিয়ে দেয়নি?
সমগ্র ভবিষ্যৎ?
মান সম্রম, সমাজ পরিচয়?
আত্মীয়জনের দিকে যায় না আর ও, পুরনো আলাপীদের ছায়া মাড়ায় না, নির্বাসন দণ্ড নিয়ে বসে আছে।
অথচ আমি ওকে অহরহই দিচ্ছি মুখনাড়া, দিচ্ছি ঝঙ্কার। বলছি, আমাকে খাঁচায় পুরে রেখেছ।…আমায় স্বাধীনতার ভাত খেতে দিচ্ছ না।
রাগ করে ও একদিন বলে বসেছিল, ও স্বাধীনতার চিন্তা তো তোমার লোকের বাড়ি রান্না করা? তা বেশ তো মনে কর না তাই করছ। মিটে যাবে বিবেকের দংশন।
তখন মলিনাকে বাধ্য হয়ে হৃভঙ্গি করতে হয়েছে। অলৌকিক একটু হাসতে হয়েছে।
বলতে হয়েছে, আহা তাতে তো মাইনে আছে গো! এ যে বিনি মাইনের খাটুনি।
গরিবের বাড়িতে কাজে ঢুকলে এই দুর্দশাই ঘটে।
বলে নির্নিমেষে তাকিয়ে থেকেছিল ও মলিনার মুখের দিকে।
.
যদিও মলিনার সেই পাতা কাটা চুল আর পরিপাটি টিপ পরা উজ্জ্বল মুখ আর নেই এখন।
চুল বাঁধার পাট গেছে। একরাশ জট পড়া চুল হাতে জড়িয়ে জড়িয়েই চলছে।
কিন্তু কদাচ কখনও চুলটা জট ছাড়াতে বসে আশীতে দেখতে দেখতে মনে হয় মলিনার মুখটা যেন আজকাল তার থেকে বেশি ভালো দেখাচ্ছে। অন্য ধরনের ভালো।
রাস্তায় ঘাটে যে সব ফ্যাসানি মেয়েদের দেখেছে মলিনা, মলিনার মুখে যেন তাদের ছাপ। তাছাড়া সুধানাথও তো কই বলে না চুলে তেল দাও না কেন? বাঁধো না কেন?
মলিনা তাই চুলে আর তেল দেয় না।
অথচ সুধানাথ ভাবে মলিনা কৃচ্ছ্বসাধন করছে। মলিনার চিন্তার ধারা বদলেছে বৈ কি।
আচ্ছা, এই মলিনাকে কি লোকে সতী মেয়ে বলবে?
অকস্মাৎ কর্পূরের মতো উবে যাওয়া স্বামীর জন্যে যে কেঁদে কেঁদে নিজকে কর্পূরের মতো শেষ করে ফেলছে না, পরপুরুষের ভালো-লাগা, ভালো-না-লাগার চিন্তায় দিনের অধিকাংশ ব্যয় করে ফেলছে, এ মেয়ে অসতী ছাড়া আর কি?
হঠাৎ একটা পোড়া গন্ধে চমক ভাঙল।
আর সঙ্গে সঙ্গে একটা গলার স্বরেও।
এই সেরেছে, রাঁধতে রাঁধতে ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি? কি পুড়ল?
মলিনা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বিচিত্র একটু হেসে বলে, তোমার কপাল!
আমার কপাল!
হেসে ওঠে সুধানাথ, সে কি তোমার ওই কড়াতে চাপানো ছিল নাকি?
ছিলই তো! ওই কপালকে লোহার কড়াইতে করে গনগনে আগুনে চড়িয়েই রেখেছি তো সর্বদা, পুড়ছে আঙার হয়ে।
সুধানাথ একটা সিঁড়ি টেনে নিয়ে বসে বলে, পোড়া কপালই বা মন্দ কি? বেগুন পোড়াও তো ভালোবেসে খায় লোকে।
হতভাগা, অভাগারা খায়।
সুধানাথ একটু ক্লান্ত হাসি হেসে বলে, তা সবাই কি আর ভাগ্যবান হয়?
এও ভালোই। হঠাৎ অলসভঙ্গি ত্যাগ করে রান্না ছেড়ে উঠে আসে মলিনা।
তীব্রস্বরে বলে, ভালো থেকে আমাদের কী হবে বলতে পার?
সুধানাথ দাঁড়িয়ে ওঠে।
চমকে ওঠে।
বলে, কী বলছ?
যা বলছি তা বুঝতে পারবে না এত খোকা তুমি নও। আমি বলছি আমাদের কি আর কেউ সমাজে নেবে? প্রাণপণ করে ভালো হয়ে থাকলেও কেউ ভালো বলবে? আমরা যে কী করে কাটাচ্ছি, কেউ বুঝবে? বিশ্বাস করবে?
হাঁপাতে থাকে মলিনা।
সুধানাথ উত্তর দেয় না।
সুধানাথ একটা অদ্ভুত কাজ করে। সুধানাথ দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে খিলটা বন্ধ করে দেয়।
পোড়া তরকারি সুদ্ধ কড়াটা নামানো থাকে, পড়ে থাকে মাখা ময়দা। উনুনটা জ্বলে জ্বলে ঠাণ্ডা হয়ে যায়, মলিনা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।
মলিনা বুঝতে পারে না কার কাছ থেকে পালাল সুধানাথ! নিজের কাছ থেকে, না মলিনার কাছ থেকে?
সন্ধ্যা গড়িয়ে অনেকটা রাতে গিয়ে ঠেকে।
মলিনার হঠাৎ অজিতের সেই না-ফেরার রাতটা মনে পড়ে যায়। তেমনি বুক ছম ছম রাত যেন এটা! তেমনি ভয়ানক একটা বিপদ যেন হাঁ করে তাকে গ্রাস করতে আসছে।—যেন সব কিছু হারিয়ে ফেলবে আজ মলিনা।
মলিনার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
হঠাৎ এক সময় সুধানাথের ঘরের দরজাটা খুলে যায়। মনে হয় চুলগুলো কে যেন ওর ঝুঁটি ধরে নাড়া দিয়েছে। চোখ দুটো জবাফুলের মতো লাল। কাছে এসে মলিনার একটা হাত চেপে ধরে। অস্বাভাবিক গলায় বলে, চল আজ রাত্তিরে বাড়ি থেকে কোথাও বেরিয়ে যাই।
বেরিয়ে যাব!
হা! হ্যাঁ। চল না রাস্তায়, গঙ্গার ধারে, কোনো ঠাকুরতলায়। হেঁটে হেঁটে কাহিল হয়ে ফিরে আসব।
মলিনা উঠে দাঁড়ায়।
শান্তস্বরে বলে, না! এত কষ্ট তোমায় করতে দেব না। ভালো থাকার আমার দরকার নেই।
.
চার বাড়ির কাজ করা একটা ঝি, সামান্য মাইনেয় বাসন মেজে দিয়ে যায়। ভোরের ঘুমটা ভাঙিয়ে দেয়, অধৈর্য কড়া নাড়ার শব্দে।
কিন্তু আজ যেন সে শব্দটা বুকের মধ্যে ঝনাৎ করে একটা লোহার ঘা মারল। যেন মলিনাকে ভয়ঙ্কর একটা শাস্তি দেবার গোঁ নিয়ে এই শব্দটা হানছে ও।
উঠি তো পড়ি করে ছুটে এসে দরাজাটা খুলে দিল মলিনা, আর সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল।
বসে পড়ল ধুলো কাদা আর জলে ভেজা গলিটায়।
যে এই শব্দের মুগুর হেনেছিল, সে কি মলিনার এই দুর্দশায় হেসে উঠল?
অস্ফুট চেতনায় ঘর থেকে মনে হল সুধানাথের একটা যেন হাসির শব্দ উঠল কোথায়।
যে হেসেছিল, সে কি ক্রুর একটা ব্যঙ্গের সুর নিয়ে কথাও বলেছিল কিছু?
মলিনারও মনে হল কী যেন বলল লোকটা। মলিনার মাথার মধ্যে শুধু শব্দটা ধাক্কা দিল। মলিনা কথাটা শুনতে পেল না।
তারপর মলিনা অস্ফুট চিৎকার করে উঠল, না, না, আমি মলিনা নই।
সুধানাথ খুব জোরে একটা দরজা বন্ধ করার শব্দ পেল।
সুধানাথ ভাবল ঝিটা কি অসভ্য!
এই ভোরবেলা দুম দাম! তারপর ভাবল, কিন্তু মলিনা কেন ফিরে আসছে না। ওর সঙ্গে কী এত কথা কইছে! কিন্তু নিঃসাড়েই বা কেন?
অনেকক্ষণ পরে উঠে এসে বাইরে দাঁড়াল, বলল, তোমার ঝিয়ের সঙ্গে এত দেরী হচ্ছিল কিসের?
মলিনা মাথা নেড়ে আস্তে বলল, কই আসেনি তো ঝি।
আরে! কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম, দরজা খোলার শব্দ পেলাম!
পাশের বাড়ি বোধহয়!
পাশের বাড়ি? কখনো না, কে এসেছিল বল?
মলিনা বলল, অধিকার জন্মেছে বুঝি? তাই সন্দেহ করতে শুরু করছ।
সুধানাথ একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকল মলিনার মুখের দিকে। আর সহজ সুরের সহজ কথা এগোল। আস্তে সরে গেল।
একটু পরে মলিনা বলল, শরীরটা ভালো লাগছে না, বাইরে কোথাও খেয়ে নিতে পারবে?
সুধানাথ অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, পারব না কেন? কিন্তু–তুমি?
আমি? খাবার মতো শরীর হয়, উঠব, রাঁধব, খাব।
একটু পরে জামা জুতো পরে বেরিয়ে গেল সুধানাথ।
.
তখন ভর দুপুর।
মাধব ঘোষের বাসার জোয়ান পুরুষরা তখন সকলেই কাজের ধান্ধায় বাইরে। মেয়েরা কেউ কেউ সকালের রান্নার পাট সেরে রাতের রান্না সেরে রাখছে। কেউ বা স্কুল থেকে ফেরা ছেলেমেয়ের জন্যে রুটি গড়ে রাখছে। কেউ বা সব সেরে ভাতের কঁসি নিয়েও বসেছে।
হঠাৎ চোখ পড়ল দাস গিন্নির।
চমকে উঠে বললেন, ওমা, তুমি আবার পোড়া মুখ পুড়িয়ে কোথা থেকে?
মণ্ডল গিন্নি মুখ বাড়িয়ে বললেন, কি গো দাস দিদি?
নগেনবাবুর বউ বললেন, ওমা কী সর্বনাশ!
সুখদা এল।
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে বলল, ওমা আমার কপাল! কাল মানুষটা সারাদিন এইখানে বসে, তখন তোমার টনক নড়ল না? বলি খবরটা দিল কে?
মলিনা এত কথার উত্তর দিল না।
মলিনা শুধু উভ্রান্তের মতো বলল, কোন্ ঘরে উঠেছে ও?
ঘরে আবার কি? এইখানেই। পাঁচ ঘরে। কত সাধলাম দুটো খেতে। তা কী আর খায়! এত বড়ো ঘেন্না সয়ে যে হার্টফেল করেনি, খাড়া বসে ছিল, এই ঢের! তারপর কখন যেন উঠে গেল। তা
তুমি আবার কী মনে করে?
মলিনা আরও উদ্ভ্রান্তের মতো বলে, ও কি ওর জিনিসপত্তর রেখে গেছে?
শোনো কথা, জিনিসপত্তর আবার কোথা?
আজ আসেনি ও?
আজ আবার কই এল? আর আসে মানুষ? আর মুখ দেখায়? পরিবার যার পরপুরুষের সঙ্গে বেরিয়ে যায়, সে আর লোকালয়ে থাকে? মেয়ে জাতের মুখে তুমি কালি দিয়েছ মলিনা। তোমার কলঙ্কে আমাদের মাথা হেঁট!
মলিনা উঠে দাঁড়ায়।
মলিনা রাস্তায় বেরিয়ে অনেকগুলো গলার হাসি শুনতে পায়।
লহরে লহরে হাসি। তার সঙ্গে টুকরো টুকরো কথা।
ঘরের খোঁজ! জিনিসপত্তরের খোঁজ! আবার সংসার করবার সাধ না কি লো? হতে পারে। ছোঁড়া বোধহয় ভেগেছে। শুনল কোথায়? কে বলল?
কানের পর্দাটা পুড়ে যাচ্ছে। এত রোদ কেন?
মলিনা ছুটতে শুরু করল।
মলিনা এই ভর দুপুরের চড়া রোদ থেকে পালাবে।
.
খবরটা আনল সেই হাবা, কালা মদনা।
বলল, ও বাবা গো, সে কী রক্ত! যেন এক কুড়ি পাঁঠা কেটেছে?
তিন কুড়ি লোক ঠিকরে রাস্তায় বেরিয়ে এসে বলল, কোথায় কোথায়?
উই সেইখেনেই। সেই লেবেল ক্রসিংয়ের ওইখানে। মুখটা ঘেঁচে যায়নি, তাই সদ্য চিনতে পারলাম বামুন কাকি। রক্তে আর কাপড়চোপড়ের কিছু পদাথ্যি নেই–
ওরা শেষ অবধি শুনল না।
ছুটতে লাগল।
এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখবার সুযোগই বা কবার আসে জীবনে?