কাকা-কাকীমার ফিরতে সত্যিই দেরি হচ্ছিল। তবু কাল অফিস নেই বলে বাবলি সাড়ে এগারোটা অবধি দেখল। তারপর খেতে বসল। একা। একা। খাওয়ার পর কিষাণ সিংকে দিয়ে কাকা-কাকীমার খাবার-টাবার ঠিক করে রাখিয়ে, জলের জাগ, গ্লাস, প্লেট, চামচ ইত্যাদি সব সাজিয়ে ও ঘরে গেল।
ঘরের দরজা সবে বন্ধ করেছে এমন সময় টেলিফোনটা বাজল।
বাবলি উঠে গিয়ে টেলিফোনটা ধরল।
কাকার ফোন। কাকার গলা খুব ভারী শোনাল। কাকা শুধু দুটো কথা বললেন। বিমানবাবু মারা গেলেন রে বাবলি। আমাদের আসতে একটু দেরি হবে। তুই শুয়ে পড়িস। আজ আর খাব না আমরা।
মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
বিমানবাবু ও তার মোটাসোটা হাসিখুশি স্ত্রীকে দু-একদিন দেখেছে। বাবলি ওদের বাড়িতে। বিমানবাবু খুব দরাজ হাসি হাসতেন। হঠাৎ কার যে কি হয়। মানুষের জীবনের কিছুই ঠিক নেই।
বাবলি তখনো ঘরে ঢোকে নি, বসবার ঘরে একটা জানালা খোলা ছিল, কিষাণ সিং বুঝি বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। বাবলি জানালাটাকে বন্ধ করছে এমন সময় ফোনটা আবার বাজল। বাবলি ওয়াল-ক্লকে চেয়ে দেখল, সাড়ে এগারোটা বাজে রাত।
ফোনে একবার খারাপ খবর এলে পরের বার ফোন বাজলে ফোন ধরতে ইচ্ছে করে না। কারুরই করে না। বুকের মধ্যে দুরদুর করে। তখন অন্য কেউ হাতের কাছে থাকলে তাকেই ফোন ধরতে বলতো ও। কিন্তু কেউই নেই এখন। বাবলি ভীরু পায়ে এগিয়ে ভয়ে ভয়ে রিসিভারটা তুলোে। তারপর যেন কোনো খারাপ খবর আর ও শুনতে রাজী নয়, এমনভাবে প্রতিবাদের গলায়, বিরক্তির গলায় বলল, হ্যালো।
ওদিক থেকে কঁপা ভয়ার্ত গলায় কে যেন বলল, হ্যালো, আপনি কে?
বাবলি ভয় পেল। কোনো বাজে লোক নয়তো? হয়তো জেনে গেছে, বাবলি একা আছে বাড়িতে।
সেই রাতের রহস্যময় চাপা দ্বিধাগ্রস্ত স্বর আবার বলল, বাবলি আছেন?
বাবলি রুক্ষ গলায় বলল, আপনি কে?
আবার সেই স্বর বলল, আপনি বাবলি?
হঠাৎ, একেবারে হঠাৎ, যেভাবে হঠাৎ কোনো ইলেকট্রিক ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যায়, তেমন করে সেই ভয়টা বাবলিকে ছেড়ে চলে গেল। তার বদলে একটা আলোজ্বলা খুশির ট্রেন বাবলির মনের প্ল্যাটফর্মে এসে ঢুকল।
বাবলি একটু থেমে বলল, আপনি কে? অভী?
–হ্যাঁ, আমি। রাগ করলেন? ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আপনি?
–না। বাবলি বলল। তারপরেই বলল, আপনি কি করছিলেন?
–শুয়ে ছিলাম।
–ঘুমোন নি কেন এত রাত পর্যন্ত?
–ঘুম আসছিল না। কিছুতেই ঘুম আসছিল না।
বাবলি হাসলো। বলল, আমি কি আপনার ঘুমের ওষুধ? আমি কি স্লিপিং পিল?
লজ্জিত গলায় ওপাশ থেকে অভী বলল, জানি না।
বাবলি বলল, অমন চোরের মতো গলায় কথা বলছেন কেন?
অভী আরো লজ্জা পেল। বলল, সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। দাদা-বৌদির ঘরের পাশেই ফোনটা। শুনতে পেলে?
–শুনতে পেলে কি? বাবলি হেসে শুধোল।
বাবলির জীবনে বাবলি এই-ই প্রথম জানলো ওর কতখানি দাম, কত ইমপর্ট্যান্ট ও অন্য একজনের চোখে। জেনে ভালো লাগল যে, সে ঘুমপাড়ানি মাসী-পিসী হয়ে আরেকজনের চোখে গিয়ে উড়ে না বসলে একজনের ঘুম আসে না।
অভী বলল, নাঃ, রাত বারোটার সময়! তা-ই।
বাবলি বলল, তাহলে ঘুমিয়ে পড়ুন।
অভী একটু চুপ করে থাকল। তারপর বলল, কাল দেখা করতে চাই। কাল কখন অফিস ছুটি আপনার?
বললাম না ছুটি নিয়েছি অফিস। ধমকের সুরে বাবলি বলল।
বাবলির একথা ভেবে ভালো লাগল যে, তার এতদিনে একজন ধমক দেওয়ার লোক হল। সে মুখ নীচু করে ভালোলাগার সঙ্গে তার ধমক শুনবে।
অভী বলল, ইউনিভার্সিটিতে আমার কাজ চারটের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। আপনি সাড়ে চারটেয় আসুন।
–কোথায়? বাবলি বলল।
–কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজের রেস্তোরাঁয়। আমি থাকব! কনট সার্কাসে।
বাবলি বলল, আসব।
অভী বলল, ছাড়ি?
বাবলি বলল, ঘুমিয়ে পড়ন লক্ষ্মীছেলের মতো কেমন?
অভী হাসল। বলল, লক্ষ্মীমেয়ের মতো আপনিও।
বাবলি হাসল। বলল, তাই-ই।
–ছাড়ুন। অভী বলল।
–না। আপনি আগে ছাড়ুন।
অভী ফোন ছেড়ে দিল।
তারপর বাবলিও ছাড়ল।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে অনেকক্ষণ বসে রইল বাবলি। শাড়িটাড়ি ছেড়ে হাল্কা সুতীর নাইটিটা পরল। মুখে ক্রীম লাগাল। ঘাড়ে, গলায় বুকে এবং সমস্ত শরীরে পাউডার মাখল। গলার কাছে ফ্রিল দেওয়া ও লেস বসান হাল্কা গোলাপী রঙা নাইটিটাতে ও নিজেকে খুব সুন্দরী দেখে। আয়নার সামনে বসে ও আয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলল, একদিন শুধু তুমিই আমাকে এই রুদ্ধ ঘরের মধ্যে নাইটিতে দেখেছ। দিন আসছে, যেদিন তুমি ছাড়াও আর একজন আমাকে দেখবে। সেদিন তোমার সামনে বসে একা একা এমন করে তোমার সঙ্গে কথা বলার অবসর আমার হবে না। বুঝেছ আয়না? তখন একজনের চোখের সামনে আমায় বসে থাকতে হবে–অনেকক্ষণ অনর্গল আগল দেওয়া ঘরে বসে আমায় কথা বলতে হবে তার সঙ্গে। সেদিন তুমি কি হিংসা করবে তাকে? সেই অন্যজনকে? কি আয়না। করবে হিংসা?
বিছানায় গিয়ে শুল বটে। কিন্তু ঘুম এল না বাবলির। কিছুতেই ঘুম এল। অভীর ঘুম না-আসা রোগটা টেলিফোনের তার বেয়ে এসে বাবলিকে কোনো অদৃশ্য ভাইরাস ইনফেকশনের মতো পেয়ে বসল।
এপাশ ওপাশ করল। পাখাটাকে আরো জোর করল। বারান্দার দিকের জানলা খুলে দিল। এক সময় নাইটিটাও খুলে ফেলল। শুধু প্যান্টি পরে শুয়ে রইল। তবুও ঘুম এল না বাবলির। বাবলির সব ঘুম কে যেন চুরি করে নিয়ে গেছে। বাবলির সমস্ত হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও।
পরদিন দুপুরের খাওয়ার পর বাবলি শুয়েছিল। কাকীমাও ঘুমোচ্ছিলেন নিজের ঘরে– সারারাত ঘুমোন নি কাকীমা। বাবলি যখন শেষ রাতে ঘুমিয়েছিল ভোর হওয়ার আগে ঠিক তখনই কাকা-কাকীমা বাড়ি ফিরেছিলেন। বাবলি জানতে পারে নি। কাকীমার মুখে সেই এক কথা। বিমানবাবুর স্ত্রীর বিলাপ। ছেলেমেয়েদের কান্নাকাটির কথা।
বাবলির ভালো লাগছিল না ওসব কথা শুনতে। ও মনে মনে যখন এক দারুণ আনন্দময় অবস্থার মধ্যে অবস্থান করছিল সেই সময় কারও করুণ দুঃখের কাহিনী, তার শোকাবহতা; এসব কিছুই বাবলি শুনতে রাজী ছিল না। তাছাড়া আশ্চর্য! বাবলি নিজেও ভেবে অবাক হল যে, কাকীমার এই মন খারাপ, বিমানবাবর মত্যর এই শোক তার মনকে একেবারে স্পর্শমাত্র। করল না। সেই মুহূর্তে ওর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে, পৃথিবীতে মৃত্যু আছে, শোক আছে, কাউকে হারাবার বিয়োগব্যথা আছে। ওর সমস্ত মনে আনন্দ, সমস্ত রকম আনন্দের যোগফল তখন ওর পায়ের রুপোর পায়জোরের মতো চলতে ফিরতে ঝমঝম করে বাজছিল।
ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে উঠে বাবলি বাথরুম থেকে ঘুরে এল মুখ-টুখ ধুয়ে। ভালো করে চুলটা বাঁধল। আজ চান করার সময় শ্যাম্পু করেছিল ও। চুল বাঁধল, আইব্রো পেন্সিল বোলাল ভুরুতে–তারপর সাদা জমির ওপর কালো ছাপার কাজের একটা অর্গান্ডী শাড়ি বের করল আলমারি থেকে। সঙ্গে কালো সিল্কের ব্লাউজ, কালো ব্রেসিয়ার, ছাইরঙা সায়া। কালো পাথরের একটা তিব্বতী মালা বের করল ড্রয়ার থেকে। তারপর কালো একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে ঠিক পৌনে চারটার সময় বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।
দিল্লিতে এ সময়টা ভীষণ গরম পড়ে। বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই ঘেমে উঠল বাবলি। ট্যাকসিই নিত একটা কিন্তু ট্যাকসিস্ট্যান্ডে ট্যাকসি ছিল না।
কনট্ সার্কাসে গিয়ে ও যখন নামলো, তখন চারটে বেজে কুড়ি। বাসে একেবারে ঘেমে উঠল বাবলি। ভীষণ রাগ হচ্ছিল ওর। কটেজ ইন্ডাস্ট্রীর রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে একটা কোকা-কোলার অর্ডার দিল বাবলি। পাখার নীচের টেবিল বেছে নিয়ে বসল ও কামনা করছিল যে, অভী একটু দেরি করে আসুক। ওর ঘামটা ততক্ষণে শুকিয়ে যাক। ও চায় না যে, অভী ওকে এমন ভূতের মতো দেখুক।
কোকা-কোলাটা খাওয়ার পর দেখল ঘড়িতে প্রায় সাড়ে চারটে বাজে। ততক্ষণ ওর ঘাম শুকিয়ে গেছে। তবুও একবার উঠে গিয়ে কটেজ ইন্ডাস্ট্রীর এম্পোরিয়ামের ভেতর ঢুকে লেডিজ রুমে গিয়ে ভুরুটা ঠিক করে নিল। ঠোঁটটা গরম হাওয়ায় শুকিয়ে গিয়েছিল। পাতলা করে ভেসলিন বুলিয়ে নিল একটু। তারপর রেস্তোরাঁতে ফিরে এলো। তখনও অভী আসে নি।
অভী এল চারটে চল্লিশে। একটা সাদা রঙের ট্রাউজার আর তার ওপরে খয়েরীরঙা ফ্রেড-পেরী গেঞ্জী পরে অভী রেস্তোরাঁর মুখে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিকে চেয়ে বাবলিকে খোঁজার চেষ্টা করছিল।
ওর গেঞ্জীর বোতামগুলো সব খোলা ছিল। কপালে চুল লেপ্টে ছিল ঘামে। লম্বা সুগঠিত শরীরের অভীকে অনেক অনেক সুন্দর স্মার্ট পাঞ্জাবী ছেলেদের পটভূমিতেও স্ট্রাইকিংলি হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছিল। বাবলি অবাক হল ভেবে যে,ইম্ফল থেকে ডিমাপর আসার পথে অভীর এই পুরুষালী সৌন্দর্য কেন একবারও ওর চোখে পড়ে নি? কে জানে? ভাবল বাবলি, ওর চোখ দুটোই হয়তো এখন বদলে গেছে। অভী হয়তো আগের মতই আছে।
বাবলি উঠে দাঁড়াল, উঠে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল অভীকে।
অভী হাসল। হেসে কাছে এল। তারপর চেয়ার টেনে বাবলির সামনে বসে পড়েই বলল, এ জায়গাটা বেশ স্টাফী-যদিও সামনেটা খোলা। চলুন, কিছু খেয়ে, বাইরে বেরিয়ে পড়ি।
বাবলি বলল, যা বলবেন।
তারপর বলল, আমারও এ জায়গাটা ভালো লাগে না। সব সময় লোক গিজ গিজ করে-কনুইয়ে কনুইয়ে ঠেকে যায়।
অভী বলল, কি খাবেন বলুন?
বাবলি বলল, আমি খাওয়াব কিন্তু।
একটু থেমে বাবলি বলল, দহিকচুরি খাবো আমি। আপনি?
অভী বলল, আমি কিছুই খাব না, শুধু চা।
–না, তাহলে হবে না। আপনারও কিছু খেতে হবে।
অভী ওর বলার ধরন দেখে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, আপনি এখনও বাচ্চা মেয়ে আছেন। বলে ফেলুন, না খেলে খেলব না।
বাবলি লজ্জা পেল। বলল, আ-হাঃ, আমি মোটেই বাচ্চা নেই। বলুন কি খাবেন?
অভী বলল, তাহলে একটা দোসা খাব। প্লেন দোসা।
বাবলি বেয়ারাকে ডেকে খাবার অর্ডার দিল। তারপর অভীর দিকে ফিরে বলল, কি? শেষ পর্যন্ত ঘুম হয়েছিল?
অভী লজ্জা পেল। রাতে কেন সে এমন ছেলেমানুষী করেছিল, তা ভেবেই ওর লজ্জা লাগছে। ও বলল, না। বৌদি পোলাও-মাংস রান্না করেছিলেন; তাই বোধহয় খেয়ে পেট গরম হয়ে থাকবে।
বাবলিও কথা ঘুরিয়ে বলল, এখন ভালো আছেন?
অভী বলল, হ্যাঁ। ভালো। আপনাকে দেখেই হয়ে গেলাম।
বাবলি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ইস্, বানিয়ে বানিয়ে বলতে হবে না।
খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে বিল মিটিয়ে ওরা যখন জনপথ ধরে হেঁটে যেতে লাগল পাশাপাশি, তখন রোদের তেজ একটু কমেছে। কিন্তু সন্ধ্যা হতে তখনও অনেক দেরি। সাতটার আগে দিল্লিতে সন্ধ্যে হয় না গরমের দিনে। পথঘাট সব তেতে রয়েছে। একটা গরম ঋঝ উঠছে চতুর্দিক থেকে।
ওরা ধীরে ধীরে তিব্বতী রিফিউজীদের দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ বাবলি বলল, দাঁড়ান, আপনাকে দুটো কাফ-লিংকস্ কিনে দিই।
অভী আপত্তি করল না।
বাবলি বেছে বেছে একজোড়া কাফ-লিংকস্ কিনে দিল।
ওরা ইম্পিরিয়াল হোটেল ছাড়িয়ে, ওয়েস্টার্ন কোর্ট ছাড়িয়ে জনপথ হোটেলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল।
অভী হঠাৎ বলল, কাউকে কিছু দিতে আপনি খুব ভালোবাসেন, না?
বাবলি মুখ ঘুরিয়ে অভীর দিকে তাকাল।
বলল, সকলকে না। কাউকে–কাউকে।
পরেই বলল, আপনি ভালোবাসেন না দিতে?
অভী বলল, মাকে, দিদিকে দাদা-বৌদিকে দিতে ভালো লাগে। বন্ধুদেরও। তবে বাইরের লোককে কখনও কিছু দিই নি।
‘বাইরের লোক’ কথাটা বাবলির কানে লাগল। একটু গম্ভীর হয়ে বলল, হ্যাঁ, বাইরের লোকদের কিছু দেবেন না। মিছিমিছি অপচয় করবেন কেন?
অভী হাসল। বলল, কথাটা আপনি বুঝলেন না। আমি বলতে চেয়েছিলাম যে, দেবার মতো কোনো সম্পর্ক মা-দিদি-দাদা-বৌদি ছাড়া এখনও কোনো মানুষের সঙ্গে তেমনভাবে পাতানো হয় নি। হবে হয়তো। হয়তো শীগগিরই হবে।
বলেই, বাবলির মুখের দিকে তাকাল।
কেন জানে না, দিল্লি জায়গাটা অভীর দারুণ লাগে। শুধু খারাপ লাগে এক কারণে যে পুরো ভারতবর্ষের, বিশেষ করে কলকাতার দারিদ্র্য, নোংরা, ভিড়, অসুবিধা, কষ্ট এসব দেখে এসে দিল্লি যে ভারতবর্ষেরই রাজধানী, একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কনট সার্কাসের রঙীন ফোয়ারার খরচে অনেক হাসপাতাল, অনেক বেশি প্রয়োজনীয় জিনিস বানানো যেত হয়তো। তাই এই অসাম্যটা বড় চোখে লাগে।
এছাড়া দিল্লির কোনো খুঁত নেই। বিশেষভাবে নতুন দিল্লির চওড়া চওড়া। পথঘাট, চমৎকার আবহাওয়া। হাঁটতে, বেড়াতে খুব ভাল লাগে অভীর এখানে।
ওরা কোটার মহারাজার বাড়িটা বাঁদিকে রেখে এম পি-দের বাংলোগুলো ডানদিকে রেখে হাঁটতে লাগল। বড় বড় গাছ ছায়া ফেলেছে পথে। গাড়ি, সাইকেল সব ছুটে চলেছে অফিস ছুটির পর। ওরা দুজনে নানারকম কথা বলতে বলতে হেঁটে চলেছে তো হেঁটে চলেইছে। যেসব কথার মানে নেই কোনো। মিরান্ডা হাউসের গল্প। এ গল্প, সে গল্প। অফিসের গল্প।
অভী কথা বেশি বলছে না। শুনছে বেশি। বাবলিই বকবক করছে।
ওরা একটা পথ পেরোবে, এমন সময় একটা টোয়োটা গাড়ি, সাদা রঙা, দাঁড়িয়ে পড়লো ওদের দেখে, পথের বাঁপাশে থামল। অভী দেখল, স্টিয়ারিং-এ বসা, একটি পাঞ্জাবী মেয়ে হাত নাড়িয়ে বাবলিকে ডাকছে।
বাবলি হাত নাড়িয়ে ওকে হাত দিয়ে এগিয়ে যেতে ইশারা করে বলল, থ্যাংকুয়ু অনীতা, থ্যাংকুয়ু। উই আর এনজিয়িং দ্য ওয়াক। থ্যাংকুয়ু ভেরী মার্চ।
অভী শুধাল না কিছু।
একটু পরে বাবলি নিজেই বলল, আমার বন্ধু অনীতা সাবারওয়াল। আমার সঙ্গে মিরান্ডা হাউসে পড়ত। এখানে বাটিকের দোকান করেছে। একটা। খুব ভালো ব্যবসা। ওর স্বামীর কি সব কারখানা-টারখানা আছে ফরিদাবাদে। ভদ্রলোক এঞ্জিনীয়র।
অভী বলল, তাই বুঝি?
অনীতার কথা উঠতেই বাবলি হঠাৎ বলল, আচ্ছা আপনি ঝুমাকে চেনেন? ঝুমা সেন। এয়ার হোস্টেস। ওকে একবার দেখলে ভোলবার কথা নয়। দারুণ সুন্দরী।
বলেই, একঝলক দেখে নিলো অভীর চোখে।
অভীর মুখে কোনো ভাবান্তর হল না।
হল না দেখে, বাবলি খুশি হল।
অভী বলল, নাম তো মনে নেই। একজন এয়ার হোস্টেসের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, বাঙালি; কলকাতার ক্লাবে সাঁতার কাটতে গিয়ে। হ্যাঁ, এখন মনে পড়ছে, বেশ ভালোই দেখতে। তবে মনে করে রাখার মতো কিছু বলে তো মনে হয় নি।
তারপর বলল, আসলে শুধুই চেহারাটা বোধহয় কোনো ব্যাপার নয়। আমার চোখে বোধহয় খুব সুন্দরী হলেই কাউকে অ্যাট্রাকটিভ ঠেকে না। হয়তো এই আমার দোষ, কিংবা গুণ; জানি না।
বাবলি বলল, ঝুমাও আমাদের সঙ্গে পড়ত। এবার আসবার সময় দমদম এয়ারপোর্টে দেখা হল ওর সঙ্গে। ও কিন্তু আপনার সম্বন্ধে না বলেই, চোখ বড় বড় করে ভুরু নাচিয়ে বলল, যাকে বলে একেবারে কি বলবো–হেড ওভার হিলস। আপনার স্যুইমিং কস্টুম পরা ছবি হ্যান্ডব্যাগে করে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝুমা। এ খবর কি আপনি রাখেন?
কথাটা বলে ফেলেই বাবলি বুঝতে পারল যে ভুল করেছে ও। বাবলি ভাবল, অভী বাবলির চোখে একটা অপ্রত্যাশিত ঈর্ষার আগুন নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবে।
নিজেকে অভিশাপ দিতে লাগল বাবলি কথাটা মুখ ফুটে বলার জন্যে।
অভী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আশ্চর্য।
তারপর বলল, ইটস্ ভেরী কাইন্ড অফ হার। তবে, আমার সঙ্গে ওঁর আলাপ নিতান্তই ফর্মাল আলাপ।
বাবলি কথাটার মোড় ফেরাবার জন্যে বলল, ও আমার সঙ্গে পড়তো তো, তা-ই।
অভী ইনডিফারেন্ট গলায় যেন অনেক দূর থেকে বলছে, এমনভাবে বলল, আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু?
বাবলি সতর্ক হয়ে গেল। কি জবাব দেবে ভেবে পেল না।
বলল, যখন একসঙ্গে কলেজে পড়তাম, তখন ঘনিষ্ঠতা নিশ্চয়ই ছিল। এখন অবশ্য দেখা-সাক্ষাৎ নেই।
অভী হঠাৎ বলল, উনি কি ইম্ফলের ফ্লাইটে যান কখনও?
বাবলি মিথ্যা কথা বলল। বলল, জানি না।
বাবলির গলাটা এমন শোনাল যে, ও যে শুধু জানে না, তা-ই নয়, জানতে চায়ও না।
অভী বলল, আমি যেদিন ইম্ফল থেকে আসি, তার আগের দিন অফিসে একজন এয়ার হোস্টেস আই এ সির অফিস থেকে ফোন করেছিলেন। আমি অফিসে ছিলাম না তখন, আমার টেবলে মেসেজটা লেখা ছিল। তখন মনে হয়েছিল, অপারেটর ভুল মেসেজ নিয়েছে। কারণ আমি মোটেই সুইমিং ক্লাবে দেখা আপনার বান্ধবী যে ইম্ফলে এসেছেন, এ ব্যাপারটা কানেক্ট করতে পারি নি তখন। এখন তো মনে হচ্ছে, মিস সেন তাহলে উনিই হবেন হয়তো।
বাবলির খুব রাগ হল মনে মনে। ঝুমার এই গায়ে-পড়া জোর করে ভালোবাসা স্বভাব দেখে ঘেন্নাও হল। কিন্তু দোষটা বাবলির। কেন এই প্রসঙ্গ ও তুলতে গেল?
পরক্ষণেই অভী বলল, অত্যন্ত স্বল্পপরিচিত একজন ভদ্রলোককে এমনভাবে ফোন করে দেখা করতে বলাটা বেশ ব্যাড টেস্ট কি বলুন? তবে আমার মনে হয়, উনি নিশ্চয়ই আমার পিসতুতো দাদার কাছ থেকে কোনো জিনিস নিয়ে এসেছিলেন–অথবা কোনো খবর দেওয়ার ছিলনইলে কেনই বা ফোন করবেন? কোনো কাজ না থাকলে কি কেউ এমনভাবে ফোন করতে পারেন?
বাবলি বলে উঠল, মেসেজ দেওয়ার থাকলে তো ফোনেই দিতে পারত। পারত না?
অভী যেন একথাটা জানত না, এমনভাবে বলল, ও হ্যাঁ। তা-ই-ই তো। এ কথাটা মনে হওয়া উচিত ছিল আমার।
এরপরই অভী যেন কি রকম গম্ভীর হয়ে গেল।
বাবলির মনে হতে লাগল, ঝুমার প্রসঙ্গ উঠতেই অভীর এই পরিবর্তন। তবে কি ঝুমা ইতিমধ্যে অভীর সঙ্গে দেখাও করেছে? বাবলি যে ঝুমাকে ঈর্ষা করে এ-কথাটা যে আর অভীর কাছে গোপন রইল না এটা বুঝতে পেরেই বাবলির ভীষণ খারাপ লাগতে লাগল। অভীর সঙ্গ ওর আর একটুও ভালো লাগছিল না যেন। ওর মনে হতে লাগল, ও যেন পালাতে পারলে বাঁচে।
একটু পরে বাবলি বলল, এবার কিন্তু আমাকে বাড়ি যেতে হবে।
বাবলি ভেবেছিল, অভী বলবে, সে কি? এত তাড়াতাড়ি কিসের? কিন্তু অভী বলল, হ্যাঁ, আমারও কাজ আছে। তারপর নেমন্তন্ন আছে।
বাবলি চুপ করে রইল। বাবলির খুব রাগ হচ্ছিল। নিজের ওপর তো বটেই। অভীর ওপরও। এতই যদি কাজ তাহলে রাত বারোটার সময় ফোন করে দেখা করতে বলা কেন? সত্যি সত্যিই ক্যাবলা লোকটা।
বাবলি ভাবল, এর সম্বন্ধে এ ক’দিনে মনে মনে যে সুন্দর ধারণাটা গড়ে উঠেছিল, তা বুঝি ভুল। ওর মনের ধারণাটা বুঝি ভুল। অভী নিতান্তই সাধারণ ছেলে। ঝুমার চেহারা দেখেই ঝুমা ওর প্রতি ইন্টারেস্টেড শুনেই বাবলির প্রতি সমস্ত ইন্টারেস্ট চলে গেছে। বাবলি মনে মনে রায় দিল যে, এসব বাজে ছেলে বাবলির যোগ্য নয়।
অভী একটা ট্যাক্সি ধরেছিল। বাবলিকে আবার কষ্ট সার্কাসেই নামিয়ে দিল। ওখান থেকে বাস, স্কুটার, ট্যাক্সি, সবই পাওয়া সোজা।
বাবলি ট্যাক্সি থেকে নেমে, খুব জোরে দরজাটা বন্ধ করল। প্রায় অভীর কানে তালা লাগিয়ে।
অভী চমকে মুখ তুলে তাকাল বাবলির দিকে।
তারপর জানালা দিয়ে মুখ বের করে বাবলিকে বলল, এ্যাই! রাগ করলেন? সত্যিই কাজ আছে। বিশ্বাস করুন। আমি মেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে জানি না। একটু বেরসিক আছি। কোনো দোষ হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন।
বাবলি হাসবার চেষ্টা করল। বোধহয় হাসলও হাত নাড়ল।
অভী আবার বলল, কাল সন্ধ্যে লাগতে না লাগতেই আপনাদের বাড়ি পৌঁছবো। কি কি খেতে ভালোবাসি মনে আছে তো? না আবার বলব?
পেছনে অনেক গাড়ি ছিল। এতক্ষণ ট্র্যাফিক লাইটটা লাল ছিল। কখন যে হলুদ হয়ে সবুজ হয়ে গিয়েছিল, খেয়াল ছিল না অভীর। পেছন থেকে প্রাইভেট গাড়ি, ট্যাক্সি ও ভটভটিয়ার এঞ্জিনের যুগপৎ আর্তনাদে এবং দাড়িওয়ালা এবং দাড়ি-ছাড়া পাঞ্জাবীদের শাঁখের আওয়াজের মতো সুখকর সম্বোধনে ট্যাক্সিটাকে আর দাঁড় করিয়ে রাখা গেল না।
বাবলি উত্তরে কি বলল, শোনা-হল না অভীর।
অভীর মনে হল এতগুলো গাড়ির সঞ্জস্ট পাইপের চোখ জ্বালা-করা ধোঁয়ার মধ্যে বাবলি বুঝি হারিয়ে গেল।
বাবলি এক গমগমে গর্বময় প্রত্যাশায় ভর করে আজ বিকেলে কষ্ট সার্কাসে এসে বাস থেকে নেমেছিল।
একটা ট্যাক্সিতে ও যখন উঠে বসল, তখন ও আশাভঙ্গতার গ্লানিতে, অপমানের ঘামে জবজবে হয়ে গেছিল।
ঘামে জবজবে হয়ে, একবুক অভিমান নিয়ে ও ট্যাক্সির পেছনের সীটের সঙ্গে গা এলিয়ে বসে রইল।
ট্যাক্সিটা হু-হু করে হাউজ-খাস এনক্লেভের পথে ছুটে চলল।
তখনো গরম রুক্ষ রাজস্থানী হাওয়া এসে থাপ্পড় মারতে লাগল ওর চোখেমুখে। ওর বুকের ভেতর পর্যন্ত এক অকারণ অবুঝ জ্বালায় জ্বলতে লাগল। বাবলি ঠিক করলো, বাড়ি গিয়ে অনেক-অনেকক্ষণ ধরে ও চান করবে।