কয়েক মাস কেটে গেল। ইবনে সামির এখনো বিন ইয়ামিনের নিকট অবস্থান করছে। এর মধ্যে বিন ইয়ামিন ইবনে সামির ও আইনীর শুভ বিবাহও সম্পাদন করে দিয়েছে। ইবনে সামির একজন দৈনিক। বেকার বসে থাকা তার ধাতে সয় না। তাই কিছু একটা করার জন্য সে অস্থির হয়ে পড়ল।
এ ছাড়াও সে এক কট্টরপন্থী গোঁড়া কিবতী খৃস্টান। সে ছিল বিন ইয়ামিনের গুপ্তচর। নানা ধরনের সংবাদ সে বিন ইয়ামিনের নিকট পাঠাত। কিন্তু এখন সে বেকার নিষ্কর্ম হয়ে পড়ে আছে। বিন ইয়ামিন তাকে কোন কাজ দিচ্ছে না। তার কারণ, ইবনে সামির পলাতক সৈনিক। দুজন সৈন্যকে হত্যা করে সে পালিয়ে এসেছে। তদুপরি একজন অপহৃত যুবতাঁকে সাথে করে যদি সে ধরা পড়ে তাহলে হত্যা ছাড়া তার অন্য কোন শাস্তি হবে না। এ সব বিবেচনা করেই বিন ইয়ামিন এখন তাকে কোন কাজের দায়িত্ব দিচ্ছে না। এদিকে ইবনে সামির বেকার থাকতে থাকতে একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।
সম্রাট হিরাক্লিয়ার্সের প্রাসাদ পর্যন্ত বিন ইয়ামিনের গুপ্তচর বাহিনী ছড়িয়ে আছে। সে সময় মিশরে সম্রাট হিরাক্লিয়ার্স থাকত না, বাইজেন্টাইনে থাকত। তবে মিশরের শাসন কার্য পরিচালনা করত সম্রাটের নিযুক্ত প্রাদেশিক গভর্নর মুকাওকিস। আর সামরিক বিষয়গুলো পরিচালনা করত সম্রাটের নিযুক্ত এক প্রসিদ্ধ জেনারেল আতরায়ূন।
মুসলমানরা শাম পদানত করে নেয়ার পর সম্রাট তা পুনরায় দখল করার চিন্তায় বিভোর ছিল। তাই সৈন্য বাহিনী পুনর্গঠনের প্রতি তার দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল।
একদিন বিন ইয়ামিনের নিকট দুব্যক্তি এল। এরা তারই নিযুক্ত গুপ্তচর। মিশরের রাজ প্রাসাদে তারা নিয়োগপ্রাপ্ত। কিছুদিনের জন্য তারা বাইজেন্টাইনে এসেছে। বিন ইয়ামিন তাদের নিকট খবরাখবর জানতে চাইলে তারা বলল, সম্রাট হিরাক্লিয়ার্সের মাথায় এখন শামের চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে সে শামে সৈন্য পাঠানোর চিন্তা করছে।
আরবে যখন দুর্ভিক্ষ চলছিল তখন হিরাক্লিয়ার্স সেখানে সৈন্য পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু সম্রাটের পরামর্শদাতারা তাকে বারণ করে বলল, এ দুর্ভিক্ষ শুধু আরবে। শামে কোন দুর্ভিক্ষ নেই। রোমান সৈন্যরা আরবে প্রবেশ করলে শাম থেকে মুসলিম বাহিনী দ্রুত আরবে ছুটে আসবে এবং পিছন দিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলবে। ফলে রোমান বাহিনীর যে কি অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়।
তারপর তারা বলল, এর কিছুদিন পর শামে যখন মহামারী দেখা দিল, হাজার হাজার মানুষ যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে লাগল, তখন সম্রাট হিরাক্লিয়াস শাম আক্রমণ করার ইচ্ছে করল। সম্রাটের পরামর্শ দাতারাও এবার আক্রমণের পক্ষে মত দিল। সম্রাট এতে মহা খুশি। কিন্তু মহাপাদ্রী কীরস ভেবে চিন্তে বলল, সম্রাট মহাশয়! যদি রোমান সৈন্যরা শামে প্রবেশ করে তাহলে। তাদের মাঝেও মহামারী ছড়িয়ে পড়বে। ফলে অবস্থা এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে যে, পশ্চাতে ফিরে আসা বা মুসলিম বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়া ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না।
এছাড়া যদি মিশর থেকে রোমান সৈন্যদের শামের যুদ্ধ ময়দানে নেয়া হয় তাহলে এই সুযোগে কট্টরপন্থী কিবতী খৃস্টান ও অন্যান্য খৃস্টান দলগুলো বিদ্রোহ করে বসবে। মিশরে অবশিষ্ট সামান্য সৈন্যরা তাদের দমন করতে ব্যর্থ হবে। ফলে মিশর হাত ছাড়া হয়ে যাবে আর শামও পুনর্দখল করা সম্ভব হবে না।
গুপ্তচরদ্বয় আরো বলল যে, মিশর শাসক মুকাওকিস ও সেনাপতি আতিরাবুন হিরাক্লিয়াসকে এ পরামর্শ দিচ্ছে যেন তারা শামের খৃস্টানদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত করে এবং ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়। মুকাওকিসের এ পরামর্শ তারা উভয়ে পছন্দ করেছে। তবে তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ এখনো নেয়া হয়নি।
শামের অধিবাসীদের অধিকাংশই খৃস্টান। এরা বিদ্রোহ করলে অবস্থা কোন দিকে মোড় নেয় তা বলা মুশকিল। কারণ এরা যোদ্ধা জাতি। তবে ইতিপূর্বে একবার বিদ্রোহ করে সফল হতে পারেনি। মুসলিম বাহিনী কঠোর হাতে তাদের দমন করেছে। তবুও শামে এ ধরনের বিদ্রোহের আশংকা এখনো রয়েছে।
ঐতিহাসিকরা বলেছে, যদি মহামারী চলাকালে সম্রাট হিরাক্লিয়াস শাম আক্রমণ করে বসত তাহলে মুসলিম বাহিনী এক ভীষণ সংকটে নিপতিত হত। কারণ ইতিমধ্যে বহু মুসলিম মুজাহিদ মহামারীতে ইন্তেকাল করেছেন। কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় সেনাপতিও ইন্তেকাল করেছেন। হিরাক্লিয়াস আক্রমণ করলে হয়তো ইতিহাসের ধারা অন্য পথে যাত্রা করত। কিন্তু মহাপাদ্রী কীরাসের পরামর্শে তা হয়নি। সম্রাট আক্রমণ করার পরিকল্পনা স্থগিত করে দিয়েছিলেন।
***
ইতিমধ্যে বিন ইয়ামিনের নিকট আরো কয়েকজন গোঁড়া খৃস্টান এসেছে। এরা সবাই তার গুপ্তচর। তাদের দুএকজন ইবনে সামেয়ের মত পালাতক সৈন্য। এদের দুজনের সাথে ইবনে সামেবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। খৃস্টান ধর্মে গোড়া প্রকৃতির এই তিন বন্ধুর মাঝে অনেক গোপন আলোচনা হল। এরা তিনজনই মুসলমানদের ও রোমানদের ঘোর বিরোধী।
একদিন পড়ন্ত বিকেলের সোনালী আভায় যখন প্রকৃতি মোহময়, চারদিকে বইছে মৃদুমন্দ শীতল বায়ু তখন তিন বন্ধু এক গাছের নিচে গিয়ে বসল। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে আলোচনা করছিল। শামের কথা, মুসলমানদের উত্থানের কথা, নানা যুদ্ধের কথা, রোমান সৈন্যদের ভীরুতার কথা, সম্রাট পরিবারের কথা ইত্যাদি ইত্যাদি।
কথা প্রসঙ্গে এক বন্ধু বলল, তোমাদের কি মনে হয়, শামের খৃস্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে?
অপর বন্ধু বলল, না, বিন ইয়ামিন এ ধরনের বিদ্রোহের পক্ষে নয়, তার কথা হল, এ ধরনের বিদ্রোহ ইতিপূর্বে হয়েছে। কিন্তু নির্মমভাবে তা ব্যর্থ হয়েছে। আর সম্রাট হিরাক্লিয়াসের মহাপাদ্রী কীরাসও তাই বলে। সেও এ ধরনের বিদ্রোহ অপছন্দ করে।
ইবনে সামির বলল, তাহলে কি সম্রাট হিরাক্লিয়াস শাম আক্রমণ করেছেন না!
অপর বন্ধু বলল, না, তা আর হচ্ছে না। সম্রাট হিরাক্লিয়াস দোটানা অবস্থায় আছেন। কি করবেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
ইবনে সামির বলল, আমার মনে হচ্ছে, এরা মুসলমানদের সুযোগ দিচ্ছে যা খৃস্টধর্মের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটাই আক্রমণের সুবর্ণ সুযোগ, মোক্ষম সময়। এ সুযোগকে কাজে না লাগালে মুসলমানরা আবার শক্তি সঞ্জয় করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিবে। তারপরই মিশর আক্রমণ করবে।
এক বন্ধু বলল, বিন ইয়ামিনের চিন্তাধারা অত্যন্ত বিস্ময়কর। সে ভাবছে, শামে কোন প্রকার বিদ্রোহের প্রয়োজন নেই। মুসলমানরা মহামারী থেকে মুক্তি পেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে মিশর আক্রমণ করে রোমানদের তাড়িয়ে দিক। তারপর সে মিশর দখলের ব্যবস্থা করবে।
আরেক বন্ধু অত্যন্ত উদ্বেলিত কণ্ঠে বলল, না না, তা হতে দিব না। তাহলে কি সে চায় যে শামের ন্যায় মিশরও মুসলমানরা পদানত করুক। এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। প্রয়োজনে আমরা শামে বিদ্রোহ করাব। কি বন্ধুরা! তোমরা কি এতে একমত?
তারা একটা পরিকল্পনা তৈরী করল। ভাবল, শামের খৃস্টানদের বিদ্রোহে উৎসাহিত ও উদ্বেলিত করার জন্য এখান থেকে কিছু লোক শামে পাঠানো দরকার। তারা শামে গিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এ কাজ সম্পাদন করবে। কিন্তু কাদেরকে তারা পাঠাবে। তাদের অনুগত তো কেউ নেই। বরং তারাই তো বিন ইয়ামিনের অনুগত গুপ্তচর।
একজন বলল, বন্ধুদ্বয়! আমরাই তো এ কাজ সম্পাদনে এগিয়ে যেতে পারি। এ গুরুতর কাজ অন্যের দ্বারা কতটুকু হতে পারে! আমরা তিন বন্ধু তো আছি আর আমাদের সাথে থাকবে আইনী। জীবনের সকল সঞ্চিত অভিজ্ঞতা দিয়ে যদি সফল হতে পারি তাহলে খোদাবন্দ ইসা মসীহ এর অনুগ্রহে আমাদের জীবন হবে চির ধন্য। আমরা হব চির অমর। যুগ যুগ ধরে খৃস্টধর্মে বিশ্বাসীরা আমাদের নাম শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে।
অপর দুই বন্ধু বলল, বন্ধু! তুমি এক চমৎকার প্রস্তাব দিলে। আমরা প্রস্তুত।
কথা চলাকালে আইনী এসে তাদের পাশে বসেছিল। সবকিছুই সে শুনেছে। তার মনেও ছিল দুঃসাহসিক কিছু একটা করার অনন্ত জোয়ার। স্বামী ও তার বন্ধুদ্বয়ের কথাবার্তা শুনে সে তেজোদ্বীপ্ত কণ্ঠে বলল, আমিও থাকব আপনাদের পাশে। খৃস্টধর্মের জন্য জীবন কুরবান করতে আমিও প্রস্তুত।
বিন ইয়ামীনের আস্তাবলে বেশ কিছু ঘোড়া ছিল। এক রাতে তারা আস্তাবল থেকে চারটি ঘোড়া নিয়ে সবার অজ্ঞাতসারে বেড়িয়ে পড়ল। বিন ইয়ামিনের আস্তাবলে কোন প্রহরী ছিল না। তাই কেউ তাদের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারল না।
***
সকালের সূর্য যখন নিটোল চেহারায় হাসতে হাসতে উদ্ভাসিত হল তখন তারা অনেক দূর চলে গেছে। দুর্গম পথ, বালিয়াড়ির পর বালিয়াড়ি আর মরুভূমি অতিক্রম করে তারা এখন অনেক দূরে। বিন ইয়ামিনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বিন ইয়ামিন সকালে সংবাদ পেল যে তার আস্তাবলের চারটি ঘোড়া নেই আর। সেই চারজন লোক উধাও। ইবনে সামির, আইনী আরো দুজন। এ সংবাদে বিন ইয়ামিন ভারাক্রান্ত হল। বিষণ্ণতার একটা মলিন সূক্ষ পর্দা যেন তার উজ্জ্বল চেহারায় আবরণ ঢেলে দিল। বিন ইয়ামিন তাদের সম্পর্কে কিছুই বললেন না। কেন যেন নিরব রইলেন।
চলার পথে তারা জনবসতি ও সৈন্যদের চৌকি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। ইবনে সামিরকে নিয়েই ভয়। কারণ সে পলাতক সৈন্য। যে কোন সময় রোমান সৈন্যদের হাতে গ্রেপ্তার হতে পারে। ইবনে সামির অবশ্য তার বেশভূষা ও আকার আকৃতি পাল্টে নিয়েছে। ঘন চাপ দাড়িতে তাকে এখন চেনাই মুশলিক। আর তার গায়ে এখন পাদ্রীদের লম্বা আলখেল্লা। দেখলে এখন কোনভাবেই বুঝা যায় না যে, সে সেই দুর্ধর্ষ রোমান সৈনিক।
ইবনে সামির সৈনিক জীবনে মিশরের অনেক জায়গায় ঘুরেছে। অনেক মানুষের সাথে মিশেছে। মিশরের সকল সেনানিবাসেই তার পরিচিত লোকজন আছে। তাদের থেকে দূরে থাকা এখন খুবই জরুরী। মিশরের বন্দরগুলো তার নখদর্পণে। সে জানে, মিশরের পূর্বপ্রান্তে লোহিত সাগরের তীরে এবং আরো একটু সামনে দুটি বন্দর রয়েছে। কিন্তু এ বন্দর দুটিতে যাওয়া যাবে না। কারণ সেখানে সর্বদা রোমান সৈন্যরা প্রহরা দেয়। এছাড়া লোহিত সাগরের তীরে এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে ছোট খাট জাহাজ নোঙ্গর করে। রোমান সৈন্যরা সেখানে প্রহরা দেয় না।
তিন দিন তিন রাত পর তারা এক বন্দরে পৌঁছল। এখানে ছোট পালতোলা জাহাজ পাওয়া যাবে। বন্দরটি নিরাপদ। রোমান সৈন্যদের প্রহরা সেখানে নেই। বন্দরে পৌঁছে তারা জানতে পারল, তিন চারদিন পর একটি জাহাজ বন্দর ছেড়ে যাবে। জাহাজটি বেশ বড়। তারা তাদের ঘোড়াও সাথে করে নিয়ে যেতে পারবে। তারা বন্দরেই বিশ্রাম করল। চতুর্থদিন তারা জাহাজে আরোহণ করল। তাদের পরিকল্পনা, আরবের কোন উপকূলে পৌঁছতে পারলেই তারা সেখান থেকে সহজে শামে পৌঁছতে পারবে।
***
যদি জাহাজটি সোজাসুজি আরব উপকূলের দিকে যেত তাহলে তার দূরত্ব হত প্রায় একশত মাইল। কিন্তু জাহাজটি আরব উপকূলের এক দূরবর্তী বন্দরে যাচ্ছে তাই প্রায় সাড়ে তিনশত মাইল নদীপথ অতিক্রম করতে হবে। এতে কয়েকদিন লেগে যাবে।
জাহাজ নোঙ্গর তুলে পাল উড়িয়ে দিল। তর তর করে সামনে চলতে লাগল। পিছনে পড়ে রইল উপকূলের ছোট ছোট ঘর আর দোকানগুলো। বাতাসের ঝাঁপটায় কম্পমান গাছের ডালপালাগুলো যেন হাত নেড়ে নেড়ে তাদের চির বিদায় জানাচ্ছে। তরঙ্গ মালার বুক চিরে জাহাজটি বেশ দূর এগিয়ে গেলে ইবনে সামির তার দুই বন্ধুকে বলল, জাহাজের আরোহীদের সাথে কথাবার্তা আর আলাপ-আলোচনা করে যাদের খৃস্টান পাওয়া যায় তাদেরকে আমাদের এই মিশনের সঙ্গী বানানোর প্রচেষ্টা করতে হবে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হল। দুদিনে তারা জেনে নিল জাহাজে কতজন খৃস্টান আছে আর কতজন মুসলমান আছে।
ইতিমধ্যে ইবনে সামির জেনে নিয়েছে যে, জাহাজটি তাদেরকে আরব উপকূলের কোন এক বন্দরে নামিয়ে দিবে। সেখান থেকে শাম অনেক অনেক দূর। এ দীর্ঘ পথে রয়েছে মরুভূমি আর মরুভূমি। খৃস্টধর্মের নামে এ দীর্ঘ সফরের কষ্টের জন্য সে নিজেও মানসিকভাবে প্রস্তুত হল। সাথীদেরও প্রস্তুত করে নিল। তা ছাড়া তাদের সাথে ঘোড়া রয়েছে। তাই তারা তেমন পেরেশান হল না।
এ কয়েকদিনের প্রচেষ্টায় তারা জাহাজে তাদের সমমনা চার-পাঁচজন নেতৃস্থানীয় খৃস্টান পেল। তাদের একজন শামের এক গোত্রের সর্দার। তিন বন্ধু মিলে তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কাতে লাগল। আলোচনা পর্যালোচনাও হল বেশ। অবশেষে তারা তাদের মতামত মেনে নিতে বাধ্য হল। ইবনে সামির ও তার বন্ধুরা তাদের এ কথা জানাল, তারা এখন শামে যাচ্ছে। সেখানে খৃস্টান গোত্রগুলোকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত ও উদ্বেলিত করবে। প্রয়োজনে তারা খৃস্টধর্মের প্রচার প্রসার ও রক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করবে।
তারা আরেকজন মধ্যবয়সী খৃস্টানকে পেল। দারুন সতর্ক। তার কথা বলার ভঙ্গীই অন্য ধরনের। কারো সাথে কথা বললে শ্রোতা অবশ্যই তার কথায় প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং তার মতামত মেনে নিতে বাধ্য হয়।
ইবনে সামির ও তার সাথীরা এ মধ্যবয়সী খৃস্টানকে তাদের দলে ভীড়ানোর পরিকল্পনা করল। একদিন তিনজনই তার নিকট এল। কথাবার্তা শুরু করল। ইবনে সামির জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় থাকেন?
লোকটি বলল, আমি শামের অমুক শহরে থাকি। এবার তাদের টনক নড়ে উঠল। ভাবল, তাহলে তো ভালই হবে; সাথে তাকে নিতে পারলে বেশ জমবে। তারা তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক আলোচনা করতে লাগল। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের আলোচনা, মুসলমানদের আলোচনা, মিশরের অবস্থা ইত্যাদি আলোচনার পর এবার আসল কথা শুরু হল। তাহল বর্তমান প্রেক্ষাপটে খৃস্টধর্মের অনুসারীদের কি করতে হবে। কিভাবে মুসলমানদের এই আগ্রাসন থেকে তারা স্বধর্ম নিয়ে স্বকীয়তা বজায় রেখে বেঁচে থাকতে পারবে?
কথার মাঝে ইবনে সামির বলল, কে কি করল বা না করল তা এখন আমরা ভাবতে পারি না। বরং খৃস্টধর্মের অনুসারীদের এখন একতাবদ্ধ হয়ে খৃস্টরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হবে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সর্বত্র বিদ্রোহ করতে হবে।
ইবনে সামির আরো একটু অগ্রসর হয়ে বলল, এখন যদি শামের খৃস্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাহলে কমপক্ষে তাদের ঐ অঞ্চলে খৃস্টরাজ্য তো প্রতিষ্ঠিত হবে।
মধ্য বয়সী খৃস্টান লোকটি ইবনে সামিরের কথা জোড়ালভাবে সমর্থন করল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, আচ্ছা তা বাস্তবায়নের উপায় কি হতে পারে?
ইবনে সামির তখন হাসতে হাসতে বলল, আমরা এ বার্তা নিয়েই শামে যাচ্ছি। গোপনে আমরা এ কাজটাই করতে চাচ্ছি।
খৃস্টান লোকটি কথার ছলে তাদের থেকে সম্রাট হিরাক্লিয়ার্স, বিন ইয়ামিন ও মুকাওকিসের কি পরিকল্পনা তাও জেনে নিল। লোকটি তাদের থেকে এ কথাও জেনে নিল যে, বর্তমানে রোমান সৈন্যদের অবস্থা কেমন? রোমান জেনারেলরাই বা কি চিন্তা করছে? ইবনে সামির নিজেও সৈনিক, তাছাড়া বিন ইয়ামিনের নিকট গিয়ে সে আরো অনেক কিছু জানতে পেরেছে। সে এসব কিছুই লোকটিকে বলেছে।
এক রাতে ইবনে সামির জাহাজের উপরে একেবারে ছাদে গেল, ছিল জ্যোৎস্না বিধৌত রজনী। আকাশে হাল্কা মেঘের ফাঁক গলে যেন গলিত চাঁদির ধারা সমুদ্রের বুকে পড়ছে। তরঙ্গমালা যেন মাথায় ঝিকমিকি তাজের মুকুট নিয়ে ছুটে চলছে। ইবনে সামির বিমোহিত হৃদয়ে চারদিক অবলোকন করছে।
হঠাৎ তার দৃষ্টি এক ব্যক্তির উপর পড়ল। জাহাজের ছাদের এক প্রান্তে। মনে হল লোকটি সেই মধ্যবয়সী খৃস্টান। আবছা অন্ধকারে তার সন্দেহ হল। অন্য লোকও হতে পারে। ইবনে সামির আরো একটু এগিয়ে গেল। বিস্ময়ে তার চোখ একেবারে ছানাবড়া। আরে সে তো সেই মধ্যবয়সী লোকটি। তবে তার বিস্ময়ের কারণ কিন্তু অন্য কিছু। সে দেখল, সেই লোকটি সেখানে নামায পড়ছে। আরো দুজন লোকও তার অদূরে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছে।
নামায শেষ হলে ইবনে সামির তার আরো নিকটে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, তুমি বলেছিলে, তুমি মুসলমান নও। কিন্তু এখন দেখছি তুমি নামায পড়ছো?
খৃস্টান লোকটি বলল, ভাই আমি দরবেশ মানুষ। আল্লাহর ইবাদত করা দরকার, তাই তার ইবাদত করি। আমি মুসলমানদের নামায পড়ছি না; বরং আমি এভাবে আল্লাহকে স্মরণ করছি।
এ উত্তর শুনে ইবনে সামির সন্তুষ্ট হতে পারল না। আরো বেশ কিছু প্রশ্ন তাকে করল আর সে প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করল। এরপর ইবনে সামির চলে এল। তবে তার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না যে সে একজন খৃস্টান। তার নিশ্চিত বিশ্বাস হয়ে গেছে যে সে মুসলমান। সে তার বন্ধুদ্বয়ের নিকট গিয়ে সবকিছু বলল। তারপর অভিমত প্রকাশ করে বলল, এ ধরনের লোকেরা গুপ্তচর হয়। আমার মনে হয়, সে মুসলমানদের গুপ্তচর।
পরদিন ইবনে সামির অন্যান্য মুসলমান যাত্রীদের সাথে আলোচনা করে জেনে নিল যে, সে মুসলমান। একজন আরব। তবে কেউ বলতে পারেনি, সে কি গুপ্তচর না সাধারণ নাগরিক।
একথা জানার পর ইবনে সামির দারুন ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। কারণ লোকটি খৃস্টানের বেশ ধরে তার থেকে অনেক গোপন কথা জেনে নিয়েছে যা সে কারো নিকট বলত না। এরপর ইবনে সামির তার বন্ধুদ্বয়ের নিকট বলল, এই খৃস্টানভেশী লোকটি আমার থেকে অনেক গোপন কথা জেনে নিয়েছে। তাকে কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না। বন্ধুদ্বয়ের মাথায়ও ছিল উন্মাদনা। তারা সিদ্ধান্ত নিল, হাত পা বেধে তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে হবে।
ইবনে সামির বলল, দেরি করা ঠিক হবে না। আজ রাতেই তা করতে হবে। তার সাথে আমার বেশ আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়েছে। আমি তাকে বলল, চল বন্ধু জাহাজের ছাদে গিয়ে বসি। তারপর তাকে ছাদের এমন এক জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে কেউ যায় না। সেখান থেকেই তাকে সমুদ্রে ফেলে দিব।
বিকালে ইবনে সামির সেই মুসলমান গুপ্তচরের নিকট গেল। গভীর আন্তরিকতার সাথে কথাবার্তা বলল। তারপর বিনীত কণ্ঠে বলল, বন্ধু! আজ আমি তোমার সাথে রাতে নির্জনে কিছু কথা বলতে চাচ্ছি।
মুসলমান গুপ্তচর বলল, কোন বিশেষ কথা আছে, না এমনি গল্পগুজব করবে?
ইবনে সামির বলল, ভাই! আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি। অবশেষে তোমার কথাই মানতে বাধ্য হয়েছি যে, তুমি সত্যই একজন দরবেশ মানুষ। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য তুমি কত ইবাদত করছ। তুমি অত্যন্ত জ্ঞানী। আমি তোমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে চাচ্ছি। আজ রাতে তুমি আমাকে সে পথের সন্ধান দিবে। আসলে আমি এক পেরেশান ও অস্থির চিত্তের মানুষ। কোথাও শান্তি পাই না। মনে হয় আল্লাহ্ আমার প্রতি নারাজ। আমি তোমাকে আমার জীবন কাহিনী শুনাতে চাই।
মুসলমান গুপ্তচর বলল, তুমি যখন বলবে তখনই আমি এসে উপস্থিত হব। তুমি চাইলে আমি সারারাত জেগে তোমার জীবন কাহিনী শুনব।
ইবনে সামির বলল, যখন জাহাজের যাত্রীরা সবাই ঘুমিয়ে পড়বে তখন তুমি ছাদে চলে আসবে। মুসলমান গুপ্তচর তা মেনে নিল।
ইবনে সামিরের অন্তর এবার মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় আনন্দে দুলছে। ছুটে গেল বন্ধুদ্বয়ের নিকট। বলল, আজ রাতে শিকার নিজেই নিজের জালে আটকা পড়বে। একথা শুনে বন্ধুদ্বয় খুব আনন্দিত হল। মুসলমান গুপ্তচরকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করার সব পরিকল্পনা পাকা করে নিল।
***
সে দিন জাহাজটি প্রায় অর্ধপথ অতিক্রম করে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। রাতে নির্ধারিত সময়ে মুসলমান গুপ্তচরটি জাহাজের ছাদে চলে গেল। এর কিছুক্ষণ পরই ইবনে সামির তার নিকট এল। জাহাজের যাত্রীরা সবাই শুয়ে আছে। ছাদে দুতিন জন মানুষ বসে আছে। তারা রাতের জ্যোৎস্নার অপরূপ দৃশ্য উপভোগ। করছে। আকাশে তখন থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আকাশের দিগন্ত থেকে মেঘমালারা যেন বিক্ষোভ করতে করতে ছুটে আসছে। সমুদ্রের বুকে বাতাস একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। থমথমে অবস্থা। জাহাজের বিরাট পাল যা বাতাসের ঝাঁপটায় ফুলে ছিল তা চুপসে গেছে। ফলে জাহাজও তার গতি হারিয়ে ধীরে ধীরে চলছে।
ইবনে সামির মুসলমান গুপ্তচরটির হাত ধরে জাহাজের ছাদের উপর হাঁটছে। তারা জ্যোৎস্নার অপরূপ ধারা দেখছে। তারা জাহাজের একেবারে কিনারায় এসে দাঁড়াল। ইতিমধ্যে চাঁদ মেঘের আড়ালে মুখ লুকাল। ফলে চারদিক আবছা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ইবনে সামিরের উভয় বন্ধু ঠিক তখনই ছাদের উপর উঠে মুসলমান গুপ্তচরটির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
এ সময় জাহাজের ছাদে আর কেউ নেই। তাছাড়া মেঘমালাও তাদের সাহায্য করছে। জ্যোত্সলোকিত রাতকে হঠাৎ অন্ধকার করে দিয়ে তাদের সহায়তায় যেন এগিয়ে এসেছে। ঠিক তখন ঠাণ্ডা বায়ুর ঝাঁপটায় জাহাজটি দুলে উঠল। তিনজনই প্রস্তুত, এখনই মুসলমান গুপ্তচরকে অনন্ত পানির বুকে ফেলে দিবে। ঠিক তখন পশ্চাৎ দিক থেকে উচ্চ কণ্ঠে আওয়াজ এল, ভাইয়েরা! দ্রুত নিচে নেমে আসুন। ঝড় ধেয়ে আসছে। কেউ জাহাজের ছাদে থাকবেন না। তারা পশ্চাতে ফিরে দেখল, জাহাজের দুতিনজন মাল্লা তাদের দিকে ছুটে আসছে। তাদেরকে দ্রুত নিচে যাওয়ার জন্য তাড়া করছে। আর নিজেরা পালের দড়ি ঠিকঠাক করছে।
সাথে সাথে বাতাস তীব্র আকার ধারণ করল। দৈত্যের মত শিষ দিতে দিতে এগিয়ে আসতে লাগল বাতাস। তারপরই শুরু হল মুষল ধারায় বৃষ্টি। ঝর ঝর করে অবিরাম ধারায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। সাথে বইছে ঝঞ্জা বায়ু। বিরাট জাহাজটি কাগজের নৌকার মত সমুদ্রের বুকে হেলে দুলে চলছে। আর পর্বতমালার ন্যায় উঁচু উঁচু তরঙ্গমালা সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়ছে।
জাহাজের যাত্রীদের ঘুম ভেঙে গেছে। একে অপরের গায়ে ছিটকে পড়ছে। শিশু আর মহিলারা চিৎকার করে কাঁদছে। ভয়ে সবাই সন্ত্রস্ত। সবার চেহারা ফ্যাকাসে রক্তশূন্য। ইবনে সামির আর তার বন্ধুরা নীল নক্সা ফেলে কোথায় গেল তার খবর নেই। সমুদ্রের বিশাল বিশাল তরঙ্গ ঝাঁপটায় জাহাজে পানি ঢুকছে।
জাহাজের পাল খুলে মাস্তুলের সাথে পেচিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তড়িঘড়ি করার কারণে ভালভাবে আটকানো হয়নি। তার কিছু অংশ খুলে বাতাসের ঝাঁপটায় বিকট আওয়াজ করতে লাগল। জাহাজটি এক প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে পড়ল। কেউ কারো দিকে খেয়াল রাখতে পারছে না। মায়েরা শিশু বাচ্চাদের বুকে চেপে ধরে রেখেছে। ঢেউয়ের তালে তালে যখন জাহাজটি উপরে উঠছে তারপর আছড়ে পড়ছে তখন শিশু বাচ্চাদের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখাও কষ্টকর হচ্ছে। জাহাজের ভিতর প্রচুর পানি প্রবেশ করে সব ভিজে গেছে।
যাত্রীরা সবাই চিৎকার করছে। ডাকাডাকি করছে। কিন্তু ঝড়ের প্রচণ্ডতায় তা শোনা যাচ্ছে না। জাহাজটি এখন মাঝি মাল্লাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। জাহাজকে আর সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ঝড়ের ঝাঁপটায় জাহাজটি উপকূলের অনেক নিকটে চলে এসেছে। প্রচুর পানি উঠার কারণে তা ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ নিরাশ হয়ে পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে এবং উপকূলের দিকে সাঁতরে যাচ্ছে। এরপরই এক প্রবল ঝাঁপটায় জাহাজটি কাত হয়ে ডুবে গেল।
***
সকালের প্রশান্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে উড়ে যাচ্ছে খণ্ড খণ্ড মেঘ। এ শান্ত পরিবেশ দেখে বুঝা যাবে না, রাতে কী তাণ্ডব লীলা বয়ে গেছে সমুদ্রের বুক জুড়ে। অথচ এখন সমুদ্রের বুক একেবারে শান্ত সমাহিত।
উপকূলের দূরে দূরে এদিকে সেদিকে কিছু কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। কেউ কেউ পা টেনে টেনে হাঁটছে। এরা ভাগ্যবান। সাঁতার কেটে কোনক্রমে উপকূলে এসে জীবন বাঁচিয়েছে। যারা সাঁতার জানে না তাদের এই সমুদ্রের বুকে সলিল সমাধি রচিত হয়েছে।
জাহাজ নিমজ্জিত হওয়ার পরের দিনের ঘটনা। তিনজন লোক ধীরে ধীরে সমুদ্র উপকূলের বহুদূর থেকে হেঁটে যাচ্ছে। দেখলেই বুঝা যায় এরা আরব। তাদের জানা আছে, সন্ধ্যার আগেই তারা এক জনবসতিতে পৌঁছে যাবে। এ এলাকা তাদের নখদর্পণে। তারা জিদ্দা ও মদীনার মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছে। তাদের দেখলেই বুঝা যায়, তারা বিধ্বস্ত, তারা সমুদ্রের ঝড়ের কবলে পড়েছিল। কোন রকম সাঁতরে উপকূলে উঠতে সক্ষম হয়েছে।
প্রায় আড়াই তিন মাইল অতিক্রম করার পর তারা দেখল, এক ব্যক্তি বসে আছে। মনে হয়, বসে বসে ঝিমাচ্ছে। এরা তিনজন সেই লোকটির নিকট গেল। লোকটি এবার মুখ তুলে তাকাল। ডাগর দৃষ্টি মেলে তাদের দেখতে লাগল। একজনকে চিনে ফেলল। সে ঐ মুসলমান গুপ্তচর যাকে ইবনে সামির ও তার বন্ধুরা জাহাজের ছাদ থেকে সমুদ্রে ফেলে হত্যা করতে চেয়েছিল।
মুসলমান গুপ্তচরও তাকে চিনে ফেলল যে, সে ইবনে সামির। বলল, ইবনে সামির! তুমি খুব ভাগ্যবান। এ প্রচণ্ড ঝড়ের মাঝে সমুদ্রের বুক চিরে উপকূলে পৌঁছতে পারা বড়ই ভাগ্যের ব্যাপার। আচ্ছা, তোমাদের সাথে যে সুন্দরী যুবতীটি ছিল তাকে তো দেখছি না। তাহলে কি সে ডুবে গেছে?
ইবনে সামিরের কণ্ঠ বিষণ্ণ। বলল, না বন্ধু; সে আমার স্ত্রী। সে সমুদ্রে ডুবে যায়নি। এ মরুভূমিতে ডুবে গেছে।
মুসলমান গুপ্তচর বলল, ইবনে সামির! তোমার দুঃখের কথা আমি বুঝতে পেরেছি। সে সমুদ্র থেকে তো মুক্তি পেয়েছে কিন্তু বেঁচে থাকতে পারেনি। মৃত্যুবরণ করেছে। আর তুমি তাকে মরুর বুকে দাফন করে দিয়েছো!
ইবনে সামিরের কণ্ঠ আরো বেশী ভারাক্রান্ত ও বিষণ্ণ শোনা গেল। বলল, বন্ধু! তুমি আমার কথা কিছুই বোঝ নি। আমার জীবনের উপর দিয়ে যে কি নির্মম ঝঞ্ছা বয়ে গেছে তাকি আমি তোমাকে বলব?
মুসলমান গুপ্তচর বলল, ইবনে সামির! আমি এখন তোমাকে আমার ব্যাপারে সঠিক তথ্য দিচ্ছি। আমি খৃস্টান নই। আমি মুসলমান। আমার নাম মাসউদ ইবনে সুহাইল মক্কী। তুমি এখন আমার দেশে এসে গেছে। আমি আর আমার এই বন্ধুরা তোমাকে এখানে একাকী রেখে যেতে পারি না। মাসউদ ইবনে সুহাইল ও তার দুই বন্ধু ইবনে সামিরের পাশে বসে পড়ল। মাসউদ বলল, এখন তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পার যা তুমি বলতে চাচ্ছো।
ইবনে সামিরের স্মৃতিতে বারবার এ কথা ভেসে উঠছে, সে তো তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। ভাগ্যের জোরে বেঁচে আছে। ঘোর বিপদের সময় সে যখন বন্ধু হিসাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে তখন দেখা যাক সে কি উপকার করে। এ কথা ভেবে সে তার নির্মম কাহিনীটি বলতে আরম্ভ করল।
কী আর বলব বন্ধু! জাহাজটি যখন ডুবতে ছিল তখন আমি আর আমার দু সঙ্গী সমুদ্রের বুকে ঝাঁপ দিলাম। আইনীর প্রতি আমার খেয়াল ছিল সবচেয়ে বেশী। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যদি আমার আইনী নিমজ্জিত হয় তাহলে আমিও তার সাথে নিমজ্জিত হয়ে পরপারে চলে যাব। আইনী ছাড়া এ জীবন আমার বৃথা, অর্থহীন।
আমি সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আইনী আইনী বলে চিৎকার করতে লাগলাম। আইনীও সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিল। কিন্তু আমি তাকে খুঁজে পেলাম না। আইনীর সন্ধানে আমি পাগলের মত এদিক সেদিক সাঁতার কাটছি। হঠাৎ আমি দেখলাম, আমার এক সাথী আইনীকে তার পিঠে তুলে নিয়ে সাঁতরে উপকূলের দিকে যাচ্ছে। আর আমাকে বলছে, আইনীর ব্যাপারে চিন্তা করো না, চলে এস। তখন ছিল এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। যেন কিয়ামত। ঝড়ের তীব্র বেগ। মানুষের আর্তচিৎকার,নারীদের আহাজারি আর শিশুদের আর্তনাদে কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। তবুও আমি আমার বন্ধুর কথা শুনে নিশ্চিত হলাম। উপকূলের দিকে সাঁতার দিলাম। আমরা তিনজন যখন বহু কষ্টে সাঁতরে উপকূলের নিকট পৌঁছলাম তখন এক বিশাল ঢেউ এসে আমাদের একেবারে উপকূলে ফেলে নীচে নেমে গেল।
আমরা প্রাণে বেঁচে গেলেও শরীরের অবস্থা একেবারে কাহিল। ক্লান্তিতে দাঁড়াতে পারছিলাম না। বেশ কিছুক্ষণ মাটিতে পড়ে রইলাম। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু কোথায় যাব। কোন দিকে যাব কিছুই চিনি না। জাহাজের দুএকজন বেঁচে যাওয়া যাত্রী বলল, এটা আরব উপকূল। শাম এখান থেকে অনেক অনেক দূর।
আমরা অজানা উদ্দেশে রওনা দিলাম। বহু পথ অতিক্রম করার পরেও কোন জনমানবের চিহ্ন পেলাম না। ইতিমধ্যে রাত ঘনিয়ে এল। রাত কাটানো ও বিশ্রামের জন্য এক জায়গায় শোয়ার ইচ্ছে করলাম। আইনী আমার স্ত্রী। তাই আইনী ও আমি একটু দূরে একত্রে শুইলাম। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর। শোয়ার সাথে সাথে গভীর ঘুমে হারিয়ে গেলাম।
রাত প্রায় অর্ধ। হঠাৎ চিৎকার আর কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। জ্যোৎস্না বিধৌত রজনী। বেশ দূর পর্যন্ত সবকিছু দেখা যায়। আমি দেখলাম, আইনী আমার পাশে নেই। দূরে, বেশ কিছুটা দূরে তাকিয়ে দেখলাম, আমার সাথী দুইজন আইনীর সাথে ধস্তাধস্তি করছে। যে সাথী আইনীকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করেছিল সে আইনীর উপরে চেপে বসতে চাচ্ছে আর অপর সাথী আইনীর হাত ধরে তাকে সহায়তা করছে।
আমি দৌড়ে সেখানে গেলাম। মাথায় যেন আগুন ধরে গেছে। প্রথমে এক বন্ধুকে ঘুসি মেরে মাটিতে ফেলে দিলাম। তারপর অন্য জনকে লাথি মেরে ফেলে দিলাম এবং আইনীকে হাত ধরে তুলে নিলাম। আমি ভাবতেই পারিনি, বন্ধু হয়ে কিভাবে বন্ধুর স্ত্রীর ইজ্জত নষ্ট করতে পারে! অথচ আমরা কতো পবিত্র মিশন নিয়ে এদেশে এসেছি।
রাতের নিরবতা ভেঙে এক বন্ধুর কণ্ঠ শোনা গেল, দূরে থাক হে ইবনে সামির! আমি তাকে সমুদ্র থেকে তুলে এনেছি। আর আমার এই বন্ধু আমাকে সহায়তা করেছে। তাই তার উপর আমাদের অধিকার আছে।
আরেকজনের কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল, বলল, তুমি তো তাকে ডুবে মরার জন্য সমুদ্রে ফেলে এসেছিলে। এখন তার উপর তোমার কি অধিকার আছে?
আমি আইনীকে পিছনে দাঁড় করালাম। ভাবলাম, এদের মাথায় শয়তান আশ্রয় নিয়েছে। এরা তাদের পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশের কথা ভুলে গেছে। তাই আমাদের লক্ষ্য উদ্দেশের কথা বলে, খৃস্টধর্মের দোহাই দিয়ে এ পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে তাদের অনুরোধ করলাম। কিন্তু কোন প্রচেষ্টাই ফলপ্রসূ হল না। তারপর তাদের ধমক দিলাম। শাসালাম। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হল না। তারা তাদের দাবীতে অটল।
সবশেষে এক বন্ধু প্রস্তাব দিল, বলল, অন্তত আজ রাতের জন্য তুমি আইনীকে আমাদের হাতে সোপর্দ করো। আমি তাতেও রাজী হলাম না। কারণ আইনী আমার স্ত্রী। জীবন থাকতে আমি তার ইজ্জতহানী সহ্য করতে পারি।
আমি তাদের কথাবার্তায় অত্যন্ত ক্ষীপ্ত হয়ে উঠলাম। বললাম, তোমাদের উপর শয়তান ভর করেছে। আর শয়তানকে কিভাবে তাড়াতে হয় তার পন্থা আমার বেশ ভাল করে জানা আছে।
এ কথা বলে তাদের দিকে অগ্রসর হলাম। তারাও আর দেরি করল না। আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমাদের কারো নিকট কোন অস্ত্র ছিল না। থাকলে তখনই কেউ না কেউ নিহত হয়ে যেত। উভয়জন আমাকে মুষ্ঠাঘাত, পদাঘাত করতে লাগল। আমিও সাহসিকতার সাথে প্রতিহত করতে থাকলাম। কিন্তু তারা ছিল শক্তিশালী যুবক। তারা আমাকে ক্রমেই মেরে যাচ্ছে। আইনী অবলা নারী। অল্প তার বয়স, সে আমাকে কিভাবে উপকার করবে। অদূরে দাঁড়িয়ে সে শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানাচ্ছে।
তারা আমাকে মারতে মারতে বেহুশ করে মাটিতে ফেলে দিল। তারপরও তারা আমাকে মারল, যেন আমি আর উঠে দাঁড়াতে না পারি।
আমার যখন হুশ ফিরে আসল, মনে হল যেন আমার শরীরের অনেকগুলো হাড় ভেঙে গেছে। মাথা কেবল ঘুরছে। আমি উঠে দাঁড়াতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। তখন সূর্য উদিত হয়ে গেছে। চারদিকে ঘুরে ফিরে তাকালাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। চারদিকে শুধু বালি আর বালি। আমি বুঝে ফেললাম, তারা আইনীকে নিয়ে চলে গেছে। আমার জীবনের চারদিক এখন অন্ধকার হয়ে গেছে। জীবন যুদ্ধের ব্যর্থতার কথা বসে বসে চিন্তা করছিলাম আর ক্রমেই যেন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। ঠিক এরই মাঝে তোমরা এসে আমাকে জাগালে।
ইবনে সামির বিষণ্ণ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল, ভাই মাসউদ! আমি এ আশা রাখি না যে তোমরা আমাকে সাহায্য করবে। তবে তোমাদের একটি কথা আমার অন্তরে আশার সঞ্চার করেছে। তোমরা বলেছে, আমি তোমাদের দেশে পৌঁছেছি। তাই তোমরা আমাকে একা ফেলে যেতে পার না। তাহলে কি আমি আশা করতে পারি যে, তোমরা আমাকে সাহায্য করবে? মাসউদ ইবনে সুহাইল বলল, শোন ইবনে সামির! আমি একজন মুসলমান। আমি ইসলামের বিধি বিধান মেনে চলি। তোমার ধর্ম যাই হোক, কিন্তু তুমি একজন মানুষ। বিপদে আক্রান্ত। এ অবস্থায় আমার ধর্মের নির্দেশ, তোমাকে সহায়তা করা। আমরা অবশ্যই তোমার সহায়তা করব।
***
ইবনে সামির উঠে দাঁড়াল। মাসউদ ও তার বন্ধুরাও উঠে দাঁড়াল। তারা প্রথমে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে বালুকাময় ভূমির দিকে তাকাল। হ্যাঁ স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, এখানে মারামারি হয়েছে। ইবনে মাসউদ দেখল, বালুকাময় প্রান্তরে পায়ের ছাপ এক দিকে চলে গেছে। মাসউদ সে দিকে অগ্রসর হল। তার পিছু পিছু অন্যরাও অগ্রসর হল। মাসউদ অত্যন্ত বিচক্ষণ গুপ্তচর। মাঝে মাঝে পদচিহ্ন দেখে বুঝে ফেলল, আইনীকে তারা জোর করে নিয়ে গেছে। টেনে টেনে নিয়ে গেছে।
মাসউদ তার এক সঙ্গীকে বলল, মনে হচ্ছে তারা বেশী দূর যেতে পারেনি। আচ্ছা ইবনে সামির! তুমি কি বলতে পারবে, তাদের সাথে কি পান করার মত পানি আছে?
ইবনে সামির বলল, না, তাদের নিটক পানি থাকার কথা নয়। কারণ আমরা তো সমুদ্র থেকে মাত্র উঠে এসেছিলাম। ইবনে সামির হাঁটতে পারছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। মাসউদ ও তার এক সাথী ইবনে সামিরের হাত কাঁধে নিয়ে তাকে বয়ে চলছে।
ইবনে সামিরকে মাসউদ বলল, আমাদের গন্তব্য অন্যত্র হলেও আমরা প্রথমে তোমার স্ত্রী আইনীকে উদ্ধারের চেষ্টা করব।
সূর্যের আলো আরো একটু তীব্র হলে তার উত্তাপে ইবনে সামির কিছুটা সুস্থতা বোধ করতে লাগল। সে একজন সৈনিক। দেহ তার কষ্টসহিষ্ণু। জীবনে আরো কয়েকবার সে আহত অবস্থায় সফর করেছে, তাই সহজেই সে হাঁটতে পারছে।
পদচিহ্ন অনুসরণ করে তারা যথাসম্ভব দ্রুত চলতে লাগল। বেশ কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর দেখল, সেখানে যমীন কিছুটা শক্ত। আরো কিছুটা অগ্রসর হওয়ার পর নিম্নভূমি পেরিয়ে উঁচু ভূমিতে উঠল। পথের কোন চিহ্ন নেই। তবে পদচিহ্ন লক্ষ্য করে করে তারা এগিয়ে চলল। আরো কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর এক নিম্নভূমির দিকে তারা এগিয়ে গেল। বেশ দূর পর্যন্ত বিস্তৃত নিম্ন ভূমি অতিক্রম করে যখন তারা উচ্চ ভূমিতে উঠতে লাগল তখন মাসউদ আনন্দে চিৎকার করে উঠল। আল্লাহর দয়া দেখ। এখানে জান্নাত নেমে এসেছে যেন!
পিপাসায় তাদের হৃদয় শুকিয়ে গিয়েছিল। মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছিল না। তাই খেজুর বাগান দেখে আনন্দে তারা উদ্বেলিত হয়ে উঠল। খেজুর বাগান প্রায় দুমাইল দূরে অবস্থিত। তাদের বিশ্বাস, সেখানে পৌঁছতে পারলে পানিও পাওয়া যাবে। খাবারও মিলবে। এ আশায় তাদের শরীর বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল। তারা দ্রুত হেঁটে চলল।
খেজুর বাগানের নিকট গিয়ে দেখে, বাগানের চারপাশ মাটি দেয়ালের ন্যায় উঁচু। এ প্রাকৃতিক দেয়াল টপকে ওপারে পৌঁছলেই তারা পাবে পানি আর টাটকা খেজুর। তারা খেজুর বাগানের নিকটে পৌঁছেই বাতাসের কোলে একটি মেয়েলী কণ্ঠের আর্তচিৎকার শুনতে পেল। সাথে সাথে তারা উৎকর্ণ হয়ে উঠল। আর্তচিত্তার লক্ষ্য করে তারা ছুটে গেল এবং সেই উঁচু ভূমিতে উঠতে লাগল। এবার সেই আর্তচিৎকার স্পষ্ট শুনতে পেল। তারা এবার তাদের দৃষ্টি সেদিকে নিবন্ধ করতেই দেখতে পেল, দুজন পুরুষ একজন নারীকে টেনে উঁচুতে তুলতে চেষ্টা করছে।
ইবনে সামির এ দৃশ্য দেখে বিহ্বল কণ্ঠে বলল, এই তো আমার আইনী!
মাসউদ ইবনে সুহাইল ও তার সাথীদ্বয় দৌড়ে গিয়ে সেখানে পৌঁছল এবং আইনীকে ধরে নিজেদের দখলে নিয়ে এল। ইবনে সামিরের বন্ধু দুজন ক্ষীপ্ত হয়ে বলল, এই মেয়ে তাদের। একে কেউ তাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। ইবনে সামির ছুটে গিয়ে বলল, এ আমার স্ত্রী।
মাসউদ ও তার সাথীরা খঞ্জর বের করল। ইবনে সামিরে বন্ধুদ্বয়ের কাছে কোন অস্ত্র ছিল না। তারা অসহায়ের ন্যায় ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মাসউদ বলল, চুপ করে বসে থাক। একটু নড়বে তো সেখানেই শেষ হয়ে যাবে। তারা বসে থাকল। মাসউদ আইনীকে এনে সামনে দাঁড় করাল। বলল, হে মেয়ে! নির্ভয়ে বল, এরা তোমার সাথে কী আচরণ করেছে?
আইনী সবকিছু বলল, সবশেষে বলল যে, তারা তাকে এখানে এনে তার ইজ্জত হনন করেছে।
একথা শোনার সাথে সাথে ইবনে সামিরের চোখ ক্রোধে জ্বলন্ত কয়লার মত হয়ে গেল। অগ্নিঝরা কণ্ঠে বলল, এ পাপের শাস্তি হত্যা ছাড়া আর কি হতে পারে? এ কথা শুনার সাথে সাথে ইবনে সামিরের বন্ধুদ্বয় বিনয় বিগলিত কণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল।
তিনজনে ধরে তাদের একজনকে মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে দিল ও তার হাত পা বেধে দিল। মাসউদ তার খঞ্জরটি আইনীর হাতে দিয়ে বলল, এই খঞ্জরটি তার হৃদপিণ্ড বরাবর বসিয়ে দাও। তারপর তার পেট চিরে ফেল।
আইনী এমন ক্ষীপ্ত ছিল যা চিন্তা করা যায় না। সে খঞ্জরটি হাতে নিয়ে প্রথমে তার হৃদপিণ্ডে আঘাত করল। বিরামহীনভাবে আঘাত করতেই থাকল। যেন তার প্রতিশোধ স্পৃহা মিটছে না।
এভাবে দ্বিতীয় জনকেও আইনীর হাতেই হত্যা করাল। দু দুজনকে হত্যা করার পর আইনী ইবনে সামিরকে ঝাঁপটে ধরে দীর্ঘক্ষণ কাঁদল।
এরপর তারা উঁচু ভূমি টপকে খেজুর বাগানে নেমে দেখে, সেখানে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে। তারা সেখান থেকে অঞ্জলি ভরে ভরে পানি পান করল। মাসউদের দুই সাথী গিয়ে খেজুর নিয়ে এলে তারা খেজুর খেয়ে জঠর জ্বালা নিবারণ করল।
***
ক্লান্ত সূর্য বিষণ্ণ বদনে অস্তমিত হওয়ার সকল আয়োজন শেষ করেছে। যাই যাই করে অস্তমিত হয়ে গেলেও তার আভা এখনো পশ্চিমাকাশ জুড়ে বিরাজ করছে। ক্ষুধা পিপাসায় দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর ক্লান্ত শ্রান্ত বদনে শীতল পানি পান ও খেজুর খাওয়ার পর সত্যই তাদের শরীর নেতিয়ে পড়ল। মাসউদ ইবনে সুহাইলের এক বন্ধু মাগরিবের আযান দিল। জামাতের সাথে তারা মাগরিবের নামায আদায় করল। ইবনে সামির ও আইনী নিষ্পলক নয়নে তাদের ইবাদতের বিস্ময়কর দৃশ্য দেখতে লাগল। এশার নামাযও তারা জামাতের সাথে আদায় করার পর একসাথে শুয়ে পড়ল।
ইবনে সামির ও আইনী তাদের নিকটে শুইতে চাইলে মাসউদ বলল, ভাই! তোমরা স্বামী স্ত্রী। তোমরা একটু দূরে গিয়ে শয়ন করো।
তারা একটু দূরে গিয়ে শোয়ার আয়োজন করল।
আইনী এমন ভয় পেয়েছে যে তার চোখে আর ঘুম আসছে না। ইবনে সামিরের অবস্থাও তাই। দীর্ঘক্ষণ তারা শুয়ে এপাশ ওপাশ করল। কিন্তু ঘুম এল না।
চারদিকে নিরব নিস্তব্ধ সুনসান। গোটা পৃথিবী যেন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। শুধু চোখ মেলে তাকিয়ে আছে ইবনে সামির ও আইনী। আইনী ফিফিসিয়ে ইবনে সামিরকে বলল, আপনি কি এ তিনজনকে বিশ্বাস করতে পারছেন?
ইবনে সামির বলল, এখনো আমি কিছু বলতে পারছি না। আমার বড়ই আক্ষেপ হয় যে, আমার নিকট কোন অস্ত্র ছিল না। একেবারে খালি হাতে সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিলাম। যদি আবার তেমন কঠিন কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে আমি তাদের থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করব।
আইনীর কণ্ঠ অত্যন্ত ভয়াতুর। বলল, আপনি কিন্তু ঘুমাবেন না। কিন্তু ধীরে ধীরে ঘুম ইবনে সামিরকে পরাজিত করতে যাচ্ছে। আর ইবনে সামির চাচ্ছে, কিছুতেই যেন ঘুম তাকে পরাজিত করতে না পারে। কারণ। আইনীর বয়স অল্প, অনিন্দ্য সুন্দরী। যদি তার স্বধর্মের লোকেরা আইনীকে নিয়ে এমন অপকর্ম করতে পারে তাহলে এদের ব্যাপারে ভরসা কি? এরা তো অন্য ধর্মের অনুসারী। এদের উপর কিভাবে ভরসা করতে পারি!
তারা উভয়ে বহু কষ্টে নিজেদের জাগ্রত রাখছে। অথচ মুসলমান তিনজন গভীর ঘুরে নিমজ্জিত। অর্ধরাত অতিক্রান্ত হওয়ার পর ইবনে সামির ও আইনী নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল এবং গভীর ঘুমে লুটিয়ে পড়ল।
হঠাৎ হাদের কানে এমন আওয়াজ পৌঁছল যেন কয়েকজন মানুষ লড়াই করছে। ডাক চিৎকার করছে। ইবনে সামির ও আইনী ভয়ে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল। ভয়াতুর দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। দেখল, মাসউদ ইবনে সুহাইল ও তার বন্ধুদ্বয় এখনো ঘুমে নিমজ্জিত। ইবনে সামিরের দৃষ্টি অন্য দিকে নিপতিত হলে দেখল, দূরে তার নিহত সাথীদের লাশ নিয়ে একদল মরু শৃগাল টানাটানি করছে আর মনের আনন্দে চিৎকার করে খাচ্ছে। তারা আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
আযানের আওয়াজ শুনে তাদের ঘুম ভেঙে গেল। দেখল, মাসউদের এক সাথী দাঁড়িয়ে উচ্চ কণ্ঠে আযান দিচ্ছে। আর মাসউদ ও অন্যজন ঝরণার পাশে বসে ওযু করছে।
ইবনে সামির আইনীকে বলল, আইনী ঘুমাও। এরা এখন নামায পড়বে। এরপর তারা আরো ঘুমাল। কিছুক্ষণ পর মাসউদ ইবনে সামিরকে জাগিয়ে বলল, যাত্রার সময় হয়ে গেছে। যদি আমাদের সাথে যেতে চাও তাহলে উঠ।
ইবনে সামিরের কণ্ঠে অভিমানের আভাস। বলল, আমি একা তো কোথাও যাব না। তোমাদের গন্তব্যস্থল পর্যন্ত তোমাদের সাথে যাব। তারপর সামনে অগ্রসর হব।
মাসউদ জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় যাবে?
ইবনে সামির থেমে গেল। কোন উত্তর দিল না। আইনীর দিকে আড় চোখে তাকাল। তারপর মাথা নত করল। আবার মাসউদের দিকে তাকাল। তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে,সে কোথায় যাবে তার সঠিক উত্তর সে জানে না। মাসউদ তাকে পুনরায় একই প্রশ্ন করলে সে মাথা নত করে নিল।
মাসউদের এক সঙ্গী বলল, তাহলে কি তুমি কোথায় যাবে তা ভুলে গেছ?
ইবনে সামির উত্তরে বলল, না….আমার কোন গন্তব্য নেই। তবে আমার একটি উদ্দেশ্য আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
মাসউদের কণ্ঠ স্থির। বলল, আমরা তোমাকে বাধ্য করব না। যদি মনে কর আমাদের সাথে তোমার থাকার প্রয়োজন আছে তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের সাথে থাকতে দিব। আর যদি প্রয়োজন না থাকে তাহলে এখানেই আমরা তোমাদের বিদায় জানাব।
ইবনে সামিরের কণ্ঠ এবার আবেগাপ্লুত হয়ে উঠল। বলল, তোমাদের আচার-আচরণে আমি এতো অভিভূত হয়েছি যে, আমার মনে চাচ্ছে, আমি আমার উদ্দেশের কথা তোমাদের নিকট বলে দেই। আমি একজন অত্যন্ত গোড়া প্রকৃতির খৃস্টান। খৃস্টধর্মের বিরুদ্ধে কোন কথা আমি সহ্য করতে পারি না। কিন্তু আমার ঐ নিহত দুই বন্ধু আমার বিশ্বাসে চির ধরিয়েছে। ওরা গোঁড়া খৃস্টান ছিল। আমাদের অন্তর দুই জাতির ঘৃণায় ছিল টইটুম্বর। রোমান জাতির ঘৃণা আর মুসলিম জাতির প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা। আমি একজন কিবতী খৃস্টান। আমাদের নেতা বিন ইয়ামিন।
মাসউদ বলল, তুমি মনে হয় ভুলে গেছো; জাহাজে তুমি আমাকে খৃস্টান মনে করে তোমার উদ্দেশ্যের কথা আমার নিকট ব্যক্ত করেছিলে। বলেছিলে, তুমি শামে যাচ্ছে। কিন্তু ঝড় তোমার উদ্দেশ্যকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। তুমি শামের খৃস্টানদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত করতে যাচ্ছিলে।
ইবনে সামির বলল, হ্যাঁ আমি সে উদ্দেশ্যেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন আর যাব না।
মাসউদ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন? কেন তুমি যাবে না? যদি তুমি মনে কর আসল কথা বললে আমরা তোমাকে হত্যা করব তাহলে তুমি ও তোমার স্ত্রীর এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়া ভাল। আমরা মদীনায় যাচ্ছি। ঝড়ের কারণে আমরা উদ্দিষ্ট বন্দরে পৌঁছতে পারি নি। আর যদি চাও তাহলে আমাদের সাথে মদীনায় যেতে পার। সেখান থেকে আমরা তোমাকে শামের পথ দেখিয়ে দিব। আগে স্থির সিদ্ধান্ত নাও, আমাদের সাথে যবে কি-না?
আসলে ইবনে সামিরের মানসজগতে এক প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়েছে। তার চিন্তা চেতনা ও বিশ্বাসের দুনিয়া লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সেখানে দেখা দিয়েছে বিধৌত বিমল আকীদা বিশ্বাসের আলোকময় সূর্য। যার আলোয় সে উদ্বাসিত। আর বিষয়টি বুঝতে পেরেছে মাসউদ ও তার সাথীদ্বয়। তাই তারা ইবনে সামির ও আইনীকে সাথে নিয়ে মদীনার পথে অগ্রসর হয়।
এভাবে তিন দিন তিন রাত চলার পর তারা মদীনায় গিয়ে পৌঁছল। ইতিমধ্যে ইবনে সামিরের সাথে মাসউদ অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে নিয়েছে। মিশরে রোমান সৈন্যদের অবস্থা সম্পর্কেও বহু দুর্লভ তথ্য জেনে নিয়েছে।
মাসউদ মদীনায় পৌঁছার পর ইবনে সামিরকে জিজ্ঞেস করল, বন্ধু! এখন কোথায় যাবে?
ইবনে সামির দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলল, আমি আমার গন্তব্য স্থানে পৌঁছে গেছি। আমি এ উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি যে, আমি ও আইনী মুসলমান হয়ে যাব।
মাসউদ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, আরো একটু ভেবে দেখ। আমরা তোমাদের উপর কোন চাপ প্রয়োগ করব না। যদি তোমরা ইসলাম গ্রহণ না কর তবুও আমরা তোমাদেরকে তোমাদের গন্তব্যস্থানে পৌঁছার ব্যবস্থা করব।
ইবনে সামিরের কণ্ঠ আবেগ বিজড়িত। বলল, ভাই মাসউদ! তোমাদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা আর ইবাদত বন্দেগী দেখে আমার ভাবনা পাল্টে গেছে। আমি শুনেছি, ইসলাম আরবের অশিক্ষিত বর্বর লোকদের লাঞ্ছনা আর অপদস্ততার তলদেশ থেকে ইজ্জত ও মর্যাদার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। আমি তা যথার্থভাবে বুঝতে পারছি। আমার বিশ্বাস, যদি আইনী একা তোমাদের সাথে থাকে তাহলেও তোমরা তার সাথে এমন আচরন করবে না যা আমার স্বধর্মের ভাইয়েরা করেছে। সুতরাং আমি ও আইনী প্রতিজ্ঞা করেছি, আমরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজেদের ধন্য করব।
মাসউদ ও তার সাথীদ্বয় ইবনে সামির ও আইনীকে তাদের সালারের নিকট নিয়ে গেল। ইবনে সামির তার জীবন বৃত্তান্ত সালারকে শুনাল এবং তারা মুসলমান হয়ে গেল।
ইবনে সামিরের দেয়া তথ্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো এ তথ্যগুলো আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর নিকটও উপস্থাপিত হয়েছিল।