৬. এ সংসারে আমরা সবাই

এ সংসারে আমরা সবাই মনে করি, সবকিছু জানি। সাধারণতঃ মানুষ–মানুষ এতই অহংকারী হয় যে, সে কিছুতেই স্বীকার করবে না, খুব সামান্য বিষয়েই তার জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা আছে, অধিকাংশ বিষয়েই সে অন্ধকারে। অহংকার আমারও ছিল। খবরের কাগজের রিপোর্টর বলে নিজেকে প্রায় সবজান্তাই মনে করতাম।

টুকটাক হোঁচট খেলেও শৈলেনদার সঙ্গে পরিচয় হবার পরই প্রথম বুঝলাম, এই দুনিয়ার মনুষ্য চরিত্র সম্পর্কে আমি কত অনভিজ্ঞ। শুধু মনুষ্য সম্পর্কে কেন, এই বিশ্ব-সংসারে কোথায় কত কি ঘটে, তারই বা কতটুকু খবর রাখি?

পোস্ট অফিস পুলিসের গোয়েন্দা দপ্তর নয়। কোন লুকোচুরির ব্যাপার এখানে নেই। সবকিছুই সবার সামনে হয়। চিঠিপত্র, রেজেষ্ট্রী, পার্সেল, মনি অর্ডার। এমনকি সেভিংস ব্যাঙ্কের কাজ কারবারের মধ্যে কোন রহস্য বা লুকোচুরির ব্যাপার নেই। তবু চোখের সামনের এই কাজকর্মের মধ্যেও কখনো কখনো কত বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে যায়।

আর-এল-ও, রিটার্ন লেটার অফিসে শুধু চিঠিপত্রই আসে না। রেজেস্ট্রী, ইন্সিওরড, চিঠি-প্যাকেট-পার্সেল, মনি অর্ডার ও আরও কত কি আসে কিন্তু তাই বলে প্যাকেট বা পার্সেলের মধ্যে বোমা? না, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

অতি সাধারণ একটি ছেলে। বস্তিবাসী। হয়ত কোন কলকারখানায় সামান্য কাজ করে। অথবা আশেপাশে কোন পানবিড়ির দোকান চালায়। বয়স বড় জোর বাইশ-তেইশ কিন্তু স্বাস্থ্য বেশ ভাল। হঠাৎ দেখলে মনে হয় সাতাশ-আঠাশ। বোম্বে মার্কা হিরোদের মত মাথায় লম্বা লম্বা চুল। দাড়ি না থাকলেও গোফ রেখেছে লম্বা-চওড়া এক কথায় হঠাৎ দেখলে মনে হয় গুণ্ডা, মস্তান।

পিয়ন জগদীশ সরকার এ অঞ্চলে চিঠিপত্র-রেজেস্ত্রী-মনি-অর্ডার ইত্যদি বিলি করছেন বিশ-বাইশ বছর কিন্তু মনে পড়ে না ওদের বাড়িতে একটা পোস্টকার্ড এসেছে। তারপর হঠাৎ একদিন ঐ অসীমের নামে রেজেস্ট্রী বুকপোস্টে একটা বইয়ের বাণ্ডিল এসে হাজির। পিয়ন জগদীশবাবু একটু অবাকই হন কিন্তু সেকথা তো প্রকাশ করতে পারেন না! সই করিয়ে প্যাকেট ওর হাতে তুলে দেন। প্যাকেটটা হাতে পেয়ে অসীমের খুশি দেখে জগদীশবাবুর বিস্ময় হয় কিন্তু সে বিস্ময় প্রকাশ করেন না।

জগদীশবাবু অন্যদিকে পা বাড়াতেই অসীম ওকে ডাক দেয়, দাঁড়ান, দাঁড়ান!

উনি পিছন ফিরে তাকাতেই অসীম একটু এগিয়ে তাড়াতাড়ি ওর হাতে পাঁচটা টাকা দেয়। পিয়ন ওর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে টাকাটা পকেটে রেখে অন্যদিকে পা বাড়ান।

দিন দশ-পনের পরে আবার একটি প্যাকেট। তবে বুক পোস্টের প্যাকেট নয়, রেজিস্টার্ড পার্সেল। অসীম খুশি হয়ে জগদীশবাবুর হাতে পাঁচ টাকা দেয়।

এর পর থেকে চিঠি না, মনি অর্ডার না, অসীমের নামে নিয়মিত প্যাকেট আর পার্সেল আসে এবং জগদীশবাবুর অদৃষ্টেও কিছু কিছু প্রাপ্তিযোগ ঘটে।

তারপর হঠাৎ একদিন একটা পার্সেল ডেলিভারী দিতে গিয়ে জগদীশবাবু অসীমকে পান না। ঐঘর থেকেই একজন মধ্যবয়সী ভদ্র লোক বেরিয়ে এসে বললেন, অসীম বলে তো এখানে কেউ থাকে না।

গত কয়েক মাস ধরে যে ছেলেটি এখানে থাকত, সেই ছেলেটিই তো অসীম।

ভদ্রলোক হেসে বলেন, কি বলছেন আপনি? যে ছেলেটিকে এখানে রেখে আমি দেশে গিয়েছিলাম, তার নাম তো হৃদয়।

হৃদয়? জগদীশবাবু যেন গাছ থেকে পড়েন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, হৃদয়। ওর বাবার নাম শ্রীনিবাস। এই শ্রীনিবাস আমার গ্রামের দোকানের দেখাশুনা করে।

জগদীশ একটু ভাবেন। তারপর বলেন, আচ্ছা সেই হৃদয়কে একটু দেখতে পারি?

তাকে তো আমি বাজারে পাঠিয়েছি।

এখুনি আসবে?

না, না, একটু দেরি হবে। এইতো তাকে পাঠালাম।

শেষে জগদীশবাবু বলেন, কাল এই সময় তাকে থাকতে বলবেন।

ভদ্রলোক একটু হেসে বলেন, তা বলব কিন্তু বাড়ির চাকরের নামে বইয়ের বাণ্ডিল বা পার্সেল আসে, তা তো বাপের জম্মে শুনিনি।

পরের দিন হৃদয়কে দেখে জগদীশবাবু অবাক! হা ভগবান! অসীম বলে, এই তো এত কাল সব প্যাকেট পার্সেল নিয়েছে।

হৃদয় ওরফে অসীম ইসারা-টিসারা করেও জগদীশবাবুর কাছ থেকে প্যাকেটটা হস্তগত করতে পারেনি। উনি প্যাকেট ফেরত নিয়ে চলে গেলেন।

প্যাকেটটি নিয়ে মহা সমস্যায় পড়লেন পোস্ট অফিসের বাবুরা। পার্সেলটি রেজেষ্ট্রী করা হয়েছে ধানবাদ হেড পোস্ট অফিস থেকে কিন্তু যিনি এটি পাঠিয়েছেন তার নাম-ঠিকানায় আছে–অবিনাশ, হ্যারিসন রোড, কলকাতা-১। হ্যারিসন রোডে লক্ষ লক্ষ লোকের বাস এবং তার মধ্যে কত শত অবিনাশ রয়েছে, তার কি ঠিকঠিকানা আছে?

শেষ পর্যন্ত অগতির গতি আর-এল-ও।

বুঝলে বাচ্চু, ঐ প্যাকেটের মধ্যে একটা পিস্তল ছিল।

বলেন কি দাদা?

হ্যাঁ ভাই, ঠিককথাই বলছি।

তারপর আপনারা ঐ পিস্তল নিয়ে কি করলেন?

শৈলেনদা একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে বললেন, আমরা আর কি করব? পুলিশকে খবর দেওয়া হল।

যত অনভিজ্ঞই হই, তবু তো রিপোর্টার। তাই কাহিনীর শেষটুকু শুনে স্বস্তি পাই না। জিজ্ঞেস করি, তারপর কি হল, তা কি জানেন?

শৈলেনদা একটু থেমে সিগারেটে আবার একটা টান দিয়ে বললেন, সবকিছু জানতে পারিনি ঠিকই কিন্তু কিছু কিছু জেনেছিলাম বৈকি!

আমাকে আর প্রশ্ন করতে হয় না। উনি নিজেই বলে যান, আমরা শুধু এইটুকু জানতে পারি, ঐ ছেলেটার নাম অসীমও না, হৃদয়ও না। ওর নাম অন্য কি যেন ছিল। তার চাইতে বড় কথা ছেলেটি মোটেও ঐ ভদ্রলোকের চাকর ছিল না।…

বলেন কী?

উনি একটু হেসে বলেন, হ্যাঁ বাচ্চু, ছেলেটি বি. এ. পাস ছিল এবং পলিটিক্স করত।

আচ্ছা! আর ঐ ভদ্রলোক কি ছিলেন জান?

কী?

শৈলেনদা হেসে বললেন, মূৰ্ছা যাবে না তো?

ওঁর কথায় আমিও হাসি। বলি, মূর্ছা যাব কেন?

ঐ ভদ্রলোক পুলিসের গোয়েন্দা ছিলেন।

তাই নাকি?

শৈলেনদা মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ।

ঐ রিটার্ন লেটার অফিসে বসে ভারতীয় ডাক ও তার বিভাগের সেবা করতে দশের ও দেশেরও কত কি জানা যায়।

জান বাচ্চু, প্যাকেট-পার্সেলের মধ্যে বোমা-পিস্তল-পাইপ ছাড়াও আরও কত কি পাওয়া যায়।

কত কি মানে?

খুন করা মানুষের এক টুকরো হাত-পা পর্যন্তও আমরা পেয়েছি।

বলেন কী দাদা?

শৈলেনদা মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ ভাই, সত্যি কথাই বলছি।

আমি তাড়াতাড়ি একটু হেসে বলি, আমি কি বলছি আপনি মিথ্যে কথা বলছেন?

উনি গম্ভীর হয়ে বললেন, নাসিকে এক ব্যবসাদারের মেয়েকে রেপ করে খুন করা হয়। তারপর ঐ খুনী মেয়েটির বডিকে তিরিশ-বত্রিশ টুকরো করে এক একটা টুকরো দেশের এক এক জায়গায় ফলস ঠিকানায় পাঠায়। ইস্!

ইস্ করছে কি! মানুষ কি না পারে?

তা ঠিক। একটু থেমে জিজ্ঞেস করি, লোকটা ধরা পড়েছিল?

হ্যাঁ, ফাঁসীও হয়েছিল।

শৈলেনদার কাছে আর-এল-ও অফিসের গল্প শুনতে শুনতে সত্যি মুগ্ধ হয়ে যাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওঁর কথা শুনি। বৌদি খেতে দিয়ে বার বার না ডাকলে আমাদের হুঁশ হত না। একদিন তো শৈলেনদার কথা শুনতে শুনতে ঘড়ি দেখার কথা মনেই পড়েনি। যখন আমাদের বৈঠক শেষ হল, তখন রাত প্রায় একটা। সে কাহিনী আমি কোনদিন ভুলব না।…

ইন্সিওর্ড পার্সেলটা ঠিক ঠিকানাতেই গিয়েছিল কিন্তু মেয়েটির মা পিয়নকে বললেন, না, এ পার্সেল আমার মেয়ে নেবে না।

পিয়ন জিজ্ঞাসা করলেন, তবে কী এই পার্সেল ফেবত পাঠিয়ে দেব?

ভদ্রমহিলা বেশ রাগ করেই বললেন, যা ইচ্ছে করুন, মোট কথা এ পার্সেল আমরা নেব না।

পিয়নের সঙ্গে মাকে এত কথা বলতে দেখে একটি সদ্য বিবাহিত মেয়ে ভদ্রমহিলার পাশে এসে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করল, কী ফেরত দিচ্ছ মা?

ভদ্রমহিলা কিছু বলার আগেই পিয়ন ওকে বললেন আপনার নামের এই পার্সেলটা।

মেয়েটি একটু ব্যস্ত, একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল, কেন মা? এই পার্সেলটা নেবে না কেন মা?

ভদ্রমহিলা বেশ রূঢ় হয়েই বললেন, কোথাকার কে পাঠিয়েছে, তার নেই ঠিক! যে যা পাঠাবে, তাই আমরা নেব নাকি?

মার কথায় মেয়েটি একটু অবাক হয় কিন্তু মুখে কিছু বলে না।

এবার ওর মা প্রায় আনমনেই বলেন, কার মনে কি মতলব আছে, তার কি কোন ঠিকঠিকানা আছে!

পিয়ন আবার প্রশ্ন করেন, তাহলে এটা ফেরত পাঠাব তো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফেরত দিন।

পিয়ন পকেট থেকে কলম বের করে লেখেন, রিফিউজড।

এবার মেয়েটি ওর মাকে জিজ্ঞেস করল, মা, এটা কে পাঠিয়েছেন।

কে এক অরূপ মুখার্জী!

বাপির কোন বন্ধু না তো?

না, না, কোন জন্মেও নাম শুনিনি।

পার্সেলটি ফেরত গিয়েছিল অরূপ মুখার্জীর ঠিকানায়। সেখানে গিয়ে জানা গেল, হা, উনি কদিনের জন্য এই হোটেলে ছিলেন কিন্তু দুতিন দিন আগেই চলে গেছেন।

বাড়ির ঠিকানা?

খাতা খুলে ম্যানেজারবাবু বললেন, শুধু লেখা আছে দার্জিলিং।

পার্সেল কলকাতা থেকে ভুবনেশ্বর ঘুরে গেল দার্জিলিং।

সেখানে কিছুদিন বিশ্রাম নেবার পর পার্সেলটি শেষ পর্যন্ত আর এল-ওতে হাজির।

শৈলেনদা বললেন, পার্সেলটি খুলেই ঘোষদা অবাক!

কেন?

ওর মধ্যে একটা দামী ডায়মণ্ডের নেকলেস, একটা অত্যন্ত পুরনো সিঁদুরের কৌটো আর একটা বিশ-পঁচিশ পাতার চিঠি দেখে ঘোষদা অবাক!

আমি চুপ।

শৈলেনদা বলেন, ঘোষদা চিঠিটা পড়ার পর আমাদের সবাইকে ডেকে চিঠিটা শুনিয়েছিলেন।…

মা অনুরাধা, সবার আগে তুমি আমার প্রাণভরা স্নেহাশিস নাও।

জানি না তোমাকে আমার চিঠি লেখার অধিকার আছে কিনা কিন্তু স্নেহ-ভালবাসা মানুষের এমনই এক রকম সম্পদ যা ন্যায়-অন্যায় উচিত-অনুচিত সময়-অসময় মানতে জানে না। তোমাকে দেখতে, কাছে পেতে, আদর করার জন্য মন অনেক সময়ই ব্যাকুল হয়েছে, কিন্তু মা, তুমি তো জান, এ সংসারে শুধু হৃদয়ের তাগিদে জীবনের জটিল-কুটিল পথে চলা যায় না। সম্ভব নয়। নানা পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপে আমরা সবাই নিজের মনকে উপেক্ষা করি। আমিও করেছি, না করে পারিনি। বাধ্য হয়ে করেছি। তবে বিনিময়ে কখনও বিনিদ্র থেকেছি রাতের পর রাত, কখনও আবার সবার আড়ালে চোখের জল ফেলেছি। সত্যি বলছি মা, মাঝে মাঝে শুধু তোমাকে একটু দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠেছি। স্নেহ-ভালবাসার আতিশয্যে তোমার কোন ক্ষতি না হয় ভেবেই পাগলামি করতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়েছি। নিজেকে সংযত করেছি, করতে বাধ্য হয়েছি। তবে রক্ত-মাংসের কোন মানুষই সব সময় সংযত থাকতে পারে না, কিছুতেই পারে না। আমিও পারিনি। কদাচিৎ কখনও ছুটে গেছি তোমার স্কুলের সামনে, কলেজের সামনে। কোনদিন তোমাকে দেখেছি, কোনদিন দেখিনি।

ঠিক পঁচিশ বছর আগে দশই ডিসেম্বর তুমি এই পৃথিবীর আলো প্রথম দেখেছিলে। তাইতো প্রতি বছর ঐ দশই ডিসেম্বর এলেই তোমাকে একটু দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠি। একবার আমি কি করেছিলাম জানো?

অনেক টফি আর চকোলেট কিনে সোজা চলে গেলাম তোমাদের স্কুলে। সেদিন কোন কারণে তোমাদের হেডমিস্ট্রেস মিসেস রায় স্কুলে আসেনি। তাই তোমাদের প্রতিমাকে বললাম, আমার নাম অরূপ মুখার্জী। আমি বোম্বে থাকি কিন্তু জরুরী কাজে দুতিন দিনের জন্য কলকাতা এসেছি। আজ আমার মেয়ের জন্মদিন কিন্তু ওকে কাছে পাচ্ছি না বলে

আমি এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেছিলাম। এবার উনি আমাকে বললেন, আগে আপনি বসুন।

হ্যাঁ, তারপর বসে বললাম, আমার মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ে। তাই যদি আপনি দয়া করে অনুমতি দেন তাহলে আপনাদের স্কুলের ক্লাস ফাইভের মেয়েদের আমি একটু টফি-চকোলেট দিতাম।

প্রতিমাদি অবাক হয়ে আমাকে দেখে নিয়ে বললেন, চলুন, আমার সঙ্গে।

সেদিন ওর সঙ্গে তোমাদের ক্লাসে গিয়েছিলাম। তোমার হাতেও টফি-চকোলেট দিয়েছিলাম, মুগ্ধ হয়ে দুচোখ ভরে তোমাকে দেখে ছিলাম কিন্তু মন চাইলেও মুখ দিয়ে একটি শব্দ বের করিনি। তোমার কী সেদিনের কথা মনে আছে?

সেদিন তুমি দশ বছরে পা দিলে! আমার জীবনের সে এক অবিস্মরণীয় দিন!

তুমি যখন কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করেছ, তখনও আমি তোমাকে দেখেছি। তবে সব সময়ই দূর থেকে। কখনও কখনও অবশ্য খুব কাছ থেকেই তোমাকে দেখেছি কিন্তু ভয়ে ভয়ে। কিসের ভয়ে জানো? তোমার মার ভয়! সে যদি কোন কারণে আমাকে তোমার কাছাকাছি দেখত, তাহলে নিশ্চয় কিছু অঘটন ঘটত। যাই হোক কফিহাউসে তুমি যখন বন্ধুবান্ধুবদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক হাসি-ঠাট্টা করতে তখন তোমাকে দেখে তোমার কথাবার্তা শুনে আমার মন ভরে যেত। ঐ কফিহাউসের আড্ডায় তোমার একটা কথা আমি জীবনেও ভুলব না। বেশ মনে আছে, ওথেলো আর ডেসডিমনার ভালবাসা নিয়ে তোমাদের আলোচনা শুরু হয়েছিল। আলোচনা একটু জমে ওঠার পরই ওথেলো ডেসডিমনা হারিয়ে গেল। প্রেম ভালবাসা নিয়ে তোমাদের তর্ক জমে উঠল। সেদিন সব আলোচনার শেষে তুমি বলেছিলে, যে ভালবাসার দ্বারা প্রিয়জনের কল্যাণ হয় না, তা কখনই ভালবাসা না!

কথাটা শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই এবং তোমরা সবাই চলে যাবার পরও আমি ওখানে স্থবিরের মত বসে বসে তোমার কথাটাই ভেবেছি ঘন্টার পর ঘণ্টা।

এই দীর্ঘ পঁচিশ বছরের মধ্যে অনেক সময় ভেবেছি, তোমার কাছে ছুটে যাই, তোমাকে আদর করি, জড়িয়ে ধরি, কোলে তুলে নিই। তুমি একটু বড় হবার পর বহুবার ভেবেছি, তোমাকে আমার চোখের জলের ইতিহাস বলি কিন্তু তা পারিনি। শুধু এই কথা ভেবে নিজেকে সংযত রেখেছি যে যদি আমার আবেগ-ভালবাসার আতিশয্যে তোমার কোন ক্ষতি হয়, তাহলে সে দুঃখ আমি সহ্য করতে পারব না। তুমি যখন এম. এ. পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলে, তখন মনে হয়েছিল, না, না, আর দেরি করব না। এখন তুমি বড় হয়েছ, তোমার বিচার-বুদ্ধি হয়েছে, ভাল-মন্দ ন্যায়-অন্যায় বিচার করতে শিখেছ। সুতরাং আর দেরি করব কেন? না, তখনও পারিনি। তখনো অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করেছি কিন্তু মা, আর যে পারছি না। বোধ হয় সময়ও বেশি নেই।

তাছাড়া আজ তুমি বিবাহিতা। যে সহপাঠীকে তুমি জীবনসঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করেছ, সেই সুদীপও অত্যন্ত আদর্শবান ও বুদ্ধিমান ছেলে। আজ তুমি শুধু তোমার বাবা-মার সন্তান না, তুমি সুদীপের স্ত্রী। তাইতো আজ তুমি এই পৃথিবীর, এই সংসার ও মানুষজন সম্পর্কে নিজস্ব মতামত গ্রহণ করার অধিকারিণী এবং সেই সাহসেই আজ তোমাকে প্রথম চিঠি লিখছি।

মাগো, এত দীর্ঘ ভূমিকার জন্য তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তবে শুধু এইটুকু মনে রেখ, আমি দুঃখী, চির দুঃখী। আমি সারাজীবন শুধু চোখের জলই ফেললাম। এই পৃথিবীর কারুর বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ নেই। এই পৃথিবী, এই সংসারের জন্য আমরা সবাই কি উপযুক্ত? না, তা হতে পারে না। আজ আমি মনে মনে বিশ্বাস করি, আমি শুধু হতভাগ্য না, আমি একটি ব্যর্থ, অপদার্থ জীব মাত্র।

দীর্ঘ চিঠির শেষের দিকে উনি লিখেছিলেন, ধনীর ঘরে জন্মে সুখ পেলেও শান্তি পাইনি। আনন্দময় হয়নি আমার শৈশব-কৈশোরের দিনগুলি। ছোটবেলায় মাতৃহীন হলে কি কোন শিশু বা কিশোরের জীবন মধুর হতে পারে? তবু জীবন এগিয়ে চলল। তারপর একদিন সরকার জমিদারী-প্রথা বিলোপ করলেন ও সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞাতিদের শত্রুতাও চরমে উঠল। বাবা সবকিছু হারিয়েও নির্বিবাদে সেক্সপিয়ার চর্চা নিয়ে মেতে রইলেন। তারপর একদিন শুধু ফার্স্ট ডিভিশান না, তিনটে লেটার পকেটে করে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হলাম। দেখতে দেখতে প্রেসিডেন্সী কলেজের দিনগুলোও কেটে গেল। বাবা জোর করেই বিলেত পাঠালেন। বাবাকে শুধু বৃদ্ধা বিধবা পিসীর ভরসায় রেখে সাত সমুদ্র পাড়ি দেবার একটুও ইচ্ছা ছিল না কিন্তু বাবার ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করতে না পেরে সত্যি সত্যি একদিন বোম্বে থেকে পি. অ্যাণ্ড ও লাইনের জাহাজে চড়লাম। বিলেত বাসের মেয়াদ শেষ করে কলিকাতায় ফিরে দেখি, বাবা মৃত্যুশয্যায়। বোধ হয় আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।

জানো মা, বাবার মৃত্যুর দিন পনেরো পর আবিষ্কার করলাম, তিনি আমার পাত্রীই শুধু নির্বাচন করেননি, বিয়ের দিনও পাকা করে গেছেন। না, ঐ দিনই আমার বিয়ে হয়নি কিন্তু ঐ পাত্রীর সঙ্গেই আমার বিয়ে হল। সেটা সাতাশ বছর আগেকার কথা। যাকে আমি বিয়ে করি তিনি শুধু সুন্দরী ছিলেন না, উচ্চশিক্ষিতাও ছিলেন এবং ওর বাবা আমার বাবার বিশেষ বন্ধু ছিলেন।

অত্যন্ত দুঃখের কথা আমার বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিয়ে করলেই কি ভালবাসা হয়? ছন্দপতনের সঠিক কারণটা আজো আমি জানি না। শুধু এইটুকু জানি, আমার স্ত্রীকে আমি সুখী করতে পারিনি এবং তিনি যেদিন আমার বন্ধন থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন, সেদিন আমি নীরবে সম্মতি জানিয়েছিলাম। তারপর একদিন আমার স্ত্রী তার শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন। মাগো, সেদিনের সেই শিশুকন্যাটি আর কেউ নয়, তুমি!

আমি তোমার জন্মদাতা হলেও তোমার পিতৃপরিচয় দেবার সাহস বা অধিকার আমার নেই। সবাই জানেন, তুমি ডাঃ সন্তোষ রায়ের কন্যা। আমিও জানি, তিনি তোমাকে পিতৃত্বের স্নেহ-ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছেন এবং সেজন্য আমিও তার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।

আমার পরলোকগতা মার ইচ্ছা পূরণের জন্যই এই চিঠি লিখছি। বাবা এই নেকলেসটা আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, তোমার প্রথম সন্তান পুত্র হলে, তোমার পুত্রবধূকে এইটি দিও। আর যদি প্রথম সন্তান কন্যা হয়, তাহলে তার বিয়ের সময় এই নেকলেসটা তাকে দিও। মার ইচ্ছা পূরণের জন্যই এই নেকলেসটা তোমাকে পাঠালাম।

আর একটি কথা। এ সংসারে আমার মেয়াদ আর খুব বেশি দিনের নয় বলেই মনে হচ্ছে। তোমাকে দেবার মত আমার বিশেষ কিছুই নেই। তাছাড়া আমার কী অধিকার? তবু বলছি, গ্রাচুইটি প্রফিডেন্ট ফাণ্ডের যা কিছু ইউনিভার্সিটি থেকে পেয়েছি, তার অর্ধেকেরও বেশি চিকিৎসার জন্য ব্যয় করেছি। আগামী সপ্তাহে ভেলোর যাচ্ছি অপারেশনের জন্য। সে জন্যও বেশকিছু ব্যয় হবে। তবু কিছু থাকবে বৈকি। যা থাকবে, তা তোমার সন্তানের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে রেখে দেব। স্টেট ব্যাঙ্কের গড়িয়াহাট বাঞ্চে সব নির্দেশ দেওয়া আছে। যদি তোমার ও সুদীপের আপত্তি থাকে তাহলে ব্যাঙ্ক এই টাকা রামকৃষ্ণ মিশনে পাঠিয়ে দেবে।

তোমরা দুজনে আমার প্রাণভরা ভালবাসা নিও।

শৈলেনদা থামলেন।

আমিও চুপ।

কিছুক্ষণ পরে উনি বললেন, এই চিঠিটার কথা আমরা কেউ কোনদিন ভুলব না।

কেন?

উনি একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, যেদিন সকালের কাগজে দেখলাম, ভেলোরে অধ্যাপক অরূপ মুখার্জীর মৃত্যু হয়েছে, সেইদিনই অনুরাধা আর তার স্বামী ঐ পার্সেলটার খোঁজে আমাদের অফিসে এসে হাজির।

বলেন কী?

হ্যাঁ ভাই।

তারপর?

তারপর ঐ পার্সেলটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে অনুরাধার কি কান্না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *