৬. একটু চা না হলে তো বাঁচিনে

একটু চা না হলে তো বাঁচিনে! কল্পনা দীর্ঘনিঃশ্বাসের দ্বারা বক্তব্যটা বিশদ করল।

চা-বিহনে মারা যাচ্ছি এমন কথা আমি বলতে পারিনে –সত্যনিষ্ঠার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বলতে হয় : তবে এক কাপ পেলে এখন মন্দ হেতো না নেহাত!

চায়ের একটা দোকান কাছাকাছি আছে কোথাও নিশ্চয়।

আমারও তাই ধারণা। চায়ের গন্ধ পাচ্ছি যেন! মিনিট খানেকের মধ্যেই কোনো চায়ের আড্ডার ওপরে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারি মনে হচ্ছে।

কিন্তু মিনিটের পর মিনিট কেটে যায়, অগুনতি মিনিট, এবং হোঁচটও বড়ো কম খাইনে, কিন্তু কোনো চাখানার চৌকাঠে নয়। আমি হতাশ হয়ে পড়ি এবং কল্পনা পেঁয়ো লোকের বোকামি আর ব্যবসাবুদ্ধিহীনতার প্রতি তীব্র কটাক্ষপাত না করে পারে না।

বাস্তবিক, গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে যাচ্ছি অথচ চায়ের নামগন্ধ নেই। কেন, গাঁয়ে গাঁয়ে চায়ের দোকান খুললে কী ক্ষতি ছিল? ফলাও কারবারে দু পয়সা উপায় হতে বইতো নয়! এই তো, আমরাই তো দু কাপ খেতাম। ডবল দামেই খেতে পারতাম। এমনকি, চারগুণ দাম দিতেও পেছপা ছিলাম না—চা-র এমনি গুণ।

কিন্তু এই গেয়ো লোকগুলো—একালে বাস করেও সেকেলে—সেসব কিছু বোঝে কি? যাতে দু পয়সা সাশ্রয় নগদা-নগদি আমদানি, তাতেই ওরা নারাজ।

নাঃ, এখনকার কারু দূরদৃষ্টি নেই। কেন যে লোক মরতে আসে এখানে? বেড়াবার কি আর–

কথাটা কল্পনাকে কটাক্ষ করেই বলা। পল্লী অঞ্চলে, পল্লী মায়ের আঁচলে হাওয়া খাবার সখ ওরই উথলে উঠেছিল হঠাৎ। এবং বলতে কি, যে-আমি এমন কলকাতাসক্ত, যাকে কলকাতার বাইরে টানা ভারী শক্ত ব্যাপার, প্রাণ গেলেও পাড়াগাঁর দিকে পা বাড়াইনে—সেই আমাকে একরকম তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে যাদুরে।

–আর জায়গা পায় না? বাক্যটাকে উপসংহারে নিয়ে আসি। এবং বলতে, বলতে, পাড়াগাঁ-সুলভ-আরেক নম্বরের দূরদৃষ্টিহীনতা—পথভ্রষ্ট এক গাদা গোবরের ওপর পদক্ষেপ করে বসি। ঠিক বসিনি—তবে আরেকটু হলেই বসে পড়তে হতো, চাইকি ধরাশায়ী হওয়াও বিচিত্র ছিল না, কিন্তু হাতের কাছাকাছি কল্পনাকে পেয়ে পেয়ে গিয়ে, তক্ষুনি তাকে পাকড়ে, নড়বোড় করে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে গেছি।

তোমার যে বাপু অদূরদৃষ্টিও নেই। বিরস-বদনে কল্পনা বলে। স্বামীর আশ্রয়স্থল হয়েও সে সুখী নয়। তার ব্লাউজের একটা ধার নাকি ফ্যাঁ—স করে গেছে।

ব্লাউজ উদ্ভিন্ন হওয়ার দুঃখ আমার মনে স্থান পায় না। আমার আত্মরক্ষাতেই আমি খুশি। তাছাড়া ভেবে দেখলে, কে কার? রাউজ তো আমার নয়। এবং ব্লাউজ ইত্যাদি বিসর্জন দিয়েও স্বামীরত্নদের যদি অধঃপতনের হাত থেকে বাঁচানো যায় (সাধ্বীদের অসাধ্যি কী আছে?) তা কি স্ত্রীজাতির কর্তব্য না?

বা রে। তুমি কি বলতে চাও যে আমি ইচ্ছে করে পড়তে গেছি? মানে, ঐ গোবরটার সঙ্গে চক্রান্ত করে–? ক্ষুব্ধ কণ্ঠে আমি বলি : এই কথা তুমি বলতে চাও?

যাও। এদিকে চায়ের তেষ্টায় প্রাণ যাচ্চে–তোমার ইয়ার্কি আমার ভালো লাগে না।

বাস্। আমি তো নেমেই চায়ের কথা তুলেছি। রেলওয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই যাচ্ছিলাম—তুমিই বাধা দিলে।

আমাদের আগে আগে রেস্তোরাঁয় সেই মেয়েগুলো ঢুকলো না? মনে নেই তোমার?

হ্যাঁ, সেই অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান মেয়েরা? তাতে কী?

কী সব খাটো খাটো ফ্রক-পরা তাদের–দেখেছিলে তো?

দেখেছিলাম।

তুমি যে দেখেছিলে সেটা আমিও দেখেছি। লক্ষ্য করতে আমার দেরি হয়নি।–আর সেই কারণেই ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না আমরা স্থির করলাম।

আহা? আহা। কল্পনার এই স্ব-গৌরবে বহুবচন—আমার ন্যায় নেহাৎ আ-স্বামীর পক্ষে এর জবাব আর কী আছে? তবুও আমতা আমতা করে বলতে যাই। কিন্তু ওরা তো বাঙালী নয়? মেম তো?

কিন্তু তা হলেও—তবুও তো অসময়ে চায়ের পিপাসা জেগে উঠতে তোমার কোন বাধা হয়নি।

তোমার ভারী সন্দিগ্ধ মন। আমার বিশ্বাস, দার্জিলিঙে গেলে তুমি আমাকে কাঞ্চনজংঘার দিকেও চোখ মেলে চাইতে দেবে না। আমাকে দেখছি সব সময়েই এভারেস্টের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে।

বলার সাথে সাথে, দৃষ্টান্ত-স্বরূপ, (দার্জিলিঙে না গিয়েই) এভারেস্টের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করি। আমার চিরতমার আগাপাশতলা বারেক পর্যবেক্ষণ কবে নিই—এমনকি, অভ্রভেদী গিরিশৃঙ্গ (সম্প্রতি কুটিকামুক্ত) অব্দি বাদ যায় না। আগার দিক থেকেই আগাই-গোড়ায়।

ইয়ার্কি কোরো না, যাও! কল্পনা রাগ করে।

ইয়ার্কি হলো কোনখানে? ভেবে দেখলে তুমিই তো আমার, একাধারে, ইভ এবং রেস্‌ট,—আর দ্বিধামুক্ত হলেই-এক কথায় ঐ! ব্যাকরণমতে দাঁড়ায় এভারের সুপারলেটিভ! তাই নও কি? সাদা বাংলায় যাকে চিরন্তনী বলে গো!

কল্পনা কোনো জবাব দেয় না। কথাটা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করে হয়ত বা।

অবশ্যি কবিতা করেও বলা যায় কথাটা। সাদা বাংলাতেই আজকাল কবিতা লেখা হচ্ছে কিনা! আমি দৃষ্টান্তের দ্বারা আরো প্রাঞ্জল করি : সুধীন দত্তের লেখা পড়েছো তো? পড়োনি?

খুব হয়েছে। আর ব্যাখ্যানায় কাজ নেই। এখন কোথায় চাখানা আছে একটু দয়া করে দেখবেন মশাই?

এভারেস্টের উচ্চতম চূড়া থেকে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলে বাক্যস্ফূর্তি কেন, সব ফুর্তিই লোপ পায়। আমিও আর উচ্চবাচ্য না করে চুপটি করে চলতে থাকি। ইতস্তুত-বিক্ষিপ্ত গোবরদের সন্তর্পণে বাঁচিয়ে, ছোটখাট খানাখন্দ, উঁচু-নীচু নীরবে অতিক্রম করে চলি।

একটু পরে কল্পনাই নিজের থেকে পাড়ে : তখন আমি এইজন্যেই বলেছিলাম যে টিফিন ক্যারিয়ার সাথে নিই। তুমিই তো না করলে। আনতে দিলে না আমায়।

আমিও না বলে পারি না: যত দোষ নন্দ ঘোষ!

এক বাক্যে, ঐ একটি মাত্র প্রবচনে, আমাদের অসন্তোষ ব্যক্ত করি—আমার আর নন্দ ঘোষের।

এবার ও গম্ভীর হয়ে যায়। বহুক্ষণ গুম-কোন কথাবার্তা নেই। আমাকে ব্যস্ত হতে হয় অগত্যা। আমার কি রকম যে স্বভাব-অপর কেউ গুম্ হলেই আমি যেন খুন হয়ে যাই। কোথায় আমার খুনসুটি লাগে, বুকের মধ্যে গুমরে ওঠে। ডিজিটালিস খেয়ে, এমন কি, গীতার সেই মারাত্মক শ্লোক আউড়েও কোনো ফল হয় না কিছুতেই এই ক্ষুদ্রং হৃদয়-দৌর্বলং কাটিয়ে উঠতে পারি না দেখা গেছে। মার্জনা-প্রার্থনার সুরে, মার্জিত স্বরে অনুতাপের আর্জি পেশ করি।

খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে বিশ্বাস করাই ভুল হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম যে কী বড়লোকের অট্টালিকায় আর কী ছোটলোকের হট্টমন্দিরে রাজপ্রাসাদেই কী আর পর্ণ কুটিরেই বা কী, বাংলার ঘরে ঘরে ভারতীয় চা আজকাল সমাদৃত হচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে তা নয়—অন্তত ঠিক ততটা নয়।

টিফিন ক্যারিয়ারটা আনতে দিতে কী হয়েছিল? কল্পনার সেই এক কথা—প্রাচীন পরিকল্পনা।

থার্মোফ্লাসকে চাও আনা যেত। এখন তাহলে যেখানে হয় বসে পড়ে মজা করে পিকনি করা যেত কেমন?

আনতে দিতে আর আপত্তি কী ছিল, কেবল বইতে তোমার কষ্ট হতো বই তো  না–তাইতো বারণ করলুম। মানে—মানে আমারই হাত ব্যথা হয়ে যেত কি না শেষটায়,-কল্পনার বহন-নৈপুণ্যে আমি অতাব নাস্তিক্যবাদী।

টিফিন-ক্যারিয়ারের প্রস্তাবটা একধারে যেমন মুখরোচক, দূরদৃষ্টি আর বিচক্ষণতা-সহকারে চিন্তা করে দেখলে, অপরদিকে তেমনই ঘর্মাক্তকর-দিব্যদৃষ্টির সাহায্যে এই মর্মান্তিক ভবিষ্যৎ, পা বাড়াবার আগেই আমি পরিষ্কার দেখেছিলাম, কল্পনার কাছে এই অপরাধ এখন মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি।

তুমি ভারী স্বার্থপর! ও বলে: নিজের হাত পার ওপর এত দরদ তোমার?

তা স্বার্থপর আমি একটু বইকি। ভূতপূর্ব আমার সেই ভবিষ্যৎ-দর্শন এবার আরো একটু স্পষ্ট করি : ভেরে দেখলাম এও তো হতে পারে, তুমি নিজেই অচল হয়ে পড়লে! হাঁটাহাঁটির বালাই তো নেই আমাদের। তখন এক হাতে টিফিন ক্যারিয়ার আরেক হাতে তুমি কোনটা সামলাই? আর, গ্রাম্য দৃষ্টিতেও সেটা খুব সুদৃশ্য নয়! এমনিতে হয়ত একটা বোঝা তত বেশি না—কিন্তু তার ওপরে শাকের আঁটি চাপালেই মাটি! ঐতিহাসিক উটের পিঠে চূড়ান্ত তৃণখণ্ডের মতোই দুঃসহ কাণ্ড! তা ছাড়া ছাড়া বিষয়টা আমি আরো খোলসা করি: দুটো বোঝা থাকলে হয়ত আমি দোনামোনায় পড়ে যেতাম। ওরকম অবস্থায় মানুষ অপেক্ষাকৃত হাই বেছে নেয় কিনা!

জানি জানি, আর বলতে হবে না। কল্পনা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে: তুমি টিফিন ক্যারিয়ারটাই হাতে নিয়ে ট্যাং ট্যাং করে বাড়ি ফিরে যেতে আমি খুব জনি।

মোটেই না। আমি গম্ভীর ভাবে ঘাড় নাড়ি: আমি তোমাকেই নিতাম। টিফিন ক্যারিয়ারের চেয়ে মাউন্ট এভারেস্টই আমার কাছে বেশি হাল্কা মনে হতো। তাছাড়া, পর্বতচূড়া বইবার ভাগ্য কজনের হয়? হলে কজন সে সুযোগ ছাড়তে পারে? পুরাকালে সেই একদা শ্রীমান্ হনুমান এই মোকা পেয়েছিলেন—গন্ধমাদন-বহনের সময় কিন্তু তিনি—তিনিও যতই বোকা হন, হাতছাড়া করতে পারেননি।

হয়েছে হয়েছে, খুব হয়েছে। যেমন পুরাণ, তেমনি ইতিহাস, সবই তোমার নখদর্পণে—টের পেয়েছি বেশ। এখন কোথায় গেলে একটু চা পাওয়া যায় তা যে কেন তোমার মাথায় আসছে না, তাতেই আমি ভারী অবাক হচ্ছি।

দাঁড়াও না। এক্ষুনি একজন সদাশয় অতিথি-বৎসল আদর্শ গ্রাম্য লোকের দেখা পেলুম বলে। আমাদের দেখেই তিনিই আপ্যায়িত হয়ে অভ্যর্থনা করবেন—চা-তো খাওয়াবেনই, সেই সঙ্গে চিড়েমুড়কি-ঘোরো গোরুর খোড়ো দুধ—সমস্ত মিলিয়ে মিষ্টি একটা ফলারও বাদ যাবে না। শুনেছি পাড়াগাঁর ওরা নিরাশ্রয় বিদেশী লোক দেখলেই কোন কথা শোনে না, ধরে বেঁধে খাইয়ে দ্যায়।

সেসব দিন গেছে। কল্পনার হাহুতাশ শুনিঃ এসব দৈত্য নহে তেমন। দুঃখের চোটে, হেমচন্দ্র থেকে পঞ্চোদ্ধার করতেও সে বাকী রাখে না।

আচ্ছা, এইবার কাউকে দেখতে পেলে জিগেস করব। আমি বলি। মরিয়া হয়ে বলি।

দেখতে পেলে তো। কল্পনা বিশেষ সান্ত্বনা পায় না।

বাস্তবিক, এতক্ষণ ধরে, এতখানি পথ—এত গণ্ডা চষা এবং না-মা মাঠ পার হয়ে এলাম, দু-একটা গণ্ডগ্রামও যে না পেরিয়েছিল তা নয়, কিন্তু বাক্যালাপ করবার মতো একটা মানুষ চোখে পড়ল না। যাও বা এক আধটা আমাদের সীমান্ত প্রদেশ ঘেঁষে গেছে, তাদের চাষাভুষো ছাড়া কিছু বলা যায় না। চাষা কি আর চায়ের মর্ম জানে, চায়ের সোয়াদ চায়? তাকে চায়ের কথা জিজ্ঞেস করাও যা, আর কল্পনাকে চাষের কথা জিজ্ঞেস করাও তাই—একজাতীয় কল্পনাতীত ব্যাপার!

কিন্তু না, এর পর যে ব্যক্তিই সামনে পড়বে, তা সে যেই হোক, তার কাছেই চায়ের কথা পাড়ব। এ-গাঁয়ের চাষাই হোক আর ভুষোই হোক, প্রথম কথাই চায়ের কথা এবং চায়ের ছাড়া অন্য কথা না।

এবং পড়লও একজন সামনে!

তিনটে চষা ক্ষেত আর সিকি মাইল সরু আলের রাস্তা ডিঙিয়ে গিয়ে তার দেখা মিলল। গাছের মগডালে পা ঝুলিয়ে বসেছিল লোকটা। গাছের ডালে বসে থাকাটাই বোধ হয় এধারকার লতি ফ্যাসানট্যাকসোবিহীন আমোদ-প্রমোদ—এইরকম আমার ধারণা হয়েছে। যখনই কোনো গেঁয়ো লোকের প্রাণে ফুর্তির সঞ্চার হয়, সাধ হয় যে একটু হাওয়া খাই, অমনি সে খুঁজে পেতে বিলাসিতার নামান্তর সহনশীল একটা গাছ আবিষ্কার করে তার ডালে উঠে বসে থাকে।

এখানে চাখানা কোথায় বলতে পারো? বৃক্ষাশ্রী লোকটাকে আমি প্রশ্ন করি।

ও নামে কেউ এখানে থাকে না। পা দোলাতে দোলাতে সে জানায়। এবং তার কাছ থেকে কিছুতেই এর বেশি আর কিছু বার করা যাবে না। আমরা তাকে গাছের ডালে পরিত্যাগ করে আবার আমাদের ভূপর্যটনে বেরিয়ে পড়ি।

এর পরেই একটি তরুণী মহিলার সহিত আমাদের ধাক্কা লাগলো। মেয়েটি রাস্তার ওপরে বসে ধূলো-মাটি জমিয়ে বালির ঘর রচনায় ব্যস্ত ছিল—কি এমনও হতে পারে, মাটির বানানো পুলিপিঠেই বানাচ্ছিল হয়ত বা।

খুকি, শোনো তো? এখানে কোথায় চা পাওয়া যায়, জানো তুমি? কল্পনাই জেরা করে।

হ্যাঁ, জানি। খুকি তার সপ্রতিভ ছোট্ট ঘাড়টি নেড়ে তক্ষুনি জানায় আমাদের কেদার কাকু। কেদার কাকু চা ব্যাচে। কেদার কাকুর কাছে চলে যাও।

কোথায় থাকেন তিনি—সেই তোমাদের কেদার কাকু? এই গাঁয়ের শেষে—একেবারে শেষে গিয়ে।

খুকির ব্যবহারে এবং বুদ্ধিমত্তায় চমৎকৃত হই। তৎক্ষণাৎ পকেট হাতড়ে কে দুটো আনি ওর দু হাতে সঁপে দিই—সত্যি, পৃথিবীতে মেয়েরা না থাকলে—এই স উপাদেয় প্রাণীরা আজো না টিকে থাকলে আমরা দাঁড়াতাম কোথায়?

তারপর—চলেছি তো চলেইছি। যে-গাঁয়ের অবশেষে কেদার কাকুর উপনিবেশ সে গাঁ আর আসে না। এক মাইল হাঁটাহাঁটির পর আমি বলি : এতখানি পথ পেরিয়ে এলাম, এতক্ষণে তো সে গ্রামে আমাদের পৌঁছানো উচিত ছিল।

আমিও সেই কথাই ভাবছি। কল্পনাও ভাবিত হয়েছে দেখা যায় : আরো কতোদূরে গ্রামটা, এসো, ঐ বুড়ো লোকটাকে জিজ্ঞেস করে জানা যাক।

আমাদের প্রশ্ন শুনে বুড়ো লোকটি আকাশ থেকে পড়লেনঃ সে-গ্রাম তো তোমরা পেছনে ফেলে এসেছ বাপু! আনমনা হয়ে ছাড়িয়ে এসেছ, তাই তোমাদের নজরে পড়েনি।

বুড়ো লোকটি ভারী অবাক হয়ে যান—এবং আমরা—ততোধিক অবাক হই।

যাই হোক, ফিরে চলি আবার—এবারে দুধারে খর-দৃষ্টি চালিয়ে যাই—দুজনেই কড়া নজর রাখি—যাতে ফের আবার কোনো গতিকে না ফসকে যায় গ্রামখানা।

আমার-আমার মনে হচ্ছে এইটাই বোধ হয় সেই গাঁ। পথিমধ্যে থেমে পড়ে কমনা আপন সংশয় ব্যক্ত করে।

এটা যদি এদের গ্রাম হয়— আমি বলি–তাহলে পর্ণ কুটির বলতে এরা কী বোঝে তাই আমি জানতে চাই।

আমরা কুটির ওরফে সেই পল্লীগ্রামের দ্বারে গিয়ে ঘা মারি। দরজা বলতে বিশেষ কিছু ছিল না-দরজার পাঠান্তর সেই নামমাত্র একটি যা ছিল তার ওপরে করাঘাত করতে হলে যথেষ্ট সাহসের দরকার—কেননা তার ফলে গ্রাম-চাপা পড়বার দস্তুরমতই আশঙ্কা ছিল।

কল্পনার হারমোনিয়াম বাজিয়ে অভ্যেস–সে-ই করাঘাতের দায়িত্ব নেয়। আমি গ্রামের আওতা থেকে সরে দাঁড়াই। কাপুরুষতার জন্যে না, দৈবাৎ যদি একজন গ্রামের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে নিমজ্জিত হয়—তাহলে তাকে সেই গ্রাম্য সমাধির কবল থেকে উদ্ধার করতে, নিতান্ত না পেরে উঠলে সেই গ্রামেই সমাধি দিয়ে ফিরতে আরেক জনের থাকা দরকার।

করাঘাতে একটু পরেই, গ্রাম ভেদ করে—কিংবা গ্রামান্তর থেকে একটি বুড়ো লোক বেরিয়ে আসেন।

কেদারবাবু এখানে থাকেন কোথায় বলতে পারেন দয়া করে? দুজনেই যুগপৎ জিগেস করি : কেদারবাবু ওরফে কেদারকাকু?

আমিই কেদারকাকু।

ও, আপনিই! যাক, বাঁচিয়েছেন। আমি উৎসাহিত হয়ে উঠি: গাঁয়ের ওরা বললে আপনি নাকি—মানে আপনার নাকি—মানে—আপনার এখানে কিনা—

কী করে কোন ভাষায় যে চায়ের নেমন্তন্নটা অযাচিতভাবে গ্রহণ করবার সুযোগ নেব ভেবে পাইনে।

আপনি নাকি মনে করলে আমাদের একটু চা খাওয়াতে পারেন। কল্পনার কিন্তু বলতে দেরি হয় না। প্রাণকাড়া একখানা হাসি হেসে চোখ ঘুরিয়ে কথাটা বলে দ্যায়।

বাস্তবিক, অদ্ভুত এই মেয়েরা! ভাবলে চমক লাগে! সত্যি, পৃথিবীতে এরা না থাকলে অব্যর্থ আমরা গোয় যেতাম।

কেদার কাকু নিজের দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে প্রকাশ করলেনঃ ও—হ্যাঁ–তা ওরা ঠিকই বলেছে। কিন্তু চা আমার পুরোণো খুব। তিন মাসের মধ্যে নতুন চা আসেনি—জেলায় আর যাওয়া হয়নি কিনা। কিন্তু চা তৈরির তো কোনো পাট আমার নেই। এমনি ছটাক খানেক দিতে পারি—অরই রয়েছে। পাঁচ আনা লাগবে কিন্তু।

আপনি–আপনার এখানে চা তৈরি হয় না? কল্পনার তারস্বর—হতাশার সুরে মেশানো।

আমার এটা মুদির দোকান—চায়ের আড্ডাখানা না! কেদার কাকুর বিরক্তিম মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। পাঁচ আনা দিয়ে আধ ছটাক চা-র একটা প্যাকেট বগলদাবাই করে আমরা সেই গ্রামের দ্বারদেশ থেকে ছিটকে বেরুই। এবং আবার আমাদের অভিযানে বেরিয়ে পড়ি।

 

তারপর কত যে হাঁটি তার ইয়ত্তা হয় না—স্টেশনের দিকেই হাঁটবার চেষ্টা করি। কিন্তু বিভিন্ন পথিকের বিবৃতি থেকে যা টের পাই তার থেকে এহেন ইষ্টিসন-বহুল গ্রাম যে ভূপৃষ্ঠে আর দুটি নেই এই ধারণাই আমাদের হতে থাকে। এখান থেকে–পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ-যেদিকেই যাই না কেন একটা করে স্টেশন পাবো—অচিরেই পেয়ে যাবে—দশ বিশ মাইলের মধ্যেই পাওয়া যাবে তাও জানা গেল। এমনকি, সরাসরি নাকের বরাবর নৈশৃং কোণ ধরে চলে গেলেও আর একটা নাকি পেতে পারি, সেরকম সম্ভাবনাও রয়েছে। অতএব কোনদিকে যাওয়া শ্রেয় হবে স্থির করতে না পেরে, অস্থির হয়ে আমরা দিঘিদিকে চলতে শুরু করে দিলাম।

চলতে চলতে হঠাৎ এক অভাবনীয় দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে উদঘাটিত হলো। পার্শ্ববর্তী ছোট্ট একটি আমবাগানের ছায়ায় দুটি হেলে-স্কুল-পালানো বলেই সন্দেহ হয়—পিকনিকের আযোজনে মশগুল বয়েছে।

সুচারু একটি পিকনিক! স্টোভে খিচুড়ি চাপানো হয়েছিল প্রায় শেষ হয়ে এল বলে—ভুরভুরে তার স্টে চারিদিক আমোদিত। পেঁয়াজ ছাড়ানো। ছোট বড় গোটাকতক ডিম কাছাকাছি। ডাগডি যাচ্ছে—খিচুডির সাথে আমলেটেব যোগাযোগ হবে আন্দাজ করা কঠিন নয়।

ঘেসো জমির ওপর খবরের কজ বিছানো হয়েছে। তার ওপরে ঝকঝকে চিনেমাটির প্লেট—খিচুড়ির আবির্ভাবের প্রতীক্ষায় সেজেগুজে বসে।

আহা! আমার জিভে জল এসে যায়। চাযের তেষ্টা তো ছিলই, তার ওপরে খিদেও পেয়েছিল বেশ।

এক প্লেট খিচুরি পেলে মন্দ হতো না। এই কথাটা স্বগতোক্তির নেপথ্যেই রেখে দি।

চায়ের কাপও রয়েছে দেখেছে!কল্পনা দেখিয়ে দ্যায়। তাবা মনে, চায়ের আয়োজনও হয়েছে ওদের বলতে গিয়েও মুখ ফুটে বলতে পারে না ও—মনের মধ্যেই চেপে রাখে। ওর জিভের খবর বলতে পারি না, তবে ওই কথাটাই ওব নখ চোখে উম্মুখর হয়ে—ভরপুর হয়ে উঠেছে, দেখতে পাই।

খবরের কাগজের ওপরে আরো কী কী যেন ছিল—আচার, আমসত্ত্ব, পাঁপড়, হানার মণ্ডা, মাখন এবং আরো কী কী সব-পাশ দিয়ে যাবার সময়ে, ঝুকে পড়ে, খুঁটিয়ে দেখবার আমি চেষ্টা করি—দেখেই যতটা সুখ। কল্পনা আমাকে এক হ্যাচকা লাগায়। চলে এসো! ছিঃ! ওকি? হ্যাংলা ভাববে যে!

অবশ্যি, দেখতে পায়নি। হেলে দুটি খিচুড়ি নিয়েই মত্ত। তাহলেও কল্পনাই ঠিক। পরের খিচুড়ি এবং ইত্যাদি—পরকীয় যা কিছু, চেখে দেখার আশা নেই তা শুধু শুধু চোখে দেখে লাভ? সুধা দেখলে কি আর ক্ষুধা মেটে?

পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ করে ফের আমরা রওনা দিই। কল্পনা আমাকে বকতে বকতে যায় তোমার ভারী পরের জিনিসে লোভ! বিচ্ছিরি! কেন, আমি—আমি তো একটুও লালায়িত হইনি।… সুরুৎ করে জিভের ঝোল টেনে নিয়ে সে জানিয়ে দেয়।

আমবাগানটা পেরুতে না পেরুতেই বিরাট এক চিৎকার এসে পৌঁছয়। আওয়াজটা আমাদের তাড়া করে আসে। আমরা দাঁড়াই, সেই হেলেদুটিই দৌড়তে দৌড়তে আসছে।

আপনাদের পিছু ডেকে বাধা দিলুম, কিছু মনে করবেন না। ওদের একজন কিন্তু-কিন্তু হয়ে বলে: দেখুন, আমরা ভারী মুস্কিলে পড়েছি—পিকনিকে সমস্ত আনা হয়েছে, কেবল চায়ের প্যাকেটটা আনতে ভুলে গেছি। অথচ, সব কিছু হলেও, চা ছাড়া কি পিকনিক জমে, বলুন তো?

অপর ছেলেটি শুরু করে পাশের জেলা থেকে বেড়াতে এসেছি—এখানকার দোকান হাট কোথায় কিছু জানিনে। কোথায় গেলে চা কিনতে পাওয়া যাবে, মুদিখানা কিম্বা মনোহরী দোকানটা কোন ধারে বলে দেবেন দয়া করে?

মুদিখান। এখান থেকে ঢের দূর। প্রায় একখানা গ্রাম জুড়েই একটা মুদিখানা। আমি বলিঃ কিন্তু তার দরকার কী, আমাদের সঙ্গেই এক প্যাকেট চা আছে—ইচ্ছে করলে নিতে পারো—স্বচ্ছন্দেই।

দেখেছিস! একটি ছেলে জ্বলজ্বলে চোখে আরেকটির দিকে তাকায়। একেই বলে বরাত—দেখলি তো। কী বলেছিলাম? ধন্যবাদ। আপনাদের কী বলে যে ধন্যবাদ দেব বলতে পারি না। তা—তা এর দাম কতো?

ও-না না। সে তোমাদের দিতে হবেনা।আমি হাত নেড়েকথাটা উড়িয়ে দিই—প্রায় মাছি তাড়ানোর মতই।

এবং এর পর—এর পর আর ওদের কী করবার ছিল? নিতান্তই যা ছিল তা না করে উপায় ছিল না। এবং পর পর অনিবার্যরূপেই মিনিট দশেক বাদে সবাই আমরা, সেই ভূপতিত খবরের কাগজকে ঘিরে খিচুড়ির চার পাশে জমায়েত হলাম।

মাখম-মাখানো আলু-সফুল গন্ধ-ভুরভুরে গরম গরম সেই খিচুড়ি, অমলেটের সাহায্যে কী তোফাই যে লাগলোতা আর বলবার নয়। তার সাথে মাঝে মাঝে চাটনি——পাঁপড়ের টুকরো—আচারের টাকরা—প্রভৃতিরা—আর অবশেষে, সবশেষে চা, আহা,–বলাই বাহুল্য।

 

সেদিন রাত্রে বাড়ি ফেরার পর কল্পনা বলল : বলতে গেলে হয়তো তুমি ছোটলোক বলবে! কিন্তু আমাদের চায়ের বাকীটা, সেই প্যাকেটটা, সঙ্গে নিয়ে আসা উচিত ছিল। প্রায় আধ-পোটাক চা–পাঁচ আনা দাম তো।

সংসারে ফিরে এলে উচ্চ নজরও তুচ্ছ খবরে নেমে আসে। সংসার এমনিই! তাছাড়া, তিল কুড়িয়েই তাল, তে কি। এবং যে সব তিলোত্তমাকে সেই তাল সামলাতে হয় তাঁরাই জানেন।।

পকেট থেকে বার করে বিনাবাক্যব্যয়ে চায়ের প্যাকেটটা ওর হাতে তুলে দিই।

কিন্তু এতো —আমাদের কেনা চায়ের প্যাকেট নয়। …একি? …য়্যাঁ? ১/৩ বিস্মিত, ১/৩ বিমুগ্ধ, ১/৩ বিরূপ দৃষ্টিতে আমার দিকে সে তাকায়।

এ ছাড়া—ভেবে দ্যাখো—ওদের পিকনিকে যেগ দেবার আর কোনো উপায় ছিল। আর তুমি—তুমিও চা চা করে যেমন চাতকের মত হয়ে উঠলে–কী করব?

কৈফিয়তের সুরে আমি বলি : আর তোমার জন্যে—বলো–কী না আমি করতে পারি?

সহধর্মিণীর জন্যে লোকে সহনীয় অধর্ম তো করেই, করে থাকেই, অসহনীয় ধর্মাচরণেও পেছপা হয় না—আমি আর এমন কী বেশি করেছি? দস্যু রত্নাকরের খুনসুরি থেকে শুরু করে তাজমহল স্রষ্টার প্রিয়তমার কর-ই রচনা—অহো। আগাগোড়া সব জড়িয়ে শেষ পর্যন্ত আমার নিজের জ্বাজ্বল্যমান উদাহরণে এসে পৌঁছব—জবাবদিহির এই সব পাচ মনে মনে ভাঁজছি, কল্পনা আমার চিন্তাশীলতায় বাধা দেয় : অবশ্যি, চায়ের জন্যে কী না করা যায়! তা ঠিক। কিন্তু তা বলে এতটা—এতদূর–কূটনৈতিক ভাষায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে অবশেষে ও স্পষ্টবাদী হয়ে পড়ে : য়্যাঁ? শেষটায় চুরি-চামারিও তুমি বাদ দিলে না। ছি ছি!

দ্যাখো, আর যাই বলো চুরি বলো না! ক্ষোভার্ত কণ্ঠে আমি বলি : চামারি বলতে পারো ইচ্ছা করলে।… কিন্তু যারা দুবেলা চা মারে তাদের আর চামার হতে বাকী কী?

হাতসাফাইটা করলে কখন শুনি? অবাক লাগছে আমার!

সেই যখন ঝুঁকে পড়ে খবরের কাগজের ওপরে সমবেত খাদ্য-তালিকাদের দেখছিলাম, সেই সময় ওদের এই চায়ের প্যাকেটটাকে অসহায় অবস্থায় পেয়ে—প্রথম দর্শনেই–

যাও যাও, আর বলতে হবে না। ছি ছি! কল্পনা কানে আঙুল দ্যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *