৬. উপসংহার

৬. উপসংহার

এই পুস্তিকায় কোন কথাটি বলা হলো না, কী কী ত্রুটি রয়ে গেল, ভাসাভাসাভাবে কী কী বলা হয়েছে যা ক্ষতিকর, কতটা অপ্রয়োজনীয় পুনরাবৃত্তি আছে— এসব নিয়ে আমি দীর্ঘদিন ধরে ভেবেছি এবং বারবার সংশোধন করেছি।

আমার শব্দগুলোর চেতনাকে উপলব্ধি করার মতো যথেষ্ট বোধশক্তির কোনো ন্যায়পরায়ণ পাঠক কিন্তু আমার এসব ত্রুটির কারণে নিরস্ত হবেন না। তিনি বরং তার বুদ্ধিমত্তা ও শক্তির সাহায্যে এমন একটি কাজে— যে কাজ আসলে কোনো মানুষের একার কাজ নয়— সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ হবেন এবং এর মানের উন্নয়ন ঘটাবেন।

আমি অনস্বীকার্য বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা করিনি কি? গুরুত্বপূর্ণ আপত্তিগুলোকে উপেক্ষা করেছি কি?

সুস্পষ্ট কিছু আপত্তি নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারপরও আমি জানি যে উচ্চ ও নীচ মনমানসিকতার জায়গা থেকে আরও অনেক আপত্তি ও অভিযোগ উঠবে।

প্রথম শ্রেণীর আপত্তির মধ্যে এই মন্তব্যটি রয়েছে যে ইহুদিরাই বিশ্বে একমাত্র দুর্দশাগ্রস্ত মানবগোষ্ঠী নয়। এ ক্ষেত্রে আমার জবাব হচ্ছে, আমরাও এই দুর্দশার কিছুটা দূর করে শুরুটা করতে পারি, প্রথমত যদি এই দুর্দশা আমাদের চেয়ে কারো বেশি না হয়।

এখানে আরও বলা যেতে পারে যে মানুষের মধ্যে নতুন কোনো বিভেদ সৃষ্টি করা আমাদের উচিত হবে না; আমাদের উচিত হবে না নতুন কোনো বাধার সৃষ্টি করা, বরং আমাদের উচিত হবে পুরোনো বিভেদ ও বাধা অপসারণ করা; কিন্তু যারা এভাবে ভাবেন তারা খুবই হৃদয়বান স্বপ্নদ্রষ্টা (ভিশনারি)। এবং তাদের হাড়ের গুঁড়োগুলো বাতাসে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরও জন্মভূমির ধারণা বিকশিত হবে না। সাৰ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ এমনকি একটি সুন্দর স্বপ্নও নয়। মানুষের মহত্তম প্রচেষ্টার বিরোধিতার প্রয়োজন আছে। ইহুদিরা একবার তাদের নিজস্ব রাষ্ট্রে থিতু হয়ে গেলে সম্ভবত তাদের আর কোনো শত্রু থাকবে না। যারা পিছিয়ে থাকবে, যেহেতু সমৃদ্ধি তাদের দুর্বল ও ক্ষীণ করে দেয়, তারা সবাই শিগগিরই একসাথে নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমি মনে করি ইহুদিদের সবসময়ই পর্যাপ্ত শত্রু থাকবে, যেমনটা সব জাতিরই আছে; কিন্তু একবার নিজেদের ভূমিতে স্থায়ী হয়ে গেলে তাদের পক্ষে আর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সম্ভব হবে না। পুরো পৃথিবীর সভ্যতা ভেঙে না পড়লে ইহুদিদের নানা দেশে বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে না; এবং এই ধরনের একটি পরিসমাপ্তির বিষয়ে নির্বোধ ছাড়া আর কেউ শঙ্কিত হবে না। আমাদের বর্তমান সভ্যতার আত্মরক্ষার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে।

যেহেতু বিশ্বে মহৎ মানুষের চেয়ে নীচ মানুষের সংখ্যাই বেশি সেহেতু নীচতার জায়গা থেকে অসংখ্য অভিযোগ-আপত্তি থাকবে। আমি নীচ মানসিকতার কিছু ধারণা দূর করার চেষ্টা করেছি। যারা আমাদের সাতটি তারকা খচিত সাদা পতাকার পেছনে হাঁটতে চাইবে তাদের অবশ্যই আলোকায়নের এই প্রচারণায় সহযোগিতা করতে হবে। সম্ভবত আমাদের প্রথম লড়াই করতে হবে আমাদের স্বগোত্রীয় দুষ্টু-প্রকৃতির, সংকীর্ণ-হৃদয় এবং অদূরদর্শী অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে।

অনেকেই আবার বলবে যে আমি ইহুদিবিদ্বেষীদের অস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করছি? কে তা বলবে? কারণ, আমি সত্য স্বীকার করছি। কারণ আমি মনে করি না যে, আমাদের মধ্যে শুধু চমৎকার সব মানুষই আছে।

লোকে কি বলবে না যে আমি শত্রুদের আমাদের আহত করার উপায় দেখাচ্ছি। এ ব্যাপারে আমার পুরোপুরি আপত্তি আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ইহুদিদের অবাধ সম্মতির মাধ্যমেই কেবল আমার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইহুদিদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ও গ্রুপের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হতে পারে, কিন্তু সরকার তাদের সবার বিরুদ্ধে কখনো পদক্ষেপ নেবে না। একবার স্বীকার করে নেওয়ার পর সব ইহুদির অধিকার সমানের যে আইনগত ধারণা তা প্রত্যাহার করা যাবে না। প্রত্যাহারের প্রথম পদক্ষেপেই সব ইহুদিকে, ধনী ও দরিদ্রদের সমানভাবে, বিপ্লবী দলগুলোর দিকে নিয়ে যাবে। ইহুদিদের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের দাপ্তরিক অন্যায় কার্যক্রম শুরুতেই অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে আসে। যে কারণে আমাদের বিরুদ্ধে কোনো অস্ত্রই কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ তাতে যে হাত ওই অস্ত্র ধরে থাকে সে হাতই আঘাতপ্রাপ্ত হবে। এ ছাড়া ঘৃণাও আরো দ্রুত বেড়ে যাবে। ধনীরা তা খুব একটা টের পায় না; কিন্তু দরিদ্ররা তা টের পায়। আসুন আমরা আমাদের দরিদ্রদের জিজ্ঞাসা করি, যারা ইহুদিবিদ্বেষের শেষ অপসারণের পর, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে, আরও মারাত্মকভাবে সর্বহারা হয়েছে।

আমাদের বিত্তশালীদের কেউ কেউ হয়তো বলবেন, অভিবাসনের ন্যায্যতা প্রমাণের মতো গুরুতর পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি এবং যেখান থেকে জোরপূর্বক উৎখাতের ঘটনা ঘটছে সেখানে দেখা যায় যে আমাদের লোকেরা ওই জায়গা ছেড়ে আসতে কতটা অনিচ্ছুক। কথা সত্য, কারণ তারা জানে না যে তারা কোথায় যাবে; কারণ তারা কেবল একটি বিপদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে আরেকটি বিপদে পড়ে। কিন্তু আমরা তাদের ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’র পথ দেখাচ্ছি; এবং উদ্দীপনার দুর্দান্ত শক্তিকে অভ্যাসের ভয়ানক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।

মধ্যযুগে নিপীড়ন যতটা প্রকট ছিল এখন তো তা ততটা মারাত্মক নয়, তাই না? সত্য, কিন্তু আমাদের সংবেদনশীলতা বেড়েছে, যে কারণে আমরা আমাদের এই ভোগান্তিকে কম মনে করি না; দীর্ঘস্থায়ী নিপীড়ন আমাদের মাত্রাতিরিক্ত স্নায়বিক চাপ তৈরি করেছে।

লোকেরা কি আবারও বলবে যে আমাদের এই উদ্যোগের কোনো আশা নেই, কারণ আমরা যদি আধিপত্য করার অধিকারসহও ভূমিটি পাই, তারপরও কেবল দরিদ্ররাই আমাদের সাথে যাবে? এই দরিদ্রতমদেরই আমাদের প্রথমে প্রয়োজন। বেপরোয়ারাই কেবল ভালো বিজয়ী হয়।

এবার কেউ কি একথা বলবেন যে এটা যদি সহজ হতো তাহলে তো তা অনেক আগেই হতো?

এটা এতদিনেও সম্ভব হয়নি; এখন তা সম্ভব। একশ কিংবা এমনকি ৫০ বছর আগেও এটা স্বপ্ন ছাড়া কিছুই ছিল না। আজ তা বাস্তব হয়ে উঠতে পারে। আমাদের প্রযুক্তিগত সব অর্জনের সঙ্গে আমাদের ধনীদের আনন্দঘন পরিচিতি আছে। তারা ভালো করেই জানেন টাকা কতটা করতে পারে এবং এটি হবে এভাবে- দরিদ্র ও সাধারণরা, যারা জানে না যে, প্রকৃতির ক্ষমতার ওপর মানুষ ইতিমধ্যেই কী ধরনের শক্তি প্রয়োগ করেছে, তাদের কেবল নতুন বার্তার ওপর দৃঢ় আস্থা থাকবে। তারা কখনোই ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’র ওপর আস্থা হারায়নি।

যা বললাম এটা হচ্ছে তাই। হে প্রিয় ইহুদি সহকর্মীরা, এটা কল্পকাহিনিও নয়, প্রতারণাও নয়! প্রতিটি মানুষ এর বাস্তবতাকে নিজের জন্য পরখ করে দেখতে পারে, কারণ প্রতিটি মানুষ তার নিজের সঙ্গে ‘প্ৰতিশ্ৰুত ভূমি’র একটি অংশ বহন করে চলবে— একটি অংশ থাকবে তার মাথায়, অন্য একটি অংশ থাকবে তার হাতে এবং আর একটি অংশ থাকবে তার অর্জিত সম্পত্তিতে।

এখন, এসব কিছুকে একটানা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার বলে মনে হতে পারে। এমনকি সবচেয়ে অনুকূল পরিস্থিতিতেও রাষ্ট্রের ভিত প্রতিষ্ঠার সূচনা করার আগে অনেক বছর কেটে যেতে পারে। এরই মধ্যে ইহুদিরা হাজারও জায়গায় অপমান, যন্ত্রণা, অপব্যবহার, আঘাত, অবনমন এবং মৃত্যুর শিকার হবে। না; আমরা যদি কেবল পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন শুরু করি, তবে ইহুদিবিদ্বেষ একবারে এবং চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ এটি শান্তির উপসংহার।

আমাদের ইহুদি কোম্পানি গঠনের খবর টেলিগ্রাফের তারের মাধ্যমে বিদ্যুতের গতিতে বিশ্বের প্রত্যন্ত প্রান্তে এক দিনেই পৌঁছে দেওয়া হবে।

এবং তাৎক্ষণিক স্বস্তি আসবে। আমাদের মধ্যবিত্তদের মধ্যে আমরা যে বুদ্ধিমত্তাগুলো বিপুল পরিমাণে উৎপাদন করি তা আমাদের প্রথম সংস্থাগুলোতে প্রযুক্তিবিদ, অফিসার, অধ্যাপক, কর্মকর্তা, আইনজীবী ও চিকিৎসক হিসেবে একটি জায়গা খুঁজে পাবে; এবং এভাবে আন্দোলন দ্রুত কিন্তু মসৃণভাবে এগিয়ে চলবে।

মন্দির ও গির্জাগুলোতেও আমাদের কাজের সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করা হবে; কারণ এতে করে যে দুর্ভোগ সবাই ভোগ করেছে সেই পুরোনো দুঃসহ ভার লাঘব হবে।

কিন্তু আমাদের প্রথমেই মানুষের মনকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে হবে। আমাদের মানুষেরা যে অত্যন্ত দূরবর্তী ও করুণ গর্তগুলোতে বাস করে ধারণাটিকে অবশ্যই সেখানে পৌঁছার পথ করে নিতে হবে। তারা গভীর বিষণ্নতা থেকে জেগে উঠবে, কারণ তাদের জীবনে একটি নতুন তাৎপর্য আসবে। প্রতিটি মানুষের কেবল নিজেকে নিয়ে চিন্তা করা দরকার এবং আন্দোলনটি বিশাল সুসঙ্গত অনুপাত গ্রহণ করবে।

যারা নিঃস্বার্থভাবে লড়াই করে তাদের জন্য কী গৌরব অপেক্ষা করে?

তাই আমি বিশ্বাস করি যে ইহুদিদের মধ্যে একটি বিস্ময়কর প্রজন্মের জন্ম হবে। ম্যাকাবিয়ানরা[৩২] আবার জেগে উঠবে।

[৩২ ম্যাকাবিয়ান: প্রাচীন ইহুদি নেতা ম্যাকাবিয়াসের অনুসারীরা। যারা সেলুসিডদের সময়ে যে ইহুদিরা বিদ্রোহ করে লড়াই করে জুদাইয়া বিজয় করে নিয়েছিল।]

আমাকে আর একবার আমার শুরুর কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করতে দিন, যে ইহুদিরা একটি রাষ্ট্র চায় তারা তা পাবে। আমরা শেষ পর্যন্ত আমাদের মাটিতে স্বাধীন মানুষ হিসেবে বাঁচব এবং আমাদের নিজের ঘরে শান্তিতে মরব।

আমাদের স্বাধীনতার মাধ্যমে বিশ্বও মুক্ত হবে, আমাদের সম্পদে সমৃদ্ধ হবে, আমাদের মহত্বের মাধ্যমে বিশ্ব আরও মহৎ ও বৃহৎ হবে।

এবং সেখানে আমরা আমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্য যা কিছু করার চেষ্টা করব তা শক্তিশালীভাবে ও উপকারীভাবে মানবতার মঙ্গলের কাজে আসবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *