৬. উপসংহার

উপসংহার

১ ভারতবর্ষের প্রাগিতিহাস সম্পর্কে কিছু মন্তব্য

এই ক্ষুদ্র পুস্তকে আমরা এতক্ষণ এক নাগাড়ে, প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে, তথ্য সাজিয়ে গেছি—যা আমরা জানি প্রাগৈতিহাসিক ভারতবর্ষ সম্পর্কে তার সংক্ষিপ্তসার। এই তথ্য সাজানো থেকে যদি কোনও জিনিস পরিষ্কার হয়ে থাকে তবে তা হচ্ছে ভারতবর্ষ নামক ভূখণ্ডে, উপমহাদেশে, মানবসংস্কৃতির, মানুষের বেঁচে থাকার ইতিহাসের ক্রম আবর্তন। এই ভূখণ্ডে মানুষের প্রথম পরিচয় কত পুরনো হতে পারে আমরা তার ইঙ্গিত পাই; আমরা এও দেখি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন পর্যায়ক্রমের ভেতর দিয়ে তার জীবনযাত্রার বিকাশ। পাথরের হাতিয়ারের বাইরে জীবনযাত্রার বিকাশ খুবই কম জানি, তবু পুরাপ্রস্তর যুগের শেষ পর্যায়ের যে ভারতবর্ষ তাকে আমাদের চেনা লাগে। পূর্বঘাট পর্বতমালার জঙ্গলে ছড়ানো উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার বিন্যাস দেখে বা এ-ধরনের হাতিয়ারের বিস্তৃতির ধরন দেখে মনে হয় যে, ওই অঞ্চলে তখনকার মানুষ যেভাবে খাদ্য আহরণ করত তাঁদের সেই জ্ঞান এখন যাঁরা খাদ্য আহরণ করেন ওই জমি থেকেই, তাঁদের ভেতর এখনও বেঁচে আছে। কর্নাটকের হুনস্‌গি উপত্যকায় নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের যে সমস্ত মানুষ ঘুরে বেড়াত খাদ্য সংগ্রহের তাগিদে—বর্ষায় দূরে দূরে চলে গিয়ে, আর শুকনোর সময় শুকিয়ে না যাওয়া জলের সংস্থাগুলির আশপাশে—তাদেরও আমাদের ঠিক অচেনা লাগে না। পশ্চিম রাজস্থানের মরুসদৃশ অঞ্চল জয়ালে পাথুরে পাহাড়ের ওপরে বসে সেই মানুষ পাথরের হাতিয়ার বানাত; শুকিয়ে আসা বহু প্রাচীন নদীতীরে—ঠিক তীরে না হোক, মজে আসা দহের পারে—খাদ্যসংগ্রহের খোঁজে ঘুরত এবং কখনও কখনও হাতিয়ার হাত থেকে জলে পড়ত—এটিও একটি মানবিক ছবি। প্রকৃতি নিশ্চয়ই কিছু পালটেছে সেই সুপ্রাচীন বা অতি প্রাচীন কাল থেকে—উদ্ভিজ্জ আবরণ তো যথেষ্ট কমেছে, মূল আবহাওয়া না পালটালেও। তবু, প্রকৃতি যে একেবারে ভোল বদলেছে তা নয়। মাঠে ঘুরতে ঘুরতে এটা অনেক সময়ই বোঝা যায়। সিংভূমে যাদুগোড়া আর রাখার মাঝে একটি অনুর্বর এবড়ো-খেবড়ো জায়গায় চোখে পড়েছিল যে, জমি থেকে বেরিয়ে আসা একটা পাথরে কেউ আর একটা পাথর দিয়ে মেরে চাকলা তুলেছিল—চাকলাটা কোনও কারণে ব্যবহার করেনি, ফেলে রেখে গেছে। যে পাথর থেকে ওটা আঘাত করে বের করেছিল সেই পাথরে আঘাতের দাগও রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল মানুষটি একটু আগেই এদিক দিয়ে চলে গেছে। যাঁরা পাথরের হাতিয়ার খোঁজ করে বেড়ান তাঁরা জানেন আমাদের চারপাশে অজস্র আছে। শুধু জানতে হবে, কোথায় ছড়িয়ে থাকতে পারে। তারপর, ঘোর লাগলে মনে হবে তারা নিজেরাই সামনে আসছে! বাঘোরে উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের ছোট বেদিতে বসানো মাতৃচিহ্ন হিসেবে বিশেষ পাথর এবং বর্তমানে ওই গ্রামাঞ্চলে একই ধরনের পাথর পুজো হওয়ার কথা আমরা বলেছি। উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগ যে আমাদের ভেতর থেকে হারিয়ে যায়নি, এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে? ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের পর্যায়ে এসে সাক্ষ্যের ব্যাপ্তি অনেক বাড়ে—শুধু খাদ্য আহরণ নয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে খাদ্য উৎপাদনেরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বাড়িঘরের অথবা অস্থায়ী আস্তানার ছবি একটু স্পষ্ট হয়—বাঘোরে এই ধরনের আস্তানার ভেতর দিয়ে শম্বর হরিণ হেঁটে যাওয়ার ছবিটা মনে রাখার মতো। এই পর্যায়েই অজস্র গুহাচিত্রের মাধ্যমে শুধু শিল্প চেতনা নয়, বেঁচে থাকার প্রচেষ্টাও চোখে পড়ে। বন্য ফলমূল, মধু আহরণ, মোটা ইঁদুর ধরা (খাবার জন্য), দল বেঁধে শিকার করা—যা দেখি, আবার বলতে হয়, আমাদের অপরিচিত নয়। ভারতবর্ষের সংস্কৃতির ভেতর, জীবনের ভেতর—খাদ্য সংগ্রহকারী একটা বড় ধারা আছে। যতদিন জঙ্গলে খাবার ছিল তখন জঙ্গলের অধিবাসীদের স্বাস্থ্য ভাল ছিল; বর্তমানে জঙ্গলে খাবার কম বা নেই। তাই আমাদের উপজাতীয়দের স্বাস্থ্যও এখন অপেক্ষাকৃত অনেক খারাপ। খাদ্য আহরণকারী এই ধারাটি আমাদের প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চলে আসছে।

প্রাগৈতিহাসিক চর্চা শুধু চোখে দেখে মাঠে খেটে হয় না—বিজ্ঞান লাগে। তারিখ, পরিবেশ, অনেক কিছুই বের করার চেষ্টা করতে হয়। এই চর্চায় বিজ্ঞানের প্রয়োগ এখনও আমাদের দেশে লজ্জাকরভাবে সীমিত; যতদিনে এটি সীমিত থাকবে না ততদিনে দেশে হয়তো প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া দুর্লভ হবে। কাজেই বিজ্ঞানের বাইরেও যতটুকু প্রাগিতিহাস চর্চা করা যায় আমাদের তাই করাই ভাল। খাদ্য আহরণের সমস্যা—মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রচেষ্টা—এই গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিতে পারে। যেসব অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন আছে সেসব অঞ্চলে জমি থেকে কী কী খাদ্য বছরের কোন কোন সময়ে কী কী ভাবে সংগৃহীত হয় তার খোঁজ করা ভাল। পশ্চিম দেশে, বর্তমানে ক্ষুধার সমস্যা না থাকার জন্য, প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনোজগৎ, ক্ষমতার জগৎ—এসব দিকে ঝুঁকেছেন। যেহেতু ভারতীয় জনজীবনে খুব বেশি সংখ্যার মানুষের কাছে ক্ষুধা একটি বড় সমস্যা তাই আমরা ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিকরা খাদ্যসংগ্রহ প্রচেষ্টাকে প্রাগিতিহাস চর্চা থেকে দূরে সরাতে পারি না। অন্তত, দূরে সরানো উচিত নয়।

প্রথমে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ কী করে খাদ্যসংগ্রহের সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন ও পশুপালনের দিকে এগোল, সেই সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের অল্পতার কথা যথাস্থানে বলেছি। তবে, একটি বিস্তৃত অঞ্চলের কথা স্পষ্ট, বালুচিস্তান থেকে হরিয়ানা, গুজরাট পর্যন্ত গম, যব, গবাদি পশু, ভেড়া, ছাগল নিয়ে যে কৃষিসংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, খ্রি. পূ. ৭০০০ অব্দ বা তার আগে থাকে, তার ছবি স্পষ্ট এবং সিন্ধু সভ্যতা তার ফল। অন্যত্র, সূত্রপাত হলেও, কেন খাদ্য উৎপাদনের ধারা জোরালো হতে সময় নিল, সে সম্বন্ধে আমরা শুধু অনুমানই করতে পারি। হয়তো জঙ্গলে, প্রকৃতিতে যথেষ্ট খাদ্যসম্ভার থাকায় এখানে উৎপাদনের তেমন প্রয়োজন অনুভূত হয়নি। এটা খুব অসঙ্গত ব্যাখ্যা নাও হতে পারে—পৃথিবীর অন্যত্রও এই ধরনের চিন্তা প্রত্নআত্ত্বিকরা করেছেন। আমাদের আরও ধারণা সিন্ধু সভ্যতা গড়ে ওঠার বেগবতী ধারা, সিন্ধু সভ্যতা এবং সিন্ধু সভ্যতার রূপান্তর ভারতবর্ষের অন্য অঞ্চলগুলির খাদ্য উৎপাদন ধারাকে অনেক জোরালো করে দিয়েছে। অথবা, যেখানে খাদ্য উৎপাদনের ধারা আদৌ ছিল না সেখানে খাদ্য উৎপাদনে উত্তরণ সম্ভব করেছে। যে-সব অঞ্চলের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ের অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক ভৌগোলিকভাবে সম্ভব, সে সব অঞ্চল সম্পর্কেই এই কথা বলা যায়।

সিন্ধু সভ্যতা ব্যাপারটি এখনও একটি বিস্ময়: এত বড় আয়তন, এত দীর্ঘ কালপরিধি, আঞ্চলিক কিছু তফাত সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক ঐক্যভাবই জোরালো হওয়া, নগর-পরিকল্পনা, কারিগরি শিল্প, অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিল্প ইত্যাদিতে উৎকর্ষ। তারপর একসময় আবার গ্রামীণ সংস্কৃতির ধারাতে রূপান্তরিত হয়ে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ধারাতে মিশে যাওয়া—এর বিস্ময় পদে পদে। তারপর, গুরুত্বপূর্ণ খননাদির ফল সুষ্ঠুভাবে প্রকাশিত না হওয়ার ফলে এই বিস্ময় বোধ কম হওয়ার কোনও কারণ দেখছি না। যথা, ২৪ জুন ১৯৯৭ তারিখের এশিয়ান এজ বলে একটি দৈনিক সংবাদপত্রে ‘খোলাবিরা রিভিল্‌স মোর অফ হরপ্পা’ শিরোনামে ধোলাবিরার খননকর্তার একটি বক্তৃতার বিবরণ আছে। সেই বিবরণে দেখছি, তিনি ধোলাবিরাতে ৭৯ মি. লম্বা (এখন পর্যন্ত যতটুকু দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা গেছে), ৭ মি. গভীর, পাথর কেটে বানানো একটি জলাধারের কথা বলেছেন। এই বিবরণটি এই পুস্তকে সিন্ধু সভ্যতার ওপর অধ্যায়টি লিখে ফেলার পরই দেখেছি এবং বিস্মিত হয়েছি, কারণ খননকর্তা তাঁর কোনও প্রকাশিত বিবরণে এই তথ্যটি জানানোর দরকার মনে করেননি। এখন কথা হচ্ছে যে, ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের লোকদেরই যদি পদে পদে এভাবে বিস্মিত হতে হয়, তবে যাঁরা বিষয়ের বাইরে, তাঁদের বিস্ময়ের কথা বলাই বাহুল্য।

আমাদের আলোচনা থেকে বোধ হয় বোঝা গেছে যে, সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেক পালটেছে। বাহাওয়ালপুরে চোলিস্তানে এর উৎপত্তি, প্রাচীন সরস্বতী প্রবাহের এই ব্যাপারে গুরুত্ব, এর সুদীর্ঘ কালক্ৰম, মহারাষ্ট্রে এবং মালব অধিত্যকাতে এর প্রভাব—এগুলি অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক গবেষণার ফল। সিন্ধু সভ্যতা আমাদের দূরের ব্যাপার নয়—আমরা বিভিন্নভাবে এর উত্তরসূরী— আমাদের এটা বোঝা প্রয়োজন। পরবর্তী ভারতবর্ষের গ্রামপ্রবাহ সেই প্রবাহের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের ভেতর এসেছে।

পরবর্তী যে গ্রামপ্রবাহের কথা বললাম, ভারতীয় কৃষিভিত্তিক জনজীবন বুঝতে তা কত প্রয়োজনীয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা এর দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। এই প্রবাহটি মিশেছে গিয়ে আমাদের ঐতিহাসিক পর্যায়ে, গঙ্গা উপত্যকার নব নাগরিকীকরণে। এই ঐতিহাসিক পর্যায়ের সম্পর্কে কিছু সাধারণ কথা ‘উপসংহার’ অংশে আমাদের বলা উচিত।

২ ঐতিহাসিক পর্যায়

গৌতম বুদ্ধ, বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যের ষোলোটি মহাজনপদ যারা সব মিলিয়ে উত্তর-পশ্চিম ও আফগানিস্তানে হিন্দুকুশের দক্ষিণ থেকে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত ছড়ানো, এ-সব নিয়ে আমাদের যে ঐতিহাসিক যুগ, তা শুরু হল কবে? মৌর্য সম্রাট অশোক যে লিপিতে তাঁর বাণী লিখিয়েছিলেন সেই ব্রাহ্মী লিপি, মুদ্রা, নগর—এদেরই বা সুত্রপাত কবে? আর, পুরো উপমহাদেশে এই ঐতিহাসিক পর্যায়ের সূত্রপাতের কি একই সময়, না কিছু বৈষম্য আছে?

প্রত্নতত্ত্বের দিক থেকে উত্তর দুরূহ নয়। ‘এন বি পি’ পর্যায়ে গাঙ্গেয় উপত্যকায় ঐতিহাসিক পর্যায় শুরু হয়েছিল। মসৃণ ও উজ্জ্বল কৃষ্ণলেপযুক্ত এই মৃৎপাত্রটি ছাড়া এই পর্যায়ে অন্য, সহজে চেনা যায় এমন মৃৎপাত্র গোষ্ঠীও ছিল; তা ছাড়া ছিল মুদ্রা। তারিখ সব জায়গায় এক নয়, তবে খ্রি. পূ. সপ্তম-ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রি. পূ. দ্বিতীয় শতক; সোজা ভাবে ৬০০/৭০০—২০০ খ্রি. পূ.। স্তরটির শেষের দিকে বা উপরের দিকে লিপি উৎকীর্ণ সামগ্রীও পাওয়া যায়। লিপির ব্যবহার প্রথম কবে? সিন্ধু লিপি থেকে ব্রাহ্মী লিপি উদ্ভব হয়েছে এটা অনেক পণ্ডিতই বলেছেন। সিলমোহর ইত্যাদি প্রায় চিরস্থায়ী বস্তুতে উৎকীর্ণ না থাকলেই যে লিপি প্রচলিত থাকবে না এটা বোধ হয় ঠিক নয়। বিশেষত ভারতবর্ষে, যেখানে ঊনবিংশ শতকের শেষভাগেও সরকারি কাজে পর্যন্ত তালপাতার ব্যবহার ছিল। কাজেই, সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের পর থেকে খ্রি. পূ. তৃতীয় শতক (অশোকের শিলালিপি) পর্যন্ত লিপির ধারা, পরিবর্তিত/ রূপান্তরিত হলেও, অক্ষুণ্ণ থাকতে পারে। তবে খ্রি. পূ. তৃতীয় শতকের আগে গাঙ্গেয় উপত্যকায় লিপি ছিল না এটা অবান্তর কথা হওয়াই স্বাভাবিক। অন্য সব কিছু যুক্তি বাদ দিলেও, পাণিনির কথা বাদ দেওয়া যায় না। খ্রি. পূ. পঞ্চম শতাব্দীতে পাণিনি তাঁর ব্যাকরণ লিখেছিলেন লিপি প্রচলনের আগে এটা অন্ধ মূর্খ ছাড়া কারও বলা সাজে না। পাণিনির তারিখ শ’খানেক বৎসর কমিয়ে দিলেও লিপির অশোক-পূর্ব অস্তিত্বের কথা প্রমাণ হয়। এ ছাড়া, অপেক্ষাকৃত সম্প্রতি, শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুর নামক প্রাচীন নগরে খনন করে খ্রি. পূ. প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি ব্রাহ্মী লিপি পাওয়া গেছে। এর আর একটি সোজা অর্থ হচ্ছে যে, দক্ষিণ ভারতের অনেক জায়গায় যে প্রাচীন ব্রাহ্মী লিপি পাওয়া গেছে সেগুলিও অনুরাধাপুরের উদাহরণের সমসাময়িক। এখানে বলা ভাল যে, মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি, গোরখপুরের কাছে সোহগৌরাতে প্রাপ্ত একটি উৎকীর্ণ তাম্র ফলক এবং এরকম দু-চারটি উদাহরণ সম্পর্কে আগে পণ্ডিতদের ধারণা ছিল যে তারা অশোক-পূর্ব কালের। অপেক্ষাকৃত সম্প্রতি অন্য পণ্ডিতেরা এই ধারণা থেকে সত্যি বলতে, বিনা কারণেই বিরত হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে জানাই, লিপিতত্ত্ববিদ অর্থাৎ, খোদাই করা অক্ষরের প্রকারভেদ দেখে যাঁরা লিপিমালার ক্রমবিবর্তন এবং তারিখ ঠিক করেন তাঁদের চর্চাতেও অনেক সময় যুক্তি কম, ব্যক্তিগত মত বেশি! আর, অক্ষরের আঁকড়া, মাত্রা ইত্যাদি দেখে লিপির মূল পর্যায় ঠিক করা যায় নিঃসন্দেহে, তবে ৫০/১০০ বছরের ভেতর তারিখ ঠিক করা যায় এটা খুব আশাবাদী দাবি। কাজেই, মহাস্থানগড়, সোহগৌরা ইত্যাদি স্থানের লিপির উদাহরণ অশোক-পূর্ব কালের স্বচ্ছন্দে হতে পারে।

মুদ্রার প্রচলনটা সে তুলনায় অনেক পরিষ্কার। কয়েকটি জায়গাতেই ‘এন বি পি’ স্তরের নীচের দিকে মুদ্রা পাওয়া গেছে। খ্রি. পূ. ষষ্ঠ-সপ্তম শতক না হওয়ার কারণ নেই। ভারতবর্ষের এই মুদ্রা সাধারণভাবে দ্বিবিধ—ঢালাই করা তামার ছোট টুকরো। (‘কাস্‌ট কপার’) এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রূপার বিভিন্ন চিহ্নের দাগ দেওয়া ছোট ছোট খণ্ড। ‘পাঞ্চড মার্ক’ মুদ্রা। এগুলি ভারতবর্ষের নিজস্ব এবং এদের সঙ্গে সমসাময়িক মধ্য এবং পশ্চিম এশিয়ার মুদ্রার কোনও মিল নেই।

এ ছাড়া ঐতিহাসিক যুগের প্রথম পর্যায়ে নগর গড়ে ওঠার কথা আছে। এই নগর গড়ে ওঠা প্রথম দেখা যায় পূর্বে চম্পা নগরী (বর্তমান ভাগলপুরের উপকণ্ঠ) ও পশ্চিমে, প্রাচীন বারাণসী (বর্তমান বারাণসীর গঙ্গাতীরে রাজঘাট অংশে) হয়ে মালব অধিত্যকার উজ্জয়িনী পর্যন্ত। এদের চোখে পড়ার মতো প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ব্যাপক প্রাকার ও পরিখা নির্মাণ। এটা কত বিস্ময়কর হতে পারে তা চম্পার ও কৌশাম্বীর ধ্বংসস্তুপ দেখলে বোঝা যায়। গঙ্গা তীরে, বর্তমান ভাগলপুরের নাথনগরে, মহাশয় দেউড়ির সামনে অনেকখানি জায়গা প্রায় ৬০ ফুট বা বেশি উঁচু করে সমতল করা হয়েছে। এটাকে প্রাকার ও বুরুজ দিয়ে শক্তিশালী করা হয়েছে। নীচে, চারপাশে পরিখা। এই দুর্গের ওপর থেকে গঙ্গাবক্ষে নিশ্চয় বহু দূর পর্যন্ত দৃষ্টি যেত। এই দুর্গের পাদদেশে, গঙ্গাতীর পর্যন্ত, একদিকে মহাশয় দেউড়ি এবং অন্যদিকে চম্পা নালার ওপর একটি পুল পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত সরু এবং ফালি জমিতে সাধারণ মানুষের শহর। চম্পার মাত্র সূচ পরিমাণ ভূমি খোঁড়া হয়েছে; বাকি অন্ধকারের ভেতর। কৌশাম্বী যমুনার তীরে, একটি সোজা বাঁকের মুখে, দুর্গপ্রাকার, বুরুজ, ব্যাপ্তি এখনও সম্ভ্রম জাগায়। যা খোঁড়া হয়েছে তা অকিঞ্চিৎকর, আর যা পাওয়া গেছে তাও খননকারী প্রত্নতাত্ত্বিকের মৃত্যুর পর, বিভিন্ন অপ্রীতিকর বিবাদে জর্জরিত। সব মিলিয়ে এই সময়ে নগর পত্তন হচ্ছে বুঝতে পারি, বিশদ বিবরণ যে জানি তা নয়।

খ্রি. পূ. ষষ্ঠ শতক নাগাদই নগর পত্তনের ঢেউ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পর্যন্ত পৌঁছয়, গাঙ্গেয় উপত্যকা বেয়ে। পারস্যের ফার্স প্রদেশের পার্সিপোলিসের ‘আকামেনিড’ রাজারা খ্রি. পূ. ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয় ভাগে সিন্ধু উপত্যকা পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেন এবং তক্ষশিলা নগরীর গোড়াপত্তন হয় তখন। যদিও তক্ষশিলাতে আরও পুরনো, প্রাগৈতিহাসিক পর্যায়ের বসতি থাকতে পারে।

ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহাসিককালের নগরপত্তন আরও দুটি পর্যায়ে এগোয়। একটি খ্রি. পূ. তৃতীয় শতকে মৌর্যদের নেতৃত্বে মগধের ক্ষমতা বিস্তারের পর্ব। দ্বিতীয় শতকে উত্তরভারতে কুষাণ এবং দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন ইত্যাদিদের ক্ষমতার সময়। পশ্চিমবঙ্গে খ্রি. পূ. তৃতীয় শতকের পর থেকে সাক্ষ্য স্পষ্ট। দক্ষিণ ভারতেও মোটামুটি এই সময় অথবা কিছু আগে থেকে শুরু। সব অঞ্চলের কথা না বলেও পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটি দেওয়া যেতে পারে। ভাগিরথীর পূর্বপারে যা পাওয়া গেছে তা একেবারে অববাহিকা অঞ্চলে; কলকাতার নীচ থেকে আদি গঙ্গার প্রবাহ ধরে সাগরদ্বীপ পর্যন্ত। এর পূর্ব দিকে বিদ্যাধরীর পুরনো কোনও প্রবাহ ধরে নগরের অস্তিত্ব আছে। এর বাইরে পশ্চিম দিকে রূপনারায়ণ পারের তমলুক বা প্রাচীন তাম্রলিপ্তের কথা আমরা সবাই জানি। আরও পশ্চিমে মেদিনীপুরের উপকূল ধরে কাঁথির আগে বাহিরী। রাঢ় অঞ্চলে মুর্শিদাবাদে কেন সমসাময়িক নগরী নেই জানি না, থাকা উচিত। তবে বর্ধমানে ঢুকেই আছে—মঙ্গলকোট। বীরভূমে ময়ূরাক্ষীর ওপর কোটাসুর। বাঁকুড়াতে দামোদরতটে পখন্না বা পোখরনা। তারপর, বিষ্ণুপুরের কাছে ডিহর। উত্তরবঙ্গে বাণগড়, বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের মহাস্থানগড়ের সঙ্গে যুক্ত। আরও পূর্বে নরসিংদির কাছে ওয়ারী-বটেশ্বর।

খ্রি. পূ. তৃতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় দশম-দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ (এবং বাংলাদেশেরও) অঞ্চলের নাগরিক সমৃদ্ধি ভারতবর্ষের অন্য বহু অঞ্চলের তুলনায় বেশি। বিদ্যাধরী প্রবাহের কাছে বর্তমান চন্দ্রকেতুগড়ের মতো সমৃদ্ধ প্রাচীন নগরী যে কোনও জায়গাতেই বিরল। এখানে অতি সীমিত যতটুকু অনুসন্ধান হয়েছে তারও যে বিবরণ বেরোয়নি—সেটা অন্য কথা। আদি গঙ্গা ধরে অন্তত ১০টি নগরকেন্দ্রের কথা ভাবা যেতে পারে; গত ৩০ বছরে হরিনারায়ণপুর নামে ডায়মণ্ডহারবারের দক্ষিণে একটি কেন্দ্র পুরো হুগলি নদীতে কেটে গেছে। খননের সুযোগ ছিল, হয়নি। তমলুকে খনন হয়নি বলা যাবে না, তবে তা যৎকিঞ্চিৎ। অন্যগুলি সম্পর্কেও একই কথা। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য; রোমক পৃথিবীর সঙ্গে বাণিজ্য—দুটিরই বড় কেন্দ্র ছিল বঙ্গ উপকূল। উপকথার ‘সপ্তডিঙ্গা’ সাজানোটা ঐতিহাসিক বাস্তবে গভীর প্রোথিত।

প্রাচীন ভারতের ঐতিহাসিক যুগের কথা, প্রথমদিকের নগরপত্তন ইত্যাদির কথা আলোচনা করতে গেলে আমাদের জানা দরকার যে, এই সময় সম্পর্কে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য অতি সীমিত। উদাহরণস্বরূপ মগধের দুটি প্রাচীন রাজধানীর কথা যদি ধরি অর্থাৎ রাজগৃহ ও পাটলিপুত্রের কথা, তা হলে দেখব যে রাজগৃহের বেশির ভাগ সমস্যা সম্পর্কেই আমাদের উত্তর নেই। আর রাজগৃহ শহরের প্রায় কিছুই খোঁড়া হয়নি। রাজগৃহে অন্তত সুদীর্ঘকাল খননকার্য চলতে পারে, পুরো প্রাচীন শহরটাই অখোদিত অবস্থায় আছে। পুরনো পাটলিপুত্র আধুনিক ‘পাটনা সিটি’র নীচে; প্রত্নতত্ত্ব না জানলেও বোঝা যায় ‘পাটনা সিটি’ অর্থাৎ পুরনো পাটনার অনেকটা একটি বড় ঢিবির ওপর। পাটনাতে কুমরাহার বুলান্দিবাগে যা খনন হয়েছে সে সম্পর্কে বলা দরকার বুলান্দিবাগ প্রাচীন শহরের সীমানায়, আর, কুমরাহার শহরের বাইরে।

আর একটি কথা। আমাদের প্রাচীন নগরগুলি যে-সব প্রাসাদে মণ্ডিত ছিল, সেগুলি সব প্রকার ঘেরা বিশাল জায়গা তা নয়। ছোট নগরীর সংখ্যাও কম নয়, তবে তার হিসেবনিকেশ হয়নি; ধরা যাক, কপিলাবস্তু নগরী—কয়েক একরের বেশি নয়; প্রকার নেই। মাটির ঘর, অল্প কিছু পাকা ইটের ঘর নিয়ে। চারিদিকে দিগন্তবিস্তৃত ক্ষেত নিয়ে দাঁড়ানো একটি বসতি। বুদ্ধের বাবার রাজধানী ছিল—রাজা যে খুব বড় ছিলেন শহর দেখে একেবারেই মনে হয় না। অদূরে মহারাজগঞ্জের জেলাসীমানায় একটি স্তূপ নিয়ে একটি ছোট বসতিকে স্থানীয় লোক বলেন ‘বুদ্ধের নানিহাল’ অর্থাৎ বুদ্ধের মার বাড়ি। বুদ্ধের একটি মামাবাড়ি নিশ্চয় থাকতে পারে; সেটা কথা নয়; কথা হচ্ছে প্রাচীন শহর সম্পর্কে আমাদের সাহিত্যভিত্তিক ধারণা ও প্রত্নতাত্ত্বিক বাস্তব এবং জ্ঞান দুয়ে অনেক তফাত থাকতে পারে। না জানার পরিমাণটা ভাবলে অনেক সময় স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। কপিলাবস্তু পেরিয়ে, লুম্বিনী পেরিয়ে, কিছু দূরে তিলৌরাকোট নগরী—প্রাকার ঘেরা, বড়, সামনে পাহাড়ি বানগঙ্গা নদীর বালু দেখা যায়। নদীর পর শিবালিক শ্রেণীর পাহাড়— নিঃসন্দেহে মৌর্যদের একটি শাসন কেন্দ্র। শ্রাবস্তীর রাজপুরুষের শাসনের নীচে, শ্রাবস্তীর সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তাটি আধুনিক রাস্তার থেকে বোধ হয় বিশেষ তফাত নয়। অথচ, ভেবে দেখলে, সামান্য একটু খোঁড়া ছাড়া কেন্দ্রটি তো না-খোঁড়াই হয়ে পড়ে আছে। অথচ, মৌর্যযুগ সম্পর্কে আমরা কতই না কথা বলি; মৌর্যদের রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা কতটুকু কেন্দ্রায়িত ছিল বিচার করতে চাই: সাহেবসুবোর তত্ত্বকথার সঙ্গে মিলিয়ে নিজেদের পাণ্ডিত্যে নিজেরাই বিগলিত হই। এটা কোন ধরনের ইতিহাস চর্চা? প্রাগিতিহাসের কথা বাদই দিলাম, কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস সংক্রান্ত প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায়ও এত অনীহা কেন?

৩ আধুনিক ভারতে প্রাচীন ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব চর্চা ইত্যাদি প্রসঙ্গ

আধুনিক ভারতে ‘প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব’ বিভাগ খুলতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কার্পণ্য করেছেন এটা বলা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গ সীমানার ভেতরই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই জাতীয় বিভাগ আছে। একটিতে আবার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আলাদা করা। অন্যত্র, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই এই জাতীয় বিভাগ প্রাচীন ইতিহাস চর্চার জন্য নেই। সেখানে সাধারণত ইতিহাস বিভাগেই একটি বা দুটি পেপার ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস/প্রত্নতত্ত্ব পড়ানো হয়। প্রত্নতত্ত্বের কথায় পরে আসছি। প্রাচীন ইতিহাসের চর্চাটি ভালভাবে না চলার কিছু কারণ আছে। প্রথমত, হচ্ছে, কার্যক্ষেত্রে ভারতীয় কর্মদাতাদের চক্ষে, এর অনুপযোগিতা; ইংরেজির এম এ আর প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের এম এ’র ভেতর আমাদের চাকুরি স্থলে তফাত করা হয়; কেন করা হয় তা অন্য প্রশ্ন, তবে করা হয়। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস চর্চাকে আমরা সামাজিক বা শিক্ষাগত ভাবে গুরুত্ব (তুলনামূলক ভাবে) দিই না। যেখানে শিক্ষকতা/অধ্যাপনা এসব চাকুরির প্রশ্ন আসে সেখানেও প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে শিক্ষিতের দরজা খোলা নয়। অনেক জায়গাতেই বি এ পড়ানো কলেজে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস বিষয় হিসাবে পড়ানো হয় না। সেক্ষেত্রে ইতিহাসের অধ্যাপক নিয়োগে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের এম এ-দের স্থান পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়। স্কুলের অবস্থাও বোধ হয় এই দিক দিয়ে খুব ভাল নয়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কালে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস চর্চা নিয়ে কিছু গৌরব বোধ ছিল। এই চর্চার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বড় বড় ঐতিহাসিক তখন হয়েছেন। ইংরেজ রাজত্বে আমাদের যে অবস্থা, প্রাচীন ভারতে তা ছিল না—গণতন্ত্র ছিল, স্পিকারের গদা ছিল, সব ছিল। খুব যে একটা আতিশয্য হয়েছিল তা নয়; প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে কৌতূহল বোধ ছিল; উপাদান সংগ্রহে, চর্চায় পরিশ্রম ছিল। রাজারাজড়ার কাঠামো তৈরি করা হয়েছে; সামাজিক, অর্থনৈতিক ইতিহাস, শিল্পের ইতিহাস, স্থাপত্যের ইতিহাস, প্রাচীন মুদ্রা, লিপি, ধর্ম—সব ব্যাপারে উৎসাহ ছিল। দেশের ঐতিহ্যের সম্মানের জন্যে ঔপনিবেশিক পশ্চিমি পণ্ডিতদের সঙ্গে তর্ক ছিল। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে ইতিহাস চর্চায় নতুন শ্রেণীর উদ্ভব হল; চর্চার সঙ্গে রাজনীতির চর্চা বাড়ল। প্রাচীন ইতিহাসের ক্ষেত্রে, আমাদের নতুন শাসক শ্রেণীর যাঁরা প্রতিভূ হলেন ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে, তাঁদের কাছ থেকে আমরা শুনতে লাগলাম। যে প্রাচীন ভারতের কোনও কিছু প্রশংসা করা যাবে না। ধর্মনিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হবে— প্রাক্-স্বাধীনতা যুগের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক ও সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমি ঐতিহাসিক সব আমাদের কাছে এখন এক পর্যায়ের। শাসকশ্রেণীর রাজনীতিকদের আনুকূল্যে, সরকারি দানে অথবা সরকারি দানে তৈরি করা সংস্থাগুলির দানে পুষ্ট ও ক্ষমতাশালী, গোষ্ঠীস্বার্থের বাইরে কিছু দেখতে অক্ষম, ঐতিহাসিকেরা যখন সবিস্তারে ভারতের অন্য ঐতিহাসিকদের চিন্তা নিয়ন্ত্রণে অগ্রসর হলেন, তখন প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস চিন্তাতে নৈরাজ্যের সময় এল। আমরা সমাজ ও অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে কিছু অনুমান দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও কিছু করতে পরান্মুখ হলাম। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের মূল তথ্য যাঁরা যাচাই করতে পারবেন—অর্থাৎ প্রাচীন মুদ্রা, শিলালিপি, গ্রন্থ ইত্যাদি যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে অনুসন্ধান করতে পারবেন এমন গবেষকের সংখ্যাও শীঘ্র কমে গেল।

অথচ এই সময়েই আমরা দেশের প্রাচীন ইতিহাস খোঁজার জন্য নতুন মাধ্যম সংযোজন করতে পারতাম। এই নতুন মাধ্যম সংযোজনের যথেষ্ট প্রয়োজন এই জন্য যে, আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের যা লিখিত তথ্য তার ভিত্তিতে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যায় না। যাঁদের কাছে এটা আপত্তিজনক মনে হবে তাঁদের কাছে দু’-একটা কথা নিবেদন করি।

প্রথম কথা, স্থান কাল পাত্র না থাকলে ইতিহাস হয় না। আমাদের লিখিত উপাদানে প্রাচীন যুগের স্থান কাল পাত্র সম্পর্কে তথ্য বিশেষভাবে কম। ‘এটা বেশ ছিল’, ‘আমাদেরও যথেষ্ট ইতিহাস বোধ ছিল’—এ সমস্ত নিতান্ত তর্কের কথা। আমরা যাকে বৈদিক যুগ বলি—একটি সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক যুগ বলে ভাবি— ঘোড়ায় চড়া পশুপালক আর্যরা ধীরে ধীরে পদ্মাসনে উপবিষ্ট জটামুকুটে সত্যদ্রষ্টাতে রূপান্তরিত হল, রাজা ও রাজত্বের সৃষ্টি হল—এসব ভাবি। বৈদিক সাহিত্যের ভিত্তিতে এরকম একটি যুগ সত্যই কল্পনা করা যায় কি না, আমরা কখনও বিশেষ ভেবে দেখেছি কী? এই সাহিত্যের কোনও সঠিক তারিখ আছে? নেই। এই সাহিত্যের কোনও বিশেষ গ্রন্থ, যেমন ঋগ্‌বেদ, তার বিভিন্ন মণ্ডলের কোনও সর্বজনস্বীকৃত স্তরবিভাগ আছে? নেই। ঋগ্‌বেদে যে স্তোত্র আছে তার ভেতর থেকে যে সমস্ত শব্দের যে ভাবে অর্থ করা হয়েছে তার সম্পর্কে সর্বজনস্বীকৃত মত আছে? নেই। একই শব্দের যে বিভিন্ন ভাবে অর্থ করা হয়েছে—এটা আমরা জানি। এ ছাড়া, এই সমস্ত সাহিত্য কোনও বিশেষ সময়ের ধারণা ধরে আছে —এটাই বা কে বলল? ‘বৈদিক যুগ’ বললে, সত্যি বলতে, কোনও কিছুই বোঝায় না। যাকে বৈদিক যুগ বলে মনে করা হয়, অথবা চালানো হয়, তা, আলাদা আলাদা কিছু গ্রন্থের (যে সমস্ত গ্রন্থের আলাদা আলাদা পাতা আলাদা আলাদা সময়ের হতে পারে!) কিছু শব্দের অনেক ক্ষেত্রেই মন গড়া ব্যাখ্যা এবং পরে, এই ধরনের ব্যাখ্যাসমষ্টিকে খেয়ালখুশি মতো ঐতিহাসিক কালের একটি বিশেষ পর্যায়ে ঢুকিয়ে দেওয়া। বৈদিক সাহিত্য ভারতীয় হিন্দুদের ধর্মের, ঐতিহ্যের, দর্শনের, সাহিত্যের উৎস হতে পারে—এই সমস্ত চর্চার দিক থেকে পণ্ডিতেরা এর আলোচনা করবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা দিয়ে ইতিহাস হয় না। এর সন তারিখ, ভূগোল, শব্দের অর্থ কিছুই যে ঠিক নেই এটা বুঝতে ভারতীয় বিদ্যাভবনের প্রকাশিত ইতিহাস-গ্রন্থমালার প্রথম খণ্ডটির আলোচনা পড়াই যথেষ্ট। যে কোনও তথ্যনিষ্ঠ সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস পড়লেও চলে। অথচ, এসব গ্রন্থেই এই সাহিত্যকে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক যুগের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এটা কেন?

কারণ স্পষ্ট নয়। কোনও বিশ্বাস যখন অনেক দিন ধরে জন্মায়, এই সম্পর্কে যখন বহু পণ্ডিত এক হয়ে কথা বলেন, তখন সেই বিশ্বাসের বিপক্ষে কথা বলা অনেক সময়ই অসম্ভব হয়। এটাও সেরকম। তা ছাড়া, এর পেছনে আর্য-অনার্য ব্যাপারটা আছে। আর্য-অনার্য ব্যাপারটি সেই সময়ের ফল যখন ইংরেজীতে যাকে ‘রেস’ বলা হয় তার পূর্ণ স্বীকৃতি ছিল। এর সঙ্গে আর একটি ধারণার স্বীকৃতি ছিল। ‘রেস’ এর সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতিকে মিলিয়েই আমাদের ইতিহাস বুঝতে হবে। এই ‘রেস’ এর ধারণা এবং ‘রেস’, ভাষা ও সংস্কৃতি মিলিয়ে প্রাচীন ইতিহাস চর্চার যে কাঠামো— এটার পেছনে যে পাণ্ডিত্যের জগৎ তার বিশদ বিশ্লেষণের স্থান এই পুস্তক নয়। এর পেছনে একটি বহুদিনের বর্ণবিদ্বেষী জগৎ আছে—এবং ভারতীয় পণ্ডিতেরাও ঔপনিবেশিক ও বর্ণবিদ্বেষী এই জগতের বাসিন্দা। পৃথিবীতে খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতক থেকে বিংশ শতকের অন্তত মাঝামাঝি পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন ভাবে মানবজাতিকে তার দৈহিক কিছু তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্নভাবে ভাগ করা হয়েছে এবং তার সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাষা ও ভাষা গোষ্ঠীকে মেলানো হয়েছে। এই শ্রেণী বিভাগের ভেতর উচ্চবর্গের ও নিম্নবর্গের রেস-ভাষা-সংস্কৃতি গোষ্ঠীর প্রভেদ খুব পরিষ্কার। উচ্চবর্গের গোষ্ঠী নিম্নবর্গের গোষ্ঠীর ওপর প্রভুত্ব করার এটা খুব স্বাভাবিক কথা। পৃথিবীতে নিরঙ্কুশ ইউরোপীয় প্রভুত্বের দিনগুলিতে এই চিন্তাই বৈজ্ঞানিক চিন্তা বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে এই চিন্তা প্রবলভাবে শুরু হয় খ্রিস্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে। ভারতীয় জনগোষ্ঠীর খুলি এবং নাকের, চুলের, ত্বকের নমুনা পর্যালোচনা করে যে ‘বৈজ্ঞানিক জনকাঠামো’ তৈরি করা হয়েছিল তার সঙ্গে সত্বর ভাষার কাল্পনিক ইতিহাস এবং সংস্কৃতি জুড়ে দেওয়া হল। ভাষার ইতিহাস যখন লিখিত উপাদান অর্থাৎ প্রত্যক্ষ উপাদানের বাইরে হয়, অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক বা প্রাক্‌-লিখিত পর্যায়ের হয়, তখন তাকে ‘কাল্পনিক’ বলাই উচিত। ধরুন, দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর কোনও লিখিত সাক্ষ্য নেই খ্রি. পূ. তৃতীয়-প্রথম শতকের আগে (‘সংগম যুগের সাহিত্য’) —কেউ কেউ এটাকে আরও পরেরও বলেন—অথচ, একটি বড় পণ্ডিতগোষ্ঠী তো এই ভাষার সঙ্গে অনেক কিছুই প্রাগৈতিহাসিক মিলিয়েছেন! সবটাই পণ্ডিতদের নিজস্ব এবং সমষ্টিগত বিশ্বাস এবং স্বার্থের ব্যাপার— প্রত্যক্ষ উপাদান বলতে কিছু নেই। এই ধরনের বিশ্বাস নিয়ে ইতিহাস চর্চা হয় কী?

হওয়া উচিত নয়, অথচ হয়েছে এবং হচ্ছে। অন্য অঞ্চলের কথা বাদ দিলাম, কিন্তু ভারতবর্ষে এই ধরনের ইতিহাস চর্চার প্রাবল্য হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে, এবং তার আগে থেকে, ‘আমরা আর্যজাতির উত্তরাধিকারী’ এই ধারণা থেকে। রমেশ চন্দ্র দত্ত থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত ভারতীয় ঐতিহাসিকরা এই ধারণার বশবর্তী হয়ে লিখেছেন। আর্য জাতির আগমন আমাদের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ—এঁদের সংস্কৃতির সঙ্গে অনার্য জাতিবর্গের সংস্কৃতির সংমিশ্রণে ভারতীয় সংস্কৃতির সৃষ্টি, এটি আমাদের কাছে অতি সত্য কথা। আর্য জাতির ধারণা কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল, পেছনে কী রাজনৈতিক স্বার্থ ছিল—এসব নিয়ে গবেষণা হয়েছে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক ধারণাটি ছিল তা হচ্ছে ইংরেজ ও ভারতীয় উচ্চ বর্গের জনগোষ্ঠীর দুই-ই আর্য পরিবারের; সেদিক থেকে ইংরেজ এবং ভারতীয়ের পারস্পরিক মিলন বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া পারিবারিক সদস্যদের মিলনের মতো। দ্বিতীয়ত, একদা আর্যজাতির আগমন ভারতীয় ইতিহাসে যেমন বিপুল মাঙ্গলিক পরিবর্তন এনেছিল, তেমনি ইংরেজ জাতির আগমনও সেই পর্যায়েরই মাঙ্গলিক পরিবর্তন সূচনা করছে। এই প্রসঙ্গ নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা হয়েছে; আরও আলোচনার অপেক্ষা রাখে। প্রসঙ্গত বলি, জাতীয়তাবাদী অনেক বড় নেতাই এই আর্য প্রসঙ্গ বিশেষ উত্থাপন করেননি; বি. আর. অম্বেডকার পরিষ্কার বলেছিলেন যে আর্য ধারণাটি সত্যি হতে পারে না। আমাদের ঐতিহাসিকরা অবশ্য এতে বড় বিশ্বাসী ছিলেন। বস্তুত, আমাদের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের সম্পর্কে যদি অগৌরবের কোনও জিনিস থাকে তবে তা হচ্ছে পশ্চিমি বর্ণবিদ্বেষী ও ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকরা (যাঁদের ধারা পশ্চিমদেশে ভারত চর্চা বিভাগগুলিতে এখনও অব্যাহত) ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসে যে ‘রেস-ভাষা-সংস্কৃতি’র কাঠামো চাপিয়েছিলেন তা চোখ বুজে মেনে নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতির ওপর তাই চাপিয়েছিলেন। শুধু, সেখানে আর্য/ইংরেজ/পশ্চিমিদের স্থান ভারতীয়েরা নিয়েছিল।

আমাদের ঐতিহাসিকরা এই একটি দিকে একেবারেই নজর দেননি। যদি আমাদের প্রাচীন ইতিহাস আর্য জাতির ইতিহাস হয় তবে ভারতবর্ষের ‘অনার্যরা’ যারা আছে—সংখ্যাগরিষ্ঠতা বোধ হয় তাদেরই—তাদের ইতিহাস কী হবে? আর্যদের সঙ্গে তাদের সমীকরণের মাত্রা অনুযায়ী তাদের ইতিহাস বিচার হবে? কোন অতীত তাদের কাছে সত্য হবে; যে অতীতে তাঁরা অসভ্য ছিলেন এবং যে অতীতে আর্য মুনিরা তাঁদের সভ্যতা শেখাচ্ছেন?

আমাদের গোড়ার কথায় ফিরে আসি। বৈদিক সাহিত্য বিশ্লেষণ করে ভারতবর্ষের তথাকথিত আর্য জাতির যে ইতিহাস রচিত হয়েছে তা ভারতের সর্বস্তরের জনগণের ইতিহাস হতে পারে না। তা ছাড়া আরও কথা হচ্ছে যে বৈদিক সাহিত্যকে ভিত্তি করে কোনও যুগ তো দূরের কথা, কোনও স্থান-কাল-পাত্র ভিত্তিক ইতিহাসই হতে পারে না। শুধু বৈদিক সাহিত্য নিয়ে নয়, যাকে আমরা বৌদ্ধ যুগ বলি তাকে নিয়েও আমরা একই কথা বলতে পারি। প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্য যা খ্রি. পূ. ৬০০ থেকে ২০০ অব্দের ভেতর সাধারণভাবে সংগ্রথিত হয়েছিল তা নিয়ে এই চারশ বছরের মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকার একটি ছবি মেলে। শুধু এই পর্যন্তই—এর ভেতর ক্রমবিভাগ হয় না; অল্প কিছু অংশ বাদ দিলে, মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকার বাইরেরও ইতিহাস হয় না। আর একটি প্রশ্ন থাকে, একে বৌদ্ধ যুগ বলছি কেন? ভারতবর্ষে তখন সব বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তার প্রমাণ আছে কী? অবৌদ্ধদের কী হবে? এখানে আর একটি রাজনীতির কথা বলা যায়। ‘বৌদ্ধ যুগ’ বলে মাতামাতি হয়েছিল এই কারণে যে, হিন্দুধর্মের বাইরে প্রাচীন ভারতে আর একটি বড় ধর্ম প্রবর্তিত হওয়ার অর্থ এই যে, বর্তমানের (অর্থাৎ ইংরেজ রাজত্বেও) খ্রিস্ট ধর্মের বৌদ্ধ ধর্মের মতো প্রবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে!

প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান প্রসঙ্গে আরও দুয়েকটি কথা বলার লোভ সংবরণ করা কঠিন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের কথা ভেবে দেখা যাক—এর কাল কি খ্রি. পূ. তৃতীয় শতক না বিভিন্ন সময়কার? পুরো দেশের না আংশিক ভাগের? নিষ্পত্তি হয়নি, অথচ ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে আমরা আমাদের সুবিধামতো এটিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করছি।

শিলালিপির কথা ভেবে দেখা যাক। গুপ্ত যুগের পরবর্তী সময়ের তুলনায় প্রাচীন যুগের মোট শিলালিপি এত বড় একটি ভূখণ্ডে সর্বমোট কতগুলি? কতটুকু ইতিহাস বেরোয় এতে? অশোকের সময়ের পুরো কথা, দেশের জমির কথা অশোকের শিলালিপি থেকে জানা যাবে? আমরা জানি, জানা যাবে না। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের যা সীমিত উপাদান তা থেকে প্রাচীন ভারতের জনগণের ইতিহাস হতে পারে না। এই সীমিত উপাদানে নৃতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বকথা মেলালেই ইতিহাস হয় না। দু-পাতা ইংরেজি পড়া ভারতীয় ‘সাহেব মেম’ জাতীয় ঐতিহাসিকদের মুখ থেকে আমরা ১৯৬০ এর দশক থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে শুনে আসছি যে, আমাদের নৃতাত্ত্বিক সমাজতাত্ত্বিক কোণ থেকে প্রাচীন ইতিহাসের উপাদানকে অর্থাৎ ইতিহাসকে দেখতে হবে—এতেই আমাদের ঐতিহাসিক মুক্তি! যে উপাদান আছে তা নিয়ে ‘ত্রিকালজ্ঞ’ সত্যদ্রষ্টা ছাড়া আর কেউ কিছু খুঁজে পাবেন না—তা বিলেত আমেরিকায় তৈরি নৃতত্ত্ব সমাজতত্ত্বের নামাবলি গায়ে চাপালেও!

উত্তর একটিই। যেভাবেই বিশ্লেষণ করি না কেন, উপাদান যদি কম থাকে তবে উপাদান বের করে নিতে হবে; বিশেষ করে বর্তমান পৃথিবীতে যখন ঐতিহাসিক উপাদান বের করার পদ্ধতির কমতি নেই। জমি ও মানুষের সম্পর্ক রচনায় আজকাল বিজ্ঞানের অগ্রগতি যে পর্যায়ে তা বিস্ময়ের অপেক্ষা রাখে। একটি ঘরোয়া উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আমরা সবাই জানি যে, পুলিশের তদন্তের পেছনে ‘ফরেনসিক’ বিজ্ঞানের সাহায্য পাওয়া যায়। নইলে সমস্যার সমাধান আজকাল দুরূহ। তেমনি, ঐতিহাসিক কাল বিচারে সেই সময় জমি এবং মানুষ বিচারের ক্ষেত্রে, ফরেনসিক জ্ঞানের প্রয়োগ বর্তমানের পৃথিবীতে ব্যাপক। অন্য সব কিছু বাদ দিলেও বলা যায়, প্রাচীন খুলি পেলে সেই মানব/মানবীকে বাস্তব রূপ দিয়ে সামনে আনা যায়— ‘পোরট্রেট’ আঁকবার মতো করে। যে কোনও সমস্যাই হোক না কেন বৈজ্ঞানিকরা সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে পারেন। বর্তমান ভারত এই ব্যাপারে খুবই পিছিয়ে। রেডিওকার্বন ল্যাবরেটরি দুটিও দেশে ভালভাবে কাজ করে না বহুদিন। এতটা হওয়া উচিত ছিল না—দেশে সুদক্ষ বিজ্ঞানী আছেন। বিদেশে ‘প্রত্নতাত্ত্বিক বিজ্ঞান’ বহুদিনের বিষয়। বিদেশি বিজ্ঞানীরাও এতে এগিয়ে আসবেন, কাজ করার সুযোগ পেলে। আগ্রহ আমাদেরই নেই। দেশের প্রাচীন ইতিহাস, প্রতত্ত্বের সরকারি/বেসরকারি, প্রগতিবাদী/অপ্রগতিবাদী, সাহেব/ মেমসাহেব/ ‘ধুতিওয়ালা’ কোনও গোষ্ঠীরই নেই। কয়েকটি কারণ আছে এই অবস্থার, এই অনুৎসাহের। প্রধান কারণটি হচ্ছে যে, প্রাচীন ইতিহাস চর্চায় যদি বিজ্ঞানীদের প্রাধান্য আসে তবে বিভিন্ন নামাবলির মাধ্যমে যে ঐতিহাসিকরা সুযোগ সুবিধা ও প্রতিপত্তি ভোগ করছেন তাঁদের কী হবে?

বিজ্ঞানের প্রয়োগ যদি বাদও দিই—বর্তমান ভারতে এই প্রসঙ্গে যতটুকু হয়েছে তা একান্তই অকিঞ্চিৎকর—তবুও প্রাচীন পদ্ধতির প্রত্নতত্ত্বের কথাটা থাকে। ব্যাপক প্রত্নতত্ত্ব চর্চার ভেতর দিয়ে তো অন্তত প্রাচীন ইতিহাসের সুষ্ঠু উপাদান অনেক বাড়তে পারে। সেখানে বাধা কোথায়? সেখানেও বাধা আছে। প্রথম বাধা হচ্ছে: আমাদের ইতিহাস চর্চায় জমির কোনও স্থান নেই। স্থানীয় অনেক অনুসন্ধানী আছেন—তারাপদ সাঁতরার প্রতিষ্ঠিত এবং বর্তমানে অন্য সম্পাদনায় কৌশিকী সাময়িকীটিতে স্থানীয় ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বহু লেখা থাকে—কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলিতে এই ধরনের জমি-ভিত্তিক গবেষণার রেশ পৌঁছয় না। একটি উদাহরণ দিই। তারাপদ সাঁতরা মশাই পশ্চিমবঙ্গে পেতলের রথের একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছিলেন। এই সমীক্ষার পেছনে, পেতলের রথগুলির পেছনে একটি বিরাট ইতিহাসের জগৎ আছে। পেতলের কারিগরি বিদ্যার বিশ্লেষণ— বিজ্ঞানীরা এখানে কাজে লাগবেন—এত ধাতু কীভাবে ঢালাই হত, আলাদা আলাদা অংশগুলি কীভাবে জোড়া হত, ইত্যাদি। এই তামা কাঁসা পেতলের বাজারই বা কী ছিল? তারপর, যে সমস্ত পরিবারের আনুকূল্যে এত বড় বড় কাজ সম্ভব হয়েছিল, তাঁদের ধনেরই বা উৎস কী? তাঁদের ইতিহাসই বা কোথায় গেল? রথগুলির গায়ে যে অলংকরণ তাতে কল্পনা বা চিন্তা বা বাস্তব ইতিহাসের কোনও সত্য ধরা পড়ে? আমাদের পেশাদার ঐতিহাসিকরা এই ধরনের স্থানীয় বা আঞ্চলিক ইতিহাস কবে রচনা করবেন? সম্রাট অশোক লুম্বিনীতে বুদ্ধের জন্মস্থান দর্শনে গিয়েছিলেন আমরা জানি। তবে, পাটনা থেকে বেরিয়ে কোন দিক দিয়ে, কোন কোন অঞ্চলের ভেতর দিয়ে গিয়েছিলেন, কোথায় গঙ্গা বা কোথায় সরযূ পেরোতে পারেন, আমরা জানি কী? তার চাইতে সাহেবদের তত্ত্ব আউড়ে সম্রাট অশোকের রাজত্ব কতটা কেন্দ্রীভূত ছিল তা নিয়ে কল্পনা অধিকতর কাম্য। কাজেই, আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের উপাদান বৃদ্ধির পক্ষে একটি বড় বাধা আমাদের পেশাদারি ইতিহাসের জগতের মানসিকতা। আর একটি প্রায় সমপর্যায়ের বাধা, ভারতে প্রত্নতত্ত্ব চর্চার সীমাবদ্ধতা। খুব অল্প সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া (এবং সেখানেও মানের যথেষ্ট তারতম্য আছে) ভারতীয় শিক্ষার আঙ্গিনায় প্রত্নতত্ত্বের কোনও স্থান নেই। ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা এবং বিভিন্ন রাজ্যস্তরের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ভেতরই ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব চর্চা মূলত সীমিত। এই সমস্ত সংস্থার মোট কাজকর্ম এবং যতটুকু কাজকর্ম হয় তার সুষ্ঠু প্রকাশনাতেও এদের অনীহার ওপর মন্তব্য নিরর্থক। একটি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিক উপদেষ্টা সমিতি আছে; বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং আরও কিছু ইতস্তত সদস্য নিয়ে এই সমিতি। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের গবেষণা এঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন। বর্তমান লেখকের মতো ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের প্রাচীন পদাতিকেরা জানেন যে, এই সমিতির বেশির ভাগ সদস্যদের উদ্দেশ্য আর যাই হোক না কেন, ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের মঙ্গলসাধন নয়।

ভবিষ্যত দেখাই যাচ্ছে, হতাশাব্যঞ্জক। তবে আমাদের প্রাচীন ইতিহাস চর্চায় যদি স্থানীয় ইতিহাস, জমির ইতিহাস ইত্যাদির গুরুত্ব বাড়ে, তবে হয়তো নতুন জোয়ার এসে আমাদের প্রাচীন ইতিহাস চর্চার অচলায়তনের পতন ঘটাবে। আমরা আমাদের জমি চিনব; সেই সঙ্গে জমির ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্বও। এই জোয়ার কবে আসবে জানি না, তবে তার প্রতীক্ষায় থাকা ছাড়া আমরা আর কী করতে পারি?

.

ষষ্ঠ অধ্যায়

। এই প্রসঙ্গে কিছু বিস্তারিত আলোচনা, দিলীপ কে চক্রবর্তী, কলোনিয়াল ইন্ডোলজি: সোসিওপলিটিকস অভ দ্য এনশেন্ট ইন্ডিয়ান পাস্ট, দিল্লি, ১৯৯৭।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *