উদাস চোখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে বর্ষা।
মিনু এসে তার রুমে ঢুকলেন বর্ষা খেয়ালই করল না, যেমন তাকিয়ে ছিল তেমনি তাকিয়ে রইল।
কয়েক পলক তাকিয়ে বর্ষাকে দেখলেন মিনু, তারপর তার পাশে বসলেন। এ সময় শুয়ে আছিস কেন?
বর্ষা কথা বলল না, ফিরেও তাকাল না।
মিনু বললেন, ওঠ। ঐ রুমে চল। বিকেলের নাস্তা দিয়েছে। তোর বাবা বসে আছেন, তুই গেলে নাস্তা খাবেন।
এবারও মায়ের দিকে তাকাল না বর্ষা। ধীর গলায় বলল, আমি খাব না।
কেন?
খেতে ইচ্ছে করে না আমার।
ইচ্ছে না করলেও খেতে হয় মা। না খেলে শরীর খারাপ হয়।
হোক।
বর্ষার মাথায় হাত দিলেন মা, এমন করে না। চল সামান্য কিছু হলেও মুখে দে।
বর্ষা এবার মায়ের দিকে তাকাল, অসহায় গলায় বলল, খেতে আমার ভাল লাগে। না। শুধু বাদলের কথা মনে হয়। তারপর কেমন যেন দুঃখি হয়ে গেল বর্ষা। মা, তোমার মনে আছে শেষ দিকে খিদে খুব বেড়ে গিয়েছিল বাদলের। বারবার শুধু খেতে চাইত।
বর্ষার কথা শুনে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল মিনুর। তবু নিজেকে সংযত করলেন তিনি। শান্ত গলায় বললেন, ডায়াবেটিক রোগীদের এমন হয়।
আগের মতো করেই বর্ষা বলল, তুমি বাবা ভাইজান, তোমরা সবাই ওর ওপর খুব রেগে যেতে। তোমরা রেগে গেলে মুখটা এমন অসহায় দেখাত ওর, আমার যে তখন কী কষ্ট হতো! কিছুতেই কিছু খেতে পারতাম না আমি। আমার খুব কান্না পেত, মনে হতো ইচ্ছে করে বাদলকে তোমরা খেতে দিচ্ছ না।
মিনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। না, এটা তোর ভুল ধারণা। সন্তানকে ইচ্ছে করে না খাইয়ে রাখতে পারে না কোনও মা বাবা।
তোমরা তো রাখতে।
ইচ্ছা করে রাখতাম না মা। ওর ভালর জন্য খাবারটা কন্ট্রোল করতাম।
তারপর একটু থেমে বললেন, আমি, তোর বাবা, আমরা কি কম ভালবাসতাম বাদলকে? বল।
এই কথাটা যেন শুনতেই পেল না বর্ষা। বলল, আমি কিন্তু চুপি চুপি খেতে দিয়ে আসতাম বাদলকে।
সত্যি?
হ্যাঁ, তোমরা কেউ যাতে দেখতে না পাও, পা টিপে টিপে খুব সাবধানে ওর ঘরে গিয়ে খাবার দিয়ে আসতাম। যেসব খাবার নিষিদ্ধ ছিল সেসব খাবারের দুএকটি পেলে মুখটা যে কী উজ্জ্বল হতো ওর!
বর্ষার কথা শুনতে শুনতে জলে চোখ ভরে এল মায়ের। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে তিনি বললেন, এভাবে বলিস না মা, এভাবে বলিস না। আমি সহ্য করতে পারি না। আমার বুক ফেটে যায়।
কিন্তু মায়ের কথা যেন শুনতেই পেল না বর্ষা। উদাস গলায় বলল, আমাদের ছেড়ে কোথায় চলে গেল বাদল? কেন চলে গেল?
.
বাড়ি থেকে বেরিয়েই শুভর মনে পড়েছিল নাহিদের কথা। নাহিদ কি এখন হোটেলে আছে? তাহলে নাহিদের ওখানে যাওয়াই ভাল। নাহিদের মা, বাবা, বর্ষা, সবাই মিলে অন্যরকম একটা পরিবেশ। ওদের কাছে ভালই লাগবে শুভর। যদিও বর্ষা একটু অন্য রকম, তাকে নিয়ে নানা রকমের জটিলতায় আছে তিনজন মানুষ, তবু তাদের কাছে। যেতে ভাল লাগে শুভর।
কিন্তু হোটেলের লনে এসেই ভাল রকমের একটা হোঁচট খেল শুভ।
রিকশা বিদায় করে রিসিপশানের দিকে যাচ্ছে শুভ, বর্ষা বেরিয়ে এল। এসে শুভর পাশ দিয়ে অচেনা মানুষের ভঙ্গিতে হেঁটে লনের দিকে চলে গেল। শুভকে সে চিনতেই পারল না।
শুভ বেশ অবাক হল। তারপর বর্ষার পিছু কয়েক পা এসে ডাকল। শোন।
বর্ষা থমকে দাঁড়াল। অচেনা মানুষের ভঙ্গিতে তাকাল শুভর মুখের দিকে। খানিক তাকিয়ে তাকে চেনার চেষ্টা করল, আপনি যেন কে?
শুভ মৃদু হাসল, আমি বুঝেছিলাম।
কী বুঝেছিলেন?
তুমি আমাকে চিনতে পারনি।
হ্যাঁ।
আমি শুভ।
ও।
নাহিদ আছে?
না।
আগের মতোই নির্বিকার ভঙ্গিতে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল বর্ষা।
শুভ বলল, কোথায় যাচ্ছ?
বর্ষা আবার দাঁড়াল। কাল সকালে বাড়ি চলে যাব।
শুভ হাসল। কাল সকালের কথা বলছি না। এখন কোথায় যাচ্ছ?
কোথাও না।
রিসিপশানের সোফা দেখাল শুভ। তাহলে চল ওখানে বসি।
কেন?
কথা বলি তোমার সঙ্গে। গল্প করি।
সঙ্গে সঙ্গে মুখ উজ্জ্বল হল বর্ষার। বাদলের গল্প! চলুন। দ্রুত হেঁটে সোফার সামনে এল বর্ষা। নিজে একটি সোফায় বসে মুখোমুখি সোফাটি দেখাল শুভকে। বসুন।
শুভ বসল।
বর্ষা দূরাগত গলায় বলল, স্পাইনাল কর্ডে যখন টিবি হল, চার মাস ধরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বাদল। অত শুয়ে থাকলে কি ঘুম আসে মানুষের? বাদলেরও ঘুম আসত না। আমি থাকতাম পাশের রুমে। গভীর রাতে আস্তে আস্তে বাদল আমাকে ডাকত। বর্ষা বর্ষা। জোরে ডাকত না, জানেন! একটুও জোরে ডাকত না। জোরে ডাকলে যদি অন্যদের ঘুম ভেঙে যায়! জানেন, একবার ডাকলেই আমি টের পেতাম। মাত্র একবার ডাকলেই। আসলে বাদলের জন্য আমি যেন সারারাতই জেগে আছি।
বর্ষার কথা বলার ভঙ্গিতে মন খারাপ হলো শুভর। অবস্থাটা বদলাবার জন্য বলল, বাদলের কথা নয়, তুমি তোমার কথা বল।
অপলক চোখে শুভর দিকে তাকাল বর্ষা। আমার কী কথা? আমার তো কোনও কথা। নেই। আমি আর বাদল, আমরা দুজন এক সঙ্গে পৃথিবীতে এসেছিলাম। এক সঙ্গে বড় হয়েছিলাম, এক সঙ্গে এসে, এক সঙ্গে থেকে একজন কী করে আরেকজনের আগে চলে। যায়? বাদলকে ছেড়ে আমি কেমন করে থাকি বলুন তো, একটু থামল বর্ষা। তারপর বলল, বাদল আমাকে বলত, আমার মনে মনে বলা কথাও সে শুনতে পায়। এই যে এখন আমি ওর কথা বলছি, ও কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছে? বলুন না, শুনতে পাচ্ছে?
শুভ বলল, না মৃত্যুর পর আর কিছুই থাকে না।
কেন থাকে না? মৃত্যু এমন কেন? বলুন না মৃত্যু এমন কেন? বাদল কেন মরে গেল?
বর্ষা হুহু করে কাঁদতে লাগল।
.
নিজের রুমে বসে সেতু যখন কাঁদছে, ড্রয়িংরুমে বসে সেতুর দুভাই তখন তাকে নিয়ে নানা রকমের চিন্তাভাবনা করছে। ভেতরে ভেতরে রাগে গজরাচ্ছিল স্বপন। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ওকে যখন কাঁদতে দেখি, আমার ইচ্ছে করে ওর গলা টিপে ধরি।
মামুন বললেন, রিল্যাক্স। যতোই কান্নাকাটি করুক কোনও লাভ হবে না। শোন তোকে নিয়ে আমি একটু ঐ ছোকরার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
কোন ছোকরা?
আরে ঐ যে, শুভ না কী যেন নাম!
শুনে চোখ কপালে উঠে গেল স্বপনের। বল কী তুমি? ওর সঙ্গে আমরা কেন দেখা। করব?
মামুন গম্ভীর গলায় বললেন, কারণ আছে।
কী কারণ?
যাওয়ার আগে সব বলব। তুই কি ওদের বাড়ি চিনিস?
চিনি।
তাহলে এখুনি চল।
তারপরই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে দুভাই। শুভদের বাড়ি এসেছে। কলিংবেল বাজাবার পর শুভই দরজা খুলে দিয়েছে। খুলে হতভম্ব হয়ে গেছে। আপনারা? আসুন, আসুন।
শুভর পিছু পিছু ড্রয়িংরুমে এসে ঢুকেছে মামুন এবং স্বপন।
বসুন।
স্বপন বলল, তুমি কি আমাদেরকে চিনেছ?
জ্বি। একটু বসুন, ভাবীকে ডেকে আনি।
দরকার নেই।
চা, চা খাবেন তো?
এবার কথা বললেন মামুন। আমরা চা খেতে আসিনি, অন্য কারও সঙ্গে দেখা করতেও আসিনি। বরং অন্য কারও না থাকাই ভাল, আমরা তোমার সঙ্গে দুএকটা কথা বলব।
শুভ একটা সোফায় বসল।
সেতুর দুভাইকে দেখার পর থেকেই বুকটা ধুকধুক করছিল। গলাটা শুকিয়ে আসছিল। খুবই নার্ভাস লাগছিল তার। কোন ফাঁকে যেন সেই ভাবটা কেটে গেছে।
সোফায় বসে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মামুন এবং স্বপনের দিকে তাকাল শুভ। ধীর শান্ত গলায় বলল, জ্বি বলুন। স্বপন বলল, ব্যাপারটা আমরা জেনেছি।
সঙ্গে সঙ্গে আরও বললেন, খুবই দুঃখ এবং লজ্জাজনক ব্যাপার, বিশেষ করে আমাদের জন্য। আমার বোন এরকম একটা কাজ করবে এ আমরা কল্পনাও করিনি।
স্বপন বলল, এবং এমন সময় ব্যাপারটা আমরা জেনেছি…। হাত তুলে স্বপনকে থামালেন মামুন। আমি বলছি। তারপর শুভর দিকে তাকালেন তিনি। যা হোক, যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। যা করতে হবে তাই নিয়ে ভাবা উচিত। একটু থামলেন তিনি। তারপর বললেন, আমরা চাই ব্যাপারটা তোমার দিক থেকে শেষ হয়ে যাক।
শুভ চমকালো। মানে?
স্বপন বলল, মানে জানতে চাওয়ার দরকার নেই। মানেটা খুব পরিষ্কার। যা লাগে আমরা দিয়ে দেবো। কাজটা যেভাবে করেছ সেভাবেই গোপনে শেষ করে দেবে।
মামুন বললেন, অত কিছুর দরকার নেই। আমাদের ল ইয়ার পেপারস রেডি করে নিয়ে আসবে, তুমি শুধু সই করে দেবে।
ফ্যালফ্যাল করে মামুন এবং স্বপনের মুখের দিকে তাকাল শুভ। আপনাদের কথা আমি বুঝতে পারছি না। কীসের পেপারস? কীসের সই?
স্বপন বলল, ডিভোর্সের।
জ্বি?
হ্যাঁ, সেতুকে তোমার ডিভোর্স করতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল শুভ। দৃঢ় গলায় বলল, একথা বলার জন্য আমাদের বাড়িতে আসা আপনাদের ঠিক হয়নি। মরে গেলেও সেতুকে আমি কখনও ডিভোর্স করব না।
.
মা বললেন, কারা এসেছিল তোর কাছে?
শুভ একটু থতমত খেল। তুমি চিনবে না।
চিনিনি বলেই তো জিজ্ঞেস করছি। কারা?
আমার পরিচিত।
কেমন পরিচিত?
বিশেষ পরিচিত।
মা ভুরু কুঁচকালেন, বিশেষ পরিচিত?
হ্যাঁ।
কিন্তু তাদেরকে তো চা খাওয়াতে দেখলাম না।
শুভ কথা বলল না।
মা তীক্ষ্ণ চোখে শুভর দিকে তাকালেন। কেন এসেছিল?
ওই একটা কাজ আর কি! তুমি বুঝবে না।
তোর মতো মানুষের কাছে কী এমন কাজে গাড়ি নিয়ে সুট-টাই পরা লোকজনরা আসবে যা আমি বুঝব না?
শুভ একটু বিরক্ত হল। তুমি আমাকে যা ভাব আমি তা নই মা। আমি বড় হয়েছি, আমার একটা সার্কেল তৈরি হয়েছে, কিছুদিনের মধ্যে দেখবে ভাল একটা চাকরিও পেয়ে গেছি। তখন আর যখন তখন আমাকে গালাগাল করতে পারবে না।
মা কথা বললেন না। কী রকম সন্দেহের চোখে শুভর দিকে একবার তাকিয়ে শাহিন-সুরমার বেডরুমে এসে ঢুকলেন।
সুরমা রুমেই ছিল। শাশুড়িকে দেখে চোখ তুলে তাকাল।
মা বললেন, বউমা, তুমি আমাকে সত্য একটা কথা বলবে?
সুরমা মৃদু হাসল। আমি আপনার সঙ্গে কখনও মিথ্যে বলি না।
মা যেন একটু বিরক্ত হলেন। সব কথায় প্যাঁচ ধরো না। শুভর কাছে যারা এসেছিল তাদেরকে তুমি চেন?
না। কারা এসেছিল?
সে কথাই তো জিজ্ঞেস করছি। আমি মা, কিন্তু শুভ আমাকে সব কথা বলে না। তোমাকে বলে। কারা এসেছিল তোমাকে বলেনি?
না। আমি কিছু জানিই না। বাড়িতে যে কেউ এসেছিল একথা এইমাত্র আপনার মুখে শুনলাম।
আমার কী রকম যেন সন্দেহ হচ্ছে।
কীসের সন্দেহ?
আজকালকার এই বয়েসি ছেলেরা নানারকমভাবে বখে যায়। শুভর ব্যাপারটা কি তুমি একটু জানার চেষ্টা করবে?
অবশ্যই করব। শুভর সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাব।
ঠিক আছে।
মা বেরিয়ে গেলেন।
সামান্য সময় কী ভাবল সুরমা তারপর শুভর রুমে এসে ঢুকল। কপালে আড়াআড়ি করে ডান হাত ফেলে শুয়ে আছে শুভ। সুরমার সাড়া পেয়ে কপাল থেকে হাত সরাল তারপর বিছানায় উঠে বসল। আমি জানি তুমি কেন এসেছ?
শুভর খাটে বসল সুরমা। কেন বলতো?
মা গিয়েছিলেন তোমার কাছে?
হ্যাঁ। কারা এসেছিল তোর কাছে?
সেতুর দুভাই।
সুরমা চমকাল, কী?
হ্যাঁ।
হঠাৎ?
আমি কল্পনাই করিনি ওঁরা এভাবে আমাদের বাড়িতে আসবেন।
কিন্তু এসেছিলেন কেন?
আশ্চর্য এক আবদার নিয়ে। আমি যেন সেতুকে ডিভোর্স করি।
কী?
হ্যাঁ।
সুরমা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল শুভর দিকে।
শুভ বলল, এভাবে এসে ওঁরা যে আমাকে ডিভোর্সের জন্য চাপ দেবেন আমি ভাবতেই পারিনি ভাবী।
সুরমা একটু নড়েচড়ে উঠল। কিন্তু ওদের পলিসিটা আমি একদম বুঝতে পারছি। এসব ক্ষেত্রে নিজেদের মেয়েটিকেই সাধারণত প্রেসার দেয় সবাই। তা না করে, ওঁরা তোর কাছে এলেন কেন?
সেতুকে যে প্রেসার দেয়নি তাই বা কী করে বলছ? হয়ত তাকে ম্যানেজ করতে পেরেই আমার কাছে এসেছে।
হতে পারে। সেতুর ব্যাপারে তুই কতটা সিরিয়াস তা হয়ত ওঁরা দেখতে চাইলেন।
শুভ কথা বলল না।
সুরমা বলল, কিন্তু এদিকে কী করবি?
চোখ তুলে সুরমার দিকে তাকাল শুভ। এদিকে মানে?
সেতুর ভাইদেরকে দেখার পর থেকে মা কী রকম যেন সন্দেহ করছেন। তাঁকে ম্যানেজ করবি কী করে?
কথাটা আমিও ভেবেছি। ভাবী, বিয়ের ব্যাপারটা কি আমাদের বাড়িতে জানিয়ে দেবে? দুদিন আগে পরে জানাতে তো হবেই।
সুরমা কাতর গলায় বলল, আমার খুব ভয় করছে। মা যে রকম মেজাজি মানুষ! তুলকালাম করে ফেলবেন।
শুভ শান্ত গলায় বলল, সেই ভয়ে কি বসে থাকা যাবে? তুমি একটা কাজ কর, ভাইয়াকে বল। ভাইয়া বলবে মাকে।
তারপরই সুরমার একটা হাত ধরল শুভ। ভাবী, তুমি ছাড়া আমার পাশে এখন। কেউ নেই। জানি তোমার ওপর দিয়ে অনেক ধকল যাবে। তবু তোমাকে সব সামলাতে হবে।
সুরমা চিন্তিত চোখে শুভর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে টিভি দেখছে শাহিন।
সুরমা এসে ঢুকল কিন্তু শাহিন তার দিকে ফিরেও তাকাল না। কয়েক পলক স্বামীকে দেখে রিমোট টিপে টিভি অফ করল সুরমা। এতে শাহিন তেমন বিরক্ত হল না। হাসিমুখে স্ত্রীর দিকে তাকাল। অফ করলে কেন?
সুরমা সঙ্গে সঙ্গে বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
কী এমন কথা যে জন্য টিভি অফ করতে হবে?
তারপরই তীক্ষ্ণ চোখে সুরমার মুখের দিকে তাকাল শাহিন। এ
ত গম্ভীর হয়ে আছ কেন? মা কিছু বলেছেন?
না।
তাহলে?
একেবারেই অন্যরকম ব্যাপার।
বলে ফেল।
কথাটা তুমি কীভাবে নেবে বুঝতে পারছি না।
আমাকে কিছু বলতে এত দ্বিধা করার মানে নেই। সরাসরি বলে ফেল।
শুভ চাকরি বাকরির কথা বলায় তুমি সেদিন যেমন চিন্তিত হয়েছিলে, আজ আমি বুঝেছি কেন সে ওসব কথা বলেছিল।
কেন?
আগে আমাকে তোমার একটা কথা দিতে হবে। উত্তেজিত হবে না, রেগে যাবে না।
শাহিন গম্ভীর গলায় বলল, কী হয়েছে?
আগে কথা দাও।
এত ভণিতা করো না। ভাল লাগছে না। কী হয়েছে বল।
সুরমা পরিষ্কার গলায় বলল, সেতু নামের খুব বড়লোক বাড়ির একটি মেয়ের সঙ্গে শুভর অ্যাফেয়ার।
শাহিন বেশ একটা ধাক্কা খেল। তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কই, তুমি তো আমাকে কখনও বলনি?
ছোটভাই একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে সে কথা বড়ভাইকে বলার কী আছে?
তাহলে এখন বলছ কেন?
বলতে চাইনি। বাধ্য হচ্ছি।
কীসের বাধ্য?
সেতুর সঙ্গে শুভর বিয়ে হয়ে গেছে।
কথাটি যেন বুঝতে পারল না শাহিন। কী বলছ তুমি?
সুরমা গম্ভীর গলায় বলল, হ্যাঁ।
কবে? কোথায়? কীভাবে হল?
ব্যাপারটা খুলে বলল সুরমা।
শুনে শাহিন একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল।
সুরমা বলল, এখন আসল কাজটা তোমাকে করতে হবে।
আসল কাজ কোনটা?
মাকে ম্যানেজ করতে হবে।
মানে?
ব্যাপারটা মাকে বলে তাঁকে তুমি ম্যানেজ করবে।
কিন্তু কাজটা কি শুভ ভাল করেছে?
এছাড়া ওদের কোনও উপায় ছিল না।
তা বুঝলাম কিন্তু মাকে ম্যানেজ করা খুব কঠিন হবে। শুনেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করবে, রাগারাগি শুরু করবে।
তাকে তুমি বোঝাবে সেতু খুব বড়ঘরের মেয়ে। শিক্ষিতা, সুন্দরী।
যত যাই হোক, আমাদের দেশের মা বাবারা এই ধরনের খবর শুনলেই রেগে যান। ছেলেমেয়েদেরকে এই ধরনের স্বাধীনতা তাঁরা দিতেই চান না। তার ওপর মা যদি শোনে। সেতুর ভাইরা এসে ডিভোর্সের জন্য প্রেসার দিয়ে গেছে তাহলে একেবারে কেলেঙ্কারি করে ফেলবে।
এই কথাটা মাকে বল না।
কিন্তু আমি অন্য রকমের একটা ভয় পাচ্ছি।
সেতুর ভাইয়েরা কোনও ঝামেলা করে কি না?
হ্যাঁ।
আমিও সেই ভয়টা পাচ্ছি। এত টাকা পয়সা ওদের। টাকা দিয়ে সব হয় আজকাল।
তা ঠিক।
একটু চুপ করে থেকে শাহিন বলল, এমনিতেই শুভর ওপর সবসময় রেগে আছে। মা, এসব শোনার পর যে কী হবে ভাবতেই পারছি না।
স্বামীর কাঁধে হাত দিল সুরমা। মা তোমাকে খুব ভালবাসেন। আমার বিশ্বাস, তুমি তাঁকে ম্যানেজ করতে পারবে। যেমন করে হোক শুভকে তুমি সেভ কর।
শাহিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাতো করতেই হবে। তবে আপাতত মাকে কিছুই জানাবার দরকার নেই।
মানে?
আর কিছুদিন যাক, এরপর জানাব।
শাহিন থামল। হাসিমুখে সুরমার দিকে তাকাল। সেতুর একটা ছবি আমাকে দেখিও তো। দেখব মেয়েটা কেমন।
সুরমা মুগ্ধ গলায় বলল, খুব সুন্দর মেয়ে।
.
টেলিফোন সেটটা খুবই যত্নে মুচছে মালা।
এই একটি ব্যাপারে অপরিসীম যত্নবান সে। আর কাজটি করার সময় অন্যদিকে মনোযোগ প্রায় দেয়ই না।
কিন্তু এখন একটু দিল।
শুভ এসে অদূরে দাঁড়িয়েছে আড়চোখে তা দেখল মালা। দেখেই মুখটা গম্ভীর, শক্ত ধরনের করে ফেলল।
অপরাধী ভঙ্গিতে শুভ এসে দাঁড়াল মালার পাশে। নরম গলায় বলল, আপা।
অভিমানে গলা ভারি হল মালার, আমাকে আপা বলার দরকার কী?
তাহলে কী বলব?
নাম ধরে বল, তুই করে বল।
শুভ মাথা নিচু করল, আমার মনটা সেদিন ভাল ছিল না।
কেন?
খুব টেনশন যাচ্ছে।
মালা অবাক হল। কীসের টেনশন? কী হয়েছে তোর?
এমন একটা ব্যাপার, কাউকে বলতেও পারছি না।
শুভর কথা বলার ধরনে বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল মালার, টেলিফোন রেখে শুভর মুখোমুখি দাঁড়াল। তোর কথা শুনে আমার ভয় লাগছে। কোথাও কোনও বিপদ হয়নি তো? মা বলল, কারা নাকি এসেছিল তোর কাছে?
শুভ বলল, ভয় পাওয়ার মতো কিছু না। একেবারেই অন্যরকম একটা ব্যাপার।
সঙ্গে সঙ্গে সেদিনের কথা ভুলে গেল মালা। যাবতীয় অভিমান ভুলে গেল। গভীর মমতায় ছোটভাইর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, কী হয়েছে আমাকে বল।
বলতে পারি, কিন্তু প্রমিজ কর এখুনি কাউকে বলবে না।
অন্য হাত শুভর গালে চুঁইয়ে মালা বলল, প্রমিজ করলাম।
তাহলে আমার রুমে এস, বলছি।
শুভর পিছু পিছু তার রুমে এসে ঢুকল মালা। অনেকক্ষণ ধরে সেতুর ব্যাপারটা মালাকে বলল শুভ। শেষ পর্যন্ত সেতুর একটা ছবি বের করে দিল মালার হাতে।
সেতুর ছবি দেখে মালা একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। ওমা, কী সুন্দর মেয়ে! জীবনে এত সুন্দর মেয়ে আমি দেখিনি।
তারপরই শুভর দিকে তাকাল মালা। এই গাধা, তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন?
শুভ ম্লান গলায় বলল, তোমাদের কাউকে ভয় পাচ্ছি না। ভয় পাচ্ছি শুধু মাকে।
সেতুকে দেখে আমার চেয়েও বেশি মুগ্ধ হবে মা।
কিন্তু আমাকে তো মা দেখতে পারে না।
তোকে দেখতে পারে না ঠিকই কিন্তু সেতুকে খুব আদর করবে দেখিস।
ওসব তো বাড়ির বউ হয়ে আসার পর। আগে সব ঠিকঠাক করতে হবে না?
আমাদের বাড়ি নিয়ে তুই ভাবিস না। ভাইয়া দেখবি ঠিকই মাকে ম্যানেজ করে ফেলেছে। দরকার হলে ভাইয়ার সঙ্গে আমিও থাকব।
তুই কিছু বলতে গেলে মা আরও রেগে যাবে।
মালা ঠোঁট উল্টাল। ইস রেগে যাবে! আমরা তিনভাইবোন আর ভাবী যদি একদিকে থাকি, আমাদের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছুই করতে পারবে না মা।
শুভ কথা বলল না।
.
কোনও কোনও রাতে দুধভাত খাওয়ার খুব শখ হয় টুপলুর। সন্ধেবেলাই মাকে বলে, আম্মু আমি আজ দুধভাত খাব।
আজও বলেছে।
তারপরই প্লেটে দুধভাত নিয়ে চামচে করে মেয়েকে খাওয়াতে বসেছে রেখা। প্রথম প্রথম আস্তেধীরেই খাওয়াচ্ছিল। এখন খাওয়াবার গতি একটু দ্রুত হয়েছে। ব্যাপারটা খেয়াল করে টুপলু বলল, এত তাড়াতাড়ি খাওয়াচ্ছ কেন আম্মু?
রেখা বলল, এমনি।
আমি এত তাড়াতাড়ি খেতে পারি না।
খাওয়া দাওয়ার জন্য বেশি সময় নষ্ট করতে হয় না।
কেন?
খেতে বসে বেশি সময় নষ্ট করলে পড়বে কখন?
এখন আমার পড়া নেই। টিচার চলে গেছে।
আমি এখনকার কথা বলিনি।
তাহলে কখনকার কথা বলেছ?
রেখা একটু রাগল। চুপ কর। তুমি খুব বেশি কথা বল।
ঠিক তখুনি রুমে এসে ঢুকল স্বপন। কী যেন কী কারণে মেজাজ খিঁচড়ে আছে তার। রেখা টুপলুকে খাওয়াচ্ছে এই দৃশ্য দেখে খিচড়ানো মেজাজ আরও খিঁচড়ে গেল। খেকুড়ে গলায় টুপলুকে বলল, তুমি এখানে বসে খাচ্ছ কেন? এটা কি খাওয়ার জায়গা? যাও ডাইনিং টেবিলে যাও।
বাবার এরকম আচরণে টুপলু নার্ভাস হয়ে গেল। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার। ব্যাপারটা খেয়াল করে স্বামীর দিকে তাকাল রেখা। বাড়ি এসেই মেয়েটাকে ধমকাচ্ছ কেন?
আগের ভঙ্গিতেই স্বপন বলল, এখানে বসে খাচ্ছে কেন?
খেতে চায়নি, আমি নিয়ে এসেছি।
এক চামচ দুধভাত টুপলুর মুখে দেয়ার চেষ্টা করল রেখা। টুপলু মুখ সরিয়ে নিল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমি আর খাব না আম্মু।
সঙ্গে সঙ্গে প্লেট সরিয়ে নিল রেখা। তুমি তাহলে মুন্নি আপুর রুমে যাও। টিভি দেখ গিয়ে।
আচ্ছা।
টুপলু বেরিয়ে গেল।
তারপর স্বামীর দিকে তাকাল রেখা। গম্ভীর গলায় বলল, তোমার আচরণ সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
আগের মতই রাগী ভঙ্গিতে স্বপন বলল, কী রকম?
ভেবে দেখ। বউ বাচ্চার সঙ্গে এই ধরনের আচরণ কোন ভদ্রলোক করে না।
বিছানার এক পাশে বসল স্বপন। সেতুর ব্যাপারে আমার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
তাতে আমাদের কী?
মানে?
যার জন্য মেজাজ খারাপ, রাগটা গিয়ে তাকে দেখাও। আমাদেরকে দেখাবে না। তোমার জন্য আমার মেয়েটি এখন খেতে পারল না। তোমার আল্লাদি বোনের জন্য আমাকে তুমি চড় মেরেছ। অন্যায়টা তো আমরা করিনি। করেছে তোমার বোন। তার জন্য আমরা কেন সাফার করব?
একটু থামল রেখা। তারপর বলল, আর একদিন যদি দেখি তুমি আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছ, তাহলে টুপলুকে নিয়ে আমি আমাদের বাড়িতে চলে যাব। গিয়ে সবাইকে বলব তোমার বোন এই এই করেছে, তার রাগ তুমি আমাদের ওপর ঝাড়ছ, পায়ে ধরলেও এই বাড়িতে আমি আর ফিরব না।
টুপলুর আধখাওয়া দুধভাতের প্লেট হাতে রাগী ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল রেখা। স্বপনের এখন খুবই অসহায় লাগছে। কাতর মুখে নিজের বিছানায় বসে রইল সে।
.
ঠিক স্বপনের মতো করেই নিজের বেডরুমে নিজের বিছানায় বসে আছে মামুন। তার সামনে দাঁড়িয়ে শিলা বলল, আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম শুভর কাছে গিয়ে কোনও লাভ হবে না। যে ছেলে এভাবে বিয়ে করতে পারে তার বুকের পাটা বেশ চওড়া। তোমাদের কথায় বউ সে ছেড়ে দেবে না।
মামুন বলল, এটা যে আমিও না বুঝেছি তা নয়। তবু গেলাম। চেষ্টা একটু করে দেখলাম। ছোকরাটিকে আমার একটু বোঝার দরকার ছিল, বুঝলাম।
কী বুঝলে?
লোভে পড়ে কাজটা করেছে।
তা আমারও মনে হয়েছে।
লোভ হচ্ছে তিনটি। প্রথমত, সেতু আমাদের একমাত্র বোন। এত বড় ফ্যামিলির একমাত্র মেয়ে, তাকে যে বিয়ে করবে প্রচুর জায়গা সম্পত্তির মালিক হবে সে।
সেতু দেখতে খুব সুন্দর এটাও একটা কারণ।
এটা হচ্ছে তৃতীয় কারণ।
দ্বিতীয় কারণটা কী?
দ্বিতীয় কারণটি হল, ছোকরাটি খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সেতুকে পাওয়া মানে, জাতে উঠে গেল সে।
শিলা ঠোঁট উল্টে বলল, আমার মনে হয় না এতকিছু ভেবে কাজটা সে করেছে।
মামুন বলল, আমার মনে হয় ভেবেই করেছে।
কিন্তু এখন কী করবে?
দেখি কী করা যায়!
.
বিষণ্ণ মুখে শুয়ে আছে সেতু।
খুবই নরম ভঙ্গিতে তার রুমে এসে ঢুকল মুন্নি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেতুকে কয়েক পলক দেখল। তারপর তার পাশে এসে বসল। ফুপি, তোমার কি শরীর খারাপ?
সেতু শান্ত গলায় বলল, না।
তাহলে সারাক্ষণ শুয়ে থাক কেন? রুম থেকে বেরও না, কারও সঙ্গে কথা বল না। কী হয়েছে?
কিছু না।
তুমি কি কারও ওপর রাগ করেছ?
না মা।
হাত বাড়িয়ে মুন্নির একটা হাত ধরল সেতু। তুই এখন যা। কথা বলতে আমার ভাল লাগছে না।
মুন্নি দেখতে পেল কথা বলতে বলতে জলে চোখ ভরে আসছে সেতুর। হয়ত চোখের জল লুকোবার জন্যই পাশ ফিরল সে।
মুন্নি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মন খারাপ করে সেতুর রুম থেকে বেরিয়ে এল।
.
বাবলু বলল, পঞ্চাশটা টাকা দাও মা।
আনমনা ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে শিলা। ছেলের কথা শুনে তার দিকে তাকাল। কেন?
কম্পিউটার ডিস্ক কিনব।
এখন হবে না। পরে।
বাবলু অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল।
শিলা বিরক্ত হল। বললাম তো পরে দেব। তারপরও দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
বাবলু চিন্তিত গলায় বলল, তোমাদের কী হয়েছে?
কী হবে?
সবাই কী রকম চেঞ্জ হয়ে গেছ। আমি টাকা চেয়েছি আর তুমি দাওনি এমন কখনও হয়নি।
হয়নি, আজ হল। এসব নিয়ে কথা বলার কিছু নেই। যা এখান থেকে।
বাবলু এবার একটু রাগল। এত বাজে বিহেভ করছ কেন? তুমি না বললেও যাব।
চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল বাবলু।
শিলা বলল, শোন।
বাবলু ঘুরে দাঁড়াল। বল।
টাকা নিয়ে যা।
শিলা উঠল।
বাবলু বলল, লাগবে না।
.
রাতেরবেলা খেতে বসে টুপলু বলল, ফুপি এখন আমাদের সাথে খেতে বসে না কেন?
এ বাড়ির নিয়ম হচ্ছে রাতেরবেলা সবাই এক সঙ্গে খেতে বসে। ডাইনিং রুমের বিশাল টেবিলে মামুন, শিলা, স্বপন, রেখা, সেতু এবং বাবলু মুন্নি টুপলু। কদিন ধরে সবাই থাকে শুধু সেতু থাকে না। তার চেয়ারটা খালি।
আজ সেই চেয়ারের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল টুপলু।
শুনে মেয়ের দিকে তাকাল রেখা। চুপ কর।
সঙ্গে সঙ্গে টুপলুর পক্ষ নিল মুন্নি। কেন চুপ করবে? ঠিকই তো বলেছে। ফুপিকে তোমরা ডাকো না কেন?
ব্যাপারটা সামাল দেয়ার চেষ্টা করল শিলা। সেতুর শরীর খারাপ। ডাকলেও সে আমাদের সঙ্গে খেতে আসে না। এজন্য ওর খাবার ওর রুমেই পাঠিয়ে দিই।
বাবলু বলল, মিথ্যে কথা বলছ কেন? কে বলছে ফুপির শরীর খারাপ?
বাবলুর কথা বলার ভঙ্গিতে রেগে গেল স্বপন। চোপ। মায়ের মুখে মুখে তর্ক করছ। তোর মা যা বলেছেন তাই ঠিক। কোনও কথা বলবি না। চুপচাপ খেয়ে নে।
সেতুর কথা ওঠার পর থেকেই অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন মামুন। খাবার নাড়াচাড়া করছিলেন কিন্তু মুখে দিচ্ছিলেন না। এখন ব্যাপারটা খেয়াল করল শিলা। বলল, কী হল।
মামুন মন খারাপ করা গলায় বলল, কী?
খাচ্ছ না কেন?
খেতে ইচ্ছে করছে না।
প্লেট সরিয়ে উঠে দাঁড়াল মামুন। ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে ঢুকল।
খানিক পর এই রুমে এসে ঢুকল স্বপন। মামুনের মুখোমুখি বসল। সঙ্গে সঙ্গে মাঝখান থেকে কথা বলতে শুরু করল মামুন। ওর মুখ দেখতে আমার ইচ্ছে করে না। এজন্য ওর সামনে আমি যাই না।
স্বপন বলল, কিন্তু আমরা যেমন চুপচাপ বসে আছি, এভাবে বসে থাকলে সেতু ভাববে ব্যাপারটা আমরা মেনে নিচ্ছি।
তা ভাববার কোনও কারণ নেই। মাথায় যদি ঘিলু থাকে তাহলে বুঝবে, বাড়িতে ওকে এক রকম বন্দি করে রাখা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছাড়া কাজটা আমরা করিনি।
সবকিছু মিলিয়ে আমার যে কী রাগ লাগছে ভাইয়া! বোন না হয়ে ও যদি আমার ছোট ভাই হত, ওকে এমন মারতাম আমি!
একটু থামল স্বপন। মামুনের মুখের দিকে তাকাল। ভাইয়া, ওই বদমাশটাকে একটা মার দিয়ে দিই।
মামুন গম্ভীর গলায় বলল, না না, মারামারি করা ঠিক হবে না।
কেন ঠিক হবে না?
এককান দুকান করে কথাটা ছড়িয়ে যাবে। আমি চাই না কিছুতেই এসব কথা বাইরের কেউ শুনুক। বাইরের কাউকে জানাতে চাইলে তোকে নিয়ে নিজেই ওদের বাড়িতে যেতাম না। অন্য কাউকে পাঠাতাম।
স্বপন তার স্বভাব মতো রাগল। এখন তাহলে কী করব? হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব?
সঙ্গে সঙ্গে স্বপনকে ধমক দিল মামুন। চোপ। কোনও বাড়াবাড়ি করবি না। আমি যা বলব তাই হবে।
স্বপন থতমত খেয়ে মাথা নিচু করল, সরি ভাইয়া।
মামুন এবার নরম হল। মাথা গরম করে সব কাজ করা যায় না। নোংরা যত ঘাটবি ততো দুর্গন্ধ বেরুবে। কাজ করতে হবে অন্যভাবে। বোস, কী করতে হবে বলছি।
.
সকালবেলার আকাশের দিকে তাকিয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেতু। ছোট্ট টেবিলে নাস্তা পড়ে আছে। সেতু ছুঁয়েও দেখেনি।
সেতুর রুমে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে অবাক হল রেখা। বলল, নাস্তা খাওনি কেন?
সেতু কথা বলল না। যেমন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল, তাকিয়ে রইল।
রেখা বলল, কাল রাতে ভাতও খাওনি শুনলাম। এভাবে চললে তো অসুখ হয়ে যাবে।
গভীর অভিমানের গলায় সেতু বলল, আমি চাই আমার অসুখ হোক। আমি চাই আমি মরে যাই।
এসব ছেলেমানুষির কোনও মানে নেই। এমনিতেই এমন ছেলেমানুষি করেছ, এত সুন্দর ফ্যামিলিটাকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছ। নতুন করে আর কোনও ঝামেলা করো না।
কথা বলতে বলতে সেতুর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে রেখা। ব্যাপারটা পাত্তা দিল না সেতু। বলল, যা বলতে এসেছ তাই বল। অন্য কথা বলে কোনও লাভ নেই।
রেখা একটু বিরক্ত হল। কোনও কথা বলতেই তোমার কাছে আমি আসতে চাইনি। তোমার ভাই আমাকে পাঠিয়েছেন।
কেন?
যা করে ফেলেছ তার একটা সমাধান তোমার ভাইরা করতে চান।
একথায় মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল সেতুর। শুভকে তারা মেনে নেবে?
না।
উজ্জ্বল মুখ আগের মতো ম্লান হল সেতুর। তাহলে?
শুভকে তোমার ছেড়ে দিতে হবে।
মানে?
ডিভোর্স করতে হবে তাকে।
শ্লেষের হাসি হাসল সেতু। তাই নাকি! কিন্তু ভাইয়াদের ভাবনাটা ঠিক হয়নি। ডিভোর্স করার জন্য শুভকে আমি বিয়ে করিনি। ভালবেসে যাকে বিয়ে করেছি মৃত্যু ছাড়া তার কাছ থেকে আমাকে কেউ সরাতে পারবে না। কথাটা ভাইয়াদেরকে তুমি বলে দিও।
অফিসে যাওয়ার আগে শিলার মুখে কথাগুলো শুনল মামুন। শুনে অবাক হল। তাই নাকি? একথা বলেছে?
শিলা বলল, রেখা তো তাই বলল!
রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে থাপড়ে ওর দাঁতগুলো ফেলে দিই।
নিজের বোনটিকে যত সহজ তুমি মনে কর তত সহজ সে নয়।
আমার ধারণা ছিল, সামান্য অ্যাফেয়ার ট্যাফেয়ার হওয়ার পর সেতু ফসকে যেতে পারে ভেবে ছোকরাটা ওকে পটিয়ে পাটিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। ছোকরাটার সঙ্গে কথা বলে আমার তাই মনে হয়েছে।
ঠিক না।
মানে?
আমার ধারণা দুজনেই তখন সিরিয়াস ছিল। সেতু যে ধরনের মেয়ে, তাকে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলা সম্ভব নয়। সবদিক ভেবেই কাণ্ডটা সে করেছে।
মামুন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, কিন্তু ডিভোর্স ওই ছোকরাকে সেতুর করতেই হবে। ওর কাছে সেতুকে আমরা কিছুতেই দেব না। রেখা কথা বলেছে, এখন বলবে তুমি। দেখা যাক কতদিন সে আমাদের কথা না শুনে পারে।
কিন্তু শিলাকে দেখেই গম্ভীর হয়ে গেল সেতু। বলল, আমি জানি তুমি কী বলতে এসেছ।
শিলা বলল, তুমি অনেক কিছুই জানো। আমার ধারণার চে’ তুমি অনেক বেশি চালাক। তোমার সঙ্গে কোনও কিছুতেই আমি কিংবা রেখা পারব না।
পারবে না তো আস কেন?
আসতে চাই না। তোমার ভাইরা আমাদেরকে বাধ্য করেন।
উষ্ণ সুরে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই নরম হল শিলা। সেতুর কাঁধে হাত দিল। আমরা কেউ তোমার খারাপ চাই না। রাজকন্যার মতো মানুষ হয়েছ তুমি। আমরা চাই সারাজীবন রাজকন্যা হয়েই থাক তুমি। জীবনটা সুখে আনন্দে কাটাও।
যদি তাই চাও তাহলে শুভকে তোমরা মেনে নাও।
তা আমরা নেব না। কারণ ওরা হতদরিদ্র।
পৃথিবীর সবাই কি বড়লোক হয়ে জন্মাবে?
না তা জন্মাবে না।
তাহলে?
ওদের সঙ্গে আমাদের স্ট্যাটাসেও মিলবে না।
টাকা ছাড়া তোমাদের আবার স্ট্যাটাস কী?
একথায় রেগে গেল শিলা। তর্ক করো না। ধরে নাও টাকাই আমাদের স্ট্যাটাস। আজকালকার দিনে টাকা ছাড়া কিছু হয় না। সামান্য চাকরি বাকরি করে ওই ছেলে তোমাকে নিয়ে চলতে পারবে না। এসব ছেলেমানুষি ছেড়ে দাও। সংসারে অভাব দেখা দিলে ভালবাসা থাকে না।
সেতু মৃদু হাসল। এখন যদি আমাদের সংসারে অভাব দেখা দেয়, তুমি কি আমার ভাইয়াকে ছেড়ে চলে যাবে? তোমার ভালবাসা কি নষ্ট হয়ে যাবে?
আমাদের সঙ্গে ওকে তুমি জড়াচ্ছ কেন?
জড়াচ্ছি এজন্য, তুমি তোমার স্বামীকে যেমন ভালবাস, আমিও আমার স্বামীকে তেমন ভালবাসি। কোনও অবস্থাতেই ওকে আমি ছাড়ব না। বেঁচে থাকব ওর হাত ধরে, মরে যাব ওর হাত ধরে।
সেতুর এসব কথা শুনে খুবই বিরক্ত হয়ে নিজের রুমে ফিরল শিলা। মামুন তখনও বেরুয়নি। শিলাকে দেখে বলল, কী হল?
শিলা ঝাঁঝাল গলায় বলল, তোমার বোনের কাছে আমাকে আর কখনও পাঠাবে না।
কেন? সেতু কি তোমার সঙ্গে কোনও দুর্ব্যবহার করেছে?
দুর্ব্যবহার না। যুক্তি দিয়ে চটাং চটাং কথা বলেছে। ওসব কথার জবাব দেয়া মুশকিল। যার সঙ্গে কথায় পারব না তার কাছে আমি যেতে চাই না।
সংসারে কোনও জটিলতা দেখা দিলে বড়দেরকেই সামলাতে হয়। তুমি বাড়ির বড় বউ, কিছু ঝক্কি ঝামেলা তোমাকে সামলাতেই হবে।
এটা বোধহয় সামলানো যাবে না।
কেন?
সেতু খুব সিরিয়াস। কিছুতেই তোমাদের কথা সে শুনবে না।
বল কী? তাহলে?
শিলা গম্ভীর গলায় বলল, একটাই পথ আছে।
কী?
সে পথে চললে সমস্যাটা সহজেই মিটিয়ে ফেলা যায়।
মামুন অধৈর্যের গলায় বলল, কিন্তু পথটা কী?
শুভকে মেনে নাও।
মামুন থতমত খেল। শিলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কথা শুনে খুবই রেগে যাওয়া উচিত আমার। কিন্তু আমি এখন রাগব না। শোন সেতুর জায়গায় যদি তোমার মুন্নি হতো তাহলে কি এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে তুমি?
একথায় আবার বিরক্ত হল শিলা। তুমি এবং সেতু একরকম। কথায় কথায় যুক্তি দাও। আমিও যুক্তি দিচ্ছি। মুন্নির ক্ষেত্রে এরকম হলে আমি কখনও হাল ছেড়ে দেব না। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে মেয়েকে ফিরিয়ে আনব। কারণ সে আমার মেয়ে আর সেতু হচ্ছে ননদ। মেয়ে আর ননদ এক নয়।
শিলার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে তার কাঁধে হাত দিল মামুন। অনুরোধের গলায় বলল, আমার জন্য, শুধু আমার জন্য মুন্নি এবং সেতুকে তুমি এক ভাব। সেতুকে তুমি ফেরাও। আমি বেঁচে থাকতে ওর জীবনটা যেন নষ্ট না হয়।
কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল মামুন। স্বামীর চোখের জল দেখে মনটা অন্যরকম হয়ে গেল শিলার।