৬. আগুন

আগুন

সেদিন ছিল ঁবিজয়া দশমী। বিকেল না-হতেই আমাদের বেলতলী গ্রামের সব মেয়েরা, আমার বৌদি-বোনেরা, ভাইঝি-ভগ্নীরা-সবাই এসে জমা হয়েছে আমাদের পুজোমণ্ডপে, মা দুর্গাকে বরণ করতে। তাদের মধ্যে আমার মা-ও ছিলেন। অনেকেরই গায়ে চওড়া লালপেড়ে ধবধবে সাদা শাড়ি। পাড়ের পাশে চমকে জরির কাজ লালের বাহার যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। নিচে সাদা-লালের খেলা বড়োই চমৎকার দেখাচ্ছিল। ওপরে সোনালী-হলদে রঙ মাখা অর্ধেক মুখ জুড়ে, শ্বেতপদ্মের পাপড়ির মতো, দেবীর ডাগর চোখের মণি যেন দুটি কালো কোহিনুর। আমার দৃষ্টি ওখানে যেতেই কয়েক মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল। বৌদের কপালে লাল করমচার মতো মস্ত বড়ো-বড়ো তাজা লাল সিঁদূরের ফোঁটা। পায়ে তেমনই লাল আতা। পাড়টা দিয়ে মাথার খানিকটা ঢেকে মুখের দু-পাশ দিয়ে নামিয়ে দিয়েছে। চাবির গুচ্ছ বাঁধা আঁচল গলায় জড়িয়ে দেওয়ায়, পাড় মুখের বহি:রেখার সঙ্গে সেঁটে গিয়েছে। কুমারী মেয়েদের কালো জামরঙের মোলায়েম চুল পিঠের ওপর লুটিয়ে প’ড়ে কটিদেশের শ্রী আরো ফুটিয়ে তুলেছে। রঙবেরঙের জামা পরা কিশোরীদের ঘন কাজল দিয়ে ঘেরা চোখগুলো বরণের প্রদীপশিখার প্রক্ষিপ্ত আলোকে স্ফটিকের মতো ঝকঝক করছে, আর ঝকমক করছে বৌদের নাকের মুক্তাবসানো নথ্ আর ছোট্ট হীরেগুলো। বাঙালী স্ত্রী-কান্তির দুই অনুপম বৈশিষ্ট্য–লাবণ্য এবং কমনীয়তা-এ দুইই যেন ভরা কলসীর মতো পুজোমণ্ডপের মধ্যে উপচে পড়ছে। সব মিলে গোলাপসুন্দরীর রচয়িতা, কালীঘাটের দক্ষ পটুয়া নিবারণ ঘোষের আঁকা একটি মাস্টারপিস্। অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে আমার মা-ও ঠাকুর বরণ করছেন। ঢাক, কাঁসর-ঘণ্টা এবং উলুধ্বনিতে সমস্ত পুজোমণ্ডপটা ক্রমশই উৎসবমুখর চূড়ান্ত মুহূর্তের দিকে এগুচ্ছে। রুপোর-কৌটো থেকে অনেকটা সিঁদুর তুলে আমার মা-র তর্জনী দেবীর কপালের দিকে এগিয়ে গেল। ‘একী! বৈশাখী বিদ্যুতের মতো ঠাকুরের খাঁড়াটা হঠাৎ ঝিলিক মেরে উঠল কেন? চোখে ভুল দেখছি না তো! না, না! এ-সব অলুক্ষুণে কথা মনে আনতে নেই।’ এ-কথা ভেবে, কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক, ব্যাপারটা মা একেবারেই চেপে গেলেন।

কোজাগরী পূর্ণিমার তিন-চারদিন পরে বাবা অসুস্থ হলেন। তেমন কিছু নয়। সাধারণ জ্বর। এভাবে আট-দশদিন কেটে গেল কিন্তু জ্বরের তেমন উপশম নেই। বাড়ির জ্যেষ্ঠদের, বিশেষ ক’রে আমার মেজোকাকা, বড়দা এবং মার চোখেমুখে একটা অব্যক্ত চিন্তার ভাব দেখা দিল। বিক্রমপুরে অজ পাড়াগাঁয়ে তখনকার দিনে কবিরাজি এবং অ্যালোপাথি চিকিৎসা যতটুকু সম্ভব ছিল, তাই করা হ’ল। বাড়ির আবহাওয়ায় কেমন যেন একটা থমথমে ভাব।

‘ওঠ, ওঠ, শিগির ওঠ, এক্ষুনি উঠে পড়!’ এই চিৎকারে এবং অসাধারণ একটা ঝাঁকুনি খেয়ে আমি বিছানায় ধড়ফড় ক’রে উঠে বসলাম। রাত হয়তো তখনো দুটো কি তিনটে হবে। আমার চোখ তখনো বেশ তন্দ্রাচ্ছন্ন। ঐ অবস্থায় দেখি ছোটদি সামনে দাঁড়িয়ে-চোখ লাল, টসে জ্বলের ফোঁটা চোখ থেকে গড়িয়ে দুই গালে সরু পাহাড়ী স্রোতের মতো লাইন কেটেছে। আমাদের হায়-হুঁতাশ ক’রে বললেন, ‘শিগির চলো, বাবাকে শেষ-দেখা দেখে নাও!’ এই ব’লে আমাকে এবং পিঠোপিঠি আমার তিন কিশোর ভাইবোনকে হাত ধ’রে–পশ্চিমের দালানে হড়হড় ক’রে টেনে নিয়ে এলেন। চারদিকে সাংঘাতিক কান্নার রোল উঠেছে। ঘর ভরতি লোকজন। আমি বিস্মিত, স্তম্ভিত এবং বিহ্বল। আমার চোখ খুব ধীরে-ধীরে ঘরের একপাশ থেকে আরেকপাশের দিকে যাচ্ছে। একটা জায়গায় থামতেই দেখি মা বাবার বুকের ওপর মাথা রেখে অসহায় একটি শিশুর মতো চিৎকার ক’রে কাঁদছেন। দেখেই আমার চোখে বন্যা এল। উপস্থিত সবাই কাঁদছে। ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা। সৌম্য, প্রশান্ত-মূর্তি। বেশ তো সুন্দর ঘুমিয়ে আছেন! এত কান্নাকাটি কিসের! পাশের ঘরে গিয়ে কখন যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেরও পাইনি।

ঘুম যখন ভাঙল তখন দেখি ঘরে আর কেউ নেই। আতঙ্কে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। পূবের আকাশে লাল মুলোর রঙ ধরেছে। মাকে খোঁজ করি। পূবের দালানের উঠোনে তাঁকে ঘিরে মেয়েরা কান্নাকাটি করছেন। কেউ-কেউ তাঁকে সান্ত্বনা দেবারও চেষ্টা করছেন। একটু এগোতেই দেখি পুজোমণ্ডপের দক্ষিণ ধারের পুকুরপাড়ে পুরুষদের ভিড়। হাল্কা নীলরঙের স্বচ্ছ একটা ধোঁয়া সবার মাথার ওপর দিয়ে উঠছে। সেটি পাকিয়ে-পাকিয়ে আকাশের রঙের সঙ্গে মিশে ধুতুরাফুলের কেন্দ্রের মতো বেগুনী রঙে রূপান্তরিত হচ্ছে। এক পা, দু-পা ক’রে এগুলাম। ভিড়ের মাঝখান দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতেই দেখি নিচে এবং ওপরে চেলাকাঠ দিয়ে বাবার দেহ ঢাকা। শুধু মুখটা বেরিয়ে আছে। মনে হ’ল কাঠে অল্পক্ষণ আগেই আগুন ধরানো হয়েছে। চিতার পাশে মস্ত বড়ো মাদার গাছটার একটা ডাল নেমে এসে বিলের গাঢ় সবুজ জলের সঙ্গে চুমোচুমি করছে। কয়েকটা ছোটো কচুরিপানা দলচ্যুত হয়ে, হাল্কা বাতাসে কাগজের নৌকোর মতো ভাসতে ভাসতে মাদারের ডালটায় ধাক্কা খেতেই বিহ্বল হয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে রইল। একটা ফড়িং তার ওপর বসতে যাবে আর-কি, ঠিক সেই মুহূর্তে একটু হাওয়া লাগতেই আবার আস্তে-আস্তে পাশ কাটিয়ে চ’লে গেল। একটু দূরে আমাদেরই দু-তিনটে ডিঙি নৌকো ঘাটে বাঁধা আছে। সদ্য আলকাতরা-মাখানো কালো নৌকাগুলো সবুজ জলে প্রতিবিম্বত হয়ে একদিকে সবুজের বৈভব যেমন বাড়িয়ে তুলেছে অন্যদিকে তেমনই তৈরি হয়েছে ঘনকালো রঙের কনভেক্স এবং ককেভের চমৎকার একটি নক্সা

আগুন ঢেউ-খেলে-খেলে শুঁয়োপোকার মতো আস্তে-আস্তে চিতার ওপরের দিকে উঠছে। সামনে আগুনের জাফরানী লাল, আর তারই পেছনে পুকুরের জলের ঠাণ্ডা সবুজ। বাঃ! এ তো ভারী চমৎকার। এত সুন্দর রঙের খেলা এর আগে তো তেমন দেখিনি। এই পটভূমিকায় সমবেত লোকদের ছায়ার মতো কালো কৃশ দেহগুলো, আর তাদের কোমরে বাঁধা লাল গামছা-সব মিলে চমৎকার একটি ছবির মতো দেখাচ্ছে। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা চাপা সুরে কে ব’লে উঠল, বল হরি, হরি বল।’ ধোঁয়ার রঙ এবার নীল থেকে মোষের গায়ের ভুষোকালো রঙ ধরেছে। মাদার গাছটার পাতার আড়ালে, কোথাও কয়েকটা টিয়ে পাখি এতক্ষণ গা-ঢাকা দিয়েছিল। আতঙ্কে উড়ে গিয়ে দক্ষিণপাড়ার শিবমন্দিরটার চূড়ায় গিয়ে বসল। তাদের গলায় এবং বুকেও লাল রঙের ছোপ। আগুন ক্রমশই আরো প্রজ্বলিত হয়ে উপস্থিত সকলের মাথা ছাপিয়ে উঠছে। আগুন! আগুন তো এর আগে কতই দেখেছি–মোমবাতির আগুন, প্রদীপের আগুন, উনুনের আগুন, কর্পূরের আগুন, পাট-খড়ির আগুন, আরো কতরকমের আগুন। এ-সব আগুনই তো মানুষের কত উপকারে আসে। কিন্তু এ তো সে-রকম নয়। এর রঙ আলাদা, এর শব্দ আলাদা, এর গন্ধও একেবারেই স্বতন্ত্র। এর চেহারাটা কী সাংঘাতিক! এর চোখ কামারের কালো নেহাইয়ের ওপর গরম লোহার মতো টকটকে লাল। এর চোখের মণিও তেমনি সদ্য-বলি-দেয়া পাঁঠার মতো থকথকে গাঢ় লালের দুটি পান্না। আর তারই কেন্দ্রবিন্দুতে বোয়াল মাছের চোখের মতো দুটি সাদা হীরের ভেতর থেকে প্রচণ্ড তেজের আলোর রশ্মি-বড়ো-বড়ো রুপোলী আপিনের মতো ঠিকরে পড়েছে। থোকা-থোকা চুলগুলো লাল শরের মতো ওপরের দিকে ছুটছে। যেন কাশবনে আগুন লেগেছে। চোখের নিচটাই-বা কী বিশ্রী দেখতে। যেন পৃথিবীর যত মদোমাতালদের মেদ জমা হয়ে বেলুনের মতো ফুলে উঠেছে। তার হাঁ-করা মুখের ভেতরটাও ক্ষুধিত কাকপক্ষীশাবকের মতো। কুশ্রী একটা তাজা ক্ষতের রঙের বিশাল গহ্বর। সেই গহ্বর থেকে তার লক্‌ব্লকে জিভটা একটা লাল কীর্তিনাশা নদীর মতো তড়িৎবেগে নেমে এসেছে, নতুন ডাঙা খুঁজছে যেন। পেলেই তাকে মুহূর্তের মধ্যে চেটে সাফ্ ক’রে দেবে। মাঝে-মাঝে জিভটাকে সুড়ুৎ-সুড়ুৎ আওয়াজে গুটিয়ে নিয়ে যেই-না ভেতরে ঢোকাচ্ছে, তক্ষুনি সাদা ইস্পাতের তৈরি গিলোটিনের মতো তার দাঁতগুলো ঝড়ের বিদ্যুতের মতো ঝিলিক্ মেরে উঠছে। একেকটা দাঁতই যেন একেকটা পাটি। গাছপালা, পাহাড়পর্বত, মানুষজন, যা-ই সামনে পাবে, চিবিয়ে, গুঁড়িয়ে কিমার মতো কুচিয়ে দেবে। বহুশীর্ষ সাপের ফণার মতো আগুন নাসারন্ধের অন্ধকার গুহার ভেতর পাকিয়ে-পাকিয়ে বেরিয়ে এসে যেন হয়েছে তার বিরাট-একটা নয়, কয়েকটা-গোঁফজোড়া। শকুনির চোখের মতো গোল-গোল লাল পাথর বসানো দুই মাকড়ি কান থেকে ঝুলে কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। ঐ চোখগুলো যেন পৃথিবীর সব মৃতদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।

ভিড়ের মধ্য থেকে কে-একজন একটা লাঠি দিয়ে আগুনটাকে খুঁচিয়ে দিল। আগুনও কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে পড়ে না কি! তাকেও কি বর্শার ফলকের খোঁচা মেরে জাগিয়ে দিতে হয়। মাতালকে মাতাল বললে সে যেমন ক্ষেপে ওঠে, আগুনও তেমনি সাংঘাতিক রকম ক্ষেপে উঠল। তার সেই গিলোটিনের মতো দাঁতগুলো ঘ’ষে-ঘ’ষে এমন বিকট আওয়াজ বের করতে লাগল যে, তার স্পন্দনে সব-কিছু কেঁপে উঠল। আমার পায়ের তলার মাটিটাও। পাশেই বাহির-বাড়ি ঘরের থাটা দু- হাত দিয়ে ধ’রে ফেললাম। আমার ভীষণ ভয় করছে। কী ভয়ংকর এর চেহারা। এ কি সেই অগ্নি-যার ক্রোধের ঘনঘটার গভীর গর্জনে সমস্ত খাণ্ডব বন কেঁপে উঠেছিল? যার উত্তাপে হাজার-হাজার পশু ভয়ানক চিৎকারে ঊর্ধ্বশ্বাসে দিক্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে গিয়ে–অর্ধদগ্ধ অবস্থায় এবং গলিত নয়নে বিশীর্ণ হয়ে গিয়েছিল? এ কি সেই হুতাশন যার ঘূর্ণিহাওয়ায় পালিয়ে-যাওয়া ঈগল, চিল, শকুনদের বিরাট ডানাগুলো দাউ-দাউ ক’রে জ্ব’লে উঠে, পাক খেতে-খেতে খান্ডবের অগ্নিকুণ্ডে পুড়ে ভস্ম হয়ে গিয়েছিল? এবং দুর্যোধন কি এই সর্বগ্রাসী আগুনকে মনে ক’রেই নিরপরাধ, সমাতৃক পাণ্ডবদের জতুগৃহে আগুন লাগিয়ে তাদের পুড়িয়ে মারবার মানস করেছিল?

হঠাৎ বাবার মুখমণ্ডলের দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভেতরটায় ধপাস ক’রে যেন একটা পাথর পড়ল। বাঘের মতো চেহারাটায় অমন ক’রে কে বিশ্রী কালো রঙ মাখিয়ে দিল? অত বড়ো ডাকসাইটে মুখটা এরই মধ্যে একটা পোড়া বেলের মতো কুঁকড়ে গেল কী ক’রে? না! না! এ-দৃশ্য আমি দেখতে পারছি না।

‘মৈনমগ্নে বিদহ মাভিশোচ মাস্য ত্ব চে
চিক্ষিপো মা শরীরম্’…

হে আগুন। তোমার পায়ে পড়ি। দোহাই তোমার! তুমি এই মৃত লোকটিকে একেবারে ছাই কোরো না। এঁকে কষ্ট দিয়ো না। এঁর চামড়া বা এঁর শরীর এমনভাবে ছিন্নভিন্ন করো না। আগুনের এই ভয়ংকর চেহারা তো দেখছি সেই নরকের আগুনের মতোই। যার ছবি দেখে একদিন ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। অনেক দুঃস্বপ্ন দেখে নিদ্রাহীন রাত কাটিয়েছিলাম। দেখেছিলাম সে-অগ্নিকুণ্ডের ওপর বিরাট টগবগে তেলের কড়াইয়ে-পৃথিবীর পাপীরা মুসুরির ডালের মতো সেদ্ধ হয়ে মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। সেই টগবগে আওয়াজ যেন আমি এখনো শুনতে পাচ্ছি।

একটা মাটির মাল্সা থেকে বড়দা কয়েক হাতা ঘি চিতায় ছিটিয়ে দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গেই আগুন একটা আহত হিংস্র বাঘের রূপ ধারণ করল। যেন দাঁতমুখ পট্- পট্-পটাশ। কাঠের আগুনের মধ্যেও কি বিস্ফোরক মেশানো আছে? এই শব্দের সঙ্গে-সঙ্গেই আগুনের স্ফুলিঙ্গগুলো ছুঁচোবাজির মতো চারদিকে ছুটছে। ভয়ে চিতার পাশের লোকেরা দু-হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। পুকুরের দক্ষিণ দিকে কয়েকটা বড়ো আমগাছ ছিল। আগুনের এই ভয়ংকর মূর্তি দেখে, আর শব্দ শুনে সেখানকার দাঁড়কাকগুলো নিরাপত্তাহীন বোধ ক’রে, ক্রোয়য়াঃ, ক্রোয়য়াঃ, ক্রাঃ, ক্রাঃ চিৎকারে গাছগুলোর চারপাশ দিয়ে উড়ে বেড়াতে লাগল। যেন তাদের সমস্ত জ্ঞাতিগুষ্টিকে আসন্ন বিপদের সম্ভাবনায় সতর্কবাণী প্রচার করছে। ভয় পাবারই কথা। আবার সেই কানফাটানো আওয়াজ, বুম্‌-পট্-পট্-পটাশ। সেই আওয়াজ গাছের ডালে আর জলে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি করতে থাকল। আখের পাতার মতো লম্বা-লম্বা আগুনের শিখাগুলো একটু সামান্য হাওয়া লাগতেই কাত্ হয়ে, দোল খেয়ে, গাছগুলোকে লক্ষ ক’রে দক্ষিণের দিকে ছোটে। ক্রোয়াঃ, ক্রোয়াঃ, ক্রাঃ, ক্রাঃ! দেখতে-না-দেখতেই ছোটো কাক, শালিখ, চড়ুই, পানকৌড়ি, চিল, শকুন, শ্যামাপাখি-রাজ্যের যত পাখিরা আকাশে উড়তে আরম্ভ করল।

‘পর্বতপ্রমাণ অগ্নি ভয়ংকর দেখি।
পিঞ্জর সহিত পোড়ে পোষনিয় পাখী।।
শারীশুক্ কাকাতুয়া সারস সারসী।
নানাজাতি বিহঙ্গ পুড়িল রাশি রাশি।।’

ঠাকুরমার কাছে হনুমানের লঙ্কাদাহনের বীভৎস কাহিনী শুনেছিলাম। সে ভয়ংকর দাবানলে নাকি শতশত হাতি-ঘোড়া, ময়ূর-ময়ূরী, ময়না, টিয়েপাখি এবং আরো হাজার রকম রঙবেরঙের পাখি পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল।

চিতার আগুন আরো লম্বা হয়ে, শাঁই-শাঁই ক’রে উঠে আমাদের গ্রামের এই নিরীহ পাখিগুলোর এই দশা করবে নাকি! হে ভগবান! দোহাই তোমার! ওদের যেন এ-সর্বনাশ না হয়! ভাবতেও আমার বুকের ভেতরটা বিলিতি ঢাকের মতো ঢুমটুম ক’রে বাজছে। আমি তাড়াতাড়ি বাহিরবাড়ির নিচু দাওয়ায় ধপ্ ক’রে ব’সে পড়লাম।

বড়দা আবার বেশ-খানিকটা ঘৃতাহুতি করবার সঙ্গে-সঙ্গেই আগুন এক বিরাট কুণ্ডের রূপ ধরল। আগুন যেন এবার এক আগ্নেয় গিরির গহ্বর থেকে উঠছে। কুচকুচে কালো ধোঁয়ার-রেখায়-ঘেরা আগুনের রঙ এমনই লাল বৈভবে পরিপূর্ণ, এমনই তার জেল্লা যে, আমি আর তাকাতে না-পেরে দু-হাত দিয়ে চোখ ঢেকে হাঁটুর ওপর মাথা গুজলাম। কী অদ্ভুত! কী আশ্চর্য! চোখ বুজতেই স্পষ্ট দেখি ঘন অন্ধকারের গহ্বরের মধ্যে আগুনের সেই শিখাগুলো ঠাণ্ডা সবুজ রঙ ধরেছে। এ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা! এর বিপরীতটাও কি তাহলে সম্ভব! কত ভোরের আলোতেই তো আমাদের পুকুরঘাটে ব’সে, তার উল্টোদিকে বৃষ্টিধোয়া তাজা সবুজ রঙের কলাবাগানটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছি। চোখে পোকা কিংবা ধুলোর কণা ঢোকায় অকস্মাৎ কতবারই তো চোখ বুজেছি। কই! কখনো দেখিনি যে, কলাগাছগুলো আগুনের রঙ ধরেছে! এই লাল রঙটা আমার চোখের স্নায়ুগুলোর ওপর এক আজব প্রতিক্রিয়া ঘটায়। দীর্ঘ শিল্পীজীবনে রামধনুর সবচেয়ে শক্তিশালী এই বর্ণচ্ছটার সঙ্গে যখনই মোলাকাৎ হয়েছে তখনই চোখে অন্ধকার দেখেছি। তবুও তাকে আজ পর্যন্ত আমার প্যালেট থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। এমনই সাংঘাতিক তার আকর্ষণ শক্তি।

নেহাৎ ছোটোবেলায় আমাদের বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই, নিতান্ত আপনজনের চিতায় সেই-যে ভয়ংকর আগুন দেখলাম, তা সারা জীবনের মতো আমার শিল্পী মনের ওপর একটা গভীর ছাপ রেখে দিয়ে যায়। একবার এই আগুনের রঙে একটা একরঙা ছবি আঁকতে গিয়ে মাথার মধ্যে কী যে বিপর্যয় ঘটে গেল বুঝতে পারলাম না। মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। সাধে কি এই রঙকে সাংঘাতিক সব বিপদ-আপদ, যুদ্ধ-ধ্বংস, বিদ্রোহ-বিপ্লবের প্রতীক মনে করা হয়? আমি যতদূর জানি, একালের আরো দু-জন চিত্রশিল্পী আগুনের ভয়ংকর সম্মোহনী শক্তিতে সম্পূর্ণরূপে অভিভূত হয়েছেন। একজন মেক্সিকোর রুফিনো তামায়ো এবং অন্যজন আমেরিকার বেন্ শান্– এ দুজনই আগুনের ভয়ংকর সব ছবি এঁকেছেন।

রঙের রাজা তামায়ো-র আঁকা আগুনের ছবিগুলোতে লাল-সোমরসের লাল, পোড়া-ইটের লাল, শরতের বার্চ, ডগ্‌ উড্ আর মেপেল বৃক্ষের লাল, এমনই হরেকরকম লালের ব্যবহার দেখে শুধু শিল্পীদের এবং শিল্পরসিকদেরই নয়, একটি সরল অনভিজ্ঞ শিশুরও তাক লেগে যায়। বেন্ শানের ছবিতে শুধু আগুনের ভয়ংকর গম্ভীর রাজকীয় রুদ্রমূতি–তার মুখমণ্ডলে এমনই চোখ-ধাঁধানো সোনালী এক দীপ্তি যে, সিংহের কেশরের মতো অগ্নিশিখায় ঘেরা তার মুখ কালো কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখতে হয়–যেমন করে দেখি আমরা গ্রহণের সময় সূর্যকে। আবার কখনো আগুন তাঁর ছবিতে এক বিরাট আদিম পশুর রূপ ধারণ করছে যার হাঁ-করা করাল বদনের লোল জিহ্বা পৃথিবীর সব জীবদের লাল রক্ত নিঃশেষে শুষে নিয়েছে- তার সেই লক্লকে জিভ, তার বিকট চোখ-মুখ-কান, হিংস্র ঠ্যাং-ল্যাজ–বস্তুত সমস্ত শরীরটাই প্রখর গ্রীষ্মের জলন্ত সূর্যের অন্তকালীন রঙ দিয়ে আঁকা, যেন তার শরীর শুধু কাঁচা মাংসের তৈরি, অনাবৃত, চর্মহীন। এমন-কি তার পায়ের নখগুলো পর্যন্ত বৃশ্চিকের বিষের থলির মতো লাল গরলে পূর্ণ। শুনেছি শৈশবে তাঁদের নিজেদের বাড়ির অগ্নিকাণ্ডে ধরা প’ড়ে যে সাংঘাতিক ভয় পেয়েছিলেন, এ-ছবি সেই নিদারুণ অভিজ্ঞতারই অসাধারণ অভিব্যক্তি। সে-ছবি রূপে যেমন ভয়ংকর, তেমনই সম্মোহনী।

ছবির সুত্রে আরেকজন শিল্পীর কথা এ-প্রসঙ্গে মনে আসছে। আগুন মানে তো শুধু রূপ আর রঙ নয়, আগুন মানে আলোও বটে। ছবির বেলায় আলোর ভূমিকা একটা প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আলো যে কখনো-কখনো কত ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, তা হঠাৎ যে কারো চোখে ধরা পড়তে পারে। সেদিন অন্তত আমার তা-ই মনে হয়েছিল। আমার কাছে আজও তা সমান সত্য। অনেকক্ষণ চোখ বুজে থাকার পর মাথা উঁচিয়ে মাদার গাছটার দিকে তাকতেই চোখ ঝলসে গেল। সুর্য গাছটার প্রায় মাথার ওপর এসেছ। তার রশ্মিগুলো সদ্য-ছাঁচে-ঢালা ইস্পাতের ছুঁচের মতো সোজা হয়ে সামনের পুকুরটাতে এসে ধাক্কা খেয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পুকুরটাকে মনে হচ্ছে সূর্যের মুখোমুখি রাখা একটা বিরাট আরশি। তলা থেকে এই আলোতে আশেপাশের গাছগাছালির ডালপালাগুলো মুনিয়া পাখির বুকের পালকের মতো তামার রঙ ধরেছে। চিতার কাছের লোকজনদের নাকের ডগায়, থুনিতে এবং চিবুকের হাড়ে এই আলো লেগে মুখগুলো একেকটা জাপানী নৃত্যের মুখোশের মতো দেখাচ্ছে। সবার চোখ এই প্রক্ষিপ্ত আলোর ঝলকানিতে এমনই সংকুচিত হয়ে গেছে যে, মনে হচ্ছে চোখ নয় তো যেন নরকঙ্কালের দুটি কালো গর্ত। নিচে থেকে প্রক্ষিপ্ত এই নাটকীয় আলোতে কোন্ মানুষের চেহারাই-না বিকৃত এবং ভয়ংকর দেখায়! বহুদিন পরে একজন য়ুরোপীয় শিল্পীর কাজ দেখে, আবার চিতার পাশে দেখা সেই বিকৃত মুখোশের মতো মুখগুলোর কথা আমার মনে পড়ে গিয়েছিল। বিখ্যাত স্প্যানিশ শিল্পী গোহয়া’র বিদ্রোহ সংক্রান্ত ছবিগুলোর কথা বলছি আমি। তাঁর ওই ছবিগুলোতে তিনি এমনই বিচ্ছুরিত আলোর আশ্চর্য ব্যবহার করেছেন।

ঠিকরে-পড়া আলো আর সরাসরি আলোর মধ্যে বিপুল পার্থক্য আছে–দু-রকম আলো দর্শকের মনে দু-রকম প্রতিক্রিয়া জাগায়। দান্তের লেখা ‘দি ডিভাইন কমেডি’ নামক মহাকাব্যে পরমসত্তাকে বর্ননা করা হয়েছে সরাসরি চোখ-ধাঁধানো আলো রূপে, মহাজ্যোতিই হ’ল সর্বোচ্চ দিব্যতার স্বরূপ, যার সামনে মহাকবি আপনিই অন্ধ হয়ে গেছেন। কোন্ মানুষ তার চোখ খুলে থাকতে পারে একাধিক সূর্যের দিকে?

‘And suddenly, as it appeared to me
day was added to day, as if He who can
had added a new sun to Heaven’s glory.‘

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, দান্তে যে-রকম অদ্ভূত অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, আমাদের দেশের মহাসাধক ঠাকুর রামকৃষ্ণের বেলাতেও তেমনই অভিজ্ঞতার কথা পাই। মহামায়ার কৃপায় একদিন ঠাকুর দেখলেন, ঘরের কোণের ছোট্ট প্রদীপের আলোটি ধীরে-ধীরে প্রদীপ্ত থেকে আরো প্রদীপ্ত হয়ে সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডকে উদ্‌ভাসিত ক’রে তুলল। সেই আশ্চর্য আলো তাঁর অন্তরে প্রবেশ ক’রে সমাধি অবস্থায়, এক দিব্য জ্যোতির মতো তাঁর দেহ থেকে চারদিকে বিচ্ছুরিত হতে লাগল। সেই জ্যোতি কি আগুন ছিল না আলো ছিল? না বৈশাখী জড়ের বিদ্যুৎ! এই অবস্থাতেই তো শ্রীমান নরেনের বুকে পা ছোঁয়াতেই প্রিয় শিস্যর সমস্ত চৈতন্য চকিতে লুপ্ত হ’ল।

শ্রীনরেন্দ্রনাথ দত্ত তখনো স্বামী বিবেকানন্দ হননি, তখনো তিনি দিগ্বিজয়ী হননি। কিন্তু দিগ্বিজয়ী বীর অর্জুনও যে শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ দেখে, ক্ষণিকের জন্যে সম্পূর্ণ বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন সে কথা আমরা মহাভারতে পাই। তখন কী ছিল কৃষ্ণের স্বরূপ? কী দেখে অন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে অর্জুন আর্তনাদ ক’রে উঠেছিলেন,

‘তব ইদম্ উগ্রম্ অদ্ভুত রূপং দ্রষ্টা
লোকত্ৰয়ং প্রব্যথিতম্।’

কৃষ্ণের সেই ভয়ংকর রূপ দেখে শুধু অর্জুনের চোখই ঝলসে যায়নি, স্বর্গ-মর্ত- রসাতল–এ তিন লোকই সাংঘাতিক বিচলিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ভক্তের দুর্দশা দেখে ভগবান, স্বয়ং তক্ষুনি তাঁর পরমভক্তকে দিব্যদৃষ্টি দিয়েছিলেন। তবু ভীষণ সাংঘাতিক সব বিকটদংষ্ট্রা দ্বারা বিকৃত, প্রলয়ের আগুনের মতো জ্বলন্ত, ভগবান কৃ ষ্ণের মুখমণ্ডল দেখে অর্জুন নাকি এতই আতঙ্কিত হয়েছিলেন যে, তাঁর দিগ্‌বিভ্রম হতে লাগল। কিছুতেই স্থির থাকতে পারছিলেন না, সহ্য করতে পারচিলেন না। ব্যাকুল হয়ে তিনি দেবেশকে তাঁর সেই ভয়ংকর রূপ সংবরণ করতে মিনতি জানালেন। অমনই জগদাধর ফিরে এলেন স্বাভাবিক রূপে। কিন্তু কেই-বা আমার ঠাকুর রামকৃষ্ণ, কেই-বা আমার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ! কেনই-বা আগুনের এই ভীষণ রূপ প্রকটিত হ’ল। আর কেই-বা করল। কার কাছে আমি মিনতি ক’রে কাঁদব, আমাকে রক্ষে করো। শুধুই কি ভীষণ রূপ? তার সঙ্গে বিচিত্র শক্তি নয়? বিচিত্র শিল্পী নয়? বিচিত্র অস্ফুট মর্মর আর তার হঠাৎ বিস্ফোরণে কোনো দুর্বোধ্য সম্মোহনী মন্ত্রের মতো এক বিচিত্র ধ্বনির আবর্তন নয়?

ভিড়ের ভেতর থেকে কালো, রোগাপটকা, উস্কোখুস্কো চুলওয়ালা সদাকাকা এগিয়ে এসে বাঁশের লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে দিলেন আগুনটাকে। মাল্সার থেকে আরো খানিকটা ঘি বড়দা আবার ছিটিয়ে দিলেন। অমনি আগুন অজস্র রক্ত পিপাসু ধারালো বাঁকা তলোয়ারের মতো শাঁই-শাঁই ক’রে উঠে মাদার গাছটার মগডালটা জ্বালিযে দিতে চাইল। গাছের নিচের ডালপালাগুলোর ছাল ফেটে প্রায় অঙ্গারের রূপ ধরেছে। আবার জায়গায় জায়গায় ভরা-গ্রীষ্মের পিচের রাস্তার মতো ফোস্কা পড়েছে। ঝলসানো খয়েরি রঙের পাতাগুলোর ভেতরকার সুক্ষ্ম শিরা-উপশিরাগুলো নিপুণ হাতের তৈরি লেস্ বা জালিকাজের মতো দেখাচ্ছে। পাতার ভরাট সবুজের আড়ালে যে এত অপূর্ব জঠিল কারুকার্য লুকিয়ে থাকে, কে জানত। একটি অতি সাধারণ, অতি নগণ্য গাছের পাতায়ও যে উঁচু-দরের দক্ষ স্বর্ণকারের এত অসাধারণ কারিগরি থাকে–তা দেখে আমি যতই বিস্মিত, ততই রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম যেমন হয়েছিলেন অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখে। প্রাপ্তবয়সে, এ-যুগের মহান শিল্পী Paul Klee-র জীবনীতে পড়েছিলাম যে উনি শুকনো পাতার ভেতরকার এই জটিল কাঠামো, অতি সযত্নে, দুটি কাঁচের মধ্যে সংরক্ষণ ক’রে রেখেছিলেন। প্রকৃতির এই আশ্চর্য সৃষ্টির নিদর্শনে মোহিত হয়ে তিনি এ-ধরনের–অর্থাৎ সুক্ষ্ম রেখার জালভিত্তিক কয়েকটি অত্যন্ত মৌলিক ছবিও আঁকেন।

আমাদের কাঠুরে কার্তিকচাঁদ আর আমাদের ভুঁইমালী–এ-দু-জন মিলে বেশ কয়েকখানা বড়ো সাইজের চেলাকাঠ চিতার আগুনের ফাঁক-ফাঁকে গুঁজে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘন কালো ধোঁয়া শোঁ-শোঁ ক’রে পাকিয়ে উঠে গাছপালা, আকাশবাতাস আচ্ছন্ন ক’রে দিল। চাটুর তলায় ভুসার মতো কালো এই ধোঁয়ার মাঝে-মাঝে আগুনের ছোটো ফুল্কিগুলো অমাবস্যা রাত্রির তারার মতো ঝম করছে। তারই ফাঁক দিয়ে মাঝে-মাঝে হেমন্তের স্বচ্ছ নীল আকাশ গোলগোল নীল কাঁচের মতো উঁকিঝুঁকি মারছে… “বল হরি, হরি বল।

সদাকাকা, আর বোধ করি তুরতুরাদা দুটো বাঁশ দিয়ে চিতার আগুনকে বেশ ক’রে খুঁচিয়ে দিল। ঝিমিয়ে-পড়া পোষা সাপ যেমন সাপুড়ের খোঁচা খেয়ে ফণা তলে, ল্যাজে ভর ক’রে দাঁড়িয়ে ওঠে, আর ফোঁস ফোঁস আওয়াজে সাপুড়েকে ছোবল মারতে উদ্যত হয়, আগুনও তেমনি শত-শত তুবড়িবাজির মতো হুশ্-হুঁশ্ ক’রে ওপরের দিকে উঠে, বিদ্যুৎবেগে তার মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। কী হিংস্র তার চেহারা! বিশটা নরখাদক বাঘও এর সামনে কিছু নয়। আমার ভেতরটা একটা অজানা আসন্ন আশঙ্কায় ধক্ করতে থাকল।

বড়দা মাল্সাটাকে উপুড় ক’রে অবশিষ্ট সব ঘিটুকুই চিতায় ঢেলে দিলেন। আগুন এবার দাপিয়ে উঠে তার চূড়ান্ত রূপ ধারণ করল। কী সাংঘাতিক। কী ভয়ংকর, কী সর্বনাশা, কী সর্বগ্রাসী তার চেহারা। তার জোড়া-জোড়া চোখ যেন ফুটন্ত লোহার বৈকাল হৃদ। তার মাথার চারপাশের থোকা থোকা কেশরগুলো বিরাট লাল লঙ্কার মতো বাঁকিয়ে উঠেছে। যেন একটা অতিকায় দানব শত-শত মশাল হাতে ক’রে উন্মাদ বক্ররেখার ভঙ্গিতে নাচছে। কী আবোল-তাবোল তার ছন্দ! কী আবোল-তাবোল তার লয়! প্রকৃতির সৃষ্টির মধ্যে এমন-কিছু কি আর আছে যা সামান্য হাওয়ার ছোঁয়াচেই এত মাতামাতি, পাগলামি করে! এ তো ভীম ভৈরবের নাচ! তিব্বতি-তনাকায় বজ্রপাণির চতুর্দিকের সহস্র শিখার আগুনও এর কাছে অতি নগণ্য, অতি তুচ্ছ। তার হাঁ-করা মুখের গহ্বর থেকে এবার-একটা নয়, সাত- সাতটা-আনাভিলম্বিত লক্‌লকে জিভ যেন রক্তের সাতটা পাহাড়ী প্রস্রবণ। তার ভয়ংকর মুখমণ্ডল –চুল থেকে নিয়ে জিভের ডগা পর্যন্ত–সবটাই যেন পৃথিবীর তাবৎ লাল রঙের মিলনক্ষেত্র। রক্তজবার লাল, রক্তকরবীর লাল, পলাশের লাল, শিমুল ফুলের লাল, কৃষ্ণচূড়ার লাল, রঙ্গনের লাল, রডোডেনড্রনের লাল, বকুল-বটফল- লিচুর লাল, শীতের বাদাম পাতার লল, তরমুজের লাল, আবির-আলতার লাল, স্বর্ণসিন্দুর মকরধ্বজের লাল, মোরগের ঝুঁটির লাল, টিয়েপাখির ঠোঁটের লাল-আরো যে কতরকমের লাল, তার হিসেব কে করে! পৃথিবীর সব ইস্পাত কারখানার ফার্নেসের পুঞ্জিত উত্তাপে যেন লালের নির্যাস তৈরি হচ্ছে। আমার পলক পড়ছে না। আমি স্বপ্নাবিষ্ট, অর্ধ-অচৈতন্য।

আগুন যেমনই ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতর হতে লাগল, তেমনি আকারেও বৃহত্তর হতে থাকল। খুব ছোটোবেলায়, রূপকথার গল্পে, এক আদিম দৈত্যের কথা পড়েছিলাম। সেই দানব তার প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে একটা গ্যাসভর্তি বেলুনের মতো ফুলে-ফুলে উঠে সমস্ত বায়ুমণ্ডলকে ছেয়ে ফেলল। এই আগুনও তেমনি তার নিশ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বাড়তে-বাড়তে লাফাতে-লাফাতে আমাদের গ্রামের সব গাছগুলোতে সব কুড়েঘরের চালার খড়কুটোতে ছড়িয়ে পড়বে নকি? কী সর্বনাশ! তাহলে কী হবে? ভাবতেও আমার মেরুদণ্ড সিরসির করছে। আমার কপালে জলবসন্তের গুটির মতো অসংখ্য ফোঁটার ঘাম জমছে।

কিছুদিন আগে আফ্রিকার জন্তু-জানোয়ারের একটা সিনেমা দেখেছিলাম। দেখে যেমন আমার পঞ্চেন্দ্রিয়তে রোমাঞ্চের তরঙ্গ উঠেছিল তেমনি বয়েছিল আতঙ্কেরও। একটা ক্ষুধার্ত সিংহ একদল জেব্রাকে তাড়া করছে। জেব্রাগুলো স্বভাবতই সিংহের কবল থেকে নিজেদের রক্ষে করবার উদ্দেশ্যে মরি-কি-বাঁচি ক’রে ছুটে পালাচ্ছে। দলের মধ্যে সবচেয়ে শেষের জেব্রাটি পেছন-পানে তাকিয়ে, সিংহটা কতটা দূরে আছে দেখতে যাবে আর-কী, ব্যাস্! তার সঙ্গে একেবারে চোখাচোখি হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে সাদা-কালো ডোরাকাটা জন্তুটা যেখানে ছিল সেখানেই জ’মে গেল । বাপরে বাপ্! পশুরাজের চোখের কী সাংঘাতিক মোহিনী শক্তি। কী লোলুপ দৃষ্টি তার। আমার আতঙ্কিত বুকের ভেতরটা রেলগাড়ির চাকার মতো ধক্-ধক্ করতে লাগল। আমার নিশ্বাস দ্রুততর হতে থাকল। আমার চোখ বিস্ফারিত, স্থির, ইস্কুপ দিয়ে কেউ আটকে দিয়েছে। আগুনের সঙ্গে আমারও যে চোখাচোখি হ’ল। কী আক্রমণাত্মক তার চেহারা! আফ্রিকার এই নিরীহ জেব্রাটার মতো আমাকেও কি আগুন তার উদরে পুরে দেবে নাকি? হে অগ্নিশ্রেষ্ঠ হে হুতাশন, হে দীপ্তিমান অগ্নি, হে জ্যোতির্ময় অগ্নি, হে সৰ্বদৰ্শী অগ্নি, হে পাপনাশক অগ্নি, হে সৰ্বভূতজ্ঞ অগ্নি, হে শুভ্রদীপ্ত, হে বৈশ্বানর, হে অঙ্গিরাশ্রেষ্ঠ, হে শত্রুহন্তা, হে প্রজ্ঞাবান্। আমি জানি তুমি প্রবৃদ্ধ, তুমি অভীষ্ট ফলসাধক, তুমি সত্যভূত। তুমি যজ্ঞের মহান্ নেতা। তুমি তোমার যজমানদের কত অভিলষিত ধন দান কর, পুত্র-পৌত্রাদি দাও। তুমি ক্রতুর ন্যায় উপকারী। আমি! আমি!… আমি তোমার যজ্ঞের বেদী তৈরি করব। তোমাকে কুশের আসনে উপবেশন করাব । আমি তোমাকে প্রতিদিন তিনবার হব্য দান করব। তুমি সকলের ধারক, তুমিই মনুষ্যলোকের পালনকর্তা। তুমি এই অসহায় নাবালকের সব দোষ ক্ষমা করো। আমার অসহ্য জালা-যন্ত্রণা, আমার সকল দাহ জুড়িয়ে দাও । আমাকে আমার মা-র কাছে ফিরে যেতে দাও।

ভয়ে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। না, না! আমি পালাই। আমি পালাই। কিন্তু আমার পা নড়ছে না কেন? আমার পায়ে যেন জগদ্দল নেমেছে। আমার পা অসাড়। আমার পা বটগাছের শেকড়ের মতো পাতালে প্রবেশ করেছে। আমার হাতও মনে হচ্ছে যেন আস্তে-আস্তে শিথিল হয়ে আসছে আমি তাড়াতাড়ি দু-হাতে আমার সর্বশক্তি দিয়ে পা-দুটোকে টানছি। কিন্তু কিছুতেই এতটুকুও নড়াতে পারছি না। আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বড়দা, সদাকাকা, হীরাদা, ধনদা, তুরতুরাদা, খোকাদা, চিনিদা, কার্তিকচাঁদ, ভূঁইমালী এবং সমস্ত শ্মশানবন্ধুরা, আর অতি নিকট আমাদের পোষা কুকুর ভোলা-এদের সবাইকে কি এই সর্বনাশা আগুন গ্রাস ক’রে ফেলবে? আর আমি! আমার দিকেই তো আগুনটা কখন থেকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আমার দিকেই তো ভ্রুকুটি ক’রে, দাঁত কড়মড় ক’রে–এগিয়ে আসছে। আমি ঝড়ের রাতের কিশলয়ের মতো কাঁপছি। না, না! যেমন ক’রেই হোক এই আসন্ন বিপদ থেকে পালিয়ে আমাকে বাঁচতেই হবে। যেমন ক’রেই হোক আমাকে আমার মা-র কাছে ফিরে যেতেই হবে। আমার স্নায়ুকেন্দ্র ঝিঁঝিন্ করছে। আমি নিরুপায়! মাগো, তুমি কোথায়? কিন্তু গলা দিয়ে যে একটুও আওয়াজ বেরুচ্ছে না। আমার বুকের ভেতরটা কে যেন দুড়ে-মুচড়ে থেঁতলে দিচ্ছে। আমি পালাই আমি পালাই। উঃ… আমি … পা … লা… ই…।

হঠাৎ দূর থেকে মা-র কান্নার ক্লান্ত করুণ সুর কানে ভেসে এল। এ তো কান্না নয়। এতো অভয়বাণী! এই সুরে আমার মনের ময়ূর নেচে উঠল। আমি মুক্তির আভাস পেলাম। মা, মা! আমি আসছি। আমি … এই… এলাম!

একপাশে দশমাসের ছোট্ট শিশুভাই। আরেকপাশে মা-র কোলে আমার মাথা। “আমার শরীর অবসন্ন। আমার ভীত, রক্তাক্ত, দাহ্যমান বুকের ভেতরটার সব স্ফুলিঙ্গ নিভে গেছে। সব অন্ধকার দূর হয়ে গিয়ে জ্যোৎস্নার আলো প্রবেশ করেছে। মার চোখের টাকা গরম কয়েক ফোঁটা জল আমার মুখের ওপর পড়ল। সে তো অশ্রু নয়, মরুভূমির বুকে আষাঢ়ের প্রথম বারিধারা। এক হাতে তাঁর ডানদিকের স্তনকে শিশু ভাইয়ের মুখে ধরে আছেন। অন্য হাতে আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আঃ! কী ঠাণ্ডা! আঃ! কী আরাম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *