০৬.
অষ্টমী পুজোর দিন সকাল থেকেই মেঘলা। বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে মেঘলা আরও ঘন হয়ে এল। বৃষ্টি যেন মেঘের নিচে দাঁড়িয়ে আছে–যে-কোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়বে। এরই মধ্যে ফকির রায়দের ঠাকুর-দালানে পুজো চলছিল। ঢাক বাজছে, ফকিরদের বুড়ো পুরোহিত পুজোয় বসেছেন, অন্দরমহলের লোকজন বাইরে, ঠাকুর-দালানে, গ্রামের অনেকেই এসেছে পুজোতে। কলকাতার বারোয়ারি পুজো নয়, গ্রামের বাড়ির পুজো, তারাপদ একপাশে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ পুজো দেখল। ভালই লাগছিল তার। শহুরে জাঁকজমক নেই, অথচ কিসের যেন এক সাদামাটা সৌন্দর্য রয়েছে।
শেষ পর্যন্ত তারাপদ ঠাকুর-দালান ছেড়ে চলে এল। ঘরে গেল না। কাছাকাছি খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করার জন্যে বেরিয়ে পড়ল। বৃষ্টি আসতে পারে। এলেও ক্ষতি নেই। কাছাকাছি থাকবে তারাপদ।
ফকির রায়দের বাড়ির শ’খানেক গজের মধ্যেই গ্রাম। বোধ হয় গ্রামের শুরু, কেননা, যত পুব দিকে যাওয়া যায় ততই ঘরবাড়ি বেশি করে চোখে পড়ে। পাকা বাড়ি, কাঁচা বাড়ি, দুরকম বাড়ি রয়েছে। চোখে দেখলে মনে হয়, নিতান্ত ছোট গ্রাম নয়। তিরিশ-চল্লিশ ঘর লোকের বসবাস তো নিশ্চয়। কোথাও আকন্দগাছের বেড়া, কোথাও কাঁটাগাছের, বাঁশের খুঁটি আর কাঁটাতার দিয়েও কেউ-কেউ বেড়া বেঁধেছে, নানা ধরনের গাছপালা, শিউলী করবী জবা, কোথাও লাউ কিংবা কুমড়োর মাচা। পুজো বলেই বাড়ির সামনে দাওয়া নিকোনো, গ্রামের মুদির দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে কেউ কেউ, ময়রা-দোকানে ফুলুরি ভাজা চলছে, একরাশ ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে।
তারাপদ যেন মজা পাচ্ছিল। ফুলুরি খাবার সাধ হলেও সে এগুল না। সময় বুঝে এক বেলুনঅলাও হাজির হয়েছে। কাঁধে কাগজের খেলনা, কাঁধের ঝুলিতে বেলুন, এক হাতে সাইকেলের পাম্প, মুখে একটা বিচিত্র হুইসল। মাঝে মাঝে হুইসল বাজাচ্ছে।
এগিয়ে আসতেই তারাপদ পুকুর দেখতে পেল। খুব বড় না। পুকুরের চারদিকে কিছু গাছপালা। জনা-দুই লোক পুকুরের পাশে সবজি-খেতে কাজ করছে।
আরও সামান্য এগুতেই পেছন থেকে যেন কে ডাকল। দাঁড়াল তারাপদ। ঘর তাকাল।
বাউল বৈরাগী গোছের কে একজন এগিয়ে আসছে। বোধ হয় গাছপালার আড়ালে ছিল–চোখে পড়েনি।
কাছে এসে লোকটি তারাপদকে দেখল সামান্য, তারপর হাত জোড় করে নমস্কার করল। ”বাবু লতুন বটে। চিনতে লারছি।”
তারাপদ লোকটাকে নজর করতে লাগল। বয়েস হয়েছে। একমাথা বাবরি চুল। জট পড়েছে যেন। মুখে দাড়ি, অর্ধেক সাদা হয়ে গেছে। গায়ে একটা আলখাল্লা ধরনের জামা। হয়ত কোনোকালে কালো জামাটার রঙ গেরুয়া ছিল, এখন মাটির মতন রং ধরেছে। পায়ে ছেঁড়া-ফাটা চটি। লোকটা মাথায় লম্বা। তবে রোগা। মুখের আদলও লম্বা। সাদামাটা নিরীহ মুখেই তাকিয়ে ছিল লোকটা।
তারাপদ বলল, “হ্যাঁ, আমি নতুন।”
“কুথা থেকে আসছেন বটে?”
“কলকাতা।”
“কে আছেন হেথায়? লিজের লোক?”
“ফকিরবাবুর বাড়িতে উঠেছি। তুমি এখানে থাকো?”
“আজ্ঞা না। আমার গাঁ দামড়া। চতুর্দিকেই ঘুরি ফিরি।…বাবু ঘুরতে এসেছেন?”
“হ্যাঁ, বেড়াতে।”
“একা বটে?”
“না,” মাথা নাড়ল তারাপদ।”সঙ্গে লোক আছে বলেই তারাপদ হঠাৎ কেমন সাবধান হয়ে গেল। সন্দেহের চোখে লোকটাকে দেখল।”তোমার নাম কী?”
লোকটা আচমকা কেমন থতমত খেয়ে গেল। মুখে একই রকম হাসি। সামান্য যেন শুকনো দেখাল হাসিটা। তারপর বলল, “আমাদের নির্দিষ্ট ডাক আই, বাবু। যে যেমন ডাকে। কেউ হাঁকে খেপা, কেউ ডাকে বোরেগি। আমার নাম শশিপদ পঙ্খি।”
তারাপদ হাসির মুখ করল।”বাঃ, বেশ নাম।”
আরও দু-একটা মামুলি কথার পর তারাপদ আকাশের দিকে তাকাল। বলল, “বৃষ্টি আসবে। আমি চলি।”
শশিপদ দাঁড়িয়ে থাকল। তারাপদ ফিরতে লাগল। অনেকটা এগিয়ে এসে পেছন ফিরে তাকাল একবার, দেখল, শশিপদ পুকুরের দিকে চলে যাচ্ছে।
তারাপদ খুব সময়ে বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিল। বৃষ্টি নেমে গিয়েছে। দু-চার ফোঁটা জল গায়ে মাথায় মেখে তারাপদ কিকিরার ঘরে গিয়ে হাজির।
কিকিরা জানলার কাছে চেয়ার টেনে বসে আছেন। সামান্য তফাতে টেবিলের ওপর একটা বন্দুক পড়ে আছে।
তারাপদ বেশ অবাক হল। বন্দুক কেন ঘরে! কার বন্দুক?
“ঘরে বন্দুক কেন, কিকিরা?” তারাপদ বলল।
কিকিরা খুবই অন্যমনস্ক। কিছু ভাবছেন। আজ সকালেও তারাপদ। কিকিরাকে অন্যমনস্ক দেখেছে।
তাকালেন কিকিরা। ”বেড়ানো হল?”
“হ্যাঁ, তা হয়েছে। কিন্তু বন্দুক সামনে রেখে বসে আছেন কেন?”
“দেখছিলাম। বোসো।”
জলের ছাট এদিকের জানলায় আসছে না। বাইরের কালচে রঙ আরও ঘন হয়ে বৃষ্টি বেশ জোরেই নেমেছে।
তারাপদ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। বলল, “ফকিরবাবুর বন্দুক?”
মাথা নাড়লেন কিকিরা। “না। আমার।”
“আপনার বন্দুক? আপনার বন্দুক হল কবে?” তারাপদ বিশ্বাস করতে পারছিল না। আবার একবার বন্দুকটার দিকে তাকাল।
কিকিরা বললেন, “ওটা আমারই বন্দুক। ম্যাজিক বন্দুক বলতে পারো। ম্যাজিক দেখবার সময় দরকার হত। বাইরে থেকে কিছু বুঝবে না। ভেতরে তেমন কিছু নেই।”
তারাপদ নিশ্বাস ফেলল।”সত্যি বন্দুক তা হলে নয়। ওটা আপনি আনলেন কেমন করে? সঙ্গে তো দেখিনি?”
“ট্রাংকে ছিল। খোলা যায় পার্টসগুলো।”
“সত্যি কিকিরা, আপনি মিস্টিরিয়াস” তারাপদ হেসে ফেলল। কালো ট্রাংকটায় কি ম্যাজিকের জিনিস ভরে এনেছেন?”
“কিছু কিছু এনেছি। দাও, একটা ধোঁয়া দাও।”
তারাপদ সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই দিল ককিরাকে। দুজনেই সিগারেট ধরাল।
তারাপদ বলল, “এবার আপনাকে আমি সারপ্রাইজ দেব। খানিকটা আগে একজনের সঙ্গে আলাপ হল। নাম শশিপদ পঙ্খি। বলল, বৈরাগী।”
তাকালেন কিকিরা। “এই গ্রামের লোক?”
“না, ঠিক এই গ্রামের নয় বলল।” বলে তারাপদ শশিপদর সঙ্গে দেখা হবার ঘটনাটা পুরো বলল।
কিকিরা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, “লোচনকে জিজ্ঞেস করলেই বোঝা যাবে, ওই নামে আশেপাশের গ্রামে কেউ থাকে কি না। তা ছাড়া এই গ্রামে আসা-যাওয়া করলে তোক নিশ্চয় তাকে চিনবে।”
“ডাকব লোচনকে?”
“এখন কি তাকে পাবে? শুনেছিলাম, এই সময়টায় সন্ধিপুজো। ফকির তাই বলছিল।”
জানলার বাইরে আরও তোড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘও ডাকছিল। বাইরের দিকে তাকিয়ে তারাপদ বলল, “ফকিরবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?”
“হ্যাঁ। খানিকটা আগে উঠে গেল। স্নান করে সন্ধিপুজো দেখতে যাবে।”
ইতস্তত করে তারাপদ আবার বলল, “কালকের কথা বলেছেন?”
“বলেছি।..ফকির বিশ্বাসই করল না, ঘোড়া-সাহেবের কুঠিতে কেউ থাকতে পারে। বলল, পুরনো বাড়ি, অনেক কিছুই ভেঙেচুরে পড়ে। হয়ত কিছু ভেঙে পড়েছিল।”
“কোথাও কিছু নেই, ভেঙে পড়বে?”
“হতে পারে। তা আমি ঠিক করলাম, আগামী কাল সকালের দিকে আমরা আবার ঘোড়া-সাহেবের কুঠিতে যাব।” বলে মুহূর্তের জন্যে থেমে আবার বললেন, “এবার শুধু তুমি আর আমি নয়। সঙ্গে ফকির থাকবে। নকুলকেও সঙ্গে নেব। বিশুকে নিতে পারলে আরও ভাল হত। কিন্তু তাকে নেবার। উপায় নেই।”
“বিশুকে কেন নেবেন?”।
“ঠিক কোথায়, কোন জায়গায় খুনের ব্যাপারটা ঘটছিল সেটা জানা দরকার। কখনো শুনছি পুব দিকের ঘরে, কখনো শুনছি উত্তর দিকের ঘরের বড় জানলার কাছে। সঠিকভাবে বলতে পারছে না।”
“যে জানালার কাছেই হোক, তফাত কোথায়?”
“তফাত,” কিকিরা তারাপদর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থেকে একটু যেন হাসির মুখ করলেন, “তফাত অনেক। সে তুমি এখনো বুঝতে পারবে না।”
“আপনি বুঝেছেন?”
“না,” মাথা নাড়লেন কিকিরা, “বুঝিনি; বোঝার চেষ্টা করছি।”
তারাপদ চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিল। বৃষ্টির, তোড় কমে এসেছে খানিকটা। শরৎকালের বৃষ্টির অনেকটা এই ধরন।
কিকিরা বললেন, “তোমার সঙ্গে খানিক পরামর্শ করা যাক।…কাল থেকে আজ পর্যন্ত যা দেখলে তাতে কিছু আন্দাজ করতে পারো?”
তারাপদ ভাবল সামান্য। মাথা নাড়ল।”না, আমি কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না। সমস্ত ব্যাপারটাই আমার কাছে অপরিষ্কার।”
“যেমন?”
“প্রথমত ধরুন, ঘোড়া-সাহেবের কুঠি নিয়ে ফকিরবাবুদের মধ্যে রেষারেষি এত বেশি হবে কেন? অন্য পাঁচটা সম্পত্তি যদি তাঁরা ভাগাভাগি করে নিয়ে থাকতে পারেন, এটাও পারতেন। যদি ভাগাভাগিতে রাজি না-থাকতেন, মামলা-মকদ্দমা করতেন–তারপর কোর্টের বিচারে যা হবার হত। মামলা তো ওঁদের হাতের পাঁচ।”
কিকিরা বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ। ফকিররা পাঁচ-সাতটা মামলা তো লড়ছেই, আর-একটা বেশি হলে কোনো ক্ষতি হত না। কিন্তু তারা লড়ছে না। কেন? এর নিশ্চয় কোনো কারণ রয়েছে। কারণটা কী?”
“সে তো আপনার বন্ধু ফকিরবাবু বলবে।”
“ফকির বলছে না। এড়িয়ে যাচ্ছে। ও যা বলছে তাতে মনে হয়, নেহাতই রেষারেষির ব্যাপার। আমার কিন্তু তা মনে হয় না।”
“আপনার কী মনে হয়?”
“ঘোড়া-সাহেবের কুঠির মধ্যে অন্য কোনো রহস্য আছে। সেটা যে কী রহস্য, তা আমি তোমায় বলতে পারছি না।”
“যদি কোনো রহস্য থাকবে–সেটা কি এতকাল পরে জানা গেল?”
কিকিরা বললেন, “বোধ হয় তাই। তা বলে ভেবো না আমি বলছি দু’দশ দিনের মধ্যে জানা গিয়েছে। হয়ত আরও আগে গিয়েছে। তবে খুব বেশিদিন আগে নয়।”
তারাপদ কী মনে করে ঠাট্টার গলায় বলল, “কোনো গুপ্তধনের খবর পাওয়া গিয়েছে নাকি?”
কিকিরা বললেন, “হতে পারে।”
তারাপদ চুপ করে থাকল।
সামান্য পরে কিকিরাই আবার বললেন, “দ্বিতীয় ব্যাপারটা হল, ফকিরের ছেলে বিশু কেন ঘোড়া-সাহেবের কুঠিতে গিয়েছিল?”
কেন গিয়েছিল তারাপদ জানে না, কিকিরাও নয়। ফকিরও বলেছেন, তিনি জানেন না। সত্যি বলেছেন না মিথ্যে বলেছেন, তিনিই জানেন।
তারাপদ যা শুনেছে, তা এই রকম ঘোড়া-সাহেবের কুঠির কাছাকাছি নুনিয়ার এক পাশে এক সাধু এসে আড্ডা গেড়েছিল। বিশাল এক বটগাছের তলায় বসে থাকত সাধুবাবা। ধুনিও জ্বালাত না, গাঁজাও খেত না। শুধু একটা ত্রিশূল সাধুবাবার সামনে মাটিতে পোঁতা থাকত। সাধুবাবার সঙ্গী বলতে একটা জংলি কুকুর। সাধুবাবার খবর কিছুদিনের মধ্যে সর্বত্র রটে যাবার পর অনেকেই বাবাকে দেখতে যেত। অসুখ-বিসুখের ওষুধ চাইত, ভাগ্যে কী আছে জানতে চাইত। সাধুবাবা কথাবার্তা বড় বলত না, ওষুধ-বিষুধও দিত না। তবে খেয়ালের মাথায়-দু একজনকে গাছ-গাছড়ার কথা বলে দিয়েছে। বিশুর এক বন্ধু আছে কাছাকাছি এক কোলিয়ারিতে। ম্যানেজারের ছেলে। সে-বেচারির মা অসুখে খুব ভুগছিল। ছেলেটার বাবা সাধুবাবার কাছে গিয়েছিল দৈব কোনো ওষুধ চাইতে। বন্ধুর মুখ থেকে সাধুবাবার কথা শুনে বিশু সাধুর কাছে গিয়েছিল। সাধুবাবা বিশুকে পরের দিন একা দেখা করতে বলে। বিশু জিজ্ঞেস করেছিল, কেন সে দেখা করবে? সাধুবাবা কথার কোনো স্পষ্ট জবাব দেয়নি; শুধু বলেছিল “তোর মঙ্গল হবে।”
পরের দিন যাব কি যাবনা করে বিশু সাধুবাবার কাছে যায়। বাড়িতে কাউকে কিছু বলেনি। বিকেলের পর সাধুবাবা বিশুকে যেতে বলেছিল। বিশু সেই সময়েই যায়। বিকেল শেষ হয়ে আসার পর সাধুবাবা অন্য যে দু-পাঁচজন ছিল তাদের সরিয়ে দিয়ে বিশুকে নিয়ে ঘোডা-সাহেবের কুঠির মধ্যে ঢোকে। সঙ্গে অন্য কেউ ছিল না। শুধু কুকুরটা ছিল। কুঠির মধ্যে বেশ খানিকক্ষণ ঘঘারাঘুরি করে শেষে সাধুবাবা তাকে দোতলার বড় একটা ঘরে নিয়ে যায়। সেই ঘরে বিশু আরও দুজনকে দেখতে পায় একজন চরণমামা, মানে অমূল্যর শালা, অন্য একজন চরণের সঙ্গী, বিশু তাকে চেনে না।
সাধুবাবার সঙ্গে চরণমামার কথা কাটাকাটি বেধে যায়, কুকুরটা চেঁচাতে থাকে, আর হঠাৎ চরণমামার সঙ্গী সাধুবাবার কুকুরটাকে বন্দুকের বাট দিয়ে মারে। প্রচণ্ড জোরে। এত আচমকা ঘটনাটা ঘটে যায় যে, বিশু প্রথমটায় ভয় পেয়ে পালাতে যাচ্ছিল। পালাতে গিয়ে তার সঙ্গে চরণের সঙ্গীর ধাক্কা লাগে। বন্দুক পড়ে যায় সঙ্গীর হাত থেকে। বিশু সেটা কুড়িয়ে নিতে যায়। বন্দুকটা সে তুলেই নিচ্ছিল। চরণমামা তার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নেয়। তখনই সাধুবাবাকে গুলি করা হয়। সাধুবাবা জানলা দিয়ে লাফ মারছে–বিশু দেখেছে। তারপর কী হয়েছে, তার খেয়াল নেই। শুধু সে যে পালাতে পেরেছিল, এইটুকু তার মনে আছে।
যা শুনেছে তারাপদ সেই ঘটনা থেকে স্পষ্ট করে কিছুই ধরা যায় না। তবু একবার ঘটনাটা ভেবে নিল।
তারাপদ বলল, “সাধুবাবা বোধ হয় বিশুকে কোনো গোপন খবর দিতে চাইছিল। দেখাতে চাইছিল কিছু।”
কিকিরা বললেন, “হতে পারে। নাও হতে পারে। সেই খবর শোনার জন্যে বিশু গিয়েছিল? না, এমনিই গিয়েছিল? মনে রেখো, বিশু ছেলেমানুষ। ছেলেমানুষের মনে নেহাতই একটা কৌতূহল থাকতে পারে। কিংবা ধরো, বিশু খানিকটা ভয়ও পেয়েছিল। সাধুবাবার কথা না শুনলে পাছে অমঙ্গল হয়।”
“সেই সাধুবাবাই বা কোথায় গেল?”
“সেটাও একটা রহস্য।…রহস্য অনেক। কে এই সাধুবাবা? কোথায় গেল সে? কেন ওই কুঠিবাড়িতে চরণ গিয়েছিল, তার সঙ্গীই বা কে? বন্দুক কেন ছিল চরণদের সঙ্গে? এতগুলো কেনর কোনো জবাবই পাচ্ছি না, তারাপদ।”
তারাপদ বলল, “আপনার একার পক্ষে কি এতগুলো কেন র জবাব খুঁজে পাওয়া সম্ভব, কিকিরা? আমার মনে হয়, ফকিরবাবুর উচিত ছিল পুলিশের কাছে যাওয়া।”
মাথা নাড়লেন কিকিরা।”তাতে লাভ হত না।”
“কেন?”
সাধুবাবাই যেখানে বেপাত্তা, সেখানে বিশু কেমন করে প্রমাণ করত যে, সাধুবাবা তাকে কুঠিতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল? তা ছাড়া, চরণ আর চরণের সঙ্গী কুঠিতে ছিল, এটাও সে প্রমাণ করতে পারত না। কেননা, চরণরা অস্বীকার করত।”
“তা হল চরণরাই বা কেমন করে বিশুকে ফাঁসাতে পারে?”
“পারে না। পারছে না বলেই চুপ করে আছে। তবে ওরা একেবারে চুপ করে নেই। বাইরে চুপ। ভেতরে-ভেতরে ফকিরকে অস্থির করে তুলেছে।”
তারাপদ চুপ করে থাকল। তার মাথায় কিছু আসছিল না।
বৃষ্টি থামেনি। তোড় অনেকটা কমে এসেছে। কালচে আলো অল্প পরিষ্কার হয়েছে।
মাথার চুল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে কিকিরা বললেন, “কাল আমরা ঘোড়া-সাহেবের কুঠিতে যাব। তন্ন-তন্ন করে সব দেখব। চরণরা মিছেমিছি কুঠিতে যাবে না। তারা কেন যেত? কী তাদের উদ্দেশ্য? আর ওই সাধুবাবাই বা কে?”
তারাপদ বলল, “চরণ নিশ্চয় অমূল্যর কথা-মতন কাজ করত? তাই না?”
“নিশ্চয়। তা ছাড়া চরণ লোক ভাল নয়। পাকা শয়তান বলে আমি শুনেছি।” তারাপদ আর কোনো কথা বলল না।