৬. অপারেশন বাংলাদেশ

অধ্যায় : ৬ – অপারেশন বাংলাদেশ

Special Operation: Bangladesh

এমন সময় আসে যখন পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা একটি দেশের নিজস্ব শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে। এমনকি যে সব ঘটনার সাথে অল্পবিস্তর বা বহির্মুখী কোনো সম্পর্কই নেই তাও হঠাৎ করে ভীতিকর সমস্যা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরণের সমস্যাকে অন্যভাবে বিবেচনা করলে তা শেষ পর্যন্ত প্রলয় ডেকে আনে।

আবার এমন অবস্থাও হয় যখন এ সব পরিস্থিতিতে সরাসরি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় না, কারণ বিশ শতকের এ পৃথিবী ‘সভ্য’ বলেই বিবেচিত। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসাই একমাত্র সমাধান। যেহেতু প্রায়ই এ সব উদ্যোগ অবচলাবস্থায় পর্যবসিত হয়, তাই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা বাহিনীর ঘাড়ে এসে বর্তায়। বাংলাদেশ হলো এ ধরণের একটি উদাহরণ।

সাধারণত এরূপ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের ইতিবৃত্ত (বিদেশে পরিচালিত গোয়েন্দা কার্যক্রম) কখনই প্রকাশ করা হয় না। গোয়েন্দা কার্যক্রমের বিশেষ প্রকৃতির জন্য, গোপনীয় ‘অপারেশন’সমূহ সব সময় গোয়েন্দা বিভাগে ‘বিশেষ গোপনীয়’ ব্যাপার হিসেবেই আবদ্ধ থাকে। যদি ‘অপারেশন’ ব্যর্থ হয় তবে-এর ফলাফল অপরিবর্তনীয়রূপে প্রকাশ করা হয় এবং এর সাফল্যে কদাচিৎ কোনো মন্তব্য করা হয়। বিশেষ করে জনগণ এ ব্যাপারে অন্ধকারেই থেকে যায়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে জনগণকে এ সব ‘অপারেশন’ কি জন্য গৃহীত হলো তা জানানো মঙ্গলজনক। (বিশেষ করে যখন জনসাধারণ ভুল তথ্য ও বিরূপ প্রচারণায় বিভ্রান্ত থাকে)।

ক। বাংলাদেশ অপারেশন (The Bangladesh Operation )

বাংলাদেশ অপারেশন (বাংলাদেশে পরিচালিত ‘র’ কার্যক্রমের সার্বিক কোনো ‘ছদ্মনাম’ ছিল না তবে আংশিকভাবে কোনো কোনো খুচরো অপারেশনের ‘কোড’ বা ‘ছদ্মনাম’ ছিল) সম্ভবত মূল গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরুর এক বছর পূর্বেই শুরু হয়। এমনকি মুক্তিবাহিনী গঠনের মাধ্যমে পৃথিবী যখন বাংলাদেশ সম্পর্কে অল্পবিস্তর ধারণা করছিল তখন পর্যন্ত অনেকেই বাংলাদেশে ‘র’-এর গতিবিধি সম্পর্কে কিছুই জানতো না। অবশ্য ইতোমধ্যে ‘বাংলাদেশ অপারেশনের’ প্রথম পর্যায়ের ইতি ঘটেছে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে তৈরি হয়ে বসে আছে। বিদেশী পর্যবেক্ষকরা ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর সাফল্যকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মান ‘রীস ক্রীগ’ রণকৌশলের অভাবিত সাফল্যের সাথে তুলনা করেছেন। লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকা ১২ ডিসেম্বর ‘৭১ সংখ্যায় উল্লেখ করে যে, “ভারতীয় বাহিনী মাত্র ১২ দিনে প্রতিরোধ চূর্ণ করে ঢাকায় পৌঁছে, যা ১৯৪০ সালে ফ্রান্স দখলে জার্মান ‘ব্লিস ক্রীগ’ কৌশলের অতীত সাফল্য স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে রণকৌশল ছিল একই সাথে গতি, প্রচণ্ডতা ও নমনীয়তা (রণকৌশল পরিস্থিতি বুঝে যাতে পরিবর্তন করা যায়)”। আজ পর্যন্ত ধারণা করা হয়, ভারতীয় বাহিনী একাই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। যদিও এটা সত্য যে, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতা ও শৌর্যবীর্যের সাথে যুদ্ধ লড়েছে এবং ইতিহাসে খুব কমসংখ্যক সামরিক অভিযানই এরূপ বিস্ময় ও বিবেচনার দাবি রাখে, কিন্তু সশস্ত্র বাহিনী ব্যতীত অন্য আরো অনেকে এ ক্ষেত্রে অমূল্য সহায়তা প্রদান করেছেন। শত্রু সীমানায় ও পশ্চাতে থেকে যারা যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছে উপযুক্ত সম্মান তাদেরও প্রাপ্য এবং তারা ছিল ‘র’-এর এজেন্ট ও ‘মুক্তিবাহিনীর’ দামাল সৈনিক।

‘র’ মুক্তিবাহিনীর সাথে একত্রে একটি ধ্বংসাত্মক বাহিনীতে পরিণত হয় এবং ভারতীয় বাহিনীকে তথ্য প্রদান আরম্ভ করে। পাকিস্তানী বাহিনীকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাশ কাটিয়ে ত্বরিত অগ্রসর হবার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠতর কৌশলে পরাজিত করা সে জন্যে সম্ভব হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন রণাঙ্গনে জয়লাভ করার আগেই ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধ জয় করার সুযোগ লাভে ধন্য হয়।

কোনো সন্দেহ নেই যে, এ সামরিক অভিযানের সাফল্যে অন্য অনেক বিষয়ই সহায়ক শক্তি হিসেবে অনুঘটকের কাজ করেছে, কিন্তু ‘র’ এর সমর্থন এক্ষেত্রে ‘চূড়ান্ত তাৎপর্য’ বহন করে।

খ। প্রারম্ভিক তথ্যাদি (Early Reports )

পাকিস্তানী চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে ‘র’-এর মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম শুরুর এক বছর পূর্বেই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। লন্ডনে গোয়েন্দা সংস্থার ‘পররাষ্ট্র বিভাগে’ কর্মরত একজন এজেন্ট পাকিস্তানী কূটনীতিকের মন্তব্য থেকে এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহে সমর্থ হন। সেখানে পাকিস্তানী কূটনীতিক ইশারা করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে “ব্যবস্থা গ্রহণে মনস্থ করেছে”, পাকিস্তানী কূটনীতিকের ভাষায় “ওই সব মূর্খ বাঙালিদের এমন শিক্ষা দেয়া হবে যা তারা সারাজীবনেও ভুলবে না।” এ ধরণের একটি মন্তব্য গোয়েন্দা এজেন্টের নিকট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই প্রতীয়মান হয় এবং সে অতিদ্রুত এ ব্যাপারটি দিল্লিকে অবহিত করে। গোয়েন্দা সদর দপ্তরের ‘পাকিস্তান বিভাগে’ পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে অন্যান্য আরো সংগৃহীত তথ্যে পাকিস্তানী কূটনীতিকের ‘লন্ডন মন্তব্যের’ সমর্থনে একটি পরিকল্পনার চিত্র ধীরে ধীরে পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। এ সমস্ত গোয়েন্দা তথ্যাদি শীঘ্রই ‘সংযুক্ত গোয়েন্দা কার্যনির্বাহী পরিষদে’ পাঠানো হয়। অবশ্য সে সময় এ ধরণের পরিকল্পনার কথা সম্পূর্ণরূপে অবিশ্বাস করা হয় এবং ব্যাপারটি সে মুহূর্তে ফেলে রাখা হয়।

গ। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (Agartala Conspiracy Case)

পূর্ববর্তী ঘটনার সূত্র ধরে ঘটে যাওয়া একটির পর একটি (কোনোটি বড় মাপের ও কোনটি তেমন উল্লেখযোগ্য নয়) ঘটনাকে ক্রমানুযায়ী বিস্তারিত বর্ণনা করা কষ্টসাধ্য। শেষ পর্যন্ত র’-এর ‘বাংলাদেশ অপারেশন’ এ যুক্ত হবার জন্য ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর একটি পরিষ্কার সারসংক্ষেপ প্রকাশ করতে হলে একজনকে অবশ্যই ১৯৬৮ সালে ‘র’- এর জন্ম সালের পরপর ঘটে যাওয়া গোয়েন্দা কার্যাদির পর্যালোচনা করতে হবে। কিন্তু ততোদিনে ভারতীয় এজেন্টরা পূর্ব পাকিস্তানের ‘মুজিবপন্থী’ (Pro-Mujib) একটি অংশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। আগরতলায় ১৯৬২-৬৩ সালে ভারতীয় এজেন্ট ও ‘মুজিবপন্থীদের’ মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পরবর্তী গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।

কর্নেল ‘মেনন’ (Menon) যিনি ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী ও মুজিবপন্থী অংশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী ছিলেন (আসলে কর্নেল মেনন ছিল শংকর নায়ারের গৃহীত ছদ্মনাম), তিনি আগরতলা বৈঠকের পর ইঙ্গিত পান যে, ‘মুজিব পন্থী’ গ্রুপ আন্দোলন শুরু করার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব। ‘কর্নেল মেনন’ তাদের এই বলে সতর্ক করে দেন যে, তার মতে ‘সঠিক ফলদায়ক সিদ্ধান্তে আসার সময় এখনো হয়নি।’ এ ক্ষেত্রে তারা যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা অসম্পূর্ণ ও এভাবে কাজ না হবার সম্ভাবনাই বেশি। কর্নেল মেনন ঠিক কথাই বলেছিলেন- ‘তারা অস্ত্রের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে’ এবং ঢাকাস্থ ‘ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস’ (এখানে আসলে হবে EPR বা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-অনুবাদক) অস্ত্রাগারে হামলা চালায়, কিন্তু এ প্রাথমিক প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আসলে এ পদক্ষেপ একটি ধ্বংসাত্মক ফলাফল ডেকে আনে, ঠিক যেরূপ ‘কর্নেল মেনন’ ধারণা করেছিলেন। এর কয়েক মাস পর ৬ জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, ভারতের সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার চক্রান্ত করার জন্য ২৮ জন পাকিস্তানীর বিচার করা হবে। শেখ মুজিবকেও বারদিন পর একজন দোষী হিসেবে জড়িত করা হয়। এ মামলাই পরবর্তীতে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবে পরিচিতি পায়। অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে কামালউদ্দীন আহমেদের ‘সত্য বলে উল্লেখ’ করা স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে অভিযোগ গঠন করা হয়। পাকিস্তানী পত্রিকা ‘ডন’ (Dawn)-এ হাইকোর্টের বিচারকার্যের যে বিবরণ প্রকাশিত হয় তাতে উল্লেখ করা হয়, ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে ‘মেজর মেনন’ ও ‘কর্নেল ত্রিপাথী’ নামের দু’জন ভারতীয় এজেন্টের যোগাযোগ ছিল। এটা নিশ্চিতই যে, পাকিস্তান সরকার ভারতকে জড়ানোর চেষ্টায় দু’জন এজেন্টের উল্লেখ করে, কিন্তু তাদের প্রাপ্ত তথ্যাদি সম্পূর্ণ তথ্যের ছিটেফোঁটা লাভেও ব্যর্থ হয়। তারা দু’জন কর্মকর্তার পদমর্যাদা নির্ধারণেই ভুল করে বসে; যারা আসলে ছিলেন ‘কর্নেল মেনন’ ও ‘মেজর ত্রিপাথী’ এবং পাকিস্তানীদের ধারণা করা এর উল্টোটা নয়।

ঘ। ‘র’-এর কার্যক্রম বৃদ্ধি (RAW Steps Up It’s Activitiess)

ইতোমধ্যে গোয়েন্দা দপ্তরের (IB= Intelligence Bureau) পাকিস্তান শাখা ‘র’-এর নতুন প্রশাসনিক কাঠামোয় বদলি হয় এবং তিনজন কর্মকর্তা সেখানে অবিরত সংগৃহীত তথ্যাদি পর্যালোচনায় নিয়োজিত হন। এদের মধ্যে ছিলেন ‘র’-এর যুগ্ম পরিচালক পি এন ব্যানার্জি, যিনি পূর্বাংশের প্রধান ও তাঁর সদর দপ্তর ছিল কলকাতায় এবং এস, শংকর নায়ার, যিনি দিল্লিতে ‘পাকিস্তান শাখা’র দায়িত্বে ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে একটি গোপন সংস্থা গড়ে তোলার কাজ ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে ‘শত গুপ্তচরের’ বছর এভাবেই শুরু হয়।

পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের পূর্বাংশের জনগণ ও এর নেতৃবর্গের প্রতি নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণই প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠার প্রাথমিক কারণ বলে বিবেচিত হয়। কর্নেল মেননের অবিরাম ভ্রমণ ও যোগাযোগের জন্য সীমান্তব্যাপী ‘র’-এর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র খোলা হয় এবং কর্নেল মেননের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরের প্রতিরোধ আন্দোলনকারীদের নিবিড় যোগাযোগ ওইসব তরুণ, অবিশ্রান্ত ও উৎসর্গীকৃত গুপ্ত যোদ্ধাদের মনোবল দারুণভাবে বৃদ্ধি করে। এভাবে ভ্রমণের ফলে ‘স্থানীয় কেন্দ্র প্রধান’ নির্বাচনের বিশেষ সুবিধা হয়। এ সব কেন্দ্র প্রধানদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন কর্নেল এম এ জি, ওসমানী (যিনি পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনী ও স্বাধীনতা যোদ্ধাদের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন নেতৃত্বাধীন মেজর খালেদ মোশাররফ (পূর্বে একজন সামরিক স্টাফ অফিসার-ব্রিগেড মেজর), মেজর শফিউল্লাহ ও আব্দুল কাদের সিদ্দিকী যিনি বাঘা সিদ্দিকী ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন এবং পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনী’ ও ‘র’ এজেন্টদের মধ্যে যোগাযোগকারী রূপে আবির্ভূত হন।

ইতোমধ্যে যখন বিভিন্ন কেন্দ্র স্থাপন শেষ হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে ‘র’ এজেন্টদের মাধ্যমে (যারা ভারতীয় বিভিন্ন সংস্থা থেকে অস্থায়ীভাবে ‘র’-এর নিয়োগকৃত হয় আন্দোলনকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়, তখনই সেই ভয়াবহ ‘কালো রাত্রির’ পদধ্বনি শোনা যেতে থাকে। অনেক পরে, শেখ মুজিব বলেছিলেন, “আজ যদি হিটলার বেঁচে থাকতেন, তবে তিনিও লজ্জিত হতেন…” শেখ মুজিব প্রকারান্তরে বাংলাদেশকে ‘ধর্ষণের’ কথাই উল্লেখ করেন।

ঙ। পূর্ব-পাকিস্তানী নেতাদের দাবি (Demands of East Pakistani Leaders)

বাংলাদেশ আন্দোলনের ইতিহাস অনুসন্ধান করতে হলে ১৯৫২ সালের মার্চ মাসে ফিরে যেতে হয়, যখন বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে একটি গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়েছিল। (আসলে লেখক এখানে ফেব্রুয়ারি মাসের বদলে ভুলে মার্চ মাস উল্লেখ করেছেন-অনুবাদক)। এরপর ‘র’-এর সূত্র মতে, ক্রমানুযায়ী ঘটে যাওয়া ঘটনার ফলশ্রুতিতে ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে বিদ্রোহের চিহ্ন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথম সার্থক দিকনির্দেশক ছিল ১৯৫২ সালের মার্চ মাসের ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’। পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রতি নগ্ন ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ছিল অবশ্যম্ভাবী এবং বাঙালিদের ঘৃণাভরে উল্লেখ করা হয় “ওই সব কালো ছোটোখাটো মানুষগুলো” হিসেবে। গোয়েন্দা বিভাগের কাছে এ ধরণের মন্তব্য ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ আর ভারতীয় আমলাদের নিকট এটি বিবেচিত হয় একটি তাৎপর্যহীন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে। পরবর্তী ঘটনাসমূহ অবশ্য ভিন্ন কাহিনীর জন্মকথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এরূপ তাৎপর্যহীন বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলীই পরবর্তীতে পরিবর্তনের সূচনাকারীরূপে চিহ্নিত হয়।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পরপর ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ বিশেষ বিচারালয়ে (Tribunal) শেখ মুজিব, প্রেসিডেন্ট আইউবকে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য বিবৃতি প্রদান করেন। এ দাবি অনুসরণ করে ১৯৬৬ সালের প্রথমদিকে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংযুক্ত বিরোধী দল গঠনের জন্য লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সভায় শেখ মুজিব তাঁর বিখ্যাত ‘ছয় দফা’ দাবি পেশ করেন। ‘ছয় দফা’ কর্মসূচি সামরিক জান্তাকে দুর্বল করে তোলে এবং নিম্নোক্ত দাবিনামা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিতে সহায়ক হয় :

১। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনসহ পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতির শাসনতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সার্বভৌম সংসদসহ সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

২। দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রবিষয়ক ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রেখে অবশিষ্ট সব বিষয়ে অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকবে।

৩। দেশের দুটি অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক অথচ অবাধ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে অথবা সমগ্র দেশে একটি মুদ্রা থাকবে, তবে সে ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রোধের যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক অঞ্চলে একটি করে রিজার্ভ ব্যাংক থাকতে হবে।

৪। রাজস্ব নীতিনির্ধারণ ও কর ধার্যের ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকার আঞ্চলিক সরকারের রাজস্বের একটি নির্দিষ্ট অংশ লাভ করবে।

৫। পর্যায়ক্রমিক অর্থনৈতিক ও রাজস্ব সংস্কারের / পুনর্গঠনের মধ্যদিয়ে উভয়াংশের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে। (আসলে এ দফাটি লেখক সংক্ষিপ্তাকারে উল্লেখ করেছেন-অনুবাদক)

৬। আঞ্চলিক সংহতি রক্ষার জন্য আধাসামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন করতে দিতে হবে, যেখানে বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই।

চ। ভোট গ্রহণের আশ্বাস (Promise of Holding Election )

সামগ্রিকভাবে এ সব দাবি দাওয়াকে পশ্চিম পাকিস্তানী, বিশেষ করে পাঞ্জাবীরা যারা কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করে তারা ভাষাভিত্তিক উগ্র স্বাদেশিকতা হিসেবেই চিহ্নিত করে। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে প্রেসিডেন্ট আইউব বিরোধী আন্দোলন গতিময়তা লাভে সক্ষম হয়। একজন হতাশ ব্যক্তি হিসেবে প্রেসিডেন্ট আইউব জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে ঘোষণা করেন যে, তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা হস্তান্তর করছেন। পূর্ব পাকিস্তানীদের ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের মনোভাবও ভিন্ন কিছু ছিল না। তবে পূর্বের মতো অতো খারাপ না হলেও সর্বময় ক্ষমতা তাঁর ‘নবনির্বাচিত সামরিক জান্তার’ হাতে রাখতেই তিনি ইচ্ছুক ছিলেন। ১০ এপ্রিল তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে এবং এর পরবর্তীতে ২৮ নভেম্বর তার প্রদত্ত প্রতিজ্ঞা পুনঃনিশ্চিত করলেন যে, ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর ভোট গ্রহণ করা হবে। এ ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, যদিও পরে ভোটগ্রহণ ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হয়েছিলো (ঘূর্ণিঝড়ের কারণে)। তখন পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান অনুধাবন করতে পারেননি যে, এ পদক্ষেপ গ্রহণের (ভোট) মানে হবে তাঁর ‘ভেটো’ ক্ষমতা প্রয়োগের বিলুপ্তি ও সামরিক শাসনের অবসান।

ছ। ‘র’-এর কার্য নির্ধারণ পর্যালোচনা (Assessment of RAW)

ইতোমধ্যে ‘র’-এর এজেন্টরা পূর্ব পাকিস্তানের আনাচে-কানাচে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়। ‘র’-এর পক্ষে কাজ করা অনেক ‘ডবল এজেন্ট’ পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের মধ্যে অথবা আশপাশে নেতৃত্বের পর্যায়েও ছিল (যাদের কথা ‘গোপনীয়’ হিসেবে কখনোও প্রকাশ করা যাবে না)। একজন নেতৃস্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ পাকিস্তানী কর্মকর্তা যিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন; তিনি ‘র’-এর অপারেটরদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার করেন এবং ঢাকা পতনের একদিন পূর্বে তিনি অন্য পাকিস্তানীদের সাথে নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হন। ‘র’-এর অনুমান ছিল, যদি ডিসেম্বরে আদৌ ভোট হয়, তবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে তারা (‘র’) পাকিস্তানের ক্ষমতার মসনদে দেখতে পাবে (এ ব্যাপারটি ‘র’ এবং সরকারের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ধাঁধায় ফেলে দেয়, কারণ তাঁরা ধারণা করতে ব্যর্থ হন যে, কিসের ওপর আস্থা রেখে ইয়াহিয়া ভোট গ্রহণে সম্মত হয়েছিলেন। পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনীও ভুল তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করে অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিল)।

জ। আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ (Awami League Wins Majority)

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ভোটে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তবে ২০ ডিসেম্বর ফলাফল ঘোষণার পর জুলফিকার আলী ভুট্টোর উচ্চবাচ্যে ভিন্ন পরিস্থিতির আবির্ভাব অনুভূত হয়। তিনি ঘোষণা করেন, পিপলস পার্টি বিরোধী দলীয় আসনে বসবে না এবং তৎসঙ্গে যুক্ত করেন “সংখ্যাগরিষ্ঠতাই শুধুমাত্র জাতীয় রাজনীতির একক পরিমাপক নয়”। এরপর পাকিস্তান তার নিজস্ব আইন- কানুন তৈরি করতে শুরু করে।

পহেলা মার্চ ১৯৭১-এ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘জাতীয় পরিষদের’ অধিবেশন উদ্বোধন বাতিল বলে ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের একটি সমাধানে পৌঁছানোর ব্যর্থতায় এ ঘোষণা প্রদান করা হয়, যখন শেখ মুজিব সামরিকজান্তার ভয় প্রদর্শনে নত হয়ে কোনো বিনিময় চুক্তিতে আসতে অস্বীকৃতি জানান। দু’দিন পর এক বিরাট মিছিলে আওয়ামী ছাত্রনেতৃবর্গ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং এভাবেই অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় ও এর সাথে সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।

ঝ। ‘মহাপ্রলয়ের’ আগমনী বার্তা (Reports of Major Crackdown)

অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই করাচির ‘র’ এজেন্ট করাচি বন্দর দিয়ে ঢাকায় সৈন্য প্রেরণের সংবাদ পাঠায়। এদিকে লে. জে. টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ৩ মার্চে চট্টগ্রামে বালুচ রেজিমেন্টের উপস্থিতি, বাঙালি অফিসারদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও ভারতীয় সীমান্ত হতে ঢাকায় সাঁজোয়া বহর স্থানান্তর, এ সব কিছু মিলে একটি আসন্ন ‘প্রলয়ের’ ইঙ্গিত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সেই একই দিনে ঢাকার ‘র’ এজেন্টও একটি বড় ধরণের বিপর্যয় সমাগত’ বলে কলকাতায় বার্তা প্রেরণ করে। করাচি ও চট্টগ্রামের তথ্যাদি এবং সাঁজোয়া বহরের ঢাকামুখী চলাচল ঢাকা হতে পাঠানো বার্তাটির পক্ষে দৃঢ় সমর্থন জোগায়। অতএব যখন এ সব রিপোর্ট দিল্লিতে পাঠানো হয়, তখন ‘র’ সদর দপ্তরের একটি অতিজরুরী’ বার্তায় নির্দেশ দেয়া হয়, “মেননকে উপদেশ দাও…. আমাদের বন্ধুদের নিয়ে আসতে”।

ঞ। মুজিব বন্দী-তাজউদ্দীন কলকাতায় আশ্রয়প্রার্থী (Mjuib Caged – Tajuddin Seeks Refuge In Calcutta)

চট্টগ্রামে যখন পাকিস্তানী সৈন্য মাঠে নেমে পড়ে তখন ‘র’ অপারেটরদের দিল্লি থেকে পাওয়া বার্তানুযায়ী আদেশ পালনে পাগলপারা অবস্থা হয়। তারা দীর্ঘ বারো ঘণ্টা ধরে শেখ মুজিবকে ঢাকা ত্যাগ করার অনুরোধ করতে থাকেন। কিন্তু মুজিব জেদের সাথে ঢাকা ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত নেন। শেষে মরিয়া চেষ্টার মাধ্যমে একটি মধ্যপন্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। তখন পর্যন্ত কেউ জানতেও পারেনি যে, “ওদেরকে (বাঙালিদের) সমূলে উৎখাত করো” বলে টিক্কা খান একটি ঘৃণ্য আদেশ ইতোমধ্যেই প্রদান করেছেন, যে আদেশ বলে অল্প কিছুক্ষণ পরেই এমন একটি ভয়াবহ গণহত্যা সাধিত হয় যার কথা পূর্বে পৃথিবীর কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। সে সময়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তারের সম্ভাবনা দেখা দেয়। পরিশেষে বিপর্যয় শুরুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পূর্বে শেখ মুজিব তাঁর কয়েকজন সঙ্গী সাথীকে ভারত যাত্রার অনুমতি দেন। তাঁরা হলেন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ (যিনি পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন) ও আরো কয়েকজন নেতৃস্থানীয় যাঁরা, ‘র’-এজেন্টদের সাথে সারারাত ভ্রমণ করে ‘মুজিব নগরে’ (পরে এ নামেই এ জায়গার পরিচিতি ঘটে) এসে পৌঁছেন ও প্রবাসে ‘বাংলাদেশ সরকার’ গঠন করেন।

নোংরা লুঙ্গি ও ছেড়া শার্ট পরিহিত এই দলটি সারারাত শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিয়ে ভ্রমণ করে এবং যশোরের উত্তর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে এসে পৌঁছে। এদেরকে অন্য আর দশটা শরণার্থী দলের মতোই দেখা যাচ্ছিল যারা ইতোমধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করা শুরু করেছে। তাজউদ্দীনের সাথে অন্য আর যারা ছিলেন তারা হলেন জনাব নজরুল ইসলাম, মোশতাক আহমেদ, সামাদ আজাদ এবং চারজন ছাত্রনেতা-ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক এবং সিরাজ-উল-আলম খান (লেখক এখানে কয়েকজনের নামের বানান ভুল লিখেছেন যেমন-Fazul Haq Moni, Tufal Ahmed, Abdul Razakar-অনুবাদক)। ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে বিপর্যয় শুরু হয়ে গেছে; কিন্তু শেখ মুজিব ও অন্যান্য নেতৃস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গের ভাগ্য ততোক্ষণ পর্যন্ত অজানাই রয়ে যায়, যতোক্ষণ না ভারতীয় গোয়েন্দা বেতার মনিটরিং ফ্রিকোয়েন্সিতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো বার্তায় জানা যায়, “পাখিকে খাঁচাবন্দী করা হয়েছে।” এ সাংকেতিক বার্তার অর্থ উদ্ধার করে ‘র’-এর বুঝতে বাকি থাকে না যে, উল্লেখিত ‘খাঁচা বন্দী পাখি” শেখ মুজিব ব্যতীত আর কেউ নয়।

কলকাতায় অল্প কিছুক্ষণ অবস্থান করার পরই জনাব তাজউদ্দীন নয়াদিল্লির উদ্দেশে রওনা দেন। এর পরপরই যশোরের নিকটে পূর্ব-পাকিস্তানের ১০০ গজ অভ্যন্তরে ‘মুজিবনগর’ গঠিত হয়। কিন্তু বাস্তবে ‘মুজিবনগর’ ছিল কলকাতার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি বাড়ি, যেখান থেকে ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল কলকাতায় ‘বাংলাদেশ প্রাদেশিক সরকার’ গঠিত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, তাজউদ্দিনের সাথে আসা চার ছাত্রনেতা নিজেদের মুজিবের নিজস্ব রাজনৈতিক শিষ্য’ হিসেবে পরিচিতি প্রদান করে, যা তাজউদ্দীন অন্যভাবে গ্রহণ করেন।

ট। শরণার্থী স্রোতধারা (Avalanche of Refugees)

এপ্রিলের শেষার্ধেও গণহত্যা চলতে থাকে (ধারণা করা হয় যে, ২০০,০০০ হতে ১০,০০,০০০ পর্যন্ত লোক গণহত্যার শিকার হন) এবং ৯৮,০০,০০০ লোক বিতাড়িত হয়ে ভারতে প্রবাসী হতে বাধ্য হওয়ায় ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি বিশেষ হুমকি দেখা দেয়। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী ‘র’ তাদের ধারণানুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে যদি ঠিকঠাক ঘটনা না ঘটে তবে তারা (RAW) পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধের আশ্রয় নেয়ার যে কোনো সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে এবং এ ব্যাপারে ‘সংযুক্ত গোয়েন্দা কমিটির’ তথ্য পুনর্মূল্যায়নের অপেক্ষায় থাকে। মে মাসের শেষের দিকে আরেকটি ‘র’ পর্যালোচনা রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো হয় এবং “সরাসরি হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। যে সমস্ত তথ্য ‘র’ দপ্তরে আসতে থাকে তাতে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, পাকিস্তান একটি পরিপূর্ণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুতরাং ‘র’ তার সকল সম্পদ কাজে লাগিয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করার জন্য ‘সবুজ সংকেত’ লাভ করে।

ঠ। মুক্তিবাহিনী (Mukti Bahini )

‘র’-এর পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তব্যাপী বিভিন্ন গোপনীয় আশ্রয়স্থান মুক্তি ফৌজ’কে পর্যাপ্ত আশ্রয় প্রদান নিশ্চিত করে। এতে ব্যাপক সীমান্ত এলাকার গুপ্তস্থান হতে মুক্তি ফৌজ’কে অনুসন্ধান করে বের করা পাক বাহিনীর জন্য দুঃসাধ্য ব্যাপারে পরিণত হয়।

‘মুক্তি ফৌজ’ নামকরণ পরিবর্তিত হয়ে দু’মাস পর মুক্তিবাহিনী’ নাম ধারণ করে (‘মুক্তি ফৌজ’ গঠিত হয় ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর কালো রাতে)। এ ক্ষেত্রে নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনবিদ্বেষ একটি বিদ্রোহী বাহিনী সৃষ্টিকে ত্বরান্বিত করে। হাজার হাজার ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, ভূমিহীন শ্রমিক, সৈনিক এবং আধা সামরিক বাহিনীর জোয়ান পশ্চিম পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘মুক্তি বাহিনী’র সাহসিকতার ইতিহাস ও মুক্তিবাহিনীকে’ একটি কার্যকর যোদ্ধাবাহিনীতে পরিণতকরণে ‘র’-এর ভূমিকার কথা আজও পরিপূর্ণভাবে লিখিত হয়নি।

প্রেস রিপোর্ট ও অন্যান্য তথ্য সূত্র অনুযায়ী ‘মুক্তিবাহিনী’ চারটি প্রধান অংশ বা উপদল নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এ চারটি অংশ হচ্ছে (১) ১৫-২০ বছর বয়স্ক সর্বস্তরের তরুণ যুবক, (২) আওয়ামী লীগের উগ্রবাদী তরুণ-যুবক সমন্বয়ে একদল, (৩) আধা-সামরিক বাহিনী (EPR), আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও ফ্রন্ট্রিয়ার গার্ডস, (৪) নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকবৃন্দ বিশেষ করে ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’।

শুরুতে মার্চ থেকে মে ‘৭১ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর এ সব অংশ ও তাদের সহযোগী শক্তি স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহে অংশ নেয়। কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় সাধনে ব্যর্থ হয়। প্রথম ধাক্কাতে তারা সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করতে সমর্থ হয়; কিন্তু এ সাফল্য ছিল ক্ষণস্থায়ী। অসংখ্য সু-প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত পাকিস্তানী সৈন্য (সাড়ে চার ডিভিশন অর্থাৎ ৮০,০০০ সৈনিক ও ট্যাংক, ভারী কামান এবং রোমারু বিমান) স্বল্পসময়ের মধ্যেই প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। (এই তথ্যটি সঠিক নয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত পাক বাহিনীর নিয়মিত সৈন্য সংখ্যা ছিল ৪২,০০০-অনুবাদক) প্রতিরোধ বাহিনীর ছড়ানো ছিটানো অংশ তখন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ শুরু করে। যেহেতু ‘র’ সমগ্র সীমান্তজুড়ে প্রশিক্ষণ শিবির প্রতিষ্ঠিত করে তাই এ সব গেরিলাকে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজন হয়নি। এ ব্যাপারে পরবর্তীতে একজন ‘র’ এজেন্ট তার স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেন- “তারা আসছিল শ’য়ে শ’য়ে, দুর্বল অভুক্ত কিশোরের দল, তাদের আমরা খাবার, কাপড় ও প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং এটা সহজ কাজ ছিল না। বৃহৎসংখ্যক শিক্ষিত যুবক অন্তর্ঘাত, গোপন যোগাযোগ এবং ‘আঘাত করো ও সরে আসো’ (hit & run) পদ্ধতির গেরিলা রণকৌশলের উপর পরিচালিত সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ খুব তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করতে সমর্থ হয়। শত্রু অবস্থানের পশ্চাতে প্রয়োজনীয় সব প্রশিক্ষণই তাদের দেয়া হয়।”

কর্নেল ওসমানী ‘মুক্তি বাহিনীর’ কার্যক্রম সম্পর্কে সুখওয়ান্ত সিংকে বলেছিলেন “মে মাসের শুরুতে আমার বাহিনী বিকেন্দ্রীকৃত দলবদ্ধ বহিনী হিসেবে পুনর্গঠিত হয়েছে এবং প্রথাসম্মত যুদ্ধকৌশলের পরিবর্তন করে ছত্রী সৈন্যের হঠাৎ হানা দেয়ার কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে। যদিও এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু ভূমি হারাতে হয় কিন্তু আমরা শত্রু সৈন্যদের বিস্তীর্ণ প্রতিকূল গ্রামগুলোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছি। যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে তাদের সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত রাখা হচ্ছে। প্রতিদিন আমরা একশ’র বেশি শত্রুকে খতম করছি এবং তারা প্রতিদিনই পশ্চিম পাকিস্তানী প্লেন বোঝাই করে কফিন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।”

এদিকে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন অংশ ও অন্যান্য সহযোগী শক্তিকে একটি সংযুক্ত সুশৃঙ্খল বাহিনীতে পরিণত করা হয়। ১৯৭১-এর জুন-জুলাই মাসের মধ্যে ১০,০০০-এর বেশি মুক্তিযোদ্ধা নিম্নোক্ত চারটি সেক্টরে কাজ আরম্ভ করেঃ (১) রংপুর-দিনাজপুর-রাজশাহী সেক্টর, (২) ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সেক্টর, (৩) ময়মনসিংহ-সিলেট সেক্টর ও (৪) কুষ্টিয়া- যশোর-খুলনা সেক্টর। ততোদিনে এই সুসংগঠিত বাহিনীর আক্রমণ হয়ে ওঠে প্রলয়ঙ্কারী এবং ২ আগস্ট ‘৭১ সংখ্যা টাইম’ পত্রিকায় লেখা হয়, “ইতোমধ্যেই প্রতিরোধ যোদ্ধারা রাতে পুরো গ্রামাঞ্চল ও দিনে এই বেশিরভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে”। কর্নেল ওসমানীও দাবি করেন যে, “সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত আমরা ২৫,০০০ পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করেছি, ২১টি জাহাজ নিমজ্জিত হয়েছে, ৬০০ ব্রিজ ও কালভার্টের ধ্বংস সাধন করা হয়েছে এবং রেলপথ ও নদীপথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে।”

ডিসেম্বরের শুরুতে মুক্তি যোদ্ধার’ সংখ্যা এক লক্ষ অতিক্রম করে এবং দিন দিন এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। কয়েকজন পর্যবেক্ষক তাদের পর্যালোচনায় উল্লেখ করেন, মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই পাকিস্তানী সৈন্যদের বাংলাদেশ হতে বিতাড়িত করতে সক্ষম’; কিন্তু এ ধরণের প্রচেষ্টায় একটি দীর্ঘায়িত গেরিলা যুদ্ধ ও প্রচুর রক্তপাতের সম্ভাবনা জড়িত ছিল। ‘নিউজউইক’ (News Week) পত্রিকার সম্পাদক আর্নল্ড ডি বোটগ্রেভ প্রত্যন্ত গেরিলা অঞ্চলসমূহ ভ্রমণ শেষে তাঁর পত্রিকায় মন্তব্য করেন যে,

“ইতোমধ্যেই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অস্ত্রশস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। গেরিলারা গ্রামাঞ্চলে ক্রমাগত তাদের প্রভাব বিস্তার করছে। সরকারি কর্মকর্তা, চাকুরে ও গ্রামীণ নেতৃত্ব, সকলেই প্রচুর সংখ্যায় বিভিন্ন ছদ্মাবরণে বিদ্রোহীদের সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছেন এবং সময়ে সময়ে নদী অতিক্রম করা ব্যতীত সরকারি সৈন্যদের কদাচিৎ শহর-বন্দরে বের হতে দেখা যায়।”

ভারতীয় বাহিনীর ‘ঢাকা অভিযানের’ সময় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একত্রে শেষ যুদ্ধে শরীক হয়। ‘মুক্তিবাহিনীর’ বিভিন্ন ‘অপারেশন’ সন্দেহাতীতরূপে ভারতীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে বিশেষভাবে ত্বরান্বিত করে। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি সংখ্যা ‘দি স্টেটসম্যান’ (কলকাতা থেকে প্রকাশিত) পত্রিকায় বলা হয়, ‘মুক্তিবাহিনী মাসের পর মাস ধরে বিশেষ করে ঢাকা-কুমিল্লা-ময়মনসিংহ সেক্টরে যে সব খুঁটিনাটি অপারেশন পরিচালনা করে তা মিত্র বাহিনীকে রেকর্ড গতিতে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে বিশেষ সাহায্য করেছে’। প্রায় ২০,০০০ মুক্তিযোদ্ধা শত্রুকে ক্লান্ত শ্রান্ত (Softening the enemy) করতে নিয়োজিত রয়েছে। আবার, রায়পুরা ও নরসিংদীতে ভারতীয় বাহিনীর হেলিকপ্টারের সাহায্যে অবতরণ প্রচেষ্টা যা তাদের ঢাকার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছিয়ে দেয় তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সফল হয়েছিল ‘অবতরণস্থলগুলো মুক্তিবাহিনীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকায়।

ড। উচ্চ পর্যায়ে সমন্বয় সাধন (Co-ordination At The Top )

ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান এস, এইচ, এফ, জে, মানেকশ ছিলেন একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জেনারেল। ‘বাংলাদেশ অপারেশনের’ দ্বিতীয় ধাপ ছিল সামরিক হস্তক্ষেপ। এ পর্যন্ত ‘র’-এর ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবেই সম্পাদিত হয়। এখন বাকি বোঝা কাঁধে নেয়ার দায়িত্ব জেনারেল মানেকশ’র ওপর বর্তায়। তিনি হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হন ‘ভারতীয় প্রতিরক্ষা’ সংক্রান্ত নীতিমালা শুধু সামরিক পদ্ধতিতে কার্যে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র, অর্থনৈতিক এবং অভ্যন্তরীণ নীতিমালার সাথে প্রতিরক্ষার একান্ত সমন্বয় সাধন প্রয়োজন; আরো বৃহৎ অর্থে গোটা জাতির ‘রাষ্ট্র সম্পর্কীয়’ সচেতন চিন্তা- চেতনার সাথে ‘প্রতিরক্ষা নীতি’ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ‘চিফস অব স্টাফ কমিটির’ চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি একটি ব্যাপক কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে সরকারের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার ওপর জোর দিলেন এবং কার্যসিদ্ধির জন্য সুনির্দিষ্ট পন্থা প্রয়োগের আবেদন জানালেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ থাকায় তিনি এ সব আবেদন পেশ করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে রাজনৈতিক উপদেষ্টা কমিটিকেও এ ব্যাপারে অবহিত করতে সমর্থ হন। এই প্রথমবারের মতো একজন রাজনৈতিক প্রতিনিধি জনাব ডি, পি, ধর যিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা কমিটির সভাপতি ছিলেন, তাঁকে ‘যুদ্ধ সম্বন্ধীয় পরিষদে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্যদিকে সামরিক পক্ষে ‘র’, আই বি ( Intelligence Bureau) ও তিন বাহিনীর মিলিত ‘ডিরেক্টর অব ইন্টেলিজেন্স’-এর প্রতিনিধি সমন্বয়ে ‘সংযুক্ত গোয়েন্দা কমিটি’ (Joint Intelligence Committee) গঠিত হয়, যার চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান। এভাবে উচ্চ পর্যায়ে সমন্বয় সাধন করা সম্ভব হয়েছিল।

একইভাবে ‘সংযুক্ত পরিকল্পনা কমিটি’ আন্তঃবাহিনী সমন্বয়ে একটি সমন্বিত কার্য পদ্ধতি উদ্ভাবনে ব্যস্ত থাকে ও সম্মিলিত বাহিনীর ‘অপারেশনাল সদর দপ্তর’ স্থাপনের মাধ্যমে কাজ শুরু হয়। বেসামরিক পর্যায়ে যুদ্ধ প্রস্তুতি ও তার প্রয়োগে নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি ‘সেক্রেটারিয়েট কমিটি’ গঠিত হয়। প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, অর্থ ও পররাষ্ট্র সচিব সমন্বয়ে এই সচিব পর্যায়ের কমিটি কাজ আরম্ভ করে এবং ‘র’ প্রধান কাও (Kao) সদস্য সচিব হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার ওপর ভিত্তি করে ওই সব মন্ত্রণালয়ের সচিবগণকেও অবস্থাভেদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পকিল্পনার প্রয়োজনীয় পর্যায়ে বি এস এফ-এর মহাপরিচালক, সিভিল ডিফেন্সের প্রধান, অন্যান্য আধা-সামরিক বাহিনীর প্রধানগণ ও বিভিন্ন যুদ্ধ সম্পৰ্কীয় বাহিনীকে পরামর্শ গ্রহণের জন্য আলোচনায় ডাকা হয়। জেনারেল মানেকশ’ ও ডি পি ধর এ দু’জনই প্রকৃত নির্দেশনা, সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত থাকেন। প্রধানমন্ত্রী ও রাজনৈতিক উপদেষ্টা কমিটিকে সার্বক্ষণিক সম্পূর্ণ বিষয়ে অবহিত রাখা হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটিকে কখনই আমলাতান্ত্রিক লালফিতার গোলকধাঁধায় জট পাকাতে দেয়া হয়নি। কাও (র-প্রধান) ও ধরের মধ্যে সুন্দর বোঝাপড়া এবং মানেকশ’ ও ধরের মধ্যকার সুসমন্বয় শেষ পর্যন্ত লাভজনক ফললাভে সমর্থ হয়।

এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার পূর্ব পাকিস্তানে ড. এ, এম মালিককে টিক্কা খানের স্থলাভিষিক্ত করে সারা পৃথিবীকে ‘বেসামরিক সরকার’ প্রতিষ্ঠার ধোঁকাবাজিতে আচ্ছন্ন করে। এই সময়ক্ষেপণ কৌশল শুধু মুক্তিবাহিনীকে আরো সুসংগঠিত হতে অধিক সময় প্রদান করে। ‘র’-এর বিশ্লেষণ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে, মুক্তিবাহিনীর দিন দিন শক্তিবৃদ্ধি সত্ত্বেও পাকিস্তান বাহিনীকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। সুতরাং ‘সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণই’ হচ্ছে একমাত্র সমাধান।

ঢ। পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণা (Pakistan Declares War)

‘র’-এর ‘সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের’ সত্যতা প্রমাণ করে ৩ ডিসেম্বর বিকাল ৫-৩০ মিনিটে ইয়াহিয়া খান সর্বাত্মক যুদ্ধের পন্থা বেছে নেন। নয়াদিল্লির ধারণা মতে পাকিস্তানের এতোশীঘ্রই যুদ্ধঘোষণা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, কারণ তারা এ ব্যাপারে তাদের সময়ের হিসেব সঠিকভাবে মিলাতে পারছিলেন না। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কলকাতায়, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ছিলেন তাঁর নির্বাচনী এলাকা বিহার সফরে দিল্লির বাইরে, অর্থমন্ত্রী ছিলেন বোম্বেতে এবং প্রেসিডেন্ট ভি, ভি, গিরি সংসদ লনে এক সংবর্ধনা সভায় ব্যস্ত ছিলেন; তখন হঠাৎ বিমান হামলার সতর্ককারী সংকেত বেজে ওঠে। যে মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী পশ্চিম পাকিস্তানী আক্রমণের সংবাদ পান তখনি তিনি রাজধানীতে ছুটে আসেন। এরপর সেই রাতেই জেনারেল অরোরা সেনা সদর দপ্তর থেকে ‘এগিয়ে যাও’ ( Go Ahead) সংকেত পান। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণে উল্লেখ করেন “বাংলাদেশের যুদ্ধ আজ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।”

গোয়েন্দা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আয়োজিত পদক্ষেপসমূহ এবার ফলদায়ক রূপে প্রতিভাত হয়। ২ ডিসেম্বর পেশোয়ারের ‘র’ এজেন্ট বার্তা পাঠায় যে, সপ্তম পাকিস্তানী ডিভিশন ভারতের পশ্চিমে পুঞ্চ ও চম্ব এলাকায় অগ্রসর হচ্ছে। ‘এগিয়ে যাবার ‘ সংকেত ও কলকাতায় জেনারেল অরোরার পূর্ব কমান্ডের সদর দপ্তর স্থাপনের পরপর পূর্ব-পাকিস্তানব্যাপী ‘র’-এর গোপনীয় নেটওয়ার্ক পূর্ণ শক্তিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। যে সব এলাকায় পাকিস্তানী শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল, সে সব জায়গায় অনুপ্রবেশকারী গোপনীয় ওয়্যারলেস সেটগুলো সরব হয়ে ওঠে। সামরিক লক্ষ্যস্থল ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ভূ- রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র ঢাকা। ‘বার দিনের যুদ্ধ’ নামে পরবর্তীতে পরিচিত সামরিক অভিযান এভাবেই শুরু হয়েছিল।

ণ। গেরিলা কার্যক্রম বৃদ্ধি (Guerillas Accelerate Activities)

‘র’-প্রতি ছয় সপ্তাহে ২,০০০ গেরিলাকে প্রশিক্ষণ দেয়, যারা শত্রুকে ‘আঘাত করো ও সরে আসো’ (Hit and Run) পদ্ধতিতে মোকাবেলায় সক্ষম ছিল এবং পাকিস্তানী বাহিনীকে অনেক জায়গায় গভীরভাবে পর্যুদস্ত ও নাজেহাল করেছিল। জুলাই পর্যন্ত শুধু সীমিত পরিসরে হানা দেয়ার (Raids) কাজ চলতে থাকে। ‘র’ এজেন্ট, ধার করা বি, এস, এফ জোয়ান ও ছোট ছোট গ্রুপে মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ১০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে বিভিন্ন অপারেশন চালাতে থাকে। শত্রুবাহিনী দখলকৃত অঞ্চলের গভীরে গোপন অনুপ্রবেশ পাকিস্তানী সৈন্যদের বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর অপারেশন ক্রমান্বয়ে শুধু শত্রুকে নাজেহাল করা ও অস্ত্র কেড়ে নেয়ার পরিবর্তে অর্থনৈতিক যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটিয়ে জোরালো রূপ ধারণ করে।

‘অফিস অব স্পেশাল অপারেশনস’ (OSO)-এর একটি ‘স্পেশাল অপারেশন উইং’ এরপর পাকিস্তানী সৈন্যদের চলাচলের তথ্য সংগ্রহের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে। মাঝে মধ্যে প্রায়ই ইচ্ছাকৃতভাবেই মুক্ত বেতার তরঙ্গে পাকিস্তানীরা তাদের সৈন্য চলাচল ও অবস্থানের খবর প্রচার করতো যা কিছুটা হলেও ও, এস ও (OSO)-কে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী মুক্তিবাহিনীর মধ্যে তাদের এজেন্টের অনুপ্রবেশ ঘটায়। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর কোনো এলাকায় অপারেশন করে সাথে সাথে সে স্থান থেকে সরে আসার ফলে অনুপ্রবেশকারীরা তাদের কন্টাক্ট বা গোপন সংবাদ বহনকারীদের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তান গোয়েন্দাবাহিনীর এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।

ইতোমধ্যে লে. জে. নিয়াজী পাকিস্তান বাহিনীর অধিনায়ক ও পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। অন্যদিকে ব্যাপক অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা পাকিস্তানী নিয়ন্ত্রকদের জীবন বিপন্ন করতে শুরু করে।

ত। ঢাকার পতন (Fall of Dhaka)

এদিকে ঘটনা এগিয়ে যায় খুব দ্রুত। পাকিস্তানী প্রতিরোধের দ্বীপগুলো (এখানে পূর্ব- পাকিস্তান বিভিন্ন বড় বড় নদী দ্বারা দ্বীপের মতো বিভক্ত ছিল বলে এ শব্দটি লেখক ব্যবহার করেছেন-অনুবাদক) এড়িয়ে ভারতীয় বাহিনীর ‘ঢাকা অভিযান’ দ্রুতগতি লাভ করে। ‘র’ এজেন্টদের সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ সব প্রতিরোধ সহজে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। কোনো কোনো এলাকায় পাকিস্তানীরা দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কিন্তু মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত ‘উৎপাত’ ও ভারতীয় বাহিনীর দ্রুত সাফল্য তাদের হতাশায় নিমজ্জিত করে। ঢাকা ও এর আশপাশে ক্রমাগত কামানের গোলাবর্ষণ পাকিস্তানী পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তরকে পুরোপুরি অচল করে দেয় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের জন্য কোনো আদেশ প্রেরণে পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়।

ভারতীয় বাহিনী যখন চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ে যাচ্ছে, তখন ১২ ডিসেম্বর অত্যন্ত চতুরতার সাথে জাতিসংঘে পাকিস্তানী দূত কোনো রাজনৈতিক সমাধান ছাড়াই যুদ্ধবিরতি ঘোষণার দাবি করে বসেন। এদিকে গোয়েন্দা বেতার তরঙ্গে ধৃত একটি পাকিস্তানী বার্তা পাকিস্তান বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে সাহায্য করে। ওই বার্তায় উল্লেখ ছিল, “আমরা দুপুর ১২টায় গভর্নর হাউসে এক আলোচনা সভায় মিলিত হচ্ছি।” ওই বার্তা থেকে বোঝা যায় যে, একটি উচ্চপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এবং আলোচনা ভেঙে দেয়ার জন্য একটি পরিকল্পনা নেয়া হয়। কিন্তু ভারতীয় বিমান বাহিনীর পূর্ব কমান্ড বোমাবর্ষণের লক্ষ্যস্থল ‘গভর্নর হাউসের’ অবস্থান নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়। সেনা ও বিমানবাহিনী সদর দপ্তরে উত্তেজিত অনুসন্ধানও ব্যর্থ হয়ে যায়। এদিকে সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসে; তখন শেষ মূহূর্তে তড়িঘড়ি করে ‘র’ এজেন্ট যারা পূর্বে ঢাকায় ছিল তাদের সভা ডাকা হয়। এ সব এজেন্ট পাকিস্তানী বর্বরতার শুরুতেই ঢাকা ত্যাগ করে চলে আসেন। এদের একজন তার কাছে রয়ে যাওয়া একটি ট্যুরিস্ট ম্যাপ’ হাজির করে। যদিও ম্যাপের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুণ তবুও খুব দ্রুত একটি নির্দেশিকা তৈরি করা হয় যাতে গভর্নর হাউসের একদম সঠিক অবস্থান নিশ্চিত করা হয় এবং বিমান বাহিনীর পাইলটকে ‘র’-এর প্রস্তুতকৃত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য স্থানের চিহ্নসহ ওই ম্যাপটি হস্তান্তর করা হয়। ওই নির্দেশক ম্যাপে পল্টন ময়দানকে চিহ্নিত করা হয় যেখানে গম্বুজে গাঢ় নীল রেখা ধারণকারী একটি বড় মসজিদ ও এর সন্নিকটে অন্যান্য বাড়ি থেকে দূরে একা একটি বাড়ি নির্দেশ করা হয় এবং ঐটিই ঢাকার গভর্নর হাউস। এরপর কলকাতা থেকে ‘হকার হান্টার’ বোমারু বিমান উড়ে এসে ঠিক ১২টার সময় গভর্নর হাউসে বোমা ফেলে।

পরবর্তীতে সংগৃহীত বর্ণনানুযায়ী গভর্নর মালিক সে সময় ভূগর্ভস্থ কক্ষে আশ্রয় নেন ও প্রার্থনা করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর বাংকার হতে বের হয়ে তিনি তাঁর সকল সহকর্মীসহ পদত্যাগ করেন ও ইয়াহিয়া সরকারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে ‘রেডক্রসের’ নিয়ন্ত্রণাধীন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ফলে পাকিস্তান সরকারের একমাত্র অবশিষ্ট প্রতিনিধি সামরিক প্রশাসক জেনারেল নিয়াজীর কাঁধে সব দায়িত্ব এসে চাপে। তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ প্রায় শেষ পর্যায়ে উপনীত; দু’দিন পর নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেন এবং বাংলাদেশ নামে একটি নতুন স্বাধীন দেশের জন্ম হয়।

থ। সামরিক অভ্যূত্থান (The Coup)

স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং শেখ মুজিব নির্বাচিত হয়েছেন এর- কর্ণধার হিসেবে। ‘র’ এজেন্টরা তখনো নব্য স্বাধীন রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে নজর রাখা অব্যাহত রাখে। ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে ‘র’- এর সংগৃহীত তথ্যাদি বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলার ইঙ্গিত দেয়া শুরু করে। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে এ সম্ভাবনা সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়, যখন দু’টি বড় রকমের ধর্মঘটের পরপর ক্ষুধার্ত জনতার বিরাট মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিশৃঙ্খল অবস্থার চাপে বাধ্য হয়ে ১৯৭৪ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব এক দল প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ‘র’- সূত্রানুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থা ক্রমান্বয়ে জটিল আকার ধারণ করতে থাকে।

এদিকে অন্যান্য তথ্য সূত্র অনুযায়ী বিদেশী গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর অতিরিক্ত সচলতার আভাস পাওয়া যায়। শংকর নায়ার যিনি ততোদিনে মুজিব সরকারের নিকট একজন অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে নন্দিত, তিনি বাঘা সিদ্দিকীকে সাথে নিয়ে মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন ও তাঁকে চলমান ঘটনাবলী সম্পর্কে অবহিত করেন। মুজিব বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করা অন্যান্য ঘটনাবলী নিয়ে এতোই চিন্তিত ও ব্যতিব্যস্ত ছিলেন যে, তিনি আসন্ন সামরিক অভ্যুত্থানকে গুরুত্ব দেয়ার ফুরসতই পাননি।

চার মাস পর ‘র’-এজেন্টরা জিয়াউর রহমানের বাসায় মেজর ফারুক, মেজর রশিদ ও লে. কর্নেল ওসমানীর একটি সভার তথ্য লাভে সমর্থ হয়। অন্যান্য বিষয়ে আলাপ হলেও সামরিক অভ্যুত্থান নিয়েই আলোচনা কেন্দ্রীভূত ছিল। তিন ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় একজন অংশগ্রহণকারী উদ্দেশ্যহীনভাবে কাগজে কিছু লিখে ফেলেন ও পরে তা অমনোযোগবশত ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ছুঁড়ে ফেলে দেন। সেই দোমড়ানো কাগজটি আবর্জনা স্তূপ হতে একজন কেরানী (‘র’ এজেন্ট) সংগ্রহ করতে সমর্থ হন ও পরে তা দিল্লির ‘র’ সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অভ্যুত্থান অত্যাসন্ন বুঝতে পেরে কাও (‘র’- প্রধান) একজন বিশ্বব্যাপী রপ্তানীকারকের ছদ্মাবরণে ঢাকা এসে পৌঁছেন। ঢাকা পৌঁছার পর তাঁকে পূর্বনির্ধারিত একটি স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। মুজিব এরূপ ঘটনাকে চরম নাটকীয়তারূপে গণ্য করেন ও কাও কেন সরকারিভাবে তাঁর সাথে দেখা করতে এলেন না তা ভেবে অবাক হন। কিন্তু কাওকে ব্যক্তিগতভাবে চেনার সুবাদে তিনি তাঁর এ হেঁয়ালিপূর্ণ আচরণের ব্যাখ্যা শুনতে রাজি হন। মুজিব-কাও আলোচনা একঘণ্টা স্থায়ী হয়। কাও মুজিবকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হন যে, একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা পরিকল্পনাধীন ও তাঁর (মুজিবের) জীবন বিপদাপন্ন; তথাপি তিনি এ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় জড়িত সন্দেহভাজন অফিসারদের নাম উল্লেখ করার পরও শেখ মুজিব মন্তব্য করেন, “এরা আমারই সন্তান এবং এরা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে না”; এভাবেই শেখ মুজিবের মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠে।

দ। মুজিব হত্যাকাণ্ড (Mujib Massacared)

তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে ১৪ আগস্টের এক উত্তপ্ত রাতে সেনাবাহিনীর একটি মহড়া অনুষ্ঠানের নামে সৈন্য পরিচালনা লক্ষ্য করা যায়। ‘বেঙ্গল ল্যাঞ্চারস’ ও বাংলাদেশ সাঁজোয়া কোর রাজধানীর বাইরে অর্ধনির্মিত বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় (এখানে লেখক একটি ভুল করে থাকবেন, তা হলো বেঙ্গল ল্যাঞ্চারসই তখন একমাত্র ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট তাই আলাদাভাবে বাংলাদেশ সাঁজোয়া কোর সম্পূর্ণ অপারেশনে অংশ নিতে পারে না। কারণ বেঙ্গল ল্যাঞ্চারস একটি অপারেশনাল ইউনিট, পক্ষান্তরে সাঁজোয়া কোর একটি প্রতীকী নাম, যেমন সিগন্যাল কোর, আর্টিলারি কোর ইত্যাদি-অনুবাদক)। এরূপ সৈন্য পরিচালনার ব্যাপার পূর্বেও ঘটেছে, তাই যারা তাদের বাইরে যেতে দেখলেন তারা স্বভাবতই অন্যকিছু ধারণা করতে পারেননি। এর কয়েকঘণ্টা পর সে রাতেই শেখ মুজিব ও তাঁর ৪০ জন আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের অন্যরা নিহত হন। এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডে সময় লাগে মাত্র তিন মিনিট। শেখ মুজিবের দুই ভাগিনা বাংলাদেশ টাইমস সম্পাদক শেখ মণি ও বাকশালের ছাত্র সংগঠনের সম্পাদক শেখ ইসলাম কর্তৃক শেখ মুজিবকে স্বয়ং অপহরণ করার একটি পরিকল্পনার কথা হত্যাকাণ্ড ঘটার একঘন্টা পর জানা যায় (‘র’ জানতে পারে), কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এ অভ্যুত্থান শেখ মুজিবের চার দশকের ঘনিষ্ঠ সহচর খন্দকার মোশতাককে ২০ আগস্ট প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসায়।

হত্যাকাণ্ডের পরপরই সি, আই, এ ‘র’-এর ঘাড়ে এর দায়-দায়িত্ব চাপানোর চেষ্টা চালায় ও উল্লেখ করে যে, এ অভ্যুত্থান ‘র’-এর পরিকল্পনার ফসল। ‘র’-সূত্র অবশ্য জানতে পারে, সি, আই, এ শেখ মুজিবের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল এবং সম্ভবত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই এ অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা নেয়া হয়। ১৯৭১-এর জুনে ঢাকার সি আই এ আঞ্চলিক প্রধান (Station Chief) ফিলিপ চেরী মুজিবের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন বলে ধারণা করা হয়। মুজিব মারা যাবার কয়েক মাস পূর্বে ১৯৭৪-এর আগস্টে তড়িঘড়ি করে ঢাকা যাবার প্রাক্কালে চেরী দিল্লিতে আসেন।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ তার সব সমস্যার জন্য ভারতকে দায়ী করতে আরম্ভ করে যা, দেশে-বিদেশে সব জায়গাতেই ‘রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক’ থাকায় বিশ্বাস করা সহজ ছিল। আমেরিকানদের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুজিব কিছু সময়ের জন্য আমেরিকান পন্থা অনুসরণ করেন। তবে কিছুদিন পর ১২ মে ‘৭৫ এ মুজিবের দিল্লি সফরের পর তিনি পুনরায় তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করেন। এ পরিস্থিতি সি আই এ’কে তাই অন্য ব্যবস্থা গ্রহণে উৎসাহিত করে যা সম্ভবত অভ্যূত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুতে সহায়তা দেয় এবং এর ফলে মুজিব নিহত হন।

এটা অত্যন্ত আশ্চর্য ও দুর্ভাগ্যজনক হলো, অভ্যূত্থানে যে ট্যাংক ব্যবহার করা হয় তা মুজিব ১৯৭৩ সালে মিসর সফরের সময় নিজে সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৭৩-এর যুদ্ধে মিসরকে সমর্থন করার বিনিময়ে মিসর সরকার ট্যাংক উপহার নেয়ার জন্য মুজিবকে অনুরোধ করে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কোনো ট্যাংক না থাকায় তিনি তা গ্রহণে সম্মত হন।

রাজনৈতিক গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটানো সি আই এ’র নিকট নতুন নয় এবং এ ধরণের পরিস্থিতি তারা ইতোমধ্যেই গোটা দক্ষিণ আমেরিকায় ছড়িয়ে দিয়েছে। এগুলো উচ্চ স্টেকে জুয়াখেলা ছাড়া কিছুই না এবং সবসময়ই কেউ না কেউ এ সবের মূল্য পরিশোধ করে থাকেন। গোটা পৃথিবী পরম নিশ্চিন্তে অভ্যুত্থানের পরদিন পর্যন্ত এ হৃদয়বিদারক ঘটনা সম্পর্কে অনবহিত রয়ে যায়। পরদিন ঢাকা রেডিও ঘোষণা করে “জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করেই এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাঁর স্বৈর সরকারের পতন ঘটেছে।” মুজিব মারা গেলেন বটে, তবে সে সাথে তাঁর ‘সোনার বাংলার’ স্বপ্নসাধও মাঠে মারা গেল।

ধ। পাল্টা অভ্যুত্থান (The Counter Coup)

এরপর বাংলাদেশে দ্রুত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটা শুরু হয়। ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এক পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করেন। কিন্তু আবার আরেকটি পাল্টা অভ্যুত্থান ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। বছর কয়েক পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ভারত সফরে আসেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আনুষ্ঠানিক আলোচনার সময় ‘র’ প্রধান কাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর এক প্রশ্নের জবাবে জিয়া কাওকে উল্লেখ করে মন্তব্য করেন “যতোটুকু না আমি জানি, তার থেকে এই ভদ্রলোক বেশি জানেন- আমার দেশ কিভাবে চলছে।” এই ছিল ‘র’-এর ক্ষমতা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট জিয়ার উপযুক্ত স্বীকৃতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *