2 of 2

৬৯. সিংহল, বর্মা সমেত এই যে ভারতবর্ষ

সিংহল, বর্মা সমেত এই যে ভারতবর্ষ নামের দেশটি, এ দেশের প্রকৃতি বড় সুন্দর। লর্ড কার্জনের এ দেশটিই বড় পছন্দ। এত বড় দেশটির ভূ-প্রকৃতির মধ্যে কত বৈচিত্র্য, এক দিকে গগনচুম্বী পর্বত, আর প্রায় তিন দিকে নীল সমুদ্র। মধ্যে কত নদী, কত অরণ্য, কত প্রাচীন জনপদ। ঐতিহাসিক সম্পদও রয়েছে প্রচুর। কত মন্দির, মসজিদ, মিনার, স্তম্ভ, সেগুলির শিল্পগুণ লর্ড কার্জনকে আকৃষ্ট করে। ওই সব অনেক পুরাকীর্তি ভেঙে পড়েছে, ধ্বংসোম্মুখ, লর্ড কার্জন সেগুলিরও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে চান। তাজমহল সারা বিশ্বের সপ্ত বিস্ময়ের অন্যতম, সেই তাজমহল সম্পর্কেও কার্জনের মুগ্ধতার শেষ নেই, বার বার দেখতে ইচ্ছে হয়। তিনি ঠিক করেছেন, ভারতবর্ষকে আর একটি নতুন তাজমহল উপহার দেবেন, সেটি হবে সদ্য স্বর্গগতা মহারানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধ, প্রতিষ্ঠিত হবে রাজধানী কলকাতায়।

এ দেশের অনেক কিছুই ভাল, শুধু এ দেশের মানুষগুলি সম্পর্কে কার্জনের উচ্চ ধারণা নেই। অধিকাংশই গরিব, তারা নিরীহ, শান্ত, তাদের ভাষা নেই, তারা ঠিক আছে। কিন্তু যারা লেখাপড়া শিখেছে, ইংরেজি জানে, গড়ে তুলেছে একটা মধ্যবিত্ত সমাজ, তাদের আচরণ মাঝে মাঝে বড়ই বিরক্তিকর মনে হয়। এরা শুধু কথাতেই দড়, বক্তৃতায় তুফান তোলে, অথচ কর্মোদ্যম নেই। এই শিক্ষিত সম্প্রদায় থেকে উঁকিলব্যারিস্টার, চিকিৎসক-অধ্যাপক, আমলা বেরিয়ে আসছে প্রচুর, তা হোক, তাতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু এরা এখন শাসন কার্যে অংশ নেবার আবদার ধরেছে। নাগরিক পুরসভায়, আইন পরিষদে এরা এদের সদস্য সংখ্যা ক্রমাগতই বাড়াতে চায়। কংগ্রেস নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে বছরে একবার কোনও শহরে সম্মিলিত হয়, তাতে এই সব দাবি তুলে চ্যাঁচামেচি করে। নেটিভ সংবাদপত্রগুলিতেও অনবরত এই বিষয়ে লেখালেখি হয়। না, এই দাবির ব্যাপারে লর্ড কার্জনের সম্মতি নেই। দেশ-শাসন সম্পর্কিত বিষয়ে নেটিভদের মাথা ঘামাবার দরকারই বা কী? ইংরেজরাই তো রয়েছে। ইংরেজরা এ দেশে দৃঢ়, ন্যায়সম্মত প্রশাসন উপহার দিয়েছে। প্রায় এক শতাব্দীব্যাপী এই ভারতবর্ষে অরাজকতা চলছে, ভারতীয়রা শাসন কার্যের কী বোঝে? যে-কোনও একজন ভারতীয়ের তুলনায় একজন ইংরেজ অনেক বেশি দক্ষ।

কার্জনের ধারণা, শুধু মুষ্টিমেয় শিক্ষিত সম্প্রদায়ই এই রকম শোরগোল তুলেছে, সুতরাং তাদের কথায় কান দেবার দরকার নেই। দেশের অধিকাংশ মানুষ ইংরেজ শাসনেই সুখী, তারা পেয়েছে শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা। এই সব মানুষদের ওপর কোনও অত্যাচার বা অবিচারও পছন্দ করেন না কার্জন। ইংরেজরা ভদ্র, সুসভ্য জাতি, তারা সাধারণ, দরিদ্র, নিরস্ত্র মানুষের ওপর অত্যাচার করবে কেন? শুধু তাই নয়, এ দেশে প্লেগ, কলেরা, ম্যালেরিয়ার মতন ভয়াবহ রোেগ মাঝে মাঝেই মহামারীর রূপ ধারণ করে। সেই সব রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাও করা দরকার। দুর্ভিক্ষের সময় নিরন্ন মানুষকে সাহায্য করাও রাজশক্তির দায়িত্ব। এ দেশ শাসন করার বিনিময়ে ইংরেজ সরকার কর নিচ্ছে, হাজার হাজার ইংরেজ কর্মচারী এ দেশে বেতন পায়, বিপদের সময় সাধারণ মানুষের পাশে তাদের দাঁড়াতে হবে।

কার্যভার বুঝে নিয়ে কলকাতায় কিছুদিন কাটাবার পর লর্ড কার্জন তাঁর স্ত্রী মেরিকে নিয়ে বেরুলেন ভারত দর্শনে। তিনি এ দেশটা আগে থেকেই চেনেন। কিন্তু মেরি তো কিছুই জানেন না। মেরির কাছে ভারত একটা রূপকথার দেশ।

মেরি প্রথম থেকেই খুশিতে ডগোমগো হয়ে আছেন। এত আড়ম্বর, এক খাতির যত্ন তিনি জীবনে দেখেননি। রাজকীয় সম্মান বললেও যেন কম বলা হয়। মেরি সবচেয়ে বেশি অভিভূত হয়েছে সেবাদাসদের সংখ্যা দেখে। ভাইসরয়ের এই প্রাসাদে ভৃত্যের সংখ্যা প্রায় চারশো জন! স্নানের সময় একজন জল গরম করে। একজন বাথটব এনে দেয়, একজন সেই বাথটাবে জল ঢালে, আর একজন পরে সেটা পরিষ্কার করে। প্রত্যেক কাজের জন্য এক একজন নির্দিষ্ট!

মেরি আমেরিকান, তার দেশে এই গৃহভৃত্য প্রথাটি প্রায় উঠে যাচ্ছে। ক্রীতদাস প্রথা রহিত হবার পর কৃষ্ণাঙ্গ দাস-দাসী পাওয়াও দুষ্কর। লন্ডনে যখন কার্জন আন্ডার সেক্রেটারি ছিলেন, তখন সেখানে সংসার পেতে বসার পর কয়েকটি ভৃত্য ছিল বটে, কিন্তু ইংরেজ ভৃত্যরা অতিশয় বেয়াদপ। একদিন একটু বকাবকি করলেই ইচ্ছে করে রান্না এমন খারাপ করে দেবে যে মুখে দেওয়া যাবে না। কলকাতায় ভৃত্য-খিদমতগাররা পরিচ্ছন্ন, সুন্দর পোশাকে সেজে-গুঁজে থাকে, তারা মুখফুটে একটা কথা বলে না, ছায়ার মতন তাদের অস্তিত্ব, সামান্য ইঙ্গিতেই তারা কাজের কথা বুঝে যায়। এক একদিন নৈশ ভোজের জন্য যখন অতিথিদের আমন্ত্রণ করা হয়, তাদের সংখ্যা দেড়শো-দুশো জন হলেও তাদের প্রত্যেকের চেয়ারের পেছনে একজন করে খিদমতগার নীরবে দাঁড়িয়ে থাকবে, যাতে কোনও অতিথিকেই নিজের হাতে গেলাসে জল পর্যন্ত ঢালতে না হয়।

কার্জন দম্পতির ট্রেন ভ্রমণের সময়ও শত শত ভৃত্য সঙ্গে যায়। ট্রেনটি যেন চলন্ত এক প্রাসাদ। সম্পূর্ণ ট্রেনটি সাদা ও সোনালি রঙ করা। শুধু মেরির জন্যই আছে পালঙ্ক সজ্জিত মস্ত এক শয়নকক্ষ, একটি পোশাক-পরিবর্তন কক্ষ, একটি খাসকামরা, বাথটাব সমেত স্নানের ঘর, দুজন ইওরোপীয় দাসীর জন্য একটি ঘর। আর বড় লাটের নিজস্ব অংশে এই সব কিছুর সঙ্গে আছে একটি গ্রন্থাগার।

কিছুদূর অন্তর অন্তর কার্জন দম্পতি এক একজন দেশীয় রাজার আতিথ্য গ্রহণ করেন। এরকম দেশীয় রাজ্যের সংখ্যা কম নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের পাঁচ ভাগের দু ভাগ দেশীয় রাজাদের অধীনে। ইংরেজ রাজশক্তি অবশ্য এক একটি থাপ্পড়ে এই সব দেশীয় রাজাদের মুণ্ড উড়িয়ে দিতে পারে, কিন্তু ইচ্ছে করেই এদের পুষে রাখা হয়েছে। সিপাহি বিদ্রোহের পর লর্ড ক্যানিং সুপারিশ করে গেছেন, এই সব দেশীয় রাজ্যগুলি টিকিয়ে রাখা হোক। এদের যে রত্নখচিত সিংহাসনে পুতুলের মতন বসিয়ে রাখা হচ্ছে, সেই কৃতজ্ঞতায় এরা চিরকাল ইংরেজদের প্রতি অনুগত থাকবে, আবার কখনও যদি দৈবাৎ ঝড় ওঠে, তখন এদের সাহায্য পাওয়া যাবে।

ত্রিপুরা ছাড়া আর কোনও দেশীয় রাজ্যই স্বাধীন নয়। ত্রিপুরাও নামেমাত্র স্বাধীন। রাজারা ইংরেজ সরকারের অঙুলিহেলনে ওঠে বসে। প্রত্যেকবার উত্তরাধিকারের প্রশ্নে ইংরেজ সরকার নাক গলায়, এমনকী রাজকুমারদের লেখাপড়ার কী রকম ব্যবস্থা হবে, সে বিষয়েও ইংরেজ সরকারের নির্দেশ নিতে হয়।

এইসব রাজাদের বিলাসিতা, উৎকট খেয়াল ও লালসা-প্রবৃত্তির বহু কাহিনী লোকের মুখে মুখে ছড়ায়। এদের যুদ্ধ করার অধিকার নেই, নিজেদের দেশ আক্রান্ত কখনও হলে ইংরেজ সামলাবে, আর কোনও দায়-দায়িত্বও নেই, তাই ধনরত্নের অপব্যয়েই এরা সময় কাটাবার শ্রেষ্ঠ উপায় মনে করে। কেউ অনবরত ঘোড়া কেনে, গাড়ি কেনে, কেউ বাঁদরের বিয়েতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে, কেউ হারেম পোষে, কেউ সিঁড়ির দুপাশে নগ্ন নারীদের দাঁড় করিয়ে রাখে, কেউ বাঘ শিকার করতে গিয়ে জ্যান্ত বাচ্চা ছেলেকে বেঁধে রাখে টোপ হিসেবে।

যারা লেখাপড়া শিখেছে, তারা প্রায়ই ইওরোপে পাড়ি দেয়। লন্ডনে এইসব রাজা-মহারাজারা এক একখানা বাড়ি কিনে রেখেছে, কেউ কিনেছে প্রমোদ তরণী। গণ্যমান্য অতিথিদের ডেকে কোনও প্রসিদ্ধ নর্তকী বা অভিনেত্রীকে জয় করবার জন্য ইওরোপীয় ধনীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মেতে নিঃস্ব হয়। রানিরাও বাদ যায় না। ভারতে, নিজের রাজ্যে এই সব রানিরা অন্তঃপুরবাসিনী, কিন্তু ইওরোপে গিয়ে তারা একেবারে লাগাম ছাড়া। সেখানে গিয়ে তারাও খোলামেলা পোশাকে পার্টিতে নাচে, মদ্যপান করে বেসামাল হয়, জুয়ার আড্ডায় নায়িকা সাজে। মহারাজা, মহারানি এই সব শব্দগুলি এখন ইওরোপের সব দেশেই পরিচিত, এর প্রতিশব্দ হল দারুণ ঐশ্বর্যশালী নির্বোধ।

এই সব দেশীয় রাজাদের অতিথি হয়ে কার্জন দম্পতি বিপুল সমাদর পান। বিগলিত রাজন্যবর্গ তাঁদের দেবতাজ্ঞানে পূজা করে। স্টেশনে পাতা থাকে লাল কার্পেট, ট্রেন থামা মাত্র বড় লাটের অভ্যর্থনায় শোনা যায় তোপধ্বনি। বাইরে যেখানে চার ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে, সেই পর্যন্ত কার্পেটের ওপর পা ফেলে ফেলে মেরির বাহু ধরে এগিয়ে যান কার্জন, ঘোড়াগুলির অঙ্গসজ্জা সব সেনার। পথের কিছুদূর অন্তর অন্তর স্বাগতম তোরণ। দু পাশে সার বেঁধে থাকে হাজার হাজার বিহ্বল মানুষ। এই সব কিছুই মেরিকে মুগ্ধ করে, কার্জনের অহমিকা প্রদীপ্ত হয়। ইংল্যান্ডের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে তাঁকে প্রায় কেউ চিনবেই না, আর এই ভারতের মতন বিশাল দেশে তিনি যেখানেই যাবেন, সেখানেই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। যদিও তিনি ইংলন্ডেশ্বরের একজন কর্মচারী, তবু এখানকার মানুষ তাঁকে সম্রাটের সম্মান দেয়। কার্জনের ভাবভঙ্গিও বকলমে সম্রাটেরই মতন।

মাঝে মাঝে কৌতুকের উপাদানও পাওয়া যায়। পথের তোরণগুলিতে অনেক কিছুই লেখা থাকে ইংরিজিতে। কিন্তু যে কারিগররা ওই সব নির্মাণ করে, তারা এক অক্ষরও ইংরিজি জানে না। মাঝে মাঝে হাস্যকর ভুল চোখে পড়ে। এক জায়গায় লিখতে চাওয়া হয়েছিল A Gala Day, তার বদলে লেখা হয়েছে A Gala day! তা দেখে কার্জন মেরির দিকে একচক্ষু টিপলেন।

প্রাসাদের শ্রেষ্ঠ অংশে থাকতে দেওয়া হয় তাঁদের, ফরাসি দেশ থেকে পাঁচক ও সর্বোৎকৃষ্ট সুরা আনানো হয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, দু ধরনেরই নৃত্যের ব্যবস্থা থাকে প্রতি সন্ধ্যাকালে। কার্জন দম্পতির এক পয়সাও ব্যয় হয় না, বরং অনেক মণি-মাণিক্য উপহার পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে যাওয়া হয় শিকার অভিযানে, সেও বেশ অদ্ভুত ধরনের শিকার। হাজার খানেক লোক জঙ্গলে কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে, ঢাক ঢোল পিটিয়ে একটা বাঘকে তাড়িয়ে নিয়ে আসে। বেচারি বাঘটি এক সময় কোনঠাসা হয়ে যায়, উঁচু করে বাঁধা মাচার ওপরে নিরাপদ স্থানে বসে কার্জন গুলি করে সেই বাঘের ভবলীলা সাঙ্গ করে দেন। তারপর নেমে এসে মৃত বাঘটির মাথায় পা দিয়ে সদর্পে তিনি সম্মুখীন হন ক্যামেরার।

কোথাও কোথাও গুলি খাওয়ার পরেও অকৃতজ্ঞ বাঘটা পালিয়ে যায়। যেমন হয়েছিল গোয়ালিয়রে। সেখানে শিকারের ব্যবস্থা এলাহি রকমের। জঙ্গলের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে ইন্দ্রপুরী, ফুলের বাগান, ফোয়ারা, বিশ্রামের কক্ষ, বহু রকম খাদ্য-পানীয়ও মজুত। গোটা দশেক হাতির পিঠে চেপে এসেছে বিরাট একটি দল, বাজনা বাজিয়ে, ঝোঁপঝাড় পিটিয়ে একটা বাঘকে তাড়িয়ে আনা হল কাছাকাছি, তার হলুদকালো ডোরাকাটা শরীরটাও দেখা গেল, কার্জন সাহেব বন্দুক তাক করে গুলি চালালেন, অন্য সকলে দেখল, নিঘাত সেই গুলি বাঘের পিঠ ভেদ করে চলে যাবার কথা। তবু চোখের নিমেষে এক লক্ষ্য দিয়ে সেই বাঘ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর খোঁজ খোঁজ খোঁজ, বহুলোক ছড়িয়ে পড়ল বনে, কিন্তু সন্ধান পাওয়া গেল না সেই আহত বাঘের।

কার্জন সাহেব রীতিমতন ক্ষুব্ধ। মানুষের মতন, এই ভারতের পশুরাও তো ব্রিটিশের প্রজা। এই বাঘটা মহামান্য বড় লাটকে পৃষ্ঠ প্রদর্শনের সাহস পেল কী করে? গোয়ালিয়রের মহারাজও তটস্থ, তাঁর রাজ্যের এত বড় অতিথি যদি শিকারে অসার্থক হয়ে ফিরে যান, তবে সেটা যেন তাঁরই অপরাধ, তাঁরই গাফিলতি। ভোজ্য-পেয়র দিকে আর মন না দিয়ে সস্ত্রীক লর্ড কার্জন ফিরে গেলেন প্রাসাদে। কয়েক ঘণ্টা পরে, কার্জন মনের দুঃখে বিছানায় শুয়ে আছেন, মেরি জানলা দিয়ে দৃশ্য উপভোগ করছেন। হঠাৎ মেরির দুই চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে গেল, তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, জর্জ, জর্জ, শিগগির এসে দেখে যাও!

একটা চার ঘোড়ার গাড়ি ছুটে আসছে দুরন্ত বেগে, তার ওপর দাঁড়িয়ে আনন্দে প্রায় নৃত্য করছেন গোয়ালিয়রের মহারাজ। তাঁর সর্বাঙ্গ ধূলি ধূসরিত, পেছন দিকে দু দুটো বিশাল মৃত বাঘ! এর মধ্যে কোনটি বা কোনওটিই কার্জনের গুলিতে আহত বাঘ কি না তা নির্ধারণ করা অসম্ভব, তবু ধরেই নেওয়া হল যে, কার্জনের বাঘটি পাওয়া গেছে, এবং সংশয়ের অবকাশ না রাখার জন্য একটির বদলে দুটি বাঘ মেরে আনা হয়েছে!

ত্রিবাঙ্কুর, হায়দরাবাদ, ভোপাল, পাতিয়ালা, গোয়ালিয়র এবং আরও কয়েকটি দেশীয় রাজ্যের আতিথ্য নিতে নিতে চললেন এই দম্পতি। মহারাজ-মহারানিদের অলঙ্কার, রত্নসম্ভার, পায়রার ডিমের মতন হীরক, দেখেই মেরি বেশি অভিভূত। নিজেরও সংগ্রহ হল কিছু কিছু। কার্জন নিজে এক ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত বংশের সন্তান, ঐশ্বর্যের জাঁকজমক তাঁর বেশ পছন্দ। কিন্তু কার্জন কর্মদ্যোগেও বিশ্বাসী। ভোগ-বিলাস থাকবে, তার সঙ্গে কাজও করতে হবে। এই রাজাগুলি কাজের ব্যাপারে একেবারে অপদার্থ, কোনও কাজই করে না, সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে না, কেউ কেউ প্রায় সারা বছরই বিলেতে কাটিয়ে আমোদের স্রোতে গা ভাসায়, এটা কার্জনের পছন্দ নয়। মাঝে মাঝে তিনি এদের ধমক ও উপদেশ দিতেও ছাড়েন না।

এই সফরের সময় কার্জন লক্ষ করলেন, এ দেশে মানুষ রাজাদের দৈবনিযুক্ত বলে মনে করে। রাজার সামনে মাটিতে লুটিয়ে প্রণাম জানায়। রাজার সর্বময় ক্ষমতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করে না। সারা জীবনে কেউ একবার রাজার দর্শন পেলে ধন্য হয়ে যায়। গোটা ভারতবর্ষের আসল রাজা তো ইংলন্ডের রাজা। তাঁকে তো ভারতীয় প্রজারা কখনও চর্মচক্ষে দেখতে পায় না। একবার ইংলন্ডেশ্বরকে আনতে পারলে এই সাম্রাজ্যের প্রজাদের আনুগত্য ও রাজভক্তি আরও দৃঢ় করা যায়। দেশীয় রাজ্যগুলির জনসাধারণকেও বোঝাতে হবে যে তাদের এই সব রাজারাও আসলে ইংলন্ডের রাজার ভৃত্য।

তখনই এক রাজদরবার বসাবার পরিকল্পনা কার্জনের মাথায় এল। কলকাতার বদলে দিল্লিই হবে তার প্রকৃষ্ট স্থান। দিল্লিতে মুঘল সম্রাটদের মহা আড়ম্বরময় দরবারের সঙ্গে পাল্লা দেবে এই ইংরেজ দরবার। এক সময় মুঘল সম্রাটরা ছিলেন ভারতের একচ্ছত্র অধিপতি, ভারতীয়রা এবার দেখবে, সেই দিল্লির মসনদে বসেছেন ব্রিটিশ সম্রাট।

মহারানি ভিক্টোরিয়ার পক্ষে শেষ বয়েসে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া সম্ভব ছিল না। এখন সম্রাট হয়েছেন সপ্তম এডোয়ার্ড, তাঁকে সরাসরি চিঠি লিখে কার্জন তাঁর প্রস্তাবটি সবিস্তারে জানালেন। সেই সঙ্গে চলতে লাগল দরবারের প্রস্তুতি।

শেষ পর্যন্ত সপ্তম এডোয়ার্ড আসতে পারলেন না। তাঁর বদলে এলেন তাঁর ভাই ডিউক অফ কনট। এতে কার্জন-দম্পতি গোপনে দারুণ উল্লাস বোধ করলেন। রাজার ভাই সিংহাসনের অধিকারী নন, ভারতের মাটিতে পদমর্যাদায় তিনি কার্জনের নীচে। সুতরাং দিল্লি দরবারের প্রধান পুরুষ হবেন লর্ড কার্জন।

বিশাল সেই উৎসবের প্রতিটি অঙ্গ নিজে তত্ত্বাবধান করে নিখুঁত ভাবে সাজালেন কার্জন। আমন্ত্রণ জানানো হল, দেশের সব কটি দেশীয় রাজ্যের নবাব ও রাজাদের, বিশিষ্ট ধনী ব্যক্তিদের, ইওরোপীয় সমাজের গণ্যমান্যদের। খুঁজে খুঁজে আনা হল ভারতের সবচেয়ে বড় হাতিটি, তার হাওদা স্বর্ণখচিত, সেখানে বসলেন কার্জন, তাঁর মাথায় সোনার ছত্র। সহস্র কণ্ঠের সহর্ষ ধ্বনির মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ করল হাতিটি, কার্জন একটা হাত তুলে রইলেন, যেন তিনিই সম্রাট। আর মখমলের পোশাক পরা, হিরে-মুক্তোর গয়নায় মোড়া, যাত্রাদলের রাজা-সাজা বড় বড় দেশীয় রাজ্যের রাজা ও নবাববৃন্দ বিগলিতভাবে, মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানালেন সেই রাজ-ভৃত্যকে।

যারা সেই দরবারে এল না, সেই শিক্ষিত সমাজ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, স্বদেশপ্রেমিকগণ সম্রান্ত ভারতীয়দের এই করুণ বিদৃষকের ভূমিকা দেখে লজ্জায় অধোবদন হল। পত্র-পত্রিকায় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ চলল বেশ কিছুদিন।

গ্রীষ্মকালে ভারতের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় সিমলায়। বছরের অন্য সময় কার্জন সারা ভারত ঘুরে ঘুরে কার্য পরিদর্শন করেন। নিয়ম শৃঙ্খলায় সামান্য গাফিলতি তিনি সহ্য করেন না। তিনি নিজেও যেমন পরিশ্রম করেন, অন্যরাও তেমন পরিশ্রম করুক, তিনি চান। সরকারি কাগজপত্র দেখার জন্য রাত্রি জাগরণেও তাঁর দ্বিধা নেই। তাঁর পিঠের ব্যাথাটা মাঝে মাঝেই চাড়া দিয়ে ওঠে, তিনি গ্রাহ্য করেন না, কোনও কাজ তিনি পরের দিনের জন্য ফেলে রাখেন না। দিল্লির দরবারে অত বড় হাতির পিঠ থেকে নামার সময় তিনি পিঠে শূল বেঁধার মতন ব্যথা অনুভব করেছিলেন, কেউ তা বুঝতে পারেনি।

কলকাতার শীত বেশ মৃদু। ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস নেই, তুষারপাত নেই, এই রকম শীতই মেরির পছন্দ। শীতের কয়েকটা মাস কার্জনদম্পতি কলকাতায় কাটান।

একদিন সকালবেলা ছোটহাজরি খেতে খেতে মেরি বললেন, আচ্ছা জর্জ, আমরা ভারতে এসেছি প্রায় চার বছর হয়ে গেল, বহু জায়গায় ঘুরেছি, বহু সম্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়িতে আতিথ্য নিয়েছি। কলকাতাতেও তো বাঙালিদের মধ্যে অনেক সম্ভ্রান্ত ধনী আছে, তাদের কারুর বাড়িতে তো আমরা কখনও যাইনি? তারা কি আমাদের ডাকবে না?

কার্জন মুখ তুলে বললেন, ডাকবে না কেন? অনেকেই ডাকে। আমরা গেলে তারা ধন্য হয়ে যাবে। কিন্তু আমার যেতে ইচ্ছে করে না।

 মেরি বললেন, কেন? চলো না, একবার অন্তত গিয়ে তাদের আচার ব্যবহার কেমন দেখে আসি!

কার্জন বললেন, না!

এই বাঙালি জাতিটিকে কার্জন কিছুতেই পছন্দ করতে পারেন না। দিন দিন তাঁর মনোভাব আরও কঠোর হয়ে আসছে। বাঙালিদের মধ্যে হিন্দু আর মুসলমান, এই দুটি জাতি আছে। এদের মধ্যে বাঙালি বলতে যেন হিন্দুদেরই বোঝায়। শিক্ষিত হিন্দুরা সবাই বাঙালিবাবু। এই হিন্দুগুলোই বেশি বক্তৃতাবাজ, কলমবাজ, বেশি বিরক্তিকর। কার্জন মুসলমানদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারেন, এরাই ছিল কিছুকাল আগে এ দেশের শাসক শ্রেণী, ইংরেজ আমলে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তারা এখন আহত সিংহের মতন ক্ষতস্থান চাটছে, আপাতত তারা নীরব। ইংরেজ সরকারের উচিত এদের শুশ্রূষা করা। এদের ক্ষোভ নিরসনের ব্যবস্থা করা। ত আর হিন্দুরা? বহু শতাব্দী ধরে তারা অন্যের পদানত, না জানে যুদ্ধবিদ্যা, না জানে কূটনীতি। এখন দু’পাতা ইংরেজি পড়ে কিংবা লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসে যে গলাবাজি শুরু করেছে, তা সহ্য করা হবে কেন?

কার্জন গোপন রিপোর্ট পেয়েছেন, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে মুসলমানরা খুব কম সংখ্যায় যোগ দেয়। কংগ্রেসে হিন্দু-প্রাধান্যের জন্য বেশ কিছু মুসলমান ক্ষুব্ধ। আর কংগ্রেসের হিন্দুদের মধ্যেও অধিকাংশ বাঙালিবাবুই জায়গা জুড়ে আছে। এই বাঙালিবাবুদের হীনবল করে দেবার জন্য কৌশলে মুসলমান সমাজকে আরও দূরে সরিয়ে দেওয়াই সরকারি নীতি হওয়া উচিত।

মেরি বললেন, জর্জ, তুমি একটা মজার গল্প জানো? এখানকার পুরনো কর্মচারীদের কাছে শুনেছি। এক সময় এখানে গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড ডাফরিন। তিনি নাকি বাঙালি রান্না খেতে খুব ভালবাসতেন। আর লেডি ডাফরিন খুব রূপসী ছিলেন বুঝি? একদিন তিনি এক বাঙালির বাড়িতে গেছেন, অমনি সে বাড়ির মহিলারা তাঁকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে তাঁর গাউন খুলিয়ে শাড়ি পরিয়ে দিল। তুমি জানো, বাঙালিরা টেবল চেয়ারে বসে খায় না, মাটিতে বসে খায়। কাঁটা-চামচ ব্যবহার করে না, আঙুল দিয়ে খাবার তোলে, অদ্ভুত না? মেঝেতে বুদ্ধের মতন পা মুড়ে বসতে হয়। লেডি ডাফরিনকে একটা রূপোর থালার মাঝখানে ভাত, আরও কী সব দিল, তিনি নাকি দিব্যি হাত দিয়ে তুলে তুলে সেইসব খেলেন। সবাই বলেছিল, উনি ঠিক বাঙালিদের মতনই খেতে জানেন!

গল্পটা শেষ করে মেরি বললেন, শাড়ি জিনিসটা কী রকম করে পরে? আমি শাড়ি পরলে আমাকে মানাবে?

মেরি হাসছেন, জর্জ ভুরু কুঁচকিয়ে বললেন, তুমি নেটিভদের পোশাক পরবে? ছিঃ!

কলকাতায় মেরিকে এই সরকারি প্রাসাদেই আবদ্ধ থাকতে হয়, অনেক বাঙালি অভিজাতদের বাড়ির সান্ধ্যভোজের উৎসব-আসরের কথা তাঁর কানে আসে, কিন্তু কার্জন কোথাও যেতে রাজি নন।

বাঙালিবাবুদের জব্দ করার জন্য এর মধ্যেই কার্জন কিছু কিছু কাজ শুরু করে দিয়েছেন। প্রথম কোপটা পড়েছিল, ভারতে এসে পৌঁছবার কিছুদিনের মধ্যেই।

কিছু কিছু কাজে ভারতীয়দের জনপ্রতিনিধিত্ব রাখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল কয়েক বছর আগে থেকেই। যেমন কলকাতা করপোরেশন পরিচালনা। নগর উন্নয়ন এবং নাগরিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য ব্যবস্থাপনার জন্য করদাতাদের মধ্য থেকে পঞ্চাশজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হত। ফলে দলে দলে বাঙালিবাবু করপোরেশনের কমিশনার হতে লাগল, এরা আলোচনা সভায় চ্যাঁচামেচি করে, নীতি-নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করতে চায়। সরকারি নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে কার্জন আসার আগেই ছোট লাট ম্যাকেঞ্জি একটি সংশোধনী বিল আনতে চেয়েছিলেন। কার্জন এসে সব দেখে শুনে মনে করলেন, সেই সংশোধনী বিলও যথেষ্ট কড়া নয়। দেশের রাজা ইংরেজ, রাজধানী কলকাতার নগর পরিচালনার ব্যাপারে মাথা গলাবে এ দেশের মানুষ? তা কখনও হয়? খচাখচ করে কেটে তিনি বিলের অনেক ধারা বদলে দিলেন। করদাতাদের প্রতিনিধিদের সংখ্যা পঞ্চাশ থেকে নেমে গেল পঁচিশে, এক্সিকিউটিভ কমিটিতেও তাদের সংখ্যা হয়ে গেল এক তৃতীয়াংশ, সরকারি প্রতিনিধির সংখ্যা বেড়ে গেল! অর্থাৎ করপোরেশন পরিচালনার পুরোপুরি ক্ষমতা চলে গেল সরকার ও ইওরোপীয় প্রতিনিধিদের হাতে, বাঙালি পুঙ্গবরা বড়জোর সেখানে কিছু গলাবাজি করতে পারবে।

 প্রতিবাদে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সমেত আঠাশজন কমিশনার পদত্যাগ করেছিলেন। কার্জন ভ্রুক্ষেপ করেননি। এদেশের কীসে ভাল হয়, তা ইংরেজদের চেয়ে কি দেশীয় লোকরা ভাল বুঝবে? তিনি যা করেছেন, ঠিক করেছেন।

এরপর শিক্ষা। শিক্ষাখাতে সরকারের বহু অর্থ ব্যয় হয়, কিন্তু দিন দিন দেখা যাচ্ছে শিক্ষানীতির ব্যাপারে সরকারি লাগাম ক্রমশ আলগা হয়ে আসছে, বেসরকারি কলেজ গজিয়ে উঠছে চতুর্দিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের অধিকাংশ সদস্যই নেটিভ। এ দেশে এত উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বা কী? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটে ঢুকে পড়েছে বাংলার বহু রাজনৈতিক নেতা, সেখান থেকে তারা বাংলার লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হয়ে আসছে। আই সি এস-দের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। প্রথম দিকে যারা, আই সি এস পাশ করেছিল, সেই চারজনই বাঙালি, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিহারীলাল গুপ্ত এবং রমেশচন্দ্র দত্ত। এখনও আই সি এস-দের মধ্যে বাঙালিদেরই প্রাধান্য। ইংরেজি-পড়া উচ্চশিক্ষিত বাঙালিবাবুরা দেশাত্মবোধের কথা ছড়াচ্ছে। সুতরাং উচ্চশিক্ষার জন্য টাকা খরচ করা তো সরকারের পক্ষেই ক্ষতিকর। তার চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধিই ভাল। ম সরকার পক্ষ থেকে সিমলায় একটি শিক্ষা কমিশন বসানো হল। ছ’জন সদস্যের সেই কমিশনে চারজন ইংরেজ আর দু’জনের নাম সৈয়দ হোসেন বিলগ্রাসী আর নবাব ইমাদ-উল-মুলক। এ যেন কার্জন সাহেবের কৌতুক। ভারতে শিক্ষিতদের মধ্যে হিন্দুরা বিপুল পরিমাণে সংখ্যাধিক, অথচ শিক্ষা কমিশনে একজনও হিন্দু নেই!

সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদ ও সংবাদপত্রগুলিতে প্রচুর লেখালেখির ফলে কার্জন হিন্দুদের মধ্য থেকে একজন প্রতিনিধি নিতে সম্মত হলেন কোনও ক্রমে। এলেন বিচারপতি গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

কমিশনের সুপারিশ লর্ড কার্জনের অনুজ্ঞারই প্রতিধ্বনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সরকারি অধিপত্য বজায় রাখতে হবে। সেনেটগুলিতে দেশীয় ব্যক্তিদের সদস্য সংখ্যা কমিয়ে ইংরেজ সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। বেসরকারি কলেজে আইন পড়ানো চলবে না। সমস্ত স্কুল-কলেজের অনুমোদন কিংবা অনুমোদন প্রত্যাহারের ক্ষমতা থাকবে কাউনসিলের হাতে। কিছু কিছু কলেজ বন্ধ করে দেওয়া এখনি দরকার। এ দেশের ছাত্রদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধে কমিয়ে দেবার জন্য বেতন বৃদ্ধি ও পাশ মার্ক বাড়াতে হবে। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে একমাত্র গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই সুপারিশের প্রতিবাদ করেন, তা অগ্রাহ্য করা হল। বড় বড় শহরগুলিতে সরকারের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অনেক সভা-সমিতি হল, ছাত্ররা মিছিল করে বেরুল রাস্তায়। কার্জন তাতে মজাই পেলেন বেশ। সেক্রেটারি অফ স্টেট-কে একটা চিঠিতে সকৌতুকে লিখলেন, টাউন হল আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে ঘামে-ভেজা, গলা-ফাটানো গ্রাজুয়েটরা জমায়েত হয়ে গিসগিস করছিল, আমার নাম করে তারা বারবার ধিক্কার দিয়েছে, যেন আমিই ভারতে উচ্চশিক্ষার ধ্বংসকারী!… তবে বিশ্ববিদ্যালয় বিল নিয়ে নেটিভদের চ্যাঁচামেচিতে আপনি বিচলিত হবেন না। এর বেশির ভাগই কৃত্রিমভাবে বানানো!

বাঙালি ভদ্রলোকদের জব্দ করার আর একটি মারাত্মক অস্ত্র কার্জন আকস্মিকভাবে পেয়ে গেলেন।

পুলিশ বিভাগের বড় কর্তা অ্যান্ড্রু ফ্রেজার কার্জনের খুব ঘনিষ্ঠ। একদিন সান্ধ্য আসরে পানীয়ের গেলাস হাতে নিয়ে সে কার্জনকে বলল, সম্প্রতি আমি ঢাকা, মৈমনসিং ইত্যাদি অঞ্চল ঘুরে এলাম। ওখানকার লোকদের মতিগতি সুবিধের নয়। এক শ্রেণীর বাঙালিবাবু নানান আলাপ-আলোচনায় রাজদ্রোহিতা ছড়াচ্ছে। সারা বাংলা জুড়েই উত্তপ্ত রাজনীতির আবহাওয়া। এখনও সে রকম বড় কিছু হয়নি, তবে এই ধরনের বিষবৃক্ষের বিনাশ অঙ্কুরেই করা উচিত।

কার্জন বললেন, সেটা তো তোমারই কাজ।

ফ্রেজার বলল, এখনই ধরপাকড় করে আমি কোনও সন্ত্রাসের আবহাওয়া সৃষ্টি করতে চাই না। অন্য একটা ভাল উপায় আছে। পুলিশের কতা হিসেবে আমার এক্তিয়ারের মধ্যে না পড়লেও, আমার মনে হয়, ঢাকা আর মৈমনসিং এই জেলা দুটোকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে, অসমের সঙ্গে জুড়ে দিলে কেমন হয়? কিংবা অন্যভাবেও বাংলাকে ভাগ করা যায়। বাঙালিদের দুর্বল করে দিতে হলে বাংলাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়াই শ্রেষ্ঠ উপায়।

কার্জন ভ্রুকুঞ্চিত করে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, বাংলা ভাগ করলে কী লাভ হবে?

ফ্রেজার বলল, মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলি নিয়ে যদি আলাদা রাজ্য গড়া যায়, মুসলমানরা রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করে না, তারা ইংরেজ বিরোধী নয়, তাতে হিন্দুবাঙালিদের শক্তি কমে যাবে। এদিককার রাজ্যটি ছোট হয়ে গেলে বাঙালিবাবুদের কণ্ঠস্বর সারা ভারতে গুরুত্ব পাবে না।

এবারে কার্জন উৎসাহিত হয়ে উঠে বললেন, হিন্দু আর মুসলমানদের পৃথক করে দেওয়ার এ একটা ভাল উপায় বটে, কিন্তু বাংলাকে ভাগ করা হবে কোন যুক্তিতে?

ফ্রেজার বলল, কেন, যুক্তি তো তৈরি আছেই। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি রাজ্য হিসেবে বড় বড়, তাতে শাসনকার্য চালাবার খুব অসুবিধে। সিভিলিয়ানরা অনেক দিন থেকেই এ ব্যাপারে আপত্তি জানাচ্ছে। বাংলাকে ভাগ করার প্রস্তাব আগেও অনেকবার ভোলা হয়েছে। এমনকী, আপনার আগে যিনি ছিলেন, সেই লর্ড এলগিনের কাছে একটা পরিকল্পনা পেশ করাও হয়েছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয়, তিনি কিছুই করলেন না।

কার্জন জিজ্ঞেস করলেন, কেন লর্ড এলগিন সেটা বিবেচনা করলেন না, তা আমার জানা দরকার।

ফ্রেজার বললেন, তিনি হ্যাঁ-ও বলেননি, না-ও বলেননি। লর্ড এলগিনের এই তো এক দুর্বলতা ছিল, তিনি সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করতেন।

কার্জন টেবিলে এক মুষ্ট্যাঘাত করলেন। লর্ড এলগিন আর লর্ড কার্জন এক নন। সিদ্ধান্ত নিতে লর্ড কার্জনের কখনও সাহসের অভাব হয় না। ডিভাইড অ্যান্ড রুল! হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে হবে, তার জন্য চাই পর্যায়ক্রমে নিখুঁত পরিকল্পনা। বাংলা ভাগ অতি উত্তম প্রস্তাব।

ফ্রেজার এবার উৎসাহ পেয়ে বলল, প্রায় বছর তিরিশেক আগে অসমকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, তখন সিলেট, কাছাড় আর গোয়ালপাড়া এই তিনটে বাংলাভাষী রাজ্য বাংলা থেকে কেটে অসমে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। তাতে বাঙালিরা আপত্তি করেনি। এখন শাসন কার্যের সুবন্দোবস্তের কথা বলে পূর্ব বাংলার জেলাগুলি নিয়ে আলাদা রাজ্য গড়লে বাঙালিরা বিশেষ আপত্তি জানাবার যুক্তি খুঁজে পাবে না।

কার্জন বললেন, আপত্তি জানালেই বা কানে তুলতে হবে কেন? দেশ শাসন করছে কে, ইংরেজরা। তাদের ওপর বাঙালিবাবুদের কথা বলার কী অধিকার আছে। তুমি ভাল করে পরিকল্পনা তৈরি করো!

এতই খুশি হলেন লর্ড কার্জন যে অবিলম্বে ফ্লেজারের পদোন্নতির আদেশ দিলেন। পুলিশের বড় কতা থেকে এক লাফে লেফটেনান্ট গভর্নর বা ছোট লাট হয়ে গেল অ্যান্ড্রু ফ্রেজার।

কার্জন স্বয়ং বেরুলেন পূর্ববঙ্গ পরিদর্শনে। প্রথমে এলেন মৈমনসিংহে, এখানকার প্রধান জমিদার সূর্যকান্ত আচার্যচেীধুরীকে লোকে বলে মহারাজ। এই প্রথম এক বাঙালি হিন্দুর প্রাসাদের আতিথ্য নিলেন লর্ড কার্জন। মেরিকে সঙ্গে আনেননি, এবারে তাঁর সফরের মূল উদ্দেশ্য বঙ্গবিভাগের পরিকল্পনার সমর্থন আদায় করা। সরকারের এই উদ্দেশ্য বা চক্রান্তের কথা ইতিমধ্যেই প্রচারিত হয়ে গেছে, অধিকাংশ লোকই কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না। বাঙালিদের মতামত না-নিয়েই বঙ্গদেশকে ভঙ্গ করা হবে? বাংলার এক দিকে শুধু মুসলমান, এক দিকে শুধু হিন্দুরা থাকে, এমন তো নয়। হিন্দু ও মুসলমান সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে, কোনও কোনও জেলায় কোনও এক সম্প্রদায়ের সংখ্যাধিক্য। জন্মসূত্রে, ভাষার সুত্রে সবাই বাঙালি।

মৈমনসিং-এর মানুষ শত শত আবেদনপত্র জমা দিল কার্জনের কাছে। মহামান্য বড় লাটের কাছে তারা মিনতি জানাচ্ছে এই প্রস্তাব রদ করার জন্য। কার্জন সেই সব আবেদনপত্র বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিলেন। তাঁর কাছে এসবই যেন অবোধ শিশুদের কান্নাকাটি।

মহারাজের প্রাসাদে লর্ড কার্জনের আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি নেই। কিন্তু মধ্যাহ্নভোজের সময় কার্জন যখন সূর্যকান্তকে বঙ্গভঙ্গ বিষয়ে মতামত জিজ্ঞেস করলেন সূর্যকান্ত দ্বার্থহীন ভাষায় জানালেন, তিনি এ পরিকল্পনা একেবারেই সমর্থন করেন না। বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোথাও অশান্তি নেই, এই বিচ্ছেদ নীতি কোনও বাঙালিই মেনে নেবে না।

সূর্যকান্তর কথা শুনে এমনই বিরক্ত হলেন লর্ড কার্জন যে, সেই প্রাসাদে রাত্রিবাস করতেও রাজি হলেন না আর { সকালে এসে পৌঁছেছিলেন, বিকেলেই রওনা দিলেন ঢাকার দিকে।

ঢাকার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি নবাব সলিমুল্লা। তিনিও প্রকৃতপক্ষে নবাব নন। তাঁর পিতামহ ছিলেন একজন অতি ধনী ব্যবসায়ী, ঢাকা এবং সন্নিহিত এলাকায় প্রচুর ভূসম্পত্তিতে অর্থলগ্নি করেছিলেন। তাঁর অনেক সদগুণ ছিল, তিনি হিন্দুদের কাছেও ছিলেন খুব জনপ্রিয়। তিনি হাসপাতাল ও অনেক দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন, সেই সব কারণে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সাধারণ মানুষই তাঁকে নবাব উপাধি দিয়েছিল। বর্তমান নবাব অবশ্য সেসব গুণের অধিকারী নন, উপরন্তু কিছু কিছু অবিবেচনার ফলে ঋণভারে জর্জরিত।

নবাবের এই ঋণগ্রস্ত অবস্থার কথা অ্যান্ড্রু ফ্রেজার আগেই লর্ড কার্জনকে জানিয়ে দিয়েছিল। কার্জন ঢাকায় এসেই নবাবকে সরকারের পক্ষ থেকে এক লক্ষ পাউন্ড ধার দেবার প্রস্তাব দিলেন। দেশের আর কোনও ব্যক্তি সরকারের কাছ থেকে এরকম অযাচিত ঋণ কখনও পায়নি। লর্ড কার্জনের এরকম অভূতপূর্ব উদারতার পেছনে উদ্দেশ্যটি প্রকট। নবাব সলিমুল্লা এলোরে বিগলিত হয়ে বড় লাটের আজ্ঞাবহ হয়ে গেলেন।

বঙ্গভঙ্গ খুব দ্রুত কার্যকর করা অবশ্য কার্জনের পক্ষে সম্ভব হল না। এর জন্য সেক্রেটারি অফ স্টেটের অনুমোদন প্রয়োজন। চিঠিপত্র চালাচালি চলছে, এর মধ্যে মেরিকে পাঠাতে হল ইংল্যান্ডে, তিনি সন্তানসম্ভবা, তৃতীয়বার জননী হবেন। কিছুদিন পরেই সংবাদ এল, আর একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন বটে মেরি, কিন্তু তিনি নিজে গুরুতর অসুস্থ, তাঁর জীবনসংশয়। কিন্তু খবর পেলেও তৎক্ষণাৎ পৌঁছবার তো কোনও উপায় নেই। ভারত থেকে জাহাজে ইংল্যান্ডে পৌঁছতে অন্তত সতেরো দিন লাগে। এর মধ্যে কিছু অঘটন ঘটল না।

কার্জন ইংল্যান্ডে গিয়ে বসলেন স্ত্রীর শয্যাপার্শ্বে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *