অষ্টষষ্টিতম অধ্যায় – ষড়োশোপচার–আসনাদি-উপচার ষটক বিধান
ভগবান্ বলিলেন;–হে ভৈরব! এক্ষণে ষোড়শ উপচারদিগের উল্লেখ করিতেছি, শ্রবণ কর; যাহা সম্যক্ ভক্তিসহকারে প্রদত্ত হইলে দেবী এবং অন্য দেবতা পরম সন্তোষ লাভ করেন। ১
প্রথমে পুষ্পময় অথবা দারুময়, কিংবা বস্ত্র, চর্ম বা কুশনির্মিত আসন দান করিবে, ঐ আসন মণ্ডলের উত্তরে নিক্ষেপ করিবে। ২
যদি পদ্মে আসন দান করে তাহা হইলে বাক্য পুষ্প ও জলের সহিত উহা মণ্ডলের উত্তরে নিবেদন করিবে। ৩।
পুষ্প ভিন্ন আচ্ছাদক বস্তু দান করিলে উহা পদ্মের বহির্দেশে দ্বারাদিতে নিবেদন করিবে। ৪
অর্ঘ্য, পাদ্য, আচমন, স্নানীয়, নেত্ররঞ্জন, মধুপর্ক, গন্ধ এবং পুষ্প এই সকল বস্তু পদ্মেই দান করিবে। ৫
হে উত্তম পুরুষদ্বয়! যে সকল বস্তু প্রতিমার গাত্রাদিতে দান করিবার যোগ্য তাহাদিগকে যথাস্থানে দান করিবে এবং যে সকল বস্তু গাত্রে দান করিবার অযোগ্য সেই সকল বস্তু আর নৈবেদ্য ও ভোজনাদির বস্তু সম্মুখে দান করিবে। ৬
পুষ্পাসন যে বিহিত হইয়াছে তাহা যদি পুষ্পের গর্ভমাত্র হয়, তাহা হইলে পদ্মেতেই উহা দান করিবে। আর যদি উহা বৃহদাকার হয় তবে দ্বারেই অর্পণ করিবে। ৭
হে ভৈরব! কুশ সূত্ৰাদিসংযুক্ত, পুষ্পৌঘরচিত পৌষ্প আসন দেবীর, আমার এবং অপর দেবতারও অতিশয়, প্রীতিকর জানিবে। ৮
ব্রণরহিত যজ্ঞকাষ্ঠ-সমূদ্ভুত নাতি-উচ্চ নাতি-বিস্তীর্ণ আসনই শুভকর। ৯
কণ্টক ও ক্ষীরযুক্ত কাষ্ঠের সারবর্জিত অন্য কাষ্ঠ-নির্মিত উত্তম আসনও দান করিতে পারে। ১০
চৈত্যবৃক্ষ, শ্মশানসম্ভূত বৃক্ষ এবং বিভীতক ইহাদের আসন পরিত্যাগ করিবে। ১১
বল্কজ, কোষজ, শাণ এই তিন প্রকার বস্ত্র রোমজ কম্বল লইয়া চারি প্রকার বস্ত্র। ১২
ইষ্ট সিদ্ধির নিমিত্ত এই চারি প্রকার বস্ত্র দ্বারা নির্মিত আসন দান করিবে। সিংহ, ব্যাঘ্র, তরক্ষু, ছাগ, মহিষ, হস্তী, ঘোটক, সৃমর প্রভৃতি এবং নয় প্রকার মৃগ ইহাদের চর্মদ্বারা নির্মিত আসন সকল দেবতারই প্রীতিপ্রদ। ১৩-১৪
বস্ত্রাসনের মধ্যে কম্বলাসনই প্রশস্ত এবং দেবতাদিগের তুষ্টি প্রদ, চৰ্মাসনের মধ্যে রাঙ্কব এবং কাষ্ঠাসনের মধ্যে চন্দন কাঠ নির্মিত আসনই প্রশস্ত। ১৫-১৬
দেবতা এবং যতাত্মা ঋষিদিগের পক্ষে কুশাসনের মত সৰ্বোত্তম আসন আর নাই। ১৭
আসন যোগপীঠসদৃশ স্থান বলিয়া কথিত হয়। আসন প্রদান করিতে সৌভাগ্য এবং মুক্তি লাভ হয়। ১৮
সম্বর, রোহিত, নৃঙ্কু, রঙ্কু, শশ, রুরু, এণ, হরিণ প্রভৃতি নয় প্রকার মৃগ। ১৯
হে ভৈরব! হরিণেরও পাঁচ প্রকার ভেদ আছে জানিবে। যথা ঋষ্য, খড়্গ, রুরু, পৃষত এবং মৃগ, বলি প্রদান বিষয়ে এবং চৰ্ম্মদানে ইহারাই প্রশস্ত বলিয়া কীৰ্তিত হইয়াছে। ২০-২১
লৌহ, কাংস্য এবং সীসক ভিন্ন সমুদয় তৈজস আসন প্রশস্ত বলিয়া কীর্তিত হইয়াছে। ২২
ভুক্তি এবং মুক্তির নিমিত্ত শিলাময়, মণিময়, এবং রত্নময় আসন পরিত্যাগ করিবে। ২৩
হে ভৈরব! এই প্রসঙ্গেই সাধকদিগের আসন শ্রবণ কর, যে আসনে আসীন হইয়া পূজা করিলে সাধকের ধর্ম সিদ্ধি হয়। ২৪
সাধকদিগের পক্ষে কাষ্ঠনির্মিত, চৰ্ম্মনিৰ্ম্মিত, বস্তুনির্মিত এবং তৈজস এই এই চারিপ্রকার আসন কার্তিত হইয়াছে। ২৫
পূর্বে দেবতাদিগকে দান করিবার নিমিত্ত, যে সকল আসন কথিত হইয়াছে, পূজা কৰ্ম্মে সাধকের উপবেশনার্থ সেই সকল প্রকার আসনই প্রশস্ত।
সাধক পূজা কাৰ্যে আপনার ইচ্ছামত আসনে উপবেশন করিবে না। পণ্ডিত সাধক এই নিমিত্ত কাষ্ঠাদির অন্যতম আসন করিবে। কাষ্ঠাসন চতুর্বিংশতি অঙ্গুলি দীর্ঘ, ষোড়শাঙ্গুল বিস্তীর্ণ এবং চতুরঙ্গুলি পরিমিত উচ্চ হইবে। অথবা উচ্ছ্রিত করিবে, ইহা অপেক্ষা অধিক উচ্চ করিবে না। ২৭-২৮
পূর্বে যে সকল আসন বর্জনীয় বলিয়া উক্ত হইয়াছে, সেই সকল আসন পরিত্যাগ করিবে। ২৯
পূজা কৰ্ম্মে বস্ত্ৰাসন দ্বিহস্তের অধিক দীর্ঘ, অর্ধহস্তের অধিক বিস্তৃত করিবে এবং তিন অঙ্গুলির অধিক উচ্চও করিবে না। ৩০
পূর্বোক্ত সিদ্ধিদায়ক চৰ্মাসনে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আপনার ইচ্ছানুসারে করিতে পারে কিন্তু উহা কখন ছয় অঙ্কুলের অধিক উচ্চ করিবে না। ৩১
মহামায়া এবং কামাখ্যা দেবীর পূজায় কাম্বল, চাৰ্ম্মণ এবং শৈল আসন প্রশস্ত বলিয়া উক্ত হইয়াছে। ত্রিপুরা দেবী এবং বিষ্ণুর পূজায় কুশাসনই সৰ্ব্বদা প্রশস্ত। ৩২-৩৩
বহু দীর্ঘ, বহু উচ্চ এবং বহু বিস্তৃত দারু এবং প্রস্তরখণ্ড সকল কর্মে ভূমির সমান জানিবে। ৩৪
ঐরূপ কাষ্ঠের এক এক অংশকে পৃথক পৃথক্ আসনরূপে কল্পনা করিবে। কোন পূজায় পত্রকে আসন করিয়া উপবেশন করিবে না। ৩৫
হস্তিভিন্ন অপর প্রাণীর অস্থি আদি নির্মিত আসন গ্রহণ করিবে না। ৩৬
কাম্য পূজায় মাতঙ্গদন্তনির্মিত আসন গ্রহণ করিবে এবং পূর্ব কথিত চর্ম সকল ও গন্ধমৃগের চর্মও আসন করিতে পারে। ৩৭
যদি জলে দেবতার পূজা করে তাহা হইলেও আসনে উপবিষ্ট হইয়াই পূজা করিবে, দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া পূজা করিবে না। ৩৮
জলে পূজা করিবার সময় শিলাময়, কৌশ আসন গ্রহণ করিবে, কিন্তু কাষ্ঠময় অথবা তৈজস আসন গ্রহণ করিবে না। ৩৯
যদি সেই জলে আসরোপে সংস্থান না থাকে, তাহা হইলে পূজক মনে মনে আসনের কল্পনা করিয়া পূজা করিবে!eo
যদি জলের মধ্যে অথবা অন্যত্র আসন পাতিবার সুযোগ না থাকে, তাহা হইলে সেই স্থানে দাঁড়াইয়া দেবপূজা করিবে। ৪১
হে পূর্বদ্বয় বেতাল ও ভৈরব! পূজা এবং পূজক সম্বন্ধে আসনের কথা বলা হইল, এক্ষণে পাদ্যের কথা শ্রবণ কর। ৪২
পাদপ্রক্ষালনার্থ উদকের নাম পাদ্য; উহা কেবল জল। উহা কোন তৈজস পাত্রে অথবা শঙ্খে রাখিয়া দান করিবে। ৪৩
এই পাদ্য ধৰ্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের সংস্থান। আসনের পরই মূলমন্ত্র উচ্চারণ করিয়া পাদ্য দান করিবে। ৪৪
কুশ, পুষ্প, অক্ষত, সিদ্ধার্থ, চন্দন এবং জল এই সমস্ত দ্রব্য অথবা ইহাদের যাহা যাহা লব্ধ হইবে, তাহা দ্বারা সিদ্ধিলাভের নিমিত্ত অর্ঘ্য দান করিবে। ৪৫
অর্ঘ্য দ্বারা কামনায় সিদ্ধি হয়, অর্ঘ্য দ্বারা ধনলাভ হয় এবং অর্ঘ্য দান করিলে পুত্র, আয়ু, সুখ ও মোক্ষ লাভ হয়। ৪৬
বিচক্ষণ সাধক শঙ্খজলের দ্বারা সূৰ্য্যকে এবং শুক্তিপাত্রে বিষ্ণুকে অর্ঘ্য দান করিবে না। ৪৭
সুগন্ধি, নিৰ্ম্মল, ফেনবর্জিত কৃষ্ণাগুরু ধূপ দ্বারা ধূপিত, কর্পূরবাসিত শুভরূপ সলিল আচমনরূপে তৈজস পাত্রে বা শঙ্খে রাখিয়া দান করিবে। ৪৮-৪৯
দেবতার উদ্দেশে ফেনবর্জিত কেবল যে নিৰ্ম্মল জলদান করা হয়, তাহাকে আচমনীয় বলে। ৫০
অমিশ্রিত কেবল শুদ্ধ জলই আচমনীয়রূপে দান করিবে এবং যদি সুলভ হয়, তবে গন্ধদ্রব্যে সুগন্ধি করিয়া আচমনীয় দান করিবে। ৫১
সাধক আচমনীয় দান করিয়া নিত্য আয়ুঃ, বল, যশঃ, বৃদ্ধি এবং অভিলষিত লাভ করে। ৫২
দধি, ঘৃত, জল, মধু এবং চিনি এই পাঁচটী দ্রব্য মিশ্রিত হইয়া মধুপর্ক হয়, ইহা দেবতাগণের তুষ্টি প্রদান করে। ৫৩
মধুপর্কে জল অতি অল্প মাত্রায় দান করিবে, চিনি, দধি এবং ঘৃত সমান পরিমাণে দান করিবে এবং মধু অধিক পরিমাণে দান করিবে। ৫৪
ঐ মধুপর্ক জ্যোতিষ্টোম, অশ্বমেধ, পুৰ্ত্ত, ইষ্ট বা পুজায় কাংস্য পাত্রে রৌক্ম বা শ্বেতময় পাত্রে দান করিবে। ৫৫
এই মধুপর্ক সমুদয় দেবতাগণের তুষ্টিপ্রদ এবং ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের সাধক। ৫৬
মধুপর্ক, সৌখ্য, ভোগ্য, তুষ্টি ও পুষ্টি প্রদান করে। ৫৭
পিষ্টাতক, কস্তূরী, রোচনা, কুঙ্কুম, গুড়, মধু, পঞ্চগব্য, সর্বৌষধিগণ, চিনি, নির্ণেজন, তৈল, স্নিগ্ধ স্নেহ এবং স্বস্তিক এই সকল দ্রব্য দানের পর কল্পকোবিদ পণ্ডিতগণ কর্পূরাদিদ্বারা অধিবাসিত সুবর্ণ বা রত্নোদক স্নানীয়দ্বারা দান করিতে বিধান করিয়াছেন। ৫৮-৫৯
তৈজস, কাংস্য পাত্র বা শঙ্খের দ্বারা ঐ স্নানীয় জল মণ্ডলে কেশরাগ্রে বা প্রতিমাতে দান করিবে। ৬০
শিবলিঙ্গে, যোগপীঠে, দেবতাশরীরে, সদ্যস্নিগ্ধে মৃন্ময়ে, ঘৃত ও সিন্দুর অঙ্কিত করাইবে। ৬১
শ্রীচন্দন প্রতিষ্ঠা বা লেপজ প্রতিমার গাত্রে, স্বস্তিকস্থাপিত প্রতিমায়, খড়্গে অথবা দর্পণে স্নান করাইবে। ৬২
মহাদেবীকে বিশেষ ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবের পূজায় এইরূপে স্থানীয় দান করিবে। ৬৩।
পূজক সম্যক্ বিধিপূর্বক স্নানীয় দান করিয়া চিরায়ুঃ হয় এবং কল্পান্ত পৰ্যন্ত স্বর্গভাগী হয়। ৬৪
পাদ্য, গন্ধ ও পুষ্প প্রভৃতি সমুদয় উপচার অর্ঘ্যপাত্রনিহিত অমৃতীকৃত ও সংস্কৃত জল দ্বারা অভিষিক্ত করিয়া ইষ্ট দেবকে দান করিলে ইষ্টদেব উহা স্বয়ং গ্রহণ করেন। ৬৪-৬৬
অর্ঘ্যপাত্রনিহিত জল দ্বারা অভিষেক ব্যতীত যদি ইষ্ট দেবকে কোন বস্তু দান করা যায় তাহা হইলে উহা নিষ্ফল হয়। ৬৭।
মোহেই হউক, লোভেই হউক অথবা প্রমাদবশতই হউক, অর্ঘ্যপাত্র হইতে অমৃতীকৃত জল যদি নিঃসৃত হয়, তাহা হইলে পুনৰ্বার অমৃতীকরণ করিবে। ৬৮
পাত্রে অমৃতীকৃত জলের অল্প মাত্র অবশিষ্ট থাকিলে তাহাতে অন্যপত্র হইতে উদক ঢালিয়া দিবে এবং উহাও অমৃত হইবে। ৬৯
যদি পুষ্প অনেক থাকে এবং মালা প্রচুর হয় তাহা হইলে অর্ঘ্যপাত্ৰস্থিত জল দ্বারা উহা সিক্ত করিয়া দান করিবে। ৭০
যাহা অর্ঘ্যপাত্র ভিন্ন অন্য পাত্রস্থিত জল দ্বারা সিক্ত হয়, উহা শত বিধি পূর্বক দান করিলেও দেবতা গ্রহণ করেন না। ৭১
নয় প্রকার প্রতিপত্তি দ্বারা অর্ঘ্যপাত্র সংস্কৃত হইলে তাহাতে সকল তীর্থ এবং সর্বপ্রকার অমৃত আসিয়া অবস্থান করে। ৭২
অতএব সকল প্রকার উপচার অর্ঘ্যপাত্রস্থিত জল দ্বারা অভ্যুক্ষিত করিয়া দান করিবে এবং যাহা অর্ঘ্যপাত্রে রাখিবার যোগ্য তাহা অর্ঘ্যপাত্রে রাখিয়া নিবেদন করিবে। ৭৩
হে ভৈরব! এই তোমার নিকটে আসনাদি ছয় বস্তুর দানের কথা বলিলাম; এক্ষণে জ্ঞানবৃদ্ধির নিমিত্ত বস্ত্রাদি দশ বস্তু দানের কথা শুন। ৭৪ অষ্টষষ্টিতম অধ্যায় সমাপ্ত। ৬৮