2 of 3

৬৮. নিজেকে মুক্ত রাখা কি সোজা কথা

৬৮

নিজেকে মুক্ত রাখা কি সোজা কথা? অনেক কষ্টে কচ্ছপের মতো নিজের ভিতরে গুটিয়ে থাকা শিখেছি।

নয়নতারা পান মুখে দিয়ে বেড়ার গায়ে ঠেস দিয়ে বসে বলল, তোমার মতো কি আমি পারি? আমি হলাম মেয়েমানুষ।

বিষ্ণুপদ নয়নতারার দিকে চেয়ে একটু হেসে বলে, আজকাল মেয়েরা কিছু কম পারছে নাকি? তোমাতে আমাতে তফাত করো কেন? তফাতটা কম বয়সে ছিল। বুড়ো হলে আর তফাতটাই বা কি?

নয়নতারা কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ও পাপের কথা, মেয়েমানুষে আর পুরুষমানুষে তফাত থাকবে না, তাই কি হয় গো?

বিষ্ণুপদ উঠোনে পড়ে থাকা শীতের রোদের দিকে চেয়ে থেকে বলে, তফাত আছে, প্রকৃতির তফাত। কিন্তু ক্ষমতার নয়।

ওসব কি আমি বুঝি! পুরুষমানুষ চালায়, মেয়েমানুষ চলে— এই তো দেখে আসছি চিরকাল।

তুমি আর দেখলে কতটুকু? ঘরে মুখ গুঁজে পড়ে আছো। আসল কথাটা আমার কি মনে হয়। জানো? পুরুষমানুষের মধ্যে যা আছে, মেয়েমানুষের মধ্যে তা নেই। আবার মেয়েমানুষের মধ্যেও এমন কিছু আছে যা পুরুষের নেই। হরেদরে দু’পক্ষই সমান। যিনি মানুষ তৈরি করেছেন তিনি তো আর আহাম্মক নন, একচোখোও নন। সমান সমানই দিয়েছেন দুজনকে, তবে রকমটা আলাদা।

তোমার সব অলক্ষুণে কথা।

আমি যেমনটা বুঝেছি বলোম। তবে কি জাননা, মেয়েমানুষ যদি পুরুষের সঙ্গে গায়ের জোরে পাল্লা দেয় বা পুরুষের যা জন্মগত গুণ সেইটে নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, তাহলে তো হেরেই যাবে। আবার মেয়েমানুষের যা বিশেষ গুণ সেখানে পুরুষ ভেড়া। বুঝলে? সৃষ্টিকর্তা দুজনকে দু’রকমভাবে গড়েছেন— এইটে বুঝতে লাগবে। নইলে হবে না। তাই বলছিলাম, তোমার সঙ্গে আমার যা তফাত সেটা প্রকৃতিগত।

ও বাবা, ওসব বুঝে আমার কাজ নেই। এ জন্মে আমার যা বুঝ হয়েছে তাই নিয়েই কাটিয়ে যাই।

বিষ্ণুপদ একটু হেসে বলে, পরের জন্মে যদি আমেরিকায় মেম হয়ে জন্মাও তখন কি হবে?

ও বাবা! ওসব খারাপ কথা বলছো যে! তোমার মুখের কথা ভীষণ ফলে যায়, তা জানো?

কেন, আমি কোন বাকসিদ্ধাইটা?

আছো একটু। দেখেছি তো, যা বলল তাই হয়।

তাহলে এটাও হোক।

নয়নতারা হেসে ফেলল, বাব্বা, রক্ষে করো, ফ্রক পরে, গা দেখিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারব না মরে গেলেও। কথা ফিরিয়ে নাও বলছি।

বিষ্ণুপদ খুব মজার হাসি হেসে বলে, খারাপ কি? তুমি মেম হয়ে জন্মালে আমিও না হয় সাহেব হয়ে জন্মাবো।

নয়নতারা চোখ কপালে তুলে বলে, তোমারও জন্মানোর দরকার নেই বাপু। গরুটরু খায় ওরা। কত অনাচার করে।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, তা বললে চলবে কেন? সাহেবরা যদি খারাপই হবে তবে দুনিয়াটা জানাচ্ছে কি করে?

আমার দুনিয়ার খবরে কাজ নেই বাপু।

বিষ্ণুপদ খুব হাসল। মাথা নেড়ে বলল, কাজ নেই বললেই হয়? তোমার বড় ছেলে সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছে, তুমি তার মা হয়ে একটু ভূগোল না জানলে লোকে বলবে কি?

নয়নতারা হেসে ফেলে বলে, এই বুড়ো বয়সে কি আমার ওপর মাস্টারি করবে নাকি? ভূগোল শিখে এখন আর কী হবে?

দুনিয়ার হালচাল একটু জানা ভাল। চাল ডাল তেল নুন ছেলেমেয়ে স্বামী এসব নিয়ে তো কম ভাবো না। আর একটু বড় করে ভাবলে দেখো ভালই লাগবে।

নয়নতারা একটু দোক্তাপাতা ছিড়ে মুখে দিয়ে বলে, এই চিন্তাতেই বলে সময় পাই না। বামা আর রেমোতে কেমন লেগে যাচ্ছে দেখছো তো! কুরুক্ষেত্র হবে এইবার। ভয়ে মরি।

বিষ্ণুপদ হাসি-হাসি মুখ করে বলে, সেইজন্যই তো কচ্ছপের মতো হতে বলি।

তুমি পারো। আমি পারি না। বাড়ি ভাগ বাটোয়ারা হবে, তার আগেই কিরকম লেগে যাচ্ছে দু’ভাইয়ে। বামা তো রোজ আমাকে ঘর ছেড়ে দিতে বলছে।

বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমাকেও বলছে। ভাগের কাগজপত্র তৈরি হবে, আদালতে যাবে, তারপর তো! তাছাড়া বামা ভুলেই যাচ্ছে যে, বাড়ি জমি আমার নামে, আর আমি এখনও বেঁচে আছি। বামাকে নিয়ে ওইটেই মুশকিল। ওর তর সয় না।

নয়নতারা একটু চারদিকে চেয়ে দেখে নিল। রামজীবন বা বামাচরণ বাড়িতে নেই। বউরা যে যার নিজের ঘরে। গোপালকে নিয়ে পটল গেছে খেলতে। পটলের বইখাতা এখনও বিষ্ণুপদর সামনে পাতা মাদুরে ছড়ানো। নয়নতারা হামাগুড়ি দিয়ে একটু কাছে এসে বসল। তামাকপাতার হেঁচকি তুলে বলল, আর জন্মে সাহেবদের দেশেই জন্মাবো দুজনে চলো। যদি তাতে একটু শান্তি পাই।

বিষ্ণুপদ হাসিমুখে বলে, শান্তি কি ভাল জিনিস?

নয়নতারা অবাক হয়ে বলে, নয়?

সবসময় নয়। শান্তিতে থাকলে মানুষের চনমনে টগবগে ভাবটা থাকে না। পান্তা ভাতের মতো হয়। এই যে সংসারে নানা উপসর্গ নিয়ে আছো, এসবও জীবনের ঝাল-নুন। সবই দরকার হয়। সাহেবরাও যে শান্তিতে থাকে এমন নয়। ও জিনিস দুনিয়ার কোথাও নেই।

ভয় কি জানো? এরপর বামা না আমাদের জোর করে ঘর থেকে বের করে। তাহলে রেমোর সঙ্গে ওর লাগবে। রেমো তো ঘরখানা শেষ করতে পারল না। আমাদের রাখবেই বা কোথায়?

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, ওসব নিয়ে ভেবো না।

সবসময়ে যে মাথায় দুশ্চিন্তা, ভাবতে ভাবতে মাথাটা এমন করতে থাকে।

বিষ্ণুপদ চুি হয়ে খুঁজে পটলের ভূগোল বই আর অ্যাটলাস তুলে নিয়ে বলল, কৃষ্ণ কোথায় আছে এখন জানো?

না তো! কোথায়?

বিষ্ণুপদ অ্যাটলাস খুলে ইউরোপের ম্যাপখানা বের করে দেখাল নয়নতারাকে, এই দেখ, এ হল হল্যান্ড। সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে জল সরিয়ে জমি বের করে করে তবে দেশটা হয়েছে।

ও বাবা!

বিষ্ণুপদ হাসল খুব। বলল, ময়দানবের কাণ্ডকারখানা। বিশ্বকর্মার সঙ্গে পাল্লা টানছে। এই জায়গাটা হল আমস্টারডাম। কৃষ্ণ এখন এইখানে।

এখান থেকে কত দূর হবে?

পাঁচ হাজার মাইলের কাছাকাছি হবে।

বাবা গো! ভাবলেই কেমন করে, না?

আজকাল আর দূর বলে কিছু নেই। কলকাতা থেকে উড়ে দিনকে দিন পৌঁছে যাচ্ছে।

এরোপ্লেন এক আজব জিনিস। এ জীবনে আর চড়া হল না।

আমাকে মেরে ফেললেও আমি এরোপ্লেনে চড়তে পারব না। হ্যাঁ গো, কৃষ্ণ নাকি তোমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল আমেরিকায়।

তা চেয়েছিল। খুব ইচ্ছে, আমাকে একটু দুনিয়াটা দেখায়।

তুমি কী বললে?

বিষ্ণুপদ হেসে বলল, কী আর বলব? ছেলে হিসেবে সে চায় বাপকে একটু ঘুরিয়ে আনে। কিন্তু বড্ড খরচ। কৃষ্ণ হয়তো পিছপা নয় তাতে। কিন্তু ভাবি, বউমা রয়েছে, বাচ্চা-কাচ্চা রয়েছে, আমার জন্য এত খরচ করলে তাদের হয়তো ভাল ঠেকবে না। কি দরকার শেষ বয়সে অত খরচপত্র করে বাইরে যাওয়ার!

নয়নতারা বলল, সে ভাল করেছো। বড় বউমা লোকও খুব সুবিধের নয়। আর তোমাকে আমি যেতে দিতাম নাকি?

বিষ্ণুপদ নয়নতারার দিকে চেয়ে বলে, আটকে রাখতে নাকি? নয়নতারা চোখ বড় বড় করে বলে, তোমাকে অতদূরে ছেড়ে দেবো? পাগল হয়েছে নাকি!

বিষ্ণুপদ খুব হাসতে লাগল, দুলে দুলে।

হাসছো কেন গো? হাসির কথা কী বললাম?

ভাবলাম, কতদিন আটকাবে! না ছেড়ে উপায় আছে! একদিন এরোপ্লেন ছাড়াই তো ফুরুৎ করে উড়ে যাবো। কত দূরে যাবো তার ঠিকানাই নেই।

নয়নতারা আজ একটু হাসল। বলল, অত সোজা নয়। বোকেনবাবু সেদিন কী বলল জানো? বলেছে, আমি সধবা মরব।

বিষ্ণুপদও হাসল, সধবা মরে যে কী সুখ কে জানে! তবে বলি কি মরামরি নিয়ে ভেবে লাভ নেই। ও কেউ দুদিন এগিয়েও আনতে পারবে না, পেছিয়েও দিতে পারবে না। দিনটা ঠিক করাই আছে। তবে আমাদের জানা নেই, এই যা। অদৃষ্ট মানে যা দৃষ্ট নয়, গোচর নয়। তা সে-ই ভাল। জানা থাকলে কি ভাল লাগত?

নয়নতারা আর একটু তামাকপাতা মুখে পুরে বলল, হ্যাঁ গো, তোমাকে যে কৃষ্ণ কত জিনিস এনে দিয়েছে, সেগুলো ব্যবহার করো না কেন? খেউড়ি হওয়ার কি সব এনে দিল না?

ওঃ, সে আর এক কাণ্ড। কৌটোর মধ্যে সাবানের ফেনা পোরা আছে। ওপরে একটা জায়গায় চাপ দিলেই ভস ভস করে এত বেরিয়ে আসে। কৃষ্ণ শিখিয়ে পড়িয়েও দিয়ে গিয়েছিল সব। হল কি জানো, টিপতেই সে এমন ফেনা বেরুলো যে গালের ওপর গন্ধমাদন দাড়িয়ে গেল। এই এত ফেনা। তার মধ্যে নিজের গালখানাই খুঁজে পাই না। তারপর থেকে আর ব্যবহার করি না। চাকা সাবানই ভাল।

নয়নতারা হেসে ফেলল। বলল, হাসাতেও পারো বাপু। আর ওই সুন্দর গন্ধওলা জিনিসটা!

ওটা কামানোর পর লাগায়। আফটার শেভ লোশন। কেটেকুটে গেলে ওটা লাগালে আর বিষিয়ে যায় না।

তা লাগাও না কেন?

গন্ধ মেখে হবেটা কি? ফিটকিরিতেই কাজ হয়ে যায়। আছে জিনিসটা থাক।

বড্ড হিসেব করো তুমি। এনে দিয়েছে, ব্যবহার করলেই তো হয়।

বিষ্ণুপদ নয়নতারার দিকে চেয়ে বলল, আর তোমাকে যে ফোল্ডিং ছাতা, ব্যাগ, শাড়ি এনে দিয়েছে তা ব্যবহার করো কি?

রেখে দিয়েছি। পটলের বউ এসে ব্যবহার করবে।

আমারটাও পটলকেই দিয়ে যাবো।

ম্যাপটা খুলে বিষ্ণুপদ দেখছিল, বলল, তোমার একদম মনোযোগ নেই। আমস্টারডামটা কোথায় এবার দেখাও তো। ভুলে গেছ?

নয়নতারা আঙুল বাড়িয়ে দেখিয়ে দিল, এইখানে তো!

ওঃ, পেরেছে তো, দশে দশ।

নয়নতারা হাসল, আর আমার ওপর মাস্টারি ফলাতে হবে না।

বিষ্ণুপদ একটু আনমনা হয়ে বলল, কৃষ্ণ এখন এইখানে। বুঝলে! হল্যান্ড। সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে, জল ঘেঁচে তবে মাটি বার করা হয়েছে। সেখানে চাষবাস হয়, বাড়ি ঘর করে লোকে থাকে, গাড়ি চলে। বাঁধ ভেঙে গেলে দেশ ভেসে যাবে চোখের পলকে। কিন্তু ভাঙে না। শয়ে শয়ে বছর ধরে দিব্যি আছে।

হ্যাঁ গো, এই যে সমুদ্রকে হটিয়ে দিচ্ছে, এতে মানুষের পাপ হয় না? এ যে খোদার ওপর খোদকারি।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, তা কেন? মানুষকে যে এত বুদ্ধি, এত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা কাজে লাগাতে হবে না। আমার মতো ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকবে সবাই? সে দেশে মাটির অভাব। সেই অভাব পুষিয়ে না নিলে চলবে কেন? মাটির জন্যই দেখ না, এত ঝগড়া-কাজিয়া, মারপিট, ভাইয়ে ভাইয়ে মুখদর্শন বন্ধ।

নয়নতারা ফের সাদা পাতা ছিঁড়ছিল।

বিষ্ণুপদ একটু লক্ষ করে বলল, ডোজটা যেন বেশ বেড়েছে মনে হয়?

নয়নতারা লজ্জা পেয়ে বলল, এবারের পাতাটায় ধকটা যেন কম।

তা নয়, তোমার নেশাও বাড়ছে। অত খেও না। অম্বল হবে।

আর অম্বল! মনটাই ভাল নেই।

বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্যাপ দেখতে লাগল। কৃষ্ণ এখন আমস্টারডামে। কবচখানা সঙ্গে নিয়ে গেছে কি? না নিক, তাতে কিছু নয়। কৃষ্ণ তো তারই ছেলে। ছেলের মধ্যে বাপের অস্তিত্ব থাকেই। কৃষ্ণের মধ্যে বিষ্ণুপদও কি একটু নেই? আছে বোধহয়।

কী ভাবছো?

এই নানা কথা। উল্টো-পাল্টা। ঠিক থাকে না।

ভূগোল বইটা একটু আমাকে পড়ে শুনিও তো।

তুমি নিজেও তো পড়তে পারো।

অক্ষর চিনবো কি? ভুলে-টুলে গেছি বোধ হয়।

ভোলোনি। চেষ্টা করলেই পারবে।

তুমিই শুনিও।

বিষ্ণুপদ হল্যান্ডের বিবরণ একটু পড়ে শোনাল নয়নতারাকে। বলল, বুঝতে পারছো?

তা পারছি।

এসব জায়গায় যেতে ইচ্ছে করে না তোমার?

করলেই বা লাভ কি?

বিষ্ণুপদ হাসিমুখে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, আমারও ইচ্ছে হয়। আমি কি ভাবি জানো? কৃষ্ণর সঙ্গে সঙ্গে আমার সত্তাটাও ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা দেশ।

তুমি বেশ ভাবতে পারো। আমি পারি না।

ওই জন্যই তো কচ্ছপ হওয়া তোমার আর হল না। ওইটে যদি পারতে তবে অনেক অশান্তি থেকে বেঁচে যেতে।

নয়নতারা স্বামীর দিকে চেয়ে বলে, ওইটেই তো তফাত।

বিষ্ণুপদ হাসিমুখে উঠোনের দিকে চেয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, নতুন গুড় ওঠেনি?

না বোধ হয়। উঠলে রেমো ঠিক আনত। কেন, পায়েস খেতে ইচ্ছে যায় নাকি?

তা যায়।

এখানকার বাজারে বোধ হয় ওঠেনি। বলব’খন রেমোকে। বললেই এনে দেবে।

বিষ্ণুপদ একটু চুপ থেকে বলল, থাক। বলো না। নিজে থেকে আনলে সেটাই ভাল হবে।

ও মা! ছেলের কাছে সংকোচ কিসের? সে তো ভক্ত হনুমানের মতো তৈরীই আছে।

তা জানি। তবু থাক।

কেন গো?

বিষ্ণুপদ সামান্য সংকোচের সঙ্গে বলল, নোলা জিনিসটা ভাল নয়। ভাবছি জিভকে একটু শাসনে রাখব।

আমার বাপু ওটা সহ্য হবে না। তোমার কিছু খেতে ইচ্ছে গেলে না খাইয়ে আমার শান্তি নেই।

আবার বেশী খেলে তো টিক টিক করো।

তাও করি। আমি বলেই করি। তোমাকে নিয়ে আর কে ভাববে বলো তো, আমার মতো?

তা বটে।

আজই আনাবো।

বিষ্ণুপদ তবু মাথা নাড়ে, থাকগে। নবুর বাড়িতে অনেক খেজুর গাছ। তারা রস জাল দেয়। করেও ভাল। বললেই দিয়ে যাবে। এখন থাক।

নয়নতারা উঠে গেল। রান্নাঘরের দিকে। যেতে যেতে বলল, রাঙা বউমা আজ রাঁধবে না। অশুচি হয়েছে। কী রাঁধবো বলো তো?

কচু ঘেঁচু যা হয়।

ফুলকপির ঝোল রাঁধি?

রাঁধো। মাছ নেই বুঝি?

না। ডিম আছে। বাড়ির হাঁসের ডিম।

একটা ভেজে দিতে পারবে? ডালের মুখে খাবো।

দেবো’খন।

বিষ্ণুপদ ফের একা হয়ে যায়। একা হয়ে চেয়ে থাকে।

এই বাড়িঘর, বাগান নিয়ে যে এলাকাটুকু, এটার দলিল তার নামে। বামাচরণ সব ভাগজোখ করাল। দখল চাইছে। বাড়িতে বড় অশান্তি হচ্ছে তাই নিয়ে। হোক, যা খুশি হোক। বিষ্ণুপদ আর ভাবে না। সে বরং আমস্টারডামের কথা ভাবে। কৃষ্ণর কথা ভাবে।

এই অন্যমনস্কতার মধ্যেই দুটো সাইকেল এসে থামল উঠোনে। কালো চেহারার দুটো লোক।

একজন একটু হেঁকেই বিষ্ণুপদকে বলে, কোন ঘরে বামাচরণ থাকে বলুন তো!

বিষ্ণুপদ তটস্থ হল। বলল, বামা? বামা তো বাড়ি নেই।

সে আমরা জানি। তার বউ আছে তো!

আছে বোধ হয়। কী দরকার?

ডেকে দিন। দরকার আছে।

বিষ্ণুপদ একটু অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। এরা বোধ হয় রামজীবনের বন্ধুবান্ধবই হবে। কিন্তু মতলব ভাল নয়।

বিষ্ণুপদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, তার বোধ হয় শরীর ভাল নয়।

একজন সাইকেল থেকে নেমে চারধারে চেয়ে দেখে নিয়ে বলল, ওই ঘরটা।

বিষ্ণুপদ সভয়ে দেখল, লোকটা এগিয়ে গিয়ে বন্ধ দরজায় দমাস করে একটা লাথি কষাল।

এই, বেরিয়ে আয়।

বামার বউ দরজা খুলল না। কিন্তু ঝাঁপের জানালা তুলে সভয়ে বলল, কে? কী চাই?

তোকেই চাই। বেরিয়ে আয় তো!

জানালার ঝাঁপটা ফেলে দিয়ে বউটা চেঁচাল, বাবা! বাবা! শুনছেন! এরা সব গুণ্ডা। লোকজন ডাকুন…

বিষ্ণুপদ উঠল। হাতপায়ের জড়তা উঠতে দিচ্ছিল না তাকে। তবু উঠল।

কী হয়েছে? আপনারা কারা?

আপনি ঘরে যান। এর সঙ্গে কথা আছে।

গোলমাল শুনে নয়নতারা বেরিয়ে এসেছে রান্নাঘর থেকে। বলল, কী হয়েছে? তোমরা কারা?

আপনারা ঘরে যান।

বিষ্ণুপদ উঠোনে নামতে নামতে বলল, এটা ঠিক হচ্ছে না। এ কাজটা ভাল হচ্ছে না।

লোকটা দমাদম কয়েকটা লাথি দিল দরজায়। সঙ্গে যে সব কথা বলল তা শুনে কানে আঙুল দিতে হয়।

বিষ্ণুপদ এত ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল যে, বাক্য সরল না।

লোকটা বলল, এ গাঁয়ের পাট চুকিয়ে তিনদিনের মধ্যে যদি চলে না যাস তা হলে জোড়া লাশ ফেলে দিয়ে যাবো।

শ্যামলী ঘর থেকে চিৎকার করছে, বাবা! আপনি লোক ডাকুন। মেরে ফেলবে যে!

লোকটা আর একটা লাথি কষাল দরজায়, কেন, বুড়ো শ্বশুরকে যখন ভিটেছাড়া করতে চাও তখন বাবা ডাক কোথায় থাকে রে মাগী? আঁ! এখন নাকী কান্না কাঁদছে, বাবা—বাবা। শালী, যত নষ্টের গোড়া।

শ্যামলী বোধ হয় ভয়ে চুপ করে গেল।

লোকটা ফের সাইকেলে চেপে বলল, বামা আসুক, তার ব্যবস্থা হচ্ছে। শালাকে জানে মেরে দিয়ে যাবো আজ।

লোক দুটো যেমন এসেছিল, তেমনি হুস করে চলে গেল।

বিষ্ণুপদ বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল উঠোনের মাঝখানে। রাঙা ঘর থেকে বেরোেলো না। পিছনে দাওয়ায় বসে কাঁদছে নয়নতারা।

দরজা খুলে শ্যামলী বেরিয়ে এল। আতঙ্কিত মুখচোখ।

শুনলেন! শুনলেন আপনি? কী বলবেন এখন? রামজীবনের সঙ্গে সাট নেই আপনার?

আমার!

আপনারা সবাই সমান। সব এক দলে। আমি আজই পুলিশের কাছে যাবো। কোমরে দড়ি পরাবো আপনাদের সবাইকে।

নয়নতারা বলল, ওঁকে কেন বলছো? উনি তো ওদের চেনেনও না।

শ্যামলী মুখ ভেঙিয়ে বলে, চেনেন না! আহা, কী ন্যাকা রে। চেনেন না! ঠিক আছে, চেনেন কিনা তা পুলিশ এলেই বোঝা যাবে। কিনা তা পুলিশ এলেই বোঝা যাবে।

নয়নতারা বলল, তাই যাও। আমাদের বরং বেঁধে নিয়ে যাক। তাই ভাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *