শীতের প্রারম্ভে বৃক্ষ থেকে খসে পড়া পাতার মতন অনবরত চিঠি আসছে মধুসূদনের কাছ থেকে। বিদ্যাসাগরকেই এখন একমাত্র অবলম্বন করেছেন মধুসূদন, প্রবাসে গ্রহ-বৈগুণ্যে বিষম দারিদ্র্য ও অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে তিনি বুঝেছেন, ঐ জেদী ব্ৰাহ্মণটি শুধু বিদ্যার সাগর নন, করুণাসাগরও বটে। আর যাঁদের তিনি বন্ধু বলে মনে করেছিলেন, তাঁরা সবাই বিমুখ করেছেন, একমাত্র বিদ্যাসাগরের কাছ থেকেই সাহায্য এসেছে বিনা শর্তে। রাজা দিগম্বর মিত্র মধুসূদনের বাল্য সুহৃদ, দেশের বিষয়সম্পত্তির ব্যাপারে মধুসূদন তাঁর ওপরেই নির্ভর করেছিলেন সবচেয়ে বেশী, সেই দিগম্বর মিত্রই তাঁর সর্বনাশের পথ সুগম করেছেন। অর্থ প্রেরণ করা তো দূরের কথা, একটা চিঠিরও উত্তর দেন না। অথচ এই রাজা দিগম্বর মিত্রকেই তিনি মেঘনাদবধ কাব্য উৎসর্গ করেছেন!
স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে দেশে রেখে একাই লণ্ডনে পাড়ি দিয়েছিলেন মধুসূদন। হেনরিয়েটার সংসারের ভরণপোষণের জন্য যে অর্থ বরাদ করে দিয়ে গিয়েছিলেন সম্পত্তির পত্তনীদারদের কাছে, তারা সে অর্থ নিয়মিত দেয় না। তাই নিরুপায় হয়ে হেনরিয়েটা পুত্র-কন্যাকে নিয়ে চলে গেলেন লণ্ডনে। বিপদ তাতে বৃদ্ধি পেল শতগুণ। মধুসূদনের ব্যারিস্টারি পড়ার ব্যয় ছাড়াও এত বড় একটি সংসার চালানো একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়লো। নিতান্ত খাদ্যচিন্তা ছাড়া আর কোনো চিন্তার অবকাশ রইলো না। ইংলণ্ডের তুলনায় ফরাসী দেশে জীবনধারণ-ব্যয় কিঞ্চিৎ কম বলে মধুসূদন সদলবলে চলে এলেন প্যারিসে। কিন্তু যখন হাতে একটি মুদ্রাও থাকে না, তখন কোন দ্রব্যের মূল্য কত সে বিচারে লাভ কী? অবস্থা পৌঁছলো একেবারে চরমে। শিশু পুত্র-কন্যা অনাহারের কষ্টে রোদন করে, পিতা হয়ে মধুসূদনকে তা দর্শন করতে হয়। রাজনারায়ণ দত্তের পুত্র, মুখে সোনার চামচ নিয়ে যাঁর জন্ম, যিনি যৌবনে-কৈশোরে খোলামকুচির মতন দু হাতে মুদ্রা ছড়িয়েছেন, আজ তাঁর নিজ সন্তান-সন্ততির এই দশা! যদিও দেশে তাঁর যথেষ্ট সম্পত্তি আছে, সুন্দরবনের এক আবাদ থেকেই বার্ষিক আয় দশ সহস্ৰ মুদ্রা, শুধু স্বদেশবাসীর বিশ্বাসঘাতকতায় বিদেশে তিনি মরণাপন্ন। দত্ত কারো ভৃত্য নয়। এই দম্ভোক্তি যাঁর মুখে সর্বদা শোনা যেত, আজ সেই তাঁকেই সামান্য ভিখারীর মতন চ্যারিটেবল সোসাইটিতে গিয়ে হাত পাততে হয়।
নিজস্ব জিনিসপত্র বিক্রয় ও বন্ধকী দিতে দিতে আর কিছুই বাকি নেই। নবীনকুমার সিংহ প্রদত্ত রৌপ্য পাত্রটি মধুসূদনের অতি প্রিয়, সেটি শেষ পর্যন্ত রেখে দিয়েছিলেন। স্বদেশে তাঁর কাব্য রচনার স্বীকৃতিতে একমাত্র সংবর্ধনা সভায় তিনি এটা পেয়েছিলেন। তবু একদিন সেটিকেও নিয়ে যেতে হলো বন্ধকী দোকানে। এর বিনিময়ে যে অর্থ পাওয়া গেল, তাতে পুত্র-কন্যাদের কয়েকদিনের দুগ্ধের খরচ সঙ্কুলান হবে।
অন্য সকলের কাছ থেকে হতাশ হয়ে তারপরই মধুসূদন সাহায্যের আবেদন করেছিলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। এমন যে অপ্রত্যাশিত ফল হবে, তিনি স্বপ্নেও আশা করেন নি। কোনো রকম জামিন ছাড়াই টাকা পাঠালেন বিদ্যাসাগর। কলকাতায় এত সব মহা মহা ধনী ব্যক্তি, তাঁদের তুলনায় বিদ্যাসাগর কী আর! অতি লোভনীয় সরকারী চাকুরি ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন বিদ্যাসাগর, এখন তাঁর যাবতীয় আয় শুধু গ্ৰন্থ বিক্রয় থেকে। জমিদার বা ধনীরা কেউ নয়, গদ্য গ্ৰন্থকার বিদ্যাসাগরই শুধু সাহায্য করলেন কবি মধুসূদনকে।
কিন্তু তাতেও যে চলে না। বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে দুই তিন সহস্র টাকা আসে, আর দু-এক মাসের মধ্যেই তা উড়ে যায়। তখন আবার কাকুতি-মিনতিপূর্ণ পত্র। এখন মধুসূদনের সমস্ত প্রতিভা নিয়োজিত হয়েছে করুণা-নিষ্কাষণী পত্র রচনায়। বিদ্যাসাগরকে খুশী করবার জন্য তিনি ইংরেজি চিঠির মধ্যে মধ্যে কয়েক ছত্র লেখেন বাংলা অক্ষরে, বিদ্যাসাগর ভারতচন্দ্রের কাব্য পছন্দ করেন বলে প্রায়ই ভারতচন্দ্রের রচনার উদ্ধৃতি দেন, ফ্রান্সের শীতের বর্ণনা দিতে গিয়ে ভারতচন্দ্রের ভাষায় বলেন, বাঘের বিক্রম সম মাঘের হিমানী। বিলাতি পত্র-পত্রিকায় কখন কোথায় বিদ্যাসাগর সম্পর্কে সংবাদ প্ৰকাশিত হয়, সে খবরও জানান সাগ্রহে। একদিন প্যারিসের এক দোকানে দেখলেন বিদ্যাসাগরের লেখা কয়েকটি বই। দারুণ গর্ব হলো মধুসূদনের। দোকানদারকে বলেই ফেললেন, এই লেখক আমার বিশিষ্ট বন্ধু। তাই শুনে দোকানদার বললেন, নাকি, আমাদের ধারণা, এই লেখক এখন জীবিত নেই। মধুসূদন বললেন, কী সাঙ্ঘাতিক কথা! না, না, তাঁর দেশ এবং তাঁর সুহৃদরা তাঁর বিয়োগ সহ্য করতে পারবেন না।
সনির্বন্ধ পত্র প্রেরণ করলে বিদ্যাসাগর ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে টাকা পাঠাবেনই, এরকম একটা সংস্কারের মতন বদ্ধমূল বিশ্বাস হয়ে গেল মধূসূদনের। কিছুদিনের জন্য তিনি সপরিবারে এসে রয়েছেন ভাসাঁই নগরীতে, বিদ্যাসাগর প্রেরিত অর্থ দ্রুত নিঃশেষিত হতে চলেছে, আবার সাহায্যের আবেদন করে পাঠানো হয়েছে পত্র। এক সকালে মধুসূদন কিছু পড়াশুনোর চেষ্টা করছেন, এমন সময় হেনরিয়েটা অশ্রুপরিত নয়নে এসে বললেন, আর যে পারি না! এভাবে আর কতদিন বেঁচে থাকতে হবে!
নতুন কী আবার হলো? ব্যাপার অতি সামান্য, কিন্তু বড়ই মর্মভেদী। তাঁদের বাসগৃহের সন্নিকটেই ধুমধাম করে একটি বেশ বড় মেলা বসেছে। পল্লীর সব শিশুরা ছুটে চলেছে সেদিকে। তাই দেখে হেনরিয়েটার পুত্র-কন্যাও সেই মেলায় যাবার জন্য বায়না ধরেছে। অবোধ শিশু, ওদের কীভাবে নিরস্ত করা যাবে? কিছু না ভেবেই মধুসদন বললো, যাবে না কেন, যাক না। মেলা দেখে আসুক। হেনরিয়েটার বিলাপ উচ্চতর হলো। তাঁর হাতে রয়েছে মাত্র তিন ফ্রাঁ, তা দিয়ে কিছু কেনাকাটা তো দূরের কথা, মেলার প্রবেশ মূল্যই যে ওর চেয়ে বেশী।
একটুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন মধুসূদন। তিনি অক্ষম পিতা, আজ প্রাতে নিজের সন্তানদের মুখে হাসি ফোঁটাবার মতন সাধ্য তাঁর নেই। উপায়ান্তর না দেখে তিনি বলে উঠলেন এক সময়, একটু অপেক্ষা করো, দেখো, আজই নিশ্চিত বিদ্যাসাগরের নিকট থেকে অর্থ এসে পৌঁছোবে! তিনি কি যে সে মানুষ! তাঁর প্রতিভা ও প্রজ্ঞা প্রাচীন ঋষিদের মতন, তাঁর কর্মোদ্যম ইংরেজদের মতন আর তাঁর হৃদয়খানি বাঙালী মায়ের মতন! তিনি ঠিকই বুঝবেন!
এমনই কাকতালীয় যোগাযোগ, এক ঘণ্টার মধ্যেই ডাকে এলো বিদ্যাসাগরের এনভেলাপ, তার মধ্যে দেড় হাজার টাকা!
নিয়মিত বিদ্যাসাগর প্রেরিত অর্থে মধুসূদন সাংসারিক অনটন কিছুটা সামলে উঠে আবার পড়াশুনোর কথা ভাবতে লাগলেন। ইতিমধ্যে কয়েকটি ভাষা শিক্ষা করেছেন শখ চরিতার্থ করবার জন্য, কিন্তু তাতে তো উদরান্নের সংস্থান হবে না! অনিশ্চিতকাল ধরে প্রবাসে থাকাও সম্ভব নয়, আর দেশে ফেরার আগে ব্যারিস্টারি পাশ না করলে ফিরে গিয়েও তো সেই একই অবস্থায় পড়তে হবে। দেবেন্দ্রবাবুর পুত্র সত্যেন্দ্র সসম্মানে আই সি এস পরীক্ষায় পাশ করে সকলকে চমকিত করে দিয়েছে। সাহেবদের সঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে সে প্রথম ভারতীয় আই সি এস। সত্যেন্দ্ৰ যথেষ্ট মেধাবী বটে, তা ছাড়া ধনীর সন্তান, তাকে পড়াশুনোর সময় অর্থচিন্তা করতে হয়নি। শোনা যাচ্ছে যে, সত্যেন্দ্ৰ আই সি এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় ইংরেজ কর্তৃপক্ষ শঙ্কিত হয়ে ঐ পরীক্ষার মান আরও কঠিন করার কথা চিন্তা করছেন। ভারতীয়রা করবে ইংরেজদের সঙ্গে সমান পদে চাকুরি! মধুসূদন ভয় পেলেন, তা হলে কি ব্যারিস্টারি পরীক্ষাও আরও কঠিন হয়ে যাবে? ভারতের বিভিন্ন নগরে, বিশেষত কলকাতার সুপ্রিম কোটে ইংরেজ ব্যারিস্টারদের উপার্জন যথেষ্ট, সেখানে কি তারা সহজে ভারতীয়দের প্রতিযোগিতায় নামতে দেবে? সুতরাং, দ্রুত ব্যারিস্টারি পাশ করতে গেলে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে আরও অর্থ চাই। তাঁর সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় বা বন্ধক দেবার অধিকার দিয়ে বিদ্যাসাগরের নামে পাঠিয়ে দিলেন এক ওকালতনামা।
মধুসূদনের চিঠিপত্র এবং সংবাদাদি পাঠ করে শুধু করুণ রস নয়, মাঝে মাঝে কৌতুকও পান বিদ্যাসাগর। একদিন তিনি কয়েকজন বন্ধুকে বললেন, ওহে, তোমাদের অমিত্ৰাক্ষরের কবির আর একটি নতুন খবর শুনেছে? ফরাসী দেশের পুলিস নাকি তাঁকে পলাতক ধুন্ধুপন্থ নানাসাহেব বলে সন্দেহ করেছে!
সকলে বিস্মিত।
কাহিনীটি একেবারে অলীক নয়। সিপাহী বিদ্রোহের প্রধান নায়ক নানা সাহেবকে এখনো বন্দী করতে পারে নি ব্রিটিশ ফৌজ। প্রায়ই তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার গুজব রটে। বিদ্রোহ প্রশমনের পর সাত-আট বৎসর পার হয়ে গেলেও ইংরেজ সরকার এখনও তাঁর অনুসন্ধানে তল্লাসী চালিয়ে যাচ্ছে। পাওনাদারবৃন্দের ভয়ে মধুসূদন প্রায় সময়ই গৃহের মধ্যে লুকিয়ে থাকেন, বাইরে নির্গত হন কদাচিৎ। সেইজন্য ফরাসী পুলিসের মনে সন্দেহের উদয় হলো। এই কৃষ্ণবর্ণ, স্থূলকায়, মুখ গুম্ফ-দাড়িতে ভরা ব্যক্তিটিই ছদ্মবেশী নানাসাহেব নন তো!
মধুসূদনের আর এক পত্রে বিদ্যাসাগর জানতে পারলেন যে, প্রখ্যাত পণ্ডিত গোল্ডস্ট্রকার সাহেব মধুসূদনকে অনুরোধ করেছেন। লণ্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজে বাংলার অধ্যাপক পদ গ্রহণ করবার জন্য। পদটি অতি সম্মানের হলেও অবৈতনিক। ব্যারিস্টারি পাঠ শেষ করার জন্য মধুসূদন প্যারিস থেকে চলে এসেছেন লণ্ডনে। কিন্তু গোল্ডস্ট্রকার মহোদয়ের অনুরোধ মান্য করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু সম্মান নিয়ে তিনি ধুয়ে খাবেন! এক প্রকার বিষাক্ত কীটের আক্রমণে ব্রিটেনে গবাদি পশুর মড়ক শুরু হয়েছে বলে বর্তমানে সকল প্রকার মাংসই অগ্নিমূল্য, অন্তত মাসিক সাড়ে তিনশো টাকার কমে সংসার চালানো দুঃসাধ্য। এই টাকা তাঁকে কে দেবে?
চিঠিখানি পড়ে বিদ্যাসাগর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বাংলা অধ্যাপকের পদ অলংকৃত করবেন একজন বিশিষ্ট বাঙালী কবি, এটাই তো স্বাভাবিক, কিন্তু ইংরেজ সরকার সে জন্য কোনো পারিশ্রমিক দিতে পরাস্তুখ! আর এ দেশ থেকেই বা কে সাহায্য করবেন। তিনি কতকাল একার চেষ্টায় চালিয়ে যেতে পারবেন? সে চেষ্টাও অবাস্তব।
ভিতরে ভিতরে বিদ্যাসাগর যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, তা অনেকে বোঝে না। দাতা হিসেবে একবার নাম রটে গেলে তার বিড়ম্বনাও কম নয়। এখন আর কারুকে বিমুখ করার উপায় নেই। দশজনকে দান করার পর একজনকে ফিরিয়ে দিলে সেটাই লোকে বড় করে দেখবে। তিনি বুঝতে পারেন, অনেকে তাঁর সঙ্গে তঞ্চকতা বা বঞ্চনা করে টাকা নিয়ে যায়। পিতৃদায়ের অজুহাতে যে ব্যক্তি অর্থ সাহায্য নিয়ে যায়, সে-ই পরে ইয়ার বক্সীদের নিয়ে মদ্যপান করে। যে সব অনাথিনী যুবতীদের জন্য তাঁর মাসিক সাহায্য বরাদ্দ আছে, অকস্মাৎ তিনি এক সময় জানতে পারেন, তাদের কেউ কেউ বেশ্যাবৃত্তিতে নিযুক্ত।
এর চেয়েও সাঙ্ঘাতিক কথা, সত্যিকারের কোনো কোনো অভাবী ব্যক্তি বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে সঙ্কটমুক্ত হবার পর তারাই বিদ্যাসাগরকে আড়ালে নিন্দা-মন্দ করে। কৃতজ্ঞতা একটা বিষম বোঝা। অনেকেই সারা জীবন এ বোঝা বহনে অক্ষম। তাই এই বোঝা ঝেড়ে ফেলে। উপকারী ব্যক্তির শক্ৰতা করে তারা স্বস্তি বোধ করে। বিদ্যাসাগর এটা বুঝতে পারেন, তবু প্রত্যেকবার মনে নতুন করে আঘাত লাগে।
দান কখনো নিঃস্বর্থ হয় না। তার বিনিময়ে আত্মশ্লাঘার সুখ অনুভব করা যায়। বিশেষত দরিদ্র অবস্থা থেকে যিনি প্রাচুর্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তাঁর দানের মধ্যে কিছু অহমিকা থেকেই যায়। বিদ্যাসাগর ধর্মভীরু বা পুণ্যলোভী নন, সুতরাং তিনিও দান করেন আত্মসুখের জন্যই। যদিও অপরের দুঃখের কথা শুনে তাঁর চক্ষে জল আসে, কিন্তু এমন অশ্রুপাতও সুখের।
তবু, এরও একটা সীমা আছে। দান যখন নিত্য-নৈমিত্তিক বাঁধা-ধরা ব্যাপার হয়ে যায়, তখন তার মধ্যে থাকে শুধু ক্লান্তি। নিজেকে মনে হয় অর্থ মোক্ষণের একটি যন্ত্র। কারুর মুখে দু-একটি প্রশংসা বা স্তুতিবাক্য শুনলেই ভয় হয়। এই রে, এবার বুঝি অর্থ চাইবে! মানুষের আন্তরিকতা সম্পর্কেই একটা সন্দেহের ভাব আসে। এভাবে যতই দিন কাটে, ততই নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে হয়।
বিদ্যাসাগর বেশী দিন নিস্তেজ হয়ে বসে থাকতে পারেন না। কর্মচাঞ্চল্য তাঁর রক্তের অন্তর্গত। দেশবাসীর প্রতি ক্ষোভ করে তিনি কিছুদিন নিজেকে গুটিয়ে রাখেন নিরালায়, আবার তাঁকে বেরিয়ে আসতেই হয়, বিধবা আইন পাশ হলেও তার প্রয়োগ ব্যাপক হল না দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। যাঁরা তাঁকে মৌখিক সমর্থন জানিয়েছিলেন, কার্যকালে তাঁরা অনেকেই পিছিয়ে গেছেন। এবার তিনি আবার উদ্যমী হলেন বহু বিবাহ নিরোধ করবার জন্য। এই বহু বিবাহ নামক সামাজিক ব্যবস্থাই তো বিধবা উৎপাদনের কারখানা। সুতরাং, এটা বন্ধ করতে পারলেই মূল সমস্যায় আঘাত করা যাবে। আর একটি উপায় অবলা নারীগণকে স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা দেওয়া। গ্রামাঞ্চলে স্কুল খোলার ব্যাপারকে কেন্দ্র করেই সরকারের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়, সেই উপলক্ষে তিনি চাকুরি পরিত্যাগ করেন। এবার আবার তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
এই সময় এক সচ্চরিত্রা বিবি এলেন কলকাতায়। এর নাম মেরি কর্পেন্টার। এই প্রৌঢ়া নারী ইংলণ্ডে স্ত্রী-শিক্ষা প্রসারের জন্য বহুদিন যাবৎ অনলসভাবে ব্যাপৃত। ভারত সাম্রাজ্যেও তিনি রমণীকুলের মধ্যে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা পৌঁছে দিতে চান। ইনি পূর্বেই বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের নাম ও কমোদ্যমের কথা জানেন। সুতরাং, তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী।
দেবেন্দ্রবাবু সাহেব-মেমের সংসৰ্গ এড়িয়ে থাকতে চান, প্ৰায় বলতে গেলে মেরি কর্পেন্টারের ভয়েই তিনি পলায়ন করলেন মফস্বলে। এক রাজপুরুষ একদিন মেরি কর্পেন্টারকে নিয়ে এলেন বেথুন স্কুলে, সেখানে প্রাথমিক পরিচয় হলো বিদ্যাসাগরের সঙ্গে। তরুণ ব্ৰাহ্মরা মহোৎসাহে সভাসমিতি করতে লাগলো মেরি কর্পেন্টারকে নিয়ে। কেশব সেনের উদ্যোগে এক সভায় উপস্থিত হতে হলো বিদ্যাসাগরকে, সেখানে মেরি কর্পেন্টার প্রস্তাব দিলেন এ দেশে স্ত্রী-শিক্ষা বিস্তারের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশীয় শিক্ষিকা, শুধু মেম-শিক্ষিকা দিয়ে এ কাজ হবে না, সুতরাং শিক্ষিকা তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য ঝটপট তৈরি হয়ে গেল একটি কমিটি, তাতে বিদ্যাসাগরের নামও স্বভাবতই অন্তর্ভুক্ত হলো।
কিন্তু পরে বিদ্যাসাগর ভাবলেন, তার এ সবের মধ্যে না থাকাই ভালো। ইংরেজদের উদ্যোগে এ দেশে শিক্ষা বিস্তার হবে, এটা তাঁর আর মানতে ইচ্ছে করে না। এ দেশীয়দের যে কোনো উদ্যম কোনো না কোনো ইংরেজ নারী-পুরুষকে কেন্দ্র করেই হতে হবে কেন? শুধু নিজেদের চেষ্টায় কিছু করা যায় না? অত্যুৎসাহী ব্ৰাহ্মদের উপরেও তিনি আর আস্থা রাখতে পারেন না। তিনি পাঠিয়ে, দিলেন তাঁর পদত্যাগপত্র ঐ কমিটি থেকে।
কিন্তু মেরি কাপেণ্টার তাঁকে ছাড়তে চান না। ঘন ঘন দূত পাঠাতে লাগলেন তাঁর কাছে! বিদ্যাসাগরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নানা স্থানের চালু বালিকা বিদ্যালয়গুলির অবস্থা স্বচক্ষে দেখতে চান। অগত্যা বিদ্যাসাগরকে রাজি হতে হলো।
উত্তরপাড়ার হিতকারী সভার অধীনে কিছুদিন যাবৎ একটি বালিকা বিদ্যালয় চলছে, একদিন যাওয়া হলো সেখানে। ছোট লাট স্বয়ং অনুরোধ করেছেন বিদ্যাসাগরকে। সঙ্গে রয়েছেন স্কুলসমূহের ইন্সপেক্টর উড্রো সাহেব এবং ডিরেক্টর অ্যাটকিনসন সাহেব। ফেরার পথে বগী গাড়িতে হলো নিদারুণ এক দুর্ঘটনা।
এক স্থানে বগী গাড়িটি সবেগে মোড় ঘুরবার সময় উল্টে গেল, বিদ্যাসাগর ছিটকে গিয়ে পড়লেন পথের ওপর, তাঁর মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডে প্ৰচণ্ড আঘাত লাগায় তিনি সঙ্গে সঙ্গে সংজ্ঞাহীন হয়ে গেলেন। অকস্মাৎ এই দুৰ্দৈবে ঘোড়াটি দিশাহারা হয়ে লাফালাফি করছে, যে-কোনো সময় অচৈতন্য বিদ্যাসাগরের মুখে বা বক্ষে তার পদাঘাত লাগতে পারে। অপরাহ্ন কাল, পথ জনবিরল নয়, সঙ্গে সঙ্গে ভিড় জমে গেছে, এবং এ দেশীয় ব্যক্তিদের স্বভাব অনুযায়ী সকলেই হায় হায় করছে, কেউই বিদ্যাসাগরের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো না। এই সময় পিছনের বগীটি এসে থামতেই উড্রো ও অ্যাটকিনসন সাহেব লম্ফ দিয়ে নেমে এসে অসীম সাহসে সেই উন্মত্ত অশ্বের বল্গা চেপে ধরে বিদ্যাসাগরের প্রাণ রক্ষা করলেন। মেরি কাপেন্টার পথের ধূলায় বসে পড়ে অচৈতন্য বিদ্যাসাগরের মস্তক তুলে নিলেন নিজের ক্ৰোড়ে, তাঁর চক্ষু দিয়ে আশ্র ঝরে পড়তে লাগলো।