শোকের সময়ও পেলেন না নিবেদিতা। শোকের বদলে যেন বুকের মধ্যে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে ক্ষোভ আর অভিমান। তাঁর প্রভু কেন এভাবে চলে যাবেন? না, না, এ সময়ে তাঁর চলে যাওয়া মোটেই উচিত হয়নি। তাঁর এত প্রিয় এই দেশ, এই দেশের মানুষ, এখানে অবিলম্বে কত কী ঘটতে যাচ্ছে, স্বামীজি নিজে তখন উপস্থিত থাকবেন না? স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হবে, তার নেতৃত্ব দিতে অস্বীকার করেছিলেন স্বামীজি, কিন্তু নিবেদিতা ঠিক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাজি করাতেনই। এই নেতৃত্বের যোগ্যতা স্বামীজির চেয়ে আর কার বেশি? পরাধীনতার মর্মবেদনায় এক এক সময় তাঁকে ক্ষিপ্তের মতন হয়ে যেতে কি দেখেননি নিবেদিতা? যদি বা স্বামীজি প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দিতে রাজি নাও হতেন, তবু তাঁর উপস্থিতিই এক বিশাল প্রেরণা।
তিনি কাছে নেই, তবু কোথাও আছেন, তাতেই অনেক জোর পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি নেই, আর একেবারেই নেই, এ যে মেনে নেওয়া অসম্ভব। তিনি সত্যিই নেই? বিলীন হয়ে গেছেন পঞ্চভূতে? হিন্দুরা পরলোকে বিশ্বাস করে। মৃত্যুলোকের ওপারে কোথাও বিরাজ করে মানুষের আত্মা। কেউ কেউ মৃত ব্যক্তিদের কখনও কখনও সশরীরে দেখতে পায়। মহাপুরুষরা মাঝে মাঝে দর্শন দিতে আসেন। আজন্ম সংস্কারে নিবেদিতার পক্ষে এসব মানা সম্ভব নয়, আবার পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। কই, দশদিন কেটে গেল, তবু তো স্বামীজি একবারও তাঁর প্রিয় শিষ্যাকে দর্শন দিলেন না। নিবেদিতার বিশ্বাসের তীব্রতা নেই, সে জন্য তিনি দেখতে পান না?
এমন নিঃসঙ্গতা আগে কখনও বোধ করেননি নিবেদিতা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভরা নিঃসঙ্গতা। এ দেশে তাঁর আর কে আছে? কথা বলারও আর কেউ নেই। কারুর মৃত্যু হলে আনুষঙ্গিক ও পারিপার্শ্বিক এমন অনেক কিছু ঘটতে থাকে যে, সেই দিকেই মন চলে যায়, শোক করার সময় থাকে না।
এর মধ্যে নিবেদিতা কয়েকবার বেলুড় মঠে গিয়েছিলেন, সন্ন্যাসী ও গুরুভ্রাতাদের ব্যবহার তাঁর কাছে বড় অদ্ভুত মনে হয়েছে। দিনের পর দিন ধরে প্রায় সকলেই কান্নাকাটি ও হা-হুঁতাশ করে চলেছেন। অথচ এখনই তো কাজের সময়, কাজের মধ্য দিয়েই শোক দমন করতে হয়, স্বামীজি
প্রতিষ্ঠিত এই মঠ ও কর্মপন্থাকে সচল রাখা, আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তো স্বামীজির স্মৃতিরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। সেদিকে যেন কারুর মন নেই। নিবেদিতা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করলেও কেউ ঠিক উত্তর দেয় না। এমনকী নিবেদিতার এমন সন্দেহও হয় যে, সন্ন্যাসীরা যেন তাঁকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। একদিন ওকাকুরাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, ওকাকুরাও স্বামীজির আকস্মিক তিরোধানে খুব আঘাত পেয়েছেন, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, মঠের কেউ ওকাকুরার উপস্থিতি গ্রাহ্য করল না, কেউ কথাও বলল না। ওরা দুজনে মঠের বাইরে স্বামীজির চিতাস্থলের কাছে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। গঙ্গায় চলমান জলযানগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, জীবনের স্রোত একইরকম বয়ে চলেছে, শুধু স্বামী বিবেকানন্দ নেই। তাঁর উপস্থিতি অতি প্রবল ছিল বলেই তাঁর না-থাকাটা একেবারে অসহনীয় মনে হয়।
দু দিন পরে নিবেদিতা মঠে গিয়েছিলেন একা। সেদিনও অন্যদের নিস্পৃহ ভাব দেখে তিনি সারদানন্দের পাশে গিয়ে বসলেন। সারদানন্দের সঙ্গে তাঁর অনেক বিষয়ে আগে আলোচনা হয়েছে, ইনি ইংরিজি ভাল জানেন বলে কথাবার্তা সহজে বলা যায়। নিবেদিতা সরাসরি সারদানন্দকে প্রশ্ন করলেন, বেলুড় মঠের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা কোনও পরিকল্পনা করব না? স্বামীজির আর কাজের দায়িত্ব এখন আমাদেরই ভাগ করে নিতে হবে।
সারদানন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সরাসরি নিবেদিতার মুখের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে চোখ ফেলে বললেন, হ্যাঁ, এ বিষয়ে আমরা অনেক চিন্তা করেছি। ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে তোমার বিষয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে। আমাদের সবার প্রিয়, বন্ধু এবং গুরু নরেন এখন নেই, তার অবর্তমানে অনেক কিছুই বদলে গেছে। তুমি বরং ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে নিভৃতে কথা বলে নাও।
ব্রহ্মানন্দকে খবর দেওয়া হল, তিনি ওপরতলায় স্বামীজির ঘরের পাশের বারান্দায় নিবেদিতাকে নিয়ে বসলেন। সেখানে কয়েকজন সন্ন্যাসী চক্ষু বুজে, জপ-তপধ্যান করছেন, তাঁদের বলা হল নীচে চলে যেতে। স্বামীজির ঘরের জানালা খোলা, দেখা যাচ্ছে তাঁর খাটটি। বৃষ্টি শুরু হয়েছে, বৃষ্টির ধারায় গঙ্গানদী এখন ঝাঁপসা।
আর কেউ নেই, তবু ব্ৰহ্মানন্দ কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে চুপ করে বসে রইলেন। যেন তিনি আরম্ভের বাক্যটি খুঁজে পাচ্ছেন না। নিবেদিতা কৌতূহলী হয়ে চেয়ে রইলেন তাঁর দিকে। নীরবতা কাটছে না দেখে তিনিই ব্রহ্মানন্দকে প্রশ্ন করলেন, আপনি আমাকে কিছু বলবেন না?
মুখ তুলে ব্রহ্মানন্দ বললেন, ভগিনী, তুমি কি এই বেলুড় মঠকে ভালবাস? আমাদের রামকৃষ্ণ সঙেঘর মঙ্গল চাও?
নিবেদিতা চমকে ভুরু তুলে তাকালেন। এ কী অদ্ভুত প্রশ্ন! স্বামীজির প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করার জন্যই তিনি এ দেশে এসেছেন। স্বামীজির নিজের হাতে গড়া এই মঠ, এই সঙ্ঘ, এর জন্য স্বামীজি কত পরিশ্রম করেছেন, নিবেদিতা কি সব সময় স্বামীজির সঙ্গে সঙ্গে থাকেননি? এখানে এক সময় মাঠ ছিল, বিদেশি ভক্তদের টাকায় জমি কেনা হল, আস্তে আস্তে গড়ে উঠল এত বড় মঠ, স্বামীজির চেষ্টায়, স্বামীজির ব্যক্তিত্বের আকর্ষণেই টাকা এসেছে বিদেশ থেকে, নিবেদিতাও কি সেই অর্থ সংগ্রহে সহায়তা করেননি? স্বামীজি দ্বিতীয়বার যখন আমেরিকায় গেলেন, তখন নিবেদিতাকেও কি বহু জায়গায় এই উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে হয়নি? এখন এমন প্রশ্ন উঠতে পারে যে তিনি এই মঠকে ভালবাসেন কি না?
ব্রহ্মানন্দ আবার বললেন, জানি, তুমি মন প্রাণ দিয়ে এখানকার সব কিছু ভালবাস, তবু, বলতে আমার খুবই খারাপ লাগছে, কষ্ট হচ্ছে, তা হলেও বলতেই হবে, তুমি আর এখানে এসো না। তুমি এলে আমাদের ক্ষতি হবে!
নিবেদিতা আর্ত স্বরে বলে উঠলেন, আমি এলে ক্ষতি হবে?
ব্রহ্মানন্দ বললেন, তোমার কাজের ধারা বদলে গেছে, তুমি এখন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছ, আমরা সন্ন্যাসী, আমরা রাজনীতির সঙ্গে কোনও সংস্রব রাখতে চাই না। তুমি ওকাকুরা সাহেবকে সঙ্গে করে আনন, তিনিও কী সব উগ্র মতবাদ প্রচার করেন শুনেছি। আমরা বেলুড় মঠকে রাজনীতির আখড়া বানাতে চাই না।
নিবেদিতা বললেন, সে প্রশ্নই ওঠে না। মঠের সঙ্গে রাজনৈতিক কার্যকলাপের কোনও সম্পর্ক নেই। সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। স্বামীজির সঙ্গে আমার এ বিষয়ে কথা হয়েছে, তর্ক হয়েছে, কিন্তু তিনি তো আমাকে আসতে বারণ করেননি। মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি অসুস্থ শরীর নিয়েও আমার বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন। আমাকে মঠে আসতে বললেন, আমি এলাম, তিনি নিজের হাতে আমাকে আহার্য প্রস্তুত করে দিলেন–
ব্রহ্মানন্দ বললেন, নরেন ছিল পাহাড়ের মতন, সে অনেক কিছু সামলাতে পারত, এখন মঠের ওপর যদি পুলিশের নজর পড়ে তা হলে সব কিছু তছনছ হয়ে যাবে। এখানে আর কেউ আসবে না। এমনিতেই গোঁড়া হিন্দুরা আমাদের নামে অনেক কিছু বলে–
নিবেদিতা বাধা দিয়ে বললেন, স্বামীজি কোনওদিনই গোঁড়া হিন্দুদের মতবাদ কিংবা হীন কুৎসা তোয়াক্কা করতেন না। সন্ন্যাসীরা নির্জন জঙ্গলে কিংবা গিরিকরে আশ্রম বানিয়ে বসবাস করলে শুধু আধ্যাত্মিক চিন্তায় নিমগ্ন থাকতে পারেন। কিন্তু লোকালয়ের মধ্যে এরকম মঠ বানিয়ে থাকলে আশেপাশের মানুষদের সম্পর্কে কি উদাসীন থাকতে পারে? মানুষের অভাব, অনাহার, দুর্বলের ওপর শক্তিমানের উৎপীড়ন, পরাধীনতার গ্লানি, এই সব বিষয়ে স্বামীজি স্বয়ং বিচলিত হতেন না? এই সব দূর করার চেষ্টাই কি রাজনীতি?
ব্রহ্মানন্দ নিবেদিতার কথায় কান না দিয়ে বললেন, সঙ্ঘ, মঠের জন্য তুমি যত টাকাপয়সা তুলেছ, এখনও তোমার নামে অনেক চেক ও ড্রাফট আসে, সে সব মঠেরই প্রাপ্য। সেগুলি তুমি এখানে জমা করে দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে অবিলম্বে। এ যাবৎ তোমার ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগৃহীত অর্থ ন্যায়ত মঠেরই প্রাপ্য। তোমার মঠে আসা-যাওয়া বন্ধ করাই যথেষ্ট নয়, বিভিন্ন সংবাদপত্রে তোমার একটা বিবৃতি দেওয়া দরকার যে তুমি বেলুড় মঠের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছ।
নিবেদিতার সমস্ত অন্তরাত্মা চিৎকার করে বলতে চাইল, না, না, আমি এ সব মানি না। এই মঠের ওপর আপনাদের যতখানি অধিকার আছে, আমার অধিকারও কোনও অংশে কম নয়। আমি কেন সেই অধিকার ছাড়ব? আমি যখন ইচ্ছে আসব। যেকক্ষে আমার প্রভু, আমার স্বামীজি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন, আমি সেখানে বসে থাকব। তিনি আমাকে কখনও ছেড়ে যাবেন না বলেছিলেন, ওই ঘরটায় বসলে তবু আমি তাঁর কিছুটা সাহচর্য পাব।
ব্রহ্মানন্দ বললেন, মঠের সঙ্গে তোমার আর সম্পর্ক না থাকলেও তোমার সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ থাকবে—
নিবেদিতা আর কিছুই শুনলেন না। রাগে তাঁর শরীর জ্বলছে, তিনি তরতর করে নেমে এলেন নীচে। অন্য দিন কেউ না কেউ তাঁকে নৌকোর ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, শেষের দিকে স্বামীজি নিজে না এলেও সঙ্গে কোনও লোক দিতেন আর ওপরের জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন, আজ কেউ এল না। নিবেদিতা বৃষ্টির মধ্যে একা দৌড়ে চলে গেলেন।
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মধ্যে গঙ্গার ওপর দিয়ে নৌকো চলেছে বাগবাজার ঘাটের দিকে। নিবেদিতার দু চক্ষু দিয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রু। আজই তিনি প্রথম কাঁদলেন।
বাড়ি ফিরে তাঁর মনে হল, এই সিদ্ধান্ত কি ব্রহ্মানন্দের একার, না মঠের সকলের? ব্রহ্মানন্দ মঠাধ্যক্ষ হলেও এরকম সময়ে নিশ্চয় সকলের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। স্বামী বিবেকানন্দর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিবেদিতাকে মঠ থেকে তাড়িয়ে দেবার ব্যাপার সবাই মেনে নেবে? তিনি আশা করতে লাগলেন, অন্য কেউ এসে বলবে,, না, ও সব ভুলে যাও, তুমি আগের মতনই মঠে আসবে, কাজের ব্যাপারে পরামর্শ দেবে। সেরকম কেউ এল না, তবে কানাঘুষো শোনা যেতে লাগল যে নিবেদিতা যদি রাজনীতির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বর্জন করেন, সেই ধরনের লোকজনের সঙ্গে মেলামেশাও বন্ধ করে মঠের নির্দেশ মেনে চলেন, তা হলে তাঁকে ফিরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এ কথা শুনলেও নিবেদিতার মেজাজ দপ করে জ্বলে ওঠে। এরা ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল্য বোঝে না! দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি অন্য অনেককে উদ্বুদ্ধ করেছেন, এখন নিজে পিছিয়ে আসবেন? না, তা হতেই পারে না।
দিনকতক পরে ব্রহ্মানন্দের কাছ থেকে গম্ভীর সরকারি ধরনের চিঠি এল। নিবেদিতা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা তিনি জানতে চান। সংবাদপত্রের বিবৃতির ব্যাপারে তিনি আর দেরি করতে চান না।
সঙ্গে সঙ্গে চিঠিখানির উত্তর না দিয়ে নিবেদিতা স্নান করতে গেলেন। তারপর ধ্যানে বসলেন, মুদ্রিত চক্ষুর অন্ধকারে বারবার ভেসে উঠছে স্বামী বিবেকানন্দর মুখ, অসুস্থ হবার আগেকার সেই দিব্যকান্তি, উজ্জ্বল দুই চক্ষু। কিন্তু শুধুই মুখচ্ছবি, তা সবাক নয়, স্বামীজি তাঁর প্রিয় শিষ্যাকে কোনও নির্দেশ দিলেন না।
অনেকক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকবার পর নিবেদিতার মন প্রশান্ত হয়ে গেল। বেলুড় মঠের সঙ্গে তাঁর কোনও প্রকার মতবিরোধ বাইরে জানাজানি হলে বহু লোক মজা পাবে, হাসাহাসি করবে। মঠের কোনও প্রকার ক্ষতি হয়, এমন কাজ তিনি কিছুতেই করতে পারেন না। ব্রহ্মানন্দ যা চান তাই হবে, মঠের ওপর অধিকার তিনি ত্যাগ করবেন। টাকাপয়সা যা আছে, তা পাইপয়সা পর্যন্ত হিসেব করে চুকিয়ে দেবেন মঠের কাছে।
কাগজ কলম নিয়ে তিনি চিঠি লিখতে বসলেন এর পর। একটি চিঠিতে ব্রহ্মানন্দকে সশ্রদ্ধভাবে জানালেন, যতই বেদনাদায়ক হোক, তবু আপনি যে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চান, তা আমি মেনে নিলাম। প্রতিদিন শ্রীরামকৃষ্ণ ও আমার প্রিয় গুরুর ভস্মাবশেষের বেদীমূলে আমার ভালবাসা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ভুলবেন না।
সংবাদপত্রের জন্যও একটি বিবৃতিতে লিখলেন, তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মধারা সম্পূর্ণ তাঁরই ব্যক্তিগত, রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের নির্দেশের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক থাকবে না। কাছেই অমৃতবাজার পত্রিকার অফিস, বিবৃতিটি পাঠিয়ে দিলেন সেখানে।
গুরুভ্রাতাদের সঙ্গেও সম্পর্ক রইল না, এখন আর কেউ নেই। কার কাছে প্রাণ খুলে দুটো কথা বলবেন? জগদীশ আর অবলা এখন কলকাতায় রয়েছেন বটে, কিন্তু ওঁরাও রাজনীতির সঙ্গে জড়াতে চান না।
নিবেদিতার এখন চলবে কী করে? তাঁর নিজস্ব সম্বল কিছু নেই। স্বামীজির সহযোগিনী হিসেবে কাজ করছিলেন বলে বিদেশি ভক্তরা তাঁর খাদ্যবস্তু-বাসস্থানের জন্য মাসে মাসে টাকা দিতেন, এখন নীতিগতভাবে সে টাকা তিনি নিতে পারেন না, সব টাকাই সঙ্ঘের প্রাপ্য। একটি অনাথ আশ্রম ও একটি বিধবা আশ্রম ভোলার জন্য বিদেশ থেকে কিছু টাকা সংগ্রহ করে এনেছিলেন, ওই সব চালাবার অধিকারও আর তাঁর নেই, সে টাকাও সঙ্ঘকে ফেরত দিতে হবে। তা হলে নিবেদিতার ভবিষ্যৎ কী? দেখা যাক, বই লিখে কিছু কিছু উপার্জন করা যায় কি না। কিছুতেই তিনি হার মেনে ফিরে যাবেন না, এই ভারতই তো তাঁর দেশ।
মাঝে মাঝে অন্য লোকজন কিছু কিছু আসে। স্বামীজির ছোট ভাই ভূপেন এলে তাঁর ভাল লাগে, এর মুখের গড়নে, পাশ ফিরে তাকানোয় স্বামীজির কিছুটা আদল আছে। কিন্তু ছেলেটিকে পছন্দ করা শক্ত, তার ব্যবহার উদ্ধত ধরনের, অল্প বয়েস, তবু চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। একদিন দীনেশচন্দ্র সেন নামে একজন লেখকও এসে উপস্থিত হয়েছিল। নিবেদিতা তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার সময় বলেছিলেন, ইনি স্বামী বিবেকানন্দর ছোট ভাই। ভূপেন অমনি মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, আমাকে সব সময় বিবেকানন্দর ভাই বলতে হবে কেন, আমি ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, এই পরিচয়টাই যথেষ্ট!
ভূপেনের মধ্যে তবু দেশপ্রেমের আঁচ আছে, দীনেশের মধ্যে তাও নেই। সে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের উপাদান ও নানা লোককাহিনী খুঁজে খুঁজে বার করছে, সেটা প্রশংসনীয় বটে, কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই। একদিন দীনেশচন্দ্রের সঙ্গে নিবেদিতা বাগবাজারের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন, হঠাৎ একটা ক্ষ্যাপা ষাড় তাড়া করে এল। অমনি নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য চোঁ চোঁ করে দৌড়, মারল দীনেশ, নিবেদিতার কী হল, তা ফিরেও দেখল না! এই কি পুরুষমানুষ, এ যে অবলা নারীরও অধম! এক-এক সময় দীনেশ রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে যায়, তখন বোঝা যায়, এ বিষয়ে তার সামান্য জ্ঞানও নেই। মাঝে মাঝে নিবেদিতা ধমক না দিয়ে পারেন না, তিনি বলেন, আপনি চুপ করুন তো। যে বিষয়ে কিছু জানেন না, সে বিষয়ে কথা বলবেন না। বরং সাহিত্য বিষয়ে যা বলার আছে, বলুন।
একদিন সকালবেলা সাইকেলে চেপে একজন ইংরেজ যুবক এল দেখা করতে। কৃশকায় দীর্ঘ শরীর, বুদ্ধিদীপ্ত মুখোনিতে কিছুটা সারল্যও রয়েছে, এ দেশের অধিকাংশ ইংরেজের মতন অহংকারী ভাব-ভঙ্গি নেই। নিবেদিতা একটু বিস্মিত হলেন। শহরবাসী ইংরেজ সমাজের আমন্ত্রণে তাঁকে মাঝে মাঝে দু-একটা আসরে যেতে হয় বটে, কিন্তু তিনি যে শাসক শ্রেণীর কেউ নন তা বুঝিয়ে দেবার জন্য তিনি সাহেবপাড়ায় থাকেন না, উত্তর কলকাতার ঘিঞ্জি গলির মধ্যে এ বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। এখানে সচরাচর কোনও ইংরেজ পুরুষ রমণী তাঁর কাছে আসে না।
যুবকটি বিনীতভাবে জানাল যে, আগে থেকে খবর না দিয়ে চলে আসার জন্য সে দুঃখিত। তার নাম স্যামুয়েল কে র্যাটক্লিফ, সে দা স্টেটসম্যান পত্রিকার সহকারী সম্পাদক, লন্ডন থেকে কিছুদিন মাত্র আগে এ দেশে এসেছে। সে নিবেদিতার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে চায়।
নিবেদিতা বললেন, আমার এখনও প্রাতরাশ হয়নি, তুমি আমার সঙ্গে যোগ দাও। তুমি আমার কথা জানলে কী করে?
র্যাটক্লিফ বলল, কয়েক দিন আগে লাউডন স্ট্রিটে একটি চায়ের আসরে আপনাকে দেখেছি। অনেক লোকজন ছিল, আপনি হয়তো আমাকে লক্ষ করেননি। সেখানে আপনাকে কিছু বলতে বলা হয়েছিল, আপনার বক্তৃতা শুনে আমি দারুণ চমকে গেছি। এ দেশে এসে এরকম কথা আমি আগে আমার কোনও স্বদেশবাসীর মুখে শুনিনি। আমি নতুন এসেছি, সবাই আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করে যে এ দেশের লোকরা কত খারাপ, মিথ্যেবাদী ও ভণ্ড, মেয়েদের ওপর সাঙ্ঘাতিক অত্যাচার করে, মেয়েরাও অবোধ ও কুসংস্কারগ্রস্ত! আপনি অতগুলি ইংরেজ ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলার সামনে অকুতোভয়ে বললেন, ইংরেজরাই কিছু বোঝে না। এ দেশের নারীদের গৌরবময় ঐতিহ্য, সেবার আদর্শ ও মানবিকতার দিকগুলি গভীরভাবে জানার চেষ্টাও করে না, ওপর ওপর কিছু ব্যাপার দেখে নিন্দে করে। শুধু তাই নয়, শাসকশ্রেণী ভারতীয় সমাজের অনেক ভাল ভাল রীতি ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমি শুনে একেবারে স্তম্ভিত।
নিবেদিতা স্মিতহাস্যে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি স্টেটসম্যান পত্রিকায় ঠিক কী কাজ করো?
র্যাটক্লিফ বলল, প্রধানত সম্পাদকীয় লেখানোর জন্য আমাকে আনানো হয়েছে।
নিবেদিতা বললেন, তুমি যদি পার্ক স্ট্রিট-লাউডন স্ট্রিটের সমাজে ঘোরাফেরা করো, তা হলে এ দেশ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবে না। সরকারি বক্তব্য ও ইংরেজ সমাজের একপেশে মন্তব্যই তোমার লেখায় ফুটে উঠবে। সেটা কি যথার্থ সাংবাদিকতা! সম্পাদকীয় লেখক এ দেশের মানুষ, তাদের আচার-ব্যবহার, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা-অভিযোগের কথা জানবে না?
র্যাটক্লিফ বলল, জানবার চেষ্টা করছি। সেই জন্যই আমি সময় পেলেই বাইসাইকেল নিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াই। নেটিভ পাড়াতেও আসি। গ্রামাঞ্চলেও যাবার ইচ্ছে আছে!
নিবেদিতা বললেন, ইংরেজদের পত্র-পত্রিকাগুলি সবই সরকারের ধামাধরা। লর্ড কার্জন কী সব কাণ্ডকারখানা শুরু করেছেন, তুমি তা সমর্থন করো? লোকটা কী সাঘাতিক অহংকারী। এ দেশের মানুষদের মানুষ বলেই মনে করে না। ওর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, ইংরেজরা যেন আরও এক হাজার বছর এই দেশ শাসন করবে। কলকাতা কর্পোরেশনের কী হাল করল! দেশীয় লোকদের হাতে আরও কিছু ক্ষমতা দেবার বদলে বরং উল্টে তাদের সংখ্যা কমিয়ে দিল। শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি সরকারি চাপে রাখতে চায়। দিল্লিতে আবার দরবার বসতে চলেছে, শুধু শুধু কত টাকার অপব্যয় হবে, সব এ দেশেরই টাকা!
র্যাটক্লিফ বলল, আপনি আমাদের পত্রিকায় লিখবেন?
নিবেদিতা ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করলেন, আমি! আমাকে তোমাদের পত্রিকায় লিখতে দেবে?
র্যাটক্লিফ বলল, আমি ব্যবস্থা করব। এর মধ্যে আপনার দু-একটি রচনা আমি পড়েছি। আপনার ভাষার জোর আছে।
নিবেদিতা খুশিই হলেন এ প্রস্তাবে। স্টেটসম্যান অতি শক্তিশালী পত্রিকা, তার মাধ্যমে নিজের কথা বলতে পারলে শাসকশ্রেণীর কিছুটা টনক নড়বে। তাঁর জীবিকারও খানিকটা সুরাহা হবে।
চায়ের টেবিলে বসে নানা রকম গল্প হল। কলকাতার ইংরেজ সমাজে র্যাটক্লিফের মতন মুক্তমনা মানুষ দুর্লভ। এরকম মানুষের সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়।
ওকাকুরা কয়েক দিনের জন্য বাইরে গিয়েছিলেন, তিনি ফিরে আসতেই তাঁর সঙ্গে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নিবেদিতা। রামকৃষ্ণ সঙঘ ও বেলুড় মঠের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবার ব্যাপারটা তাঁর প্রাণে খুব বেজেছে। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না, কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে তবু সেটা ভোলা যায়। আর যে-জন্য সঙ্ঘের গুরুভাইদের সঙ্গে মতভেদ, সেই কারণটাকেই সার্থক করে তুলতে হবে। শুধু আধ্যাত্মিকতার পরিপোষণ নয়, এখন এ দেশের পক্ষে বেশি প্রয়োজন পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি। তার জন্য চাই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি। তার জন্য শুধু সভা-সমিতি বা বক্তৃতায় হবে না, চাই সশস্ত্র অভ্যুত্থান।
ওকাকুরার এশিয়ার ঐক্য নীতি অনেককেই নাড়া দিয়েছে। ভারত পরাধীন, কিন্তু তার সংগ্রামের সাথি হিসেবে অন্য দেশগুলি পাশে এসে দাঁড়াবে, তারা অস্ত্র দেবে। সমগ্র এশিয়ার দেশগুলি একজোট হলে ইওরোপীয় শক্তিগুলি ভয়ে পালাবে। এশিয়ার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে এশিয়াবাসীরাই। এ জন্য অচিরেই দরকার ভারতের সর্বাত্মক প্রস্তুতি।
নিবেদিতা ওকাকুরাকে নিয়ে ঘুরতে লাগলেন বিভিন্ন গুপ্ত সমিতির আখড়ায়। ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রের অনুশীলন সমিতির ছেলেরা যথেষ্ট উৎসাহী। প্রমথ মিত্র এখন বৃদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু দেশোদ্ধারের তেজ একটুও কমেনি। কলকাতা ছাড়া বরিশালেও তাঁর সংগঠন আছে। সার্কুলার রোডে যতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেলারা দেশের জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। অভিজাত শ্ৰেণীদের মধ্যেও কেউ কেউ স্বাধীনতা সংগ্রামে গোপন সমর্থন জানাচ্ছেন। একজন ধনী ব্যক্তি, নিজের নাম না জানিয়ে লোক মারফত ঘোষণা করেছেন যে, গুপ্ত সমিতির ছেলেরা যদি অন্তত একজন উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীকেও খুন করতে পারে, তা হলে তিনি এক হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন। অর্থাৎ তিনি বিপ্লবীদের শক্তি পরীক্ষা করতে চান। যতীন ব্যানার্জির দলের দু-চারজন যুবক এখনই এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চায়।
সরলা ঘোষালের মনোভাব নিবেদিতা এখনও বুঝতে পারছেন না। সরলার দল যে উৎসব অনুষ্ঠানেই বেশি আগ্রহী, লাঠি খেলা, ছোরা খেলার চর্চা যে চলছে, তা যেন অনেকটা শখের। প্রদর্শনীর জন্য। সরলা এক সময় রুডিয়ার্ড কিপলিঙ-কে ডুয়েল লড়ার জন্য আহ্বান জানাতে চেয়েছিল। একটি গল্পে কিপলিং বাঙালিদের ভীরু, কাপুরুষ, গিদ্দর বলে গালি দিয়েছিল, এক বাঙালি আই সি এস অফিসার পাঠান বিদ্রোহের সময় ভয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে, তারপর তার মুণ্ডু কেটে বর্শা ফলকে গেঁথে ঘোরানো হয়েছিল এক শহরের পথে পথে। সেই গল্প পাঠ করে সরলার রক্ত টগবগ করে ফুটেছিল, কিপলিংকে সে চিঠি লিখেছিল, পাঁচ বছর বাদে একজন বাঙালি যুবকের সঙ্গে কিপলিং এসে বন্দুক, তলোয়ার অথবা যে-কোনও অস্ত্রে লড়ে যাক। সে চিঠি অবশ্য পাঠানো হয়নি, তারপর পাঁচ বছর কেটে গেছে, কিন্তু সরলা এখনও প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কথা উঠলেই ইতস্তত করে।
বরোদার অরবিন্দ ঘোষ যতীন ব্যানার্জির দলটির মন্ত্রগুরু। সেই দলের বারীন্দ্র, হেমচন্দ্র, ভরত নামে যুবকদের সঙ্গে নিবেদিতা ও ওকাকুরার প্রায়ই আলোচনা হয়। এরা প্রায়ই প্রশ্ন করে, কবে শুরু হবে সংগ্রাম? কোনও ইংরেজের ওপর আঘাত হানার জন্য এরা অস্থির। শুধু হেমচন্দ্র একদিন সন্দেহ প্রকাশ করে বলল, আমরা যে শুনেছিলাম, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে গুপ্ত সমিতিগুলি এমন কি পাহাড়ের আদিবাসীরাও সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত, বাংলাতেই তেমন কিছু সংগঠন এখনও নেই, কিন্তু মিস নোবল, তার প্রমাণ কোথায়? অন্য কোনও অঞ্চলের গুপ্ত সমিতির সঙ্গে তো আমাদের যোগাযোগ হল না এখনও!
ওকাকুরা তাদের আশ্বাস দিলেন। অন্য প্রদেশের দলগুলির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তিনি এক মাসের সফরে বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন সুরেন ঠাকুরকে। যাত্রার সময় তিনি সহাস্যে নিবেদিতাকে বললেন, যদি আমি পথে খুন হয়ে না যাই, তা হলে অবশ্যই সফল হয়ে ফিরে আসব। যদি ফিরে না আসি, আমার কার্যের সব ভার তুমি নেবে।
এ কথা শুনে নিবেদিতার বক্ষ কেঁপে উঠল। না, না, চরম প্রস্তুতি পর্বে এই বীর নায়কের খুন হওয়া কিছুতেই চলবে না। ওকাকুরা যাতে সাবধানে থাকেন, ভাল হোটেলে অবস্থান করতে পারেন, এ জন্য নিবেদিতা তাঁর হাতে তুলে দিলেন এক হাজার টাকা।
এই টাকা মঠের নয়, নিবেদিতার নিজস্বও নয়। জো ম্যাকলাউড তাঁকে নিয়মিত টাকা পাঠাচ্ছেন। একমাত্র জো-কেই নিবেদিতা অকপটে নিজের সব কথা জানাতে পারেন চিঠিতে। বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীরা স্বামীজির মৃত্যুর পর এখনও কান্নাকাটি ও পূজা-প্রার্থনায় ডুবে আছে। স্বামীজি অসুস্থ অবস্থায় ও ঝোঁকের মাথায় রাজনীতির বিরুদ্ধে যা বলেছিলেন, সেটাকেই ওরা ধরে বসে আছে, এ দেশের জন্য স্বামীজির সামগ্রিক চিন্তা ওদের মাথায় নেই। ওকাকুরার সঙ্গে নিবেদিতা এখন কোন ব্যাপারে জড়িত তা জো ম্যাকলাউড জানেন। ওকাকুরার জীবনযাত্রা ব্যয়বহুল, সে খরচ জোগাতে জোর আপত্তি নেই।
ওকাকুরা ‘আইডিয়ালস অফ দা ইস্ট’ নামে আর একটি বই লিখছেন, সে কাজেও সাহায্য করছেন নিবেদিতা। বাইরে যাবার আগে ওকাকুরা পাণ্ডুলিপি রেখে গেলেন নিবেদিতার কাছে, তিনি তার ভাষা আদ্যোপান্ত সংশোধন করতে লাগলেন। এই বইতেও আছে এশিয়ার একাত্মতার আদর্শের কথা, এরকম বইয়ের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে বিপ্লবীদের কাছে।
লেখাপড়া ও বিপ্লবীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের কাজ করে যাচ্ছেন নিবেদিতা, কিন্তু এক দিনের জন্যও তাঁর অতি প্রিয় গুরুর কথা ভোলেননি। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর জীবনসর্বস্ব। নিবেদিতার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি এখনও যা কিছু করছেন, সবই তাঁর গুরুর কাজ। এ দেশের মানুষকে তিনি গভীরভাবে ভালবাসতেন, এ দেশের মানুষের পরাধীনতার মোন কি তিনি চাইতেন না?
ওকাকুরা ফিরে এলেন নির্বিঘ্নেই। কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলের বিপ্লব প্রস্তুতি সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে চান না। সব কিছুই রহস্যময় করে রাখার দিকে তাঁর ঝোঁক। জিজ্ঞেস করলেই বলেন, সব ঠিক আছে, বারুদের আগুনের মতন এখানে একবার আগুন লাগলেই সারা ভারতে দপ করে আগুন জ্বলে উঠবে একসঙ্গে। কিন্তু এখানে শুরু হবে কবে?
ওকাকুরার চরিত্রের আর একটা দিকও নিবেদিতার নজরে পড়ল। নিবেদিতার মন একমুখী, এখন বিপ্লব চিন্তা ছাড়া অন্য কিছু তাঁর মাথায় নেই। কিন্তু ওকাকুরা শিল্পরসিক, বিপ্লবের কথা বলতে বলতে এক-এক সময় তিনি আবার শিল্প বিষয়ক আলোচনায় মগ্ন হয়ে যান। ঠাকুরবাড়ির গগনেন্দ্র, অবনীন্দ্রের সঙ্গে অনেক সময় কাটান। বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত হলে যে জীবনের অন্য উপভোগ বাদ দিতে হবে, এমন তিনি মনে করেন না। ব্র্যান্ডি ও সিগারেটের জন্য তাঁর অনেক টাকা খরচ হয়। নারীদের সঙ্গ তিনি বিশেষ পছন্দ করেন।
বালিগঞ্জে সরলাদের বাড়িতে গেলে ওকাকুরা আর উঠতেই চান না। ওখানকার ছেলেরা ওকাকুরাকে যেন মাথায় করে নাচে। কী করে যেন রটে গেছে, ওকাকুরাই এ যুগের কল্কি অবতার। পীত দেশ থেকেই তো কল্কির আসার কথা। কেউ কেউ তাঁকে কৃষ্ণ বলতেও শুরু করেছে।
এ সব নিবেদিতার আগে ভালই লাগত। কিন্তু এখন সরলা ঘোষালের সাহচর্য আর তাঁর পছন্দ হয় না। ও বাড়িতে বসে শুধু কথার ফুলকি ছড়ানো যেন সময়ের অপব্যয়।
ওকাকুরা চৌরঙ্গিতে এক বাড়িতে অতিথি হয়ে আছেন। সুন্দর সাজানো গোছানো প্রকোষ্ঠ, সেখানে বিলাসিতার কোনও দ্রব্যেরই অভাব নেই। একদিন সেখানে নিবেদিতা এসেছেন ‘আইডিয়ালস অফ দা ইস্ট’ গ্রন্থটির পরিমার্জনা বিষয়ে আলোচনা করতে। ওকাকুরা ব্র্যান্ডি পান করতে করতে শুনছেন, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। নিবেদিতার সাহায্যের জন্য তিনি উচ্ছ্বসিত। নিবেদিতার ইংরেজি ভাষায় বক্তব্যগুলি অনেক সুবোধ্য ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ এক সময় হাতের সিগারেট নিবিয়ে ওকাকুরা উঠে গিয়ে নিবেদিতার দু কাঁধে হাত রাখলেন। মৃদু টান দিলেন নিজের বুকের দিকে।
পাংশু হয়ে গেল নিবেদিতার মুখ। ছিটকে সরে গিয়ে বললেন, এ কী!
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ওকাকুরা বললেন, না, না, আমার কোনও অসৎ উদ্দেশ্য নেই!
নিবেদিতা আরও সরে গিয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বললেন, আপনি, আপনি আমাকে স্পর্শ করলেন?
ওকাকুরা বললেন, তোমার এই অপূর্ব রূপ দেখে, তোমার মুখে বিকেলের রোদ পড়েছে, দেবী প্রতিমার মতন তুমি সুন্দর…মিস নোবল, আমার কোনও কুমতলব নেই, তুমি, তুমি আমাকে বিবাহ করবে? আমি নতজানু হয়ে তোমার পাণিপ্রার্থী!
নিবেদিতার দুই চক্ষে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখা দিল। বলে কী লোকটা! তিনি কে, তা কি এই জাপানি ভদ্রলোকটি জানে না? তিনি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দর নিবেদিতা। বিবেকানন্দর মতন মানুষের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে যে এসেছে, সে কখনও অন্য পুরুষকে কামনা করতে পারে! প্রথম প্রথম স্বামীজিকে অতি আপন করে পেতে চেয়েছিলেন নিবেদিতা। তখনও সন্ন্যাসীর জীবন সম্পর্কে তাঁর সঠিক জ্ঞান ছিল না। স্বামীজির সঙ্গে তার সম্পর্ক শুধুই গুরু শিষ্যের, এমনি নারী-পুরুষের মতন হতে পারে না? একদিন সোজাসুজি প্রায় কেঁদে উঠে প্রশ্ন করেছিলেন স্বামীজিকে, আমরা সাধারণ নারী পুরুষের মতন হতে পারি না!
সে প্রশ্নের গঢ়ার্থ বুঝেছিলেন স্বামীজি। নিবেদিতা যেন বলতে চেয়েছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণও তো বিবাহিত ছিলেন, তাতে তাঁর সাধনায় তো কোনও বাধা হয়নি।
স্বামীজি গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, আমি তা পারি না মার্গট, আমি রামকৃষ্ণ পরমহংস নই!
আরও কিছু কথা হয়েছিল। স্বামীজি বারবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন নিবেদিতার মুখ থেকে। তাঁর মনের মধ্যে যে ঝড় বইছে, তা বোঝা যায়, বারবার মাথা নেড়ে বলছিলেন, না, না না। তা হয় না মার্গট! এদেশের মানষু বুঝবে না।
এর পর স্বামীজি তাঁকে আজীবন ব্রহ্মচারিণী থাকার দীক্ষা দিয়েছিলেন। তার থেকে বিচ্যুত হবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
নিবেদিতা একটুক্ষণ ওকাকুরার দিকে চেয়ে রইলেন। নিশ্বাস অতি উষ্ণ। তীব্রভাবে বললেন, আপনি বিবাহ করতে চান? এর আগে আর কতজনের কাছে প্রস্তাব করেছিলেন? সরলাদের বাড়িতে প্রিয়ংবদার সঙ্গে আপনার প্রেম প্রেম ভাব কি আমার নজরে পড়েনি? ও বাড়িতে নয়নমণি নামে একটি অভিনেত্রীকে দেখেও আপনি মুগ্ধ হয়েছিলেন, তাকে বারবার দেখার জন্যই ওখানে যান। এমনকী সরলার কাছও আপনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সে রাজি হয়নি শুনেছি। আপনি কি এ দেশে বিপ্লব করতে এসেছেন, না প্রেম করতে এসেছেন।
ওকাকুরা কিছু বলতে যেতেই নিবেদিতা তাঁকে বাধা দিয়ে আবার বললেন, বিপ্লবের এত উদ্যোগ আয়োজন, সবই আপনার কথার কথা? এত দিনে কতটুকু এগিয়েছি আমরা? কোন কোন দেশ আমাদের অস্ত্র সাহায্য করবে? কোনও চিহ্নই নেই, সবই আপনার গল্প! এশিয়ার একাত্মতার যে তত্ত্ব, তাও আসলে ইউরোপিয়ানদের তাড়িয়ে দিয়ে জাপানের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, তাই না? জাপান সব চেয়ে বড় হবে, জাপান হবে এশিয়ার প্রভু!
নিবেদিতার ক্রুদ্ধ বাক্যাবলির তোড়ে ওকাকুরার সব যুক্তিই দুর্বল হয়ে গেল। তিনি বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না। ই এক সময় থেমে গিয়ে নিবেদিতা বললেন, আপনার সঙ্গে আর আমার দেখা হবে না।
তিনি দ্রুত বেরিয়ে গেলেন সেখান থেকে।
সত্যিই আর দেখা হল না। সমস্ত বিপ্লব উদ্যোগে জলাঞ্জলি দিয়ে ওকাকুরাও কয়েকদিন পরই ফিরে গেলেন জাপানে।