৬৬.
আচ্ছা এই স্ট্রোক জিনিসটা ঠিক কেমন হয় বলতে পারেন? লোকের মুখে শুনি কিন্তু ঠিক আন্দাজে আসে না।
হঠাৎ স্ট্রোক নিয়ে ভাবতে লেগেছিস কেন?
না এই কদিন ধরেই ভাবছি। বয়সও তো হচ্ছে। এক সময়ে তো চৌকাঠ ডিঙোতেই হবে। তাই ভাবছিলাম একটু আন্দাজ যদি করা যায়। মরার সময় কীসে মরছি, শরীরে কেমনধারা হচ্ছে সেটা বেশ বুঝতে বুঝতে মরা যাবে।
তোর যেমন বুদ্ধি। মরার সময় কি অত শরীরবোধ, অত টনটনে জ্ঞান থাকবে রে? আর আগাম ভেবেই বা কী হবে? থাকবি তো চিৎপাত হয়ে শুয়ে। যা ইচ্ছে হোক না। আগে থেকে ভেবে মরবি কেন?
তা অবিশ্যি ঠিক। তবে কী জানেন দাদা, মরতে তেমন ভয়-টয় নেই আমার। ভাবি কী জানেন, বাঁচাটার মতো মরাটাও বেশ উপভোগ করারই জিনিস। মনে হয়, শরীরের মধ্যে ঠিক যেন ইস্টিশন, গার্ডবাবু হুইসল দিল, ঝান্ডা নাড়ল, ড্রাইভারসাহেব ভেঁপু বাজাল, তারপর প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে কু ঝিকঝিক করে ট্রেন চলে গেল। ফাঁকা ইস্টিশন এই দেহখানা রইল পড়ে। পুরো ব্যাপারটাই বেশ একটা ঘটনা।
ঘটনা তো বটেই রে, তবে যে মরে সে কি আর অত বুঝতে পারে? গৌরদাকে তো দেখলি, দুদিন তো জ্ঞানই ছিল না।
সেও তো স্ট্রোক!
সেরিব্রাল। যাওয়া নিয়ে কথা, উপলক্ষ যা-ই হোক।
আগে কিন্তু মরাটা ভারী সোজাসরল ছিল। ডাক্তারবদ্যি ছিল না, এত রক্ত পরীক্ষা, ইসিজি, এক্স রে, স্ক্যানেরও বালাই ছিল না। যমে আর মানুষে টানাহ্যাঁচড়া হত কম। কলেরা হল কি সান্নিপাতিক, জ্বরবিকার বা সন্ন্যাস পটাপট মরে যেত লোকে। এমনকী আমাশয়ে ভুগেও কি কম মরেছে? আজকাল কিন্তু ডাক্তারবদ্যি এসে নতুন নতুন ওষুধ দিয়ে মরণটাকে খুব আটকেছে।
হ্যাঁ। আজকাল মরছে কম। তা আজ বেহানবেলাটায় কু-ডাক ডাকছিস কেন?
কী যে বলেন দাদা, কু-ডাক ডাকব কেন? এসব তত জ্ঞানেরই কথা কিনা। আগে থেকে ভেবে রাখা ভাল। দেহখানা যাবে সে তো জানাই আছে। কিন্তু কোন কায়দায় যাবে সেইটেই ভাবি। আপনার কি যোগেন রায়ের কথা মনে আছে? শিবশূলের যোগেন রায়!
তা মনে থাকবে না কেন? সাহেবের সঙ্গে মারপিট করে জেল খেটেছিল বলে তাকে নিয়ে বর্ধমানে সভা হয়।
হ্যাঁ সে-ই। সুভাষ বোস ডেকে পাঠিয়েছিল কলকাতার কংগ্রেস অফিসে। পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল। মনে আছে দাদা?
খুব। যোগেন তো মহেন্দ্র জমিদারের বাড়িতে নিয়ম করে ব্রিজ খেলতে আসত। খেলতও ভাল।
হ্যাঁ। তা সেই যোগেন রায় মরল, আমার চোখের সামনে। তখন প্রায়ই গিয়ে বসে থাকতুম তো। আমাদের যৌবনের হিরো বলে কথা। একদিন বিকেলে গিয়ে বসেছি। যোগেন রায় বাগানে ইজিচেয়ার পেতে বসা। ক্ষিতীশ ঘোষ, নবেন্দু চৌধুরী, গণেশ হালদার সব বসে আছে। যোগেন রায় চা খেতে খেতে কী একটা হাসির কথা বলছিল। বলতে বলতে সামনের বেতের টেবিলটায় চায়ের কাপটা রেখে হঠাৎ একটু পিছনে হেলে গেল। মাথাটা চেয়ারের কানায় রেখে ঊর্ধ্বমুখে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। চেয়ে রইল তো চেয়েই রইল। চোখের পাতা আর পড়ে না। ঝাড়া আধঘণ্টা সামনে বসে থেকেও আমরা বুঝতে পারিনি যে মারা গেছে। মুখে তখনও হাসিটা লেগে আছে।
মহিম রায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ভাগ্যবান লোক, বুঝলি? অমন মরা মরতে পারলে আর চাই কী?
তা যা বলেছেন। তবে কিনা সাহেব পেটানোয় কত দূর পুণ্যি হয় তা আমি জানি না, কিন্তু সেটা বাদ দিলে যোগেন রায়ের আর পুণ্যিটা কোথায় বলুন তো! চেহারাখানা ছিল বটে দেখনসই, লোকে বলত শিবশূলের নেতাজি। কিন্তু কোনও দেখনসই মেয়ে চোখে পড়লে পার পেত না। বউ হোক ঝি হোক যোগেন রায়ের এঁটো হয়নি এমন মেয়ে পাবেন না। তার ওপর বন্ধকী কারবার ছিল। লোকে বলে বন্ধকী কারবার করলে নরকের পথে আর খানাখন্দও থাকে না। তা এত সব করেও অমন ইচ্ছামৃত্যুর মতো ব্যাপার হয় কী করে? প্রাণটা যেন গুতুলের মতো বেরিয়ে গেল। তাই বলছিলুম, ওসব কর্মফল টল সব বাজে কথা, পাপপুণ্যির ব্যাপার-ট্যাপারগুলোতেও গোলমাল আছে, আর ভগবান বলেও কিছু তো ঠাহর হচ্ছে না। কী বলেন?
মহিম একটু হেসে বলল, তা ওরকম হিসেব করলে তাই দাঁড়ায় বটে। কিন্তু তুই কি শেষে বুড়ো বয়সে নাস্তিক হলি?
আস্তিকই বা কবে ছিলুম বলুন! সাধনভজন তো আর করিনি কিছু। ওই বাড়িতে ষষ্ঠী বা বারের পুজো হলে বউ নড়া ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে গড় করায়। তা সেও বলে, তুমি হলে পাষণ্ড, মুষল। পচেগলে মরবে। ঠাকুর-দেবতায় যার অত অচ্ছেদ্দা তার রাক্ষসের ঔরসে জন্ম।
এসব বলে?
খুব বলে। জিবে তার ভীষণ ধার। তবে মিছে কথাও তো বলছে না। বিচার করে দেখেছি, ঠাকুর দেবতা মানামানির ইচ্ছেটাই হয়নি কখনও আমার। ভাবি যা সব অকাজকুকাজ করেছি তার জন্য নাকিকান্না কেঁদে লাভ নেই। ভগবান বলে যদি কেউ থেকেও থাকেন তিনি নাকিকান্নায় ভোলার লোক নন।
অনেক এগিয়ে বুঝেছিস রে ধীরেন।
না দাদা, বুঝেছি বলা যায় না। বুঝতে হলে পেটে বিদ্যে চাই। তা সে বস্তু তো আর নেই। আমার বুঝ হল চাষাভুষোর মতো।
দুর বোকা! চাষাভুষোরা নাস্তিক হয়, দেখেছিস? ভয়ভীতি নিয়ে যাদের বেঁচে থাকতে হয় তাদের মধ্যে নাস্তিক খুঁজে পাওয়া ভার। যে যেমন জীবন যাপন করে তার ভগবানের বোধ তেমনতর। এই তো শুনলাম, সেদিন কে যেন বলছিল, কোরিয়া না কোথায় যেন লোকে ভগবানের ভাবটাই লোপাট করে দিয়েছে। মঠ মসজিদ গির্জার বালাই নেই, থাকলেও সেখানে কেউ তেমন যায় না। তারা খাটেপেটে, দেশ গড়ে, ভাল-মন্দ নিয়ে বেঁচে থাকে, খামোখা ভগবান আমদানি করে জীবনে জটিলতা বাড়ায় না, ও তাদের দরকারও হয় না। ভগবান ছাড়াই যখন চলে যাচ্ছে তখন খামোখা ডাকবে কেন বল!
আমারও তো সেই কথা। ডেকে হবেটা কী? আমার উদ্ধার নেই তা আমি জানি। মিদ্দারের পো এখনও আড়ে আড়ে ঘুরে বেড়ায়, ঘাড় মটকায় না বটে, কিন্তু ভুলতেও দেয় না।
ভগবান মানিস না, ভাল কথা। তবে ভূতই বা মানবি কেন রে?
ভূতের কথা বললুম নাকি? না দাদা, সে ভূত নয়।
তবে কী? এই যে বললি মিদ্দারের পো আড়ে আড়ে ঘুরে বেড়ায়।
তা ঘোরে। তবে সে ভূত নয়। মানুষ মরলেও তার ব্যথা বেদনা জ্বালা কি আর সহজে মরে! সেগুলোই যেন ঘুরে ঘুরে খুঁজে বেড়ায়।
তোর মাথা। কবে কী একটা ঘটনা ঘটেছিল তাই নিয়ে ঘষটে মরছিস। মানুষ কত কী ভুলে থাকে।
নিষ্কর্মারা ভুলতে পারে না। কাজকর্ম নিয়ে মেতে থাকলে হয়তো হত। ভেবে দেখতে গেলে মিদ্দারের পো কিন্তু খারাপ মরেনি। হেঁপো রুগি, শরীরে তো কিছু ছিল না। শুধু রোখের বশে বউটাকে তারের ফাঁস দিয়ে মেরেছিল। ওই রোখের জোরেই আমাকেও পেড়ে ফেলেছিল প্রায়। আমি তখন সা জোয়ান। শেষরক্ষা হয়নি অবশ্য। জলে চেপে ধরেছিলাম, মিনিটখানেক ভুড়ভুড়ি কেটে মরে গেল। এই দেখুন, এখনও রোঁয়া দাঁড়িয়ে যায় ভাবলে।
তোর শ্রীমন্তকে মনে আছে?
তা থাকবে না? দিনেদুপুরে পাঁচকড়িকে রামদা দিয়ে কাটল বটতলায়, এক হাট লোকের সামনে। সে কী হুড়োহুড়ি করে লোকে পালিয়েছিল বাপ।
তুই তো একটা দেখিছিস। শ্ৰীমন্ত কত খুন করেছিল তার হিসেব নিজেও রাখত না। বুড়ো হয়ে যখন বয়সের কাছে জব্দ হল তখন মাঝে মাঝে খাল পেরিয়ে ওর ঘরে গিয়ে বসতাম। খুব খাতির করত। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতাম, খুন করতে কেমন লাগে? কী বলত জানিস?
কী বলত?
বলত, কেমন যেন একটা ঝাঁকুনি লাগে। কেমনতরো ঝাঁকুনি, কীসের ঝাঁকুনি তা অত ব্যাখ্যা করে বলতে পারত না। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, খুনের পর অনুতাপ হয় কিনা। কেমন ভ্যাবলার মতো চেয়ে থাকত। অনেক ভেবেচিন্তে বলত, না, তবে পরে কেমন কঁকা ফাঁকা লাগে। মায়াদয়া তো ছিল না। বুকখানা পাথর হয়ে গিয়েছিল। ওই যে ফাঁকা ফাঁকা লাগত ওইটেই ওর অনুতাপ বলে ধরে নিতে হবে। তা অত খুন করেও তো বুড়ো বয়স অবধি বেশ বেঁচেবর্তেই ছিল। ডাকাতির পয়সা দিয়ে পাকা বাড়ি, ধানী জমি সবই করেছিল। কিছু তো আটকায়নি। তুই তবে দগ্ধে মরছিস কেন? ওটা মোটে খুনই নয়। প্রাণ বাঁচাতে যা করিছিস তাতে আইনেও তো আটকায় না।
আইনে তো অনেক কথাই আছে দাদা। তা দিয়ে কি আর মনের আগুন নেভে? আজকাল কেবল ভাবি, বরং নিজে মরলেই ভাল হত। এই এতদিন বেঁচে থেকে দুনিয়ার কী উপকারটা করলুম বলুন। আর বেঁচে থাকাটাও কি মানুষের মতো হচ্ছে? গোরুছাগলের অধিক নিজেকে ভাবতেই পারি না। বড় গ্লানি হয়।
তা আর কী করবি! লাখো লাখো লোক তো ওরকমভাবেই বেঁচে আছে। কটা লোক আর মানুষের মতো বেঁচে আছে বল।
ওই জন্যই তো ভগবানে বিশ্বাস হতে চায় না। ভগবান বলে কিছু থাকলে কি এরকম ধারা হতে পারত, বলুন?
আজ তোকে ফিলজফিতে পেয়েছে দেখছি। কফি খাবি?
এক গাল হাসল ধীরেন কাষ্ঠ। খুশিয়াল গলায় বলল, এই একটা জব্বর কথা বলেছেন। জিনিসখানাও একেবারে মনের মতো। আগেও দু-চারবার খেয়েছি বটে, কেমন পোড়া-পোড়া গন্ধ লাগত। আপনার এখানে খেয়েই প্রথম বুঝলাম, এর সঙ্গে কেউ লাগে না।
আমারও বুড়ো বয়সের নেশা। এই শীতে শরীরটা বেশ গরম হয়।
মহিম কফি করে নিয়ে এল।
বিস্কুট খাবি সঙ্গে? দাঁড়া, দিই।
তা বিস্কুটও হল। দিব্যি মুড়মুড়ে ফুরফুরে দুখানা বিস্কুট।
এই বিস্কুটও নাতনি কলকাতা থেকে এনে দিয়েছে। ওতে নাকি চিজ আছে। তা সে বস্তু বিশেষ চেখে দেখা হয়নি। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছি।
চিজের কথা খুব জানি। শুনেছি, দুধ পচিয়ে নাকি হয়। আজকাল বাঙালিরাও খুব খাচ্ছে। বাসস্ট্যান্ডের মহেশ বলছিল দোকানে নাকি পিজ্জা বানাবে। তাতে মেলা চিজ দিতে হয়।
গাঁ তো শহর হয়ে উঠল রে।
তা তো হওয়ারই কথা।
পিজ্জা খাবি নাকি? সোহাগ বলে গেছে আসছে শনিবার সব নিয়ে এসে এখানে বানিয়ে আমাকে খাওয়াবে। রোববার চলে আসিস এক ফাঁকে। তোর জন্য খানিকটা রেখে দেবোখন। নতুন খাবার, সহ্য হবে কিনা জানি না। চেখে দেখিস একটু।
আমার তো সবই ভাল লাগে। আমার বউ বলে, তোমার জিব হল লম্পট।
তা তোর একটু নোলা আছে বটে। এই সেদিন দেখলাম, হরিপদর মেয়ের বিয়েতে চারখানা রাধাবল্লভি বসান দিলি, তারপর এক কাড়ি পোলোয়া, খাসির মাংস, সাত টুকরো মাছ, দই-মিষ্টি, ওরে বাবা, এই বয়সে অত খেতে আছে গবগব করে? এখন একটু বেছে গুছে বুঝে খাবি তো!
তাই বলে বটে সবাই। কিন্তু আমার তো সবই তল হয়ে যায়। খেয়েই যদি মরি তাহলেই বা কী বলুন। স্ট্রোক হয়ে মরলেও যা পেট ফেটে মরলেও তাই। চৌকাঠ ডিঙোনো নিয়ে কথা, তা খেয়েই মরা ভাল।
মরার জন্য বড় ব্যস্ত দেখছি যে আজকাল। বলি তোর হলটা কী? এতকাল তো এসব বলতিস না।
আজকাল মরা নিয়ে একটু ভাবছি। মরতে যে ইচ্ছে যায় তা নয়। কত কী দেখার রয়ে গেল, বোঝার রয়ে গেল, আয়ুর অর্থটাই ঠাহর হল না, মনে একটা খিচ তো আছেই। তবে লজ্জার মাথা খেয়ে আর কতকালই বা বাঁচব বলুন। এই তো সেদিন ছোট নাতিটাও বলছিল, ও দাদু, বিশুর দাদু মরে গেল তো, তুমি মরছ না কেন?
বলল?
তা বলবে নাই বা কেন। ঠাকুমার কাছে শুনে শুনেই শিখেছে।
নাতি বলল বলেই মরার কথা ভাবছিস?
না দাদা, তা নয়। ওই ভাবছি আর কী। কত কী ভাবি।
তোর চেয়ে আমিই তো বোধহয় বছর তিনেকের বড়।
তা হবে।
কফি শেষ করে উঠে পড়ল ধীরেন কাষ্ঠ। ফেরার সময় টের পেল, রাত হয়েছে। আন্দাজ নটা সোয়া নটা হবে। একে গাঁ, তায় শীতকাল। সন্ধ্যারাতেই ভারী নিঃঝুম হয়ে যায় চারদিক। রাস্তায় ভুতুড়ে কুয়াশা আর নির্জনতা। তবু বাসস্ট্যান্ডের দিকটায় এখনও লোকজন দেখা যায়, দোকানপাটও খোলা থাকে। কিন্তু গাঁয়ের ভিতরটা বড্ড সুনসান।
একটা ভাল চোখ আর একটা আবছা চোখে ঝুঝকো অন্ধকারে কুয়াশামাখা এক অলৌকিককে প্রত্যক্ষ করে ধীরেন। দিনের বেলাটা যেমন দগদগে বাস্তবতা এখন সেটাই যেন সাঁঝের পর সেজেগুজে মোহিনীবেশে চোখ ভোলাতে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। কুয়াশায় একটা বাড়ির ছাদটুকু শুধু ভেসে আছে, বাকিটা লোপাট, মনে হচ্ছে যেন, ভেসে থাকা বাড়ি। কালিপড়া লণ্ঠনের মতো ভাঙা একটু চাঁদ আছে আকাশে, তাকে ঠিক ঠাহর হচ্ছে না বটে, কিন্তু এই আলোটুকুই কুহক ছড়িয়ে রেখেছে চারধারে।
ধীরেন হ-হ-হ করে আপনমনে একটু হাসল। বিড়বিড় করে বলল, খুব ম্যাজিক দেখাচ্ছ বাবা! অশৈলী কাণ্ড সব।
কথাটা ঠিক যে, আজকাল সে মরা নিয়ে ভাবছে। মরার পর আত্মা বেরিয়ে আর এক দফা বেঁচে থাকে বলে কারও কারও বিশ্বাস। যদি মরার পর ফের বেঁচে থাকাই বরাতে থাকে তাহলে সেটাই বা কেমন হবে! দেহ মরলে একরকম শান্তি। কিন্তু ফের যদি আত্মা হয়ে বেঁচে থাকতে হয় তাহলে তো আবার ভজঘট্ট পাকাল। তখন আবার কেমন সব বিলিব্যবস্থা হবে, তাও ভাববার কথা। ধীরেনের সেটা খুব পছন্দ হচ্ছে না। সর্বক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে লেগে থাকলে তো মুশকিল।
ভাবতে ভাবতে বটতলায় এসে পড়ল ধীরেন। এ ভারী অপয়া জায়গা। খুব নির্জন। বটগাছটা বোধহয় দেড়শো বছরের পুরনো। চারদিকে ঝুরি নেমেছে মেলা। তলাটা বাঁধানো, শিবের থানও আছে। কিন্তু বড় ছমছমে জায়গা। অনেকেই এখানে ভয়টয় পায়।
চারপাশটা তাকিয়ে দেখল ধীরেন। জায়গাটা যেন একেবারে জমাট বেঁধে নিথর হয়ে আছে। গাছের পাতাটাও নড়ছে না। আর কী ঝিঁঝির ডাক বাবা।
ধীরেন! বলে কেউ ডাকল নাকি? গা শিউরে উঠল হঠাৎ। হ্যাঁ, মিদ্দার ডাকে বটে। কাছাকাছি চলেও আসে। না, ভূত-টুত নয়। ধীরেন কাষ্ঠ জানে, এ হল তার নিজেরই ভিতরকার অনুতাপ। সে-ই মিদ্দার হয়ে কথা কয়। তবু গা ছমছম করে খুব।
ও ধীরেন, মনে পড়ে?
পড়বে না! খুব মনে পড়ে।
বিশ্বাসঘাতক, নিমকহারাম, কত বড় সর্বনাশ করেছিলি আমার! তবু দিব্যি বেঁচেবর্তে আছিস!
আমার দোষটা কোথায় বল। তোমার বউ যদি ওরকমধারা করে আমার কী দোষ? আমার তখন কঁচা বয়স, বুদ্ধি পাকেনি, সেও এসে হামলে পড়ল। আমার কী করা উচিত ছিল বলো!
সাধু সাজছিস হারামজাদা!
তোমাকেও বলি দাদা, ওই জরাজীর্ণ শরীর, হেঁপো রুগি হয়ে অমন ডবকা মেয়েছেলেকে বিয়ে করা তোমার ঠিক হয়নি। মেয়েমানুষ তো আর ঝাপির সাপ নয় যে বন্ধ করে রাখবে।
আমি তোর গুরুর সমান। আমার বউ তোর মায়ের মতো। ঠিক কিনা!
ওসব সেকেলে সম্পর্কের কথা ছাড়ো। ওসব কি আর কেউ মানে! আর গুরু বললেই তো হবে না। হাতের কাজ শিখতে তোমার কাছে ঘুরঘুর করতুম। চাকরের অধিক খাটিয়ে মারতে, মনে আছে?
তোর যদি লজ্জা থাকত তাহলে গলায় দড়ি দিতি।
মরতে বলছ! তা বেঁচেই বা আছি কোথায়? গলায় ফাঁস দিলে তো অনেক জ্বালা জুড়িয়ে যেত গো! বেঁচে থাকার মানে কী বলো তোশুধু দেহখানার বেঁচে থাকাটাই কি সব? বেঁচে থাকার মানে হল উপভোগ। দিনরাত কেঁদে ককিয়ে, উঞ্ছবৃত্তি করে, লাথিটা খেয়ে এই যে থাকা, এ বেঁচে থাকা হয় কী করে? মরেই আছি বলে ধরে নাও না কেন!
বিড়বিড় করতে করতে জায়গাটা পেরিয়ে এল ধীরেন। সামনে পান্নাদের বাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। আর একটু এগোলে গৌরদাদার বাড়ি। চেনা ছক, চেনা রাস্তা। তবু ভারী অচিন লাগে ধীরেনের। একটা স্পষ্ট চোখ, আর একটা আবছা চোখে কত বিভ্রম তৈরি হয়। পাপে জর্জরিত মন কত ভূতপ্রেত সৃষ্টি করে যায়। অনাবিল সত্য বলে তো কিছু নেই।
.
তিন দিন বাদে এক দুপুরে কাঙালি ভোজন করাচ্ছিল রসিক বাঙাল। বাসন্তীর পঞ্চামৃত আছে আজ। উপলক্ষ্য সেটাই৷ মহাবীর তেওয়ারিকে বর্ধমান থেকে ভাড়া করে এনেছে রসিক। খিচুড়ি, লাবড়ার তরকারি, বোঁদে আর পায়েস। ভোজের খবর পেয়ে লোক জুটেছে মেলাই। হিসেব করলে শ দুই তো হবেই। উঠোনের রোদে সারি সারি শালপাতার থালা নিয়ে বসে গেছে। চিল্লামিল্লি হচ্ছে খুব। এখনও পাতে খিচুড়ি পড়েনি, পড়বে পড়বে ভাব।
বারান্দায় দুখানা চেয়ারে বাঙালের পাশাপাশি ধীরেন।
রসিক বলল, ঠাইরেন আইজকাইল এই বাড়িতেই বহাল হইছে, বুঝলেননি খুড়া?
ধীরেন জানে, এ গাঁয়ে কোনও গাছের পাতা খসলেও তা রটে যেতে দেরি হয় না। নিষ্কর্মার তো অভাব নেই।
একটু হেসে ধীরেন বলল, ভালই তো। বাসন্তীর দেখাশোনা হবে।
কচু হইব। ঠাইরেনরে তো বিলাই পার করছে। আইয়া অখন খাদিমা হইয়া তো বইছে আর গজরাইতাছে।
গজরাচ্ছে কেন?
গজরাইব না! এই যে খরচাপাতি হইতাছে, অপোগণ্ডোরা আমার পয়সায় খাইয়া যাইতাছে, ঠাইরেনের তাতে গায়ে বড় জ্বালা। বোঝালেন? ঠাইরেন চায় সব পোটলা কইরা রাখতে। এই যে গরিবগুলা প্যাট ভইরা খাইব, কালা কালা শুকনা মুখগুলায় একটু ঝিলিক দেখা যাইব ঠাইরেনের বড় অপছন্দ।
খিচুড়ির গন্ধটা ছেড়েছে খুবই ভাল। বাতাস শুঁকেই ধীরেন বলে দিতে পারে খিচুড়িতে ভালরকম গাওয়া ঘি, ফুলকপি, মায় গরমমশলা অবধি পড়েছে। কাঙালিভোজনের খিচুড়িতে এত তরিবত থাকার কথা নয়। তবে বাঙালের ব্যাপারই আলাদা। সে যা করে মোক্ষম করে। গরিব বলে যারা খেতে এসেছে তারা যে সবাই একেবারে কাঙাল-ফকির তা নয়। বাদামগাছের নীচে একটু ছায়ায় ময়লা হলদে রঙের শাড়িতে ঘোমটা টেনে যে বউটা বসে আছে সে কার্তিকের বউ। বছরটাক আগেও তাদের অবস্থা খারাপ ছিল না। কার্তিক শয্যাশায়ী হল ওই স্ট্রোকে না কী যেন বলে তাইতে। অবস্থা একেবারে তরতর করে পড়তে লাগল। এখন হাঁড়ির হাল। দুটো বাচ্চা নিয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে ওই এসে বসেছে গাছতলায়। ঘোমটায় কি আর সব ঢাকা যায়? শীতল ভট্টাচার্য যেমন, তারও কি কাঙালিভোজনে আসবার কথা! বছর ত্রিশেক আগে এই শীতল ভট্টচার্যই তো নেমন্তন্ন বাড়িতে গিয়ে ছাঁদা নিয়ে কত তড়পেছে। এখন ছেলের বউরা নোড়া দিয়ে বিষদাত ভেঙেছে ভালরকম। বামনাই এখন খিদের আগুনে ঝলসে গেছে। ওই সেও এসে একটু ফঁক রেখে বসে গেছে পঙক্তিভোজনে। দেখলে কষ্টও হয়, ঘেন্নাও হয়।
ধীরেন বলল, বাঙাল, ওই বাদামতলার বউটা আর শীতল ভট্টচার্য ওদের একটু ভাল করে দিতে বলে দিও। অবস্থা বিপাকে এই দশা বইতো নয়।
নিশ্চিন্ত থাকেন খুড়া, আমার বাড়িতে কারও আধাপেটা হইবো না। ঠাইস্যা খাইব সকলে। যা আয়োজন আমারই বসে যেতে ইচ্ছে করছে।
রসিক বাঙাল দুঃখ করে বলল, আরও কিছু করার ইচ্ছা আছিল, বুঝলেন! ভাবছিলাম খাসির মাংস খাওয়ামু। কিন্তু ঠাইরেনের যা চক্ষুটাটানি তাতে আর আউগাইলাম না। বাসন্তী কইল, বেশি আয়োজন কইরো না, মায়ের অভিসম্পাত লাগব। এমনিতেই নাকি জ্বইলা পুইড়া মরতাছে।
ও মানুষ এরকম ছিল না হে বাঙাল। বড় রসের মানুষ ছিল। একসময়ে ওবাড়িতে কত গুলতানি করেছি। বাসন্তীর বাবা ছিল বৈঠকী মানুষ, দরাজ দিল। বউঠানও ছিল ভারী মিঠে স্বভাবের। পয়সার অভাবই মানুষকে বড্ড শুষে নেয়, বুঝেছ?
মানতে পারলাম না খুড়া। লোকে কয় বটে অভাবে স্বভাব নষ্ট, কিন্তু আমি কই নষ্টের বীজ ভিতরে না থাকলে অভাব তারে টলাইতে পারে না।
খিচুড়ির কড়াই চলে এল। একটা জয়ধ্বনির মতো কোলাহল উঠল চারধারে। খিদের মুখে খাবারের চেয়ে মোক্ষম জিনিস আর কীই বা হতে পারে? পাতে ঘপাত ঘপাত খিচুড়ি পড়ছে, খিচুড়ির পাশেই বড় হাতায় এক খাবলা লাবড়া। দেওয়ার হাতটা লক্ষ করল ধীরেন। নাঃ, বড় মাপেই দিচ্ছে। বাচ্চাগুলো কি খেতে পারবে অত? নষ্ট হবে পাতে।
মোহময় গন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে। মহাবীরের রান্না এ-তল্লাটে বিখ্যাত। পাঁচ-সাতশো টাকার নীচে কাজ করে না। লাবড়ার গন্ধটাও এবার পাচ্ছে ধীরেন। মনে হচ্ছে ডালের বড়ি আর ধনেপাতাও দেওয়া হয়েছে।
লাবড়ায় বড়ি পড়েছে নাকি হে বাঙাল?
তবে? বড়ি না দিলে জমবো কেমনে?
.
৬৭.
হুট বলতেই রাজ্যের ইষ্টিগুষ্টি খাওয়ানোর ধুম পড়ে যায়, কী কাণ্ড বাবা! শুনেছিস কখনও পঞ্চামৃত না কোন গুষ্টির পিণ্ডি বলেও আবার কাণ্ড আছে! যত বাঙাল দেশের নিয়মকানুন বাবা, সাতজন্মে শুনিনি। তা সে না হয় হল। কিন্তু এই রাজ্যের বউ ঝি, ভিখিরি কাঙালিদের গাভেপিণ্ডে গেলানোর মতো কী মচ্ছব পড়ল বল তো!
হিমি পালানোর ফাঁক পাচ্ছে না। বাইরে কত কী হয়ে যাচ্ছে। উলু শোনা যাচ্ছে, শাঁখ বাজছে, আরও সব কী কী হয়ে যাচ্ছে, কে জানে। সে অত শত না জেনে একটা পিড়ি খুঁজতে এ-ঘরে ঢুকে পড়েছিল। কদিন হল ছেলে আর বউদের তাড়া খেয়ে বুড়িটা এবাড়িতে এসে জুটেছে। উত্তরের দালানে মরণের পড়ার ঘরের পাশে এই একটেরে ঘরখানায় রাজ্যের জিনিসপত্র ঠাসা থাকে। হেন জিনিষ নেই পাবে না। কোদাল, কুড়ুল, দা, দড়িদড়া, উঁই করা মাদুরি, পিড়ি, তক্তা থেকে যা চাও। ছুঁচো, ইঁদুর, আরশোলা আর মাকড়সার আঁতুড়ঘর। এ-ঘরেই মরণদের দুটো বেড়াল বছর বছর বাচ্চা বিয়োয়। এই গুদোমের মধ্যেই কবেকার একটা তক্তপোশ পড়ে ছিল। সেটাই এখন বুড়ির ঠেক। পিড়ি খুঁজতে এসে ঘরে ঢুকতেই বুড়ি খপ করে ধরে বসিয়েছে। আর ছাড়া পাচ্ছে না হিমি। সে বলল, তা কেন দিদিমা, পঞ্চামৃত এদেশেও হয়। এই তো সুবলদের বাড়িতেও হল সেদিন, ওর কাকীমার পঞ্চামৃত। এত ঘটা হয়নি অবশ্য।
ওরে সেই কথাই তো বলছি। কত টাকা গচ্চা গেল জানিস? বলি নতুন তো মা হচ্ছে না। আরও তিনবার তো বিইয়েছে। নতুন পোয়াতি হলেও না হয় কথা ছিল।
এখন ছাড়ো তো দিদিমা, মনা জেঠিমা কাজে পাঠিয়েছে।
আহা, বোস না একটু। কাজের বাড়ি সে না হয় বুঝলুম, কিন্তু সকাল থেকে একটা কাজেও ডেকেছে কেউ আমায়? আমার পেটের শব্দুরটা অবধি নয়। এত আস্পদ্দা কি ভাল বল? এই জন্যই মেয়ে জামাইয়ের কাছে থাকতে নেই।
তাহলে কি ও বাড়ি যাবে?
কী বলব ভাই, এ বাড়িতে আজ মচ্ছব, তা ভাই দুটোকেও তো একটু ডাকতে পারত! বড্ড গুমোর হয়েছে মেয়েটার। জামাইয়ের কথা বলছি না, সে হল মগ দেশের লোক। ওরা অদ্রতা-ভদ্রতা জানে না, শেখেওনি। বনজঙ্গলের লোক তো, জাতজন্মেরও ঠিক নেই। কিন্তু মেয়েটা তো মানুষের মতো হবে। জামাইয়ের পাল্লায় পড়ে সেও এমন গোল্লায় যাবে কে জানত বল!
কেন দিদিমা, বাঙাল মেসো তো খুব ভাল। সবাই বলে অমন দরাজ বুকের লোক হয় না। কত লোককে খাওয়ায়, আপদেবিপদে দেখে।
ওটা তো ভড়ং। লোককে ভুলিয়ে ভালিয়ে মন্তর করে ফেলে, তারপর রক্ত শুষে খায়। তা এত লোকের জন্য করে, নিজের শালা দুটোর জন্য করেছে কিছু আজ অবধি? দুটো জোয়ান ছেলে হাত পা গুটিয়ে বসে আছে, ঘরে হাঁড়ির হাল, আর এ বাড়িতে নিত্যি ভূতভুজ্যি হচ্ছে। এত অবিচার কি ভগবান সইবে রে?
ও দিদিমা, বলাই মামাকে তো কালও দেখলুম কাটাপুকুরের ধারে মাতাল হয়ে পড়ে আছে সকালবেলা।
তা কী করবে বল! মনের দুঃখেই খায়। ছেলে তো খারাপ ছিল না। অভাবে স্বভাব নষ্ট।
তোমাকে নাকি তাড়িয়ে দিয়েছে?
বউ দুটো তো দুটো ডাইনি। ছেলেদের দুষলে তো হবে না। তারা সাতেপাঁচে থাকে না। খোঁড়ে তো ওই দুটো পাজি মাগী। কোন আঘাটা থেকে ধরে এনেছে কে জানে বাবা। মুখ নয় তো আস্তাকুঁড়।
এখন আমি যাই দিদিমা? দেরি হলে জেঠিমা বকবে। পিড়ি দিয়ে যেন কী কাজ আছে।
আর একটু বসে যা। কী হালে রেখেছে আমাকে দেখছিস তো। এই ঘরে মানুষ থাকতে পারে বল দেখি! আমাকে ওদের ঘরদোরে অবধি ঢুকতে দেয় না। কেন রে বাপু, আমি কি সোনা-দানা চুরি করব? বাড়ির ঝি মুক্তা অবধি কী মুখনাড়া দেয় না শুনলে বিশ্বাস করবি না। পাঁচজনকে যদি ডেকে বলি তাহলে ওদের মুখে থুথু দেবে না লোকে?
হিমি করুণ গলায় বলল, এসব কথা আমায় বলছ কেন দিদিমা? আমি কি এত সব জানি? তুমি বাড়ি ফিরে যাও না কেন?
তাই যাবো বাছা। ভাঙা ঘরদোর হোক, সংসারে অশান্তি থাক, তবু সে আমার জোরের জায়গা। এখানে অপমানের ভাত কে খায় বল!
তাই যাও না কেন? এবার আমার হাতটা ছাড়ো, বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আ মোলো, অত ছটফট করছিস কেন? বলি, যা বুঝলি তা পাঁচজনকে গিয়ে বলিস। সবাই এসে আমার হেনেস্তাটা দেখে যাক। বেড়ালের মুতের গন্ধে নাক জ্বলে যায়। তার ওপর পোকামাকড়। কী জ্বালায় যে জ্বলছি।
বলবখন সবাইকে। বলে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল হিমি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
বুড়িটাকে তার মোটে ভাল লোক বলে মনে হয় না। মরণের সুন্দর দাদাটা যখন ছিল তখন হিমিকে ওই বুড়িই তুতিয়ে-পাতিয়ে ওর ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিল একদিন দুপুরবেলা। বলেছিল, যা না, ওরা শহুরে ছেলে, ওদের কাছে বসলেও কত শিক্ষে হয়।
তা হিমিরও একটু দুর্বলতা ছিল। সুমন একে দেখতে সুন্দর, তার ওপর কী ভাল যে গান গায়। বুড়িটা রোজই তাকে উসকে দিত। গুরুজন মানুষ, খারাপ কথা তো আর বলবে না, এই বিশ্বাসে গিয়েছিল হিমি। বাড়িতে কেউ ছিল না সেদিন। সুমন খারাপ ছেলে হলে সেদিন তার সর্বনাশ হয়ে যেতে পারত। হয়নি। সুমন তাকে মোটেই পছন্দ করেনি তা ওর চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছিল হিমি।
কিন্তু পরে বুড়ি তাকে অনেক জেরা করেছিল। ভারী অসভ্য সব ইঙ্গিত, হ্যাঁ রে, ও ঘরে যে গেলি, গায়ে হাত-টাত দেয়নি তো।
না তো দিদিমা! ওসব আবার কী কথা!
আহা, ওই বলছিলাম আর কী। কাঁচা বয়সের ছেলে তো!
তুমিই তো পাঠালে!
আহা, আমি তো ভাল ভেবেই তোকে যেতে বললাম। তা বলে কি আর নজর রাখিনি! বলি, কী বলল-টলল? রসের কথাটথা কিছু বলেনি?
তুমি যেন কী দিদিমা! সুমনদা তো এমনি গল্প-টল্প করল।
আহা, ওর মধ্যেই কথা চাপা কথা থাকে। তা বিছানায় বসলি নাকি?
না, চেয়ারে।
মাথাটাথা টিপে দিতে বলেনি?
খুব রাগ হয়েছিল হিমির। বলেছিল, বললেই টিপব নাকি?
আহা, তাতে তো আর দোষের কিছু নেই। আবার যাস না হয় ফাঁক বুঝে।
কেন যেতে বলছ?
ওরে, তোর হিল্লের জন্যই বলছি।
পরদিন তাকে ডেকে বাসন্তীমাসি সব জিজ্ঞেস করেছিল। বলেছিল, খবর্দার মায়ের সঙ্গে কথা কইবি না। দেখলে অন্য দিকে চলে যাবি। মা যে কী সর্বনাশা মানুষ তা আমি জানি।
মেয়েরা কি সর্বনাশ চায় না? সর্বনাশকে ভয় পায়? মেয়েমানুষের যে সর্বনাশটা নিয়ে সমাজে এত চিন্তা-ভাবনা, এত সাবধানী হওয়া, এত শাসন আর আঁটবাঁধ তা কি লুকিয়ে রাখা আচারের শিশির মতোই লোভ দেখায় না মাঝে মাঝে? ভেসে যেতে ইচ্ছে করে না? হিমির মতো বয়সে পারে কি একটা মেয়ে নিজেকে অত সামলে-সুমলে রাখতে? শরীরেরও কত খবর সে জানে না। জানে না এখনও চুম্বনের সুস্বাদ, এখনও নিবিড়ভাবে পায়নি পুরুষের স্বেদগন্ধ। তাই ওই অত নিষেধ, অত ভয় সত্ত্বেও সে মাঝে মাঝে সুযোগ বুঝে সুমনের ঘরে গেছে।
গিয়ে দেখেছে, ছেলেটা হয় মোটা-সোটা বই পড়ে, নয় তো ঘুমোয়।
তবে হিমিকে একেবারে তাচ্ছিল্যও করেনি। বসে হেসে কথা বলেছে, চোখে চোখ রেখেছে। কিছু চোখের কথাও হয়েছে তাদের। প্রেম ব্যাপারটা হিমি এই চোদ্দো পনেরো বছর বয়সে ততটা বোঝে না। সে জানে, সব প্রেমেরই পরিণতি হয় বিয়ে, না হয় ছাড়াছাড়ি।
সুমন কেবল বন্ধুদের কথা বলত। ছেলের সঙ্গে মেয়ের বন্ধু-বন্ধু সম্পর্ক হয় বটে, কিন্তু শেষ অবধি বন্ধুত্বই তো ঝুল খেয়ে সেই প্রেমের কোলে গিয়েই পড়ে। আর প্রেম ঢলে পড়ে বিয়ের গায়ে। তাই না?
জিজিবুড়ি নজর রাখত ঠিকই। ধরল একদিন জামতলায়।
ওলো ও হিমি, বলি খবর-টবর কী রে?
কীসের খবর চাও?
বলি, কতদূর এগোলি?
কী বলছ বুঝতে পারছি না।
কচি খুকিটি তো নোস বাছা, সবই তো জানিস। বলি কী, বেশি সতীপনা থাকলে কিন্তু ফসকাবি।
তার মানে কী গো দিদিমা?
পুরুষমানুষকে একটু আসকারাও দিতে হয়। একটু হাত-টাত ধরলে, কি কাছে ঘেঁষলে চেঁচাসনি যেন বোকার মতো। ওতে তো আর মহাভারত অশুদ্ধ হচ্ছে না রে বাপু। ওভাবেই খেলিয়ে তুলতে হয়।
যাঃ, কী যে সব অসভ্য কথা বলো দিদিমা।
খারাপ কিছু বলিনি, তলিয়ে ভাবলে বুঝবি। তোর বাপের যা অবস্থা মেয়ে পার করতে কোমর বেঁকে যাবে। তিন তিনটে বোন তোর, সেদিকটাও তো ভাববি। নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নে না কেন। মাখামাখি যদি করতে চায় তো ভালই তো। গেঁথে তুলতে সুবিধেই হবে। শহুরে ছেলে ওরা, খুব চালাক। পিছলে যাতে না যায় তার ব্যবস্থা করে রাখবি। বুদ্ধি খাটিয়ে চললে দেখিস, কাজ ফর্সা।
দিদিমা যে ভাল লোক নয় তা সবাই জানে, হিমিও জানে। আর কথাগুলোর মধ্যে ভারী অসভ্য ইঙ্গিত। তবু কিন্তু শরীরে একটু শিহরণ দিয়েছিল তার।
খুব ভালমানুষের মতো বুড়ি বলেছিল, তুই তো হাঁদা, তাই বলি, অত গা বাঁচিয়ে চললে কাজ হবে না। কাছ ঘেঁষে বসবি। মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে দিবি, ওই সব যা করে আর কী। একটু হাতটা ধরলে ঝটকা মেরে সরে আসিস না যেন।
ইস, তুমি ভারী অসভ্য দিদিমা। বলে পালিয়ে এসেছিল হিমি।
কী করলে কী হয় তা কি অত জানে নাকি হিমি?
তবে সে তার সাধ্যমতো, যতদূর সাহসে কুলোয়, লজ্জার মাথা খেয়ে করেনি যে তা নয়।
একদিন দুপুরে নির্জন ঘরে সে বলেছিল, আপনার মাথা টিপে দেব?
খুব অবাক হয়ে সুমন বলল, কেন? আমার তো মাথা ব্যথা করছে না!
হিমি জব্দ হয়ে বসে রইল।
সুমন একটু হেসেছিল। সেটা যে করুণার হাসি তাও বুঝেছিল বোকা হিমি।
একদিন সুমন তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি পান্নাকে চেনো?
পান্না! রামহরি জ্যাঠার মেয়ে?
হ্যাঁ।
আপনি তাকে চেনেন?
না। তবে চিনতে চাই। তুমি চেনো?
চিনব না কেন? পান্নাদির কাছে আমি গান শিখতাম।
এখন শেখো না?
না। আমার গলা সাধতে ভাল লাগে না।
গান খুব ভাল জিনিস। শিখলে পারতে।
আমার গলা একটু চড়া।
তাতে কী? সাধতে সাধতে সুর এসে যায়।
পান্নাদির কথা জিজ্ঞেস করলেন কেন?
মেয়েটা বেশ গায়।
হ্যাঁ, দেখতেও সুন্দর। পান্নাদিকে আপনার কথা বলব?
না না, আমার কথা বলতে হবে না।
বোকা হিমি কী করে যেন বুঝতে পেরেছিল, সুমন পান্নার প্রেমে পড়েছে। বুঝতে পেরে তার ভারী হিংসে হল পান্নার ওপর। হওয়ারই কথা। পান্নারা একে বড়লোক, তার ওপর সুন্দরী, তার ওপর গান জানে, তারও ওপর ওরা একটু অন্য জগতের মানুষ। অনেকটা পরি-টরির মতো। সবাই ওদের সঙ্গেই ভাব করতে চায়, প্রেম করতে চায়, বিয়ে করতে চায়। যদি তাই হয়, তাহলে পৃথিবীতে হিমিদের কী হবে? সুমন পান্নার সঙ্গে ভাব করার জন্য বসে আছে। আর হিমি যে রোজ তার সঙ্গে ভাব করতে আসে সেটা বুঝি কিছুই নয়?
চোখ ফেটে জল আসতে চাইছিল হিমির।
বিকেলেই সে পান্নাকে গিয়ে বলল, জানো তো পান্নাদি, রসিক বাঙালের আগের পক্ষের ছেলেটা ভীষণ অসভ্য।
কেন রে, কী করেছে?
তোমার ওপর নজর আছে।
পান্না হাসল, কী করে বুঝলি?
তোমার কথা বলছিল খুব। খুব হ্যাংলা কিন্তু।
পান্না রাগ করল না। করবেই বা কেন, ওর সঙ্গে তো কত ছেলেই ভাব করতে চায়। সেটা অহংকারেরই ব্যাপার তো৷ হিমির সঙ্গে যদি রাজ্যের ছেলে ভাব করতে চাইত তাহলে কি হিমির রাগ হত? বরং বুক ফুলে উঠত অহংকারে।
পান্না বলল, শুনেছি, ছেলেটা গান গায়। তাই নাকি রে?
হ্যাঁ তো। হেমন্তের মতো গলা।
তুই কত গান বুঝিস!
না বুঝলে কী! শুনি তো। সবাই বলে।
একদিন নিয়ে আসিস তো! শুনবো!
শুনবে?
হ্যাঁ। দোষ কী?
বেশি লাই দিও না। ওরা কিন্তু বামুন নয়।
ওমা! বামুন নয় তো তাতে কী?
তোমরা তো বামুন, তাই বলছিলাম আর কী।
পান্না খুব হেসেছিল, বামুন হলে কী হত রে হিমি?
বোকা হিমি খুব লজ্জা পেয়েছিল। কিন্তু সে করবেই বা কী? ওই যে পান্না সুমনের গান শুনতে চাইল ওতেই তার ভিতরে একটা পাগলাঘণ্টি বেজে গিয়েছিল। যদি গান শুনে পান্নাও ঢলে পড়ে সুমনের দিকে!
আসলে ওই পান্না, ওই সুমন ওরা যেন মেঘের ওপরে থাকে। অত দূর নাগাল পৌঁছোয় না হিমির। হিমির মতো মেয়ের কাছে ওরা স্বপ্নের ঘোরের মতো। ওদের জগতে হিমির কোনও জায়গা নেই।
আজকাল আবছাভাবে হিমি বুঝতে পারে, ইচ্ছে মতো কিছু পেতে হলে মেয়েদের নিজস্ব কিছু গুণ থাকা দরকার। অনেক টাকা, না হয় রূপ, গানের গলা, বুদ্ধি এইসব। তার যে কিছুই নেই। তার যে বিয়ে হবে না তা নয়। কালো, মোটা বিচ্ছিরি চেহারার একজন মিস্ত্রি-টিস্ত্রি গোছের বা পানওয়ালা, মাছওয়ালা, মুদি যা তোক একজন জুটবে। সে তাকে ধামসাবে, চিবিয়ে খাবে, বাচ্চা পয়দা করবে, তারপর খুব নির্বিকার হয়ে যাবে। যেমন তার নিজের বাপ মা। ওরকমই তো হয়।
হ্যাঁ রে হিমি, বললি না ছেলেটা বামুন হলে কী হত!
হিমি হেসেছিল একটু। বলল, তোমাকে সাবধান করে দিলাম আর কী। বেশি প্রশ্রয় দিও না।
আচ্ছা, তা না হয় দেব না। ছেলেটাকে বলিস তো আমার সঙ্গে একদিন দেখা করতে।
ইস্। বলবে বই কী! কেন বলবে হিমি? হিমি কি পান্নার ক্রীতদাসী না দূতী? কক্ষনও বলবে না হিমি। তোমরা দুজনে উড়ে বেড়াবে আর আমি বুড়ো আঙুল চুষব বুঝি?
পান্নাদিকে আপনার কথা বলেছিলাম।
অবাক হয়ে বলল, কী বলেছ?
আপনি যে ভাব করতে চাইলেন।
এ মাঃ, তোমাকে বারণ করলাম যে! ইস, প্রেস্টিজ তো একদম ঢিলে করে দিলে দেখছি।
আহা, দোষের তো কিছু নয়।
দুর! তুমি খুব বোকা মেয়ে। কী বলেছ শুনি।
এই আপনি দেখতে খুব সুন্দর, খুব ভাল গান করেন।
কেন বলতে গেলে?
ভাবলাম পান্নাদি হয়তো ভাব করতে চাইবে।
কী বলল শুনে?
পাত্তাই দিল না।
তুমি আর এরকম কোরো না।
খুব অন্যায় হয়েছে?
তা হয়েছে। কথা চালাচালি হলে খুব মুশকিল হয়। এখানে সবাই খুব অন্যের ব্যাপারে নাক গলায়
পান্নাদিরা কিন্তু বামুন। চাটুজ্জে।
জানি ত! বামুন কায়েতের কথাও তুলল নাকি?
না, আমিই বলছি।
ও, তাই বলো। বামুন কায়েতের কথা মনে হল কেন তোমার?
বাঃ, মনে হবে না?
কেন হবে?
তাই তো! কেন হবে? হিমি যে সবসময়ে ছেলেতে মেয়েতে বিয়ের কথাই ভাবে ওরা হয়তো সেরকম ভাবে না। এরা তো মেঘলোকের মানুষ, হিমির মতো তো নয়। হিমির একটাই সুবিধে, সে সুমনদের স্বজাত। তারাও বৈশ্য। কিন্তু তাতে যে খুব একটা সুবিধে করা যায় না তাও সে বোঝে।
সুমনের কাছাকাছি আর এক কদমও এগোতে পারেনি হিমি। শুধু চলে যাওয়ার দুদিন আগে তাকে ডাকিয়ে এনে সুমন খুব নরম গলায় বলেছিল, তুমি রেশ ভাল মেয়ে। ভাল করে লেখাপড়া করো, গান শেখো। নিজেকে ছোটো করে রাখতে নেই। আমি আবার যখন আসব তখন যেন তোমাকে অন্যরকম দেখি।
এটা প্রেমের কথা কিনা তা অনেক ভেবেও পরিষ্কার হয়নি হিমির কাছে। সুমন কি বলতে চাইছিল যে, এরকম হিমিকে নয়, হিমি যদি আরও একটু তার মনের মতো হয় তাহলে সে হিমিকে ভালবাসতেও পারে? তাই বলতে চেয়েছিল সুমন?
তার পর থেকে হিমি একটু অন্যরকম হিমি হওয়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছে। হারমোনিয়াম নিয়ে ভোরবেলা বসে গলা সাধে। পান্নার কাছে গান শিখতে যায়। পড়াশুনোয় খুব মন দিয়েছে সে, যদিও ফল ফলতে শুরু করেনি। মুখে দই মাখলে নাকি ভাল, তাই সে আজকাল মুখে মাঝে মাঝে টক দই মাখে। তাদের ব্যায়ামের দিদিমনি তাদের মাঝে মাঝে বলে, ফিটনেসই হচ্ছে আসল সৌন্দর্য। যারা কসমেটিক মেখে সুন্দর হতে চায় তারা বোকা। ভাল, ছিপছিপে শরীর, সতেজ চামড়া, চলায় ফেরায় ছমছমে ভাব, চটপটে হাত পা, ভাল দাঁত, ভাল চুল এসবই হল আসল সৌন্দর্য। আর সঙ্গে চাই ব্যক্তিত্ব।
অত শক্ত শক্ত কথা তার মাথায় থাকে না। তবে সে আজকাল স্কিপিং করে, নাচের ক্লাসে যায়। এসব করে সে খানিকটা খানিকটা এগিয়েছে কিনা তা অবশ্য বুঝতে পারে না।
একদিন সে ব্যায়ামের দিদিমনিকে জিজ্ঞেস করল, ব্যক্তিত্বটা কী জিনিস দিদিমনি?
নিজের মতামতকে শ্রদ্ধা করাই হল ব্যক্তিত্ব। অন্যের কথায় বা পরামর্শে ঢলে পড়তে নেই। সব সময়ে হাঃ হাঃ হিঃ হিঃ করতে নেই, বিপদে পড়লে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। এইসব আর কী।
নিজের মতো করে হিমি এসবও যে প্র্যাকটিস করছে না তা নয়। কিন্তু কতটা কী ফল হচ্ছে তা বুঝতে পারছে না। এখনও কেউ মুগ্ধ চোখে তাকায়নি তার দিকে। কেউ বাহবা দিয়ে বলেনি, বাঃ রে, তোকে তো বেশ দেখাচ্ছে! সে যে একটু হলেও বদলে গেছে সেটাও কেউ লক্ষ করেনি আজও।
বাহবা না পেলে সেই কাজটা করে যেতে উৎসাহ থাকে কারও?
এখন সে সুমনের অপেক্ষায় আছে। যার জন্য এত করা সে যদি একটু নরম চোখে তাকে খুঁটিয়ে দেখে একটুখানিও খুশি হয় তাহলেই ঢের।
কিন্তু সে যে কবে আসবে, কখনও আসবে কিনা তা জানবে কী করে হিমি? কাউকে জিজ্ঞেস করতে তার ভয় হয়, বুক ঢিবঢিব করে। লজ্জার মাথা খেয়ে মরণকে জিজ্ঞেস করলে মরণ শুধু বলে, আমার দাদার কত কাজ! কী করে আসবে?
.
৬৮.
দুঃখী দীননাথ বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে গলায় দড়ি দেবে বলে ভরসন্ধেবেলা মাধবপুরের জঙ্গলে এসে একটা বেশ মজবুত গাছে উঠে বসে আছে। যে দড়িটা গলায় দেবে সেটা সদ্য গোরুর গলা থেকে খুলে আনা, গোরু-গোরু গন্ধ ছাড়ছে। দড়িটা কোমরে পেঁচানো। দীননাথের গায়ে একটা ময়লা গেঞ্জি, কাঁধে গামছা। পরনে ময়লা ধুতি। গাছের ডালে বসে দীননাথ এখন বিড়ি খাচ্ছে। ঝুলে পড়ার আগে এই যে একটু সময় আরাম করে কাটাচ্ছে সে, এ সময়টা বড়ই মূল্যবান। সময় জিনিসটা যে কী ভীষণ দামি তা জীবনে এই প্রথম টের পাচ্ছে দীননাথ। চারদিক ভারি সুনসান, ধারেকাছে জনমনিষ্যি নেই, গাছের তলায় তার তাপ্পি দেওয়া পুরনো হাওয়াই চটিজোড়া পড়ে আছে। অনেক দিনের সঙ্গী, টেনে-মেনে দু-আড়াই বছর চটিজোড়া দিয়ে কাজ চালিয়েছে সে। আজ থেকে চটিজোড়ার বিশ্রাম। বেঁচে থাকতে কত কী লাগে। বড়লোকেদের বায়নাক্কা বেশি বটে, কিন্তু গরিব কাঙালদেরও বেঁচে থাকার হ্যাপা তো কম নয়। খিদেতেষ্টা, লজ্জা নিবারণ, শীত-বর্ষার আচ্ছাদন, বিড়িটা-আশটা, একটা মেয়েমানুষ বা একটু ঘরদোর, হিসেব করলে কম নয় ব্যাপারটা। আর ভেবে দেখলে এই দেহখানার জন্যই যা ঝাট। এটি না থাকলে আর কোনও ঝামেলা থাকে না। তার বউ ফুলি বড্ড গেছে মেয়েছেলে, একটা দিন শান্তিতে তিষ্ঠোতে দেয়নি তাকে। মেয়েছেলের শরীরের ক্ষ্যামতা না থাক, গলার জোরেই পুরুষ কাত। আর সেই জোরটা দীননাথের মোটেই নেই। কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে পাল্লা দেয় বটে, তারপর বাক্যে না পেরে কিলোয়। কিন্তু তাতেও লাভ হয়েছে লবডঙ্কা। কিল-চড় খেয়ে যেন ফুলির গলার জোর দুনো হয়। বাক্যে বড্ড ঝাঁঝরা হয়েছে দীনু। কতবার ভেবেছে বাক্যে তো আর শরীরে ছ্যাঁকা লাগে না, কানে না তুললেই হল। তা সে চেষ্টাও কম করেনি সে। বাক্যেরও কিছু কেরানি আছে বইকী, বাক্য দিয়ে বোধহয় মানুষও মারা যায়।
দীনু, অর্থাৎ দীননাথ বিড়িটা ফেলে আর একটা ধরাল। বেশ ধকওলা ঝাঁঝালো বিড়ি। কালিপদর দোকানের বিড়ির স্বাদই আলাদা। কালো সুতোর মুগুর ব্র্যান্ড এই বিড়ির দাম দেড়া। আজ জীবনের শেষ দিন বলে কিনেছে দীনু। পুরো এক বান্ডিল। সঙ্গে নতুন দেশলাই।
মাধবপুরের জঙ্গলে আগে বাঘ ছিল। আরও নানা জানোয়ার দেখা যেত মাঝে মাঝে। কয়েকটা হরিণও দেখেছে সে ছেলেবেলায়। এখন শেয়ালও নেই বড় একটা। জঙ্গলটাই উঠে যাবে কিছুদিন পর। পুব ধার, পশ্চিম ধার সব দিক দিয়েই ধীরে ধীরে জঙ্গল হাসিল হচ্ছে। ঘন জঙ্গল ছিল এক সময়ে, এখন ভিতরটা অনেক ফাঁকা ফঁকা। গাছপালা কাটা হচ্ছে রোজই। কাঠের দাম এখন আগুন।
অন্ধকার নেমে আসছে ক্ৰমে। তবে খুব একটা ভয় নেই। আজ পূর্ণিমা। একটু বাদেই মস্ত চাঁদ উঠবে পুব ধারে। উঠেও গেছে বোধহয় খানিকটা। গাছপালার জন্য দেখা যাচ্ছে না। বিড়ি খেতে খেতে একটু কাশল দীনু। গুন গুন করে একটু গানও গাইল। মরার আগে একটু ফুর্তি করে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সে ভেবেই পেল না, ফুর্তিটা কীভাবে করবে। অভাবি মানুষ সে, ফুর্তি কীভাবে করতে হয় তা জানেই না। মাংস দিয়ে ভাত খেলে কি ফুর্তি হয়? কেত্তন শুনলে? যাত্রা দেখলে? অনেক ভেবেও সে ফুর্তির পথটা খুঁজে পায়নি। বিড়ি খেতে খেতে সে একটু ফুলির কথাও ভাবল। কতবার ফুলি তাকে গলায় দড়ি দিতে বলেছে, কিন্তু যখন সে সত্যিই গলায় দড়ি দেবে তখন মাগীর তেজ থাকবে কোথায়? হুঁ হুঁ বাবা, তখন তো গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদে ভাসাবে। ভাসাক, তাই তো চায় দীনু। তবে তার কচি মেয়েটার জন্য বুক একটু টনটন করে। মাত্র বছর চারেক বয়েস। খুব বাপন্যাওটা। তবে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই।
একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনে দীননাথ চমকে উঠে ডানধারে তাকাল। অবাক হয়ে দেখল, কখন নিঃশব্দে আরও একটা লোক তার কাছ ঘেঁষেই এসে বসেছে। কখন গাছে উঠল, কখন এসে বসল তা দীনু মোটেই টের পায়নি। তারই মতো বয়স হবে। গরিব-দুঃখী মানুষ বলেই আবছা অন্ধকারে মনে হল।
দীনুও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজকাল নিরিবিলি জায়গা খুঁজে পাওয়াই ভার। মাধবপুরের জঙ্গলে নিশ্চিন্তে মরতে এসেছে সে, এখানেও উটকো একটা লোক এসে জুটে গেল। কী মতলব কে জানে। সন্ধেরাতে গাছ-টাছে উঠতে নেই, সবাই জানে। তবু যদি উঠতেই হয় তবে অন্য গাছে গিয়ে ওঠো না বাপু, দীনুর গাছটাতেই উঠতে হবে এমন তো কথা নয়।
উত্তেজিত হলেও দীনু ফস করে কিছু বলল না। বিড়ি খেতে খেতে আড়ে আড়ে চেয়ে লোকটাকে ঠাহর করতে লাগল। লোকটার হাবভাব কিছু অন্ধকারে বোঝা গেল না। এও কি গলায় দড়ি দেবে বলেই গাছে উঠেছে? কে জানে বাবা। তবে ফাঁসি দেওয়ার জন্য গাছেরও তো অভাব নেই। আর ফাঁসিই বা কেন, মরার কত উপায় আছে। আড়াই মাইল হেঁটে গেলেই রেলরাস্তা। গামছা পেতে লাইনে মাথা দিয়ে শুয়ে ঘুম লাগাও। এক সময়ে ট্রেন এসে কাজ ফর্সা করে দিয়ে চলে যাবে। টেরটিও পাবে না। কিংবা এক বোতল অ্যাসিড বা পোকা মারার বিষ কিনে ঢক ঢক করে মেরে দাও, লক্ষ মেরে আকাশে উঠে পড়বে।
এখন মুশকিল হল, লোকটা কেমন এবং কী মতলব তা না বুঝে দীনু গলায় দড়ি দিতে পারছে না। লোকটার হয়তো দয়া উথলে উঠবে, দীনুকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। নয়তো উপদেশ-টুপদেশ দেবে। ওসব ভ্যাজর ভ্যাজর এখন আর তার সহ্য হবে না।
দীনু অগত্যা বিড়িটা ফেলে গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, বলি কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
লোকটার মুখ ভাল দেখা যাচ্ছে না। তবে গলার স্বর শুনে মনে হল, কথা কওয়ার তেমন জো নেই। বলল, কাছে-পিঠেই থাকি।
বিড়ি-টিড়ি চলে?
তা চলে।
খাবে নাকি একটা?
লোকটা হাত বাড়াল। দীনু একটা বিড়ি আর দেশলাই এগিয়ে দিল হাতে। লোকটা বিড়ি ধরিয়ে উদাসভাবে টানতে লাগল।
ভাবসাব করতে হলে বিড়ির মতো জিনিস নেই। চট করে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। দীনু ফের একটা বিড়ি ধরিয়ে বলল, তা মতলবটা কী? সাঁঝেরবেলায় গাছে এসে উঠেছ যে বড়!
কেন, উঠতে বাধা কীসের? ইচ্ছে হল তাই উঠে পড়লাম।
হাসালে বাপু। গাছে উঠতে ইচ্ছেটাই বা হবে কেন? পাগল নাকি হে তুমি?
তা পাগলও একটু আছি বোধহয়। মাথায় একটু গণ্ডগোল আছে যেন।
তা তোমার হাবভাব দেখেই বুঝেছি। তা বাপু, এ-গাছটাই তোমার পছন্দ হল যে! জঙ্গলে কি আর গাছ নেই?
তা আছে।
তবে?
অন্য গাছে তো আর তুমি নেই!
যাঃ বাবা, তুমি কি আমাকে দেখেই এ-গাছে উঠলে নাকি? এ তো বড় মজা মন্দ নয়। কেন হে বাপু, আমি যা করব তোমাকেও কি তাই করতে হবে?
লোকটা তেমন নির্বিকার গলায় বলল, না, ঠিক তা নয় বটে।
তাহলে?
মনে হল তোমার সঙ্গে এ সময়টায় থাকলে ভাল হবে।
এ সময়টা বলতে কী বোঝাতে চাইছ?
তুমি তো মরতে এসেছ?
কী করে বুঝলে?
না, তা অবশ্য বোঝা যায় না বটে, কেমন যেন সন্দেহ হল।
দুর দুর, মরা-টরা নয় রে বাপু, গাছে উঠেছি চন্দনা পাখি ধরতে। সন্ধের পর হলে ধরতে সুবিধে।
ও। তা হবে।
বিশ্বাস হল না বুঝি?
তা হবে না কেন? দুনিয়া জুড়ে কত মানুষ কত অদ্ভুত মতলব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তাহলে তো বুঝতেই পারছ তোমার সন্দেহটা ঠিক নয়।
তাই হবে হয়তো। চিরটা কাল তো কত ভুলই বুঝলাম। তোমার ওই ঘেঁড়া হাওয়াই চপ্পলজোড়া দেখেই পুরনো কথা সব মনে পড়ছিল কি না। তাই গাছে ওঠার আগে বসে বসে তোমার চপ্পলজোড়ার সঙ্গে কথা কইলাম।
চপ্পলজোড়ার সঙ্গে! পাগল আর কাকে বলে। তা চপ্পল তোমাকে কী বলল?
জিজ্ঞেস করলাম, ওরে বাপু, তোরা এখানে এমন একাবোকা পড়ে আছিস কেন? তো তারা বলল, জানো না বুঝি! আমাদের কর্তা গলায় দড়ি দিতে গাছে উঠেছেন। আজ থেকে আমাদের ছুটি।
বলল?
হ্যাঁ গো, পষ্ট বলল, তা আমি জিজ্ঞেস করলাম, কর্তা মরতে চায় কেন। চপ্পলজোড়া ভারী কাচুমাচু হয়ে বলল, কর্তার মনে বড় অশান্তি। পরিবারের সঙ্গে খুব ঝগড়া হয় কিনা।
দীননাথের একটু প্রেস্টিজে লাগল। একটু ঝঝের গলায় বলল, ঝগড়া হয় তো হয়, তাতে ওদের কী? বড় আম্পদ্দা তো তুচ্ছ হাওয়াই চপ্পলের!
আহা, শুধু চপ্পলই বা কেন, এই যে গাছটায় উঠে বসে আছ, এও তো সাক্ষী আছে।
বটে!
তবে আর বলছি কী, গাছে ওঠার সময় জিজ্ঞেস করলাম, ওহে বাপু, লোকটা কি ঝুলে পড়েছে। গাছ হাই তুলে বলল, আর বোলো না ভায়া, সাঁঝবেলাতেই আমার রাজ্যের ঘুম পায়। কিন্তু ঘুমুবার কি জো আছে! চোখটি লেগে আসছিল সবে এমন সময় হাড়হাভাতেটা এসে হাজির। কী না গলায় দড়ি দেবে। সেই যে ঘুমটা চটকে গেল আর চোখের পাতা এক করতে পারিনি। নবাবপুর গাছে উঠেছেন ঝুলবেন বলে, আর আমাকে ফাঁসিকাঠ হতে হবে।
বলল?
তবে আর বলছি কী! আমি বললুম, ঝুলে পড়েছে নাকি? গাছ তখন ভারী তেতো গলায় বলল, তাহলে তো বাঁচতুম। ঝুলবার বায়নাক্কা কি কম! বাবু এখন আরাম করে বসে বিড়ি ফুঁকছেন আর জ্বলন্ত বিড়ি আমার গায়েই টিপে টিপে নেবাচ্ছেন। ছ্যাঁকার চোটে প্রাণ অতিষ্ট হয়ে গেল। কী বিড়ি-খেকো লোক রে বাবা। সবাই মরার আগে কেন যে এত বিড়ি ফোঁকে কে জানে বাবা। আমার তো এটা নিয়ে ছয় নম্বর। তার মধ্যে একটা বউমানুষও ছিল, তা সে বিড়ি খায়নি বটে, কিন্তু গলায় দড়ি দেওয়ার আগে দু কলসি চোখের জল ফেলেছিল। বড্ড ঝামেলা হে। তা যাও বাপু, গিয়ে লোকটাকে বলল যা করবে তা ঝটপট করে ফেলতে। আমি আর কতক্ষণ রাত জেগে থাকব বলতে পারো?
এবার বিড়িটা আর গাছের গায়ে টিপে নেবাল না দীননাথ। একটু ধরে রইল। বিড়ির আগুন ক্ষণস্থায়ী, সহজেই নিবে যায়।
দীনু বলল, বানিয়ে বানিয়ে বলছ না তো!
লোকটা উদাস গলায় বলল, কী লাভ?
পাগলের মাথায় নানা রকম নতুন কথা আসে জানো তো!
তা জানব না? পাগল কি কম দেখেছি জীবনে?
আর একটা বিড়ি খাবে নাকি?
আছে?
মেলা আছে। এক বান্ডিল কিনেছিলাম, সব কটা কি আর মরার আগে খেতে পারব? এই নাও, ধরাও।
লোকটা বিড়ি ধরিয়ে বলল, তুমি যা ভাবছ তা কিন্তু নয়।
দীনু অবাক হয়ে বলে, কী আবার ভাবলাম।
ভাবছিলে দিব্যি চুপি চুপি মরতে পারবে, কেউ টেরও পাবে না। তা কিন্তু নয়। সবাই টের পাচ্ছে, তুমি মরতে এসেছ।
আ মোলো যা, আবার কে টের পেল?
পোকামাকড়, কাকপক্ষী, হাওয়াবাতাস, গাছপালা সবাই।
তারাও সব তোমার কাছে আমার কুচ্ছো গাইছে নাকি?
ঠিক তা নয় তবে দেখছ না চারদিকটা কেমন ঝিম মেরে আছে!
তা আছে। তাতে কী?
ওই ঝিম মেরে থাকা মানেই সবাই অপেক্ষা করছে সর্বনাশটার জন্য। দুঃখও পাচ্ছে।
বাজে কথা।
কান থাকলে ঠিক শুনতে পেতে, বাতাসে একটা হায় হায় শব্দ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
তুমি নির্যস পাগলই বটে হে। তবে স্বীকার করি, তুমি বেশ কথা কইতে পারো। আগডুম বাগড়ম বলছ বটে তবে বেশ গুছিয়ে বলছ।
কথা আমি মোটেই কইতে পারি না। আমাকে কথা কওয়ায় পরিস্থিতি। যখন যেমন কথার জোগান পাই তখন তেমন বলি। বললে প্রত্যয় যাবে না, আমাকে কথা কওয়াচ্ছে তোমারই চারদিকটা।
বেড়ে বলেছ ভায়া। কথাটা বোধহয় খানিকটা ঠিকই। মানুষ কি আর সাধে আজেবাজে কথা কয়। আমার বউমাগী ফুলি যদি অমনধারা কুরুক্ষেত্তর না করত তাহলে কি আমিই অমন সব মুখোরাপ। করতাম!
আহা, তোমার শোনার কানই নেই কিনা।
তার মানে?
ফুলি মুখে যা কয় তাই কি কথা? তার মনেও তো কিছু কথা ভুড়ভুড়ি কাটে, না কি?
তা কাটতে পারে।
সেইটে কি তুমি শুনতে পাও?
না বাপু, আমার অত শোনার প্রবিত্তি নেই।
সেইজন্যই তো বলি, তোমার শোনার কান নেই। ফুলি তোমাকে যখন মরতে বলে তখন কি আর সত্যিই মরতে বলে? তুমি মরলে তার লাভটা কী বলো তো!
ওই বজ্জাত মাগীকে তো চেনো না, তাই বলছ। হাড়মাস চিবিয়ে খাচ্ছে হে।
আচ্ছা বাপু, সে না হয় বুঝলুম। কিন্তু তোমাদের তো কখনও-সখনও আদর সোহাগও হয় নাকি?
সে কালেভদ্রে।
তখন ফুলি কী বলে? ভাল ভাল কথা কয় না তখন?
তা কইবে না কেন? খুব আঁঠালো কথাই কয়। তবে সেগুলো ওর মনের কথা নয়।
তাহলে বাপু যখন রেগেমেগে গালাগাল দেয় সেও তার মনের কথা নয়। বুঝলে?
তুমি আমাকে প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করছ বুঝি? সুবিধে হবে না। আমার পরিবারকে আমি খুব চিনি। গলায় দড়ি দিয়ে মাগীকে কঁদিয়ে ছাড়ব, তবে আমার নাম দীনু দাস।
বেশ কথা। ফুলি কাঁদলে খুশি হও বুঝি?
তা নয় তো কী?
কিন্তু ফুলি কাঁদলে খুশি হবে কেন তা ভেবে দেখেছ কী?
ও আর ভাবার কী আছে। মাগী আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়ে কাঁদছে এটা ভাবতেই সুখ।
বলি ভেবে দেখেছ কী, ফুলিই বা কাঁদবে কেন? তোমার তাকে দিয়ে সুখ, আর ফুলির তোমার জন্য কেঁদে সুখ। ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়?
কী আর দাঁড়াবে? এবার বুঝবে দীনু দাস ছাড়া কেমন চলে।
ওই তো বললাম, কান নেই বলে শুনতে পেলে না।
কী শুনলুম না বলো তো!
এই যে গাছ কথা কইছে, হাওয়াই চপ্পল কথা কইছে, ঝিঁঝি কথা কইছে, বাতাস কথা কইছে, গাছের কোটরে ব্যাঙ্গমাব্যাঙ্গমী কথা কইছে, বিবেক কথা কইছে সব কি শুনতে পাচ্ছ?
দুর! ওসব তোমার মনগড়া কথা। কেউ কিছু কইছে না।
কইছে হে কইছে। ফুলির মনেও ভুড়ভুড়ি ওঠে হে, তুমি শুনতে পাও না।
চুলোয় যাক ভুড়ভুড়ি। ভুড়ভুড়ি ধুয়ে কি জল খাব! খান্ডার মাগীর মনটাও তো আস্তাকুঁড়।
না হে, কথাটা ঠিক হল না। এ হল মাথাগরমের কথা। ঠান্ডা মাথায় ভাবলে অন্যরকম মনে হবে।
তুমি ঠিক কে বলো তো! পাগল যে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু নামটা কী?
আমার নাম আমি।
যাঃ, ও আবার একটা নাম হল নাকি?
ওইটেই যে আমার নাম। আমি, ইচ্ছে হলে আমি দাসও বলতে পারো।
ও আবার কেমনধারা নাম! আমি দাস।
কেন, নামটা কি খারাপ? তুমি দীননাথ হলে আমার নাম আমি হতে বাধা কী?
তা বটে। তবে কিনা কাউকে আমি বলে ডাকলে পাঁচজন না আবার আমাকেই পাগল ভাবে।
কিন্তু আসল কথাটাও যে তাই।
তার মানে?
তুমি যে আসলে আমিই।
দুর পাগল! আমি আবার তুমি হব কী করে?
হতে হবে না, হয়েই আছ।
দেখ বাপু, পাগুলে কথা কয়ে আমার মাথাটা আর গুলিয়ে দিও না। একটু বাদেই আমি পটল তুলব, মেলা কাজ রয়েছে হাতে। দড়িখানা ভাল করে গাছের ডালে বাঁধতে হবে। ফঁসটা ভাল করে দিয়ে তুলতে হবে। তারপর ধরো ঠাকুর-দেবতাকেও একটু ডাকতে হবে। এ সময়ে মাথা গুলিয়ে গেলে চলবে না। তুমি এবার বরং এসো গিয়ে।
ব্যস্ত হয়ো না। মরাটা এমন হাতিঘোড়া ব্যাপার নয়। নিত্যি দুনিয়া জুড়ে হাজারে হাজারে মরছে। দু দণ্ড দেরি হলেও ক্ষতি নেই। সারা রাত তো পড়ে আছে সামনে।
না হে বাপু, শুভস্য শীঘ্রম। দেরি হলে আবার মন ঘুরে যেতে পারে। তাই দেরি করাটা ঠিক হবে না।
আহা, তার আগে যে দুটো কথা ছিল।
কী কথা?
তুমি তো কানেই তুলতে চাইছ না। এই যে বললুম আমার নাম আমি, তাও তুমি ব্যাপারটা ধরতে পারলে না।
ভেঙে বলবে তো!
তাই বলছি। এই যে আমাকে দেখছ এই আমি আসলে তুমিই। তবে পটল তোলার পর।
ফের প্যাঁচ মারছ?
মাইরি না। তুমি পটল তোলার পর তোমার যে অবস্থাটা দাঁড়াচ্ছে সেটাই হচ্ছে আমি।
ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পাওনি। আমি তো এখনও পটলই তুলিনি। তুলতে যাচ্ছি মাত্র। ঝুলব, ছটফট করব, মরব, সে এখনও ঢের দেরি।
ওরে বাপু, মরা তোমার হয়েই গেছে। তোমার ভিতর থেকে আমি বেরিয়ে পড়েছি যে। এখন ও শরীর ঝোলাও, না ঝোলাও একই কথা। মোট কথা, তুমি মরেই গেছ।
অ্যাঁ!
তাই তো বলছি। তুমি মরেই তো আমি হলুম। না মরলে আমার দেখা পেতে নাকি?
বটে! তাহলে তুমি হচ্ছ মরা আমি?
এইবার ধরেছ ঠিক।
তা মরে কেমন লাগছে তোমার?
দুর, নতুন কিছু তো বুঝছি না। একই রকম। বরং ফুলির জন্য বড্ড মনটা আনচান করছে, মেয়েটার কথা ভেবে কান্না আসছে।
অ্যাই! ফুলির কথা তোলার তুমি কে? ফুলি তো আমার বউ!
সে আমারও বউ।
বললেই হল! ফুলি তোমার বউ হতে যাবে কেন?
আহা, হতে বাধা কী?
বাধা আছে বইকী!
ভাল করে ভেবে বলল। বরং ফের একটা বিড়ি ধরাও।
দীনু বিড়ি ধরাল, আমি দাসকেও একটা দিল। তারপর কষে ভাবতে লাগল। তারপর বলল, না হে একটা গোলমাল হচ্ছে।
কীসের গোলমাল?
ঠিক বুঝতে পারছি না। আরও ভাবতে হবে। আজ আর মরা হবে না। বরং বাড়ি যাই। ভেবে ব্যাপারটা বুঝে কাল বা পরশু এসে ফাঁসি যাব।
তা প্রস্তাবটা মন্দ নয়। এসো গিয়ে।
গাছটা হাই তুলে আপনমনে বলল, বাঁচা গেল। সারা রাত হাতে লাশ ঝুলিয়ে কি ঘুমোনো যায়!
একটা হাওয়াই চটি আর একটাকে ডেকে বলল, ওরে ঘুমোলি নাকি? ওরে ওঠ, কর্তা আজ মরছে না, ওই নামছে গাছ থেকে।
যাঃ বাবা, লম্বা ছুটি ভেবে জিবরাচ্ছিলুম, ছুটি কাটা গেল যে!
.
মোনা ঘরে ঢুকে বলল, শোনো, গ্রীষ্মকালে বোধহয় এখানে উইক এন্ডে আসা যাবে না।
লেখার কাগজ থেকে গভীর অন্যমনস্ক চোখ তুলে অমল বলল, কেন বলো তো!
এখানে যা গরম পড়ে, আর লোডশেডিং।
তা বটে। তারপর একটু চুপ করে থেকে অমল স্নিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ মোনা, তোমার এখানে আসতে এমনিতে খারাপ লাগে না তো!
মোনা তার দিকে চেয়ে একটু ভাবল। তারপর বলল, আগে লাগত। এখন লাগে না।
আমার বাড়ির লোকেরা তত কিছু ভাল নয়। কালচার-টালচার নেই তেমন।
একটা কথা শুনে রাখো। মেয়েদের অ্যাডজাস্ট করতে একটু সময় লাগে, কিন্তু যদি সে তার স্বামীর সাহায্য আর সহানুভূতি পায় তাহলে সে রাক্ষসের সঙ্গেও অ্যাডজাস্ট করে নেয়। বুঝেছ?
অমল মলিন মুখে বলল, হ্যাঁ, তাই বোধহয়।
বোধহয় বললে কেন?
আমার মাথা আজকাল তেমন কাজ করে না মোনা। আমি তো তোমাকে তেমন সহানুভূতি দেখাইনি, সাহায্যও করিনি। তাই ভাবছি …
মোনা এগিয়ে এসে তার মুখখানা দু হাতে তুলে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে একটা চুমু খেল। বলল, অত বুঝতে হবে না।
.
৬৯.
কথা বলল, আমার সঙ্গে কথা বলো তুমি। কেউ কি আছ কোথাও? ওই আকাশে, কিংবা শূন্যে, কিংবা পঞ্চভূতে? কেউ যদি কোথাও থেকে থাকো, ঈশ্বর বা সর্বময় কেউ, সর্বশক্তিমান কেউ, একটু চকিত আভাস অন্তত দাও তোমার। তুমি যে আছ, তা বুঝতে দাও। একবার একটিবার মাত্র আমার এই ঘোর আদিগন্ত একাকিত্ব, এই নিঃস্ব মন, এই ক্ষয়িষ্ণু শরীরের, এই অনস্তিত্বময় অস্তিত্বের উৎসকে একবার চিনে নিতে দাও। এতটুকু আভাস যদি পাই তোমার তা হলেই হৃদয় জুড়োবে। বাদবাকি জীবন নিজেকে বহন করা সহজতর হবে।
শীতের গভীর রাত্রি। চারদিকে ঘুমন্ত চরাচর। কুয়াশায় মাখা এক রহস্যময় জ্যোৎস্নার সামান্য ভুতুড়ে আলোয় ছাদে উধ্বমুখ হয়ে অমল দাঁড়িয়ে। মাথা গরম। বুকে হাতুড়ির মতো তার হৃৎপিণ্ড আছড়ে পড়ছে ভঙ্গুর পাঁজরে। দাতে দাতে ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। শীত হয়তো আছে, কিন্তু অমলের ভিতরে আজ যেন সব উত্তাপ নিবে গেছে। রক্ত আজ সাপের রক্তের মতো ঠান্ডা। সর্বাঙ্গে বয়ে যাচ্ছে শীতের প্রহারের কম্পন। পৃথিবীতে এত শীতও আছে এতকাল বুঝতেই পারেনি সে। ঘরে লেপের তলায় নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমে ঢলে আছে সবাই। তার বউ, ছেলে, মেয়ে। এই শীতের রাতে হঠাৎ এত অনিকেত কেন লাগল নিজেকে কে জানে। লেপের খোলস ছেড়ে সে নিঃশব্দে উঠে এসেছে ছাদে। কেন তাও সে জানে না। শুধু জানে, এই অর্থহীন জগৎ তাকে পাগল করে দিচ্ছে ক্ৰমে। কেন এই জগৎ? কেন এই চৈতন্য? এর কোনও স্রষ্টা নেই? শেষ নেই? ব্যাখ্যা নেই? অর্থ নেই? কেন এই আশ্চর্য ধাঁধা তার চারদিকে? এ কি অর্থহীন জড়বস্তুর সমাহার? কেন এসব? কী এসব?
না, মোনার সঙ্গে তার কোনও ঝগড়া হয় না আজকাল। বিচ্ছেদ হতে হতেও তারা খাদের কিনারা থেকে কিছুটা সরে এসেছে। খুবই সতর্কতার সঙ্গে নিজের কথা ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করছে অমল। তার ফলে সমঝোতা চমৎকার দুজনের মধ্যে। দৈহিক সম্পর্কটাও প্রায় নিয়মিত। কিন্তু মানসিক? শুধু অমল জানে, কী শূন্য হৃদয় তার। সেখানে কোনও তরঙ্গই ওঠে না আর। ভাগ্য ভাল মনের ভিতরটাকে আর কেউ দেখতে পায় না।
আজ রাতে এক অলৌকিককে অনুভব করতে চাইছে অমল। তার তো বিশ্বাসের কোনও স্থণ্ডিল নেই। তাকে পৈতে পরিয়েছে বউদি, গায়ত্রী জপ করার পরামর্শ দিয়েছে। তাও কি করেনি অমল? কিন্তু আধখানা মন নিয়ে কি ওসব হয়?
একদিন সে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, গায়ত্রী জপ করলে কী হয় বাবা? কিছু কি হয়?
প্রশ্ন শুনে মহিম রায় বিস্মিত এবং একটু বিব্রতও। একটু হেসে বলল, কেন রে?
সেই কবে তুমি আমার পৈতে দিয়েছিলে! কিন্তু দণ্ডিঘর ছেড়ে বছরখানেক কিছু করেছিলাম। তারপর সবই ছেড়ে দিয়েছি।
মহিম তার বিদ্বান ছেলেকে কী বলবে তা ভেবে পেল না প্রথমে। অনেকক্ষণ বাদে বলল, মন্ত্র তো মনকে ত্রাণই করে। করার কথা।
আমি তো আজকাল গায়ত্রী জপ করি। কিছু হয় বলে টের পাই না তো!
মহিম ফের একটু বিব্রত। ছেলে সাহেব এবং নাস্তিক হয়ে গেছে বলেই সে জানে। ছেলের সঙ্গে শাস্ত্রালোচনা করতে বোধহয় ভয়ও পায়। তাই খুবই নরম গলায় বলল, সব মন্ত্রেরই একটা সাক্ষাৎকার আছে।
অবাক হয়ে অমল বলে, সেটা কী বাবা?
কথাটা বলেই মহিম আরও বিব্রত এবং অপ্রতিভ। আবার একটু ভেবে বলল, আসলে ওসব একটু ভক্তি-বিশ্বাস নিয়ে করলে ভাল। পরীক্ষা করার মন নিয়ে করতে গেলে তেমন কিছু হয় না।
আমি তো বিশ্বাস করতেই চাই বাবা। কিন্তু জপ করেও তো বিশ্বাস আসছে না। কেন আসছে না বল তো!
বাবার মুখ দেখেই অমল বুঝতে পারছিল, এসব সংগত প্রশ্নের সামনে তার বাবা অসহায় বোধ করছে, থই পাচ্ছে না, কূল-কিনারা পাচ্ছে না। বাবা বিশ্বাস করেই বড় হয়েছে, বিশ্বাস নিয়েই বুড়ো হয়েছে। কখনও তো প্রশ্ন করেনি ব্যাপারটাকে। তার কাছে দুনিয়াটা স্বাভাবিকভাবেই ঈশ্বরসৃষ্ট, এবং তার ঈশ্বর কোথাও আছেন, ঠিকানা না জানা থাকলেও আছেন নিশ্চয়ই। এই বিশ্বাস আমৃত্যু তাকে বন্ধুর মতো সাহচর্য দেবে। এই বিশ্বাস আছে বলেই কোনও লজিক্যাল প্রশ্ন বিষধর সাপের মতো ফণা তুলবে না তার সামনে। কিন্তু অমলের তো তা নয়। তার কাছে এই চারদিকের জগৎসংসার স্বাভাবিক নয়। এ এক ধাঁধা। অর্থহীনভাবে ফলিত হয়ে আছে। এর না আছে উদ্দেশ্য, না আছে অর্থ, না ব্যাখ্যা। ঈশ্বর এক ঠিকানাবিহীন, নামগোত্রহীন নন-এন্টিটি। যদি সে না-ই থাকে তাহলে এই সৃষ্ট জগতের ধাঁধা আরও জটিল ও কঠিন হল। আশ্রয়হীন, সংহতিহীন এক বিশৃঙ্খলা মাত্র। এটা ওটা এখানে সেখানে পড়ে আছে। মাত্র, কারও সঙ্গে কারও কোনও প্রয়োজন বা সম্পর্ক নেই। সারা জগৎত্ময় ওইসব জড়বস্তুর আয়োজন, যার সমাবেশ থেকে কিছুই বুঝবার উপায় নেই। এসব কেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে? কী কাজ করছে এরা? কেন করছে? আর এই জড় জগতে সব কিছু জড়িভুত থাকার কথা, হঠাৎ তার মধ্যেই কেন চৈতন্যের উন্মেষ? আর তা হলই বা কেন?
ভাবতে ভাবতে পাগলপারা মাথা। মাথার কোষে কোষে জমে ওঠে ধাঁধা, কে এর পিছনে? কী এর কারণ? কোথায় এর শুরু বা শেষ? ছোট ঘরের অবরোধে মধ্যরাতে লেপের মধ্যে ভেপে উঠল তার শরীর। তার চেয়েও বেশি বিকল অচল হল মন, বুদ্ধি, চেতনা। দমফোট অবস্থা।
তার বাবা মহিম রায় বিজ্ঞানের মানুষ নয়। কিন্তু এককালে ইংরিজিতে এম এ পাস করেছিল। গেঁয়ো গন্ধ আজও তার বাবার গা থেকে যায়নি। খুব চোখা চালাক বুদ্ধিমান লোক নয়। মহিম রায় তার মেধাবী ছেলের দিকে চেয়ে বলল, বিশ্বাস জিনিসটা সহজে আসতে চায় না তো। অনেক দ্বিধা আসে, অনেক প্রশ্ন আসে। ওটাই তো লড়াই।
তুমি কবে থেকে ভগবান মানো বাবা?
মহিম রায় ভারী অপ্রস্তুত হেসে বলেছিল, সে কি মনে আছে? ছেলেবেলা থেকেই বোধহয়।
কখনও ঈশ্বরকে অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি?
হয়েছে। কতবার হয়েছে।
এই যে বিশ্বাস থেকে অবিশ্বাস, আর অবিশ্বাস থেকে বিশ্বাস, এই ট্রানজিটারি পিরিয়ডটার কথা আমাকে বলবে?
ছেলের দুর্মর অস্থিরতা টের পাচ্ছিল মহিম। কিন্তু বেশি কথা বলতেও বোধহয় সাহস হল না। সংক্ষেপে বলল, স্বামী বিবেকানন্দেরও তো হয়েছিল শুনেছি। সবারই হয়।
আমার একজন ভগবান দরকার। ভীষণ দরকার।
মহিম এটা হাসির কথা ভেবেই হেসেছিল। গুরুত্বটা বোধহয় বোঝেনি।
তবে কার কাছে যাবে অমল? কে ধরিয়ে দেবে তাকে?
আকাশের দিকে চেয়ে থেকে কোনও লাভ নেই। আকাশ তো কিছু বলে না। এক নিরপেক্ষ বিস্তার, মাত্র। যে যা খুশি ব্যাখ্যা করে নাও। এই নীরবতাই বড় অসহনীয় লাগে তার। ভগবান যদি আছ কোথাও, তবে সাড়া দাও না কেন? চোর-চোর খেলার লুকিয়ে থাকা খেলুড়িও তো টু দেয়। সেরকম কিছু? একটা টু শব্দও কি শোনা যাবে না কখনও? এই নির্জন মধ্যরাতে তিনি যদি থেকেই থাকেন- একবারও কি এই তাপিত হৃদয়ের ডাকে দৈবের বাণীর মতো বলে উঠবেন না, আমি আছি?
নাকি নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি নিজেও নিশ্চিত নন? তারও কি সংশয় হয়, আমি কি আছি, না নেই?
সিঁড়ি ভেঙে কে উঠে আসছে ওপরে?
বিরক্ত হল অমল। এই মধ্যরাতের নির্জনতায় সে তার অস্তিত্বকে খুঁজছে। বড় জরুরি তার প্রয়োজন। এই নিবিড় গভীর ধ্যানমগ্নতায় কেউ এসে হানা দিয়ে শতেক প্রশ্ন করলে সে খানখান হয়ে যাবে। বড় ভঙ্গুর সে, বড়ই পলকা। কোনও অজুহাত নেই তার। কোনও ব্যাখ্যাই নেই তার আচরণের যা লোকে গ্রহণ করবে।
একটা ঝংকার আশা করেছিল অমল। কিন্তু মোনা আজ সেরকমভাবে ঝংকার দিল না। উঠে এসে নিঃশব্দে তার পাশে দাঁড়িয়ে কে জানে কেন কাঁধে নরম করে হাত রাখল। তারপর কোনও প্রশ্ন না করে নরম গলায় বলল, ঠান্ডা লাগবে। ঘরে চলো।
খুব অবাক হল অমল। মোনাকে সে বাস্তবিক বাঘের মতো ভয় পায়। কিন্তু ইদানীং মোনার ব্যবহার– হোক কৃত্রিম খুব বন্ধুর মতো, বুঝদার সাথীর মতো। কোনও প্রশ্নই করল না, কৈফিয়ত চাইল না।
অনিচ্ছুক অমল এই বন্ধুত্বপূর্ণ আহ্বানকে অপমান করল না। ঘাড় নেড়ে বল, চলো।
ঘরে এসে একটু হাঁফ ধরছিল অমলের। খোলা ছাদে এতক্ষণ প্রচুর অক্সিজেন পেয়েছে সে। বদ্ধ ঘরে সেটা নেই।
মোনা দরজাটা বন্ধ করে তার দিকে ফিরে বলল, ঘুম না এলে শোওয়ার দরকার নেই। বসে বসে বরং লেখো।
বিস্মিত অমল বলল, লিখব?
আমি জানি, তুমি লিখতে ভালবাসো। আর যদি ঘুম পেয়ে থাকে তো শোও, আমি তোমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিই।
অমল মাথা নেড়ে বলল, না, আমি বরং অন্ধকারে একটু বসে থাকি। চুপচাপ।
তাই থাকো। আর দরকার হলে আমার সঙ্গে কথাও বলতে পার।
এত সহৃদয়তা আশাই করেনি অমল। ঠিক বটে, আজকাল তার সঙ্গে মোনার সমঝোতা চমৎকার। তবু এতটা বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা নয়। সে বড্ড অবাক হল। তারপর বলল, না, তুমি ঘুমাও। আমারই দোষ হয়েছে মাঝরাতে হঠাৎ ছাদে যাওয়ায়। তুমি হয়তো ভাবছিলে।
দোষ হবে কেন? ঘুম না এলে লোকে তো খোলা জায়গাতেই গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এখন বেশ শীত। এই ঠান্ডায় ছাদে যাওয়াটা বিপজ্জনক।
বুঝেছি। আচ্ছা আমি ঘরেই বসছি বরং।
কফি খাবে?
কফি? এত রাতে কোথায় পাবে?
কোনও অসুবিধে নেই। একটু আগেই বাবা উঠেছেন। ওঁর ঘরে গিয়ে পাঁচ মিনিটেই করে আনব।
অমল অবাক হয়ে বলে, বাবা উঠেছে? চারটে বেজে গেছে নাকি?
কখন। এখন চারটে কুড়ি।
ওঃ, তাহলে তো ভোরই হয়ে গেল।
কফি করে আনি?
আনবে?
বলে একটু দ্বিধা করল অমল। মোনাকে সে পারতপক্ষে কোনও কাজের কথা বলে না।
একটু বোসো। নিয়ে আসছি। বাবাও এ সময়ে কফি খান।
অমল বসে রইল ফাঁকা ঘরে। ছাদ থেকে এসে ঘরে ঢুকতেই সে ঘরের মধ্যে একটা বাসি গন্ধ পেয়েছিল। ভ্যাপসা, গা গোলানো গন্ধ। থাকলে পাওয়া যায় না, কিন্তু হঠাৎ বাইরে থেকে এসে বন্ধ ঘরে ঢুকলেই টের পাওয়া যায়, মানুষের শরীরও কিছু দূষণ ছড়ায়।
উঠে সে চোখেমুখে ঠান্ডা জল দিল।
হঠাৎ শুনতে পেল, নীচে মোনা তার শ্বশুরের সঙ্গে কথা কইছে। কী কথা তা বোঝা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু মাঝে মাঝে মোনার হাসির শব্দে বোঝা যাচ্ছে দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা সৌহার্দ্যপূর্ণ। এসব একটু আজগুবি লাগছে অমলের। কিছুদিন আগেও ছবিটা ঠিক এরকম ছিল না। তাদের বাড়ির লোকজন সম্পর্কে মোনার ধারণা ছিল, এরা একেবারেই আনকালচার্ড, ঝগড়ুটে, নিন্দুক এবং অন্যের ব্যাপারে বড় বেশি নাক গলায়। মহিম রায়কে সে একজন ব্যক্তিত্বহীন, অপদার্থ, নির্বোধ লোক বলেই জানত। কথা বলার প্রয়োজনটাও বোধ করত না। ধারণাটা কি পালটে গেল এত তাড়াতাড়ি? নাকি মোনা নিজের ভিতরকার সাপগুলোকে আঁপিতে বন্ধ করে রেখে প্রাণপণে কৃত্রিমভাবে সমঝোতার চেষ্টা করছে? কারণ মানসিকতা এমনিতে তো পালটায় না। তার একটা পদ্ধতি আছে। যাকে প্রসেস বলে। মোনা তেমন কোনও পদ্ধতির ভিতর দিয়ে যায়নি। কিন্তু সে তার বাইরের আচরণ অনেক বদলে ফেলেছে। সেটা কিছু কম কথা নয়। অভিনয় তো অমলও করে যাচ্ছে। সে জানে, এই বয়সে মোনা তাকে ছেড়ে চলে গেলে তার জীবনের ছকটা পালটে যাবে এবং সেটা মোটেই ভাল হবে না। সব সংসারেরই একটা প্যাটার্ন থাকে, প্রেম না থাকলেও। আর সেটাই আসল। সেই ছকটা হঠাৎ হাটকে মাটকে গেলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় সেটা সহজে ভরে তোলা যায় না। বন্য, বিশৃঙ্খল জীবন থেকে মানুষ যে সংসার বা পরিবার গড়ে তুলেছিল তা তো এমনি নয়। পরিবারই তাদের রক্ষাকবচ, অনেক মারের হাত থেকে ওই পরিবারই তো রক্ষা করে। প্রেম-প্রেম করে পাগল হওয়ার চেয়ে পরিবারের অবরোধটিকে দৃঢ় করে ভোলাই বরং বুদ্ধিমানের কাজ।
একটু বাদে মোনা যখন কফি নিয়ে এল তখন টেবিলে মাথা রেখে অমল ঘুমিয়ে পড়েছে।
মোনা তার মাথায় আলতো হাত রেখে বলল, কফি এনেছি।
চটকা ভেঙে উঠে অমল একটু লজ্জার হাসি হাসল, বলল, হঠাৎ একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল।
তা তো আসতেই পারে। কফিটা খেয়ে ঘুমোও।
মাথা নেড়ে অমল বলল, না, আর ঘুমোব না।
জপতপ করবে বুঝি?
অমল ফের একটু লাজুক হাসল, করে দেখছি যদি কিছু হয়।
মোনা একটুও বিদ্রূপ না করে বলল, করলে তো ভালই।
অমল হঠাৎ অবাক হয়ে ভাবল, তার বউ মোনা আস্তিক না নাস্তিক তা সে জানে না। এতকাল ঘনিষ্ঠ সাহচর্যের পরও ব্যাপারটা তার জানা হয়নি। কেন হয়নি তাও সে জানেনা। তবে তাদের বাড়িতে কোনও ঠাকুরের আসন-টাসন নেই, ঠাকুর-দেবতার ছবিও নেই। তারা কখনও কোনও ধর্মীয় আচরণ করে না। ওসব নিয়ে কথাও হয় না তাদের। ঈশ্বর প্রসঙ্গই তাদের কাছে বহুকাল যাবৎ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে আছে।
সে মোনার দিকে চেয়ে বলল, তুমি বোধহয় এসব মানো না, না?
মোনা করুণ চোখে তার দিকে চেয়ে ছিল। বলল, কী জানি, কখনও তো ভেবে দেখিনি।
তার মানে কি মোনা?
প্রয়োজন না হলে কেউ কি ভগবান নিয়ে ভাবে? আমার বাপের বাড়িতে সবাই খুব নাস্তিক ছিল। মা, বাবা, সবাই। কিন্তু তর্কবিতর্ক ছিল না।
কিন্তু আমাদের বিয়ের সময় তোমাদের বাড়িতে সবই তো মানা হয়েছিল।
হ্যাঁ, তাও হয়েছিল। ওই যে বললাম, কোনও বিতর্ক নেই। প্রয়োজন হলে সব প্রথাই মানা হয়, নইলে নয়। বিয়ের পর দেখলাম তুমিও কিছু মানো না, তাই আমিও কিছু মানিনি আর।
কিন্তু এই যে এখন আমি জপতপ করি, এতে তোমার হাসি পায় না তো!
না। বরং মনে হয়, এটা বোধহয় তোমার দরকার।
.
দরকার কথাটা ভাল বুঝল না অমল। দরকার মানে কী? বাচ্চাদের যেমন ভুলিয়ে রাখার জন্য খেলনার দরকার হয় এটা কি তেমন? না কি খিদের মুখে যেমন খাদ্যের দরকার তেমন? নাকি বৈজ্ঞানিকের যেমন সত্য বা বস্তুর মূলে যাওয়ার দরকার, তেমন? আসল কথা কী, বস্তুটা নেই, কিন্তু নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য ওরকম একটা অলীক কিছু নিয়ে পড়ে থাকা?
এই সংশয় তাকে ছাড়ে না। তাই তো মধ্যরাতে লেপের ওম, ঘরের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে ছাদে যাওয়া। সে ছাদ অবধিই মাত্র যেতে পেরেছিল। অনেকে আরও দূরে যায়। সন্ন্যাস নিয়ে, বিবাগী বা পাগল হয়ে, গলায় দড়ি দিয়ে। যায়, অনেকেই যায়, মনের ভূত যাদের তিষ্ঠোতে দেয় না।
তার সঙ্গে মোনার একটা লুকোচুরি আছে। বরাবর ছিল, এখন আরও বেশি আছে। তারা আর লড়াই করছে না বটে, কিন্তু সাবধানে পরস্পরকে নজরে রাখছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। বিদ্রূপও করছে না। আক্রমণ করছে না আর। বরং তারা পরস্পরের সঙ্গে শরীরের সম্পর্কে আসছে, এক বিছানায় শুচ্ছে, অত্যন্ত ভদ্রভাবে কথা কইছে। কিন্তু এসব সৌজন্যের ফলে দূরত্ব কি বেড়ে যাচ্ছে আরও? সেঁতো হাসি, দাঁত নখ লুকিয়ে পরস্পর গাঁ-ঘেষাঘষি, এ কি কাছে আসা, না দূরে যাওয়া?
এসব বুঝতে আজকাল খুব শক্ত লাগে অমলের। তার কাছে ক্রমে এই সম্পর্কের জটিলতা আরও বাড়ছে। সে বিজ্ঞানের ছাত্র, গণিত ভালই জানে। যত শক্ত অঙ্কই হোক, তার একটা সমাধান আছেই। আছে। কিন্তু সম্পর্কের গণিত মাঝে মধ্যেই আবছায়া হয়ে যায়, মাথা দিয়ে বোঝা যায় না, হৃদয় দিয়েও নয়। এ যেন পরস্পরের সামনে থেকেও, কাছাকাছি থেকেও কোনও দুরূহ কোণে বা আবডালে লুকিয়ে থাকা।
অসহায় মুখ তুলে অমল বলল, আমার যে জপতপ দরকার এটা তোমার কেন মনে হয় মোনা?
ইউ আর রেস্টলেস। তোমাকে আমি সবসময়ে একটা অস্থিরতায় ভুগতে দেখি। মেন্টাল প্রবলেম তোমার অনেকদিনের। আমি ভাবতাম পারুলের সঙ্গে তোমার লাভ অ্যাফেয়ারের জন্যই বোধহয় ওটা হয়।
এখনও কি তাই ভাবো?
কী ভাবব তা বুঝতে পারি না। তুমি তো কখনও আমাকে সব কথা খুলে বলো না। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, তুমি আর ইয়ংম্যান নও। মাঝবয়সি। এ বয়সে ওসব অতীতের তত প্রভাব থাকার কথা নয়। তবে কিছু বলাও যায় না। শুধু দেখতে পাচ্ছি, তুমি আরও রেস্টলেস হয়ে যাচ্ছ। তোমার বন্ধু হওয়ার চেষ্টা তো আমি করেছি, তাই না? আমি তোমাকে বুঝবার চেষ্টাও করেছি।
অমল বড্ড লজ্জায় পড়ল এ কথায়। মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ-হ্যাঁ। অ্যান্ড থ্যাংক ইউ ফর দ্যাট। ফর এভরিথিং।
লক্ষ করছি তুমিও আমাকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। হয়তো ভালবাসারও চেষ্টা করছ। কিন্তু একটা ডিসকর্ডও আছে। বেসুরো কিছু। সেটাই বুঝতে পারছি না। সেটা কি পারুল? সে তো এখন তিনটে বাচ্চার মা। তাই না?
অমল সবেগে মাথা নেড়ে বলল, না মোনা, পারুল নয়।
তাহলে?
আমি ঠিক জানি না।
হয়তো জেনেও বলতে চাও না। তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলব না বলেই আমি কখনও তোমার কাছে জানতে চাইনি। এখনও চাই না। তবে আমি চাই ইউ কাম আউট অফ দি স্টুপর। তার জন্য মেডিটেশন করতে হলে করো। মেডিটেশন ইজ এ গুড মেডিসিন। আমিও তো করি।
তুমি মেডিটেশন করো, আমি জানি। সেটা কীরকম মেডিটেশন মোনা, গডলেস?
গড! মেডিটেশনের জন্য গডের কী দরকার?
দরকার নেই?
না তো!
তা হলে?
পৃথিবীসুদ্ধ লোক যে মেডিটেশন করছে তাতে কি ভগবানের দরকার হয় নাকি?
মেডিটেশনটা কেমন একটু বুঝিয়ে দেবে?
ইজি। মন থেকে সব চিন্তা, সব স্মৃতি, সব কথা তাড়িয়ে দিয়ে একদম শূন্য করে ফেলতে হয়। চিন্তাশূন্য, ভাবশূন্য, স্মৃতিশূন্য অবস্থায় সোজা হয়ে বসে থাকা। কমপ্লিট ব্ল্যাংক।
সেটা কি সম্ভব?
প্র্যাকটিস করতে হয়। প্রথমটায় হতে চায় না। ধীরে ধীরে রেগুলার প্র্যাকটিস করতে করতে ইট বিকামস ইজি।
তাতে কী হয়?
ইট ইজ এ ফ্রেশনার। মনটা ঝরঝরে হয়ে যায়, টেনশন থাকে না।
আমাকে শেখাবে?
শেখার কিছু নেই। জটিল বা শক্ত কোনও প্রক্রিয়া তো নয়। জাস্ট কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকা। মনকে কিছুক্ষণ রেস্ট দেওয়া। নাথিং এলস।
অমল এই ধ্যানে খুব আকর্ষণ বোধ করল না। তার সমস্যা অত সহজ নয়। তবু সে বলল, ও কে। আই উইল ট্রাই।
তোমার জপতপও হয়তো খানিকটা তাই। মনটাকে বাস্তব জগৎ থেকে অন্য ট্র্যাকে ঘুরিয়ে দেওয়া।
অমল আবার খুব সরলভাবে প্রশ্ন করল, তুমি কি নাস্তিক মোনা?
ভেবেই দেখিনি কখনও। তবে এখনও ভগবানকে আমার দরকার হয়নি। যখন দরকার হবে তখন নাস্তিক থাকব কি না জানি না। আই অ্যাম কিপিং মাই ফিঙ্গারস ক্রসড। কিন্তু আমি নাস্তিক হলেই বা তোমার আস্তিক হতে বাধা কোথায়?
অমল জুলজুল করে চেয়ে ছিল মোনার মুখের দিকে। এই মহিলাকে সে একদম চেনে না। বড়ই অচেনা লাগছে এখন। দুজনের মাঝখান দিয়ে এখন যেন এক নিঃশব্দ অদৃশ্য নদী বয়ে যাচ্ছে। সাঁকোহীন, কূল-কিনারাহীন, অনন্ত।
তোমার কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
নিস্তেজ হাতে কফির কাপটা তুলতেও যেন ভার লাগছিল অমলের। গরম কফি খানিকটা চলকে পড়ল তার কোলে। ছ্যাঁকা লাগল।
কফি খেয়ে একটু ঘুমোও, বুঝলে?
ঘুমোব মোনা। তুমি শোও। আই অ্যাম সরি আই ডিসটার্বড ইওর স্লিপ।
তোমারও তো ঘুম হয়নি।
মোনা গিয়ে শুয়ে পড়ল।
কফিরকাপ হাতে ভূতের মতো অভিভূত হয়ে বসে রইল অমল। জড়বৎ। কাপটা হাতে ধরা, কিন্তু চুমুক দিতেও মনে রইল না আর।
পিছনে বাগানের দিকে একটা কাশির শব্দ শোনা গেল। বাবা ফুল তুলছে।
কফির কাপটা নামিয়ে রেখে খুব সন্তর্পণে অমল এসে জানালার কাছে দাঁড়াল। বাইরে এখনও অন্ধকার। সাবধানে জানালার একটা পাল্লা খুলে সে বুক ভরে ঠান্ডা বাতাসে দম নিল। শুনতে পেল, খুব মৃদু শব্দে মোনার নাক ডাকছে। ইদানীং একটু মোটা হয়েছে মোনা, সেইজন্যই কি নাক ডাকছে? নাকি কোনও অসুখ!
হঠাৎ চমকে উঠল অমল। মনে পড়ল মোনা একদিন তাকে বলেছিল ওর কী একটা মেয়েলি অসুখ হয়েছে। অসুখের নামটা বলতে চায়নি। একজন বড় ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিল অমলকে জানিয়েই। কী অসুখ হয়েছে মোনার? তাকে বলতে চায়নি কেন? সেও তো জানতেনা চায়নি কখনও। মোনা কি মরে যাবে নাকি?
হঠাৎ ভীষণ অস্থির বোধ করল অমল। ভীষণ।
.
৭০.
তার শরীর সংকেতময়। তার স্মৃতি নেই, বোধ নেই, মস্তিষ্ক নেই, কিন্তু শরীর আছে, আছে বিভিন্ন সংকেত। অতিশয় ক্ষীণ তার দৃষ্টিশক্তি, নিজের চারধারে কয়েক ফুট মাত্র দেখতে পায়, তার বাইরে সব আবছায়া। সে কখনও আকাশ দেখেনি, দিগন্ত দেখেনি, সে চেনে না সূর্যোদয়ের বর্ণ বা জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য। সম্পূর্ণ বধির সে, কোনও সংগীত বা শব্দই সে কখনও শোনেনি। কিন্তু গাছের একটি পাতা খসে পড়লেও তার সংকেত সে শরীরের মৃদু তরঙ্গে টের পায়। পাপ বা পুণ্য, ধর্ম বা অধর্ম কিছুই নেই তার। ভাল মন্দ নেই, অবসাদ নেই, আনন্দ বা বিষাদও নেই। আছে ক্ষুধা, এবং মেটানোর জন্য শ্রম ও ক্লেশ। আছে মরসুমি প্রজননও, যা আনন্দের চেয়ে অনেক বেশি ব্যধ্যতামূলক। হ্যাঁ, তার ভয় আছে, জৈবিক ভয়, যাকে সে সঠিক চেনে না কিন্তু টের পায়।
মাটির গভীরে আঁকা-বাঁকা এক গুহাপথ পেরিয়ে অপরিসর, অন্ধকার, কবোঞ্চ এক সংকীর্ণতায় সে তার দীর্ঘ শরীর গুটিয়ে নিস্তেজ শুয়ে আছে গভীর ঘুমে। স্বপ্নহীন এক অসাড় ঘুম। বাইরে শীত। তার শীতল রক্তের শরীরে শীতের সংকেত ধরা পড়লেই তাকে গভীর গুহায় চলে যেতে হয়। মরণের মতো ঘুম জড়িয়ে ধরে তাকে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা লোপ পায়, ধীর হয়ে যায় রক্তের প্রবাহ, বিলম্বিত স্পন্দনে শরীর স্তিমিত হয়ে যায়। উপরে উত্তরের শীতল বাতাস বয়ে যায়, সে তার পাতালঘরে শরীরের অমোঘ সংকেতে শুয়ে থাকে। যখন শীত ঋতু শেষ হবে, উত্তপ্ত হয়ে উঠবে চরাচর তখন এই গহীন গভীর গহ্বরে ঠিক সংকেত আসবে শরীরে, ওঠো! জাগো! দীর্ঘ উপবাস ভঙ্গ করো, ছাড়ো খোলস, বয়ে যাও জলের ধারার মতো। গভীর ঘুমের ভিতর থেকে সে সংকেত পায়, জেগে উঠবার আর দেরি নেই।
তুমি হাত দেখতে পারো সুদর্শনদা?
আমার দোষ কী জানো দিদি? সব জিনিসই একটু একটু জানি। কোনওটাই পুরোপুরি জানি না। শেখার কি আর সময় পেলুম! একটা জিনিস হয়তো সবে মন দিয়ে শিখতে লেগেছি অমনি সেখান যে পাততাড়ি গোটাতে হল। আর শেখা হল না।
আহা, যা জানো তাতেই হবে। বলো না আমার হাত দেখে, পরীক্ষায় কেমন হবে।
ওসব কি বলতে পারি। পয়সাখখার জ্যোতিষীরা ওসব বলে থাকে। খানিক ফলে, খানিক ফলে না। আন্দাজে বলা তো। ও ব্যাটারা জানেও না কিছু। তবে তোমার হাতের রেখা-টেখা ভাল, খারাপ হওয়ার কথা নয় দিদি।
যাঃ, ওরকম বললে হবে না। বেশ ভাল করে দেখে বলো।
বললুম তো, পরীক্ষায় কী হবে তা বলার মতো এলেম আমার নেই। ভার্গব জ্যোতিষীর কাছে শিখছিলুম একটু-আধটু। চেঁটিয়া লোক, সহজে তার কাছ থেকে বিদ্যে বের করা যায় না। শেখানোর জন্য বিস্তর ঝোলাঝুলি করতে হয়। তাও মাল ছাড়তে চায় না কিছুতেই।
ভার্গবটা কে?
নারায়ণগড়ের নাম শুনেছ?
না তো! সেটা আবার কোথায়?
খড়্গপুর থেকে কাঁথির রাস্তায়। বর্ধিষ্ণু গাঁ।
তুমি সেখানেও ছিলে নাকি?
বছরটাক থাকতে হয়েছিল। সেখানকার ইস্কুলে আমার এক মামাতো ভাই ছিল মাস্টারমশাই। কোথাও সুবিধে হচ্ছিল না বলে তার কাছে গিয়ে জুটেছিলাম। সে তখনও বিয়ে-টিয়ে করেনি, দিব্যি ছিলাম দু ভাইয়ে। ইস্কুলেরই অফিসঘরে রাতে বিছানা করে শুতুম। আমার কাজও জুটে গিয়েছিল। হোস্টেলে রান্না করতুম দু বেলা।
তোমার বেশ কালারফুল লাইফ, না সুদর্শনদা?
সুদর্শন লাজুক হেসে বলে, তা বটে দিদি। পেটের দায়ে ঘুরেছি বটে, কিন্তু তাতে ঠকিনি। মেলা মানুষ দেখেছি, মেলা দৃশ্য, কত কাণ্ডকারখানা। মাঝে মাঝে একা একা বসে সেসব খুব ভাবি।
নারায়ণগড়ে কী হয়েছিল বললে না?
হ্যাঁ, সে কথাই বলি। ইতিহাসের মাস্টার ছিলেন কামাক্ষাবাবু। বিষয়ী লোক। জমিজিরেত ছিল। সুদ আর বন্ধকীর কারবার করে বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছিলেন। কঁথিতে একটা সোনার দোকান করে বড় ছেলেকে বসিয়ে দিলেন। ওসব লোকেরই আবার জ্যোতিষীর দিকে টান থাকে খুব। সব রক্ষে হয় কিনা, কারবার আরও বাড়ে কিনা, বিপদ-আপদ হয় কিনা, নানা দুশ্চিন্তায় ভোগে তো। তা তার বাড়িতেই এসে থানা গাড়ল ওই ভার্গব জ্যোতিষী। সবাই বলত মস্ত সিদ্ধাই। তা বলব কী দিদি, দু-চারটে মোক্ষম কথা বলেও ফেলত। নিমাই জানার গোপন রোগ ছিল, কেউ জানত না, ফস করে পাঁচজনের সামনে ভার্গব ফাঁস করে দিলে। গুণধরবাবু তার বউকে নিয়ে গিয়ে সবে পেন্নাম করে বসেছেন, ভার্গব বলল, উটি কে গো তোমার সঙ্গে গুণধর? গুণধর বলল, আজ্ঞে আমার বউ। ঘন ঘন মাথা নাড়া দিয়ে ভার্গব বলল, ও তোমার বউ হতে যাবে কেন, ও তো অন্যের বউ। কী লজ্জার কথা বলো পাঁচজনের সামনে! কিন্তু বউটা তখন হাউরেমাউরে করে কেঁদে গিয়ে ভার্গবের পায়ে পড়ল। তখন জানা গেল, সে সত্যিই বালেশ্বরে স্বামী সন্তান ছেড়ে গুণধরের সঙ্গে দশ বছর আগে পালিয়ে এসেছিল।
এরকম একজন জ্যোতিষীই তো আমার এখন দরকার।
জ্যোতিষী বললে ভুল হবে। এ হল সিদ্ধাই, বুঝলে?
সিদ্ধাই আবার কী?
সে আছে। তুমি অত বুঝবে না। নিচুতলার সাধক আর কী। ওই যেসব মারণ-উচাটন, বশীকরণ করে ওরাই হচ্ছে সিদ্ধাই। পয়সার লোভে, মেয়েমানুষের লোভে শেষ অবধি স্বখাত সলিলে ডুবে যায়।
ভার্গবেরও কি তাই হয়েছিল?
তা জানি না দিদি। তবে ওরকমই হয় বলে শুনেছি। ওদের পাল্লায় যারা পড়ে তাদেরও ভাল হয় না। আমিও একটু পড়েছিলাম কিনা।
তুমি কীভাবে পড়লে?
আমিও গিয়ে জুটেছিলাম তার কাছে। বেশি কিছু আদায় করতে পারিনি ঠিকই, তবে লোকটা আমাকে হাত দেখতে শিখিয়েছিল। বেশ শিখেওছিলাম খানিকটা। একদিন আমাকে বলল, দ্যাখ, এসব কিন্তু ফক্কিকারি। খানিক মিলবে, খানিক মিলবে না। এ বিদ্যে কেউ পুরোটা জানে না। খানিকটা খানিকটা জেনে ওপরটা ওপরটা বলে। তোকে যেটুকু শিখিয়েছি তাই দিয়ে করেকন্মে খেতে পারবি। যা, লেগে যা।
তুমি কি জ্যোতিষীগিরিও করেছ নাকি?
না দিদি। সেসব করিনি। অন্তত পয়সা রোজগারের জন্য করিনি। নারায়ণগড় থেকে আমাকে পালাতে হল।
ওমা! কেন?
সে তোমাকে বলা যাবে না।
কেন বলা যাবে না?
ওসব কথা তোমার শোনার মতো নয়।
বুঝেছি।
কী বুঝলে দিদি?
বোধহয় কোনও মেয়ের পাল্লায় পড়েছিলে, তাই না?
খুব লজ্জা পেয়ে সুদর্শন বলল, ওরকমই ধরে নাও।
আহা, যখন ধরেই ফেলেছি তখন বলেই দাও না।
তুমি তো ছোট মেয়ে, তোমার কাছে কি ওসব বলতে আছে?
খুব খারাপ কথা নাকি?
না দিদি, খুব খারাপ কিছু নয়। আমি বরাবর ধর্মভীরু মানুষ। তবে বুদ্ধিটা কাঁচা। নানারকম ফেরে পড়ে নাকাল হতে হয় বুদ্ধির দোষে।
তাহলে বলতে দোষ কী?
আমি তো আহাম্মক, সবাই জানে। আর সেজন্যই ভবঘুরেমিও কাটল না আমার। তা এ সেই আহাম্মকিরই গল্প, বুঝলে?
আর ভূমিকা করতে হবে না। বলো তো!
নারায়ণগড়ে যে ইস্কুলে আমি কাজ করতাম সেটাতে ছেলে মেয়ে একসঙ্গে পড়ত। গাঁয়ের মেয়ে তো, সব বেশি বয়সে ছোট ক্লাসে পড়ত। একটা মেয়ে ছিল বেবি। ক্লাস নাইনে পড়ত। দেখতেও বেশ ছিল। স্কুলের দফতরির যক্ষ্মা হওয়ায় সে তখন দেশে গেছে। আমিই তার কাজ চালিয়ে নিচ্ছি তখন। ক্লাসে রোল খাতা বা নোটিশ নিয়ে যাওয়া, ঘন্টা মারা থেকে বাগানে ঢুকে-পড়া গোরু-ছাগল তাড়ানো অবধি। তখন উঠতি বয়স, চেহারাখানা খারাপ ছিল না। তা ওই মেয়েটা একটু ঘুরঘুর করতে লাগল। ইস্কুল ছুটির পর একটা ভাইঝিকে কোলে নিয়ে চলে আসত ইস্কুলের মাঠে বেড়াতে। কথাটথা হত।
বাঃ, বেশ রোমান্টিক ব্যাপার তো।
ভারী লজ্জা পেয়ে সুদর্শন বলল, কাঁচা বয়সের ব্যাপার তো, তাই বলতে চাইছিলাম না।
আরে দুর, এসব আজকাল জলভাত।
হ্যাঁ, তা ওই একটু ভাবসাব মতো হয়ে গিয়েছিল। তারাও বড্ড গরিব।
ব্রাহ্মণ ছিল কি মেয়েটি?
না না, তন্তুবায়।
কিন্তু তুমি যে আবার সাংঘাতিক শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণ।
ওই তো বললাম, কঁচা বয়সে কি আর হিসেব থাকে?
তারপর কী হল?
গাঁ-দেশ তো, গাছের পাতা পড়লেও পাঁচকান হয়ে যায়। সুতরাং মেয়ের মা বাপ এসে ধরল আমায় বিয়ে করতে হবে।
রাজি হলে বুঝি?
গাঁইগুঁই করেছিলাম। বংশে কেউ অন্য জাতে বিয়ে করেনি, ঘরে কথা হবে। কিন্তু সবাই এমন ধরে পড়ল যে না বলতে পারিনি। এমনকী হেডমাস্টার বলল বিয়ে করলে চাকরি পাকা করে দেবে। তাই লোভে পড়ে নিমরাজি হতে হল। এরকম যখন অবস্থা তখন ভার্গব গোঁসাই গাঁয়ে জমিয়ে বসেছে। সেই সময়কারই ঘটনা। তুমি কি মানো দিদি, যে, ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই সব ঘটে?
তাই হবে বোধ হয়।
যাই হোক, এক বর্ষাকালে ভোরবেলা উঠে শুনলাম বেবিকে রাতে সাপে কেটেছে।
ইস! মরে গেল নাকি?
না দিদি। মরেনি। রাত দশটা না এগারোটায় সাপকাটি হওয়ায় তারা গিয়ে ভার্গব গোঁসাইকে ধরে আনে। আর ভার্গব গোঁসাই নাকি সাধনপ্রক্রিয়া করে বিষ টেনে নিয়েছে নিজের শরীরে। গাঁয়ে হইচই, বেবিদের বাড়িতে লোক ভেঙে পড়েছে। কিন্তু সাপকাটি আমি খুব ভাল চিনি। আদাড়ে-পাদাড়ে ঘুরে এসব জ্ঞানগম্যি ভালই হয়েছে। সাপুড়েদের সঙ্গেও তো কম টো-টো করিনি। সাপ ধরতেও পারি।
অবাক হয়ে পান্না বলে, পারো?
সোজা ব্যাপার দিদি, সাহস করলেই শেখা যায়।
ধরেছ কখনও?
অনেকবার।
মন্ত্রতন্ত্র আছে, না?
আছে, তবে সেগুলো কোনও কাজের নয়। আসল কথা হল, কায়দা কৌশল রপ্ত করা। নইলে মন্তর জানলে কিছু হবে না।
বেবির বাড়িতে গিয়ে কী দেখলে?
সে খুব সাংঘাতিক ব্যাপার। বেবিকে কলাপাতায় শোয়ানো হয়েছে। চোখ বোজা। মুখ টুখ কেমন যেন ফোলা আর লাল। পায়ে বাঁধন। কাটির জায়গাটা কী একটা পাতা দিয়ে ঢেকে রেখেছে। প্রথমে একটু থতমত খেলেও আমার একটু সন্দেহ হল। ওর মাকে বললাম, কাটার জায়গাটা দেখাতে। তা তিনি বললেন, ভার্গব গোঁসাই নাকি নিষেধ করে গেছে। হাওয়া লাগলে খারাপ হবে। কিন্তু সাপকাটির কেস আমি অনেক দেখেছি। বিষধর কামড়ালে অন্য চেহারা হওয়ার কথা। তারপর শুনলাম গভীর রাত অবধি নাকি ঘর বন্ধ করে ভার্গব গোঁসাই কীসব প্রক্রিয়া করেছে। শুনে মাথাটা একটু গরমই হয়ে গিয়ে থাকবে। নিষেধ না শুনে আমি এক ঝটকায় পাতাটা সরিয়ে দেখলাম চারটে দাঁতের দাগ। বিষধর নয়, জলঢোঁড়া বা হেলে কিছু একটা কামড়েছে। কিন্তু সেকথা বলবই বা কাকে বলে! বাড়িসুষ্ঠু লোক ভার্গব গোঁসাইয়ের কেরানি দেখে একেবারে ভাবে ভোর হয়ে আছে। এত বড় গুণীন যে আর হয় না তা গাঁয়েও বলাবলি হচ্ছে। তা সে না হয় তোক। সব বজ্জাত গুণিন আর ওঝা তো এভাবেই হাতযশ বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু আসল কাণ্ড হয়ে বসেছে অন্য জায়গায়। আর সেটাই তোমাকে বলা যাবে না।
পান্না একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, তুমি না বললেও বুঝেছি।
বুঝেছ? ও বাবা, তোমার খুব বুদ্ধি।
এ আর না বুঝবার কী আছে। বেবিকে ভার্গব গোঁসাই রেপ করেছিল তো!
বড় লজ্জার কথা দিদি। পাষণ্ডটা নাকি বুঝিয়েছিল ওটাও একটা প্রক্রিয়া।
বেবি কথাটা বিশ্বাস করেছিল বুঝি?
গাঁয়ের মেয়ে, মাথায় তো বুদ্ধির ব-ও নেই। তার ওপর সাপের কামড়ে মাথাটারও ঠিক ছিল না। বুদ্ধিনাশ হলেই তো মানুষের সর্বনাশ কিনা। আমি রোজ সকালে জপতপের পর ঠাকুরের কাছে একটা জিনিসই চাই। বুঝলে! শুধু বলি, বাবা, আপৎকালে যেন বুদ্ধিনাশ না হয়, দেখো। বুদ্ধিনাশাং প্রণশ্যতি।
তুমি লোকটাকে কিছু বললে না?
না দিদি। আমি মাথা-পাগলা লোক বটে, কিন্তু মাথা-গরম মানুষ নই। আমি যেন দেখতে পেলাম এই ঘটনার ভিতরে আমার মুক্তির পথ খুলে গেছে। যা কিছু সব ঈশ্বরের ইচ্ছেতেই তো ঘটে।
মেয়েটাকে ফেলে পালালে বুঝি! ছিঃ সুদর্শনদা, তাহলে কিন্তু তোমাকে ভাল লোক বলা যায় না। তোমার উচিত ছিল মেয়েটাকে উদ্ধার করা।
ভাল লোক আর হতে পারলাম কই বলো! আর এ কথাও ঠিক যে পালানোর ইচ্ছেও ছিল। সেটা বুঝতে পেরেই বোধহয় পাঁচজনে আমাকে চেপে ধরল, শুভস্য শীঘ্রম, তাড়াতাড়ি বিয়ে সেরে ফেলতে হবে। ভার্গব গোঁসাইও খুব চাপাচাপি শুরু করল। বেবিও খুব গোঁ ধরল। শেষে আমি পালাতে পারি ভেবে আমাকে ইস্কুলের এক ঘরে শেকল তুলে রাখা হতে লাগল। দিনরাত চোখে চোখে রাখা হত।
ও বাবা! তুমি কী করলে?
কী আর করব দিদি? ওই অবস্থায় তো করার কিছু ছিল না। শুধু ভগবানকে ডাকতে লাগলাম। বললাম, ঠাকুর, বুদ্ধিনাশ যেন না হয়। চারদিন বাদেই বিয়ে। একদিন ভার্গব গোঁসাই এসে চোখ পাকিয়ে বলে গেল, পালিয়েও বাঁচবি না, আমার অভিসম্পাত তোকে ধাওয়া করবে। রক্তবমি হয়ে মরবি। আমি বললুম, কিন্তু আমার দোষটা কী? সে বলল, দোষ নয়? বাগদত্তাকে বিয়ে না করলে সে মহাপাতক হয়। তখন আমি বলেই ফেললাম, গোঁসাই, মেয়েটাকে তো বিষধর কামড়ায়নি, কামড়েছিল ঢোঁড়া, বিষধর কামড়ালে কী করতে ওস্তাদ? পারতে বিষ নামাতে? লোকটা কী বলল জানো? এক গাল হেসে বলল, পারতাম না। কিন্তু তাতে কী? লোকে তো জানে আমি পারি। ওতেই হবে। তারপরও আমি বললাম, মেয়েটাকে নষ্ট করলে কেন? তার জবাবে বলল, ওরে, শিবের এঁটোকে এঁটো ধরতে হয় না।
কী বদমাশ।
হ্যাঁ দিদি। বদমাশ বটে, তুখোড় বুদ্ধিমানও বটে।
তুমি কী করলে?
ওই যে বললাম, ভগবানকে ডাকতে লাগলাম। সেই রাতে সৃষ্টিছাড়া বৃষ্টি নামল। বুঝলে দিদি, ভগবানের ওপর নির্ভর করে দেখো, কেমন সব অশৈলী কাণ্ড হয়।
আহা, তোমার কী হল তাই বল না।
বৃষ্টির তোড়ে চারদিক ডুবে গেল। আশপাশের লোক বাড়িঘর ছেড়ে এসে উঁচু স্কুলবাড়িতে উঠল। আমার ঘরের দরজায় শেকল তুলে পলকা একটা তালা দিয়ে রেখেছিল। তারাই সব শেকল-টেকল উপড়ে ঢুকে পড়ল ঘরে। মেলা লোক। সেই রাতে আর পালানো হল না ঠিকই। কিন্তু ডামাডোলে খুব সুবিধে হয়ে গেল। দু দিন বাদে জল নামতেই খঙ্গাপুরের বাস ধরে একরাতে পালিয়ে এলাম। আর ওমুখো হইনি।
কিন্তু মেয়েটার কী দোষ বলো!
দোষঘাটের কথা নয় দিদি। আমিই কি আর ভাল? তবে সব ঘটনা থেকেই একটু একটু শিক্ষা নিতে হয়।
হ্যাঁ সুদর্শনদা, হাত দেখার কথাই তো হচ্ছিল। দেখই না বাপু হাতখানা আমার। থাক দিদি, দিনের বেলা দেখে দেবখন। চালসে ধরার পর সন্ধে লাগলেই চোখটা একটু ধোঁয়াটে মেরে যায়। তবে আগেই বলে রাখছি, ও বিদ্যে আমার পুরো জানা নেই।
বলে সুদর্শন উঠতে যাচ্ছিল, এক গাল হেসে বলল, ওই দেখ কে এসেছে! এসো দিদিমনি এসো! সেদিনকার মতো বেগুনি খাবে নাকি?
সোহাগ হেসে বলল, আমি বেশ পেটুক হয়ে গেছি আজকাল, না? সেদিন বড়মাও বলছিল, আমার নাকি আজকাল খুব রুচি হয়েছে। আসলে সোজাসুজি পেটুক বলছে না, মিন করছে।
পান্না গায়ের কাঁথাটা সরিয়ে উঠে বসল, তোমার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলাম। কখন এসেছ?
কাল রাতে।
ওমা! আজ সারাদিন কেটে গেল, খবর দাওনি তো!
আজ সকাল থেকে পিসির সঙ্গে অনেক কাজ করেছি। পিসি খুব লোনলি তো। সারা সপ্তাহ আমার জন্য অপেক্ষা করে। আজ দুজনে মিলে অনেক কিছু করলাম।
কী করলে?
তিন চার রকমের আচার, মশলা পাঁপড়, হজমিগুলি। খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।
তোমার সঙ্গে এখন সন্ধ্যাপিসির খুব ভাব, না?
হ্যাঁ। খুব। শি ইজ ভেরি লাভিং। আমাকে অনেক কিছু দিতে চায়।
কী?
ঘড়ি, গলার হার, নিজের সব গয়না। আমি বলি, ওসব এখন থাক। তুমি বুড়ো হলে নেব।
বোসো সোহাগ।
বসাই যাক। না বসে উপায় আছে?
ই-মেল পেয়েছ বুঝি?
হ্যাঁ তো। বলে মুখ টিপে হাসল সোহাগ।
এবারও ই-মেল কি সাংকেতিক?
তা ছাড়া কী? ওনলি ডেট অ্যান্ড টাইম।
তোমরা যেন কী! কেউ এক পা এগোবে না, একটুও আবেগ বা উচ্ছ্বাস নেই, কথাও তো বলো না। তোমাদের মধ্যে কী হচ্ছে বলো তো!
কী আবার হবে! কিছু হচ্ছে না। কোনও বোকা-বোকা ব্যাপার তো আমার সহ্য হয় না।
সে না হয় বাড়াবাড়ি না করলে, কিন্তু একটু মনের কথা জানাবে তো! নির্জনে গিয়ে দুজনে একটু বসতেও ইচ্ছে হয় না?
সোহাগ ফের সেইরকম মিষ্টি হেসে বলল, তাতে কী হবে? শুধু কতগুলো সিনেমাটিক ডায়ালগ। ও আমার অসহ্য।
বিজুদাটাও ঠিক তোমার মতো। এক জন্ম দেখে আসছি, কোনও মেয়েকে দেখেই কখনও হেলদোল নেই। একদম আনরোমান্টিক। এই প্রথম অনেক সাধ্যসাধনার পর দেখলাম তোমাকে অপছন্দ করছে না। কিন্তু রোমান্সের কী ছিরি বাবা। যেমন দেবা তেমনি দেবী।
রোমান্সের কথা আসছে কেন? উই আর নট ইন লাভ।
উঃ, এমনভাবে বোলো না তো! আমার বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ির ঘা এসে পড়ে।
তুমি ভীষণ রোমান্টিক, না পান্না?
ওঃ, আমি যদি প্রেমে পড়ি তাহলে কথা বলে বলে তাকে পাগল করে দেব।
আর কী করবে?
নির্জনে গিয়ে বসব দুজনে, গল্প হবে, কথা হবে, কবিতা হবে, কোনও অসভ্যতা হবে না অবশ্য।
অসভ্যতা বলতে?
শরীর ছোঁয়া, চুমু এইসব।
ওসব অসভ্যতা বুঝি?
না হলেও স্থূল রুচির ব্যাপার। আবেগ ভাল, কিন্তু শরীর নিয়ে নয় বাবা।
তুমি একটু পিউরিটানও আছ।
হ্যাঁ। আমার আবার দুমদাম শরীরের লজ্জা ঝেড়ে ফেলতে আপত্তি আছে। কিন্তু তুমি তো আরও পিউরিটান।
না, পিউরিটান নই, আসলে ভসভসে আবেগ আমার একদম ভাল লাগে না। দেখবে দুজনে প্রেম করার সময় কত ভসভসে কথা বলে, বিয়ের পর তিন মাসও টিকতে পারে না। কেন জানো?
ওদের কোনও ইন্টিগ্রিটি নেই।
তার মানে কী আমাকে বুঝিয়ে দেবে?
মানে বুঝতে হলে তোমাকে সমাজবিজ্ঞান জানতে হবে। জানতে হবে মানুষের ইতিহাস। মানুষ কেন একস্ট্রিম ফ্রিডম থেকে জংলি জীবনে পরিবার, বিয়ে আর সমাজের দিকে ঝুঁকল তা জানো?
বলো না শুনি?
সেটা নরনারীর প্রেম থেকে নয়। প্রয়োজনে। তখন এরকম প্রেম-ট্রেম হত না তো। তার দরকারও ছিল না। দরকার ছিল বিশ্বস্ততা, দায়বদ্ধতা আর পারস্পরিক নির্ভরতার। একটা পরিবারের ভিতে প্রেমের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন এই তিনটে জিনিসের। মানো?
সে না হয় মানছি। কিন্তু একটু আবেগও থাকবে না, তা কি হয়?
ওই তিনটে না থাকলে আবেগটা বড্ড জোলো হয়ে যায়।