৬৬-৬৭. যতদিন না রাবু নিরাময় হচ্ছে

৬৬.

যতক্ষণ বা যতদিন না রাবু নিরাময় হচ্ছে তদ্দিন শহরের ডাক্তারটি থেকে যাবে, এই ঠিক হল।

একদা যে ঘরটিতে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ত ওরা সে ঘরটিই খুলে দিল মালু। বিছানা পেতে দিল ডাক্তারের জন্য। টেবিলটা সাফ করতে গিয়ে হঠাৎ অতীতটার সাথে দেখা হয়ে গেল মালুর। দেরাজের ভেতর বাল্যশিক্ষা, ধারাপাত। নাম লেখা–আবদুল মালেক। বড় বড় বাঁকা তেড়া হস্তাক্ষর, এখনো পড়া যায়। আরো বই–গণিতের, পদ্যের, মালু রাবু আর আরিফার নাম লেখা।

অতীত বিরোধী মন মালুর। পদে পদে অতীতের শৃঙ্খল ভেঙে অতীতটাকে অস্বীকার করে চলতে হয়েছে ওকে, অথচ অতীত ওকে বার বার টেনে নেয় নিজের দিকে। অতীতের স্মৃতি আর মানুষগুলোকে জীবনের বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে ফেলতে পারেনি মালু। আজও কী এক জাদুর মায়ার মতো অতীত যেন হাতছানি দিয়ে গেল ওকে।

হ্যাঁ। সুন্দর ছিল সেই উদাম দিনগুলো। এত মৃত্যু ছিল না। এক কাপ চা খাওয়াতে পারবেন?

হঠাৎ ডাক্তারের কথায় অতীত থেকে উঠে এল মালু। বলল : হ্যাঁ। নিশ্চয়।

হ্যাঁ তো বলল। কিন্তু কোথায় চা, কোথায় চিনি। কোথায় উনুন। দুপুরে তো খাবারই প্রবৃত্তি ছিল না, না মালুর, না জাহেদের। হুরমতির খেয়াল নেই কোনো দিকে। পানি আনছে মিশ্রী ভাংছে সরবত তৈরি করছে রুগীর জন্য। বাকী সময়টা বসে থাকছে রাবুর পাশে। পাক ঘরে উনুন জ্বলেনি আজ। কিন্তু সেকান্দর মাস্টার শহর থেকে ফিরে এসেই উনুন ধরিয়েছিল। বার্লি করেছিল রাবুর জন্য। ফুটিয়ে নিয়েছিল চারটে আলু-ভাত। তারপর জাহেদকে সুমুখে পেয়ে খেঁকিয়ে উঠেছিল : বুদ্ধি সুদ্ধি লোপাট পেয়েছে নাকি? মেয়েটার তো আল্লায় জানে কী হবে। নিজেও কী অসুখ বাধাবে? যাও দুটো খেয়ে আস।

বড় দালানের পেছনে ভেতরে বাড়ির উঠোন। উঠোনের পর রসুই ঘর।

রসুই ঘরে পৌঁছে মালু দেখল তুলকালাম কাণ্ড বেধে গেছে। চাল ডাল ছিটিয়ে হাঁড়িপাতিল লণ্ডভণ্ড করে অগ্নিমূর্তিতে দাঁড়িয়ে দরবেশ। চা নেই। নাস্তা নেই। ক্ষিধেয় প্রাণ যায়। এ বাড়িতে মানুষ থাকে? চেঁচিয়ে চলেছে উত্তেজিত দরবেশ।

উনুনের সুমুখে বসে চামচ দিয়ে বার্লি নাড়ছে হুরমতি। পাশে দাঁড়িয়ে সেকান্দর। মুখ না ঘুরিয়েই বলল সেকান্দর, কেন রাগছেন দরবেশ চাচা? কে আপনাকে চা করে দেবে? দেখছেন না গোটা বাকুলিয়া আজ বিরানা। বসন্তের ভয়ে দাসী চাকর সব পালিয়েছে। কেউ নেই বাড়িতে। হুরমতি রাবুকে নিয়ে ব্যস্ত। দেখছেন না?

পালাবেই তো। আল্লা নেই খোদা নেই, যতসব মনহুসের আচ্ছা, এ বাড়িতে মানুষ থাকবে কেমন করে? খোদার কহর পড়বে এ বাড়িতে, আমি বলিনি? আমি বলিনি বিরানা হবে, ছারেখারে যাবে এ বাড়ি?

দরবেশ চাচা! অভিসম্পাতের গলাটা অন্তত আজকের দিনের জন্য থামাবেন? বাড়িতে অসুখ, দেখতে পাচ্ছেন না? অনুনয়ের স্বরেই বলল সেকান্দর। তারপর হুরমতির হাত থেকে বার্লিটা নিয়ে ঢালল বাটিতে। ঠাণ্ডা করার জন্য বাটিটা বসিয়ে দিল গামলা ভর্তি পানির উপর। চামচ দিয়ে নেড়ে চলল ঘন ঘন। অসুখ না ভড়ং। ওই মেয়েকে চিনি না আমি? কম ভড়ং ছিল নকি ওর মার? ফ্যাঁস ফ্যাঁস কান্না, এই বেহুঁশ, এই বিলাপ। এই কথা বন্ধ। দরজা বন্ধ। সেই মায়ের মেয়ে তো? করতে চায় না স্বামীর ঘর, যেতে চায় না শ্বশুর বাড়ি তাই ভড়ং ধরেছে। আমি বুঝি না ওসব?

কিন্তু, ও সব শয়তানী ভড়ং ছুটিয়ে দেবার দাওয়াইটাও আমার জানা আছে। কথার সাথে সাথে দরবেশের মুখের থুথুগুলোও ছিটিয়ে পড়ে চারিদিকে।

দপ করে জ্বলে উঠল সেকান্দর। চুপ করবেন দরবেশ চাচা? ক্ষিধে পায় তালতলি চলে যান। সেখানে রমজানের বাড়িতে আজ মোল্লা খাওয়াচ্ছে। এ বাড়িতে ভাত চা কোনো কিছুই মিলবে না আজ।

অদ্ভুতই বটে, সেকান্দর মাস্টারকে ভয় করে দরবেশ। ওর ঝামটা খেয়ে চুপ করে যায়। গুটি গুটি বসে পড়ে একটা জলচৌকির উপর।

বার্লির বাটিটা নিয়ে বেরিয়ে যায় সেকান্দর।

যাকে ঘৃণা করা যায় বেশি তার উপরও বুঝি মায়া হয়। কেমন মায়া হল মালুর। সারাদিন পেটে কিছুই পড়েনি। সন্ধ্যার দিকে খেয়েছে চারটে আলু ভাত। এখন রাত। ক্ষিধে তো পাবেই। বলল মালু : আপনি ঘরে যান দরবেশ চাচা। আমি চা করে আনছি।

ডাক্তার আর দরবেশকে চা খাইয়ে ভাত আর ডালের পানি চড়িয়ে দিল মালু। পানিটা ফুটলে চালের সাথে কয়েকটা আলুও ছেড়ে দিল মালু। আর অতিথি ডাক্তারের জন্য একটা আণ্ডা। হুরমতি শুধু একবার দেখে গেল। কিছু বলল না। একটা লাকড়িও এগিয়ে দিল না মালুর দিকে। চুলোর ভেতরে আমের শুকনো লাকড়ি কেমন ফড় ফড় কাপড় ফাটার আওয়াজ তুলে জ্বলছে। লাল ছুরির মতো লিকলিকে শিখাগুলো যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে উনুনের অবরোধ ভেঙে। রসুই ঘরের দেয়ালে সে শিখার ছায়া পড়ছে। উজ্জ্বল হচ্ছে ঘরটা! বড় আর লম্বা হচ্ছে ছায়ারা। তারপর কেঁপে কেঁপে আবার কোনো আবছা অন্ধকারের অস্পষ্টতায় মিলিয়ে যাচ্ছে ছায়াগুলো।

একটা দীর্ঘ শিখার কম্পিত প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেল মালু।

ক্ষীণ কোনো আশার মতো একটি সন্দেহ বুঝি ছিল জাহেদের মনে। হয়ত স্বাভাবিক জ্বর। অতি খাটুনি আর অল্প ঘুমে দুর্বল হয়েছিল শরীরটা। তাই এমন কাবু করেছে জ্বর।

কিন্তু, দ্বিতীয় দিনে আর কোনো সন্দেহই রইল না। বসন্তের গুটি বেরিয়েছে রাবুর গা ফুঁড়ে।

ডাক্তাররা হার মানল না। আশা ছাড়ল না আপন মানুষ। আরো ডাক্তার এল। ঢাকা থেকে এল নামী ডাক্তার। লড়াই চলল মৃত্যু আর জীবনে। যন্ত্রের মতো নিষ্প্রাণ নির্জীব হয়ে রইল জাহেদ। যন্ত্রের মতোই হাঁটে, বসে, রাবুকে ওষুধ খাওয়ায়, রাবুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

কেন এমন ভেঙে পড়েছ মেজো ভাই। আমি বলছি সেরে উঠবে রাবু আপা। সান্ত্বনা দেয় মালু।

মালুর সান্ত্বনার খোঁচায় সংযমের কৃত্রিম বাঁধটা বুঝি ভেঙে যায়। ডুকরে কেঁদে উঠে জাহেদ। বাড়ি বাড়ি ঘুরে যে সান্ত্বনা দিল সেবা দিল এ্যাদ্দিন, তাকেও কবরে রেখে আসতে হবে? অসম্ভব। অসম্ভব। শিশুর মতো কাঁদে আর চিৎকার করে জাহেদ।

আরো দুটো দিন কেটে যায় উদ্বেগ আশঙ্কায়।

দেখেছ? এমন বেদিল অমানুষিকতা দেখেছ কখনো?

উত্তেজিত সেকান্দর। হাজার গণ্ডা আজরাইলের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বুঝি ওর উত্তেজনার শেষ হবে না। সারাক্ষণ চটে আছে ও। সারাক্ষণ একটা না একটা বিক্ষোভের উপলক্ষ সৃষ্টি হচ্ছে ওর জন্যে। এই মুহূর্তে ইন্ধন যুগিয়েছে দরবেশ।

দরবেশের অপরাধ ভাত চেয়েছে। সময় মাফিক ভাত না পেয়ে চেঁচামেচি শুরু করেছে আর হুরমতিকে কাঠের চেলা ছুঁড়ে মেরেছে।

দিনরাত খালি খাই খাই…এদিকে মেয়েটা মরছে। দেখতে এল একবার? জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না কেমন আছে মেয়েটি। মানুষ তো নয় সীমার, জানোয়ার। জাহেদকে নির্বাক দেখে বুঝি বেড়ে যায় সেকান্দরের রাগের মাত্রাটা।

সারা রাত জেগেছে জাহেদ। ভোরে মালু আর হুরমতিকে রাবুর ঘরে বসিয়ে সকাল ধরেই একটু ঘুমের চেষ্টা করছে। ঘুম নেই। চোখ দুটো টনটন করছে। মাথার ভেতরে কী যেন টগবগিয়ে ফুটছে সারাক্ষণ। মাথাটাকে ছিঁড়ে ফেলতে পারলেই হয়ত একটু আরাম পেত।

দোহাই তোমার, সেকান্দর একটু চুপ কর। দু আঙ্গুলে কপালের রগ দুটো টিপে ধরে বলল জাহেদ।

মেজো ভাই, রাবু আপা ডাকছে। ভেসে এল মালুর গলা।

চমকে উঠল জাহেদ, সেকান্দর। বাকুলিয়ার ঘরে ঘরে যে দৃশ্য দেখেছে ওরা রাবুর ঘরে গিয়েও কী তাই দেখবে?

না, ভয়ের কিছু নেই। ডাক্তার বলছেন, বিপদ পেরিয়ে গেছে, এখন সেরে উঠবে। ওদের আশ্বস্ত করল মালু। তারপর বলল জাহেদের দিকে তাকিয়ে, তোমাকে ডেকেছে দুবার।

ওরা এল রাবুর ঘরে।

জাহেদ দেখল ভোরে যেমন রেখে গেছিল তেমনি শুয়ে আছে রাবু। শুধু রাতভর বুজে থাকা চোখগুলো এখন খোলা। সে চোখে সহজ দৃষ্টি, একটি ক্লান্ত শান্তি।

হাতের ইশারায় ওকে কাছে ডাকল রাবু।

রাবুর পাশে গিয়ে বসল জাহেদ।

পুরো গাল হাসল সেকান্দর। বলল, এই তো, আর কী, কালই হেঁটে চলে ঘুরে বেড়াবে। ব্যাস।

এবার বাকুলিয়ায় এসে এই প্রথম সেকান্দর মাস্টারকে পুরো গাল হাসতে দেখল মালু।

চোখের সেই টনটনে ব্যথাটা কখন সেরে গেছে। মাথার ভেতরে টগবগিয়ে ফোটা সে আগুনটা কখন নিভে গেছে। সমস্ত স্নায়ুতে অদ্ভুত এক শান্তি। জাহেদের মনে হল ওর মৃত্যু হয়েছিল। এইমাত্র বেঁচে উঠল ও।

৬৭.

রাবু সেরে উঠেছে।

একটু একটু করে উঠোনে, দহলিজে হেঁটে বেড়ায় ও। মক্তব আর স্কুলের শূন্য দালানে গিয়ে বসে।

বাব্বাঃ, কী যে ভাবিয়ে তুলেছিলে, কী যে হত, হাসতে হাসতে বলল মালু।

কী আবার হত? এত লোক মরেছে, আর একজন মরত? ম্লান হেসে বলল রাবু।

সে তো দর্শনের কথা হল…

মালুর কথাটা শেষ হবার আগেই চেঁচিয়ে উঠেছে জাহেদ, থাম তো মালু। কেন বার বার খালি মৃত্যুর কথা বলছিস?

একটা বই পড়ছিল জাহেদ। বইটা বন্ধ করে ওদের পাশে এসে বসল। কেউ যদি বই বন্ধ করে জীবনের কথা শোনায় আমাদের, আমরা কী আপত্তি করব? কৌতুক নেচে গেল রাবুর চোখে।

মোটেই না। মোটেই না। উচ্চৈঃস্বরে সায় দিল মালু।

ওরা তিনজনে গলা মিলিয়ে হাসল, যে হাসি মৃত্যুকে অস্বীকার করে। তারপর ওরা শুরু করল জীবনের গল্প, মানুষের গল্প…হাঁ, তখন সমাজে শ্রেণী বিভাগ আসেনি। দলবদ্ধভাবে শিকার করত যা পেত একসাথে ভাগ করে খেত আদিম মানুষ…দলপতি ছিল একান্তভাবেই আজকের নির্বাচিত প্রতিনিধির মতো…। এলো গোষ্ঠীপ্রথা…গভীর মনোযোগে ওরা সবাই শুনছে জাহেদের কথা।

ওরা লক্ষ করেনি লেকু আর ফজর আলী কখন এসে বসেছে দাওয়ায়। ফজর আলীর সাথে ওর বিশ বছরের জোয়ান ছেলেটাও। আজই যেন প্রথম ওকে লক্ষ করল মালু।

কী খবর লেকু? শুধাল জাহেদ।

খবর ভালোই। বুড়ো কারি সাহেব ফিরে এসেছেন। চৌকিদার বাড়ি, সারেং বাড়ি, ভুঁইয়া বাড়ির সবাই ফিরে এসেছে।

ছেলেমেয়েগুলো? ওরা ফিরে এসেছে? বুঝি স্কুলের কথাই ভাবছে রাবু। তাই ওর ছাত্র-ছাত্রীদের কথাই শুধাল রাবু।

জি হ্যাঁ। ফজর আলীর ছেলেটাই জবাব দিল।

শালা শুয়রের বাচ্চা বেঈমান নাফরমান বেজন্মা বদমাইশ হারামখোর সুদখোর…।

বচনগুলো কানে এল আর ওরা চুপ করে গেল।

দাওয়ায় উঠে বগলের ছাতাটাকে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে মারল সেকান্দর। বিড় বিড়িয়ে চলল, হারামখোর বদমাইশের দল, দেশটাকে লুটেপুটে খেল। কী হল মাস্টার? শুধাল লেকু।

হবে আবার কী? যা সব সময় হচ্ছে তাই? দেখছিস না চোখে? মুখ খিঁচিয়ে লেকুর দিকেই কট মট করে তাকিয়ে রইল সেকান্দর। যেন সব দোষ লেকুর।

আহা, ব-ল-ই না, কী হয়েছে, এবার শুধাল জাহেদ।

যা সব সময় হচ্ছে তাই, বলল সেকান্দর। তালতলির হিন্দুরা চলে যাবার পর ছাত্রের অভাব, শিক্ষকের অভাব, অর্থের অভাব, এত অভাবের মুখে বন্ধই হয়ে যেত স্কুলটা, যেমন বন্ধ হয়েছে উদরাজপুর আর চাটখিলের স্কুল। বন্ধ হতে দেয়নি সেকান্দর মাস্টার। কয়েকজন ভালো মাস্টার, ওদের দেশত্যাগ করতে দেয়নি সেকান্দর, পায়ে ধরে রেখে দিয়েছে। এদিক ওদিক থেকে রীতিমতো পায়ে ধরে ধরে ছাত্র এনেছে, জাগীরের ব্যবস্থা করেছে সেকান্দর। তবে না আজ আবার গমগম করছে তালতলির স্কুল। আশপাশের পনের বিশ গ্রামের ছেলেরা এখানেই তো পড়তে আসে। ছাত্রসংখ্যা এখন চার শো। কম কথা? এই চার শোর মাঝে তিনশোই মুসলমান, সবই কৃষকের ছেলে। কম কথা?

ভেবে দেখ তো দশ বছর আগের কথা? কটা মুসলমান ছাত্র ছিল তালতলি স্কুলে?

সে তো জানি। কিন্তু এখন তুমি চটেছ কেন? ওকে বাধা দিয়ে শুধাল জাহেদ।

চটব না? ওই ওই শালা শুয়োরখোর হারামখোর….

ও? রমজানের উপর চটেছ? সকৌতুকে হাসল জাহেদ।

যখন চলছিল না স্কুলটা, ওই বদমাইশটা এক পয়সা সাহায্য দিয়েছে? উল্টো জ্বালিয়েছে সবাইকে। যেমনি জমে উঠল স্কুলটা অমনি জেঁকে বসলেন কাজি মোহাম্মদ রমজান। সেক্রেটারী হল, প্রেসিডেন্ট হল, কত-কিছু হল। মাতব্বরির তার শেষ নেই। কী আর করি। সবই সয়ে গেলাম। কত শালার লাথিই তো খেলাম জীবন ভর। থামল সেকান্দর। পকেট থেকে বের করে বিড়ি ধরাল। বিড়ির প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিল লেকুর দিকে।

তারপর? চুম্বক কথাটা কখনও সরাসরি বলে না সেকান্দর। সেটা শোনার জন্যই অধৈর্য জাহেদ।

তারপর আর কী! শালা বলে স্কুলের নাম বদলাও, নইলে টাকা দেব না। সরকারি গ্রান্ট বন্ধ করাব।

কেন? কেন বদলাবে? কী নাম দিতে চায় ও? এবার উত্তেজিত হয়েছে জাহেদ।

শ্যামাচরণ দত্ত হাই স্কুলের নাম পাল্টে নাম হতে হবে কাজী মোহাম্মদ রমজান হাই স্কুল। নইলে টাকা বন্ধ, গ্রান্ট বন্ধ। কথাটা শেষ করে বিড়িতে ফোঁক ফোঁক দুটো টান মারল সেকান্দর। বলল আবার, এবার বুঝলে?

তুমি কী বললে? শুধাল সেকান্দর। বলেছি, অসম্ভব। সেই প্রথম যে স্কুলটা গড়ল তার নাম বদলানো চলবে না। সে কী রাগ রমজানের! পারলে আস্ত খেয়ে ফেলে আমাকে।

শেষ দম টেনে বিড়ির গোড়াটা ফেলতে গিয়ে বুঝি রাবুর দিকে চোখ পড়ল সেকান্দরের। বলল, এই দেখ, স্রেফ ভুলে বসে আছি। বহুদিন পর তালতলির বাজারে একটা কোরাল মাছ পেলাম। ভালো করে রান্না করতো। একটু মজা করে খাওয়া যাক।

মাছ ভর্তি চটের লম্বা থলেটা চেয়ারের হাতলে ঝুলিয়ে রেখেছিল সেকান্দর। থলেটা রাবুর হাতে এগিয়ে দিল। বলল আবার, নদীর মাছ নদীতেই থাকে, নদীতেই মরে। ধরবে কে? সব জেলেগুলোকেই তো দেশছাড়া করেছে শুয়রের বাচ্চা রমজান।

রাবুর তদারকিতে মাছটা রান্না করল হুরমতি। সবাই একসাথে বসে খেল। তারপরই সে দাওয়ায় বসেই গল্প জুড়ল।

গল্পের ওদের শেষ নেই। তালতলির গল্প, বাকুলিয়ার গল্প, যুদ্ধের গল্প, দুর্ভিক্ষের গল্প, দাঙ্গার গল্প, ইংরেজ চলে যাবার গল্প, রমজানের মতো এই দেশটাকে যারা ভোজবাজি দেখাল তাদের গল্প, ভিটেহারাদের গল্প সব মিলিয়ে ওদের নিজেদের গল্প। ওদের এক একটি জীবন অসংখ্য কাহিনী। সে কাহিনীর সবটুকু কেউ জানে না। মালু জানে না, লেকু আর হুরমতি কেন আর কেমন করে দূর দেশে পাড়ি দিয়েছিল, কখন আর কেনই বা ফিরে এসেছে বাকুলিয়ায়। ওই ফজর আলী। এত লোক এত কিছু করছে, এত দিকে ছুটছে, কিন্তু ফজর আলী কেন মাটি কামড়ে পড়ে আছে? মালু জানে না।

রেহানী জমিগুলো কি উদ্ধার করতে পেরেছে লেকু? বাপের কাছ থেকে পাওয়া জাম কাঠের চৌকিতে শুয়ে আজও কী স্বপ্নে দেখে ও? মালু জানে না। রোদ বৃষ্টি ঝড় তুফান মাথায় নিয়ে গোটা তল্লাট জুড়ে বটবৃক্ষের মতো যে দাঁড়িয়ে আছে সেকান্দর মাস্টার, তার কথাগুলো কী সব শোনা হয়েছে? হয়ত প্রয়োজন নেই সব কথা শোনার। কেননা একই প্রাণের সূত্রে গাঁথা ওদের জীবন। ওদের স্বপ্ন ওদের আশা-ভঙ্গ, ওদের অটুট নিষ্ঠা। সব মিলিয়ে ওরা চলমান মানুষ। কোথাও থমকে দাঁড়ায়নি ওরা।

গল্পে গল্পে রাত গড়িয়ে যায়। এক সময় লেকু আর ফজর আলীরা চলে যায়।

উঠি উঠি করেও যাওয়া হয় না সেকান্দরের। এত রাতে করবে কী বাড়ি গিয়ে? ঘুমুতে হলে এখানেই তো পাতা রয়েছে তোমার বিছানা। হাতটা ধরে ওকে বসিয়ে দেয় জাহেদ।

রাশু আসছে কাল দুপুরে। কে নাকি খবর দিয়েছে ওকে, খেটে খেটে শরীর বলে কোনো কিছু আর অবিশষ্ট নেই সেকান্দরের। তাই রাশু এত্তেলা দিয়েছে দুমাস থাকবে বাকুলিয়ায়। বলতে বলতে বুঝি সেই উদ্বিগ্না বোনটির উদ্দেশে স্নেহ ঝরিয়ে হাসে সেকান্দর।

তুই এখনও বসে আছিস রাবু? আবার অসুখ বাধাবি। যা না ঘরে। এই নিয়ে তিনবার তাম্বি দিল জাহেদ।

সেই তখন থেকেই মাথায় ঘোমটা টেনে বসে বসে ওদের গল্প শুনছে রাবু। লেকু ফজর আলীরা যাবার পর ঘোমটাটা ফেলে দিয়েছে, দেয়ালে হেলান দিয়ে পা জোড়া ছড়িয়ে দিয়েছে সুমুখে।

আমরা না উঠলে সেও উঠবে না। দাঁড়িয়ে পড়ল সেকান্দর।

না না মাস্টারজী। আপনারা গল্প করুন। ঘরে চলে গেল রাবু।

থমথমে জমাট বাঁধা অন্ধকার। আকাশের তারারাও আজ হারিয়ে গেছে অন্ধকারের আড়ালে। বিছানায় গা এলিয়েই নাক ডাকছে সেকান্দর। জেগে আছে জাহেদ আর মালু।

আশ্চর্য! এমন সময় রিহানার কথাটা মনে পড়ল? অপমান, ধিক্কার, লজ্জা। আর সেই সাথে কী এক যন্ত্রণা। অন্ধকারেই মুখ ঢাকল মালু। সব ক্ষতই শুকিয়ে যায়। রিহানার ক্ষতটাও শুকিয়ে যাবে, এখনও শুকায়নি, মনে মনে ভাবল মালু।

আরও আশ্চর্য! জাহেদ জেনেছে সবই। কেমন করে কার কাছ থেকে সে প্রশ্ন অবান্তর।

সরাসরি কিছু বলল না জাহেদ। বলল ইঙ্গিতে। জানিস মালু? এক ধারায় নয়, বহু ধারায় প্রবাহিত মানুষের জীবন। যদি শুকিয়ে যায়, যদি রুদ্ধ হয় একটি ধারা আর এক ধারায় জীবন বয়ে চলে সার্থকতার পানে। এটাই জীবনের ধর্ম। সহস্র ধারায় জীবনের বিকাশ, অজস্র পথে তার পূর্ণতা।

গভীর এক প্রত্যয়ের আহ্বান হয়ে কথাগুলো বাজে মালুর কানে।

অন্ধকারে দেখা যায় না জাহেদের মুখটা। তবু সেদিকে চোখ ফেরায় মালু। বলল, আমি জানি মেজো ভাই। সে জীবনবোধ তো তোমার কাছ থেকেই পেয়েছি।

অন্ধকার এলোমেলো করে আবারও বাতাস বইল। নিথর মৌনতা ভেঙে সচকিত হল গাছের পাতারা।

ওরা ঘুমিয়ে পড়ল।

মালুর মনে হল ঘুমিয়েও বুঝি জেগে রয়েছে ও। ওর চোখের সুমুখে হেঁটে চলেছে ওর জীবনটা। ঘাসে ঢাকা আলোর পথ, কর্দমাক্ত কোনো গ্রামের রাস্তা। ঘাস মাড়িয়ে, কাদা ভেঙে মালু উঠে এসেছে উঁচু সড়কের শক্ত মাটিতে। প্রশস্ত উঁচু সড়ক। সেখানে চেনা অচেনা কত মানুষ। রাবু, জাহেদ, সেকান্দর মাস্টার আরও অনেক যাদের কাউকে চেনে না মালু, কাউকে বা চিনেও চিনতে পারছে না মালু। ওরা চলছে। ওদের আর চলার শেষ নেই। অন্ধকার ছিল। অন্ধকারের বুক চিরে কখন তারার আলো চোখ মেলেছে। তারপর তারার উজ্জ্বল চোখগুলো এক সময় নিষ্প্রভ হল। সূর্য উঠল। স্নিগ্ধ ঔজ্জ্বল্যে নিরুপম ভোরের সূর্য।

বুঝি রোদের ছোঁয়ায় আলগা হল মালুর চোখের পাতা। চোখ মেলে ও দেখল, ঘন ঘন সিগারেট টানছে জাহেদ আর অবিরাম ধোঁয়া ছাড়ছে। কানে এল সেকান্দরের গলা, পরমাত্মীয় কিনা? তাই তোমার স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে এসেছে। যাও একবার স্বাস্থ্যটা দেখিয়ে এস।

উত্তরে সিগারেটে আরও ঘন ঘন কয়েকটা টান মারল জাহেদ। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। বিরক্তি ভরে ছুঁড়ে মারল আধপোড়া সিগারেটটা।

কোন্ পরমাত্মীয় কোত্থেকে কেনই বা এসেছে তারা, কিছুই বুঝল না মালু। শুধু দেখল সেকান্দর আর জাহেদ, ওদের দুজনের মুখই অস্বাভাবিক গম্ভীর, চোখময় অমঙ্গলের ছায়া।

কাচারীর দিকে উঠে গেল ওরা। মালুও এল পিছু পিছু।

ও, আপনি জাহেদ সাহেব? সেলামাইলাইকুম। দারোগারা, একে একে হাত মিলালো জাহেদের সাথে।

মশাই কম ভুগিয়েছেন আপনি? দিনের পর দিন সারা দেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছি আপনাকে। আর আপনি কিনা স্বগ্রামে স্বগৃহে বহাল তবিয়তে বিরাজ করছেন? সত্যি জাহেদ সাহেব, দারুণ বোকা বানালেন আমাদের। প্যান্ট কোট পরা এক তরুণ কিছু হাসি, কিছু অবজ্ঞা মিশিয়ে বলল।

বোকা আমিও কম হলাম না, স্বগতোক্তির মতো বলল জাহেদ।

এখন চলুন তো, বলল আর একজন।

না না এক্ষুণি নয়। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আপনি যখন রেডি হবেন তখুনি যাব আমরা। তরুণকে পাশে সরিয়ে আর এক প্রৌঢ় অফিসার বললেন এবং স্বাভাবিকভাবেই হাসলেন।

দেরি করে লাভ নেই। অযথা পুড়তে হবে রোদে। আপনারা বসুন। পাঁচ মিনিটে রেডি হচ্ছি আমি।

ওরা ফিরে এল ভেতর বাড়ি।

ঘুম থেকে সবার আগেই উঠেছিল রাবু। সবার আগেই বুঝতে পেরেছিল ও। ওই জাগিয়েছিল সেকান্দরকে।

নিঃশব্দে সুটকেসটা গোছাচ্ছে রাবু। পায়জামা লুঙ্গি সার্ট প্যান্ট তোয়ালে। সেভিং সেট কাঁচি আয়না সাবান।

মশারি, টুথপেস্ট, টুথব্রাস। দিয়েছিস তো? পাঞ্জাবিটা পরতে পরতে শুধাল জাহেদ। কাছে এল। কাঁধে হাত রাখল রাবুর।

ছিঃ তুই কাঁদছিস?

কই না তো? কাঁদছি কোথায়? সুটকেসের ডালার আড়ালে মুখ লুকাল রাবু। ব্যস্ততার ভানে গোছানো জিনিসগুলোকে আবার অগোছালো করল। জোর করেই রাবুর মুখটা হাতের কোষে তুলে নিল জাহেদ। বলল, তোর চোখে আমি আর অশ্রু দেখতে চাই না, রাবু। কাঁদবি না। কথা দে?

দিলাম।

লেকু, ফজর আলী, ট্যান্ডল-বৌ, ভুঁইঞা বাড়ি আর মৃধা বাড়ির যারা ফিরে এসেছে গ্রামে তারা, ওরা সবাই এল। বড় খাল অবধি এগিয়ে দিল জাহেদকে। বড় দারোগা গেছিলেন কাজি বাড়ি পদধূলি দিতে। পদধূলি দিয়ে এবং নাস্তা খেয়ে ফিরে এসেছেন তিনি। কিন্তু জীপটা আসেনি, যন্ত্রটা বিকল। রমজানের জীপ বা গাড়িতে চড়বে না জাহেদ। অতএব বড় দারোগার গোমড়া মুখ অগ্রাহ্য করেই সাম্পানে যাওয়াই সাব্যস্ত হয়েছে। দোহাই তোমার, রাবু আপা। প্রসন্ন মুখে বিদায় দাও মেজো ভাইকে। কিন্তু রাবুর কানে বুঝি পৌঁছল না কথাগুলো। সুমুখে দত্ত দীঘির তালসারি। তালসারির মাথায় আকাশের দিগন্ত। সে দিকেই চেয়ে রয়েছে রাবু।

রাবু আপা। দোহাই তোমার, একটু হাস। আবারও বলল মালু। ততক্ষণে সাম্পানে উঠেছে জাহেদ। সাম্পানে দাঁড়িয়ে হাসছে আর বলছে, মাস্টার, আবার আসব আমি।

হ্যাঁ হ্যাঁ এসো। আজ থেকে রাবুর স্কুলে আমি জয়েন করলাম। বুঝলে?

চেঁচিয়ে বলল সেকান্দর।

হ্যাঁ তাই কর।

রাবুর দিকে তাকিয়ে হাত তুলল জাহেদ। বলল, আসি।

অশ্রু টলটল রাবুর চোখ। টপ টপ করে ঝরে পড়ল দুটো ফোঁটা। রাবু হাসল। বলল এসো।

সাম্পান পৌঁছে গেছে মাঝ গাঙ্গে। পকেট থেকে রুমাল বের করল জাহেদ। উড়িয়ে দিল নিশানের মতো। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, চিন্তা করিসনে রাবু, আমি ফিরে আসব। আমি আসব।

বড় খালে জোয়ার এসেছে। জোয়ারের টানে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল সাম্পান। কল কল জোয়ার বড় খালে। শাঁই শাঁই বাতাসের দাপাদাপি বড় খালের বুকে, দখিন ক্ষেতে। সব কিছু ছাপিয়ে রাবুর কানে এসে বাজে শুধু একটি কথা–আমি আসব। আমি আসব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *