প্ৰলয়ঙ্কর ঝড়ে কলকাতা নগরীর অন্যান্য বহু অট্টালিকার মতন ব্ৰাহ্ম সমাজের উপাসনা ভবনটিরও প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। রামমোহন প্রতিষ্ঠিত এই ভবনটির একাংশ কাত হয়ে পড়েছে। ছাদ ভেঙে কড়ি-বরগা এমন খুলে ঝুলছে যে উত্তমরূপে মেরামত করার আগে ওখানে প্রবেশ করাই বিপজ্জনক।
ঝড়ে শুধু উপাসনা ভবনটিই ভাঙেনি, সেই ধাক্কায় ব্রাহ্ম সমাজও ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেল।
প্ৰবীণ দেবেন্দ্ৰবাবুর সঙ্গে জ্বলন্ত তেজী যুবা কেশবের মিলনে ব্রাহ্ম সমাজ নতুনভাবে উদ্দীপিত হয়ে উঠেছে। গুসকরা গ্রামের এক আম্রকুঞ্জে তাঁবুর মধ্যে রাত্ৰিবাস কালে দেবেন্দ্ৰবাবুর মনে যে বিদ্যুৎ চমক হয়েছিল তা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। কেশব এই ধর্ম আন্দোলনটিকে স্থানীয় গণ্ডি থেকে করে এসেছেন এই নতুন ধর্ম মত। এখন সারা ভারতে ব্ৰাহ্ম সমাজের শাখার সংখ্যা পঞ্চাশ। দীক্ষিত ব্রাহ্মের সংখ্যা দু হাজারের কিছু বেশী। যারা দীক্ষা নেয়নি এমনও অনেকে এই মুক্ত-চিন্তা ও কালোপযোগী ধর্ম-সংস্কারের প্রতি আকৃষ্ট।
পারিবারিক বাধা অগ্রাহ্য করে নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে প্রকাশ্যে মাঘ উৎসবে যোগ দিয়েছেন কেশব, এই উপলক্ষে চিরকালের মতন গৃহত্যাগ করতেও তিনি দ্বিধা করেন নি। তখন দেবেন্দ্রবাবুর সনির্বন্ধ অনুরোধে সস্ত্রীক তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। সকলের এমন আন্তরিক, আপন—করা ব্যবহার যে, এ যে পরের বাড়িতে বাস, তা একদিনের তরেও বোঝা যায় নি। কেশবের স্ত্রী জগন্মোহিনীর কী-ই বা বয়েস। এর আগে কখনো সে থাকে নি কোনো অনাত্মীয়ের গৃহে।। কিন্তু দেবেন্দ্ৰবাবুর কন্যা ও পুত্রবধুরা তাকে একেবারে নিজেদের মধ্যে মিশিয়ে নিয়েছিলেন। সকলে মিলে অন্দরমহলে কত আনন্দ-ফুর্তি। জগন্মোহিনীর তবু মন কেমন করে তার একেবারে ছোট ভাইটির জন্য। সে দুঃখও তিনি ভুলে যান দেবেন্দ্ৰবাবুর কনিষ্ঠ পুত্র রবিকে দেখে। রবির মুখে সদ্য আধো আধো বোল ফুটেছে, জগন্মোহিনী প্রায়ই তাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। রবির বড় ভাই সোম আর দেবেন্দ্ৰবাবুর এক নাতি সত্যও তার পায়ে পায়ে ঘোরে, এই শিশুরা তাঁকে মাচি বলে ডাকে। কিছুদিন ঠাকুরবাড়িতে থাকার পর কেশবের শরীরে একটি বিষম ফোঁড়া হলো। কার্বঙ্কল জাতীয়। দেবেন্দ্রবাবু খ্যাতনামা চিকিৎসকদের ডাকিয়ে চিকিৎসার কোনো ত্রুটি রাখলেন না। তবু বেশ কিছুকাল শয্যাশায়ী হয়ে রইলেন কেশব। তখন কেশবের আত্মীয়-স্বজন অনুতপ্ত হয়ে কাকুতি-মিনতি করে আবার কেশব ও জগন্মোহিনীকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। কলুটোলার বাড়িতে।
সেরে ওঠবার পর কেশব আবার বিপুল বিক্রমে লাগলেন ব্ৰাহ্ম সমাজের কাজে।
প্রথম যৌবনে বিষয়-কার্যের প্রতি দেবেন্দ্ৰবাবুর মনে একটা খুব বিরাগের ভাব ছিল। তাঁর মনে হতো, নিত্য তিরিশ দিন অর্থ সম্পদের চিন্তা মানুষের নৈতিক উন্নতি ও ধর্ম সাধনার অন্তরায়। বিশেষত তাঁর পিতা অত্যন্ত বৈষয়িক বিলাস-আড়ম্বরপ্রিয় এবং ভোগী দ্বারকানাথকে দেখেই দেবেন্দ্রবাবু তার বিপরীতমুখী হয়েছিলেন। প্রায়ই সব কিছু ছেড়ে দিয়ে সুদূর, নির্জন শৈলশিখরে সুমহান প্রকৃতির সান্নিধ্যে গিয়ে তিনি বেশী সান্ত্বনা পেতেন।
কিন্তু এখন তিনি মধ্যবয়স্ক এবং একটি সুবৃহৎ পরিবারের অধিপতি। সাংসারিক ব্যয় বিপুল তো বটেই, তা ছাড়া ব্ৰাহ্ম আন্দোলন পরিচালনার জন্যও তাঁকে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতে হয়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা এবং ইণ্ডিয়ান মিরার নামে ইংরেজি পাক্ষিকও চলে তাঁর অথানুকূল্যে! সুতরাং দেবেন্দ্রবাবু এই সময়ে মন দিয়েছেন জমিদারি দেখাশুনোর কাজে। পিতার ঋণ পরিশোধ করা হয়ে গেছে, জমিদারির আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে যথেষ্ট। এক সময় যিনি প্রায় দেউলিয়া হতে বসেছিলেন, সেই দেবেন্দ্রবাবু এখন আবার দেশের ধনী সমাজের শিরোমণি। এখন তিনি মনে করেন, পুরোপুরি সংসার ধর্ম পালন করেও ধমানুশীল এবং আত্মশুদ্ধির প্রয়াস অব্যাহত রাখা যায়। তাঁর পরিমণ্ডলের সকল মানুষের প্রতি তাঁর ব্যবহার সহৃদয় ও উদার। মুক্তহস্তে তিনি দানশীল। কিন্তু তিনি গোষ্ঠীপতি। সকলকে মেনে চলতে হবে তাঁর বিধান, তাঁর মুখের কথাই আদেশ। যেকোনো বিষয়ে তাঁর মতই চরম, মত পার্থক্যের কোনো? স্থান নেই। আসলে তো তাঁর ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে পৈতৃক রক্ত!
কেশবকে খুবই পছন্দ করেন দেবেন্দ্রনাথ কিন্তু একটা ব্যাপারে তাঁর খটকা লাগে। কেশব এত বাইবেল আর যীশুখ্রীষ্টের জয়গান করে কেন? এর মধ্যে যেন খ্ৰীষ্টানী গন্ধ আছে। সাহেব জাতি এবং খ্ৰীষ্টানী ভাবকে ঘোর অপছন্দ করেন দেবেন্দ্রনাথ। ইংরেজ রাজপুরুষদের সংস্পর্শেও তিনি পারতপক্ষেও যেতে চান না। ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর বিরাগ নেই। তিনি ফার্সী শিক্ষা করেছেন, সূফী তত্ত্বের প্রতি তাঁর ঝোঁক আছে। তবে তাঁর ব্রাহ্ম ধর্মকে তিনি হিন্দু ধর্মেরমই পরিশীলিত অঙ্গ মনে করেন, পৌত্তলিকতা যেমন হিন্দু সমাজ ছেয়ে ফেলেছে, সেই রকম একেশ্বরবাদও তো হিন্দু দর্শনের প্রধান কথা, সুতরাং একেশ্বরবাদী ব্ৰাহ্মরা হিন্দু ধর্মেরই সংস্কারক। সেই জন্যই পুরুষানুক্রমে প্রচলিত হিন্দু সমাজের পারিবারিক আচার-ব্যবহারগুলি পরিত্যাগ করার প্রয়োজন নেই। তিনি বিপ্লব পছন্দ করেন না। তিনি ধীরে ধীরে সব কিছু পরিবর্তনের পক্ষপাতী।
কিন্তু তরুণ কেশবের হৃদয় আরও অনেক বেশী উচ্চাকাঙ্ক্ষী। দেবেন্দ্ৰবাবুর ব্রাহ্মধর্ম শুধু বাঙালী উচ্চ বর্ণের হিন্দুর ধর্ম, কিন্তু কেশব মনে করছেন, তিনি সারা ভারতবর্ষ, এমন কি সারা পৃথিবীর জন্য এক নতুন ধর্মমতের প্রচারক। শুধু বাইবেল নয়, কোরান আবেস্তাও তিনি পাঠ করেন নিয়মিত। তাঁর মতে, পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলিতে যে সব পৃথক বিধান আছে, তা আংশিক সত্য, কোনোটাই পূর্ণ সত্য নয়। অতএব এই সব ধর্মের আংশিক সত্যগুলি মেলাতে পারলেই হবে পৃথিবীর সব মানুষের উপযোগী এক আদর্শ ধর্ম এবং ব্ৰাহ্মরা গ্ৰহণ করবে সেই দায়িত্ব।
কিন্তু দেবেন্দ্রবাবু আর কেশবের মধ্যে বিভেদটা শুধু তাত্ত্বিক নয়, ভেতরে ভেতরে বিচ্ছেদ ধূমায়িত হতে শুরু করেছে কিছুদিন ধরেই। তরুণ বয়সী ব্ৰাহ্মরা সকলেই কেশবের চ্যালা, তারা নিত্য নতুন এক একটা ব্যাপার নিয়ে মেতে আছে। কেশব যেন ম্যাসিডোনিয়ার সেই তরুণ রাজকুমার, মুষ্টিমেয় একটি দল নিয়ে যে দুনিয়া জয়ের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু যে-হেতু বহু শতাব্দী যাবৎ পরাধীন, যুদ্ধবিমুখ, হিন্দুর সন্তান এই কেশব, তাই তলোয়ার নয়, জিহ্বাই তাঁর অস্ত্ৰ।
পৈতেধারী আচাৰ্যদের ব্ৰাহ্মসমাজ থেকে একেবারে বিদায় করে দেবার জন্য কেশবরা তৎপর। ব্ৰাহ্মধর্মে জাতিভেদ নেই, শুধু দ্বিজের ঐ চিহ্ন থাকবে কেন? কেশবদের দৃষ্টান্তে দেবেন্দ্রবাবু নিজে উপবীত ত্যাগ করেছেন বটে, কিন্তু যে-সব ব্ৰাহ্মণ আচার্যরা ব্ৰাহ্ম সমাজের একেবারে পত্তনের সময় থেকে আছেন, তাঁদের তিনি সমাজ থেকে সরিয়ে দিতে চান না। লোকাচারের জন্য কিংবা পারিবারিক গণ্ডগোল এড়াবার জন্য যদি তাঁরা পৈতেটা রাখতে চান তো রাখুন না! কেশবরা উদ্যোগ নিয়ে ব্রাহ্মণ আর শূদ্রের মধ্যে বিবাহ ঘটাচ্ছেন, এটাই দেবেন্দ্রবাবুর মোটেই পছন্দ নয়। এমন কি বিধবা বিবাহ ব্যাপারটাকেও তিনি মনের খুব গভীরে সায় দিতে পারেন না।
কেশবের উৎসাহদাতা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নামে আর এক তরুণ। মেডিক্যাল কলেজের এই প্ৰাক্তন ছাত্রটি বাঘ-আঁচড়া নামে এক গ্রামে গিয়ে দারুণ বিক্রমের সঙ্গে প্রচারের কাজ করছেন : বিজয়কৃষ্ণের মতামত যেন কেশবের চেয়ে উগ্ৰ! পৈতেধারী আচাৰ্যদের ব্ৰাহ্মসমাজের উপাসনার বেদী থেকে না সরালে যেন তাঁর কিছুতেই স্বস্তি নেই। শেষ পর্যন্ত দেবেন্দ্ৰবাবু রাজি হলেন ওঁদের কথায়।
তারপর এলো সেই ঝড়।
ব্ৰাহ্মসমাজের নিজস্ব গৃহের ভগ্নদশা, কিন্তু সেজন্য তো প্রতি বুধবারের উপাসনা বন্ধ রাখা যায় না! তত্ত্ববোধিনীতে বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো যে যতদিন না সে গৃহের সংস্কার হয়, ততদিন সমাজের উপাসনা হবে জোড়াসাঁকোয় দেবেন্দ্রনাথের বাড়িতে।
নির্দিষ্ট সময়ে কেশবের দলবল সেখানে এসে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, উপাসনা এর মধ্যে শুরু হয়ে গেছে, আর আচার্যের বেদীতে বসে আছেন অযোধ্যানাথ পাকড়াশী। আর যায় কোথায়! এই পাকড়শী মশাই শুধু যে পৈতেধারী তাই-ই নয়, একবার রটেছিল যে তিনি উপবীত ত্যাগ করেছেন, পরে আবার তিনি জানালেন যে না। তিনি পৈতে ছাড়তে রাজি নন। সেই লোক আচার্য? অথচ কথা ছিল আজ বিজয়কৃষ্ণ এবং কমলাকান্ত আচার্য হবেন।
উপাসনার মাঝখানেই ছোঁকরারা উত্তেজিতভাবে গোলযোগ শুরু করে দিল। দেবেন্দ্রবাবু এভাবে কথার খেলাপ করলেন কেন।
দেবেন্দ্রবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এটা তো ব্ৰাহ্মসমাজের অনুষ্ঠান নয়, এটা তাঁর নিজের বাড়ি। এখানে তাঁর ইচ্ছে মতন অনুষ্ঠান পরিচালনার অধিকার তাঁর আছে।
নবীনারা বললো, মোটেই না। সকলের সম্মতি নিয়ে ব্ৰাহ্মসমাজের উপাসনার স্থান বদল হয়েছে। সে স্থানটি যার বাড়িতেই হোক, সেখানে ব্ৰাহ্মসমাজের বিধি মতই সব কিছু চলতে হবে।
দেবেন্দ্রবাবু তখনও দুদলের মধ্যে আপোস করবার জন্য বললেন যে, তা হলে এক কাজ করা যাক না। পাকড়াশী মশাই বসেছেন বসুন, তাঁর পাশে আর একজন পৈতে ত্যাগী আচাৰ্য আসন নিন। তা হলে আর কারুর কিছু বলার থাকে না। বিজয়কৃষ্ণই হতে পারেন। দ্বিতীয় আচার্য।
কিন্তু তরুণদল তা মানতে মোটেও রাজি নয়। আপোস কিসের? প্ৰাণটা তো আদর্শের। একই সঙ্গে পৈতে পরে ব্ৰাহ্মণ সেজে থাকা, আবার জাতিভেদহীন ব্ৰাহ্মধর্মে বিশ্বাসী, এ আবার কী রকম কথা।
বাইরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বিজয়কৃষ্ণ চিৎকার করে বলতে লাগলেন, দেবেন্দ্রবাবু কি পোপ নাকি যে তাঁর ইচ্ছে অনিচ্ছে অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে?
এবার কঠোর হলেন দেবেন্দ্রবাবু। হ্যাঁ, তাঁর নির্দেশই চূড়ান্ত। পাকড়াশী মশাইকে তিনি আচার্যের বেদী থেকে নেমে আসতে বলতে পারবেন না। যার ইচ্ছে হয় এই উপাসনায় যোগ দিক, যার ইচ্ছে হয় চলে যাক।
সদলবলে কেশব-বিজয়কৃষ্ণরা চলে গেলেন সেই উপাসনা সভা ছেড়ে। অন্য এক ব্ৰাহ্ম বন্ধুর বাড়ির ছাদে গিয়ে বসলেন তাঁরা।
যেন স্বপ্নাদেশ পেয়ে দেবেন্দ্ৰনাথ তরুণ কেশবকে আর সব প্ৰবীণ ব্ৰাহ্মদের ডিঙ্গিয়ে সমাজের আচার্য পদে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, বস্তুত কেশবের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন সমাজের ভার, আজ দেখা গেল সেই স্বপ্ন ভ্ৰান্ত। ব্ৰাহ্মসমাজের ভবন এবং যাবতীয় সম্পত্তির যে ট্রাস্টি বোর্ড ছিল তা থেকে কেশব এবং অন্যদের তিনি সরিয়ে দিলেন কলমের এক খোঁচায়। ওঁদের কারুকে তাঁর দরকার নেই। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্ৰকে করলেন ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক সেই অযোধ্যানাথ পাকড়াশী এবং নিজের হাতে রাখলেন সর্বময় কর্তৃত্ব।
দেবেন্দ্রনাথের এই ব্যবহারে তরুণীরা প্রথমে একেবারে হতবাক। ব্ৰাহ্মসমাজের সব সম্পত্তি কি দেবেন্দ্ৰবাবুর নিজের নাকি? তিনিই বেশী টাকা-পয়সা দিয়েছেন বটে, কিন্তু এখন তো তা একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠানের অধীনে এবং ব্ৰাহ্মসমাজের কনস্টিটিউশনও আছে। সে সব অগ্রাহ্য করে দেবেন্দ্রবাবু নিজস্ব হুকুম জারি করলেন। এ যে স্বৈরাচার। রামমোহন রায়ের এই মত ছিল না যে ব্ৰাহ্মসমাজ ভবনে সব ধর্মের লোকেরই উপাসনার অধিকার থাকবে?
ব্ৰাহ্মসমাজ ভঙ্গ হয়ে যদি দুটি টুকরোই হয়, তা হলে ট্রাস্টের বিষয়ও ভাগ হওয়া উচিত। এমন মনে করলেন কেশব এবং তাঁর সমর্থকরা। কিন্তু সে সব কিছুই হলো না। ইণ্ডিয়ান মিরর পত্রিকা সম্পাদনা করছিলেন কেশব, সে পত্রিকায়ও রাতারাতি অন্য সম্পাদক নিযুক্ত করা হলো। এতটা কেশব কিছুতেই মানতে রাজি নন। যিনি আর্থিক সাহায্য করেন, পত্রিকার ওপরে কি শুধু তাঁরই অধিকার? আর যে সম্পাদক পরিশ্রম করে সম্পূর্ণ পত্রিকাটি বার করছেন, তিনি কেউ না? কেশবের লেখনী গুণেই মিরর-এর খ্যাতি।
কেশব ঠিক করলেন, যদি মিরর নামে দুটি পত্রিকা বেরোয়, তাতেও ক্ষতি নেই, তবু তিনি মিররের সম্পাদকত্ব ছাড়বেন না। পক্ষকালের মধ্যে তিনি স্বাধীনভাবে প্রকাশ করলেন মিরর-এর নতুন সংখ্যা। নিজের নীতিতে অবিচল থাকলেও কেশবের সঙ্গে বিচ্ছেদে মনে বড় আঘাত পেলেন দেবেন্দ্রনাথ। তারুণ্যের শক্তিকে ঠিক পথে চালিত করে তাঁর অতি প্রিয় ব্ৰাহ্ম আন্দোলনকে উজীবিত করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তরুণীরা যখন তখন আঘাত দেয়। আর তারুণ্যের ধর্মই এই। প্রবীণদের চিন্তাধারা থেকে অন্তত কয়েক পা এগিয়ে থাকা। দল কাৰ্যত দু ভাগ হবার পর উত্তেজিত যুবকেরা তাঁর নামে নানারকম অভিযোগ, এমন কি কটু-কাঁটব্য করতেও ছাড়লো না। অভিজাত দেবেন্দ্রনাথ একটি প্রতিবাদও না করে নিঃশব্দ রইলেন।
কিন্তু হঠাৎ যেন নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন তিনি। যদিও তাঁর অনুগত ব্ৰাহ্মের সংখ্যাও কম নয়, বিদ্রোহী তরুণদের চেয়ে অনেক বেশীই হবে বোধ হয়, তবু দেবেন্দ্রনাথ আর আগেকার সেই উদ্দীপনা বোধ করেন না। এমন কি, তিনি যেন অনুভব করছেন, তাঁর দৃষ্টিশক্তি কমে আসছে, শ্রবণ ক্ষমতাও ক্ষীণ হয়ে আসছে, শরীরে আর সেই জোর নেই। সাতচল্লিশ বৎসর বয়েস, এর মধ্যেই যেন তাঁর জীবনসায়াহ্ন এসে গেল।
দ্বিতলের অলিন্দে আরাম-কেদারায় তিনি চুপ করে বসে থাকেন। মনকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে পারেন না। বারবার মনে পড়ে কেশবের প্রজ্বলন্ত মুখখানি। নিজের সন্তানদের চেয়েও ওকে তিনি বেশী প্রীতি করেছিলেন। এখন কেশব দূরে গেছে, তবু তিনি কেশবের ওপর রাগ করতে পারেন না। আপন মনে বলেন, কেশব বিজয়ী হোক, ওর আত্মার প্রভায় আর সকলে আলোকিত হোক, সারা বিশ্ব কেশবকে চিনুক, জানুক।