নয়নমণি এখন সারা সকাল পুঁটিকে নিয়ে কাটায়। মেয়েটা বড় ঘুমকাতুরে, তবু নয়নমণি সূর্য ওঠার আগেই তাকে ডেকে তোলে। দুজনেই পর পর স্নান সেরে নেয়। তারপর নয়নমণি নিজের হাতে পুঁটিকে শাড়ি পরিয়ে দেয়, মুখে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সাজায়। পুঁটি প্রথমে এসেছিল একেবারে হাড় জিরজিরে অবস্থায়, এখন শরীরে কিছুটা গত্তি লেগেছে, ভরাট হয়েছে চোয়াল, চোখে মানুষের তাড়া খাওয়া বন্য পশুর মতন ভয়ার্ত ভাবটা আর নেই। মুখে কথা ফুটেছে।
সাজগোজের পর শুরু হয় পুঁটির অগ্নিপরীক্ষা। নয়নমণি তাকে নাচ শেখাবেই। যতক্ষণ না পুঁটির পায়ের তাল ঠিক হয়, ততক্ষণ তার নিস্তার নেই, নয়নমণির সময়জ্ঞানও থাকে না। নয়নমণি নিজে গান গেয়ে গেয়ে হাতচাপড়ি দেয়, পুঁটি ঘুঙুর পরা পায়ে নাচে, নেচেই চলে, নাচতে নাচতে সে ক্লান্ত অবসন্ন হয়, বসে পড়তে চায়, এমনকী কান্নাও শুরু করে, তবু দয়া নেই নয়নমণির। সে আবার হাত ধরে তাকে টেনে তুলে বলে, একটা বোল একেবারে ঠিকঠাক না করতে পারলে তুইও খেতে পাবি না, আমিও কিছু খাব না।
নয়নমণির মুখ চেয়ে অমরেন্দ্রনাথ তার থিয়েটারে পুঁটিকে সখীর দলে ভর্তি করে নিয়েছিল। বেতন সাড়ে পাঁচ টাকা। সব নাটকেরই গোড়ার দিকে একদল সখীর নাচ থাকে। অন্য থিয়েটারে সখীর দলে সুযোগ পাওয়ার জন্য নতুন মেয়েরা চার টাকা মাইনে পেলেই বর্তে যায়। সেই তুলনায় পুঁটির ভাগ্য ভাল। কিন্তু দিন দশেক বাদেই নয়নমণি তাকে ছাড়িয়ে এনেছে। পুঁটি কিছুই নাচ জানে, প্রথম থেকেই বেতালা বেখাপ্পা দলের সঙ্গে মিশে গেলে ওর জীবনে উন্নতি হবে না। নাচ কি এতই সোজা! নিষ্ঠা ও পরিশ্রম ছাড়া কোনও কিছুই শেখা যায় না। পুঁটির গলা বেসুরো নয়, মোটামুটি গাইতে পারে। যার ভেতবে সুর আছে, তার তালজ্ঞানও এসে যাবে নিশ্চিত। গান পরে ভাল করে শিখে নিলেও চলবে, নাচ শেখার জন্য এই দশ-এগারো বছর বয়েসটাই প্রকৃষ্ট। বয়েস বেড়ে গেলে পায়ের আড় ভাঙতে চায় না।
ঘরের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি রয়েছে, তার সামনে অনেক বেলা পর্যন্ত চলে নাচের সাধনা।
পুঁটির আর অন্য কোনও নাম নেই। তার বাবা মা তার একটা ভাল নামও দেয়নি। পুঁটির মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবা আর একটি শয্যাসঙ্গিনী এনেছে, প্রথম পক্ষের এগারোটি ছেলেমেয়ের দায়িত্ব সেই দ্বিতীয়পক্ষের পত্নী নিতে যাবে কেন? তার ওপর বয়স্থা মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সমস্যা আছে, ঋতুমতী হওয়ার পর সেই কন্যাদের আর অনঢ়া রাখা চলে না, তা হলে সমাজে পতিত হতে হয়। দ্বিতীয় পক্ষের শ্যালকদের পরামর্শ যুক্তিযুক্ত মনে করে পুঁটির বাবা হরিশ্চন্দ্র পাল তিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে একদিন শহর দেখাবার ছল করে বেরিয়ে পড়েছিল। পুঁটিদের গ্রামের নাম গাবখালি, শুধু ওই নামটাই পুঁটি জানে, কোন থানা, কোন মহকুমা তা তাকে কেউ শেখায়নি। গ্রাম থেকে কিছু দূর হেঁটে গেলে এক নদী, সেখান থেকে শুরু হয়েছিল নৌকো যাত্রা, এক বেলা নৌকোয় কাটাবার পর স্টিমার, তাতে সারা রাত। সকালবেলায় তারা চেপেছিল রেলগাড়িতে। জীবনে সেই প্রথম রেলগাড়ি দেখা, পুঁটিরা তিন বোন রোমাঞ্চিত বিস্মিত হয়ে দেখছে জানলার পাশ দিয়ে গাছপালা দৌড়ে যায়, গরু-ছাগল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তবু মাটি সরে যাচ্ছে, পুকুরগুলো দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে যায়। রেলগাড়িতে ওঠার আগে বাবা তাদের স্টিমারঘাটার হোটেলে খাইয়েছে, একখানা করে ডুরে শাড়ি কিনে দিয়েছে, পিতৃস্নেহের এমন পরিচয় ওই তিন কন্যা আগে কখনও পায়নি। সারাটা পথ একটাও রূঢ় কথা বলেনি বাবা, বরং মাঝে মাঝে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছে। যেন দ্বিতীয় পক্ষের সামনে আগের ছেলেমেয়েদের প্রতি মনোযোগ দিতে পারে না বলেই বাবা তাদের নিয়ে যাচ্ছে এত দূরে।
কলকাতায় এসে হরিশ্চন্দ্র নিজেই হকচকিয়ে গিয়েছিল, সেও আগে কখনও এত বড় শহর দেখেনি। এত মানুষজন, এত গাড়িঘোড়া, ঘোড়াহীন মোটরগাড়ি হুস হুস করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ধেয়ে আসে, তা দেখলে আতঙ্ক হয়। হরিশ্চন্দ্র দুই মেয়ের হাত ধরেছে, এক মেয়ে জড়িয়ে ধরে আছে তার কোমর, এইভাবে তারা হেঁটেছে কলকাতার রাস্তায়, এক দোকান থেকে তারা গরম জিলিপির মতন এক অনাস্বাদিতপূর্ব সুখাদ্য খেয়েছে। আর এক জায়গায় কিনেছে রকমারি কাঁচের চুড়ি। মেয়েদের হাতে চুড়ি পরাতে গিয়ে কয়েকটা ভেঙেও গেছে, কী আশ্চর্য দোকানি তার জন্য রাগও করেনি অতিরিক্ত পয়সাও নেয়নি। কলকাতায় সব কিছুই এত ভাল।
দুপুরের দিকে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তারা বিশ্রাম নিতে বসেছিল পান্তির মাঠে একটা বড় তেঁতুলগাছের ছায়ায়। সঙ্গে এক ধামা মুড়ি আর বাতাসা। মহানন্দে সেই মুড়ি বাতাসা খাওয়া হতে লাগল, সামনের রাস্তা দিয়ে মানুষের স্রোত চলেছে, কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না তাদের দিকে। একসময় পুঁটিরা লক্ষ করল, তাদের বাবা নিঃশব্দে কাঁদছে, দু চোখ দিয়ে অঝোরে গড়াচ্ছে জল। তিন কন্যা অবোধর মতন চোখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। কোনও বয়স্ক মানুষকে তারা কখনও আপন মনে কাঁদতে দেখেনি।
পুঁটির বড় বোন টেঁপি এক সময় ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, বাবা, তোমার কী হয়েছে?
হরিশ্চন্দ্র উত্তর দিল না। কেঁদেই চলল, কান্নার দমকে কাঁপতে লাগল তার শরীর। খানিক বাদে সে ধুতির খুঁটে চোখ মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টেঁপির দিকে তাকিয়ে বলল, বড় বিপদ হয়েছে রে। আমার সব টাকাপয়সা হারিয়ে ফেলেছি! এখন কী উপায় হবে? বাড়ি ফিরব কী করে?
টেঁপি বলল, আমার কাছে পাঁচ টাকা আছে। তুমি যে আমায় পাঁচ টাকা দিয়েছিলে রাখার জন্য।
হরিশ্চন্দ্র বলল, পাঁচ টাকায় তো হবে না। সকলের গাড়ি ভাড়া লাগবে, খেতে হবে। বিপদ আপদের জন্যও হাতে দুটো পয়সা বেশি রাখতে হয়। তোরা এখানে বসে থাক, আমি টাকার সন্ধান করে আসি।
উঠে দাঁড়িয়েও একটু ইতস্তত করেছিল হরিশ্চন্দ্র, তারপর মেয়েদের মাথায় হাত রেখে কম্পিত কণ্ঠে বলেছিল, মা, ভগবান তোদের রক্ষা করবেন।
যাওয়ার সময় সে আর পিছন ফিরে তাকায়নি, ফিরেও আসেনি।
অনেকবার ধরে এই কাহিনী শুনেছে নয়নমণি। পুঁটির সঙ্গে সে তার জীবনের মিল খুঁজে পায়। ভূমিসূতা তার মা ও বাবা দুজনকেই হারিয়েছিল অকালে, অসহায় অবস্থায় তাকে তার আত্মীয়স্বজনরা বিক্রি করে দিয়েছিল। হরিশ্চন্দ্র তার তিন মেয়েকে বিক্রি করার সাহস বা সুযোগ পায়নি, কলকাতায় ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে। পুঁটি অবশ্য এখনও ভাবে, তার বাবা ইচ্ছে করে তাদের ফেলে যায়নি, নিজেই সে হারিয়ে গেছে এত মানুষের ভিড়ে। আবার কোনওদিন নিশ্চয়ই দেখা হয়ে যাবে।
ওরা তিন বোন কয়েকদিন মাত্র একসঙ্গে ছিল। টেঁপির পাঁচ টাকায় ক্ষুন্নিবৃত্তির কোনও অসুবিধে ছিল না। চিড়ে-মুড়ি-কলা সর্বত্রই পাওয়া যায়। টেঁপিই প্রথম অদৃশ্য হয়ে গেল, তার আঁচলে বাঁধা বাকি টাকা-পয়সা কটি নিয়ে। সে নিজেই গেল, না কেউ তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তা জানা যায়নি। এক সকালে ঘুম ভেঙে পুঁটি দেখল যে তার দিদি নেই পাশে। ছোট বোন বঁইচির বয়েস ন বছর, তার মুখোনাই সবচেয়ে সুন্দর, রঙটাও মাজা মাজা, তাকে এক সন্ধেবেলা দুজন লুঙি পরা লোক জোর করে একটা ঘোড়ার গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে। পুঁটি মাঝের বোন, খুব রোগা, খিদের জ্বালায় সে রাস্তার অন্যান্য কাঙালি ছেলেদের দেখাদেখি ভিক্ষে শুরু করেছিল।
শুধু বাবার নাম আর গ্রামের নাম ছাড়া আর কিছুই জানে না পুঁটি। কথার টান শুনে বোঝা যায় পূর্ববঙ্গের মেয়ে। এমনকী যে নদীতে প্রথম নৌকোয় চেপেছিল, সে নদীর নামও মনে নেই। ও, এত কম জানে কেন? এই বয়েসে নয়নমণি অনেক বেশি কিছু জানত। অবশ্য তার বাবা তাকে যত্ন করে লেখাপড়া শিখিয়েছিল। পুঁটির মতন মেয়েরা আগাছার মতন অযত্নে শুধু বেড়েই চলে, কিছু শেখে না।
নয়নমণি পুঁটির নাম দিয়েছে চারুবালা। পৃথিবীতে মানুষ হয়ে জন্মেছে, একটা মানুষের নাম ওর প্রাপ্য, শুধু মাছের নাম হয়ে থাকবে কেন? প্রথমে নাম রেখেছিল সুহাসিনী, কিন্তু সে নাম পুঁটি নিজেই উচ্চারণ করতে পারে না, সে বলত ছায়াছিনি! তারপর নাম রাখা হল বীণাপাণি, তাও পুঁটি কিছুতেই বীণা বলতে পারে না, বলে বেনা, বেনাপাণি! চারুবালাতে তেমন গণ্ডগোল নেই। এখনও এই নামে সে ঠিক রপ্ত হয়নি, চারুবালা বলে ডাকলে অনেক সময় সাড়া দেয় না। তখন পুঁটি পুঁটি বলেই চ্যাঁচাতে হয়।
দুপুরবেলা খেতে বসে দুজনে একসঙ্গে। নয়নমণি নিরামিষ আহারই বেশি পছন্দ করে, নানা জাতীয় শাক ও আলুঝিঙে করলা সেদ্ধতেই তার চলে যায়। অর্ধেন্দুশেখর তাকে মাঝে মাঝে মাংস খাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেই কথা মনে রেখে সে এখন পুঁটির জন্য পাঁঠার মাংস এনে রান্না করে। পুঁটির উঠতি বয়েস, এখন স্বাস্থ্য ভাল না হলে সে সারা জীবনই দুর্বল থাকবে। এই এগারো বছরের জীবনে পুঁটি একবারই মাত্র মাংস খেয়েছে, তাও নিজেদের বাড়িতে নয়, তাদের গ্রামের এক ধনী পরিবারের দুর্গাপূজার সময় অষ্টমীর দিনে পাঁঠা বলি হয়, গ্রামসুদ্ধ সবাই সে বাড়িতে গিয়ে পাত পেড়ে বসে গিয়েছিল। পুঁটির ভাগ্যে শুধু একটুকরো হাড় আর অনেকখানি ঝোল জুটেছিল, তবু সেই স্বাদ তার মনে আছে।
খাওয়া শেষ হয়ে গেলেও দুজনে এঁটো হাতে গল্প করে অনেকক্ষণ। লাল রঙের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে নয়নমণি, তার অঙ্গে একটা কুঁতে রঙের আলগা শাড়ি জড়ানো, কৃশ কোমর, ঈষৎ ভারী উরুদ্বয়। পুঁটি খাটের পায়ায় হেলান দেয়, দক্ষিণীদের মতন মালকোচা মেরে শাড়ি পরা, পায়ের ঘুঙুর এখনও খোলেনি, বহুক্ষণ নাচের পরিশ্রমে ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসে। বাইরে ঝকঝক করে দুপুরের রোদ, পাঁচিলে দুটি কাক অবিশ্রান্তভাবে ডেকে চলে।
নয়নমণি এই সময় পুঁটিকে জীবন সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। সচ্ছল পরিবারে, বাপ মায়ের আদরে যারা লালিত, তাদের অনেক কিছু না জানলেও চলে, কিন্তু যাদের কোনও সহায় সম্বল নেই, বেঁচে থাকার জন্য যাদের সর্বক্ষণ লড়াই করতে হয়, জীবনের ভয়ঙ্কর দিকগুলি তাদের না জানলে, না বুঝলে চলে না।
নয়নমণি বলল, মেয়েমানুষ মরে কেন জানিস চারু? কীভাবে বাঁচতে হয়, তারা যে তাই-ই জানে! তাদের আত্মসম্মানবোধ নেই। মেয়েমানুষরা ভাবে অন্যের কথা শুনেই তাদের সারা জীবন চলতে হবে!
চারুবালা জিজ্ঞেস করল, দিদি, তুমি একা একা থাকো কী করে?
নয়নমণি বলল, আরও কিছুদিন যাক, সে কথা আস্তে আস্তে বুঝে যাবি। আগে তোর কথা ভাব। মনে কর, কোনওরকমে খুঁজে খুঁজে তোকে তোর গ্রামের বাড়িতে আবার পৌঁছে দেওয়া হল। সেখানে তোর সৎ মায়ের সংসারে তুই টিকতে পারবি?
চারুবালা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।
নয়নমণি বলল, তোর বাপ-মা তোকে ফেরত নেবে না, তোর গ্রামের মানুষও তোকে দেখে দুর দুর করবে। তারা বলবে, তুই এতদিন কলকাতা শহরে একা একা থেকেছিস, হাজার পুরুষমানুষ তোকে ছুঁয়েছে, তুই নষ্ট হয়ে গেছিস।, তোর জাত-ধর্ম সব গেছে। সমাজে আর তোর ঠাঁই নেই। এটা তুই বুঝিস?
চারুবালা বলল, আমায় তো কোনও পুরুষমানুষ ছোঁয়নি!
নয়নমণি বলল, তাতে কী, কেউ তোর কথা বিশ্বাস করবে না। বাপ-দাদার সংসার বা স্বামীর সংসারের বাইরে মেয়েমানুষের একটা রাতও কাটাবার অধিকার নেই। পুরুষ ছেলেদের দোষ হয় না, তারা যেখানে খুশি যায়, যেদিন ইচ্ছে ফিরে আসে। হারানো ছেলে ফিরে এলে বাড়িতে সবাই আনন্দে নেচে ওঠে। পাড়াপড়শিদের ডেকে ভোজ দেয়। হারানো মেয়েদের ফিরে আসার পথ চিরকালের জন্য বন্ধ।
চারুবালার চক্ষু জলে ভরে এল। সে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, আমি আর কোনওদিন বাড়ি যাব না?
নয়নমণি দুদিকে আস্তে আস্তে মাথা দুলিয়ে বলল, না, তোর আর বাড়ি নেই। মেয়েদের বাপের বাড়ির মেয়াদ বড় জোর দশ-বারো বছর। যেসব বাপের সাধ্য থাকে, তারা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে পার করে দেয়। তারপর বেশিরভাগ মেয়েই সারাজীবন আর বাপের বাড়ি যায় না। মা-ভাইবোনদের চোখে দেখে না। শ্বশুরবাড়িতে লাথি ঝাঁটা খেয়েও মুখ বুজে থাকতে হয়। তোর বাপ তোদের তিন বোনের বিয়ে দিতে পারেননি, তাই এত দূর দেশে এনে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে গেছেন।
চারুবালা এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারে না, তাই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
নয়নমণি বলল, তোর অন্য দুই বোনের কী গতি হয়েছে জানিস? অল্পবয়েসী সব মেয়েরাই পুরুষমানুষের খাদ্য। পুরুষরা কামড়ে, চিবিয়ে, চুষে খায়। খেতে খেতে যখন একঘেয়ে হয়ে যায়, তখন ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এক জাতের পুরুষ আবার অন্য জাতের পুরুষদের এই খাদ্য জোগায়। সেই রকম পুরুষরাই তোর অন্য দুই বোনকে তুলে নিয়ে গেছে। কলকাতা শহরের অলিগলিতে এমন অনেক বাড়ি আছে, যেখানে ওই সব গুণ্ডারা মেয়েদের ভাড়া খাটায়। যাতনা সহ্য করে মেয়েরা, রোজগার করে পুরুষ। তোরও নিঘাত ওই গতি হত।
চারুবালা বলল, টেঁপি-বঁইচিকেও আর কোনওদিন দেখতে পাব না?
নয়নমণি বলল, দৈবাৎ দেখতে পেলেও চিনতে পারবি কি না সন্দেহ। হয় ওদের দিনের পর দিন পিষে, শুষে কঙ্কালসার করে দেবে, অথবা ভাগ্যে থাকলে যদি কোনও বড় মানুষের নেকনজরে পড়ে যায়, তা হলে দামি দামি শাড়ি-গয়নায় মুড়ে বাঁদরি সাজিয়ে রাখবে। তোর মতন মেয়েদের বাঁচার আর একটা উপায় আছে, কোনও বাড়িতে দাসী বাদি হয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে যাওয়া। কোনওদিন মুখ তুলে একটাও কথা বলতে পারবি না। কাজে সামান্য ত্রুটি হলে, এমনকী তুটি না হলেও মারবে, মুখঝামটা দেবে, অন্ধকারে ঠেসে ধরবে, তবু কারুর কাছে সুবিচার চাইতে পারবি না। বিড়াল-কুকুরেরও অধম সেই জীবন। এমন বাড়িও আছে, যে বাড়ির গিন্নি পোষা পাখির সঙ্গেও মিষ্টিভাবে কথা বলে, কিন্তু দাসী-বাঁদিদের মনে করে হারামজাদি। তোকে আমি এই সব কথা বলতে পারছি কী করে জানিস, আমি নিজেও যে এই সবের মধ্যে দিয়ে গেছি! আমিও একসময় ক্রীতদাসী ছিলাম।
চোখ বড় বড় করে চারুবালা জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হল?
নয়নমণি বলল, সে গল্প পরে শুনবি। তোকে আমি নাচ শেখাবার জন্য এত কষ্ট দিচ্ছি কেন? আমি তো আর সারাজীবন তোকে দেখব না। কেউ কারুর ওপর সারাজীবন নির্ভর করেও থাকতে পারে না। তোকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে গেলে একটা কোনও গুণ থাকা দরকার। সেই গুণটাই যোগ্যতা। মেয়েমানুষের অনেক গুণ থাকলেও সহজে কেউ দাম দেয় না, তার রূপ, তার শরীরটাকেই দেখে। এমনকী মেয়ে মানুষরা লেখাপড়া শিখলেও তাদের বাড়ির বার হতে দেয় না। বাইরে সবাই যেন তাকে খেয়ে ফেলার জন্য ওত পেতে আছে। একমাত্র থিয়েটারের মেয়েদের সে ভয় নেই। তারা সমাজের তোয়াক্কা করে না, তারা নিজেরা রোজগার করে, তারা স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে!
চারুবালা বলল, তা হলে, তা হলে তুমি কেন আমাকে থিয়েটার থেকে ছাড়িয়ে আনলে?
নয়নমণি বলল, থিয়েটারে যোগ দিলেই তো হল না। যোগ্যতা থাকা চাই। যোগ্যতা না থাকলে কদিন বাদেই তাড়িয়ে দেবে। তখন এক থিয়েটার থেকে আর এক থিয়েটারে যেতে হবে, দিন দিন কদর কমে যাবে, তারপর বদ লোকদের খপ্পরে পড়তে হবে। এমনভাবে থিয়েটারের কত মেয়ে হারিয়ে গেছে। তোকে খুব ভাল নাচ শিখতে হবে, গান শিখতে হবে, নকল হাসি, নকল কান্না, নকল রাগ দেখানো শিখতে হবে, উচ্চারণ শুদ্ধ করতে হবে, তোকে আমি তেমনভাবে তৈরি করব চারু। তুই কারুর কাছে দয়া চাইতে যাবি না, তোকে পাওয়ার জন্য থিয়েটারওয়ালারা ঝুলোৰুলি করবে, তবে না তোর মান বাড়বে! নিজের গুণের জোরে তুই সবার ওপরে উঠবি। তখনও অনেক বড় মানুষ টাকার থলি নিয়ে, গয়নার বাক্স নিয়ে তোর কাছে আসবে। তখন তুই নিজে ঠিক করবি, বাক্স ভর্তি গয়নার চেয়েও আত্মসম্মানের দাম বেশি কি না। গুণের বিনিময়ে অর্থ, না শরীরের বিনিময়ে। বুঝতে পারছিস আমার কথা? ওমা, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি, চারু, চারু, এই পুঁটি, ওঠ। কাকে বলছি এত সব কথা!
ঘুমন্ত চারুবালাকে টেনে তুলে নয়নমণি তার হাত ধুইয়ে দেয়। তাকে বিছানায় শুইয়ে সে নেমে আসে নীচে।
গঙ্গামণি এখন বাতব্যাধিতে পঙ্গু। শয্যা ছেড়ে উঠতেই পারে না। একজন মাদ্রাজি দাই রাখা হয়েছে তার জন্য, এমন গাঁট্টাগোট্টা তার শরীর যে একাধিক পুরুষকেও সে কুপোকাত করে দিতে পারবে। একদিন রাতে চোর এসেছিল, পার্বতী নামে সেই দাইটি লোহার ডাণ্ডা দিয়ে মেরেছিল চোরটিকে।
পার্বতী গঙ্গামণিকে স্নান করিয়ে এনে ধরে ধরে শুইয়ে দিল বিছানায়। তারপর বড় পাথরের বাটিতে দুধ-মুড়ি-কলা মেখে নিয়ে এল। গঙ্গামণির আঙুলগুলো এমনই শক্ত হয়ে গেছে যে খাবারও মুখে তুলতে পারে না। তার শিয়রের কাছে বসে নয়নমণি দাইকে বলল, দাও, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
চামচে করে একটু একটু করে সে গঙ্গামণির মুখে খাবার তুলে দিতে লাগল।
খেতে খেতে গঙ্গামণি বলল, নয়ন, তুই খাইয়ে দিচ্ছিস, তাই আজ যেন বেশি খিদে পাচ্ছে। ওই পার্বতী বেটির গায়ে বড় রসুনের গন্ধ। ওকে বল না ভাল করে সাবান মেখে স্নান করে আসতে।
নয়নমণি বলল, প্রায় শেষ হয়ে এল। আর একটু খাবে?
গঙ্গামণি বলল, সন্দেশ কিনে রাখা আছে। আমায় দুটো দে, তুইও খা।
নয়নমণি বলল, আমি এখন পারব না। ভাত খাওয়া হয়ে গেছে। গঙ্গামণি বলল, ভাত খাওয়ার পর বুঝি সন্দেশ খাওয়া যায় না? তোকে খেতেই হবে!
নয়নমণি তবুও আপত্তি জানাতে গঙ্গামণি বালিকার মতন অভিমানভরে বলল, তা হলে আমিও খাব না! ছুঁড়ে ফেলে দে। ওই মাদ্রাজি রাক্ষুসিটা সব খেয়ে নিকগে!
নয়নমণি বলল, আহা, অমন করে বোলো না। ও তোমার জন্য কত সেবা করে।
গঙ্গামণি বলল, সেবা না ছাই! কত পয়সা সরাচ্ছে কে জানে! পরের হাতে কখনও সেবা হয়? নিজে নড়তে চড়তে পারি না। এমনভাবে বেঁচে থাকার মুখে আগুন, ভগবান আমার মরণ দেয় না কেন?
হঠাৎ থেমে গিয়ে গঙ্গামণি একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল নয়নমণির দিকে। তারপর ধীর স্বরে বলল, দুদিন ধরে একটা কথা ভাবছি। কোনদিন হঠাৎ আমি চোখ বুজব ঠিক নেই। তখন আমার এই বিষয় সম্পত্তির কী হবে? আমার তিন কুলে কেউ নেই, পাঁচ ভূতে লুটেপুটে খাবে। তুইও বিপদে পড়বি। বরং একটা উঁকিল ডাকার ব্যবস্থা কর, তোর নামে সব লিখে দিই আগে থেকে।
নয়নমণি বলল, না, না, আমার নামে কেন?
গঙ্গামণি বলল, তুই যে আগের জন্মে আমার মায়ের পেটের বোন ছিলি নয়ন! তোর মতন আমার আপন তো আর কেউ নেই।
নয়নমণি এবার হেসে বলল, আগের জন্মের সম্পর্ক কি আর এ জন্মে খাটে! আমি একলা অবলা নারী, তোমার এত বড় বাড়ি, নীচে তিন ঘর ভাড়াটে, কত লোক এসে হুজ্জোত করে, তুমি বিছানায় শুয়ে শুয়েও সব সামলাতে পারো। আমায় কেউ মানবে না।
গঙ্গামণিও হেসে বলল, তুমি বাছা একলা হতে পারো, কিন্তু তোমায় অবলা বলবে কোন বাপের ব্যাটা? পুরুষমানুষরা ভয়ে তোর আঁচলের ছায়াও মাড়ায় না। দেখলাম তো এতদিন।
নয়নমণি বলল, দিদি, তুমি চোখ বোজার নামও করবে না। বাতের অসুখ আবার অসুখ নাকি, ওতে কেউ মরে না। তুমি নাচ ছেড়ে দিলে বলেই তো এমন হল! হ গঙ্গামণি বলল, শোনো মেয়ের কথা! বুড়ি মাগি হয়েও ধেই ধেই করে নাচব নাকি! বড় সাধ ছিল একবার তীর্থ দরশনে যাব। ই নয়নমণি বলল, একটা কাজ করতে পারো। এই বাড়ি বেচে দিয়ে তুমি কাশী কিংবা বৃন্দাবন চলে যাও। সেই টাকায় তোমার বাকি জীবন দিব্যি চলে যাবে। তীর্থস্থানেও থাকা হবে।
গঙ্গামণি বলল, ভারী বুদ্ধি দিলি তুই! বিদেশ বিভুয়ে গিয়ে থাকব, কারুকে চিনি না, একদিন কেউ আমার বুকে ছুরি মেরে সব কিছু নিয়ে পালাবে। সব তীর্থস্থানেই চোর-ডাকাতরা গিসগিস করে।
একটু থেমে গঙ্গামণি বলল, তোকে ছেড়ে দূরে কোথাও গিয়ে শান্তিতে থাকতে পারব না। তুই আমায় কী মায়ার বাঁধনেই যে বেঁধেছিস! আরও একটা কথা কী জানিস, থিয়েটারে আর যেতে পারি না, তবু মন টানে। এখানে থিয়েটারের লোকজন আসে, তোর মুখে গল্প শুনি, তাতেই কত ভাল লাগে। থিয়েটার ছাড়া আর তো কিছু জানিনি। এখনকার থিয়েটারের কত্তারা আমাকে ভুলে গেছে, দর্শকরাও আমাকে মনে রাখেনি, কিন্তু আমি যে থিয়েটারের কথা ভুলতে পারি না।
নয়নমণি বলল, কী যে বলো দিদি! তুমি বিশ্বমঙ্গলে পাগলিনীর পার্ট কী দুর্দান্ত করেছিলে, বিনোদিনীকে পর্যন্ত হারিয়ে দিয়েছিলে, সে কথা সবাই এখনও বলাবলি করে।
কোনওক্রমে মাথাটা উঁচু করে ব্যাকুলভাবে গঙ্গামণি জিজ্ঞেস করল, বলে, বলে? লোকে মনে রেখেছে?
নয়নমণি বলল, মনে রাখবে না? ওই পার্টে অন্য কেউ নামলেই তোমার সঙ্গে তুলনা হয়।
গঙ্গামণি লাজুকভাবে বলল, বিল্বমঙ্গল পালায় বিনোদিনী ক্ল্যাপ পেত বড়জোর পাঁচটা-ছটা। আমি পেতাম দশটা-এগারোটা। গানের সময় পাবলিক এনকোর এনকোর বলত!
; এরপর কিছুক্ষণ থিয়েটারের গল্পে মেতে রইল গঙ্গামণি। নয়নমণিকে উঠতে হবে। আজ তার থিয়েটার নেই, মহড়াতে না গেলেও চলে, কিন্তু বালিগঞ্জে সরলা ঘোষালের বাড়িতে যাওয়ার কথা আছে।
সে বিদায় নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই গঙ্গামণি বলল, ও শোন নয়ন, আর একটা কথা। তুই যে মেয়েটাকে রেখেছিস, পুঁটি না খুঁটি, সন্ধেবেলায় তুই না থাকলে সে নীচের তলায় এলোকেশীর ঘরে যায় কেন?
নয়নমণি ভুরু কুঁচকে তাকাল।
গঙ্গামণি বলল, এলোকেশী মেয়ে সুবিধের নয়। তার একটার বদলে দুটো বাঁধা বাবু। তারাও প্রায়ই সন্ধের পর ইয়ারবক্সি নিয়ে আসে। সেখানে ও মেয়ে গিয়ে বসে থাকবে কেন? তোকেও বাপু বলিহারি, রাস্তা থেকে হুট করে একটা মেয়ে তুলে আনলি, কোন অজাত-কুজাতের মেয়ে তার ঠিক নেই। যদি চোর ছাচোড় হয়!
নয়নমণি গম্ভীরভাবে বলল, দিদি, আমিও রাস্তার মেয়ে। একজন আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর ঋণ শোধ করতে হবে না? আর জাতের কথা বলছ, আমাদের নিজেদেরই কি জাতের ঠিক আছে? আমরা থিয়েটারের মেয়ে বলে সমাজ আমাদের আগেই পতিত করে দেয়নি? আমরা অন্যের জাত নিয়ে এখনও মাথা ঘামাব?
গঙ্গামণি জিভ কেটে বলল, অ্যাই! তাই তো। ওটা কথার কথা, লোকে বলে তাই আমারও মুখে এসে গেছে। আমাদের আবার জাত নিয়ে মাথা ব্যথা! নয়ন, তোর কাছে আমার এখনও কত কিছু শেখার বাকি আছে। আর কোনওদিন কারুকে জাত তুলে কথা বলব না!
নয়নমণি বলল, ও মেয়ে যাতে এলোকেশীর ঘরে আর না যায়, আমি নিষেধ করে দেব। নীচের তলাতেই যাওয়ার দরকার নেই।
গঙ্গামণি চোখ পাকিয়ে বলল, কেন যাবে না? এটা আমার বাড়ি, তোর ওই মেয়ে বাড়ির যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাবে। এলোকেশী নালিশ করতে এলে ওর থোতা মুখ আমি ভোঁতা করে দেব। ওকে বলে দিতে হবে, এ বাড়িতে ওসব বেলেল্লাপনা করা চলবে না।
নয়নমণি বলল, দিদি, তোমাকে আর একটা কথা মনে রাখতে হবে। ওর নাম পুঁটি কিংবা খুঁটি নয়, এখন থেকে ওর নাম চারুবালা। তুমি চারু বলে ডেকো। ও যদি কখনও চুরিচামারি করে, দেখো, তোমার সামনেই ওকে কীরকম শাস্তি দেব!
গঙ্গামণি বলল, নয়ন, তুই একটু দাঁড়া তো, তোকে দেখি। তুই দিনদিন কী সুন্দর হচ্ছিস রে! আমি মেয়েমানুষ, তবু আমার চোখ জুড়িয়ে যায়। কুসুমকুমারী-তারাসুন্দরীরা তোর ধারেকাছে লাগে না। আমি পুরুষ হলে জোর করে তোকে বিয়ে করতাম!
এবারে লজ্জা পেয়ে নয়নমণি বলল, যাঃ, কী যে বলল! আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে!
চারুবালাকে কঠিন শাসন করার ইচ্ছে নিয়ে নয়নমণি উঠে এল ওপরে। সে এখনও ঘুমোচ্ছে দেখে তাকে আর জাগাল না। নিঃশব্দে পোশাক বদল করে সে বেরিয়ে পড়ল।
বিকেল হয়ে এসেছে, পথে অনেক মানুষজন। ঘোড়ার গাড়িতে বসে জানলার এক পাশ দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে সে মনে মনে একটা গান গাইছে : ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছে নয়নে নয়নে….’। সরলা ঘোষালের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি গান শেখা হয়ে গেছে এর মধ্যে। কিন্তু আসল মানুষটির দেখা পাওয়া যায়নি এ পর্যন্ত।
সরলা ঘোষাল নয়নমণিকে অনেকখানি আপন করে নিয়েছে। থিয়েটারের অভিনেত্রী বলে কেউ তাকে অবজ্ঞা করে না ও বাড়িতে। বরং দুটি যুবক তার প্রতি বেশি বেশি উৎসাহ দেখায়। সরলা ঘোষালের এক মামাতো ভাই, খোদ ঠাকুরবাড়ির সন্তান, থিয়েটারে নয়নমণিকে দেখার জন্য প্রায় প্রতিটি শো-তে উপস্থিত থাকে। শোয়ের শেষে তার জুড়িগাড়িতে নয়নমণিকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে চায়। তার উদ্দেশ্য অতি স্পষ্ট। নয়নমণি দু-তিনবার তার গাড়িতে উঠেছে, এখন কৌশল করে এড়িয়ে যায়। সে একা ফেরে না। অভিনয়ের শেষে আর তিন-চারজনকে সঙ্গে নিয়ে সাজঘর থেকে বেরোয়। ওই ঠাকুরবাড়ির যুবকটির সঙ্গে সে রূঢ় ব্যবহারও করতে পারে না, আহত হয়ে সে যদি সরলা ঘোষালের কাছে গিয়ে কানভাঙানি দেয়, তাতে নয়নমণির বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। সরলা ও ওই বাড়ির অন্যদের সান্নিধ্য নয়নমণির বড় প্রিয়।
প্রত্যেকবার বালিগঞ্জের বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় নয়নমণির বুক এক আকাঙ্ক্ষায় কাঁপে। আজ কি তিনি আসবেন? এ বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ এক সময় ঘন ঘন আসতেন, সরলার কাছে সে গল্প শুনেচ্ছে নয়নমণি। কিন্তু ইদানীং আর তিনি আসেন না। নয়নমণি এক দিনও তাঁর দর্শন পায়নি।
দেখা না হলেও নয়নমণি রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লেখে। অনেকগুলিই মনে মনে, কিন্তু কিছু কাগজে-কলমে লিখেও ফেলেছে। এ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে তিনটি চিঠি পাঠিয়েছে সে, তার অন্তর উজাড় করে দিয়েছে, কিন্তু কোনও চিঠিতেই সাক্ষর নেই, ঠিকানা দেওয়ারও প্রশ্নই ওঠে না। রবীন্দ্রনাথ চিঠিগুলি পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকেন নিশ্চয়ই, এই দৃশ্যটি কল্পনা করেই নয়নমণি গভীর আনন্দ পায়।
বালিগঞ্জে ঘোষালবাড়ির সামনে এসে নয়নমণি দেখল, আর একটি গাড়িও ঠিক তখনই সেখানে থেমেছে, তার থেকে নামছে এক বিদেশি ও এক বিদেশিনী। নারীটি শ্বেতাঙ্গিনী, পুরুষটির গায়ের রং ঘি-মাখনের মতন, চোখ দুটি ছোট ছোট, খুব সম্ভবত চিনা বা জাপানি। নয়নমণি ইতস্তত করতে লাগল। এ সময়ে তার যাওয়া কি ঠিক হবে? সরলা সব সময় নয়নমণিকে নিজের পাশে বসায়, অন্য আগন্তুকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এই সাহেব-মেমদের সঙ্গে সে কথা বলবে কী করে? বাল্যকালে তার বাবা তাকে কিছু ইংরেজি শিখিয়েছিলেন, এখনও নয়নমণি বানান করে করে দু-চার ছত্র ইংরেজি পড়তে পারে, ক্যাট মানে বিড়াল, র্যাট মানে ইঁদুর আর ম্যাট মানে মাদুর এই সব সে জানে, কিন্তু মন থেকে বানিয়ে ইংরেজি বাক্য বলার ক্ষমতা তার নেই। সরলা দিব্যি গড়গড়িয়ে ইংরেজি বলে, সেরকম লেখাপড়ার সুযোগ তো নয়নমণি পায়নি। একবার ক্লাসিক থিয়েটারে স্টেটসম্যান নামে ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক একটা প্লে দেখতে এসেছিলেন, কবে আসবেন তা জানিয়েছিলেন আগে থেকে। অমরেন্দ্রনাথ সব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ডেকে বলেছিল, বিলিতি কেতা অনুযায়ী সম্পাদকমশাই নাটক দেখার পর সকলের সঙ্গে পরিচয় করতে চাইবেন, তোমরা অন্তত নিজের নামটা ইংরেজিতে বলা শিখে নাও। সবাই পার্ট মুখস্ত করার মতন নিজের নাম বলা মুখস্থ করেছিল। নয়নমণি অবশ্য আগে থেকেই বলতে পারে, মাই নেইম ইজ নয়নমণি দাসী।
তা হলে তার ফিরে যাওয়াই উচিত। কিন্তু সরলা যে আসতে বলেছিল আজ বিকেলে। সরলার কাছে প্রায়ই নানারকম মানুষ আসে, তাদের কথাবার্তা শুনতে সে দারুণ আগ্রহ বোধ করে। সে নিজে কিছু না বললেও তৃষ্ণার্তের মতন ওই সব আলোচনা শোনে। এ যেন এক অন্য জগৎ। এদের কত বিদ্যা, কত জ্ঞান, এরা পৃথিবীর কথা বলে, দেশের কথা বলে, স্বাধীনতার কথা বলে। থিয়েটারের ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এই বৃহত্তর জগতে প্রবেশের জন্য তীব্র ব্যাকুলতা বোধ করে নয়নমণি। কিন্তু সে যোগ্যতা যে তার নেই, না আছে বংশগৌরব, না আছে শিক্ষাদীক্ষা, সে যে শুধুই এক নটী।
কৌতূহল দমন করতে পারল না নয়নমণি, গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া ঢুকিয়ে দিল। এ বাড়ির দরোয়ান ও পরিচারকরা তাকে চিনে গেছে, আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে সে চলে এল বৈঠকখানায়। পাশের একটি ছোট ঘরে সরলা তার অফিস বানিয়েছে, তার দলের ছেলেরা ও বাইরের লোকেরা এখানেই তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। বড় বড় কাগজে দেশাত্মবোধক কবিতা লেখা পোস্টার সাঁটা রয়েছে সব দেওয়ালে। বড় টেবিলের চার পাশে আট দশটি চেয়ার, সরলা যেখানে বসে তার ঠিক পেছনের দেওয়ালে একটি ভারতবর্ষের মানচিত্র।
সরলার পাশে বসে আছে এক মহিলা, এর নাম প্রিয়ংবদা, নয়নমণি আগে একে দু-একবার দেখেছে। মহিলাটি বিধবা এবং একজন কবি। বিধবা হলেও সে লাল পাড় শাড়ি পরে, মুখোনি বেশ সুশ্রী। সরলা নয়নমণিকে দরজার কাছে দেখে বলল, এসো বোন, এখানে এসে বসো।
বিদেশি দুজন বিপরীত দিয়ে চেয়ারে উপবিষ্ট। সরলা পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ইনি মিস মার্গারেট নোবল, স্বামী বিবেকানন্দর সঙ্গে এসেছিলেন এ দেশের সেবা করার জন্য, নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। আর উনি জাপান থেকে এসেছেন, কাউন্ট ওকাকুরা, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা।
জাপানি ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে সসম্ভ্রমে অভিবাদন জানালেন, মেমসাহেবটি বাংলায় বললেন, নমস্কার।
নয়নমণির পরিচয় জানার পর ওকাকুরা বললেন, হোয়াট এ চার্মিং লেডি!
এরপর ওঁরা সকলে ইংরেজিতে কথা বলতে লাগলেন, নয়নমণি চুপ করে বসে রইল। সে সব কথা বুঝতে পারছে না। কিছু কিছু অনুমান করতে পারছে। শীঘ্রই সরলার উদ্যোগে প্রতাপাদিত্য উৎসব ও বীরাষ্টমী ব্রত উদযাপন হবে, তার প্রস্তুতি চলছে, বিদেশি দুজন সেই সম্পর্কেই কিছু পরামর্শ দিচ্ছেন মনে হল।
নীরবে নয়নমণি পর্যবেক্ষণ করছে সকলকে। ওকাকুরার চক্ষু দুটি ঈষৎ রক্তাভ ও ছলছলে। কিছুটা নেশা করে আছেন মনে হয়। মাঝে মাঝে তিনি গাঢ় চক্ষে তাকাচ্ছেন প্রিয়ংবদার দিকে। ওই দৃষ্টির অর্থ বোঝে নয়নমণি। প্রেমিক-প্রেমিকারা মনে করে অনেক লোকের মাঝখানে তাদের চকিত চক্ষুর মিলন অন্য কেউ দেখতে পায় না। আসলে সকলেই বুঝে যায়। প্রিয়ংবদার সঙ্গে এই জাপানি ভদ্রলোকের ঘনিষ্ঠতা হল কবে? মেমসাহেবটিই কথা বলছেন বেশি, তিনি মাঝে মাঝে এক একটা শব্দের ওপর বেশি জোর দেন, কেমন যেন উত্তেজিত ভাব, এঁর ওষ্ঠে একবারও হাসি ফোটেনি।
প্রিয়ংবদা একবার উঠে গেল বাড়ির অন্দরমহলে। তখন ওকাকুরা মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন নয়নমণিকে। একবার নিবেদিত কথা থামিয়ে নয়নমণির দিকে ইঙ্গিত করে কী যেন বললেন অনেকখানি। ওকাকুরা-সরলাও তাতে যোগ দিলেন। একটু পরে নিবেদিতা নয়নমণিকে বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমাদের সব কথা বুঝতে পারছেন কী?
নয়নমণি লজ্জিতভাবে দুদিকে ঘাড় নাড়ল।
নিবেদিতা বললেন, আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। শ্রীমতী সরলা দেবী যুবকদের নিয়ে একটা দল গড়েছেন। আপনি জানেন নিশ্চয়ই। উনি নিজে একজন রমণী হয়ে যে এরকম একটি সংগঠন করতে পেরেছেন, তা অতি প্রশংসার বিষয়। আমাদের জাপানি বন্ধুটি বলছিলেন যে মেয়েদের নিয়েও সেরকম সংগঠন নেই কেন? দেশের কাজে মেয়েরা কি পিছিয়ে থাকবে? নারীজাতিকে অন্তঃপুরে আগলে রাখলে কোনও জাতিই জাগতে পারে না। আপনার মতন নারীরাই সেরকম সংগঠনের ভার নিতে পারেন। প্রথমে কিছু বালিকা সংগ্রহ করে তাদের গান শেখাবেন, তারপর আস্তে আস্তে তাদের মনে দেশাত্মবোধ ঢুকিয়ে দিতে হবে।
নয়নমণির হৃদয় নেচে উঠল। এরকম কাজের ভার দিলে সে এক্ষুনি নিতে রাজি আছে। যদি থিয়েটার ছেড়ে দিতে হয়, তাতেও আপত্তি নেই। এরকম দায়িত্ব পেলে সেও এদের সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। সরলা কিংবা প্রিয়ংবদার নাম যখন কেউ বলে, তখন তারা হয়ে যায় দেবী। আর নয়নমণির মতন মেয়েরা হয় দাসী। এই সমাজের মেয়েদের গান শেখাবার ভার নিলে সেও কি দাসী থেকে দেবীত্বে উন্নীত হতে পারবে না? ত সরলা কিন্তু এই প্রস্তাবে বিশেষ উৎসাহ দেখাল না। কেমন যেন চিন্তিতভাবে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল নয়নমণির দিকে। তারপর বলল, আচ্ছা সে কথা পরে ভেবে দেখা যাবে।
পরিচারকরা রূপোর রেকাবিতে নানাবিধ মিষ্টদ্রব্য ও জলখাবার নিয়ে এল। আবার কথাবার্তা শুরু হল ইংরেজিতে। ওকাকুরা মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হাসছেন, নিবেদিতা একবারও হাসলেন না।
একজন পরিচারক এসে খবর দিল, মিস্টার অরবিন্দ ঘোষের কাছ থেকে খবর নিয়ে দুজন ব্যক্তি সাক্ষাৎপ্রার্থী। সরলা বলল, একটু অপেক্ষা করতে বলো।
চা পান শেষ করার পর ওকাকুরা ও নিবেদিতা বিদায় নিলেন। প্রিয়ংবদা তাদের এগিয়ে দিতে গেল দ্বার পর্যন্ত।
এরপর ঘরে এসে ঢুকল দুজন যুবক। সরলাকে নমস্কার করে তারা নিজেদের নাম জানাল, হেমচন্দ্র কানুনগো এবং ভরতচন্দ্র সিংহ। হেম বলল, সরলাদেবী, আমরা বরোদার মিস্টার ঘোষের কাছ থেকে এসেছি, তিনি নিশ্চয়ই আমাদের কথা আপনাকে আগে জানিয়েছেন।
সরলা খানিকটা গম্ভীরভাবে বলল, হ্যাঁ। বসুন।
ভরত নয়নমণির দিকে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল। এই কি ভূমিসুতা, না নয়নমণি? নয়নমণি এখন খ্যাতনাম্নী অভিনেত্রী, ঘোষাল পরিবারের মতন উচ্চ সমাজের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ। ভূমিসূতা নাম সে মুছে ফেলেছে, পুরনো জীবনের সব কিছুই নিশ্চয়ই সে মুছে ফেলতে চায়। ভরত সেই পুরনো জীবনের প্রেত। আর কিছু না, ভরত শুধু ভূমিসূতার কাছে একবার ক্ষমা চাইতে চায়। কিন্তু ভুমিসূতা তাকে চেনার কোনও চিহ্ন দেখাল না। পুরনো পরিচয় যদি সে অস্বীকার করে? কথা বলতে গেলেই যদি ক্রুদ্ধ হয় কিংবা অপমান করে?
ভদ্র বাড়ির মেয়েদের দিকে বারবার তাকানো বেয়াদপি, তাই ভরত নয়নমণির দিকে আর চাইল না, একটি কথাও বলল না। মুখ নিচু করে বসে রইল।
ভরতকে দেখা মাত্র নয়নমণির বুকের মধ্যে ঝড় বইতে শুরু করেছে। আকস্মিকতার একটা ধাক্কা লেগেছে বটে, কিন্তু অবিশ্বাস্য মনে হয়নি। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, একদিন না একদিন ভরতের সঙ্গে তার আবার দেখা হবেই। তার প্রতীক্ষা কি ব্যর্থ হতে পারে! কিন্তু এই কি সেই ভরত! একপলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল, তা কি ঘৃণায়? সে কি জেনে গেছে যে ভূমিসূতা এখন মঞ্চের নটী? জানাটা আশ্চর্য কিছু নয়। সকলেই জানে, নটীরা দেহোপজীবিনী। নটীদের দিকে পুরুষরা হয় লালসার দৃষ্টিতে চায়, অথবা ঘৃণা করে। ভরত তার অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেবে না, একটা কথাও বলবে না? সে নারী হয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলাটা মোটেই শোভন নয়। এই মানুষটির প্রণয়স্পর্শ না পেলে ভূমিসূতা হয়তো সারাজীবন সিংহবাড়ির দাসী হয়েই থাকত। ভরতই তাকে জাগিয়েছে, আর অন্তত একবার ভরত তার নাম ধরে ডাকবে না!
যুবক দুটিকে দেখে যে সরলা খুশি হয়নি, তা তার মুখ দেখেই বোঝা যায়। সে নয়নমণির দিকে তাকিয়ে বলল, বোন, তুমি আর প্রিয় একটুক্ষণ ভেতরে গিয়ে বসো, এদের সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
নত মুখে, নীরবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নয়নমণি।