পঞ্চষষ্টিতম অধ্যায় – শারদাতন্ত্র
ভগবান বলিলেন,–যেহেতু পূর্বে শরৎকালে দেবগণকর্তৃক মহাদেবী বোধিত হইয়াছেন, এই নিমিত্ত পীঠস্থানে এবং লোকমধ্যে তিনি শারদা নামে বিখ্যাত হন। ১
নেত্ৰবীজই তাহার মূলমন্ত্র, ইহাও পূর্বে প্রতিপাদিত হইয়াছে এবং দুর্গা তন্ত্র, তাহার মন্ত্র ও অঙ্গমন্ত্র বলা হইয়াছে। এই দুই মন্ত্রদ্বারা সেই জগন্ময়ী দেবীর পূজা করিবে। ২-৩
পূর্বোক্ত চতুৰ্বর্গ প্রদায়ক তৃতীয় পীঠ মন্ত্রদ্বারা শারদার পূজা করিলে সকল প্রকার সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ৪
ইহার স্বরূপ পূর্বেই বলা হইয়াছে, সিংহোপরিস্থিত এবং দশবাহুযুক্ত। হে পুত্রদ্বয়। এক্ষণে পূজার ক্রম শ্রবণ কর। ৫-৮
বিভূতিলাভের নিমিত্ত প্রথমে চতুর্দ্বার মণ্ডল করিবে। মহামায়ার যেরূপ মণ্ডল শারদারও সেইরূপ মণ্ডল। ৯
বৈষ্ণবীকল্পোক্ত মন্ত্রদ্বারা স্থান মার্জন করিয়া নেত্র-বীজদ্বারা প্রস্তরে মণ্ডল অঙ্কিত করিবে। ১০
যোনিতে অষ্টদল অঙ্কিত করিয়া তাহার মধ্যে ত্রিকোণ অঙ্কিত করিবে। বৈষ্ণবীমণ্ডল হইতে ইহাই বিশেষ কথিত হইল। ১১
মণ্ডলে রেখাদি অঙ্কন, ভূতাপসারণ, অর্ঘ্যপাত্রের প্রতিপত্তি, অমৃতীকরণ গন্ধ, পুষ্প ও জলক্ষেপ, আত্মা ও আসনপূজা, ত্রিবিধ প্রাণায়াম, ভূতশুদ্ধি, প্রবেশন, দহন, প্লাবন, পাণিকচ্ছপিকা এবং যোগপীঠের ধ্যান–এ সকল উত্তর তন্ত্রে বৈষ্ণবীতন্ত্র প্রসঙ্গে যেরূপ যেরূপ উক্ত হইয়াছে, শারদা দেবীর পূজাতেও সেই সেই রূপ করিবে। ১২-১৪।
সলিলে ধেনু মুদ্রা দ্বারা অমৃতীকরণ করিবে এবং দেবীর যাদৃশ দশভূজারূপ পূৰ্বে উক্ত হইয়াছে, সেইরূপ ধ্যান করিবে। ১৫
হে ভৈরব! অঙ্গন্যাস এবং করন্যাস দুর্গাতন্ত্রোক্ত নয় অক্ষর দ্বারা অঙ্গুষ্ঠাদি ক্রমে করিবে। ১৬
পরে হৃদয়াদি ক্রমে, বক্ত্রাদির ন্যাসও পূর্ববৎ করিবে। সুধী সাধক অর্ঘ্য পাত্রে ঐ মন্ত্রেরই আটবার জপ করিবে। ১৭
অনন্তর অর্ঘ্যপাত্রস্থিত জল দ্বারা আপনার মস্তক ও পুষ্প, গন্ধ আদি পূজার উপকরণ অভিষিক্ত করিবে। দেবীর মণ্ডলে এইরূপ ক্রমে পূজা আরম্ভ করিবে। ১৮
প্রথমে শিলাতলে সূৰ্য্যকে চণ্ডিকা স্বরূপ চিন্তা করিয়া সিদ্ধার্থ অক্ষত এবং পুষ্প দ্বারা তাহাকে অর্ঘ্যপ্রদান করিবে। ১৯
সাধক মণ্ডল মধ্যে ক্লীঁ এই মন্ত্র দ্বারা প্রথমে আধারশক্তি প্রভৃতির পূজা করিয়া অনন্তর পূর্ববৎ ধৰ্ম্মাদিরও পূজা করিবে। ২০
পণ্ডিত সাধক, পূর্ব তন্ত্রোক্ত সত্ত্ব আদি গুরুপাদ পর্যন্ত যাবতীয় পীঠ দেবতার মধ্যে পূজা করিবে এবং মধ্যভাগে আপনাকেও পূজা করিবে। ২১
মণ্ডলের পূর্বভাগে দেবীর শক্তিদিগকে পূজা করিবে এবং কামেশ্বরাদি নাথের ও লৌহিত্য প্রভৃতিরও পূজা করিবে। মণ্ডলের উত্তরে সমুদয় পীঠ দেবতার পূজা করিবে। ২২
মণিকর্ণ, চিত্ররথ, ভস্মকূট, শ্বেত, নীল, চিত্র, বারাহ, গন্ধমাদন, মণিকূট এবং নন্দন ইহাদিগকে পশ্চিমে পূজা করিবে। ২৩
জল্পীশ, কেদার, দিক্করবাসিনী দেবী, ধাত্রী, স্বধা, স্বাহা, মানস্তোকা এবং অপরাজিতা ইহাদিগকে এবং চতুঃষষ্টি যোগিনীগণকে দক্ষিণে পূজা করিবে। ২৪
নবগ্রহ, দিকপাল ইহাদিগেরও যাথোক্তক্রমে পূজা করিবে। বুদ্ধিমান পাঠক পূর্বোক্ত রীতিতে ভৈরব ও ভৈরবারও পূজা করিবে। ২৫
অনন্তর সাধক পাণিকচ্ছপিকা বন্ধন করিয়া পুনৰ্বার হৃদয়স্থিত দেবীর মনে মনে ধ্যান করিবে। ২৬।
অনন্তর মনঃকল্পিত গন্ধ পুস্পাদি দ্বারা হৃদয়স্থিত দেবীর পূজা করিবে। ২৭
অনন্তর দক্ষিণ নাসাপুট দ্বারা হৃদয় হইতে দেবীকে নিঃসারিত করিয়া পুষ্পোপরি আরোপণ করিবে এবং মুহুর্মুহুঃ সেই শারদা কামাখ্যা দেবীর আহ্বান করিবে। ২৮
হে পরমেশানি দেবী! আগমন করুন, আগমন করুন, এই স্থানে সান্নিধ্য স্থাপন করুন; হে শারদে! হে দুর্গে। আপনি সগণ এবং সপরিকর হইয়া এই স্থানে আগমন করিয়া এই মদ্দত্ত পূজাভাগ গ্রহণ করুন; আমার এই যজ্ঞ রক্ষা করুন, আপনাকে নমস্কার করি। ২৯-৩০
আমরা নারায়ণীকে জানিতেছি এবং চণ্ডিকারূপিণী আপনাকে ধ্যান করিতেছি। অতএব হে চণ্ডি! আমাদিগের মঙ্গল সাধন করুন। ৩১
এই মন্ত্রদ্বারা স্নানীয় দান করিয়া পুনর্বার দুর্গাতন্ত্র, নেত্রবীজ এবং পীঠমন্ত্র দ্বারা অবকাশ দান করিবে। অনন্তর চতুরক্ষর মন্ত্রদ্বারা দেবীর অঙ্গনিচয়ের পূজা করিবে। ৩২।
হে ভৈরব! চতুরক্ষর মন্ত্রদ্বারা পূর্বোক্ত পাদ্য আদি ষোড়শ উপচার প্রদান করিবে। ৩৩
দুর্গাতন্ত্রোক্ত মন্ত্রদ্বারা দেবীর অঙ্গনিচয়ের পূজা করিবে। সুধীর পূজক দুর্গা এই মন্ত্র দ্বারা হৃদয়ের পূজা করিবে, দুর্গা এই বলিয়া মস্তকের পূজা করিবে। ৩৪
শিখা, কবচ, নেত্ৰত্ৰয়, বাহুদ্বয় এবং পাদদ্বয় এই পঞ্চাঙ্গের বকারাদি পাঁচটী অক্ষরের এক একটি দ্বারা যথাক্রমে পূজা করিবে। ৩৫
অনন্তর পূর্ব আদি অষ্টদলে বক্ষ্যমাণ নায়িকাগণের অর্চনা করিবে। ৩৬
পূৰ্ব পত্রে জয়স্তীর, আগ্নেয়াদিতে মঙ্গলা কালী, ভদ্রকালী, কপালিনী, দুর্গা, শিবা, ক্ষমা এবং ধাত্রী ইহাদিগেরও যথাক্রমে পূজা করিবে। ৩৭
এই আটজন নায়িকার কেশরের মধ্যে পূজা করিবে এবং নেত্রবীজের মধ্য বীজ দ্বারা নায়িকার পূজা করিবে। ৩৮
ইহাদিগেরও মন্ত্র ঐ ছয় অক্ষর মধ্যে থাকিলে, হ্রীঁ’ হ্ৰীঁ শ্ৰীঁ এই তিন অক্ষর উপান্ত, অন্ত ও প্রান্তে থাকিলে তাহাতে আদ্যস্বর সংযুক্ত হইলে যাহা হয়, তাহাই জানিবে। ৩৯
উগ্রচণ্ডা, প্রচণ্ডা, চণ্ডোগ্রা, চণ্ডনায়িকা, চণ্ডা, চণ্ডবতী, চণ্ডরূপা এবং চণ্ডিকা ইহাদিগেরও পূজা করিবে। ৪০
ত্রিকোণ কেশরের মধ্যে কাম, প্রীতি, রতি, পাঁচটি বাণ পুষ্পময় ধনু কাম মন্ত্রদ্বারা পূজা করিবে। ৪১
পরে অষ্টপুষ্পিকা দ্বারা পরমেশ্বরীর পূজা করিয়া, দেবীর করগৃহ্য শস্ত্র ও অস্ত্রাদির পূজা করিবে। অনন্তর দেবীর বাহন সিংহ এবং ডামর নামক দৈত্যেরও অগ্রে পূজা করিবে। ৪২-৪৩
পীঠদেবতা শারদা, অধিদেবতা কামাখ্যা এবং প্রত্যধিদেবতা মহাদেবী ত্রিপুরারও পূজা করিবে। মধ্যভাগে মহোৎসাহা কামেশ্বরীরও পূজা করিবে। এবং চতুর্থাক্ষর মন্ত্র দ্বারা পুস্পাঞ্জলিত্রয় প্রদান করিবে। ৪৪-৪৫
অনন্তর জপ, স্তব, বলিদান, নমস্কার, অবগুণ্ঠন এবং যোনিমুদ্রা প্রদর্শন করিয়া ঈশান কোণে নির্মাল্য প্রক্ষেপ করিবে। ৪৬।
নির্মাল্য ক্ষেপণের মন্ত্র ‘চণ্ডেশ্বর্য্যৈ নমঃ’। নির্মাল্য ক্ষেপণান্তে বিসর্জন করিবে। ৪৭
অনন্তর অচ্ছিদ্রাবধারণের নিমিত্ত সূৰ্য্যদেবকে অর্ঘ্য প্রদান করিবে। এবং দেবীকে হৃদয়ে স্থাপন করিয়া যোনিমণ্ডলে স্থাপিত করিবে। ৪৮
যে ব্যক্তি যোনিরূপা জগন্ময়ী কামাখ্যা দেবীর এবং মহাদেবী শারদার এই রূপ বিধি অনুসারে পূজা করে, সে সমুদয় অভিলষিত প্রাপ্ত হইয়া অন্তে শিব লোক প্রাপ্ত হয়। ৪৯
যদি পীঠ ব্যতীত এই নীলকূট পৰ্বতের অন্যত্র কোন স্থানে কামরূপিণীর পূজা করে, তাহা হইলে উক্ত সকল প্রকার বিধির অনুষ্ঠান করিবে। ৫০
যদি অন্যত্র জলে স্থণ্ডিলে অথবা শিলা প্রভৃতিতে দেবীর পূজা করিবে তাহা হইলে ইচ্ছামত পীঠদেবতাদিগের পূজা করুক বা না করুক, পীঠে অবশ্য অবশ্য পীঠদেবতাদিগের পূজা করিবে। ৫১
এইরূপে যে ব্যক্তি পঞ্চমূর্তিধরা শিবাকে পঞ্চতন্ত্র সমূদয় অথবা এক একটি তন্ত্র দ্বারা পূজা করে, অম্বিকা স্বয়ং তাহাকে বরদান করেন। ৫২
তাহার কোন প্রকার বিঘ্ন আধি বা ব্যাধি উৎপন্ন হয় না। এবং ধন ধান্য ও সমৃদ্ধিতে আর কেহই তাহার তুল্য হয় না। ৫৩
কোটি গো প্রদান করিলে মনুষ্যের যে ফল লাভ হয়, কামাখ্যা দেবীকে পূজা করিয়াও মনুষ্য সে ফল প্রাপ্ত হয়। ৫৪
মনুষ্য একবার মাত্র কামাখ্যা দেবীর পূজা করিয়া পূর্ববর্তী ও পরবর্তী দশ পুরুষকে পাপ হইতে উদ্ধার করিয়া আমার লোক প্রাপ্ত হয়। ৫৫
যে মনুষ্য যোনিমণ্ডলে কামাখ্যা দেবীকে তিনবার পূজা করে, সে পাপ কোষ হইতে আত্মবংশীয় সহস্র পুরুষকে উদ্ধার করিয়া ইহলোকে সুখ ঐশ্বৰ্য্য ও দীর্ঘায়ুঃ প্রাপ্ত হইয়া দেহাবসানে আমার গৃহে গমন করিয়া গণাধিপত্য প্রাপ্ত হয়। ৫৬-৫৮
যে সাধক যে কোন অষ্টমী ও নবমীতে বরপ্রদা পঞ্চরূপা কামাখ্যাদেবীকে পৃথক পৃথক্ মণ্ডল অঙ্কিত করিয়া স্বতন্ত্র পঞ্চমন্ত্র দ্বারা পঞ্চরূপের ধ্যান এবং পঞ্চ মন্ত্র জপ করিয়া পূজা করে, সেই মনুষ্য সহস্ৰকোটি কল্প আমার লোকে বাস করিয়া অনন্তর দেবীর প্রসাদে পরম নির্বাণ প্রাপ্ত হয়। ৫৯-৬০
যে মনুষ্য ইহলোকে নিখিল বাঞ্ছিতার্থ সুখ ও যশঃ প্রাপ্ত হইয়া সিংহ যেমন অবলীলাক্রমে মাতঙ্গদিগকে বিনাশ করে, সেইরূপ অবলীলাক্রমে শত্ৰুসকল বিনষ্ট করিয়া দীর্ঘায়ুঃ পুত্রপৌত্ৰসমন্বিত হইয়া পুরস্ত্রীগণের সহিত সাদরে অমরের ন্যায় ক্রীড়া করত এবং যক্ষ, রক্ষঃ ও পিশাচদি নায়করূপে নিত্য সকল প্রকার অভিলষিত বস্তু লাভ করিয়া চন্দ্রের সাদৃশ্য লাভ করে। ৬১-৬২। পঞ্চষষ্টিতম অধ্যায় সমাপ্ত। ৬৫