2 of 2

৬৪.৮ হোটেলে চেক ইন করে

হোটেলে চেক ইন করে অতীন নিজের ঘরে উঠে এলো। পাঁচতলায়। ভাড়া করা একদিনের মাথা গোঁজার আস্তানা, এই কক্ষে নিশ্চয়ই কিছুক্ষণ আগেও অন্য মানুষ ছিল, তাদের নিশ্বাস রয়ে গেছে ভেতরের ভারি বাতাসে। তবু বেলবয়কে বখশিস গুঁজে বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করলেই এই চার দেয়াল ঘেরা জায়গাটা একটা ব্যক্তিগত গুহা হয়ে যায়। এখানে যা খুশী করা যেতে পারে।

প্রথমেই জুতো মোজা খুলে সে হালকা হলো। টাইটা খুলে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিল বিছানার ওপর। জ্যাকেটটারও সেই দশা হলো। তার ভয়ংকর তৃষ্ণা পেয়েছে। তার হাত ব্যাগে সব সময় ছোট একটা হুইস্কির বোতল থাকে, স্নানের আগে খানিকটা কড়া পানীয় নেওয়া তার অভ্যেস। তার মনে পড়লো শর্মিলার অনুরোধ, সে একটু হাসলো।

দু’বার চুমুক দিয়েই বোতলটা খাটের তলায় রেখে দিল অতীন। এখন সে সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তার পুরোনো অভ্যেসটা রয়ে গেছে, ঘরের মধ্যে একলা থাকলে সে সব পোশাক খুলে ফেলে। এবার স্নান করতে যেতে হবে। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে সে বেশ জোরে জোরে বলে উঠলো, বাবা, আমি আসছি। আমার সঙ্গে দেখা হবার আগে তুমি চলে যেও না। আমার একটু দেরি হবে, কিন্তু আমি ঠিক আসবো! মা, তুমি চিন্তা করো না, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছোবার চেষ্টা করছি। বিশ্বাস করো, এর আগে যাওয়া সত্যি সম্ভব নয়। মুন্নি আর অনুনয়রা হরিদ্বার থেকে পৌঁছে গেছে? মা, তোমার শরীর ভালো আছে তো?

ঘর সংলগ্ন বাথরুমের দরজাটা খুলে অতীন প্রথমে বাথটাবটা ভালো করে পরিষ্কার করলো। আগে যারা স্নান করে যায়, তারা অনেকেই ধুয়ে দেয় না। অন্যদের গায়ের ময়লা লেগে যাবে ভাবলেই গা-টা শিরশির করে। গরম জল ঠাণ্ডাজল এক সঙ্গে চালিয়ে বাথটাবটা ভরতে ভরতে অতীনের একটা কথা মনে পড়ে গেল। অলি লন্ডনে ফুলদিকে ফোনে খবর দিয়েছে। অলি কি শর্মিলাকেও ফোন করার চেষ্টা করে পায়নি, না ফোন করেইনি? অলির সঙ্গে শর্মিলার অবশ্য কোনোদিনই মনোমালিন্য হয়নি, ওদের পরস্পরের মধ্যে কিছু একটা বোঝাঁপড়া আছে। এখান থেকে অলিকে ফোন করে তো বাবার সঠিক অবস্থাটা জানা যেতে পারে।

।গায়ে জল না দিয়েই অতীন ফিরে এলো ফোনের কাছে। মাত্র কয়েক মাস আগে ভারতের সঙ্গে ডাইরেক্ট ডায়ালিং চালু হয়েছে। দেশ থেকে কেউ সহজে এখানকার লাইন পায় না, কিন্তু এখান থেকে অনেক সময় চট করে পাওয়া যায়। অলিদের বাড়ির ফোন নাম্বার অতীনের নোট বইতে লেখা নেই। কোনো প্রয়োজন হয় না। তবু একটু ভুরু কুঁচকে থাকতেই অলিদের নম্বরটা তার মনে পড়ে গেল, ডাবল ফোর ডাবল এইট, ওয়ান টু। হ্যাঁ, কোনো ভুল নেই। কোনো কোনো জিনিস একেবারে অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেলেও সারাজীবন মনে থেকে যায়। ওয়াই এম সি এর তলার পাবলিক রেস্তোরাঁ থেকে একদিন ফোন করতে গিয়ে অলি বলেছিল, আমাদের নাম্বারটা এইভাবে মনে রাখবে, চুয়াল্লিশ, তার ডাবল হলো অষ্টআশী, আর আট আর চার বারো!

হোটেলের ঘর থেকে লং ডিসটেন্স কল করলে চার্জ অনেক বেশি পড়ে। লবিতে আছে শস্তা ফোন। তা পড় ক গে বেশি, এখন আবার পুরো প্রস্থ পোশাক পরে অতীন নীচে যেতে পারবে না। সে বোতাম টিপতে লাগলো। কানট্রি কোড, সিটি কোড, তারপর নাম্বার…। না লাগছে না। তবু ধৈর্য হারালে চলবে না, পাঁচ বার সাতবার করলে ঠিক লেগে যেতে পারে।

অন্তত পনেরো-ষোলো বছর অতীন টেলিফোন করেনি অলিকে। আজ সে করছে নিজের স্বার্থে। হোক স্বার্থ। অলির সঙ্গে সম্পর্কটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। এখন অলির কথা মনে পড়লেই অতীনের এক ধরনের জ্বালা জ্বালা ভাব হয়। অলি সূক্ষ্ম একটা প্রতিশোধ নিয়ে। চলেছে, অথচ কিছুতেই তা বোঝা যাবে না। সবাই বলবে অলির মতন মহৎ মেয়ে আর হয় না। চতুর্দিকে অলির গুণগান। দেশে ফেরার পর সে অতীনের সঙ্গে সামান্যতম খারাপ ব্যবহার করে নি, শর্মিলাকে কত আদর যত্ন করেছে, নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছে। অলি এমন ভালো অভিনয় করতে জানে! শৌনকের নাম বলে সেবারে কী ধোঁকাই দিয়েছিল! শৌনক ছাড়া আর কারুকে বিয়ে করবে না অলি, এই তার প্রতিজ্ঞা, অথচ শৌনককে কেউ দেখতে পায় না। যত সব বোগাস ব্যাপার!

অলির জন্যই তো অনেকটা সেবার ফিরে গিয়েও দেশে থেকে যাওয়া হলো না অতীনের। অলি আসলে কিছুতেই ক্ষমা করবে না অতীনকে, সে সব সময় তার মনে অপরাধবোধটা জাগিয়ে রাখতে চায়।

আজ লাইন পেলেই অতীন প্রথমে বলবে অলি, আজ আবার তোমার কাছে দয়া চাইবার জন্য আমাকে ফোন করতে হলো। ওগো দয়াময়ী, তুমি আমার বাবার খবরটা একটু দেবে?

সবসুদ্ধ দেশে ফিরে গিয়েও যে থাকা গেল না, তার আরও কয়েকটা কারণ ছিল। তা সবাইকে বলা যায় না। চাকরির অসুবিধে, থাকার জায়গার অসুবিধে, ধুলো-ধোঁয়ার জন্য অসুখ বিসুখ, এসবই তুচ্ছ। এসবই কি অতীন আগে থেকে জেনে যায়নি? সে সব সহ্য করতে পারতো। কিন্তু আর একটা আঘাত দিয়েছিল কৌশিক-পমপম।

অতীনের মতন মানুষরা শুধু মা বাবার জন্যই ফিরে যায় না, মা বাবার সঙ্গে আর কতটুকু সময় কাটানো যায় এই বয়েসে! ফিরতে হয় দেশের টানে, বন্ধুদের টানে। অতীনের সেই দুটি টানই প্রবল ছিল। কিন্তু দেশ তাদের জায়গা দিতে চায়নি, যেন অনবরত একটা অব্যক্ত ধ্বনি শোনা গেছে, ফিরে যা! ফিরে যা! আর বন্ধুরা! কয়েকজন বন্ধু স্ত্রী-পুত্র কন্যা নিয়ে ঘোর সংসারী হয়ে গেছে। কেউ কেউ এখন ক্লাব লাইফ-পার্টি লাইফ নিয়ে গর্ব করে। কৌশিক পমপম ছাড়া তার পরিচিতদের মধ্যে আর কেউই প্রায় প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নেই, শুধু রাজনীতি নিয়ে তর্ক করে। পমপম আর কৌশিকের ব্যবহার ছিল অদ্ভুত ঠাণ্ডা। কৌশিকের পেটের মধ্যে এখনো একটা গুলি রয়ে গেছে, অতীন প্রস্তাব দিয়েছিল তাকে বিদেশে এনে চিকিৎসা করাবে, কৌশিক রাজি হয়নি। হেসে বলেছিল, ওটা আমি হজম করে ফেলেছি প্রায়। পুরোটা হজম হয়নি, মাঝে মাঝে খোঁচা দেয়। তাই বিপ্লবের চিন্তাটা একেবারে ছাড়িনি। বিপ্লবের প্রত্যাশায় কৌশিক-পমপম ঝাড়গ্রামের দিকে ইস্কুল মাস্টারি করে জীবনটা কাটিয়ে দেবে। অতীন একদিন দারুণ অভিমানের সঙ্গে কৌশিককে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছিল, তুই আমার সঙ্গে এমন পর পর ব্যবহার করছিস কেন রে? আমার গায়ে কি আমেরিকান গন্ধ হয়ে গেছে? তোর খুব বিপদের সময় আমি আসতে পারিনি বলে তুই এখনো রেগে আছিস? আমিও এক সময় একা একা কম বিপদের মধ্যে কাটাইনি।

কৌশিক ম্লান হেসে বলেছিল, আরে না, ওসব কিছু না। তুই সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে ঝাড়গ্রামের বীনপুরে আমাদের সঙ্গে এসে থাকতে পারবি? আমরা এক লেভেলে এলে তারপর আবার ঠিকমতন কম্যুনিকেশন হতে পারবে। আসল কাজ এখন এইসব জায়গাতেই শুরু করতে হবে রে, একেবারে তলা থেকে ভিত তৈরি করতে না পারলে…

সেটা কী করে অতীনের পক্ষে সম্ভব? কৌশিক পমপমদের কোনো বাচ্চা কাচ্চা নেই, ওরা তবু জীবন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু অতীন এখন দুটি সন্তানের পিতা, তার একটা অন্য দায়িত্ব আছে।

কৌশিকের চেয়ে পরপমেরই যেন বেশি বিরাগ অতীনের ওপর। আসলে ওরা দু’জনেই খুব মরালিস্ট, ওরা অলির বদলে শর্মিলার সঙ্গে অতীনের বিয়েটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। শুকনো খটখটে চেহারা হয়ে গেছে পমপমের, অলির সঙ্গে তার চরিত্রেরও কোনো মিল নেই, তবু ওদের মধ্যে এত বন্ধুত্ব কী করে হলো কে জানে!

দেশে ফিরে যাবার এক মাস বাদেই অনীতা বলতে শুরু করেছিল, ড্যাডি, লেটস গেট ব্যাক হোম। উই হ্যাভ সীন এনাফ অফ ইণ্ডিয়া!

প্রথমবার শুনে আঁতকে উঠেছিল অতীন। সে বলেছিল, চুপ, চুপ! তুই কী বলছিস রে অনীতা! হোম মানে? ইণ্ডিয়াই তো আমাদের হোম। এখানে দাদু-দিদু আছেন।

অনীতার তখন মাত্র পাঁচ বছর বয়েস। সে কিছুতেই বুঝবে না। সে বারবার মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলেছিল, নো-ও-ও! দিস ডাটি প্লেস ইজ নট আওয়ার হোম! আওয়ার হোম ইজ ইন নিউ ইয়র্ক।

অতীনের ইচ্ছে হয়েছিল, মেয়েটার কান ধরে এক চড় কষাতে। দোষ অবশ্য অনেকটা তাদেরই। অনীতার জন্মের পর সে আর শর্মিলা চাকরি নিয়ে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে মেয়েটাকে বাংলা শেখাতে পারেনি, নিজের দেশের কথা ঠিক মতন বোঝাতেও পারেনি। অনীতা জানে, যেখানে সে জন্মেছে, যে বাড়িতে তার নিজস্ব একটা ঘর আছে, যেখানে তার প্রতিবেশী খেলার সাথীরা আছে, সেটাই তার হোম। জন্মসূত্রেও তো সে আমেরিকান!

অনীতা প্রায়ই নিউ ইয়র্কে ফিরে যাবার জন্য কান্নাকাটি করতো, মাস কয়েক বাদে তার হুপিং কাশি হয়ে গেল। অবস্থা এমনই দাঁড়ালো যে, এক সময় মনে হয়েছিল, ওকে আর বাঁচানো যাবে না। দেশের কোনো ওষুধ পত্রে বিশ্বাস করা যায় না। তখন কেঁপে উঠেছিল অতীনের পিতৃহৃদয়। অনীতাকে বাঁচাবার জন্যই ফিরতে হয়েছিল অত তাড়াতাড়ি। এখান থেকে চাকরি বাকরি ছেড়ে, পোঁটলা-পুটলি বেঁধে যারা দেশে চলে যায়, আবার এক বছরের মধ্যে ফিরে এসে তিক্তভাবে স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী শোনায়, অতীন নিজেও যে সেইদলে পড়বে, তা সে কখনো ভাবেনি। যাবার আগে সে ভেবেছিল, গ্রীন কার্ড ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে যাবে। ভাগ্যিস ছেড়েনি!

এইবার লাইন পাওয়া গেছে কলকাতার। রিং হচ্ছে। প্রথমেই কি অলি ধরবে? ফোনটা ওদের বাড়ির দোতলায়, এখন ওখানে সকাল, অলি কি এরই মধ্যে অফিস ঘরে এসেছে?

একজন স্ত্রীলোকের কণ্ঠ, অলির নয়, সম্ভবত কাজের মেয়ের, সে বারবার বলছে, বাড়িতে কেউ নেই। আওয়াজ বেশ অস্পষ্ট!

অতীন বললো, অলি নেই! বিমানকাকা? কিংবা কাকিমা? বলো যে আমেরিকা থেকে একজন ফোন করছে, খুব দরকার।

কাজের মেয়েটির বোধহয় ফোন ধরার অভ্যেস নেই, সে বারবার বলছে ঐ একই কথা, বাড়িতে আর কেউ নেই কো, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে অতীনকে লাইন কাটতেই হলো। অতবড় বাড়িতে একজনও কেউ নেই ফোন ধরবার মতন? সেটা তো আরও আশঙ্কার কথা। সবাই মিলে যাদবপুরে গেছে বাবার কাছে! সব শেষ!

স্নানের কথা আর তার মনেই পড়লো না। সে উঠে দাঁড়িয়ে ছটফট করতে লাগলো। না, হতেই পারে না, বাবার সঙ্গে একবার দেখা করতেই হবে। অনেক ভুল তো বোঝাবুঝি রয়ে গেছে। বাবাকে একবার জানাতেই হবে, আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি, পি এইচ ডি করার আগে থেকেই আমি এ দেশ থেকে চলে যেতে চেয়েছিলাম, তোমরাই তখন বারণ করেছিলে, আজও আমার বিদেশে পড়ে থাকতে একটুও ভালো লাগে না। চাকরি করছি, টাকা রোজগার করছি, ঠিক যন্ত্রের মতন, এদেশের মাটিতে আমার একটুও শিকড় জন্মায়নি। এমনকি শর্মিলাও, অনেকে ওকে ঠিক বুঝতে পারে না, শর্মিলা আজকাল আরও বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে, কিন্তু ও ভেতরে ভেতরে কষ্ট পায়। অন্য অনেক বন্ধুর স্ত্রীই এদেশ ছেড়ে যাবার কথা আর ভাবে না, কিন্তু শর্মিলা এত বছর পরেও এখানকার জীবনযাত্রা পছন্দ করতে পারেনি, যে কোনো দিন, যে কোনো শর্তে সে চলে যেতে রাজি। শুধু ছেলেমেয়েদুটো চায় না। ভারত ওদের দেশ নয়, সে দেশটা সম্পর্কে ওদের কোনো মায়া নেই, সে দেশের মানুষদেরও ওরা চেনে না…।

দেয়ালের দিকে তাকিয়ে অতীন চিৎকার করে বললো, অলি, অলি, আমি পৌঁছোনো পর্যন্ত আমার বাবাকে তুমি বাঁচিয়ে রাখো। বাবাকে কয়েকটা কথা বলতেই হবে। তুমি আমার বাবার বিছানার কাছে থেকে এই সময়টুকু। তোমার ওপর এখনো আমি এই জোর করতে পারি। পারি না?

ঘুরে দাঁড়িয়ে অতীন ভাবলো। শর্মিলাকে ফোন করবে? যদি নতুন কোনো খবর এসে থাকে।  কে খবর দেবে? ফুলদি! এখান থেকেই ফুলদিকে ফোন করা যেতে পারে। এই কথাটা আগে মনে আসেনি কেন?

লন্ডনের লাইন পাওয়া সোজা। কানেকশান পেয়েই সে জিজ্ঞেস করলো, কে, আলমদা? ফুলদি কোথায়?

অন্যসময় আলম ঠাট্টা ইয়ার্কি ছাড়া কথা বলে না। আজ সে গম্ভীরভাবে বললো, শালাবাবু। তোমার ফোন এক্সপেক্ট করছিলাম এতক্ষণ। তোমার ফুলদিকে তো আমি এই মাত্তর এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে আসলাম। এতক্ষণ কলকাতার দিকে রওনা হয়ে গেছে।

অতীন চমকে গিয়ে বললো, এরই মধ্যে? ফুলদি কখন খবর পেয়েছে?

আলম বললো, খবর পেয়েছে প্রায় সন্ধ্যার সময়! ব্যাপারটা হলো কী, একটা টিকিট কোনো রকমে ম্যানেজ করা গেল, আমাদেরই হাসপাতালে একজন যাওয়া ক্যানসেল করেছে ফরচুনেটলি তোমার ফুলদি সেটা পেয়ে গেল, এই ভোর রাত্রেই ফ্লাইট।

–কলকাতায় কী হয়েছে?

–তুমি খবর সব শোনো নি?

–না,সব শুনি নি। আমার বাবা কতটা অসুস্থ? কিংবা এর মধ্যেই কিছু ঘটে গেছে?

–সেটা ফ্র্যাংকলি আমি জানি না, বাবলু। জানলে বলতাম। আমাদের দেশের লোকেরা মনে করে হঠাৎ শুনলে আমরা শক পাবো, তাই সত্য কথাটা চট করে বলে না। ক্রিটিক্যালি ইল বললে ধরে নিতে হবে এক্সপায়ার করে গেছে। ঐ শব্দটাও আমি শুনি নাই। তবে, লেটুস হোপ ফর দা বেটার।

–ফুলদি আপনাকে কিছু বলে যায় নি?

–কান্নাকাটি শুরু করেছিল। মামাকে খুব ভালোবাসে তো। মামার কাছেই মানুষ হয়েছে।

–ফুলদি কান্নাকাটি করছিল?

–আহা, তার মানে এই না যে সব শেষ। তোমার ফুলদি নিজে ডাক্তার হলে কী হয়, কোনো কঠিন খবর সহ্য করতে পারে না। তুমি কবে যাচ্ছো!

–দেখি, খুব সম্ভবত কালকেই। আচ্ছা, আলমদা, রাখি।

–ও শোনো শোনো বাবলু, আর একটা কথা। তোমার মা এখন কলকাতায় নাই, তা শুনেছো তো? সেইটাই আরও দুঃখের ব্যাপার।

-–মা কলকাতায় নেই মানে? মা কোথায়?

–মা হরিদ্বারে তোমার ছোটবোনের কাছে গেছেন, তার তো বাচ্চা হবে বোধ হয়। দ্যাটস হোয়াট আই গ্যাদার ফ্রম দা টেলিফোনিক কনভারসেশান। তোমার মা কাছে নাই, তোমরা কেউ কাছে নাই তোমার বাবার এই এতখানি বয়েসে খুব ডিপ্রেসিং তো লাগতেই পারে, আরও শোনলাম, হি অ্যাটেমটেড সুইসাইড।

–হোয়াট?

–ডোন্ট গেট আপসেট, বাবলু। সেজন্য ফেটাল কিছু হয় নাই। এখন অসুস্থ আই অ্যাম শিওর, হি উইল সারভাইভ দিস টাইম। তোমার ফুলদি গেছে, সে যথাসাধ্য ব্যবস্থা করবে।

ফোনটা ছুঁড়ে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করলো অতীনের। বাবা আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন? কার ওপর রাগ করে? বাবার চরিত্রে এটা একেবারেই মানায় না, নিজের মতামতের ওপর যার সব সময় গভীর বিশ্বাস। তা ছাড়া এখন কোনো দায় দায়িত্ব নেই, সারাটা জীবন স্ট্রাগল করে এসে এখন নিশ্চিন্ত সময়ে পৌঁছে তিনি জীবনটা আগে আগে শেষ করে দিতে চাইবেন কেন? বাবার মতন মানুষদের আত্মবিশ্বাসের জোর সহজে টলে না। আলমদার কথা ঠিক বোঝা গেল না। মা কাছে নেই! মা কি খবরটা জানতে পেরেছে? লন্ডন-আমেরিকায় ফোন করার চেয়ে হরিদ্বারে ফোন করা অনেক শক্ত।

না, অতীন আর একা সামলাতে পারছে না। শর্মিলা ঠিকই বলেছিল, আজ রাত্তিরেই তার নিউ জার্সিতে ফিরে যাওয়া উচিত ছিল। এই রকম মানসিক অবস্থা নিয়ে সে কাল সকালে একজন ঝানু ব্যবসায়ীর সঙ্গে অফিসের কাজ নিয়ে আলোচনা চালাবে? অসম্ভব? এরা সব সময় প্রথমেই উল্টো যুক্তি দিয়ে শুরু করে। অতীন হেরে যাবে।

এই হোটেলের লবিতেই দুটি স্থানীয় বিমান কেম্পানীর অফিস ও একটি ভ্রমণ সংস্থা আছে। এখন অবশ্য বন্ধ। হোটেল কাউন্টারের কর্মচারিরা অনেক সময় টিকিটের ব্যবস্থা করে দেয়, ওরা কমিশন পায়। অতীন ডেস্ক ট্যাপ করে বললো, আমাকে নিউ ইয়র্ক কিংবা নিউ অ্যার্ক যাবার একটা টিকিট যোগাড় করে দিতে পারো? খুবই জরুরি প্রয়োজন।

একটি যুবাকণ্ঠ পালিশ করা ভদ্রতার সঙ্গে বললো, কোন তারিখের টিকিট চান, স্যার?

অতীন বললো, এখন থেকে দু’ঘণ্টা পরের যে কোনো ফ্লাইটের।

সেই যুবকটি বললো, খুবই দুঃখিত স্যার আমি যতদূর জানি, আগামী তিন দিনের কোনো টিকিট নেই।

অতীন এবার বিরক্ত হয়ে বললো, ডেনভার থেকে নিউ ইয়র্ক যাবার কোনো টিকিট নেই। গাদা গাদা ফ্লাইট আছে। আজ রাত্তিরে না হয়, কাল আর্লি মর্নিং যেকোনো ফ্লাইটে।

–একটি টিকিটও নেই। এখানে দন্ত চিকিৎসকদের একটা সমাবেশ শেষ হলো, দেড় হাজার ডেলিগেট আজই ফিরছেন। তা ছাড়া আপনি নিশ্চয়ই জানেন, পরশু নিউ ইয়র্কের সঙ্গে কলোরাডো স্টেটের ফুটবল খেলা, সেজন্য অসংখ্য যাত্রী, ওয়েটিং লিস্টেই আছে একশো ছাপ্পান্ন জন। এমনকি ফার্স্ট ক্লাসের টিকিটও নেই।

অতীন তাকে জোর ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেল। লোকটি তো ইচ্ছে করে বাজে কথা বলবে না, টিকিট বিক্রি হলে ও কিছু পয়সা পেত। টিকিট গছালেই ওর লাভ। হ্যাঁ, ফুটবল খেলা এখানে একটা মস্ত বড় হুজুগ। আজকের কাগজেই আছে যে কলোরাডো স্টেট অনেকদিন বাদে ফাইন্যালে এসেছে। শীত শেষ হবার পরই শুরু হয়ে যায় স্প্রিং টাইম রাশ, অনেকেই এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে যায়, টিকিট পাওয়া শক্ত, এ কথা অতীন আগে চিন্তা করে নি।

তা বলে আমেরিকার মধ্যে এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার প্লেন পাওয়া যাবে না, এটা অতীন এখনও বিশ্বাসই করতে পারছে না। সে সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করলো, হোটেলে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। সে একটু বাদেই চেকআউট করে চলে যাবে এয়ারপোর্ট, সেখানে কোনো না কোনো ফ্লাইটে সে জায়গা পাবেই।

এবার নিজেই বেজে উঠলো টেলিফোন। সেটা তুলেই অতীন জিজ্ঞেস করলো, পাওয়া গেছে টিকিট?

শর্মিলা বললো, বাবলু, টিকিটের ব্যাপার নিয়ে খুব মুশকিল দেখা দিয়েছে। সতীশ ভাটিয়া টরেন্টোতে গেছে, তার সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না। কল্যাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু ওর যে বন্ধু ট্রাল এজেন্ট, সে বললো, আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে টিকিট পাবার কোনো আশা নেই। সব কটা এয়ারলাইনস হেভিলি বুকড। তার ওপর কী হয়েছে, আজ এয়ার ফ্রান্সের একটা জেট ক্রাশ করেছে শুনেছো? এয়ার ফ্রান্স আপাতত বন্ধ। আর এয়ারইণ্ডিয়ার লন্ডনের গ্রাউন্ড স্টাফ স্ট্রাইক করেছে, তাই এয়ার ইণ্ডিয়ার ফ্লাইট এখান থেকে যাচ্ছে না। সব ডিজরাপটেড় হয়ে গেছে। আমি এয়ার ইণ্ডিয়ার এখানকার ম্যানেজারকে বাড়িতে ফোন করেছিলাম, সব বুঝিয়ে বলাতে উনি দুঃখ প্রকাশ করলেন, এখন কোনোই নাকি উপায় নেই ওঁদের।

অতীন খুব শান্ত ঠাণ্ডা গলায় বললো, ঠিক আছে, আমি আগে গিয়ে পৌঁছেই, তারপর একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবেই। তুমি চিন্তা করো না।

শর্মিলা বললো, তোমার কী হয়েছে বাবলু? শরীর খারাপ লাগছে?

–না তো। কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।

–কল্যাণের বন্ধু বললো, মঙ্গলবার জাপান এয়ার লাইনসের একটা টিকিটের ব্যবস্থা হতে পারে, তাও ওয়েস্ট কোস্ট দিয়ে, ব্যাংকক পর্যন্ত পৌঁছে দেবে, বাকিটুকু কনফার্মড নয়, ওখানে পৌঁছে চান্স নিতে হবে।

–মঙ্গলবারের টিকিট দিয়ে আমি কী করবো? বলছি তো, আমি নিউ ইয়র্ক গিয়ে ঠিকই ব্যবস্থা করবো যা হোক, কালই পৌঁছোচ্ছি। রণ আর অনীতা খেয়ে নিয়েছে?

–ওরকম ভাবে কথা বলছো কেন বাবলু? সত্যি করে বলল, তোমার কী হয়েছে?

–আমার কিচ্ছু হয়নি। মিলি, আমি যদি এই চাকরিতে রেজিগনেশান দিই, তোমার আপত্তি আছে?

–একটুও না!

–অ্যামেরিকান কম্পানির হয়ে চায়নায় ম্যাজিক ফার্টিলাইজার গছাবার জন্য মুখের রক্ত তুলে খাটছি। জিমি বলেছিল, তোমাদের ইণ্ডিয়ায় তো আরও বেশি ফার্টিলাইজার দরকার। তুমি সেজন্য কিছু করতে পারো না? সেই কথাটা হঠাৎ এখন খুবই অপমানের মতন লাগছে। এই চাকরিটা আমি ছেড়েই দেবো!

–ঠিক আছে, চাকরি ছেড়ে দাও। তোমার গলাটা খুব টায়ার্ড শোনাচ্ছে বাবলু। এত খাটুনিরও কোনো মানে হয় না। যদি বলো তো, আমরা সবাই দেশে ফিরে যেতে পারি তোমার সঙ্গে। নেক্সট অ্যাভেইলেবল ফ্লাইটে। রণ আর অনীতাকে জোর করে নিয়ে যেতে হবে দরকার হলে।

–ছেলে-মেয়েদের কান্না আমরা কি বেশিদিন সহ্য করতে পারবো? আমাদের মন দুর্বল হয়ে যাবে। তা ছাড়া সামনেই অনীতার পরীক্ষা।

একটু পরে ফোনটা রেখে দিয়ে অতীন চুপ করে বসে রইলো। আরও কী যেন একটা বাকি আছে? মা হরিদ্বারে মুন্নির কাছে। মুন্নি বাবাকে এত ভালোবাসে, সে বাবাকে আর দেখতে পাবে না? বাবা কি এর মধ্যে চলে গেছেন, না আছেন? ফুলদি এমন হুড়োহুড়ি করে প্লেন ধরলো কেন?

ও, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, এখনো বাকি আছে জিমিকে ফোন করা। জো ম্যাককরমিকের বদলে জিমিকেই সে খবরটা জানাবে আগে। জিমি তার প্রকৃত বন্ধু। সে ঠিক বুঝবে।

শুক্রবার সন্ধ্যায় কারুকে বাড়িতে পাওয়া খুবই অনিশ্চিত। জিমির স্ত্রী সেরা ফোন ধরলো। সেরাও অতীনকে চেনে, বেশ কয়েকবার ডিনার খাইয়েছে। সেরা একটু কুণ্ঠিত ভাবে বললো, শোনো ওটিন, জিমি তো পাশের বাড়িতে টেনিস খেলতে গেছে, তোমার কি খুবই দরকার? কাল সকালে ফোন করলে হয় না। কিংবা অধিক রাতে?

অতীনও বিনীত ভাবে বললো, ক্ষমা করো, সেরা, সত্যিই খুব প্রয়োজনীয় কথা আছে। জীবন মরণের প্রশ্ন। তুমি ওকে ডাকো। আমি দশ মিনিট পরেই আবার রিং করছি।

জিমি গারনার মাঝে মাঝে সরল সরল প্রশ্ন করে অতীনকে খোঁচায় বটে কিন্তু সে মোটেই বোকা সোকা মানুষ নয়। এদেশের অনেক কিছুই অপছন্দ করে অতীন, কিন্তু জিমি গারনারের মতন কয়েকজন মানুষকে শ্রদ্ধা না করে পারে না। পরোপকারী, বন্ধুবৎসল। হিংসে বলে কোনো জিনিস নেই মনের মধ্যে। এদেশে বিশেষজ্ঞ হওয়াটাই রেওয়াজ, যে ইতিহাস ভূগোল কিছুই জানে না, সে হয়তো অর্থনীতিটা ভালো বোঝে। যে বিজ্ঞানের পণ্ডিত, সে সমাজতত্ত্ব নিয়ে একটুও মাথা ঘামায় না। জিমিও অর্থনীতি ভালো জানে, সে একবার ভারত ঘুরে এসেছে, সেখানকার অবস্থা সম্পর্কে সচেতন। সে একবার বলেছিল, আমি যদি ভারতীয় হতাম, তা হলে সোসালিজমই সাপোর্ট করতাম। আমেরিকায় আমি ক্যাপিট্যালিজিমের কোনো দোষ দেখি না, এখানে এ সিস্টেমটা ভালোই ওয়ার্ক করছে। তুমি যাই-ই বলল ওটিন, আমাদের পঁচিশ কোটি মানুষের মধ্যে বড় জোর পঁচিশ হাজার ভবঘুরে কিংবা স্বেচ্ছায় ভিখিরি। আর তোমাদের আশি। কোটি মানুষের মধ্যে তিরিশ কোটিই দারিদ্র্য সীমার নীচে। তোমাদের দেশে সমবণ্টন ছাড়া গত্যন্তর নেই।

অতীন বলেছিল, মূর্খ, সমাজতন্ত্র কখনো দুটো পাঁচটা দেশে টিকতে পারে না। সারা পৃথিবীটাকেই ঐ সিসটেমের মধ্যে আনা দরকার। ক্যাপিট্যালিজিমের মূল লক্ষ্যই হলো দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে শোষণ, তোমরা, জাপানীরা আর পশ্চিম ইওরোপের রাষ্ট্রগুলি এখন যা করছে, এতে কখনো গরিব দেশের সমাজতন্ত্র বা গণতন্ত্র সফল হতে পারে?

জিমি বললো, তুমি যাকে শোষণ বলছে, আমি তাকে বলবো, প্রতিযোগিতা। প্রকৃতির মধ্যে, সমস্ত প্রাণী জগতে সব সময় এই প্রতিযোগিতা চলছে। শুধু মানুষের স্বভাব থেকে সেটা বাদ দিতে চাও?

অতীন বললো, মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবেই তা জানি কিন্তু এটা হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা। এর পেছনে থাকে অস্ত্রবলের হুমকি!

জিমি হাসতে হাসতে বলেছিল, তাও ঠিক বটে! তা হলে দরকার হচ্ছে ক্যাপিটালিজিমের সঙ্গে সোসালিজমের একটা চূড়ান্ত লড়াই! তাই না? কে জেতে কে হারে! ঐ লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কে জিতবে বলো তো? কেউ না! মানুষের সভ্যতার দুটো হাত যখন পরস্পরের দিকে অ্যাটম আর হাইড্রোজেন বম ছুঁড়ে মারবে, তখন আর মানুষ থাকবে না, জয়ী হবে শুধু ধ্বংস।

ঠিক দশ মিনিট বাদে আবার রিং করতেই জিমি সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিয়ে বললো, জীবন মরণের প্রশ্ন? বটে! ইঁট বেটার বী টু। টেনিস খেলা ছেড়ে এসে আমি আফিসের সমস্যা নিয়ে। মাথা ঘামাতে চাই না, তুমি জানো!

অতীন বললো, জিমি, আমার বাবা খুব অসুস্থ। পারহ্যাপস হি ইজ ডাইং। জিমি বললো, এতে মরণের ব্যাপারটা বোঝা গেল। আর জীবনের ব্যাপারটা কী?

–আমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি।

–গুড! পৃথিবীতে অনেকেই চাকরি ছাড়ে। এমন কিছু নতুন কথা নয়। সে জন্য এত রাত্রে আমাকে বিরক্ত করার কী মানে হয়? আমি তোমার বস্ নই। ডেনভারে এখন রাত দশটা, এখানে এখন বারোটা তা জানো?

–বন্ধু হিসেবে তোমার কাছে আমি একটা পরামর্শ চাই। চাকরি আমি ছাড়বোই। কিন্তু এরকম মাঝপথে…শোনো, মনে করো, তোমার বাবা, অনেক দূরের কোথাও খুবই সুস্থ, তোমাকে দেখতে চান, তোমার এক্ষুনি যাওয়া দরকার। কিন্তু অফিসের অনেক কাজের দায়িত্ব তোমার মাথার ওপরে চাপানো। সেইসব কাজ বড়, না বাবাকে দেখতে যাওয়াটা আরও অনেক বড়? এটা মনুষ্যত্বের প্রশ্ন। এই রকম ক্ষেত্রে অফিসের দায়িত্বটা কাঁধ থেকে নামিয়ে ফেলা কি ইমরাল? খুব অন্যায়?

–এক এক করে উত্তর দিচ্ছি। প্রথম কথা, আমার যখন তিন বছর বয়েস তখন আমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায়। আমি মায়ের কাছেই ছেলেবেলাটা কাটিয়েছি। আমার মা পরে আবার বিয়ে করেছে, তখন থেকে আমি হস্টেলে। বাবাকে আমি খুব কমই দেখেছি, সুতরাং আই হ্যাভ হার্ডলি এনি ফিলিং ফর মাই ফাদার। তার মুখটাও মনে করতে পারি না। ফর দ্যাট ম্যাটার, আমার মা সম্পর্কেও সে রকম কিছু দুর্বলতা নেই, কারণ, মায়ের দ্বিতীয় পক্ষের দুটো ছেলে-মেয়ে হয়েছিল, তাদের নিয়েই তিনি বেশি ব্যস্ত থাকতেন। আমাদের সমাজে এরকম সম্পর্ক কিছুই অস্বাভাবিক নয়। অপর পক্ষে, তোমরা প্রাচ্যদেশীয়রা, এখনো পিতা-মাতার সঙ্গে সারাজীবন সম্পর্ক রাখো, তোমাদের একটা পারিবারিক বন্ধন আছে, সেটা খুব ভালো ব্যাপার। এই দ্যাখো না, সেরার মা আর বাবা এখন কে কোথায় আছে, সেরা ঠিক বলতেই পারবে না। তোমাদের দেশে এ রকম হতে পারে? সুতরাং বুঝতেই পারছো, তোমার অনুভূতি আর আমার অনুভূতি এক হতেই পারে না। আমার বাবার মৃত্যু সংবাদ পেলে আমি হয়তো একবার কবরখানায় যাবো, কিন্তু তার আগে, হাসপাতালে তাকে দেখতে যাওয়া বোধ হয় আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না। ক্লিয়ার? ইজ দ্যাট আন্ডারস্টুড.?

–কিন্তু জিমি, যদি তোমার বাবার সঙ্গে তোমার ক্লোজ সম্পর্ক থাকতো, যদি তোমার বাবার একটাই বিয়ে হতো, সে রকমও তো অনেকে আছে এখানে–

–ওয়েট, ওয়েট, অত হাইপথিসিস-এ কাজ নেই। তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। প্রাচ্যদেশীয়রা বাবা-মায়ের অসুখ শুনলেই দৌড়ে যায়, এটা আমি জানি। কিন্তু তোমার পক্ষে দৌড়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না, দুদিকে দুটো মহাসমুদ্র আছে। আগামী দু’দিনে তুমি কোনোক্রমেই অ্যামেরিকা ছেড়ে ভারতে যেতে পারছে না, সুতরাং চাকরি ছাড়ার জন্য এত ব্যস্ততার কী আছে? এই দু’দিন তুমি অফিসের কাজ করে নাও। ডেনভার থেকে চলে যাও সান্টা ফে, কেল্লা ফতে করো, তারপর কোম্পানিই তোমাকে একগাদা টাকা দিয়ে ভারতে পাঠাবে!

–আগামী দু’দিন আমি আমেরিকা ছেড়ে যেতে পারবো না কেন? তুমি টিকিটের রাশ-এর কথা ভাবছো? যেমন করেই হোক আমি টিকিট যোগাড় করবো, আই মাস্ট, আমার বাবার সঙ্গে একবার দেখা করতেই হবে, অ্যাট এনি কষ্ট…

–তোমার ইচ্ছেটা খুব নোবল। কিন্তু উপায় সত্যিই নেই। তুমি নিজেকে এখনো খুব ভারতীয় মনে কর, বাট ইউ আর না লংগার অ্যান ইন্ডিয়ান। তুমি এখন একজন অ্যামেরিকান। তোমার অ্যামেরিকান পাসপোর্ট। ভারতে যেতে হলে তোমাকে ভিসা নিতে হবে। শনিরবিবার সব ছুটি, তোমাকে কেউ ভিসা দেবে না! টিকিটের প্রশ্ন পরে…

অতীনের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। এই কথাটা তার মনেও আসেনি। মাত্র সাড়ে চার মাস আগে তার নাগরিকত্ব বদল হয়েছে, সে অ্যামেরিকান পাসপোর্ট নিয়েছে। এ দেশে যেসব ভারতীয় দম্পতি অনেকদিন আছে, তারা সময়মতন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজন ভারতীয় পাসপোর্ট রেখে দেয়। অন্যজন অ্যামেরিকান পাসপোর্ট নেয়। তাতে দু’নৌকোতেই পা রাখা যায়। অতীন নিজের পাসপোর্ট বদলেছে শুধু কাজের সুবিধের জন্য। কোম্পানির কাজে তাকে বিভিন্ন দেশে যেতে হয়, ভারতীয় পাসপোর্ট থাকলে অনেক দেশের ভিসা পেতে ঝামেলা ও সময় লাগে। অনেক। বিশেষত চীন তো ভিসা দিতেই চায় না। তার কোম্পানিই বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে তার অ্যামেরিকান সিটিজেনশীপের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। অতীন কি শর্মিলার চেয়েও ভুলো-মনা হয়ে গেল? অথবা, সে এটা মনে রাখতে চায় না!

অতীনের সাময়িক নীরবতায় জিমি গারনার ঠাট্টার সুরে হাসতে হাসতে বললো, ওটিন মাঝুমদার, ইউ আর ট্র্যাপড! ইউ আর অ্যান অ্যামেরিকান নাউ। তুমি যখন তখন ইচ্ছে। করলেই ভারতে যেতে পারো না! ইউ হ্যাভ টু হ্যাভ আ প্রপার ভিজা! তাহলে আর এই দুটো দিন নষ্ট করবে কেন, অফিসের কাজ করে নাও! টাকাটা পেয়ে যাবে, আমি ব্যবস্থা করে দেবো!

অতীন এবার বিকট রাগের সঙ্গে হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠল, ড্যাম ইউ! ড্যাম ইউ! আমি বলেছি, আমি এই কোম্পানির কাজ আর করবো না। আমার বাবা মৃত্যুশয্যায়, কিংবা কী হয়েছে। কে জানে, এর মধ্যে এখন আমি অফিসের কাজের কথা ভাববো?

জিমি তবু হাসতে হাসতে বললো, কাম ডাউন, কাম ডাউন! নো পয়েন্ট শাউটিং অ্যাট মি! আমি কেউ না। তুমি আমার কাছে পরামর্শ চাইছো। ইন্ডিয়ান এমব্যাসির লোকজনরা কি শনি বা রবিবার ছুটির মধ্যে তোমার ভিসা দেবে? আই ডোন্ট থিংক সো। সুতরাং, এসো, আমরা বাস্তববাদী হই। দুটো দিন তোমাকে অপেক্ষা করতেই হবে। তাহলে এই দুটো দিন কাজে লাগালে ক্ষতি কি? আর একটা কথা বলবো? তুমি ঐ যে একটু আগে বললে, একটা কর্তব্য সম্পাদনের মাঝপথে দায়িত্ব কাঁধ থেকে নামিয়ে দেওয়া ইমমরাল কি না, এই যে এই প্রশ্নটা। তোমার মনে জেগেছে, এর তাৎপর্যই হলো এই যে দা ওয়েস্ট হ্যাঁজ অলরেডি বাগড় ইউ! ইউ আর থরোলি ওয়েস্টারনাইজড, ওটিন! তুমি যদি এখনো প্রাচচদেশীয় থাকতে, তা হলে তুমি মনে মনে বলতে, চাকরিই যখন ছেড়ে দিচ্ছি, তখন এই গড় ড্যাম্ অ্যামেরিকান কোম্পানিটার লাভ হলো, না লোকসান হলো তাতে আমার কী আসে যায়? তুমি তা ভাবোনি। তুমি কাজকে সম্মান দিতে শিখেছে। তা হলে, বাকি দু’দিনে কাজটা সম্পূর্ণ করে নাও! তুমি এ পর্যন্ত যা করে এসেছে, তা হাইলি অ্যাপ্রিশিয়েটেড…

অতীন উচ্চগ্রামে বলে যেতে লাগলো, নো, নো, নো, নো…

দু’ঘণ্টা পরেও অতীন স্নান করলো না, কিছু খেলো না, পোশাকও পরেনি, একই জায়গায় বসে আছে মেঝের কার্পেটের ওপর। পর্যায়ক্রমে সে কৌশিক আর অলির কথা ভাবছে। ওরা এখন কী মনে করছে তার সম্পর্কে, সেটাই যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এর মাঝে মাঝে সে দেখতে পাচ্ছে তার মাকে। মা সাদা শাড়ী পরা। মায়ের এই রূপটা সে কিছুতে সহ্য। করতে পারছে না।

খাটের তলায় রয়েছে মদের বোতলটা। কিন্তু অতীনের আর পান করার প্রবৃত্তি হলো না। বহুক্ষণ বাদে সে একটা সিগারেট ধরালো। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে গেল জানলার ধারে। বাথরুমে দুটো কল খোলা, জল পড়ার শব্দ হচ্ছে, বাথটাব উপছে জল গড়াচ্ছে সারা মেঝেতে, তবে এই হোটেলটা কাঠের তৈরি নয়, পাথরের, কোথাও একটা নর্দমা আছে নিশ্চয়ই বাথরুমে, নইলে এতক্ষণে হৈচৈ পড়ে যেত।

অতীন জলের শব্দে ভ্রূক্ষেপও করলো না। সে খুলে দিল জানলার কাঁচ। প্রথম এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া মুখে মেখে সে এতই তৃপ্ত বোধ করলো যে সে জানলা ডিঙিয়ে চলে এলো বাইরে। সামনেই ফায়ার এসকেপের ঘোরানো লোহার সিঁড়ি। অতীন সেই সিঁড়িতে উঠে দাঁড়ালো। এটা হোটেলের পেছন দিক, একটা সরু রাস্তা, এই রাস্তাতেও গাড়ি চলাচলের বিরাম নেই, ওপর দিকে যে-কেউ তাকালে একটি উলঙ্গ পুরুষ মূর্তি দেখতে পাবে।

অতীন একবার একটু ঝুঁকে ভাবলো। এখান থেকে লাফিয়ে পড়লে কেমন হয়? অন্য যে কারুর ছাতু হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তার কিছু হবে না, বেঁচে যাওয়াই তার নিয়তি। সে জলে ডুবেও মরেনি, একবার দোতলা বাসে আগুন লেগেছিল, সে ছুটে বেরিয়ে এসেছে। উত্তর বাংলায় বোমার আঘাতটা তার গায়ে না লেগে লেগেছিল মানিকদার গায়ে, আর একবার চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়েও তার কোনো ক্ষতি হলো না, একদিন সে সাইকেল চালিয়ে আসছিল, একটা গাড়ি ধাক্কা দিল, তবু তার গায়ে আঁচড় লাগলো না। এই তো কিছুদিন আগে, অ্যারিজোনার টুন শহর থেকে তার একটা প্লেন ধরার কথা ছিল, ঠিক সময়ে এসে সে পৌঁছোতে পারলো না। সে গেল একঘণ্টা পরের একটা ফ্লাইটে, আর আগের প্লেনটা, যাতে তার সীট বুক করা ছিল, সেটা মুখ থুবড়ে মরলো মরুভূমিতে। কেন এমন হয়? তার এই বেঁচে থাকা কিসের বিনিময়ে? সে নিজে বেঁচে গিয়ে তার দাদাকে মেরেছে! না, না, সে তো একবারও তার দাদার সাহায্য চায়নি, দাদা নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জলে। অতীনের যদি সাধ্য থাকলে, তা হলে সে এক শো বারও নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাদাকে বাঁচাতে চেষ্টা করতে না! মানিকদাকে সে সেইভাবেই বাঁচাতে যায়নি? ঠিক সেই মুহূর্তে মানিকদা তার নিজের দাদা হয়ে গিয়েছিল, কেউ তা বুঝলো না! এমনকি, মানিকদাও পরে বলেছিলেন, তুই কেন পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক গুলি চালালি? সেই বদমাশটার লোহার ডান্ডা খেয়ে মানিকদা মরে গেলে কি এই প্রশ্ন করতে পারতেন! তবু মানিকদা শেষ পর্যন্ত বাঁচলেন না। অতীন কি অলিকেও মেরেছে? যে অলিকে সে প্রথম যৌবনে চিনতো, সেই অলি তো আর কোথাও নেই! জামসেদপুরে, প্রবল জ্বরের মধ্যে, অনেকদিন আত্মগোপন করে করে বিমর্ষ অবস্থায় যখন অতীনের ধারণা হয়েছিল, তার আর বাঁচার আশা নেই, আর জ্বরের ঘোরে একদিন শর্মিলাকেই সে অলি বলে ভেবেছিল। কেউ সে কথা জানে না। অলিকে অপমান করবে না বলেই সে আর পরে অলিকে সেদিনের ঘটনাটা বলতে পারেনি। কৌশিক-পমপমরা মনে করে, শুধু ডলারের ঝনঝনানির মোহ আর এলেবেলে পার্থিব সুখের জন্য সে এ দেশে পড়ে আছে! ওঃ মা, মাগো! তুমিও কি তাই ভাবো!

ফায়ার এসকেপের ঠাণ্ডা লোহার সিঁড়িতে বসে নগ্ন অবস্থায় অতীন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। এখানে কেউ তাকে দেখবে না। একবার একটু পেছনদিকে হেললেই সে নীচে পড়ে যাবে।

আজকের আকাশ বেশ পরিষ্কার। ফিনকি দিচ্ছে জ্যোৎস্না, প্রচুর নক্ষত্র এখন জাগ্রত হয়েছে। একদিকে আটলান্টিক, অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগর। এর মাঝখানের ভূখণ্ডে আটকা পড়ে আছে অতীন। প্লেনের টিকিট নেই। নিজের দেশে ফিরতে গেলেও তাকে ভিসা নিতে হবে। শুধু তার কান্নার বাষ্প হয়তো উড়ে যাচ্ছে প্রাচ্যের দিকে।

শুধু কান্নাই যায়। আর বহু আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবন বদলের ব্যাকুলতা ছুটে আসে এই দিকে। সমুদ্র পেরিয়ে এই মুহূর্তে ভারত উপমহাদেশের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে প্রতীক্ষায় অধীর হয়ে আছে, কবে তারা এ দেশে আসার সুযোগ পাবে। পাসপোর্ট, ভিসা, স্পনসরশীপ, চাকরি, কলেজে অ্যাডমিশান, গ্রীন কার্ড। কিছু একটা পেলেই মোক্ষ মিলে যাবে, অন্তত সমস্যাপীড়িত ঐতিহ্য থেকে মুক্তি। টাইম, ইউ ওল্ড জিপসি ম্যান! সময় কোনো দেশে, কোনো রাজধানীতে বেশিদিন থেমে থাকে না। এই তো কিছুদিন আগেও ইতিহাসের যাত্রা ছিল পূর্ব দিকে। আলেকজান্ডার, আট্টিলা, মেগাস্থিনিস, ম্যাগেলান, কলাম্বাস, ভাস্কো ডা গামা। যত পুবে যাবে, ততই সম্পদের সন্ধান পাওয়া যাবে। শুধু সোনাদানা নয়, পরমার্থিকও। হঠাৎ কবে যেন শুরু হয়ে গেল উল্টোদিকের প্রবাহ। আবার পূর্ব থেকে পশ্চিমে ফেরা। বারুদ আবিষ্কার করেছিল চীন, কিন্তু কামান গর্জনের প্রতাপ ঘোষিত হলো প্রতীচ্যে। শুধু ঐহিক সুখ-সমৃদ্ধি নয়। একটা মুক্ত জীবনের স্বপ্নময় ছবিও যেন ঝলসে উঠলো সেখানে। শুধু স্বাধীনতা নয়, তার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় একটি অশ্রুতপূর্ব ধারণা, ব্যক্তি-স্বাধীনতা! যৌবনের জলতরঙ্গ এখন ধাইছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। ইসকনের কয়েক হাজার নারী-পুরুষ শাড়ি কিংবা ধুতি পরে, কৃষ্ণনাম করে নেচে-গেয়ে একটু নতুনত্ব দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের কয়েক কোটি ছেলেমেয়ে এখন শুধু বিদেশী পোশাক পরে, মাতৃভাষার বদলে বিদেশী ভাষা বলে, স্বদেশের ঐতিহ্যের তোয়াক্কা করে না। তারাও নাচে, আনন্দ করে শুধু পশ্চিমের গানবাজনা শুনে। তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, বাড়তেই থাকবে।

পশ্চিমের সৌন্দর্য বড় মোহময়, কারণ তার পেছনে আছে সর্বনাশের বহুবর্ণ আভা। সেদিকে তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণেরও দুটি ভাগ, তার মধ্যে পশ্চিম টানছে পূর্বকে। একসময় গোটা প্রাচ্যের পশ্চিম সীমা ছিল রোম সাম্রাজ্য। কী দারুণ দীপ্তি ছিল তার। যতই ভোগ-ঐশ্বর্যের উচ্চ শিখরে উঠছিল রোম, ততই ধ্বংসের বিকিরণ চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। ঠিক যেন সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটা।

প্রাচীন ইজিপশিয়ান সাম্রাজ্যের গৌরব টিকে ছিল প্রায় সাতাশ শো বছর ধরে। বাইজানটাইন সভ্যতা এক হাজার বছর, অটোমান এম্পায়ার পাঁচ শো বছর। পশ্চিমের ধনতন্ত্র আর কতদিন? আবার কি কোনোদিন সময় নামে যাযাবরটি পশ্চিম থেকে পুবে গিয়ে তাঁবু গাড়বে? তার আগে বুদবুদের মতো শেষ হয়ে যাবে না তো এই ছোট্ট পৃথিবী? মহাশূন্য আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীটা বড় ছোট হয়ে গেছে। তাই বুঝি এর প্রতি আর বড় বড় রাষ্ট্রনায়কদের মায়া নেই? তারা কি ভাবছে, এখানে কয়েকটি অ্যাটম-হাইড্রোজেন বোমা ফেলে দিয়ে, এত বেশি জনতার ভিড় থেকে মুক্তি পেয়ে তাঁরা চাঁদে কি মঙ্গলগ্রহে গিয়ে বসতি গড়বে? সেখানেও পূর্ব-পশ্চিম থাকবে। এমনকি, এই সূর্যের আওতা থেকে ছিটকে গিয়ে অন্য কোনো গ্রহমণ্ডলীর মধ্যে নতুন উপনিবেশ গড়লেও মানুষের পূর্ব-পশ্চিম থেকে নিষ্কৃতি নেই। মানুষকে তো কোনো না কোনো সময়ে নিজের মনের দিকে তাকাতেই হবে।

ঝন ঝন করে আবার টেলিফোন বাজতেই অতীন চোখ মেলে মাথা উঁচু করলো। কে ডাকছে? শর্মিলা, না অলি? বাবা বেঁচে আছেন, না নেই? কী হবে জেনে? দু’দিকে দুই মহাসাগর, অতীনের টিকিট নেই, ভিসা নেই। সে তো আর হনুমানের মতন লাফিয়ে পার হয়ে। যেতে পারবে না! কারুকে এই অবস্থাটা ব্যাখ্যা করারও মানে হয় না। অতীন খাঁচায় বন্দী, সুতরাং তার বাবা বেঁচে আছেন কি না, তা জানার কোনো দরকার নেই। তার শরীরে এখন কোনো পোশাক নেই, সে শুয়ে আছে প্রায় শূন্যের ওপর। প্রায় একটা জন্তুর মতন, ধরা যাক আদি মানব, অর্থাৎ বাঁদর। তা হলে তাকে ভারতীয় কিংবা অ্যামেরিকান, কোনো জাতের মধ্যে ফেলা যাবে না। বাঃ, এই তো ভালো। বাজুক টেলিফোন, বেজে চলুক, আওয়াজটা মন্দ লাগছে না!

পৃথিবীর একদিকে যখন আলো, অন্যদিকে তখন অন্ধকার। একদিকে জাগরণ, অন্যদিকে ঘুম। কোথাও আবার দিনের বেলাতেও অন্ধকার, কোথাও রাত্তিরেও আলোর উৎসব। ডেনভারে এখন গভীর রাত, কলকাতায় প্রায় দুপুর। একই পৃথিবীর দু’প্রান্তের মানুষ অনুভবই করে না যে তাদের মাঝখানে রিখ বদলে গেছে। অতীন যে সময়টাকে মনে করছে আজ। কলকাতার মানুষ ঠিক সেই সময়টাকেই মনে করছে গতকাল।

অতীন যখন গভীর রাতে ডেনভারের নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে একবার তাকালো, তখন কলকাতায়, প্রখর মধ্যাহে একটি নার্সিংহোমের সামনে ছোটখাটো একটি ভিড় জমেছে। যে-প্রতাপ মজুমদার দুদিন আগেও বিকেল-সন্ধে কাটাবার জন্য কার বাড়িতে যাবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না, আজ তাঁকেই দেখার জন্য এসেছেন বেশ অনেকেই। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে অবশ্য প্রবেশ অধিকার আছে শুধু অলির। মমতার কাছে খবর গেছে। তিনি এখনও পৌঁছতে পারেননি। তুতুল এখনো আকাশে। অতীনের কাছ থেকে পৌঁছয়নি কোনো বার্তা। প্রতাপ সেসব কোনোই অভাব বোধ করছেন না। তাঁর নাকে নল লাগানো থাকলেও চেতনা সম্প্রতি ফিরে এসেছে পুরোপুরি, অলি যে তাঁর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, তা তিনি অনুভব করছেন, তাঁর ভালো লাগছে। অলি কোথা থেকে এখানে এলো, তা অবশ্য তিনি মনে করতে পারছেন না। এই জায়গাটাই বা কোথায়?

প্রতাপ বলতে চাইলেন, পায়ের দিকের জানলা দুটো খুলে দে তো, অলি!

প্রতাপের কণ্ঠস্বর একটুও ফুটলো না, অলি কিছুই বুঝতে পারলো না। তবু তাতেও কোনো অসুবিধে হলো না অবশ্য। অন্য কে যেন দমাস দমাস করে খুলে দিল জানলা দুটো। প্রতাপ দেখলেন তার বাইরে হরিৎ প্রান্তর। প্রায় দিগন্ত ছড়ানো। তারপর নদী। আবার ফসলের ক্ষেত, আবার নদী, একটা জলাভূমি, চৌধুরীদের পোডো বাড়ি। সুলেমান চাচার কাছারি, পীর সাহেবের মাজার, শিব মন্দির, ঠিক যেন একটা নৌকো দুলে দুলে যাচ্ছে, তিনি দেখছেন। তারপর নৌকো যেখানে থামলো, সেই ঘাটলায় একটা মকরমুখো বড় পাথর। আরে, এ যে মালখানগরের মজুমদারদের নিজস্ব ঘাট! ঠিক সেই রকমই আছে। ভিসা লাগলো না, পাসপোর্ট লাগলো না, তবু প্রতাপ এখানে পৌঁছে গেলেন কী করে? তা হলে এখনো আসা যায়? প্রতাপ বিশেষ অবাক হলেন না। তাঁর মনটা খুশীতে ভরে গেছে। ঘাটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন নীল শাড়ি পরা সুহাসিনী। রিপন কলেজ থেকে পুজোর ছুটিতে বাড়িতে আসার সময় প্রতাপ মায়ের ঠিক এই যুবতী চেহারাটাই দেখতেন। তবু প্রতাপের একবার মনে হলো, দেওঘরে মৃত্যুর আগে, মা বলেছিলেন, খুকন, তুই একবার আমারে সেই বাড়িতে নিয়া যাবি? প্রতাপ তখন কিছুই করতে পারেননি, তবু মা সেখানে পৌঁছে গেছেন? বাঃ, বেশ মজা তে।

প্রতাপ একবার চেয়ে দেখলেন, সেই বাড়ি, আটচালা, উঠোনের তিনদিকে পিসি-মাসিদের ঘর একই রকম আছে। সেই আম গাছ, অন্যদিকে বাতাবি লেবুর গাছ, দক্ষিণের পুকুরে মাছের ঘাই, তার অন্যপারে রহস্যময় জঙ্গল, সব ঠিকই আছে। এক্ষুনি যেন বাবা খড়ম ফটফটিয়ে আসবেন। কলকাতার থেকে এখানকার বাতাসে কত আরাম!

অলি যেন তাঁর বাল্যকালের খেলার সঙ্গী, এইভাবে প্রতাপ তার দিকে চেয়ে সকৌতুকে বললেন, আমি চলোম রে, তোরা আর আমায় ধরতে পারবি না। আমি মা’র কাছে যাচ্ছি! ঐ

তারপর প্রতাপ পরম সন্তোষে চোখ বুজলেন।

মায়ের কাছে যাবার আগে পা ধুয়ে নিতে হবে। পায়ে কাদা লেগেছে। সারা গায়ে এত ময়লা এলো কোথা থেকে। ও, তিনি রাস্তার ধারে একটা নর্দমায় শুয়ে ছিলেন, সেই কাদা। এখনো ওঠেনি। এমনভাবে মাকে জড়িয়ে ধরা যায় না। শুধু পা ধুলেই হবে না। সমস্ত শরীর পরিষ্কার করতে হবে। ঘাট থেকে প্রতাপ আবার জলে নামতে লাগলেন, কী সুন্দর, স্নিগ্ধ, স্নেহ স্পর্শের মতন জল, আর কী আরাম। প্রতাপ ডুব দিলেন সেই জলে।

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *