অসহায় মেয়ে মোর
শানিত ছুরিকা হানিয়া কণ্ঠে তোর
তাণ্ডবলীলা শুরু করেছিল, রক্তবসনা তুই
পূত পবিত্র এক মুঠি ফুল; শেফালী চামেলী জুই…
তারপর কী যেন? পরের লাইনগুলো মনে পড়ছে না কেন? স্মৃতি গোলমাল হয়ে যাচ্ছে বারবার। মানুষের স্মৃতিই যদি নষ্ট হয়ে যায়, তা হলে আর বেঁচে থেকে লাভ কী?
আজ সুন্দর বাতাস দিচ্ছে। রোদ বেশ চড়া হলেও জামরুল গাছটার নীচে বেশ অনেকখানি। ছায়া। আয়েশা কিন্তু রোদ্দুরের মধ্যে বসেই কতকগুলো গাঁদাফুলের চারার তলার মাটি খুঁড়ছে। মাটি ঘাটতে কী ভালোবাসে ঐ মেয়েটা! এটা খুব আশ্চর্যের যদিও, তের-চোদ্দ বছরের কিশোরী মেয়ে, শহরের ইস্কুলে পড়ে, ইংরিজি গান গায়, তার মাটির প্রতি এত টান! হালকা ঘি রঙের শালোয়ার কমিজ পরেছে আয়েশা। বয়েসের তুলনায় চেহারাটা বেশ বড়সড়। মাতামহীর ধারা পেয়েছে, অনেকেই ওকে যুবতী বলে ভুল করে, এর মধ্যেই দু এক জায়গা থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসতে শুরু করেছে।
একটা চাকা লাগানো চেয়ারে বসে মামুন মুগ্ধ হয়ে নাতনীকে দেখছেন। মেয়ে-জামাই থাকে চিটাগাং। তারা বেশি আসতে পারে না, কিন্তু স্কুল ছুটি হলেই আয়েশা চলে আসে এখানে। মামুনের ছোট মেয়ে তার স্বামীর সঙ্গে থাকে দুবাইতে, তিন বছর দেখা হয়নি তার সঙ্গে।
আয়েশাকে দেখতে দেখতে মামুনের মাঝে মাঝে দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে। তিনি ফিরে যাচ্ছেন অনেক বছর পিছনে, যেন তিনি ওখানে হেনাকেই দেখতে পাচ্ছেন। হেনার অবশ্য কোনোদিনই গাছপালার প্রতি ঝোঁক ছিল না। এরকমভাবে সে মাটিও ঘাঁটতো না। ওকে দেখে মামুনের আবার বেগম সুফিয়া কামালের কবিতাটাও মনে পড়ছিল। যাকে নিয়ে এই কবিতাটা লেখা, সেই মেহেরুননেসা নামের মেয়েটির বয়েস বোধহয় আয়েশারই সমান ছিল। এক সময় পুরো কবিতাটাই মামুন মুখস্থ বলতে পারতেন গড়গড় করে।
একটা মটোর সাইকেলের শব্দ হচ্ছে না? মামুন চমকে উঠলেন। আলতাফ এসেছে নাকি? মামুন ভয় পাওয়া চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। গেটের কাছে কেউ নেই। সামনের রাস্তাটাও ফাঁকা, দুটো ছাগল মুচমুচ করে ঘাস ছিঁড়ে খাচ্ছে। একটা শান্ত সকাল। শুধু যে স্মৃতিটাই গোলমাল হয়ে যাচ্ছে তা নয়, মাঝে মাঝে মামুন এরকম শব্দও শোনেন। এক সন্ধেবেলা মটোর সাইকেলের বিকট গর্জন তুলে আলতাফ এসে হাজির হয়েছিল এই বাড়িতে, সে কতকাল আগের কথা। কিন্তু ঐ আলতাফই মামুনের জীবনটা বদলে দিয়েছিল।
ঐ আয়েশাকে মামুন ওর জন্মের পর পুনপুনি বলে আদর করতেন। সেই নামটাও থেকে গেছে। মামুন ডাকলেন, ওরে পুনপুনি, একবার এদিকে আয় তো!
মাটিতে ল্যাটা মেরে বসেছে আয়েশা, সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। মামুন আবার ডাকতেই সে কাছে এসে বললো, কী? পানি খাবে?
মামুনের জল তেষ্টা বেশি। সারাদিন ধরে তিনি বারবার জলপান করেন, নইলে গলা শুকিয়ে যায়। ডাক্তাররাও তাঁকে যত খুশী জল খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। তাঁর চেয়ারের কাছেই রয়েছে একটা জগ আর গেলাস। আয়েশা এক গেলাস পানি ভরে দেবার পর মামুন মিনতির ভঙ্গিতে বললেন, একটা সিগারেট ধরায়ে দে, সোনা!
আয়েশা চক্ষু পাকিয়ে বললো, আবার? তিনটা দিয়েছি সকাল থেকে।
মামুনের ডান হাতটা প্রায় অসাড়, নিজে নিজে দেশলাই জ্বালতে খুবই অসুবিধে হয়। পত্নী, আত্মীয় বন্ধু ও চিকিৎসকদের প্রবল নিষেধ সত্ত্বেও মামুন সিগারেটটা ছাড়তে পারেন নি। সিগারেটে আর এখন তাঁর কী ক্ষতি হবে, তিনি তো আর আয়ু চান না! নিজে সিগারেট ধরাবার জন্য মামুন একটা লাইটার যোগাড় করেছিলেন, ফিরোজা সেটা কোথাও সরিয়ে রেখেছেন।
আয়েশা একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে আবার ফিরে গেল গাঁদা ফুল গাছগুলোর কাছে। দু একটা টান দেবার পর, মাথাটা একটু চনমনে হতেই কবিতাটার বাকি লাইনগুলো মনে এসে গেল।
ভালোবেসেছিলি
এই ধরণীরে, ভালোবেসেছিলি দেশ
তাই বুঝি তোর কুমারী তনুতে
জড়ায়ে রক্ত বেশ
। প্রথম শহিদ বাংলাদেশের
মেয়ে
দুটি ভাই আর মায়ের তপ্ত বক্ষ রক্তে নেয়ে
দেশের মাটির ‘পরে
গান গাওয়া পাখি, নীড় হারা হয়ে
লুটালি প্রবল ঝড়ে…
কবিতাটা বিড়বিড় করতে করতে মামুনের দু’ রকম অনুভূতি হলো। তাঁর স্মৃতি যে একেবারে নষ্ট হয়নি, এতে তিনি কিছুটা চাঙ্গা বোধ করলেন, তারপরেই তিনি আত্মগ্লানির সঙ্গে ভাবলেন, আরে ছি ছি ছি, আয়েশাকে দেখে একী অলক্ষুণে কবিতা মনে পড়লো তার! এ তো একাত্তরের এক শহিদ মেয়েকে নিয়ে লেখা, আর আয়েশার মতন সুন্দর, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল মেয়ে, সামনে তার সোনালি ভবিষ্যৎ…
তিনি আবার আয়েশাকে কাছে ডাকলেন, তার পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বললেন, ওরে পুনপুনি সোনা, তুইও কি বিয়ে করে সৌদি-দুবাই কিংবা বিলাত-অ্যামেরিকা চলে যাবি? আমি যতদিন বেঁচে আছি, যাইস না! তোর এই বুড়ো দাদাটারে আর তো কেউ ভালোবাসে না!
আয়েশা বললো, তুমি বেশি বেশি বুড়া বুড়া ভাব করবে না তো! তুমি এখনও দিব্যি হাঁটতে পারো। ওঠো, আমার সাথে হাঁটো! এইবার একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা ঢাকায় যাবো। মা বলেছে, তোমাকেও নিয়ে যাবে।
মামুন আর্তস্বরে বলে উঠলেন, না, না, আমি আর ঢাকায় যাবো না! ঢাকা আমার সহ্য হয় না।
বাড়ির ভেতর থেকে নাস্তা খাবার জন্য ডাক এলো আয়েশার। মামুন সকালবেলা গরম পানিতে মধু আর লেবুর রস খান শুধু, তিনি বসে রইলেন গাছতলায়। তাঁর ভুরু দুটো কুঁচকে গেছে। ঢাকার নাম শুনলেই তাঁর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তাঁর জীবন থেকে তিনি ঢাকা শহরটা মুছে দিতে চান। তিয়াত্তর সালের পর থেকে তিনি আর একবারও পা দেননি ঢাকায়। মাদারিপুরের এই গ্রামের বাড়িতেই তিনি শান্তিতে থাকেন।
দেশ স্বাধীন হবার পর তাজউদ্দিনের অনুরোধে মামুন একটা সরকারি কাজ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই সময় কাজের মানুষের খুব অভাব ছিল। একটা নতুন দেশ গড়তে গেলে যে সব সমর্থ ও বুদ্ধিমান লোকের প্রয়োজন হয় তাদের অনেককেই তো মেরে ফেলেছিল পাকবাহিনী। তারা ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ারদেরও বাদ দেয়নি। মামুন ত্রাণ ও পুনবার্সনের দায়িত্ব নিয়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিলেন, চতুর্দিকে চুরি-জোচ্চুরি, বিদেশ থেকে সাহায্য পাওয়া ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ছিনিমিনি চলছিল, দেশে একবার অরাজকতা এসে গেলে একদল লোক লুটেপুটে খাবার চেষ্টা করবেই। তবু মামুন পুনবাসনের কাজটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। দিনরাত পরিশ্রম করতেন। শত শত পরিবারের ট্র্যাজেডির কাহিনী শুনতে শুনতে তাঁর মেজাজ সবসময় উগ্র হয়ে থাকতো। একদিন একটি অসৎ কর্মচারিকে হাতেনাতে ধরে ফেলে তিনি তাকে একটা চড় কষিয়ে দিয়েছিলেন। মামুনের মতন ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষের ওরকম ব্যবহার দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সকলে। মামুনের ব্যক্তিগত সততা নিয়ে। কারুর কোনো প্রশ্ন করার সাহস ছিল না বলেই কেউ তাঁর ঐ ব্যবহারের প্রতিবাদ করেনি। সেই কর্মচারিটি তাঁর পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছিল। শেখ সাহেব নিজে মামুনকে ধানমুণ্ডির বাড়িতে ডেকে তাঁর কাজের তারিফ করেছেন।
মামুন সে সময় নিজের স্বাস্থ্যের তোয়াক্কা করতেন না। তিনি একা নন, তাঁর মতন কাজ-পাগল সেরকম আরও অনেকে ছিল। একদল লোক যেমন লুটপাট-তছরূপের সুযোগ। নিচ্ছিল, সেই রকমই আবার একদল মানুষ দেশ গড়ার উদ্যমে মেতে উঠেছিল। শেখ সাহেব নিজেও চার পাঁচ ঘণ্টার বেশি ঘুমোবার সময় পেতেন না। ঢাকা শহরে তখন চলছিল ধারাবাহিক উন্মাদনা। সদ্য পাওয়া স্বাধীনতা নিয়ে তখনও যেন একটা দিশাহারা অবস্থা। ভারত থেকেও দলে দলে মানুষ আসছিল। নানা রকম সরকারি ডেলিগেশান ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিরা, দু পক্ষেরই তখন প্রবল উচ্ছাস। হঠাৎ যেন মামুনের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতন হলো। বাবুলের সঙ্গে মঞ্জুর বিবাহবিচ্ছেদ, এবং তার জন্য তিনিই দায়ী!
বাবুলের মতন একজন শিক্ষিত, বুদ্ধিমান মানুষ যে এরকম একটা অদ্ভুত গোঁয়ার্তুমি করতে পারে, তা তার বন্ধুরাও কল্পনা করতে পারেনি। বাবুল যে মুক্তিযুদ্ধে দারুণ সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছে, সে কাহিনীও মামুন পরে শুনেছেন। কিন্তু সে সম্পর্কে কোনো কথা বলা চলবে না তার সঙ্গে, যেন ঐ বিষয়ে আলোচনাই নিষিদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা কলকাতায় চলে গিয়েছিল, তাদের সম্পর্কে বাবুল সবসময় বক্রোক্তি করতে, যেন তারা সবাই সুবিধাবাদী, পলাতক। কিন্তু বিদেশে না গেলে কি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গড়া যেত? সেরকম একটা সরকার গড়া না হলে যুদ্ধ পরিচালনা করতে কে? অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রই বা সাহায্য দিত কার হাতে? বড় বড় সব নেতারা কারাবন্দী হলে কিংবা টিক্কা খানের নির্দেশে নিহত হলে লাভ হতে কী? এক শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিই তো কী দারুণ অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছিল। কলকাতায় যারা গিয়েছিল, তাদের প্রায় সকলেই যে কত কষ্ট, উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটিয়েছে, সে সব কথা বাবুল শুনতেই চায়নি। অথচ মামুন যখন পঁচিশে মার্চের পর ঢাকা ছেড়ে চলে যান ভারতের দিকে, তখন মঞ্জুকে সঙ্গে পাঠাতে সে একটুও আপত্তি করেনি। বরং আগ্রহই দেখিয়েছিল। সেই বাবুল মঞ্জু সম্পর্কে অমন কুৎসিত একটা সন্দেহ করলো! মঞ্জুও গান গেয়ে, মিছিলে-সমাবেশে যোগ দিয়ে স্বাধীনতার লড়াইতে সামান্য কিছু সাহায্য কি করেনি? যুদ্ধ কি শুধু কামানবন্দুক নিয়েই হয়? শত্রুর বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলাও একটা বড় কাজ।
সাধ করে যেন আরও বেশি অপমানিত হবার জন্য বাবুলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন মামুন। ওঃ কী কঠোর ভাষা প্রয়োগ করেছিল বাবুল সেদিন! এ তো ঈর্ষা নয়, অন্ধ ক্রোধ। একটা যুদ্ধ এসে বাবুল চৌধুরীকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। মামুনের প্রতি তার যে কেন এত ঘৃণার ভাব, তা কিছুতেই বোঝা যায় না। মঞ্জু সম্পর্কেও তার মনে সামান্য দুর্বলতাও অবশিষ্ট ছিল না। মঞ্জুর ছেলে তখন ছোট, গর্ভে একটি সন্তান এবং সে সন্তান যে বাবুলেরই তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। মঞ্জুর সঙ্গে পৃথিবীর আর দ্বিতীয় কোনো পুরুষের সেরকম ঘনিষ্ঠতা হয়নি, তবু বাবুল সেই অসহায় অবস্থার মধ্যে মঞ্জুকে বলেছিল, তুমি যেখানে খুশী চলে যেতে পারো! মামুনকে সে তিক্ত কণ্ঠে জানিয়েছিল, আমি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আপনার সাথে আলোচনা করতে চাই না। আমার বাসায় ইউ আর নো লংগার ওয়েলকাম। মঞ্জুকেও আমি আর আমার স্ত্রী মনে করি না। শী ইজ অল ইয়োরস!
তবু মামুন বাবুলের হাত জড়িয়ে ধরতে গিয়েছিলেন। মঞ্জু বিনা দোষে শাস্তি পাবে, এটা যে তাঁর পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব। তিনি যত দুর্বলতা দেখিয়েছেন, বাবুল ততই বেশি বিদ্রূপ করেছে। তখন মামুন ভেবেছিলেন, তিনি দূরে সরে গেলে হয়তো আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবুল তো মানুষ খারাপ নয়। মামুন একেবারে চোখের আড়াল হয়ে গেলে নিশ্চয়ই তার রাগ কমবে, নিজের ভুল বুঝতে পেরে সে মঞ্জু ও তার সন্তানদের ফিরিয়ে নেবে। তাজউদ্দিনের সনির্বন্ধ অনুরোধেও কর্ণপাত করেননি মামুন। নিজের পদে ইস্তফা দিয়ে, ঢাকা থেকে সমস্ত পাট চুকিয়ে চলে এলেন মাদারিপুরে। কিন্তু বাবুল যখন আর একটা বিয়ে করলো
–আদাব মামুনসাহেব! ভালো আছেন?
মামুন গেটের দিকে ঘাড় ফেরালেন, কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সমস্ত রোমকূপে শিহরন বোধ করলেন। কেউ নেই। ইদানীং বিশেষ কেউই তাঁর কাছে আসে না। অথচ তিনি স্পষ্ট কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন এবং চেনা কণ্ঠস্বর। গোবিন্দ গাঙ্গুলী না? সেই ভদ্রলোক মাঝে মাঝে আসতো।
মামুন গলা তুলে বললেন, কে? কে ওখানে? গোবিন্দ নাকি? ভিতরে আসো।
কোনো উত্তর নেই। গোবিন্দ গাঙ্গুলী এলে লুকিয়েই বা থাকবে কেন? মামুন ভুল শুনেছেন। তাছাড়া, গোবিন্দ গাঙ্গুলী তো আর থাকে না এখানে? নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে গেল ভারতে। নাকি মারা গিয়েছে সে? ঠিক মনে পড়ে না। বেশ সাহসী ধরনের মানুষ ছিল, একাত্তরেও দেশ ছেড়ে যায়নি।
আবার মটোর সাইকেলের শব্দ। না, এটাও ভুল। এই শব্দটা তাকে বড় বেশি জ্বালাতন করে। আলতাফ, আলতাফ, সে-ই সব গণ্ডগোলের মূল। আলতাফের সঙ্গে পরিচয় না হলে তার ছোটভাই বাবুলের সঙ্গে মঞ্জুর বিয়েও হতো না।
গাঁদা গাছগুলোর ঝাড়ের সামনে, যেখানে একটু আগে আয়েশা বসেছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে গোবিন্দ গাঙ্গুলী। গায়ের রঙ কালো, শক্ত সমর্থ চেহারা, একটা দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো, লুঙ্গির ওপর ফতুয়া পরা। ডান বাহুতে একটা রুপোর তাবিজ।
মামুন জিজ্ঞেস করলেন, কী গোবিন্দ? ফিরে এসেছো? বেশ করেছে। তোমার বউ আর পোলাপানেরা সব ভালো আছে তো?
গোবিন্দ হেসে বললো, আছে একরকম আপনাদের আশীর্বাদে। আমার লঞ্চটা মাদারিপুর ঘাটে খারাপ হয়ে পড়ে আছে। সেইটার জন্য আসলাম।
মামুন বললো, তোমার লঞ্চ ডুবে গিয়েছিল না?
গোবিন্দ বললো, আবার ভাসিয়ে তুলেছি। আমি কি, এত সহজে ছাড়বার পাত্তর?
মামুনের চোখে একটা ঘোর লাগলেও তিনি বুঝতে পারছেন, তাঁর সামনে গোবিন্দ গাঙ্গুলী দাঁড়িয়ে নেই। সকালের রোদ্দুরেও তাঁর দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে। তিনি দেখছেন একটা ছায়ামূর্তি। গোবিন্দ গাঙ্গুলী মরে গেছে কবে!
তবু তিনি বললেন, তুমি আবার এখানে লঞ্চ চালাবে কী করে? তুমি না তোমার ফ্যামিলি নিয়ে ইণ্ডিয়ায় চলে গ্যালে?
–আমি যাই নাই, মামুন সাহেব। শেখ মুজিব খুন হবার পর আপনি যখন ইণ্ডিয়ায়। পালালেন, তখন আমার ফ্যামিলিও সেই স্টিমারে গিয়েছিল। ওদের পাঠিয়ে দিয়েছি, কিন্তু নিজে কখনো দেশ ছাড়ি নাই। এই একটা জীবনে কত কী দাখলাম!
–না, না, আমিও পালিয়ে যাই নাই। সে সময় আমাকে চিকিৎসা করাবার জন্য সবাই জোর করে কলকাতায় পাঠালো।
আয়েশা এসে মামুনকে ঝাঁকানি দিয়ে বললো, বিড়বিড় করে কী বলছো, দাদা? ঘুমিয়ে। পড়েছিলে নাকি? নবোদা জিজ্ঞেস করলো, তুমি এখন গোসল করতে যাবে? তোমাকে তেল মাখিয়ে দেবে?
মামুন বললেন, না, পরে। আচ্ছা পুনপুনি, তোর মনে আছে, আমি সেভেন্টি ফাইভে যে কলকাতায় গেলাম, সে কি শেখ সাহেব শহিদ হবার পরে না আগে?
আয়েশা তার গোলাপী ঠোঁটটা উল্টে বললো, সে আমি কী জানি!
মামুন হেসে বললেন, ঠিকই তো, তোর তখন দুই-তিন বছর বয়েস বোধহয়। তোর কী করে মনে থাকবে! পরেনা, আগেই। শেখ সাহেবকে ওরা খতম করে দিল অগাস্ট মাসে, আমি কলকাতায় গেলাম জুলাই মাসে। হার্টে আবার বেদনা শুরু হলো। আমি কিছুতেই ঢাকায় যাবো না, তাই তোর মা-বাবা আমায় জোর করে পাঠালো কলকাতায়। সেখানের ডাক্তাররা আমার চিকিৎসা আগে করেছে।
–শেখ মুজিবকে ওরা কেন মেরেছিল?
–হায় রে কিশোরী কইন্যা, এর উত্তর আমি তোরে কী করে দেবো? বড় হয়ে এর উত্তর তোদেরই খুঁজে নিতে হবে। আজও তো বাংলাদেশ যুদ্ধের ইতিহাস লেখা হলো না। তোদের জেনারেশানই রচনা করবে স্বাধীন বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস। আর একটা সিগারেট ধরায়ে দিবি, সোনা!
–না, নো মোর সিগারেট বিফোর লাঞ্চ!
আয়েশা একটা পাখির মতন যেন ফুরুৎ করে উড়ে গেল বাগানের দিকে। মামুনের মনে হয়, তাঁর এই আদরের নাতনীটার মুখখানা ফুলের মতন আর শরীরটা পাখির মতন। কিন্তু দুষ্ট মেয়েটা সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই নিয়ে চলে গেল! কেন আর তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা।
মুজিবের মৃত্যুর আগেই তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন, তা ঠিক, তবু তিনি সেই সকালের দৃশ্যটা অবিকল চোখের সামনে দেখতে পান। যেন তিনি সেদিন উপস্থিত ছিলেন বত্রিশ নম্বর ধানমুণ্ডির সেই বাড়িতে। ট্যাঙ্ক নিয়ে ওরা মারতে গিয়েছিল, সৈন্যের পোশাক পরা হলেও তারা তো পাকিস্তানী না, বাংলাদেশেরই মানুষ। ঘুম থেকে উঠে এসে, গুলিগোলার আওয়াজে খুব বিরক্ত হয়ে তিনি ওদের ধমক দিতে এসেছিলেন। তিনি জাতির পিতা, এদেশের সমস্ত মানুষই তাঁর সন্তান, তিনি ভেবেছিলেন তাঁর ধমক শুনে ছেলেপুলেরা ভয় পেয়ে মাথা নীচু করে, রাইফেলের নল নামিয়ে চলে যাবে। হায় রে, আজকাল ছেলেপেলেরাও কি সব সময় বাবা-মায়ের ধমক শোনে? বাপ-মাকেও সেরকম শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য হতে হয়। দোতলায় সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে শেখ সাহেব হাত তুলে গর্জে উঠলেন, এই, তোরা বেয়াদপি করতে এসেছিস কেন? এর উত্তরে এক ঝাঁক তপ্ত বুলেটে তাঁর শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেল। মৃত্যুর আগে তাঁর সারা মুখে লেগেছিল ভয়, না বেদনা, না শুধু বিস্ময়? সিঁড়ির মাঝখানে পড়ে গিয়ে তিনি আর ক’ মুহূর্ত বেঁচে ছিলেন? তিনি কি জেনে গিয়েছিলেন যে আততায়ীরা ওপরে উঠে তাঁর স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে, ভাইপো-ভাগ্নীদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে! তিনি শুনতে পেয়েছিলেন তাঁর শিশুপুত্র রাসেলের মৃত্যু-আর্তনাদ?
পাকিস্তানের জেল মানে বাঘের গুহা। সেখান থেকেও ছাড়া পেয়ে এসে শেখ সাহেব কী করে কল্পনা করবেন যে তাঁকে প্রাণ দিতে হবে বাংলাদেশের মানুষের হাতে। অবশ্য, যে তাজউদ্দিন সাহেব ছিলেন প্রথম বাংলাদেশ সরকার গড়ার প্রধান স্থপতি, যাঁর দেশাত্মবোধ নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না, সেই তাজউদ্দিন সাহেবকে শেখ মুজিব নিজে বরখাস্ত করবেন, তাই-ই বা কে কল্পনা করেছিল? যে-গণতন্ত্রের নামে শেখ সাহেব সারা জীবন গলা ফাটালেন, শেষে তিনি নিজেই হত্যা করতে গেলেন সেই গণতন্ত্রকে। খবরের কাগজের স্বাধীনতা, বিরোধী দলের অধিকার খর্ব করতে করতে শেষ পর্যন্ত শেখ সাহেব জারি করতে চাইলেন একদলীয় শাসন! বাকশাল! রাষ্ট্রপতি আবু সয়ীদ চৌধুরীকে সরে যেতে হলো, মুজিব স্পষ্টত এগিয়ে যেতে লাগলেন একনায়কতন্ত্রের দিকে। পাকিস্তানী আমলের দুঃসহ স্মৃতি তখনও সকলের মনে জ্বলজ্বল করছে। শেখ সাহেব যে-দিন তাজউদ্দিনকে সরিয়ে দেন, সেইদিনই মামুন বুঝেছিলেন, আওয়ামী লীগের ধ্বংস আসন্ন।
কলকাতায় ছাত্র আন্দোলন করার সময় মামুন একটা গল্প শুনেছিলেন নবাব ফারুকীর কাছে। উনি এক সময় ছিলেন স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেলা। এক সময় ছাত্ররা ঐ সুরেন বাড়জ্যেকে এমনই শ্রদ্ধা করতো যে একবার তাঁকে একটা জুড়িগাড়িতে চড়িয়ে কোনো সভায় নিয়ে যাওয়ার সময় ঘোড়াদুটো খুলে দিয়ে ছাত্ররা নিজেরাই সেই গাড়ি টেনেছিল। আবার এক সময় ঐ সুরেন বাড়জ্যেকেই ছাত্ররা ফুলের মালা পরাবার বদলে জুতোর মালা পরিয়েছিল। রাজনীতি এমনই বস্তু। তবে, সেই সময় এমন খুনোখুনি ছিল না। শেখ মুজিব ভুল রাস্তায় যাচ্ছিলেন ঠিকই, কিন্তু যারা তাঁকে নৃশংসভাবে খুন করতে গেল, তারাও দেশপ্রেমিক কিংবা গণতন্ত্রের পূজারী কিংবা নিপীড়িত জনগণ নয়, তারাও ক্ষমতালোভী! ইতিহাস থেকে এরা শিক্ষা নেয় না। একজনকে খুন করে সেই রক্তাক্ত সিংহাসনে কে কবে সুস্থিরভাবে বসতে। পেরেছে? খন্দকার মুস্তাক, খালেদ মশারফ, জিয়াউর রহমান…। খালেদ মশারফ-এর ঠিক যে কী হয়েছিল, তা মামুন আজও জানতে পারেননি, কেউ স্পষ্টাস্পষ্টি খুলেও বলে না। এমন চমৎকার হীরের টুকরো ছেলে, এত চেনা, মামুনের আপার বাসায় এসে কতবার ভাত খেয়ে। গেছে। মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী ছিল খালেদ। লড়াই করতে করতে একবার গুরুতর আহতও হয়েছিল, সে শেখ সাহেবের ইন্তেকালের পর আর একটা অভ্যুত্থান ঘটাতে গিয়েছিল? ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নায়কদের মতন এমন করুণ চরিত্র আর হয় না, তারা নিক্ষিপ্ত হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।
দোতলায় সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন শেখ মুজিব, সদ্য ঘুম ভেঙে উঠে এসেছেন, নীচের দিকে এল এম জি হাতে সৈন্যদের দেখতে পেলেন, হয়তো মুখ চিনতে পেরেছেন দু’ একজনের, ভুরু তুলে তিনি তাঁর গম্ভীর গলায় গর্জে উঠলেন, এই, তোরা মনে করেছিস কী? সঙ্গে সঙ্গে ঘ্যার ঘ্যার ঘ্যার শব্দে গুলি! ঝাঁঝরা শরীরে জাতির পিতা গড়াতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে, দু চোখে গভীর বিস্ময়, সত্যিই দেশের মানুষ তাঁকে মারলো?
কলকাতায় সেবার মামুন থেকে গেলেন প্রায় ছ’ মাস। অনেকেই তাঁকে ফিরতে বারণ করেছিল। তিনি শেখ সাহেবের ঘনিষ্ঠ মহলের একজন হিসেবে মাকামারা হয়ে গিয়েছিলেন, দেশে ফিরলে তাঁর বিপদের সম্ভাবনা খুব বেশি। জেলখানার মধ্যে তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ নিহত হলেন, এর পর আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের খুঁজে খুঁজে খতম করা হবে, ঠিক একাত্তরে যা হয়েছিল! মামুন বিশ্বাস করতে চাননি, বাংলাদেশ তো পাকিস্তানে আবার মিশে যায়নি, আবার নিজের দেশ থেকে পালাতে হবে কেন? জিয়াউর রহমানকে মামুন তখন অবিশ্বাস করতে চাননি। জিয়াউর রহমানও একজন মুক্তিযুদ্ধের বীরযোদ্ধা, কে-ফোর্সের কমাণ্ডার ইন চীফ, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য জীবন পণ করে লড়েছিলেন না? চিটাগাং রেডিওতে প্রথম স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেছিলেন তো তিনিই। কিন্তু মুজিব-হত্যার পর কলকাতায় যারা পালিয়ে এসেছিল, তাদের মুখে মামুন শুনলেন, জিয়াউর রহমান আসলে নাকি রিলাকটান্ট ফ্রীডম ফাইটার, মুক্তিযুদ্ধে পাকেচক্রে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তার ঝোঁক ছিল পাকিস্তানেরই দিকে। তাছাড়া তিনি ভীষণ ক্ষমতাপ্রিয়। প্রেসিডেন্টের সিংহাসনে বসেই তিনি প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে লাগলেন। তাঁর রাগ যেন অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের ওপরেই বেশি! যারা পাকিস্তানের সমর্থক, এককালের কোলাবরেটর, জিয়ার আমলে, নিশ্চয়ই জিয়ার সমর্থন পেয়ে, তারা প্রকাশ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে আবার হম্বি তম্বি করতে লাগলো! কয়েকজন কুখ্যাত ঘাতক ও দালাল জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী পর্যন্ত হয়ে বসলো! আর যারা নিঃস্বার্থভাবে দেশের জন্য লড়াই করেছিল, তারা লুকিয়ে পড়ছে, তারা আর নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয়ই দিতে চায় না! ইতিহাসের এক অসাধারণ লড়াইয়ের এই পরিণতি!
শেখ সাহেব উদারভাবে সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, সেটাই হয়েছিল তাঁর প্রথম ভুল। রাজাকার, আলবদর, লুঠেরা, ধর্ষণকারী, যারা শান্তি কমিটির নামে ঘাতক কমিটি বানিয়েছিল, তাদের তালিকা তৈরি হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি নথিবদ্ধ হচ্ছিল, কিন্তু তাদের কোনো শাস্তিই দেওয়া হলো না। সকলে ঢালাও ক্ষমা পেয়ে গেল! অপরাধের শাস্তির কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো না দেশের মানুষের কাছে। যারা পাকিস্তান আর্মিতে থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তাদের স্বাধীন দেশের আর্মিতে স্থান দিয়ে পুরো র্যাংক দেওয়ার মধ্যে কি কোনো বাস্তববুদ্ধির পরিচয় আছে? আসলে শেখ মুজিব স্বাধীন দেশ পাওয়ার আনন্দে শাস্তি দিতে ভুলে গিয়ে শুধু প্রশ্রয় দিয়েই গেছেন। তাঁর নিজের আত্মীয় বন্ধুর ছেলেপুলেরা লুঠতরাজ করছে, তাদের সম্পর্কেও তিনি চোখ বুজে থাকছেন। রেডক্রসের টাকাকড়ি নিয়ে তছরুপের অভিযোগ উঠছে, তিনি কান দিচ্ছেন না। অপোজিশান লীডার হিসেবে যিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠদের অন্যতম, শাসক হিসেবে তিনি ব্যর্থ। তাঁর কি দরকার ছিল প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট হওয়ার? তিনি বুঝতে পারেননি যে বেশির ভাগ অপরাধীই নিঃশর্ত ক্ষমা পাবার পর কৃতজ্ঞতায় অভিভূত হয়ে যায় না, তারা আবার মাথায় চড়ে বসে, ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করে। শেখ মুজিবকে যারা হত্যা করতে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে সেরকম দু চারজন ক্ষমাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিল না?
জাতির পিতার ঘাতকদের কোনো শাস্তি দিলেন না জিয়াউর রহমান। জেলখানায় কারা তাজউদ্দিনদের খুন করলো? এত বড় বড় নেতাদের জেলখানার মধ্যে অতর্কিতে গুলি করে মেরে ফেলার মতন বীভৎস ঘটনা তো পাকিস্তানী আমলেও ঘটেনি। যাদের নাম বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার কথা, তাদের প্রাণ কেড়ে নিল সৈনিকের পোশাকে আততায়ীরা? আর্মির লোকেরা তাদের চেনে না, এ কখনো হতে পারে? জিয়াউর রহমানের এরকম মনোভাব দেখেই আবার অনেকে আত্মরক্ষার জন্য দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করলো। কেউ কেউ ভারতে, কেউ কেউ ইংল্যাণ্ডে।
মামুন শুনেছেন, কাদের সিদ্দিকীও দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। টাঙ্গাইলের ঐ ছেলেটিকে মামুন আগে চিনতেন না, ওর বড়ভাইয়ের সঙ্গে সামান্য পরিচয় ছিল। একাত্তরের সেই দুঃসহ দিনগুলিতে কলকাতায় বসে মামুন কাদের সিদ্দিকীর অসীম সাহসিকতার কাহিনী শুনে রোমাঞ্চিত হতেন। সেই চরম বিপদের মধ্যেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে সে এক বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর সে শেখ মুজিবের আহ্বানে সদলবলে অস্ত্র ত্যাগ করতেও দ্বিধা করেনি। মামুন মনে মনে তার নাম রেখেছিলেন, এ যুগের গ্যারিবল্ডি। এইসব দেশপ্রেমিকরা যদি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়, তবে সেই দেশটাই কত দুভাগা! কোথায় আছে এখন কাদের? যে দেশের স্বাধীনতার জন্য সে অনেকবার জীবন বিপন্ন করেছিল, আজ সেই স্বাধীন দেশে তার ফেরার অধিকার নেই, এজন্য না জানি কত কষ্ট পাচ্ছে
গাঁদাফুলের ঝাড়টার কাছে আবার এসে দাঁড়িয়েছে দু’জন মানুষ। একজন বেশ কাছে, আর একজন খানিকটা দূরে। কাছের মানুষটি দীর্ঘকায়, সারা মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, চওড়া বুক, হাতের কবজীতে বলিষ্ঠতার স্বাক্ষর, এ কে? চেনা চেনা লাগছে। ও, এই তো কাদের সিদ্দকী? তার চক্ষু দুটি যেন বালবের মতন, সেখান থেকে স্ফুরিত হচ্ছে। অভিমান আর ঘৃণা।
মামুন অস্ফুট স্বরে বললেন, কাদের? বেঁচে আছিস? এখন কোথায় থাকিস তুই?
কাদের বললো, হ্যাঁ, বেঁচে আছি! সহজে মরবো ভেবেছেন? আবার ফিরে আসবো এই দেশে, ইনসাল্লা, এই দেশটাকে সত্যি সত্যি স্বাধীন করতে হবে। সেজন্য আপনারা কতদূর কী চেষ্টা করছেন, মামুনভাই?
মামুন একটা হাত তুলে বললেন, আমার কথা বাদ দাও। আমার সূর্য অস্ত গেছে আমার। আর কোনো ক্ষমতাই নাই!
দূরে দাঁড়ানো লোকটি বললো, আমিও বেঁচে আছি। আবার লড়াই লাগলে জান কবলু করবো।
ওকেও চিনতে পারলেন মামুন। কয়েক বছর আগে একবার টাঙ্গাইল শহরেই একজন আলাপ করিয়ে দিয়েছিল, ওর পরিচয় শুনে মামুন ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। ওর নাম হাবীব, লোকের মুখে মুখে ওর নাম হয়ে গিয়েছিল জাহাজমারা হাবীব। একাত্তরের অগাস্টে ধলেশ্বরী নদীতে সেই বিখ্যাত যুদ্ধের নায়ক। নারায়ণগঞ্জ থেকে সাতটি স্টিমার ও লঞ্চ ভর্তি একুশ কোটি টাকার অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে যাচ্ছিল পাক সৈন্যরা রংপুরের দিকে। টাঙ্গাইলের মাটি-কাটা নামে গ্রামের কাছে সেই জলযানগুলিকে আক্রমণ করে বাঙালীর ছেলেরা। পাকিস্তানী সৈন্যদের তুলনায় কাঁদেরের বাহিনীর হাতে অস্ত্র ছিল সামান্য, কিন্তু বুদ্ধি ও মনের জোর দিয়ে তারা সেই জাহাজগুলো ঘায়েল করে দেয়, প্রচুর অস্ত্র সংগ্রহ করে নিজেদের জন্য, বাকি গুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই জাহাজমারা হাবীবকে টাঙ্গাইলে যখন দেখেছিলেন মামুন, তখন তার শরীরে মলিন, ছেঁড়া পোশাক, চোখ দুটি ভেতরে ঢোকা, ঠোঁটে তিক্ততার ছাপ। সরকার তাকে বীর বিক্রম খেতাব দিয়েছে একটা, আর কিছু দেয়নি। তার এখন সংসার চলে না, সন্তানেরা অনাহারে থাকে। সেদিন হাবীব বলেছিল, গ্রাম থেকে শহরে এসেছি রোজগারের চেষ্টায়, যদি আর কিছু না জোটে, রিকশা চালাবো। সেই রিকশার হ্যাঁন্ডেলে ছোট একটা সাইন বোর্ডে লেখা থাকবে, ‘জাহাজমারা হাবীব বীর বিক্রম।
এই সব খাঁটি বীরদের যথাযোগ্য সম্মান দিল না দেশ, আর বিশ্বাসঘাতকরা হচ্ছে মন্ত্রী আর আমলা। এখন আবার খুব ধর্ম ধর্ম জিগির উঠেছে। দরিদ্র মানুষদের যারা দু’ বেলা আহার্যের সংস্থান করে দিতে পারে না, তারাই বেশি করে ধর্ম গেলাবার চেষ্টা করে।
হাবীব বললো, সেই লড়াইয়ের সময় আমার প্রাণটা গ্যালেই ভালো ছিল। ছেলে-মেয়ের কান্না আর সহ্য হয় না, মামুন সাহেব!
কাদের সিদ্দিকী বললো, কামানবন্দুকের গুলির সামনেও কোনোদিন ভয় পাই নাই। তার বিনিময়ে পেলাম নিবাসন! দেশের মানুষ আমাদের ভুলে গেল এত তাড়াতাড়ি? যারা এখন বাংলাদেশের হতাক, তারা দেশের জন্য কী করেছে? এই প্রশ্ন উঠাবার সাহস কি কারুর নাই? মামুনভাই, আপনিও কি…
মামুন দু’হাতে কান চাপা দিলেন। তিনি কী উত্তর দেবেন এইসব প্রশ্নের?
গাঁদাফুলের ঝাড়টার কাছ থেকে মূর্তিদুটো মিলিয়ে গেছে, মামুন তবু সেই দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আয়েশা কোথায় গেল, তার সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। একবার মামুনের মনে হলো, আজ এতসব পুরোনো কথা মনে পড়ছে কেন? তার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে নাকি? মৃত্যুর ঠিক আগে নাকি সব স্মৃতি একবার ঝলসে ওঠে!
নব এসে বললো, চলেন, ভিতরে চলেন। অনেক বেলা হয়ে গেছে। এবার খাবেন নাবেন। চলেন।
নবর হাত ধরে মামুন উঠে দাঁড়ালেন, আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলেন বাড়ির দিকে। এই নব মামুনের পালিত পুত্র। গত বছর ফিরোজার মৃত্যুর পর সে-ই বলতে গেলে এ বাড়ির কর্তা, মামুনকেও তার হুকুম মেনে চলতে হয়।
মামুন অনুনয়ের সুরে বললেন, অনেকক্ষণ সিগারেট খাই নাই, একটা দিবি?
নব কঠোর ভাবে বললো, না। এখন না। ভাত খাওয়ার পরে একটা পাবেন!
এই নবকে মামুন কুড়িয়ে পেয়েছিলেন সুন্দরবনে।
সেবারে মামুন কলকাতায় গিয়েছিলেন প্রতাপের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে। প্রতাপ এক অদ্ভুত গোঁয়ার মানুষ, সে এদেশে কখনো এলোই না। সে জেদ ধরে আছে, পাশপোর্ট-ভিসা নিয়ে সে তার জন্মস্থান দেখতে আসতে চায় না। যদি কখনো ভিসাব্যবস্থা উঠে যায়, তাহলে সে বেড়াতে আসবে। সে রকম সম্ভাবনাও নেই, প্রতাপের আসাও হবে না। হেনা বাবলির বিয়ের সময় প্রতাপ না এলেও মুন্নির বিয়েতে মামুন না গিয়ে পারেননি।
সেই সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। ভারতে তখন ইন্দিরা গান্ধীর পতন হয়েছিল, কেন্দ্রে শাসকদল হয়েছিল জনতা পাটি, মোরারজী দেশাই প্রধানমন্ত্রী। পশ্চিমবাংলাতেও কংগ্রেসীরা হটে গেছে, বামপন্থীরা সরকার গড়েছে। হঠাৎ দণ্ডকারণ্য থেকে হাজার হাজার রিফিউজি চলে আসতে লাগলো পশ্চিমবাংলায়। এতকাল পরেও তাদের গা থেকে রিফিউজি ছাপটা তুলে ফেলা হয়নি, দণ্ডকারণ্যে তারা নিজেদের নিবাসিত মনে করে।
কী করে যেন তাদের মধ্যে রটে গিয়েছিল যে কংগ্রেস সরকারের পতন হয়েছে বলে এরপর বাঙালী উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবাংলাতেই স্থান পাবে। পঞ্চাশের দশকে বামপন্থী নেতারা বাঙালী উদ্বাস্তুদের বাংলার বাইরে পাঠাবার বিরোধিতা করেছিল না? এখন পশ্চিমবাংলা সরকারের অনেক মন্ত্রীও তো এককালের উদ্বাস্তু। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি ছিল পূর্ব বাংলায়, তিনি নিশ্চয়ই বিধান রায়-প্রফুল্ল সেন-সিদ্ধার্থ রায়দের চেয়ে পূর্ববঙ্গের মানুষের মর্মবেদনা অনেক বেশি বুঝবেন। নদীমাতৃক দেশের এই সব মানুষ মধ্যপ্রদেশের পাহাড়-জঙ্গলে কী করে মানিয়ে নেবে?
কিন্তু বিরোধী পক্ষে থাকা আর সরকার পক্ষে থাকার মধ্যে অনেক তফাত ঘটে যায়। এক কালে যারা উদ্বাস্তুদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন, এখন তাঁরা পশ্চিমবাংলায় আবার এত উদ্বাস্তুদের ভার নিতে রাজি হলেন না। কিন্তু ততক্ষণে উদ্বাস্তুদের স্রোত প্রবল ভাবে এদিকে ধেয়ে আসতে শুরু করেছে। হাজার হাজার থেকে তাদের সংখ্যা কয়েক লক্ষে পৌঁছে গেল। এরা সত্যই ছিন্নমূল, কতবার যে মাথায় ওপরের ছাউনি ছেড়ে পোঁটলা-পুটলি নিয়ে ছেলেমেয়ের হাত ধরে এরা পথে নামলো তার ঠিক নেই। দণ্ডকারণ্যের আশ্রয়ে তারা যদি সামান্য স্বাচ্ছন্দ্য পেতো, তা হলে কি তারা অনিশ্চয়তার দিকে আবার পা বাড়াতে!
পশ্চিমবঙ্গ সরকার মাঝরাস্তায় তাদের আটকাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু সেই জোয়ার সামলানো সহজ কর্ম নয়। উদ্বাস্তুদের এই ঢল কিন্তু কলকাতা আক্রমণ করলো না, তারা এগিয়ে চললো বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে।
কলকাতায় বসে মামুন তখন আতঙ্ক বোধ করেছিলেন। এই উদ্বাস্তুরা সীমান্ত বাংলাদেশে। ঢুকে পড়বে নাকি? তা হলেই সর্বনাশ! এমনিতেই জিয়াউর রহমানের আমল থেকে ভারত-বিরোধী হাওয়া বেশ গরম, তারপর উদ্বাস্তুরা গেলে সকলেই মনে করবে, ভারত সরকার চক্রান্ত করে হিন্দুদের পাঠিয়েছে। এই মতলবেই পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভারত সরকার মদত দিয়েছিল! এইসব দেশত্যাগী হিন্দুরা এত বছর বাদে যদি প্রাক্তন জমি-বাড়ি দাবি করে বসে, তা হলে এক সাঙ্ঘাতিক হাঙ্গামা বেধে যাবে। শুধু হিন্দুরাই তো ওদিক থেকে আসেনি, ভারত থেকেও বহু সহস্র মুসলমান চলে গেছে বাংলাদেশে। কলকাতার উপকণ্ঠে যে এককালে বহু মুসলমানের বাস ছিল, তা তো মামুন নিজের চোখেই দেখেছেন। সেইসব মুসলমানরাও যদি এখন কলকাতার জায়গা-জমি দাবি করে? এটা কিছুতেই আর সম্ভব নয়। দু দিকেই অনেক ট্রাজেডি ঘটে গেছে তা ঠিক, কিন্তু এখন আর নতুন করে তার সুরাহা করা যাবে না। দেশবিভাগকে এখন বাস্তব সত্য বলে মেনে নিতেই হবে। প্রতাপ যাই-ই বলুন, ভিসা-পার্টের এই জন্যই দরকার আছে।
উদ্বাস্তুরা অবশ্য সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করলো না। তারা চায় সুন্দরবনের দ্বীপগুলিতে বসতি স্থাপন করতে। সেখানে তারা মাছ ধরবে, ধান চাষ করে জীবিকানির্বাহ করবে, এইসব কাজই তারা ভালো জানে, তারা আর সরকারের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চায় না।
কিন্তু সুন্দরবনে ব্যাঘ্র প্রকল্প হয়েছে, বাঘদের বাঁচিয়ে রাখা আন্তর্জাতিক দায়িত্ব। অরণ্য সংরক্ষণ না করলে পরিবেশ দূষণ হবে, ওখানে মানুষের পঙ্গপালদের থাকতে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া মোরারজী দেশাইয়ের কঠোর নির্দেশ, কিছুতেই উদ্বাস্তুদের প্রশ্রয় দেওয়া হবে না, সরকার তাদের যেখানে থাকতে দিয়েছে, সেখানেই তারা থাকতে বাধ্য। পশ্চিমবাংলা সরকারও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে উদ্বাস্তুদের ফেরত পাঠাতে বদ্ধপরিকর হলো। প্রথমে ভালো ভাবে বোঝাবার চেষ্টা, তারপর জোর-জবরদস্তি। তাদের র্যাশন বন্ধ করে দেওয়া হলো, তারা যাতে স্থানীয় ভাবে কোনোক্রমেই কেনো কাজ জোটাতে না পারে, পশ্চিমবাংলায় বসে এক পয়সাও রোজগার করতে না পারে, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হলো সবরকম। উদ্বাস্তুদের সম্বল কিছুই নেই, তারা ঘটিবাটি বিক্রি করে চালালো কয়েকটা দিন, তারপর স্রেফ অনাহার। তবু তারা দাঁতে দাঁত দিয়ে বাংলার মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চায়। এতই তাদের মাটির টান? বাংলা। ভাষার প্রতি টান? কিন্তু প্রাণের দায় দেখা দিলে মাতৃভূমি বা মাতৃভাষার টান কিছুই না! অনাহারের সঙ্গে সঙ্গে এলো রোগ। পট পট করে শিশু ও বৃদ্ধ বৃদ্ধারা মরতে লাগলো। হাসনাবাদ বসিরহাটে আবার জ্বলতে লাগলো গণ-চিতার আগুন। সরকার সেই ক্ষুধার্ত, ভয়ার্ত মানুষগুলোর চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখলে খালি ট্রেন। ইচ্ছে করলে ফিরে যেতে পারো, অথবা মরো।
এক সময় শুরু হলো ফেরার পালা। দণ্ডকারণ্য ছেড়ে স্বজাতির কাছে যারা আশ্রয়ের জন্য এসেছিল, তারা এখানকার বাতাসে দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে, সর্বস্বান্ত হয়ে আবার ফিরে গেল দণ্ডকারণ্যে।
অনেকেই ফিরলেও পঁচিশ তিরিশ হাজার মানুষ কিছুতেই যেতে চাইলো না শেষ পর্যন্ত। তাদের এক নেতার নাম হারীত মণ্ডল, সে আগে দু’একবার গোপনে এসে এই এলাকাটা সরেজমিনে তদন্ত করে গিয়েছিল। এই পরিবেশই তাদের পক্ষে ঠিক ঠিক মানানসই। এতবড় সুন্দরবনের দু’একটি দ্বীপ তাদের জন্য ছেড়ে দিলে কী এমন ক্ষতি হবে সরকারের? সুন্দরবনে যে একেবারেই মানুষ থাকে না, তা তো নয়!
তারা মরিয়া হয়ে পড়ে রইলো, হারীত মণ্ডল তাদের বোঝাতে লাগলো, যদি মরতে হয়, মরবো এই মাটিতেই! দণ্ডকারণ্যের আদিবাসীদের হাতে মার খাওয়ার বদলে না হয় বাঙালীরাই। আমাদের মারুক!
ঐ অবুঝ উদ্বাস্তুদের দল যাতে নদী পার হতে না পারে, সেইজন্য সরকার সেদিককার ঘাট থেকে সরিয়ে দিল সমস্ত নৌকো, বন্ধ করে দিল স্টিমার সারভিস। সুন্দরবনের নদী শুধু নোনা নয়, তাতে হিংস্র কামঠ থাকে প্রচুর। স্নান করতেও কেউ জলে নামে না। একদিন হারীত মণ্ডল বাছা বাছা জনা পঞ্চাশেক যুবককে নদীর ধারে এনে বললো, ওরে তোরা সাঁতার ভূলে গেছিস? মানুষের কামড়ের চেয়ে হাঙরের কামড়ে কি বেশি ব্যথা লাগে? যদি মায়ের দুধ খেয়ে থাকিস তো মায়ের নাম করে আয় আমার সাথে! জয় বাবা কালাচাঁদ! এইবার সুদিন আসবেই! এতদিনে আমরা সুদিনের মুখ দেখবো।
সবাই এক সঙ্গে ঝাঁপ দিল জলে। হিংস্র জলজ প্রাণীরাও বোধহয় সেই মরিয়া মানুষদের দেখে ভয়ে দূরে সরে গিয়েছিল। ওরা সাঁতার কেটে নদী পার হয়ে জোর করে দখল করে নিল অনেকগুলো নৌকো। রাতের অন্ধকারে তারা পরিবারের লোকজনদের সেইসব নৌকোয়। চাপিয়ে নিয়ে এলো মরিচঝাঁপি দ্বীপে। হিসেব অনুযায়ী দুটি বাঘের জন্য বরাদ্দ যে অরণ্য অঞ্চল, সেখানে আশ্রয় নিল হাজার তিরিশেক মানুষ।
কয়েক মাস ধরে তারা রয়ে গেল সেই দ্বীপে। সরকারের তরফে কোনো রকম সাহায্য নেই, বরং সবদিক দিয়েই বিরোধিতা, তবু তারা বেঁচে রইলো। মানুষের বেঁচে থাকা এমনই নেশা! সেখানে পানীয় জল নেই, নৌকো করে তারা দূরের গ্রাম থেকে জল আনবার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের নৌকো ডুবিয়ে দেয়। তখন মেয়েরা চালাতে লাগলো নৌকো, হারীত মণ্ডলের পালিতা কন্যা গোলাপী সেই নৌকোয় দাঁড়িয়ে পুলিশদের বলে, তোমরা আমাগো গায়ে হাত দেবা? তোমাগো ঘরে মা-বোন নাই?
কয়েক মাস পরে শোনা গেল, তারা সম্পূর্ণ স্বাবলম্বী। তারা ঐ দ্বীপে টিউবওয়েল বসিয়েছে, ইস্কুল খুলেছে। এখন আর তারা উদ্বাস্তু নয়, স্বাধীন গৃহস্থ, তারা সরকারের কাছ থেকে এক পয়সা চায় না। তারা মাছ ধরে, জঙ্গলের কাঠ কাটে, আপাতত এই তাদের জীবিকা। পরের মরসুমে শুরু হবে চাষ আবাদ। তারা এখন জঙ্গল ধ্বংস করছে বটে, আবার নতুন করে গাছও লাগাচ্ছে।
মুন্নির বিয়েতে মামুন তাঁর স্ত্রী এবং ছোট মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়। তারপর ফিরোজা বেগমের অনুরোধে সবাইকে নিয়ে গেলেন আজমীঢ় শরীফ দর্শন করতে, সেখান থেকে দিল্লি-আগ্রা এবং কাশ্মীর। কাশ্মীর দেখার খুব শখ ছিল তাঁর। ফেরার পথে কলকাতায় এসে আবার থেকে যেতে হলো বেশ কয়েকদিন। প্রতাপ কিছুতেই ছাড়তে চান না।
একদিন প্রতাপ বললেন, সুন্দরবনের সাতজেলিয়া গ্রামে আমার চেনা এক ভদ্রলোক থাকেন। চলো, সেখানে একবার বেড়াতে যাবে নাকি? দিন তিনেক পরেই ফিরে আসবো। মেয়েদের আর বাচ্চাদের অবশ্য নিয়ে যাওয়া যাবে না, ঘর মোটে একখানা, তুমি আর আমি যাবো।
মামুন রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।
সাতজেলিয়ার খুব কাছেই মরিচঝাঁপি দ্বীপ। প্রতাপের খুব ইচ্ছে ছিল, উদ্বাস্তুদের নতুন বসতিটা একবার দেখে আসার। সারা ভারতে শরণার্থী বাঙালীদের সম্পর্কে এই বদনাম যে তারা অলস, তারা খেটে খেতে জানে না, তারা গভর্নমেন্টের বোঝা হয়ে থাকতে ভালোবাসে। পাঞ্জাবী উদ্বাস্তুদের সঙ্গে তাদর অনেক তফাত। কিন্তু মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুরা সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত পরিশ্রম করে, তারা কোনো সরকারি সাহায্য চায় না, এটা কী করে সম্ভব হলো? পাঞ্জাবী উদ্বাস্তুদের তো দণ্ডকারণ্যে পাঠানো হয়নি, তারা পেয়েছে হরিয়ানা, দিল্লি, তাদের পরিচিত পরিবেশ।
কিন্তু মামুন আর প্রতাপ পৌঁছোবার আগের দিনই মরিচঝাঁপিতে এক সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড ঘটে গেছে!
সরকারের নির্দেশ অগ্রাহ্য করেও তাদের এই উপনিবেশ গড়া কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না সরকার। তারা স্বাবলম্বী হয়ে সরকারের বোঝা কমিয়েছে, কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ধারণা, ওরা অবাধ্য হয়ে একটা কুদৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাদের তাড়াবার অনেক রকম চেষ্টা চলছিল। গোটা পঁচিশেক স্টিমার ও লঞ্চ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল সেই দ্বীপ, পুলিশ বাহিনী বন্দুক উচিয়ে তাদের প্রলোভন দেখিয়েছে, দণ্ডকারণ্যে ফিরে গেলেই তারা জমি পাবে, গরু পাবে, টাকা পাবে। ওদিকে দ্বীপে দাঁড়িয়ে একটা চোঙা মুখে নিয়ে হারীত মণ্ডল ঠাট্টা ইয়ার্কি করেছে।
শেষ পর্যন্ত সরকার অবশ্য তাদের পুলিশ দিয়ে মেরে তাড়ায়নি। মধ্যরাত্রে একদল গুণ্ডা হঠাৎ ছুরি লাঠি নিয়ে আক্রমণ করলো সেই বসতি। কেউ বলে, তারা কোনো একটি বড় রাজনৈতিক দলের কর্মী, কেউ বলে তারা সরকারেরই ভাড়া করা গুণ্ডাবাহিনী! তারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে সবকটা বাড়িতে, যারা বাধা দিতে এসেছে লাঠি মেরে তাদের মাথা ফাটিয়েছে, ছুরি দিয়ে পেট ফাঁসিয়েছে কয়েকজনের। সেই অসহায় মানুষগুলো ঘুম-চোখে হঠাৎ এই উপদ্রব দেখে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল, আগুন ও মানুষের হাত থেকে বাঁচবার জন্য অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জলে। সবাইকে জোর করে টেনে-হিঁচড়ে তোলা হয়েছিল লঞ্চে-স্টিমারে। এক রাতের মধ্যে মরিচঝাঁপি সাফ। অনেক স্বপ্ন নিয়ে গড়া কুঁড়েঘরগুলির আগুন ধিকিধিকি করে জ্বললো আরও দু তিনদিন ধরে।
সাতজেলিয়া, ছোট মোল্লাখালির মানুষজন দূর থেকে শুনেছে সেই রাতের আর্তনাদ। মাছ ধরা জেলে ডিঙিগুলো শেষরাতের দিকে ওদিকে গিয়ে স্বচক্ষে দেখেছেও অনেক কিছু। অনেক রকম গল্পও ছড়িয়েছে সেই রাতের ঘটনা নিয়ে। হারীত মণ্ডলকে নাকি শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করার জন্য আগেই ঘোষণা করেছিল, তার মাথার দাম দশ হাজার টাকা। হারীত সেই দামি মাথাটা কী করে বাঁচালো কে জানে! কিংবা হয়তো তার লাশ জলে ভেসে গেছে। কেউ কেউ বলে যে গুণ্ডাবাহিনীর একজন নেতার নাম ল্যাঙা, তার একটা পা খোঁড়া, সে এই অঞ্চলে কয়েকদিন আগে থেকেই যাতায়াত করছিল, সে হারীত মণ্ডলকে মারার জন্য লাঠি তুলতেই হারীত নাকি চেঁচিয়ে উঠেছিল, ওরে ভুলু, ওরে, তুই আমায় চিনতে পারলি না? ওরে, আমি যে তোর বাবা! তুই আমার ছেলে, সুচরিত!
মামুন আর প্রতাপ সাতজেলিয়ায় এসে পৌঁছোবার পর সর্বক্ষণ এইসব কাহিনীই শুনলেন। প্রতাপ একেবারে গুম হয়ে গিয়েছিলেন। অন্য দেশের সরকারের ব্যাপারে মন্তব্য করা উচিত নয় বলে মামুন চুপ করে ছিলেন, কিন্তু তিনি একটা অন্য কাণ্ড করে বসলেন। যে বাড়িতে এসে উঠেছিলেন তাঁরা, সেই বাড়ির গোয়ালঘরে আশ্রয় নিয়েছিল একটি ছেলে। ছেলেটির সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত, একটা পা ভেঙে গেছে, সে মরিচঝাঁপি থেকে নদীতে ভেসে সাতজেলিয়ায় উঠেছে। ঐ গ্রামে কিংবা ছোট মোল্লাখালিতে এরকম আরও কিছু কিছু আহত মানুষজন ভেসে এসেছে। গ্রামের লোক এদের নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। পুলিশের হাতেই তুলে দেওয়া উচিত, কিন্তু থানা অনেক দূর, সেই গোসাবায়। এই ছেলেটি কেঁদে কেটে কাকুতি মিনতি করে বলছে, তাকে যেন পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া না হয়, পুলিশ তাকে দণ্ডকারণ্যেও ফেরত পাঠাবে না, মেরে ফেলবে। সে হারীত মণ্ডলের পালিত পুত্র, তার নাম নবকুমার। হারীত মণ্ডলের ওপর সরকারের খুব রাগ, ঐ ছেলেটির ধারণা, হারীতকে মেরেই ফেলা হয়েছে, নবকেও গুণ্ডারা নাম ধরে খুঁজেছিল, হারীতের পরিবারটাই তারা নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। সে সাতজেলিয়া গ্রামে যে-কোনো বাড়িতে চাকর হয়েও লুকিয়ে থাকতে চায়।
মামুন হঠাৎ বলে উঠলেন, এই ছেলেটাকে আমি বাংলাদেশে নিয়ে যাবো!
প্রতাপ বলেছিলেন, তা কি করে সম্ভব! ওর তো পাসপোর্ট নেই। ও বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারবে না। ওকে তুমি নিজের কাছে রাখবে কী করে? এ তো বে-আইনী কাজ!
মামুন বলেছিলেন, হোক বে-আইনী। আমার দেশে অনেক বে-আইনী কাজই তো চলছে, এইটুকু একটাতে আর কী এমন ক্ষতি হবে? একটা সিম্বলিক জেসচার হিসেবে আমি ওকে নিয়ে যেতে চাই, প্রতাপ। স্বাধীন বাংলাদেশে এই দেশত্যাগীদের অন্তত একজনকে ফিরিয়ে নিতে পারলে আমি শান্তি পাবো!
প্রতাপ অনেক ভাবে মামুনকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, মামুন তবু তাঁর গোঁ ছাড়েননি। জেলেডিঙ্গি করে নবকে প্রথমে গোপনে পার করে দেওয়া হয়েছিল খুলনার সাতক্ষীরায়। সেখানে মামুনের এক ভগ্নীপতি থাকেন, কিছুদিন সেখানে ছিল নব, তারপর মামুন তাকে মাদারিপুরে আনিয়ে নিয়েছেন। এখনও পর্যন্ত কোনো গোলমাল হয়নি। মাদারিপুরের গ্রামাঞ্চলে এখনও কিছু কিছু হিন্দু পরিবার রয়ে গেছে, সুতরাং পুলিশের নজরে ও পড়েনি। মামুন এক এক সময় ভাবেন, তাঁর মৃত্যুর পরেও কি নব এখানে টিকতে পারবে? মামুন ওর নামে কিছুটা জমি লিখে দিয়েছেন, হয়তো এর পরে ওকে লড়াই করে বাঁচতে হবে। ভারতে ফিরে গেলেও তো ওর সে একই নিয়তি, সেখানেও লড়াই না করলে কে ওকে খেতে পরতে দেবে?
খাওয়া দাওয়ার পর দুপুরে লম্বা একটা ঘুম দিলেন মামুন। বিকেলবেলা তিনি আয়েশার সঙ্গে গল্প করতে বসলেন, এই নাতনীটি যেকদিন কাছে এসে থাকে, সেই কটা দিন তিনি সত্যিকারের আনন্দ পান। আয়েশা ঝণার জলের মতন কলকল সুরে কথা বলে। মামুন মাঝে মাঝেই শুনতে পাচ্ছেন একটা মটোর সাইকেলের আওয়াজ। যেন অনেক দূর থেকে একটা মটোর সাইকেল এইদিকে ধেয়ে আসছে। প্রায়দিন সন্ধেবেলাতেই তাঁর এরকম ভুল হয়। আলতাফ! সেই আলতাফ এখন কত বদলে গেছে, তবু তাকে প্রথম দেখার দিনটি মামুন। ভুলতে পারেন না।
হঠাৎ এক সময় বাগানের গেটের সামনে সত্যি সত্যি একটা মোটর সাইকেলের গর্জন হলো। চোখের ভুল নয়, কানের ভুল নয়, মাথায় হেলমেট পরা এক যুবক ঢুকছে গেট ঠেলে। বুকটা কেঁপে উঠলো মামুনের। তিনি বললেন, কে আসে রে, দ্যাখ তো, পুনপুনি!
আয়েশা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ওমা এ তো সুখুভাই!
মঞ্জুর ছেলে সুখুকে দেখে মামুনের খুশী হয়ে ওঠার কথা, কিন্তু তাঁর কপালে আশঙ্কার ভাঁজ পড়েছে। সুখু কি এনেছে কোনো দুঃসংবাদ? না হলে সে তো এমনি এমনি এত দূর আসবে না!
গেরিলা যোদ্ধার মতন সাজপোশাক করা সুখু কাছে এসে বললো, মাদারিপুরে, টাউনের মধ্যে আমার ক্লাসের এক বন্ধু থাকে, তার বাড়িতে ছিলাম কাল রাতে, তোমার সাথে দ্যাখা করতে আসলাম। কেমন আছিস রে, আয়েশা!
তারপর সুখুর গরম পানি দেওয়া হলো, সে স্নান করলো, খেয়ে নিল। রাত্তিরে এখানেই থাকবে বোঝা গেল। মামুনের বারবার মনে হচ্ছে, মাদারিপুরে বন্ধুর বাড়িতে আসার ছুতোটা ঠিক নয়, সুখু তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছে, কিন্তু কারণটা এখনো বলছে না। ঢাকায় প্রবল ছাত্র-আন্দোলন শুরু হয়েছে, মামুন সে খবর পান রেডিও শুনে। সুখু যে একজন ছাত্রনেতা হয়েছে, সে খবরও তার কানে আসে। কিন্তু তিনি মঞ্জু কিংবা তার ছেলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই রাখেন না। তবে মঞ্জুর গানের কয়েকখানা রেকর্ড তিনি শোনেন বারবার।
রাত সাড়ে নটার মধ্যে মামুনের শুয়ে পড়া অভ্যেস। আজও তিনি শুয়ে পড়লেন, চোখের সামনে মেলে ধরলেন একটা বই। দু’তিন পাতা পড়তে পড়তেই ঘুম এসে যায়। ঠিক ঘুম আসার সেই মুহূর্তটাতেই তাঁর ঘরে এসে ঢুকলো সুখু। মামুন ভাবলেন, এবারে সে কিছু বলবে। তাও সে কিছু বলে না, ঘুরে ঘুরে আলমারির বই দেখতে লাগলো।
মামুন জিজ্ঞেস করলেন, কী রে? কাল তোদের ইউনিভার্সিটিতে অনেক হাঙ্গামা হয়েছে, তুই এ সময় ঢাকা ছেড়ে চলে আসলি যে?
সুখু বললো, তোমাকে দেখতে আসলাম। তুমি আমাদের কোনো খবর নাও না।
মামুন বললেন, খবর সবই পাই। তুই বাবা-মাকে বলে এসেছিস তত? না হলে তারা চিন্তা করবে। আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে।
সুখু বললো, মাঝে মাঝে বাবা-মাকে চিন্তায় রাখা ভালো। অন্য সময় তো তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
বাবার সঙ্গে দেখা টেখা করিস? তার শরীর ভালো আছে? ব্লাড প্রেসার হাই শুনেছিলাম।
–সব ঠিক আছে। দাদা, তুমি আমাকে কিছু টাকা দিতে পারো? মামুন এবার নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। তিনি হেসে বললেন, যাক, বাঁচা গেল। তা হলে তুই এই বুড়োটাকে দেখতে আসিসনি। অতি ভক্তি সন্দেহজনক! কত চাই?
সুখু মামুনের দিকে এবার সোজাসুজি চেয়ে বললো, ফিফটি থাউজেন্ড বাক্স?
মামুন চমকে উঠে বললেন, অত টাকা? তা আমি পাবো কোথায়! অত টাকা দিয়ে তুই কী করবি?
–ফরেনে যাবো। লন্ডনে পড়াশুনা করবো। এখানে থাকলে আমার পড়াশুনা হবে না।
–তাহলে তো ঢাকা ইউনিভার্সিটিটাই লন্ডনে তুলে নিয়ে যেতে হয়। দুই বৎসব সব পরীক্ষা পিছিয়ে আছে তাই না?
–তুমি আমাকে টাকাটা দিতে পারবে কি না বলো?
–অত টাকা আমার নাই। তোর মায়ের কাছে না চেয়ে আমার কাছে চাইতে এসেছিস যে?
-–মা দেবে না। মা আমাকে ফরেনে যাবার পারমিশনও দেবে না। মাকে বোঝাবার দায়িত্বটাও তোমাকেই নিতে হবে।
–তোর মা আমার কথা শোনবে কেন? আমি কে, কেউ না! আমি তো একটা বাতিল বুড়া। গ্রামে পড়ে থাকি।
মামুনের শিয়রের কাছে বসে পড়ে সুখু বললো, তুমি কেউ না? আমি যে শুনেছি, তোমার জন্যই আমার মা আর বাবার মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল। তখন আমি ছোট ছিলাম, কিছু বুঝি নাই, কিন্তু এখন জানি, আমার মাকে তুমি সব সময় গাইড করেছো। তোমাকে সে পীর পয়গম্বর মনে করে।
কনুইতে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে উঠে মামুন বললেন, তোকে কে বলেছে এ সব কথা? তোর মা বলেছে?
–জী না। মা আমার সাথে কোনো পার্সোনাল কথা বলে না। মাকে আমার কেমন জানি ডিসট্যান্ট আর অ্যালুফ মনে হয়। আমাকে বলেছে মনিরা আপা।
–মনিরার পেটে কোনো কথা থাকে না। তোকে শুধু এইটুক বলেছে, আর কিছু বলেনি?
–আমার বাবা তোমাকে হিংসা করতো। ফরনাথিং জেলাসি!
–ফরনাথিং? তুই ঠিক জানিস?
–আমার মায়ের সাথে তোমার সত্যি সত্যি লাভ অ্যাফেয়ার ছিল নাকি?
–সুখু, তুই সঙ্গে কোনো আর্মস এনেছিস? রিভলভার কিংবা ছোরা? আমাকে নদীর ধারে নিয়ে চল, তারপর আমাকে খুন করে রেখে যা! তা হলেই সব ঝাট চুকে যায়।
–তুমি এত আপসেট হচ্ছো কেন? আমি কি তোমাকে কোনো অ্যাকিউজ করতে। এসেছি? টাকা চাইছি, সেটাকেও ব্ল্যাক মেইল মনে করো না। আমার খুব দরকার তাই চেয়েছি, দিতে না পারলে কি জোর করবো নাকি?
–সুখু, আমি জীবনের ফ্যাগ এন্ড-এ পৌঁছেছি, এখন আর কোনোরূপ মিথ্যা বলতে পারবো না। আমার সব কথা শুনলে তোর রক্ত গরম হয়ে যাবে। আমাকে খুন করতে ইচ্ছা হলে করিস। গলাটা চিপে ধরলেও আমি খতম হয়ে যাবো। একথা সত্যিই যে, আমি তোর মাকে ভালোবাসতাম। তারচেয়েও বড় কথা, তুই বাবুল চৌধুরীর সন্তান না, তুই আমার ছেলে!
রাগ করার বদলে সুখু হা-হা করে হেসে উঠলো। মামুনের মুখের কাছে ঝুঁকে এসে বললো, আমাকে ঠকাতে পারবে না। নো ওয়ে। আমি চেক করেছি। আমার সন্দেহ হয়েছিল একবার। কিন্তু আমার জন্ম হয়েছিল স্বরূপনগরে। সেখানেও আমি গেছি একবার। বিয়ের পর আমার মা আর বাবা স্বরূপনগরে চলে গিয়েছিল। দুই বৎসরের মধ্যে তাদের সাথে তোমার একবারও দেখা হয়নি। বাবুল চৌধুরী আমার জেনুইন ফাদার, নো ডাউট অ্যাবাউট ইট। অবশ্য অন্য। কেউ আমার ফাদার হলেও আমি অখুশী হতাম না!
মামুন কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ফিজিক্যালি তুই আমার সন্তান না হলেও তুই আমার ছেলে। তোর বাবা তোক ছোটবেলায় যতবার কোলে নিয়েছে, তার থেকে অনেক বেশিবার আমি তোকে আদর করেছি। তোকে আমি একটু একটু করে বড় হয়ে উঠতে দেখেছি, ঠিক যেন আমারই ছেলে তুই, আমি এইরকম মনে করতাম। আমি ভালবাসতাম তোর মাকে। হ্যাঁ, সেটা ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই না। প্রতিদিন তাকে না দেখে থাকতে পারতাম না। যখন খবরের কাগজে এডিটারি করতাম, কত ব্যস্ততা ছিল, তবু প্রত্যেক সন্ধ্যাবেলা একবার ছুটে যেতাম তোকে আর তোর মাকে দেখবার জন্য। বাবুল চৌধুরীর জেলাস হবার যথার্থ কারণ ছিল। আমি অন্ধ ছিলাম, বুঝি নাই! বাবুলের স্ত্রী পুত্রকে আমি ভালোবাসা দিয়ে কেড়ে নিতে চেয়েছিলাম, তার তো রাগ হবেই। সেইজন্য সে সন্ধ্যার সময় বাড়ি থাকতো না। কিন্তু একটা কথা তোকে বিশ্বাস করতেই হবে, আল্লার কসম। আমি তোর মাকে কোনোদিন পাপচক্ষে দেখি নাই। কোনোদিন অন্যায়ভাবে স্পর্শ করি নাই। তোর মায়ের মতন পবিত্র রমণী আর হয় না। তার অন্তরটা নিষ্কলুষ! তবু একথা ঠিক, আমি ভালোবাসা দিয়ে তার জীবনে সর্বনাশ ডেকে এনেছি!
সুখু আবার হেসে উঠলো। এবার সে মামুনের মাথার চুলে হাত দিয়ে বললো, তোমরা এই ব্যাপারটাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছো কেন? মাই ফাদার ইজ আ ফুল! তোমার সঙ্গে তোমার ভাগ্নীর একধরনের প্লেটনিক লাভ-এর সম্পর্ক ছিল, তা নিয়ে এত মাথা ফাটাফাটি করার কী ছিল? ইউ আর টু ডিসেন্ট আ জেন্টলম্যান টু ডু এনিথিং ইমমরাল! তোমার সঙ্গে আমার মায়ের যে সম্পর্ক ছিল, সেটা স্নেহের থেকে দুতিন ডিগ্রি বেশি বলা যেতে পারে, সেটা আমার বাপ ব্যাটা। মেনে নিতে পারেনি!
মামুন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন সুখুর দিকে। সুখু কী বলছে তা যেন তিনি কিছুই। বুঝতে পারছেন না। এই জেনারেশানের ছেলেদের অন্যরকম ভাষা। তিনি ভেবেছিলেন সুখু তাঁকে খুন করতে চাইবে, তার বদলে ছেলেটা হাসছে!
সুখু আবার বললো, বৃদ্ধ, আমাকে আর মাকে যদি অতই ভালোবাসতে, তাহলে হঠাৎ ঢাকা ছেড়ে চলে আসলে কেন? এটা কী ধরনের স্যাক্রিফাইস!
মামুন বললেন, ঠিক স্যাক্রিফাইস না। আমি বাবুল চৌধুরীকে বোঝাতে চেয়েছিলাম যে, তোদের সাথে আমার কোনো স্বার্থের সম্পর্ক ছিল না। ভালোবাসা যথেষ্ট ছিল বলেই একেবারে ত্যাগ করেও চলে আসতে পেরেছি।
–তোমাদের যত সব বাজে সেন্টিমেন্ট। তবে, এ কথা জেনে রাখো, আমার বাবার চেয়ে। আমি তোমাকে অনেক বেটার পার্সন মনে করি!
–ও কথা বলিস না। বাবুলের অনেক গুণ আছে। ও যে কত বড় ফ্রীডম ফাইটার ছিল তা তো কেউ জানেই না। নিজেকে ও বড় বেশি গুটিয়ে রাখে। ওর যত যোগ্যতা ছিল, সব যদি ব্যবহার করতো, তাহলে দেশে একজন বিখ্যাত মানুষ হতে পারতো! কেন যে ও সবসময় ঘরে বসে থাকে, হয়তো আমিই সেজন্য দায়ী।
–বুল সীট! কেউ কাউর জন্য দায়ী হয় না। যার যোগ্যতা থাকে, সে নিজেই প্রকাশ করে। সবসময় যারা বই পড়ে আর থিয়োরি কপচায়, তারা দেশের কোনো কাজে লাগে না। আসল কথাটা বলো, তুমি টাকাটা আমাকে দেবে না?
–যদি বলিস, এই বাড়ি বিক্রি করে দিতে পারি তোর জন্য।
–তারপর কি তুমি ফকির হয়ে বেড়াবে! হাঁটতেও তো পারো না ভালো করে! থাক, দরকার নাই। মাকেই বলতে হবে। তুমি আমার মাকে বুঝাবার দায়িত্বটা নেবে?
–তোকে একটা অনুরোধ করবো, সুখু! তুই বিদেশে যাইস না। তোর মায়ের অনেক দুঃখ। তুই চলে গেলে সে কী নিয়ে বাঁচবে? তোদের মতন ছেলেরা দেশ ছেড়ে চলে গেলে এ দেশটার কী দশা হবে?
সুখু একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। তারপর বললো, আমি তোমার কাছে দুই চারদিন থাকবো। পুলিশ আমাকে ধরতে আসলে তুমি আমাকে বাঁচাবে?
মামুন বললেন, ও, এই ব্যাপার! না, পুলিশের হাত থেকে বাঁচাবার ক্ষমতা আমার নাই। কে আমাকে গ্রাহ্য করে। কিন্তু তোকে আমি বিদেশে পাঠাবার বদলে জেলে পাঠানোই প্রেফার করবো। আমাদের মতন দেশে একবার অন্তত জেলে না গেলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না।
পরদিনই দু’ঘণ্টার ব্যবধানে আলাদা আলাদা ভাবে এসে পৌঁছোলো মঞ্জু আর বাবুল। দু’জনেই খবর পেয়েছে যে সুখুকে অ্যারেস্ট করার জন্য পুলিশ খুঁজছে। বাবুল একেবারে সঙ্গে এনেছে পাসপোর্ট ফর্ম। সে দু’তিনদিনের মধ্যেই ছেলেকে লন্ডনে পাঠিয়ে দিতে চায়। মঞ্জুর ইচ্ছে, ছেলে কিছুদিনের জন্য কলকাতায় চলে যাক। কিন্তু সুখু হঠাৎ বেঁকে বসেছে। সে কোথাও যাবে না। বাবা কিংবা মায়ের সঙ্গে সে ভালো করে কথাই বলতে চায় না। সে আয়েশার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতে লাগলো মন দিয়ে, একসময় দু’জনে মাদারিপুর শহরে বেড়াতে চলে গেল।
মঞ্জু বাবুলের সামনে একবারও আসেনি। বাবুল মামুনের সঙ্গে কথা বললো কাটাকাটা ভাবে। ছেলের টানে সে বাধ্য হয়ে এখানে এসেছে। মামুন একসময় অসহায় ভাবে বললেন, বাবুল, তুমি এই ব্যাপারে অন্তত আমাকে দোষ দিও না। তোমার ছেলেকে আমি এখানে ডেকে আনি নাই, তাকে আমি জোর করে ধরে রাখতে চাই না। তবে, তার প্রায় বিশ বৎসর বয়েস হয়েছে, এখন সে নিজের ইচ্ছা মতনই চলতে চাইবে।
বাবুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলো।
তাকে দুপুরবেলা খেয়ে যাওয়ার অনেক অনুরোধ করলেন মামুন। বাবুল শুকনো ধন্যবাদ। জানিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করলো। সে এক বন্ধুর গাড়ি চেপে এসেছে, তাকে আজই ফিরে যেতে হবে।
বাড়ি থেকে নেমে গেটের দিকে এগিয়ে গেল বাবুল। গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। বাবুল বাইরে বেরুবার আগে থমকে দাঁড়ালো, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ডান দিকে। বাগানের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে মঞ্জু, এ দিকে পেছন ফিরে খুব মনোযোগ দিয়ে কী একটা ফুলগাছ দেখছে।
বাবুল সেদিকে এগিয়ে গেল। তার হাঁটার ভঙ্গিতে একটা দ্বিধার ভাব আছে। কাছাকাছি। গিয়ে, একটুক্ষণ থমকে থাকার পর সে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছো, মঞ্জু?
মঞ্জু মুখ ফিরিয়ে বাবুলকে দেখলো। তার মুখে রাগ, দুঃখ, অভিমান কিছুই নেই। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে, অনেকক্ষণ সময় নিয়ে, সে বললো, ভালো। তুমি ভালো আছো?