হাজরা পার্কের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন প্রতাপ। তাঁর কিছুই করার নেই, কোথাও যাবার নেই।
রাস্তায় যে এত মানুষ, তাদের প্রত্যেকেরই নিশ্চয়ই কোনো গন্তব্য আছে, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়ার উদ্দেশ্য আছে কিছু একটা। গাড়িগুলো যাচ্ছে তাড়াহুড়ো করে, কেউ অন্যকে জায়গা ছাড়ে না, যে-যেমন খুশী ওভার-টেক করতে গিয়ে পথের মোড়ে জ্যাম তৈরি করে ফেলে, স্টার্ট বন্ধ না করে গজরায়, যেন বলতে চায়, আমার দেরি হয় হোক, কিন্তু তোমাকে কিছুতেই আগে যেতে দেবো না।
বিমানবিহারী এখন কৃষ্ণনগরে। গত কয়েকদিন ধরে আবহাওয়া বেশ মনোরম, কৃষ্ণনগরে ভালোই সময় কাটতে পারতো। বাড়ির ফোনটা খারাপ, কোনো একজন লোক দিয়ে বিমান একটা খবর পাঠালেই প্রতাপ চলে আসতেন। মামলার ব্যাপারে তিনি পরামর্শও দিতে পারতেন। অবশ্য মমতা যে এখানে নেই, তা বিমানবিহারী জানতেন না, মমতাকে একা রেখে প্রতাপ কৃষ্ণনগরে যেতে পারবেন না, এটাই বোধহয় বিমান ভেবেছেন।
প্রতাপকে একা রেখে মমতা তো দিব্যি হরিদ্বারে চলে যেতে পারে।
বুলি ঠিকই ধরেছিল, মমতা এমনি এমনি যায়নি, ঝগড়া করেই গেছে। দাম্পত্য কলহ প্রৌঢ় বয়েসে নাকি বেশ গাঢ় মধুর হয়। কাঠের জ্বালে খেজুর রসের মতন। কই, প্রতাপ তো সেই স্বাদটা পাচ্ছেন না। মমতা তাঁর অমতেই চলে গেল বলে তাঁর ঠোঁটে আজও একটা তেতো তেতো ভাব।
হরিদ্বার বেশ স্বাস্থ্যকর জায়গা। সেখানে একটি ওষুধের কারখানায় অনুনয় চীফ কেমিস্ট, বেশ বড় কোয়াটার পেয়েছে। মুন্নি নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে, জামাইটিকে প্রতাপেরও বেশ পছন্দ হয়েছে। তাঁর জামাই কাজ ভালোবাসে, কাজের প্রতি একটি ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ আছে, যা এ যুগে দুর্লভ। অনুনয় স্বল্পভাষী ও বিনীত হলেও তার মতামতের বেশ দৃঢ়তা আছে। মুন্নি প্রায়ই মা-বাবাকে হরিদ্বারে আসার জন্য চিঠি লেখে। সবাই ভাবে, রিটায়ার্ড লোকদের আবার যাবার অসুবিধে কী?
তাহলেও কি মেয়ে-জামাইয়ের কাছে ঘন ঘন যাওয়ার কোনো যুক্তি আছে? হরিদ্বারে থাকে বলেই ওদের বাড়িতে অতিথির অন্ত নেই। দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন যারাই দিল্লি যায়, তারাই একবার হরিদ্বার ঘুরে আসতে চায়। বিনা পয়সায় ওরকম থাকা-খাওয়ার জায়গা পেলে সেই সুযোগে হরিদ্বার দর্শন করে আসতে কে না চাইবে? বাড়িতে ঘন ঘন অতিথি আসার যে কী বিড়ম্বনা, তা কি মমতা বোঝেন না? তবু তিনি এমনকি প্রতিবেশীদেরও ডেকে বলেন, দিল্লি যাচ্ছো? একবার হরিদ্বারে আমার মেয়ে জামাইয়ের ওখানে ঘুরে এসো, কোনো অসুবিধে নেই…
অদ্ভুত মমতার বিবেচনাবোধ, নিজের মেয়ের ঘাড়েই অতিথির বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছেন।
প্রতাপ একবারই গেছেন হরিদ্বারে। গতবছর। এমনিতে ঘিঞ্জি শহর, তীর্থস্থানের যাবতীয় ক্লেদ ও খারাপ চরিত্রের মানুষে ভরা, তবু ফাঁকার দিকে গেলে বড় সুন্দর, মসৃণ একটা শোভা আছে। পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন নগাধিরাজ হিমালয়, এই অনুভূতিই শিহরণ জাগায়।
সেবার হৃষীকেশ লছমনঝোলা পর্যন্ত শুধু যাওয়া হয়েছিল, কেদারবদ্রী যাবার পরিকল্পনাও হয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টি নেমে গেল, সেবার একটু আগেই এসে পড়লো বর্ষা।
ফেরার পথেই ট্রেনেমমতা বলেছিলেন, এখন তো আমরা ঝাড়া হাত-পা, এবার থেকে আমরা প্রত্যেক বছরই একবার করে এদিকে আসবো। এদিকে কত বেড়াবার জায়গা! হর কী-প্যারী ঘাটটাই আমার এত ভালো লাগে!
প্রায় চল্লিশ বছরের দাম্পত্য জীবনের পরও মমতা এখনো তাঁর স্বামীর চরিত্র ঠিক বোঝেননি, তাঁর স্বামীর সূক্ষ্ম পছন্দ-অপছন্দের নিরিখ পান না! মমতার উচ্ছাস শুনেও প্রতাপ গম্ভীরভাবে চুপ করে ছিলেন! হরিদ্বারে অনেক কিছু ভালো লাগলেও আসলে বেশ খানিকটা অপমানিত বোধ করেছিলেন প্রতাপ।
অনুনয়ের বাবা গোরাচাঁদও এখন প্রতাপের মতন রিটায়ার্ড, তিনি বিপত্নীক এবং ছেলের কাছেই থাকেন। ইদানীং তিনি নিরামিষ খান, কোনো এক গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছেন, চোখে মুখে ফুটিয়ে তুলেছেন এক ধরনের আধ্যাত্মিক অন্যমনস্কতার ছাপ। হরিদ্বার তো তাঁর পক্ষে আদর্শ জায়গা হবেই, তাছাড়া একা একা তিনি আর অন্য কোথায়ই বা থাকবেন! এই তো নাতি-নাতনী নিয়ে আহ্লাদ করার সময়!
এই মানুষটিকে প্রতাপ কিছুতেই পছন্দ করে উঠতে পারলেন না!
এতখানি বয়েস হলেও প্রতাপ ঠাকুর-দেবতার কাছে মাথা নোয়ান না। কোনো বিখ্যাত ধর্মস্থানে গেলে তিনি মন্দিরের বাইরের দিকে ঘুরে ঘুরে দেয়ালের কারুকার্য কিংবা ভাস্কর্য দেখেন। মমতা যান ভেতরের বিগ্রহকে প্রণাম করতে। প্রতাপের তাতে আপত্তির কিছু নেই। ধর্মবিশ্বাসীদের প্রতি তাঁর মনে কিছুটা অবজ্ঞার ভাব থাকলেও বাইরে তা প্রকাশ করেন না। কখনো। তাঁর বন্ধু বিমানবিহারীই তো রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষা নিয়েছেন কিছুদিন আগে, প্রতাপ তা নিয়ে পরিহাস পর্যন্ত করেননি। কেউ যদি ওসবে আনন্দ কিংবা শান্তি পায় তো পাক। কিন্তু ধর্ম অবলম্বন করেও কারুর মন যদি অনুদার থাকে, মুখে যা বলে নিজের জীবনে সে রকম আচরণ না করে, তাহলে সেই সব মানুষকে তিনি প্রায় অস্পৃশ্য জ্ঞান করেন।
গোরাচাঁদের ঠিক অতটা দোষ নেই। হয়তো ওর মনের মাপটাই ছোট।
এ দেশে পুত্র সন্তান আর কন্যা সন্তানের তফাত যে কতদূর যেতে পারে, তা প্রতাপ যেন প্রথম বুঝলেন হরিদ্বারে গিয়ে। গোরাচাঁদ তাঁর ছেলের বাড়িতে থাকেন, সেটা তাঁর ন্যায্য অধিকার। আর প্রতাপ-মমতা মেয়ের কাছে গেলে তাঁরা হন অতিথি। মুন্নি লেখাপড়া শিখেছে, সে-ও হরিদ্বারে সরকারি ওয়েলফেয়ার বোর্ডে চাকরি পেয়েছে, তবু গোরাচাঁদ মনে করেন, এটা তাঁর ছেলের সংসার, তিনি এই পরিবারের কর্তা। প্রতাপ হলেন কুটুম্ব। গোরাচাঁদের ব্যবহারে সব সময় এটা টের পাওয়া যায়। যদিও তিনি যে সব সময় হামবড়া ভাব দেখান তা নয়, বরং অতিরিক্ত খাতিরই করেন, কিন্তু প্রতাপের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন একটু উঁচু থেকে। মমতা ঐ খাতিরটাই দেখতে পান, গোরাচাঁদের পায়ের তলার প্লাটফর্মটা তাঁর নজরে পড়ে না।
মমতাকে এসব কথা উল্লেখ করলেই তিনি প্রতাপকে বলবেন, তোমার সবতাতেই বাড়াবাড়ি!
এ বছর মম কেদার-বদ্রী যাবার পরিকল্পনা একেবারে ঠিকঠাক করে ফেলেছিলেন, প্রতাপ চাইছিলেন দক্ষিণ ভারতের দিকে যেতে, এমন সময় মুন্নির চিঠি এলো। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি তার দ্বিতীয় সন্তান প্রসব হবে।
চিঠিটা পড়ে বেশ উৎফুল্ল ভাবে প্রতাপ বলেছিলেন, বাঃ, তবে তো আর এখন হরিদ্বারে যাবার কোনো মানে হয় না। মুদি পাহাড়ে উঠতে পারবে না, কেদারবদ্রী ক্যানসেল! তাহলে বেঙ্গালোরের টিকিট কাটি? আমরা সাউথ ইন্ডিয়া ঘুরে আসি!
মমতা গভীরভাবে অবাক হয়েছিলেন। একই সংবাদের দু’রকম প্রতিক্রিয়া!
তিনি বলেছিলেন, তুমি বলছো কী? খুকীর বাচ্চা হবে, সেই সময় আমরা ওর কাছে না গিয়ে সাউথ ইন্ডিয়ায় ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াবো?
প্রতাপ বলেছিলেন, আমরা ওর কাছে গিয়ে কী করবো? বাড়িতে বেশি লোকজন থাকলে সামলাতে ওরই ঝামেলা হবে। ওখানে ভালো হাসপাতাল আছে, কোম্পানির নিজস্ব ডাক্তার আছে…
–তা বলে আমি মা হয়ে ওর কাছে থাকবো না সেই সময়? অনুনয়ের মা বেঁচে নেই, বাড়িতে সে রকম আর কেউ নেই দেখবার…
–তবে মুন্নিকেই এখানে আসতে লিখে দাও। আমাদের এখানে এসে দু’এক মাস থাকুক। বাড়ির কাছেই নতুন একটা নার্সিং হোম খুলেছে…
–ওরা কী করে আসবে? খুকী বেশিদিন ছুটি পাবে না, ওর নতুন চাকরি। ওর ছেলেটাও ওখানকার স্কুলে ভর্তি হয়েছে
–বেশিদিন না থাকতে পারে, অন্তত এক মাস থাকুক। তাতে আর এমন কি অসুবিধে
–তোমার কি আক্কেল বুদ্ধি কোনোদিন হবে না? অতদূর থেকে মেয়েটা আসবে, তারপর আঁতুরের বাচ্চা নিয়ে ট্রেনে করে ফিরবে এতখানি পথ? কেন, আমাদের হরিদ্বারে যেতে কী অসুবিধে? তোমার এখানে কী এমন রাজকার্য আছে?
আবার হরিদ্বার যেতে হবে, গোরাচাঁদের সঙ্গে ভদ্রতার সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। দিনের পর দিন অবান্তর কথা বলে সময় কাটাতে হবে তাঁর সঙ্গে। প্রত্যেকদিনই মনে হবে, মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতে বেশিদিন থাকা হয়ে যাচ্ছে না তো! গোরাচাঁদ যতদিন খুশী থাকতে পারেন, কারণ তিনি ছেলের বাপ। এই চিন্তাতে প্রপের মনে ক্ষোভ জমছিল। তিনি হঠাৎ ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠেছিলেন, ছেলে-মেয়েদের যাঁর যখন যেখানে বাচ্চা হবে, অমনি তোমাকে সেখানে ছুটে যেতে হবে? কেন, তুমি কি দাই নাকি?
তীব্র শ্লেষ ছিল এই উক্তিতে। পুরোনো সুপ্ত বেদনা ছিল।
মমতা আহত ভাবে একটুখানি চুপ করে ছিলেন। এককালের ফর্সা মুখখানাতে একটু কালো ছাপ পড়তে শুরু করেছে। মাথার চুল অবশ্য তেমন পাকেনি। বয়েসের মেদ জমেনি, শরীরটি এখনো ছিপছিপে, কিন্তু ভাঁজ পড়েছে নাকের দু’পাশে।
স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিটি শব্দে বিষ মাখিয়ে তিনি বলেছিলেন, জানি, সারা জীবনটাই তো দেখলাম, ছেলে-মেয়েদের প্রতি তোমার একটুও স্নেহ-মমতা নেই! তুমি স্বার্থপর! নিজের সুখ ছাড়া আর কিছু বোঝে না! তোমার এত অহংকার যে ছেলে-মেয়েদের ব্যাপারেও তুমি অহংকারে মটমটিয়ে থাকতে চাও! তোমার জেদটাই সব সময় বড় হবে! তোমার জন্য আমার ছেলে-মেয়েদের আমি কিছুতেই ছাড়তে পারবো না! সারাজীবন যথেষ্ট ভুগেছি তোমার এই জেদের জন্য!
মমতা যথাস্থানেই তীব্র আঘাতটা হেনেছিলেন। প্রতাপ আর একটিও শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেন না। তিনি স্বার্থপর? ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি কিছুই করেননি?
প্রতাপ আহত ভাবে মমতার দিকে তাকাতেই তিনি আবার তিক্ত গলায় বলেছিলেন, সেবারে বাবলুদের ওখানে গিয়ে তুমি কী কাণ্ড করলে মনে নেই?
চার বছর আগে ছেলের পেড়াপিরিতে প্রতাপ আর মমতা গিয়েছিলেন বিদেশে। প্রতাপের যাবার ইচ্ছে ছিল না, সদ্য তখন বাড়ি তৈরিতে হাত দিয়েছেন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকা তাতেই প্রায় শেষ হয়ে যাবে। একতলায় দোকানঘর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাতে হবে। কিন্তু অতীন বারবার চিঠি লিখছিল, হঠাৎ একদিন দুম করে দু’খানা টিকিট পাঠিয়ে দিল।
প্রতাপের বিদেশ ভ্রমণের শখ নেই, এতবড় ভারতবর্ষেরই তো কত জায়গা দেখা হয়নি। কিন্তু মমতার খুব ইচ্ছে প্যারিস-লন্ডন দেখার। আমেরিকার থেকেও ইউরোপ সম্পর্কে তার কৌতূহল বেশি, তার কারণ অ্যামেরিকান বইপত্রের চেয়েও ইওরোপিয়ান সাহিত্য মমতার। অনেক বেশি পড়া। মুন্নির বিয়ে হয়ে গেছে, সুতরাং টিকিট পাবার পরেও না যাবার কোনো যুক্তি দেখাতে পারেননি প্রতাপ।
প্রথমে গেলেন লন্ডনে! অ্যামেরিকায় যাওয়া আসার পথে ঐ টিকিটে দু’বার ইওরোপ থামা যাবে, সেই জন্য ফেরার সময় প্যারিস দেখা ঠিক হয়েছিল। লন্ডনে এয়ারপোর্টে রিসিভ করলো তুতুল আর আলম। সুপ্রীতির মৃত্যুর আগে তুতুল টানা ছ’মাস ছিল কলকাতায়। মায়ের যতখানি সেবা সে করেছে, মানুষের পক্ষে তার চেয়ে বেশি বুঝি সম্ভব নয়। অত রোগযন্ত্রণা সত্ত্বেও শেষের কয়েকটা দিন শান্তি পেয়েছিলেন সুপ্রীতি, মাঝে মাঝে ছোট্ট মেয়ের মতন তুতুলকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতেন।
মায়ের মৃত্যুর পরেও তুতুল লন্ডন ফিরতে চায়নি,কলকাতাতেই থেকে যেতে চেয়েছিল, তখন আবার মমতার শরীর খারাপ ছিল। সেই পুরোনো আলসার। প্রতাপই জোর করে তুতুলকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। তুতুলের স্বামী থাকবে লন্ডনে, আর সে থাকবে কলকাতায়, এ আবার হয় নাকি?
তুতুল আর আলম অবশ্য প্রতিবছরই একবার করে ঢাকা যাবার পথে কলকাতা ঘুরে যায়, দু’চারদিন থাকে। যে-বারে অতীন-শর্মিলারা কলকাতায় এসেছিল, সেবার হঠাৎ কোনো খবর না দিয়েই তুতুলও এসে উপস্থিত। প্রতাপকে সে বলেছিল, মামা আমরা ভাইবোনেরা কতদিন একসঙ্গে থাকিনি! খুব ইচ্ছে হল, তাই চলে এলাম।
নতুন বাড়ি তখনো তৈরি হয়নি, সেলিমপুরের ছোট ফ্ল্যাটটায় সকলকে ধরে না, মুন্নির বিয়ে হয়নি, টুনটুনিকেও দুটি বাচ্চাসমেত ধরে নিয়ে এসেছিল তুতুল, ঐটুকু জায়গার মধ্যে ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা, তবু কী আনন্দ আর হৈ চৈ করেছিল কয়েকদিন সকলে মিলে। সেই সবকিছুর মূলে ছিল তুতুল, সে সবার ফুলদি, সকলের দিকে তার সমান নজর। বাড়ি ভর্তি লোকজন দেখে প্রতাপের এক একবার মনে পড়ে যেত মালখানগরের কথা, এই রকম পারিবারিক জীবনেই তোত তাঁরা অভ্যস্ত ছিলেন। মালখানগরে জায়গা ছিল অনেক, এখানে ওদের সবার শোওয়ার পর্যন্ত জায়গা হয় না, তবু আনন্দ কিছু কম ছিল না।
তুতুল চলে যাবার পরই যেন আবার বদলে গিয়েছিল সবকিছু। টুনটুনির স্বামী পরেশের সঙ্গে সামান্য কথা কাটাকাটি হতে হতে একসময় অতীন তাকে এমন ধমকালো যে দু’দিন পরেই টুনটুনি ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ফিরে গেল ক্ষুগ্নমনে। শর্মিলার কলকাতার জল-হাওয়া সহ্য হচ্ছিল না, জ্বর হতে লাগলো বারবার, সে চলে গেল জামশেদপুরে বাপের বাড়িতে। এখানকার চাকরিতে গণ্ডগোল শুরু হলো অতীনের। তারপর তো এক সময় বাড়ি আবার ফাঁকা।
তুতুলের আন্তরিক ইচ্ছেতে শুধু সেই একবারই একটা পারিবারিক সম্মেলন হয়েছিল বলা যায়।
লন্ডনে এসে প্রতাপ দেখলেন, এখানেও যেন তুতুল একটা মস্তবড় পরিবার নিয়ে থাকে। তুতুল-আলমের কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি এখনো, কিন্তু ওদের কেনসিংটনের বাড়িটা যেন সব সময় একটা হট্টমেলা। কে কখন আসছে-যাচ্ছে তার কোনো ঠিক নেই। প্রত্যেক বেলা অন্তত দশ-বারোজন খায়, তুতুল আর আলম দু’জনেই কাজে বেরিয়ে গেলে বাইরের লোকরাই রান্নাবান্না করে বাংলাদেশের অনেক ছেলেমেয়ে লন্ডনে এসে কোথাও থাকার জায়গা না পেলে তুতুলদের এখানে এসেই ওঠে। প্রতাপ আর মমতা যখন এলেন, তখনও ঐ বাড়িতে আরও পাঁচজন যুবক-যুবতী অতিথি হয়ে ছিল।
লন্ডন শহরে পা দেবার পর থেকে প্রতাপ কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না যে এটা তাঁর প্রাক্তন প্রভুদের দেশ। চাকরির প্রথমদিকে প্রতাপ যখন নদীয়ায় পোস্টিং পেয়েছিলেন, তখন সেখানকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ফ্র্যাঙ্কলিন সাহেব, বাঘের মতন গরগরে মেজাজ, কথায় কথায় সুভাষ বোসকে বলতেন জামান স্পাই আর জওহরলাল নেহরুকে বলতেন, ব্লাবারমাউথ, ওপন এয়ার ব্যারিস্টার। শুধু নিজের ওপরওয়ালার জন্যই নয়, সমস্ত ব্রিটিশ জাতটাকেই প্রতাপ মনে করতেন শত্রুপক্ষ। লন্ডনের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়, কিংবা কোনো দোকানে ঢুকে প্রতাপ যেন সর্বাঙ্গে রোঁয়া ফুলিয়ে থাকতেন, কেউ একটু খারাপ ব্যবহার করলেই যেন তিনি ধমকে উঠবেন। আমরা এখন স্বাধীন জাতি, নিজের টাকায় বেড়াতে এসেছি, তোমাদের দয়ার তোয়াক্কা করি না!
আসলে এসব কথা যে অনেকেই এখন আর মনে রাখেনি, প্রতাপের তা খেয়াল থাকতে না। রাস্তাঘাটের সাধারণ ইংরেজরা একদিন পরে আর তাদের আঙুলে পুরোনো এম্পায়ারের ঘিয়ের গন্ধ শোঁকে না। কালো লোকদের যে তারা অনেকে পছন্দ করে না, সেটাও নিছক বর্ণবিদ্বেষ নয়, প্রতিযোগিতার ভয়।
তুতুল-আলমের বাড়িতে যে অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েরা আসে, তারা যেন ঔপনিবেশিক আমলের কথা জানেই না। তারা ইংরেজদের সমালোচনা করে, গালাগালি দেয়, আবার প্রশংসাও করে, যেন সমান সমান। কেউ কেউ ইংরেজ মেয়ে বন্ধু নিয়ে আসে, সেই সব মেয়েদের তারা মেমসাহেব বলে একটুও বেশি খাতির করে না, অনেক সময় তাদের ওপর হুকুম চালায়, রান্নাঘরে পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশের এই নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের প্রতাপ আগে ভালো করে দেখেননি, তিনি মুগ্ধ হয়ে ওদের কথা শোনেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম-বগুড়া-রাজশাহী থেকে আসা এই সব ছেলেমেয়েদের সুন্দর স্বাস্থ্য, চোখেমুখে কোনো রকম হীনমন্যতার ছাপ নেই, বরং কলকাতার ছেলেমেয়েদের তুলনায় এরা অনেক বেশি প্রাণবন্ত, সব সময় উৎসাহে টগবগ করছে, কোনো আড়ষ্টতা নেই কথাবাতায়। কয়েকজন পড়াশুনোতেও খুব ভালো।
প্রতাপের শুধু একটা ব্যাপারে খটকা লাগতো। এত ভালো ভালো ছেলেমেয়েরা সব দেশের। বাইরে চলে এলে বাংলাদেশটা গড়া হবে কাদের নিয়ে? মুক্তিযুদ্ধে অনেক তরুণ প্রাণ দিয়েছে, অনেক বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে, তার পরেও যদি এই সব শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা দেশ ছেড়ে চলে আসে, তা হলে সেটা সে দেশের বড় দুর্ভাগ্য!
এই প্রসঙ্গটা একবার আলমের কাছে তুলতেই সে দুঃখের হাসি হেসে বলেছিল, মামাবাবু, এর মধ্যে অনেক ঘাপলা আছে। বাংলাদেশ নামে একটা স্বাধীন দেশেরই শুধু জন্ম হয়েছে, কিন্তু সে দেশের মানুষগুলো স্বাধীন হয় নাই! স্বাধীনতার নামে মানুষ যত কিছু আশা করে, তার কিছুই কি আমরা পেয়েছি? সাধে কি আর এই সব ছেলেমেয়েরা দেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়! তবু দেখবেন, ইন্ডিয়ার ছেলেমেয়েদের তুলনায় এই নতুন বাংলাদেশীরা বিদেশে বসেও অনেক বেশি দেশের কথা চিন্তা করে, কষ্ট পায়, দেশের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ এদের অনেক বেশি। ইন্ডিয়ার লোকেরা অনেকটা সিনিক্যাল হয়ে গেছে, তাদের ধারণা, দেশটার আর কিচ্ছু হবে না, ক্রমশ আরও গোল্লায় যাবে, সুতরাং বিদেশে থাকাই ভালো। কিন্তু আমরা এখনো আশাবাদী। আসলে, আমাদের লড়াইটা এখনো থামে নাই!
লন্ডনে সাতটি দিন প্রতাপ-মমতা পরম আনন্দে কাটিয়েছিলেন। ডাক্তার হিসেবে তুতুল আর আলম দু’জনেই যথেষ্ট ব্যস্ত, তবু ওরা পালা করে ছুটি নিয়ে মামা-মামীমাকে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি। ঘুরিয়েছে। মমতার ব্রিটিশ কান্ট্রিসাইড দেখার বাসনা ছিল, তাই দুটো দিন থেকে আসা হলো। ডোভারে আসার সময় তুতুল এত দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে শেষদিন সে হঠাৎ ঠিক করেছিল, প্রতাপ আর মমতাকে সে একেবারে অ্যামেরিকায় অতীনের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে। অতীনরা থাকে নিউ ইয়র্ক শহর থেকে বেশ দূরে, যদি কোনো কারণে তারা ঠিক সময়। এয়ারপোর্টে পৌঁছতে না পারে, তা হলে প্রতাপরা বিপদে পড়বেন। যদিও লন্ডন থেকে দু’বার ফোনে কথা হয়েছে অতীন-শর্মিলার সঙ্গে, সে রকম গণ্ডগোলের কোনো সম্ভাবনাই নেই। তুতুলের কথা শুনে আলম আপত্তি করেনি, সে বলেছিল, যাও না, ঘুরে এসো, কয়েকদিন থেকে এসো ভাইয়ের কাছে। কিন্তু তার দু’দিন বাদেই আলমের নিজের মামা, যিনি অল্প বয়েসে পিতৃহীন আলমকে নিজের সন্তানের মতন মানুষ করেছেন, তিনি লন্ডনে চিকিৎসা করাবার জন্য আসছেন শুনে প্রতাপ-অমমতা দু’জনেই বলেছিলেন, এখন তুই চলে যাবি কী? তা কখনো হয়? তুই আর আলম পরে আসিস অ্যামেরিকায়, আমরা তো থাকছি কিছুদিন।
নিউ ইয়র্কে এয়ারপোর্টে শর্মিলা আসতে পারেনি, কারণ তার ছেলের সবে মাত্র আড়াই মাস বয়েস, অতীন ঠিক দাঁড়িয়েছিল। একটা রাত বাবা-মাকে নিয়ে নিউইয়র্কের একটা হোটেলে কাটিয়ে পরদিন সে গাড়ি চালিয়ে ওদের নিয়ে এলো ট্রয় নামে একটা ছোট শহরে। নিজের ছেলের বাড়িতে পা দেবার সেই প্রথম কয়েকটি মুহূর্তের কথা মমতা অনেকবার অনেকের কাছে গল্প করেছেন। বাড়ির সামনে একটা বাগান, তারপর ঠিক যেন হলুদ রং দিয়ে আঁকা ছবির মতন একটা বাড়ি, পেছনদিকে ঘন জঙ্গল। গাড়ি থেকে নামবার পর দেখলেন, সেই বাড়ির দরজার সামনে আড়াই মাসের ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শর্মিলা। বাচ্চাটা হাত-পা ছুঁড়ে যেন ঠাকুদা-ঠাকুমাকে অভ্যর্থনা করছে। সেদিকে তাকিয়ে মমতার বুকখানা ধক করে উঠেছিল। বাচ্চাটার মুখখানা যেন অবিকল তাঁর বড় ছেলে পিকলুর মতন!
আসলে পিকলু আর বাবলু দু’ভাইয়েরই চেহারায় যথেষ্ট মিল ছিল। বাবলুর ছেলে বাবলুরই মতন হয়েছে। তবু মমতার মনে পড়েছিল পিকলুর কথা, কেন যে এতকাল বাদে হঠাৎ পিকলুর স্মৃতি এমনভাবে ফিরে এলো তা কে জানে! আর কেউ মনে রাখেনি, কিন্তু মমতার মনে তো এখনো পিকলুর সব বয়েসের চেহারাই জ্বলজ্বল করে। তাঁর চোখে জল এসে গিয়েছিল হঠাৎ। পরে মমতার মুখে ঐ কথা শুনে প্রতাপ হেসে বলেছিলেন, তোমরা যে ঐটুকু বাচ্চাকে দেখে কার সঙ্গে মিল না অমিল তা কী করে বোঝো, ভগবান জানেন! আমার। কাছে তো সব বাচ্চাই সমান মনে হয়!
গয়না-গাঁটি আর কিছুই অবশিষ্ট নেই মমতার, শুধু কী করে যেন নিজের মায়ের কাছ থেকে পাওয়া একটা মোহর থেকে গিয়েছিল, সেটা সঙ্গে করে এনেছিলেন। সেই মোহর দিয়ে তিনি নাতির মুখ দেখলেন। তারপর শর্মিলার কোলের দিকে হাত বাড়াতেই ঐ আড়াই মাসের বাচ্চা ঝাঁপিয়ে চলে এসেছিল তাঁর কোলে। তখন তাঁর চোখের জল সামলানো সত্যিই দায়।
তুতুল-আলমের বাড়ির তুলনায় অতীন-শর্মিলাদের বাড়ির অনেক তফাত। লন্ডনের সঙ্গে এই ছোট জায়গাটার তো কোনো তুলনাই চলে না। যদিও এখানকার পরিবেশ ও প্রকৃতি অত্যন্ত সুদৃশ্য ও মনোরম। লন্ডনে ওদের বাড়িতে যেমন সর্বক্ষণ হৈ চৈ লেগে থাকতো, এই বাড়ি আবার সব সময় নিস্তব্ধ, নির্জন। শনিরবিবার ছাড়া কোনো অতিথি আসার সম্ভাবনাই নেই। শর্মিলা আর অতীন দু’জনেই চাকরিতে বেরিয়ে যায় সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে, তার একটু আগেই ওদের মেয়ের স্কুলের বাস আসে। এরপর থেকে সারা সকাল, দুপুর, সন্ধে প্রতাপ আর মমতাকেই একসঙ্গে থাকতে হয় বাড়িতে। কলকাতার সঙ্গে তফাত এই, এখানে আর একটি আড়াই মাসের প্রাণী থাকে। সেই নাতিকে নিয়ে মমতার সময় বেশ ভালোই কাটে। যদিও সেই শিশুর সারাদিন একেবারে ছকে বাঁধা, সে কখন খাবে, কখন ঘুমোবে, কখনো হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠলে কী করতে হবে, তা শর্মিলা প্রায় পাখি পড়াবার মতন মমতাকে বুঝিয়ে দিয়েছে।
প্রতাপের সময় কাটে শুধু টিভি দেখে আর বইপত্র পড়ে। তিনি অবশ্য কোনোদিনই তেমন পড়ুয়া স্বভাবের নন, খবরের কাগজ-টাগজ পড়তে ভালোবাসেন, কিন্তু গল্প-উপন্যাসের দিকে ঝোঁক নেই। তবু অতীনের বেডরুম থেকে একদিন তিনি একটি হাল আমলের মার্কিনী নভেল নিয়ে পড়ার চেষ্টা করলেন। প্রথম আট-দশ পাতা পড়েই তাঁর প্রায় বমি এসে গেল, বইখানা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। এত সব অশ্লীল, কুৎসিত কথা ও শরীরের বর্ণনা এরা এমন অবলীলাক্রমে লেখে? লেখকের নাম জন আপডাইক, পেছনের মলাটে বড় বড় পত্রিকার সমালোচকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার উদ্ধৃতি! গোপন পর্ণোগ্রাফি নয়, এটাই আধুনিক সাহিত্য? বইখানা ছুঁড়ে ফেলে দেবার পরেও প্রতাপ আবার কুড়িয়ে নিয়ে সাবধানে ঠিক জায়গায় রেখে দিয়েছিলেন, যাতে ছেলে এবং ছেলের বউ বুঝতে না পারে তিনি ঐ বই হাতে নিয়েছিলেন!
অতীনরা রবিবার শুধু নিউ ইয়র্ক টাইমস রাখে, অন্যদিন একটি স্থানীয় পত্রিকা। প্রথমবার একশো কুড়ি পৃষ্ঠার নিউ ইয়র্ক টাইমস দেখে প্রতাপ প্রায় হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন। এত বড় খবরের কাগজ! পরে দেখলেন তার অধিকাংশই বিজ্ঞাপনে ভর্তি, খবরগুলি দেখলে মনে হয়, কলকাতার তো কোনো উল্লেখের প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি ভারত নামে যে একটা দেশ আছে পৃথিবীতে, সেটাই বোঝা যায় না! একদিন শুধু হায়দ্রাবাদে একটি ট্রেন দুর্ঘটনায় আড়াইশো। জনের মৃত্যুর সংবাদ ভেতরের একটা পাতায় আবিষ্কার করা গিয়েছিল, সারা ভারতে ঐ একমাত্র উল্লেখযোগ্য খবর। আড়াইশো জন মরেছে, আর সত্তর কোটি মানুষ যে কী করে বেঁচে আছে, সে সম্পর্কে এদের মাথাব্যথা নেই।
স্থানীয় পত্রিকাটি একেবারেই স্থানীয়। কোনো একটি ফার্মে গোরুদের কী একটা অসুখ হয়েছে, সেটাই একদিন প্রথম পাতার হেডলাইন। নীচের দিকে ছোট করে ছাপা হয়েছে মহাশূন্যে এই প্রথম দু’জন নভোচারী কী করে এক রকেট থেকে আর এক রকেটে যাতায়াত করলে তার বিবরণ এটাকেও এরা খবরের কাগজ বলে! তবে, এই স্থানীয় কাগজটিও বত্রিশ পৃষ্ঠা, পাতা জোড়া জোড়া বিজ্ঞাপন, তার মধ্যে আবার কী সব কুপন থাকে, শর্মিলা কেটে কেটে রেখে দেয়। ঐগুলো দেখালে সুপার মার্কেটে কিছু জিনিসপত্র শস্তায় পাওয়া যায়।
টিভি দেখতে দেখতেও প্রতাপ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। চার-পাঁচটা চ্যানেল থাকলেও দুপুরের দিকে একেবারে অসহ্য প্রোগ্রাম দেখায়, রান্না, ব্যায়াম, কিংবা অতি ন্যাকা ন্যাকা সিরিয়াল, তাতে যত থাকে চুমু, ততই কান্নার দৃশ্য। প্রতাপ বরং কমার্শিয়াল বা বিজ্ঞাপনের স্পটগুলো আগ্রহের সঙ্গে দেখেন। তাতে এই প্রবল কনজিউমার সোসাইটির চিত্রটা যেন ঠিক ঠিক ফুটে ওঠে। সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় কতকগুলো জিনিস নিয়ে কী বিরাট কর্মকাণ্ড! কয়েকটা ছেলেমেয়ে নেচে কুঁদে চিউয়িংগামের গুণকীর্তন করে গেল। এখন এরা চিউইংগাম বলে না তো, বলে বাবলগাম। টিভিতে তিরিশ সেকেন্ডে ঐ বিজ্ঞাপনের দাম নাকি পঞ্চাশ-ষাট হাজার ডলার, শর্মিলার কাছে এই কথা শুনে প্রতাপ আঁতকে উঠেছিলেন। পঞ্চাশ-ষাট হাজার ডলার মানে তো বিশাল টাকা! পৃথিবীতে চিউইংগাম কিংবা বাবলগাম না থাকলেই বা কী ক্ষতি হতো! ময়লা ফেলার বড় ঠোঙা, যাকে এরা ট্র্যাস ব্যাগ বলে, তারও ঐ রকম বিজ্ঞাপন লাগে। এইসব বাজে জিনিস কেনানোর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে, আর ঐ সব জিনিস যারা কেনে, তারাও টাকা রোজগারের জন্য সারা সপ্তাহ মুখের রক্ত তুলে খাটছে। মেয়েরা পারফিউম মাখতে ভালোবাসে সেটা বোঝা গেল, কিন্তু তাদের মুখের গন্ধ, বগলের গন্ধ ঢাকার জন্য স্প্রে, হাতে মাখার লোশান, নোখে মাখার রং, চোখের পল্লবে মাখার কালি, এই সবও চাই! এই সব কিছু মাখলে তাদের একটা কিম্ভুতকিমাকার প্রাণী মনে হবে না? বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে যখন, মেয়েরা কেনে নিশ্চয়ই। অতীন আর শর্মিলা দু’জনে দুটো গাড়ি নিয়ে অফিস যায়। দুটো গাড়ি রাখার জন্য ওরা বেশি উপার্জন করতেও বাধ্য। গ্যারাজের দরজা আপনি আপনি খুলে যাবে, তার জন্যও একটা যন্ত্র। হাত দিয়ে দরজাটা খুললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়!
প্রতাপের মনে পড়ে অনেকদিন আগেকার একটা খবর। সোভিয়েত ইউনিয়ানের প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ সেবার এসেছিলেন অ্যামেরিকা সফরে। রুশ-মার্কিন ঠাণ্ডা লড়াই তখন সবে কমতে শুরু করেছে। ক্রুশ্চেভই বোধহয় প্রথম সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পদার্পণ করেছিলেন অ্যামেরিকায়। এ দেশের গমের ক্ষেত, ভুট্টার ক্ষেত দেখে তিনি মুগ্ধ। এত উৎপাদন পৃথিবীর আর কোনো দেশে হয় না। যন্ত্র দিয়ে ফসল কাটা হয়, একজন মাত্র চাষা একরের পর একর জমি চাষ করে, ফসল তোলে। এখানকার অনেক চাষার নিজস্ব প্লেন আছে। এক জায়গায়। ক্রুশ্চেভকে আধুনিকতম যন্ত্রপাতি দেখানো হচ্ছিল। অনেক গুলি দেখলেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তার মধ্যে একটা ছিল লেবুর রস করার যন্ত্র। রান্নাঘরে কাজে লাগে, যখনই দরকার হবে, ঐ যন্ত্র একটা লেবু কেটে রস বার করে দেবে। ক্রুশ্চেভ এক টুকরো লেবু তুলে নিয়ে বলেছিলেন, কিন্তু তোমরা যাই-ই বললো, আমার দু’আঙুলে টিপে আমি ঐ যন্ত্রের চেয়ে আরও ভালোভাবে রস বার করতে পারি!
বিমানবিহারীর বাড়িতে বসে স্টেটসম্যান পত্রিকায় ঐ খবরটা পড়ে প্রতাপ খুব হেসেছিলেন। বিমানবিহারী বলেছিলেন, পশ্চিমী দেশগুলো যাচ্ছে কোথায় বলো তো! এরা কি মানুষের হাতের আঙুলের ব্যবহারও ভুলিয়ে দেবে? সবই যদি যন্ত্রে করে দেয়। তা হলে মানুষ যে ক্রমশ অথর্ব হয়ে যাবে! ওদের বিজ্ঞানীরা এটা চিন্তা করে না? প্রতাপ বলেছিলেন, যারা মেধাবী, খুব বুদ্ধিমান, তারাই বিজ্ঞানী হয়, তাই না? কিন্তু মানুষের সভ্যতা ধ্বংস করার জন্য যে বিজ্ঞানীরা অ্যাটম বোমা বানায়, তাদের কি তুমি বুদ্ধিমান বলতে পারো?
না অতীন আর শর্মিলা ফেরে সন্ধের পর। সারাদিন অফিস করার পর, পনেরোকুড়ি মাইল গাড়ি চালিয়ে এসে ওরা বেশ ক্লান্ত থাকে। এ দেশের অফিসগুলোতে যেমন মাইনে ভালো দেয়, তেমনি খাঁটিয়েও মারে। ফাঁকি মারার উপায় নেই, কারণ প্রত্যেকেরই কাঁধে চাপানো থাকে আলাদা আলাদা দায়িত্ব। অতীনকে তো এক-একদিন বাড়িতে ফিরেও অনেক রাত পর্যন্ত অফিসের কাজই করতে হয়। শর্মিলার কিন্তু আশ্চর্য জীবনীশক্তি, বাড়ি ফিরেই সে কাজে লেগে যায়। বড় মেয়ের পড়াশুনো দেখা, ছেলেকে ঘুম পাড়ানো, তারই মধ্যে রান্নাবান্না, তখন সে মমতাকে কোনো কাজই করতে দেবে না। আর প্রত্যেকদিন সে শ্বশুর-শাশুড়িকে চার-পাঁচ রকম রান্না করে খাওয়াবেই। দুপুরবেলা সে থাকতে পারে না সেজন্য তার আফশোসের শেষ নেই, যদিও সব কিছুই সে গুছিয়ে রেখে যায়।
শর্মিলার মতন মেয়েকে ভালো না লাগার কোনো উপায় নেই। সব সময় তার মুখে একটা সারল্য মাখানো হাসি, অবিরাম সারা বাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছে, সে একটু ভুলোমনা স্বভাবের, এইমাত্র কোনো একটা জিনিস কোথায় রেখেছে তাও ভুলে যায়, এবং নিজের ভুলের কথা সে নিজেই হাসতে হাসতে স্বীকার করে। মমতা তো তাঁর পুত্রবধূর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। প্রতাপ অবশ্য শর্মিলার সঙ্গে ব্যবহারে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেননি, খানিকটা আড়ষ্টতা রয়েই গেছে। একমাত্র ছেলের বউ, তাকে তো নিজের মেয়ের মতনই মনে করা উচিত, প্রতাপ তা বুঝলেও মনটাকে সে রকমভাবে তৈরি করতে পারেননি আজও। প্রথম অতীনের চিঠিতে তার বিয়ের খবর পেয়ে প্রতাপ আর মমতা দু’জনেই তীব্র আঘাত পেয়েছিলেন। তারপর অন্তত তিনমাস তাঁরা দু’জনেই ছেলেকে এক লাইনও চিঠি লিখতে পারেননি, অতীনের পাঁচখানা চিঠির উত্তর দেওয়া হয়নি। প্রতাপের মনে হয়েছিল, তিনি নিজেই যেন তাঁর শ্রেষ্ঠ বন্ধু বিমানবিহারীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। যদিও বিমানবিহারী কিংবা অলি সামান্যতম বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বরং অলি তার অ্যামেরিকার কোন বান্ধবীর কাছ থেকে অতীনের বিয়ের খবর পেয়ে বাড়ি বয়ে এসে মমতার কাছে শর্মিলার খুব সুখ্যাতি করে গিয়েছিল।
মমতা সেসব ভুলে যেতে পেরেছেন, প্রতাপ পারেন না। বিয়ের সাড়ে পাঁচ মাসের মধ্যেই যে সন্তান প্রসব করে, সেই মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেওয়া কি সহজ? শর্মিলাকে চোখে দেখার আগে প্রতাপ এমনও ভেবেছিলেন যে একটা নষ্ট, দুশ্চরিত্র, লোভী স্বভাবের মেয়ে টোপ ফেলে তাঁর ছেলেকে বিয়ের জালে জড়িয়েছে। পশ্চিমী প্রভাবে যে-মেয়ের নৈতিকতা দূষিত হয়ে গেছে, সে হবে মালখানগরের মজুমদার বংশের বউ! সে বিয়েতে বাধা দেবার কোনো উপায় ছিল না বলেই অসহায় ক্রোধে প্রতাপ আরও বেশি জ্বলেছিলেন। শর্মিলাকে দেখার পর অবশ্য প্রতাপের সে ভুল ভেঙে যায়। শর্মিলার নির্মল মুখোনি দেখেই তিনি বুঝেছিলেন, ভুল বা অন্যায় যা কিছু হয়েছে, সেসবের জন্য তাঁর গোঁয়ার ছেলেই দায়ী। শর্মিলাকে যে এক সময় প্রতাপ খুব খারাপ মেয়ে ভেবেছিলেন, শর্মিলা সে কথা না জানলেও তবু সেই জন্যই শর্মিলার সামনে দাঁড়ালে প্রতাপ এখনো লজ্জা বোধ করেন।
প্রথম শনিবারেই এসে পড়েছিল সিদ্ধার্থ সপরিবারে, সঙ্গে আর একটি বন্ধু দম্পতি। ওরা আসার পর বাড়িটা সরগরম হয়ে উঠলো। নিজের ছেলের চেয়েও সিদ্ধার্থের সঙ্গেই প্রতাপের কথাবার্তা হলো অনেক বেশি। অতীনের যত ভাব তার মায়ের সঙ্গে, বাবার কাছে এসে সে। কাজের কথা বলে, গল্প করতে পারে না।
সিদ্ধার্থ এসেই জিজ্ঞেস করেছিল, মেসোমশাই, এ দেশটা কেমন লাগছে, বলুন!
প্রতাপ হেসে বলেছিলেন, বেশ ভালো!
সিদ্ধার্থ সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিল, কী করে বললেন, ভালো? কিছুই তো দেখেননি! এয়ারপোর্ট থেকে এক রাত হোটেলে কাটিয়ে সোজা এখানে চলে এসেছেন। বাড়ির মধ্যে বসে থেকে দেশটটার কী বুঝবেন! অতীনকে বলেছিলুম, নিউ জার্সিতে আমার ওখানে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসতে আপনাদের নিয়ে… জানেন মেসোমশাই, আপনার ছেলে বড় কাজ-পাগল হয়েছে! আমি ওকে কতবার বলেছি, অফিসে বেশি বেশি কাজ দেখালে ওরা আরও নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে! ব্লাড সাকার্স! প্রমোশন, মাইনে বাড়াবার লোভ দেখিয়ে বলবে, সব, রক্ত নিঙড়ে দাও! আমরা ব্রাউন স্কিন বলে আমাদের পিঠ চাপড়ে বলবে, তোমরা খুব কাজের লোক, এসিয়ানস আর ডিলিজেন্ট পীল! তাতেই আমরা গলে যাই! মেসোমশাই, আপনি দেশটা ভালো করে ঘুরে দেখুন, তারপর আপনার মতামত শুনবো, আপনাদের জেনারেশানের মতামতটা জানতে চাই!
প্রতাপ বলেছিলেন, যেটুকু দেখেছি এর মধ্যে, রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বড় পরিষ্কার আর সুন্দর। সব জায়গায় একটা আনন্দ ফুর্তির ভাব আছে!
সিদ্ধার্থ বলেছিল, ওরকম ওপর ওপর দেখলে চলবে না। বড় বড় বাড়ি আর চওড়া চওড়া রাস্তা, ওসব তো আছেই। দোকানগুলো জিনিসপত্রে ঠাসা, বেশিরভাগ ফ্যামিলিতে দুটো গাড়ি, নানা রকম গ্যাজেট, চতুর্দিকে ডলারের ঝনঝন শব্দ, শুধু ভোগ-বিলাসের জিনিসই নয়, আর্ট-কালচারের ব্যাপারেও পৃথিবীতে যা কিছু শ্রেষ্ঠ তা এরা পয়সা দিয়ে কিনে আনতে পারে। তবু, এ সব দিয়েও তো একটা দেশ বা জাতকে ঠিক বোঝা যায় না। আপনি সারা দেশটা ঘুরে দেখুন এই অতীন, মেসোমশাই-মাসিমাদের কবে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছিস? নিউ ইয়র্কটা ভালো করে দ্যাখা, তারপর ওয়াশিংটন ডি সি।
অতীন বলেছিল, সামনের মাসে ছুটি নিচ্ছি, তখন বেরুবো, তোরাও চল না, একসঙ্গে দুটো গাড়ি নিয়ে…
সিদ্ধার্থ বলেছিল, যেতে পারি। মেসোমশাই, আপনি শুধু বড় বড় শহরের বাইরের চাকচিক্য দেখে ভুলবেন না। নিউ ইয়র্কেও আছে হালেম, বাওরি, শিকাগোয় ঘেটো আছে, তারপর যদি মিড ওয়েস্টের গ্রামে যান, দেখবেন কী কনজারভেটিব সব লোকগুলো। সে এক অন্য অ্যামেরিকা।
রাত্তিরবেলা বাগানে বারবিকিউ করা হলো। লোহার উনুনে ঝলসানো হচ্ছে মুগী, গোল হয়ে ঘিরে বসেছে সবাই। আকাশ পরিষ্কার, ঈষৎ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে, মাঝে মাঝে খুব নীচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে প্লেন। একটু দূরে বাচ্চারা কী যেন একটা দুর্বোধ্য গান দু’এক লাইন গাইছে আর হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছে।
সিদ্ধার্থ একটা স্কচের বোতল বার করে বললো, মেসোমশাই, আপনার ছেলে লজ্জায় বলতে পারছে না। আমরা একটু হুইস্কি খাবো, তাতে কি আপনি আপত্তি করবেন? আমাদের খাওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে, এখন আপনারা এসেছেন বলে যদি লুকিয়ে লুকিয়ে বেসমেন্টে গিয়ে খেয়ে আসতে হয়…
প্রতাপ বললেন, না, না। তোমরা খাও, তাতে কী হয়েছে? জানি, এ দেশে থাকলে, মানে অনেক পার্টি-টাটিতে যেতে হয়…
সিদ্ধার্থ বললো, ঠাণ্ডার দেশ তো, একটু-আধটু খেলে ভালোই লাগে। আপনি একটু খাবেন?
প্রতাপ বললেন, না, আমি খাই না। তোমরা খাও! আমার জন্য তোমরা চিন্তা কোরো না।
খেলার ক্যাপটেনের ভঙ্গিতে সিদ্ধার্থ মাথার ওপর দু’হাত তুলে হাততালি দিয়ে সবাইকে ডেকে বললো, এই, শোনো, মেলোমশাই আমাদের ড্রিংক করার পারমিশান দিয়েছেন। সিগারেট টানার জন্যও কারুর আড়ালে যাওয়ার দরকার নেই। আমি তো জানিই, উনি খুব ব্রড মাইন্ডেড!
গেলাসে স্কচ ঢালতে ঢালতেই সিদ্ধার্থ আবার চেঁচিয়ে বললো, এই অতীন, ওয়াইনের বোতলগুলো ডিপ ফ্রিজে রেখে আয়। খাওয়ার সময় লাগবে।
অতীন বললো, আমি দুটো হোয়াইট ওয়াইনের বোতল অলরেডি চিল করতে দিয়েছি।
সিদ্ধার্থ বললো, আমি একটা ক্যালিফোর্নিয়ার রোজে এনেছি, ওটাকেও ঢুকিয়ে দে প্লিজ।
অতীন বললো, মুর্গীর সঙ্গে হোয়াইট ওয়াইনই তো ভালো।
সিদ্ধার্থ বলল, আমার মিষ্টি ওয়াই ভালো লাগে। বিশেষ করে রোজের টেস্টটা… বোতলটাকে ঠাণ্ডা করতে দে, ডিপ ফ্রিজে দিলে একেবারে চিলড় হবে।
অতীন এক ধমক দিয়ে বললো, ঠিক আছে, তোর খেতে ইচ্ছে হয় খাবি। কিন্তু রেড ওয়াইন আবার কেউ চিড় করে খায় নাকি? বাঙালের মতন কথা! রেড ওয়াইন খেতে হয় নর্মাল টেম্পারেচারে, ছিপিটা একটু আগে খুলে রাখলে।
প্রতাপ চোখ বড় বড় করে শুনছেন। মদ বিষয়ে তাঁর ছেলের এত জ্ঞান দেখে তিনি একেবারে চমৎকৃত। মদ খাওয়ারও এত নিয়মকানুন থাকে! এ দেশে থাকতে গেলে বোধহয় এসব শিখতে হয়। যস্মিন দেশে যদাচারঃ! মেয়েরা বীয়ার নিয়েছে। সিদ্ধার্থর এগারো বছরের ছেলেটি বায়না ধরলো, আমি কোক খাবো না, আমাকে রুট বীয়ার দাও! রুট বীয়ার কথাটা প্রতাপের কানে খট করে লাগে, যদিও তিনি জেনেছেন যে ওর মধ্যে অ্যালকোহল থাকে না। তবু বাচ্চা বয়েস থেকেই বীয়ার নামটার দিকে ঝোঁক।
খাদ্য পরিবেশনের সময় খোলা হলো ওয়াইনের বোতলগুলো, অন্যরকম গেলাস এলো। একটা সুন্দর গেলাসে লাল রঙের মদ ঢেলে সিদ্ধার্থ প্রতাপের কাছে এসে বললো, মেসোমশাই, আপনি একটু খেয়ে দেখুন, খারাপ লাগবে না।
প্রতাপ সন্ত্রস্তভাবে বললেন, না, না, আমি খাবো না। আমি কোনোদিন…
সিদ্ধার্থ গেলাসটা প্রতাপের মুখের কাছে এনে বললো, একটু খেয়ে দেখুনই না। এতে কোনো দোষ নেই। ওয়াইন কিন্তু মদ নয়। আমাদের দেশে সব কিছুকেই ওয়াইন বলে। এটা। স্রেফ আঙুরের রস। আপনি তো এমনি আঙুর খান, এটা খেলে প্রায় সেইরকমই… একটু চেখে দেখুন!
প্রতাপ বেশ দৃঢ়ভাবে গেলাসটা সরিয়ে দিয়ে বললেন, না, আমাকে দিও না।
তিনি একটু বিরক্ত হয়েছেন। যে-কোনো ফলকেই ফারমেন্ট করলে অ্যালকোহল তৈরি হয়, তা কি তিনি জানেন না! এরা বিদেশে থাকে বলে মনে করে, দেশের লোক সব বিষয়ে অজ্ঞ! আঙুর আর ওয়াইন এক! পুই শাক, পালং শাকও গাছ, গাঁজাও একটা গাছ থেকে হয়। তাই বলে যে পুঁই পালং খায়, তাকে গাঁজা খেতে হবে?
প্রতাপের কাছে সুবিধে করতে না পেরে সিদ্ধার্থ মমতাকে জোরাজুরি করতে লাগলো। মমতা অনেকবার আর্তভাবে না না বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত গেলাসটা নিলেন। প্রতাপের দিকে আড়চোখে লাজুক লাজুক ভাবে তাকিয়ে চুমুক দিলেন সেই লাল মদে।
সিদ্ধার্থ হাততালি দিয়ে বলে উঠলো, ব্রাভো! মাসিমা অনেক বেশি স্মার্ট!
একসময় মমতার বাপের বাড়িতে কিছুটা ইঙ্গবঙ্গ পরিবেশ ছিল। ছোটবেলায় মমতা একজন মেমসাহেবের কাছে কিছুদিন ইংরিজি শিখেছিলেন। মমতার বাবা বিলিতি মদ্য পান করতেন মাঝে মাঝে, বাড়িতে অতিথি এলে তাঁদেরও খাওয়াতেন। বিয়ের দু’এক বছর পরেও প্রতাপ শ্বশুরবাড়িতে এরকম পাটি দেখেছেন, তখনও অবশ্য ত্রিদিব জোর করেও প্রতাপকে ওসব খাওয়াতে পারেননি। কিন্তু মমতা বোধহয় চেখে দেখেছেন দু’একবার। সে সব অনেককাল আগের কথা, এত বছর এক গরিববাড়ির বউ হয়ে থেকেও মমতা সেসব একেবারে ভোলেননি। প্রতাপ লক্ষ করেছেন, এদেশে এসে মমতা ইংরিজিতে কথাবার্তা বেশ চালিয়ে যেতে পারেন।
সিদ্ধার্থ শুধু জোর করে মমতাকে ওয়াইন খাইয়েও ছাড়লো না, মমতাকে দিয়ে গানও করালো। খাওয়া দাওয়ার পর গান শুরু হয়েছিল, সিদ্ধার্থ ধরে বসলো, প্রত্যেককেই কিছু না কিছু গাইতে হবে, মমতা হাসতে হাসতে প্রবলভাবে মাথা নাড়ছিলেন, তার মধ্যে অতীন বলে দিল, হ্যাঁ, মা গান জানে, আমি ছোটবেলায় শুনেছি! শেষ পর্যন্ত মমতা গাইলেন একখানা অতুলপ্রসাদের গান, অনভ্যাসের জন্য গলা দুএকবার কেঁপে গেলেও এখনো সুর আছে বোঝা যায়। পিকলুর মৃত্যুর পর প্রতাপ আর কোনোদিন মমতাকে গাইতে শোনেননি। প্রতাপকে অবশ্য কেউ গান করার জন্য অনুরোধ জানালো না।
সিদ্ধার্থরা চলে যাবার পর, আবার সোমবার দুপুরে বাড়িটা যেন আরও বেশি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর প্রত্যেকটি দিন একই রকম। প্রতাপের কিছুই করার নেই। একা একা তিনি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বেশিদূর যেতে পারেন না। রাস্তা হারাবার ভয় শুধু নয়, খুব খরচের ব্যাপার। অতীনের বাড়িটা শহর ছাড়িয়ে একটা ফাঁকা জায়গায়, কাছাকাছি মাত্র আর একখানা বাড়ি আছে, এদিকে বাস চলে না, গাড়ি ছাড়া যাতায়াতের কোনো উপায় নেই। ট্যাক্সি মানেই অনেক খরচ। ডলারের মূল্য টাকায় হিসেব করলে পিলে চমকে যায়। প্রতাপের নিজস্ব কিছু ডলার ফুরিয়ে গেলে কি ছেলের কাছে হাত পাততে হবে?
শর্মিলা আর অতীন সময়ই পায় না। শনিবার রবিবার কাছাকাছি কোনো নদী দেখতে যাওয়া। হয় কিংবা বাইরের কোনো হোটেলে খাওয়া, তাও অন্য অতিথি এসে গেলে সেদিন আর বেরুনো হয়ে ওঠে না। মাঝে মাঝে অতীন পরিকল্পনা করে বাবা-মাকে নিয়ে দূরে কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবে, কিন্তু অফিসে এই সময়টাতেই তার এত কাজের চাপ যে কিছুতেই ছুটি দিচ্ছে না।
মমতা বেশ নাতি-নাতনীকে নিয়ে মেতে আছেন। তাঁদের নাতনী অনীতার বয়েস এখন। তেরো, কিন্তু সে একবর্ণ বাংলা জানে না। জীবনে মাত্র একবারই সে কলকাতায় গেছে, তখন বেশ বাংলা কথা শিখে নিয়েছিল, আবার ভুলে গেছে সব। তার বাবা-মাও তার সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলে। অনীতা যখন ছোট ছিল, তখন প্রতাপের সঙ্গে তার বেশ খাতির জমেছিল, দাদুর হাত ধরে সে বালিগঞ্জ লেকে বেড়াতে যেত আর নিজেই অনর্গল কথা বলতো। এখন সে যেন সেই দাদুকে ভুলেই গেছে। ভালো করে কথাই বলতে চায় না। প্রতাপের ইংরিজি শুনে বুঝতেই পারে না, বারবার বলে, পাৰ্ডন মী? পাৰ্ডন মী? এদের উচ্চারণ অন্যরকম, প্রতাপের জিভেই আসে না ঠিক মতন। নাউ-কে বলে ন্যাও, কাউকে বলে খ্যাও। শুধু উচ্চারণ নয়, অনেক কথাও যে আলাদা। সিডিউল-কে যে এরা স্কেজুল বলে ল প্রতাপ জানবেন কী করে? প্রথম প্রথম তিনি বুঝতেই পারতেন না। আদালতে তিনি চিরকাল শুনে এসেছেন, আই বেগ ইয়োর পাৰ্ডন, এরা বলে পাৰ্ডন মী!
মমতার কোনো অসুবিধে হয় না। তাঁর ইংরিজি তো বটেই, তাঁর বাংলা কথাও অনীতা বুঝতে পারে। কিছু একটা উপায়ে ওদের মনের যোগাযোগ ঘটে গেছে, সেটাই আসল। মমতা, অবশ্য খুব সাধ করে তাঁর নাতনীর নাম রেখেছিলেন উজ্জযিনী, চিঠিতে প্রত্যেকবার তিনি সেই নামই লিখতেন, এখানে আসার পর বোঝা গেল, সে নামের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। শর্মিলা বলেছিল, আমার নামটাই এরা উচ্চারণ করতে পারে না, উজ্জয়িনী বলতে তো এদের দাঁত ভেঙে যাবে! সেইজন্যই অনীতা নাম রাখা হয়েছে, মেমসাহেবদেরও নাম হয় অ্যানিটা। প্রতাপ মাঝে মাঝে ভাবেন, অনীতা মানে কী?
কাছাকাছি আর একটিমাত্র বাড়ি, প্রতাপের ঘরের জানলা দিয়ে সেই বাড়ির পেছন দিকের কিছুটা অংশ ও বাগান দেখা যায়। ওদের বাগানটা ভারি সুন্দর, কতরকম গোলাপ যে লাগিয়েছে তার ঠিক নেই। গোলাপের যে এত বিভিন্ন রং হয়, তাও প্রতাপ জানতেন না, তাকিয়ে থাকলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু তাকাবার কি উপায় আছে! জানলার ধারে গেলেই প্রতাপের চোখে পড়ে, ওই বাড়ির পেছনের বারান্দায় ডেক চেয়ারে বসে আছে একটি কিশোরী মেয়ে, তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে একটি যুবক। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, প্রায় সব সময়েই ওদের দেখা যায়। ওরা কি স্কুল কলেজে যায় না? মেয়েটির পায়ে বোধহয় পোলিও, প্রায় অনীতারই সমান বয়েস, ছেলেটিকেও প্রায় কিশোরই বলা চলে। কথা বলতে বলতে ওরা টপ টপ করে চুমু খায়। এদেশে পথে-ঘাটে যুবক-যুবতীদের প্রকাশ্যে চুমু খেতে দেখলেই প্রতাপ চোখ ফিরিয়ে নেন। টিভি-তে প্রতি দু মিনিট অন্তর চুমু, এসব দেখে অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েরা তোত। শিখবেই! একদিন দেখলেন, ছেলেটা ওই মেয়েটার বুকের জামার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। লজ্জায় নয়, রাগে প্রতাপের মুখটা রক্তিম হয়ে গেল!
মমতা একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি জানলার ধারে দাঁড়িয়ে কী দেখছো?
প্রতাপ বলেছিলেন, এসো, দ্যাখো, এদেশের ছেলেমেয়েদের কাণ্ড!
কিশোরী মেয়েটিকে তখন চেয়ার থেকে কোলে তুলে নিয়ে সেই ছেলেটি কাঠের বারান্দায় শুইয়ে ফেলেছে, ফ্রকটা উল্টে দিয়েছে কোমর পর্যন্ত।
মম সঙ্গে সঙ্গে জানলার পর্দা টেনে বলেছিলেন, ছিঃ, তোমার কি ভীমরতি হয়েছে নাকি?
প্রতাপ বলেছিলেন, ওই টুকু বয়েস, কী কাণ্ড বলো তো! ও বাড়িতে কি দেখবার আর কেউ নেই? ছি ছি ছি–
–তুমি ওই পর্দা আর সরিও না।
–এই বয়েস থেকেই এরা শরীরের ব্যাপার শুরু করে, কদিন বাদেই তো সব জানা হয়ে যাবে, সব পুরোনো হয়ে যাবে। তারপর কী নিয়ে বাঁচবে! আমি মরাল কোয়েশ্চেন তুলছি না, কিন্তু এরকম লাগামছাড়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে কি সমাজ গড়া যায়? ওদের বাপ-মা কিছু খেয়াল করবে না, এত ইরেসপনসিবল…
–তুমি কি এদেশটাকে বদলাবার জন্য এখানে এসেছো নাকি? চুপ করো তো। ওদের ব্যাপার ওরা বুঝবে!
–আমাদের অনীতাও ওই বয়েসী, সেও যদি…
–ছি ছি ছি, তোমার মুখে কি কোনো কথাই আটকায় না?
প্রতাপ চুপ করে গেলেও নিজের নাতনী সম্পর্কে তিনি একেবারে সন্দেহমুক্ত হতে পারেন না। অনীতার কাছেও তার ছেলেবন্ধু আসে, সে তখন দরজা বন্ধ করে দেয়। অনীতার কথাবাতার মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ একটা পরিণত মন উঁকি মারে। সে যেন বাচ্চা নয়। দেশে এই বয়েসের মেয়েদের মুখে সেরকম কথা শোনার কথা কল্পনাও করা যায় না।
মাস দেড়েক বাদে এক রাত্রে প্রতাপ হঠাৎ মমতাকে বলেছিলেন, এবার বাড়ি চলো! আর এখানে আমার ভালো লাগছে না!
সে রাতে অতীন আর শর্মিলাকে একটা নেমন্তন্নে যেতে হয়েছিল। এরকম ওদের মাঝে মাঝে যেতেই হয়। একবার এখান থেকে সত্তর মাইল দূরে আর এক বাঙালী পরিবারের নেমন্তন্নে অতীনরা বাবা-মাকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পরই প্রতাপ বুঝেছিলেন, তাঁরা দু’জনে সেখানে বেমানান। আর সবাই যুবক-যুবতী, তারা নিজেদের মতন হাসি-ঠাট্টা করে, গান গায়, নাচে, সেখানে দু’জন অভিভাবকশ্রেণীর মানুষ শুধু অন্যদের অস্বস্তির কারণ ঘটায়। প্রথম প্রথম তারা দু’একটা শুকনো ভদ্রতার কথা বলে, তারপর নিজেদের মধ্যে গল্পে মত্ত হয়। প্রতাপ-মমতাকে খেতে দেওয়া হয়েছিল বাচ্চাদের সঙ্গে, তারপর বিশ্রাম নিতে বলা হয়েছিল একটা ফাঁকা ঘরে। প্রতাপ আরও লক্ষ করেছিলেন, সেই পার্টিতে যে-সব বাঙালীরা এসেছিল, তারা কলকাতার খবর কিংবা দেশের কথা জানার জন্য একটুও আগ্রহী নয়, তারা এখানে নতুন বাড়ি কেনা কিংবা গাড়ি বদলানো কিংবা অফিসের খবর কিংবা নিউ ইয়র্ক স্টেটের নতুন গভর্নর কে হবে, সেইসব নিয়ে আলোচনা করছিল। তাহলে কি আলমের কথাই সত্যি? আলম-তুতুলের বাড়িতে একগাদা অল্পবয়েসী ছেলেমেয়ে থাকলেও কখনো প্রতাপ নিজেকে বাতিলের দলে বলে অনুভব করেননি। ওরা তাঁকেও আলোচনায় জড়াতো, তাঁর সঙ্গে তর্ক করতো।
সেই সন্ধেবেলাতেও অতীন আর শর্মিলা তাদের সঙ্গে পার্টিতে যাবার জন্য বাবা-মাকে অনুরোধ করেছিল। ওদের কোনো বন্ধুর ম্যারেজ অ্যানিভাসারির পার্টি, অতীনের বাবা-মা এখানে আছেন শুনে তাঁদেরও নিয়ে যাবার জন্য বিশেষ করে বলেছে। প্রতাপ ততদিনে বুঝে গিয়েছিলেন যে এগুলো এদেশী ভদ্রতা। বাড়িতে বাবা-মা থাকলে তাঁদেরও নিয়ে যাবার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হবে, বাবা-মায়েরও ভদ্রতা হচ্ছে, খুব ধন্যবাদ জানিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করা। এদেশে ভদ্রতা মানেই অতিশয়োক্তি, বহু অকারণ কথা খরচ। সারাদিনে কতবার থ্যাঙ্ক ইউ বলতে হয়। কতবার বলতে হয় হাউ নাইস, ইজট ইঁট ওয়ান্ডারফুল!
প্রতাপও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অতীন যেন তাতে স্বস্তি পেয়ে বলেছিল, তাহলে আর অনীতারণকে নিয়ে যাবো না। ওরা তোমাদের কাছেই থাকুক!
লিভিংরুমে বসে প্রতাপ টিভি দেখতে লাগলেন অনেক রাত পর্যন্ত। অনীতাও রাত জাগে, সে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকে, তার ঘরেও একটা ছোট টিভি আছে। রণকে ঘুম পাড়িয়ে, অন্যান্য কাজকর্ম সেরে মমতা প্রতাপের পাশে এসে বসতেই প্রতাপ মুখ ঘুরিয়ে গম্ভীর ভাবে বললেন, এবার বাড়ি চলো। আমার এখানে আর ভালো লাগছে না। বাবলুকে বলবো, সামনের সপ্তাহেই আমাদের জন্য প্লেনের সীট বুক করতে!
মমতা আকাশ থেকে পড়ে বললেন, এর মধ্যেই ফিরে যাবো মানে? কেন, তোমার এত তাড়া কিসের? ফিরে গিয়ে কী করবো?
–বললাম যে আমার আর ভালো লাগছে না!
–এখনো তে এদেশটার কিছুই দেখা হয়নি। বাবলুরা সামনের মাসে ছুটি নেবেই বলেছে।
–ওদের কবে সময় হবে, ততদিন আমরা এখানে খাঁচার মধ্যে বন্দী হয়ে থাকবো নাকি!
–কে তোমাকে বন্দী করে রেখেছে? রোজ খানিকটা হেঁটে এলেই পারো। কাছেই কী সুন্দর একটা ফরেস্ট, আপেল ফলে থাকে, কত রকম চেরি হয়েছে দেখলাম, কেউ নেয় না।
–মমো, তুমি আমার কথাটা বুঝতে পারছো না? এখানে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকলে আরও তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যাবো।
–দেশে ফিরে গিয়েই বা তুমি কী কাজ করবে এখন?
–নিজের দেশ, নিজের বাড়ি, সেটাই আমাদের পক্ষে সবচেয়ে ভালো জায়গা। রাস্তাঘাটে পাঁচ জনের সঙ্গে কথা বলাও একটা কাজ। এখানে আমাদের কথা বলারও কোনো অধিকার নেই। পাশের বাড়িতে একটা ছেলে বাঁদরামি করলেও কিছু বলতে পারবো না।
একটু থেমে, মমতার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি হঠাৎ উচ্চারণ করেছিলেন সেই কঠোর কথাটা।
তিনি বললেন, বাবলু আর শর্মিলা এত আগ্রহ করে আমাদের এদেশে নিয়ে এসেছে কেন জানো? বাব-মাকে খাতির করার জন্য নয়। এখন আমি বুঝেছি। ওরা আমাদের এনেছে, ছেলে-মেয়েদের পাহারা দেবার জন্য। কেন, তোমার ছেলের বউ তোমাকে নিজের মুখে বলেনি যে আমরা আসবার আগে রণকে পাহারা দেবার জন্য বেবী সীটার লাগতো! সে জন্য অনেক পয়সা খরচ হতো। এখন সেই পয়সাটা বাঁচাচ্ছে!
মমতাও প্রবল বিতৃষ্ণার সঙ্গে বলেছিলেন, ছিঃ! তোমার মনটা এত ছোট! তুমি এত স্বার্থপর। রণ আর অনী বুঝি শুধু বাবলুর ছেলেমেয়ে? ওরা আমাদের নাতি নাতনী নয়? ওদের সম্পর্কে আমাদের কোনো দায়িত্ব নেই? ভালোবাসা নেই? ওদের কাছে পেয়ে আমি যে কত সুখ পাচ্ছি তা তুমি বোঝো না? শর্মিলা প্রাণ দিয়ে আমাদের যত্ন করে।
কথাটা একবার উচ্চারণ করে ফেলার পর প্রতাপ আর তা ফেরত নেননি। কয়েকদিন ধরে কথাটা মনের মধ্যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাঁর ধারণাটাই আরও দৃঢ় হলো।
রক্তের সম্পর্ক! নিজের ছেলে-মেয়ের সঙ্গেই রক্তের সম্পর্ক টের পাওয়া যায় না এক এক সময়, নাতি-নাতনী সম্পর্কে আর কতটা টান থাকতে পারে? দূরত্বই অনেক সম্পর্ক ঘুচিয়ে দেয়। আবার চার-পাঁচ বছর দেখা না হলে অনীতা আর রণ তাঁদের চিনতেই পারবে না। কাছাকাছি থাকলে, নিজের বাড়িতে কোনো শিশু থাকলে তার ওপর মায়া পড়ে, সে কি শুধু রক্তের সম্পর্কের জন্য?
অতীন আর শর্মিলা বাবা-মাকে দিয়ে শুধু বেবী সিটিং করাবার জন্যই এদেশে নিয়ে আসেনি, তারা এতটা স্বার্থপর নয় নিশ্চয়ই, প্রতাপ তা বোঝেন। কিন্তু প্র্যাকটিক্যালি প্রতাপদের সেই ভূমিকাই তো পালন করতে হচ্ছে! এখানে প্রতাপের নিজস্ব চলাফেরার স্বাধীনতা নেই, পুত্র ও পুত্রবধূর ওপর সব সময় নির্ভরশীল, গাড়ি ছাড়া কোথাও যাওয়া যাবে না। এই অবস্থাটা প্রতাপ কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না।
প্রতাপ জেদ ধরে রইলেন, অতীন-শর্মিলার হাজার পেড়াপীড়িতেও তিনি আর কর্ণপাত করলেন না। এমনকি মমতাকে ওখানে রেখে তিনি একা ফিরে আসতেও রাজি ছিলেন। মমতা অবশ্য তা হতে দেননি, তিনিও ফিরলেন স্বামীর সঙ্গে। কিন্তু সে জন্য তিনি স্বামীকে আজও ক্ষমা করতে পারেননি!
হাজরা পার্কের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে প্রতাপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এখানে তিনি প্রায়। ঘণ্টাখানেক ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। শেষ হয়ে এসেছে বিকেল। বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করছে না, অথচ কোথায় যাবেন?
রাস্তাটা পার হয়ে তিনি হাঁটতে লাগলেন উদ্দেশ্যহীন ভাবে।