সেগুন বাগিচার অতবড় বাড়িটা এক সময় নানা বয়সের মানুষের কণ্ঠস্বরে ঝমঝম করতে, এখন সেখানে কয়েকটি মাত্র প্রাণী থাকে। মঞ্জুর বাবা শামসুল আলম শেষজীবনে একেবারে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। অমন হাসিখুশী মানুষটিকে আর চেনাই যেত না। যে-কোনো ঘরে ঢুকেই তিনি দৌড়ে এক কোণায় গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়তেন, ভাবখানা এই যে পেছন থেকে কোনো শত্র তাঁকে আক্রমণ করতে পারবে না। পা দুটি সামনের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে মাটিতে ঠকতে ঠকতে শঙ্কাতুর মুখে বলতেন, ঐ আসছে, ঐ আসছে!
অথচ তিনি খবরের কাগজ পড়তেন, বই পড়তেন, চেনা মানুষদের চিনতে পারতেন। এককালের নামজাদা উকিল, পড়াশুনো করা মানুষ, সেসবও কিছু ভোলেননি, কিন্তু দশ মিনিটের বেশি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারতেন না। অনেক চিকিৎসা করানো হলো। কিছুদিনের জন্য লন্ডনেও পাঠানো হয়েছিল তাঁকে, কোনো ফল হয়নি। উন্মাদ বলে তাঁকে কিন্তু অবজ্ঞা করার উপায় ছিল না, হঠাৎ হঠাৎ তিনি কোনো গভীর ধরনের সত্য উচ্চারণ করে চমকে দিতেন সকলকে। কলকাতা থেকে ফিরে মঞ্জু যখন প্রথম তার বাবাকে কদমবুসি করতে যায়, তখন শামসুল আলম বসেছিলেন চিলেকোঠায় দেয়ালে ঠেস দিয়ে, লুঙ্গির কষি আলগা হয়ে গেছে, ঠোঁটের কষ দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছে, চক্ষু দুটি ঘোলাটে, বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন আপন মনে, তবু তিনি ঠিক চিনতে পারলেন মঞ্জুকে। মঞ্জুর মুখোনি দু’হাতে ধরে স্নেহশীল পিতার মতন আবেগের সঙ্গে বলেছিলেন, ফিরা আসছোস! আয়, আয়, সোনা মাইয়্যা আমার। সুখু মিঞা কোথায়? ওরে মঞ্জু, তুই পোলার নাম রাখছোস সুখু। কিন্তু তোর কপালে সুখ নাই, তার কপালেও সুখ নাই!
বাড়িসুদ্ধ লোক এরকম অলক্ষুণে কথা শুনে আঁতকে উঠেছিল, কেঁপে উঠেছিল মঞ্জুর বুক।
শেখ মুজিব যেদিন সপরিবারে নিহত হলেন, সেদিন আলম সাহেব এক সাঙ্ঘাতিক ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। বাড়ির অন্য লোকেরা যখন ভয়-বিহ্বল কণ্ঠে নানা রকম আলোচনা করছে, তখন তিনি হঠাৎ বলে উঠেছিলেন, এবার যাবে তাজউদ্দিন। সৈয়দ নজরুল, মনসুর আহমদ, কামরুজ্জামান, এরাও খতম হবে। স্বাধীনতার জন্য যারা লড়াই করেছিল, তারা কেউ থাকবে না।
জেলখানার মধ্যে সত্যি সত্যি সেই নৃশংস ঘটনা ঘটার দু’দিন আগেই শামসুল আলমের লাশ ভোরবেলা ভাসতে থাকে বাড়ি সংলগ্ন পুকুরের পানিতে। সেটা দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা, তা আর জানা যায় নি।
শামসুল আলমের পুত্র কন্যাদের মধ্যে এখনো বেঁচে আছে পাঁচ জন। দুই বিবাহিতা কন্যা আছে চিটাগাং ও রাজশাহীতে। এক পুত্র বিদেশে। বাড়িটির মাঝখানে প্রাচীর তুলে দুটি ভাগ করা হয়েছে। মধ্যম পুত্র মওদুদের স্ত্রী যোবায়দার সঙ্গে তার শাশুড়ির একেবারেই বনিবনা হয়নি, নিত্যদিন ঝগড়াঝাটির বদলে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হওয়াই ভালো। মালিহা বেগম নিজের অংশ পৃথক করে নিয়েছেন, তাঁর অন্য ছেলেমেয়েরা কখনো ঢাকায় এলে সেই অংশেই ওঠে। মঞ্জু রয়েছে তার মায়ের সঙ্গে।
মালিহা বেগমের অংশটিতেও মোট পাঁচখানি শয়নকক্ষ, দুটি বারান্দা, দুটি বাথরুম, দুটি রান্নাঘর, অনেকখানি বড় উঠোন। এদিকে থাকে মাত্র তিনটি রমণী আর পুরুষ বলতে মঞ্জুর ছেলে সুখু, তার বয়েস এখন সদ্য উনিশ। মালিহা বেগম এখনও বেশ শক্ত সমর্থ আছেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে তাঁর হাঁটু দুটো মাঝে মাঝেই প্রতিবাদ করে, তবু তিনি চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। প্রায়ই তিনি সন্ধেবেলা ছাদে উঠে অন্য অংশটির দিকে উৎসুক নয়নে তাকিয়ে থাকেন। যোবায়দা তার ছেলেমেয়েদেরও এইদিকে আসতে দেয় না। মওদুদ মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে না। মালিহা বেগম দুর থেকে তাঁর ছেলে ও নাতি-নাতনীদের এক ঝলক দেখতে পেলেই তৃপ্তি পান। এই তৃপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রুর ঢল নামে।
মঞ্জু এখন বাংলাদেশের নামকরা গায়িকা বিলকিস বানু। কখনো সে দোকানবাজারে গেলে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা তার অটোগ্রাফ চায়। খবরের কাগজে তার ছবি ছাপা হয়, টি ভি-তে প্রায়ই দেখা যায় বলে তার মুখোনি পরিচিত। খুব প্রয়োজন ছাড়া মঞ্জু অবশ্য বাড়ি থেকে কমই বেরোয়।
মনিরাকে সে নিজের কাছে এনে রেখেছে। কোথায় যাবে মেয়েটা, কেউ তো ওর নেই। আগে ও বাড়িতে থাকার সময় মনিরা যখন তখন ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে যেত, তিন চারদিন তার কোনো পাত্তাই পাওয়া যেত না। তার দৃঢ় ধারণা ছিল, সিরাজুলকে সে খুঁজে পাবেই। এরকম একটা দুর্দিনের পর কোনো একজন মানুষকে খুঁজে পেলেও তাকে যে আর নিজের করে পাওয়া যায় না, তা ও কী বুঝবে! অবশ্য সিরাজুল সত্যিই বেঁচে আছে না তার মৃত্যু হয়েছে, সে সম্পর্কে সঠিক করে কেউ কিছু বলতে পারেনি। সেই বিভীষিকার দিনগুলির পাঁচ সাত বছর পরেও মনিরার মতন হাজার হাজার নারী আশা করে বসে ছিল, তাদের প্রিয়জন হয়তো ফিরে আসবে। স্বাধীনতার যুদ্ধে যে কতজন শহিদ হয়েছে আর কতজন নিরুদ্দেশ, আজও তার হিসেব হলো না।
সকাল দশটা, স্বরলিপি দেখে একটা নতুন গান তুলছে মঞ্জু। কামাল তাকে জাপান থেকে একটা অদ্ভুত যন্ত্র এনে দিয়েছে, এই যন্ত্র থেকে হারমোনিয়াম, তানপুরা, এস্রাজ, পিয়ানো, বেহালার সুর বার করা যায়। সেই যন্ত্রটা সম্পর্কে মঞ্জুর মুগ্ধতা এখনো কাটেনি, প্রত্যেকদিন সেটা বাজাতে বসলেই অবাক হয়ে জাপানীদের বুদ্ধির কথা ভাবে।
একটু পরেই টেলিফোন বেজে উঠলো। মঞ্জু শুধু মুখ তুলে তাকালো একবার, গান থামালো না। সে নিজে টেলিফোন ধরে না। ওটা মনিরার কাজ। মনিরা এখন বলতে গেলে তার প্রাইভেট সেক্রেটারি। যদিও টি ভি, সিনেমা, রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ ও পাওনা আদায়ের জন্য মালেক নামে একটি ছেলেকে মাইনে দিয়ে রাখা হয়েছে, সে সব বাইরের কাজ করে। মালেক প্রতিদিন সকালে এসে নিচের ঘরে বসে ঘণ্টাখানেকের জন্য চিঠিপত্র লেখালেখি করে। এই মালেকের সঙ্গে মনিরার প্রায়ই খটাখটি লাগে।
ফোনটা কয়েকবার বাজবার পর মনিরা ছুটে এলো অন্য ঘর থেকে। ফোনটা তুলে হ্যালো বলার পর সে একঝলক তাকালো মঞ্জুর দিকে। অর্থাৎ সে বুঝিয়ে দিল, মঞ্জুর উঠে আসার দরকার নেই। বেশ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সে বললো, বিলকিস বানু এখানে ব্যস্ত আছেন, কী কওয়ার আছে, আমারে বলেন!
ওপাশ থেকে একজন ধমক দিয়ে বললো, এই মনিরা পাকামি করিস না, মঞ্জুরে ডাক!
মনিরা চোখ বড় বড় করে জিভ কেটে ফেললো। এক হাতে ফোনটা চাপা দিয়ে হাসিমুখে বললো, কামাল সাহেব!
বাজনা বন্ধ করে উঠে এলো মঞ্জু। তার মুখে সামান্য বিরক্তির ছায়া ফুটে উঠলেও কামালকে অগ্রাহ্য করবার উপায় নেই।
মঞ্জু রিসিভারটা নিতেই কামাল বললো, গুড মর্নিং বেগম সাহেবা, মেজাজ শরীফ আছে।
মঞ্জু বললো, জী। আজ বিকাল চারটার সময় রেকর্ডিং তো? মনে আছে আমার। কামাল বললো, সেইটা তো ক্যানসেলড়!
মঞ্জু বললো, ক্যানসেলড? আজ রেকর্ডিং হবে না?
কামাল বললো, আজ স্ট্রাইকের দিন না? সবকিছু বন্ধ। কোনো ট্রান্সপোর্ট পাওয়া যাবে না।
–আজ কিসের স্ট্রাইক?
–তুমি সে খবরও রাখো না? কোন জগতে থাকো! আজ সবকটা অপোজিশান পার্টি প্রতিবাদ দিবস পালন করছে, গত শনিবার কুমিল্লায় ছাত্রদের উপর যে ফায়ারিং হলো…আমি মালেককে বলে দিয়েছি আগামীকাল স্টুডিও খালি নাই। রেকর্ডিং হবে পরশু, সে খবর দেয় নাই?
–মালেক আজ আসে নাই। হরতালের জন্যই আসতে পারে নাই।
–তুমি কী করছিলে মঞ্জু? তোমাকে ডিসটার্ব করলাম?
–গান তুলছিলাম।
–একটু শোনাও না! তোমার বাসায় তো কখনো আসতে বলো না, টেলিফোনেই শোনাও, কানের ভিতর দিয়া একেবারে মরমে পশে যাবে।
আর দু’ চারটি কথা বলে মঞ্জু ফোন রেখে দিল। কামাল রঙ্গ-রসিকতার মুডে ছিল, কিন্তু মঞ্জু তাকে প্রশ্রয় দেয়নি।
একথা ঠিক, সিনেমা-গানবাজনার জগতের কোনো মানুষকে মঞ্জু তার বাড়িতে আসতে দেয় না। টি ভি স্টেশনে কিংবা রেকর্ডিং স্টুডিওতে গেলেও সে বিশেষ কথাবার্তা বলে না কারুর সঙ্গে। অহংকারী, বদমেজাজী গায়িকা হিসেবে তার দুনাম আছে, তার কোনো বন্ধু নেই। একমাত্র কামাল ছাড়া আর কেউ তার সঙ্গে হালকা সুরে কথা বলার সাহসই পায় না।
ফোনটা রেখে দেবার পর মঞ্জু অন্যমনস্ক ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। একটা হালকা নীল রঙের টাঙাইল শাড়ী পরেছে সে, তার শরীরে এখনও বয়েসের ছাপ পড়েনি। সারাদিনে সে এত কম খাবার খায় যে মেদ জমার কোনো সম্ভাবনাই নেই। মনিরা জোর করে প্রতিদিন তাকে কিছু খাওয়াবার জন্য হন্যে হয়ে যায়। তবে তার চুলে সামান্য পাক ধরেছে, তাও বোঝা যায় না, মনিরা মেহেদি মেখে দেয়।
মঞ্জু অস্ফুট স্বরে বললো, আজ হরতাল, সুখু কোথায় রে মনিরা!
মনিরা বললো, কী জানি, ঘরেই আছে বোধ হয়। নাস্তা খেয়েছে একটু আগে।
মঞ্জু বললো, দ্যাখ তো, দেখে আয় তো!
সুখু থাকে তিন তলার ঘরে, সেখান থেকে তো কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। অন্যদিন এই সময় তার ঘরে জগঝম্প শব্দ শোনা যায়। খুব জোরে রেকর্ড চালায় সুখু, মাইকেল জ্যাকস, রোলিং স্টোন, পুলিশ এইসব তার পছন্দ। সে বাংলা গান ভালোবাসে না, মায়ের গান নিয়ে কোনোদিন উচ্চবাচ্য করে না। সুখু এক একদিন এমন রেকর্ড বাজায় যে মঞ্জুর গলা সাধার খুব অসুবিধে হয়, তবু ছেলেকে থামতে বলা যাবে না।
মনিরা ডাকবার আগেই ওপর থেকে দুমদুম করে নেমে এলো সুখু। সুন্দর স্বাস্থ্য হয়েছে তার, এর মধ্যেই যথেষ্ট লম্বা, চওড়া কাঁধ। একটা ফেডেড জিনসের ওপর গেঞ্জি পরে আছে, তার গালে নদীর পলিমাটিতে সদ্য গজানো তৃণের মতন দাড়ি।
এ ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে বললো, মা, গিভ মি ফাইভ হান্ড্রেড বাক্স!
মঞ্জু উদ্বেগের সঙ্গে বললো, তুই এখন কোথায় যাস?
সুখু হাত বাড়িয়ে বললো, টাকাটা দাও। ইউনিভার্সিটি যাবো।
মঞ্জু বললো, আজ না স্ট্রাইক? আজ কেন যাবি?
সুখু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, তোমরা এমন অদ্ভুত কথা বলো! স্ট্রাইকের জন্য সবাই বাড়িতে বসে থাকবে নাকি? তা হলে স্ট্রাইক হবে কী করে? মিছিল বেরোবে কাদের নিয়ে?
মঞ্জু এগিয়ে এসে বললো, না, না, তোকে যেতে হবে না, আবার একটা গণ্ডগোল হবে।
এসব অবান্তর কথা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে অস্থির ভাবে সুখু বললো, টাকাটা দাও! আমাকে এগারোটার মধ্যে পৌঁছাতে হবে।
মঞ্জু বললো, সোমবার এক হাজার নিলি, সব খরচ হয়ে গেল এর মধ্যে? আজ বাড়িতে থাক, লক্ষ্মী সোনা…
সুখু সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে বললো, দেবে না? তবে থাক! আমি গ্যালাম!
মঞ্জু বললো, সুখু দাঁড়া, দাঁড়া, টাকা দেবো না বলিনি, আমার একটা কথা শোন–
সুখু আর গ্রাহ্য করলো না, দ্রুত নামতে লাগলো সিঁড়ি দিয়ে। মনিরা ছুটে গিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করলো, সুখু তার দিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ গরম করে বললো, এই, ‘বি না আমারে!
জেদী ছেলে, সে ইদানীং মায়ের কথা শোনে না। সে একবার গোঁ ধরলে আর ফেরানো যায় না তাকে।
অন্য ঘর থেকে মালিহা বেগম এসে শঙ্কিত মুখে জিজ্ঞেস করলেন, আইজ সব গাড়ি ঘোড়া বন্ধ, তার মইধ্যে পোলাড়া বাইরহিয়া গ্যালো? তুই আটকাইতে পারলি না?
মঞ্জু কোনো উত্তর না দিয়ে জানলার ধারে এসে দাঁড়ালো, তার চোখে অশ্রু এসে গেছে। এই বয়েসের ছেলে যদি অবাধ্য হয়ে পড়ে, তাহলে কী করে তার ওপরে জোর খাটানো যায়? খুব খরচের হাত হয়েছে ছেলেটার, যখন তখন টাকা চায়, কিন্তু এত টাকা কি ওর হাতে দেওয়া। ভাল? না দিলে আরও অভিমান করে।
গ্যারাজ থেকে মোটর বাইকটা বার করে স্টার্ট দিয়েছে সুখু। তার ওপর বসেই বলশালী শব্দ তুলে তীব্র গতিতে বেরিয়ে গেল, যেন এক তেজী ঘোড়সওয়ার।
মা এসে দাঁড়ালেন মঞ্জুর পাশে। দু’জনেরই মনের মধ্যে একই কথা, কিন্তু তার ভাষা নেই।
মাঝে মাঝেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বোমা ফাটে, গোলাগুলি চলে। পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ হয়, আবার ছাত্রদের বিভিন্ন দলের মধ্যেও লড়াই লাগে। জামাতে ইসলামী দল আবার শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, তাদের ছাত্র সংগঠন বেশ জোরালো। ছাত্র লিগের সঙ্গে তাদের প্রায়ই সংঘর্ষ হয়। সেই একাত্তর সালের আগেরই মতন, দিনের শেষে ঘরের ছেলেরা ঠিকঠাক ঘরে না। ফেরা পর্যন্ত দারুণ দুশ্চিন্তা থেকেই যায়। হায় আল্লা, এই দুশ্চিন্তার কি নিষ্কৃতি নেই?
সুখু মাঝে মাঝে রাত্তিরেও বাড়িতে ফেরে না। বলে তো যে বন্ধুদের কাছে থাকে। কী করে বন্ধুদের সঙ্গে রাত জেগে? বোমা বানায় নাকি? মনিরা বলেছিল, একদিন সে সুখুর ঘরে ছোট একটা বন্দুক দেখেছিল। সুখু অবশ্য তা প্রবলভাবে অস্বীকার করেছে। মনিরাকে সে দারুণ বকুনি দিয়েছিল মিথ্যে কথা বলার জন্য। কিন্তু মঞ্জুর মন থেকে সন্দেহ যায় নি। মনিরা অকারণে এমন মিথ্যে কথা বলবে কেন? খবরের কাগজেও তো লেখে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হাতেও মাঝে মাঝে বন্দুক-রিভলবার দেখা যায়, তাই নিয়ে তারা পুলিশের মুখোমুখি রুখে দাঁড়ায়। ছাত্ররা যে বোমা ছোঁড়ে, এত বোমা তারা পায় কোথা থেকে?
এই ছেলেই মঞ্জুর জীবনের একমাত্র অবলম্বন, কিন্তু ছেলে এখন মায়ের জন্য সময় দিতে পারে না। মায়ের কাছে এসে দু’দণ্ড বসে না, মা কোথায় গান গাইতে যাচ্ছে কিংবা মায়ের নতুন কী গানের রেকর্ড বেরুলো, সে সম্পর্কে ছেলের কোনো আগ্রহ নেই। মায়ের সঙ্গে যেন শুধু টাকা পয়সার সম্পর্ক।
মঞ্জুর ব্যক্তিগত খরচ প্রায় কিছুই নেই। সাজপোশাকের বাহুল্য নেই, তার মতন আর কোনো নামকরা গায়িকা এমন সাধারণ সাজে মঞ্চে ওঠে না। মঞ্জুর উপার্জন যথেষ্ট ভালো, ফিলমের প্লেব্যাক সিংগার হিসেবে সে এখন এক নম্বর। জনপ্রিয় গায়িকা সেলিমার সবকটি গান তাকেই গাইতে হয়। কামাল হোসেনের হিট ছবিগুলিতে সেলিমা আর বিলকিস বানুর যুগলবন্দী থাকবেই।
মঞ্জুর এই সব উপার্জনই তো তার ছেলের জন্য। সেই সব পাবে। কিন্তু এত কম বয়েসে তার হাতে বেশি টাকা দেওয়া কি যুক্তিসঙ্গত?
কলকাতা থেকে পলাশ ভাদুড়ী মাঝে মাঝে ঢাকায় আসে গানের অনুষ্ঠান করতে। পলাশ আজও বিয়ে করেনি। কিন্তু মঞ্জু তাঁকেও বিশেষ প্রশ্রয় দেয় না, বাড়িতে আসতে বলে না। জীবন সম্পর্কে সে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। কলকাতায় অনেকগুলি গানের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েও প্রত্যাখ্যান করেছে সে।
দূরে কোথাও পর পর দুটো বোমার বিকট শব্দ হলো।
জানলার ধারে দাঁড়ানো তিনটি রমণী বিবর্ণ মুখে তাকালো পরস্পরের দিকে। তারা অসহায়। স্নেহের বন্ধনে আটকাতে না পারলে একটি উনিশ বছরের স্বাস্থ্যবান যুবককে আটকাবার আর কোনো উপায় নেই।
সারা দুপুর বিকেল ধরেই এরকম শব্দ শোনা যেতে লাগলো, আজ আবার বোধ হয় বড় রকমের একটা হাঙ্গামা লেগেছে। শহরের কোথায় কী ঘটছে, তা ওরা ঘরে বসে জানবে কী করে? বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই এখন বেশি রকম গোলমাল হয়। পুলিশ মিলিটারি পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢুকতে সাহস পায় না।
মঞ্জু একটা ট্রানজিস্টার রেডিও নিয়ে খবর শোনবার চেষ্টা করলো। ঠিক একাত্তর সালের আগের মতনই চলছে, সত্যি কথা বলে না রেডিওতে। খবরে শোনালো যে ছাত্রদের ডাকা হরতাল ব্যর্থ হয়েছে, যানবাহন সব ঠিকঠাক চলছে। ঢাকা শহর শান্তিপূর্ণ। অথচ ওরা পথে একটাও গাড়ি দেখেনি সারাদিন, দূরের বোমা বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দ বুঝি শান্তির জয়ধ্বনি!
রেডিও থেকে আরও ঘোষণা করলো, রাত ন’টা থেকে কারফিউ! এটাও শান্তির চিহ্ন!
মনিরার মনে পড়ছে, একাত্তর সালের আগে সে ঠিক এই রকম উদ্বেগ নিয়ে বসে থাকতো সিরাজুলের জন্য। শেষের দিকে তো সিরাজুল সর্বক্ষণের জন্যই মেতে উঠেছিল। কিন্তু বাড়িতে ফিরতে না পারলেও সিরাজুল কোনোক্রমে একটা খবর পাঠাতো মনিরাকে। সুখু কি একটা খবরও দিতে পারে না? ফোন করতে পারে না? একবার সে স্নেহের বন্ধন ছিঁড়েছে, মায়ের দুঃখ আর বোঝে না সে! বরং মায়ের ওপর সব সময় যেন তার একটা রাগ রাগ ভাব।
মনিরা অনেক চেষ্টা করেও মঞ্জুকে কিছুই খাওয়াতে পারলো না আজ। রাত ন’টা বেজে যাবার পর সে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে।
একবার মনিরা জিজ্ঞেস করলো, সাহেবরে একটা ফোন করবেন?
মঞ্জু কোনো উত্তর দিল না।
মনিরা আবার জিজ্ঞেস করলো, আমি তাইলে কামাল সাহেবেরে ফোন করি?
মঞ্জু এবারও উত্তর দিল না বটে, তবু মনিরা ফোনটা তুললো। সুখুর বাবাকে নিজে থেকে ফোন করার সাহস তার নেই, কিন্তু কামাল হোসেনের কাছে সে খবর নিতে পারে।
ভাগ্যবানের বউ মরে। এই প্রবাদটি কামাল হোসেনের জীবনে সার্থক হয়েছে। আগে হামিদার ভয়ে সে অন্য মেয়েদের সঙ্গে ভালো করে কথাই বলতে পারতো না। সামান্য অসুখে, ভুল চিকিৎসায় হামিদার মৃত্যু হয়েছে। পেনিসিলিন তার সহ্য হয় কিনা তা পরীক্ষা না করেই এক ডাক্তার তাকে ইঞ্জেকশান ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে অপঘাত। ইতিমধ্যে সেলিমার সঙ্গে তার স্বামীর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তারপর সেলিমার সঙ্গে জুটি বাঁধতেই কামালের উন্নতি হতে লাগলো তরতর করে। রাজনীতির সঙ্গে কামালের সমস্ত সম্পর্ক ঘুচে গেছে, আগের আমলের বন্ধুদের সঙ্গেও বিশেষ সম্পর্ক নেই। এখন সে ফর্মুলা ফিলম বানায় আর বছরে একবার দুবার সস্ত্রীক বিশ্বভ্রমণ করে আসে।
কেউ কেউ একবার ছদ্মবেশ ধরলে আর তা খুলতে পারে না। মুখোসটাই আসল মুখ হয়ে। যায়।
মনিরা যখন ফোন করলো, তখন কামালের নিউ এস্কাটনের বাড়িতে বিশাল পার্টি চলছে। সব সময়েই একশ্রেণীর মানুষ থাকে, যাদের জন্য স্ট্রাইক, কারফিউ এসব কোনো বাধাই নয়। বাজার থেকে কখন নুন উধাও হয়ে যায়, চালের দাম কত বাড়লো সেসব খবর জানার দরকার নেই তাদের। যতই সরকারি ভাবে নিষিদ্ধ হোক, স্কচ হুইস্কি তারা সব সময়েই পেয়ে যায়।
এর মধ্যেই কামালের পেটে তিন চার পেগ পড়েছে, সে জমিয়ে তিন চারজনের সঙ্গে গল্প করছিল, এর মধ্যে এসে তাকে টেলিফোন ধরতে হলো। সবাই জোরে জোরে কথা বলছে, প্রথম তিন চারবার সে নামটাই বুঝতে পারলো না। কে? কোথা থেকে? কী চাই? করতে করতে সে মনিরাকে চিনতে পেরে বিরক্তির সঙ্গে বললো, কী হইছে কী? কী চাস তুই?
এই সব পার্টিতে মঞ্জুকে দাওয়াত দিলে কখনো সে আসে না। এরকম সময়ে মঞ্জু কখনো টেলিফোন করে না। মনিরার ব্যাকুল স্বর শুনে প্রথমে কামাল ভাবলো ম বুঝি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তা হলেই মুশকিল! নতুন ছবি শুরু হতে যাচ্ছে, আগে গান রেকর্ডিং না হলে নায়িকার লিপ মেলে না।
মঞ্জুর ছেলে বাড়ি ফেরেনি শুনে কামাল ভুরু কোঁচকালো। আজ বেশ বড় রকমের একটা গণ্ডগোল হয়েছে, সে শুনেছে। দু তিনটি ছাত্র মারা গেছে। এরকম তো প্রায়ই হয়, নতুন কথা কী! পড়াশুনো তো সব গোল্লায় গেছে, ছাত্ররা এইসব নিয়েই মেতে আছে। আরে বাবা, দু চারটে বোমা ছুঁড়ে আর বাস পুড়িয়ে কি আর মিলিটারি রেজিমকে হঠানো যায়?
তবে, এইসব হাঙ্গামায় মফস্বলের ছেলেরাই মরে। শহরের ছেলেরা তুখোড় হয়, তারা পুলিশের রাইফেলের সামনে বুক পেতে দেয় না, তারা গ্রামের ছেলেগুলোকে সামনে এগিয়ে দেয়। এই যে মাঝে মাঝেই দুটো-চারটে ছাত্র প্রাণ দিচ্ছে, কই, চেনাশুনো কোনো বাড়ির ছেলে তো তাদের মধ্যে নেই। মঞ্জুর ছেলেই বা মরতে যাবে কেন?
সে মনিরাকে বোঝালো যে কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া এখন তো খোঁজখবর করার কোনো উপায় নেই। সুখু মিঞার ভালো নাম কী যেন? নজরুল ইসলাম, না, ঐ নামে কোনো ছাত্রের কোনো বিপদ হয়নি, পুলিশের একজন বড় কতা এখানেই রয়েছেন, তিনি বললেন। চিন্তার কিছু নেই। সুখু মিঞা ঠিক ফিরে আসবে।
ফোন রাখার আগে কামাল কৌতুক করে বললো, এই মনিরা তোর মালকানীরে বল এবার। একটা শাদী করতে! বাড়িতে একটা জবরদস্ত পুরুষ মানুষ না থাকলে কী চলে! তুই নিজেও তো আর করলি না, পাত্তর দেখুম নাকি?
সারা রাত প্রায় বিনিদ্র ভাবেই কাটলো। এক একবার একটা গাড়ির শব্দ হতেই মনিরা আর মঞ্জু জানলার ধারে ছুটে যায়। সেগুলো পুলিশের গাড়ি। এর আগে কারফিউয়ের মধ্যেই সুখু দু একবার বাড়ি ফিরেছে। অনেক ছাত্রই কারফিউ মানে না।
সকাল ন’টার মধ্যেও সুখু ফিরে এলো না দেখে মঞ্জুর মনে হলো, কাল সে টাকা দিতে চায়নি বলেই তার ছেলে রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে। ইত্তেফাক পত্রিকায় ছাত্র-পুলিশ মারামারির বিস্তৃত বিবরণ ও ছবি বেরিয়েছে, সুখুর নাম কোথাও নেই।
একটা বিমর্ষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মঞ্জু বললো, মনিরা, তুই একবার ধানমণ্ডির বাসায় যা! খবর দিয়া আয়।
মনিরা মুখ কুঁচকে বললো, মালেক আসুক। মালেকই তো খবর দিতে পারে। মঞ্জু বললো, মালেক গ্যালে হবে না, তুই যা! আগে দ্যাখ, রিকশা চলে কিনা!
গতকালের কোনো চিহ্ন আজকের রাস্তায় নেই। দোকানপাট সব খোলা, এর মধ্যেই সাইকেল রিকশায় পথ একেবারে ছয়লাপ হয়ে গেছে, লোকেরা অফিস-কাঁচারির দিকে দৌড়োচ্ছে। মাঝে মাঝে আন্দোলন হয়, পুলিশ-মিলিটারি গুলি চালায়, কিছু মানুষ মরে, অন্যদের তা গা সহা হয়ে গেছে। পাকিস্তানী আমলে যেমন চলতো, বাংলাদেশী আমলেও তার খুব একটা হেরফের হয়নি।
একটা রিকশা নিয়ে মনিরা এলো ধানমণ্ডির বাড়িতে। তার মুখখানা ব্যাজার হয়ে আছে, শুধু সুখুর জন্য দুশ্চিন্তাতেই নয়, এ বাড়িতে আসতে তার একেবারেই ইচ্ছে করে না।
এতগুলি বছরে এই বাড়িতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগের তুলনায় বাড়িটা অনেকখানি বেড়েছে, দুদিকে নতুন কনস্ট্রাকশান হয়েছে, তার অনেকখানিই আলতাফের দখলে। হোটেলওয়ালা হোসেন সাহেব বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর চুটিয়ে ব্যবসা করতে গিয়েও পারেন। নি, অকস্মাৎ হার্ট অ্যাটাকে তাঁকে দুনিয়ার মায়া কাটাতে হয়। তাঁর ছেলে ও জামাইরা সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে আলতাফকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে এবং অমন চালু ব্যবসাটিকেও লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে একেবারে আলতাফের এখন নিজস্ব কারবার। এ বাড়িতেই সে গারমেন্ট ফ্যাকটরি বসিয়েছে, বিদেশ থেকে সুতো আসে, ডিজাইন আসে, এ দেশের শস্তা মজুরিতে জামা-প্যান্ট সেলাই হয়, সেগুলো আবার বিদেশের বাজারে চলে যায়। তা ছাড়া সে মানুষও চালান দেয়। তেলের টাকায় ধনী আরব দেশগুলিতে শ্রমিক-মজুরের খুব চাহিদা। যে দেশে সবাই প্রায় বড়লোক, সে সব দেশে রাস্তা ঝাঁট দেওয়া, বাথরুম সাফ করার লোক পাওয়া যাবে কী করে, গরিব দেশ থেকেই সেইসব কাজের লোক আমদানি করতে হবে।
বাড়ির পুরোনো অংশটায় থাকে বাবুল চৌধুরী।
সদর দরজা খোলা, ভেতরে এসে মনিরা সিঁড়িটার মুখে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। সে একদিন গ্রাম থেকে সিরাজুলের সঙ্গে এসে ঐ পাশের ঘরখানায় উঠেছিল। কতরকম আবর্জনায় ভরা ছিল ঘর, সব কিছু পরিষ্কার করে সে সাজিয়েছিল নিজের সংসার। ঐদিকে ছিল রান্নাঘর। সব ভেঙে গেছে, ঘরখানা আবার গুদাম হয়েছে। ঠিক এইখানে তার চুলের মুঠি ধরে টেনেছিল খান সেনারা, আর ঐ সিঁড়ির মাঝখানে বাবুল চৌধুরী গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
মনিরা পরে শুনেছে যে কে খোঁজার জন্যই বাবুল চৌধুরী গিয়েছিলেন একেবারে বাঘের মুখে, খান সেনাদের ডেরায়; তাকে না পেয়ে উনি নিজের হাতে কত পাকিস্তানী সৈন্য মেরেছেন। সে একটা সামান্য মেয়ে, তার জীবনের কীই বা দাম আছে, তার জন্য অতবড় একটা বিদ্বান মানুষ লড়াই করতে নেমেছিলেন!
সেই বাবুল চৌধুরী এখন মনিরার সঙ্গে ভাল করে কথাই বলতে চায় না। দেখলে বিরক্ত হয়। মানুষের জীবন এমন অদ্ভুত কেন?
সেফু নামের সেই মেয়েটি এখনো এ বাড়িতে কাজ করে। বাবুল চৌধুরী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একটি অল্প বয়েসী অনাথ ছেলেকে কুড়িয়ে এনেছিল, কয়েক বছর পর তার সঙ্গেই সেফুর বিয়ে দেওয়া হয়েছে, ওরা দু’জনে ছাদের ঘরে থাকে।
সেফুর সঙ্গেই মনিরার প্রথম দেখা হলো। আগে ছিল নেংটি ইঁদুরের মতন চেহারা, এখন দিব্যি মোটাসোটা হয়েছে সেফু। তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ মনিরার চোখে জল এসে গেল। এই বাড়িতে কেটেছে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দুটি বছর। কিসের জন্য প্রাণ দিল সিরাজুল? তার বদলে কী পাওয়া গেল?
দোতলায় উঠতেই লায়লা জিজ্ঞেস করলো, সেফু, কে আসছে রে?
মনিরা কাঁচুমাচু মুখে বললো, ভাবী আমি মনিরা।
এক সময় যেটা ছিল মঞ্জুর শয়নকক্ষ, সেখান থেকে বেরিয়ে এলো লায়লা। বেশ দীর্ঘকায়া তরুণী, গায়ের রং একেবারে যেন দুধে-আলতায় মেশানো, তবু মুখখানা খানিকটা রুক্ষ ধরনের।
মনিরার চোখে অশ্রুর ঝালর, সে ঐ দরজার সামনে লায়লার বদলে যেন মঞ্জুকেই দেখছে। সেই তার আগেকার মঞ্জু ভাবী, সরল উচ্ছল, সুন্দর। এইটাই তো মঞ্জু ভাবীর নিজস্ব জায়গা।
যুদ্ধ থেকে সাংঘাতিক আহত হয়ে ফিরেছিল বাবুল, আবার তাকে ভর্তি হতে হয়েছিল নার্সিং হোমে। মঞ্জু-হেনা-মামুনরা কলকাতা থেকে ফিরেছিল দশ দিন পর। মামুন আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে তাঁর চিকিৎসার জন্য ফিরতে দেরি হলো, মঞ্জু এসেই ছুটেছিল নার্সিং হোমে। কেন তাদের ফিরতে দেরি হলো, সে কারণটা আর বলা হয়নি ভাল করে, বাবুলও মন দিয়ে শুনতে চায়নি, তার তীব্র অভিমান হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না।
কলকাতায় বা ভারতে যারা আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের সম্পর্কে বাবুলের মনোভাব ভাল ছিল না। বাবুলের মতে তারা সুবিধাবাদী। বড় বড় নেতারাও ভারতে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে আরাম উপভোগ করেছে, মুক্তি যোদ্ধাদের তুলনায় কী আত্মত্যাগ করেছেন তাঁরা? স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে দু একটা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাহায্য নিতে হয় ঠিকই। কিন্তু বড় বড় নেতাদের কি মাঝে মাঝে রণপ্রাঙ্গণে এসে সাধারণ সৈনিকদের পাশে দাঁড়ানো উচিত ছিল না? বাংলাদেশ বাহিনীর সেনাপতি কর্নেল ওসমানী চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিনগুলিতেও কোনো একটা ফৌজের সঙ্গে পাকিস্তানী ব্যহ ভেদ করতে পারলেন না। আত্মসমর্পণের সময়েও তিনি কলকাতায় বসে রইলেন? নিজের প্রাণের মূল্যটাই তাঁর কাছে বেশি!
মঞ্জু কলকাতার প্রবাস কাহিনী শুরু করলেই বাবুল অন্যমনস্ক হয়ে যেত কিংবা কাজের ছুতোয় উঠে পড়তো। কলকাতার গল্প সম্পর্কে তার কোনো আগ্রহ নেই। ছেলেমানুষী স্বভাবে মঞ্জুও কলকাতায় তাদের দিনগুলির কথা যতটা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বললে, ততটা উৎসাহ সে দেখায়নি এই সুদীর্ঘ ন’ মাস ধরে বাবুলদের যে কী নিদারুণ অবস্থা গেছে তা শোনার জন্য।
শরীরে দুটি বুলেটের ক্ষত সারতে বাবুলের সময় লেগেছিল প্রায় তিন মাস। সেই সময়টায় সে খুব খিটখিটে আর বদমেজাজী হয়েছিল, পুরোপুরি সুস্থ হবার পরেও তার স্বভাবটা বদলালো না। শারীরিক কষ্টের জন্য তার মানসিক কষ্ট হচ্ছিল বেশি। স্বাধীনতা এলো বটে, কিন্তু দেশটা চলেছে কোন্ দিকে? শেখ মুজিব ফিরে এলেন, একচ্ছত্র ক্ষমতা পেলেন তিনি সরকার পরিচালনার, কিন্তু নতুন রাষ্ট্রটির কোনো শক্ত বেদীমূল প্রতিষ্ঠিত হলো না।
কিছু লোক স্বাধীনতার নামে শহরে লাফালাফি করছে, অন্যদিকে গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। মুনাফাবাজ ও কালোবাজারিরা নুন, তেল, চালের মতন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে ফাটকা খেলছে, ব্যাঙ্ক লুঠের টাকায় একশ্রেণীর লোক রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, বিদেশ থেকে সাহায্য হিসেবে যেসব খাদ্য, কম্বল ওষুধ আসছে, তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে একদল ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, সেসব চোরাচালান হয়ে যাচ্ছে ভারতে।
শেখ মুজিব এসব কঠোর হস্তে দমন করার বদলে উদার ভাবে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন। সবাইকে। তিনি নিজের জীবন ফিরে পেয়েছেন এবং সত্যিই স্বাধীনতা এসেছে, এতে তিনি এমনই অভিভূত যে এখন আর তিনি কোনো কটু কথা বলতে চান না। যারা তাঁর পার্টির প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছে এই দুর্দিনে তাদের শাস্তি দেবার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না, যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, যারা নরহত্যার রক্তে হাত রাঙিয়েছিল তাদেরও তিনি ক্ষমা করে যেতে লাগলেন। তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, চাটুকারদের মধ্যে অনেকে এই সুযোগে লাগাম ছাড়া হয়ে গেল।
সুস্থ হয়ে ওঠার পর বাবুল আবার ফিরে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনায়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সে কোনো কৃতিত্ব নিতে চায়নি। যখন অনেককে বীর উত্তম, বীর প্রতীক, বীর শ্রেষ্ঠ, বীর বিক্রম–এইসব সম্মানজনক খেতাব দেওয়া হতে লাগলো, তখন বাবুল চৌধুরীর নামও কে যেন প্রস্তাব করেছিল শেখ মুজিবের কাছে। অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কেউই তার মতন এমন অস্ত্র নিয়ে পুরোপুরি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, কিন্তু বাবুল আগেই চিঠি লিখে সেই খেতাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে। কেউ ঐ প্রসঙ্গ তুললেই সে হেসে বলতো, আরে না, না, ওসব গুজব! লোকে গল্প বানাতে ভালোবাসে। আমি ফ্রিডম ফাইটারদের ক্যাম্পে রান্নাবান্না করে দিতাম, কোনদিন এল এম জি হাতে নিয়েই দেখিনি!
বাহাত্তর সালে মাসের পর মাস বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জের অত্যাচার কাহিনী ছাপা হতো, যা আগে কিছুই জানা যায়নি। যারা পাক বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, বাঙালী হয়েও যারা বহু বাঙালীকে হত্যা করেছে, তাদের পরিচয়ও প্রকাশিত হয়ে পড়ছিল। বাবুল সংবাদপত্রের সেইসব অংশ কেটে কেটে রাখতে, মঞ্জুকে সে বলতো দ্যাখো, প্রথম তিন মাস আমিও তো মুক্তিযুদ্ধ সাপোর্ট করি নাই, আমার মনে হতো, এসব আওয়ামী লিগের স্বেচ্ছাচারিতা, এমনভাবে পাকিস্তান ভাঙা যুক্তিসঙ্গত না। আমাকে অনেকে কোলাবরেটার বলতো, কিন্তু আমি শান্তিবাহিনীতে যোগ দিই নাই, মানুষ মারা সাপোর্ট করি নাই, প্রথম যেদিন নিজের চক্ষে দ্যাখলাম ব্রুট ফোর্স কোনো যুক্তির ধার ধারে না, সেইদিনই ঠিক করেছিলাম, যে-কোনো উপায়ে এদের রেজিস্ট করতেই হবে! যে-কোনো থিয়োরির চেয়ে মানুষের জীবন বেশি মূল্যবান। আমার চোখের সামনে যদি কেউ কোনো নিরীহ মানুষের বাড়িতে আগুন লাগায়, তা হলে সেই আগুন নিবানো আর যে ঐ আগুন লাগিয়েছে তাকে শাস্তি দেওয়াই আমার প্রধান কর্তব্য। ক্লাস স্ট্রাগল কবে হবে, তখন এই সব সমস্যা মিটে যাবে। তার জন্য বসে থাকা যায় না। সেটা কাপুরুষতা। সেই জন্যই আমি যুদ্ধে গেছি। কিন্তু যারা নয় মাস ধরে অত্যাচার করেছে, খুন আর লুটপাটে অংশ নিয়েছে, রাও ফরমান আলীর হাতে বুদ্ধিজীবীদের খতম করার তালিকা তুলে দিয়েছে, তাদের কোনো শাস্তি হবে না? তারা নিশ্চিন্তে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে? শেখ মুজিব তা হলে দেশ চালাবেন কী করে? ঐ সব পাষণ্ডগুলাই আবার সব ক্ষমতা দখল করে বসবে।
একদিন বাবুল মঞ্জুকে রান্নাঘর থেকে ডেকে এনে জানলার ধারে দাঁড় করিয়ে বলেছিল, মঞ্জু, ঐ লোকটাকে দ্যাখো, দ্যাখো। ঐ যে লুঙ্গি আর সিল্কের কুর্ত পরে হেঁটে আসছে। ঐ লোকটা লাইব্রেরি সায়েন্সের একজন অধ্যাপক। আর ঐ দ্যাখো, মনিরা ওর পাশ দিয়ে হেঁটে আসছে। এটা একটা অদ্ভুত দৃশ্য।
মঞ্জু সেই দৃশ্যটার তাৎপর্য বুঝতে পারেনি। সাধারণ একটা সকাল। পথ দিয়ে অনেক মানুষ আসছে, যাচ্ছে। তার মধ্যে সিল্কের কুতা পরে হাঁটছে একজন, মনিরা বাজার করে ফিরছে বিপরীত দিক দিয়ে, কেউ কারুকে চেনে বলে মনে হয় না। এর মধ্যে অস্বাভাবিক কী আছে?
মঞ্জুর বিস্মিত দৃষ্টি দেখে বাবুল উত্তেজিতভাবে বলেছিল, মনিরাকে অন্তত পাঁচজন খান সেনা অত্যাচার করেছে। দুইবার প্রেগনেন্সির পর মিসক্যারেজ হয়েছে, মাথাটাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তবু যে বেঁচে আছে, আবার প্রায় নমল হয়েছে, সেটা শুধু ওর ভাইটালিটির জোরে। আর ঐ মানুষটা…
মঞ্জু ভয় পেয়ে বলেছিল, ঐ মানুষটাও কি মনিরাকে…
বাবলু উত্তর দিয়েছিল, না, ঐ মানুষটা বোধ হয় মনিরাকে চেনে না। কিন্তু ঐ হারামজাদা গত বৎসর ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির সামনে দাঁড়ায়ে কী বলেছিল জানো? ও চ্যাঁচায়ে। বলেছিল, পাকিস্তানী আর্মির লোকেরা বাঙালী মেয়েদের রেপ করতাছে, একথা কে কইলো? সব মিথ্যা প্রচার! যদি দুই-দশটা মেয়েরে ভাগ করে থাকে, তাতে কোনো পাপ নাই! ইসলাম রক্ষার জন্য ওরা জেহাদে নেমেছে, এখন এমন একটু-আধটু তো হবেই। এইসব ভোগ ‘মুতা’ বিবাহ বলে ধরে নিতে হবে। সেদিন এই কথা শুনে আমি ঐ লোকটাকে মারতে গেছিলাম, অন্যরা আমাকে ধরে আটকালো। এখন, এই স্বাধীন বাংলাদেশেও ঐ লোক বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াবে! মঞ্জু, আমার ইচ্ছা হচ্ছে, এখনই ওকে গিয়ে খুন করি।
মঞ্জু তার স্বামীর হাত চেপে ধরে ব্যাকুলভাবে বলেছিল, না, না, তুমি ঐ সব কথা আর মনে। স্থান দিও না। খুন-জখমের কি শেষ নাই? হায় আল্লা…
সেইসব দিনগুলিতে বাবুল মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। সব সময় গুম হয়ে থাকতো। দেশের অবস্থা যে দিন দিন খারাপ দিকে যাচ্ছে, এ দায়িত্বও যেন তার। বন্ধু বান্ধবদের থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। যারা চাকরি করতো, তারা অনেকেই ব্যবসা শুরু করে সহজে টাকা বানাবার নেশায় মেতে উঠেছিল। মাঝে মাঝে বাবুল এমন বিলাপ করতো যে ভয় হতো, যে-কোনো মুহূর্তে সে হয়তো তার মস্তিষ্কের ভারসাম্য হারাবে। মঞ্জু প্রাণপণে সেবা করতো। তার স্বামীকে। এক এক সময় বাবুল সংযত হতো তার সন্তান সুখুকে কোলে নিয়ে। সুখুর নরম রেশমের মতন চুলে হাত বুলাতে বুলোতে সে বলতো, তুই যখন বড় হবি, তখন এই দেশ, এই পৃথিবীটারে কেমন দেখবি রে?
কলকাতা থেকে ফেরার সাত মাস পরে মঞ্জু আবার গর্ভবতী হয়েছিল, তারপরেই এলো বিপর্যয়। বাবুল এই ঘটনাটা কিছুতেই সহজভাবে নিতে পারলো না। মঞ্জুর গর্ভে এসেছে তার নিজের সন্তান, তবু বাবুল ঝোঁকের মাথায় উচ্চারণ করে ফেললো একটা কঠিন খারাপ কথা। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, মনিরাকে ধর্ষণ করেছিল পাঁচজন খান সেনা। তুমিও ধর্ষিতা না কি? এতদিন বলা নাই তো! তোমারে কে ধর্ষণ করলো, তোমার মামুনমামা?
মামুন তখন কামারুজ্জামানের অনুরোধে রিলিফ ডিপার্টমেন্টের ভার নিয়েছেন। দুর্নীতি সামলাতে সামলাতে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছেন। বাবুল কোনোদিনই মামুনকে পছন্দ করতে পারেনি, রিলিফের নানা কেলেংকারির সমস্ত দায়িত্বই মামুনের ওপর চাপিয়ে সে তখন মামুনকে রীতিমতন ঘৃণা করতে শুরু করেছিল, সেই ঘৃণা থেকেই সে এমন কথা বললো?
একবার বলে ফেলেও সে কথাটা ফেরত নিল না। আরও দু তিনবার সে বলতে লাগলো। যে মঞ্জুকে নিয়ে ফুর্তি করার জন্যই তো মামুন তাকে নিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন। কলকাতা-ফেরত অনেক লোকই বলেছে যে মামুন মঞ্জুকে নিয়ে থাকতেন এক ঘরে। হোসেন সাহেব নিজের চোখে দেখে এসেছে।
স্বামীর প্রতি যতই ভক্তি থাক, এই ধরনের কথা শুনে মঞ্জু গভীর বিতৃষ্ণার সঙ্গে বাবুলের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ছিঃ! তুমি এত ছোট!
তারপর চললো জেদাজেদির পালা। মঞ্জু একবস্ত্রে ধানমণ্ডির বাড়ি ছেড়ে চলে গেল তার মায়ের কাছে। অবাঞ্ছিত বলেই হয়তো তার গর্ভের সন্তানটি পৃথিবীর আলোহাওয়ায় নিশ্বাস ফেললো না। তবু বাবুল আর ফিরিয়ে নিতে চাইলো না মঞ্জুকে। কাজীর অফিস থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিস এলো। বিনা প্রতিবাদে সেই বিচ্ছেদ মেনে নিল মঞ্জু। অবিলম্বে, ঝোঁকের মাথায় বাবুল বিয়ে করলো তার এক ছাত্রী লায়লাকে।
বাবুলের মা বাবা কেউ তখন নেই। আলতাফের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো না, বাবুল তার বড় ভাইটিকে অশ্রদ্ধা করে। একমাত্র জাহানারা ইমামের বাড়িতেই সে মাঝে মাঝে যেত, সেই পুত্র শোকাতুরা রমণীর কাছে গিয়ে সে চুপ করে বসে থাকতো। জাহানারা ইমামও মঞ্জুর পক্ষ নিয়ে বাবুলকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বাবুল যেন তখন সত্যিই উন্মত্ত। সে কারুর কথা শোনেনি।
মনিরাও সেই সময় এই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল মঞ্জুর সঙ্গে। বাবুল চৌধুরীর সঙ্গে ছিল তার কৃতজ্ঞতার সম্পর্ক, কিন্তু সে ভালোবাসতো মঞ্জুকে। কৃতজ্ঞতার চেয়ে ভালোবাসার জোর অনেক বেশি। মামুন সাহেবের মতন এক বৃদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে মঞ্জুর নামে ঐ অপবাদ সে একেবারে সহ্য করতে পারেনি। পুরুষ মানুষগুলো কী, কিছুই বোঝে না? সাত মাস স্বামী সহবাসের পর যে গর্ভ লক্ষণ, তার জন্য হুট করে কি পরপুরুষের নামে দোষ দেওয়া যায়? কোনো স্ত্রীলোক যদি সত্যিই সেরকম কিছু চায়, তা হলে তার জন্য তাকে কলকাতা কিংবা বিলেত-অ্যামেরিকা যেতে হবে কেন?
বাবুল আবার বিবাহ করেছে, আর মঞ্জু এতগুলি বছরের মধ্যে আর কোনো পুরুষের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা করেনি। এটাই যেন তার প্রতিশোধ, মনিরা মঞ্জুর চরিত্রের এই দৃঢ়তাটাকেই শ্রদ্ধা করে। সে-ও আর কোনো পুরুষ মানুষের সান্নিধ্য চায় না। কোনো পুরুষের কাছাকাছি এলেই তার শরীর সিটিয়ে যায়।
বিশেষ কাজে মনিরাকে এ পর্যন্ত মোট তিনবার ধানমণ্ডির এই বাড়িতে আসতে হয়েছে। কোনোবারই লায়লাকে এড়িয়ে সে বাবুলের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি।
লায়লা তার চুলে একটা চিরুনি চালাতে চালাতে বললো, কেমন আছোস রে মনিরা? ঐ বাসার খবর সবর সব ভালো? কবে যেন তোর ভাবীর গান শোনলাম টি ভি-তে, ভালোই গান। করছেন। তবে আধুনিকের থিকা নজরুলগীতিই বেশি ভালো।
মনিরা জিজ্ঞেস করলো, সাহেব আছেন নি?
লায়লা বললো, হ, আছেন তো, দ্যাখ গিয়া, বই মুখে নিয়া বইস্যা আছে। কোনো খবর। আছে নাকি?
মনিরা বললো, জী, সাহেবরে একটা খবর দিতে আসছি।
লায়লা উদাসীন গলায় বললো, আমারে বুঝি বলা যায় না। সাহেব একা থাকতে ভালোবাসে। তুই হুট কইরা ঘরে ঢোকলে সাহেব পরে আমারে খুব বকবে।
মনিরা জানে যে লায়লা এরকম আলগা আলগা কথা বললেও তার কৌতূহল খুব বেশি। মনিরার মতন দূতীর মুখে সাধারণ কিছু শুনলেও সে মানতে চাইবে না। সে অনেক কিছু। জানতে চাইবে।
মনিরা বললো, সুখু মিঞা কাল রাইতে বাড়ি ফেরে নাই। তার মায়ের কষ্ট চোখে দেখোন যায় না। সাহেব যদি ছেলেটার একটু খবর ন্যান!
লায়লা বললো, সুখু? সে কবে যেন আসছিল এখানে? এই সেফু, সে গতকালই আসে নাই?
সেফু বললো, না, চাইর-পাঁচদিন আগে।
লায়লা বললো, সে তো কেবল আসে আর টাকা চায়। বাপের কাছে শুধু হাত পাততেই আসে। কী শিক্ষাই তারে দিতেছে তার মায়। ছেলে একেবারে গোল্লায় গেছে। সাহেবের শরীর। ভালো না, এখন বিরক্ত করিস না। আমি পরে কইয়া দিমু অ্যানে।
মনিরা বললো, কাইল ইনভারচিটিতে খুনাখুনী হইছে, তাইর মধ্যেই সুখু গেছিল।
হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো বাবুল চৌধুরী। অনেক শীর্ণ হয়ে গেছে তার চেহারা, চোখ দুটি কোটরে ঢাকা। মাথার চুলে সাদা ছোপ লেগেছে। লুঙ্গির ওপর গেঞ্জি পরা, কাঁধে তোয়ালে, এক হাতে বই। বাথরুমেও সে বই নিয়ে যায়।
মনিরার দিকে একবার তাকিয়েই সে মুখ ফিরিয়ে নিল। যেন সে তাকে চিনতেই পারেনি। স্ত্রীলোকদের কথাবার্তায় তার কোনো আগ্রহ নেই। সে গম্ভীরভাবে বললো, এই সেফু, গোছলখানায় গরম পানি দিছোস?
লায়লা তাড়াতাড়ি মনিরাকে সরিয়ে নেবার জন্য বললো, আয়, তুই এদিকে আয়, চা খাবি?
মনিরা তবু চেঁচিয়ে বললো, সাহেব, সুখু কাল রাতে বাসায় ফেরে নাই! দুপুরে ইনভারচিটি গেছিলো…
বাবুল থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী?
মনিরার কাছে সংক্ষেপে বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে বদলে গেল তার মুখের বর্ণ। ভোয়ালে আর বই সে ছুঁড়ে ফেলে দিল। অত্যন্ত দ্রুত পোশাক বদলে নিয়ে, লায়লাকে কিছুই না বলে সে ছুটে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
Well Done!