নিউ জার্সি টার্ন পাইকের কাছে গাড়ি থামতে সিদ্ধার্থ একটা সিগারেট ধরিয়ে বললো, ভদ্রলোকের আসল নাম অভয়চরণ দে। কলকাতায় হ্যারিসন রোডে, মানে এখন যেটা মহাত্মা গান্ধী রোড, সেখানে থাকতেন। ওর বাবার ছিল কাপড়ের ব্যবসা। পুরোনো কলকাতার সুবৰ্ণবণিক, বুঝলি। বাড়ির সবাই বৈষ্ণব। ভদ্রলোক পড়াশুনা করেছেন স্কটিশচার্চ কলেজে। ওঁর এক ইয়ার ওপরে পড়তেন সুভাষ বোস, মানে নেতাজী সুভাষ বোস।
অতীন বললো, ওরে বাবা, তা হলে তো অনেক বয়েস। তুই এতসব জানলি কী করে?
সিদ্ধার্থ গাড়িতে আবার স্টার্ট দিয়ে বললো, আমার সঙ্গে একবার ওর দেখা হয়েছিল। আউট অফ কিউরিয়সিটি গিয়েছিলাম আমি। তারপর শোন, ফ্যানটাস্টিক গল্প। ঐ অভয়চরণ ফোর্থ ইয়ারে উঠে পড়া ছেড়ে দিলেন, ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েও বোধ হয় ডিগ্রি নেননি, বা এই রকম একটা কিছু। তখন ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা স্বদেশী হাওয়া ছিল তো! তাঁর বাবা তাঁকে একটা স্বদেশী কম্পানিতে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিলেন, ইন ফ্যাকট একজন বাঙালীর ওষুধ কম্পানি। সেই কম্পানির কাজে তাঁকে মাঝে মাঝে এলাহাবাদ, লক্ষী, ঝাঁসী এই সব জায়গায় যেতে হতো। এর মধ্যে তিনি বিয়ে করলেন, ছেলেপুলে হলো, রীতিমতন সংসারী মানুষ, আর পাঁচজন বাঙালী মধ্যবিত্ত যেমন হয়। চাকরিতে বেশ উন্নতি করেছিলেন, নিজস্ব ব্যবসাও ছিল, কলকাতা আর এলাহাবাদে উনি নিজের দোকানও করেছিলেন। তবে মাথায় একটু ধর্মের পোকা ছিল। বোষ্টম বাড়ির ছেলে তো, মাছ-মাংস খেতেন না, চাও খেতেন না, ঝোঁক ছিল। পুজো-আচ্চার দিকে, সে রকম তো অনেকেরই থাকে। যৌবনে উনি একবার এক বন্ধুর পাল্লায়। পড়ে গৌড়ীয় মঠের এক সাধুর সঙ্গে দেখা করতে যান। গৌড়ীয় মঠ কোথায় জানিস।
অতীন ভুরু কুঁচকে বললো, আমরা আবার মঠ-মন্দিরের খোঁজ রেখেছি কবে? তোকে এত ফেনিয়ে বলতে হবে না। কাট ইট শর্ট।
সিদ্ধার্থ বললো, ব্যাকগ্রাউণ্ডটা একটু বলে নিচ্ছি। এটা কিন্তু একটা বিরাট ফেনোমেনান, আমাদের জানা দরকার। এ যুগে এরকম রিয়েল লাইফ অ্যাডভেঞ্চার স্টোরি কল্পনাওকরা যায় না। আমি তোকে এর রিলিজিয়াস অ্যাঙ্গেলটা দেখতে বলছি না, অন্য দিকটা ভেবে দেখিস। ঐ গৌড়ীয় মঠের সাধু অভয়চরণকে বলেছিলেন, তোমরা শিক্ষিত যুবকেরা সারা পৃথিবী জুড়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী প্রচার করছে না কেন? এটা একটা উদ্ভট প্রস্তাব। সেই নাইন্টিন টুয়েন্টিজের কথা, দেশ পরাধীন, সেখানকার ছেলেরা সারা পৃথিবীতে চৈতন্যের বাণী শোনাতে যাবে? কে শুনবে? তা ছাড়া অভয়চরণ সংসারী মানুষ, ধর্মপ্রচারের দায়িত্ব তাঁর নয়। তবে, ঐ গৌড়ীর মঠের গুরুর কথাবার্তা তাকে বেশ ইমপ্রেস করেছিল। মাঝে মাঝে কলকাতায় এলে তিনি ঐ গুরুর সঙ্গে দেখা করতেন। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অভয়চরণের ধর্মের দিকে ঝোঁক বাড়তে লাগলো, বাড়িতে পাঁচজনকে ডেকে ধর্মের কথা আলোচনা করতেন। যেমন কিছু কিছু ব্যবসায়ীদেরও অবসর সময়ে ধর্মবাতিক থাকে, সেরকম বলতে পারিস। ওঁর স্ত্রী বা পরিবারের লোকজন এসব পছন্দ করতেন না। অভয়চরণ চা খান না, ওঁর স্ত্রীর চা খুব প্রিয়। বৃদ্ধ বয়েসে, অভয়চরণ যখন সংসার ছাড়বেন ঠিক করলেন, তখন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের কারণটা বেশ মজার। উনি স্ত্রীকে আলটিমেটাম দিলেন, চা এবং স্বামী, এই দুটোর মধ্যে তোমাকে একটা বেছে নিতে হবে। ওঁর স্ত্রী হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন, তা হলে তো স্বামীকেই ছাড়তে
অতীন বললো, ধ্যাৎ! এই জন্য কেউ বউকে ছাড়ে নাকি? শুধু চা খাওয়ার জন্য যদি কেউ বউয়ের ওপর রাগ করে, তা হলে তো বুঝতে হবে, সে একটা হামবাগ!
সিদ্ধার্থ হেসে বললো, শুধু ঐ জন্যই বউকে ছাড়েননি নিশ্চয়ই। আসলে পারিবারিক জীবনটাই তাঁর ভালো লাগছিল না। গৌড়ীর মঠের সেই সাধু, নামটা ভুলে গেছি, মৃত্যুর আগে অভয়চরণকে বলে গিয়েছিলেন, যারা বাংলা আর হিন্দী জানে না, তাদের মধ্যে চৈতন্যদেবের আদর্শ প্রচার করার জন্য সংসার ছেড়ে অভয়চরণ সেই কাজে লেগে গেলেন। কলকাতা থেকে চলে এলেন দিল্লি, বিনা পয়সার কোনো গেস্ট হাউসে জায়গা পেলেন কোনো রকমে, সেখানে শুধু নিজের চেষ্টায় ব্যাক টু গড় হেড’ নামে একটা কাগজ বার করতে লাগলেন ইংরিজিতে। তিনি একলাই তার লেখক, সম্পাদক, প্রুফ রিডার আর সেলসম্যান। কোনো চায়ের দোকানের সামনে রাস্তায় বসে বিক্রি করতেন সেই পত্রিকা, মানে লোককে ধরে ধরে গছাবার চেষ্টা আর কি। ভদ্রলোকের বয়েস তখন ছাপ্পান্ন-সাতান্ন!
অতীন বললো, এই রকম ক্ষ্যাপাটে ধরনের লোক কিছু থাকে।
সিদ্ধার্থ বললো, বেশ কিছু থাকে। তারা এক সময় হারিয়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্য এই বুড়ো লোকটির জেদ। বাড়ি থেকে তো পয়সা কড়ি কিছু নেন না, খাওয়ার ঠিক নেই, শীতের জামা কাপড় নেই, তবু চালিয়ে যেতে লাগলেন এই পত্রিকা। সেই সঙ্গে ভগবদগীতার অনুবাদ ও টীকা রচনা করতে লাগলেন ইংরিজিতে, সেগুলোও ছাপাবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
–ইংরিজি ভালো জানতেন?
–পুরোনো আমলের বি-এ পাশ লোকেরা ইংরিজি মোটামুটি জানতো। বোম্বাস্টিক ধরনের ইংরিজি। ঐ সব ছাপাবার জন্য তিনি চিঠি লিখে বিভিন্ন লোকের কাছে সাহায্য চাইতেন। চিঠি। লিখতে পারতেন প্রচুর, অনেকের সঙ্গে সরাসরি দেখাও করতেন। সাধাসিধে ধরনের মানুষ, নিজের কোনো স্বার্থবুদ্ধি নেই, এই সব দেখে কিছু কিছু লোক সাহায্য করতো। তা ছাড়া ধর্মের ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা মাঝে মাঝে টাকা দিয়ে গিলটি-ফ্রি হতে চায়।
–অ্যাই কী করছিস, রাইট টার্ন নিতে হবে না এখানে?
–এর পরেরটা। টানেল দিয়ে যাবো। টাইম স্কোয়ারের কাছে আমাকে একটু থামতে হবে, বুঝলি। ভয় নেই, তোকে ঠিক সময় এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেবো। তুই আবার কবে চায়না যাচ্ছিস?
–এই তো ক্যানাডা থেকে ফিরেই। থার্ড উইকে।
–এবার কলকাতা ঘুরে আসবি নাকি?
–কী করে কলকাতায় যাবো? কম্পানির কাজে মাত্র পাঁচ দিন থাকবো সাংহাইতে। টিকিট দেবে ভায়া টোকিয়ো। ওদিক থেকে ইণ্ডিয়া যাওয়ার স্কোপ কোথায়? এখন ছুটিও পাওয়া যাবে না।
–আমার চায়নাটা যাওয়া হয়নি। অফিস থেকে আমাকে একবার হংকং পাঠাবে শুনছি। দেখি যদি তোর ট্রিপটার সঙ্গে ট্যাগ করতে পারি, তা হলে আমিও ওখান থেকে একবার ঘুরে আসবো। তুই তো আগে দু’ বার চায়না গেছিস, অতীন, ওদেশের গ্রাম-ট্রাম কিছু ঘুরে দেখেছিস?
–একগাদা কাজ নিয়ে যাই, নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকে না। চাইনীজরা কাজের ব্যাপারে বড় খুঁতখুঁতে, যে-কোনো ডিসিশান নেবার আগে অন্তত তিনবার ঝালিয়ে নেবে। শোন সিদ্ধার্থ, রণের একটু জ্বর চলছে দু’ দিন ধরে, আমি কয়েকদিন থাকবো না, তুই একটু খবর নিস। জানিস তো শর্মিলা কী রকম ঘাবড়ে যায়।
–নীপা বলেছে শর্মিলার কাছে গিয়ে এই উইক এণ্ড স্পেণ্ড করে আসবে। আমাদের ছোটবেলায় এরকম কত জ্বর হতো, মাবাবারা মাথাই ঘামাতো না। ও বয়! দ্যাখ, সামনে। বিরাট জ্যাম।
–কেন টানেল নিতে গেলি! বিকেলের দিকটায় প্রত্যেকদিন টানেলের মুখে জ্যাম হচ্ছে।
সিদ্ধার্থ রেডিওটা চালিয়ে ট্রাফিক-সংবাদ শোনার চেষ্টা করলো। সেরকম কোনো ঘোষণা নেই, তাহলে অবস্থা বিশেষ ভয়াবহ নয়। নীচের লেভেলের রাস্তায় গাড়িগুলো বাম্পার টু বাম্পার ঠেকে থাকলেও এক একবার একটু একটু নড়াচড়া করছে।
পেছন দিকে হেলান দিয়ে সিদ্ধার্থ বললো, বাকি গল্পটা শুনবি?
অতীন বললো, সেই বুড়ো লোকটি অ্যামেরিকাতে এলো কী করে?
সিদ্ধার্থ বললো, স্রেফ ইচ্ছা শক্তিতে। এ ছাড়া কোনো ব্যাখ্যা নেই। চায়ের দোকানের সামনে যিনি নিজের পত্রিকা ফিরি করতেন, সেই ব্যক্তিটি প্রায় পনেরো বছর ধরে লোকের কাছে চেয়ে-চিন্তে পত্রিকা ও গীতার অনুবাদ খণ্ডে খণ্ডে ছাপিয়ে চালিয়ে যাবার পর একদিন ভাবলেন, এই সব তিনি পশ্চিমী মানুষের মধ্যে প্রচার করতে যাবেন। টাকা পয়সা কিছু নেই, কী করে যাবেন তার ঠিক নেই, তবু ঠিক করলেন যাবেন। এক সময় ব্যবসা-ট্যবসা করেছেন তো। সেইজন্য তিনি কাজের ব্যাপারে খুব মেথডিক্যাল। পাসপোর্ট, পি ফর্ম, যাওয়া-আসার ভাড়া, এসবের চেয়েও বেশি ইম্পর্ট্যান্ট ভিসার ব্যবস্থা করা। উনি মাঝে মাঝে বৃন্দাবনে গিয়ে থাকতেন, সেখানে আগরওয়াল বলে একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় ছিল। সেই আগরওয়ালের ছেলের নাম গোপাল, সে ইঞ্জিনিয়ার, থাকে পেনসিলভানিয়াতে। এই আগরওয়ালকে ধরে তার ছেলের কাছ থেকে আনালেন একটা স্পনসরশীপ। তাতে ভিসার সমস্যা গেল। পাসপোর্টও পাওয়া গেল। এবার টিকিট। তিনি চলে এলেন বোম্বাইতে, দেখা করলেন শ্রীমতী সুমতি মোরারজির সঙ্গে। এই মহিলাটি কে জানিস?
অতীন বললো, শিপিং টাইকুন না?
–দ্যাটস রাইট। সিন্ধিয়া স্টিমশীপ লাইনের একজন মালিক। এই মহিলা অভয় দে-কে গীতার অনুবাদ ছাপবার জন্য একবার কিছু টাকা দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর প্রস্তাব শুনে তো একেবারে হাঁ। ধুতি আর ফতুয়া পরা প্রায় সত্তর বছরের এক বৃদ্ধ একা একা অ্যামেরিকায় ধর্ম প্রচার করতে যেতে চায়। কে এর কথা শুনবে, কে একে পাত্তা দেবে? এই বৃদ্ধ বয়েসে ঐ ঠাণ্ডার দেশে গিয়ে বেঘোরে মরবে নাকি? কিন্তু উনি নাছোড়বান্দা। উনি যাবেনই। শেষ পর্যন্ত শ্ৰীমতী মোরারজি ওঁদের লাইনের একটা জাহাজে অভয়চরণের জন্য একটা সীট করে দিলেন। একটা সুটকেস, একটা ছাতা আর কিছু চিড়ে-মুড়ি নিয়ে উনি উঠলেন জাহাজে। ওঁর ধারণা ছিল, আমেরিকায় গরু-শুয়োর ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না।
–আমেরিকায় যতদিন থাকবেন, ততদিনের খাবার সঙ্গে এনেছিলেন?
–তা জানি না। আমি এদেশে আসার মাত্র দু বছর আগে উনি একটা জাহাজে চেপে ব্রুকলীন পোর্টে নামলেন। কপালে তিলক কাটা, গেরুয়া পোশাক, গলায় কণ্ঠীমালা, হাতে জপের মালা, পায়ে সাদা রবারের জুতো, আমাদের দেশে যেমন পাওয়া যায়, এদেশে ওরকম জুতো কেউ দেখে নি, ওরকম বিচিত্র পোশাকের মানুষও এরা দেখেনি। ওঁর পকেটে মাত্র আটটা ডলার আর সঙ্গে গাদা খানেক সেই নিজের লেখা বই; পোর্ট থেকে বেরিয়ে ডান দিকে না। বাঁ দিকে যেতে হয় তাও জানেন না। একজন সত্তর বৎসরের বৃদ্ধ এত দূর বিদেশে এসেছিলেন কিসের ভরসায়? কিন্তু ওঁর ধারণা, উনি অ্যামেরিকা জয় করতে এসেছেন।
–পরশুদিন ম্যানহাটনে কয়েক হাজার ছেলেমেয়ে নাচতে নাচতে মিছিল করে রাস্তা জ্যাম করে দিল, টি ভি-তে দারুণ কভারেজ দিয়েছে, কিছু ছেলে আবার মাথায় টিকি রেখেছে দেখলুম, এতগুলো অ্যামেরিকান ছেলেমেয়েকে উনি দলে টানলেন কী করে? সত্যি ঐ রকমভাবে একা এসেছিলেন?
–সেই জন্যই তো এত সবিস্তারে বলছি। এটা একটা দিগবিজয় কাহিনী। মাত্র আট ডলার পকেটে নিয়েই এসেছিলেন। প্রথম কিছুদিন সেই আগরওয়ালের ছেলে গোপাল পেনসিলভানিয়ার বাটলার নামে একটা ছোট্ট জায়গায় ওঁকে আশ্রয় দেন। গোপালের বউ আবার আমেরিকান মেয়ে। ওদের দুটি ছেলেমেয়ে। নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টে এরকম একজন লোককে রাখা মুশকিল। গোপাল তাই ওয়াই এম সি এ হস্টেলে একটা ঘর ভাড়া করে দিয়েছিল। দিনের বেলা অভয়চরণ গোপালের বাড়িতে এসে নিজে রান্না করে খেতেন। ইণ্ডিয়া থেকে উনি একটা কুকার এনেছিলেন, যে রকম টিপিক্যাল পেতলের কুকার পাওয়া যায়, তাতে উনি ডাল, তরকারি রান্না করতেন। গোপালের বউ স্যালির উনি মন জয় করেন ঐ রান্না দিয়ে। সাদাসিধে নিরামিষ রান্না তো এরা কখনো খায়নি। অনেক লোক এত বিচিত্র সাধুকে দেখতে আসতো। ন্যাড়া মাথায় বোস্টম বাবাজীদের মতন কাপড়ের টুপী, সঙ্গে সব সময় উনি ওঁর ছাতাটি রাখবেনই। ওর আর একটা গুণ ছিল, স্মৃতিশক্তি খুব ভালো ছিল। আমাদের দেশের অনেকেই সাহেবদের নাম শুনে একটু পরেই ভুলে যায়। অন্য কারুর সঙ্গে পরিচয় করাতে গেলে নাম ভুলে যায়। উনি কিন্তু যার সঙ্গেই পরিচয় হলে, প্রত্যেকের নাম মনে রাখতেন, রাস্তায় দেখা হলে নাম ধরে ডাকতেন।
অতীন জিজ্ঞেস করলো, তুই এত ডিটেইলস জানলি কী করে?
সিদ্ধার্থ বললো, আমার কৌতূহল হয়েছিল বলেই খোঁজ খবর নিয়েছি।
ট্রাফিকের জট একটুখানি খুলেছে, গাড়িগুলো আবার কচ্ছপের গতিতে চলতে শুরু করেছে। সামনে-পেছনে প্রায় শ পাঁচেক গাড়ি, কিন্তু একটাও হনের শব্দ নেই। সিদ্ধার্থ গাড়ি চালাতে চালাতে বাকি কাহিনীটা বলে গেল।
মাসখানেক বাটলারে থাকার পর অভয়চরণ বুঝলেন যে গোপালের ওপর বেশি চাপ দেওয়া ঠিক হবে না। তা ছাড়া ওখানে তিনি দু একটা বক্তৃতা দিলেও তাঁর আরও অনেক বড় ক্ষেত্র দরকার। এর মধ্যে তিনি অ্যামেরিকার জীবনযাত্রা কিছুটা বুঝে নিয়েছেন। তিনি চলে এলেন নিউ ইয়র্ক। সেখানে থাকবেন কোথায়? এর মধ্যেই তিনি ডাঃ রামমূর্তি মিশ্র নামে একজনের খোঁজ পেয়েছিলেন। চিঠি লিখে যোগাযোগ করেছিলেন এই রামমূর্তি মিশ্রর সঙ্গে। এর বয়েস অনেক কম, স্মার্ট গাই, সাদা স্ন্যাকস্ আর নেহরু জ্যাকেট পরে, কথাবার্তায় খুব তুখোড় আর ছটফটে। অ্যামেরিকানদের মতন কথায় কথায় ওহ হাউ লাভলি, কিংবা ইজনট ইঁট বিউটিফুল বলা শিখে নিয়েছে। এর আবার একটা ‘হঠযোগ স্টুডিও আছে। অর্থাৎ হি সেলস ইন্ডিয়া। মাঝে মাঝে ভারতীয় গান বাজনার উৎসব করেন, রবিশঙ্করকে আনান ইত্যাদি। ইনি কিছুদিনের জন্য আশ্রয় দিলেন অভয়চরণকে। অভয়চরণের তখনকার নাম অবশ্য শ্রীঅভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী। পরে আর একটা নাম হয় প্রভুপাদ। এই দু’জনের কিন্তু বেশিদিন বনলো না। রামমূর্তি মিশ্র আধুনিক শহুরে ধরনের মায়াবাদী। আর প্রভুপাদ ভক্তিবাদী, কৃষ্ণভক্ত। প্রভুপাদ রামমূর্তি মিশ্রের দয়ায় বেশিদিন থাকতে চাইলেন না। নিজস্ব একটা ঘর ভাড়া করলেন। খুবই ছোট্ট, খুপরি মতন ঘর, তারই ভাড়া বাহাত্তর ডলার। সেটাই হলো তার কৃষ্ণ মন্দির, সেখানে তিনি কীর্তন গান আর ভক্তদের উপদেশ দেওয়া শুরু করলেন।
অতীন জিজ্ঞেস করলো, বাহাত্তর ডলার ভাড়া, তা ছাড়া নিজস্ব খাওয়া-দাওয়ার কিছু খরচ তো ছিলই। উনি সে পয়সা পেতেন কোথায়?
সিদ্ধার্থ বললো, ঐ যে বইগুলো তিনি সঙ্গে এনেছিলেন, সেগুলো ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন। কিছুতেই তিনি নিরুৎসাহিত হন। সামনের মাস কী করে চলবে তার ঠিক নেই, তবু তিনি কৃষ্ণ মাহাত্ম্য প্রচার চালিয়ে যেতে লাগলেন তেজের সঙ্গে। ডঃ মিশ্রের সঙ্গে থাকার সময় কিছু ইন্ডিয়া সম্পর্কে, ইন্ডিয়ান ফিলসফি সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড লোক তাঁকে চিনেছিল। তা ছাড়া কাছেই ছিল প্যারাডক্স নামে একটা রেস্তোরাঁ, সেখানে আসতো লম্বা চুল আর দাড়িওয়ালা বাউণ্ডুলে ছোকরারা, তারা কেউ ছবি আঁকে, কেউ বাজনা বাজায়, পরে এদেরই বলা হতো হিপি। এই ছোকরারা একজন দু’জন করে আসতে লাগলো তাঁর কাছে। প্রভুপাদ যে করতাল বাজিয়ে কীর্তন করতেন, ঐটাকেই তারা একটা নতুন ধরনের গান বলে মনে করে আগ্রহী হলো, তা ছাড়া ভিয়েৎনামী যুদ্ধের ছায়ায় এরা খুঁজছিল একটা কিছু নতুন দর্শন।
প্রভুপাদের নিজস্ব জিনিসপত্র কিছুই প্রায় ছিল না, এক ট্রাঙ্ক ভর্তি বই, একটা ভাঙা টাইপ রাইটার আর ভক্তরা দিয়েছিল একটা টেপ রেকডার। একদিন সেই ঘরেই চুরি হয়ে গেল। চোরেরও কী করুণ অবস্থা! প্রভুপাদ তখন সেভেন্টি সেকেন্ড স্ট্রিটের সেই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে উঠে গেলেন বাওরী অঞ্চলে। হার্ভে নামে একটা ছেলের একটা অ্যাটিকের ঘর ছিল ওখানে, সে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যাচ্ছে বলে প্রভুপাদকে ওখানে বিনা পয়সায় থাকতে দিয়ে গেল। অবশ্য, সেখানে ডেভিড অ্যালেন নামে আর একটা ছেলেও থাকবে। ঐ ডেভিড আবার নেশাখোর, প্রায় আধ পাগল।
বাওরীতে তুই কখনো গেছিস, অতীন? আমরা সন্ধের পর সেখানে যেতে ভয় পাই। নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড এরিয়া হচ্ছে ঐ বাওরী, যত রাজ্যের মাতাল, লুম্পেন, চোর-জোচ্চোর, বেশ্যাদের আড্ডা। নেশাখোররা পেভমেন্টের ওপরে শুয়ে থাকে। যখন তখন মাঝ রাস্তায় ছুরি মারামারি হয়। প্রভুপাদের যেন সেসব ব্যাপারে কোনো ভূক্ষেপই নেই। একটা বেশ বড় ঘর পেয়ে সেখানে তিনি ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে প্রত্যেক সন্ধেবেলা কীর্তন আর গীতাপাঠ চালিয়ে যেতে লাগলেন। আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে লাগলো তাঁর কাছে। ঐ কীর্তনের জন্যই ছেলেমেয়েরা বেশি আসে, তারাও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হরে কৃষ্ণ গায়।
পাড়ার মাতাল, ভবঘুরে কিংবা খুনেরা প্রভুপাদকে কোনোদিন ডিসটার্ব করেনি। এই অদ্ভুত চেহারার স্বামীজীকে তারা বরং সমীহই করতো। উনি একা একা বাজার করতে যেতেন, রাস্তায় সকলের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসতেন, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বিনীতভাবে উত্তর দিতেন। তাঁর কীর্তনের আসরে দিন দিন ভক্তের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। প্রভুপাদ ঠিক করলেন, সেই ঘরটাকেই রাধাকৃষ্ণের মন্দির বানাবেন। কিন্তু বিপদ এলো অন্য দিক থেকে।
ঐ যে ডেভিড অ্যালেন বলে একটি ছেলে ঐ ঘরে থাকতো, সে এমনিতে ছিল নিরীহ, কীর্তন গান করতো, প্রভুপাদের উপদেশ মন দিয়ে শুনতো। কিন্তু সাঙ্ঘাতিক নেশার দাসত্ব কিছুতেই ছাড়তে পারছিল না। গাঁজা, এল এস ডি, অ্যামফেটামাইনস-এর নেশা দিন দিন বাড়িয়েই যাচ্ছিল। ঐ নেশার ঝোঁকে সেও উগ্র হয়ে উঠতে। এক একসময় স্বামীজীকে মারতে যেত। একদিন ঘরে আর কেউ নেই, ঐ ডেভিড হঠাৎ বিকট হুংকার দিয়ে স্বামীজীর সামনে এসে দাঁড়ালো, তার চোখ দুটো হিংস্র পশুর মতন। প্রভুপাদ তাকে বোঝাতে গেলেন, কোনো ফল হলো না, তার তখন কিছুই বোঝার মতন অবস্থা নেই। প্রভুপাদ চার তলার সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলেন রাস্তায়। নিজস্ব জিনিসপত্র কিছুই আনলেন না। অ্যামেরিকায় আসবার ন মাস পরে তিনি আবার আশ্রয় হারিয়ে পথে নামলেন।
এরপর তিনি কী করবেন? একটিই উপায় আছে। তার দেশে ফেরার টিকিট আছে, তিনি আবার জাহাজে চেপে বসে পড়তে পারেন। অনেকক্ষণ তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালেন। কিন্তু সত্তর বছরের বৃদ্ধটি কিছুতেই হার মানবার পাত্র নন। এদেশে এসেছেন কৃষ্ণের নাম প্রচার করতে, যতক্ষণ প্রাণ থাকবে, ততক্ষণ তিনি সে চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। ঐ অ্যাটিকের ঘরে তাঁর আর ফিরে যাওয়ার রুচি নেই। তিনি তাঁর কীর্তনের আসরের দু চারজন ভক্তের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন। এদের মধ্যে একজন হচ্ছে মাইকেল গ্রান্ট, সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তার খানিকটা নাম হয়েছিল, ইস্টার্ন ফিলোসফির প্রতি তার আগ্রহও ছিল, সে এগিয়ে এলো সাহায্য করতে। ‘ভিলেজ ভয়েস’ পত্রিকা থেকে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে সে সেকেণ্ড এভিনিউয়ের একটা খালি দোকান ঘর ভাড়া করে ফেললো বন্ধু বান্ধবদের কাছে চাঁদা তুলে। দোকান ঘরটার বাইরে একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে, তাতে লেখা ম্যাচলেস গিফট। প্রভুপাদকে সঙ্গে করে সেখানে নিয়ে গিয়ে সে বাড়ি ভাড়ার এজেন্টের সঙ্গে কথা বলছে, প্রভুপাদ সেই এজেন্টকে নিজের অনুবাদ করা ভাগবতের তিন খণ্ডের একটা সেট উপহার দিলেন নিজের নাম লিখে। যেন তিনি ঐ বাড়ির দালালটিকে মহামূল্যবান কিছু দিয়ে ধন্য করছেন। তারপর গম্ভীরভাবে তাঁকে বললেন, আমরা এখানে কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ স্থাপনা করবো, আপনি হবেন। তাঁর প্রথম অফিশিয়াল ট্রাস্টি।
অতীন হেসে উঠতেই সিদ্ধার্থ আবার বললো, অ্যাকচুয়ালি তাই হয়েছিল। লোয়ার ইস্ট সাইডে আমরা যে বাড়িটায় এক সময় থাকতাম তোর মনে আছে? তুই প্রথম এদেশে এলি, সেই বাড়ি থেকে এই সেকেণ্ড অ্যাভিনিউয়ের বাড়িটা বেশি দূর নয়। ঐ দোকান ঘরটিতেই প্রতিষ্ঠিত হলো ইসকন, ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস। কেউ কেউ বলেছিল, সংস্থাটির নাম হোক গড় কনশাসনেস, এদেশের লোক তা হলে সহজে বুঝতে পারবে। প্রভুপাদ জোর দিয়ে বললেন, তিনি এদেশের মানুষকে কৃষ্ণের নাম জানাতে এসেছেন, তিনি ঐ নামই রাখবেন। ঐ দোকানঘর আর তার পেছনের অ্যাপার্টমেন্টটা হলো একটা আশ্রমের মতন। সেখানে ভাত-ডাল-চাপাটি-নিরামিষ তরকারি রান্না করে খায়, প্রার্থনা আর কীর্তনের সময় সবাই জুতো বাইরে খুলে আসে, কেউ সেখানে নেশা করতে পারবে না, এমন কি সিগারেটও খেতে পারবে না, সেই বৃদ্ধের এই সব কঠোর নিয়ম অ্যামেরিকান ছেলেমেয়েরা মেনে নিল কেন? দিন দিন তাঁর ভক্তের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। একদিন সেখানে সদলবলে এলেন অ্যালেন গীনবার্গ। তারপর তিনি ভক্তদের নিয়ে ওয়াশিংটন পার্কে হরেকৃষ্ণ গান গাইতে যেতে শুরু করলেন।
গাড়ি ঢুকে পড়েছে লিংকন টানেলের মধ্যে। সমুদ্রের নীচের এই সুড়ঙ্গ উজ্জ্বল আলোকমালায় সাজানো, গাড়িগুলো এখন ছুটছে তীব্র গতিতে, কোনো একটা গাড়ি যদি হঠাৎ থেমে যায় তা হলে পর পর কতগুলো গাড়িতে যে ধাক্কা লাগবে তার ঠিক সেই। তবু সবাই ছোটে।
সিদ্ধার্থ বললো, এখন অ্যামেরিকার প্রায় প্রত্যেক শহরে ইসকনের মন্দির আছে। ক্যানাডা, ইউ কে, ফ্রান্স, জাপান, কোথায় নেই? একটা বিরাট ধর্মীয় এমপায়ার বলতে পারিস। একজন মধ্যবিত্ত বাঙালী ওষুধ ব্যবসায়ী বুড়ো বয়েসে এসে এত বড় একটা ব্যাপার কী করে করলো?
অতীন বললো, এর সাকসেস স্টোরিটা খুবই চমকপ্রদ ঠিকই। কিন্তু এবার বল তো সিদ্ধার্থ, এ সম্পর্কে তোর এত আগ্রহ কেন? তুই ধর্মের দিকে ঝুঁকেছিস নাকি?
সিদ্ধার্থ বললো, আমি ধর্ম-টর্ম কিছু বুঝি না। তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমি ব্যাপারটা দেখছি অন্য অ্যাংগল থেকে। এই প্রভুপাদ একলা নিঃসম্বল অবস্থায় এসেছিলেন এদেশে। কিন্তু নিজের স্ট্যাণ্ড পয়েন্ট থেকে এক চুলও নড়েননি। এই মাংসাশী জাতকে ইনি বাধ্য করেছেন নিরামিষ খেতে। এদেশে এত সেকসুয়াল পারমিসিভনেস, অথচ ইনি ভক্তদের আদেশ দিয়ে রেখেছেন অবৈধ যৌন সংসর্গ চলবে না। এর ভক্তদের নাম দেন মুকুন্দ, হয়গ্রীব, কুশ, কমলা, অনুরাধা। পুরুষরা মাথা ন্যাড়া করে, মেয়েরা শাড়ি পরে। এগুলো তো শুধু হুজুগ নয়। অ্যামেরিকান হুজুগ দু চার মাস, বড় জোর এক বছর থাকে। শুধু হুজুগে এতখানি আত্মত্যাগ কি সম্ভব? সেই তুলনায় আমরা কী করছি? আমরা এদেশে এসেই নিজের নামটা বদলাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি। অফিসে আমাকে সবাই সীড বলে ডাকে। আমি নিজেও টেলিফোন তুলে বলি, সীড স্পিকিং। তোর মনে আছে অতীন, একবার একটা ইন্টারভিউয়ের সময় একটা সাহেব তোর নামটা বদলাবার জন্য বলেছিল বলে তুই কীরকম রাগারাগি করেছিলি? এখন। তোর সাহেব তোক আদর করে ম্যাজ বলে। আমরা টাই না পরে অফিস যাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারি না। এমন কি নিজেদের মধ্যে বসেও আমরা সব সময় দেশের নিন্দে করি। আমাদের দেশ কত নোংরা, কত দারিদ্র্য, দেশের গভর্নমেন্ট কত করাপ্ট যেন ওদেশে যে আমরা জন্মেছি, সেই পরিচয়টা যত তাড়াতাড়ি মুছে ফেলা যায় ততই ভালো। আমরা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলি, ওরা মাতৃভাষা তে শেখেই না, বাপ-মায়ের দেশ সম্পর্কে কিছু জানতে চায় না। অথচ ঐ বুড়ো লোকটি পুরো ভারতীয় কালচার চাপিয়ে দিচ্ছে এদেশের হাজার হাজার ছেলে-মেয়ের মধ্যে।
অতীন গম্ভীরভাবে বললো, ভারতীয় কালচার নয়, ধর্ম। তুই এটা বুঝতে পারছিস না কেন? ধর্মের আফিমে লক্ষ লক্ষ লোককে আজও উন্মাদ করা যায়। আমরা যে ধর্মকে রিজেক্ট করেছি, ওয়েস্টে সেই ধর্মই এখন ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে।
–আমরা ধর্মকে রিজেক্ট করেছি? ইণ্ডিয়ায় ধর্ম নেই। তুই পাগল নাকি? তুই নিজের দেশটা ভালো করে চিনলিই না।
–ইণ্ডিয়ায় ধর্ম নিয়ে মাতামাতি নেই, সে কথা বলছি না। বলছি আমাদের কথা। এখানে যে-ধরনের ছেলেমেয়েরা এই প্রভুপাদের ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করছে, আমাদের দেশের সেই ধরনের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা কি ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামায়। এখানে ইসকনের যে সব মিছিল হয়, তাতে কোনো ইণ্ডিয়ান তো দেখতে পাই না, সবই তো সাহেব-মেম।
–যারা বাংলা-হিন্দী জানে না, অর্থাৎ বিদেশীদের কাছে কৃষ্ণ নাম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে উনি এসেছিলেন।
–কেন, যারা বাংলা-হিন্দী জানে, তারা সবাই কি কৃষ্ণ নাম জপ করে? তারা আগেই উদ্ধার পেয়ে গেছে?
–মেটেরিয়ালিস্টিক পশ্চিম জগতে ভক্তিধর্ম ছড়াবার ব্রত নিয়েছিলেন উনি, গোটা পৃথিবীর দায়িত্ব ওঁকে নিতে হবে তার কোনো মানে নেই।
–এদের মিছিলে আমি ব্ল্যাকদেরও দেখি না। এদেশে কালো মানুষরাই বঞ্চিত, নিপীড়িত শ্ৰেণী। তাদের উদ্ধার করার জন্য বুঝি প্রভুপাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
–এটা একটা পিকিউলিয়ার ব্যাপার। এদেশের নিগ্রোরা দলে দলে মুসলমান হয়। দ্যাখ না, কেসিয়াস ক্লে মহম্মদ আলী হয়ে গেল। আরও অনেকেই। ওরা হিন্দু ধর্মের দিকে ঘেঁষতে চায় না। স্বামী বিবেকানন্দরও কি কোনো নিগ্রো ভক্ত ছিল অথচ হোয়াইটরা হিন্দু ফিলজফিতে এত আগ্রহ দেখায় কেন কে জানে?
–এটা মোটেই পিকিউলিয়ার নয়। সিম্পল। মুসলমানদের ধর্মে, ইসলামে বেসিক প্রিন্সিপল হল সমভ্রাতৃত্ব, সব মুসলমানেরই ইকুয়াল রাইটস রয়েছে, নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য তারা লড়াই করায় বিশ্বাসী।
–মুসলমানদের মধ্যে বুঝি গরিব বড়লোকের বিভেদ নেই? খুব বেশি মাত্রাতেই আছে। মুসলমানরা বুঝি নিজেদের মধ্যে লড়াই করে না? এত সিমপল নয়।
–আমি বলছি, বেসিক প্রিন্সিপলের কথা। হিন্দু ধর্মের বেসিক প্রিন্সিপল হচ্ছে ত্যাগ, মায়া, পারলৌকিক মুক্তি, এই সব। এই প্রিন্সিপালগুলো ভারতীয় হিন্দুদের অলরেডি বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আরে, যারা খেতে পায় না, মাথার ওপর রোদ বৃষ্টি আটকাবার মতন একটা ছাদ নেই, তাদের আবার ত্যাগ, মুক্তি কী রে? এককালে যখন প্রচুর ভোগের ব্যাপার ছিল, তখন ত্যাগের প্রশ্ন এসেছিল। এদের এখন সেই অবস্থা। পৃথিবীতে হোয়াইট রেস এখন সমস্ত ক্ষমতা দখল করে আছে, এদের মধ্যে কিছু লোক ভোগ দর্শনে ক্লান্ত হয়ে গেছে। তাদের কাছে এই ফিলোসফি খানিকটা অ্যাপিল করবে তাতে আর আশ্চর্য কী!
–তুই বড্ড সোজা করে দেখছিস রে, অতীন। একজন বুড়ো লোক পুরোনো ধরনের ইংরিজিতে এদের বৈষ্ণব দর্শন বোঝালো, তাতেই সবাই মেতে গেল? তুই প্রভুপাদের অ্যাচিভমেন্টের সিগনিফিকেন্স বুঝতে পারছিস না।
–আমি বুঝতে পেরেছি, তোর কী হয়েছে। একজন বাঙালী এসে এদেশে এতগুলো মঠ-মন্দির বানিয়েছেন, এত বড় একটা অগানাইজেশনের হেড হয়েছেন, তুই তাতেই মুগ্ধ হয়ে গেছিস। আমি এতটা গুরুত্ব দিতে পারছি না। ধর্মের নাম করে যে প্রতিষ্ঠানই হোক, সেটা ক্রমশ আর একটা সেট হয়ে উঠবে, অ্যাফফ্লুয়েন্ট শ্রেণীর শখের খেলা হবে কিংবা অন্য ধর্মের সঙ্গে লাঠালাঠি লাগবে। আমি মনে করি, ধর্মকে একেবারে নির্মূল করতে না পারলে এই পৃথিবীর মানুষের মুক্তি নেই।
–এসব তোর গোঁড়ামির কথা অতীন। তুই অন্য অ্যাংগেলটা একেবারে দেখছিস না। আমি মনে করি, পশ্চিমী জগৎ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আর ব্যবসা দিয়ে এতদিন আমাদের জয় করে রেখেছিল, এখন প্রাচ্যদেশের একজন এসে আমাদের দর্শন দিয়ে এদের জয় করছে। ইসকনের অনেক ছেলে মেয়ে প্রভুপাদের জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারে। উনি অবশ্য জীবন দিতে বলতেন না কখনো। ওঁর মতে, এই ধর্ম পৃথিবীতে একটা যুদ্ধবিরোধী শান্তির বাণী প্রচার করবে। তুই ধর্মের ওপর এত খাপ্পা কেন? মানুষ যদি ধর্মের কাছে শান্তি পায়, তাতে আপত্তির কী আছে? স্বার্থপর কিংবা মতলববাজরা অন্যভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে, কিন্তু সেটা তো ধর্মের দোষ নয়। কোটি কোটি মানুষ এখনো যে ধর্মের কাছে আস্থা ও সান্ত্বনা পায়, সেটা তো মিথ্যে নয়।
–তোর দেখছি মাথাটা একেবারে গেছে। তার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। তুই যা, ওদের দলে ভিড়ে পড়, দীক্ষা নিয়ে চ্যালা হয়ে যা। অবশ্য দ্যাখ, তোকে ওরা আবার দলে নেবে কি না।
–আমি দীক্ষা টিক্ষা নেবার কথা ভাবি না। কিন্তু প্রভুপাদের সমস্ত কেরিয়ারটা স্টাডি করে আমার একটা অদ্ভুত ফিলিং হয়েছে। একজন মানুষ নিজের বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে এতদূর তো উঠতে পেরেছে? আর আমরা কী করছি? আমাদের তো কোনো কিছুতেই বিশ্বাস নেই। অনবরত টাকা রোজগার করছি আর খরচ করছি। দু’ বছর অন্তর গাড়ি বদলাচ্ছি, বাড়ি কিনছি, এই কি জীবন? আমার এই একটা কমপ্লেক্স পেয়ে বসেছে। আমি ঠিক করেছি দেশে ফিরে যাবো। তারপর যা হয় তোক। এদেশে দাসত্ব করা আর ভালো লাগছে না।
সিদ্ধার্থর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে অতীন বললো, কাল রাত্তিরে কতটা মাল টেনেছিস! এখনো হ্যাং ওভার কাটেনি মনে হচ্ছে? সেবার কি অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তোর মনে নেই? আবার বোকামি করবি?
সিদ্ধার্থ বললো, আমি ঠিক করেছি, আবার ফিরে গিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করবো।
শহরে দু একটা কাজ সেরে সিদ্ধার্থ অতীনকে নামিয়ে দিয়ে গেল জে এফ কে এয়ারপোর্টে। আজ থ্যাংকস গীভিং ডে-র ছুটি, অতীনকে যেতে হবে শিকাগো। তার ফ্লাইটের এখনো দেরি আছে, তাড়া কিছু নেই। লাউঞ্জে বসে সে হ্যাণ্ড ব্যাগ খুলে জরুরি ফাইলটা বার করলো। এই বিজনেস ডিলটা ঠিক মতন করতে পারলেই অতীনের আর একটা প্রমোশন হবেই।
কোটের পকেট থেকে ছোট্ট ক্যালকুলেটারটা বার করে রাখলো বাঁ হাতে। এটা এমনই অভ্যেস হয়ে গেছে যে যে-কোনো অঙ্ক দেখলেই হাত নিশপিশ করে। যদিও ফাইলে অঙ্কগুলো সবই আগে থেকে করা আছে নির্ভুল ভাবে।
অতীনের মন বসছে না। নিউ ইয়র্কে ইসকনের মিছিলের জন্য ট্রাফিক জ্যাম একটা বড় ঘটনা, সব কাগজে প্রথম পাতার খবর হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গটা একবার তুলতেই সিদ্ধার্থ লম্বা গল্প ফেঁদে বসলো। সিদ্ধার্থ যে এই সব ধর্মীয় ব্যাপার নিয়ে এতখানি আগ্রহী হয়ে পড়েছে, তা অতীনের ধারণাই ছিল না। সব সময় হাসি-ঠাট্টা আর ফক্কড়ি করা স্বভাব ছিল সিদ্ধার্থর। এটা বদলে গেছে গত বছর সেই ঘটনার পর। দেশ থেকে নিজের বাবা আর মাকে এনে নিজের কাছে রেখেছিল সিদ্ধার্থ। এখন ও বড় বাড়ি কিনেছে, কোনো অসুবিধে ছিল না। সিদ্ধার্থর বাবা একটা কলেজের হিস্ট্রির অধ্যাপক ছিলেন, পড়য়া মানুষ, এখানে তিনি পড়াশুনো নিয়েই থাকতে পারতেন, কিন্তু হঠাৎ গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেলেন। অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট। দেশে কি অ্যাকসিডেন্ট হয় না? কেউ গাড়ি চাপা পড়ে মরে না? কলকাতায় যা ট্রাফিকের অবস্থা…। এদেশে ফাঁকা রাস্তায় দুর্দান্ত স্পীডে গাড়ি চলে, সিদ্ধার্থর বাবা একা একা হেঁটে বেরোতেই বা গিয়েছিলেন কেন? তাও হাইওয়ে দিয়ে…
কিন্তু তারপর আর সিদ্ধার্থর মা কিছুতেই এদেশে থাকতে চাইলেন না। একেবারে অবুঝ হয়ে গেলেন। সিদ্ধার্থর আর ভাই বোন নেই। ভদ্রমহিলা একা একা কলকাতা শহরে একটা ফ্ল্যাটে থেকে কী আনন্দ পাবেন? কিন্তু তিনি কারুর কথাই শুনলেন না। জোর করেই ফিরে গেলেন দেশে। সিদ্ধার্থ তে খুব আঘাত পেয়েছিল। ওর স্ত্রী নীপাই নাকি মাকে ধরে রাখতে পারেনি। হয়তো কথাটা ঠিক নয়। নীপা অনেক চেষ্টা করেছিল। নিজের মাকে সিদ্ধার্থ নিজেই যদি বোঝাতে না পারে, তা হলে নীপা আর কী করে তাঁর মত ফেরাবে।
এখন সিদ্ধার্থ কি ভাবছে, এদেশ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ফিরে গিয়ে মায়ের কাছে থাকবে? বস্তা সেন্টিমেন্ট! নীপার ইচ্ছে-অনিচ্ছের মূল্য দেবে না, ছেলে-মেয়ের সুবিধে অসুবিধের কথা। চিন্তা করবে না?
সিদ্ধার্থর বাবা শান্ত, নিরীহ ধরনের মানুষ ছিলেন, প্রায় কথাই বলতেন না। অতীনের সঙ্গে দু’ তিনবার দেখা হয়েছে, কিন্তু কেমন আছেন, ভালো আছেন ছাড়া আর কোনো কথাই হয়নি। বই পড়া ছাড়া আর কোনো ব্যাপারে উৎসাহ ছিল না। এইটাই অতীন বুঝতে পারে না, এদেশে কত কী দেখার আছে, এত রকম মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি, থিয়েটার, বেড়াবার কত জায়গা, তবু সেসব দেখতে ইচ্ছে করে না? ইতিহাসের অধ্যাপক, কিন্তু ইতিহাস কি শুধু বইয়ের পৃষ্ঠায়? তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল, শুধু শুধু প্রাণটা দিলেন।
ইসকনের প্রভুপাদের কথা শুনে অতীন তেমন কিছু মুগ্ধ হয়নি। তার বাঙালী বাঙালী। বাতিক নেই। ধর্মীয় গুরুরা পৃথিবীর কোনো উপকার করতে পারে, একথা সে কিছুতেই মানতে পারবে না। বাবার মৃত্যুর পর সিদ্ধার্থ বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে, ঐ ভক্তিপাদের মধ্যে সে কি ফাদার ফিগার খুঁজছে?
ঐ সব শুনতে শুনতে বার বার দেশের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
শুধু কলকাতা নামটা একবার কেউ উচ্চারণ করলেই অনেকগুলো ছবি ফুটে ওঠে চোখের সামনে।
অতীন যে আগে দু’ বার চীনে গেছে, সে কথা মা-বাবাকে জানায়নি। মা অন্তত ভাবতেন, চীনে গেলেই অতীন একবার নিশ্চয়ই কলকাতায় ঘুরে আসবে। ওঁরা বোঝেন না যে পিকিং থেকে কলকাতায় যাওয়ার চেয়ে নিউ ইয়র্ক থেকে কলকাতায় যাওয়া সোজা। ছুটি পাওয়াটাই সবচেয়ে শক্ত।
সিদ্ধার্থ আর সে একসঙ্গে দেশে পাকাপাকি ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেনি? ওঃ, সেই অভিজ্ঞতার কথা ভাবলেই এখনো জিভটা তেতো হয়ে যায়। দেশে লোকাল ট্রেনগুলো সব সময় ভর্তি থাকে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একদল লোক বলে, জায়গা নেই, জায়গা নেই। সারা দেশটাই যেন অতীন আর সিদ্ধার্থকে সব সময় এই কথাটাই শুনিয়েছে, জায়গা নেই, জায়গা নেই!
এমার্জেন্সির পর ইন্দিরা গান্ধী হেরে গেলেন ইলেকশানে, তারপর পশ্চিম বাংলায় বামফ্রন্ট পাওয়ারে এলো। সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হলো, পেণ্ডিং কোর্ট কেসগুলোও তুলে নেওয়া হয়েছিল। অতীন পলিটিক্যাল প্রিজনার ছিল না, তার নামে ছিল মাড়ার চার্জ। কিন্তু বিমানবিহারী কী যেন কলকৌশল করে অতীনের কেসটাও পলিটিক্যাল কেসের মধ্যে ফেলে দিয়ে উইথড্র করিয়ে নিয়েছিলেন। বেইল জাম্প করায় ব্যাপারটাও চেপে দেওয়া হয়েছিল। প্রতাপ খুব ভালো রকম খোঁজ খবর নিয়েছিলেন, অতীনের দেশে ফেরার আর কোনো ঝুঁকি ছিল না। অতীন তো সেই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। প্রয়োজনের বেশি তে। সে একদিনও থেকে যেতে চায়নি অ্যামেরিকায়। শর্মিলাও এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। তখনও রণ জন্মায়নি। অনীতার পাঁচ বছর বয়েস, তার লেখাপড়ার কোনোই অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কলকাতায় একটা ঐটুকু মেয়েকে ভালো স্কুলে ভর্তি করাই যে বিরাট সমস্যা, তা কি অতীন কখনো ভাবতে পেরেছিল?
কলকাতায় ফিরে অতীন দেখেছিল, সে যে শহরটাকে চিনতো, সে শহরটাই আর নেই, যেন এক অন্য কলকাতা।
সেলিমপুরে বাবা-মায়েরা যে অত ছোট একটা ফ্ল্যাটে থাকেন, তা-ও অতীন এতদিন চিঠি পড়ে বুঝতে পারেনি। তাদের কালীঘাটের বাড়িতে সেই তুলনায় অনেক বেশি জায়গা ছিল। সে যাই হোক, একখানা ঘরে গাদাগাদি করে থাকতেও অতীনের আপত্তি ছিল না। ঐ রকমভাবে তো কত লোকই থাকে। সে অ্যামেরিকা থেকে ফিরেছে বলে কি অন্যদের মাথা কিনে নিয়েছে? বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকার জন্যই তো ফিরে আসা।
শর্মিলার কষ্ট হচ্ছিল বটে কিন্তু মুখে সে কথা প্রকাশ করেনি। শর্মিলা ধুলো আর ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না, অতীন বলেছিল, আস্তে আস্তে মানিয়ে নাও। আমাদের জীবনের অর্ধেকের বেশি সময়ই তো আমরা এই ধুলো-ধোঁয়ার মধ্যে কাটিয়ে গেছি, এখানেই মানুষ হয়েছি, আবার সব অভ্যেস হয়ে যাবে।
শর্মিলা অবশ্য জামসেদপুরের মেয়ে, সেখানকার বাতাস কলকাতার চেয়ে অনেক পরিষ্কার, জামসেদপুরে গেলে শর্মিলা ভালো থাকতো। অতীন টিসকো-তে একটা চাকরির অফার পেয়েও নেয়নি, সে থাকতে চেয়েছিল কলকাতাতেই। সে গিয়েছিল প্রতাপ মজুমদারের পরিবারের দুই ছেলের শূন্যস্থান পূর্ণ করতে।
ওঃ, ড্রাগ রিসার্চ লেবরেটরির সেই চাকরি। ভাবলেই এখনো শরীরটা রি রি করে। কেউ মন দিয়ে কাজ করবে না, অন্যদেরও কাজ করতে দেবে না। কাজ না করেও মাইনে নিতে বিবেকে লাগে না কারুর। একজন যদি ভালোভাবে কাজ করতে চায়, তা হলে সেটা যেন তার অপরাধ, অন্যরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে। অতীনকে তার সহকর্মীরা কথায় কথায় বলতো, মশাই, আপনাদের অ্যামেরিকায় ওসব চলে! ঐ ‘আপনাদের অ্যামেরিকা’ শুনলেই অতীনের গা জ্বালা
আর ঈর্ষা। কত রকম নোংরা ধরনের ঈষই যে হয়। সিদ্ধার্থরও একই রকম অবস্থা হয়েছিল। সিদ্ধার্থ বলতো, মাইরি, নিষ্কাম ঈর্ষা কাকে বলে দেখেছিস? আমাকে ঈর্ষা করলে অন্য একজনের কোনো লাভ নেই, তার লাইন আলাদা, তার কোনো প্রমোশন হবে না, তবু সে আমার পেছনে লাগবে, আড়ালে আমার নিন্দে করবে। এটা নিষ্কাম ঈর্ষা ছাড়া আর কী?
তবু সব অসুবিধেই তুচ্ছ করতে পারতো অতীন। কিন্তু কলকাতায় তার বন্ধু কোথায়? সিদ্ধার্থ চাকরি নিয়েছিল দুর্গাপুরে। কৌশিক আর পমপম, ওদের দেখে খুব দুঃখ পেয়েছিল অতীন। সবচেয়ে বেশি আঘাত দিয়েছিল অলি।
…সিকিউরিটি চেক-এর কল দিয়েছে। ব্যাগ গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালো অতীন। টিকিটটা হাতে নিয়ে ঘড়ি দেখলো। অনেকটা সময় চলে গেল, কাগজপত্র কিছুই পড়া হলো না।
সিদ্ধার্থ আবার দেশে ফেরার কথা ভাবছে। মাঝে মাঝে এরকম ভাবালুতা আসে, ভালো করে ওকে কড়কে দিতে হবে। দেশ! দূরে থাকলেই তবু দেশের কথা ভাবতে ভালো লাগে।
শর্মিলা এ বছর একবার দেশে বেড়াতে যাবার বায়না ধরেছে। তিন বছর আগেই শর্মিলা ছেলে মেয়েকে নিয়ে একবার দেশে ঘুরে এসেছে, সেবার অতীন যায়নি। এ বছর বাড়ি সারাতে গিয়ে অনেক খরচ হয়ে গেল, এবার আর যাওয়া হবে না। সামনের বছর দেখা যাবে। অতীনের নাক দিয়ে গরম প্রশ্বাস বেরুতে লাগলো, রোমকূপ খাড়া হয়ে উঠলো। অলির কথা মনে পড়লে তার এখনো এরকম রাগ হয়।