উপসংহার
বিকেল শেষ হবার মুখে, সন্ধে নামবার আগে, এক একদিন আকাশ হঠাৎ ঝলমল করে ওঠে। অনেকটা বিশুদ্ধ দিনের ভোরবেলার মতন। সূর্য তখন বেশি উজ্জ্বল মনে হয়, কিন্তু তাপ কম, পাতলা পাতলা মেঘ ভেদ করে আকাশ-গঙ্গার মতন নেমে আসা আলোর রশ্মি খালি চোখেও দেখা যায়। যেন কোনো দৈব দৃশ্য। এ রকম সন্ধিকাল কচিৎ কখনো আসে বলেই তা বড় সুন্দর।
এমন বিকেলে বৃদ্ধ মানুষদের বাড়ির বাইরে বেরুনো ঠিক নয়। জ্যৈষ্ঠ মাসে যেমন কোকিল ডাকে না, মাঘ মাসে যেমন শিউলি ফোটে না, হেমন্তকালে যেমন বাতাসের চাঞ্চল্য বন্ধ থাকে, সেই রকম মানুষের জীবনেও নানা ঋতুর পালাবদল মেনে নিতে হয়।
প্রতাপ মজুমদার এমন এক বিকেলেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন। তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আকাশ কিংবা প্রকৃতি দেখছিলেন না, তিনি লক্ষ করছিলেন পথের মানুষের স্রোত। বাড়ি ফাঁকা, একেবারেই ফাঁকা, তিনি যেন এক নিঃস্ব পরিত্যক্ত, তাঁর কেউ নেই! এ কথা সত্যি নয় অবশ্য। শহরের অনেক বাড়িই দুপুর-বিকেলে নির্জন, বা একজন-দু’জন মহিলা, অতি শিশু, বা কাজের লোক থাকে, কিন্তু সন্ধের পরেও কেউ ফিরবে না, রাত্তিরেও কেউ আসবে না, এ রকম জানা থাকলে দুপুরবেলাটাও বড় শূন্য মনে হয়। একাকিত্ব খুব ভারি হয়ে চেপে বসে। প্রতাপ আর সহ্য করতে পারছিলেন না।
লোকে আর তাঁকে প্রৌঢ় বলে না। পাড়ার ছেলেরা কাকাবাবুর বদলে এখন তাঁকে দাদু বলে ডাকে। প্রথাগত কারণে তিনি এখন বৃদ্ধ তো বটেই, কিন্তু তাঁর চেহারায় এখনও বার্ধক্যের তেমন ছাপ নেই। শরীর বেশ মজবুত, চামড়ার কুঞ্চন চোখে পড়ার মতন নয়, শুধু চুলগুলোই প্রায় সমস্ত সাদা হয়ে এসেছে। এক সময় এই বয়েসী বাঙালীবাবুরা ছড়ি ব্যবহার করতেন। উড়ুনি ও পাম্প শুর মতন ছড়িও এখন প্রায় অন্তর্হিত, শুধু সাহিত্য-চলচ্চিত্র-নাটকে তার রেশ রয়ে গেছে কিছুটা। ছায়াছবি ও মঞ্চে এখনো বয়স্ক বাবা ও অল্পবয়েসী ঠাকুদারা ধুতি-পাঞ্জাবী, কাঁধে চাঁদর ও রূপো বাঁধানো ছড়ি হাতে আবির্ভূত হন। প্রতাপ সাধারণত ট্রাউজার্স ও হাওয়াই শার্ট পরেন, হাতে ছড়ি নেবার প্রশ্নই ওঠে না। অবশ্য আজকালকার ছেলেদের মতন তিনি প্যান্টের সঙ্গে চটি পরতে পারেন না, মোজা ও ফিতে বাঁধা জুতো এবং কোমরে বেল্ট ছাড়া রাস্তায় বেরুলে তাঁর কী রকম যেন গ্লানি বোধ হয়।
তাঁকে বৃদ্ধদের দলে ঠেলে দেবার প্রধান কারণ এই যে তিনি চাকরি থেকে পাকাপাকিভাবে অবসর নিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে।
ব্রিটিশ আমলের তাড়াহুড়ো করা জোড়াতালি দিয়ে তৈরি এই শহরে পচন ধরতে শুরু করেছে বেশ কিছুদিন যাবৎ। ভিত শক্ত ছিল না বলেই ওপরটা নড়বড় করতে শুরু করেছে তাড়াতাড়ি। রাস্তাগুলি যেখানে সেখানে ধসে পড়ছে যখন তখন, পুরনো অট্টালিকাগুলোকে এখন কুৎসিত মনে হয়, পরিকল্পনাবিহীন নতুন সৌধগুলি আরও উৎকট, ইংরেজিতে যাকে বলে মন্সট্রসিটি। মাঝে মাঝে এ শহরের দু-একটি অঙ্গে একটু আধটু পলেস্তারা বুলিয়ে সুন্দর করার চেষ্টা হয়, কিন্তু তা যেন অকালে বুড়িয়ে যাওয়া বারবনিতার মুখে রুজ পাউডার মাখার মতন। মনে মনে এই উপমাটা প্রতাপ মজুমদারেরই। তাঁর যে বেশ্যাদের, যুবতী বা বৃদ্ধা যাই-ই হোক, সে রকমভাবে দেখার অভিজ্ঞতা আছে তা নয়, নিছক একটা তুলনা। প্যারিসে কোনো শিল্পীর আঁকা এ রকম এক করুণ রূপোপজীবিনীর ছবি তিনি দেখেছিলেন বটে, ছবিটা মনের মধ্যে ছাপ ফেলে আছে। শিল্পীর নাম মনে নেই।
শহরের চেয়েও শহরতলি অঞ্চল আরও কদর্য। বন্যার পর জল সরে গেলে যেমন থিকথিকে নোংরা কাদায় হাজার রকম আবর্জনা ছড়িয়ে থাকে। দেশ বিভাগের পরবর্তী বছরগুলিতে কলকাতা শহরের দিকে মানুষের বন্যা ধেয়ে এসেছিল, দেশ বিভাগের সেই স্মৃতি এখন অনেকের মন থেকেই মুছে গেছে; কিন্তু চতুর্দিকে এখনো ছড়িয়ে রয়েছে মানুষের অস্থায়ী আস্তানা। হোগলার ঘর সরে গিয়ে এখন টিন বা টালির ছাদ হয়েছে, একতলা-দোতলা বাড়িও উঠেছে প্রচুর, তা হলেও এর কোনোটাই যেন এখনো পুরোপুরি গৃহ নয়, নিছক মাথা গোঁজার জায়গা, এর সঙ্গে জড়িয়ে যায়নি বংশানুক্রমিক মমতা।
শহরতলির কলোনি সম্পর্কেই প্রতাপের এ রকম বিরাগ, মানুষ সম্পর্কে নয়। তিনি মানুষ সম্পর্কে সব সময় কৌতূহলী। জুয়াড়ী যেমন সর্বক্ষণ লাভ-লোকসানের কথা চিন্তা করে, তিনিও সেরকম মানুষের জীবনের উত্থান-পতন লক্ষ করে আনন্দ পান। অতি অসহনীয় অবস্থার মধ্যেও যেসব মানুষ যুদ্ধ করে খানিকটা ওপরে উঠতে চায়, তিনি শ্রদ্ধা করেন সেইসব মানুষকে।
প্রতাপদের বাড়িও শহরতলিতে, তাঁর নিজের খুব একটা ইচ্ছে ছিল না, মমতার সনির্বন্ধ অনুরোধ বা গঞ্জনা বা কটুক্তি, অর্থাৎ আদেশেই তিনি তাঁর প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রায় সব টাকা। দিয়ে এই ছোটবাড়িটি বানিয়েছেন। জীবনের বহু বছরই তিনি কাটিয়েছেন বিভিন্ন ভাড়া বাড়িতে এবং সেটাই তাঁর পছন্দ ছিল। যাযাবর পুরুষদের বোধহয় মেয়েরাই থিতু করিয়েছে শেষ পর্যন্ত। সমবয়েসীদের কাছে রঙ্গচ্ছলে প্রতাপ বলেন, দ্যাখো ভাই, আমেরিকা রাশিয়ায় শান্তি চুক্তি হওয়া উচিত কিনা কিংবা ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, এই সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের সংসারে আমার মতামতটাই প্রধান। কিন্তু আমার রোজগারের টাকা কীভাবে খরচ হবে কিংবা বোপা আসেনি বলে কয়েকটা রাত বিনা মশারিতেই শুতে হবে কিনা, এই সব ছোটখাটো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন আমার স্ত্রী।
বাড়িটি সাদা রঙের, দোতলা। যাদবপুর বাস ডিপো ছাড়িয়ে সামান্য দূরে। কারুকে বাড়ির অবস্থান বোঝাতে গেলে প্রতাপ মজুমদার বলেন, কৃষ্ণা গ্লাস ফ্যাক্টরি পার হয়ে একটুখানি গেলেই ডানদিকে দেখবে দশ ফুট চওড়া একটা গলি, সেখানে তিনটে বাড়ি বাদ দিয়ে…
রাজভবন থেকে মাত্র পঞ্চাশ মিনিটের জানি।… অবশ্য মাঝপথে জ্যাম থাকলে কতক্ষণ সময় লাগবে সে কথা তিনি উল্লেখ করেন না, সেরকম প্রায়ই থাকে। রাজভবন থেকে বাড়ির দূরত্নমাপা যে এক ধরনের দুর্বলতা, প্রতাপ সেটা বুঝতে পারেন না।
আসলে, সদ্য তৈরি বাড়িটির জন্য প্রতাপও বেশ গর্বিত। তাঁর নিজের বাড়ি। এতদিনে তাঁর রিফিউজি পরিচয়টা ঘুচেছে, এই দেশে তাঁর নিজস্ব এক খণ্ড ভূমি হয়েছে। বাড়ির জন্য মমতাই জেদ ধরেছিলেন বটে, প্রতাপেরও গোপন ইচ্ছে ছিল। বাড়িওলার নোটিশ পেয়ে যখন-তখন বাড়ি ছাড়ার গ্লানি তাঁকে আর সহ্য করতে হবে না। তা ছাড়া ছেলে-মেয়েরা এসে থাকবে, তাদের জন্যও তত ঘর দরকার।
একতলায় তিনটি দোকান, গাড়ি না থাকলেও একটা গ্যারাজ করানো হয়েছে। দোতলাটি গৃহকর্তাদের নিজস্ব। মমতা গেছেন হরিদ্বারে। এখন বাড়িতে নানু নামে যে ছেলেটি সব কাজ করে, সেও আজ ছুটি নিয়েছে, রাত্তিরে ফিরবে না। তাই বেরুবার আগে প্রতাপ দু’ তিনটে দরজায় তালা দিলেন। চাবি সম্পর্কে তাঁর অন্যমনস্কতা আছে, মমতা এই ব্যাপারে তাঁকে বার বার সাবধান করে গিয়েছেন, সেই জন্য প্রতাপ তালা লাগাবার পর দু বার পকেট বাজিয়ে দেখলেন। হ্যাঁ, সব ঠিক আছে।
যতই আন্তর্জাতিক অপবাদ রটে থাকুক, তবু এই কলকাতারও কিছু কিছু রমণীয় মুহূর্ত আছে। যার দেখার চোখ আছে শুধু সে-ই দেখতে পায়। এই শহর মাঝে মাঝে এক মায়াদর্পণ তুলে ধরে, সকলের জন্য নয়, যেমন আজ এই বিকেল ও সন্ধের মাঝখানটিতে। এ এক অন্যরকম আলো যাতে পথের বিভঙ্গ চোখে পড়ে না, বাড়িগুলির অসামঞ্জস্য তুচ্ছ হয়ে যায় মনে হয় পৃথিবী তো মানুষের বসবাসের জন্য। যে যেখানে আছে কোনোক্রমে কি নির্ঝঞ্ঝান সেখানে বাস করতে পারে না?
সময় যৌবন-ভোগ্য। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। প্রতাপ মজুমদার নিজেও যে তা জানেন ন তা নয়। কিন্তু বহিরঙ্গে বৃদ্ধ বলে মনে হলেই তো সবাই বুড়িয়ে যায় না। একলা পথে বেরুলে প্রতাপ এখনো প্রায়ই মনে মনে একটা ছোকরা হয়ে যান। ফুচকা বা আলুকাবলিওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। পল্লীর অল্পবয়েসী ছেলেরা যখন তাঁকে দেখে সিগারেট লুকোয় কিংবা কেউ দাদু বলে সম্বোধন করে, তখন তিনি সচেতন হয়ে মুখে একটা গাম্ভী ফুটিয়ে তোলেন। এই শহরে এত মানুষ, এত বেশি মানুষ, যে কখনো নিরালা হবার উপায় নেই। কেউ না কেউ মনে করিয়ে দেবেই যে তুমি কে, তোমার বয়েস বা টাকাপয়সার জোর আছে কিনা!
বারান্দায় একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে প্রতাপের হঠাৎ মনে হয়েছিল, আজকের দিনটা বেশ সুন্দর, তবু এ জীবনের কী মানে হয়? এই ধরনের চিন্তা এক হিসেবে নিতান্তই অর্থহীন, আবার বিপজ্জনকও বটে। আজকাল প্রায়ই প্রতাপের মাথায় এই চিন্তাটা আসছে। এটা তাড়াতে হলে মানুষের সংসর্গ চাই, কথাবার্তায় ভুলে থাকা দরকার। সেইজন্যই তিনি ছটফটিয়ে পথে নেমে এসেছেন। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? তাঁর চোখে ভেসে উঠলো বিমানবিহারীর বাড়ির ছবি। একমাত্র ঐ বাড়িতেই তিনি যখন তখন যেতে পারেন, কিন্তু যান না, আজকের অপরূপ বিকেলের মতনই তিনি ঐ বাড়িটিকে বছরে মাত্র আট দশবার দেখতে চান। যেন একটা মূল্যবান কাশ্মীরী শাল, যা বহু ব্যবহারে জীর্ণ হতে দেওয়া যায় না!
প্রতাপ বাস স্টপে এসে দাঁড়ালেন। এই সময়টায় এখান থেকে ট্যাক্সি পাওয়া যায়, কিন্তু ট্যাক্সি চাপার ব্যাপারে প্রতাপের মনে একটু কৃপণতার ভাব আছে, মনে পড়ে যায় যে তাঁর আয় এখন সংকুচিত। আবার, কাছেই সরকারি বাস ডিপো হলেও পয়সা বাঁচাবার জন্য তিনি সাধারণ অল্প ভাড়ার বাসে চাপতে পারেন না।
সামনেই একটা বেশ চওড়া ধরনের অসমাপ্ত তিনতলা বাড়ি, আরও অনেক উঁচুতে যাবে হয়তো। মাল্টি স্টোরিড় বিল্ডিং-এর রেওয়াজ ক্রমশই শহরতলির দিকেও এগিয়ে আসছে। নিজের তদারকিতে একটা বাড়ি বানিয়েছেন বলেই এখন নতুন তৈরি হওয়া বাড়ির দিকে আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে থাকেন। জানলার গ্রীলটা কী রকম, দরজার কাঠ প্লাইউড না সলিড পাঁচ ইঞ্চি না দশ ইঞ্চি দেওয়ালের গাঁথনি, এসব দেখেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
সেই নির্মীয়মাণ বাড়ির বাইরের কাঠের ভারা বেয়ে নেমে এলো একজন প্রৌঢ়, পরনে লুঙ্গি ও ছেঁড়া গেঞ্জি হলেও মুখে বেশ একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ। এই লোকটিই কি এই হবু প্রাসাদের রাজমিস্তিরি? অন্যরা এখনো কাজ করছে, ও হঠাৎ নেমে এলো কেন? লোকটি নিজের যন্ত্রপাতি একটা চটের থলিতে ভরে নিয়ে কারুকে কিছু না বলে হাঁটা শুরু করে দিল। ও একা একা কোথায় যাচ্ছে? একটু পরেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।
এত বড় একটা ইট-কংক্রিটের প্রাসাদ যে বানায়, সে কাজের শেষে কোথায় যায়? তার। নিজের বাড়িটি কী রকম? এমনও হতে পারে, লোকটি আর কালকে ফিরে আসবে না। কেউ কি ওর খোঁজ করতে যাবে? সে যাই হোক, এই বাড়িটা অসম্পূর্ণ পড়ে থাকবে না, অন্য কোনো রাজমিস্তিরি নিশ্চিত আসবে। একদিন এই বাড়ির প্রত্যেক ঘরে ঘরে দেখা যাবে নতুন মুখ, কোথাও কোনো দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যাবে না। এই রকমই তো নিয়ম।
প্রতাপের হঠাৎ মনে হলো, ঐ বিষণ্ণ রাজমিস্তিরিটি তাঁর যমজ ভাই!
হাওয়া জোরালো হচ্ছে, আকাশে পাতলা লালচে আভা। ঝড় আসবে নাকি? প্রতাপ ঝড় ভালোবাসেন, কিন্তু যেখানে আকাশ বা মাটি দিগন্ত ছোঁয়া, বড় বড় গাছের মাথা নুয়ে পড়ে, বিভ্রান্ত গরুর গাড়ি এদিক ওদিক ছোটে, ওপরের দিকে তাকালে পবন-পদবী কথাটার অর্থ চাক্ষুষ হয়। শহুরে ঝড়ে সে রকম প্রকৃতি নেই।
রাস্তা পার হতে হতে একটি ধুতি ও শার্ট পরা লম্বা লোক দু-তিনবার তাকালো এদিকে। লোকটিকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কিন্তু কোথায়, কী সূত্রে চেনা তা ঠিক মনে পড়ছে না। এই সব পরিস্থিতিতে নিছক অবান্তর কথায় কয়েক মিনিট সময় অপ-খরচ করতে হয়। প্রতাপ। দেখতে না পাওয়ার ভান করে মুখটা ফিরিয়ে নিলেন।
তাঁর পেছনেই একটা শাড়ির দোকান। ছ-সাত মাস ধরে খুলেছে, বেশ কায়দায় সুসজ্জিত। বাঁ দিকের কাচের শো উইন্ডো-তে একটি হলুদ রঙের ম্যনেকুইন, সেদিকে তাকিয়ে তিনি চমকে উঠলেন। এই নকল নারীমুর্তির কি গম্ভীর চাহনি। তার মুখ এবং একটু বাঁ পাশ ফিরে তাকানোর ভঙ্গিটি খুব চেনা।
এই বাস স্টপে প্রতাপ অনেকবার দাঁড়িয়েছেন, কাপড়ের দোকান আর ম্যানেকুইনটিকেও তিনি দেখেছেন। কিন্তু আজ এই অভিনব বিকেলের আলোকেই এই নিথর মূর্তিটি হঠাৎ এমন। একটা চেনা রূপে উদ্ভাসিত হলো।
এই সব মূর্তি কী দিয়ে বানায়? আগেকার গ্যাটাপাচার কিংবা আলুর খেলনার আর এখন চলন নেই। সব কিছুই প্লাস্টিক কিংবা পলিথিন। সেই রকমের কিছুই হবে, কাঠের মূর্তির এমন। নিখুঁত মুখের ডৌল কি হতে পারে? কোন অজ্ঞাত শিল্পী সুলেখার মুখোনি এমন হুবহু নির্মাণ করলো।
প্রৌঢ়ত্ব পার হয়ে এলে, বিশেষত কর্মহীন জীবনে, খুব পুরনো কথা মনে পড়ে। যৌবন পেছন ফিরে তাকায় না। মানুষ একনাগাড়ে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর ছুটে এসে হঠাৎ এক সময় থমকে গিয়ে ভাবে, এত নদী, এত বিপদসঙ্কুল গিরিখাদ যে পার হয়ে এলুম, কোথাও তো। অতলে তলিয়ে গেলুম না! বৃষ্টিভেজা ঝাঁপসা গাছপালার মতন বিস্মৃতি ভেদ করে উঠে আসে। কয়েকটি উজ্জ্বল মুখ।
কোথায় হারিয়ে গেল সুলেখা! এমন সুন্দর, এমন প্রাণবতী রমণী আর তোত একটিও চোখে পড়লো না এতখানি জীবনে। সে তো শুধু প্রতাপের কুটুম্ব ছিল না, ত্রিদিবের স্ত্রী হওয়াটাই তার একমাত্র পরিচয় ছিল না, সে ছিল মূর্তিমতী লাবণ্য, প্রতাপের সঙ্গে তার বিশেষ একটা মধুর সম্পর্ক ছিল। সুলেখারা বুঝি বেশিদিন পৃথিবীতে থাকে না?
কেন যে সুলেখা জীবনের এমন একটা অপচয় করলো, তা প্রতাপ আজও বুঝতে পারেন না। ত্রিদিবেরও বহুদিন কোনো খবর নেই। ত্রিদিবের জীবনটাও তছনছ হয়ে গেল।
সে তো প্রায় কুড়ি বাইশ বছর আগেকার কথা। মনের কোন খোপটায় সুলেখার স্মৃতি লুকিয়ে ছিল এতদিন। বহু বছর তার নাম উচ্চারিত হয়নি, তার মুখখানাও বোধহয় অনেকের মনে নেই। সুলেখা দিল্লি চলে যাবার পর তাকে আর প্রতাপ একদিনও দেখেননি।
কোনো কিছুই একেবারে হারিয়ে যায় না, এই নিয়মেই বোধহয় সুলেখা আবার ফিরে এসেছে, এক কারিগরের কল্পনায়, যাদবপুরের এক দোকানে নমুনা শাড়ি পরানো হলুদ মূর্তি হিসেবে। প্রতাপের দৃঢ় ইচ্ছে হলো, এই মুতিটা কে বানিয়েছে তা খুঁজে দেখতেই হবে। লোকটি সুলেখাকে দেখেছে কখনো? না দেখে থাকলে, সে সুলেখাকে অবিকল কল্পনা করলে কী করে?
ধুতি-শার্ট পরা ঢ্যাঙা লোকটি পাশে এসে বললো, কেমন আছেন, স্যার?
গলার আওয়াজ শুনেই লোকটিকে মনে পড়লো। এ বছরের গোড়াতেই তিনখানা নতুন পাখা কিনেছিলেন প্রতাপ, তখন দেওয়া হচ্ছিল টেন পার্সেন্ট রিবেট। কম্পানিটা নতুন।
তিনটির মধ্যে দুটো পাখাই অচিরে গোলমাল করতে শুরু করে। বাঙালি জীবনের মতনই ধীর গতি, রেগুলেটারের শেষ পয়েন্টেও দুরন্ত হয় না। মমতা ঘোরতর আপত্তি করেছিলেন, কারণ পাখাগুলি কেনা হয়েছিল যাদের কথা চিন্তা করে, তারা খুব বেশি গতি পছন্দ করে। যাদবপুর অঞ্চলে পাখার প্রধান উপযোগিতা মশা তাড়াবার জন্যই।
স্ত্রীর তাড়নায় প্রতাপকে সেই পাখা বদলাতে যেতে হয়েছিল রাধাবাজারে। আবার ট্যাক্তি ভাড়া করে। বাড়িতে আর কোনো পুরুষ মানুষ তো নেই যে এইসব হেঁদো কাজ করবে। সেই দোকানে গিয়ে প্রতাপ শুনলেন যে পাখা সেখান থেকে বদল হয় না, দাম ফেরত দেবার তে প্রশ্নই নেই। তাঁকে যেতে হবে কম্পানির গুদামে। সেটা অবশ্য কাছেই।
সেই পাখা-কম্পানির গুদামে এই লম্বা ফর্সা লোকটি ইনচার্জ। বিশেষ কারণে একে মনে আছে। আজ তো ছুটির দিন নয়, এই বিকেলে সেই গুদামে বসে না থেকে লোকটি রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে কী করে?
সেদিন লোকটির ওপর প্রথমে খুবই রেগে গিয়েছিলেন প্রতাপ। একা ট্যাক্সি নিয়ে এতদূরে নতুন পাখা বদলানোর মতন বিরক্তিকর কাজ করতে গিয়ে এমনিতেই তাঁর মেজাজ খিঁচড়ে ছিল, তার ওপর এত কাণ্ড করে কম্পানির গুদামে পৌঁছোবার পর এই লোকটি বলেছিল, ছাপ্পান্ন ইঞ্চি পাখা আর স্টকে নেই। বদল হবে না। অথবা সাতদিন পর আবার আসতে হবে।
প্রতাপের ন্যায়-অন্যায় বোধ অমনি দপ করে জ্বলে উঠেছিল। ব্যাঙ্ক থেকে তোলা নতুন নগদ টাকা দিয়ে পাখা কিনেছেন। সাত বছরের গ্যারান্টি। এর মধ্যে কিছু অসদ্ভাব হলে কম্পানি পাখা মেরামত কিংবা বদল করতে বাধ্য। খবরের কাগজে তারা অনুরূপ শর্তে বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু এর মধ্যেও একটা বিরাট তঞ্চকতা আছে। প্রতাপ মজুমদারের মতন একজন রাশভারি মানুষকেও এই কম্পানির যে-কোন একজন খুদে কর্মচারী অবজ্ঞার সঙ্গে বলে দিতে পারে, আজ হবে না, সাতদিন পর আসবেন। সেই সাতদিন পরে গেলে আবার অনায়াসেই বলবে, আজও নতুন স্টক আসেনি, আপনি এক সপ্তাহ বাদ দিয়ে ঘুরে আসুন!
প্রতাপের মুখখানা রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছিল। তিনি অনেকগুলি ভর্ৎসনা বাক্য উচ্চারণ করার পর দৃঢ় স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি আজই অন্য পাখা চাই, না হলে আপনাদের নামে আমি মামলা করবো!
এই সব ক্ষেত্রেও ঐ খুদে কর্মচারী তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলতে পারে, যান যান মশাই, আপনার যা খুশী করুন গিয়ে। ও সব আমাদের ঢের দেখা আছে। আজ অবধি আমরা নতুন পাখা সম্পর্কে একটাও কমপ্লেন পাইনি…
কিন্তু এই লম্বা, ফ্যাকাসে ধরনের ফর্সা চেহারার কর্মচারীটি অন্য ধাতুর। সে কাঁচুমাচুভাবে বলেছিল, স্যার, আপনি বড় রেগে গেছেন, আপনার ব্লাড প্রেসার হাই মনে হচ্ছে, একটু বসুন! কারখানায় গো স্লো হলে আমরা কী করবো বলুন! বসুন না, কোল্ড ড্রিংকস এনে দেবো? স্যার, আপনার কি সিংহ রাশি? কিছু মনে করবেন না স্যার, মানুষের মুখ দেখে আমার অ্যাস্ট্রোলজি স্টাডি করার হ্যাঁবিট আছে…
পাখা উপলক্ষে প্রতাপকে ঐ গুদামে তিনবার যেতে হয়েছিল, কিন্তু তাঁর ক্রোধ উপশমে সাহায্য করেছিল ঐ লোকটি। এর সাহচর্যে তাঁর সময় মন্দ কাটেনি। এ আর পাঁচটা মানুষের মতন নয়। সারাদিন আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়, এমন একটা বদ্ধ গুমোট ঘরে বসেও এই লোকটি গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান ও মানুষের নিয়তি বিষয়ে চর্চা করে। নিজস্ব থিয়োরি আছে। প্রতাপের অতীত-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বেশ কিছু উদ্ভট কথা বলেছিল। প্রতাপের একেবারেই জ্যোতিষ-ট্যোতিষে বিশ্বাস নেই, শতকরা পঞ্চাশ ভাগ আন্দাজে মেলানো কথা শুনে তিনি মজা পান।
লোকটির নামও তিনি জানেন না। ঐ লোকটিও সম্ভবত প্রতাপের নাম-ধাম মনে রাখেন। পরস্পরের মুখ চেনা। তবু লোকটি এতদিন পর দেখা হলেও এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার, আপনার পাখা ঠিকঠাক চলছে তো? কেমন আছেন স্যার। কিছু মনে করবেন না, আপনার কি ইদানীং অকারণে মন খারাপ হয়? ফাঁকা ফাঁকা লাগে? মাটির নীচে যে-সব জিনিস জন্মায়, সেগুলো আপনি খাবেন না স্যার। সেদিনই বলেছিলাম, মনে আছে? মুখ দেখেই বুঝতে পারছি, আপনার ওপরে এখনো বৃহস্পতির প্রভাব চলছে, কচু, আলু, পেঁয়াজ, মুলো, আদা এসব একদম বাদ!
প্রতাপ হেসে বললেন, আপনার বাড়ি এদিকেই নাকি?
লোকটি উদাসীন ভাবে বললো, বাড়ি? না, আমার বাড়ি নেই। সেসব ছিল ওদিকে, নেহরু আর জিন্না সাহেব সে বাড়ি খেয়ে নিয়েছেন। এদিকে আর কিছু হয়নি।
প্রতাপ আবার জিজ্ঞেস করলেন, থাকেন কোথায়?
লোকটি বললো, গড়িয়া থেকে একটু এগিয়ে, অ্যানুয়াল লীভ নিয়েছি স্যার, ভাবছি একবার রমন মহর্ষির আশ্রমটা দেখে আসবো।
প্রতাপ তাকে নিজের বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে বললেন, এই তো কাছেই, আসবেন একদিন, গল্প করা যাবে…।
এই মানুষটি কোনোক্রমেই প্রতাপের সামাজিক সমস্তরের নয়। তবু তিনি ওকে আগ বাড়িয়ে নিজের বাড়িতে আসতে বললেন কেন? এ রকম তার স্বভাব তো নয়। তিনি হেরে যাচ্ছেন? জ্যোতিষচর্চার ওপর তাঁর একটু একটু করে ঝোঁক জন্মাচ্ছে নাকি? প্রতাপ আপনমনে একটু হাসলেন। আসলে ঐ লোকটিকেই তিনি স্টাডি করতে চান। ও প্রতাপের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত কেন, ওর তো কোনো স্বার্থ নেই। পয়সা চাইবার মতন লোক ও নয়। আসুক না বাড়িতে, মমতার হাত দেখানো-টেখানোতে খুব উৎসাহ আছে, সে খুশী হবে।
পরপর দুটি মিনিবাস এসে দাঁড়িয়েছে। প্রথমটি ছেড়ে দিয়ে তিনি দ্বিতীয়টিতে উঠলেন। তার কারণ গোলাপী শাড়ি পরা একটি যুবতী। তার মুখ তিনি ভালো করে দেখেননি, মেয়েটি ছাতা গুটিয়ে মিনিবাসের পাদানিতে একটি পা রাখার পর তিনি দেখলেন লাল রঙের চটি পরা একটি নিখুঁত পা, ঈষৎ উঁচু হয়ে ওঠা শাড়িতে ফসা, মাখন-কোমল গুলফ, সব মিলিয়ে চমৎকার একটা সামঞ্জস্য। অল্প বয়েস থেকেই তিনি সম্ভব হলে সুন্দর কোনো রমণীকে নির্বাচন করে বাসে-ট্রেনে ওঠেন, এখনো সেই অভ্যেসটি রয়ে গেছে। তাঁর এখন সাতষট্টি বছর বয়েস, তবু তিনি এ জন্য নিজের বিবেকের কাছেও লজ্জা বোধ করেন না। এ তো শুধু সৌন্দর্যের উপাসনা।
পিছন দিক থেকে সেই যুবতাঁকে দেখতেও যেন সুলেখার মতন। আজ বারবার তিনি সুলেখার আদল দেখছেন কেন? নিজেই আবার তৈরি করছেন সুলেখাকে? ঐ রমণীর মুখ দেখার জন্য প্রতাপ অবশ্য সামনে এগিয়ে গেলেন না, বেশ দূরত্ব রেখে বসলেন।
চুরানব্বই বছর বয়স্ক এক খরখরে, সক্রিয়, গান্ধীবাদী সমাজসেবককে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার আত্মোৎসর্গের সব ব্যাপারটাই তো বুঝলুম, কিন্তু আপনি ব্যক্তিগত জীবনে এত কঠোর সংযম পালন করলেন কী করে? এমনকি আপনার গুরু গান্ধীজীও তো কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা…
উত্তরে সেই মহৎ ব্যক্তিটি হেসে বলেছিলেন, মানুষের চিন্তার তো কোনো ছবি ওঠে না, তার কোনো রেকর্ডও থাকে না, তবু তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি বাবা। প্রায় ষাট বৎসর কোনো নারীর সঙ্গে সহবাস করিনি, সেটা ইচ্ছাকৃত ব্রহ্মচর্য বলতে পারো। নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেছি। সেখানে আর কোনোরকম ব্যক্তিগত কামনা-বাসনার স্থান না থাকাই উচিত, কেননা, নারী এলে বিষয়-সম্পত্তির মোহও এসে পড়ে। কিন্তু এখনো, এই বয়েসেও কোনো রূপবতী স্ত্রীলোক দেখলে মনে হয়, অন্য পুরুষরা দূরে সরে থাক, সে আমার পাশে দাঁড়াক, আমার সঙ্গে দুটো কথা বলুক এই ইচ্ছেটাকে তুমি কী বলবে, বাবা, সংযম না লোভ?
খবরের কাগজে এই বিবরণটি পড়েই প্রতাপের মনে হয়েছিল, সুলেখার সঙ্গেও আমার ঠিক ঐ রকম সম্পর্কই ছিল। সুলেখা নিভৃতে দুটো কথা বললেই তিনি বড় আনন্দ পেতেন। ঐ বৃদ্ধ বড় সাংঘাতিক কথা বলেছেন। তবে, চুরানব্বই বছর বয়েসেও এমন আকাঙ্ক্ষা থাকে?
হাজরা মোড়ে নেমে প্রতাপকে খানিকটা হাঁটতে হলো। পাতাল রেলের জন্য এদিককার রাস্তার এখনো লণ্ডভণ্ড অবস্থা। চেনা জায়গাগুলো অচেনা লাগে। প্রত্যেকটি মানুষই যে সমাজে বাস করে, সেই সমাজের নিরন্তর সমালোচনাও করে যায় মনে মনে। এইভাবেই জনমত জিনিসটা নিঃশব্দে গড়ে ওঠে। প্রতাপ ভাঙা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে বলতে লাগলেন, এত দেরি হয় কেন, সব কিছু ঠিকঠাক হতে এত দেরি লাগে কেন?
তাঁর মনটা আজ মাঝে মাঝে উৎফুল্ল হয়ে উঠছে, যদিও হালকা ফুরফুরে নয়, তলায় তলায় রয়েছে একটা প্রচ্ছন্ন অভিমানের বিরুদ্ধতা, অবশ্য তিনি নিজেও সচেতন নন সে ব্যাপারে। আজ বিকেলের নতুন রকমের আকাশ তাঁর অজান্তেই তাঁর মনটাকে একটা নদীর জোয়ার-ভাঁটায় রূপান্তরিত করেছে।
বিমানবিহারীর বাড়ির সামনে এসে প্রতাপ থমকে গেলেন। তিনি তো এখানে আসতে চাননি। কোথায় যেতে চেয়েছিলেন? হ্যাঁ, বাড়ি থেকে বেরুবার সময় একবার ভেবেছিলেন গঙ্গার ধারে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখবেন। অন্যমনস্কভাবে নেমেছেন হাজরায়। বাড়িতে একা মন টিকছিল না। গঙ্গার ধারে চুপ করে বসে থাকতে খারাপ লাগে না, ওখানে বড় একটা চেনাশুনো কারুর সঙ্গেও দেখা হয় না।
সেই নকশাল আমলে খুব বোমাবাজি হতো এই গলির মধ্যে। একবার বেশ বড় রকমের চুরিও হয়েছিল। বিমানবিহারীর বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটা আর নেই, তিনি তখন একটা উঁচু পাঁচিল তুলে দিয়েছেন। বড্ড বেমানান দেখায়। বাড়িটার আদি নকশার সঙ্গে এই দেয়ালের–ঘেরাটোপ একেবারে খাপ খায়নি, কিন্তু উপায়ই বা কী, এটা সাময়িকতার দায়। যে-দেশে অর্ধেকের বেশি মানুষ শুয়োরের খোঁয়াড়ের মতন খুপরিতে কোনোক্রমে মাথা গুঁজে থাকে, সে দেশে একটা সাধারণ তিনতলা বাড়িকেও দুর্গে পরিণত করতে হয়। শুধু পাঁচিল নয়, বসানো হয়েছে একটা লোহার গেট, নিযুক্ত হয়েছে একজন দারোয়ান।
দারোয়ানটি গেটের কাছে ছিল না, কোথা থেকে যেন প্রতাপকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে একটা লম্বা সেলাম দিয়ে বললো, আচ্ছা হ্যায়, সাব?
প্রতাপ নিঃশব্দে সরে পড়তে চাইছিলেন। এখন দাঁড়াতেই হলো। তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, হাঁ। তোমাদের সব খবর ভালো।
গেটের তালা খুলতে খুলতে দারোয়ানটি জানালো যে বিমানবিহারী বাড়িতে নেই। বাবু আর মা আজ সকালেই কৃষ্ণনগর গেছেন।
সেই মুহূর্তে প্রতাপের মুখ দেখলে মনে হবে, কেউ যেন তাঁকে একটা অতি নিষ্ঠুর, কটু, অপমানজনক কথা বলেছে। বিমানবিহারীর এখন বাড়িতে না-থাকাটা যেন একটা বিশ্বাসঘাতকতা। প্রতাপ কোনো খবর দিয়ে আসেননি, তিনি ইদানীং এ বাড়িতে যখন তখন আসেন না। তিনি যে আজ আসবেন, তার কোনোরকম ইঙ্গিতও বিমানবিহারী পাননি। প্রতাপের বাড়ির টেলিফোন একমাস ধরে খারাপ। তবু প্রতাপ বিক্ষুব্ধ হলেন। তাঁর চরিত্রই যে এরকম। তিনি ভাবলেন, বিমান কেষ্টনগরে গেছে, নিশ্চয়ই গাড়িতেই গেছে, একবার তো সে আমার বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারত, আমি যাবো কি না?
দারোয়ানটি বললো, আইয়ে, অন্দর আইয়ে।
দারোয়ান জানে, বিমানবিহারী না থাকলেও প্রতাপের পক্ষে এ বাড়িতে এসে বসার বাধা নেই। প্রতাপদের মতন তো নয়, এ বাড়িতে অনেক লোক, সস্ত্রীক বিমানবিহারী কলকাতার বাইরে গেলেও সদরে তালাচাবি লাগান না।
প্রতাপ বললেন, না, আজ আর বসবো না। বাবুরা কবে ফিরবেন?
বিমানবিহারী দিন সাতেকের জন্য গেছেন শুনে প্রতাপ আরও দাহ বোধ করলেন। বিমান তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যাবার প্রস্তাব পর্যন্ত দিল না? প্রতাপের পক্ষে এটাই ছিল বেড়াতে যাবার প্রকৃষ্ট সময়। মমতা হরিদ্বারে গেছেন, অন্তত দু’সপ্তাহের মধ্যে ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রতাপের কলকাতায় থাকার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
বিমান তাঁকে অবজ্ঞা করছে? তাই যদি হয়, তা হলে আর রইলো কে? বৃদ্ধ হলে কুকুর-বিড়ালের গা থেকে লোম খসে যাবার মতন মানুষেরও বন্ধুবান্ধব খসে যায়। নিজের স্বভাবের তীব্রতার জন্যই প্রতাপের বন্ধু সংগ্রহ খুবই কম। কেউ যদি তুল্যমূল্য ব্যবহার না করে, সামান্য অমনোযোগের ভাব দেখায়, তা হলেই প্রতাপ তার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখেন না। সম্পর্ক হারাতে হারাতে প্রতাপ প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় পৌঁছে গেছেন। এবার বোধহয় মমতাকেও হারাতে হবে। মমতার সঙ্গে প্রায়ই মতের অমিল হচ্ছে আজকাল।
প্রতাপ ফেরার আগেই পেছন থেকে একটি সরু, সুরেলা কণ্ঠ বলে উঠল, প্রতাপকাকা!
প্রতাপ মুখ ফিরিয়ে দুই বোনকে দেখলেন পাশাপাশি। ট্যাক্সি থেকে নেমেছে, হাতে অনেকগুলি প্যাকেট, নিশ্চয়ই নিউ মার্কেট থেকে এলো। এদের দেখেই প্রতাপের ক্ষোভ অনেকটা মিলিয়ে গেল। তিনি হালকা স্বরে বললেন, দুই প্রজাপতি, কোথায়, কোন কাননে গিয়েছিলে?
বুলির বেশ ভার ভরন্ত চেহারা হয়েছে, রূপ অনেক খুলেছে। একটা রাগী রাগী ভাব; স্বভাবটা অবশ্য আগেরই মতন উচ্ছল। প্রতাপকাকাকে সে গুরুজন বলে বাড়াবাড়ি সম্মান করে না। সে বললো, নন্দন কানন। এই, তুমি চলে যাচ্ছিলে যে?
প্রতাপ বললেন, বাড়িতে কেউ নেই শুনলাম। তুই কবে এলি বম্বে থেকে?
বুলি বললো, পরশু। কাল আমার টিভি-তে একটা রেকর্ডিং আছে। সুজন সিং, প্যাকেটগুলো ধরো না! প্রতাপকাকা, ভেতরে চলো।
ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে অলি হাসি হাসি মুখ করে চেয়ে আছে প্রতাপের দিকে। হালকা ঘি রঙের শাড়ী পরা, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। চেহারাটা এখনো লম্বা, ছিপছিপে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা হিসেবে বুলির বেশ খানিকটা নাম হয়েছিল, কিন্তু বিয়ের পর তাকে চলে যেতে হলো বম্বেতে। তবু গানের টানে সে প্রায়ই আসে কলকাতায়। মাত্র দু’মাস আগেও একবার এসেছিল।
বুলি বললো, আমি এবার দু’সপ্তাহ থাকবো। এবার যাওয়া হবে সুন্দরবন? তুমি বড় মিথ্যুক হয়েছে আজকাল। খুব যে বলেছিলে লঞ্চ জোগাড় করে দেবে!
তুমি একা একা মাঝে মাঝে সুন্দরবন যাও!
আগেরবার বুলি যখন এসেছিল, তখন কথায় কথায় একদিন সুন্দরবন বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা হয়েছিল। অলি আর বুলি দুই বোনেরই খুব উৎসাহ। কলকাতার এত কাছে, তবু ওরা সুন্দরবন দেখেনি। টাইগার প্রজেক্টের এখন যে ডিরেক্টর তার বাবা প্রতাপের সহকর্মী ছিলেন, সেই সুবাদে প্রতাপ লঞ্চের ব্যবস্থা করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তারপর কথাটা চাপা পড়ে যায়। বুলির স্বভাবই এই, সে প্রথমেই অভিযোগের সুরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
প্রতাপ বললেন, তুই তো আর আমাকে মনে করিয়ে দিসনি।
বুলি বলল, আহা-হা, তারপর আর তুমি এলেই না। তুমি আমার আর খোঁজও নিলে না!
প্রতাপ বললেন, তুই কলকাতায় এসে তো আমার একটু খবর নিতে পারিস। তুই কখন আসিস, চলে যাস, আমি জানতেই পারি না। এখন যে অনেকদূরে থাকি!
অলি বললো, এমন কিছু দূর না! আমাদের ঐ যাদবপুর যাবার চেয়ে তোমার পক্ষে এখানে আসা খুব সহজ। বাবা বলছিল, তোমার আজকাল পাত্তাই পাওয়া যায় না!
অলি বলল, কাল রাত্তিরে কৃষ্ণনগর থেকে একটা টেলিগ্রাম এসেছিল, বাবাকে তাই আজ সকালেই তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে হলো। বাবা একবার বলেছিল, যদি তোমাকে খবর দেওয়া যায়। কিন্তু আজই দুপুরে কোর্টে মামলা আছে, বাবাকে তার আগে পৌঁছতে হবে, সময় ছিল না।
সম্পূর্ণ যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা। অলি ঠিকই বুঝেছে যে বিমানবিহারী কিছু না জানিয়ে হঠাৎ কৃষ্ণনগরে চলে গেছেন শুনে প্রতাপের মনে খটকা লাগবে। কৃষ্ণনগরের সম্পত্তি নিয়ে কিছুদিন ধরে বেশ শরিকী ঝাট চলছে।
বুলি বলল, তোমার নতুন বাড়ি তো আমি দেখিইনি। হাউস ওয়ার্মিং পার্টি দেবে না? কাল টিভি স্টেশন থেকে তোমার ওখানে যেতে পারি। কাকিমাকে বলে রাখবে, ওঁর হাতে তৈরি মটরশুটির কচুরি খাবো।
প্রতাপ বললেন, কাল আসতে পারিস। কিন্তু তোর কাকিমা এখানে নেই। হরিদ্বার গেছে।
বুলি সঙ্গে সঙ্গে ভুরু কুঁচকে বললো, হরিদ্বার গেছে কেন? একা?
অলি বললো, মুন্নিরা এখন হরিদ্বারে থাকে। কাকিমা সেখানে গেছেন।
বুলি তবু অবাক ভাবে বললো, কাকিমা একা গেল কেন? প্রতাপকাকা, তুমি নিশ্চয়ই কাকিমার সঙ্গে ঝগড়া করেছে।
প্রতাপ হাসলেন। খানিকটা শ্লেষের সঙ্গে বললেন, তোদের কাকিমা এখন স্বাধীন। এখন আর আমাকে সঙ্গে নিতে চায় না। শোন, তোরা বাজার টাজার করে এলি, এখন বিশ্রাম নিবি, আমি আর এখন বসবো না। পরে একদিন আসবো।
বুলি বলল, আমাদের মোটেই বিশ্রাম নেবার দরকার নেই। তুমি বসবে এসো। প্রতাপ বললেন, আমার একটা কাজ আছে রে। যেতে হবে!
অলি প্রতাপের বাহু ছুঁয়ে বললো, যতই কাজ থাক, একটু না বসে যেতে পারবেন না। চা খাবেন না?
অলি জোর করলে প্রতাপ দুর্বল হয়ে পড়েন। একমাত্র অলিই তাঁর ওপর জোর করতে পারে।
প্রতাপ বললেন, চট করে এক কাপ চা খেয়েই উঠবো কিন্তু!
দোতলায় এসে অফিস ঘরে বসলেন প্রতাপ। বড় হল ঘরটায় পার্টিশান দিয়ে তিনটে চেম্বার করা হয়েছে। তার মধ্যে একটা চেম্বারে অলি বসে। ব্যবসা বড় হয়েছে, কয়েকজন কর্মচারী রাখা হয়েছে। তারা বোধহয় একটু আগেই চলে গেছে। চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর বিমানবিহারী অনেকবার প্রতাপকে বলেছিলেন তাঁর অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশানের ভার নিতে। প্রতাপ কিছুতেই রাজি হননি। প্রস্তাবটা উড়িয়ে দিয়ে প্রতাপ বলেন, এতকাল চাকরি করেছি, এবার পরিপূর্ণ ছুটি উপভোগ করতে চাই, বুঝলে!
কথাটা যে সত্যি নয়, তা প্রতাপও জানেন। কোনো রকম কাজ না থাকলে ছটি উপভোগ করাও যায় না। কিন্তু বিমানবিহারীর সঙ্গে কোনোরকম বৈষয়িক সম্পর্কে যেতে চান না প্রতাপ, বই অনুবাদও বহুদিন বন্ধ করে দিয়েছেন।
বুলি বললো, একটু বসো, কাকা, আমি আসছি ওপর থেকে।
অলি বললো, চা-টা আমি তৈরি করে আনছি। জগদীশ নেই, পারুলের মায়ের চা আমার পছন্দ হয় না।
প্রতাপ হাসিমুখে তাকালেন অলির দিকে। এর আগের দিন পারুলের মায়ের তৈরি চা খেয়ে প্রতাপ প্রসন্ন হননি, অলি ঠিক মনে রেখেছে। চায়ের ব্যাপারে প্রতাপ খুব শৌখীন।
অলির সবদিকে নজর। একসঙ্গে এত কাজ করে অলি, তবু-তার কোনো ব্যাপারেই ক্লান্তি নেই। এখানে প্রকাশনার অনেকখানি দায়িত্বই নিয়েছে অলি, একটা কলেজে সে আবার। ইংরিজির লেকচারার, আবার বহরমপুর-মুর্শিদাবাদের দিকে কোনো একটা সমাজসেবা
প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও সে জড়িত। তবু তার সময়ের অভাব হয় না। প্রতাপ বেশ কিছুদিন এ বাড়িতে না এলেই অলি নিজে থেকে খোঁজ নিতে যায় যাদবপুরে। একদিন মমতা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, হঠাৎ রক্তস্রাব শুরু হয়েছিল, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। প্রতাপ দিশেহারা বোধ করছিলেন, যে-ডাক্তারটি এখন তাঁদের পারিবারিক চিকিৎসক, তিনি ছুটিতে গিয়েছিলেন পুরীতে, পাড়ার একজন নতুন ডাক্তারকে ডেকেও প্রতাপ ভরসা পাচ্ছিলেন না। বাড়িতে অন্য কোনো স্ত্রীলোক নেই, এইসব অসুখে পুরুষ মানুষ কতটা কী করতে পারে? ঠিক সেই সময়ে উপস্থিত হয়েছিল অলি। কয়েক মিনিটের মধ্যে সে সমস্ত ভার নিয়ে নিল। এক ঘণ্টার মধ্যে একটা নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হলো মমতাকে। আর কোনো অসুবিধেই হয়নি। মমতা অনেক ব্যাপারেই নির্ভর করেন অলির ওপর।
অথচ বাবলু যখন এসেছিল, অলি তখন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতো। বাবলুর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে সে কথা বলেছে ঠিকই, কিন্তু সেই সব কথাই অর্থহীন, অবশ্য শর্মিলার সঙ্গে তার বেশ ভাব হয়েছিল।
চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে ফিরে এলো অলি। প্রতাপ তার দিকে একবার চেয়েই অপরাধীর মন মাথা নীচু করলেন।