2 of 2

৬৩. লাল রঙের গাড়িটার ওপর

লাল রঙের গাড়িটার ওপর পাতলা বরফ বিছিয়ে আছে। যেন একটা সাদা সিল্কের চাঁদর দিয়ে গাড়িটা ঢাকা। ডিসেম্বরের গোড়া থেকেই বেশ ঘন তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে, এ বছর একেবারে সাদা ক্রিসমাস হবে, মাত্র আর দুদিন বাকি। চতুর্দিকে ছুটি ছুটি রব উঠে গেছে। বাতাস এমন নির্মল যে বড় একটা নিশ্বাস নিলে মনে হয় যেন বুকটা জুড়িয়ে গেল।

পায়ে গ্যালশ, অর্থাৎ গামবুট, ভারি ওভারকোটটার কলার তুলে দেওয়া, কান ঢাকা টুপি, হাতে একটা বেলচা নিয়ে বরফ পরিষ্কার করছে অতীন। রাস্তার বরফ সাফ করার ভার মিউনিসিপ্যালিটির, বাড়ির সামনের ড্রাইভওয়ে পরিষ্কার করার দায়িত্ব সত্যদা এক একদিন এক একজন ভাড়াটেকে ভাগ করে দিয়েছেন। অতীন ভোরে উঠতে পারে না। নির্দিষ্ট দিনগুলিতে শর্মিলা তাকে ফোন করে জাগিয়ে দেয়। এই মাসেই অতীনের নিজস্ব টেলিফান এসেছে।

রাস্তার দু ধারের গাছগুলিতে ঝুলন্ত সরু সরু বরফের অজস্র সোনাঝুরি, সকালের রোদে ঝলমল করছে সব কিছু। আকাশ এখন পরিষ্কার, কিন্তু কখন যে হঠাৎ আবার তুষারপাত শুরু হবে, তার কোনো ঠিক নেই।

গাড়ির ভেতরে ঢুকে হিটার চালিয়ে দেবার একটু পরেই গাড়িটা গরম হয়ে গলিয়ে দিল তুষারের আবরণ, বেশ নিজে নিজেই ধোয়া হয়ে গেল। এক টুকরো ফ্লানেল দিয়ে অতীন আদর করে মুছতে লাগলো গাড়িটাকে। এর মধ্যেই গাড়িটা তার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে, থার্ড হ্যাণ্ড গাড়ি। কিন্তু এর মধ্যে একদিনও গড়বড় করেনি। নিউ ইয়র্কে বেকার থাকার সময় অতীন মাকে চিঠি লিখেছিল যে সে একটা লাল রঙের গাড়ি কিনেছে। তখন গাড়ি কেনা দূরে থাক, টিউব ট্রেনের টিকিট কাটার জন্যই তাকে পয়সা ধার করতে হতো সিদ্ধার্থর কাছে। এতদিন পর অতীন যে গাড়িটা কিনলো, সেটার রং সত্যিই লাল।

নিছক শখে কেনেমি, গাড়িটা অতীনের কাছে এখন জামা-জুতোর মতনই প্রয়োজনীয় জিনিস। বাড়ি থেকে তার অফিস এগারো মাইল দূরে, বাসে বা ট্রেনে প্রতিদিন যাতায়াত করতে যা খরচ পড়ে তার চেয়ে গাড়ির খরচ কম। তা ছাড়া প্রতিদিন সময় বাঁচে। টিউব স্টেশান। থেকে তার অফিস প্রায় পনেরো মিনিট হাঁটার দূরত্বে।

চাকরি পাওয়ার জন্য অতীনের কোনো চেষ্টাই করতে হয়নি, এমনকি একটা দরখাস্তও লিখতে হলো না। ইউনিভার্সিটিতেই বিভিন্ন বড় বড় কম্পানির প্রতিনিধিরা আসে, পি-এইচ ডি-র ছাত্রছাত্রীরা কে কীরকম কাজ করছে তার খবরাখবর নেয়। তিনটি কম্পানির প্রতিনিধির কাছ থেকে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিল অতীন, তাদের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে খেতে সে চাকরির শতাদি আলোচনা করেছে। সেই সময় তার মনে পড়ছিল, নিউ ইয়র্কের এক হোটেলের সুইমিং পুলে এক ব্যাটা সাহেবের সঙ্গে ইন্টারভিউ দেবার কথা। কত অপমান সহ্য করতে হয়েছে সেসব দিনগুলিতে। সিদ্ধার্থর সুট ধার করে পরে যেত, নিখুঁতভাবে বাঁধতে টাইয়ের গিট। আর এখন টাই-ফাইয়ের বালাই নেই, জিনস আর পাকা পরেই সে লাঞ্চ খেতে গেছে। এখন তার গায়ে একটা নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পি-এইচ ডি শেষ করেই তার দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল না! চাকরিটা নেবার আগে দিন তিনেক অতীন খুব মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে মুখ ভ্যাংচাতো। শর্মিলা তাকে বুঝিয়েছে। শর্মিলা সেই কয়েকটা দিন প্রায় সর্বক্ষণ তার সঙ্গে ছিল। এখনো অতীনের ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই, জোর করে দেশে ফেরা মানে আত্মহত্যার সমান। অতীনের বাবা-মাও তাকে ফেরার কথা একবারও লেখেন না।

সোমেনের কাছে এসে উঠেছে তার মামালে ভাই শমীক, সে সদ্য পাশ করে এসেছে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। তার কাছ থেকে পশ্চিমবাংলার রাজনীতির অবস্থা শুনলে শিউরে উঠতে হয়। নকশালপন্থীরা এখন যাকে বলে অন দা রান। বড় নেতাদের মধ্যে এখনও একমাত্র চারু মজুমদারই ধরা পড়েননি। কানু সান্যাল, সুশীতল রায়চৌধুরী, অসীম চ্যাটার্জিরা চারুবাবুর নীতির বিরোধিতা করতে শুরু করেছেন জেলে বসেই, খতম আন্দোলনকে এখন বলা হচ্ছে ভুল, মাও সে তুং খতম বলতে খুন বোঝাননি, নতুন ব্যাখ্যায় খতম মানে নিরস্ত্রীকরণ, ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া। অর্থাৎ যাকে ইচ্ছে তাকে খুন করাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু বড় দেরিতে এসেছে এই উপলব্ধি। এখন চলেছে খুনের বদলা খুনের পালা। সি পি এমের ছেলেরা ঠিক করেছে, তাদের একজন খুন হলে প্রতিশোধ হিসেবে তিনজন নকশালকে শেষ করে দেওয়া হবে। কংগ্রেসের ছেলেরা এক একটা পাড়া ধরে নকশাল ছেলেদের খুঁজে বার করে প্রকাশ্যে হত্যা করছে। পুলিশও মারছে নির্বিচারে। এখন যে সব ছেলেমেয়ের গায়ে সামান্য নকশাল গন্ধ আছে, তাদেরই জীবন বিপন্ন।

অতীনের তুলনায় শমীকের বয়েস কম, কিন্তু সে অতীন মজুমদারের নাম জানে। অতীন ঠিক নেতা ছিল না, তবু বিভিন্ন পোস্টারে ও দেওয়াল লিখনে নাকি তার নামে লাল সেলাম জানানো হয়েছে। অনেকের ধারণা অতীন মজুমদার মৃত, কারুর কারুর ধারণা সে নিরুদ্দিষ্ট। এই সময় অতীন মজুমদার দেশে ফিরলে তাকে ফুলের মালা কিংবা লাল সেলাম দিয়ে সংবর্ধনা জানাবার জন্য কেউ থাকবে না। বরং তার জন্য অপেক্ষা করবে ছুরি, বন্দুক অথবা জেলের দরজা।

অতীন তার সাইকেলটা শমীককে দিয়ে দিয়েছে। ছাত্র অবস্থায় সাইকেল নিয়ে ঘোরা যায়। কিন্তু সাইকেল চেপে রোজ অফিস যাওয়া যায় না। তা ছাড়া রোজ বাইশ মাইল সাইকেল চালানো কি চাট্টিখানি কথা! আসলে গাড়ি কেনার ব্যাপারে অতীনের একটা লজ্জাবোধ আছে, সেইজন্য সে মনে মনে প্রায়ই এই যুক্তিগুলো আওড়ায়। গাড়িটার দাম সে শোধ করে দিয়েছে এই মাসেই, এটা এখন তার নিজস্ব গাড়ি, এর মধ্যেই গাড়িটা তার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে। দেখে কেউ চট করে বুঝতে পারবে না যে এটা পুরোনো গাড়ি।

এই ছুটিতে প্রথম সে গাড়িটা নিয়ে লং ড্রাইভে যাবে। সিদ্ধার্থ ক্রিসমাসের ছুটিটা একসঙ্গে কাটাবার জন্য নেমন্তন্ন করেছে অতীনদের। প্রথমে দুদিন থাকা হবে নিউ ইয়র্কে, তারপর বাফেলো। পাঁচুদা-শান্তা বউদিরা এখন বাফেলোতে আছেন। ওদের ওখানে নিউ ইয়ার্স ইভের বিরাট পাটি। মাঝখানে ওরা নায়েগ্রা জলপ্রপাত দেখে ঘুরে আসবে টরোন্টো। এতদিন হয়ে গেল, অতীন আমেরিকার কোথাও বেড়াতে যায়নি, কিছুই প্রায় দেখেনি। শমিলার মামাতো বোন সুমিও যাবে সঙ্গে, মেরিল্যাণ্ড থেকে অলিকে তুলে নেওয়া হবে।

ডিসেম্বরের গোড়া থেকেই সবাই জিজ্ঞেস করে, ছুটিতে কোথায় যাচ্ছো? এদেশে অনেকেই প্রায় প্রতি উইক এণ্ডে বাইরে যায়, আর ক্রিসমাসের লম্বা ছুটিতে চতুর্দিকে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। দেশে পুজোর ছুটির মতন। অতীনের মনে পড়ে প্রত্যেক পুজোর ছুটিতে বাড়িসুদ্ধ সকলে মিলে দেওঘরে যাওয়া হতো। শুধু দেওঘরেই প্রত্যেকবার। আর কোথাও না। কারণ দেওঘরে ঠাকুমা থাকতেন। দাদার মৃত্যুর পর আর যাওয়া হয়নি। একটি মৃত্যু বদলে দিয়েছিল অনেক কিছু।

এদেশে ট্রেনে তেমন ভিড় হয় না, সবাই বেরিয়ে পড়ে গাড়ি নিয়ে। শর্মিলা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে, অতীন মদ খেয়ে গাড়ি চালাতে পারবে না। গত বছর ক্রিসমাস থেকে নিউ ইয়ার্স ডে-র মধ্যে সাড়ে পাঁচ শো লোক গোটা আমেরিকায় মারা গিয়েছিল শুধু গাড়ির অ্যাকসিডেন্টে। নিজে মদ না খেলেও অন্য মাতালরা গাড়িতে এসে ধাক্কা মারতে পারে, সে ঝুঁকি তো রয়েছেই।

গাড়িটা মুছে পরিষ্কার করে অতীন দোতলায় উঠে এসে ব্রেক ফাস্ট বানাতে লাগলো। দুটো ডিম সেদ্ধ, খানিকটা স্যালামি, চারখানা টোস্ট, দু কাপ কালো কফি। কফির সঙ্গে আবার একটুকরো কেক। সকালবেলাটায় অতীন বেশি করে খেয়ে নেয়, দুপুরে সে লাঞ্চ খায় না, তাতে শরীরটা ঝরঝরে থাকে, মাঝে মাঝে চা খায়, তার সঙ্গে বড় জোর একটা স্যাণ্ডউইচ। নতুন চাকরিতে ঢুকেই অতীনকে খুব খাটতে হচ্ছে। প্রথম থেকেই তাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে ল্যাবে। এই ওষুধ কম্পানির নিজস্ব রিসার্চ ল্যাব তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও বড়।

রাত্তিরের খাওয়াটা সে আর শর্মিলা একসঙ্গে খায়। হয় কোনো রেস্তোরাঁয়, অথবা শর্মিলা রান্না করে। এখন সুমির সঙ্গেও অতীনের বেশ ভাব হয়ে গেছে, সুমির রান্নার হাত শর্মিলার চেয়ে অনেক ভালো, অবশ্য সুমি প্রায় সন্ধেতেই বাড়ি থাকে না, সে একটি মারাঠী ছেলের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে।

অফিস থেকে অতীন আর নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফেরে না, সোজা শর্মিলাদের ওখানে চলে যায়। ওখানে স্নান করে। শর্মিলা টি ভি আসক্ত, দুটো সিরিয়াল সে কিছুতেই মিস করে না। ‘ডালাস’ থাকলে শর্মিলা কিছুতেই বাড়ি থেকে বেরুবে না, রান্না করতে করতে টি ভি দেখবে।

আজ শর্মিলা কিছু কেনাকাটি করবে বলে রেখেছে, আজ বাইরে খাওয়া। শর্মিলাদের বাড়ির সামনেটা বরফে ঢাকা। এ বাড়িতে প্রায় শুধু মেয়েরাই থাকে, এরা বরফ পরিষ্কার করে না। গাড়িটা রাস্তায় পার্ক করে অতীন দৌড়ে এসে পর্চে উঠলো, তারপর পা ঠুকে ঠুকে বরফ ঝাড়তে লাগলো। এর মধ্যেই মাইনাস টেন, তাপমাত্রা রোজই নামছে। একটু আগে ঝিরিঝিরি তুষারপাত শুরু হয়েছে।

দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো সুমি। গলার কাছে ফার লাগানো একটা সুন্দর নীল রঙের ওভারকোট পরেছে, চুল বাঁধারও কী যেন একটা কায়দা করেছে নতুন ধরনের। সুমির নতুন বন্ধু ভিজেয় শাঠে ভালো ছবি আঁকে, সে সুমির একটা বড় পোর্ট্রেট আঁকছে কয়েকদিন ধরে।

হাই বলে সুমি এদেশী কায়দায় অতীনের গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো, তারপর বললো, তুমি যেই এলে, অমনি স্নো পড়তে শুরু করলো!

অতীন বললো, একটু স্নোর মধ্যে হাঁটলে তোমার গালটা আরও লালচে দেখাবে। তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসবো, সুমি?

সুমি বললো, নতুন গাড়ি, তাই সবাইকে তুমি লিফট দিচ্ছো? না, আজ আমার দরকার নেই। তোমরা কপোত-কপোতী নিরিবিলিতে থাকো, আমি দশটার পর ফিরবো!

অতীন তবু বললো, শর্মিলা তো শপিং করবে, আমরা এক্ষুনি বেরুবো। তোমাকে বিজয়ের ওখানে নামিয়ে দিতে পারি।

এ কথার উত্তর না দিয়ে সুমি অতীনের চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, এইবার বুঝবে মজা!

তারপর সে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছুটে গেল।

অতীন একটু হকচকিয়ে গেল, সুমির কথাটার মানে সে বুঝতে পারলো না। কিসের জন্য মজা বুঝবে? চাকরিটা ভালো পেয়েছে বলে? সে তো দু মাস হয়ে গেল।

ওপরে উঠে এসে দেখলো, শর্মিলা এখনো বেরুবার জন্য তৈরি হয়নি বিছানার ওপর একটা বই খোলা, টি ভিও চলছে, শর্মিলা পরে আছে একটা পাতলা হাউসকোট। অতীনকে দরজা খুলে দিয়ে সে আবার বিছানায় গিয়ে বসে পড়লো।

অতীন ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করলো, এ কী, তুমি দোকানে যাবে না?

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শর্মিলা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অতীনের দিকে। যেন সে অতীনকে নতুন দেখছে। অতীন মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,কী? তাও কোনো উত্তর নেই। এক একটা দিন মেয়েরা এরকম রহস্যময়ী হয়ে যায়, তাদের ভাবভঙ্গি কিছুই বোঝা যায় না।

ওভারকোটটা খুলে অতীন একটা চেয়ারের ওপর রাখলো। তারপর জ্যাকেট, সোয়েটারও খুলতে লাগলো। ঘরের ভেতরটা বেশ গরম হয়ে আছে, শর্মিলাদের বাড়িটা পুরোনো আমলের। প্রত্যেক ঘরে ফায়ার প্লেস রয়েছে, সেখানে অবশ্য কাঠের আগুন জ্বলে না, একটা ইলেকট্রিক হীটার গনগন করছে।

অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে অতীন আবার জিজ্ঞেস করলো, তোমার শরীর খারাপ?

শর্মিলা বললো, বাবলু, আমার পাশে এসে একটু বসো।

জুতোটা খুলে অতীন শর্মিলার পাশে এসে শুয়ে পড়ে বললো, কী ব্যাপার। আজ আর বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না? দ্যাটস ফাইন ফর মি।

শর্মিলা বললো, বাবলু, আমি যদি হঠাৎ মরে যাই?

শর্মিলাকে চুমু খেতে গিয়েও থেমে গেল অতীন। কনুইতে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে শর্মিলার চোখমুখ দেখলো, কোনো অসুস্থতার লক্ষণ তার চোখে পড়লো না। শর্মিলার চোখের পাতা। তিরতির করে কাঁপছে।

সে গম্ভীর গলায় বললো, মরে গেলে আর কী হবে, হারিয়ে যাবে! হঠাৎ মরার শখ হলো। কেন?

আবার কোনো উত্তর না দিয়ে অতীনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো শর্মিলা। অতীনের মুখে চেপে রইলো মুখখানা। এরকম সময় কী কথা বলতে হয় অতীন জানে না তার ইচ্ছে করছে খুব কষে একটা ধমক লাগাতে। কিন্তু অতীন একটু জোরে কথা বললেই শর্মিলা তাকে বলে মেল শোভেনিস্ট। আর একবার যদি শর্মিলা অভিমান করে, তা হলে সেই অভিমান ভাঙাতে অতীনের তিন-চারদিন লেগে যাবে। সে চুপ করে থেকে শর্মিলার পিঠে হাত বোলাতে লাগলো।

একটু পরে শর্মিলা ধড়মড় করে উঠে পড়ে চলে গেল বাথরুমে। অতীন চিৎ হয়ে শুয়ে একটা সিগারেট ধারালো। এ সব কী হেঁয়ালি হচ্ছে, সে কিছুই ধরতে পারছে না। পুরুষরা এরকম পারে না, তারা তাদের প্রত্যেকটি আচরণের একটা না একটা ব্যাখ্যা দিয়ে যায় সব সময়। ভুল বা মিথ্যে হলেও একটা কিছু যুক্তি সাজাবার চেষ্টা থাকে। হয়তো সামান্য কোনো ব্যাপার নিয়ে শর্মিলার মন খারাপ হয়েছে। অতীন তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলো, তার ব্যবহারে কোনো ত্রুটি হয়েছে কি না। আজ সকালেও শর্মিলার সঙ্গে টেলিফোনে গল্প হয়েছে, তখন সে ভালো মেজাজেই ছিল। অবশ্য, কখনো কখনো দু তিনদিন, বা কয়েক সপ্তাহ আগের কোনো ঘটনা মনে পড়ে যাওয়াতেও শর্মিলা ব্যাকুল হয়ে পড়ে।

হঠাৎ অতীনের কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো। অলি কি কিছু বলেছে? অলির সঙ্গে শর্মিলার প্রায়ই টেলিফোনে কথা হয়, ওদের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব।

অতীনের মুখখানা কুঁচকে গেল। সে এক হাতের আঙুল চালাতে লাগলো চুলের মধ্যে। বাথরুমে অবিরাম কলের জল পড়ার শব্দ হচ্ছে। কল খুলে রেখে কি শর্মিলা চুপ করে বসে আছে?

যখনই কোনো পরিস্থিতিতে অতীন বুঝতে পারে না যে তার কী করা উচিত। তখনই সে রেগে যায়। মাথা ঠাণ্ডা করে কোনো সিদ্ধান্ত সে নিতে পারে না। একবার সে ভাবলো, এক্ষুনি লাফিয়ে উঠে বাথরুমের দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা মেরে বলবে, এসব কী ন্যাকামি হচ্ছে? আমি অফিস থেকে খেটেখুটে ফিরছি, বরফ ভরা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসতে হয়েছে, তারপরেও তোমাকে দোকানে নিয়ে যাবার জন্য তৈরি আছি, খিদেয় পেট জ্বলছে, তবু তুমি আমার দিকে মনোযোগ না দিয়ে নিছক ভাবালুতা করে যাচ্ছো? তোমার যদি রাগ বা দুঃখের কারণ কিছু ঘটে থাকে, তা হলে আমাকে সেটা পরিষ্কার খুলে বলো!

অতীন বিছানা ছেড়ে ওঠার আগেই শর্মিলা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। অনেকটা স্বাভাবিক গলায় বললো, চলো, বেরোই। কয়েকটা জিনিস কিনতেই হবে।

শর্মিলা পোশাক বদলাতে লাগলো, অতীন ওদের রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ খুলে খানিকটা আগের দিনের ডাল, একটুখানি স্প্যাগেটি-চিংড়ি এই সব লেফট ওভার খেয়ে মেটালো খিদে। একটা বীয়ারের ক্যান খুলে চুমুক দিল।

নিচে নেমে এসে, গাড়িতে বসে উইণ্ডস্ক্রিন পরিষ্কার করতে করতে অতীন জিজ্ঞেস করলো, এবার জানতে পারি কি মহারানীর আজ কী জন্য মেজাজ খারাপ?

শর্মিলা তার নরম হাতে অতীনের গালটা ছুঁয়ে বললো, বাবলু, তোমাকে আমি ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি! কিন্তু তোমাকে না জানিয়ে আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি।

–কী সেটা?

–সেটা আমি তোমাকে কিছুতেই বলতে পারছি না। প্লিজ, ডোন্ট ইনসিস্ট। পরে একদিন বলবো। অন্তত দু-একদিন পরে। এই, তুমি সীট বেল্ট বাঁধোনি?

–তুমিও বেঁধে নাও।

অতীন গাড়ি ঘোরালো ডাউন টাউনের দিকে। তুষারপাত থামেনি, তবু রাস্তায় অনেক মানুষ। দোকানগুলোতে চাঁদের হাট বসে গেছে। এত আলো যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কোনো কোনো দোকানের সামনে জ্যান্ত সান্টাক্লজকে ঘিরে মজা করছে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা।

অতীনের কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিয়েছে শর্মিলা। অতীন একটা ব্যাপারে স্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছে। অলি নয়, অলি কিছু বলেনি। শর্মিলাটা একেবারে পাগলী, নিশ্চয়ই অতি তুচ্ছ কোনো ব্যাপারকে সে অন্যায় বলে ভাবছে। এইরকম সূক্ষ্ম-অনুভূতিপরায়ণতার জন্যই শর্মিলাকে তার বেশি ভালো লাগে। অলির সঙ্গে এই দিক দিয়ে তার খুব মিল।

শর্মিলা আপন মনে বলে উঠলো, খুব মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে একবার। আমি আমার মায়ের কাছে আজ পর্যন্ত কোনো কথা গোপন করিনি। মা তোমার কথাও সব জানে। কিন্তু এই কথাটা মাকে কী করে বলবো!

–কোন কথাটা?

–টেলিফোনেও বলা যাবে না। দেশে ফিরে, মার পাশে শুয়ে রাত্তিরবেলা চুপি চুপি বলতে হবে। মা ঠিক বুঝবে, রাগ করবে না।

–তা হলে একবার দেশে ঘুরে এসো। এই সেপ্টেম্বরে তোমার রিসার্চ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ছ সপ্তাহ ঘুরে এলে ক্ষতি কী?

–ভ্যাট! তোমাকে ছেড়ে আমি দেশে যাবো? তোমাকে ছেড়ে আমি আর একদিনও থাকতে পারবো না। যদি হঠাৎ মরে যাই, তুমি আমার পাশে থাকবে।

–আবার ওইসব বাজে কথা! শোনো, লেটস বী প্র্যাকটিক্যাল। আমার দেশে ফেরার অসুবিধে আছে। কিন্তু, তুমি কেন যাবে না? পাঁচ-ছ সপ্তাহের জন্য ঘুরে এসো!

–কোনো প্রশ্নই ওঠে না আমার একার যাওয়ার। যাক গে, ওসব কথা থাক। নিউ ইয়র্ক যাওয়ার প্রোগ্রাম ঠিক হয়ে গেছে? সিদ্ধার্থর সঙ্গে আর কথা হয়েছে কিছু?

–হ্যাঁ, আজ ও অফিসে টেলিফোন করেছিল। খুকু, ক্রিসমাসে তো আমরা বেড়াতে যাচ্ছিই একসঙ্গে। তারপর জানুয়ারি মাসটা তুমি দেশে ঘুরে আসতে পারো। নো প্রবলেম। কালকেই আমি একটা সীট রিজার্ভেশন করিয়ে রাখতে পারি। টাকার জন্য আটকাবে না। মায়ের জন্য তোমার মন কেমন করছে…

–আমি দেশে যাবো না। হ্যাঁ, নিউ ইয়র্কে আমরা সবাই মিলে কি সিদ্ধার্থর ওখানেই থাকবো? এতজন মিলে যাচ্ছি। সুমির সঙ্গে ভিজেয়-ও যেতে পারে।

–সিদ্ধার্থ সেসব ব্যবস্থা করবে।–অলিকে বলে রেখেছো? কখন স্টার্ট করা হবে, অলি জানে?

–তুমি আজ রাত্তিরে ফোন করে বলে দিও।

–কেন, তুমি ফোন করতে পারো না? আমিই তো অলির সঙ্গে বেশির ভাগ দিন কথা বলি। এটা তোমারই জানানো উচিত। আমি কিন্তু এক সপ্তাহ অলিকে ফোন করতে পারিনি। অলি নিজে থেকে একবারও ফোন করে না।

–তুমি মাকে কিছু জানাতে চাও, অথচ দেশেও ফিরতে চাও না, আমি ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না, খুকু।

–ওই জুতোর দোকানটার সামনে একটু দাঁড়াবে, প্লীজ!

গাড়ি পার্ক করতে জায়গা খুঁজে পাওয়া একটা বিরাট সমস্যা। অতীন নামে না, সে প্যারালাল পার্কিং করে গাড়িতেই বসে থাকে। পুলিশ এসে তাড়া দিলে সে আস্তে আস্তে চালাতে শুরু করে, আবার ঘুরে সেখানেই আসে। দোকানে কেনাকাটি করতে সে পছন্দও করে না।

তিনটি দোকান ঘোরার পর ওরা একটা চীনে রেস্তোরাঁয় খেতে ঢুকলো। পুরোনো প্লাজার পেছন দিকে এই দোকানটা বেশ নিরিবিলি, দুটি বুড়ি এটা চালায়, অতীনদের দেখলে চেনা সুরে কথা বলে।

ঢুকেই ডানদিকের টেবিলে বসে আছে সুমি আর ভিজেয়, আরও দু-একজন যুবক-যুবতী। অতীন থমকে দাঁড়ালো। সে শর্মিলাকে নিয়ে নিরালায় কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু এড়াবার উপায় নেই, ভিজেয় দারুণ আড্ডাবাজ ধরনের, সে উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত তুলে বললো, হাই! ইধার আও! কাম অ্যাণ্ড জয়েন আস!

দুটো টেবিল জুড়ে বসার ব্যবস্থা হলো। এক ক্যারাফে লাল মদ এলো। অন্য ছেলেমেয়ে দুটিও মহারাষ্ট্রীয়, বেশ প্রাণবন্ত, শর্মিলার সঙ্গে তারা গল্প জমিয়ে দিল, কিন্তু অতীন কিছুতেই স্বচ্ছন্দ হতে পারছে না।

খাওয়া টাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, সুমি উঠে গেল ওয়াশরুমে। এদের ওই সব জায়গা বেসমেন্টে, একটা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে হয়। একটুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অতীনও উঠে গেল, সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আয়নার সামনে। সুমি টয়লেট থেকে বেরুতেই অতীন ঘুরে দাঁড়িয়ে খানিকটা রুক্ষ গলায় বললো, তোমরা দু’জনে আমার সঙ্গে চালাকি করছো কেন?

সুমি বললো, আমি? আমি কী করেছি?

অতীন বললো, তুমি তখন আমাকে বললে কেন মজা বুঝবে? কী হয়েছে?

সুমি হাসি মুখে বললো, ও, সেটা ভুল বলেছি। অ্যাকচুয়ালি ইউ আর আ ভেরি আনলাকি গাই! এর মধ্যেই বাঁধা পড়ে গেলে। সেজদি কিছু বলেনি তোমাকে?

–হেঁয়ালি করছে। কিছুই বুঝতে পারছি না। একবার বলছে দেশে ফিরে মায়ের সঙ্গে দেখা করা উচিত, আবার বলছে যাবে না। ব্যাপারটা কী?

–সেজদি মাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করে না। আমি অবশ্য বলেছি, এখন দেশে না ফেরাই ভাল। পরে এক সময় বললেই হবে।

–বলবার মতন ব্যাপারটা কী, সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না!

দু তিনটে পেপার ন্যাপকিনে হাত মুছে সুমি নগ্ন কোমরের কাছ থেকে ছোট রুমালটা বার করে এনে মুখ মুছলো। তারপর বললো, সেজদি কি নিজের মুখে তোমাকে বিয়ের কথা বলবে! তুমি আর কতদিন দেরি করবে?

–বিয়ে!

–বাবলুদা, তুমি আঁতকে উঠলে মনে হচ্ছে। বিয়ে কথাটা কখনো শোনোনি? নাকি তুমি বিয়ে নামের ইনস্টিটিউশানে বিশ্বাস করো না?

–আমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। বিয়ের জন্য এত ব্যস্ত হবার কী আছে!

–আমার মত যদি শোনো, দু-এক মাসের মধ্যে তোমরা বিয়েটা সেরে নাও। এখানকার কমিউনিটি হলে অ্যারেঞ্জ করা যেতে পারে, অনিল সাহনি আর দুগার তো ওইভাবেই বিয়ে হলো। এই ধকলটা কাটিয়ে উঠলেও এরপর সেজদির মনের ওপর খুব চাপ পড়বে! আমার মতন তো নয়। সেজদি অনেক নরম মেয়ে!

–এই ধকল মানে!

–অ্যাবরশান করাবার পর মনের ওপর একটা চাপ পড়বে না?

কেউ যেন অন্ধকারে অতীনের মাথায় একটা ডাণ্ডা মেরেছে। অতীনের বোধশক্তি খানিকটা অবশ হয়ে গেল। সে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো।

সুমি খানিকটা বকুনির সুরে বললো, আগে থেকে কোনো প্রটেকশান নেবে না, কিছু না! সেজদি দু মাস হলো কনসিভ করেছে, তার খোঁজও রাখো না?

একটি বিশুদ্ধ নির্বোধের মতন অতীন জিজ্ঞেস করলো, কনসিভ করেছে মানে?

অতীনের গায়ে একটা খোঁচা মেরে সুমি বললো, কী তখন থেকে মানে মানে করছো? কিছুই বোঝা না তুমি, ন্যাকা? সব ছেলেরাই এই রকম, নিজের দায়িত্বটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। যেন শুধু মেয়েদেরই দোষ। সেজদির দু মাস ধরে পীরিয়ড বন্ধ।

ছাব্বিশ বছর বয়েসের যুবকের তুলনায় অতীন সত্যিই এই সব ব্যাপার খুব কম জানে। সে মেয়েদের রূপ দেখে, শর্মিলার মনটাকেও সে বুঝবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু নারী শরীরের কলকজা কিংবা জন্মরহস্য সম্পর্কে তাঁর ধারণা অস্পষ্ট। সে আবার সরল বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো, পীরিয়ড? তা বন্ধ হলে কী হয়?

সুমি বললো, ইউরিন টেস্টে পজিটিভ পাওয়া গেছে। এখন খুব তাড়াতাড়ি কিউরেট করিয়ে নিলে কোনো রিস্ক থাকবে না। ভাগ্যিস এটা লিগ্যাল হয়েছে কয়েক মাস আগে। না হলে কী ঝাট হতো বলো তো? ইওরোপে যেতে হতো। ভিজেয়র এক বন্ধু ডাক্তার, সে সব ব্যবস্থা করে দেবে বলেছে, ক্রিসমাসের ছুটিটার পরেই!

শুনতে শুনতে অতীনের চোখ বিস্ফারিত হতে লাগলো। এতক্ষণে যেন মাথায় ব্যাপারটা ঢুকেছে। শর্মিলার গর্ভে এসেছে তার সন্তান। হঠাৎ একটা হিংস্র জানোয়ারের মতন সে সুমির কাঁধ চেপে ধরে বিকট গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, কিউরেট করা হবে মানে? মেরে ফেলবে? আঁ? কে বলেছে? কার এত সাহস? অ্যাঁ?

এক মধ্যবয়স্কা শ্বেতাঙ্গিনী সিঁড়ি দিয়ে নেমে এই দৃশ্য দেখে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল, কোনো কৌতূহল প্রকাশ করলো না। যেন একটি কালো বিদেশী যুবক তার সঙ্গিনীর গলা টিপেও মেরে ফেলে এই নিভৃত জায়গায়, তাতেও ওর কিছু যায় আসে না।

সুমি চাপা গলায় ধমক দিয়ে বললো, কী পাগলের মতন করছো। ছাড়ো!

অতীনের মুখখানা অস্বাভাবিক হয়ে গেছে, জ্বলজ্বল করছে চোখ, সে আবার চেঁচিয়ে বললো, কেন আমাকে আগে এইসব বলোনি? কে বলেছে মেরে ফেলতে? খবর্দার!

সুমি তাকে বেশ জোরে এক ধাক্কা দিয়ে বললো, ছেলেমানুষী করো না, বাবলুদা! আগে বিয়ে করোনি কেন? এখন আর এ ছাড়া উপায় কী? এই আর্লি স্টেজে অ্যাবরশান করালে ভয়ের কিছু নেই। এবার যাও, সেজদির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে একটা হাত ধরে বলো, আমি তোমার, কী যেন বলে, কী যেন কথাটা, হ্যাঁ, পাণিপ্রার্থী!

সুমি ওপরে চলে যাবার পরেও অতীন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটেছে। তার মাথার মধ্যে সত্যি সত্যি একটা ঝড় বইছে। সে এখন অন্য মানুষ। সে একজনের পিতা। শর্মিলার সঙ্গে শারীরিক উন্মত্ততার সময় সে এই সম্ভাবনার কথা খেয়ালই করেনি।

ওপরে উঠে এসে সে শর্মিলার দিকে তাকিয়ে বললো, চলো, আমরা বাড়ি যাবো।

তারপর কোটের পকেট থেকে ওয়ালেট বার করে কিছু ডলার রাখতে গেল টেবিলে। ভিজেয় তার হাত চেপে ধরে বললো, ইউ ওয়ান্ট টু স্টার্ট এ ফাইট?

এটা একটা চালু রসিকতা। কে বিল মেটাবে তা মারামারি করে জিতে ঠিক করতে হবে। অর্থাৎ যারা আগে থেকে বসে আছে, তারা তাদের টেবিলে অন্যদের ডাকলে সেই অতিথিদের দাম দিতে নেই।

শর্মিলা বললো, আর একটু বসি না। বাবলু, বসো

সুমি শর্মিলার দিকে চোখ টিপে ইঙ্গিত করলো। অতীন ততক্ষণে শর্মিলার হাত ধরে টানতে শুরু করেছে, শর্মিলা উঠে দাঁড়িয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল।

রেস্তোরাঁর বাইরে পা দিয়েই অতীন চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো, আমি তোমায় খুন করে ফেলবো! তুমি আমায় চেনো না!

শর্মিলা হেসে বললো, তোমাকে আমি ভালোই চিনি।

–তুমি আমাকে এসব কথা বলোনি কেন?

–আমি কী করে বলবো বলো তো? নিজেরই যে মাথাটা ঘুলিয়ে গেছে। সুমি ইউরিন টেস্ট করাতে বললো, তখনও আমি বিশ্বাস করিনি।

–তোমার সব কথা আমাকে বলার কথা ছিল না? ঐ যে পীরিয়ড না কি বন্ধ হয়ে গেছে

–ঐ কথাটা বলা যায় না। মেয়েরা বলতে পারে না। এটা বলার মানে হলো, আমি প্রেগনেন্ট হয়ে গেছি বাবলু, এবার তুমি আমাকে বিয়ে করো। এটা কি কোনো মেয়ে বলতে পারে?

–তুমি একদিন বলেছিলে দেশে ফিরে গিয়ে, মা-বাবাকে জানিয়ে বিয়ে করবে! আমি সেই কথাটাই ধরে বসে আছি। সেইজন্যই এখন বিয়ের কথা ভাবিনি।

–আমাদের দেশে ফেরার অসুবিধে। তাই অ্যাবরশান করাতে হবে।

যেন শর্মিলার হাতটা মুচড়ে ভেঙে দেবে, সেইভাবে আঁকড়ে ধরে অতীন গর্জন করে উঠলো, না! কিছুতেই না!

শর্মিলা কাতর ভাবে বললো, প্লীজ চেঁচিয়ো না, বাবলু। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ভয়ের কিছু নেই, বিশ্বাস করো!–অতীন গাড়ির দরজা খুলে শর্মিলাকে প্রায় ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো, আমার বুঝি কোনো মতামত নেই? মাই চাইল্ড! আমি বলছি, ওসব চলবে না। আমরা এখানেই বিয়ে করবো, এই সপ্তাহে!

শর্মিলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললো, আমার মাকে আগে না জানিয়ে আমি কী করে বিয়ে করবো? মা আমার কোনো কথায় আপত্তি করে না। আমি পারবো না, পারবো না। বাবলু, প্লীজ, প্লীজ!

এতক্ষণ রাগে গজরাচ্ছিল অতীন, এবার সেও হঠাৎ হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো। এমনভাবে সে জ্ঞান হবার পর আর কোনোদিন কাঁদেনি। কাঁদতে কাঁদতে সে মাথা ঠুকতে লাগলো স্টিয়ারিং হুইলে। শর্মিলার কান্না বন্ধ হয়ে গেল, সে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো অতীনের দিকে। তার রাগী, গোঁয়ার প্রেমিকটির এমন অসহায় শিশুর মতন গলার আওয়াজ সে কখনো শোনেনি।

সে অতীনের পিঠ ধরে থামাবার চেষ্টা করে বলতে লাগলো, এই, এই, কী করছো!

অতীন বললো, আমি এই গাড়িটা পুড়িয়ে ফেলবো। চাকরি ছেড়ে দেবো। তোমার সঙ্গে। জীবনে আর দেখা করবো না! কেউ আমাকে আর খুঁজে পাবে না! আমি একটা বাজে ছেলে, আমার বেঁচে থাকার কেনো মূল্য নেই! খুকু, তুমিও আমাকে বুঝলে না!

শর্মিলা বললো, বাবলু, ওরকম করো না। তোমাকে ছেড়ে আমি একটা দিনও থাকতে। পারি? সুমিরা বলছে, এই স্টেজে অ্যাবরশান করানোতে কোনো অসুবিধে নেই…

জলে ভেজা মুখোনি তুলে জন্ম দুঃখীর মতন গলায় অতীন বললো, খুকু, আমি একটা। অপদার্থ! আমার জন্য আমার দাদা মরেছে। হ্যাঁ, আমারই জন্য, আমার দাদার মতন ব্রিলিয়ান্ট ছেলে জলে ডুবে গেল! তারপর মানিকদাকে বাঁচাবার জন্য একটা লোককে, হ্যাঁ, আমিই তাকে মেরেছি, এই হাত দিয়ে, আমি, আমি মানুষ মেরেছি। এরপর আমার সন্তানকেও মারবো? আমি সারা জীবন খুনী হয়ে থাকবো? আমার জীবনের তা হলে কী মূল্য রইলো?

শর্মিলা নিঃশব্দে হাত বোলাতে লাগলো অতীনের মুখে। তার আঙুলে এখন লেগে আছে। স্নেহ।

একটু পরে সে বললো, আমিও কি মন থেকে সত্যিকারের চাই? আমার নিজেরও যে মরে যেতে ইচ্ছে করে, বাবলু! এসো, তা হলে আমরা দু’জনে একসঙ্গে মরে যাই?

খুব আগ্রহের সঙ্গে অতীন বললো, তাই করবে? ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে গ্যাস খুলে দিয়ে আমরা যদি ঘুমের ওষুধ খাই, কোনো কষ্ট হবে না।

শর্মিলা আচ্ছন্ন গলায় বললো, তুমি যদি চাও…

অতীন বললো, চলো, আজই! আমার ঘরে চলো।

শর্মিলা অতীনের বুকে মুখ রেখে বললো, আমি সব সময় তোমার সঙ্গে থাকবো। তুমি যা বলবে,

শর্মিলার তলপেটে হাত রাখলো অতীন। আবার কান্নার তোড় এসে গেল তার চোখে। সে বললো, তা হলে এই বাচ্চাটাও মরে যাবে? আবার একজনকে মারবো? না, না, খুকু, আমি আর শুধু নিজেকেই মারতে পারি। তুমি থাকো। তুমি ওকে মেরো না।

শর্মিলা আস্তে আস্তে বললো, মাকে সব কিছু খুলে লিখলে মা বুঝবে। মা তোমার কথা জানে। লোকে যাই বলুক, আমরা এখানেই বিয়ে করতে পারি। প্রেগনেন্ট মেয়ের বিয়ে কি এ দেশে হয় না?

অতীন বললো, সিদ্ধার্থ সব ব্যবস্থা করে দিতে পারে। নিউ ইয়র্কে ওর অনেক চেনাশুনো আছে। আমরা নিউ ইয়র্কে গিয়ে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে…

–এখন সব ছুটি–

–হোক ছুটি। জোর করে অফিস খোলাবো। না হলে নিউ ইয়ার্স ডের পর আরও দু চারদিন থেকে যাবো নিউ ইয়র্কে।

–তোমার মা বাবাকে জানাবে না?

–এখন জানাবার সময় নেই। আই মীন, আমার মা বাবার মতামত নেবার প্রশ্ন ওঠে না, ওদের জানাবো নিশ্চয়ই…

দু’জনেই চোখের জল মুছে ফেললো। হঠাৎ যেন মনে হলো, সব বাধাগুলোই তুচ্ছ। লোকলজ্জাকে গুরুত্ব দেবার কোনো মানেই হয় না। বাবা-মাকে আগে থেকে জানিয়ে কিংবা দেশে ফিরে গিয়েই যে বিয়ে করতে হবে, তারই বা কী মানে আছে? ওরা যথেষ্ট অ্যাডাল্ট এবং দু’জনের বাবা-মারই আপত্তি জানাবার কোনো প্রশ্নই নেই। এই সব অকিঞ্চিৎকর কথা ভেবে ওরা ভূণহত্যা কিংবা আত্মহত্যার মতন সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড করতে যাচ্ছিল! ওরা এত নিবোধ!

দুরন্ত স্পীডে গাড়ি চালিয়ে অতীন ফিরে এলো নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। প্রথমেই ফোন। করলো সিদ্ধার্থকে। রিং হয়ে গেল, কেউ ধরলো না। সিদ্ধার্থ বাড়িতে নেই।

অতীন বললো, সিদ্ধার্থর সঙ্গে তো কথা হয়েই আছে। ওকে কাল সকালে ঠিক পেয়ে যাবো।

শর্মিলা বললো, অলিকে জানিয়ে দাও। ও কখন রেডি হয়ে থাকবে…

অতীন একটু ইতস্তত করে বললো, হ্যাঁ, অলিকে জানাতে হবে। তুমি ওকে ফোনে বলে দিও।

শর্মিলা বললো, তুমি ওকে ফোন করো, বাবলু! এটা তোমারই বলা উচিত।

অতীন ফোনের বোতাম টিপলো। কিছুক্ষণ ইংরিজিতে কথা বলার পর ফোন রেখে দিয়ে আড়ষ্ট গলায় বললো, ব্যাপারটা কী হলো বুঝতে পারলাম না। সেই আর্টিস্ট মহিলা বললেন, অলি চলে গেছে। ইন্ডিয়ায় ফিরে গেছে। তা কখনো হতে পারে?

শর্মিলা বললো, অলির ওই বাড়ি ছেড়ে ছেড়ে যাবার কথা ছিল। অন্য বাড়িতে উঠে গেছে?

অতীন বললো, ভদ্রমহিলা দু’তিনবার বললেন যে শী হ্যাঁজ লেফট ফর ইন্ডিয়া। তা কখনো হতে পারে? মাত্র কয়েকমাস হলো এসেছে, এর মধ্যে ফিরে যাবে? ও আমাদের না জানিয়ে?

শর্মিলা হিসেব করে বললো, আমার সঙ্গে অলির লাস্ট কবে কথা হয়েছিল? লাস্ট সোমবার? না, রবিবার, আট দিন আগে। সেদিনও আমায় কিছু বলেনি। আচ্ছা, পাপিয়াকে ফোন করে দ্যাখো তো!

পাপিয়া নামের একটি বাংলাদেশের মেয়ের সঙ্গে অলির পরিচয় হয়েছিল, সেও মেরিল্যান্ডে অলির বাড়ির কাছেই থাকে। তাকে শর্মিলাই ফোন করলো। পাপিয়া বেশ অবাক ভাবেই বললো যে অলি চারদিন আগে একটা চার্টার্ড ফ্লাইটে দেশে চলে গেছে। টিকিট কেটেছিল এক মাস আগে। জিনিসপত্র সব নিয়ে গেছে। সে আর ফিরবে না। সে যাবার আগে শর্মিলা-অতীনদের জানায়নি? এখানকার সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেছে সে।

শর্মিলা আর অতীন বেশ খানিকক্ষণ মুখোমুখি চেয়ে চুপ করে বসে রইলো। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আমি জানি না, শৌনক ছেলেটি কেমন। আশা করি সে অলির মতন একটা সরল, ভালো মেয়েকে দুঃখ দেবে না। অলি শৌনককে ছেড়ে থাকতে পারলো না। আমাদের না জানিয়ে চলে গেল। আমরা কি বাধা দিতাম? খুকু, তোমার কাছে আমার কোনো কিছুই গোপন নেই। শুধু একটা কথা বলিনি এতদিন। আজ না বললে অন্যায় হবে। একসময় অলির সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক ছিল।

মাটির দিকে চেয়ে শর্মিলা বললো, আমি জানি। তোমার দিকে অলির তাকানোর ভঙ্গি। ওর বিষণ্ণ মুখে হাসি ফোঁটাবার চেষ্টা। এ সব দেখেই আমি বুঝেছি।

অতীন বললো, কিন্তু ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক, মানে, কোনোদিন সেরকম কিছু, আই মীন, ফিজিক্যাল ঘনিষ্ঠতা হয়নি।

শর্মিলা বললো, তাতে কিছু আসে যায় না। অলি তোমাকে ভালবাসে। ও তোমাকে দেখাব জন্যই শুধু এদেশে এসেছিল। অলি আমার কথা কিছু জানতো না। আমি অলির কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নিয়েছি!

অতীন জোর দিয়ে বললো, দ্যাট কোয়েশ্চেন ডাজ নট অ্যারাইজ অ্যাট অল। অলি আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারেনি। শৌনকের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হয়েছে, সে কথা ও নিজের মুখে স্বীকার করেছে আমার কাছে। বিশ্বাস করো! সে জন্য আমি অলিকে মোটেই দোষ দিই না। অলির সঙ্গে আমার যোগাযোগ রাখার কোন উপায় ছিল না।

শর্মিলা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমি এবার যাই, বাবলু।

অতীন বিস্মিত ভাবে বললো, যাবে মানে, কোথায় যাবে?

শর্মিলা বললো, বাড়ি যাবো। আমাদের বোধ হয় আরও কিছুদিন ভেবে দেখা দরকার।

অতীন এগিয়ে এসে শর্মিলার হাত ধরে বললো, আজ রাত্তিরটা তুমি আমার সঙ্গে থাকো।

এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে শর্মিলা পাগলাটে গলায় বললো, যাস্ট বিকজ আই অ্যাম প্রেগনেন্ট, সেজন্যই আমাকে তুমি বিয়ে করবে? ছিঃ! অলিকে কষ্ট দিয়েছি, সে কথা কি আমি সারাজীবন ভুলতে পারবো? আমার চেয়ে অলি অনেক ভালো মেয়ে। ওকে যেভাবেই হোক। ফিরিয়ে আনে।

অতীন শর্মিলার দু’হাত আবার জোর করে ধরে রেখে বললো, তুমি ভুল করছে। আমার থেকেও শৌনকের জন্য অলির টান অনেক বেশি। সেইজন্য ও আমাকে কিছু না জানিয়ে চুপি চুপি চলে গেল। অলির জীবনে আর আমি নেই। আমি ওকে আর ডিসটার্ব করতেও চাই না। খুকু, তুমিই আমার সব কিছু!

শর্মিলাকে টানতে টানতে এনে লম্বা আয়নাটার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে অতীন তীব্র গলায় বললো, খুকু, তুমি শুধু এখন আমার প্রেমিকা নও। তুমি এখন মা। আমার সন্তানের মা। ছেলে বা মেয়ে যাই হোক, তার তো দেশে ফিরে যেতে কোনো বাধা থাকবে না কখনো। আমার যা হয় হোক! তবু আমাদের সেই বাচ্চাটা একদিন বড় হবে, দেশে ফিরে যাবে, একটা সুন্দর, সুস্থ জীবন গড়ে তুলবে। তার মধ্য দিয়ে আমি বাঁচবো। খুকু, ওকে বাঁচিয়ে রাখো, আমাকে বাঁচতে দাও।

দু’জনে কপালে কপাল ঠেকিয়ে আবার কাঁদতে লাগলো একসঙ্গে।

(উত্তরপর্ব সমাপ্ত)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *